লাঞ্চের পরপরই এক গ্লাস মদ খুব দ্রুত শেষ করেছে মেডক। এখন দ্বিতীয় গ্লাসটা সামনে নিয়ে বসে ধীরে ধীরে পান করছে সে। নিজের অভ্যাস ভাল করেই জানা আছে তার। দ্বিতীয়টা শেষ করলেই তৃতীয় আয় চতুর্থও শেষ করতে সময় লাগবে না, তারপরই কাউকে না কাউকে ঘুসি মেরে বসবে ও। কিন্তু এবারে অনেক বড় খেলায় নেমেছে মেডক, এখন মাথা গরম করলে চলবে না তার। চিন্তা করে ঠাণ্ডা মাথায় সব কাজ করতে হবে।

হোয়েল কিড় বারে ঢুকল। মেডকের টেবিলে বসতে বসতে নিচু স্বরে বলল, জুলিয়াস এখনও শহরে আছে, আবার রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। বলো তো হিউ আর আমি গিয়ে ওর সাথে একটা ঝগড়া বাঁধিয়ে ওকে শেষ করে আসতে পারি-একাই আছে সে।

ধমকে উঠল মেডক, বোকার মত কথা বোলো না। যত সুন্দর করেই সাজাও এখন আর সেটা ভাল দেখাবে না। জুলিয়াসকে ঘাটাতে যেয়ো না এখন।

গ্লাসে আর একটা চুমুক দিয়ে নীরবে বসে রইল মেডক। একটা প্ল্যান ভেস্তে গেছে তার, কিন্তু তাতে কি? আবার নতুন করে আরেকটা প্ল্যান আটবে সে সব কিছুর সাথে সুন্দর করে খাপ খাইয়ে। অনেকক্ষণ মনে মনে নানান দিক বিবেচনা করে দেখল মেডক, তারপর খুশি মনে শেরিফকে খুঁজতে বেরুল।

অনেক ভেবে দেখলাম, শেরিফ, ধীরে ধীরে বলল মেডক। জুলিয়াসকে খুন করতে চায় এমন লোক রকিং এইচে পোষা ঠিক হবে না। হাজার হোক জুলিয়াস যদি ঠিক পথে চলত তবে আজ সে রকিং এইচেই থাকত।

ওসব তোমার সমস্যা নয়, মিছেই ভাবছ তুমি।

হয়তো তাই, কিন্তু আমি ঠিক করেছি নকারকে আর কাজে রাখব না, বিদায় করে দেব ওকে।

তুমি ভাল মানুষ বলেই এত ভাবছ।

জুলিয়াসকে নিয়ে সত্যিই দুশ্চিন্তায় আছি আমি। জারভিসের ধারণা সে একটা গোলমাল বাধাবেই।

ওকে বের করে দেয়া হয়েছে, এখন আর সে কি ঝামেলা করবে? ওর ভাইয়ের সাথে তোমার মিলমিশ কেমন?

মাথা ঝাঁকাল মেডক ছেলেটা ভালই। তরুণ তো, এখনও অনেক কিছু ওকে শিখতে হবে। মাঝে মধ্যে কঠোরভাবে শাসন করতে হয়-তবে ছেলেটা মানে আমাকে। এবার উঠি, আবার দেখা হবে।

সন্তষ্ট মনে ফিরে এল মেডক। আজকের আলাপে বেশ কাজ হয়েছে, নিখরচায় ডিগবিকে নিজের পক্ষে টানতে পেরেছে সে। রাস্তার ওপাশে এডকে ঘোড়ায় চড়তে দেখে হঠাৎ রেগে উঠে তাকে চিৎকার করে ডাকল।

কোথায় যাওয়া হচ্ছে, শুনি?

সুন্দর একটা হাসি দিল এড। এদিককার খেল খতম। পেপি বাসায় রয়েছে, সেখানেই যাচ্ছি।

কোন নতুন খবর আছে?

না।

অনেকদিন তো হলো, এক ফোঁটা কাজও করোনি, আর কতদিন লাগাবে?

পেপির মত মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যথেষ্ট সময়ের দরকার, জবাব দিল এড। ঠিক মত জাল পেতেছি আমি-সময়ে অবশ্যই কাজ হবে।

কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছি কই?

কোন জবাব না দিয়ে কেবল কাঁধ ঝাঁকাল এড।

অনিশ্চিতভাবে এডের দিকে চাইল মেডক। ওর ব্যাপারে কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারছে না সে প্রথম থেকেই। কেন, তা সে নিজেও জানে না। তার কথা মতই কাজ করতে রাজি হয়েছে এড-তবে কেন স্বস্তি পাচ্ছে না মেডক?

এড, তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে তোমাকে, বলল মেডক।

কেন? মুখ বাঁকাল এড। ধীরে সুস্থে কাজ সারারই কথা ছিল আমার।

তাই বলে সারা জীবন কাটিয়ে দেবে এমনও কোন কথা ছিল না। আর এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি তোমাকে।

দুই সপ্তাহ।

এক।

ঘোড়ার পিঠে একটু ঝুঁকে সামনে এগিয়ে এল এড। ঠিক আছে। চেষ্টা করব, কিন্তু মনে হয় আরও সময় লাগবে আমার। চটকদার গেঞ্জি পরা নকার বোকা বনেছে বলেই তোমার এতটা আতঙ্কিত হয়ে ওঠার কোন কারণ দেখি না। প্রয়োজন হলে আরও সময় নেব আমি।

উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করেই ঘোড়া ছুটিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল এড।

বিড়বিড় করে কয়েকটা গালি দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই সেলুনের কোণে দাড়ানো হিউ-এর দিকে চোখ পড়ল তার। মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে মিছেই এডকে নিয়ে এত চিন্তা করছে ও। আগে কাজ শেষ করুক এড, তারপর হিউকে ব্যবহার করলেই চলবে। তার জানা মতেই হিউর সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা কারও নেই।

বাকি দিনটা শহরের বিভিন্ন লোকের সাথে সদালাপ করে কাটিয়ে খাওয়া সেরে রাত নটার দিকে কি এইচে পৌঁছল মেডক। মাডি এদিককার চার্জে ছিল। সে জানাল, এড আর পেপি একসাথে কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। আর সব খবরও ভাল। ওকে কর্মচারীদের থাকার ঘরে ফিরে যেতে বলে সোজা সেবাস্টিন দত্তের ঘরে ঢুকে আলো জ্বালাল মেডক। বিছানায় স্থির হয়ে শুয়ে আছেন সেবাস্টিন।

নিচু স্বরেই কথা বলল মেডক। ওঠো, তোমার সাথে কথা আছে। কোন সাড়া দিলেন না সেবাস্টিন।

জুলিয়াসকে আজই শেষ করার প্ল্যান ছিল কিন্তু ঘটনাক্রমে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে নকারকে আবার পাঠাব আমি, এবার আর ব্যর্থ হবে না সে।

সেবাস্টিন দত্তের চোখ খুলল এবার, কিন্তু কোন কথা বললেন না তিনি।

নকারের মত দ্রুত বন্দুকবাজ কমই আছে। জুলিয়াসকে ও-ই কবর দিয়ে আসবে।

লড়তে গেলে জু’র হাতে মারা পড়বে সে, এতক্ষণে কথা বললেন রকিং এইচের মালিক।

ছাই হবে। নকারকে পাঠানো মানেই জুলিয়াসের মৃত্যু। কিন্তু কথা হচ্ছে, তুমি আর কতদিন বেঁচে থেকে জ্বালাবে আমাদের?

চোখ বুজে শুনছিলেন সেবাস্টিন দত্ত। শেষ প্রশ্নটা শুনে তার চোখ দুটো আবার খুলে গেল। এখন মরব না, দুর্বল স্বরে বললেন তিনি, তোমাকে মেরে তবে মরব আমি।

তাঁর হাস্যকর দাম্ভিকতায় মাথা পিছনে হেলিয়ে হা-হা করে প্রাণখোলা হাসি হাসল মেডক। প্রায়ই রাতের বেলা ধারে কাছে কেউ না থাকলে সেবাস্টিন দত্তের ঘরে ঢুকে এই ধরনের কথাবার্তা বলে মেডক। এতদিন যার দাপটে পার্কের সবাই কাপত আজ তাকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে মানসিক কষ্ট দিয়ে পৈশাচিক এক আনন্দ পায় সে।

তোমার মেয়ের সাথে প্রেম করে তাকে পটানোর জন্যে লোক লাগিয়েছি

আমি-তার সাথেই পেপি আজ বাইরে বেড়াতে গেছে। আর জারভিস আছে আমার হাতের মুঠোয়। আমার প্ল্যান মতই এগিয়ে চলেছে সব। তুমি আরও কিছুদিন টিকে থাকলেও অসুবিধা নেই, কিন্তু বেশিদিন বাঁচলে বাধ্য হয়েই সুবিধা মত ব্যবস্থা করব। জানো তো ইচ্ছা কলেই যে-কোন মুহূর্তে তোমাকে শেষ করতে পারি আমি?

কোন জবাব না দিয়ে আবার চোখ বুজলেন সেবাস্টিন। অত্যন্ত ক্ষীণ আর রক্তশূন্য দেখাচ্ছে তাকে।

শুভ রাত্রি, বুড়ামিয়া, বলল মেডক। শুয়ে শুয়ে কত একর জমি আমার জন্যে রেখে যাচ্ছ সেই স্বপ্ন দেখো।

এবারেও কোন জবার দিলেন না সেবাস্টিন দত্ত।

আরও দুইদিন কাজ করার পর জুলিয়াস নডিকে জানাল তার ছুটি দরকার। এড আর পেপির ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছে সে পেপির সাথে দেখা তাকে করতেই হবে একটা কিছু এখনই করা দরকার।

কিন্তু পেপির সাথে দেখা করবে কিভাবে? প্রশ্ন করা নডি। কাজটা মোটেও সোজা হবে না।

পেপির ঘোড়ায় চড়ে একা একা বেড়াতে বেরুনো অনেক দিনের অভ্যাস-দেখা করা কঠিন হবে না।

নকারের সাথে যদি দেখা হয়ে যায়?

শহরে যাচ্ছি না, রকিং এইচের রাস্তার ওপর গোপনে নজর রাখব আমি-নকারকে দেখলে এড়িয়ে যাব।

আর আপত্তি তুলল না নডি। বলল, এই কয়দিন একেবারে হাড়ভাঙ খাটুনি খাটিয়েছি, ছুটি পাওনা হয়ে রয়েছে তোমার-তবে সাবধানে থেকে কোন ঝুঁকি নিয়ো না।

কয়েকদিনের খাবার সাথে নিয়ে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ল জুলিয়াস হয়তো আজ সন্ধ্যার মধ্যেই দেখা হয়ে যেতে পারে, কিংবা কপাল মন্দ থাকলে কয়েকদিনেও দর্শন না-ও মিলতে পারে। কোন নিশ্চয়তা নেই দেখে তৈরি হয়েই বেরুল সে।

দুপুরের আগেই নদীর ধারে ঝোঁপের আড়ালে আস্তানা গাড়ল জুলিয়াস। রকিং এইচ থেকে শহরে যাবার রাস্তাটা ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। দুপুর বেলা মেডককে দেখল জুলিয়াস। ওর সাথে আরও চারজন লোক রয়েছে। প্রতিদিনই পেপির একবার করে শহরে যাওয়ার অভ্যাস। অভ্যাসটা থাকলে আজই দেখা মিলবে। শেষ পর্যন্ত পেপির দেখা পেল জুলিয়াস-কিন্তু সে একা নয়, ওর সাথে রয়েছে এড।

দু’জনে ঘোড়ায় চড়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। বোঝাই যায় একে অন্যের সঙ্গ দারুণ উপভোগ করছে ওরা। ওদের হাসি শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু হাসি-খুশি ভাবটা দূর থেকেই টের পাচ্ছে। দেখছে আর অস্বস্তি বোধ করছে জুলিয়াস। পেপির একজন পুরুষ বন্ধু দরকার, যে তাকে আনন্দ দেবে, সঙ্গ দেবে, হাসি ফোঁটাবে তার মুখে। কিন্তু এ বিশ্বাসঘাতকতা করবে, তার বোনকে খেলাচ্ছে সে, শেষ পর্যন্ত ঠকাবে।

ওখানে বসে বসেই ওদের ব্যাপারে কি করা যায় ভাবছে জুলিয়াস পেপি যদি সত্যিই এডের প্রেমে পড়ে থাকে, তাকে বোঝা কঠিন হবে। সহজে। বুঝতে চাইবে না সে। জুলিয়াসের প্রতি তার মনোভাব আরও বিরূপ হবে। পেপিকে ওরা এডের মাধ্যমে হাত করলেও জারভিসকে সামলাবে কিভাবে? চরম বিপদের মধ্যে রয়েছে জারভিস। নাহ্, যে করেই হোক পপির সাথে তাকে কথা বলতেই হবে।

অন্ধকার হয়ে এল। খাবারের পোঁটলা বের করে কিছু খেয়ে নিল জুলিয়াস এখানে বসে থেকে কোন লাভ নেই, বুঝতে পারছে সে। ওরা শহরে গেছে দু’জনে, ফিরবেও একই সাথে। পেপিকে একা পাওয়া যাবে না। শহরে গিয়ে জোর করে দেখা করা যায়। কিন্তু কি লাভ হবে তাতে? এত অল্প সময়ে তাড়াহুড়ো করে কথা বলে কিছুই বোঝাতে পারবে না, তাছাড়া শহরে গেলে নকারের সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে অথ ওর সাথে মারপিট করে কোন লাভই নেই।

হঠাৎ তার মনে অন্য একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল। লুকিয়ে রকিং এইচে পেপির ঘরে ঢুকে দেখা করলে কেমন হয়? খামারের প্রতিটি ইঞ্চি তার চেনা। র‍্যাঞ্চের কুকুর দুটোও জুলিয়াসকে চেনে, ঘেউ ঘেউ করবে না ওরা। অন্ধকারে ছায়ার মতই পেপির ঘরে পৌঁছে যেতে পারবে সে। একবার ওখানে পৌঁছতে পারলে পেপি যে তাকে ধরিয়ে দেবে না, এ বিশ্বাস তার আছে।

অন্ধকার গাঢ় হতেই রকিং এইচের বাড়িতে পৌঁছে গেল জুলিয়াস। বাইরে কর্মচারীদের ঘর থেকে লোকজনের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে-এখনও ঘুমায়নি ওরা। কিন্তু ওদিকে নজর দেয়ার দরকার বোধ করল না সে, তাকে ওরা কেউ আশা করবে না।

নিঃশব্দে, বারান্দায় উঠে এল জুলিয়াস। কেউ বাধা দিল না ওকে। চাবির গর্ত দিয়ে ভিতরে চেয়েই চমকে উঠল সে। ভাগ্যিস দরজা খুলে সোজা ঢুকে পড়েনি জুলিয়াস। ভিতরে একটা চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছে সেই বিশাল-দেহ লোকটা! কি যেন নাম ওর? হ্যাঁ, মাডি। মাডি লরিমার।

পিছিয়ে এল জুলিয়াস। ভিতরে কেউ না কেউ থাকবে এটাই আশা করা উচিত ছিল ওর। একটা কুকুর এর মধ্যেই জুলিয়াসকে খুঁজে বার করে লেজ নাড়তে নাড়তে মহা আনন্দে ওর গা চাটছে। কুকুরটার পিঠ থাবড়ে একটু আদর করে বাইরে দিয়ে ঘুরে পেপির জানালার কাছে সরে এল সে। কায়দা করে জানালা খুলে টপকে ভিতরে ঢুকে পড়ল জুকিয়াস। এখন শুধু পেপির ফেরার অপেক্ষা।

প্রায় রাত বারোটার দিকে পেপি এডের সাথেই ফিরল শহর থেকে। উঠানে ওদের আওয়াজ শুনতে পেল জুলিয়াস। কয়েক মিনিট পরেই বাড়ির ভিতরে পেপির গলা শোনা গেল, তুমি এবার নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও, বাবার কিছু দরকার হলে আমিই দেখব। বাকি সবাই কিছুক্ষণ পরেই ফিরবে-জারভিস ফিরেছে?

এখনও ফেরেনি, জবাব দিল মাড়ি।

তাহলে জিনার সাথেই কাটাচ্ছে সে, খুশি মনেই বলল পেপি। ভিতরের বারান্দা থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল। কিন্তু সরাসরি নিজের ঘরে না এসে প্রথমে বাবার ঘরে ঢুকল সে। বাবা কেমন আছেন দেখে ঘরে ফিরল পেপি। দরজা বন্ধ করে আপন মনে গান গাইতে গাইতে কাপড় ছাড়ার জন্যে দেয়াল আলমারির কাছে গিয়ে আলো জ্বালাল সে।

নীরবে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে জুলিয়াস। মুহূর্তে ঘরটা আলোয় ভরে উঠল। ঘুরেই ওকে দেখতে পেল পেপি। সাথে সাথে চিনলেও চমকে উঠে ওর মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল। হাত দুটো আপনা আপনি উঠে এল বুকের উপর। চোখ দুটো বিস্ফারিত।

আমি পেপি, ভয়ের কিছু নেই, শান্ত স্বরে বলল জুলিয়াসপ

চট করে বন্ধ দরজাটা একবার দেখে নিয়ে সে বলল, এখানে কি করছ তুমি?

তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।

ওরা যদি জানতে পারে তোমাকে খুন করে ফেলবে, জানো?

কেন? আমাকে কেউ মারতে চাইবে কেন?

নকার নামে একজন লোক কাজ করে এখানে। সে যদি…

আমার মৃত্যু কামনা কি সে একাই করে?

তাই কি যথেষ্ট নয়? আরও দরকার আছে তোমার?

বাবার শরীর কেমন?

পেপির চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। তুমি যদি বাবাকে বিরক্ত করতে এসে থাকো …

না, আমি সেজন্যে আসিনি। বাবা যা বলছেন তার পরে তাঁর সম্পত্তির কানাকড়ি অংশও আমি চাই না। জানি না, মনে হচ্ছে কোন কারণে আমার প্রতি তার মন বিষিয়ে গেছে। মনের ওপর হাত নেই কারও, তবু হাজার হোক নিজের বাবা তো, তাই জানতে ইচ্ছা করে। কেমন আছেন তিনি?

দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল পেপি। এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দাটা ভাল করে টেনে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। চেহারাটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে তার-হঠাৎ তাকে অত্যন্ত ক্লান্ত আর চিন্তিত দেখাচ্ছে। বাবা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছেন, জুলিয়াস। খুব কষ্ট হচ্ছে তার, বুকের ব্যথাটা সব সময়ই থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় যেন এর চেয়ে তার মরে যাওয়াই ভাল। এমন মনে হওয়া কি অন্যায়?

না, বোন, তোমার ব্যথাটা আমি বুঝি।

আমি যতটা সম্ভব বাবার কাছে থাকতে চেষ্টা করি, কিন্তু আমার মনে হয় সেটা উনি চান না। কথা মোটেও বলেন না-তার ধারণা কথা না বলে শক্তি সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে ভাল হয়ে উঠবেন। আবার একদিন আগের মত বাইরে ঘুরে বেড়াবেন কিন্তু সে আশা মিছে-একেবারেই অসম্ভব।

এ ব্যাপারে জারভিসের কি মত?

সে দুঃখিত, কিন্তু…ওর কথা আলোচনা করতে চাই না আমি

বস সাজতে ভালই লাগছে ওর, পেপির মনের কথা আন্দাজ করে বলল জুলিয়াস

এখনও ছোট, সব বোঝার বয়স হয়নি ওর।

তা ঠিক, বলে প্রসঙ্গ বদলাল জুলিয়াস। অন্য একটা ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছি আমি। কিন্তু কথাটা কিভাবে পাড়ব, মানে

বুঝেছি। এডের ব্যাপারে আলাপ করতে এসেছ, সহজ ভাবেই বলল পেপি।

কি করে বুঝলে?

হয়তো তোমাকে কিছুটা চিনি বলেই বুঝেছি!

বড় ভাইগিরি ফলাতে আমি আসিনি।

সরাসরি জুলিয়াসের চোখে চোখ রাখল পেপি। তুমি আমাকে বলতে এসেছ এড একজন বন্দুকবাজ, একসময় ডাকাতির সাথেও জড়িত ছিল সে। বলবে ওকে ভাড়া করে আনা হয়েছে আমার সাথে প্রেম করে আমাকে বিয়ে করার জন্যে হয়তো এও বলবে আমার মত অনেক মেয়েকেই এর আগে ভোগ করেছে সে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে জুলিয়াস এই বয়সেই পেপি এত বোঝে তা কল্পনাও করতে পারেনি সে বলল, এত রূঢ়ভাবে কথাটা বলতাম না আমি।

বললেও মিথ্যে বলা হত না।

সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

খাটের ধারে হাত দুটো কোলে রেখে মেঝের দিকে চেয়ে বসে রইল পেপি। একটু পরে স্বগতোক্তির মত বলে চলল, হ্যাঁ, এড সম্বন্ধে যা বললাম সেগুলো সবই সত্যি। বন্দুকবাজ ডাকাত ছিল সে। আমি সুন্দরী বলে নয়, আমি একদিন রকিং এইচের একটা অংশের মালিক হব বলেই আমাকে বিয়ে করতে এসেছিল সে! আমি তার জীবনের প্রথম নারীও নই। কিন্তু সে কি ছিল, কেন এখানে এসেছিল, সেসব কিছুই জানতে চাই না, আমি ওকে বিয়ে করব।

কেন? অস্থিরভাবে নড়ে উঠল জুলিয়াস।

কারণ ওকে ভালবাসি আমি!

চোখ তুলে চাইল পেপি! পানি টলটল করছে ওর দুই চোখে। মুখটা ব্যথায় বিকৃত ওর এই রূপ আগে কোনদিন দেখেনি জুলিয়াস। হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের সাথে আবদ্ধ-মুখে ভয় আর বেপরোয়া ভাবের একটা অদ্ভুত মিশ্রণ।

তাহলে তো আমি শত বোঝালেও কোন ফল হবে না।

না, আমি মনস্থির করে ফেলেছি

জারভিস কি বলে?

ওর কথায় কিছু আসে যায় না

মেডক সম্বন্ধে কিছু ভেবেছ?

এর সাথে মেডক লেটনের কি সম্পর্ক?

ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো, ধীরে ধীরে বলল জুলিয়াস! আপাতত সে-ই সবকিছু চালাচ্ছে। খামারের লোকজনও সবাই তার বাছাই করা নিজস্ব লোক। এখন সে জারভিসকে বড় বলে মানছে বটে, কিন্তু বাবা মারা গেলে কি ঘটবে? র‍্যাঞ্চ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। তুমি বিয়ে করলে তোমার অংশটা মেডক এডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। কিন্তু জারভিসের অংশ কিভাবে দখলে রাখবে ওরা? একটা উপায় হতে পারে জারভিসকে মেরে ফেলা-তা হলে পুরো সম্পত্তিই তোমার অর্থাৎ মেডকের হাতে চলে যাবে।

উঠে দাঁড়াল পেপি। ওর গাল দুটো রক্তহীন ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ওরা জারভিসের কোন ক্ষতি করবে না। সে তো ওদের কথা মতই চলে। কোন বাধাই সৃষ্টি করছে না সে।

এখন করছে না বটে, কিন্তু পরে করতে পারে। ছড়ি ঘুরিয়ে আদেশ দেয়া আর কর্তৃত্ব করা পছন্দ করে নে। এখন মেডক সেটা সহ্য করছে-কিন্তু পরে কি হবে? সূক্ষ্ম একটা সুতোয় ঝুলছে জারভিসের জীবন।

তর্ক করল না পেপি জুলিয়াসের কথাগুলো যে কতটা সত্যি তা সে বেশ বুঝতে পারছে এগিয়ে এসে জুলিয়াসের দুই বাহুমূল খামচে ধরল পেপি জুলিয়াস, কি করব আমরা? কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে।

জানি না। জারভিসের সাথে কথা বলে লাভ নেই। কারও কথাই সে শুনবে না।

আমি…আমি যদি বিয়েতে রাজি না হই তাহলে কি সমস্যার সমাধান হবে?

কিছুটা সাহায্য হবে বটে কিন্তু তাতে স্থায়ী সমাধান হবে না। এখনও কোন নির্ভরযোগ্য উপায় খুঁজে পাইনি, কিন্তু সেই চেষ্টাতেই আছি আমি।

কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখল পেপি। মুহূর্তের জন্যে শিউরে উঠল ওর সারা দেহ। ওহ, জুলিয়াস আমি যে কি করব। বুঝি না। মাঝে মাঝে মনে হয় আবার সেই ছেলেবেলার নিশ্চিন্ত জীবনে যদি ফিরে যেতে পারতাম!

না, পেপি, তা হয় না। কঠিন বাস্তবের সম্মুখীন একদিন আমাদের হতেই হবে। বড় হয়েছি…বড়দের মতই বুদ্ধি-বিবেচনা করে চলতে হবে এখন।

আমরা যদি

কথার মাঝেই থেমে মুখ তুলে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল পেপি। বাইরের উঠানে কয়েকটা ঘোড়া এসে থামার শব্দ শোনা গেল। ওদের অস্পষ্ট কথাবার্তার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে জুলিয়াস।

শহর থেকে লোকজন ফিরে এসেছে, বলল পেপি, ওরা আসার আগেই এখান থেকে বেরিয়ে পড়া উচিত ছিল তোমার।

অসুবিধা হবে না, ঠিক চলে যাব আমি।

ফু দিয়ে বাতি নিভিয়ে জানালার ধারে এসে অন্ধকারে পর্দা সরিয়ে বাইরে উঁকি দিল পেপি। উঠান থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওর ঘর। ঘোড়া থেকে নামছে ওরা। ওদের কারও এদিকে আসার সম্ভাবনা খুব কম।

জুলিয়াস এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। আমরা ভাগ্যচক্রে এই বিপাকে জড়িয়ে না পড়লেই ভাল ছিল, পেপি।

ঘুরে দাঁড়াল পেপি। তোমার আর জিনার মধ্যে সম্পর্ক এখন কেমন? প্রশ্ন করল সে।

ওর সাথে ভাল করে কথা বলারই সুযোগ হয়নি আমার।

জারভিসের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ওর।

শুনেছি।

ওর যে কি হয়েছে জানি না, হয়তো তোমার কারণেই ওখানে যাওয়া আরম্ভ করেছে। তুমি যাবার পর এখানে সে তোমার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে জিনার কাছেও সেই একই ব্যাপার করার চেষ্টা করছে। কেমন যেন বদলে গেছে জারভিস। তোমাকে দেখতে তো পারেই না, আমার সাথেও ইদানীং বিশেষ কথা বলে না।

ছোটকাল থেকেই আমি ওর দু’চোখের বিষ। বাবা আমাদের যত কিছু শেখাতে চাইতেন তার কোনটাতেই ওর আগ্রহ ছিল না। বাবা আমার সাথে বেশি সময় কাটাতেন বলে ও ধারণা তিনি আমাকেই ওর চেয়ে বেশি ভালবাসেন। সেই জন্যেই জারভিসের এত রাগ।

মাথা ঝাঁকাল পেপি। ওরা ভিতরে গেছে রান্নাঘরে ওদের আওয়াজ পাচ্ছি আমি, এই সুযোগে পালাও।

সত্যি আর থাকাটা উচিত হবে না। এমনিতেই অনেক ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছে সে। পেপির পাশ দিয়ে এগিয়ে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে নিচে লাফিয়ে পড়ল জুলিয়াস। মাটিতে শুয়ে পড়ে চারপাশে চেয়ে দেখল-অন্ধকারে কোন নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল না।

জুলিয়াস? ফিসফিস করে ঘর থেকে ডাকল পেপি।

কিছু বলছ?

আমি এডের সম্বন্ধে কি করব জানি না। ওকে হারাতে চাই না আমি। আমার ভিতর যে কি ঝড় বইছে বোঝাতে পারব না। থাক, এখন কিছু বোলো না, আমি নিজেই ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নেব।

আর একবার চারদিকটা ভাল করে দেখে নিল, জুলিয়াস। জানালা বন্ধ করার আওয়াজ পেল সে। কোথাও কিছু নড়ছে না। মৃদু বাতাস বইছে। দূর থেকে কাঁপানো স্বরে একটা কয়োটির ডাক ভেসে এল।

বিপদের সম্ভাবনা নেই দেখে সেন্টিনেল পাহাড়ের ঢাল ধরে রওনা হলো জুলিয়াস। কয়েক পা এগিয়ে বাড়ির কোনা থেকে একটা খসখস আওয়াজে ঝট করে ঘুরে তাকিয়েই মাটিতে শুয়ে পড়ল। পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছে ওর হাতে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে আছে জুলিয়াস। বাড়ির কোনায় কাকে দেখল সে? লোকটা কি তাকে দেখেছে? ওখানে কি করছিল ও?

পরিষ্কার গলায় কেউ বলে উঠল, দুই হাত মাথার ওপরে তুলে দাঁড়াও, জুলিয়াস। চারজন লোক বন্দুক তাক করে রয়েছে–পালাবার পথ নেই তোমার।

তবু নড়ল না জুলিয়াস। মাথাটা সামান্য একটু ফিরিয়ে নিজের দুই পাশ ভাল করে দেখল। যে লোকটা কথা বলেছিল প্রথমে তাকেই কেবল চোখে। পড়ল। পরে খেয়াল করল বাড়ির কোনা থেকে একটা রাইফেলের ব্যারেল সামান্য ঝিলিক দিয়ে উঠল।

উঠে দাঁড়াও, জুলিয়াস, লোকটা আবার আদেশ দিল। কোন আড়াল নেই তোমার, ভাল মতই ফাঁদে পড়েছ। লক্ষ্মী ছেলের মত মাথার ওপরে হাত তুলে দাঁড়াও।

বেশ অন্ধকার, কিন্তু গা ঢাকা দিয়ে পালাবার জন্যে যথেষ্ট নয়। দু’জনকে জুলিয়াস নিজেই দেখতে পেয়েছে-হয়তো আরও লোক তৈরি রয়েছে ওকে গুলি করার জন্যে। সেন্টিনেল পাহাড়ের দিকে দৌড় দিয়েও বিশেষ লাভ নেই-সিকি মাইলের আগে বাচবার মত কোন আড়াল নেই। ভাল মতই ফেঁসেছে সে।

শেষবারের মত বলছি, আবার লোকটার গলা শোনা গেল। হাত তুলে উঠে দাঁড়াও, জুলিয়াস।

আর কোন উপায় নেই। পিস্তলটা খাপে ভরে হাত তুলে উঠে দাঁড়াল জুলিয়াস। আগের দু’জনসহ দু’পাশ থেকে আরও দু’জন এগিয়ে এল ওর দিকে। ওদের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সে ভাবছে: তার উপস্থিতি ওরা টের পেল কি করে? অবশ্য সে প্রশ্ন এখন অবান্তর, তাকে নিয়ে ওরা কি করবে সেটাই বড় কথা।

কাছে আসতেই ওদের দুজনকে চিনল জুলিয়াস। একজন এড, অন্যজন হিউ হার্পার-বাকি দুজন তার অচেনা। এই ওদের পরিচালনা করছে।

ওর পিস্তলটা নিয়ে নাও, হিউ, আদেশ করল এড।

ওকে গুলি করে মেরে ফেললেই তো ঝামেলা চুকে যায়, হিউ গজর গজর করতে থাকল বটে, কিন্তু আদেশ অনুযায়ী জুলিয়াসের পিস্তল তুলে নিয়ে পিছিয়ে। গেল।

টুপিটা মাথার পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে দাঁত বের করে হাসল এড। বলল, দুঃখিত, জুলিয়াস, মাথা খাটাওনি তুমি। তারপরই ওর গলার স্বর একেবারে বদলে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে সে আদেশ দিল, ওকে গুদাম ঘরে নিয়ে যাও, আমি মেডককে খবর দিচ্ছি।

<

Super User