পরদিন সকাল। বাঙ্কহাউসে উইলসন, রজার এবং অন্য লোক তিনটির ঘুম ভাঙল প্রায় কাছাকাছি সময়ে। ফায়ারপ্লেসের সামনে জড়ো হল ওরা। খুব বেশি গিলে ফেলেছে কাল রাতে। রেশ কাটতে চাইছে না।
ইণ্ডিয়ান হারামজাদাটা কফি আনছে না কেন? খিস্তি করল রজার।
খানিক বাদেই খুলে গেল বাঙ্কহাউসের দরজা। বিশাল এক কফিপট হাতে ঘরে ঢুকল পিকো। অন্যহাত ভর্তি টিনের কাপ।
কফিপটটা নামিয়ে রাখল সে। ওটা টেনে নিয়ে নিজের কাপটায় কফি ঢালল রজার। তারপর পটটা বাড়িয়ে দিল অন্যদের দিকে। দাঁড়িয়ে রইল পিকো। কিছু বলতে চায়, সাহসে কুলোচ্ছে না। শেষমেশ বলেই ফেলল, আমাকে একটু হুইস্কি খাওয়াবে?
লাথি ছুঁড়ল রজার। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল পিকো। তারপর ছুটল দরজার দিকে। কফি শেষ করে লোকগুলো কাপড় পরতে লাগল একে একে।
মিস্টার হিগিন্স যদি আজই এসে পড়েন! বলল একজন।
আসতে পারেন, বলল উইলসন। শোনোনি টেকন বলছিল, রেলরোড় খুব কাছে এসে গেছে।
বার্নার্ড নামের লম্বা, হালকা-পাতলা লোকটি বলল, রেলরোড়, দুটো জোড়া দেবে কিভাবে বুঝতে পারছি না আমি। একটা শুরু করেছে ইস্ট কোস্ট হক, আরেকটা ওয়েস্ট কোস্ট। দুটো মেলাতে চায় কাছাকাছি কোথাও।
রেলরোড দুটো ইউট-র কাছে কোথাও মিলবে। এখান থেকে মাইল পঞ্চাশেক উত্তরে, বলল উইলসন।
ওজায়গাটা আমি ঘুরে দেখে এসেছি। ফাঁকা প্রান্তর। আবার কোথাওবা দুর্গম, মেলাবে কি করে? বলল বার্নার্ড।
জরিপ করেছে ওরা। মেলাবেই, ব্যাখ্যা করল উইলসন।
জরিপ করেছে মানে?
আহ্, চুপ করবে? খেকিয়ে উঠল রজার। ফালতু চিন্তা ছেড়ে কাজের কথা ভাব। কাজটা করতে পারলে ভাল পয়সা পাবে।
কারও মুখে কথা নেই। নীরবতা ভাঙল উইলসন। রজারের দিকে চেয়ে বলল, এতবড় একটা ব্যাপারে জড়াব, কোনদিন ভাবতেও পারিনি।
হুঁ, আমিও, সায় দিল রজার। ঠোঁট চাটল সে।
খানিক ইতস্তত করে বলল উইলসন, আমরা…মানে খুব বেশি ঝুঁকি নিয়ে ফেলছি। তাই না?
মানে? রজার প্রশ্ন করল তাকে।
মানে••একটু ভয় ভয় করছে না?
ঠাণ্ডা দৃষ্টি বোলাল রজার, উইলসনের চোখে মুখে।
আমার করছে না।
তিতে ঠেকল উইলসনের জিভ। তবু বলল, এটা স্যালুন নয়। গলাবাজি করছি না আমি। বলতে চাইছি ব্যাপারটা খুব সাধারণ নয়। ব্যাঙ্ক ডাকাতি বা ফালতু কাউকে খুন করার মত সহজও নয়।
আমার কাজ টার্গেট সই করা। ব্যস। তাই করব আমি, একগুলিতেই শেষ করব ওকে। রজার বলল ঘৃণাভরে।
আর চুপ করে থাকতে পারল না বার্নার্ড। এতক্ষণ চরম আগ্রহ নিয়ে শুনছিল ওদের কথা। এবার বলল, একটামাত্র লোকের জন্যে এত খরচ? এতসব পরিকল্পনা?
সাধারণ লোক নয় ও, নরম গলায় বলল উইলসন। চাইলেই ওর পেটে পিস্তল ঠেকানো যাবে না।
তারমানে ওর চারপাশে গার্ড থাকবে প্রশ্ন করল বার্নার্ড।
থামবে তুমি? গলা উঁচিয়ে বলল রজার।
মুখ কালো করল বার্নার্ড। মিস্টার হিগিন্স দেশের সেরা পাঁচজন গানম্যানকে জড়ো করেছেন। কিন্তু কেন, সেটা জানতে চাইব না?
সময় হলে সবই জানতে পারবে, উইলসন বলল।
আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসছি, কোট পরতে পরতে বলল একজন। বেরিয়ে এল সে। হাই তুলল। ঝলমল করছে রোদ। ওর নজর গেল গ্রিফিথের স্যালুনের দিকে। একটা ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে স্যালুনের সামনে। লাগাম ঝুলে রয়েছে গলার কাছে। দেখে মনে হল পরিত্যক্ত। ওটার দিকে এগিয়ে গেল সে। তারপর ভালমত দেখে নিয়েই ছুটল বাঙ্কহাউসের দিকে। ঝড়ের বেগে। রজার, শিকারী ব্যাটা মনে হয় ফিরে এসেছে, বুড়ো আঙুল ঝাঁকাচ্ছে পেছন দিকে।
বাঙ্কে বসে ছিল রজার। নিরুত্তাপ গলায় প্রশ্ন করল, কি বললে?
ওর ঘোড়াটাকে দেখলাম, স্যালুনের সামনে। আর একটি কথা না বলে। লাফিয়ে নামল রজার। গানবেল্ট পরে নিল। বেরিয়ে এল দ্রুত। পেছনে অন্যরা।
রজার বলল উইলসনকে, সত্যি যদি ফিরে এসে থাকে তবে বেজন্মাটা এবার আর বাঁচবে না। দেখব মিস্টার হিগিন্স কি বলেন।
ঘোড়াটার কাছে গিয়ে থামল ওরা। ঠাণ্ডার ধকলে কাবু হয়ে গেছে। সারারাত বাইরে ছিল। লাগামটা ধরল উইলসন। বলল, ধ্যাৎ, ঘোড়াটা একাই ফিরে এসেছে। এই দেখ। স্যাডলে পুরু হয়ে জমে থাকা তুষার দেখাল সে। ঘোড়াটা সারারাত এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। একাই ফিরে এসেছে।
আমারও তাই মনে হয়, সায় দিল বার্নার্ড। ঘোড়াটার দিকে তাকাল রজার, ঠোঁট চেটে বলল, আমি নিশ্চিত হতে পারছি না।
আমি নিশ্চিত, উইলসন বলল। ঘোড়াটার পিঠে স্যাডল আছে। অথচ স্যাডলব্যাগগুলো নেই। রাইফেলটাও। লোকটা হয়ত ক্যাম্প করতে নেমেছিল কোথাও। সেই সুযোগে পালিয়েছে ঘোড়াটা।
কে জানে, রজার বলল। গাল চুলকাল, হতেও পারে।
উইলসন ঠিকই বলেছে, বলল আরেকজন। ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে থাকতে চায়নি ওটা। তাই পরিচিত পরিবেশে ফিরে এসেছে।
হয়ত তাই, উদাস কণ্ঠে বলল রজার।
স্যালুনের দিকে এগোল ওরা। চাইল রাস্তার দিকে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সাদা। তুষার ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না ওদের। লোকটা নিশ্চিত মারা গেছে। আহত অবস্থায়, ঘোড়া ছাড়া কারও পক্ষে টেকা সম্ভব নয়। উইলসন বলল।
তবু খোঁজ করা দরকার, রজার বলল। ফিরে এসে লুকিয়ে থাকাও অসম্ভব নয়।
তা অবশ্য ঠিক, সম্মতি জানাল উইলসন। বাঙ্কহাউস, স্যালুন আর ক্যাথিদের বাড়িতে থাকবেনা ও। তাহলে বাকি রইল বার্ন আর দুটো বাড়ি। বার্নার্ড, ঘোড়াটাকে বার্নে রেখে এস। আমরা বাড়ি দুটো দেখতে যাচ্ছি।
দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্যাথির মা। লোকগুলোকে জটলা করতে দেখলেন তিনি। তারপর ছড়িয়ে পড়ল ওরা। কেন সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না তার। ছুটে এলেন তিনি ক্যাথির ঘরে। ঘুমোচ্ছিল ক্যাথি। ডেকে তুললেন।
রজাররা ঘোড়াটা দেখতে পেয়েছে। খুঁজতে বেরিয়েছে লোকটাকে। ছুটে জানালার কাছে গেল ক্যাথি। লোকগুলোঁকে দেখতে পেল না, ওরা এখানে আসবে না, মাকে সান্ত্বনা দিল সে।
কি করে বুঝলি তুই? বিশ্বাস হল না মায়ের। ওরা ধরে নেবে ঘোড়া থেকে পড়ে মারা গেছে ও। আর খুঁজতে আসেও যদি দোতলায় আর আসবে না। কাজেই চিন্তা কোরো না।
কি জানি বাবা, আমার ভাল ঠেকছে না, চিন্তামুক্ত হতে পারলেন না মা।
স্যালুনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুরুট ফুকছে লোকগুলো। রজার বলল, কারও গিয়ে দেখে আসা দরকার রাস্তাটা। কোনও চিহ্ন পাওয়া যেতে পারে। লোকটা মরেছে কিনা নিশ্চিত হতে পারছি না।
কিছু করার নেই। সারারাত তুষার পড়েছে। তুষার খুঁড়ে চিহ্ন বার করা অসম্ভব, উইলসন বলল।
জানি। তবুও। মিস্টার হিগিন্স আসছেন…’ কথা শেষ করতে পারল না। রজার। বাধা দিল তাকে উইলসন। ব্যাপারটা কি রজার? এত খুঁতখুঁত করছ কেন? এই শীতে কি কেউ আশ্রয় ছাড়া বাঁচে? আসলে ভয় পাচ্ছ তুমি। তাই না? ও বেঁচে থাকলে প্রতিশোধ নেবেই।
জবাব দিতে পারল না রজার। চুপ করে রইল। সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে অস্বস্তি।
মেরীর ঘরে শুয়ে রয়েছে টেকন। ওর শার্টটা খুলে ফেলল ক্যাথি। কেটে দিল গেঞ্জি। ফলে বেরিয়ে পড়ল ব্যাণ্ডেজ। শুকনো রক্ত লেগে রয়েছে। কাচি দিয়ে সাবধানে ওটা কাটতে লাগল ক্যাথি। বোকা, আপন মনেই বলল সে। নইলে এ অবস্থা হয়?
পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন ওর মা এবং মেরী। মায়ের মুখ গম্ভীর। মেয়ের কাজ কারবার মোটেও ভাল লাগছে না তার। কোত্থেকে একটা উটকো লোককে ধরে নিয়ে এসেছে। হিগিন্সের লোকেরা জানতে পারলে ভয়ানক বিপদ হবে। এমনিতেই ওরা সানশাইন ছেড়ে যেতে দিচ্ছে না ওদের।
ব্যাণ্ডেজটা কাটা হয়ে গেছে। চামড়ার সাথে শক্ত হয়ে লেগে রয়েছে ব্যাণ্ডেজ। ফলে ওটা খোলার সময় তীব্র ব্যথায় ছটফট করতে লাগল টেকন।
ক্যাথি খুলে ফেলল ব্যাণ্ডেজটা। বেরিয়ে পড়ল ক্ষত। চমকে উঠলেন ক্যাথির মা। দগদগে ঘা। লাল বুলেটের ফুটোটা চোখে পড়ল পরিষ্কার।
মাগো, লোকটা বেঁচে আছে কিভাবে? বলল মেরী। বিকৃত হয়ে গেছে মুখ।
জখমটা ভাল হয়ে যেত আপনিই। বোকা লোকটা রজারের সঙ্গে লাগতে গিয়ে এ অবস্থা করেছে নিজের, ক্যাথি বলল।
ক্ষতস্থানের চারপাশে আঙুল দিয়ে আলতো করে চাপ দিল সে। গুঙিয়ে উঠল টেকন।
পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। আমাদের করার নেই কিছু। মেরী,খানিকটা গরম পানি আর সাবান নিয়ে এস গে। ক্ষতটা পরিষ্কার করতে হবে, ক্যাথি বলল।
ক্যাথি যখন ক্ষতস্থান ধুয়ে দিচ্ছে তখন নড়ে উঠল টেকন। ব্যথা লাগছে। চোখের পাতা দুটো কাপল তার। তবে খুলল না। অসহ্য যন্ত্রণা, গুলিটা লাগার পর যেমন লেগেছিল ঠিক তেমন।
আচ্ছন্ন টেকনের মনে নানা কথা ভিড় করছে এসে। ফিরে আসতে চাইছে স্মৃতিরা। হ্যাঁ, মনে পড়ে গেছে। হিংস্র একটা মুখ। হুরন, না না, হুরনের ভাই স্যাটান। হুরন তো আগেই মারা গেছে। পুবের একটা পরিবারকে সাহায্য করেছিল টেকন। তখনই বেধেছিল গোলমালটা। হুরনের সঙ্গে গানফাইটে নামতে হয়েছিল তাকে। তার জীবনের ভয়ঙ্করতম প্রতিপক্ষ। কিন্তু যতই ভয়ঙ্কর হোক টেকনের কাছে ঠিকই হার মেনেছিল সে। মারা পড়েছিল।
তারই ভাই স্যাটানের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল টেকনের। একটা স্যালুনে। ওকে খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হয়েছিল স্যাটান। দুর্ধর্ষ গানফাইটার সে-ও। তবে ফেয়ার ফাইটে টিকতে পারেনি টেকনের সামনে। বিদ্যুৎ গতিতে ড্র করেছিল টেকন। গুলি খেয়ে থরথর করে কেঁপে উঠেছিল স্যাটানের দেহ। আছড়ে পড়েছিল একটা চেয়ারের ওপর। তবে তার আগে ছোবল দিয়ে গিয়েছিল সে। পাঁজর ফুটো করে দিয়েছিল টেকনের।
আর ভাবতে পারল না টেকন। পড়ে রইল চুপ-করে।
<