টেকনকে স্যালুনে আনার আগে হিগিন্সের সাথে কথা প্রায় সেরে ফেলল উইলসন। নাস্তা খাওয়া হয়ে গেছে, ওদের। এঁটো প্লেটগুলো সরিয়ে রাখল একপাশে।
মিস্টার হিগিন্স, যা ঘটে গেছে সেজন্যে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। কিন্তু ও নিয়ে ভেবে তো আর লাভ নেই। আমার মনে হয় ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারব আমরা, উইলসন বলল।
হিগিন্সের রাগ কমছে না কিছুতেই। ঠাণ্ডা গলায় বলল, এত সোজা নয়, আক্ষেপ ঝরে পড়ল তার কণ্ঠে। পুরো ব্যাপারটার সাথে বিরাট অঙ্কের টাকা জড়িয়ে আছে। এখন যদি সব ভণ্ডুল হয়ে যায়।
হবে না, স্যার, প্রবোধ দিল উইলসন। আমি হতে দেব না। রজার মারা গেছে সত্যি কিন্তু ওই লোকটা তো আছে। হয়ত রজারের মত অতটা দক্ষ নয়। তবে ওর রাইফেলটা দেখে মনে হয় ওকে দিয়ে হবে।
এই শেষ মুহূর্তে প্ল্যান বদলাতে বলছ? না না, সেটা সম্ভব নয়। নতুন কাউকে দলে নেয়া ঠিক হবে না। তারচেয়ে বরং তুমি তৈরি হও। রজারের বিকল্প তো তুমিই ছিলে। গুলিটা, তুমিই করবে।
আমার আপত্তি নেই, বলল উইলসন। তবে নিশ্চয়তা দিতে পারব না। রজারের নিশানা ছিল অব্যর্থ। আমার তা নয়। আর দুরতুটাও কম নয়। প্রায় সিকি মাইল। রজার নার্ভাস হয়ে পড়লে ওর রাইফেলটা তুলে নিয়ে হয়ত গুলি করে দিতে পারতাম। কিন্তু লাগাতে পারতাম কিনা টার্গেটে, আমি নিজেই জানি না। আমার মনে হয় এ ব্যাপারে আপনার আরও ভেবে দেখা দরকার।
কঠিন হল হিগিন্সের মুখের পেশীগুলো। কাজটা তোমাকেই করতে হবে।
করব। তবে ওটা আমার রেঞ্জের বাইরে। তাছাড়া রজারের রাইফেলে প্র্যাকটিস করিনি আমি। ও করত। প্রতিদিন।
নিজেকে এবার আর সামলাতে পারল না হিগিন্স। চিৎকার করে বলল, এ জন্যেই বলেছিলাম কোনও ঝামেলায় জড়াতে যেয়ো না। কথাটা শুনলে না তোমরা। সব পয়সা পানিতে গেল আমার।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উইলসন বলল, আসলে আমাদের কপালটাই খারাপ। তা না হলে আহত লোকটা এখানে আসবে কেন? ঠাণ্ডার মধ্যে তাকে তাড়িয়ে দিতে মন সরছিল না। আবার মেরে ফেলতেও ভয় হচ্ছিল। পসি বাহিনী এসে পড়তে পারত।
রজারের জায়গায় ওই লোকটাকে নিতে বলছ কেন? হিগিন্স প্রশ্ন করল।
আমার মন বলছে ও পারবে।
মন বলছে!
যুক্তিও আছে। ফেয়ার ফাইটে হারিয়েছে রজারকে। মুখোমুখি। তাছাড়া ওর রাইফেলটা দেখলেই বোঝা যায়, অনেক ব্যবহার হয়েছে।
দেখেছ ওটা?
ইয়েস, স্যার। একদিন সকালে বাঙ্কহাউসে গিয়েছিলাম আমরা। ও ঘুমোচ্ছিল। তখন দেখেছি। বিশেষভাবে তৈরি ওটা। দারুণ জিনিস! কামান বলতে পারেন। ৯০ ক্যালিবারের কম হবে না।
হুম্, চুরুটের গোড়াটা হুইস্কির গেলাসে ফেলে দিল হিগিন্স।
স্যার, আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে। ওকে টেস্ট করে দেখি। টিকে গেলে তো কথাই নেই। আর ফেইল করলে শেষ করে দেব।
বললেই ও রাজি হবে?
হবে না আবার? কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করব আমি। ভুল উত্তর দেবে না ও।
সকালের ব্যাপারটা ভুলে যেয়ো না। আমি গুলির হুকুম দেয়ার পরও নড়েনি ও। মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিল।
তা ঠিক। তবে ক্যাথি মেয়েটা জড়িত ছিল সে ঘটনায়। যে তাকে লুকিয়ে রেখে সুস্থ করল, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিল, তার নাম জানতে চাইছিলেন। আপনি। ও বলেনি। ওর জায়গায় হলে আমিও বলতাম না। তাছাড়া রেল রোডের চাকরি করত ও। আমাদের প্ল্যানটা বুঝতে সময় লাগবে না ওর। আমার ধারণা গররাজি হবে না ও। জীবনের মায়া বড় মায়া।
বুঝলাম, কিন্তু…’।
সুযোগ দিয়েই দেখি না। মাথায় পিস্তল ঠেকাব ওর। যেখানে বলব ওকে সেখানেই লাগাতে হবে গুলি। না পারলে…’
মাঝপথে ওকে থামিয়ে দিল হিগিন্স। ঠিক আছে। ওকে নিয়ে এস এখানে। দৈখি ব্যাটা কি বলে। দিন দুয়েক আছে হাতে। দেখা যাক চেষ্টা করে। কিন্তু উইলসনের দিকে চেয়ে যোগ করল সে, দায়িত্বটা তোমার। যাকে দিয়ে ইচ্ছে গুলি করাও। আমি চাই কাজ।
ঠিক আছে, সায় দিল উইলসন।
টেকনকে নিয়ে আসা হল। হিগিন্সের টেবিলে। একাই বসে আছে সে এখন।
বস, মিস্টার টেকন, নিরুত্তাপ গলায় বলল হিগিন্স।
চেয়ার টেনে বসে পড়ল টেকন। তার পেছনেই বসল বার্নার্ড। রাইফেল হাতে। সতর্ক।
হুইস্কির বোতল আর একটা গেলাস ওর দিকে ঠেলে দিল হিগিন্স। নাও।
না, ধন্যবাদ, কঠিন গলায় বলল টেকন।
খাবে না? বেশ। ওর দিকে চাইল হিগিন্স। তোমার কথা কিছু বল। খানিকটা শুনেছি। আরও শুনতে চাই।
বলার মত কিছু নেই। থাকলেও আপনার জানার দরকার নেই, টেকন বলল।
সীমা ছাড়িও না, মিস্টার। বেশি বাড়াবাড়ি করো না। তোমাকে আমি এই মুহূর্তে গুলি করে মারতে পারি, জান? রাগে লাল হয়ে গেছে হিগিন্সের মুখ।
জানি। এ-ও জানি পারলেও মারবে না।
কি বলতে চাও তুমি?
বলতে চাই তুমি মতলববাজ। আমাকে মারার ইচ্ছে থাকলে এত কথা বলতে না।
মতলবটা কি বল দেখি?
জানি না।
আগ্রহের সঙ্গে সামনে ঝুঁকল হিগিন্স। শুনেছি তোমার দারুণ একটা রাইফেল আছে। ওটায় হাত কেমন তোমার?
মৃদু হেসে চুপ করে রইল টেকন।
চারশ গজের টার্গেট সই করতে পারবে? কারও হ্যাটে গুলি লাগাতে বললে পারবে?
হাসিটা বিস্তৃত হল টেকনের।
তাসের গায়ে?
জানার রাস্তা একটাই, টেকন বলল।
কি সেটা?
তোমার বুক পকেটে তাসটা রেখে চারশ গজ দূরে গিয়ে দাঁড়াও। আমাকে রাইফেলটা দিয়ে যেয়ো। জেনে যাবে।
রসিকতা ভালই জান দেখছি, শুকনো হেসে বলল হিগিন্স।
টেকন কিছু বলল না।
উইলসনের দিকে চেয়ে হিগিন্স বলল, তুমি ঠিকই বলেছিলে। তারপর টেকনের দিকে মুখ ফেরাল, আমাদের দলে যোগ দাও তুমি। তবে তার আগে প্রমাণ করতে হবে লং রেঞ্জের যে-কোন টার্গেট সই করতে পার তুমি। উতরে গেলে ভাল পারিশ্রমিক পাবে।
না, স্পষ্ট গলায় বলল টেকন।
খানিকটা বিস্মিত মনে হল হিগিন্সকে। কাজটা সম্বন্ধে না জেনেই নিষেধ করে দিলে?
তোমাকে পছন্দ করি না আমি, টেকন বলল। তোমার লোকদেরও না। আর কাজটা সম্বন্ধে কিছু জানতেও চাই না আমি।
ওর মুখ দেখে বোঝা গেল না ভেতরে ভেতরে কী পরিমাণ টেনশনে ভুগছে সে। বিপদ ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। বুঝতে পারছে টেকন।
কুৎসিত ভাবে হেসে উঠল হিগিন্স। এমন উদ্ভট কথা বাপের জন্মে শুনিনি। টেকনের চোখের দিকে কড়া চোখে চাইল সে, তোমার পছন্দ-অপছন্দে কিছু এসে যায় না, মিস্টার টেকন। রাজি না হয়ে উপায় নেই তোমার।
আছে, হালকা গলায় বলল টেকন।
বুদ্ধ কোথাকার, হিগিন্স বলল। শেষ কথা বলে দিচ্ছি আমি। যা বলব তাই করতে হবে তোমাকে। নইলে মরবে। বুঝেছ?
টেকন জবাব দিল না।
আর মনে কর না তোমাকে দলে নিচ্ছি। আগে প্রমাণ চাই আমি। রাইফেলে হাত কেমন দেখব। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।
না, সম্ভব নয়, দৃঢ় গলায় বলল টেকন।
বার্নার্ড! ক্লিনসন। নিয়ে যাও একে। বাঙ্কহাউসে নিয়ে যাও। কড়া পাহারা। দেবে। পকেট থেকে সোনার ঘড়িটা বার করল হিগিন্স। সময় দেখে নিয়ে বলল, আধ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি তোমাকে। ভেবে দেখ। ঠিক ত্রিশ মিনিট। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ সে।
ওরা দুজন নিয়ে গেল টেকনকে। রাইফেলের নল দিয়ে খুঁচিয়ে। দৃষ্টির আড়ালে ওরা চলে গেলে পর উইলসন জিজ্ঞেস করল, রাজি হবে মনে করেন, মিস্টার হিগিন্স?
হিগিন্সের রাগ পড়েনি তখনও। হলে হবে না হলে না। কিছু এসে যায় না। শালাকে গুলি করে মারলে আশা মিটবে আমার।
কিন্তু ওকে আমাদের প্রয়োজন…’
ওসব বুঝি না। হয় রাজি হবে নইলে শালাকে কুকুরের মত মারব আমি।
একটা উপায় কিন্তু আছে, ওকে রাজি করানোর, বলল উইলসন।
কি উপায়? ব্যগ্র হল হিগিন্স।
পিস্তল ঠেকাতে হবে।
দূর! পিস্তল কেন, রাইফেলটাই তো ঠেকানো আছে সর্বক্ষণ। কাজ হচ্ছে। কই?
হবে। পিস্তলটা ঠেকাতে হবে ক্যাথির মাথায়।
থমকে গেল হিগিন্স। তাতে কাজ হবে মনে কর? বিশেষ আশাবাদী হতে পারছে না।
হ্যাঁ, আমি এদের ধরনটা ভালই জানি। বহু লোকের সঙ্গে তো মিশলাম। মেয়েদেরকে সম্মান করতে জানে এরা। ক্যাথির মাথায় পিস্তল ঠেকালেই আর ভাবতে হবে না। ব্যাটাকে যা বলব তাই করবে। কিছুতেই ক্ষতি হতে দেবে না ক্যাথির। আজ সকালে দেখেননি?
উজ্জ্বল হয়ে উঠল হিগিন্সের মুখ।
দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে ছিল মেরী। টেকনকে বাঙ্কহাউসে নিয়ে যেতে দেখল সে। ছুটে গিয়ে ক্যাথিকে জানাল। সবশুনে ক্যাথি কাবার্ড থেকে একটা হইস্কির বোতল বার করল। গেলাস নিল। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কয়েকটা গলি পেরোল। দ্রুত পৌঁছে গেল বাঙ্কহাউসের পেছন দরজায়। ওর মা জানতে পারলেন না কিছুই।
ভেতরে একটা বাঙ্কে বসে রয়েছে টেকন। মুখোমুখি আরেকটা বাঙ্কে বসে ক্লিনসন আর বার্নার্ড। রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে ওকে।
পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে ধরাল বার্নার্ড! টেকনকে বলল, খাবে?
ওর কাছ থেকে চুরুট নিয়ে ধরাল টেকন। গলগল ধোয়া ছাড়ল একরাশ। ধোয়ার মাঝ দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুই পাহারাদারকে। সেদিকেই চেয়ে রইল টেকন।
ওর নিষ্পলক দৃষ্টি বার্নার্ডের অস্বস্তির কারণ হল। সে বলল, মিস্টার হিগিন্স খুব কড়া লোক। তুমি তেড়িবেড়ি করে পার পাবে না। আমার মনে হয় তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত তোমার।
মুচকি হাসল টেকন। কিছু বলল না। অস্বস্তি আরও বাড়ল বার্নার্ডের।
এসময় পকেট থেকে ঘড়ি বার করল ক্লিনসন। পনেরো মিনিট কেটেছে। আর পনেরো মিনিট পর ওকে নিয়ে যেতে হবে, বলল সে।
এখনই, বলল বার্নার্ড। মনস্থির করে নাও। মিস্টার হিগিন্স তোমাকে এতবড় একটা কাজের দায়িত্ব দিতে চাইছেন; তোমার তো গর্ব বোধ করা উচিত।
কাজটা কি? নরম গলায় প্রশ্ন করল টেকন।
জানি না ঠিক। শুধু জানি কাজটার সঙ্গে রেলরোড আর হোমরা-চোমরা কেউ জড়িত, বার্নার্ড বলল।
ওকে এতসব বলার দরকারটা কি? ক্লিনসন বিরক্ত হয়ে বলল।
কই, কিছুই তো বলিনি।
মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ওদের দিকে তাকাল টেকন। সরু হল চোখ।
এসময় পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল ক্যাথি। হাতে হুইস্কির বোতল, গেলাস। রাইফেল উঠিয়েছিল বার্নার্ড আর ক্লিনসন। চিনতে পেরে নামাল।
তোমার এখানে আসা ঠিক হয়নি, ক্লিনসন বলল।
বেশিক্ষণ থাকব না আমি, ওর দিকে না চেয়েই বলল ক্যাথি। চোখ তার টেকনের দিকে। মিস্টার টেকনের জন্যে খানিকটা হুইস্কি নিয়ে এসেছি। দরকার হতে পারে, কঠিন, তেতো গলায় বলল সে। ঝট করে ওর দিকে তাকাল টেকন। মুখ দেখে বুঝতে পারল না কিছু।
গেলাসটা পূর্ণ করল ক্যাথি। নাও, এগিয়ে দিল ওটা টেকনের দিকে। টেকন গেলাসটা নিতেই দু পা পিছিয়ে গেল ক্যাথি।
গেলাসটা নিয়ে এক মুহূর্ত স্থির বসে রইল টেকন। পরমুহূর্তে ওটা ঠোঁটের কাছে আনতেই দাঁত বার করে হাসল বার্নার্ড। আগে আমি, মিস্টার। রাইফেল সরিয়ে রাখল সে। ওটার নল এখন ছাদের দিকে তাক করা। গেলাসটার দিকে হাত বাড়াল ও। সুযোগটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করল টেকন। ক্লিনসনের মুখে ছুঁড়ে মারল গেলাস ভর্তি হুইস্কি। প্রায় অ্যাসিডের মত কাজ করল ওটা সে মুহূর্তে। চোখে অন্ধকার দেখল ক্লিনসন।
টেকন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কেড়ে নিল বার্নার্ডের রাইফেলটা। রাইফেলের নল। দু’হাতে শক্ত করে ধরে বসিয়ে দিল ক্লিনসনের মাথায়। বাঙ্ক থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল সে। পরক্ষণেই রাইফেলটা আঘাত করল বার্নার্ডের মুখে। সে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে প্রচণ্ড লাথি কষাল টেকন ওর মাথায়। বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করল না টেকন। ঘুরে দাঁড়িয়েই চেপে ধরল ক্যাথির হাত। প্রায় হিচড়ে নিয়ে চলল পেছনের দরজার দিকে। বাইরে বেরিয়ে ক্যাথিকে কাছে টেনে নিল টেকন। গালে। চুমু খেয়ে বলল, সোজা বাড়ি চলে যাও। স্যালুনে যাবে না কিছুতেই। যাও। তুমি কোথায় যাচ্ছ? উৎকণ্ঠিত ক্যাথি বলল। কী করতে যাচ্ছ?
ফাইট।
অস্ত্র কোথায় তোমার?
আছে, বলল টেকন। ওকে বাড়ির দিকে ঠেলে দিয়েই দৌড়াল টেকন। বার্নের দিকে। সেদিকে এক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বাড়ির পথে, দ্রুত পা চালাল ক্যাথি। ঝড়ের বেগে বার্নে ঢুকল টেকন। লাগাম চেপে ধরে উঠে বসল স্যাডলে। খোলা দরজা দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বেরিয়ে এল ঘোড়া। ডানে মোড় নিয়ে ছুটল শহরের বাইরে। স্ক্যাবার্ড থেকে ততক্ষণে বিশাল রাইফেলটা এসে গেছে টেকনের হাতে।
স্যালুনে বসে টের পেল না ওরা কিছুই। হিগিন্স আর উইলসন টেবিলে বসে গিলেই চলেছে তখনও। ঘড়িটা তুলে নিয়ে দেখল হিগিন্স। আর তিন মিনিট, বলল সে।
ক্যাথিকে এখানে আনা উচিত এবার। কি বলেন, মিস্টার হিগিন্স? উইলসন প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ। স্যাণ্ডার্স, মিস ক্যাথিকে এখানে নিয়ে এস। ভদ্র ব্যবহার করবে, মুখ ফিরিয়ে বলল হিগিন্স।
ইয়েস, স্যার। কোটটা গায়ে চাপিয়ে ঘর থেকে বেরুল স্যাণ্ডার্স। বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখতে পেল ছুটে চলেছে টেকনের ঘোড়া।
স্পার দাবাল টেকন। গন্তব্য পাহাড়। শহরের মাইল আটেক বাইরে সেটা। পিস্তলের জন্যে হাত বাড়াল স্যাণ্ডার্স। কিন্তু বাদ সাধল লম্বা কোট। সে ড্র করার আগেই রেঞ্জের বাইরে চলে গেল টেকন। ছুটে ঘরে ফিরে এল ও। পালিয়েছে, চেঁচাল। টেকন ঘোড়াসহ পালিয়েছে।
কী? লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল হিগিন্স। ধর! ধর ওকে! কিছুতেই যাতে পালাতে না পারে।
অন্যদের উদ্দেশ্যে চেঁচাল উইলসন, শিগগির ঘোড়া বের কর। পেছনের দরজা দিয়ে হুড়োহুড়ি করে বেরোল ওরা। স্যালুন থেকে বার্ন প্রায় গজ পঞ্চাশেক দূরে। সেদিকেই ছুটল সবাই।
এ সময় টলতে টলতে বাঙ্কহাউস, থেকে বেরোল ক্লিনসন আর বার্নার্ড। দুজনের মাথা-মুখ রক্তাক্ত। এগোতে গিয়ে হোঁচট খেল বার্নার্ড। পড়ে গিয়েই উঠে পড়ল আবার, বাচাও! বাঁচাও! চিৎকার করতে লাগল সে।
ওদের দুজনকে দেখে থমকে গিয়েছিল সবাই। ঘোড়া বার করার কথা মনে ছিল না কারও। উইলসন ছুটে গেল বাঙ্কহাউসের দিকে। কী হয়েছে?
বার্নার্ডের হাত উঠে এল মুখে। আমি শেষ। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল সে পুরু হয়ে জমে থাকা তুষারে।
ঘোড়া বের কর, উইলসন বলল।
বার্নের দিকে ফের দৌড়াল ওরা। গজ পঁচিশেক দূরে থাকতে বোমা ফাটার মত শব্দ হল, একটা। ওদের একজন পড়ে গেল একপাশে। ভাঙা ওয়াগনের মত। বেশ খানিকটা হেঁচড়ে গিয়ে থামল সে। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে আসছে শরীর। থেকে। বিশাল একটা গর্ত সৃষ্টি হয়েছে পেটের বাঁ দিকে। সাদা তুষার লাল হয়ে গেল।
গুলির উৎসের দিকে চমকে তাকাল ওরা। নিচু একটা পাহাড়ের চূড়ায় দেখা গেল টেকনকে। আবছা ভাবে। ছায়ামূর্তির মত ঘোড়ায় বসে রয়েছে সে। বোল্ট টেনে রিলোড করল।
শিগগির আড়াল নাও তোমরা। ও সেই রাইফেলটা ব্যবহার করছে, চিৎকার করে সাবধান করল উইলসন।
ছিটকে গেল সবাই। উইলসন, ক্লিনসন আর একজন গানম্যান ছুটল পেছনে, স্যালুনের দিকে। অন্য দুজন দৌড়াল বার্নের নিরাপদ আশ্রয়ে।
উইলসনের কাছাকাছি পড়ল পরবর্তী গুলিটা। বেশ খানিকটা তুষার ছিটকে উঠে লাগল তার পায়ে। তবে নিমেষেই নিরাপদ অবস্থানে পৌঁছে গেল সবাই। কেবল বার্নার্ড ছাড়া। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে সাহায্যের জন্যে চিৎকার করছে তখন সে। বিকট শব্দ হল আবারও। বার্নার্ডের চিৎকার থেমে গেল চিরদিনের মত।
ওদিকে খালি গুলিটা ফেলে দিল টেকন। পকেট থেকে কার্তুজ বার করে ভরল। নিরুদ্বিগ্ন, উত্তাপহীন সে। গোড়ালি দিয়ে আলতো আঘাত করল ঘোড়াটাকে। চলে গেল অন্য একটা পাহাড়ের চূড়ায়। অনেকগুলো পাহাড় পাশাপাশি রয়েছে এখানে। পরবর্তী আক্রমণ চালানোর জন্যে বেছে নিল পছন্দসই জায়গা।
স্যালুনে ঢুকে হিগিন্সকে সব খুলে বলতে চাইল উইলসন। হাঁপাচ্ছে। ক্লিনসনের মাথা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে তখনও। গ্রিফিথের কাছ থেকে বরফ চেয়ে নিয়ে ঘষল সে।
দেখেছি সবই। জানালায় ছিলাম। কোন্ দুজন মরল? ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল হিগিন্স।
বার্নার্ড আর এলভিস। কার্টার আর স্যাণ্ডার্স রয়েছে বার্নে, দ্রুত বলল উইলসন।
আচমকা ক্লিনসনের কলার চেপে ধরল হিগিন্স। হারামজাদা। ও পালাল কি করে? তোরা কী করছিলি? চিৎকার করে কথাগুলো বলল হিগিন্স। সামনে-পিছে ঝাঁকাল কয়েকবার ক্লিনসনকে।
সব দোষ ক্যাথির, ক্লিনসন বলল। নিজেকে হিগিন্সের হাত থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল না সে। পুরো ঘটনাটাই খুলে বলল ও।
প্রচণ্ড রাগে কাঁপতে লাগল হিগিন্স। কুত্তী, চিৎকার করল সে। কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব ওকে আমি। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল উইলসন।
জানালায় না দাঁড়ানোই ভাল, ও গুলি ছুঁড়তে পারে, বলল সে। ওর কথা কানেই তুলল না হিগিন্স। খানিক বাদেই বিকট শব্দে বিশাল একটা শেল এসে আঘাত হানল মেঝেতে। ছাদের খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ল। সেখানেই শুয়ে পড়ল হিগিন্স। রাগ সরে গেছে মুখ থেকে। সে জায়গায় এসে জমেছে ভয়।
ওপরের দিকে চাইল উইলসন। প্রায় দেড় ফুট মত গর্ত হয়ে গেছে ছাদ। মেঝেয় শুয়ে পড়ল সে-ও।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল গ্রিফিথ। শেলটা এসে পড়তেই ছুটে গিয়ে ডাইভ দিল বারের আড়ালে। মাথাটা সামান্য তুলে চেঁচাল, মিস্টার হিগিন্স, আমি ক্ষতিপূরণ চাই।
চুপ, শালা! ক্রুদ্ধ গর্জন করল হিগিন্স। গুলি চালাল সে গ্রিফিথকে লক্ষ্য করে। অল্পের জন্যে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল ওটা। আবার হারিয়ে গেল গ্রিফিথ। বারের আড়ালে।
ফায়ারপ্লেসের কাছে জড়সড় হয়ে কাঁপছে পিকো। মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরুচ্ছে।
হামাগুড়ি দিয়ে একজন গানম্যান স্যালুনের পেছনের দরজার দিকে এগোল। মাথা বার করে টেকনকে দেখার চেষ্টা করল।
দুড়ুম শব্দে স্যালুনটা কেঁপে উঠল আবার। আরও কয়েকটা টুকরো খসে পড়ল ছাদের।
খানিকক্ষণ নীরবতা। সেই সুযোগে পেছনের দরজার গানম্যান হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে এল জানালার কাছে। মিস্টার হিগিন্স, আমরা কী করব?
জানি না, জানালার নিচে গুটিসুটি মেরে বসল হিগিন্স। তোমাদের জন্যেই এই অবস্থা হয়েছে।
ঘরের মাঝখানে যেয়ো না। দেয়ালের সঙ্গে মিশে থাক, উইলসন বলল।
তা না হয় থাকলাম। কিন্তু আমাদের যে বোতল-বন্দী করে ফেলেছে। গানম্যান বলল। জানালা দিয়ে উঁকি মারল উইলসন। ঐ যে! ক্যাথিদের বাসার পেছনেই পাহাড়ের ওপর রয়েছে ও।
সাহস করে অন্যরাও মাথা জাগাল। ছোট একটা পাহাড়ের চূড়ায় পরিষ্কার দেখা গেল টেকনকে। পাহাড়টা আধ মাইল দূরে। হঠাৎ কালো ধোয়ার মাঝে মিলিয়ে গেল টেকনের শরীর। পরক্ষণেই জানালার খড়খড়ি ভেঙে পড়ল গুলির আঘাতে। জানালার নিচে গড়াগড়ি করতে লাগল ওরা। কাঠ আর প্লাস্টার ঝুরঝুরিয়ে পড়ল ওদের গায়ে।
তারমানে চারশ গজের দূরত্ব ওর কাছে কিছুই নয়, শুকনো গলায় বলল উইলসন।
রিলোড করতে টেকনের কয়েক সেকেণ্ড সময় লাগবে বুঝে আবার মাথা তুলল ওরা। আগের জায়গাতেই রয়েছে টেকন। রাইফেলটা ভেঙে গুলি ভরল আবার। তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল হিগিন্স। গুলি কর। বাঁচতে চাইলে গুলি কর কেউ!
প্রাণের মায়া বড় একটা করে না হিগিন্স। এখনও করছে না। প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করছে সে। একটামাত্র লোক তার সমস্ত পরিকল্পনা ভেস্তে দিচ্ছে। তার এতদিনের পরিশ্রম, এত অর্থব্যয় সব পানিতে যাচ্ছে। কিছুই করতে পারছে না সে। আবার চিৎকার করল ও, গুলি কর।
ও আমাদের রেঞ্জের বাইরে, স্যার।
আমার আর কিছু বলার নেই, চরম হতাশা হিগিন্সের কণ্ঠে, দেশের সেরা গ্যানম্যানেরা সামান্য একজন শিকারীর সঙ্গে পারে না! আমি আর কি বলব!
পরবর্তী গুলিটা উড়িয়ে নিল জানালার ওপরের অংশ। রজারকে আগেই বলেছিলাম, ওর সঙ্গে লাগতে যেয়ো না, বিড়বিড়িয়ে বলল উইলসন।
খেঁকিয়ে উঠল হিগিন্স, ওকে তখন খুন করনি কেন? সামান্য উঁকি মেরে আবার বলল, ওকে ধরতে হবে।
কিভাবে?
ধাওয়া করে। কেঁপে উঠল উইলসন। কী বলছেন আপনি? একশ গজও তো যেতে পারব আমরা। পাখির মত মরব।
সে সময় ক্লিনসন হঠাৎ পিকোকে দেখিয়ে বলল, এটাকে পাঠালে কেমন হয়, স্যার? আমাদের ঘোড়াগুলো নিয়ে আসুক।
তাই কর, নির্দেশ দিল হিগিন্স।
মাথা নিচু করে ফায়ারপ্লেসের কাছে চলে গেল ক্লিনসন। একটানে দাড় করিয়ে ফেলল বসে থাকা পিকোকে। ঠেলে নিয়ে চলল স্যালুনের পেছন দরজার দিকে। বার্নে গিয়ে লোক দুটোকে বলবে ঘোড়াগুলো নিয়ে এখানে আসতে। জলদি যাও।
পা-পারব না।
ওর কপালে পিস্তল ঠেকাল ক্লিনসন। স্যালুনের পেছনে ঘোড়াগুলো নিয়ে আসতে বলবে। দরজা দিয়ে ঠেলে বার করে দিল পিকোকে।
দরজা দিয়ে বেরিয়েই ছুটতে শুরু করল পিকো। তবে বার্নের দিকে নয়। ছুটল সে বাঙ্কহাউসের উদ্দেশে। খিস্তি করল ক্লিনসন। শুয়োরের বাচ্চা! রিভলভার তুলে নিয়ে পরপর দুটো গুলি করল সে। একটা বেরিয়ে গেল দু’ফুট দূর দিয়ে। অন্যটা লাগল পায়ে। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল পিকো! বাঙ্কহাউসটা তখনও গজ পাঁচেক দূরে। উঠে পড়ল ও। খোড়া বেড়ালের মত ছুটতে শুরু করল দরজার দিকে। ঠিক তার মাথার ওপর দরজায় লাগল ক্লিনসনের পরের গুলিটা। তবে নিরাপদেই ঢুকে পড়ল সে বাঙ্কহাউসে।
হিগিন্সের দিকে ফিরে দাঁড়াল ক্লিনসন। স্যার, এখন উপায়?
জবাব দেয়ার সময় পেল না হিগিন্স। তার আগেই প্রচণ্ড শব্দে এল গুলিটা। চিৎকার করে পড়ে গেল ক্লিনসন। তার একটা পা যেন কেটে নিয়েছে কেউ। ডান
পায়ের উরুতে বিশাল গর্ত হয়ে গেছে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল সে।
ওর দিকে এগোচ্ছিল উইলসন। কিন্তু ছাদ ভেঙে পড়ল আবার। মাথা নিচু করে চেঁচাল সে। গ্রিফিথের উদ্দেশ্যে। ক্লিনসনকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে বলল।
গ্রিফিথের ইচ্ছে ছিল না মোটেই। তবু বেরিয়ে এল সে। কলার চেপে ধরল ক্লিনসনের। হেঁচড়ে নিয়ে গেল বারের পেছনে।
কি করতে বলেন? প্রশ্ন করল উইলসন।
হিগিন্সকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। দিশা হারিয়ে ফেলেছে যেন সে। ক্রল করে দরজার কাছে যাও। চিৎকার করে বার্নের ওদেরকে ডাক।
টেকন ওদিকে অবস্থান পাল্টেছে আবার। পাহাড়গুলোর যেখান থেকে সরু রাস্তাটা শহরের দিকে গিয়েছে সেখানে ঘোড়া সমেত পৌঁছে গেছে সে। সানশাইন শহরের ঘড়বাড়ি ভালমতই চোখে পড়ে এখান থেকে। সামান্য ফাঁক হল বার্নের দরজা। দেখতে পেল টেকন। রাইফেল তুলে নিয়েই গুলি করল সে। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল মুহূর্তেই।
ক্যাথিদের বাড়িতে ওরা সবাই জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছে। ওর মা জিজ্ঞেস করলেন, এসব কী হচ্ছেরে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
বুঝতে হবে না, মা। কেবল প্রার্থনা কর ও যেন হেরে না যায়, ক্যাথি বলল। মুখে হাসি ফুটে উঠেছে তার।
স্যালুনের ভেতরে তখন জঞ্জালের স্তূপ। ভেঙে পড়েছে ছাদের অনেকাংশ। ভেঙে ঝুলে রয়েছে জানালাগুলো। দেয়ালের প্লাস্টার খসে গেছে। একটা ভারি টেবিল কাৎ করে ওদের তিনজনের পেছনে রেখেছে উইলসন। ইট-কাঠের টুকরোর আঘাত থেকে বাঁচার জন্যে। সে অবস্থাতেই গ্রিফিথকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল সে; ক্লিনসনের অবস্থা কেমন?
বারের পেছন থেকে জবাব এল, খুব খারাপ, বাঁচবে না বেশিক্ষণ। রক্ত পড়েই চলেছে।
কোনও ভাবে ওটা বন্ধ করা যায় না? আবার জিজ্ঞেস করল উইলসন।
এখন আর সম্ভব নয়। রক্ত সব প্রায় বেরিয়ে গেছে, চিৎকার করে জানান দিল গ্রিফিথ।
হিগিন্সকে বলল উইলসন, কিছু একটা করতেই হবে আমাদের। এখানে থাকলে মরব সবাই।
ফাসফেঁসে গলায় হিগিন্স বলল, ওকে শেষ করতে হবে। এখনই। দেরি করলে আমাদের সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে।
প্ল্যান? অবাক হল উইলসন। প্রাণে বাঁচি কিনা সেটা ভাবুন আগে। আপনি সহ আমরা মাত্র পাঁচজন এখন।
চোখ পিটপিট করে বলল হিগিন্স, অ্যাঁ! পাঁচজন? মাত্র পাঁচজন? ইয়েস, স্যার। চারজন গেছে। ক্লিনসন সহ। তবে সবই গেছে, আর কোনও উপায় নেই! আমার এতগুলো টাকা•••
পাহাড় থেকে সরু রাস্তাটা ধরে নেমে এল টেকন, পৌঁছে গেল শহরে। এবার সামনাসামনি আক্রমণ চালাতে চায় সে। স্যালুনের কাছাকাছি পৌঁছে সে স্যাডলের একদিকে ঝুলিয়ে দিল শরীর। ঘোড়র পেছন দিকটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ডান পা দিয়ে। বাঁ পায়ে পেঁচিয়ে ধরল গলার নিচের অংশ। বাঁ হাতে ধরে রইল স্যাডল হর্ন। স্যাডলের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখল, রাইফেলটা। ধেয়ে এল স্যালুনের দিকে। দরজা লক্ষ্য করে গুলি চালাল। উড়ে গেল দরজার অর্ধেকটা। প্রচণ্ড শব্দে।
ভেতরে বসা লোকগুলো আঁতকে উঠল। বাপরে! চিৎকার করে উঠল গ্রিফিথ।
ওদের বল ঘোড়া নিয়ে আসতে। পালাতে হবে এখান থেকে, কোনও মতে উইলসনকে বলল হিগিনস।
হামাগুড়ি দিয়ে পেছন দরজার দিকে এগোল উইলসন। দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল বার্নের লোক দুটোর। পিস্তল দিয়ে গুলি করল বার কয়েক। চেঁচাল। কাজ হল তাতে। একজন সাহস করে দরজা দিয়ে মাথা বার করল।
এক্ষুনি ঘোড়া আন, চিৎকার করে বলল উইলসন।
এক্ষুনি? ভীত মনে হল লোকটাকে।
হ্যাঁ।
স্যালুনের দরজার ওপর আবারও আঘাত হানল শেল। পুরোটাই গায়েব হল এবার। জানালার দিকে ছুটে গেল উইলসন।
ও ঢুকে পড়বে,এক্ষুনি।
ভীত-হতাশ কণ্ঠে বলল হিগিন্স, আড়াই লাখ ডলার! সব গেল!
তার মানে?
হিংস্র দৃষ্টিতে উইলসনের দিকে চাইল সে, কাজটা করে দিতে পারলে আড়াই লাখ ডলার জুটত। এই ব্যাটার জন্যে সব গেল আমার। ওকে মারতে হবে এই মুহূর্তে। চারদিকে বন্য দৃষ্টি বোলাল হিগিন্স। ওই লোক দুটো আসছে না। কেন? উইলসন, দেখ তো গিয়ে কি হল ওদের। উইলসনকে পেছন দরজার দিকে যেতে নির্দেশ দিল সে।
উইলসন আবার হামাগুড়ি দিল দরজার দিকে। পরের গুলিতে বারের পেছনে রাখা বোতলগুলো ভাঙল। মেঝেতে লেপ্টে গেল সে।
মরে গেলাম, বাঁচাও! গ্রিফিথের চিৎকার শোনা গেল। দাঁড়িয়ে পড়েছে সে। বোতলের ভাঙা টুকরো লেগে কেটে গেছে গাল। হিগিন্সকে উদ্দেশ্য করে চেঁচাল সে, বেরিয়ে যাও তুমি। এই মুহূর্তে।
গ্রিফিথকে লক্ষ্য করে আবার গুলি চালাল হিগিন্স। লক্ষ্যভ্রষ্ট হল এবারও। বারের আড়ালে উধাও হল গ্রিফিথ।
ওরা আসছে। বার্নের দরজা খুলেছে ওরা, উইলসন বলল,।
বার্নের দরজা দড়াম করে খুলে যেতে দেখল টেকন। বুঝতে অসুবিধে হল না ওদের মতলব। রাইফেল রিলোড করল সে দ্রুত। সে সময় দেখতে পেল স্যালুনের পেছন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একজন। ইশারা করছে বার্নের লোক দুটোকে। রাইফেল তুলল সে। গুলি করবে। কিন্তু পরিচিত মনে হল লোকটির অবয়ব। উইলসনকে চিনতে পারল টেকন। নামিয়ে নিল রাইফেল।
ঋণ শোধ করলাম, আপন মনেই বলল ও।
বার্নের দিকে নজর দিল টেকন। রাইফেল তুলে দেখতে পেল দরজা দিয়ে। বেরিয়ে আসছে দুজন গানম্যান। ঘোড়ায় চেপে। বাড়তি আরও দুটো ঘোড়া নিয়ে আসছে ওরা। বার্ন থেকে স্যালুনের দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ গজ। কিন্তু প্রচণ্ড বেগে ঘোড়া ছোটাল ওরা। স্যাডলের সঙ্গে প্রায় মিশিয়ে দিয়েছে শরীর। পূর্ববর্তী লোকটিকে লক্ষ্য করে গুলি করল টেকন। লাগল না। আহত হল ঘোড়াটা। গুলি খেয়ে আরোহী সুদ্ধ পড়ে গেল। অন্য অশ্বারোহী স্যালুনের পেছন দিকে সবেগে দুটল। রিলোড করল টেকন। এর ফাঁকে লোকটি পেীছে গেল দরজার কাছে। ঘোড়া থেকে নেমেই ছুটল সে। ওকে দৌড়ানোর সুযোগ দিল টেকন। লোকটি ঘরে ঢুকে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে গুলি করল সে। পিঠ দিয়ে ঢুকল শেলটা। বেরিয়ে গেল বুক দিয়ে। গুলির প্রচণ্ডতায় ঘরের ভেতর বেশ খানিকদূর হেঁচড়ে গেল মৃতদেহ।
ভেতরের লোকগুলো চেয়ে দেখল। আত্মা খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে ওদের।
প্রথমজন এসময় দৌড়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। ঝাপিয়ে শুয়ে পড়ল হিগিন্সের পাশে।
উইলসন দরজা থেকে ছুটে এল ওদের কাছে। জানালার নিচে। দুটো ঘোড়া পালিয়েছে। ঠিকমত বাঁধনি তুমি, বার্নের জীবিত লোকটিকে বলল সে।
তুমি গিয়ে বরং নিয়ে এস ঘোড়া দুটো। তারপর শক্ত করে তোমার দুপায়ের সাথে বাঁধ, প্রায় পেঁকিয়ে উঠল লোকটি।
ঘোড়া মাত্র দুটো এখন। দুটো পালিয়েছে আর একটা গুলি খেয়েছে, বলল উইলসন। কেউ চাইলে আমার ঘোড়াটা নিতে পার। তবে পালাতে পারবে এমন নিশ্চয়তা নেই। মেঝেতে পড়ে থাকা মৃত লোকটির দিকে চেয়ে আবার বলল, মিস্টার হিগিন্স, বড় বিপদ।
দেখতেই তো পাচ্ছি, কাটখোট্টা জবাব এল হিগিন্সের কাছ থেকে। সবার ওপর থেকে কর্তৃত্ব হারিয়েছে সে এখন। তার প্রতিটি কথাতেই ভয়ের ছোঁয়া। মেজাজ দেখিয়ে চাপা দিতে চাইছে ভয়।
আমরা মাত্র চারজন এখন। অবশ্য তাতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। আমাদের প্ল্যান সফলও হতে পারে। টেকন যদি সারেণ্ডার করে। বিনাশর্তে। হিগিন্সকে ব্যঙ্গ করে বলল উইলসন।
চুপ করবে তুমি? গর্জে উঠল হিগিন্স।
ভাঙা জানালা দিয়ে ইতিউতি চাইল হিগিন্স। ভুলেই গেল গুলিগুলো এখন আসছে পেছন দিক থেকে। পেছনের দরজাটা আলগা হয়ে ঝুলছিল এতক্ষণ। এবার গুলি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। সশব্দে।
হিগিন্স, ডাকল উইলসন। এই প্রথম নামের আগে মিস্টার বলল না সে। এখান থেকে যে করেই হোক আমাদের পালাতে হবে। ও পুরো স্যালুনটাই উড়িয়ে দেবে।
ইতিমধ্যে সেলুনের ভাঙা দরজা-জানালা আর ফুটো ছাদ দিয়ে তুষার এসে জমছে ঘরে। সঙ্গে বিকেলের ঠাণ্ডা বাতাস। তুষারের পাতলা আস্তরণ পড়েছে মেঝেতে। চেলা কাঠের অভাবে, নিভে গেছে ফায়ারপ্লেসের আগুন। ফলে হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে শীত।
মনে হয় আঁধার হলে পালানো যাবে। আর কতক্ষণ বাকি? যে লোকটি ঘোড়া নিয়ে এসেছে জিজ্ঞেস করল সে।
কমপক্ষে দু’ঘণ্টা, উইলসন বলল।
স্যালুনের সামনের দিকটাতে রয়েছে এখন টেকন, ঘোড়ার পিঠে বসে চাইল আকাশের পানে। হিসেব করল, আঁধার ঘনাতে আর কতক্ষণ লাগরে। যথেষ্ট ক্ষতি করা গেছে ওদের, ভাবল সে। ছাদ আর দেয়ালের ভাঙা টুকরো পড়েও ওরা আহত হয়েছে নিশ্চিত।
ক্লান্তিতে ছেয়ে গেছে তার শরীর-মন। চিনচিনে ব্যথাটাও টের পাচ্ছে। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এই রাইফেল দিয়ে এত বেশি গুলি আর কখনও করেনি ও। প্রচুর শক্তিক্ষয় হয়েছে। ট্রিগার টানলেই ব্যথা করছে বুকের এক পাশটা। এভাবে আর কতক্ষণ সম্ভব বুঝতে পারল না সে। ব্যথাটা সেরে এসেছিল প্রায়। কিন্তু আজকের পরিশ্রমের ফলে পাজরে ছুরির তীক্ষ্ণ ফলা অনুভব করছে টেকন।
রাত নামলে বড় অসুবিধেয় পড়বে সে। আলো থাকতে থাকতেই শেষ করে দিতে হবে ওদের। কিছুতেই বেরুতে দেয়া চলবে না ওদেরকে। এ ব্যাপারে সামান্য ভুলচুক হলে বাচবে না সে। রাতটা কাটাতে হবে ক্যাথিদের বাড়িতে। ঠাণ্ডার মধ্যে বাইরে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু স্যালুনের লোকগুলোকে খুন না করে ক্যাথিদের বাসায় যাওয়া যাবে না। গেলে সকালবেলাতেই ঘেরাও হয়ে যাবে সে। মারা পড়বে ক্যাথিসুদ্ধ। ওর মা আর মেরীকে ছাড়বে না ওরা। অবশ্য ঘোড়াসহ পালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু অসম্ভব সেটা। ক্যাথিদের রেখে কিছুতেই যাবে না সে।
স্যালুনে ওদিকে সাবধানে মাথা তুলল উইলসন। টেকনকে দেখতে পেল সে। শুয়ে পড়! গুলি ছুঁড়ছে। সতর্ক করে দিল সবাইকে।
ওদের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। বার্ন থেকে ঘোড়া নিয়ে আসা গানম্যান উফ্! বলে শুয়ে পড়ল। মাথার পেছন দিকটা থেঁতলে গেছে তার। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। সেদিকে চেয়ে ভয়ে ছিটকে সরে গেল হিগিন্স।
তিনজন বাকি রইলাম, নিপ্রাণ গলায় বলল উইলসন। আমি, টাইগার আর তুমি। তবে গানম্যান আমরা দুজন। আমি আর টাইগার। হিগিন্সের দিকে চেয়ে বলল সে। গ্রিফিথ, মোটকাটাকে দু’বার গুলি করেও লাগাতে পারনি তুমি। তোমার থাকা না থাকা সমান।
চুপ কর, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে খেকিয়ে উঠল হিগিন্স।
করব, উইলসন বলল। আগে তুমি দায়িত্ব পালন কর। বুদ্ধি বাতলাও। পালের গোদা তো তুমিই।
সারেণ্ডার করব আমরা, বলল হিগিন্স।
পাগল, টাইগার বলল।
উইলসন বলল, ভাল।
উইলসন! হিগিন্সের গলায় উত্তেজনা।
স্যার!
এটা নাও, সাদা বড়সড় একটা রুমাল টেনে বার করল হিগিন্স পকেট থেকে। উইলসনের হাতে ওটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা নাড়াও। জানিয়ে দাও আমরা সারেণ্ডার করছি।
কাজ হবে না, বলল উইলসন। যা বলছি কর!
না, ও রাজি হবে না।
আরে গাধা, আমরা কি সত্যি সত্যি সারেণ্ডার করছি নাকি? ওকে কোনভাবে এদিকে নিয়ে আসবে। তারপর গুলি করে শুইয়ে দেবে।
মাথা নাড়ল উইলসন। তার আগেই জানে মরব আমি।
মরবে না, বলল হিগিন্স। রুমাল দেখাবে তো। ও ছোটলোক নয়।
ও বোকাও নয়। ওসব চালাকিতে কাজ হবে না, মিস্টার।
ওকে বলবে তুমি ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। সারেণ্ডার করতে চাইবে। রেঞ্জের মধ্যে নিয়ে আসতে পারলেই হল।
বললাম তো, হিগিন্স, ওসবে কাজ হবে না। আবার উঁকি দিল উইলসন। টেকনের অবস্থান দেখার জন্যে। আগের জায়গাতেই রয়েছে এখনও। প্রায় ছয়শ গজ দূরে। ঘোড়ায় বসে। উইলসন উঁকি দিতেই ট্রিগার টিপল টেকন। লক্ষ্য সেই একই। ছাদ। খানিকটা অংশ ভেঙে পড়ল এবারও।
আমাদের ঠাণ্ডায় জমিয়ে মারতে চায় ও, বলল টাইগার। কি ভেবে মৃত গানম্যানের কাছে পৌঁছল হিগিন্স। হামাগুড়ি দিয়ে। তারপর ছিড়ে ফেলল লোকটির রক্ত ভেজা সাদা শার্ট। এবার উইলসনের দিকে হামা দিল সে। পৌঁছে ওর প্যান্টের পায়ে ঘষতে লাগল রক্ত।
ছিটকে সরে গেল উইলসন। কর কি, কর কি?
দাড়িয়ে থাক, নির্দেশ দিল হিগিন্স। রক্ত মাখানো হয়ে গেলে বলল, খোড়াতে খোড়াতে বাইরে যাও। ও মনে করবে তুমি আহত।
পাগলামি ছাড়, উইলসন রেগে বলল।
খানিক খুঁড়িয়ে হেঁটে পড়ে যাবে তুমি। ভান করবে যেন হাঁটতে পারছ না। ও আসবেই। একশ গজের মধ্যে ওকে পেলেই হল।
পারব না, উইলসন মাথা নেড়ে বলল। আমাকে দেখামাত্রই গুলি করবে। তোমাকে দুশ ডলার দেব।
না, উইলসন বলল।
স্থির দৃষ্টিতে চাইল হিগিন্স ওর চোখে। পাচশ পাবে।
দ্বিধায় পড়ে গেল উইলসন, পাঁচশ?
আমি রাজি, মিস্টার হিগিন্স, টাইগার বলল।
উইলসন গেলে ভাল হয়। কেননা ঐ লোকের হয়ে কথা বলেছিল সে। জীবন বাঁচিয়েছিল। তাই না, উইলসন? তার দিকে তাকিয়ে সকৌতুকে প্রশ্ন করল হিগিন্স।
হ্যাঁ, বলল উইলসন। তবে মাথা নিচের দিকে তার।
পাঁচশ পাবে।
নগদ?
হ্যাঁ
দাও।
পকেট থেকে গুনে গুনে পাঁচশ ডলার বার করে দিল হিগিন্স। টাকাটা পকেটে পুরল উইলসন।
এক হাতে রুমাল আর অন্য হাতে রাইফেল নিয়ে দেয়াল ঘেঁষে ক্রল করতে শুরু করল উইলসন। দরজার দিকে সাবধানে একটা হাত বার করে দিল বাইরে। জোরে জোরে নাড়তে লাগল রুমাল।
রুমাল দেখে স্যাডলে সোজা হয়ে বসল টেকন। রাইফেল ওঠাল।
ভয়ে ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এল উইলসন। প্রাণপণে নাড়ছে রুমালটা। চিৎকার করে বলছে, আমাকে মেরো না। আমাকে মেরো না!
উইলসনের হাতের রাইফেলটা টেকনের দৃষ্টি এড়াল না। স্যালুনের বারান্দায়। এখন উইলসন। দুটো হাতই ওপরে ওঠানে। এক হাতে রুমাল, অন্যহাতে রাইফেল। দু-এক কদম এগিয়েই পড়ে গেল উইলসন। রাইফেলটা ফেলে দিল তুষারে। কর্কশভাবে ফিসফিস করে বলল সে, নিশ্চিত হয়ে গুলি করবে। কিছুতেই যেন মিস না হয়। হিগিন্সর্দের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলল সে।
টেকনের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করল, আমি সারেণ্ডার করছি, টেকন। সবাই মরেছে। আমিও আহত। পা গেছে আমার।
কিছু বলল না টেকন। চেয়ে রইল ওর দিকে। বহু কষ্টে উঠে সিঁড়ির দিকে আসতে লাগল উইলসন। খোঁড়াতে খোড়াতে।
দোতলার জানালা দিয়ে ক্যাথি উইলসনের এই নাটক দেখছিল। সে পাশে দাঁড়ানো মাকে বলল, জানালার নিচে একটা মাথা দেখতে পাচ্ছ, মা?
হ্যাঁ, পাচ্ছি, ফাঁদ পেতেছে ওরা, মা বললেন। ওদিকে চমৎকারভাবে খুঁড়িয়ে চলেছে উইলসন। বারান্দা থেকে নেমে গেল ধাপে ধাপে। দু’কদম এগিয়ে আবারও রুমাল নাড়তে লাগল সে। টেকন! আমাকে বাঁচাও! আমি মারা যাচ্ছি, বন্ধু! আরও কয়েক পা এগিয়ে টলতে শুরু করল উইলসন। রক্তমাখানো পাটা চেপে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। রাইফেল নামিয়ে নিল টেকন। পা চেপে ধরে গড়াতে শুরু করল উইলসন। তবে রুমাল নাড়তে ভুলল না। বাঁচাও, টেকন! চিৎকার করল আবার। ভান করল উঠতে চাইছে সে। কিন্তু ভাঙা পায়ের কারণে চিৎ হয়ে পড়ে গেল তুষারে। এতক্ষণ অভিনয়ের পরে উইলসন নিশ্চিত হল, গুলি করবে না টেকন।
জানালার কোণ দিয়ে উইলসনের নাটক উপভোগ করল হিগিন্স।
টাইগার তাকে জিজ্ঞেস করল, ও আসছে?
উঁহু, তবে মনে হচ্ছে আসবে, হিগিন্স বলল। তারমানে পটিয়ে ফেলেছে। ওর কথামতই কাজ করা উচিত আমাদের, বলল টাইগার।
তুমি তৈরি থাক। যে-কোন মুহূর্তে আসবে ও, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দিল হিগিন্স।
আমি তৈরিই আছি। একটামাত্র গুলি খরচ করব, গর্ব প্রকাশ করল টাইগার।
আমি না বলা পর্যন্ত গুলি করবে না, নির্দেশ দিল হিগিন্স। বাইরে চোখ রেখেছে এখনও।
চিন্তিত ভঙ্গিতে তুষারে পড়ে থাকা দেহটার দিকে চেয়ে রয়েছে টেকন। কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে। একে গুলি করে মেরে অপেক্ষা করতে পারলেই ভাল হত। ভেতরে কেউ থেকে থাকলে তাকে বেরিয়ে আসতেই হবে। এখন না হোক পরে। উইলসনকে গুলি করতে মন চাইছে না টেকনের। যথেষ্ট ভাল ব্যবহার করেছে সে তার সঙ্গে। আর সত্যিকারেরই আহত মনে হচ্ছে উইলসনকে। ওর প্যান্টে লেগে থাকা রক্ত দেখতে পাচ্ছে সে। অনেকক্ষণ যাবৎ স্যালুনের ভেতরে কোন সাড়াশব্দও নেই। মিথ্যে কথা বলেনি বোধহয় উইলসন।
সূর্যের দিকে তাকাল টেকন। ঢলে পড়েছে অনেকখানি। আঁধার হতে দেরি নেই বিশেষ। আকাশের রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছে তুষারপাত বাড়বে। মনস্থির করে ফেলল টেকন। যাবে উইলসনের কাছে। ওর কথা সত্যি হলে বাঁচোয়া।
বড় ক্লান্ত সে। ঠাণ্ডায় আর ব্যথায় কাবুও বটে।
আলতো করে স্পার দাবাল টেকন। ঘোড়াটা আগে বাড়ল। ধীরে।
দাঁতে দাঁত পিষে ফিসফিসিয়ে বলল হিগিন্স, আসছে!
একটা বুলেটই যথেষ্ট, বিড়বিড় করল টাইগার।
আরও কাছে আসুক, হিগিন্স আদেশ দিল। তাড়াহুড়ো করতে যেয়ো না। শত্রুকে বাগে পাওয়ায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে তার সারা মুখে। শিকারের আনন্দ অনুভব করছে যেন সে।
এগিয়ে আসতে লাগল টেকন। আর শ’খানেক গজ এগোলেই রাইফেলের রেঞ্জে এসে যাবে সে।
রাইফেল হাতে জানালার কোণে তৈরি রয়েছে টাইগার। হাঁটুতে ভর দিয়ে নিজের রাইফেলটা কক করল হিগিন্স। অন্য কোণে অবস্থান নিল সে।
তুষারে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েই চলেছে উইলসন। শীতে দাঁত কপাটি লাগার দশা তার। বাঁচাও, টেকন। মারা যাচ্ছি আমি, বাঁচাও।
স্যালুন থেকে সাড়ে তিনশ গজ দূরে থাকতে লাগাম টানল টেকন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলাল স্যালুনের ডানে-বাঁয়ে সর্বত্র। নাহ! উইলসন আর তার রুমাল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।
শালা থেমে দাঁড়িয়েছে, দাঁত কিড়মিড় করল হিগিন্স।
গুলি করব? টাইগার প্রশ্ন করল। লেগেও যেতে পারে।
দরকার নেই। এখন জানালা দিয়ে রাইফেল বার করলেই দেখে ফেলবে ও। পালাবে।
টেকন এখন দুশ গজের মধ্যে এসে গেছে। দোতলার জানালায় কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথি, ওকে সাবধান করে দেয়ার জন্যে চেঁচাল সে, পালাও, টেকন।
পেছন দরজার দিকে ছুটল ক্যাথি। বাইরে বেরিয়ে এসে পা ঠুকল তুষারে। এদিকে এস না, টেকন। দোহাই তোমার। ওরা তোমাকে ফাঁদে ফেলতে চায়। টেকনের দিকে দৌড়াতে শুরু করল সে। প্রাণপণে। পুরু তুষারে দেবে যাচ্ছে পা, শ্লথ হয়ে আসছে গতি।
স্যাডলে বসা টেকন অবাক হয়ে দেখল ছুটে আসছে ক্যাথি। ওর হাত নাড়া দেখে বুঝতে পারল কিছু বলছে ক্যাথি। কিন্তু মেয়েটি বাতাসের বিপরীতে থাকায় কথাগুলো কানে গেল না তার। এসময় ক্যাথিকে দেখে ফেলল হিগিন্স। গুলি চালাও, টাইগারকে নির্দেশ দিল সে।
দুজনেই গুলি করতে শুরু করল। স্যালুন থেকে। রাইফেল নিয়ে লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নামল টেকন। শুয়ে পড়ল মাটিতে। পরপর কয়েকটা গুলি এসে বিধল ঘোড়ার গায়ে। লুটিয়ে পড়ল ওটা। মাটিতে শুয়ে পড়েই রাইফেল সহ অবস্থান নিল টেকন। ক্যাথি ইতিমধ্যে উপুড় হয়েছে তুষারে। ওভাবেই থাক। নড়ো না, চিৎকার করে বলে দিল টেকন।
টেকনের গলার স্বরে বুঝতে পারল উইলসন, মরেনি ও। হিগিন্সরা মিস করেছে। লাফিয়ে উঠেই ঝেড়ে দৌড়াল সে স্যালুনের দিকে। কিন্তু বারান্দায়। ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে গেল তুষারে। হাঁকুপাঁকু করে উঠে দাঁড়াতেই গুলি করল টেকন। তার বাঁ হাত উড়িয়ে নিল গুলিটা। বাহু থেকে। তারপর ঢুকে গেল শরীরের বাঁ দিকে। গভীর ক্ষত সৃষ্টি হল, জীবনীশক্তি যেন হঠাত্র শেষ হয়ে গেছে তার। পড়ে রইল সেখানেই। এক্ষুনি ব্যাণ্ডেজ করতে না পারলে বাঁচার আশা নেই বুঝল সে। ডান হাত দিয়ে উইলসন রুমালটা পেঁচাল বা বাহুতে।
স্যালুন থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করছে ওরা দুজন। খামোকাই। মৃত ঘোড়াটার পাশে ততক্ষণে আড়াল নিয়েছে টেকন। ক্যাথির দিকে তাকাল সে। ওর শরীর ডুবে যাচ্ছে তুষারে। রাইফেল রিলোড করে তৈরি হল টেকন। শোন, আমি গুলি করামাত্রই বাড়ির দিকে দৌড়াবে তুমি। ভেতরে ঢুকে বসে থাকবে। আর বেরোবে না। বুঝেছ? ক্যাথিকে বলল সে।
মাথা নাড়ল ক্যাথি।
জানালার ফ্রেম লক্ষ্য করে টেকন গুলি ছুঁড়তেই লাফিয়ে উঠে দৌড়াল ক্যাথি। সে বাড়ির পেছনে হারিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে দেখে ফেলল হিগিন্স। গুলি চালাল সে। বহুদূর দিয়ে গেল ওটা।
আবার সেই হারামজাদী। ওকে দেখে নেব আমি, ক্রুদ্ধ হিগিন্স স্বগতোক্তি করল।
খানিকক্ষণ চুপচাপ, উভয়পক্ষই অপেক্ষা করছে প্রতিপক্ষের পরবর্তী অ্যাকশনের জন্যে। টেকনের চোখ গেল উইলসনের দিকে। এখনও পড়ে রয়েছে। সে। মারা গেছে উইলসন, ভাবল টেকন। রাইফেল তাক করে শুয়ে রইল সে। উইলসন বাচল কি মরল তাতে কিছু এসে যায় না তার। আর ফাঁদে পড়বে না। সে।
স্যালুনে বিড়বিড় করে চলেছে টাইগার। কি বলছ তুমি তখন থেকে? কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হিগিন্স।
গুনছি, গোমড়ামুখে বলল টাইগার। উইলসনকে নিয়ে সাতজন গেল। চলুন পালাই। এছাড়া রক্ষা নেই।
চুপ কর, হিগিন্স ধমকাল, সময় হোক আগে।
শুনুন, ঘোড়াগুলো বাইরে রয়েছে। এখনও চাইলে পালাতে পারি আমরা। ও ঘোড়াছাড়া পিছু নিতে পারবে না আমাদের।
আগে ও মরুক, খেকিয়ে উঠল হিগিন্স। ওই শালা আর হামরাজাদটাকে মেরে তারপর যাব এখান থেকে। তার আগে নয়।
বিড়বিড় করেই চলল টাইগার। অসন্তুষ্ট। হিগিন্সের কথা পছন্দ হয়নি তার।
দেখ, ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে বলল হিগিন্স, এই-ই সুযোগ। ওর ঘোড়া নেই। ইচ্ছেমত ঘুরতে পারছে না ও। দুদিক থেকে এগিয়ে যাব আমরা। ও ঘোড়ার আড়ালে থাকলেও লাভ নেই। একদিকে আড়াল পাবে। অন্যদিক খালি। আর ওর রাইফেলটাও সিঙ্গল শট।
কিন্তু একটা গুলিতেই যে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেয়!
ঘোড়া নিয়ে ওর পেছন দিকে চলে যাবে তুমি। গোল হয়ে ঘুরবে। আর এদিক থেকে বেরিয়ে আসব আমি। গুলি করতে থাকব, ওকে কোণঠাসা করতে অসুবিধে হবে না।
খানিক চিন্তা করল টাইগার। বুদ্ধিটা মন্দ নয়। কাজ হতেও পারে, বলল সে।
হবেই। আমার নির্দেশ পেলেই ওকে ধাওয়া করবে তুমি। ঘোড়াটার আড়াল থেকে ওকে বার করতে পারলেই হল। আর চিন্তা নেই। খুব কাছ থেকে গুলি করা যাবে।
টাকা পাব তো কাজটার জন্যে? প্রশ্ন করল টাইগার।
নিশ্চয়। লোকটাকে মারতে পারলে অন্যদের পাওনাটাও তোমাকে দেব আমি, নরম সুরে বলল হিগিন্স।
মনে থাকে যেন, বলল গানম্যান। দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গেল সে ঘর থেকে।
টাইগারকে ঘোড়া দাবড়ে বেরিয়ে যেতে দেখল টেকন। পেছন দিকে চক্কর দিতে শুরু করল লোকটা। ওর রেঞ্জের বাইরে।
স্যালুনের দরজায় ক্ষণিকের জন্যে দেখা দিল হিগিন্স। টেকন আর টাইগারের অবস্থান বুঝে নিয়ে চিৎকার করল সে টাইগারের উদ্দেশে, ধাওয়া কর। কথাটা বলেই গুলি ছুঁড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল টাইগার, পিস্তল হাতে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে লাগল টেকনের দিকে। পেছনে এক ঝলক তাকাল টেকন। দেখতে পেল হিগিন্সকে। দ্রুত থলি থেকে দুটো শেল বার করল সে। মুখে পুরে রাইফেল তাক করল। ওদের মতলবটা বুঝতে সময় লাগল না ওর। বুদ্ধিটা খারাপ নয়। তবে খুব একটা সুবিধে করতে পারবে না ওরা। ও গুলি আরম্ভ করলেই ঘোড়ার রাশ টানবে লোকটা। এগোতে সাহস করবে না। আর হিগিন্স যে কাজের নয় বোঝাই গেছে।
ওকে লক্ষ্য করে কয়েকটা উল্টো-পাল্টা গুলি করল হিগিন্স। টেকন ফের মনোযোগ দিল ঘোড়সওয়ারের দিকে। ধেয়ে আসছে লোকটা। গুলি করল কয়েকটা, তুষার ছিটাল সবগুলো গুলিই। লোকটার সঙ্গে তার দূরত্ব অনুমান করে নিল টেকন।
টাইগার উপলব্ধি করল দূরত্ব অনেকখানি কমে এসেছে দুজনের মধ্যে। তার মানে সামনে সমূহ বিপদ। ওদিকে হিগিন্স ঘাপটি মেরে রয়েছে। গুলি ছোঁড়ার নাম নেই। সে প্রাণপণে চেঁচাল, হিগিন্স! হিগিন্স!
টাইগারের মুখে নামটা শুনে চরকির মত ঘুরল টেকন। হিগিন্স এখন বেরিয়ে আসছে দরজা দিয়ে। চৌকাঠে বিধল টেকনের পরবর্তী গুলিটা। ঘরের ভেতরে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হল হিগিন্স, খালি খোলসটা ফেলে দিয়ে দ্রুত রিলোড করল টেকন। কাঁধে ঠেকানো রাইফেল, টাইগার তখন পঞ্চাশ গজের মধ্যে এসে গেছে। বিপদ বুঝে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরল সে। উল্টোদিকে ছোটাতে পারল যখন ঘোড়াটাকে তখন টেকনের সঙ্গে দূরত্বের ব্যবধান মাত্র ত্রিশ গজ। দেখে শুনে, সময় নিয়ে গুলিটা করল টেকন। টাইগার এখন ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় বাজিমাৎ করতে চাইছে। এত কাছ থেকে গুলি খেয়ে ছিটকে পড়ে গেল সে ঘোড়া থেকে। প্রতিযোগিতায় হার মানল টাইগার।
রিলোড করে স্যালুনের দিকে ঘুরল টেকন। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। হিগিন্স দৌড়ে প্রায় উঠে পড়ল ক্যাথিদের বারান্দায়। টেকন গুলি করল ঠিকই কিন্তু ছুটন্ত হিগিন্সের গায়ে লাগাতে পারল না।
টাইগারকে সাহায্য করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না হিগিন্সের। সে আসলে চাইছিল টেকন টাইগারকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। সেই সুযোগে সে পৌঁছে যাবে। ক্যাথিদের বাড়িতে। ক্যাথির ওপর প্রচণ্ড রাগে জ্বলছে তার শরীর। টেকনের চেয়ে কম শত্রুতা করেনি মেয়েটি। হিগিন্স এ-ও জানে কান টানলে মাথা আসে। ক্যাথিকে একবার বাগে পেয়ে গেলে টেকনও ধরা দেবে।
গুলির থলিটা তুলে নিয়েই ছুটতে শুরু করল টেকন। ক্যাথিদের বাড়ির দিক থেকে দ্রুত সরে যেতে লাগল। স্যালুনের এক পাশে জায়গা নিল এখন সে।
ক্যাথিদের বারান্দায় উঠে দরজায় দুটো গুলি করল হিগিন্স, পরপর। তারপর লাথি মেরে খুলে ফেলল দরজাটা। এক ছুটে উঠে এল দোতলায়। দেখা হয়ে গেল ক্যাথিদের সঙ্গে। এবার দেখা যাবে, মিস ক্যাথি, টেকন না এসে পারে কি না, বলল সে।
ক্রোধে জ্বলছে হিগিন্স। ওর রণমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে গেল ওরা তিনজন।
দ্রুত জানালার কাছে গেল সে। রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করল কাঁচে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। তাকিয়েই দেখতে পেল ঘোড়ার পেছনে এখন। আর কেউ নেই। খিস্তি করল সে।
কিন্তু পরক্ষণেই ঘুরে দাঁড়াল সে। মুখে ব্যঙ্গের হাসি। সকলের উদ্দেশে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ক্যাথিকে উদ্ধার করতে আসবেই ও। সুযোগ আমি পাবই।
পেছনের দরজা দিয়ে স্যালুনে ঢুকল টেকন। সতর্ক। স্যালুনের ভেতরটা আঁধার। তবে চোখ সয়ে এল দ্রুত। ঘরের ভেতর লাশের ছড়াছড়ি। হঠাৎ একটা। আওয়াজ হল তার ডান দিক থেকে। মুহূর্তে ঘুরল সে। গ্রিফিথ বারের আড়াল থেকে মাথা তুলেছে। হাত দুটো মাথার ওপর তোলা। মেরো না তোমার পায়ে পড়ি, আমায় মেরো না। প্রায় কেঁদে ফেলল সে।
ওর দিকে রাইফেল তাক করল টেকন। বেরোও, যেন বিশ্বাসই হল না গ্রিফিথের। দাঁড়িয়েই রইল সে। কথা কানে যায় না? ধমক দিল টেকন।
যাচ্ছি, স্যার। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে গ্রিফিথ। মুক্তির আনন্দে ছুটল দরজার দিকে। ও বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে পিছু ডাকল টেকন। পিকো কোথায়?
মনে হয় মারা গেছে। ক্লিনসনের মৃতদেহের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ও মেরেছে।
ঠিক আছে, যাও।
টেকন দরজায় দাঁড়াল গিয়ে। দেখল গ্রিফিথ পড়িমরি করে ছুটছে বাঙ্কহাউসের দিকে। তুষার মাড়িয়ে।
বেরিয়ে এল টেকন। সতর্ক দৃষ্টিতে জরিপ করল চারপাশটা। পেছন দিকে গেল। বাধা রয়েছে ঘোড়াগুলো এখনও। ঘোড়াগুলো পরখ করে দেখল সে। বেছে নিল পছন্দসই একটা। খানিক দূরে বাঁধল ওটা।
টেকন ফিরে এল স্যালুনে। বার থেকে তুলে নিল হুইস্কির একটা বোতল। ছিপি খুলে জানালার কাছে গিয়ে বসল হাঁটু গেড়ে। লম্বা এক টান দিয়ে চাইল ক্যাথিদের বাড়িটার দিকে।
শান্ত চারদিক। বোতলটা রেখে দিয়ে জানালায় অবস্থান নিল সে। রাইফেল তাক করল। হিগিন্সের একমাত্র তাস ক্যাথি। এছাড়া ওর হাতে আর কোনও খেলা নেই। ওর সব লোক মরেছে। ঘোড়াগুলো এখন টেকনের জিম্মায়। পুরো ব্যাপারটাই আসলে নিয়ন্ত্রণ করছে টেকন। কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। ক্যাথি হিগিন্সের হাতে। কাজেই টেকনের আপাতত করার কিছুই নেই। হিগিন্সের মতলব বুঝে এগোতে হবে তাকে। খানিক আগেই ক্যাথিদের বাসা থেকে চিৎকার ভেসে এল, টেকন! টেকন! মৃতপুরীর নিস্তব্ধতা যেন ভেঙে পড়ল হিগিন্সের ডাকে।
বল, শুনছি, পাল্টা চিৎকার করল টেকন। মাথার ওপর হাত তুলে বেরিয়ে এস, এক্ষুনি, হিগিন্স আদেশ করল।
ওর আদেশ পালন করার প্রয়োজন অনুভব করল না টেকন।
শুনতে পাচ্ছ? এবারও চুপ করে রইল টেকন।
ক্যাথিকে বাঁচাতে চাইলে আসতেই হবে তোমাকে।
তোমাকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি, হিগিন্স। ওদের ছেড়ে দাও। এ শহর থেকে চলে যাও তুমি। ঘোড়া আমি দেব। তুমি নিশ্চিন্তে বেরিয়ে আসতে পার। গুলি করব না আমি, চিৎকার করে বলল আবার টেকন।
আমি মশকরা করছি না, টেকন। আমার কথা না শুনলে তোমার প্রেমিকা বাঁচবে না।
ওকে তুমি ছুঁয়ে দেখ শুধু!
এক মিনিট সময় দিচ্ছি, টেকন। ভেবে দেখ।
ক্যাথিদের বাড়িতে হিগিন্স তখন চুলের মুঠো ধরে কাৎ করে ফেলেছে ক্যাথিকে। ওর মাথায় ঠেকিয়ে ধরেছে পিস্তল। জানালায় পর্দা থাকায় টেকন দেখতে পেল না এসব। তবে দেখলেও গুলি করতে পারত না সে। কেননা তাতে ক্যাথির আহত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যেত।
হারামজাদী, তুই ওকে বল ও না এলে মরতে হবে তোকে। ওকে শিগগিরই বেরিয়ে আসতে বল, ক্যাথির চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল হিগিন্স।
ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল ক্যাথি। চিৎকার করে বলল, ওর কথা শুনো না তুমি, টেকন। প্রচণ্ড চড় কষাল হিগিন্স। ক্যাথির আর্তচিৎকার কানে এল টেকনের।
জোরালো গলায় হাঁক ছাড়ল সে, খবরদার, হিগিন্স! ওর গায়ে আর একটা টোকাও যেন না পড়ে। বাচতে চাইলে বেরিয়ে এস। কথা রাখব আমি। সন্ধের। আগেই ঘোড়া নিয়ে চলে যেতে পারবে তুমি।
হিগিন্সকে দেখার চেষ্টা করল টেকন। কিন্তু পর্দার কারণে দেখতে পেল না।
তাস সব আমার হাতে, টেকন। তুমি কিছুই করতে পারবে না। মাঝখান থেকে জান যাবে তোমার প্রেয়সীর।
উদ্বিগ্ন চোখে সূর্যের দিকে চাইল টেকন। ঢলে পড়েছে। সন্ধে নামতে বেশি দেরি নেই। তবে কিছুক্ষণ সময় হাতে আছে এখনও।
হঠাৎ ভেসে এল ক্যাথির গলা। আমার জন্যে ভেব না, টেকন। আমাকে ও মারবেই। আমাকে বাঁচাতে চাইলে ওকে খুন-।
কথা শেষ করতে পারল না ক্যাথি। মুখ চেপে ধরেছে তার হিগিন্স।
টেকন, আসছ? হিগিন্স চেঁচাল।
গোধূলি ছায়া ফেলেছে তুষারে। দেখে নিল টেকন। দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে সময়। চাইলে ওকে মেরে ফেলতে পার। আমার কিছু যায় আসে না তাতে। চলে যাচ্ছি আমি।
মিথ্যে কথা!
সত্যি যাচ্ছি। দক্ষিণ দিকে।
ক্যাথিকে ফেলেই?
অবশ্যই। উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গেল সে। ঘোড়াগুলো নিয়ে যাচ্ছি আমি। ঠাণ্ডায় জমে মরবে তুমি।
ভাওতা দিচ্ছ।
চেয়ে দেখ।
ক্যাথিকে আমি কুচিকুচি করে কাটব।
আমি চললাম, টেকন চেঁচাল আবার। স্যালুনের পেছনে চলে এল সে। বেছে রাখা ঘোড়াটায় লাগাম পরাল। ওটায় চেপে অন্য ঘোড়াগুলো নিয়ে রওনা। দিল। হিগিন্সের রাইফেলের রেঞ্জের বাইরে রইল সে। ফাঁকা গুলি করল একটা। কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে দক্ষিণ দিকে এগোল টেকন। খানিক বাদেই সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ও।
জানালা দিয় মুখ বাড়াল হিগিন্স। ক্যাথির চুলের মুঠি ধরেই রেখেছে হাতে। টেকনকে চলে যেতে দেখল সে। ও দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই দেয়ালে মাথা ঠুকে দিল ক্যাথির। সজোরে। যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলল ক্যাথি। ফুলে উঠল জায়গাটা।
এসময় কাঠের বড়সড় একটা টুকরো নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ক্যাথির মা। সন্তর্পণে। তবে হিগিন্সের মাথায় বাড়িটা দেয়ার আগেই দেখে ফেলল সে। সজোরে চড় কষাল সে তার গালে। ভদ্রমহিলাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বার করে দিল ঘর থেকে। ভেতর থেকে আটকে দিল দরজাটা। দরজায় দুমাদম কিল মারতে লাগলেন ক্যাথির মা। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে গিয়ে বসল হিগিন্স। খানিক বাদে হতাশ হয়ে চলে যেতে, হল তাকে।
ঘোড়াগুলো নিয়ে আধ মাইলটাক এল টেকন। শহরটা ভালমত দেখা যায় না এখান থেকে। নিশ্চিন্ত হয়ে সে ঘোড়া থেকে নামল। সবগুলো ঘোড়া একসঙ্গে বেঁধে রাইফেলের নলটা পুতল তুষারে। খুঁটির মত। তারপর ঘোড়াগুলো বাধল তার সাথে। বেল্ট থেকে রিভলভার বার করে লোড পরীক্ষা করল। স্যালুনের একজন মৃত গানম্যানের বেল্ট থেকে নিয়ে এসেছে জিনিসটা। ঢুকিয়ে রাখল আবার। হ্যাটটা খানিক টেনে নামাল টেকন। কোটটা টেনে-টুনে জড়িয়ে নিল ভালমত। আবছাভাবে নজরে এল ঘোড়াগুলো। ঠাণ্ডার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে গাদাগাদি করে রয়েছে।
ক্যাথিদের ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়েছে হিগিন্স। বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছে সে এখন। ঘরের ভেতর রয়েছে ও। তাছাড়া জিম্মি করে রেখেছে ক্যাথিকে। ওদিকে বাইরে ঠাণ্ডায় ঘুরে মরছে টেকন। ক্যাথির দিকে চেয়ে কুৎসিত হাসল সে।
ক্যাথিদের বাসা থেকে গজ ত্রিশেক দূরে থামল টেকন। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার চারদিকে। ফলে পিকোর মইটা খুঁজে পাওয়ার জন্যে অনেকখানি কাছে চলে আসতে হল ওকে। মইটা সেভাবেই হেলান দেয়া অবস্থায় রয়েছে। মেরীর ঘরের সাথে।
চারপাশে তাকাল টেকন। কেউ নেই। কেবল টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে বাঙ্কহাউসে। অস্পষ্ট। হয়ত গ্রিফিথ জ্বালিয়েছে।
মইটার ভার সইবার ক্ষমতা হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখল টেকন। বাড়ির ভেতরে কোনও সাড়াশব্দ নেই।
নিঃশব্দে উঠে আসতে লাগল টেকন মই বেয়ে। শেষ ধাপে পৌঁছে দেখতে পেল জানালাটা বন্ধ। অবশ্য খোলা পাবে এমন আশাও করেনি সে। জানালার নিচের দিকে হাত দিয়ে আস্তে করে টানল সে। খুলল না। তবে কয়েকটা আঙুল ঢোকানোর মত জায়গা পেয়ে গেল সে। আবার টানল জানালাটা। এবার আগের চেয়ে জোরে। কাঁচের ভেতর দিয়ে উঁকি দিল টেকন। ছিটকিনি লাগানো রয়েছে। কাঁচ ভাঙা ছাড়া উপায় নেই। রিভলভারের বাঁট দিয়ে আলতো করে বাড়ি দিল কাঁচে। নিঝুম রাতে খুব বেশি কানে বাজল শব্দটা। তবে কাঁচ ভাঙল না। আরও জোরে আঘাত করতে হবে। তাতে আওয়াজ হবে অনেক বেশি। উপায় নেই। ধরা হয়ত পড়তেই হবে।
ওদিকে হিগিন্স পকেট থেকে লম্বা ছুরিটা বার করে ক্যাথিকে ভয় দেখাল। তারপর টেনে নিল ওর ডান হাতটা। আলতো করে হাত বুলিয়ে চুমু খেল সেটায়। ছুরির ডগা দিয়ে চিরে দিল ইঞ্চি চারেক। বেরিয়ে আসতে লাগল রক্ত। ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ল মাটিতে। দাঁত বের করে হাসল হিগিন্স, চেঁচাও। প্রাণ খুলে চেঁচাও। টেকনকে বল, তোমাকে এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।
ক্যাথিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাঁচ ভাঙার শব্দ কানে গেল না হিগিন্সের। ক্যাথি ঠিকই শুনতে পেল। তারস্বরে চেঁচাতে লাগল সে। যাতে শব্দটা হিগিন্সের কানে না। যায়। ক্যাথির চিৎকার শুনে ওর মা আবার দুমদুম কিল বসাতে লাগলেন দরজায়। চিৎকার করে অনুনয় করলেন, হিগিন্স, আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। তোমার পায়ে পড়ি। তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না হিগিন্স।
কাচ ভেঙে ততক্ষণে ছিটকিনি খুলে ফেলেছে টেকন। বহু কষ্টে জানালা দিয়ে শরীর গলিয়ে দিল। ঘরে ঢুকে কোটটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেঝেতে। পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল বাইরে। হাতে রিভলভার।
হঠাৎ দরজায় বাড়ি দেয়ার শব্দ শুনতে পেল। ক্যাথির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে গ্রিফিথ। দরজায় কিল দিচ্ছে সে। গ্রিফিথকে দেখে দরজার সঙ্গে মিশে দাঁড়াল টেকন।
হিগিন্স! দরজা খোল। আমি গ্রিফিথ।
দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দরজাটা খুলে দিল হিগিন্স। পিস্তল তাক করল ওর বুকে। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল গ্রিফিথ। ওকে দেখে পিস্তলটা কোটের পকেটে রেখে দিল হিগিন্স।
ওই লোকটাকে দেখলাম! বাইরে! হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলল সে।
বিজয়ীর হাসি হাসল হিগিন্স। ক্যাথির দিকে চেয়ে। বলেছিলাম না ওকে আসতেই হবে?
জানালা দিয়ে বাইরে চাইল হিগিন্স। খুঁজল টেকনকে। গাঢ় অন্ধকারে কাউকেই দেখা গেল না।
এই সুযোগে নিঃশব্দে দৌড়ে দরজার পাশে পৌঁছে গেল টেকন। পরবর্তী পদক্ষেপে দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। রিভলভার সোজা তাক করা হিগিন্সের বুকে। ওকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল হিগিন্স। হাত থেকে পড়ে গেল পিস্তলটা।
এসে গেছে! বলে দোতলার জানালা দিয়ে শরীর গলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল গ্রিফিথ। কষ্টে-সৃষ্টে গলাতে পারল স্থূল শরীরটা। লাফিয়ে পড়ল তুষারে। তারপর খোড়াতে খোঁড়াতে উধাও হল আঁধারে।
টেকনকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল ক্যাথি। দুগালে অবিরাম চুমো খেতে লাগল। ওকে একপাশে সরিয়ে দিল টেকন। চলে যেতে বলল বাইরে। নির্দেশ অমান্য করল না ক্যাথি। মাকে খুঁজতে চলে গেল সে।
আতঙ্কে হিগিন্সের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটছে। আমাকে মাফ করে দাও, টেকন। আমার সঙ্গে অনেক টাকা আছে। সব তুমি নাও, টেকন। আমাকে প্রাণে মেরো না, প্লীজ। প্রায় কেঁদে ফেলল হিগিন্স।
হিগিন্সের ডান হাঁটুতে প্রথম গুলিটা করল টেকন। বাপরে! বলে বসে পড়ল সে।
দোহাই তোমার, আমাকে মেরো না, প্রাণ ভিক্ষা চাইল হিগিন্স।
উঠে দাঁড়াও, আদেশ করল টেকন।
পারছি না, ব্যথায় বিকৃত হয়ে গেছে হিগিন্সের মুখ। দরজার দিকে হেঁচড়ে এগোল সে।
ওর উরুতে গুলি করল টেকন। চিৎকার করে দুহাতে ঊরু চেপে ধরল হিগিন্স। শুয়ে পড়ল।
ওঠ, টেকন শান্তস্বরে বলল। এবারে গুলি করল কাঁধে।
ওঠ, আবার আদেশ করল সে। ধীরে ধীরে তীব্র ব্যথা সহ্য করে উঠে বসল হিগিন্স। ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাত তুলল সে।
বুকে গুলি খেয়ে একবার মাত্র কাঁপল তার শরীর। তারপর স্থির হয়ে গেল।
মৃতদেহের কাছে পৌঁছাল টেকন। কোটের কলার চেপে ধরল এক হাতে। টেনে নিয়ে এল জানালার কাছে। সাহায্য নিল ক্যাথির মা, ক্যাথি আর মেরীর। ওরা হিগিন্সের দুরবস্থা উপভোগ করার জন্যে ক্যাথির ঘরে এসে গেছে ততক্ষণে। সকলে মিলে টেনে তুলে জানালা গলিয়ে বাইরে ফেলে দিল হিগিন্সের নিপ্রাণ দেহটা। নিচে তুষারে সশব্দে পড়ল মৃত হিগিন্স।
<