বাইরে হালকা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। র‍্যাঞ্চ হাউসের ছাদে ছন্দ তুলছে বৃষ্টির ফেটা। লিভিংরুমে বসে আছে বেন, ফায়ারপ্লেসে আগুনের শিখার নাচন দেখছে পলকহীন দৃষ্টিতে, মনের গভীরে কাঁটার মত বিঁধতে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে।

কার্ল ব্রেনেলের খুনী কে? কি উদ্দেশে তাকে খুন করা হয়েছে?

হারলো আর কারাঞ্চোকে ওর পিছনে লাগিয়েছে কে? বছরকে বছর ধরে দুটো বাথানের শক্রতা, অথচ হঠাৎ করে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে লেযি-এন? কি এমন ঘটল যে ডাবল-বি করায়ত্ত করার জন্যে খেপে উঠেছে টম নোলান? কার্ল ব্রেনেলকে খুন করার মাধ্যমে এর শুরু?

আর যে-ই করুক, বেন অন্তত বিশ্বাস করে না কার্ল ব্রেনেলের খুনের পেছনে কোন ভূমিকা আছে লেযি-এন মালিকের। মানুষটা নিষ্ঠুর বা চরমপন্থী হতে পারে, কিন্তু মোটেই কাপুরুষ নয়; বুক ফুলিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে শত্রুর শেষ দেখবে, এটাই মানায় টম নোলানকে। অথচ নির্মম, নীচ একজন খুনীর অসাধারণ দক্ষতায় মারা গেছে মানুষটা, যে ছিল ডাবল-বি বাথানের প্রাণ! তার মৃত্যুর পর সাজানো একটা সংসার তছনছ হয়ে গেছে, প্রতিটি মানুষের ভবিষ্যৎ হয়ে গেছে সুনিশ্চিত। খোদ ডাবল-বির অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।

পদশব্দে মুখ তুলে দরজার দিকে তাকাল বেন। দীর্ঘদেহী ডেপুটি শেরিফ পল লিন্ডলেকে কামরায় ঢুকতে দেখে খানিকটা অবাক হলো।

দৃঢ় পায়ে ভেতরে এসে একটা চেয়ার দখল করল সে, নির্বিকার মুখে দেখল বেনকে। পকেট থেকে তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল। আমি দুঃখিত, বেন, আন্তরিক স্বরে বলল সে। বিলের জন্যে দুঃখই হচ্ছে। আর যাই হোক, এভাবে ওর মত লোকের মৃত্যু কাম্য হতে পারে না।

নীরবে নড করল বেন। কার কাছ থেকে খবর পেলে?

শহরে গিয়েছিল ডড কিনলে।

সিগার ধরিয়ে অপেক্ষায় থাকল ও।

মি. কিনলের কাছ থেকে যা শুনেছি, তাতে অনায়াসে দোষী সাব্যস্ত করা যায় স্টিভ হারকারকে। খুনের অভিযোগে ওর নামে একটা ওয়ারেন্ট ইস্যু করেছি আমি।

ভার্ন কোথায়?

ডরোটিও, নাভারেজের খবর পেয়ে বেরিয়ে গেছে ও। দক্ষিণে রেলরোডের কাছে নাকি দেখা গেছে নাভারেজকে। ভার্ন বেশ আত্মবিশ্বাসী যে খুনীটাকে ধরতে পারবে, এবার। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে গেছে।

কিন্তু তার আগে নিশ্চয়ই বিলের খুন হওয়ার খবর শুনেছে? শুকনো স্বরে জানতে চাইল বেন।

অযথাই ওর ওপর নাখোশ হচ্ছ, বেন, ঠিক হচ্ছে সেটা?

কিন্তু এটাই সত্যি। এডলে ভার্নকে ভাল করে চিনি আমি, বহু বছর ধরে দেখছি। স্টিভ হারকার দূরে থাক, লেযি-এনের অন্য যে কোন কুকেও পাকড়াও করতে গাট-হুক র‍্যাঞ্চে যাবে না সে।

একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় খুন, মন্তব্যের সুরে বলল পল লিন্ডলে।

ধীরে ধীরে ডেপুটির দিকে ফিরল বেন। তোমার কাছ থেকে রায় শুনতে চাইনি আমি। লেযি-এনে যাচ্ছ তুমি, স্টিভ হারকারকে পাকড়াও করতে?

খানিকটা ব্ৰিত দেখাল ডেপুটিকে, তবে মুহূর্তের মধ্যে সামলে নিল সে। উঁহু, তা কিন্তু বলিনি আমি। এডলে আমাকে নির্দেশ দিয়েছে সারাক্ষণ যেন সিরেনো কর্নারের ধারে-কাছে থাকি, প্রয়োজনের সময় আমাকে যাতে পায় ও। সুতরাং…বুঝতেই পারছ, স্টিভ হারকারের পিছু নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও আপাতত সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সরল ব্যাখ্যা দিলেও অজান্তে লালচে হয়ে গেল ডেপুটির মুখ। যাকগে, এডলে কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার বলে দিয়েছে, দরকার হলে যেন ডেপুটি হিসেবে তোমাকে শপথ করিয়ে নিই… শ্রাগ করল সে, তারপর বেনের চোখে প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখে দ্রুত যোগ করল: যদি স্টিভ হারকারের পিছু নিতে চাও তুমি।

মুহূর্ত খানেক ভাবল বেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাত তুলল। মত বদলে ফেলার আগেই শপথ করাও আমাকে, পল!

মিনিট কয়েকের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলল পল, লিন্ডলে। বেনের জ্যাকেটে একটা টিনের তারা আটকে দিয়েছে সে, হাতে একটা ওয়ারেন্ট ধরিয়ে দিয়েছে। পকেটে সেটা রেখেছে বেন। ডেপুটির তাড়াহুড়োর কারণ স্পষ্ট বুঝতে পারছে, পালাতে পারলেই যেন বাঁচে সে। সিরেনোর চৌহদ্দিতে টম নোলানের অবস্থান এতটাই উঁচুতে যে তাকে ঘটানোর সাহস করতে পারছে না এডলে ভার্ন, কিন্তু বেনকে ব্যবহার করে নিজের অক্ষমতা পুষিয়ে নিতে চাইছে।

ডেপুটি বিদায় নেওয়ার পর লিভিংরুমে একা হয়ে গেল বেন। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, দেখল বাইরে আন্ডারটেকার সহ বিলের মৃতদেহ ওয়্যাগনে তুলে নিল ডেপুটি, তারপর নিজের ঘোড়ায় চেপে বসল। বৃষ্টির ছাঁট উপেক্ষা করে এগোল রিও ফ্রিয়োর দিকে, নদীর মুখে বাঁক ঘুরে শহরের ট্রেইল ধরবে। সযত্নে লেযি-এনের জমি এড়িয়ে যাচ্ছে ওরা, ওয়াগন আর নিঃসঙ্গ রাইডারের অস্পষ্ট অবয়বের দিকে তাকিয়ে ভাবল বেন, ঘুরপথে অতিরিক্ত ছয় মাইল পাড়ি দিতেও কুণ্ঠা বোধ করছে না।

মিরিয়াম ঢুকল কামরায়। এখনও শোক সামলে উঠতে পারেনি, মুখটা থমথমে দেখাচ্ছে। বেনের শার্টে আঁটা তারাটা দেখে মুহূর্তের মধ্যে নিপ্রাণ দৃষ্টি বদলে গিয়ে সচকিত হয়ে উঠল। ঠোঁট কামড়ে ধরে বোধহয় ওটার গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা বিচার করল মনে মনে। তারপর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। এ তো স্রেফ পাগলামি, বেন! শেষে অসন্তোষের সুরে মন্তব্য করল মেয়েটি। তোমাকে দেখেই গুলি করবে ওরা!

হয়তো এছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। এডলে বা ওর ডেপুটি, কেউই লেযি-এনে গিয়ে হারকারকে গ্রেফতার করার সাহস করতে পারছে না।

সেই দায়িত্ব তাহলে তোমাকে দিয়েছে ওরা? এডলে ভার্ন বোধহয় সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছে, নইলে কিভাবে নিজে সরে থেকে তোমাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয় কিংবা দায়িত্ব অস্বীকার করে? রিও ফ্রিয়ের লোকজনকে দেখছি এখনও চেনা বাকি রয়ে গেছে আমার, বেন! বিতৃষ্ণা ফুটে উঠল মেয়েটির কণ্ঠে, হতাশায় কাঁধ নুয়ে পড়ল। কিন্তু বেন…লেযি-এন র‍্যাঞ্চ হাউসের ধারে-কাছেও যেতে পারবে না। তুমি। নিজেদের জমিতে রাসলার বা ড্রিফটারদের খোঁজে পাহারা দেয় ওরা, এখন তো জানেই যে বিলের খুনের প্রতিশোধ নিতে ওখানে যাবে তুমি। পথে যদি খুন–ও হও, নির্ঘাত র‍্যাঞ্চ হাউসে ঢোকার আগেই তোমার লাশ ফেলে দেবে ওরা।

স্টিভ হারকারকে চাই আমি, মিরিয়াম।

একটা তারা পরেছ তুমি, বেন। নিজের ইচ্ছেমত এখন আর কিছু করতে পারবে না, যেহেতু আইনের প্রতিনিধিত্ব করছ। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা ক্ষোভ…আসলে আমার চেয়ে তুমিই ভাল বোঝো এসব। আমি যা বলতে চাই…স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করবে না সে। হয়তো অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু

তুমি খুন হয়ে গেলে? কোন কিছুরই সুরাহা হবে না, বেন!

ঝুঁকিটা নেওয়া ছাড়া উপায় দেখছি না।

হারকারকে না হয় বাদ দিলাম! অন্যরাও কি ছেড়ে দেবে তোমাকে? যেমন ফ্রেড মোরিস, কারাঞ্চো…স্বয়ং জেফরিও তোমার বিরুদ্ধে পিস্তল তুলতে পারে!

ক্ষীণ, তিক্ত হাসি ফুটে উঠল বেনের ঠোঁটে। জেফরি কিন্তু আগের মত অতটা আত্মবিশ্বাসী নেই আর, থেমে আগুনের দিকে তাকাল ও। তাছাড়া, অন্য একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়, ডড কিনলের একটা কথা শোনার পর থেকে ভাবছি…

কি? উদ্বেগে বড় বড় হয়ে গেছে মিরিয়ামের চোখ।

শুনেছ তো কি বলেছে ও। কার্ল ব্রেনেলের খুনের কিনারা করার জন্যে ওকে ভাড়া করেছে টম নোলান, এটা একটা কারণ।

কিন্তু তাতে কি?

কেন করবে সে কাজটা?

জানি না। তুমি জানো?

বোতল থেকে গ্লাসে ড্রিঙ্ক ঢালল বেন। টম নোলানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আলাপের প্রসঙ্গগুলো মনে পড়ছে। টম নোলান নিজেই বলেছে কাল ব্রেনেলকে। খুন করার কোন সঙ্গত কারণ নেই ওর। সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে, চোখের দিকে তাকিয়ে বাবার শরীরে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়ার সাহস বা ইচ্ছে ছিল, কিন্তু ড্রাই-গালশ করার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র ছিল না তার।

হেসে উঠল মিরিয়াম, কিন্তু আনন্দের ছিটেফোঁটাও নেই তাতে। তুমি ওর কথা বিশ্বাস করেছ?

নড করল বেন। টম নোলান কঠিন মানুষ, সন্দেহ নেই অন্যায় সুযোগ নিতেও দ্বিধা করে না সে, কিন্তু খুনী নয় লোকটা। এটা সত্যি যে লেযি-এন রেঞ্জে অনেক লোক খুন হয়েছে, এর কারণ রেঞ্জটাকে নিজের সাম্রাজ্য মনে করে সে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাসলিং ঠেকানোর জন্যে এ কাজ করেছে ওর ভ্যাকুয়েরোরা। এভাবে হয়তো বেসিনের কিছুটা উপকারই করেছে সে, সীমান্তের কাছাকাছি হলেও সিরেনোর আশপাশে রাসলিং কিন্তু কখনোই বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি।

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মিরিয়াম, নিরীখ করছে ওকে। তুমি বোধহয় বদলে গেছ, বেন।

হয়তো।

স্টিভ হরকারকে তখন হাতে গুলি না করে বুকে বা মাথায় গুলি করলেই বোধহয় ভাল হত, অনুশোচনা মিরিয়ামের কণ্ঠে। তখন যদি জানতাম বিল ওর গুলিতে মারা যাবে…নিশ্চয়ই বুকেই করতাম গুলিটা!

একজন খুনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের পার্থক্য এখানেই, ক্ষীণ হেসে শ্রাগ করল বেন, ড্রিঙ্ক গলায় ঢেলে ফের গ্লাস ভরে নিল, জানে নীতি-কথা বা এমনকি হুইস্কিতেও হতাশা ঘুচবে না ওর। মিরিয়ামের ক্ষেত্রেও তাই সত্যি। দেরি করে লাভ কি, কাজটা যখন করতেই হবে! বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করল ও।

রিও ফ্রিয়োর ওপাশে যাবে না তুমি, বেন! আচমকা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল মিরিয়াম।

কে বলল লেযি-এন র‍্যাঞ্চ হাউসে যাচ্ছি আমি, কিংবা ভদ্রলোকের মত স্টিভ হারকারকে আইনের হাতে আত্মসমর্পণ করতে বলব?

তাহলে কি করবে?

দাঁত বের করে হাসল বেন, নীরব চোখের চাহনিতে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল মেয়েটাকে। লেযি-এনের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে হবে। কাউকে না কাউকে তো কাজটা করতে হবে, তাই না? হারি বা জিতি, নিজস্ব রীতিতে কাজটা করার চেষ্টা করব আমি।

মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার!

কিন্তু এছাড়া উপায় দেখছি না। তুমি কি বুঝতে পারছ না?

পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিরিয়াম, শক্ত হয়ে চেপে বসা ঠোঁট জোড়ায় রহস্যময় কাঁপন দেখা গেল, কিন্তু দৃষ্টিতে অদম্য অভিমান নিয়ে তাকিয়ে থাকল বেনের দিকে। শঙ্কা আর আশাহতের যন্ত্রণার ঝড় বইছে ওর মনে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল শেষে, দুলে উঠল কাঁধ জোড়া। প্রায় অস্ফুট স্বরে বলা প্রশ্নটা কামরার নীরবতাকে ছাপিয়ে উঠল: কিন্তু আমার কি হবে, বেন?

নিজের শঙ্কা বা নিরাপত্তার কথা বোঝাতে চায়নি মিরিয়াম, বরং হঠাৎ করেই মনের গভীর আবেগের কথা বলে ফেলেছে। পালক-ভাই হিসেবে একসঙ্গে বড় হয়েছে বেন স্লেজেল, কিন্তু মিরিয়ামের কাছে সে ওর মনের মানুষ, প্রিয় মানুষ–এই মুহূর্তে একমাত্র অবলম্বন। এই লোকটিকে হারানোর ইচ্ছে নেই ওর।

মিরিয়াম!

তুমি নিশ্চয়ই আমাকে করুণা করবে এখন! মাথা নিচু হয়ে গেল মেয়েটার, তারপর আচমকা চোখ তুলে তাকাল, গভীর দৃষ্টি চোখে; বেনের চোখে চোখ রাখল মেয়েটি। হ্যাঁ, তুমি যাই ভাবো না কেন, আমি তোমাকে ভালবাসি। নীরবে ভালবেসেছি এতদিন, এখান থেকে চলে যাওয়ার আগে দেখেছি অ্যাগনেসকে নিয়ে ভাবতে তুমি।  ছোট ছিলাম আমি, বুঝিনি কতটা তোমাকে চাই, কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর বুঝেছি…

এগিয়ে গেল বেন। লজ্জায় নিচু হয়ে গেছে মিরিয়ামের মুখ, বেন ওর কাঁধে হাত রাখতে কেঁপে উঠল মেয়েটা। মিরিয়ামের চিবুক তুলে চোখে দৃষ্টি রাখল বেন। এটাই কি সকালের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর? স্মিত হেসে জানতে চাইল ও।

আরক্ত হয়ে গেল মিরিয়ামের মুখ, আয়ত চোখ জোড়ায় খুশির ঝিলিক; জানে ওর প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং সানন্দে, কৃতজ্ঞ চিত্তে সেটা মেনে নিয়েছে পুরুষটি।

কোমর চেপে ধরে মেয়েটিকে কাছে টানল রেন। ওর বুকের সঙ্গে সেঁটে এল মিরিয়াম-আশ্রয় আর ভরসা চাইছে যেন।

পাইনের সুবাস মাখা মৃদু হাওয়া ভেসে আসছে পাহাড়শ্রেণী থেকে, সঙ্গে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ। পোর্চে দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ জমিতে বিছিয়ে থাকা গোধূলির আবছা অন্ধকারের দিকে তাকাল বেন স্লেজেল। বাইরে ব্র্যান্ডিং পেনে ডাকছে একটা বাছুর। ফেন্স করালের ওপাশে বিরাট পন্ডেরেসোর গায়ে ঠোকর মারছে একটা কাঠঠোকরা।

দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে আকাশের ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে তাকাল ও রিও ফ্রিয়োর উচ্ছল প্রবাহকে ঘোলাটে একটা ক্ৰীকের মত দেখাচ্ছে এখান থেকে, উইললা আর কটনউডের সারিতে শীতল বাতাস বইছে, পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ঘাপটি মেরে আছে রহস্যময় অন্ধকার।

জায়গাটা সত্যি সুন্দর, বিষণ্ণ মনে ভাবল ও। ডাবল-বির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ রীতিমত পীড়া দিচ্ছে ওকে। বেপরোয়া হয়ে উঠতে চাইছে মন, কিন্তু একইসঙ্গে অনিবার্য এক পিছুটানও অনুভব করছে-মিরিয়াম ব্রেনেল। স্বল্পভাষী মেয়েটি হঠাৎ করে নিজের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে ওকে। বেনকে মনে করিয়ে দিয়েছে হৃদয়ের গভীরে কোথাও স্থায়ী একটা অংশ জুড়ে ছিল মেয়েটি, কিন্তু জানা হয়নি। এতদিন।

ভাবনা বাদ দিয়ে স্টেবলের দিকে এগোল কেন। ধীরে সুস্থে একটা সোরেলের পিঠে স্যাডল চাপাল, আচমকা বাইরে মৃদু পদশব্দ শুনতে পেল। পিছিয়ে এসে একটা স্টলে ঢুকে পড়ল ও, হাতে কোল্ট চলে এসেছে।

দরজায় গাঢ় একটা ছায়া দেখা গেল। স্লেজেল?

কণ্ঠটা চেনা মনে হলেও উত্তর দিল না বেন। অতিমাত্রায় সতর্ক ও, বহুবার দেখেছে সামান্য শব্দ শুনেই নিখুঁত নিশানায় গুলি করতে সক্ষম কিছু মানুষ। পশ্চিমে টিকে থাকতে হলে এই যোগ্যতা অর্জন করতেই হয়।

কাঁধের ওপর হাত তুলল ডড কিনলে, বোঝাতে চাইছে হাতে অস্ত্র নেই। স্লেজেল? ফের ডাকল সে।

ভেতরে এসো।

ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকল ডিটেকটিভ। তুমি দেখছি দারুণ সতর্ক, আমাকেও বিশ্বাস করছ না! খানিকটা বিস্ময়ের সুরে বলল সে।

ওই জিনিসটার কারণেই এখনও বেঁচে আছি।

সমঝদারের ভঙ্গিতে নড় করল সে। সিগার চলবে? উত্তরের অপেক্ষায় থাকল না কিনলে, একটা কেস এগিয়ে ধরল বেনের দিকে। স্নান আলোয় বেনের বুকের তারাটা চোখে পড়ল তার, খানিকটা উজ্জ্বল হলো চোখের চাহনি। তাহলে ঠিকই শুনেছি?

নীরবে মাথা ঝাঁকাল বেন।

খবরটা কিন্তু লেযি-এন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, ওখান থেকেই জেনেছি আমি।

জানতাম এমন কিছুই হবে।

সিগারের প্রান্তে লেপ্টে আছে ডড কিনলের দৃষ্টি, আসলে কি যেন ভাবছে সে। লোকটা তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, এবং মাথা গুলিয়ে যায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। নিশ্চয়ই মাথা গরম করে লেযি-এনে হানা দিতে যাচ্ছ না? দারুণ বোকামি হবে সেটা। তবে হারকারকে ধরার অন্য কোন উপায়ও বোধহয়, নেই, একটা পোস্টের সঙ্গে হেলান দিয়ে এবার বেনের দিকে ফিরল সে। কিন্তু তোমার। প্রতিপক্ষ শক্তপাল্লা, শ্লেজেল। হারকার একাই একশো, তাছাড়া কারাঞ্চো, ফ্রেড মোরিস, স্লিম, কার্লি তো আছেই। এমনকি তোমার ভাইও তোমার বিপক্ষে অস্ত্র ধরবে।

রক্তের সম্পর্কের ভাই নয়, শুধরে দিল বেন।

কিছু যায়-আসে না তাতে। ছেলেটাকে পছন্দ করো তুমি। ওকে হয়তো হারিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু অন্যদের…একটা কথা না বলে পারছি না, এত নিঃশব্দে চলাফেরা করো কিভাবে? কাউকে এত ক্ষিপ্র হতে দেখিনি আমি!

হয়তো সেজন্যেই বেঁচে আছি।

হ্যাঁ, লিয়ন সিটিতে অন্তত সেটা প্রমাণ করেছ তুমি, চিন্তিত স্বরে বলল ডিটেকটিভ। হর্সহেড ক্রসিঙের ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে কতটা ক্ষিপ্র তুমি।

আবছা অন্ধকারে লোকটিকে নিরীখ করছে বেন, কিন্তু ভাবলেশহীন দেখাচ্ছে ডড কিনলের মুখ। হর্সহেড ক্রসিঙে এ লোক উপস্থিত ছিল না, নিশ্চিত জানে ও, হয়তো কারও কাছে ওখানকার ঘটনা শুনেছে।

টাসকোসার বাররূমের ঘটনাটাকে কি বলবে? সে-রাতে ক’জন লোক মারা গেছে, স্লেজেল?

মনে হচ্ছে সংখ্যাটা তুমিও জানো, কিনলে।

পাঁচজন, আমার ধারণা। এদের দু’জন তোমার গুলিতে মারা গিয়েছিল।

এ নিয়ে দুঃখ বা অনুশোচনা নেই আমার।

থাকাও উচিত নয়। কিন্তু তোমার সম্পর্কে আরও কিছু খবর জানি আমি।

কে তোমাকে এসবে জড়িয়েছে, কিনলে? টম নোলান?

এক হিসেবে তাই বলা যায়। যদিও এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানে না সে।

তাহলে আমার ওপর নজর রাখতে চাইছে সে, তাই না?

অযথা নিজেকে প্রলুব্ধ কোরো না! এতদিন তোমাকে মনে রাখার কোন কারণ ছিল না ওর, কিন্তু ফিরে এসে লেযি-এন রেঞ্জে যখন পা রেখেছ, সঙ্গে সঙ্গেই তোমার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে সে, কারণ বেন স্লেজেলের মত লোককে। কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। বাধ্য হয়েই তোমার ওপর নজর রাখছে টম। নোলান।

জানি।

সিগারে পাফ করল কিনলে, ফু দিয়ে ধোয়া ছেড়ে একটা চাকতি তৈরি করল বাতাসে। বুড়ো ভাল মজুরি দেয়, স্লেজেল, দার্শনিক সুরে খেই ধরল সে। আমাকে ভাড়া করার একটা কারণ বলেছি তোমাকে, আরেকটা কারণ কিন্তু বলিনি। অন্যদের সামনে বলার ইচ্ছে ছিল না, এবার বোধহয় বলা যেতে পারে।

আমাকে বলতে চাইছ কেন?

খুব একটা নিশ্চিত নই আমি। তুমি কি জানতে চাও না?

কিন্তু বলার জন্যে তোমাকেই বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে।

নড করল ডিটেকটিভ। মিসেস নোলান সম্পর্কে কতটা জানো?

ক্যাস্টানে পরিবারের বড় মেয়ে ছিল মহিলা, ল্য, ডলোরেস ক্যাস্টানের বড় বোন। কখনও মহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়নি আমার। মহিলা যখন এখান থেকে চলে যায় একেবারে বাচ্চা ছিলাম আমি। সত্যি কথা বলতে কি, মিসেস ব্রেনেলকেও ঠিকমত মনে নেই। জেফরিকে জন্ম দেয়ার সময় মারা যায় ডলোরেস ব্রেনেল। সবাই তো বলে দারুণ সুন্দরী ছিল মহিলা, কার্ল ব্রেনেল ওর কথা কখনোই ভুলতে পারেনি।

নিভে যাওয়া সিগার আবার ধরাল কিনলে, আগুনের শিখার ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছে বেনকে। লয় নোলান কখনও ফিরে আসেনি বেসিনে, তাই না?

হ্যাঁ। লোকজনের কাছে শুনেছি দক্ষিণের কোন এক শহরে মাসক্ত হয়ে শেষে মারা গেছে মহিলা। তুমি কি মনে করো, কিনলে, টম নোলানের সঙ্গে বাস করা কি খুব স্বাস্থ্যকর ব্যাপার? ক্ষীণ হাসল বেন। আমার তো মনে হয় গাট-হুক বুড়োর সঙ্গে থাকতে গেলে মদ বা কোন একটা অবলম্বন আঁকড়ে ধরা ছাড়া উপায় নেই।

বেনের সূক্ষ্ম বিদ্রূপ গ্রাহ্য করল না ডিটেকটিভ। মজার ব্যাপার কি জানো, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত টম নোলান আর কার্ল ব্রেনেলের মধ্যে সদ্ভাব ছিল। দুটো র‍্যাঞ্চের শত্রুতার শুরু কিন্তু ডলোরেসের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে দেওয়া জমি নিয়ে।

নড করল বেন–শোনা কথা সব। টেরিটরি সরকারের অনুমোদিত হলেও ক্যাস্টানেডাদের দলিল কিন্তু পুরোপুরি নির্ভেজাল নয়, অন্তত আইনের দিক থেকে। দুই বোনই একমত ছিল এ ব্যাপারে। বড় বোন হিসেবে রিও ফ্রিয়োর পুব অংশটা দাবি করে ল্য ক্যাস্টানেড়া, আর ডলোরেস পায় পশ্চিম অংশ। সূর্য সেরা জমি পেলেও পাহাড়ী এলাকাটা জোটে ডলোরেসের ভাগ্যে। টম, নোলানের তাতেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত ছিল।

মাথা নাড়ল ডড কিনলে। কিন্তু কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না সে, কিংবা দুই বোনও ছিল না। ব্যাপারটা সত্যিই বিস্ময়কর, ব্যক্তিগত অসন্তোষ আর ঈর্ষা। রোগের মত সংক্রমিত হচ্ছিল ওদের মধ্যে অন্তত টম নোলানের ক্ষেত্রে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। অথচ সেরা জমিটা পেয়েছে সে, সমৃদ্ধিও জীবনে কম আসেনি তার। তারপরও কি এক অতৃপ্তিতে যেন পেয়ে বসেছে মানুষটাকে। এখনও প্রায়। সাধারণ জীবন যাপন করে সে, প্রায়ই জাকাল র‍্যাঞ্চ হাউস ছেড়ে খোলা প্রান্তরে গিয়ে ঘুমায়। সাধারণ মাংস আর বীনই পছন্দ করে।

আসলে কি চায় সে, এতদিন পর হিসেব মেলানোর দরকার পড়ল কেন?

চোখ তুলে তাকাল ডিটেকটিভ। স্ত্রীর সঙ্গে কখনোই সদাচারণ করেনি নোলান, নিজেই স্বীকার করেছে। অপরাধবোধ তাড়া করছে ওকে। মিসেস নোলানের শেষ জীবনের দিনগুলি কেমন কেটেছে, কোথায় কেটেছে জানতে চাইছে লেযি-এন কস্। আমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছে। ঠিকই বলেছ তুমি। অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ে মিসেস নোলান, এখান থেকে এল পাসোতে চলে যায় মহিলা।

শুনে সত্যিই খারাপ লাগছে।

মৃত্যুর আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ল্য নোলান। যে নার্স ওর সেবা করেছিল, মেয়েটার সঙ্গে কথা বলেছি আমি। মরার আগে অদ্ভুত এক গল্প বলেছে ওকে মিসেস নোলান, শেষ মুহূর্তের স্বীকারোক্তি বলতে পারো। মেয়ে নয়, সন্তান হিসেবে একটা ছেলে প্রত্যাশা করেছিল টম নোলান, যাতে ওর সাম্রাজ্যের হাল

ধরে রাখতে পারে সে-আরেকজন নোলান হতে পারে!

টম নোলানের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু সন্তান জন্ম নেয়ার সময় র‍্যাঞ্চের কাজে বাইরে ছিল সে। ওখানেই খবরটা পায়-একটা মেয়ের জন্ম হয়েছে।

শ্রাগ করল বেন। ওর প্রত্যাশা অ্যাগনেস যে একেবারে পূরণ করেনি তা বলা যাবে না।

টম নোলান কিন্তু মোটেই খুশি হয়নি তখন। সন্তানকে মেনে নিয়েছিল সে, কিন্তু সূর্য নোলানকে মেনে নেয়নি। বছর ঘোরার আগেই তাকে ছেড়ে চলে যায় মহিলা, অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছে।

একটু আগে বলেছি, মহিলার নার্সটির সঙ্গে কথা হয়েছে আমার। শেষ দিকে বিকারগ্রস্ত ছিল মিসেস নোলান, পাগলের মত হাসত। বলত উচিত শিক্ষা দিয়েছে। টম নোলানকে, প্রতিশোধ নিয়েছে। মহিলা দাবি করত একটা অভিশাপ রেখে গেছে টম নোলানের জন্যে। সব শুনে সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠি আমি, ভুলেই গিয়েছিলাম টম নোলানের হয়ে কাজ করছি।

কয়েকটা সূত্র বাকি রয়ে গেছে এখনও। কিছু রেকর্ড যাচাই করার জন্যে কাউন্টি অফিসে যাচ্ছি আমি। কিন্তু তোমাকে একটা কাজ দিয়ে যাব, দয়া করে কাজটা করে দেবে?

বলো।

আমার ফিরে আসা পর্যন্ত লেযি-এন থেকে দূরে থেকো।

তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল বেন।

কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জেনেই ফিরে আসব আমি।

ঠাণ্ডা মাথায় আমার ভাইকে খুন করেছে হারকার। ওকে চাই আমার, এবং অন্য ভাইটাকেও নিয়ে আসতে চাই, কারণ, এখানেই থাকার কথা ওর।

যৌক্তিক দাবি, কিন্তু দুটো দিন দেরি করলে এমন কিছু যাবে-আসবে না।

দেখো, কিনলে, তুমি নিজেই বলেছ দুটো উদ্দেশ্য নিয়ে টম নোলানের হয়ে কাজ করছ। একটা হচ্ছে কার্ল ব্রেনেলের খুনীর পরিচয় জানা, আরেকটা কাজ মিসেস নোলানকে ট্রেস করা। দ্বিতীয় কাজটা সাফল্যের সঙ্গে করেছ, কিন্তু প্রথমটার ব্যাপারে, সত্যি কথা বলতে কি, তোমাকে খুব একটা আগ্রহী মনে হচ্ছে না। সুতরাং দায়িত্বটা আমাকেই নিতে হচ্ছে, কারণ মাথা যার, ব্যথাও তার!

হয়ত দুটো কারণই পরস্পারের সঙ্গে সম্পর্কিত, কখনও কি ভেবেছ তুমি?

না।

আমার ধারণা কিন্তু সেরকমই, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেনকে দেখছে কিনলে, নীল চোখে প্রত্যাশা ফুটে উঠল। এবার দয়া করে আমি ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করো। করবে?

না।

শ্রাগ করল ডিটেকটিভ। যত দ্রুত সম্ভব কাউন্টিতে পৌঁছা’র চেষ্টা করব, খোদার কাছে প্রার্থনা করছি আমার সন্দেহই যেন সত্যি হয়। আশা করছি রক্তপাত শুরু হওয়ার আগেই ফিরে আসতে পারব।

তাতে কি হবে? তাচ্ছিল্যের হাসি বেনের ঠোঁটে। টম নোলান ভাল মানুষ হয়ে যাবে? আজীবন ডাবল-বি কিংবা অন্যান্য বাথানের ওপর যেসব অন্যায় করেছে, সেজন্যে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইবে?

গম্ভীর হয়ে গেল ডড কিনলে, সরু চোখে দেখল বেনকে। অতীতের কথা জানি না, কিন্তু টম নোলান এখন ভিন্ন একজন মানুষ। কে জানে, কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুও একটা কারণ হতে পারে। এটা তো ঠিক, একসময় ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল দু’জন। নিজের হাত পরিষ্কার রাখতে চাইছে নোলান, ওর ধারণা ব্রেনেলের মৃত্যু রহস্যের কিনারা না হওয়া পর্যন্ত বেসিনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, রক্তারক্তি বেধে যেতে পারে। সেটাই এড়াতে চাইছে কেউ।

মা-র চেয়ে মাসীর দরদ বেশি দেখছি!

কারণও আছে। টম নোলানের ধারণা তৃতীয় একটা পক্ষ আছে এসবে-দুই বাথানের শত্রুতার ফায়দা লুটতে চাইছে সে।

আনমনে মাথা নাড়ল বেন, নিজের মনে উল্টে-পাল্টে দেখল ধারণাটা, তারপর বাতিল করে দিল। হতে পারে, এ নিয়ে ভাবার বিলাসিতা নেই আমার। সারা জীবন যা দেখেছি, সেটাই বিশ্বাস করব আমি। অন্যরাও তাই করবে।

তুমি কি বিশ্বাস করো কার্ল ব্রেনেলকে খুন করিয়েছে নোলান?

এবার ভাবতে হলো বেনকে। নিজে সে করেনি কাজটা, কে জানে হয়তো ওর কোন ক্রু করেছে–ভাড়াটে লোকের অভাব নেই এ দেশে।

উঁহু, টম নোলান এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র জানে না। ক্রুদের কাউকে নির্দেশ দেয়নি সে, এবং কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুর পর সব ক্রুকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল-কেউ স্বীকার করেনি। প্রত্যেকের অ্যালিবাই যাচাই করেছি আমি। সেদিন রিও ফ্রিয়োর ধারে-কাছেও ছিল না এদের কেউ।

তাতে কি প্রমাণ হলো?

আরও একটা পক্ষ আছে বেসিনে, খুবই ধুরন্ধর কোন লোক আছে এসবের পেছনে। কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যুর কারণে অশান্ত হয়ে ওঠা পরিস্থিতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চাইছে সে। বিল ব্রেনেলের মৃত্যু স্রেফ এর জের মাত্র।

একটু পর হয়তো বলবে স্টিভ হারকারও নির্দোষ! বিদ্রুপের সুরে অসন্তোষ প্রকাশ করল বেন।

ডাবল-বি বা লেযি-এন স্রেফ দাবার ঘুটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে দুই আউটফিটের মধ্যে তেমন কোন রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি; পরিস্থিতি মোটামুটি শান্তই ছিল। কার্ল ব্রেনেলের মৃত্যু দিয়ে শুরু, প্রায় নখ দন্তহীন হয়ে পড়ল ডাবল-বি। তুমি আসায় আবারও শুরু হলো সংঘর্ষ…

সেজন্যে শুধু লেযি-এনকেই দায়ী করা যায়, ডিটেকটিভের মুখের কথা কেড়ে নিল বেন।

হয়তো, কিন্তু এসবের পেছনে টম নোলানের কোন মদদ নেই। নিজের মুখে স্বীকার করেছে সে, কিছু কিছু ঘটনা ওর নির্দেশ ছাড়াই ঘটছে।

তার মানে ঘরেও শক্ত আছে তার, তাই তো বলতে চাইছ?

ব্যাপারটা ওরকমই দাড়াচ্ছে।

নীরব হয়ে গেল দু’জনেই। আনমনে সম্ভাবনাটা বিচার করছে বেন, প্রায় অসম্ভব হলেও ধারণাটা একেবারে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। জ্যাক হারলোর কথায়ও এরকম একটা ইঙ্গিত ছিল। তাহলে লেযি-এন বস্ এখন আর ক্রুদের সামলে রাখতে পারছে না? কে এদের নিয়ন্ত্রণ করছে, স্টিভ হারকার?

সম্ভব। কিন্তু নিশ্চিত বলা যাবে না। টম নোলান চরমপন্থী বা নিষ্ঠুর বটে, কিন্তু চাতুরি বা হীন কৌশল প্রয়োগ করা ধাতে নেই তার, আজীবন তাই দেখে এসেছে বেন। বুড়ো বয়সে এসে মানুষটার অধঃপতন হয়েছে, ভাবতে বাধছে ওর। কিন্তু ডাবল-বি বন্ধকী রাখল কেন? এ ব্যাপারটাই খটকা জাগায়।

রাজি আছ আমার প্রস্তাবে? উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল কিনলে।

মাথা নাড়ল বেন। স্টিভ হারকারকে ধরে আনব আমি, কিনলে, এটাই হচ্ছে আসল কথা। তবে আরও একটা কাজ করব, সরাসরি কথা বলব টম নোলানের সঙ্গে। হারকারকে যদি বিনা শর্তে আইনের কাছে সোপর্দ করে, তাহলে বুঝব সত্যিই আন্তরিক সে–বেসিনে অশান্তি চায় না, কিংবা কার্ল ব্রেনেলের খুনের কিনারা হোক দেখতে চায়। যাই ঘটুক, শিগগিরই লেযি-এনে বাথানে যাচ্ছি আমি!

শ্রাগ করল ডড কিনলে, কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিবৃত্ত করে নিল নিজেকে। বেন স্লেজেলের মুখের দৃঢ় পেশী আর চোয়াল দেখেই বোঝা যাচ্ছে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যাবে না জেদী, একগুয়ে লোকটিকে।

একটা হাত বাড়িয়ে দিল বেন। এখানে আসার জন্যে ধন্যবাদ।

ভুলে যাও। আশা করছি তোমাকে সাহায্য করতে পারব। হয়তো ফিরে এসে দেখব দেরি হয়ে যায়নি তখনও।

হতে পারে, অ্যামিগো।

ভ্যায়া কন ডিওস (ঈশ্বর তোমার সহায় হোন), স্লেজেল।

ভ্যায়া কন ডিওস।

ঘোড়া হাঁটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল বেন, একটু পর দক্ষিণের প্ৰেয়ারিতে হারিয়ে গেল ওর ঘোড়া।

নতুন একটা সিগার ধরাল ডড কিনলে। কুঁচকে উঠেছে জোড়া ভুরু। চিন্তিত মনে স্টেবল থেকে বেরিয়ে এসে ঘোড়ায় চড়ল। স্পার দাবাল সে, তারপর উত্তরের পাহাড়সারির দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। জানে ঘোড়াটার ওপর দিয়ে ধকল যাবে, কিন্তু উপায় নেই। বেসিনের অশান্তি চিরতরে মিটিয়ে দেয়ার জন্যে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরী হয়ে পড়েছে, এবং ষাট মাইল দূরের কাউন্টি অফিসের রেকর্ড ঘেঁটে গোপন তথ্য জানতে হবে ওকে। যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসতে হবে, বেন স্লেজেল বেপরোয়া হয়ে লেযি-এনের ওপর চড়াও হওয়ার আগেই।

টম নোলানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সুযোগ কি পাবে বেন স্লেজেল? আনমনে ভাবল কিনলে, মনে হয় না। সম্ভবত তার আগেই খুন হয়ে যাবে স্টিভ হারকারের হাতে, কিংবা কারাঞ্চো বা মোরিসের হাতে।

প্রথমে দক্ষিণে এগোলেও মাঝরাতের পর দিক বদলে ঠিক উল্টোদিকে এগোল বেন স্নেজেল, পাহাড়সারির সমান্তরালে এগিয়ে ব্রাভো ক্রীকের ফোর্ড পেরিয়ে লেযি-এন জমিতে পা রাখল। ক্রীকের বাকের মুখে একটা লাইন ক্যাম্প এড়িয়ে গেল ও, তারপর নিচু পাহাড়ী এলাকা ধরে দক্ষিণ-পুবে এগোল। পাহাড় বা ট্রেইলে আড়াল পাওয়ার মত পরিবেশ নেই, খানিকটা হলেও উদ্বিগ্ন মনে এগোতে হচ্ছে ওকে। অনায়াসে যে কারও চোখে পড়ে যেতে পারে, কারণ নিজের সীমানায় কয়েকটা লাইন ক্যাম্পে পাহারা বসিয়েছে টম নোলান। এভাবেই রাসলার আর অনাকাঙ্ক্ষিত রাইডারদের অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছে সে।

ঘণ্টা দুই টানা চলার পর নিরাপদে মালপেই ভ্যালিতে পৌঁছল ও। সবে ডোর হচ্ছে তখন, পুব আকাশের কোলে গোলাপী বিছানায় আড়মোড়া ভাঙছে সূর্য। পর্যাপ্ত পানি আর ঘাস আছে এমন একটা অগভীর ড্র-তে ঘোড়া রেখে রীমের ওপর উঠে এল বেন। কিনারে এসে মাটির ওপর শুয়ে পড়ল, হাতে কার্ল ব্রেনেলের জার্মান ফিল্ড গ্লাস। লেযি-এন হেডকোয়ার্টারের ওপর নজর রাখছে।

জায়গাটাকে ক্যাটক্ল, অ্যাকাসিয়া আর বুনো ঝোঁপের নরক বলা চলে। তীক্ষ্ণ সুচাল শরীরের পাথর, বোন্ডার আর বুনো কাটা ঝোঁপ জাতীয় গাছ তো রয়েছেই। বেশিরভাগ গাছ শুকিয়ে মরে গেছে, কিন্তু খোঁচা খোঁচা দাড়ির মত মাটির ওপর বেরিয়ে আছে ওগুলোর মূল। অবস্থা এমন যে জায়গাটা পার হওয়া প্রায় অসম্ভব, নেহাত প্রয়োজন ছাড়া এখানে আসে না কেউ। কিন্তু এত অসুবিধের পাশাপাশি বিরাট একটা সুবিধাও আছে। ম্যালপেই ভ্যালির কিনারা থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত লেযি-এন হেডকোয়ার্টারের পুরোটাই স্পষ্ট চোখে পড়ে।

কাজটা সত্যিই কঠিন হবে। ঝুঁকি নিতে হবে। হারকার, মোরিস, স্লিম, কার্লি, কারাঞ্চো, এবং সম্ভবত জেফরির মুখোমুখি হতে হবে। চোখ বন্ধ করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করল বেন, শীতল অনুভূতি হচ্ছে, অস্বীকার করার উপায় নেই এতগুলো বিপজ্জনক লোকের মুখোমুখি হওয়ার চিন্তাটাই অস্বস্তিকর।

ক্ষৌরিহীন চিবুকে হাত ঘষল বেন। ধারণাটা মন্দ নয়, কিন্তু স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে, সমস্যাটা এখানেই। হয়তো দেখা যাবে কাজের কাজ কিছু হবে না, স্রেফ ধরা পড়ে যাবে ও। নিজের সাম্রাজ্যে টম নোলন, সত্যিই বেপরোয়া, হিংসুটে ইন্ডিয়ানদের মত সবকিছু আগলে রাখে সে। যে কোন কিছু। গাট-হক রেঞ্জ থেকে এ পর্যন্ত কেউ কিছু ছিনিয়ে আনতে পারেনি, যদি না নোলান নিজে সুযোগ দিয়ে থাকে। একাধিক লোক সেই চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মাথা হারিয়ে সেই ভুলের মাশুল দিয়েছে। চড়া বেতনের বিনিময়ে ক্রুদের কাছ থেকে দুটো জিনিস আদায় করেছে টম নোলান: মারকুটে স্বভাব আর বিশ্বস্ততা।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। সূর্য একসময় মাথার ওপর উঠে এল, পিঠ তাতাচ্ছে এখন। কিন্তু অনড় পড়ে আছে বেন, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে লেযি-এন। হেডকোয়ার্টার।

দিনের বেলায় কিছু করতে যাওয়া বোকামি হবে, সামান্য সম্ভাবনাও নেই ওর। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেন, তারপর নিজের খেলা খেলবে। গাট-হুক ক্রুরা জানে বুকে একটা টিনের তারা ঝুলিয়েছে ও, এবং ওকে আশা করছে লোকগুলো। কি ধরনের অভ্যর্থনার আয়োজন করেছে কে জানে, কিন্তু সেটা যে ওর জন্যে সুখকর কিছু হবে না সেটা নিশ্চিত।

পরিণতিতে হারুক বা জিতুক, খেলাটা খেলতেই হবে ওকে।

<

Super User