নিমেষে হুঁশিয়ার আর প্রস্তুত হয়ে গেল সবাই। কেউ নেই আগুনের পাশে। থমথম করছে রাত। আকাশে নিঃশব্দ তারার জোনাকি। তিনদিক থেকে পাহাড় উঁকি দিয়ে দেখছে নির্জন আগুনটাকে। অকস্মাৎ দম আটকানো নীরবতা নেমেছে সর্বত্র।
অন্ধকারে একটা পাথরের পাশে বসে আছে ইয়াসীন। তার কাছে গুটিগুটি এগিয়ে এল রস। শব্দটা অস্পষ্ট। তবে শুনেছি আমি তাতে সন্দেহ নেই, বলল সে। ওই দিক থেকে এল মনে হয়। আঙুল তুলে কিছুদূরের ঝোঁপগুলো দেখাল।
মরুভূমিতে আনাড়ী নয় রস। কোনও সন্দেহজনক শব্দ সে শুনেছে-এ নিয়ে বাজি ধরা যায়। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দূরের ঝোঁপগুলোর দিকে তাকাল ইয়াসীন। দেখে আসছি আমি ওদিকটা। তুমি নজর রেখো ফাউলার আর পার্টনারের দিকে।
একটু ঘুরে ঝোঁপগুলোর মধ্যে এল ও। ক্যাকটাসের ঝোঁপ সব। কোনটারই উচ্চতা কোমরের বেশি নয়। কোনও শব্দ নেই। কেউ নেই ঝোঁপের আড়ালে।
পিছনের ক্যাম্পফায়ারটা লক্ষ করল ও। এখান থেকে পঞ্চাশ ফুট মাত্র দূরত্ব অথচ একটা লাল আভা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। লুকিয়ে আগুন জ্বালানোর জন জায়গাটা সত্যি চমৎকার। সহজে খুঁজে বের করতে পারবে না কেউ।
অথচ একটা শব্দ শুনেছে রস!
ঝোঁপগুলো পেরিয়ে ওপাশের খোলা মরুভূমিতে হেঁটে গেল ও। কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। একখণ্ড পাথরের পাশে অনড় বসে রইল উত্তর্ণ হয়ে।
হয়তো খোলা মরুভূমি নয়, পাহাড়ের ওদিক থেকে এসেছে শব্দটা। কোনও পাহাড়ী ছাগল বা হরিণ চলতে গিয়ে ঝরিয়ে দিয়েছে আলগা পাথর। ইন্ডিয়ানরা আসতে পারে ওই দুর্গম পথে। কিছুই অসাধ্য নয় ওদের।
অনেকক্ষণ পর শব্দটা পেল ইয়াসীন। মরুভূমির দিক থেকেই আসছে। খুব ক্ষীণ একটা আওয়াজ। আর শোনা যাচ্ছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল ও। পাছে নিঃশ্বাসের শব্দে বিফল হয় তার অপেক্ষা!
আবারও ভেসে এল আওয়াজ। মরুভূমির বালিতে ঘষে যাচ্ছে কিছু। মানুষের অস্পষ্ট গোঙানি! উঠে, দ্রুত সেদিকে গেল ইয়াসীন।
একজন মানুষ পড়ে আছে বালিতে। মরা জ্যোৎস্নায় দেখা যায় না ভাল। আশেপাশে নেই কেউ। একজন আহত ইন্ডিয়ান নয় তো! আরও একটু এগোল সে। এবং চিনতে পারল। মোকাটো!
দৌড়ে তার কাছে গেল ইয়াসীন। দ্রুত কাঁধে তুলে নিল নিস্পন্দ দেহটা। ফিরে এল আগুনের পাশে।
‘পানি!’ উদ্বেগ আকুল কণ্ঠে মার্থা খালাকে বলল ও। ‘পানি প্রথমে’। মোকাটোর নিঃসাড় দেহটা শুইয়ে দিল আগুনের পাশে।
কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই দেহে। কিছুটা আশ্বস্ত হলো ও। তবে আঁতকে উঠল জুতো জোড়ার চেহারা দেখে। ছিড়ে ফালা ফালা হয়ে গেছে!
আহাম্মক বটে। নইলে অমন জুতো নিয়ে মরুভূমিতে বেরোয় কেউ? আহাম্মকের মত মন্তব্য করল ফাউলার।
‘ঘণ্টাকয়েক আগেও নতুন ছিল জুতোজোড়া।’ বিরক্তিভরে বলল ইয়াসীন। জমাটবাঁধা লাভার জমিতে হাঁটতে ওই অবস্থা হয় জুতোর।
লাভা পেরিয়ে কতদূর এসেছে মোকাটো!
মার্থা খালা আঙুল পানিতে ভিজিয়ে মোকাটোর ঠোঁট মুছে দিলেন। সামান্য হাঁ হলো তার মুখ। ফোঁটায় ফোঁটায় পানি মুখে ঢেলে দিলেন মার্থা খালা।
কিছুক্ষণ পর জুলজুল করে তাকাল ইন্ডিয়ান। আরও পানির জন্য মাথা তুলল। নিজের কোলের উপর মাথাটা তুলে তাকে আরও তিন ঢোক পানি খাওয়াল খালা।
এতক্ষণে ঘোর কেটে যাচ্ছে মোকাটোর। শক্তি ফিরছে দেহে। ব্রেন সচল হচ্ছে আবার। কনুইয়ে ভর দিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে উঠল সে। চারদিক দেখল ভয়ে ভয়ে।
‘মোকাটো!’ কোমল স্বরে ডাকল ইয়াসীন। তাকে চিনতে পেরে আশ্বস্ত হলো ইন্ডিয়ান। চোখে চমকে গেল খুশির ঝিলিক। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল।
‘আমি জানতাম তুমি বেঁচে আছ।’ ওকে লক্ষ করে এই প্রথম কথা বলল ইন্ডিয়ান। হাত বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।
সে হাত ধরে মোকাটোকে তুলে বসাল ইয়াসীন। গরম কফির মগ নিয়ে এলেন মার্থা খালা।
লেফটেন্যান্ট সাইমন কোথায়? জিজ্ঞাসা করল ইয়াসীন।
‘নেই।’ গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বলল মোকাটো।
‘মারা গেছে?’
জানি না। সম্ভবত মরেনি। মার্থা খালা এবং অন্যান্য সবার দিকে তাকাল মোকাটো। তুমি এগিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরই আক্রান্ত হই আমরা। পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি চালাই। বেশ কিছুক্ষণ পর পজিশন ছেড়ে সামান্য মাথা তুলতেই মারা পড়ে আমাদের একজন। দু’দুটো তীর এসে বিঁধেছিল তার গলায়।
উত্তর দিক থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই আমরা…সম্ভবত তুমি।
আমাকে ঘিরে ফেলেছিল একদল ইন্ডিয়ান, বলল ইয়াসীন।
তোমার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল আমার। তুমি ফিরে আসছ না দেখে বিকেলের দিকে তোমাকে খুঁজে দেখার জন্যে অফিসারের কাছে অনুমতি চাই আমি। কিন্তু আমাকে ঝুঁকি নিতে নিষেধ করে সে। বলে-তুমি হয়তো মারা পড়েছ। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষার পর আবার অনুমতি চাই আমি এবং তার জবাবের আগেই পজিশন ছেড়ে উঠে চলে যাই উত্তরে। ওদিকেই তো গিয়েছিলে তুমি। কফির মগে চুমুক দিল মোকাটো।
অবাক হয়ে ভাবছে ইয়াসীন। রেড ইন্ডিয়ান এই সৈনিক সত্যিই ভালবাসে তাকে! অতীতেও অনেকবার খেয়াল করে দেখেছে সে।
তবে অফিসারের আদেশ অমান্য করা উচিত হয়নি তার। বলতে যাচ্ছিল কথাটা। থেমে গেল মোকাটোর কথার তোড়ে।
তোমার শেল্টার ঠিকই খুঁজে পাই আমি। কিন্তু তোমাকে পেলাম না। এক জায়গায় বালি লাল হয়ে আছে রক্তে। অথচ কোনও মৃতদেহ নেই। অগত্যা অফিসারের কাছে ফিরে যাই আমি। গিয়ে দেখি কেউ নেই।
চারপাশে অনেক খুঁজেছি তাদের। কিন্তু পাইনি। অন্ধকারে খুঁজতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত স্টেজটার ট্র্যাক দেখতে পাই আমি। এবং ইন্ডিয়ানদের পায়ের ছাপ। তাই লাভার জমিতে নেমে যাই। ওর ভিতরে সহজে নামে না কেউ। তবে লুকিয়ে এগোনোর জন্য যথেষ্ট আড়াল পাওয়া যায়।
দুটো লাভাস্রোতের মাঝখানের ঢালে ঘোড়াটাকে ছেড়ে দিয়ে মোযেভদের মত পায়ে হেঁটে এগোই। কারণ স্টেজটার কাছাকাছি হবার জন্যে দুটো উঁচু লাভার দেয়াল টপকাতে হয় আমাকে। একটা বিস্তীর্ণ লাভার জমি পায়ে হেঁটে পার হতে হয়।
রাত হয়ে গেলেও দু’বার ইন্ডিয়ানদের দেখতে পাই আমি। একবার বারোজন আর একবার আটজনের একটা দল। ওদের অতিক্রম করে স্টেজের কাছে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। তাই শর্টকাট খুঁজতে থাকি। একটা ছোট্ট পাহাড়ের পশ্চিম ঢাল ধরে স্টেজের ট্র্যাকটা ঘুরে গেছে দেখে পাহাড়টার পুব ঢাল দিয়ে সরাসরি এগোই আমি। তারপর লাভার ভিতরে পথ হারিয়ে ফেলি।
ইন্ডিয়ানদের কী হলো? প্রশ্ন করল রস।
ঠিক জানি না। তবে তারা আছে।
মার্ল স্প্রিং-এ যাচ্ছি আমরা, মোকাটোকে বলল ইয়াসীন।
তা হলে দেরি কেন, এক্ষুণি রওনা হওয়া যায় না?
না, মোকাটো। ঘোড়াগুলো হাঁপিয়ে গেছে। ভোররাত পর্যন্ত বিশ্রাম দিতে হবে ওদের, বলল ইয়াসীন।
আগুনটা আর উসকে দেওয়া হলো না। যে যার মত কম্বল বিছিয়ে শোবার আয়োজন করতে লাগল। রাতের প্রথম প্রহরে পাহারায় থাকবে ফাউলার। তারপৰ্ব রসের সঙ্গী, টমাসের দায়িত্ব। মোকাটো এল ইয়াসীনের সাথে ঘুমাতে।
আকাশের তারা দেখছে ইয়াসীন। অফিসারের কথা শোনা উচিত ছিল। তোমার, পাশে শোয়া মোকাটোকে বলল ও।
অফিসার? মানে ইউরোপিয়ান? যারা জোর করে কেড়ে নিয়েছে আমার মাটি আর এই আকাশ? ঘৃণাভরে বলল মোকাটো। ফৌজী চাকুরিটা তো দায় ঠেকে করছি। তাও ছেড়ে দিতাম এতদিনে। শুধু তোমার জন্য রয়ে গেছি। তুমি চলে গেলে আমিও চলে যাব, ইয়াসীন।
আমাকে খুব ভালবাস বুঝি?
তুমিও যে আর এক হতভাগা ইন্ডিয়ান!
মৃদু হাসল ইয়াসীন। তোমাতে আমাতে কী দুস্তর ব্যবধান, তা যদি জানতে!
খুব আর ব্যবধান কোথায়? আমি রেড ইন্ডিয়ান তুমি গ্রীন ইন্ডিয়ান। দুজনেই হারিয়েছি দেশ। দুজনেরই বুকের মাঝে দুঃখটা এক!
কী অবাক মিল! এভাবে কখনও ভেবে দেখেনি, ইয়াসীন। দেশের কথা মনে পড়ল। স্বপ্নে সেখানে ফিরে গেল ও।
টমাস ডেকে তুলল তাকে। উঠে পড়ো, সার্জ। সময় বয়ে যাচ্ছে।
ঝটপট উঠে পড়ল ইয়াসীন। দ্রুত হাতে ঘোড়ায় জিন আঁটল। নিভে যাওয়া কয়লার উপরে তখনও গরম কফির কেতলি। বরফের মত ঠাণ্ডা হাত দিয়ে কফি ঢালল মগে। সবাইকে ডাকো। টমাসকে নির্দেশ দিল।
এধরনের খোলা ক্যাম্পে অভ্যস্ত বেলিন্দা আর মার্থা খালা। মেয়েলী মন্থরতায় অহেতুক সময় নষ্ট করল না ওরা। মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে গেল সবাই। অন্ধকারে যাত্রা শুরু হলো।
ঘোড়ায় চড়ে আগে আগে যাচ্ছে ইয়াসীন। মাইল ছয়েক এগোনোর পর একটা গিরিপথ পাওয়া গেল। ঘোড়া থামাল সে। মাটিতে নেমে ঝুঁকে ট্র্যাক দেখতে চেষ্টা করল। দেখা যায় না কিছু। গিরিপথ ধরে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেল ও ম্যাচ জ্বালাল। একাধিক চাকার দাগ ধুলোয়। ওয়াগন চলাচল করে এপথে। তা হলে এপথ দিয়েই পুবে বেরিয়ে যাওয়া যাবে। ফিরে গিয়ে স্টেজের অপেক্ষা করতে লাগল সে।
ওকে অনুসরণ করে অন্ধকার গিরিপথে প্রবেশ করল স্টেজ। দুপাশে পাহাড়ের সারি। বামদিকের পাহাড়গুলো খাড়া উঠে গেছে কয়েকশো ফুট। ডানের পাহাড়শ্রেণী অত খাড়া নয়।
বেশ আগে এগিয়ে চলেছে ইয়াসীন। চাকার আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনও সন্দেহজনক আওয়াজ শোনার উদ্দেশে। কিন্তু কোথাও তেমন কোনও শব্দ নেই।
সামনে খাড়া দেয়ালের মত পথ আগলে আছে উঁচু পাহাড়। এখান হতে রাস্তা প্রায় নব্বই ডিগ্রী কোণে মোড় নিয়েছে ডানে। তারপর সোজা দক্ষিণ-পুবে গিয়ে মিশেছে খোলা মরুভূমিতে।
মোড়ের উপর স্টেজটার জন্য দাঁড়িয়ে রইল ইয়াসীন। দক্ষ হাতে রস চালিয়ে আনছে সেটা।
‘একটু বিশ্রাম?’ রসকে জিজ্ঞাসা করল ও।
মন্দ হয় না? উত্তর এল।
দাঁড়াল স্টেজ। ঘোড়াগুলো পাথুরে রাস্তায় পা ঠুকে ঠুকে দম নিতে লাগল। মার্ল স্প্রিং-এর দূরত্ব অনুমান করার চেষ্টা করছে ইয়াসীন। এখনও হয়তো কয়েক ঘন্টার পথ।
ভোরের আলো ফুটছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের চিহ্ন দেখতে পাবে ইন্ডিয়ানরা। তারপর?
এ পর্যন্ত প্রায় আটমাইল পথ এসেছে ওরা। ওদের অনুসরণ করে আটমাইল দৌড়ে আসতে ইন্ডিয়ানরা সময় নেবে পৌনে একঘণ্টা। চলন্ত স্টেজটা ধরতে সময় নেবে আরও ঘণ্টাখানেক। আর যদি সমকোণী গিরিপথ ধরে না এসে পাহাড় ডিঙিয়ে অতিভুজ বরাবর সোজা পুবে এগোয়, তা হলে অনেক কম সময়ে স্টেজের নাগাল পাবে ওরা। পাহাড়গুলো অতিক্রম করা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু প্রয়োজনে নরকও অতিক্রম করতে পারে মোযেভরা।
‘মার্ল স্প্রিং আর কতদূর?’ প্রশ্ন করল রস।
এখান থেকে দূরতুটা সঠিক জানে না ইয়াসীন। হবে সতেরো আঠারো মাইল, অনুমানে বলল সে।
অর্থাৎ, হামলা হবেই। ঠিক আছে, লড়ব আমরা। চাবুক হাঁকাল রস। আবার চলতে শুরু করল স্টেজ।
স্টেজের প্রায় চারশো গজ আগে চলেছে ইয়াসীন। দুদিকের পাহাড়গুলো সতর্কতার সাথে লক্ষ করে এগোচ্ছে সে। ক্রমশ উঁচুতে উঠছে পথ। সামনে গিরিপথ বেশ প্রশস্ত। তারপর আবার খুব সংকীর্ণ হয়ে ওপাশের মরুভূমিতে মিশেছে।
প্রশস্ত জায়গায় এসে শেষ হয়ে গেল চড়াই। গিরিপথ এখানে প্রায় তিনশো গজ চওড়া। মাঝ বরাবর এসে ঘোড়া থামাল ও। তাকাল দুপাশের পাহাড়সারির দিকে। চলন্ত টার্গেট মাত্র কয়েকগজ দূর থেকেই মিস হয়। সে তুলনায় দেড়শো গজ অনেক দূর। ওই পাহাড় থেকে স্থির টার্গেটও মিস করতে পারে ইন্ডিয়ানরা। ঘোড়া থেকে নেমে বিশ্রাম নিতে বসল ইয়াসীন।
রোদ পড়েছে গিরিপথে। শীতল ধোঁয়াটে ভাবটা কেটে দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। সকাল। পিছনে অশ্বক্ষুরের প্রতিধ্বনি, স্টেজের সচল শব্দ। সামনে ক্রমশ-সংকীর্ণ গিরিপথ।
বাঁ দিকের উঁচু পাহাড়টা বেশি চেপে এসেছে। চিরুনির দাঁতের মত দেখতে তার চূড়া, ঝুলে আছে পথের উপর। আরও সামনের পাহাড়গুলো পথের উপর এত নুয়ে পড়েছে যে পথটা প্রায়-অন্ধকার সুড়ঙ্গের আকার ধারণ করেছে। দূরে-ওপাশের খোলামুখে একঝলক রৌদ্রকরোজ্জ্বল মরুভূমি।
মার্ল স্প্রিং-এর ট্র্যাক ওপাশের খোলামুখে পৌঁছে চট করে বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। তারপর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চলে গেছে উত্তরে।
ইন্ডিয়ানরা যদি শর্টকাটে আগেই এসে থাকে, তবে দুজায়গায় পজিশন নিতে পারে। বাঁ দিকের ওই চিরুনি চূড়ায়, কিংবা ওপাশের খোলামুখে, পথ যেখানে বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। সুড়ঙ্গের মত সংকীর্ণ পথটুকু অ্যামবুশের জন্যে সবচেয়ে উপযোগী। তবে পর্যাপ্ত আলো আর কভারের অভাবে ওখানে হামলা করার ঝুঁকি ওরা নেবে না।
স্টেজ এসে থামল ইয়াসীনের পাশে। রস আর টমাস নামছে। পিছনের দরজা দিয়ে মোকাটো নেমে এল। চোখের ইশারায় মাইলখানেক দূরের চিরুনির মত চূড়াটার দিকে ইঙ্গিত করল সে। ওখানে?
পিছনে ফেলে আসা পথের দিকে টমাসের শঙ্কিত দৃষ্টি। আমাদের ধাওয়া করেও আসতে পারে, বলল সে।
কিংবা সামনে এগিয়ে খোলামুখের ওখানে পজিশন নিতে পারে, যোগ করল ইয়াসীন।
এই অল্প সময়ে পাহাড় ডিঙিয়ে অত সামনে ওরা পৌঁছায়নি হয়তো, সন্দেহ প্রকাশ করল রস।
‘তোমার’ ‘হয়তো’ শব্দটা মোযেভরা বোঝে না, বলল মোকাটো।
ট্রাকটা কি এই গিরিপথের মোহনায় বাঁয়ে মোড় নিয়েছে? ইয়াসীনকে জিজ্ঞাসা করল রস।
হ্যাঁ। এবং ওখানে মোড় নিয়েই ওদের বুলেটের তোড়ে ভেসে যেতে পারি আমরা।
তা হলে?
সেরকম সম্ভাবনা দেখা দিলে, চিন্তিত স্বরে বলল ইয়াসীন, বায়ে মোড় নেব না আমরা। সোজা বেরিয়ে যাব খোলা মরুভূমিতে। পরে বাঁয়ে ঘুরে, আরও উত্তরে কোথাও মার্ল স্প্রিং-এর ট্র্যাকে উঠব।
ঘোড়ায় চড়ল ইয়াসীন। স্টেজের জানালার কাছে এগিয়ে গেল। বেলিন্দা বসে আছে ভিতরে। ভয় করছে? জিজ্ঞাসা করল তাকে।
তার চোখে চেয়ে পরম নিশ্চিন্তে স্মিত হাসল বেলিন্দা। জবাব দিল না।
ওপাশে বসে আছে সেই কালো চোখ আর কালো চুলো লোকটা। তার পাশে ফাউলার। ইন্ডিয়ান? জানতে চাইল সে।
ওখানে বসে দেখা যাবে না, বলল ইয়াসীন। মাইলখানেক সামনে থাকতে পারে। সেই পিস্তলটার ব্যবহার জানা থাকলে বের কোরো তখন।
পিস্তলটা বের করল ফাউলার। ঠিক আছে দেখে নিও, জানি কিনা, চ্যালেঞ্জের সুরে বলল।
রওনা হলো স্টেজ। এবারে সৈটার সামান্য আগে চলল ইয়াসীন। ঘোড়ার জিনে আটকানো রাইফেল টেনে দেখল, ঠিকমত বেরিয়ে আসে কি না। কোমরে ঝোলানো কোল্টের বাটটা সামান্য বের করে রাখল খাপের বাইরে।
কাছে এগিয়ে আসছে চিরুনির মত চূড়াটা।
<