মরুভূমির সাথে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ইয়াসীনের। গোপন রহস্য উন্মোচনের রোমাঞ্চকর সম্পর্ক। তার মাঝে হারিয়ে যাবার তৃষ্ণার্ত ভালবাসার সম্পর্ক। সেই কবে থেকে মরুভূমিকে ভালবাসে সে। অথচ বিনিময়ে মরুভূমি কিছুই দেয়নি। মরুভূমি কাউকেই কিছুই দেয় না!
শুধু শোনা যায় দেবার মত অনেক আছে তার। হয়তো অগাধ ঐশ্বর্যময় কোনও বিলুপ্ত সাম্রাজ্য, হয়তো অঢেল হিরা জহরত সমৃদ্ধ কোনও পাথুরে খনি, কিংবা হয়তো হারিয়ে যাওয়া একটা সোনার নদী! থাকতে পারে এসব মরুভূমিতে। ওই আদিগন্ত খাঁ খাঁ বালুর বিস্তারে যে কোনও ঐশ্বর্যই থাকা সম্ভব।
মরুভূমি প্রকৃতির এক আজব কোষাগার। অন্যত্র যা ধ্বংস হয়, মরুভূমিতে তা থাকে সংরক্ষিত। মৃতদেহ থেকে পানি বের করে নেয়। পচনশীল উপাদানগুলো নিংড়ে ফেলে। তারপর প্রাকৃতিক মমি বানিয়ে রেখে দেয় নিজস্ব ভাড়ারে। তাই, মরুভূমি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসে ইতিহাস।
পৃথিবীর অনেকগুলো মরুভূমিতে থেকেছে ইয়াসীন। ভারতের থর মরুভূমি হতে পাড়ি জমিয়েছে আফ্রিকার সাহারায়। হাজার হাজার মাইল মরুপথ তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে শুকনো তপ্ত বালুর উজানে। কখনও উটের পিঠে কখনও ঘোড়ায় চড়ে আবার কখনও পায়ে হেঁটে।
প্রতিটি মরুভূমি সম্পর্কে অদ্ভুত সব গল্প শুনেছে সে। প্রতিটি মরুভূমিই কিছু দুর্বোধ্য প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছে সামনে। সব দেখেশুনে বিপন্ন বোধ করছে ইয়াসীন। কত অল্প জানে মানুষ, অথচ জানা বিষয় কী বিশাল!
এই মোযেভ মরুভূমিকেই বা কতটুকু জানা গেছে এ পর্যন্ত? লসএঞ্জেলস এর বাফাম সেলুনে এক লোক তাকে একটুকরো সোনা দেখিয়েছিল। স্যান গ্যাব্রিয়েল পাহাড় থেকে সংগৃহীত। ক্যাম্পকেডির মাইল খানেক দক্ষিণে, একটুকরো অ্যাজেট কুড়িয়ে পেয়েছিল ইয়াসীন। আরও দক্ষিণের একটা ক্যানিয়নে পেয়েছিল দুপ্রাপ্য জেসপার পাথরের কয়েকটি খণ্ড। কতগুলো রুবির টুকরোও পেয়েছিল একবার। পরে জানা গেল ওগুলো আসলে দামী গার্নেট পাথর, রুবি নয়।
একাধিকবার, টহলে বেরিয়ে এমন কিছু ইন্ডিয়ান ট্রেইল ইয়াসীন দেখেছে-যার গন্তব্য আজও অনাবিকৃত। কয়েক জায়গায় দেখা গেছে দুর্বোধ্য সব ইন্ডিয়ান শিলালিপি। কত আগে কারা লিখেছিল ওগুলো-জানে না কেউ। কী লিখেছিল তাও অজানা।
একবার মরুভূমিতে ট্রেঞ্চ খুঁড়তে গিয়ে, কালো মাটির স্তর পেয়েছিল ও। নিকট অতীতে; এখানে শ্যামল অরণ্য ছিল, তার সাক্ষী। সাহারা মরুভূমিতেও পাওয়া গেছে এমনটি। হগারের একটা পাহাড়ের গায়ে বিচিত্র সব ছবি আঁকা দেখেছিল ইয়াসীন। রথটানা ঘোড়া, জিরাফ, জেব্রা এবং আরও অনেক নাম না জানা প্রাণী। ওই মরুভূমিতে এককালে ছিল তাদের কোলাহলমুখর পদচারণা। পরে কোথায় হারিয়েছে! অলৌকিক মরুপ্রেত দখল করে নিয়েছে তাদের বাসস্থান।
জীবনের এসব নির্বাক বিস্ময় বিচলিত করে ইয়াসীনকে। ইতিহাসের অপঠিত অধ্যায়গুলো খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু বিদায় সমাগত। ছেড়ে যেতে হবে তাকে মরুভূমি। সবাইকে সব ছেড়ে যেতে হয়!
আবার কি ফিরে আসবে সে মরুভূমিতে? একবার ছেড়ে গেলে আবার কি, ফিরে আসা হবে? কীসের জন্য ফিরে আসা?
জীবনে অনেক মরুপাগল মানুষ দেখেছে ইয়াসীন। বারবার ফিরে এসেছে তারা। রহস্যময়ী শরীরের লোভ দেখিয়ে, মরুভূমি একে একে কেড়ে নিয়েছে। তাদের সব। সব কিছু।
বিত্ত বসন হতে শুরু করে হৃদয়ের অব্যক্ত প্রেম। হৃদয় সমৃদ্ধ বুকের কংকাল। ঙের অ্যালকহলিক স্বপ্ন। সম্পদ-স্থাবর অস্থাবর, সব!
নগবীর নটিনীর ঘরে গেলেও ফিরে আসার মত অবশিষ্ট কিছু থাকে। কিন্তু মরুভূমি শুধু ডেকে নেয়। একবার তার নেশায় মজে গেলে ফেরা যায় না কিছুতেই।
হেনরীর পায়ের আওয়াজ। পাশে এসে বসল। ‘নতুন কমান্ডিং অফিসারকে দেখেছ?’ প্রশ্ন তার।
‘না’।
‘দেখে নিও। কড়া ইস্ত্রি দেওয়া মাল। কপালে খারাবী আছে আমাদের।’
বিরক্ত হলো ইয়াসীন। তার ভাবনায় ছেদ পড়েছে। সহ্য করতে পারে না সে হেনরীকে। লোকটার কথাবার্তা, চালচলনে একটা খারাপ মতলবের গন্ধ।
‘মরুভূমির কিছু গোপনীয়তা থাকে,’ বলল হেনরী। ‘আর তা দেখার জন্যে পাঁয়তারা করে চলে মানুষ। জুলিয়ানের কথাই ধরো। কিছু একটা খুঁজতে এসেছিল সে এদিকে। আমার মনে হয় খোঁজার মত কিছু সত্যিই আছে এখানে। তুমি আর আমি যদি লেগে পড়ি, তবে পেতেও পারি তা। শক্ত মানুষ আমরা। জুলিয়ানের মত ভুয়া তো নই।’
‘ভুয়া!’
‘আরে ইয়ার-আর্মিতে কোনও কিছু গোপন থাকে না সে তো জানো। দশমুখে কথা ছড়াতে ছড়াতে বেরিয়ে আসে আসল সত্য। জুলিয়ান অফিসার ছিল, ঠিকই, তবে অন্য কোথাও। এখানে এসেছিল ভেজাল কাগজপত্র নিয়ে। আর্মি অফিসারের পরিচয়ে, টহলদলের সহায়তা নিয়ে খুঁজতে এসেছিল কিছু’।
‘নাকি মরতে এসেছিল?’
‘হ্যাহ্’। অসভ্যের মত হাসল হেনরী। ‘কথাটা বিশ্বাস করো তুমি? জন্মস্থানের মত প্রতিটা মানুষের মৃত্যুর স্থানও কি ঠিক করা থাকে আগে থেকে?’
‘না। ওটা কথার কথা। মরুভূমিতে মানুষ সাধারণত অসতর্কতার কারণে মারা যায়। তাই আমি কখনও অসতর্ক থাকি না, হেনরী’।
‘তাই নাকি?’ বিদ্রূপ করে বলল হেনরী। ‘জুলিয়ানের মত অপঘাতে মরতে চাও না বুঝি? জুলিয়ান কি খুঁজতে এসে মারা পড়ল সেটাও বোধহয় জানাতে চাও না আর কাউকে। ঠিক আছে, সতর্কই থেকো, ইয়াসীন। তবে তোমার পিছু আমি ছাড়ছি না সহজে’। কথাগুলো বলে আর বসল না হেনরী।
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ইয়াসীনের। আসলে ঠিক কী খুঁজতে এসেছিল জুলিয়ান জানে না সে। জানার ইচ্ছেও নেই। জুলিয়ানের ম্যাপটা রেখে দিয়েছে সেফ কৌতূহল বশে। ভাল করেনি।
শুধু ছাড়পত্রের অপেক্ষায় বসে আছে ও। বসেই আছে। কারণ পুরোনোদের দলে নতুন সৈন্যদের দিয়ে ডিউটির অভ্যাস করানো হচ্ছে। গত কদিন খুব বেশি দর্শন মেলেনি মেজর সাইকের। অফিসে কাগজপত্রে ডুবে আছে সে।
খুব একটা উৎসাহ পাচ্ছে না মেজর সাইক। সব সাদামাটা দৈনন্দিন রুটিন রিপোর্টে ঠাসা কাগজপত্র। কোথাও যুদ্ধের সংবাদ নেই। কেবল মাঝেমধ্যে সুযোগমত গুলি করে পালিয়ে গেছে ইন্ডিয়ানরা। কিংবা হয়তো ঘোড়া চুরি করে নিয়ে গেছে বা অন্য কোন ভাবে অপদস্থ করে গেছে। বড়সড় লড়াইয়ের কথা লেখা নেই কোথাও।
এখানে রোমাঞ্চকর কোনও কিছু আশা করা বৃথা। শুধু আড়ালে ওত পেতে থাকা শত্রুর জন্যে অপেক্ষা করে যেতে হবে। তারপর সামান্য অসতর্ক হলেই বিরস বদনে গুণতে হবে দু’একটা লোকসান। হয়তো এতটা সহ্য করতে না পেরে দুএকজন সৈনিক পালিয়ে যাবে মাঝেমাঝে। মরুভূমিতে আর্মি ডিউটির চিরাচরিত একঘেয়ে নিয়ম।
অবসর বিনোদনের কোনও ব্যবস্থা নেই। নিকটতম শহর স্যানবার্নারডিনো বা লসএঞ্জেলেস-এ পৌঁছা’নো প্রচুর কষ্ট ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সময় কাটানোর সার্বক্ষণিক সঙ্গী গ্রীষ্মের চাঁদি ফাটানো রোদ, আর শীতের হাড় কাঁপানো হাওয়া।
ক্যাপ্টেন রিচার্ডের রিপোর্ট লেখার স্টাইলটা ভাল লাগল সাইকের। কোথাও শব্দের বাহুল্য নেই। এখানে ওখানে সংক্ষিপ্ত পাদটীকা। ইন্ডিয়ানদের রণকৌশল, কুসংস্কার, খাদ্যাভ্যাস, বিবাহ, মৃতসকার-ইত্যাদি নানান বিষয়ের অবতারণা সেখানে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোযেভদের সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠছে সাইক!
একটা অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল রিচার্ডের। শত্রুর প্রতিটা খুঁটিনাটিতে আগ্রহ ছিল। জেনারেল সিকার্টও পছন্দ করত শত্রু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে। এ ব্যাপারটায় সাইক অবশ্য বেশি আগ্রহ বোধ করে না। তার মতে-শত্রুর ব্যক্তিগত জীবন জেনে যুদ্ধে খুব লাভ করা যায় না।
ইয়াসীনের রিপোর্টটা আগ্রহের সাথে পড়ল সাইক। লোকটা যে অফিসার ছিল তা এই এক রিপোর্টেই বোঝা যায়। বেছে বেছে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে সর্বত্র এবং সেগুলো বোনা হয়েছে দক্ষতার সাথে। ফলে-পুরো ঘটনাই যেন ছবির মত পরিষ্কার ফুটে ওঠে চোখের সামনে। সেই সাথে রয়েছে বিশেষ ব্যাপারগুলোর প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ। যুদ্ধে মোযেভরা কী পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল, আশেপাশের ওয়াটারহোলগুলোর অবস্থান ও অবস্থা কেমন ছিল, ঠিক কোন জায়গায় কীভাবে গুলি খেয়েছিল জুলিয়ান এবং অঞ্চলটার কী কী বৈশিষ্ট্য ছিল, এসব ব্যাপারে যুদ্ধে প্রয়োজনীয় কোনও কিছুই চোখ এড়ায়নি তার।
জুলিয়ানের ব্যাপারটা দুর্বোধ্য। অচিরেই হেডকোয়ার্টার থেকে ব্যাপারটা সম্পর্কে আরও জানতে চাওয়া হবে নির্ঘাত। জুলিয়ানের পুরো ঠিকানা, তার বদলীর কাগজপত্র, সৈন্যদের টহলে নেতৃত্ব দেবার বৈধতা ও তার মৃত্যু সব ব্যাপারে নানান প্রশ্ন আসবে। কোনও তদন্ত টিম আসাও বিচিত্র নয়।
জুলিয়ানের ফাইলটা নিল সাইক। হেডকোয়ার্টার থেকে পাঠানো নিয়োগপত্র ই সবকিছুই আছে তাতে। ক্যাপ্টেন রিচার্ডের সন্দেহ জাগানোর মত কিছু নেই।
জুলিয়ানের সংক্ষিপ্ত মিলিটারি রেকর্ড আছে ফাইলে। ভার্জিনিয়া মিলিটারি কাডেমি হতে কমিশন পেয়েছিল সে। তথ্যটা যাচাই করার কথা ভাবল সাইক।
এর আগে পুবের একটা সেনানিবাসে দায়িত্ব পালন করেছিল জুলিয়ান। সেখানেও খোঁজ খবর করা যায়।
ক্যাপ্টেন রিচার্ড এবং ইয়াসীন-দুজনার রিপোর্টেই বলা হয়েছে, অফিসার হিসাবে যোগ্যতার কমতি ছিল না জুলিয়ানের। অফিসার সে ছিল ঠিকই-তবে হয়তো তার এখানে বদলীর কাগজগুলো ঠিক ছিল না।
কোথাও ক্যু করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল কোনও সুযোগের অপেক্ষায়?
কীসের সুযোগ নিতে সে এই কষ্টকর টহলডিউটি বেছে নিয়েছিল বলা কঠিন। তবে খুব অল্পসময়ে কাজ উদ্ধারের আশা নিয়ে এসেছিল সে। কারণ আর্মিতে এ ধরনের একটা জাল পরিচয় বেশিদিন গোপন রাখা যেত না। এবং সবাই জানত, অল্পদিন পরই মেজর আব্রাহাম সাইক আসবে চার্জ নিতে।
হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠল সাইক। জুলিয়ানও কি জানত তার আগমন সংবাদ? সেজন্যেই সময়টা বেছে নেয়নি তো সে? পকেটে ম্যাচ হাতড়াতে শুরু করল সে।
তারপর পরিচিত কে হতে পারে? একটা জাল পরিচয় মেনে নেবে সাইক, এমন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আর্মিতে কজন আছে তার? নাকি তেমন কোনও কারণ ছিল যা দিয়ে সাইককে মানিয়ে নিতে পারত জুলিয়ান? ব্যাপারটা খুব সতর্কতার সাথে ভাবতে বসল সাইক।
সেনাবাহিনীতে বেশি বন্ধু নেই তার। বাইরেও নেই। বন্ধুত্ব মানে সহঅবস্থান, আর একজনকে নিজের কাছাকাছি ভাবা। চিরকালই উপরতালার মানুষ সাইক। কাছাকাছি হবার মত খুব কম মানুষ পাওয়া যায় অত উপরে। আর্মিতে অবশ্য কিছু নিচুতালার মানুষ বন্ধু ছিল তার। তবে সেটা স্বার্থসিদ্ধির বন্ধুত্ব। পদোন্নতির সাথে সাথে বন্ধুত্বে বন্ধ্যাত্ব এসেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে।
‘ইয়াসীন?’ বাইরে মেজরের গলা। ‘ইয়েস, সার।’ কোয়ার্টার হতে বেরিয়ে এসে স্যালুট করল ইয়াসীন। ‘তোমাকে এখানে পাব আশা করিনি, সার্জেন্ট’।
‘ইয়েস, সার’।
‘ইয়াসীন, শীঘ্রিই আমি জুলিয়ানের ব্যাপারে একটা তদন্ত করতে যাচ্ছি। তোমার রিপোর্টটা দেখা হয়েছে আমার। ওর সাথে আর কিছু যোগ করতে চাও?’
‘নো, সার’।
‘জুলিয়ান কোনও অতি কৌতূহলী প্রশ্ন করেছিল তোমাকে? কোনও নির্দিষ্ট জায়গা বা পাহাড়ের অবস্থান জানতে চেয়েছিল কখনও? বা অন্য এমন কিছু যাতে এখানে তার আসার উদ্দেশ্য আঁচ করা যায়?’
‘নো, সার’।
নিজের কলমটা দিয়ে কয়েকবার চিবুকে টোকা দিল সাইক। ‘তুমি শিওর যে জুলিয়ানের নিয়োগপত্র জাল এবং এখানে অন্য কোনও কারণে এসেছিল সে। কোনও নির্দিষ্ট প্রমাণ কিন্তু নেই তোমার ধারণার স্বপক্ষে’।
‘আরও একটা ব্যাপার আমার ধারণাকে জোরাল করে, সার। সেটা আমি আমার রিপোর্ট পেশ করার পরে জানতে পারি। লস এঞ্জেলস হতে এখানে আসার সময় তার বদলির কাগজ-পত্রের সরকারী ইনভেলপটা অন্য একজন পকেট থেকে বের করে তার হাতে দিয়েছিল। কোনও আর্মি অফিসার তার অফিশিয়াল কাগজপত্র একজন সিভিলিয়ানের কাছে রাখতে দেয় না। এবং সেই নির্দিষ্ট ইনভেলপটাই পরে জুলিয়ান জমা দিয়েছিল ক্যাপ্টেন রিচার্ডের কাছে। এটা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’।
ভাবনা আর একটু বাড়ল সাইকের। ইয়াসীনই বাড়িয়ে দিল। লোকটাকে মনে মনে ঘৃণা করে সাইক। তবে সে যে সুযোগ্য ও বুদ্ধিমান তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আবার অফিসে ফিরে ম্যাপ নিয়ে বসল সাইক। দেখা যাচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক উত্তরে টহল নিয়ে গিয়েছিল জুলিয়ান। তবু আশা পূরণ হয়নি তার।
আশা পূর্ণ হবে না ইয়াসীনেরও। পকেট থেকে তার ছাড় পত্রখানা বের করে ফাইলে রাখল সাইক। আপাতত ওটা ওখানেই থাকবে। এত সহজে তার নাগালের বাইরে যেতে পারবে না ওই বুদ্ধিমান অপসৃষ্টিটা।
নতুন সৈন্যদের পাহারা দেখল ইয়াসীন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ঘোড়ার খোয়াড় দেখতে গেল। এগুলো এখন দায়িত্ব নয় তার। তবু পুরোনো অভ্যাস। তা ছাড়া মেজর সাইকের আনা বিরাট একটা কালো ঘোড়া বশ করছে সে।
ক্যাপ্টেন ম্যালেটের সাথে দেখা সেখানে। ‘খারাপ নয় আগের ঘোড়াগুলো’। মন্তব্য করল ক্যাপ্টেন। তবে কিছুটা রোগা। শুনলাম ভাল কয়েকটা ঘোড়া চুরি করে নিয়ে গেছে ইন্ডিয়ানরা?’
‘ঘোড়ার মাংস প্রিয় ওদের। তা ছাড়া বুলেটের বিনিময়ে বিক্রিও করে।
‘বুলেট পায় কীভাবে?’
‘পেগলেগ স্মিথ ও জিম বেকওয়ার্থের মত কিছু কুখ্যাত ঘোড়াচোরের সাথে লেনদেন আছে ইন্ডিয়ানদের। বুলেটের বিনিময়ে ইন্ডিয়ানদের কাছ থেকে ঘোড়াগুলো বাগায় ওরা। তারপর নেভাডা, অ্যারিজোনা কিংবা আরও দূরের কোনও হাটে বেচে দেয় চড়া দামে’।
অনেক ব্যাপারে তার কাছে প্রশ্ন রাখল ক্যাপ্টেন ম্যালেট। খোলামেলা কৌতূহল প্রসূত প্রশ্ন সব। ক্যাপ্টেনকে ভাল লাগল ইয়াসীনের। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা দীর্ঘকায় ভালমানুষ অফিসার। সেই কারণেই হয়তো পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও ক্যাপ্টেনের সিঁড়িটা টপকাতে পারেনি!
‘তোমাকে প্রয়োজন আমাদের, সার্জেন্ট ইয়াসীন। কিন্তু, বিদায় নেবার সময় এসেছে তোমার। মরুভূমিতে অভিজ্ঞতা আছে এমন মানুষ হারানো বিরাট লোকসান। বিশেষ করে তোমার মত একজনকে’।
কথাগুলো এড়িয়ে গেল ইয়াসীন। বিদায়ের মুহূর্তে এসমস্ত সংলাপ বড় বেদনাদায়ক। দিগন্তে তাকাল সে। দূরে একটা সচল বিন্দু। ক্রমেই বৃহত্তর হতে লাগল সেটা। একটা স্টেজ আসছে ধুলো উড়িয়ে। স্টেজ থামার জন্য নির্ধারিত স্থানের দিকে এগোল ইয়াসীন।
স্টেজ কোচটা আমার ঠিক আগের মুহূর্তে লাফিয়ে নেমে গেল দুজন। ঘাড় খাটো, চিতানো বুকের লোকটা নেমেই দ্রুত এগিয়ে গেল নিকটতম ছাপরাটার ছায়ায়। অন্য লোকটার ভিতরে কোনও তাড়াহুড়ো নেই। তীক্ষ্ণ অথচ অলস চোখে একবারেই সে দেখে নিল সব। ও ধরনের দৃষ্টিতে কিছুই এড়িয়ে যায় না, অভিজ্ঞতা হতে জানে ইয়াসীন। কালো চোখ এবং কালো চুলের ধূসর একজন লোক। মনে রাখতে হবে কথাটা।
‘সী-ন!’ মরীচিৎকার মত সেই কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ চমকে দিল ত্রিভুবন!
স্টেজ কোচ হতে বেলিন্দাকে নেমে আসতে দেখল ইয়াসীন!
<