‘চেনো মেজরকে!’ বিস্মিত ক্যাপ্টেন রিচার্ড।
‘ইয়েস, সার। একাধিকবার দেখা হয়েছে আমাদের। আমাকে তার পছন্দ হয়নি। আমরা ভারতীয়রা বিধাতার অপসৃষ্টি-একথাটা প্রচার করতে ভালবাসে সে’।
‘আমিও শুনেছি কথাটা। আশা করি তার সাথে আর একবার দেখা হওয়ার আগেই তোমার ছাড়পত্র এসে যাবে।’
‘ওতে খুব একটা আসে যায় না, ক্যাপ্টেন। আমরা ভারতীয়রা অনেক সয়েছি বৃটিশদের অত্যাচার। আর একটুতে খুব একটা হেরফের হবে না। তা ছাড়া আমাদেরও নিজস্ব ঘৃণা ভালবাসা আছে।’
‘দেশ ছাড়লে কেন তবে?’
‘অজানার সন্ধানে’।
‘ঐশ্বর্যের সন্ধানে নয়?’
‘এ প্রশ্ন হঠাৎ!’ মনে মনে সতর্ক হয়ে গেল ইয়াসীন।
‘কেন, শোনোনি তুমি? এই মোযেভ মরুতে নাকি লুকানো আছে রাশিরাশি সোনা!’ খাদে নামল ক্যাপ্টেনের গলা।
‘কোথায়?’
‘ওরা বলে সোনার নদী। এই মরুভুমির নীচে কোথাও বয়ে চলেছে। হারিয়ে গেছে বিশাল একপাতাল গুহায়!’
শ্রাগ করল ইয়াসীন ‘ওরকম গল্প সব মরুভূমিরই থাকে। অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা বেরিয়ে ছিল আফ্রিকা বিজয়ে। খৃষ্টানদের কাছ হতে তারা জিতে নেয় সমস্ত উত্তর আফ্রিকা। ফলে, অনেক খৃষ্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে প্রাণ বাঁচায়। কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায় বাকিরা। কেউ মারা পড়ে, কেউ অন্যত্র পালিয়ে যায়, কেউ বা আত্মগোপন করে। ফলে অবশিষ্ট থাকে না কোনও খৃষ্টান। স্রেফ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তারা।
‘ওদিকে আজব সব গল্প তৈরি হলো সাহারা মরুভূমিকে ঘিরে। গভীর রাতে নাকি রহস্যময় গুমগুম শব্দ শোনা যায়। চাঁদনী রাতে ধু-ধু মরুভূমিতে ক্ষণিকের জন্যে দেখা যায় বেপরোয়া ঘোড়সওয়ারদের অপসৃয়মাণ ছায়া। ওখানকার বর্বর আর তুরেগরা কলে-মরুভূমির নীচে নাকি বিশাল সব পাতাল শহর গড়ে তুলেছে খৃষ্টানরা। ওই শব্দ সে সব শহরের। যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে। আর সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আচমকা আক্রমণ করে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলবে মুসলমানদের’।
‘তা হলে তো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে তাদের!’ হালকা গলায় বলল রিচার্ড। ‘তবে মোযেভ মরুভূমির, সব কথাই কিন্তু গুজব নয়। থাকতেও তো পারে তেমন কোনও নদী? যা-মরুভূমির তাপ সইতে না পেরে হারিয়ে গেছে নীচে। হয়তো কেনেও সোনার খনি আছে নদীটার আশেপাশে কোথাও। মোযেভদের কথাই ভেবে দেখো। প্রচুর সোনা ব্যবহার করে ওরা। কোথায় পায়?’
‘বয়সে তুমি যুবক-ইয়াসীন। স্বপ্ন দেখার বয়স তোমার। সুখের স্বপ্ন, ঐশ্বর্যের স্বপ্ন, রাশি রাশি সোনার তূপের সোনালী স্বপ্ন। তোমার বয়েসটা যদি থাকত আমার!’ শেষের দিকে উদাস হয়ে গেল রিচার্ড।
পরের কয়েকটা দিন কাটল সাদামাটা। তিনজনের একটা দল দক্ষিণের ট্রাকগুলোতে টহল দিয়ে ফিরে এল। পুবে বেরোল তিনজনের আর একটা দল। ইন্ডিয়ানদের মুখোমুখি হলো তারা। সামান্য গুলি বিনিময়ও হলো। তবে ঘটনা বলতে যা বোঝায়, ঘটল না তেমন কিছু। কয়েকবার মোযেভদের দেখা গেল ক্যাম্পকেডির আশেপাশে।
দুবার দুটো ওয়াগনের বহর-কলোরাডো যাবার পথে ক্ষণেক থেমে গেল ক্যাম্পে। লা-পাজ এর কাছে একজনের অকালমৃত্যুর দুঃসংবাদ রেখে গেল তারা। শক্তপোক্ত মরুযাত্রী সব কাফেলায় কাফেলায় জীবন কেটেছে তাদের। মরুভূমি আর মোযেভ-দুটোই ভাল চেনে। জানে কী করে ওদের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে হয়। তবু কোনও যাত্রায় কমবেশি লোকসান এড়াতে পারে না। হয়তো ঘোড়া কিংবা ওয়্যাগনগুলো কেড়ে নিল ইন্ডিয়ানরা। কখনও হয়তো ঘোড়া মরূদ্যানে কোনওদিনই পৌঁছা’তে পারল না কোনও মন্দ-ভাগ্য মরুযাত্রী। তবু এগিয়ে যায় ওদের ওয়্যাগনের কাফেলা!
জীর্ণ চেহারা ক্যাম্পকেডির। অনেকদিন আগে কাঁচা ইট গেঁথে কতগুলো ঘর তালা হয়েছিল। সংস্কারের অভাবে তার অধিকাংশ ধসে যাচ্ছে। কখনও কখনও কলোরাডোর অকাল বন্যা এসে চেটে খায় কাঁচা ইটের মেঝে। ধ্বংস ত্বরান্বিত হয়।
কয়েকটা ঘরের অল্পবিস্তর সংস্কার করল ইয়াসীন ও অন্যান্যরা। দুটো কুড়েঘর নির্মাণ করা হলো শুকনো ডালপালা ও পাতা দিয়ে। ঘোড়ার খোয়াড় পরিষ্কার করা হলো। সেনাবাহিনীর একটা বড় দল আসার কথা শীঘ্রিই। কিন্তু এল না। এল না ইয়াসীনের ছাড়পত্র।
সেদিন সামনের চত্বরে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট ঝোঁপগুলো পরিষ্কার করছিল ইয়াসীন। ক্যাপ্টেন রিচার্ড এল পরিদর্শনে।
‘লেফটেন্যান্ট জুলিয়ান সম্পর্কে কিছু বলার ছিল, সার’, তাকে বলল ইয়াসীন।
‘গো অন।’
‘আমার সন্দেহ লেফটেন্যান্টের পরিচয় ভুয়া ছিল।’
‘হোয়াট?’
‘তার চালচলন কথাবার্তা অবশ্য অফিসারের মতই। হয়তো সে অফিসার ছিল অতীতে। তবে এই ক্যাম্পে তার ডিউটিতে আসার অর্ডারটা মনে হয় জাল’।
‘কিন্তু ভুয়া পরিচয় দিয়ে এই মরুভূমিতে চাকুরীর জোয়াল টানতে আসবে কোন বোকা!’
‘জোয়াল টানতে হয়তো আসেনি। কিছু খুঁজতে এসেছিল। ইন্ডিয়ানদের এই এলাকায় কিছু খুঁজতে এলে প্রয়োজন হয় সশস্ত্র সঙ্গী ও পর্যাপ্ত রসদ। আর আর্মি অফিসারের পরিচয়টা দাঁড় করাতে পারলে অনায়াসে মিলে যায় দুটোই’।
‘কিন্তু কী খোঁজার আছে এই নরকে?’
‘কেন, সার? আপনিই তো বলেছিলেন-সোনার নদী আছে এই মরুভূমিতে কোথাও? বয়সে তরুণ ছিল জুলিয়ান। স্বপ্নের বয়স।’
‘আরে ওসব তো কেবল কথার কথা। মরুভূমিতে কিছুই থাকে না। শুধু বালি আর আজগুবী সব গপ্পো ছাড়া।’ অবহেলায় বাতাসে হাত ঝাপটে বলে রিচার্ড।
অবয়বে অব্যক্ত হতাশা!
ঘোড়াগুলো দিনে চলতে দেওয়া হয় ন্যাড়া মাঠটাতে। উইলী পাহারা দিচ্ছিল ওগুলো। ইয়াসীন যোগ দিল তার সাথে। তখনও সকাল।
পাহাড়ের কাজল ছায়া পড়েছে-দূরের ক্যানিয়নগুলোতে। পাহাড়ের চূড়ায় ঝিকমিক করছে রোদ। অপরূপ আলোছায়া। প্রহরে প্রহরে বসন পাল্টায় মরুভূমির পাহাড়। সূর্যোদয়ে একরকম, সম্পূর্ণ আলাদা সূর্যাস্তে।
‘দেশটাকে মাঝে মাঝে খুব ভালবাসতে ইচ্ছে হয়। অবশ্য তোমাদের মিনেসোটা হয়তো আরও সুন্দর’। উইলিকে বলল ইয়াসীন।
‘এর চেয়ে অনেক সুন্দর’। জন্মভূমি সম্পর্কে চিরকালীন সিদ্ধান্তটা জানাল উইলী। ‘সবকিছু অন্যরকম সেখানে। এমনকী সিউ ইন্ডিয়ানরাও’।
‘লেফটেন্যান্ট জুলিয়ানের সাথে এখানে এসেছিলে তুমি, তাই না, উইলী?’
‘সাথে ঠিক নয়। বেলাইউনিয়নে স্টেজকোচের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। এমন সময় অফিসার এল সেখানে। জানাল সে-ও ক্যাম্পকেডির যাত্রী।’
‘কেউ তুলে দিতে আসেনি?’
‘একজন। তীক্ষ্ণ চোখ আর ভাঙা নাক লোকটার। ফিসফিসিয়ে কথা বলে। ভিতরের বুক পকেট থেকে একটা লম্বা খাম দিয়েছিল লেফটেন্যান্টকে। এই ক্যাম্পে বদলির কাগজপত্র ছিল তাতে’।
‘তুমি জানলে কী করে?’ ঝট করে তার চোখে তাকাল ইয়াসীন।
‘ক্যাপ্টেন রিচার্ডের অফিসে নিয়োগপত্র হিসাবে ওই ইনভেলাপটাই দাখিল করতে দেখেছি তাকে আমি’।
‘হয়তো কোনও পাড়া প্রতিবেশী’।
‘নাহ-তার চেয়েও ঢের ঘনিষ্ঠ কেউ। না হলে অফিশিয়াল কাগজপত্র তার কাছে রাখতে দেয়!’
হু-তা হলে জুলিয়ানের বদলির কাগজগুলো ছিল আর একজনের পকেটে!
প্রসঙ্গ পাল্টাল ইয়াসীন। কিন্তু কোনও আলাপই জমল না বেশিক্ষণ। অগত্যা ফিরে এল সে মাঠ থেকে।
কোয়ার্টারে ঢুকেই ধাক্কা লাগল হেনরীর সাথে। চোখ আটকে গেল মেঝেতে ছড়ানো নানান জিনিসপত্রে। ডাফেলব্যাগটা হাঁ হয়ে আছে!
‘কী হচ্ছে এখানে? মরবার জায়গা ছিল না আর?’ ধমকে উঠল ইয়াসীন।
‘তামাকের তেষ্টা পেয়েছিল খুব। ভাবলাম তোমার যদি থাকে-‘
‘থামো। ঠগ কোথাকার। আমি সিগারেট খাই না, ভালভাবেই তুমি জানো’।
জোর করে হাসবার চেষ্টা করল হেনরী। ‘তাইতো! মনেই ছিল না কথাটা’।
‘ফের যদি আমার কামরায় দেখি তোমাকে-বাপের নামটাও ভুলিয়ে ছেড়ে দেব।’
‘ও, কে, সার্জেন্ট। তোমার বাপের নামটাও মুখস্থ রেখো।’ ইয়াসীনকে ঠেলে-বেরিয়ে গেল সে।
কী খুঁজতে এসেছিল হেনরী? সে-ও কি জানে গোপন কোনও তথ্য? নাকি নিছক কৌতূহল।
পর্দার ফাঁক দিয়ে দূরে তাকাল ইয়াসীন। বাইরে একটানা বালি আর রোদ। বাতাস থমকে আছে। মানুষের চিহ্ন নেই কোথাও। তবু ইন্ডিয়ানরা আশেপাশেই আছে। সামান্য সুযোগের অপেক্ষায়। যদি জানত-এখানে সৈন্যের সংখ্যা মাত্র আট!
তদারকির কাজগুলো আজকাল ছেড়ে দিয়েছে ক্যাপ্টেন রিচার্ড। ইয়াসীনই করে দেয় সব। ঘোড়াগুলোকে খোয়াড়ে ফিরিয়ে আনল সে। ডিউটি বেঁটে দিল সৈন্যদের মধ্যে। বেলা শেষ প্রায়।
পাহাড়ের চূড়ায় ঝুলে আছে শেষ বিকেলের সূর্য। তারপর নেই। ঝপ করে নামল রাত। মরুভূমি মুখে টেনে নিয়েছে কালো নেকাব।
রাতের প্রথম প্রহর সামলাবে দুজন। হেনরী আর কিড। আলাদা ধরনের দুই চরিত্র। মরুভূমিতে অভ্যস্ত হেনরী ফাঁকি দেবে না ডিউটিতে। এখানে ডিউটিতে ফাঁকি দেওয়া মানে নিজেরই বিপদ। এতদিনে ভাল করে জেনে গেছে সে। কিড অবশ্য এতখানি উপলব্ধি করে না। প্রয়োজনও মনে করে না। মনে তার একটাই চিন্তা। পালাতে হবে আর্মি থেকে। যত শীঘ্র সম্ভব।
‘ক্যাপ্টেনকে একটু বুঝিয়ে বলো না, সার্জেন্ট! ইয়াসীনকে সেধেছে কিড। এই যুদ্ধ-টুদ্ধ আসলে আমার কম্মো নয়। বউটার উপর মেজাজ দেখাতে চলে এসেছি ঝোঁকের মাথায়। আসলে তো ভালবাসি। ফিরে যেতে চাই।’
করুণ হাসল ইয়াসীন। ‘চাইলেই যদি ফিরে যাওয়া যেত!’
‘মানে? জোর করে রেখে দেওয়া হবে নাকি আমাকে!’
‘এটা গোল্লাছুট খেলা নয়, ম্যান। ইচ্ছে করলেই তুমি থুড়ি বলতে পারো না এখানে।’
‘তা হলে বউ? ছেড়ে দেবেতো আমাকে!’
‘যদি সে ভয় থাকে তবে তুমিই ছেড়ে দাও তার চিন্তা। ভাল থাকবে। লাগাম টেনে ধরো বোকা মনটার। মাঠ থেকে ইচ্ছামত বিদায় নেওয়া যায় না এ খেলায়। শেস পর্যন্ত খেলে, তারপর যাওয়া’।
কোয়ার্টারের সামনে সময় কাটাতে বসে আছে ইয়াসীন। আকাশে চোখ পাছে চাদ। ঘোলা জোছনায় কেমন এলোমেলো মনে হয় সব। দূরে কাছে ছায়ার লুকোচুরি। যেন ওত পেতে আছে কোনও ঘাতক ইন্ডিয়ান। কী অসহ্য নিঝুম, চারদিক!
ইয়াসীনের সাড়া পেয়ে বাইরে আসে রিচার্ড। ‘বুঝি না এই দেশ, এই জীবন। তবু ছেড়ে যাবার কথা মনে হলে বুকের মধ্যে দুঃখের ধস নামে!’ আনমনে বলে সে।
‘যোদ্ধার বেশেই জীবনটা কাটিয়ে গেলেন। তাই না, ক্যাপ্টেন?’
‘তবু যুদ্ধ করা হলো না, এই যা দুঃখ। নইলে আজ জেনারেল হয়ে বিদায় নিতে পারতাম’।
‘মানে?’
‘আর্মিতে ঢুকেছিলাম বড় যুদ্ধটার আগে। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ছিল আমার। রক্তে ছিল প্রলয় মাতন। অথচ সেটা শান্তির সময় একটা ভাল লড়াইয়ের জন্যে আফসোস করে করেই জুড়িয়ে গেলাম। সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় নামলাম।’
‘জেনারেল হপকিন্স্ এর মত?
‘অনেকটা। তবে সঠিক সময়ে আর্মিতে ফিরতে পেরেছিল সে। কিন্তু ব্যবসার লোভ আমাকে লড়তে দিল না। তারপর গেরিলাবাহিনী যখন আমার স্টোরটা পুড়িয়ে দিল, ফিরে আসতে বাধ্য হলাম। আবার তুলে নিলাম রাইফেল আর ইউনিফর্ম। অথচ যুদ্ধের আগুন তখন নিভে গেছে। ফিরে এসেছে শান্তির শীত!’
‘জীবনে উন্নতি করার জন্য যুদ্ধটা হয়তো প্রয়োজন ছিল আপনার। কিন্তু সবাই চায় শান্তি’।
‘শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই যুদ্ধ করে মানুষ। কিন্তু তোমার মুখে এসব কথা কেন, ইয়াসীন? তুমিও তো যোদ্ধা একজন’।
‘পরাধীন দেশে জন্মেছি, সার। জীবন মানেই একটা ক্ষমাহীন যুদ্ধ, আমার কাছে’।
‘মেজর আব্রাহাম সাইককে কতদিন ধরে চেনো?’
‘তা, হবে অনেকদিন। সে-ই তো কর্পোরাল পদ থেকে নামিয়ে দিয়েছিল আমাকে। দু’দুবার’।
‘বিশেষ কিছু ঘটেছিল নাকি?’
‘মনে নেই ভাল। তবে একদিন আগবেড়ে একটু উপকার করতে গেছিলাম তার। কাপড় কাঁচা নিয়ে আন্দাজে ঝগড়া বাধিয়েছিল এক চাইনীজ ধোপার সাথে। অথচ ভাষাটা জানে না সে। আমি এগিয়ে গেছিলাম দোভাষীর ভূমিকায়। তাতে খুশি হবার বদলে উল্টে রেগে গেল আমার ওপর’।
‘দোভাষী? চাইনীজ জানো নাকি তুমি?’
‘সাতটা ভাষা জানি আমি, সার। কিন্তু একজন ভারতীয়র জন্যে সেটাও অপরাধ। অকারণে দুর্ব্যবহার শুরু করল মেজর। সবচেয়ে কঠিন ডিউটিগুলো চাপিয়ে দিলো আমার ঘাড়ে। টেনে যাচ্ছিলাম তবু। কিন্তু মেয়েটা ডুবিয়ে দিল একদম’।
‘মেয়ে!’
‘মরুভূমির ক্যাকটাস ফুলের মত। দুষ্প্রাপ্য, সুন্দর। মেজর সাইক নিমন্ত্রণ করেছিল তাকে। ঘুরে ফিরে দেখছিল সে আমাদের সেনানিবাস। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল হঠাৎ। মেজর ইয়াসীন!-বলে ছুটে এল কাছে।
আমি তো হতবাক। চিনতে পারলাম না সহসা। তারপর নাম বলতেই মনে পড়ল সব। খুব মিষ্টি একটা নাম। বেলিন্দা!
ওর সাথে দেখা হয়েছিল চীনে। সোকাও-এর কাছাকাছি একটা প্যাগোডার পাশে পজিশন নিয়েছিলাম আমরা। এমন সময় সেখানে এল ওরা। বেলিন্দা আর তার বাবা। পালিয়ে এসেছে বিদ্রোহীদের বন্দী শিবির হতে। এমনিতেই শত্রুরা ঘিরে ফেলেছিল আমাদের। তার উপর ক্ষুধার ক্লান্তিতে অবসন্ন দুজন অসহায় মানুষের বোঝা। কিন্তু সার-সেটা ছিল ওয়ার্ডের দুর্ধর্ষ সেনাদল। আর আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমাকে। চীন সাগরের টাইফুন বইয়ে দিয়েছিলাম গোটা অঞ্চলটার ওপর। শত্রুর অবরোধ ভেঙে তছনছ করে বেরিয়ে এসেছিলাম মুক্ত এলাকায়।
চিনতে না পারার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিলাম বেলিন্দার কাছে,। চিনিই বা কী করে! চীনে যখন দেখেছিলাম-ওর চোখে ছিল শরতের চকিত চপলতা। কালে কালে কোথাও উধাও হয়েছে তা! সেখানে ঠাঁই নিয়েছে রহস্য-কাজল শাওন’।
‘ওখানে মেজর ছিলে তুমি? মাইগড! অত ওপরে উঠলে কীভাবে?’
‘ফ্রান্সিস টাউনসেন্ড ওয়ার্ডের আর্মিতে বর্ণভেদ ছিল না ক্যাপ্টেন। পৃথিবীর প্রায় সব জাতির মানুষ ছিল তার বাহিনীতে। দুর্ধর্ষ যোদ্ধা সব। চামড়ার রং সেখানে যোগ্যতার শর্ত ছিল না। যুদ্ধই নির্ধারণ করে দিত কার স্থান কোথায় হবে।’
‘সাইকের সামনেই মেয়েটার সাথে আলাপ হয়েছিল তোমার?’
‘প্রথমে লক্ষ করেনি। পরে দেখতে পেয়ে তো মহাখাপ্পা। একজন সাধারণ সিপাহীর এতবড় স্পর্ধা! তার আমন্ত্রিত অতিথিকে সামান্য সম্মান দেখানো তো দুরের কথা-একেবারে বন্ধুর মত আলাপ! রেগেমেগে তেড়ে আসছিল আমার দিকে। বেলিন্দার অন্তরঙ্গ কণ্ঠস্বর নিভিয়ে দিল তাকে। শতমুখে আমার প্রশংসা করে চলেছে সে সাইকের কাছে।
কিছুক্ষণ পরে সেখানে এলেন বেলিন্দার বাবা। চীনে তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বারবার কৃতজ্ঞা প্রকাশ করলেন তিনি। বেড়াতে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ ওনালেন। ব্যাপার দেখে সরে পড়ল মেজর সাইক।
তার দুইদিন পরে বদলীর আদেশ আসে আমার। পশ্চিমের এক দুর্গম সীমান্ত ঘাটিতে’।
‘মেয়েটা?’ আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করল রিচার্ড।
‘জানি না।’
<