ক্যাম্পের এক প্রান্তে কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন রিচার্ডের অফিস। দরজায় ভারি ক্যানভাসের পর্দা। বিবর্ণ, ধূসর কাঠের দেয়ালে-মলিন কয়েকটা ম্যাপ। খটখটে চেয়ার টেবিলে সরুসরু ফাটল। মেঝেতে কিচকিচ্ করছে হালকা বালুর আস্তর। মরুভূমি উঠে এসেছে এখানেও!

ওধারে বসে আছে ক্যাপ্টেন রিচার্ড। গায়ে ইউনিফর্ম নেই, শুধু গেঞ্জি। এই মাত্র উঠে এল শয্যা ছেড়ে, তার প্রমাণ। মোমবাতির ম্লান আলোয়, তার মুখোমুখি হলো ইয়াসীন।

‘সার’।

‘সংক্ষেপে বলে ফেলো কী হয়েছিল,’ বলল ক্যাপ্টেন।

বেছে বেছে শব্দ প্রয়োগ করল ইয়াসীন। অল্প সময়েই গত কয়েকদিনের সমস্ত ঘটনা জেনে গেল ক্যাপ্টেন। চেয়ার ছেড়ে উঠল সে। চিন্তিত ভঙ্গিতে এগোল দেয়ালের ম্যাপগুলোর দিকে। ‘দেখাতে পারবে ঠিক কোন জায়গায় ঘটেছিল ঘটনাটা?’

‘ইয়েস, সার’। দেয়ালের কাছে এগিয়ে গেল ইয়াসীন। আঙুল রাখল একটা ম্যাপে। এখানে।

‘মাই গড! অত উত্তরে কেন গেল জুলিয়ান! তোমাদের কিছু বলেছিল? তার পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনও আভাস বা অন্য কিছু?’

‘এটা, অন্যান্য বারের মতই একটা রুটিন টহল। এটুকু জানানো হয়েছিল’।

চেয়ারে ফিরে গেল ক্যাপ্টেন। চিন্তিত ভঙ্গিতে তা দিচ্ছে গোঁফে। ‘কতদিন আছ তুমি ইন্ডিয়ান ফাইটিং আর্মিতে?’ ইয়াসীনের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল।

‘তিন বছর সার।’

‘চাকরির মেয়াদ তা হলে তোমার শেষ?’

‘দশদিন বাকি আছে’।

‘সার্ভিস রেকর্ড বলছে, দুবার কর্পোরাল পদ পর্যন্ত প্রমোশন হয়েছিল তোমার। নেমে গেলে কী কারণে?’

‘মারপিট, সার। জাত তুলে গাল দিয়েছিল’।

‘সেনাবাহিনীতে গালি হজম করা শিখতে হয়,’ মন্তব্য করল ক্যাপ্টেন রিচার্ড। তারপর চট করে তাকাল ইয়াসীনের চোখে। ‘অফিসার ছিলে কখনও?’

ক্ষণিক ইতস্তত করল ইয়াসীন। ‘ইয়েস, সার। অন্য আর্মিতে’।

‘ছেড়ে দিলে কেন? সেখানেও গাল দিয়েছিল কেউ?’ তিক্তকণ্ঠে জানতে চাইল রিচার্ড।

‘নো, সার। ভাল লাগেনি, তাই চলে এসেছিলাম। আমি একজন ভারতীয়, সার। বর্তমানে বৃটিশ শাসন চলছে সেখানে। দেশটা থেকেও নেই আমার। অগত্যা ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে যুদ্ধ করি দেশ-বিদেশে। ভাল না লাগলে করি না সে যুদ্ধ’।

‘মিঘেরের বাহিনীতে ছিলে কখনও?’

ইয়েস, সার’

‘দ্যাটস গুড।’ ক্যাপ্টেন রিচার্ডের দৃষ্টিতে প্রশংসা। ‘তা হলে, কিছু জানো মনে হয়। ঠিক আছে, লিখিত রিপোর্ট চাই আমি। আর লেফটেন্যান্ট জুলিয়ানের সব জিনিসপত্র প্যাক করো এখানে নতুন এসেছিল সে। খুব বেশি জানি না আমি তার ফ্যামিলি সম্পর্কে তবে ব্যক্তিগত জিনিসপত্রগুলো পাঠাতে হবে তাদের কাছে’।

‘এক্ষুণি সব করতে হবে, সার?’

ভ্রু তুলল রিচার্ড ‘নো!’ আগে বিশ্রাম প্রয়োজন তোমার ঠিক আছে যাও এখন। তবে অফিসার ছিলে তুমি, সুতরাং রিপোর্ট যেন সেরকমই হয়। মোযেভদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই আমি। ওদের জীবন, ওদের যুদ্ধ, ওদের এই মরুর দেশ, সবকিছু কৌতূহলী করে তোলে আমাকে।

পরদিন দুপুরে ঘুম ভাঙল ইয়াসীনের। ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। ব্যথায় টাটাচ্ছে ফুলে উঠা পা দুটো। চারদিক নিস্তব্ধ। ক্যাপ্টেনকে বাদ দিয়ে আর মাত্র আটজন সিপাহী আছে ক্যাম্পে। তার মধ্যে তিনজনের অবস্থা তারই মত শোচনীয়।

পা দুটোকে যথেষ্ট দয়া দেখিয়ে আস্তে আস্তে বিছানা ছাড়ল সে। ড্রেস করল, শেভ হলো ধীরেসুস্থে। তারপর খেয়েদেয়ে হাজির হলো জুলিয়ানের কোয়ার্টারে।

দরজায় মোটা ক্যানভাসের পর্দা। ভিতরে ঢুকে থমকে গেল ইয়াসীন। ট্র্যাঙ্কটা হাঁ করে খোলা। জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে। তার আগে ঢুকেছিল কেউ ওখানে।

বাইরে বেরিয়ে এল ও। মাটিতে নানা ধরনের পায়ের ছাপ। কোনটা গেছিল। ঘর পর্যন্ত–বোঝা মুশকিল। পাশের কোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন রিচার্ড থাকে। তাকে ডেকে আনল সে।

        ‘চোর!’ ধমকে উঠল রিচার্ড। ‘আটজন মাত্র মানুষ, তার ভেতরেই চোর!’

‘সাতজন সার’। তাকে শুধরে দিল ইয়াসীন। ‘আমার পারমিশন আছে ঢোকার’।

‘ঠিক আছে, দেখছি আমি’। আর কথা না বাড়িয়ে নিজের কোয়ার্টারে চলে গেল ক্যাপ্টেন রিচার্ড।

সাবধানে, জুলিয়ানের জিনিসপত্র গুছিয়ে ট্রাঙ্কে তুলল ইয়াসীন। সম্ভবত খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর সাদাসিধে মানুষ ছিল লেফটেন্যান্ট জুলিয়ান। মরুভূমিতে ডিউটিতে আসা একজন অফিসারের জন্যে কিছুটা বেমানান। কেমন খটকা লাগল তার আবার উল্টেপাল্টে দেখল সে জিনিসগুলো।

প্রতিটা ইউনিফর্ম নতুন। প্রতিজোড়া বুট নতুন। একজোড়া ইউনিফর্ম ও একজোড়া বুট কখনও ব্যবহার করা হয়নি আগে। নিত্যদিনের অপরিহার্য জিনিসগুলোও নতুন কেনা। সদ্য কমিশন প্রাপ্ত অফিসাররাও এভাবে সব নতুন জিনিস পত্র নিয়ে চাকুরীতে আসে না। মরুভূমিতে তো নয়ই। তা ছাড়া, ব্যাচেলর হলে-তাদের সাথে থাকে ছবি, পত্রিকা, বই বা সময় কাটানোর জন্য অন্য কিছু। সে-সব কিছুই আনেনি জুলিয়ান। এমন কী মরুভূমিতে অতি প্রয়োজনীয় একটা বাড়তি সাবানও নয়। বোধহয় জানত-অল্পদিনেই চলে যাবে সে।

একে একে জিনিসপত্রগুলোর একটা ফর্দ তৈরি করল ইয়াসীন। তারপর নিজে নিয়ে আসা ছোট্ট পোঁটলাটা খুলে ঢালল টেবিলের উপর। এগুলোও জুলিয়ানের। তার মৃতদেহ হতে ইয়াসীন সংগ্রহ করেছিল, ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনার জন্য। একটা সোনার আংটি, রুমাল, তিনটে চাবিসমেত একটা রিং ও একটা মানিব্যাগ।

মানিব্যাগটা খুলল সে। ঝনঝন করে দশটা সোনার ঈগল পড়ল টেবিলে। আরিব্বাপ-রীতিমত বড়লোক! মানিব্যাগটা রেখে দিচ্ছিল ইয়াসীন। কী মনে করে আবার হাতিয়ে দেখল। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মোটা মনে হচ্ছে। একটা গোপন পকেট। তার ভিতরে পাওয়া গেল ভাঁজ করা একখণ্ড মলিন কাগজ আকৃতির পাতলা চামড়া।

দুর্বোধ্য আঁকিবুকি তাতে। লাল কালিতে বেশ কয়েকটা গুণ চিহ্ন আর ছোট্ট বৃত্ত। একটু লক্ষ করতে সংকেতগুলো চিনে ফেলল ও। গুণ চিহ্ন পাহাড় আর বৃত্ত ওয়াটার হোল নির্দেশ করছে। মোযেভ মরুভূমির ম্যাপ আঁকা রয়েছে পাতলা চামড়াটায়!

ম্যাপটা অসম্পূর্ণ। ডেথভ্যালি দেখানো হয়নি। যে পর্বতশ্রেণী মোযেভ মরুভূমিকে পশ্চিমের সাগর থেকে বিছিন্ন করেছে তাও অনুপস্থিত। অনেক ছোট ছোট পাহাড় বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে কলোরাডো নদীটা দেখানো হয়েছে নিখুঁত ভাবে। এবং ইয়াসীনরা যে এলাকায় টহলে গিয়েছিল তার উত্তর পুবের মরুভূমি আর পাহাড়গুলো স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত। কৌতূহল জাগানো একটা ম্যাপ। মরুভূমি সম্পর্কে যার বিস্তারিত অভিজ্ঞতা নেই, তার পক্ষে কিছুই বোঝা সম্ভব নয়। হয়তো গোপনীয় কোনও ম্যাপ!

কিছুক্ষণ চিন্তা করল ইয়াসীন। ম্যাপটা ভাঁজ করে রেখে দিল নিজের পকেটে। বাকি সব কিছু ঢুকাল ট্রাঙ্কে। তারপর সেটা বয়ে নিয়ে চলল ক্যাপ্টেন রিচার্ডের কোয়ার্টারে।

‘ওটা তোমার জিম্মায় রেখে দাও,’ বলল ক্যাপ্টেন রিচার্ড। ‘আগামীকাল স্যানবার্নারডিনো যাবে এক মরুযাত্রী। তার কাছে দিও। এই ঠিকানায় পৌঁছে দেবে।’ ঠিকানাটা দিল সে।

        নিজের কোয়ার্টারে ট্রাঙ্কটা নিয়ে চলল ইয়াসীন। ভিতরে ঢোকার মুখে হেনরীর সাথে দেখা।

‘এটা কি জুলিয়ানের ট্রাঙ্ক?’

‘হ্যাঁ। আমার জিম্মায় রাখতে হবে আপাতত’।

‘তারপর?’

‘পাঠিয়ে দিতে হবে একটা ঠিকানায়। তার বোন না কে যেন হয়-তার কাছে।’

‘মাত্র একটা ট্রাঙ্ক। তাও খুব বেশি জিনিস ধরবে না ওতে। এর আগে যে ছাউনিতে ছিলাম, সেখানে পুরো একটা সংসার নিয়ে আসত অফিসাররা। জুলিয়ান একটু অন্যরকম ছিল, কী বলো?’

‘জানি না’।

‘রিচার্ডের সাথে তোমার একটু বেশি মাখামাখি মনে হচ্ছে আজকাল। কী ব্যাপার?’ চোখ টিপল হেনরী।

‘একজন অফিসারের কমতিতে, কিছু অফিসারের কাজ করে দিচ্ছি আর কী’। কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না ইয়াসীন। ঢুকে গেল নিজের কামরায়।

মনে মনে হেনরীকে অপছন্দ করে সে। বেয়াড়া ধরনের আচরণ। শক্ত শরীর। কিছুতেই কাবু হয় না। বুলেটের জখমটা বেশ মারাত্মক ছিল ওর। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেই অবস্থায় লড়ে ফিরে এসেছে। পাওয়েলের মত ভেঙে পড়েনি। এরাই টিকে থাকে। আর যারা টিকে থাকে, তাদের অধিকাংশই মন্দলোক।

ইয়াসীনের মাথায় ঘুরছে ম্যাপটা। ওটার জন্যেই হয়তো গোপনে ঢু মেরেছিল কেউ জুলিয়ানের কোয়ার্টারে। ধারণাটা অমূলক হতে পারে। হয়তো হুইস্কির নেশা চেপে গিয়েছিল কারও। থাকতে না পেরে…

কিন্তু ম্যাপ কেন? সংকেতের সাহায্য নিয়ে আসলে কী দেখানো হয়েছে? আর জুলিয়ানের কাছেই বা তা আসল কীভাবে। সে তো এসেছিল। এ অঞ্চলে জীবনে এই প্রথম! 

এঁকেছে সে-ও খুব ভাল চেনে না অঞ্চলটা। হয়তো একবার মাত্র এসেছিল। পাহাড়গুলো নিখুঁতভাবে আঁকতে পারেনি। অবশ্য কম্পাসের অভাবেও হতে পারে অমন। কলোরাডো নদীর পশ্চিম ও উত্তর দিকটা দেখানো হয়েছে। ক্যাম্পকেডির এই ছাউনি ও তার আশপাশটা বাদ গেছে। খুব প্রাচীন ম্যাপ। এবং সম্ভবত অসম্পূর্ণ।

তা হলে বাকিটা কোথায়? ক্যাপ্টেন রিচার্ডের কথা মনে হলো ইয়াসীনের। মন্দ নয় লোকটা। তবে ঝিমিয়ে গেছে বেশ বয়স আর মরুভূমির সম্মিলিত ফলাফল। ধার নেই তেমন হয়তো ভাল সুযোগ পায়নি ক্যারিয়ার গড়ার। অথবা এসেছিল সুযোগ, চিনতে পারেনি।

সেনাবাহিনী এরকমই। খুব বেশি সুযোগ আসে না তবে বড় যুদ্ধটুব্ধ বাধলে আলাদা কথা। কিন্তু যুদ্ধের কোনও সম্ভাবনা নেই অদূর ভবিষ্যতে। অর্থাৎ রিচার্ডের ভবিষ্যৎও শেষ। বাকি দিনগুলো কাটবে এ ক্যাম্প হতে ও ক্যাম্পে একঘেয়ে, নিরুত্তাপ বড়জোর মেজর পর্যন্ত উঠতে পারে।

রাইফেল আর জুলিয়ানের কাছে পাওয়া পিস্তলটা পরিষ্কার করতে করতে বিকেল হয়ে গেল। মোকাটোকে সাথে নিয়ে ছাউনির বাইরে আসতে হলো ইয়াসীনকে। ক্যাম্পের ঘোড়াগুলোকে নিয়ে এসেছে ওরা। কিছু দূরে একটা ঘেসো মাঠ আছে। খাওয়াতে হবে ঘোড়াগুলোকে।

হেঁটে যাচ্ছে ওরা। বেশ সামনে একটা ঝোঁপ। তার আড়ালে সামান্য নড়াচড়া। সতর্ক হয়ে গেল ইয়াসীন। এদিকে আসে না ইন্ডিয়ানরা। তা হলে কে?

ঝোঁপটার কাছে এগিয়ে এল। নেই কেউ। তবে ছিল। বুটের ছাপ দেখা যাচ্ছে বালিতে। অনায়াসে চিনতে পারল ইয়াসীন। হেনরীর বুটের ছাপ। তাকে আড়াল থেকে লক্ষ করছে হেনরী।

কী চায় হেনরী? ম্যাপটা? সে কি জানে ওটার অস্তিত্ব? নাকি স্বর্ণমুদ্রাগুলোর ধান্ধায় আছে। হেনরীকে খুব ভাল চেনে না ইয়াসীন। সেও এখানে এসেছে অল্পদিন। জুলিয়ানেয় কোম্পানীতে একই সাথে এখানে এসেছিল, আরও দুজনের সাথে। ভীষণ লোভী মনে হয় লোকটাকে।

পৌঁছে গেল ওরা মাঠটাতে। ছোট্ট এক চিলতে জমি। ঘাস বেশি নেই। চারদিকে সেই চিরাচরিত মরুভূমি অথবা পাহাড়। এখানে ওখানে বৃক্ষের হঠাৎ বসত। যেন করুণা করেছে এই রুক্ষ অঞ্চলটাকে।

রোদের তাপ এখনও কমেনি। সবকিছু কেমন কাঁপা কাঁপা। একটা হাওয়ার ঘূর্ণি বালি উড়িয়ে প্রেতের নাচ নাচছে দূরে। আরও অনেক দূরে অস্পষ্ট নীল পাহাড়ের সারি দিগন্তে বিলীন। নিষ্কলুষ আকাশ। অরণ্য নির্বাসিত ঊষর প্রান্তর। তবু কী শান্ত নির্জন। এ-ও এক দেশ। এক আলাদা সৌন্দর্য।

ভালবাসি এই বেঁচে থাকা-মনে মনে উচ্চারণ করে ইয়াসীন।

তবু এখানে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। নইলে বাঁচতে দেয় না মোযেভরা। দোষ মেযেভদের নয়। তারাও যুদ্ধ করে বাঁচে। তারাও ভালবাসে এই রুক্ষ প্রান্তর। এই বেঁচে থাকা!

অবশ্য দিন ফুরিয়েছে ইয়াসীনের। মেয়াদ শেষ হয়েছে চাকুরীর। ভালোলাগার হিসাব যাই হোক-চলে যেতে হবে এদেশ ছেড়ে। চাকুরীর হিসাবে।

আর কয়েকটা দিন বাকি। তারপর? কোথায় যাবে ইয়াসীন? কোথায় ফিরবে? জন্মভূমিতে? অথবা বোস্টনে? নাকি এক রণাঙ্গন হতে আর এক রণাঙ্গনে অব্যাহত থাকবে তার এই ছুটে চলা। এবারে কোন্‌দিকে তা হলে? কোন দেশে?

শুরুটা হয়েছিল ভারতে। বাংলায়।

ইয়াসীন বেগ নামে এক কিশোর নবাব তনয়-বাড়ি হতে পালিয়ে গিয়ে যোগ দিল বৃটিশ সেনাবাহিনীতে। তেমন কোনও কারণ নেই? অথবা ছিল কারণ!

কিন্তু সেই যে গেল-আর ফিরল না পিছনে।

সেনাবাহিনীতে দারুণ দক্ষতা দেখাল দামাল ছেলেটা। সুনজরে পড়ে গেল জেনারেলের। বৃটেনে পাঠিয়ে দেয়া হলো তাকে, রানীর গার্ড রেজিমেন্টের জন্য। পড়াশুনার সুযোগ দেওয়া হলো।

সুযোগের সদ্ব্যবহার করল ইয়াসীন। একজন তরুণ অফিসার হিসেবে যোগ দিল ফ্রান্সিস টাউনসেন্ড ওয়ার্ডের সেই বিশ্বখ্যাত সেনাদলে। যুদ্ধ করতে চলে গেল সুদূর সাংহাই।

মোকাও দখল করার পর অকস্মাৎ দুঃসংবাদ এল ভারত হতে। সিপাহী বিদ্রোহের কারণে সেখানে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্যকে। ভীষণ চোট লাগল মনে। ছেড়ে দিল সে বৃটিশ সেনাবাহিনী। লুকিয়ে উঠে পড়ল সমুদ্রগামী এক জাহাজে।

কোথায় যাবে ঠিক নেই কোনও।

বন্দর আব্বাসে হঠাৎ নেমে গেল জাহাজ হতে। পারস্য অতিক্রম করে-হাজির হলো আফগানিস্তান। যোগ দিল বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে।

কিন্তু নানান বিশৃংখলতার কারণে বেশিদিন টেকা গেল না। পালাতে হলো।

তারপর হাজার মাইল খাঁ খাঁ মরুভূমি পাড়ি দিয়ে-উত্তর আফ্রিকা!

সেখানে তখন যুদ্ধ করছিল ফ্রান্সের সেনাবাহিনী। তাদের দলে যোগ দিল ইয়াসীন। না দিয়ে উপায় ছিল না। পকেটে পয়সা নেই। যুদ্ধ ছাড়া জানা নেই অন্য কিছু।

অল্পদিনেই ইয়াসীনের প্রতিভার পরিচয় পেল তারা। ওকে ক্যাপ্টেনের র‍্যাংক দেওয়া হলো। কিন্তু সে যুদ্ধটাও ভাল লাগল না বেশিদিন।

তাই আমেরিকার উদ্দেশে পাড়ি জমাল সে। এখানেও যোগ দিল সেনাবাহিনীতে। যুদ্ধ করে ফিরতে লাগল এক রণাঙ্গন থেকে আর এক রণাঙ্গনে।

‘ইয়াসীন!’ ক্যাপ্টেন রিচার্ডের গলা চমকে দিল তাকে। কখন যেন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এসেছে ক্যাপ্টেন।

‘ইয়েস, সার’।

‘ফিরে গিয়ে কী করবে?’

‘জানি না, সার’।

‘টাকা পয়সা জমেছে কিছু?’

‘সামান্য’।

‘তা হলে কোনও ব্যবসায় নামতে পারো। লাস ভেগাসে আমার ভাইয়ের একটা হোটেল ব্যবসা আছে। তুমি বললে তার কাছে একটা চিঠি লিখে দিতে পারি’।

‘ভেবে দেখি, সার’।

‘ভাববার খুব একটা সময় নেই। মাত্র কয়েকটা দিন বাকি আছে তোমার। আমিও চলে যাব এখান থেকে। বদলির আদেশ এসেছে আমার’।

‘সার?’

‘হ্যাঁ। নতুন কমান্ডিং অফিসার একজন মেজর। মেজর আব্রাহাম সাইক’।

নামটা শোনার সাথে সাথে চোয়াল শক্ত হলো ইয়াসীনের। ‘তাকে চিনি, সার।’

<

Super User