পর্বতমালার প্রান্তছোঁয়া একটা প্রকাণ্ড মাঠের-দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ওয়ারেন র‍্যাঞ্চ; জড়াজড়ি করে দাড়ানো কয়েকটা দালানকোঠা। উইলো ঝোঁপের মাঝে একেবেঁকে বয়ে যাওয়া একটা ক্ৰীকের ধারে ঘোড়া বাধলো কলিন ফোর্বস, তারপর পায়ে হেঁটে র‍্যাঞ্চ হাউসের দিকে এগোলো। আসার পথে কোথাও অযথা সময় নষ্ট করেনি ও, তাই আশা করছে ওয়ারেনদের আগেই পৌঁছুতে পেরেছে।

এখন মাঝরাত হলেও র‍্যাঞ্চ হাউসের জানালায় আর বাংক হাউসে আলোর আভাস। ওয়ারেন রাইডারদের কেউ হয়তো এখনো জেগে, র‍্যাঞ্চ হাউসে যেই থাকুক এখনো বিছানায় যায়নি।

বারান্দায় উঠে এলো কলিন, চুপচাপ দাড়িয়ে কান পাতলো দরজায়, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলো না। দরজায় টোকা দিলে ও, একই সঙ্গে পিস্তলের দিকে এগিয়ে গেল হাত। ওয়ারেনের ছেলে বিল যদি দরজা খুলে দাড়ায় কি করতে হবে জানে না ও। মিসেস ওয়ারেন দরজা খুললেই বা কি করবে? কি যেন নাম মেয়েটার? ও হ্যাঁ, হেলার বলেছিলো, লিনডা। ওর চেনা লিনডা?

কিন্তু সাড়া দিলো না কেউ।

আবার টোকা দিলে। কলিন, অপেক্ষা করলো, হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করলো ও। শিরদাড়ার কাছে টনটন করছে, খিল ধরেছে যেন পায়ের পেশীতে। বিশ্রাম না নিলে আর হচ্ছে না, শরীর মন দুটোই একটু আরামের জন্যে আঁইঢাই করছে।

কে? দরজার ওপাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। বিড়বিড় করে অস্পষ্ট একটা জবাব দিলো কলিন, আশা করলে। এতে কাজ হবে। হলোও। খুলে গেল দরজা। এবং অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো ও-পাশের মেয়েটি, বোঝা যাচ্ছে বিস্ময়ের একটা ধাক্কা খেয়েছে, একটা হাত তুলে আনলো সে মুখের কাছে। তুমি তুমি এখানে?

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি? তোমাকে এখানে দেখবে কল্পনাও করিনি হেলারের কাছে নাম শুনে সন্দেহ জেগেছিলো, কিন্তু বিশ্বাস করি নিঃ অনেকদিন পর দেখা, তাই না? কেমন আছো তুমি?

ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো কলিন ফোর্বস, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কামরার ওধারে একটা পিঠ উঁচু চেয়ার, উল্টোদিকে ফেরানো, ওটার পেছনে কেউ লুকিয়ে থাকতে। পারে। দুটো লণ্ঠন জ্বলছে কামরায়, পিয়ানো আর টেবিলের ওপর।

কলিন ফোর্বস? ফিসফিস করে বললো লিনডা ওয়ারেন, তুমি–

হ্যাঁ, ড্যানিয়েল ফোর্বস আমার বাবা, আমি আবার ফিরে এসেছি।

ভালো করে লিনডার দিকে তাকালো কলিন। তেমন বদলায়নি মেয়েটা, চেহারায় সামান্য মলিনতা এসেছে কেবল। তেমনি আছে মধুরঙা রেশমী চুল, নীল দুটো চোখ, মাখনের মতো মসৃণ ত্বক। কোমরের কাছে চাপা সার্টিনের পোশাক ওর পরনে, মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে ওটার ঝুল। ওকে দেখে মনে হয় না ও শোবার আয়োজন করছিলো। কোনো পুরুষকে আকৃষ্ট করতে কিংবা অন্য মেয়ের মনে ঈর্ষা জাগাতেই এ-ধরনের পোশাক পরা হয়। এ বোধ হয় নিজেকে খুশি করতেই পরেছে, ভাবলো কলিন। হেলারের কথা সত্যি হলে দামী পোশাক-আশাক দেখানোর সুযোগ মেলে না, ওর।

লিনডার সঙ্গে পরিচয়ের কথা ভাবলো কলিন।

সে বছর সিনডিকেটের কাজে ওয়াইমিং থেকে ক্যানসাস সিটিতে গিয়েছিলো ও। একদিন সন্ধ্যায় রেস্তরাঁয় সাপার সারছে, হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এলো, চমকে উঠলো ও, চট করে বাইরে বেরিয়ে এলো। তিনজন ষণ্ডা ধরনের লোক এক তরুণীকে টেনে হিচড়ে কাছেই দাড় করানো একটা ব্যাক বোর্ডে তুলতে চাইছে। ব্যাপার কি চট করে বুঝে নিলো কলিন। সময় নষ্ট না করে দ্রুত ছুটে গেল ও। সবচেয়ে কাছের লোকটার কলার জাপটে ধরলো ওর হাত, হ্যাঁচকা টান মারলো, এলোপাতাড়ি পা ফেলে বাকবোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো লোকটা। সঙ্গীকে আক্রান্ত হতে দেখে মেয়েটিকে ছেড়ে ওকে মোকাবিলা করতে একসঙ্গে, তেড়ে এলো অন্য দু’জন। দেরি করলো না কলিন, ওর দু’হাত বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেল দুই গুণ্ডার চোয়াল বরাবর। প্রচণ্ড আঘাতে চমকে উঠলে ওরা। সুযোগটা লুফে নিলে কলিন। চট করে সামনে বেড়ে দু’হাতে দু’জনের চুল মুঠি করে ধরে মাথা দুটো ঠুকে দিলো পরস্পর। নির্দ্বিধায় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো ওরা। এবার মেয়েটার দিকে দৃষ্টি দিলো কলিন। এক পাশে দাড়িয়ে আতঙ্কে থরথর কাপছে বেচারা চেহারা দেখে বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে, পরনে দামী পোশাক। ওর দিকে এগিয়ে গেল কলিন। ভয় নেই, বললো ও, কোথায় যাচ্ছিলে, চলো পৌঁছে দিই।

বা-বাসায়। অনেক কষ্টে মুখ খুললো মেয়েটি, এক বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম, গলা কাঁপছে, স্যালুনের সামনে আসতেই আচমকা ঝাপিয়ে পড়লো ওরা…এমন কিছু ঘটবে ভাবিনি…আমি.. আমি..মানে…।

ভুলে যাও, বললো কলিন, চলো,তোমাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিচ্ছি।

চলো। তিন গুণ্ডাকে শেরিফের হাতে সোপর্দ করার ব্যবস্থা করে তারপর এগোলে। ওরা।

আমার নাম লিনডা ওয়াইলড, পরিচয় দিলো মেয়েটা, জন ওয়াইলড আমার বাবা, শহরের সবাই এক ডাকে চেনে ওকে।

নিজের নাম বললে কলিন। তাহলে তো তোমার ওপর হামলা হবাব কথা নয়, বোধ হয় চিনতে পারেনি।

এই ঘটনার পর আর মাত্র একবার দেখা হয়েছে ওদের। তারপর আবার ওয়াইওমিংয়ে ফিরে গেছে কলিন। এতদিন নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় ওর কথা এক রকম ভুলেই গিয়েছিলো।

বর্তমানে ফিরে এলো কলিন ফোর্বস। লিনডার দিকে তাকালো। কিন্তু ও এখানে এলো কিভাবে?

এখানে এসেছো কেন? জানতে চাইলে লিনডা।

মুখে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করলে কলিন, বললো, উত্তেজিত হয়ো না, রবার্ট ওয়ারেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম আমি। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি, তুমি ওর সঙ্গে জড়ালে কি করে? 

জানালো লিনডা। বাবার কারণেই আজ ওর এ-অবস্থা। বছর খানেক আগে ক্যানসাস সিটিতে গেলে বাবার সঙ্গে পরিচয় হয় রবার্ট ওয়ারেনের। ওয়ারেনের কেতাদুরস্ত চালে মুগ্ধ হয়ে মেয়েকে ওর হাতে তুলে দিয়েছে জন ওয়াইলড। বিয়ের পর ক্যানসাস সিটি ছেড়ে এখানে চলে আসতে হয়েছে ওকে।

ক্যানসাস সিটির তুলনায় আমাদের বেসিন তোমার কাছে মৃত্যু পুরীর মতো লাগার কথা?

মৃদু হাসলো লিনডা। স্বাভাবিক কি আছে এখানে আমাকে মুগ্ধ করার মতো?

ঠিক কোন জিনিসটার অভাব বোধ করছো তুমি? জানতে চাইলে কলিন।

আনন্দ। কত মজাই না ছিলো ওখানে। আর এখানে-কথা বলবে, একটা বন্ধু পর্যন্ত নেই–ছেলে বা মেয়ে–কেউ না।

তুমি এখানে আছো জানলে আরো অগেই ফিরে আসতাম আমি।

লিনডা খুশি হয়েছে বলে মনে হলো, হাসলো ও, বিস্ময়ের ছাপ বিদায় নিয়েছে চেহারা থেকে।

কফি আছে? জিজ্ঞেস করলো কলিন।

আছে, কিন্তু ঠাণ্ডা।

তাই দাও।

একটু দাড়াও, বললো লিনডা। এখুনি আনছি।

রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল লিনডা। একটু পরেই দু’কাপ কফি নিয়ে ফিরে এলো। এক কাপ কলিনকে দিলো।

কফিতে চুমুক দিলো ওরা। ক্যানসাস সিটিতে যদি ফিরতে পারতাম, লিনডার কণ্ঠে হতাশা, আর কিছু চাইতাম না। এখানে আমার দম আটকে আসছে!

গেলেই পারো?

টাকা? রবার্ট একসঙ্গে বেশি টাকা দেয় না আমাকে।

কত টাকা লাগবে?

দেবে তুমি? কমপক্ষে পাঁচশো ডলার!

গম্ভীরভাবে মাথা দোলালো কলিন ফোর্বস। হেলারের কাছ থেকে পাঁচশো ডলার আদায় করা কঠিন হবে না। টাকাটা নিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়। লিনডাকে এই নিরানন্দ একঘেয়ে জীবন থেকে উদ্ধার করে ক্যানসাস সিটিতে ওর আপন পৃথিবীতে ফিরে যেতে সাহায্য করে একই সঙ্গে রবার্ট ওয়ারেনকে আঘাত করতে পারে। লিনডাকে পালাতে সাহায্য করে খবরটা ওয়ারেনের কানে পৌঁছে দিলেই হবে। ওয়ারেনের ঘরে সুখী নয় লিনডা, বরং বলা যায়বিপদেই আছে। মেয়েটিকে বিপদ থেকে বাঁচানোয় দোষের কিছু নেই। অতীতে একবার ওর বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ছিলো সে। ওকে এখানে দেখে এবারও নিশ্চয়ই সাহায্য আশা করবে মেয়েটা। ক্যানসাস সিটিতে ফিরতে চায় লিনডা, অথচ এক অর্থে ওকে আটকে রেখেছে ওয়ারেন কিন্তু লিনডা তার বিবাহিত স্ত্রী…উঁহু, বিয়ে করলেও ওকে স্ত্রীর পূর্ণ মর্যাদা দেয়নি সে, লিনডার কথাতেই তা বোঝা যায়…তবে… চট করে চিন্তাটা দূর করে দিতে চাইলো কলিন। বাঁকা পথে লড়াই করার সময় এখনো আসেনি।

আমাকে যেভাবে পারে, পাঁচশো ডলার যোগাড় করে দাও, কলিন, আবেদন ঝরলো লিনডার কণ্ঠে, উদ্ধার করে এ-নরক থেকে।

ঠিক আছে, বললো কলিন। ভেবো না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

হঠাৎ বাইরে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনা গেল, ক্রমশ বাড়ছে। তিনসঙ্গীসহ ফিরে আসছে রবার্ট ওয়ারেন।

ঘোড়ার খুরের শব্দ লিনডাও শুনেছে। ঝট করে দরজার দিকে তাকালো সে।

পালাও, কলিন! রুদ্ধশ্বাসে বললো। পিস্তলের দিকে হাত বাড়ালো কলিন। না, লিনডা।

কিন্তু ওরা এসে

একসঙ্গে ঢুকে পড়বে সব কটা?

রবার্ট, আর বিল। কিন্তু—

ওদের সঙ্গে দেখা করতেই তো আমার এখানে আসা। কলিনের হোলসটারে রাখা পিস্তলের দিকে তাকালো লিনড, একটু যেন শিউরে উঠলো।

আলাপ করতে, লিনডা, হত্যা নয়।

কিন্তু ওরা—

ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছে কলিন, তবু হাসতে চেষ্টা করলো।

এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, বললো ও, তুমি ঘরে চলে যাও। আমি রইলাম এখানে।

না!

উঠোনে পৌঁছে গেল ওয়ারেনরা। এক এক করে স্যাডল থেকে। নামছে। চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে কলিন, দেরি নেই, এখুনি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলে রবার্ট ওয়ারেন আর তার ছেলে।

লিনডা, বললে কলিন, ঘরে যাও।

না। আমাকে দেখলে গোলাগুলি করবে না ওরা।

কিন্তু তুমি ওদের সতর্ক করোনি বলে প্রশ্ন উঠবে। আমার কাজ আমি বুঝি, লিনডা, তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো। আমি রবার্টের সঙ্গে একটু আলাপ করে ফিরে যাবো, ব্যস।

কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই—

না। কই, গেলে? তাড়াতাড়ি করো!

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরে দাড়ালো লিনডা। বারান্দায় পায়ের আওয়াজ পেলো কলিন। উল্টোদিকে ফেরানো পিঠ উঁচু চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গেল ও, বসে পড়লো। লিনডার ঘরের দরজা বন্ধ হলো, একই সঙ্গে খুলে গেল বারান্দার দরজা। কামরার ভেতর পায়ের আওয়াজ। দরজা বন্ধ হবার শব্দ।

বাতি জ্বলছে, গজগজ করে উঠলো রবার্ট। কিন্তু লিনডা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। বাতি নেভায়নি কেন বুঝলাম না যে কোনো মুহূর্তে বিপদ হতে পারে?

ওর মাথায় ঘিলু বলে কোনো পদার্থ আছে নাকি! জবাব দিলো আরেকটা কণ্ঠস্বর।

চুপ, বিল। ধমকের সুরে বললো ওয়ারেন।

কিভাবে যে তোমায় বোকা বানিয়ে রেখেছে সে, আবার বললো বিল, পরে টের পাবে।

ধেত্তের, বললাম না, চুপ করো! গর্জে উঠলো রবার্ট ওয়ারেন।

কামরার আরো ভেতরে এলো ওর। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো কলিন, মুখোমুখি হলো ওদের, আগেই পিস্তল তুলে নিয়েছে হাতে। ওয়ারেনকে কাভার করলো ও, সামান্য নোয়ালো ব্যারেলটা।

তুমি নাকি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও? বললো ও, আমি এসেছি।

যেন নিজের বাড়ি, কাকে বলে ঢুকেছো তুমি? চিৎকার করে বললো ওয়ারেন।

তুমি রেগে যাবে ভাবিনি, বললো কলিন, দুঃখিত।

লাল টকটকে চেহারা ওয়ারেনের, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ মোটা, ঘন ভুরুর নিচে প্রায় ঢাকা পড়েছে চোখ দুটো, চৌকো চোয়াল, এক গুয়ে একটা ভাব চেহারায়। হাপাচ্ছে রবার্ট ওয়ারেন। নিজের ঘরে হঠাৎ অন্য লোকের উপস্থিতিতে কিছুটা হতবাক।

ওর ঠিক পাশে বিল, একটু সামনে ঝুঁকে আছে, আড়ষ্ট। বাপের ক্ষুদ্র সংস্করণ যেন, রবার্ট ওয়ারেনের চেয়ে একটু লম্বা, কিন্তু অতটা ভারি নয় শরীর, শুকনো চেহারা, কিন্তু বাপের মতোই একগুয়ে ভাব। হেলার বলেছিলো ছেলেটি নাকি সুদর্শন, হাসলে হয়তো ভালোই লাগবে। হেলার অবশ্য বিলকে বিপজ্জনক মনে করেনি, কিন্তু কলিনের বিশ্বাস, বিল রবার্ট ওয়ারেনের মতোই বেপরোয়া লোক।

তোমার নাম জানতে চাওয়ার দরকার আছে আর? জিজ্ঞেস করলো রবার্ট ওয়ারেন।

আমার ধারণা ওটা জানতে বাকি নেই তোমার।

তোমার বাবার প্রতি আমার কোনো ঘৃণা ছিলো না, ফোর্বস। ওর সাথে নানা ব্যাপারে আমার অমিল ছিলো বটে, অনেক ব্যাপারে ওর বিরোধিতা করেছি, লড়াই করেছি, কিন্তু কখনো ঘৃণা করিনি।

কিন্তু বাবাকে তুমি হত্যা করেছে।

না, আমি হত্যা করিনি। তোমার বাবা যেদিন আহত হয়, আমিও ছিলাম প্যসিতে, ওর গায়ে কার গুলি লেগেছে জানতে পারিনি আমরা আজও।

হামলাটার কথা একটু শোনাও।

ওটা হামলা ছিলো না, চট করে বললো ওয়ারেন। ফোর্বস রাঞ্চে শেরিফের প্যসি গিয়েছিলো, তোমার বাবা শেরিফের কতৃত্ব অস্বীকার করেছে, প্যসিকে র‍্যাঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে হুকুম দিয়েছে। শেরিফ ওর নির্দেশ অমান্য করায় গুলি ছুড়তে দ্বিধা করেনি।

তাহলে বাবার র‍্যাঞ্চে প্যসি যাবার কারণটাই বলো, বললো কলিন।

মাথা দোলালো ওয়ারেন, বললো, ফোর্বস, আর সবার বেলায় যেমন ঘটে, তোমার বাবার সঙ্গেও আমার নানা বিষয়ে মতের অমিল ছিলো। আমি আমার কথায় অনড় থেকেছি, তোমার বাবা তারটায়। অসংখ্যবার আমাদের দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়েছে, কিন্তু স্ট্যামপিড না ঘটলে ব্যাপারটা কিছুতেই এতদুর গড়াতে না। গভীর ক্যানিয়নে একসঙ্গে পনেরো শ’ গরুর একটা পাল পিছলে পড়ার পর কি অবস্থা হয়েছিলো যদি দেখতে। ক্লেব্যাংকসের ওপর থেকে এ নিদারুণ দৃশ্যটাই দেখতে হয়েছে আমাকে!

কিন্তু সেজন্যে আমার বাবাকে দায়ী করছো কেন?

গরুর পাল পাহারা দেয়ার জন্যে আমার দুজন লোক ছিলো। দুজনই তোমার বাবা আর ভাইকে দেখেছে। আরো তিনজন লোক ছিলো ওদের সঙ্গে।

ওরা সত্যি বলেছে তার কোনো প্রমাণ আছে?

ওরা মিথ্যে বলেনি। কিন্তু ব্যাপারটা আরো জটিল। তোমার বাবা আর ভাই ফিরে আসার সময় ডেনিস স্মিথ দেখেছে ওদের, স্ট্যামপিডের ঘটনাস্থলের কয়েক মাইলের মধ্যে ডেভিড স্পেক্টরও দেখেছে তোমার বাবাকে।

তবু আমি বিশ্বাস করি না, বললে কলিন।

কিন্তু এটাই সত্যি। সময় পেলে স্মিথের সঙ্গে আলাপ করো, জিজ্ঞেস করে দেখো ডেভিড স্পেক্টরকে। বেলিনতা গ্রেবারের র্যাঞ্চে পাওয়া যাবে ওকে। শেরিফের কাছে দেয়। ওদের জবানবন্দী জেনে নাও।

ঠিক আছে, তাই নেবো।

বেশ। তা, এবার পিস্তলটা হেলসটারে রাখলে হয় না? কয়েক টা ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চাই আমি। পিস্তলের মুখে কথা বলতে আমার অস্বস্তি লাগে।

ওর কোনো দরকার আছে এখানে? বিলের দিকে ইশারা করলো কলিন ফোর্বস।

বিল, বললো ওয়ারেন, তুমি আমাদের আলাপে বাগড়া দিতে এসো না। বেসিনে আর রক্তপাত চাই না আমি।

বাগড়া দেয়ার ইচ্ছে আমারও নেই, তিক্ত কণ্ঠে বললে বিল। তবে একটা কথা মনে রাখতে বলি, লাশ ছাড়া ফোর্বসদের বিশ্বাস করা ঠিক হবে না!

ফায়ারপ্লেসের দিকে এগিয়ে গেল সে, ঠেস দিয়ে দাড়ালো। বাপ বেটার মাঝখানে পড়ে গেল কলিন।

এখানে ঝামেলা করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না রবার্ট ওয়ারেন, নিজেকে আশ্বস্ত করতে চাইলো ও। লোকজন ভালো চোখে দেখবে না সেটা। আমাকে মারতে হলে অন্য কোথাও কাজটা সারবে সে, যাতে সবাই জানে লড়াই শুরু করার জন্যে আমিই দায়ী। হত্যার সময় বাইরের লোকের সাক্ষীরও দরকার হবে তার। কাধ ঝাঁকিয়ে পিস্তলটা খাপে ঢোকালে কলিন।

শুরু করো, ওয়ারেন, বললো ও, বলো, কি বলবে।

তুমি বেসিনে ফিরে এলে কেন?

বাবা আর ভাই মারা গেছে খবর পেলে তুমি কি করতে?

পকেট থেকে সিগার বের করলো রবার্ট ওয়ারেন, দাঁত দিয়ে গোড়া কেটে ফেটে ঝোলালে, অগুন জ্বেলে টান দিয়ে মাথা দোলালো। হ্যাঁ, আমিও হয়তো তোমার মতোই করতাম। আচ্ছা, শুনলাম ওয়াইওমিংয়ে নাকি বেশ ভালো একটা চাকরি করছো তুমি।

        হ্যাঁ, করতাম।

        এখন কি ফিরে যাবে আবার ওই কাজে?

        না, এখানে থেকে ফোর্বস র‍্যাঞ্চ চালাবো।

        ভুরু কোচকালো ওয়ারেন। কিন্তু আমি কিনতে চাই যে র‍্যাঞ্চটা। কথাটা হয় তো তোমার পছন্দ হচ্ছে না, পরোক্ষে হলেও ড্যানিয়েলের মৃত্যুর জন্যে আমি কিছুটা দায়ী, এখন আবার র‍্যাঞ্চ কেনার কথা বলছি-সন্দেহজনক, না? আসলে অনেক দিন থেকেই জায়গা খুজছি আমি, তোমাদের র্যাঞ্চটা আমার পছন্দ, যত দাম চাও দেবো।

র‍্যাঞ্চ আমি বিক্রি করবে না।

কি বলছো? ওয়াইওমিংয়ের চাকরিটা সত্যিই ছেড়ে দেবে?

ছেড়ে দিয়েই এসেছি।

ভালো করে ভেবে দেখলে হতো না?

ভেবেই বলছি।

কাজটা ঠিক হচ্ছে না।

আমার ধারণা অন্য রকম।

সেটা ভুল, বললে ওয়ারেন, তীক্ষ্ণ শোনালো তার কণ্ঠস্বর। এতক্ষণ বেশ অমায়িক ছিলো লেকটার আচরণ, কিন্তু এখন বদলে যাচ্ছে তার হাবভাব, দৃষ্টি কঠিন।

আমার বিশ্বাস, আবার বললো ওয়ারেন, তুমি ভুল করছে, ফোর্বস, এবং তোমাকে তা শোধরাতে হবে। আমার র‍্যাঞ্চ ছেড়ে যাবার আগেই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আমার কাছে তোমাদের র‍্যাঞ্চ বিক্রি করে ওয়াইওমিংয়ের পুরোনো চাকরিতে ফিরে যাবে তুমি।

সোজা হয়ে দাড়ালো বিল ওয়ারেন, হাসছে, দুহাত ঘষতে ঘষতে মাথা দোলালো সে।

কলিনের শিড়দাড়ার কাছটায় শিরশির করে উঠলো। এখনো সশস্ত্র ও। শক্তির পাল্লা সমান। পিস্তলে ওর হাত চালু, কিন্তু ওয়ারেন আর বিলের মাঝখানে বিস্তর ফারাক, দুজনকে এক সাথে কাভার করা যাবে না। ব্যাপারটা ড্রয়ের দিকে গড়ালে ঠিক মরতে হবে।

কি করতে হবে শোনো, ফোর্বস, খেই ধরলে। রবার্ট ওয়ারেন, আজ, এখুনি একটা কাগজে সই দেবে তুমি, তোমার র‍্যাঞ্চ আমার কাছে বিক্রি করছে লেখা থাকবে তাতে; তারপর কাল সকালে গরে গিয়ে লেনদেন চুকিয়ে ফেলবে। আমরা, এবং পরশু তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওয়াইওমিংয়ের পথ ধরবে তুমি। পরিষ্কার?

ভেবে দেখতে দাও, বললে কলিন, সময় পেতে চাইছে।

ভাবনার কিছু নেই, প্রায় খেকিয়ে উঠলো ওয়ারেন, আমি তো বিকল্প কিছু দেখছি না। যা বলছি তাই করতে হবে তোমাকে।

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালে কলিন ফোর্বস। ওয়ারেন চমৎকার বুদ্ধি বের করেছে। ওয়ারেনের কথায় রাজি হয়ে কাগজে সই দিলে ওকে সে আটকে রাখবে সারারাত, সকাল হলে ওয়াগোনারে নিয়ে যাবে, সবার সামনে ওর হাতে দলিলে সই করিয়ে বিক্রিটাকে বৈধ রূপ দেবে, তারপর বেসিন থেকে চির বিদায় জানানো হবে ওকে। লোকে জানবে স্বেচ্ছায় সম্পত্তি বিক্রি করে চলে গেছে কলিন ফোর্বস। এরপর উপত্যকায় আরো বেড়ে যাবে ওয়ারেনের প্রতি পত্তি। ধেত্তের, নিকুচি করি! ভাবলো ফোর্বস, সই না দিলে কি করতে পারবে ওরা? নিরুপায় না হলে কিছুতেই লড়াই বাধাতে চাইবে না ওয়ারেন, এবং তার আগে সম্ভাব্য সব কৌশলই কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে সে।

আমি কোনো কাগজে সই করছি না, দৃঢ় কণ্ঠে বললে কলিন।

নইলে পস্তাবে!

কিভাবে? বিলের উদ্দেশে চিবুক নাচালো রবার্ট ওয়ারেন। বিল, লুইস প্যাটেন আর চাক কনারসকে ডেকে আনো…না, দরজা থেকেই ডাকে। ওদের। পিস্তলের বাঁটে হাত রেখে একটা চোখ ফোর্বসের ওপর রেখো।

এতক্ষণে আসল কথায় এসেছ। বললো বিল।

দরজার দিকে এগোলো সে, কবাট খুলে চেঁচিয়ে প্যাটেন আর কনারসকে ডাকলো, কিন্তু কলিনের ওপর থেকে নজর সরালো না।

পিস্তল বের করার চেষ্টা করলো না কলিন। এখান থেকে অস্ত শরীরে বেরোতে পারবে ভেবে ভুল করেছে, বুঝতে পারছে। রবার্ট ওয়ারেন সম্পর্কে ওর অনুমান ঠিক হয়নি। বেসিনে নিজ থেকে বড় ধরনের গোলমাল করতে চাইবে না ওয়ারেন, ঠিক, কিন্তু নিজের ঘরে ছোট খাট হাঙ্গামায় ক্ষতি কি? এখানে সে সম্রাট। এখানে যাই ঘটুক কেউ জানবে না।

এবার গানবেলটের বাকল খুলে ফেলো, বললো ওয়ারেন, ওটা আর কোনো কাজে আসছে না তোমার।

হাসলো কলিন।

বাপের মতোই গোয়ার এবং নির্বোধ তুমি! অপেক্ষা করলো কলিন। বারান্দায় পায়ের শব্দ। কামরায় ফিরে এলো বিল ওয়ারেন, সঙ্গে আরো দুজন। একজন লম্বা, ঢ্যাঙা মত, চোখ মুখ কোঁচকানো, যেন ভেঙচি কাটছে সারাক্ষণ। অন্যজন খর্বাকৃতি, স্থূলকায়, লালচে একজোড়া গোফ ঠোঁটের ওপর।

দেখো, কে এসেছে, বললো বিল, এর নাম ফোর্বস, ওই মেরেছে আমাদের টেরেন্স মিচেলকে।

নিমেষে পিস্তল বের করে আনলো গুফো।

দাড়াও, বললো রবার্ট ওয়ারেন। এই শেষ সুযোগ দিচ্ছি তোমাকে, ফোর্বস, আমার কথা শোনো, তোমার ভালো হবে।

লম্বা করে দম নিলে কলিন। না।

এরা দুজনই মিচেলের বন্ধু, মিচেলকে ওরা পছন্দ করতে।

সে-ই আগে পিস্তল বের করেছিলো, বললে কলিন।

জানি, জবাব দিলো ওয়ারেন, রেডফিলড শেরিফের কাছে তোমার পক্ষে সাক্ষী দিয়েছে, তাতে কিছু যায় আসে না। যত যাই হোক, তুমিই মিচেলের হত্যাকারী। কাল সূর্য ওঠার আগেই আপসোস হবে তোমার কেন তার সঙ্গে দেখা হতে গেল ভেবে। প্যাটেন, কনারস, আস্তাবলে নিয়ে যাও ওকে, তবে আমি না আসা পর্যন্ত গায়ে হাত তুলল না, আমি লিনডাকে দেখেই আসছি। কই, ফোর্বস, গানবেলট খুলতে বললাম না?

বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করলো কলিন, উপায় নেই। প্যাটেন আর কনারস এগিয়ে এসে ওর দু’পাশে দাড়ালো, জাপটে বরলে কজি, তারপর টেনে হিচড়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে চললো আস্তাবলের দিকে। দাঁত মুখ খিচে ব্যথা সহ্য করলো কলিন।

<

Super User