বরাবরের মত ভোরে ঘুম ভাঙল স্যামুয়েল ব্রুকসের। চোখ বুজে শুয়ে থেকে মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করল চারপাশের শব্দগুলো। ভুল হলো না, ঘাসের ওপর দিয়ে বুক টেনে চলার হালকা শব্দ দ্বিগুণ সতর্ক করে তুলল ওকে। গড়ান দিয়ে নেমে এল মেঝেয়, রাইফেল তুলে নিয়েছে হাতে। জানালা দিয়ে তাকাতে, ফিকে আলোয় পঞ্চাশ গজ দূরে চলন্ত কয়েকটা ছায়া দেখতে পেল-পাঁচজন। কেবিনের ডানদিকে দেখল আরও চারজনকে। বন্ধ দরজার দিকে তাকাল ব্রুকস, বাজি ধরে বলতে পারবে এদিকেও কয়েকজন আছে। নিশ্চিন্তে, এগিয়ে আসছে ওরা, সহজ শিকারের আশায় উন্মুখ।

ক্রল করে ভেতরের কামরায় চলে এল ও। ছোট্ট করিডর পেরিয়ে উঠে দাড়াল। এখন থেকে প্রতিটি মুহূর্ত দারুণ মূল্যবান। পেছনের দরজার খিড়কি খুলে প্রায় নিঃশব্দে বেরিয়ে এল। দুহাত দূরে মরগান পিক্‌সের নিরেট শরীর। কেবিনের দেয়াল ঘেঁষে এগোচ্ছে ও। পনেরো গজ দূরে করাল, পৌঁছাতে তিন সেকেন্ডের বেশি লাগল না। ঘোড়াদুটো সজাগ দাড়িয়ে। দেয়ালের আঙটায় ঝোলানো স্যাডল নামিয়ে রোয়ানের পিঠে চাপাল। পাশে ছোট একটা বোঁচকা, বিপদের আশঙ্কায় আগে থেকে ওতে খাবার ভরে রেখেছে। স্যাডল হর্নের সাথে ক্যান্টিন আর বোঁচকা ঝুলিয়ে, ঘোড়ার লাগাম হাতে সজি বেডের পাশ দিয়ে এগোল। দশ হাত দূরে ঘন অ্যাসপেনের পেছনে গোপন ট্রেইলের শুরু! রোয়ানটা দ্বিধা করছে, পাছায় চাপড় মেরে এগোতে বাধ্য করল ওটাকে। ঘোড়াটা অ্যাসপেনের আড়ালে চলে যেতে ফিরে এল করালের কাছে। ততক্ষণে টের পেয়ে গেছে প্রতিপক্ষ, সমানে রাইফেল খালি করছে। বাধ্য হয়ে বানের পাশে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকল ব্রুকস। ষাট গজ দূরে আছে ওরা। তৃণভূমি থেকে ঢাল জমি যেখানে পাহাড়শ্রেণীতে গিয়ে মিশেছে ব্রুকসের অবস্থান ঠিক সেখানে, কিছুটা উঁচুতে। মাথা তুললে দেখতে পাবে ওদের, এবং ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকলে গুলি লাগার সম্ভাবনা একেবারে নেই।

রাইফেল পাশে রেখে কোস্টগুলো হাতে নিল ও, ওলি থামার অপেক্ষায় থাকল। বেশ কিছুক্ষণ পরে থামল ওদের গুলিবর্ষণ। সুনসান নীরবতা নেমে এল। ঝটিতি উঠে দাঁড়াল ও, পোর্চের কাছে পড়ে থাকতে দেখল চারটে দেহ। মাথা উঁচিয়ে দেখতে চাইছিল একজন, বুলেটটা কপালে বিধতে ঢলে পড়ল নোকটা। পাশেরজন, দশাসই শরীরে নড়তে দেরি করায় সেটাই তার কাল হলো-পেটে আর ঘাড়ে দুটো গুলি ঢুকল পরপর। নিথর হয়ে গেল দেহটা।

একপাশে রাইফেলের নিশানায় ওকে পেয়ে গেছে তিনজন, চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল ব্রুকস। দ্রুত সেদিকে ঘুরেই গুলি শুরু করল, পিস্তল দুটো খালি হওয়া পর্যন্ত থামল না। অন্তত দুজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে মাটির সাথে শরীর মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে লোকগুলো।

পিস্তলের খালি চেম্বারে হ্যামারের বাড়ি পড়তে ঝাঁপ দিল ও, একটু দেরি করলে অন্তত তিনটে বুলেট বিদ্ধ করত ওকে। হাত বাড়িয়ে টেনে নিল রাইফেল, সামনে আনতে দেরি কেবল। একটা লোক উঠে দাঁড়িয়েছে, হয়তো ভেবেছে পিস্তল ছাড়া কিছু নেই ওর কাছে, ওকে রিলোড করার সময় দিতে নারাজ। লোকটার বোকামির জন্যে করুণা অনুভব করল। শেষ মুহূর্তে ভুল বুঝতে পারল সে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। শেষ চেষ্টা করল সে, হাতের রাইফেল থেকে আগুন ঝরল, সেইসাথে বুকে হাতুড়ি পেটাল ব্রুকসের পাঠানো গুলি। টলে উঠল দেহটা, পড়ন্ত দেহে আরেকটা বুলেট পাঠাল ব্রুকস।

নীরবতা নেমে এল। পুব আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। গান পাউডারের তাজা গন্ধে ভারী হয়ে গেছে বাতাস। ঠায় পড়ে আছে প্রতিপক্ষ, আগের তুলনায় সতর্ক। দুর্বল অবস্থানের অসুবিধে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। অবশ্য বেশিক্ষণের জন্যে নয়, জানে ব্রুকস। বার-পি ক্রুরা সংখ্যায় বেশি, অধৈর্য হয়ে একসময় ওকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে।

সময় যেন আটকে আছে, ফুরোতেই চাইছে না। ব্রুকসের চঞ্চল দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রেইরি, সজি বাগান আর কেবিনের আশপাশে। সূর্য ওঠার পরও অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেল! মৃদু কথাবার্তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, কিছু একটা নিয়ে পরামর্শ করছে লোকগুলো। কেবিনের ওপাশে চলাফেরা করছে কেউ। জানালার গরাদ ভেঙে গেল একটু পর। এপাশে দরজা ও জানালার ওপর নজর বুলাল ও, কেবিনের ভেতর একটা ছায়া দ্রুত ডানদিকে সরে গেল। ওদিকে সজি বাগানের কাছে অবস্থান নেয়া লোকগুলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে।

কেবিনের দরজার ওপর চোখ রেখে ধীরে পিছু হটতে শুরু করল ব্রুকস। এখানে থেকে সুবিধে করতে পারবে না আর। যে কোন মুহূর্তে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে বার-পির ক্রুরা, তেমন হলে লোকগুলোকে সামলানো যাবে না।

অ্যাসপেন ঝোপের কাছে চলে এসেছে ও। মাথা উঁচিয়ে পেছনে তাকাল, দৃষ্টিসীমায় নেই কেউ। ঘুরে ছুটতে শুরু করল, সরু একটা পথ ধরে পৌঁছে গেল উপত্যকায়। অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে পড়েছিল রোয়ানটা, ব্রুকস স্যাডলে চাপতে ছুটতে শুরু করল। রাশ টেনে গতি কমাল ও। পথটা বিপজ্জনক, এভাবে ছুটতে থাকলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

উত্তেজিত গলার শব্দে বোঝা গেল টের পেয়ে গেছে ওরা। ট্রেইল খুঁজে বের করতে হবে, তার আগে পেছনে রেখে আসা ঘোড়াগুলোকে আনতে হবে-অনেক সময়, এ ফুরসতে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে ও তাজা ট্র্যাক ফেলে যাচ্ছে, তা ধরে সহজে এগোতে পারবে বার-পির ক্রুরা। ব্রুকসও তাই চাইছে। এমন জায়গায় ওদের নিয়ে যেতে চায় যেখানে বাড়তি কিছু সুবিধে পাবে ও, লড়াইটা তাহলে আর একতরফা হবে না। এ পাহাড়শ্রেণীতে তেমন জায়গার অভাব নেই।

ট্রেইলের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখছে ও। বুনো জানোয়ারের চলা পথ, অ্যাসপেন আর মেকিটের ছড়াছড়ি। কয়েকটা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ঝর্নার কাছে এসে পৌঁছাল। ওপাশে কয়েক মাথা উঁচু ঘন সিডারের সারি। বামে উঁচু উপত্যকা থেকে ঢলে পড়ছে শুভ্র জলরাশি, সরু নালার আকারে এটা পরে ওর জমিতে গিয়ে পড়েছে।

লাগাম ঢিলে করতে ঝর্নায় নেমে পড়ল ঘোড়াটা। স্বচ্ছ পানির নিচে শক্ত পাথুরে মাটি আর বিভিন্ন রঙের নুড়ি-পাথর। কয়েক হাত দূরে এক ঝাক ট্রাউট চোখে পড়ল। চলার মধ্যে মাথা নুইয়ে পানি পান করল রোয়ানটা। ওপাড়ে উঠে এসে সিডারের ঘন সারির মাঝখান দিয়ে চিরে চলে যাওয়া সরু পথ ধরে এগোল। কিছুক্ষণ ধরে পেছনে খুরের শব্দ পাচ্ছে। ইচ্ছে করলে এখানেই রুখে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু শত্রুপক্ষ সংখ্যায় বেশি। এখানে বড়জোর কয়েক মিনিট টিকতে পারবে ও।

সিডার উপত্যকার যেন শেষ নেই।

একসময় ঢালু জমির শুরু হলো, সিডারের সংখ্যা কমে এসেছে। আকাশছোয়া দুটো কটনউড রয়েছে পথের দুধারে। কয়েকশো ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে এল ঘোড়াটা। জায়গাটা সমতল, ওপাশের ঢাল এত খাড়াভাবে নেমে গেছে যে কোন ঘোড়ার পক্ষে পিঠে সওয়ারী ছাড়াই নেমে যাওয়া কষ্টকর। ঢালের শেষে তিনশো ফুট নিচে গভীর খাদ।

স্যাডল ছেড়ে নেমে পড়ল ব্রুকস। খাবারের পোটলা খুলে বেকন আর আলুভাজা দিয়ে নাস্তা সেরে নিল। দুই ঢোক পানি খেয়ে ক্যান্টিন আর খাবারের প্যাকেট যথাস্থানে রেখে ওপাশে ঢালের কাছে নিয়ে এল রোয়ানটাকে। চাপড় মারল ওটার পাছায়, খানিক ইতস্তত করে পা বাড়াল ঘোড়াটা। পথটা ওদের কাছে নতুন নয়, আগেও কয়েকবার আসা-যাওয়া করেছে। মেসার এ প্রান্তে এসে শক্ত মাটির ওপর শুয়ে পড়ল ও, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে ইন্দ্রিয়গুলো। আসছে শিকারীরা। প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রুকস, কাউকে জখম করতে না পারলেও কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ভড়কে দিয়ে সময় আদায় করা যাবে।

তামাক আর কাগজ বের করে সিগারেট রোল করল ও। পিঠে সূর্যের উত্তাপ অনুভব করছে। এরইমধ্যে ঘেমে গেছে, গায়ের সাথে শার্ট লেপ্টে থাকায় অস্বস্তি হচ্ছে। ধূমপানের ফাঁকে মনোযোগ দিয়ে খুরের শব্দ শুনল, হঠাৎ করে মিইয়ে এসেছে, তারমানে সিডারের বনে ঢুকে পড়েছে বার-পি কুরা। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ধীরে সিগারেট শেষ করল ও। লোকগুলোর পৌঁছাতে সময় লাগবে, ওর মত নিশ্চিন্তে এগোনোর উপায় নেই তাদের, অ্যাম্বুশের আশঙ্কা ছাড়াও ট্র্যাক পরীক্ষা করতে হচ্ছে। সময় তো লাগবেই।

রাইফেলের মাজলে একটা সিডারের শাখায় নিশানা করল ব্রুকস। ট্রিগারে আঙুল চেপে বসেছে। খুরের শব্দ জোরেসোরে শোনা যাচ্ছে এখন। ট্রেইলের ওপর আঠার মত সেঁটে আছে ওর দৃষ্টি, যে কোন সময়ে ছুটন্ত ঘোড়া দেখতে পাবে। পায়ে খিল ধরায় নড়েচড়ে ছাড়াল সেটা।

হঠাৎ দেখা গেল প্রথম ঘোড়সওয়ারকে। লোকটা প্রকাণ্ড, কোন রকমে শরীর চাপিয়েছে একটা স্ট্যালিয়নের স্যাডলে। একে একে আরও চারজনকে দেখা গেল পেছনে। রাইফেলের নলে দ্বিতীয় লোকটাকে অনুসরণ করল ব্রুকস, ট্রিগার টেনে দিল। নির্জন উপত্যকায় প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যাওয়ার আগে পরের লোকটাও ধরাশায়ী হলো। সওয়ারীকে পেছনে ফেলে ছুটতে থাকল স্যাডলশূন্য ঘোড়াটা, ঢাল বেয়ে উঠে এল মেসার ওপর।

দুটো লাশ পড়ে আছে ভোলা জায়গায়। অন্যরা পিছু হটেছে।

রাইফেলের ব্রীচে নতুন একটা বুলেট পাঠাল ও, তারপর পিছু হটতে শুরু করল। এখানে থাকলে হয়তো আরও দুএকজনকে খসিয়ে ফেলতে পারবে, কিন্তু একসময় ঠিকই ওকে কোণঠাসা করে ফেলবে প্রতিপক্ষ। দল বেঁধে ছুটে এলে কিছু করার থাকবে না। উঠে দাঁড়াতে অনেকগুলো গুলি ছুটে গেল আশপাশ দিয়ে। মেসার কিনারে এসে থামল ক্ষণিকের জন্যে, ঢালু পথের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ছুটে নামতে শুরু করল। খাড়া ঢাল ওর গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। চোখ সেঁটে আছে সামনের পথে, তাল রাখতে গিয়ে শরীর হেলে পড়েছে। মেলায় উঠে আসার পর, দলের প্রথম লোকটা হয়তো স্যাডলে চেপে ঢাল বেয়ে নামার চেষ্টা করবে, ভাবছে ব্রুকস, তেমন হলে ব্যাটার কপালে খারাবি আছে, দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। ক্ষীণ হাসল ও, একজন যদি এমনিতে কমে যায় মন্দ হয় না।

নিচে পাথুরে জমিতে নেমে এল ও। রোয়ানটা অপেক্ষা করছিল, দৌড়ের ওপর স্যাডলে চেপে বসল। নিজ থেকে ছুটতে শুরু করল ঘোড়াটা। সরু খাদটা বেশ খোলামেলা, দুশো গজের মত হবে, তারপর পাহাড়ের আড়াল পাওয়া যাবে। বার-পির ক্রুরা মেসায় উঠে আসার আগেই জায়গাটা পেরোতে হবে নইলে ইচ্ছেমত টার্গেট প্র্যাকটিস করার সুযোগ পেয়ে যাবে ওরা।

নির্বিঘ্নে জায়গাটা পেরিয়ে এসে বামে মোড় নিল ও। পাহাড়শ্রেণী ওদের কাছে অপরিচিত, অথচ ব্রুকসের কাছে তা হাতের তালুর মতই। উপযুক্ত পরিবেশের সুবিধা পেলে হয়তো খসিয়ে দিতে পারবে লোকগুলোকে। ওরা লড়তে জানে, বাফেলো টাউন বা অন্য কোথাও এদের দুতিনজনের সাথে দুই মিনিট টিকতে পারত না ব্রুকস। কিন্তু এখানকার কথা আলাদা, প্রতিপক্ষের সংখ্যা ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। পাহাড়ী গোলকধাঁধায় দুটিয়ে ওদের ক্লান্ত করে তুলতে চাইছে ও, সুযোগ পেলে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে ফায়দা লুটবে। ভাগ্যের সহায়তা পেলে হয়তো শেষপর্যন্ত এদের পেছনে ফেলে বেরিয়ে যেতে পারবে।

কিছুদূর এগিয়ে ডানে মোড় নিল। এ পথে পাহাড়শ্রেণীর ওপাশে বেরিয়ে যেতে পারে, মূল ট্রেইলে উঠে এসে ঘুরপথে এরপর কেবিনের কাছে যেতে পারে। কিন্তু তাতে লড়াইয়ের শেষ হবে না, লোকগুলো আগে-পরে ওকে কোণঠাসা করে ফেলবেই। এদের কাউকে জীবন্ত ফিরে যেতে দিতে নারাজ ও। হয় তাদেরকে নয়তো ওকেই মরতে হবে।

ডানে বাঁক নিয়েছে ট্রেইল। পথটা দুর্গম, খানা-খন্দ আর ক্যাকটি ঝোপে ভরা। বুনো জাতের কিছু ক্যাকটাসও আছে। পেরোতে সময় লাগবে। বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নিল ও। স্যাডল ছেড়ে মাথা থেকে হ্যাট সরাল। ঘামে জবজব করছে সারা শরীর, চুলগুলোও ভিজে গেছে। তপ্ত হলকা ছড়াচ্ছে মধ্যাহ্নের সূর্য। ব্যানডানার গিঁট সামান্য আলগা করে দিল। ক্যান্টিন থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গলায় ঢালল এরপর। হ্যাটের উল্টোপিঠে পানি ঢেলে, ঘোড়াটার দিকে এগিয়ে ধরল। সানন্দে তা নিঃশেষ করে ফেলল তৃষ্ণার্ত জানোয়ারটা। খানিকটা পানি ঢেলে ওটার মাথা ভিজিয়ে দিল। সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে ওটাকে, দুপা এগিয়ে ক্যাকটাসের পাশে বেড়ে ওঠা বুনো লতার দিকে মনোযোগ দিল।

বেকন আর শুকনো জার্কি দিয়ে খাওয়া সেরে নিল ব্রুকস। ধূমপানের ফাঁকে নজর বুলাল ফেলে আসা পথের ওপর। এ পর্যন্ত আসতে সময় লাগবে বার-পি রাইডারদের। মিনিট ত্রিশ বিশ্রাম নিয়ে ফের স্যাডলে চাপল। সরু উপত্যকা ধরে এগোচ্ছে। শক্ত পাথুরে জমিতে ঘোড়ার ছাপ কমই পড়ছে। একটু চেষ্টা করলে তা মুছে ফেলতে পারে, তাতে অযথাই কিছু সময় নষ্ট হবে। বার-পির লোকগুলো পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরুক, এটাই চায় ও।

সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়া পর্যন্ত টানা এগিয়ে চলল ব্রুকস। বন্ধুর পথে চলতে কষ্ট হচ্ছে ঘোঁড়াটার, তবু সন্ধ্যা নাগাদ আরও মাইলখানেক পাড়ি দিল। পাহাড়শ্রেণীর প্রায় ওপাশে এসে পড়েছে। প্রতিপক্ষ অন্তত দুই মাইল পেছনে। অন্ধকার নামলে আর এগোতে পারবে না লোকগুলো, ব্রুকসের ক্ষেত্রেও তাই। সুতরাং নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নেয়া যেতে পারে।

পাহাড়ের মধ্যে একটা ফাটল খুঁজে পেয়ে ক্যাম্প করল ও। পাশের উপত্যকায় বুনো লতা আর কিছু ঘাস রয়েছে, রোয়ানের জন্যে তা যথেষ্ট হবে। ক্যান্টিনের সবটুকু পানি ঘোড়াকে দিল, তারপর স্যাডল ছাড়িয়ে দলাই-মলাই করে দিল। আগামী কয়েকদিন ঘোড়াটা ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, পিস্তল বা রাইফেলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। ঘোড়া ছাড়া মরগান পিক্‌স পাড়ি দেয়া অকল্পনীয় ব্যাপার।

ফাটলের নিচে ঝর্নার ক্ষীণ একটা ধারা বয়ে চলেছে। ওখানে নেমে এল ব্রুকস। ক্যান্টিন ভরে কাপড় খুলে পানিতে নেমে পড়ল। ঠাণ্ডা পানির স্পর্শে শরীর জুড়িয়ে গেল, ক্লান্তি কেটে যাচ্ছে। মিনিট দশ পর উপত্যকায় উঠে এসে খাওয়া সেরে একটা জুনিপারের আড়ালে বেডরোল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। রোয়ানটা চরছে।

তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকাল ও, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ বারবার পীড়া দিতে, চাইছে। উটকো এ ঝামেলা থেকে কবে যে মুক্তি পাবে তার ঠিক নেই। হয়তো চব্বিশ ঘণ্টাও টিকতে পারবে না। সবকিছু নির্ভর করছে ভাগ্য আর প্রতিপক্ষের ওপর। যে লোকগুলো পিছু নিয়েছে তাদের মধ্যে দুএকজন ছাড়া অন্যদের তেমন শক্ত লোক মনে হয়নি। তবে সবার কাছে অস্ত্র আছে, এটাই হচ্ছে বড় কথা। কাউকে ছোট করে দেখার উপায় নেই কারণ মৃত্যুর জন্যে একটা বুলেটই যথেষ্ট। এখানে ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড নিয়ে বসে নেই কেউ, তাই নিজের খোলা পিঠ ওদের দিকে দেয়ার ইচ্ছে ওর নেই।

জোর করে সব দুশ্চিন্তা তাড়িয়ে দিল ও। পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার, আরও কদিন যে এমন হাড়ভাঙা খাটুনি যাবে বলা যাচ্ছে না।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলা শুরু করল ও। ধীরে এগোল সঙ্কীর্ণ ট্রেইল ধরে। পাহাড়শ্রেণীর ওপাশে এসে ঢাল বেয়ে নামতে যাবে, প্রেইরির ওপর চোখ পড়তে থেমে গেল। স্পষ্ট দেখতে পেল পাঁচজনের দলটাকে, উধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে। ব্রুকস জানত এখান থেকে বেরোনোর সবগুলো পথ আগলে রাখার চেষ্টা করবে প্রতিপক্ষ। ওর সৌভাগ্য লোকগুলো পৌঁছাতে খানিক দেরি করে ফেলেছে, নয়তো এখুনি হাতের মুঠোয় পেয়ে যেত ওকে। আগে আসার সুবিধেটুকু নিতে পারে ও, ভাল একটা আড়াল খুঁজে অপেক্ষা করলে বন্দুকের মুখে পাওয়া যাবে প্রেইরি ধরে আসা ক্রুদের। খোলা জায়গায় থাকবে বলে সুবিধা করতে পারবে না ওরা। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, পেছনে অন্তত একটা দল অনুসরণ করে আসছে। দুই দলের মাঝখানে পড়া ওর জন্যে মোটেও সুখের হবে না।

রোয়ানের মুখ ঘুরিয়ে ফিরতি পথ ধরল ব্রুকস। ট্র্যাক ফেলে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুই করার নেই। ওগুলো মুছতে গেলে ঘাড়ের ওপর এসে পড়বে পেছনের দলটা। দ্রুত এগোচ্ছে যদিও পুরোমাত্রায় সজাগ। একশো গজের মত এগিয়ে ডানের সরু ট্রেইলটা খুঁজে পেয়ে সেটা ধরে এগোল। খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করছে এবার। সহজে এ ট্রেইল খুঁজে পাবে না ওরা, পেলেও ওকে সাহায্য করার জন্যে সামনে দারুণ এক আয়োজনের সুযোগ পড়ে রয়েছে। মিনিট ত্রিশ এক নাগাড়ে চলে জায়গাটা পেল ও। উপত্যকা খোলামেলা হয়ে এসেছে এদিকে। পঞ্চাশ গজ দূরে ফাটলটা-পাঁচ হাত তফাতে পাহাড়ের খাড়া নিরেট দেহ, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা নদী।

লাফ দিতে ইতস্তত করছে রোয়ানটা, কাছে গিয়ে থেমে গেল, প্রথমবার যেমন করেছিল। ঝুঁকে ওটার কেশরে হাত বুলাল ও, কিছুই না, বাছা, পিছিয়ে আসার সময় বিড়বিড় করে উৎসাহ জোগাল। আগেও এটা পার হয়েছি আমরা। কিছুক্ষণের জন্যে থেমে ধাতস্থ হওয়ার সুযোগ দিল ঘোড়াকে। বড় বড় শ্বাস টানছে ঘোড়াটা, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে। মৃদু স্পর দাবাতে ছুটল এবার, খাদের কিনারায় এসে লাফ দিল। শূন্যে ভেসে থাকল কিছু সময়, তারপর ওপাড়ের শক্ত মাটিতে নেমে এল চারটে খুর। ব্রুকসের মনে হলো হোঁচট খাবে ঘোড়াটা, যদিও এলোমেলো, কয়েক পদক্ষেপের পর স্বাভাবিক হয়ে এল ওটার চলা, থেমে গেল একটু পর।

লাফিয়ে স্যাডল ছাড়ল ও। আদর করে রোয়ানের নাকে হাত ঘষে দিল। শাবাশ ব্যাটা! আরেকবার প্রমাণ করলি তোর অসাধ্য কিছুই নেই। লাগাম ধরে ওটাকে হটিয়ে নিয়ে উপত্যকার ভেতরে চলে এল। দুটো সিডার আর কয়েকটা অ্যাসপেন আছে এদিকে, আড়াল হিসেবে মন্দ নয়। ঘোড়াকে নিরাপদ দূরত্বে ছেড়ে এসে পছন্দসই একটা জায়গা খুঁজল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে এল ফুট দশেক। বোল্ডারের কোণা বেরিয়ে আছে এক জায়গায়, পাশে খানিকটা জায়গা। একজন লোকের বসে থাকার জন্যে যথেষ্ট। আড়াল হিসেবে আদর্শ না হলেও কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে। তাছাড়া প্রতিপক্ষ দারুণ ব্যস্ত থাকবে, লোকগুলোকে কোন সুযোগই দেবে না ব্রুকস।

দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল ও। হাঁটুর ওপর রাইফেল রেখে ধূমপানের আয়োজন করল। চোখ সামনের পাহাড়, উপত্যকা আর ট্রেইলে। আশা করছে অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে যাবে বার-পি রাইডারেরা।

সাতজন, খাদের কিনারায় এসে দাঁড়াল একে একে। দশাসই এক লোক, পেছনে ছিল এতক্ষণ, সামনে এসে খাদটা দেখল। তারপর তাকাল এ-পাড়ের দিকে। পাহাড়ের মধ্যে তন্নতন্ন করে খুঁজছে লোকটার চোখ, শেষে ব্রুকসের পিঠের সাথে লেগে থাকা বোল্ডারের ওপর এসে থামল। ব্রুকস চিনল তাকে, বিল লসন। এখানেই আছে ও, চড়া গলায় ঘোষণা করল ইয়েলোস্টোনের রংবাজ। যেভাবেই হোক খাদ পেরিয়ে গেছে। ও যদি পেরে থাকে তো আমাদেরও না পারার কিছু নেই। স্যাডল, হর্ন থেকে রাইফেল তুলে নিল সে, নিশানা করছে। ঠোঁটে চেপে রাখা সিগার থেকে ধোঁয়া উঠছে।

খানিক পাশে সরে এসে গুলি করল ব্রুকস। বিল লসনের সিগার সে ধূলিশয্যা নেয়ার আগেই মাটিতে পড়ল। ফের গুলি করে ভূপতিত দেহটা বিদ্ধ করল। তারপর পাশের লোকটাকে। ততক্ষণে ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়েছে যেন, উল্টোদিকে ছুটতে শুরু করেছে বাকিরা। এ-পাড়ে আসার চেষ্টা করল একজন, যথেষ্ট গতি না থাকায় খাদ পেরোনোর সময় মাঝপথে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল ঘোড়াটা। ভয়ার্ত চিৎকারকে অনুসরণ করল পানিতে ভারী কিছু আছড়ে পড়ার শব্দ। কিন্তু সেদিকে মনোযোগ দেয়ার ফুরসৎ নেই কারও। রাইডারদের একজন স্যাডল ছেড়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, রাইফেল তুলে নিশানা করছে। লোকটার কপাল বরাবর দুটো গুলি পাঠিয়ে দিল ব্রুকস।

নিচে নামতে শুরু করতে কয়েক হাত দূরে আছড়ে পড়ল বেশ কটা গুলি। তারই একটা পাহাড়ের গায়ে পিছলে গিয়ে গোড়ালির কাছে ওর বুটে আঘাত করল। কিঞ্চিৎ ভারসাম্য হারাল ও, গড়িয়ে নেমে এল বাকি পথটুকু। নিচে নেমে উপত্যকার দিকে ছুটতে শুরু করল। পাশ দিয়ে গুলির তুবড়ি ছুটছে, সবচেয়ে কাছেরটা ওর শার্টের আস্তিনে একটা টানের কারণ হলো কেবল। নিরাপদে রোয়ানের কাছে, বিশালকায় সিডারের পেছনে এসে পৌঁছাল।

সুস্থির হয়ে জায়গাটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল ও! দুটো লাশ আর একটা ঘোড়া পড়ে আছে। পেছনে ট্রেইলের আশপাশে আড়াল নিয়েছে লোকগুলো, তেমন জায়গা ওদিকে প্রচুর আছে, এদিকের মত ভোলামেলা নয়। খানিক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রুকস। জানে এত সহজে হাল ছাড়বে না ওরা, খাদ পেরোনোর চেষ্টা আবারও করবে।

অপেক্ষার পালা। দুদফা গুলি করে ওর কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে সাহস বেড়ে গেল প্রতিপক্ষের। একটু পর তর্ক শোনা গেল, চড়া গলায় খাদ পেয়োনোর পরামর্শ দিচেছ একজন, আরেকজন সেটা সমর্থন করলেও অন্যরা নারাজ। কিছুক্ষণ বাদে সন্তর্পণে বেরিয়ে এল প্রথম লোকটা, পাঁচ মিনিটের মধ্যে অনুসরণ করল বাকিরা! স্বতঃস্ফূর্ত ওদের চলাফেরা, ধরেই নিয়েছে কেটে পড়েছে ব্রুকস। আড়াল থেকে ঘোড়াগুলোকে বের করে এনে স্যাডলে চাপল, খাদের কিনারায় এসে সার বেঁধে দাড়াল। তারপর পিছিয়ে যেতে শুরু করল। অবলা প্রাণীগুলো ঝিম মেরে আছে, সহজ হতে পারছে না। নির্দয় স্পর ওগুলোকে এগোতে বাধ্য করল, কিন্তু খাদের কিনারে এসে বেঁকে বসল দুটো। সামনের পা তুলে দিয়ে থামার চেষ্টা করল, পিঠ থেকে সওয়ারীদের ফেলে দিতে চাইছে। কিন্তু গ্যাট হয়ে বসে আছে মানুষগুলো, পড়ল তো না-ই উল্টো উপর্যুপরি স্পরের খোচা খেতে হলো। আতঙ্ক তাড়া করল ঘোড়াগুলোকে, নিজ থেকে ফিরতি পথ ধরল।

পেরোতে গিয়ে ঘোড়াসমেত খাদে খসে পড়ল একজন, আরেকজন উড়ন্ত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হলো। এ-পাড়ে এসে ঘোড়া সামলাতে ব্যস্ত একজনের দিকে ছোড়া ব্রুকসের গুলি ঘোড়াটার গায়ে বিধল। সওয়ারীকে নিচে ফেলে তার ওপর আছড়ে পড়ল ওটা। খাদ পেরিয়ে আসা শেষ লোকটাকে সামলে নেয়ার সময় দিল না ব্রুকস, গলা ফুটো করল তার। স্যাডলে উপুড় হয়ে থাকা লাশ নিয়ে ছুটতে থাকল ঘোড়াটা, রক্তের ধারা উপচে পড়ছে পেছনে।

এ অবসরে ঘোড়র তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্য লোকটা, সমানে নিশানা ছাড়াই গুলি করছে। আতঙ্কে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। প্রমাদ গুনল ব্রুকস, লোকটাকে পকেটে হাত দিতে দেখে আপনমনে হাসল। বিপদ টের পেয়ে দ্রুত হাতে পিস্তলে টোটা ভরল লোকটা, তাড়াহুড়োয় ঠিকমত করতে পারল না। সিলিন্ডারে বুলেট ঢুকিয়ে হাত উঁচু করতে তার কপালে টিপ পরিয়ে দিল ব্রুকস। গুডবাই, টার্নার! বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল ও। হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল মুব টার্নার, পিস্তল ধরা হাত শিথিলভাবে পড়ে থাকল দেহের পাশে। বাড় পারকার যেদিন মারা পড়েছিল সেদিন এই বার-পি পাঞ্চারও এসেছিল ওর বাথানে।

প্রথমে সাতজন ছিল ওরা। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সংখ্যাটা আরও বেশি, পিছিয়ে আসার সময় ভাবছে ব্রুকস, তারমানে প্রেইরির ক্রুরা ছাড়াও আরও কিছু লোক যোগ দিয়েছে পেছনের দলটার সাথে। কত লোক ভাড়া করেছে পারকার? সারা অ্যারিজোনায় কাউকে ব্যক্তি রাখেনি বোধহয়। আজকের পর আর ভুল করবে না ভরা, করে ফেলার পর্ণ বন্ধ করে অপেক্ষা করবে এখানে আর আরেকটা দলকে পাঠাবে ঋ এদিবে।

রোয়ানটাকে খুশিমত এগোতে দিচ্ছে ও।

লুকোচুরি এ খেলাটাকে কখনোই সহজ ভাবেনি ব্রুকস, বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কাজটা আরও কঠিন। প্রতিপক্ষকে ফুটিয়ে হয়রান করতে গিয়ে ওর নিজের ক্লান্তি কম হচ্ছে না, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। বৈরী পরিবেশের সুযোগ নিয়ে ওদের সংখ্যা যত কমিয়ে অলা যাবে জয়ের পাল্লা কিছুটা হলেও ওর দিকে ঝুঁকবে। এখনও সবটাই পারকারের দিকে।

সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা এগোল। আরেকটু হলে মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল একটা দলের, এই দলে আছে টম স্টিরাপ। কয়েক বছর আগে রেঙরকে অ্যাকশনে দেখেছিল তাকে। ফাস্ট গান হলেও সামনাসামনি লড়ার চেয়ে চোরাগোপ্তা হামলা পছন্দ করে। চল্লিশে পড়তে যাচ্ছে, কিন্তু বয়স হার মেনেছে ওর কাছে-পঁচিশ বছরের যুবকের মত সুঠাম পৈশীবহুল শরীর। নড়াচড়া ধীর-স্থির, দৃঢ় প্রত্যয় মেশানো। ওর পেশার লোক বেশিদিন বাঁচে না, অন্তত এরকম প্রতাপের সাথে-হয়তো এটাই ওর দৃঢ়তার কারণ।

রাত পেরিয়ে ভোর হলে আবারও চলা! ওই একই পরিবেশ, নির্দিষ্ট কয়েকটা ছবি ঘুরে-ফিরে আসছে। তুষারশুভ্র সুউচ্চ পর্বতসারি, সঙ্কীর্ণ শৈলশিরা আর দৈত্যাকার রীজ। কালের গ্রাসে অটল এ্যানিটের তামাটে শরীর, শ্যাওলা আর সূর্যের আঁচে ম্লান হয়ে যাওয়া ক্লিফের সারি। অবারিত সবুজ উপত্যকায় পাইন, স্পস আর বার্চের বনভূমি। এমনও জায়গা আছে যেখানে একটা গাছও নেই-পাথুরে জমিতে লাভার চাঙড়ের মত ধারাল, ট্র্যাকহীন পথ; মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়ার মত, চলার সময় আশঙ্কা জাগে হয়তো কোন নিষিদ্ধ এলাকা, অবাঞ্ছিত প্রবেশের পর যেখান থেকে ফেরার আর উপায় থাকে না, ভুল পথের নির্দেশনায় কেবল সামনেই চলা যায়। মাঝে মাঝে পাজরের হাড়ের মত সাজানো একটার পর একটা মালভূমির মত বিস্তৃত প্রান্তর। তারপরই হয়তো সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে ছিটকে পড়া ঝর্নাধারা যেগুলো আরও এগিয়ে বেসিনের বুকে আছড়ে পড়েছে।

বিস্তৃত ঢাল বেয়ে কখনও নামল, আবার কখনও চড়াই বেয়ে উঠতে হলো-ফুটের পর ফুট, যেখানে ঘোলাটে মেঘেরা ক্লিফের গায়ে ঘুরে-ফিরে কেবলই চুমো খায়। স্বল্প দৃষ্টিসীমার মধ্যে মেঘের স্পর্শ শীতল অনুভূতি এনে দেয় শরীরে। জমে থাকা তুষারে ঢাকা একটা শৈলশ্রেণীতে উঠে এল ব্রুকস, সামনের বিস্তৃত প্রেইরির দিকে তাকাল। মাইলের পর মাইল, প্রায় পুরো বেসিনটাই চোখে পড়ছে। বার-পি, ডাবল-এস, সার্কেল-এফ, বক্স-বি, ওর রাউন্ড-এসবি…একইসাথে, পাশাপাশি একটা ছবির মত। সমভূমিতে চলমান গরুগুলোকে দেখাচ্ছে একেকটা বিন্দুর মত, আর ওগুলোর সারিবদ্ধ পালকে মনে হচ্ছে সচল একখণ্ড মেঘের ছায়া।

নির্দিষ্ট কোন ছক অনুসরণ করছে না ব্রুকস, ব্যাপারটা তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। আগে থেকে ওর গন্তব্য আঁচ করতে পারলে শুধু সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করলে ওকে পেয়ে যাবে বিপক্ষ এবং কপাল বরাবর একটা বুলেট পাঠিয়ে দিলে চুকে যাবে সব। পরদিন শত্রুর সংখ্যা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেল ও। ত্রিশজনের কম হবে না, ছয়টা দলে ভাগ হয়ে তাড়া করছে ওকে। এদের মধ্যে অন্তত দশজন সত্যিকার কঠিন ও ভয়ঙ্কর লোক। অন্য সময় হলে এদের ধারেকাছেও ঘেঁষত না ব্রুকস, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই এখন। হন্যে হয়ে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে লোকগুলো, ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে। খেলাটা ওদের ভাল লাগছে না আর, বিশেষত এ জন্যে যে পাহাড়শ্রেণী থেকে বেরোনোর সবকটা পথ বন্ধ করা ছাড়া কাজের কাজ কিছু করতে পারেনি এখন পর্যন্ত।

না চাইলেও দুশ্চিন্তা ভর করতে চাইছে। নিজেকে ফাদে পড়া ইদুরের মত মনে হচ্ছে ওর। বেরোনোর সবকটা পথ বন্ধ, পেছনে পাঁচ-ছয়জনের একটা দল সর্বক্ষণই লেগে আছে। পালা করে ধাওয়া করছে ওরা, নিজেদের লোক ছড়িয়েছিটিয়ে থাকায় অসুবিধে হচ্ছে না। বরং চারদিক থেকে ক্রমশ জালটাকে গুটিয়ে আনছে।

চতুর্থ দিন সকালে ব্রুকস টের পেল একটা সরু উপত্যকায় আটকা পড়েছে ও। ট্রেইলের দুদিকে অবস্থান নিয়েছে রাইডারেরা। একপাশে মরগান পিকসের চূড়া থেকে খসে পড়া ঝর্না, যেটা পরে ব্রুকসের জমিতে নদী হয়ে উপচে পড়েছে। অন্যপাশে আকাশছোঁয়া পর্বতশৃঙ্গ, তবে একেবারে দুর্গম নয়। আতঙ্কের সাথে লক্ষ্য করল সেখানেও আছে একটা দল, রাইফেলের নলে সূর্যের আলোর প্রতিফলনে অবস্থানটা ফাঁস করে ফেলেছে, নইলে না জেনে হয়তো ওদিকেই ঘোড়া ছোটাত ব্রুকস এবং ওদের তোপের মুখে গিয়ে পড়ত।

নিজের অবস্থান খতিয়ে বিচার করল ও। মন্দের ভাল বলা যেতে পারে। ট্রেইল থেকে একপাশে একটা উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছে, দুদিকের ঘন অ্যাসপেনের ঝোপ সামনের ট্রেইল আর পাশের উচু মালভূমির মত জায়গা থেকে আড়াল করেছে ওকে। পেছনে ক্লিফের খাড়া ঢাল নেমে গেছে ঝর্নার একেবারে তলা পর্যন্ত যেখানে শুভ জলরাশি তুমুল বেগে আছড়ে পড়ে প্রপাতের সৃষ্টি করেছে। আড়াল হিসেবে চমৎকার হত যদি প্রতিপক্ষ ওর অবস্থান না জানত। হয়তো জানে না ঠিক কোথায় আছে ও, তবে আঁচ করে নিতে পারবে। কয়েক ঘণ্টা ধৈর্য ধরে চোখ রাখলে বের করা কঠিন কিছু নয়।

শুকনো জার্কি চিবানোর ফাঁকে ট্রেইলের ওপর চোখ বুলাল ব্রুকস। উত্তেজনায় টান টান হয়ে আছে শরীর, নিশ্চিত জানে, অতি উৎসাহী হয়ে আক্রমণ করতে যাচ্ছে বিপক্ষ। চারদিনের অমানুষিক পরিশ্রমে ক্লান্ত ধৈর্যহারা হয়ে পড়েছে ওদের বেশিরভাগ লোক। তাছাড়া এ কদিনে আগ বাড়িয়ে হামলা করতে পারেনি একবারও, কেবল ঠেকাতেই হয়েছে। শিকার এখন কোণঠাসা, কাজটা দ্রুত শেষ করতে পারলে ঝামেলা চুকে যায়। ব্রুকস জানে, এভাবে চিন্তা করবে না কয়েকজন-মন্টানা কিড, টম, স্টিরাপ, গ্যারেটরা…ওদের ধৈর্য শকুনের মত, পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে না আসা পর্যন্ত বেরিয়ে আসবে না। বরং হুজুগে কয়েকজনকে উস্কে দিয়ে ওকে অধৈর্য করে তুলবে যাতে শেষ কাজটুকু নিজেরা অনায়াসে সারতে পারে।

যতক্ষণ সম্ভব লড়ে যাবে, সিদ্ধান্ত নিল ও, প্রয়োজনে আগ বাড়িয়ে হামলা করবে। অনন্তকাল এখানে আটকে থাকার ইচ্ছে নেই, খাবার আর পানিও ফুরিয়ে এসেছে। নড়েচড়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসল ও, সিগারেট ধরাল। ধীরে সময় বয়ে চলেছে।

বামদিকে ফেলে আসা ট্রেইলের কাছে মৃদু কথাবার্তার শব্দ শোনা গেল, জেফরি করবেটের গলা। রাখ-ঢাকের কোন চেষ্টা নেই, তর্ক করছে কারও সাথে। হঠাৎ অন্যদিকে ক্ষীণ নড়াচড়া ধরা পড়ল ওর চোখে। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ইন্দ্রিয়গুলো, পরিকল্পনাটা আঁচ করতে পারছে। ওপাশের লোকগুলো অতি উৎসাহী হয়ে পড়েছে, ভাবছে বার-পি ফোরম্যান ওর মনোযোগ ধরে রাখতে পারবে আর এই সুযোগে হামলা করবে নিজেরা। মৃদু হাসল ব্রুকস, আসুক ব্যাটারা। যে কজনকে পারে সাথে নিয়ে যাবে। কোণঠাসা অবস্থায় আজই নতুন নয়। একটা সুবিধে আছে ওর—খোলা জায়গা পেরিয়ে আসতে হবে রাইডারদের এবং জানে

ঠিক কোথায় ওর অবস্থান। এত অধৈর্য না হলেও চলে, কয়েকটা দিন অবরোধ করে রাখলে বাধ্য হয়ে ওকে বেরিয়ে যেতে হবেই। কিন্তু এত ধৈর্য ওদের নেই, একে তো দলে ভারী তার ওপর এই প্রথম বাগে পেয়েছে ওকে। যে-জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরা তা সামনে পেলে নিজেকে সামলে রাখতে পারে কজন?

ঠিক ইন্ডিয়ানদের মত বেরিয়ে এল ওরা দল বেঁধে, দ্রুত, নিঃশব্দে। কিন্তু ব্রুকসের সহজাত প্রবৃত্তি ওকে সতর্ক করে দিয়েছে। তিনজন বেরিয়ে আসতে সমানে গুলি চালাতে শুরু করল। সংক্ষিপ্ত লড়াইটা স্থায়ী হলো মাত্র কয়েক সেকেন্ড। দুটো লাশ আর একটা ঘোড়া পড়ে রইল জায়গাটায়। পরেরবার আরও সাবধানে আসবে; পিস্তল রিলোড করার সময় ভাবল ব্রুকস, এবং দুদিক থেকে একসঙ্গে হামলা করার চেষ্টা করবে।

অসম লড়াইটাতে ও এখনও টিকে আছে কেন? এর কারণ পরিবেশ সবসময়ই ওর অনুকূলে ছিল এবং তারচেয়েও বড় কারণ-ব্রুকস লড়েছে নিজের প্রাণ বাঁচাতে, যখুনি সুযোগ পেয়েছে নিষ্ঠুরের মত চড়াও হয়েছে প্রতিপক্ষের ওপর, বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি বা দয়া দেখায়নি। ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে। এ নিয়ে কোন অপরাধবোধ নেই ওর কারণ কিছু খুনীকে মেরেছে ও সুযোগ পেলে যারা অবলীলায় ওকেই খুন করত। একই মনোভাব দেখাতে দোষ কোথায়? দল বেঁধে এতগুলো লোক হামলা করতে পারলে ও কেন ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারবে না? সবচেয়ে বড় ব্যাপার এখানে ওর পথ কেবল দুটি—হয় মারো নয়তো নিজে মরো, মাঝামাঝি কিছু নেই।

অন্যদিকে বার-পি ক্রুরা লড়ছে টাকার বিনিময়ে, পৈত্রিক প্রাণ বিসর্জন দেয়ার ইচ্ছে তাদের নেই। বরং অবস্থা বেগতিক দেখলে পিছুটান দিতেও দ্বিধা করবে না। নাগালের মধ্যে ওকে পেলে উল্লসিত হবে, এখন সে-সুযোগ এসেছে। নগদ টাকার পাশাপাশি জেদের পর্যায়ে চলে গেছে ব্যাপারটা, একটু আগে মরিয়া হয়ে আক্রমণ চালানোর কারণ এটাই। তার মাসুলও দিয়েছে। যারা মারা গেল জুলিয়াস পারকারের টাকা তাদের কোন কাজে আসবে না, করুণাভরে ভাবল ও। অদ্ভুত যোগাযোগ! ঠিক মত এদের বেশিরভাগ লোকই ওকে চেনে না, অথচ ধাওয়া করছে মানুষগুলো, আর ব্রুকসও অবলীলায় তাদের প্রাণ সংহার করছে। পারকারের প্রতিহিংসা আর জেদ এর জন্যে দায়ী। কেবল এতগুলো লোককেই নয়, এদের প্রত্যেকের পরিবারকেও পিস্তলের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে দাম্ভিক বুড়োটি, নিজেকেও। তবে একটি সান্ত্বনা আছে ওর, তিক্ত মনে ভাবল ব্রুকস, ও মারা গেলে আফসোস করবে না কেউ। পারকার তাতে ছেলেকে ফিরে পাবে না কিন্তু শোধ নিয়েছে এ চিন্তা করার সুযোগ পাবে। শুধু এ প্রবোধটুকু পেতে এত আয়োজন, এত রক্তক্ষয়-প্রাণহানি! জুলিয়াস পারকারের প্রতি ঘৃণা অনুভব করছে ও, কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল-বেঁচে থাকলে ছাড়বে না বুড়োকে। মাসুল তাকে দিতেই হবে। এতগুলো মানুষ দিয়েছে, আশপাশে যারা আছে তাদের অনেকেই দেবে, ব্রুকস নিজেও। যদি বেঁচে থাকেও, ওর শান্তিপূর্ণ জীবন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সঙ্কল্প…সব বিলীন হয়ে গেছে। এটা কি কম মূল্যের মাসুল? ওয়েসলি হারডিন হিসেবে এখানে থাকতে চায়নি ও, গত তিনটে বছরে হারডিন নামের লোকটা পশ্চিম থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। ওরা আবার তাকে জন্ম দিয়েছে, এখানে মরগান পিসের এই উপত্যকায়। ব্রুকস যেমন নিজের শান্তিপ্রিয় পরিচয় হারিয়েছে, তেমনি চড়া মূল্যের কিছু একটা মাসুল দিতে হবে পারকারকে। ছাড়া সে পাবে না। জন ওয়েসলি হারডিন কেমন মানুষ জানবে সে, এ কদিনে তার কুরা যেমন জেনেছে।

অখণ্ড নীরবতায় সময় বয়ে চলেছে। মানসিক চাপ বাড়ছে। ব্রুকস জানে এভাবে বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। একসময় ওকে বেরিয়ে যেতেই হবে। প্রতিপক্ষকে টপকে যেতে হবে নয়তো অন্য কোন পথে সটকে পড়তে হবে। রাতটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়। অন্ধকারে কাছে চলে আসতে পারবে লোকগুলো, রাত জেগে পাহারা দেয়া সম্ভব নয় ওর পক্ষে। কয়েকদিনের লাগাতার ছোটাছুটিতে এমনিতেই ক্লান্তির চরমে পৌঁছে গেছে ও।

সন্ধ্যা পর্যন্ত কিছুই ঘটল না। বার-পি রাইডাররা বোধহয় রাতের অপেক্ষায় আছে। এদিকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ব্রুকস। স্যাডল হর্নে যে ল্যাসো ছিল লম্বায় ওটা পঞ্চাশ ফুটের মত। অ্যাসপেন ঝোপের ঠিক পেছনেই মজবুত দুটো সিডার, তারই একটার গুঁড়িতে ল্যাপোর একপ্রান্ত বেঁধে ক্লিফের কিনারা ধরে ঝুলিয়ে দিয়েছে। বেশ কবার ভেবে দেখেছে, ঝুঁকিটা নেয়া ছাড়া উপায় নেই। ওদের হাতে পড়ে অসহায়ভাবে মরার চেয়ে এ-ই ভাল।

অন্ধকার পুরো গাঢ় হতে ক্রল করে লাশগুলোর দিকে এগোল ব্রুকস, সময় নিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে। মৃত ঘোড়াটার কাছে পৌঁছাতে যেন একযুগ লেগে গেল। ল্যাসো নিয়ে নিরাপদে ফিরে এল। আগেরটার সাথে জোড়া লাগাল। সব মিলিয়ে একশো ফুটের মত হবে, মন্দ নয়। রোয়ানের কাছে গেল এবার, গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে কথা বলল। খরখরে জিভ দিয়ে ওর গাল, হাত চেটে দিল ঘোড়াটা। গলায় ক্যান্টিন ঝুলিয়ে পিছিয়ে এল ও, ল্যাসো ধরে নামতে শুরু করল।

শক্ত পাথুরে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে নেমে যাচ্ছে, তাড়াহুড়ো করছে না। বাহু, কাঁধ আর হাতের ওপর চাপ পড়ছে। দস্তানার আবরণ শক্ত ল্যাসোর অত্যাচার থেকে বাচাতে পারছে না ওর হাতের মুঠিকে। ছেচড়ে নেমে যেতে পারে, কিন্তু তাতে পরিশ্রম কম হলেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে। নিস্তব্ধ রাতে অনেকদূর থেকে শোনা যাবে শব্দটা।

ল্যাসো শেষ হওয়ার আগেই ক্লিফের গা থেকে বের হওয়া একটা চাতালে এসে নামল ও। বসে বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ, স্বাভাবিক হয়ে এল শ্বাস-প্রশ্বাস। উঁকি দিয়ে নিচে ক্লিফের খাড়া শরীর দেখল। নেমে যাওয়া সম্ভব, সেজন্যে অসীম ধৈর্য আর মনোবল দরকার হবে। মনে মনে একটা জিনিসই প্রার্থনা করছে, লোকগুলো যেন এখনই ওকে দেখতে না পায়। আরেকটা ভয় আছে, নামার পথে ক্লিফের গায়ে জন্ম নেওয়া বেশ কিছু গুল্ম জাতীয় গাছের সাহায্য নিতে হবে, ওগুলোর কোন একটা ওর ওজন সইতে না পারলে চুকে যাবে সব।

বড় করে শ্বাস টেনে বুক ভরে নিল ব্রুকস, ফের নামতে শুরু করল। প্রচুর সময় লাগছে। অন্ধকার ওকে আড়াল করেছে ঠিকই, আবার বেরসিকের মত ক্লিফের নিরেট শরীর ঠিকমত ঠাওর করতেও দিচ্ছে না। ক্রমাগত ঝুলে থাকায় টান টান হয়ে আছে হাত-পা, বিশ্রাম চাইছে শরীর। ভয় হচ্ছে হাত ছুটে গিয়ে নিচে আছড়ে পড়বে। বাধ্য হয়ে একপাশে সরে গুহার মত ছোট্ট একটা জায়গায় এসে থামল। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল প্রথমে, একটু সুস্থির হতে পানি খেল।

ক্যান্টিনে বাকি যেটুকু পানি ছিল তা নাকে-মুখে, ঘাড়ে ছিটিয়ে দিল। আর চল্লিশ কি পঞ্চাশ ফুট, তারপরই নদীতে নেমে পড়বে—পানি পাওয়া যাবে, সেই সাথে এবারকার মত বোধহয় ফাঁকি দিতে পারবে লোকগুলোকে।

দুর্ঘটনাটা ঘটল হঠাৎ করে। একটা জুনিপারের শুকনো কাণ্ডে শরীরের ভার চাপিয়ে দিতে গোড়াসুদ্ধ হাতে উপড়ে এল সেটা, আর হেঁচড়ে নেমে যেতে শুরু করল ওর দেহ। দুহাত ছড়িয়ে দিল ও, প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিছু একটা ধরতে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে শরীরের কয়েক জায়গায়, ক্লিফের দেয়ালে ঘর্ষণের ফল। কিন্তু সেটা মোটেই ভাবাচ্ছে না ওকে। শেষ মুহূর্তে এসে বৃথা গেল এত পরিশ্রম, তিক্ত মনে ভাবল ও। আতঙ্কিত ব্রুকস ডানহাতে কিছু একটা লাগতে চেপে ধরেও আশান্বিত হতে পারল না। টান টান হয়ে গেল অ্যাসপেনের কচি ডগা, কিন্তু ধরে রাখল ওকে। ওর আতঙ্ক এবার বাস্তবে রূপ নিল, নিঃশব্দ রাত্রিতে বার-পি ক্রুদের উচ্চকিত গলা শোনা গেল এবং বলা বাহুল্য সেটা ওর কানে অনেক জোরাল মনে হলো।

ত্রিশ ফুট নিচে খরস্রোতা নদীর বুকে ডুবন্ত পাথর দেখা যাচ্ছে। একবার ভাবল হাত ছেড়ে দেবে, যা হয় হোক। শেষে তাড়িয়ে দিল সে-চিন্তা। আবছা অন্ধকারে হয়তো ওর সঠিক অবস্থান আঁচ করতে পারবে না প্রতিপক্ষ।

উরুতে প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করতে ভুলটা ভাঙল, মনে হলো মাংস ভেদ করে আমূল ঢুকে গেছে তীক্ষ্ণধার একটা ছুরি। দারুণ ওদের হাত, অন্ধকারেও ওর অবস্থান ঠিক আঁচ করে নিয়েছে এবং সমানে গুলি করছে। ডান কাঁধে বিধল পরের গুলি। কেউ যেন অ্যাসপেনের ডাল থেকে প্রবল টানে ছুটিয়ে দিয়েছে ওর হাত, নামতে শুরু করল ভারী শরীর। আশপাশে বুলেট-বৃষ্টি হচ্ছে, কাছ দিয়ে যাচ্ছে সবকটা।

সশব্দে পানিতে আছড়ে পড়ল ওর দেহ। স্রোত টেনে নিয়ে চলল ওকে। এড়াবার কোন সুযোগই পেল না ব্রুকস, সোজা গিয়ে আছড়ে পড়ল পাথরটার ওপর। প্রচণ্ড ধাক্কায় টলে উঠল ওর পৃথিবী, অন্ধকার নেমে এল অনুভূতিতে।

উল্লাসে ফেটে পড়ল উপত্যকার লোকগুলো।

<

Super User