দিন যায়। কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না ব্যাপারটা। খেতে পারি না। ঘুমাতে পারি না। কাঁদতে পারি না। ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগে। যন্ত্রণা হয়। সারা জীবনে যত যন্ত্রণা পেয়েছি সেগুলো এর তুলনায় কিছুই নয়। রোগ হলে কিংবা আহত হলে যন্ত্রণা হয়, তার চিকিৎসাও থাকে, কিন্তু এর কোন চিকিৎসা নেই। কেবলই মনে পড়ে কুকুরটার কথা। কি করে সে এল আমাদের বাড়িতে, কি করে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম, কি করে আরলিসকে ভালুকটার কবল থেকে বাঁচিয়েছিল সে, কি করে খেপা শুয়োরের কবল থেকে আমাকে রক্ষা করেছিল, কি করে পাগল নেকড়ের সঙ্গে লড়াই করে আম্মা আর লিজকে বাঁচিয়েছিল। ভাবি আর ভাবি। লালু আর চিত্রাকে মারার সময় কল্পনাই করতে পারিনি ইয়েলারকেও গুলি করতে হবে আমাকে।

এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায় আম্মা। তাকে বলতে দিই। আম্মা আমাকে বোঝায়। আমিও সে সব বুঝি। কিন্তু মন থেকে শূন্য অনুভূতিটা দূর করতে পারি না কিছুতেই।

লিজও আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। কথা কম বলে সে, বেশি লাজুক। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা কথাই বলে, আর একটা কুকুর তো হয়েই গেছে তোমার। ইয়েলারের বাচ্চা। সবচেয়ে ভালটাই দিয়েছি।

কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয় না। ইয়েলারের বাচ্চা হতে পারে, কিন্তু ইয়েলার তো নয়। আমাদের সকলের জীবন বাঁচিয়েছে সে, অথচ তাকে এমন ভাবে গুলি করে মারা হলো যেন কোন দামই নেই তার।

তারপর একরাতে মেঘ করল খুব। সারা রাত বৃষ্টি হলো। সকালে থামল। আমার মনে। হতে লাগল, এ বৃষ্টি ঈশ্বরের আশীর্বাদ। ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে এবার জলাতঙ্কের জীবাণু।

পরদিন সকালে বষ্টি থামতেই দেখলাম আব্বাকে। কাদা মাড়িয়ে আসছে ঘোডায় চড়ে।

বহু পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাকে। কানসাসে একবার যাওয়া, একবার আসা, সহজ কথা নয়। বেতের মত হয়ে গেছে শরীর। দড়ির মত ফুলে উঠেছে রগ। তবে পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে এসেছে। সবার জন্যে এনেছে আনন্দ, আর আমার জন্যে একটা চমৎকার ঘোড়া। নীলচে গায়ের রঙ। কালো কেশর, কালো লেজ। প্রথমেই ধরে আমাকে ওটার পিঠে চড়িয়ে দিল আব্বা। এক চক্কর দৌড়ে আসতে বলল।

দৌড় করাতে গিয়ে বুঝলাম ঘোড়াটা সত্যিই ভাল। একেবারে আগুন। অথচ মেজাজ ঠাণ্ডা। শান্ত। যে কোন পুরুষের গর্ব।

কেমন বুঝলি? জিজ্ঞেস করল আব্বা।

ভাল।

আব্বা ভেবেছিল আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করব আমি। অনেক খুশি হব, তাকে ধন্যবাদ দেব। কিন্তু কিছুই করলাম না। ঘোড়াটা আমাকে পুলকিত করতে পারল না।

একটা কিছু হয়েছে, বুঝে গেল আব্বা। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল আম্মার দিকে। নীরবে শুধু মাথা নাড়ল আম্মা।

সন্ধ্যার একটু আগে আমাকে ঝর্নার ধারে ডেকে নিয়ে গেল আব্বা। পাশে নিয়ে বসল কথা কলার জন্যে। বলল, তোর আম্মা আমাকে সব বলেছে।

হুঁ, এর বেশি কিছু আর বলতে ইচ্ছে হলো না।

ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক। তবে তোর জন্যে আমার খুব গর্ব হচ্ছে ট্রাভিস। যে ভাবে সামাল দিয়েছিস তুই, একজন পুরুষ মানুষই কেবল পারে এরকম। তুই বড় হয়ে গেছিস।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আব্বা। কয়েকটা নুড়ি তুলে নিয়ে এক এক করে ছুঁড়তে লাগল পানিতে। লম্বা পা-ওয়ালা এক ধরনের পোকা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায় পানির ওপর। ওগুলোর মাঝে ঢিল পড়লেই অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে ছুটে সরে যায় এদিক ওদিক।

পানির দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, এখন পুরুষের মতই আচরণ করতে হবে তোকে। ভুলে যেতে হবে সব।

কি করে? এরকম একটা ঘটনা মানুষ ভোলে কি করে?

মুখ ফেরাল আব্বা। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। মাথা নাড়ল, ঠিক এটা বোঝাতে চাইনি আমি। এমন কথা ভোলে না মানুষ, ভোলা যায় না। ভুললে তো অমানুষ হয়ে গেল। আমি বলতে চাইছি, ভুলে থাকতে হবে। জীবনে এমন ঘটনা তো ঘটবেই, আরও ঘটবে। খুব নিষ্ঠুর মনে হবে সেগুলোকে। কিন্তু নিষ্ঠুরতা জীবনেরই অঙ্গ।

কিন্তু তাই বলে এটাই জীবনের সব নয়। খারাপ যেমন আছে, অনেক ভালও আছে। খারাপগুলোর জন্যে দুঃখ করে করে ভালগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা মুর্খতা। অন্তত বুদ্ধিমান পুরুষ মানুষের সেটা করা উচিত নয়। তাতে ভালগুলোও খারাপ হয়ে যায়।

হুঁ, আবার একই ভঙ্গিতে বললাম। বুঝলাম সবই, কিন্তু তাতে মনের কোন পরিবর্তন হলো না আমার। সেই আগের মতই ভোতা আর শূন্য হয়ে রইল মনটা।

আরও একটা হপ্তা পেরোল। তারপর এমন একটা ঘটনা ঘটল, যাতে হঠাৎ করেই চাঙা হয়ে উঠলাম আবার।

জাম্পার আর ঘোড়াগুলোকে খাবার দিচ্ছি আমি। এই সময় বাড়ির ভেতর থেকে আমার চিৎকার শোনা গেল, অ্যাই অই চোর! দে, দে বলছি! পরক্ষণেই কেউ কে র উঠল কুকুরের বাচ্চাটা।

রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বন্দুকের গুলির মত ছিটকে বেরোতে দেখলাম বাচ্চাটাকে। আস্ত একটা রুটি ঝুলছে মুখে। লেজটা দু-পায়ের ফাঁকে গুটানো। এমন চিৎকার করছে যেন পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে তাকে। কিন্তু রুটি ছাড়ছে না দাঁত থেকে।

বাড়ির ভেতর মহা হই-চই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে আরলিস। আম্মাকে গালাগাল করছে। কুকুরের বাচ্চাটাকে মারার প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে সে-ও নিশ্চয় আম্মার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। আম্মাও চিৎকার করছে। আব্বা হাসছে হো হো করে।

বাচ্চাটাকে ওভাবে বেরোতে দেখে মনের কোথায় যেন একটা গিট খুলে গেল আমার। কেটে গেল শূন্যতা। একটা বোঝা নেমে গেল মন থেকে।

সেদিন সারাটা দিনই ভাল কাটল আমার। ঘোড়াটাকে বের করে তাতে চেপে রওনা হলাম বনের দিকে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ালাম বনের মধ্যে, শুকনো খাড়িতে, পাহাড়ের ঢালে।।

ঘুরে ঘুরে সূর্য ডোবার আগে এসে পৌঁছলাম বার্ডসং ক্রীকের ধারে। কানে এল আরলিসের চেঁচামেচি। দেখি, একেবারে ন্যাংটো হয়ে ডোবার পানিতে দাপাচ্ছে সে। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে রুটি-চোর বাচ্চাটা। খাওয়ার পানি নষ্ট করছে।

ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। হেসে উঠলাম শব্দ করে। ঘোড়া থেকে নেমে ডোবার উঁচু পাড়ে বসে হাসতেই থাকলাম। হাসিটা এক সময় কান্নায় রূপ নিল।

কান্নাও থেমে গেল এক সময়। একেবারেই হালকা হয়ে গেছে মন। আবার গিয়ে ঘোড়ায় চাপলাম। রওনা হলাম বাড়ির দিকে। ভাবছি, কালই কাঠবেড়ালি শিকারে বেরোব আরলিস আর কুকুরের বাচ্চাটাকে নিয়ে। এখনও ওটা অনেক ছোট। কিন্তু তাতে কি? যে এই বয়েসেই বাপের মত পাকা চোর হতে পারে, সে বাপের মত পাকা শিকারী হতে পারবে না কেন?

আর কোন দুঃখ রইল না। আমার ওল্ড ইয়েলারকে ফিরে পেয়েছি।

***

<

Super User