দুদিন পর আরও খেপে গেলাম ওল্ড ইয়েলারের ওপর। কারণটা খুলেই বলি।

দুটো লংহর্ন ষাঁড় এসে আমাদের উঠানে ঝগড়া বাঁধাল। রুটি, হরিণের মাংস ভাজা, আর ঝর্নার ভাটি থেকে তুলে আনা শালুক দিয়ে ডিনার খাচ্ছিলাম। দক্ষিণের উঁচু শৈলশিরা থেকে নেমে এল একটা ষাঁড়। ক্যাটক্ল আর ওকের জঙ্গলের ভেতরে ওটার ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শুনতে পেলাম। রেগেছে কোন কারণে।

কিছুক্ষণ পর গলা চড়িয়ে এমন চিৎকার শুরু করে দিল যেন শিঙ্গা ফুঁকছে-পাহাড়ের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে গেল চারপাশে কয়েক মাইল।

ব্যাটার মাথা গরম হয়েছে, আম্মা আর আরলিসকে বললাম। বলছে, আমার চেয়ে কে বড়, গায়ে জোর বেশি, আয় দেখি, হয়ে যাক এক হাত-সামনে পড়লে বাপের নাম ভুলিয়ে ছাড়ব।

কিন্তু বাপের নামের পরোয়া করল না একটা বোকা ষাঁড়। সল্ট লিকের কাছে কোথাও থেকে বলল, কোথাকার কোন হাঁদারাম রে! এত বড় বড় কথা! তোকে তো আমি এক ফুয়ে উড়িয়ে দিতে পারি! আমি হলাম গে এ অঞ্চলের রাজা! আমার সঙ্গে মাতব্বরী করতে এসেছিস তুই কে রে!

বসে বসে শুনতে লাগলাম ওগুলোর হাঁক-ডাক। ঝোপের ভেতর দিয়ে একটা আরেকটার কাছাকাছি চলেছে। রেগে আগুন হচ্ছে ক্রমেই।

ষাঁড়, ভালুক, বুনো শুয়োর এসব বুনো জানোয়ারের লড়াই দেখতে আমার ভাল লাগে। এক লাফে উঠে ছুটে গেলাম দরজার কাছে। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম। ঠিক করে ফেলেছি, লড়াই যদি বাঁধে, দেখতে যাবই আজ। প্রচুর আগাছা হয়েছে খেতে, নিড়ানি দেয়া দরকার, সেই কাজ বাদ দিয়ে হলেও লড়াই দেখব।

ঝর্নার শখানেক গজ ওপরে একটা উঁচু জায়গায় আমাদের ঘরটা। অনেক দিন আগেই আশেপাশের সমস্ত গাছপালা, বন-জঙ্গল কেটে সাফ করে দিয়েছে আব্বা। ঘরের কাছাকাছি দুটো ওক রেখে দিয়েছে শুধু, ছায়া পাওয়ার জন্যে। বাড়ির পাশে জঙ্গল হয়ে থাকলে এমনিতেই ভাল লাগে না। তবে কেটে ফেলার আরও একটা কারণ আছে। কোমাঞ্চি কিংবা অ্যাপাচি ইনডিয়ানরা আমাদের মাথা কাটতে আসতে চাইলে যাতে দূর থেকেই তাদের দেখতে পারে, গুলি চালিয়ে খতম করে দিতে পারে, সেই জন্যে। দরজা থেকেই নিচের অনেকখানি চোখে পড়ে। খোলা জায়গায় বেরোতে দেখলাম প্রথম ষাঁড়টাকে। অনেক দিন আগে ওখানে একটা কোমাঞ্চিকে গুলি করে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছিল আব্বা।

সরষে রঙের চামড়া ষাঁড়টার। চোয়াল আর পেটের নিচে কালো ফুটকি। বিশাল দুটো শিঙের একটার মাথা ওপর দিকে তোলা, খোঁচা মারার মস্ত সুবিধে, মারাত্মক অস্ত্র। আরেকটা নিচের দিকে ঝুলে আছে অদ্ভুত ভঙ্গিতে, যেন মোমের তৈরি, গরমে নরম হয়ে ঝুলে গেছে। এরকম শিংওয়ালা বঁড়কে মেকসিকানরা বলে চোঙ্গো, অর্থাৎ ঝোলা শিং।

দুলকি চালে হেঁটে এসে খোলা জায়গাটায় ঢুকল সে। মাথাটা নিচু করে একবার ঝাড়া দিল। তারপর শুরু করল একনাগাড়ে ঘোঁৎ-ঘোৎ। শিং ঝাড়ছে আর সামনের খুর দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। সেগুলো ছুঁড়ে দিচ্ছে ঘাড়ের ওপর দিয়ে, ধুলোর ঝড় তুলছে।

অন্য ষাঁড়টাকে দেখতে পাচ্ছি না, তবে ডাক শুনে বুঝতে পারছি কাছাকাছিই আছে, এগিয়ে আসছে দ্রুত।

চেঁচিয়ে ডাকলাম আম্মা আর আরলিসকে। জানালাম, ভাল জায়গায় এসেছে। দেখতে পারব।

আমাদের কেবিনের চারপাশে কাঠের বেড়া। দৌড়ে গিয়ে উঠে বসলাম তার ওপরে, যাতে আরও ভাল করে দেখতে পাই। আম্মা আর আরলিসও এসে আমার পাশে উঠে বসল।

খোলা জায়গাটার আরেক পাশ দিয়ে ঢুকল দ্বিতীয় ষাঁড়টা। সেই লাল গরুটা, হরিণ মারতে গিয়ে সল্ট লিকের কাছে যেটাকে দেখেছিলাম। চোঙ্গোর মত পা অত লম্বা নয়, এত উঁচু আর বড়ও নয়, তবে শরীরটা বেশ গাট্টাগোট্টা, ভারি, গায়ে জোরও আছে বোঝা যায়। খাটো খাটো শিং, তবে দুটোই ওপর দিকে তোলা, দুদিক থেকেই খোঁচা মারতে পারবে।

লালুও চোঙ্গোর মত শিঙ্গা বাজাতে বাজাতে ঢুকল। থমকে দাঁড়িয়ে দেখল একবার প্রতিপক্ষকে। তারপর শিং ঝেড়ে, খুর দিয়ে খুঁচিয়ে মাটি তুলে, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, লড়াই করতে তারও এক বিন্দু আপত্তি নেই।

ঠিক এই সময় কেবিনের পেছন থেকে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে বেরোল ওল্ড ইয়েলার। ঘাড়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। ষাঁড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার। ছুটে গেল বেড়ার নিচ দিয়ে। গরুর অত বাহাদুরি পছন্দ হয়নি তার। চিৎকার করে যেন বলতে লাগল, হারামজাদা, বেল্লিক কোথাকার, মরার আর জায়গা পাওনি! যা এখান থেকে, অন্য কোথাও গিয়ে মরগে যা!

ধমক দিয়ে বললাম, সর্ হারামজাদা কুত্তা! তোকে কে মাতব্বরি করতে বলেছে!

লাফালাফি বন্ধ হলো তার, কিন্তু চুপ করল না। চেঁচিয়েই চলল।

ভীষণ রাগ লাগল। লাফ দিয়ে নামলাম মাটিতে। একটা পাথর তুলে নিলাম। আমার ঢিল কি জিনিস জানা আছে তার। মারতে আর হলো না, আমি হাত তুলতেই কেঁউ কেঁউ করে ছুটে পালাল। গিয়ে লুকাল কেবিনের পেছনে।

গেল রেগে আরলিস। আমাকে গালাগাল শুরু করল। তাতেও আমার কিছু হচ্ছে না দেখে বেড়া থেকে নামার চেষ্টা করল। ঢিল মারবে।

নামতে দিল না আম্মা। বোঝানোর চেষ্টা করল, অমন করছিস কেন? মেরেছে নাকি? শুধু ভয় দেখাল। গরুগুলোকে তাড়ালে লড়াই দেখবি কি?

কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে আমাকে না মেরে ছাড়বে না। শেষে ধমক দিয়ে তাকে থামাল আম্মা।

আবার উঠে বসলাম বেড়ায়। বাজি ধরাধরি শুরু হয়ে গেল আমার আর আম্মার মধ্যে। বললাম, আমি চোঙ্গো। ওর গায়ে জোর বেশি।

আম্মা বলল, আমি লালু। শিং দেখেছিস? ফেড়ে ফেলবে চোঙ্গোকে। হম্বিতম্বি আর বাহাদুরি চলল কিছুক্ষণ ষাঁড়দুটোর। হুমকি দিয়ে বলল যেন একটা, মাপ চা। ছেড়ে দেব।

অন্যটা বলল, তুই চা না। নাকে খত দে।

এঁএঁহ, নাকে খত! পারলে তুই দে না। তা-ও তো পারবি না। শিং একখান আছে। ঝুলে। খত দিতে হলেও তো ওটা খুলে রেখে আসতে হবে।

এই শিঙের ক্ষমতা জানিস?

জানব না কেন? কচু করবি তুই, চোঙ্গোর বাচ্চা চোঙ্গো।

কি, এতবড় কথা! আর সহ্য করল না চোঙ্গো। হঠাৎ মাটি খোঁড়া থামিয়ে লেজ উঁচু করে ফেলল।

অ্যাই, শুরু হলো! চেঁচিয়ে উঠলাম।

বিকট হাঁক ছেড়ে খুরের ঘায়ে মাটি কাঁপিয়ে তেড়ে গেল চোঙ্গো। লালুও সমান তেজে ছুটে এল মাথা নিচু করে শিং বাগিয়ে, লেজটা আকাশের দিকে তুলে।

দারুণ উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলাম আমিও।

দড়াম করে বাড়ি লাগল মাথায় মাথায়। শিঙের ঠোকাঠুকি। কেঁপে উঠলাম, যেন আমার গায়েই লাগল। বন্ধ করে ফেললাম চোখ। মনে হলো, দুটোরই মাথা শেষ, ফেটে চৌচির। কিন্তু কতটা শক্ত খুলি, তখনও বুঝিনি। পড়ে গেল লালু। চোঙ্গো জিতছে ভেবে হই হই করে উঠলাম।

বেশিক্ষণ আমাকে খুশি থাকতে দিল না লালু। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। খুরের ঘায়ে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে গিয়ে ঘ্যাঁচাং করে শিং ঢুকিয়ে দিল চোঙ্গোর কাঁধে। ঠেসে ধরে রাখল।

আটকা পড়ল চোঙ্গো। ঘুরতেও পারছে না, খুলতেও পারছে না শিংটা। কোনমতে খাড়া রয়েছে। বেকায়দা অবস্থায়।

ঠেলতে আরম্ভ করল লালু।

কাঁধে গেঁথে আছে শিং। বাধা দিতে পারছে না চোঙ্গো। ঠেলার চোটে সরছে। চলে আসছে আমাদের বেড়ার কাছে।

আঁতকে উঠল আম্মা। সব্বোনাশ! বলে এক লাফে বেড়ার ওপর থেকে নেমে পড়ল। টান দিয়ে নামাল আরলিসকে।

কিন্তু আমি এতটাই উত্তেজিত, তখনও টের পেলাম না বিপদটা। দেখতে দেখতে বেড়ার কাছে চলে এল ষাঁড়দুটো। এক ধাক্কায় বেড়ার কাঠ, খুঁটি ভেঙে ফেলল, যেন ওগুলো শোলার তৈরি। পড়ে গেলাম মাটিতে, জানোয়ার দুটোর পায়ের কাছে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আতঙ্কে কাঁপছে বুক। দাঁড়িয়েও সারলাম না, আবার ধাক্কা। মুখ খুঁজে পড়ে গেলাম মাটিতে। ধরে নিলাম, আমি শেষ। কানের কাছে ষাঁড়ের গোঁ গো, ফোসফোসানি। রক্তের উষ্ণ, আঠাল গন্ধ নাকে লাগছে। আমার চারপাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনেকগুলো খুর, একটা খোঁচাই আমার পাজরা গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। চোখের সামনে ধুলোর মেঘ। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।

আম্মার হাত এসে পড়ল আমার হাতে, চেপে ধরল, টেনে সরিয়ে নিতে লাগল। আতঙ্কিত গলায় চিৎকার করছে, ওঠ, ট্রাভিস, পালা!

কোনমতে উঠেই দিলাম দৌড়। আমার হাত ছাড়ল না আম্মা। ডাইভ দিয়ে গিয়ে পড়লাম কেবিনের ভেতর। আম্মা ঢুকে দরজাটা কেবল লাগাল, ভ্রাম করে তার ওপর এনে চোঙ্গোকে ফেলল লালু।

থরথর করে কেঁপে উঠল ঘর। বেড়ার গায়ে লেপে দেয়া কাদার আস্তর বড় বড় টুকরোতে ঝরে পড়ল। ভয় পেলাম, দরজা ভেঙেই না ঢুকে পড়ে! পড়ত, পারল না বিশাল বপুর জন্যে। দরজার ফাঁকের তুলনায় ওগুলোর শরীর অনেক বড়।

নিজেকে ছাড়িয়ে নিল চোঙ্গো। পাল্টা আঘাত হানার জন্যে ঘুরল। দুটোই এখন মুক্ত। দাপাদাপি বাড়ল। আবার মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি। শিঙে শিঙে ঘষাঘষি। বারবার এসে পড়ছে বেড়ার গায়ে। কেঁপে উঠছে ঘর।

আম্মার দিকে তাকালাম। চাদরের মত সাদা হয়ে গেছে মুখ। ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে আরলিস। একেবারে চুপ। চিৎকার করতেও ভয় পাচ্ছে। এসব দেখে হঠাৎ ভয় চলে গেল আমার। মাথা চাড়া দিয়ে উঠল রাগ। খেপে গেলাম, দাড়া ষাঁড়ের বাচ্চা ষাঁড়, আজ তোদেরই একদিন কি আমারই একদিন!

বেড়ায় গাঁথা কাঠের গোঁজ। তাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঝোলানো যোলো ফুট লম্বা একটা চাবুক। কাঁচা চামড়া পাকিয়ে তৈরি। খুলে নেয়ার জন্যে হাত বাড়ালাম।

কঁকিয়ে উঠল আম্মা, না না, এখন বাইরে বেরোসনে!

বললাম, ঘরটা তো ভাঙবে!

কিন্তু বেরোলেই ভর্তা করবে তোকে!

আবার বেড়ায় এসে আছড়ে পড়ল গরুদুটো। গোঁ-গো, ঘোৎ-ঘোৎ, বঁ-বঁ, ফেঁস-ফাঁস, যত রকম শব্দ করতে পারে ষাঁড়েরা, সব করছে। শিঙের গুঁতো, খুরের লাথি পড়ছে বেড়ায়।

দরজার দিকে এগোলাম। দেয়াল ভাঙতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। কোনভাবে ঘরে ঢুকে পড়লে যে শুধু ঘরটাই যাবে তা নয়, আমরাও শেষ হব।

ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরল আম্মা, কুত্তাটাকে দিয়ে তাড়া! পায়ে কামড়ে দিলেই ভাগবে!

বাহ্, এই তো সুযোগ! এতক্ষণ ভাবিনি কেন? তাড়াতে পারলে তো একটা কাজের কাজই করল, না পারলে লাথি মেরে তাড়াব। আম্মাকে যুক্তি দেখাব, অপদার্থ একটা কুত্তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর কোন মানে হয় না।

দরজা দিয়ে সাবধানে মাথা বের করলাম। ঘরের কাছ থেকে আবার সরে গেছে গরুদুটো। উঠানের পুরো বেড়াটাকেই ধসিয়ে দেয়ার মতলব যেন।

ঘর থেকে বেরিয়ে মাথা নিচু করে ছুটলাম। একদৌড়ে ডগ রানের একপাশ দিয়ে ঢুকে ছুটে বেরোলাম আরেক পাশ দিয়ে। চেঁচাতে লাগলাম, ইয়েলার! ইয়েলার! বলে। গরুগুলোকে তাড়াতে বললাম।

ঘরের পেছনে রয়েছে সে। আমার চিৎকারও শুনল। কিন্তু গরুর কাছে গেল না। চাবুক হাতে দেখে ভাবল তার ছাল ছাড়াতেই বেরিয়েছি। খাটো লেজটাকে দুপায়ের ফাঁকে গোটানোর চেষ্টা করতে করতে বনের দিকে ছুট। কেউ কেউউ করে টেনে টেনে চিৎকার, যেন বলছে, ওরে বাবারে, মেরে ফেলল রে, মেরে ফেলল!

সেটা করতে পারলেই খুশি হতাম। কিন্তু ভীতুর ডিম একটা কুত্তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তখন নেই। গরুগুলোর ব্যবস্থা করা দরকার। জায়গাটা ধ্বংস করে ফেলছে। অনেক কষ্ট অনেক পরিশ্রম করে এই বাড়ি-ঘর তৈরি করেছে আব্বা, আমার ওপর দেখাশোনার ভার। দুটো খেপা ষাঁড় স্রেফ গোয়ার্তুমি করে সব নষ্ট করে ফেলবে এটা হতে দিতে পারি না।

এগিয়ে গিয়ে পেটাতে শুরু করলাম। চাবুক আমার হাতে খেলে ভাল। এত জোরে চালাতে পারি, বাতাসেই ফটাস করে পিস্তলের গুলি ফোটার শব্দ তোলে। বাড়ি মেরে কড়ে আঙুলের মত মোটা মেসকিটের ডাল অনায়াসে কেটে ফেলতে পারি।

কিন্তু উন্মত্ত জানোয়ার দুটোর মারামারি থামাতে পারলাম না। শিঙের গুঁতোয় এমনিতেই শরীরে অনেক জখম। সে সবের তুলনায় আমার চাবুকের বাড়ি কিছুই না ওগুলোর জন্যে, ফুঁ। কিন্তু থামলাম না। পিটিয়েই চললাম। চিৎকার তো করছিই।

পেটাতে পেটাতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। পরোয়াই করল না দৈত্যদুটো। আমাদের বাড়িটাকে ধসানোর পণ করেছে যেন। মাটিতে না মিশিয়ে থামবে না। নাহ্, বন্দুকই আনতে হবে দেখছি।

ঘরের একধারে রাখা দুই চাকার একটা মেকসিকান ঠেলাগাড়ি-খড় আর কাঠ বোঝাই করে আনতে কাজে লাগে। ওপাশ থেকে জায়গাটা ঢাল হয়ে নেমে গেছে খাড়ির দিকে।

লালুকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে গিয়ে গাড়িটার গায়ে ঠেসে ধরল চোঙ্গো। খাড়া শিংটা রয়েছে লালুর পেটের নিচে। আচমকা এক ঝাকি…কাত হয়ে গেল লালু…তারপরেই চিত, গাড়ির ওপর পড়েছে, চার পা আকাশের দিকে।

চমকে গেলাম। শেষ পর্যন্ত আমাদের গাড়িটা বুঝি গেল! কিন্তু এতটা শক্ত, ভাবিনি। ধাক্কা খেয়ে চাকাগুলো পিছলে গেল, চলতে শুরু করল গাড়ি। লালুকে নিয়ে তীব্র গতিতে নেমে যেতে লাগল পাহাড় বেয়ে।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল চোঙ্গো। হলোটা কি, যেন বুঝতে পারছে না। কি এমন করল যে পা তুলে দিয়ে উড়ে পালাচ্ছে লালু! মার খেয়ে এমন করে পালাতে দেখেনি আর কোন গরুকে। মানুষ হলে বলা যেত হাঁ করে তাকিয়ে আছে, কিন্তু যেহেতু সে গরু, সেটা আর বলা যাচ্ছে না। লেজ ওপরে তোলা, সামনে বাড়ানো গলা, তাকিয়ে রয়েছে লালুর দিকে। যেন একটা ভাঁড়। খানিক আগের লড়াকু-দৈত্যটার ভঙ্গি দেখে এখন হাসি পেল আমার।

পাথরে ঠোকর খেতে খেতে নেমে গেল গাড়িটা। ঝর্নার কিনারে গিয়ে বড় একটা পাথরে আটকে গেল চাকা। প্রচণ্ড ঝাকি, নিচু হয়ে গেল সামনের দিকটা। প্রায় উড়ে গিয়ে পানিতে পড়ল লালু। ছিটকে উঠল পানি।

তাড়াতাড়ি দাঁড়াতে গিয়ে পা পিছলাল, আবার আছাড় খেয়ে পড়ল পানিতে। আবার দাঁড়াল। ঝাপুত-ঝুপুত করে উঠে এল পানি থেকে। গাড়ির ঝাঁকুনি, পানিতে চুবানি লড়াইয়ের ইচ্ছে দূর করে দিয়েছে তার। লেজ তুলে দৌড়। গা থেকে পানি ঝরে পড়ছে শুকনো বালিতে। ফিরেও তাকাল না আর। সোজা বনে গিয়ে ঢুকল।

লালুকে পানি থেকে উঠতে দেখেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে তেড়ে গেল আবার চোঙ্গো। কাত হয়ে থাকা গাড়িটার কাছে পৌঁছে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়াল। একটা চাকা ঘুরছে তখনও। এই জিনিস আর দেখেনি সে। তাকিয়ে রইল। বোঝার চেষ্টা করছে জিনিসটা কি? নাক বাড়িয়ে শুঁকল। বুঝতে পারল না। সাহস করে গলা আরেকটু লম্বা করে জিভ বের করল। শুঁকে যখন পারল না, যা থাকে কপালে, চেটেই বুঝবে।

চাকার চারপাশে লোহার পাত লাগানো। চলার সময় পাথরে ঘষা খেয়ে এমনিতেই খসখসে হয়ে আছে ওটা, তার ওপর লেগেছে পাথরের কুঁচি আর মাটি। ঘষা লেগে জিভ গেল ছড়ে।

বাআআআ করে বিকট চিৎকার, ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে এল চোঙ্গো। ঘুরতে গিয়ে পা পিছলাল। হড়কে নেমে গেল কিছু দূর। আরেকটু হলে সে-ও পানিতে পড়ত। হাঁচড়ে-পাচড়ে উঠে এসে লালুর মতই লেজ তুলে দিল দৌড়, তবে উল্টো দিকে। বা-বা করে চেঁচাচ্ছে। যেন বলছে, বাবাগো, গেছিগো, আমি আর নেই, আমার জিভ শেষ!

লম্বা হয়ে ঝুলছে জিভটা। বীরত্ব আর বাহাদুরি খতম। পালাতে পারলে বাঁচে এখন।

হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার জোগাড় আমার। দুর্দান্ত একটা লড়াই উপহার দিয়েছে। তবে ক্ষতিও করেছে অনেক। উঠানের বেড়াটা শেষ।

<

Super User