বারউইকের বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল, চমকে ঘুরে দাঁড়াল কর্নেল লরেন কীথ। কী বলতে চাইছ? জিজ্ঞেস করল সে।
শব্দ করে হাসল বারউইক, পুরু ঠোঁটের ফাঁকে চুরুট নাচাল। দৃষ্টিতে বিষ ঢেলে তাকাল কীথের দিকে। কেড্রিক এমন ছেলেমানুষি না করলে কত সুবিধাই না হত! সবদিক দিয়েই কীথের চেয়ে ভালো ছিল ছোঁড়াটা।
কেন, বলল অ্যাল্টন বারউইক, সাক্ষী পাওয়া না গেলে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দাঁড় করানোর উপায় থাকবে না। শহরের লোকজন কী জানে যে প্রকাশ করবে? কিছুই সন্দেহ করতে পারবে না ওর। তা ছাড়া স্রেফ সন্দেহ তো আর ধোপে টিকবে না, আদালত কিংবা তদন্ত কমিটি যাই বলো, নিরেট প্রমাণ চাইবে। কিন্তু তদন্ত কমিটি এখানে আসার আগেই দেখবে চারদিক শান্ত নিঝুম হয়ে গেছে।
করবেটা কী? আবার জানতে চাইল কীথ।
কী করব? তুমিই বলো কী করার আছে? কেড্রিক, লরেডো আর সামান্থার কবল থেকে বাঁচতে হবে না আমাদের? ওদের সরিয়ে দেব। তারপর প্যসি নিয়ে বের হবে, তুমি। রিমের ওপাশে গা ঢাকা দিয়েছে শয়তানগুলো, ওদের নিশ্চিহ্ন করে আসবে। তখন কার সাথে কথা বলবে তদন্ত কমিটি? ভয় পেয়ে গুন্টারের মুখ খোলার আশঙ্কা ছিল, কিন্তু সে এখন নেই, অন্যদেরও পথ থেকে সরিয়ে দেয়া গেলে-
সামান্থাকে বাদ দাও! প্রতিবাদ করে উঠল লরেন কীথ। ওকে নয়! তোমার আল্লার দোহাই!
ভেংচি কাটল বারউইক, ঠোঁট বেঁকে গিয়ে হিংস্র হয়ে উঠল চেহারা। বিশাল শরীর নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। হ্যাঁ, সামান্থাকেও। মেয়েটা আর সবার চেয়ে অনেক বেশি জানে। ধরো, গুন্টার ওকে সব কিছু বলে দিয়েছিল, তা হলে? সেটাই সম্ভব। তো বুঝতেই পারছ, কিছুই অজানা নেই ওর–কিচ্ছু না!
হাঁটতে হাঁটতে কামরার শেষ প্রান্তে চলে গেল বারউইক, ফিরে তাকাল কীথের দিকে। গর্দভ! ক্রুদ্ধ, বিরক্ত বারউইক। আজকাল যে কী সব লোক জন্ম নিচ্ছে দেশে! ভীত, ন্যাকা!-অসহ্য! কীথের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। কাজটা শেষ হওয়ার পরও যদি বেঁচে থাকে-ঠিক হ্যায়, ডরনি শ আবার কাথ লোকটাকে দেখতে পারে না। আচমকা হেসে ফেলল বারউইক। ওহ্, সত্যিকার কাজের লোক ডরনি। বব ম্যাকলেননকে যেভাবে খতম করল! নাও, এবার কথা শোনো, সবাইকে জড়ো করো। ফেসেনডেন, গফ, ক্লসন, পয়েটে আর দুই মিক্সাসকে ডরনি শয়ের সঙ্গে পাঠাও। ওই তিনজনের মৃত্যু চাই আমি, বুঝেছ? হপ্তা শেষ হওয়ার আগেই খতম করতে হবে সবকটাকে-এবং লাশের চিহ্নও যেন না থাকে। ঠিক আছে?
জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল কীথ, চোখে অস্থির দৃষ্টি। এরকম কিছুর জন্যে মোটেই তৈরি ছিল না সে। অল্প সময়ে নিরুপদ্রবে কাজ হাসিল হবে ভেবেছিল, অথচ এখন…
এখন, অস্বস্তির সঙ্গে উপলব্ধি করল কীথ, বিপদ যদি আসে একমাত্র ওর ঘাড়েই সব দোষ চাপবে। পুবে সবরকম লেনদেনের বেলায় আড়ালে ছিল। অ্যাল্টন বারউইক, যেমন এখানে নেপথ্যে থেকেছে সে। সুতরাং যে কোনও ঘাপলার জন্যে ওকেই দায়ী করা হবে; আর র্যানসাম যেখানে তদন্ত চালাতে যাচ্ছে, ঘাপলা হতে বাধ্য!
কিন্তু, লম্বা করে দম নিল লরেন কীথ, বারউইক মিথ্যে বলে নি। এখন একটা পথই খোলা আছে ওদের সামনে। ডরনি, আর তার দলবল অন্তত এ-কাজে আপত্তি করবে না। আচমকা একটা কথা মনে পড়ে গেল কীথের।
ক্লসনের কথা বললে না? ওকে বাদ দিতে হচ্ছে, বারউইক। স্যাডলের। সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় কালরাতে ফিরে এসেছে ক্লসন। না, ক্লসন নয়, তার লাশ, কাঠের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল!
কী বললে? পায়চারি থামিয়ে কীথের সামনে এসে দাঁড়াল বারউইক। এতক্ষণে মনে পড়ল? মাথা নামিয়ে কীথের চোখের কয়েক ইঞ্চি দূরে নিয়ে এল সে। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। ওর ঘোড়া ব্যাকট্র্যাক করতে গেছে কেউ? হায়রে, বাচাল গর্দভ!পিস্তলে দুর্দান্ত হাত ছিল ক্লসনের, সে গুলি খেয়ে মরেছে, কথাটার মানে বোঝ? এমন কাজ মাত্র তিনজনের পক্ষে সম্ভব। কে কে তুমি খুব ভালো করে জানো!
তীব্র ক্রোধে লাল হয়ে গেল বারউইক, চরকির মতো ঘুরল। ফের পায়চারি শুরু করল সে, অনুচ্চ অথচ হিংস্র কণ্ঠে বিড়বিড় করছে ক্রমাগত। ভয়ে কুঁকড়ে গেছে লরেন কীথ। আবার ওর মুখোমুখি হলো বারউইক, হিংস্র। নেকড়ের মতো চোখজোড়া জ্বলছে। বুঝতে পারছ না, কর্কশ কণ্ঠে জানতে চাইল, ওরা আমাদের জন্যে বিপজ্জনক!।
ওরা যতক্ষণ বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ আমাদের বিপদ হতে পারে। ডরনিকে অ্যাকশনে দেখেছ তুমি। কিন্তু বিশ্বাস করো, কেড্রিকের বদলে ওর সঙ্গেও লাগতে রাজি আছি! কেড্রিকের রগ চিনে গেছি আমি। আর্মি অফিসার ছিল-তুমি শুধু এদিকটাই ভেবেছ-সে এখনও একজন অফিসার এবং ভদ্রলোক!
আসলে তার চেয়েও বেশি কিছু, বুঝেছ? আরও বড় কিছু। নিখাদ ভদ্রলোক তো বটেই, কিন্তু সেই সঙ্গে লড়াকু, যুদ্ধ করতে ভালোবাসে। শান্ত নিরীহ চেহারার আড়ালে এমন একটা শক্তি, ক্ষমতা লুকিয়ে আছে, যার মোকাবেলা করা ডরনিরও সাধ্য নেই। হতে পারে ও ক্ষিপ্র, অন্তত আমি তাই মনে করি, কিন্তু ডরনির সঙ্গে কেড্রিকের পার্থক্য হলো, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে কেড্রিক, ডরনি সেটা পারবে না।
প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছে যেন লরেন কীথ। বারউইকের সঙ্গে এত বছরের জানাশোনা সত্ত্বেও তার এমন ক্রুদ্ধ ভয়াল চেহারা এই প্রথম দেখছে। আজ অবধি কাউকে এত সম্মান দেখিয়ে কথা বলতে তাকে দেখে নি সে-এ রকম ভয় পেতেও দেখা যায় নি। কেড্রিকের মাঝে কী দেখেছে বারউইক যা ওর নজর এড়িয়ে গেছে?
বিভ্রান্ত, বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে বারউইকের দিকে তাকিয়ে আছে লরেন কীথ। কিন্তু বারউইকের অনুভূতি ওর মাঝেও সংক্রমিত হতে শুরু করেছে। অস্বস্তি ভর করল ওর মনে ঠোঁট কামড়ে পায়চারিরত বারউইকের দিকে চেয়ে রইল।
কেড্রিক একা নয়, তার সঙ্গে শ্যাডও আছে। ঠাণ্ডা, চোখা চেহারার টেক্সান। আর আছে লেইন- আবার কুঁচকে উঠল বারউইকের চোখ-তিনজনের মধ্যে ও-ই সবচেয়ে বিপজ্জনক। এখানে তার ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত বলে ধরে নিয়েছে লেইন।
ব্যক্তিগত স্বার্থ মানে? জিজ্ঞাসু চোখে বারউইকের দিকে তাকাল কর্নেল কীথ, কী বলছ?
হাতের ঝাঁপটায় প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল বারউইক। বাদ দাও। যাই হোক, ওদের এখন সরিয়ে দিতে হবে-যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ঘুরে দাড়াল সে, ঠাণ্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কীথের উদ্দেশে। ওয়াশিংটনে সব ব্যাপারে তুমি সামনে ছিলে, কাজটা যদি কেঁচে যায়, তোমাকেই পস্তাতে হবে, ভুলে যেয়ো না। এবার যাও, কাজে নেমে পড়ো। হাতে সময় আছে, কাজের লোকেরও অভাব নেই। তা হলে আর দেরি কেন!
কীথ বেরিয়ে যাবার পর চেয়ারে এসে বসল বারউইক। শূন্য দৃষ্টিতে সামনে দরজার দিকে তাকাল। ঘটনা এতদূর গড়িয়েছে যে এখন ইচ্ছে করলেও আর পিছিয়ে আসা সম্ভব নয়, যদিও তেমন কোনও ইচ্ছে তার নেই। কীথ আর গুন্টারের চেয়ে ভালো লোক পাওয়া গেল না এটাই দুঃখ।
তবে এখনও সব দিক সামাল দেয়ার সুযোগ আছে। যে কোনও তদন্ত কমিটির মুখোমুখি হবার ক্ষমতা রাখে সে। এখানকার গোলমালকে অনায়াসে কাউ-কান্ট্রির স্বাভাবিক বিবাদ বলে চালিয়ে দেয়া যাবে। সবাই জানবে খামোকা তুচ্ছ বিষয়কে রঙ চড়িয়ে বিরাট রূপ দেয়া হয়েছিল। বাদী পক্ষের সাক্ষী না পেয়ে এগোতে পারবে না কমিটি। পুরো ব্যাপারটাকে চায়ের কাপের ঝড় বানানো সমস্যা হবে না। ব্ল্যানসারে ভয় করছে কীথ, বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু ওইসব র্যানসাম-টামের ঘোড়াই পরোয়া করে বারউইক।
ক্ষুদে অশ্বারোহীদল যখন শহর ছেড়ে মৃত্যু-অভিযানে যাচ্ছে, তখনও একই ভঙ্গিতে বসে আছে বারউইক। পিস্তলবাজের সংখ্যা বেড়েছে, লক্ষ্য করল সে, আরও চারজন দুর্ধর্ষ বেপরোয়া লোক যোগ দিয়েছে। কীথের সাহায্য ছাড়াও কাজ সারতে পারবে ওরা। উঠে দাঁড়াল বারউইক, জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। সামান্থার মৃত্যু তাকে দুঃখ দেবেমেয়েটাকে নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা ছিল। তবে ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠল বারউইকের।
দূর মরুভূমিতে অস্থির হাওয়া বইছে। তামাটে আকাশে অনেক ওপরে একটা শকুন চক্কর দিচ্ছে, যেন নীচের পৃথিবীর উত্তেজনার আঁচ পেয়েছে সে।
উত্তরে, বেশ দূরে, ডুরাংগোর কাছাকাছি, একজন গরু ক্রেতা দলবলসহ থমকে দাঁড়াল। আকাশের দিকে তাকাল সে। ঝড়ের লক্ষণ নেই, অথচ গরু কেনার জন্যে ইয়েলো বাট আর মাস্ট্যাংয়ের উদ্দেশে ডুরাংগো ছাড়ার পর থেকেই একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি ঘেঁকে ধরেছে ওকে। ওদিকে, গোলমাল হয়েছে শোনা গেছে, ওখানে ছোটখাট ঝামেলা লেগেই আছে, তাই ও নিয়ে আগে মাথা ঘামায় নি। কিন্তু এখন কেন যেন অস্বস্তি লাগছে। বাতাস যেন বিপদ-সঙ্কেত বয়ে আনছে।
দক্ষিণে, রিম থেকে দূরে, মাস্ট্যাংয়ের ট্রেইল থেকে ঘোড়া ঘুরিয়ে ইয়েলো বাটের পথ ধরল পল কেন্দ্রিক আর লরেড়ো শ্যাড। ওদের চলার পথ থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা, ওখানকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিজের চোখে দেখতে চায়। কিন্তু ওরা যখন শহরে পৌঁছুল, পোড়া ধ্বংসাবশেষ আর বিধ্বস্ত দালান কোঠার কথা বাদ দিলে সব কিছু শান্ত বলেই মনে হলো। আট দশটা পরিবার আবার যার যার ঘরে ফিরে এসেছে, কেউ কেউ এখান থেকে একেবারেই নড়ে নি। দুজন ঘোড়সওয়ারকে এগিয়ে আসতে দেখে সতর্ক হয়ে উঠেছিল ওরা, কেড্রিকদের চিনতে পেরে মাথা দুলিয়ে স্বাগত জানাল।
ওরা জানে, কোম্পানির বিরুদ্ধে ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে কেড্রিক আর লরেড়ো।কিন্তু কঠোর পরিশ্রম আর প্রাণ বাঁচানোর সংগ্রামে ক্লান্ত, তাই কোনওরকম উচ্ছাস ছাড়াই ওদের স্বাগত জানাল ওরা। লিভারি-স্ট্যাবলের বিশাল অফিস-কামরায় স্থানান্তরিত হয়েছে স্যালুনটা। ভেতরে ঢুকল কেড্রিক আর লরেডো শ্যাড। দুজন লোক,বারের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, ঘুরে দাড়াল, কেড্রিকদের ইশারায় শুভেচ্ছা জানিয়ে আবার আলাপে ডুবে গেল।
বাইরে এরই মধ্যে ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে, ঘরের ভেতর উষ্ণ আরামদায়ক পরিবেশ। বারের দিকে এগিয়ে গেল পল আর লরেডো। ড্রিঙ্কের ফরমাশ দিয়ে দাম চুকিয়ে দিল কেড্রিক। মদের গ্লাস হাতে নিয়ে অস্বস্তির সঙ্গে নাড়াচাড়া করতে লাগল লরেডো শ্যাড। অবশেষে কেড্রিকের দিকে তাকাল সে।
আমার অস্বস্তি লাগছে, পল, নিচু কণ্ঠে বলল লরেডো, যেভাবেই হোক র্যানসামের কথা বারউইক জানবেই। এবং তারপর সামান্থা আর ওর সাথে সাথে আমাদেরও কতল করার জন্যে খেপে উঠবে সে।
মাথা ঝাঁকাল কেড্রিক, ও-ও একই কথা ভাবছিল। কোম্পানির সামনে এখন একটা পথই খোলা, তদন্ত কমিটির সামনে দাঁড়ানো-অবশ্য সাক্ষী প্রমাণের ভিত্তিতে র্যানসাম যদি তার ব্যবস্থা করতে পারে। কমিটির কাছে প্রকৃত সত্য ঠিকই ধরা পড়বে, এবং তা যাতে না পড়ে সে চেষ্টা করবে বারউইক।
বারউইক একটা কেউটে সাপ, মন্তব্য করল লরেডো শ্যাড, হার মানার বান্দা নয়। এ-ব্যাপারটায় পুরো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, বিনা যুদ্ধে হাল ছাড়বে না!
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে এল। ওরা তাকাতেই দেখল ডাই রীড আর পিট লেইন ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে ভেতরে ঢুকছে। কেড্রিকের দিকে একবার তাকাল লেইন, তারপর বারের দিকে এগিয়ে এল। ডাই রাডকে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে, কিন্তু কিছু বলল না সে। খানিক পরেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল লেইন, বেরিয়ে গেল।
ব্যাপারটা কী? জিজ্ঞেস করল কেড্রিক।
বড় চিন্তায় আছে ছেলেটা বলল ডাই রীড, একটু লজ্জিতও। ওর বোনের জন্যেই এই অবস্থা। মেয়েটা এ কাণ্ড করবে কে জানত? শেষ পর্যন্ত কোম্পানির সঙ্গে গিয়ে হাত মেলাল। লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে ছেলেটা। বিশ্বাস করতে পারছে না। কেউ ওর দিকে তাকালেই ধরে নিচ্ছে, বোনের কার্যকলাপের জন্যে ওকে দায়ী করা হচ্ছে।
কাঁধ ঝাঁকাল কেড্রিক। উচ্চাভিলাষ আর টাকা অনেক বিচিত্র ঘটনা ঘটায় এই পৃথিবীতে। তা ছাড়া কোনও কোনও মেয়ে অমন হয়েই থাকে।
দরজা খুলল লেইন। জলদি বেরিয়ে এসো! বলল সে, বিপদে পড়তে যাচ্ছি আমরা।
একসঙ্গে বাইরে এল ওরা। পড়িমরি করে, যার যার ঘরের দিকে ছুটে যাচ্ছে লোকজন, ভয়ার্ত চেহারা।
কী ব্যাপার? দ্রুত জানতে চাইল কেড্রিক।
মেসার চূড়া থেকে সঙ্কেত দিচ্ছে বার্ট উইলিয়ামস। মাস্ট্যাংয়ের দিক থেকে একদল অশ্বারোহী আসছে!
ওরা মেসাধু চূড়ার দিকে তাকাতেই ছোটখাট একটা মানুষের আকৃতি দেখা দিল। একবারদুবারতিনবারহাত নেডে মাস্ট্যাংয়ের দিক থেকে ছজন অশ্বারোহী আসার সঙ্কেত দিল সে। একই ভাবে দক্ষিণ-পুব থেকেও চারজন ঘোড়সওয়ার আসার সংবাদ জানাল।
মোট দশজন, থুতু ফেলে বলল লেইন, ঠিক আছে, ওদের চেয়ে আমাদের দল অনেক ভারি। তবে আমার লোকেরা ওদের মতো ভয়ঙ্কর নয়, এই যা।
ভাঙা হাত বাঁচিয়ে ইয়েলো বাট মেসার মাথায় একটা ঝোঁপের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসল বার্ট উইলিয়ামস। দূরবীন দিয়ে অগ্রসরমান অশ্বারোহীদলকে জরিপ করল। পরিচয় না থাকলেও ওদের সবার চেহারা চেনা। একে একে নামগুলো উচ্চারণ করল বার্ট উইলিয়ামস: কীথ, ডরনি, শ’, ফেসেনডেন, লী গফ, পয়েন্সেট, ভুরু কোঁচকাল সে, নাহ্, পয়েন্সেট নয়, মিক্সাসদের একজন। হ্যাঁ, আর ওই তো আরেকটা!
দূরবীন ঘোরাল উইলিয়ামস। ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে অন্য চারজন। প্রথমে কাউকে শনাক্ত করা গেল না। এক এক করে চারজনকেই যথেষ্ট সময় নিয়ে জরিপ করল সে। অবশেষে একজনকে চিনতে পারল। পোর্ট স্টকটন আর ব্ল্যাক জ্যাক, কেচাম আউটফিটের এক কালের সদস্য ডুরাংগোর গুণ্ডা-ব্রকাউ!
নড়েচড়ে দূরবীন ঘুরিয়ে শহরের চারদিকে নজর বোলাল বার্ট উইলিয়ামস, কিন্তু আর কারও দেখা পেল না। আবার ছয় অশ্বারোহীর দিকে দৃষ্টি ফেরাল। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট উঁচু ঢিবির ওপর আর এক মুহূর্ত দূরবীন স্থির রাখলে ও দেখতে পেত, ঘোড়া ছাড়াই দুজন লোক উবু হয়ে দৌড়ে ঢিবিটা পেরুচ্ছে, শহরের উত্তর-পুবে বিশাল গিরিখাদে লাফিয়ে পড়ছে।
খানিক আগে দুজনের অশ্বারোহী দলে পয়েন্সেটকে দেখতে পায় নি সে, এবং অপর দলেও নেই লোকটা।
উদ্বিগ্ন চেহারায়, ছোট ছোট করে সূর্যের দিকে তাকাল বার্ট উইলিয়ামস। শহরের লোকদের বিপদ সম্পর্কে কীভাবে সতর্ক করা যায় ভাবছে। পয়েন্সটের অনুপস্থিতি ভীত করে তুলেছে, ওকে। কোম্পানির ভাড়াটে খুনীদের মধ্যে পয়েন্সেটই সবচেয়ে বিপজ্জনক। লোকটা বেপরোয়া, অতীতের কোনও তিক্ত ঘটনা হিংস্র করে তুলেছে ওকে, ভয়াবহ এক চরিত্রে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু এই মুহূর্তে পয়েন্সেটকে দেখতে পেলে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠত বার্ট উইলিয়ামস।
.
সবদিকে কড়া নজর রেখে পরিকল্পনা করা হয়েছে। কর্নেল লরেন কীথের ধূর্ত মস্তিষ্ক কাজ করেছে পরিকল্পনার পেছনে। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। ওরা কাকে কাকে খুজবে, জানে কীথ। তবে ওয়াচারের চোখে পয়েন্সেটের অনুপস্থিতি ধরা পড়বে না বলেই আশা করেছে সে। ঠিক জায়গায় উপযুক্ত মুহূর্তে পয়েন্সেট যাতে উপস্থিত হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেছে। পয়েনসেটের মতো দক্ষ মার্কসম্যান আর কেউ নেই তার দলে।
এই মুহূর্তে, শহর থেকে বড় জোর দুশো গজ দূরে, পয়েন্সেট আর তার সঙ্গী আলফ্রেড, ক্ৰকেট গিরিখাদের তীরে ঝোঁপ আর বোল্ডারের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পয়েন্সেটের হাতে একটা স্পেশার পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স, গুলি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পনের টোটার হেনরি পয়েন্ট ফোর-ফোর নিয়ে ছয় গজ দূরে অবস্থান নিয়েছে আলফ্রেড।
বিশাল রূপোর ঘড়ি বের করে সময় মেলাল পয়েন্সেট। আড়াইটার কথা বলে দিয়েছে কীথ। ঠিক আছে, সময় মতোই আওয়াজ পাবে সে। নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে একটা সিগারেট তৈরি করতে শুরু করল পয়েন্সেট। আলফ্রেড ক্রকেট তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কাগজে তামাক ভরার সময় একটুও কাপল না তার হাত, অবাক চোখে লক্ষ্য করল সে।
ইয়েলো বাট শহরের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বব ম্যাকলেননের। কিন্তু ব্যাপারটাকে কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে নেয় নি। অস্ত্র চালনায় মোটামুটি দক্ষ হলেও কোনওকালেই সৈনিক বা ইন্ডিয়ান ফাইটার ছিল না বব। তা ছাড়া শহর বাঁচানোর জন্যে পুরোদস্তুর লড়াইতে নামতে হবে, তেমন আশঙ্কাও ওর মাথায় আসে নি। সে যাই হোক একটা মারাত্মক ভুল করে গেছে ও। গিরিখাদের ধারের ঝোঁপ আর বোল্ডারের স্তূপ চমৎকার কাভারের কাজ করছে, এই তুপের আড়াল থেকে শহরের যে-কোনও জায়গা লক্ষ্য করে গুলি চালানো সম্ভব। শহরের একমাত্র রাস্তা এবং ঘরবাড়ি গুলির আওতার মধ্যে পড়েছে।
অতীতে শহরে আসার সুবাদে জায়গাটা দেখে গেছে লরেন কীথ। সতর্কতার সঙ্গে প্ল্যান নিয়েছে সে, যাতে মূল শক্তি পৌঁছুনোর আগেই পয়েটে আর ক্রকেট এখানে পৌঁছতে পারে। এখন পর্যন্ত তার পরিকল্পনায় কোনও গলদ দেখা যায় নি।
সিগারেট শেষ করে রাইফেল তুলে নিল পয়েন্সেট। সতর্কতার সঙ্গে সামনে নজর রাখতে শুরু করল। খানিক পর পর ঘড়ি দেখছে। নির্দিষ্ট করে কি করতে হবে বলে দেয়া হয়েছে ওকে, দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ। ঠিক আড়াইটায় যাকে সামনে পাবে তাকেই গুলি করতে হবে। এক গুলিতেই যেন মারা যায় সে।
শ্যাড আর কেড্রিক আবার স্যালুনে ফিরে গেছে। বাইরে পায়চারি করছে পিট লেইন। রাস্তার উল্টো দিকে গেছে ডাই রীড। লেইন যদিও পয়েন্সেটের আওতার বাইরে আছে, মুহূর্তের জন্যে চমৎকার টার্গেটে পরিণত হয়েছিল ডাই রীড; রীডের সৌভাগ্য, পয়েন্সেট গুলি করার আগেই অদৃশ্য হতে পেরেছে। কিন্তু মুহূর্ত পরেই সুযোগ ধরা দিল পয়েন্সেটের হাতে।
কাছের একটা ঘরের দরজা খুলে গেল, একটা লোক বেরিয়ে এল। চওড়া কিনারাঅলা একটা ছেড়া ধূসর টুপি তার মাথায়, গায়ে বড় বড় চেকের শার্ট, সাসপেন্ডার লাগানো প্যান্টে গুঁজে রেখেছে। দরজার দিকে ঘুরে দাড়াল সে, চুমু খেলো স্ত্রীকে। প্রচুর সময় নিয়ে পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স-এ লক্ষ্যস্থির করল পয়েন্সেট, লোকটার সাসপেন্ডারের বাঁ দিকের বাকলস্-এ। লম্বা করে দম নিল, তারপর টিপ দিল ট্রিগারে।
প্রচণ্ড শব্দে ছুটে গেল ভারি বুলেট। আঘাত করল লোকটার বুকে। একদিকে ছিটকে গেল সে, সোজা হয়ে দাড়ানোর চেষ্টা করল, পরমহর্তে হুড়মুড় করে লুটিয়ে পড়ল ধুলোয়। আর্তনাদ করে ছুটে এল তার স্ত্রী। সামনের একটা ঘরের দরজা সশব্দে খুলে গেল। রাস্তায় বেরিয়ে এল দুজন লোক, এদিক-ওদিক তাকাল। ক্রকেটের প্রথম গুলি একজনের হাতের রাইফেল ফেলে দিল, গুড়ো হয়ে গেল রাইফেলটার কুঁদো। অন্যজনকে ধরাশায়ী করল। পয়েন্সেট। পা টেনে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল লোকটা। এত দূর থেকেও তার হাঁটুর কাছে রক্তের গাঢ় দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
পয়েনসেটের মনে, দয়ামায়ার বালাই নেই। ঠাণ্ডা মাথায়, সাবধানে আবার গুলি করল সে। থেমে গেল লোকটা, একটু কেঁপে উঠল, তারপর স্থির পড়ে রইল।
আমারটা ফসকে গেল, ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল আলফ্রেড ক্রকেট। অবশ্য ব্যাটার রাইফেলের বারটা বেজে গেছে!
থুতু ফেলল পয়েন্সেট। দৃষ্টিতে শীতল ভাব। ও কিছু না, বলল সে, তবে ওই ব্যাটাও খামোশ খেয়ে গৈছে।
স্যালুনের ভেতরে, হুইস্কির গ্লাস ঠোঁটে ছোঁয়াতে যাচ্ছিল কেড্রিক, এই সময় প্রথম গুলির শব্দ হলো, তারপরই উপর্যুপরি দুদুবার গুলির শব্দ হলো।
হায়াল্লা! চরকির মতো ঘুরল লরেছো শ্যাড। ওরা তো এখনও পৌঁছে নি!
না, আগেই এসে গেছে ওরা, বলল কেড্রিক। মুহূর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেছে ওর কাছে। চট করে দরজার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল ও। চোখের সামনে তৃতীয়জনকে মাটিতে পড়তে দেখল। গলা, বাড়াতেই আরও একজনকে দেখতে পেল। পরস্পর চেপে বসল ওর ঠোঁটজোড়া। স্থির পড়ে আছে লোকগুলো, নড়ছে না।
ওই খাদে কেউ লুকিয়ে আছে, দ্রুত ব্যাখ্যা করল কেড্রিক, পুরো রাস্তা কাভার করছে সে। পেছনে কোনও পথ আছে?
বারটেন্ডার বেরুনোর রাস্তা দেখিয়ে দিলে উইনচেস্টার তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল পল কেড্রিক, পকেটে আগেই গুলি ভরে নিয়েছে ও। অন্যরা ওর পিছু নিল। দরজায় পৌঁছে থমকে দাঁড়াল কেড্রিক। দেয়ালের সঙ্গে মিশে গিয়ে গিরিখাদের দিকে তাকাল। এখান থেকে চিবিটার প্রান্ত দেখা যাচ্ছে। গুলিগুলো ওখান থেকেই এসেছে ধরে নিল পল। আটকা পড়ে গেছি আমরা, বলল ও, ওই ওখানে আছে ওরা।
নড়ল না কেউ। এলাকা সম্পর্কে কেড্রিকের স্পষ্ট ধারণা এই বিপদের মুহূর্তে কাজ দিচ্ছে।
মনে মনে গিরিখাদের চেহারা উল্টেপাল্টে দেখতেই মনে পড়ল, ঢিবির ওপাশটা শহর থেকে নিচু। কিন্তু বোল্ডার থাকায় গুলি করার জন্যে চমৎকারর আড়াল পাওয়া যাচ্ছে।খাদ থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুটে আসছে। নীরব হয়ে আছে সবাই। আর কিছুক্ষণ পর অন্যরাও এসে যোগ দেবে হামলায়। এই হামলা বেশিক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না!
<