হতাশায় ছেয়ে গেল সারা মন।

শুধু পানির আশা ওদের এতদূর লড়ে আসার শক্তি যুগিয়েছে।

ভীষণ ক্লান্ত বোধ করল ইয়াসীন। পা দুটো থরথর করে কাঁপছে। দেহের ভার নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

বসে পড়তে যাচ্ছিল হেনরী। ইয়াসীনের শব্দের চাবুক থামিয়ে দিল তাকে। ‘ঝোঁপের ওপাশে পাহারায় থাক হেনরী। মোযেভরাও জানে-হেরে গেছি আমরা। তবু যুদ্ধ করেই মরব।’

পাওয়েল হাত-পা ছড়িয়ে চিৎপাত শুয়ে আছে একটা মেসকাইটের ঝোঁপের কাছে। তার উপরে নুয়ে আছে ছয়সাত হাত লম্বা গাছগুলো। জ্ঞান নেই মনে হচ্ছে।

‘বোধহয় আর আসবে না ওরা।’ হেনরী ফিরে যেতেই বলল মোকাটো। ‘তোমার বুলেটের সামনে ঝুঁকি নেয়ার অর্থ লোকসান, টের পেয়ে গেছে ওরা’।

‘তাতে আমরা লাভ করতে পারিনি মোটেও,’ রুক্ষ কণ্ঠে বলল ইয়াসীন। বালির উপরে বসে পড়ল সে পা ছড়িয়ে। পিস্তল রিলোড করছে। ভাবছে।

এ জায়গাটা আশেপাশের যেকোনও জায়গা হতে তুলনামূলকভাবে নিচু। পিছনের সেই পিরিচের মত জায়গাটার ঢালে রয়েছে মেসকাইটের এই ঝোঁপগুলো। বৃষ্টির পানি শেষ পর্যন্ত এখানে এসেই দাঁড়াবার কথা। নোনা ঘাসও গজিয়েছে আশেপাশে।

‘মেসকাইট আর নোনাঘাস। দুটোই প্রমাণ করে পানি ছিল এখানে’। অনেক কষ্টে মোকাটোকে কথাগুলো বলতে পারল ইয়াসীন। জিভ ফুলে উঠেছে তার। কষ্ট হয় কথা বলতে।

কিন্তু এখন তো পানি নেই! কত নীচে নেমে যেতে পারে পানির স্তর? কত আগে জমেছিল এখানে পানি? মাথাটা কাজ করতে চাইছে না। কেবলই শুয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে। শুয়ে পড়ে দীর্ঘ একটি নিদ্রা। জীবনের চেয়েও লম্বা একটা ঘুম।

‘ইয়াসীন!’ সতর্ক কণ্ঠে ডাকল মোকাটো। চোখে স্পষ্ট ভয়।

‘নোনা ঘাস অর্থাৎ-পানির স্তর খুব বেশি নীচে নয়’। তাকে অভয় দিয়ে হাসল ইয়াসীন।

কতটুকু জানা আছে ওর মেসকাইট আর নোনা ঘাস সম্বন্ধে? ভাবতে চাইছে ইয়াসীন। পানির ধারেই জন্মায় মেসকাইট। তবে ওগুলোর শিকড় পঞ্চাশ ফুট গভীরে যেতে পারে। কিন্তু নোনা ঘাসের শিকড় দশ ফুটের নীচে যায় না। দশফুট? কমও তো হতে পারে!

রাইফেল নামিয়ে রাখল সে পাশে। পিঠে বাড়তি রাইফেলের বোঝাটাও নামাল। টলতে টলতে গিয়ে বসল শুকনো কাদার উপর। হাঁটু গেড়ে সরাতে শুরু করল শক্ত কাদার চাঙড়।

খুঁড়ে চলেছে ইয়াসীন। নীচ থেকে কেবলই উঠে আসছে বালি। শতাব্দীর খরায় পড়ে থাকা বাইসনের খুলির মত খটখটে, শুকনো!, জুলজুল করে তার দিকে তাকিয়ে আছে মোকাটো।

মাটির সোঁদা গন্ধ অস্পষ্ট ঝঝের মত এসে লাগছে নাকে। হাতের ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলো জ্বলছে অ্যালকালীর স্পর্শে। কিন্তু কোনদিকে খেয়াল নেই ইয়াসীনের। খুঁড়ে চলেছে সে। একটু একটু করে গভীর হচ্ছে গর্ত।

ফিরে এল হেনরী। ঝুঁকে, দেখতে চেষ্টা করছে ইয়াসীনের খোঁড়া গর্তটা। ‘কবরটা ছোট হয়ে যাবে তোমার জন্যে’। মন্তব্য করল সে। কণ্ঠে বিদ্রূপ।

‘পাহারায় ফিরে যাও হেনরী’। হাতের কাজ থামল না ইয়াসীনের।

‘চলে গেছে মোযেভরা।’

‘তবু পাহারায় ফিরে যেতে বলছি।’

‘তুমি বলার কে হে?’ খেঁকিয়ে উঠল হেনরী। ‘আমার মতই একজন সাধারণ সৈনিক, অথচ আদেশ করছ অফিসারের মত?’

থেমে গেল ইয়াসীনের হাত। উঠে দাঁড়িয়ে হেনরীর মুখোমুখি হলো সে। তাকিয়ে আছে চোখে চোখে।

‘বাঁচার শেষ সুযোগ দিলাম তোমাকে। ফিরে যাও পাহারায়। নইলে খুন হয়ে যাবে’। শান্ত ভাবে বলল ইয়াসীন।

তার দিকে তাকিয়ে আছে হেনরী। ক্ষণিক ইতস্তত করল। তারপর নামিয়ে নিল চোখ। পায়ে পায়ে ফিরে গেল পাহারায়।

আবার হাঁটু পেতে খুঁড়তে বসে গেল ইয়াসীন। মোকাটোর নির্লিপ্ত চোখ চেয়ে রইল সে দিকে। নিস্পলক।

দীঘল শরীর। চওড়া কাঁধ। পাথরের মত খাজকাটা বাহু ও বুক। কালো চুল। আরও কালো চোখের মণি। চলাফেরায় মরু সিংহের মত শক্তির নিঃশব্দ স্ফুরণ। এক অবাক লোক এই ইয়াসীন-ভাবছে মোকাটো।

চামড়াটা তোমার রেড ইন্ডিয়ানদের চেয়েও বাদামী। কোন দেশের মানুষ তুমি?-একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল মোকাটো।

গ্রীন ইন্ডিয়া। ছোট্ট করে জবাব দিয়েছিল ইয়াসীন।

দেশটা চিনতে পারেনি মোকাটো। দুর্ভাগ্য তার!

চেনাতে চেষ্টা করেনি ইয়াসীনও। কম কথার মানুষ সে বরাবর। কারও সাথে মেশে না, কখনও মদ খায় না, কাউকে চিঠি লেখে না। অথচ প্রচুর পড়াশুনা করে।

অস্ত্রে অব্যর্থ, অশ্বে নিপুণ-তুখোড় এক মরু যোদ্ধা। তিন বছর ধরে আছে ইয়াসীন এই ইন্ডিয়ান ফাইটিং আর্মিতে-জানে মোকাটো। দুবার কর্পোরাল পদে উঠেছিল লোকটা। দুবারই নেমে যেতে হয়েছে সাধারণ সৈনিকের কাতারে। অথচ কথাবার্তা চাল-চলন খোদ অফিসারের মত।

ওর সাথে নিজের কিছু মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করে মোকাটো। কোথায় যেন মিল আছে, অথচ কিছুতেই তা ধরা যায় না। হয়তো আমার মতই একটা পরাজিত অতীত আছে ইয়াসীনের-ভাবে মোকাটো। উদ্বাস্তু এবং নির্দিষ্ট একটা ভবিষ্যৎ!

খুব সহজে, কেউ আসতে চায় না এই ইন্ডিয়ান ফাইটার আর্মিতে। বুনো পশ্চিমে মানুষ আসে সৌভাগ্যের সন্ধানে। কেউ গরুর পাল জড়ো করে র্যাঞ্চ গড়ে তোলে, কেউ সরাইখানা খোলে-বসায় জমজমাট মদ কিংবা জুয়ার আড্ডা। কেউবা ওয়্যাগন শপে চালিয়ে বেড়ায় যাযাবর ব্যবসা। সুখ আর ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে পশ্চিমের এই মাটিতে, পাহাড়ে, অরণ্যে। সবাই খুঁজে ফেরে তা। কেউ পায়, কেউ পায় না। তবু আশা ছাড়ে না কেউ।

রেড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে যোদ্ধাবাহিনীতে যারা যোগ দেয়-তারা আলাদা জাতের মানুষ। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর রোমাঞ্চ-উন্মাদনা যুদ্ধে টেনে আনে তাদের।

কেউ কেউ হয়তো নিষ্কৃতি পেতে চায় কোনও দুঃসহ অতীত থেকে। একদিন নিজস্ব লোকালয় ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় তারা।

আর এক জাতের মানুষ আছে, জীবনটাকেই যারা একটা বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না। ছেলেবেলায় খেলনা পিস্তলটা হয় তাদের সবচেয়ে প্রিয় খেলনা, কৈশোরে সমবয়েসীদের সাথে ঘুমোঘুষি করে নাক ফাটায়-তারপর বড় হয়ে হাতে তুলে নেয় রাইফেল।

লোভী আর দুর্বিনীত হলে কুখ্যাত বন্দুকবাজ হয় তারা। অন্যথায় সুযোগ মত এসে জুটে যায় সেনা দলে। অদ্ভুত এক আত্মধ্বংসী প্রবণতা থাকে এদের।

যেমনটি আছে ইয়াসীনের। তবে মানুষটা খারাপ নয়। মনে মনে রায় দিল মোকাটো।

একনাগাড়ে খুঁড়েই চলেছে ইয়াসীন। বেশ গভীর হয়েছে গর্তটা। নেমে পড়ল সে গর্তের ভিতরে। দুই হাতে তুলে আনতে লাগল শুকনো বালি ও মাটি।

প্রচণ্ড পরিশ্রমের কাজ। অবসন্ন শরীরে-হাপরের মত হাঁপাচ্ছে সে। তবু সহিষ্ণু উটের মত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চালিয়ে যাচ্ছে কষ্টকর কাজটা।

মোকাটো এগিয়ে গেল গর্তটার কিনারে। মাটির সোঁদা গন্ধ এসে লাগল তার নাকে। হাত রাখল সে ইয়াসীনের পেশল বাহুতে। ‘এবারে আমি?’ অনুমতি চাইল।

পালাক্রমে খুঁড়তে আরম্ভ করল ওরা দুজন।

মেসকাইটের ঝোঁপের এপাশে বসে বসে ঢুলছিল হেনরী। আড়াল থেকে ইয়াসীন বেরিয়ে এল। হাতে রাইফেল।

‘ওঠো, হেনরী’।

চমকে তার দিকে তাকাল হেনরী। উঠে দাঁড়াল আস্তে আস্তে। ‘কী করতে চাও তুমি’-ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল।

‘ছুটি দিতে চাই।’ হাসল ইয়াসীন। ওখানে পানি পাওয়া গেছে। যাও, আমি থাকছি পাহারায়।

আবার বসে পড়ল হেনরী ধপ করে। ‘এটা কী ধরনের ঠাট্টা?’ করুণস্বরে জিজ্ঞাসা করল।

‘যাও!’ ধমকে উঠল ইয়াসীন।

ধীরে ধীরে দূর হয়ে গেল তার দৃষ্টির অবিশ্বাস। পড়িমরি করে ছুটল সে মেসকাইট ঝোঁপের দিকে।

কোথাও কোনও জনমানুষের চিহ্ন নেই। মোকাটোর মন্তব্যই হয়তো ঠিক। আর আসবে না মোযেভরা। যদি আসেও ঘাবড়ানোর কারণ নেই। পানি পাওয়া গেছে। লড়তে আপত্তি নেই ইয়াসীনের। ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার পথ নির্দিষ্ট করতে লাগল ও বসে বসে।

এখান হতে দক্ষিণ পুবে রয়েছে ইবেক্স পাহাড়। সঠিক দূরত্ব জানা নেই ওর। তবে অন্যদের কাছ থেকে যা শুনেছে, তাতে মাইল পনেরোর কম নয়। এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় পায়ে হেঁটে অত দীর্ঘপথ অতিক্রম করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তবে পানি থাকবে সাথে। ওখানে পৌঁছা’তে পারলে আরও পানি পাওয়া যাবে। অতএব চেষ্টা করা যেতে পারে।

ঝোঁপের ওপাশে ফিরে গেল ইয়াসীন। বেশ স্বচ্ছ হয়ে এসেছে কোমর সমান গভীর গর্তটার পানি। বোতল ভরে নিল সে।

হাতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে শ্রান্ত হেনরী। শুয়ে আছে মোকাটো। পা ছড়িয়ে বসে আছে পাওয়েল। অনেক সুস্থ দেখাচ্ছে তাকে, ‘তোমার জন্যে এতদূর আসতে পেরেছি আমরা।’ বলল সে। ‘নেতৃত্ব দিতে জানো তুমি। হয়তো এর আগে অফিসার ছিলে অন্য কোথাও, তাই না?’

তার কথার জবাব দিল না ইয়াসীন। ‘মোকাটো?’ ডাকল সে। ‘আরও অনেক দূর যেতে হবে আমাদের। ইবেক্স পাহাড়ের ঝর্ণাটা, চেনো?’

উঠে বসল মোকাটো। ‘শুনেছি ওটার কথা। তবে যাইনি কখনও’।

‘বারো মাইল দূরে আছে ওটা’। ইচ্ছা করে কমিয়ে বলল ইয়াসীন। ‘পারবে?’

‘সাথে পানি থাকলে সব পারে মরুভূমির সৈনিক,’ বলল মোকাটো। ‘আর যদি থাকে একজন যোগ্য নেতা। তোমার মত! যে-ঠিক সময়ে, ঠিক জায়গায় গুলি চালাতে জানে। জানে মেসকাইট এবং নোনা ঘাসের গভীরে পানির সন্ধান। আর কী কী জানো তুমি, ইয়াসীন?’

‘বিশ্রাম নিতে,’ বসল ইয়াসীন। ‘এবার পাহারায় থাকবে তুমি।’

মোকাটো উঠে এগিয়ে গেল গর্তটার কাছে। পানি ভরছে বোতলে। কী মনে করে পিছন ফিরে তাকাল ইয়াসীনের দিকে। ‘তোমার সাথে কথা বলা উচিত ছিল অফিসারের। তুমি হয়তো জানো ঠিক কী খুঁজছিল সে’।

‘মানে?’

‘কিছু খুঁজছিল ও। সবাইকে প্রশ্ন করছিল। মরুভূমি সম্পর্কে আজগুবি সব প্রশ্ন।’ পাহারায় ফিরে গেল মোকাটো।

শুয়ে পড়ল ইয়াসীন। তৃষ্ণা মিটেছে তার। শরীর জুড়ে শিশিরের প্রশান্তি। শুধু পা দুটো টনটন করছে ব্যথায়। ইচ্ছে হচ্ছে শীতল জলে ভিজিয়ে নেয় পা। কিন্তু উঠল না। ক্রমাগত হাঁটার ফলে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে পা। ফোস্কা পড়ে ফেটে ঘা হয়ে গেছে। এখন পানিতে পা ডুবালে সাথে সাথে ফুলে কলা গাছ হবে। কিছুতেই জুতোয় ঢুকবে না। এরকমই হয়। আনমনে হাসল ইয়াসীন। একটু আরাম পেলে-আরও একটুর সন্ধান করে মানুষ।

কিন্তু আরামের সময় এটা নয়। সন্ধ্যা নামছে। উঠল ইয়াসীন। চারজনের দলটা আবার শুরু করল যাত্রা।

আকাশে একটা দুটো করে তারা ফুটছে। ঝিরঝির বইছে শীতল বাতাস। চারদিক নিঝুম। শুধু চারটে অবসন্ন মানুষ নতুন আশায় হেঁটে চলেছে। আলগা বালিতে মিশে যাচ্ছে তাদের অস্পষ্ট পায়ের আওয়াজ।

ঘণ্টাখানেক হেঁটে থামল ওরা। ‘মোযেভরা-আর অনুসরণ করে আসছে না’। বলল মোকাটো।

দশ মিনিট বিশ্রাম।

‘মার্চ’। শব্দ উঠল রাতের মরুভূমিতে।

ডানদিকে পাহাড়ের সারি। নিপ্রাণ মরুভূমি কুঁড়ে হঠাৎ মাথা তুলেছে তাদের উদ্ধত শিখর। অবাক তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। শুধু পাথর আর পাথর। অনন্ত কাল ধরে স্থির, স্তব্ধ।

হেঁটে চলেছে সবাই মরুভূমির ধু-ধু প্রান্তরে এমন অনেক চলতে হয়েছে ইয়াসীনকে। ঘোড়ায় কিংবা উটে কিংবা পায়ে হেঁটে। মরুভূমিতে পথ অতিক্রমের হিসাব বিভ্রান্ত করতে পারে না তাকে আর।

প্রথম ঘণ্টায় তারা হেঁটেছিল আড়াই মাইল, তারপরের ঘণ্টাতেও তাই। তৃতীয় ঘণ্টায় অবশ্য সেটা কমে যাবে কিছু। মানুষগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া সামনে দেখা যাচ্ছে বেশ উঁচু একটা পাহাড়ী আল।

অনেক উত্তরে নিয়ে এসেছিল লেফটেন্যান্ট তাদের। ইয়াসীন যতটা ভেবেছিল তার চেয়েও অনেক উত্তরে। হাঁটতে হাঁটতে মোকোটোর কথাগুলো মনে পড়ল। কিছু খুঁজছিল অফিসার।

কৌতূহল জেগে উঠল ইয়াসীনের মনে। হয়তো মোকাটোই ঠিক। স্মৃতি হাতড়ে লেফটেন্যান্টের কাজে কর্মে অনেক অসামঞ্জস্য বের করে ফেলল সে। অনেক অসংলগ্ন কথোপকথন কানে বাজল। কিন্তু কী খুঁজছিল লোকটা?

এই পশ্চিমা মরুভূমিতে লেফটেন্যান্ট ছিল আনকোরা নতুন। অথচ টহলের সময়, সামনের গন্তব্য সম্পর্কে বেশ নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল সে। হয়তো ক্যাম্প থেকে বেরোনোর আগে, কমান্ডিং অফিসার জানিয়েছিল তাকে সব। কিন্তু কমান্ডিং অফিসার নিজেও এদিকটায় আসেনি কখনও। ক্যাম্প থেকে এত উত্তরে এর আগে টহলে আসেনি কেউ। তা হলে কীভাবে অমন নিখুঁত বর্ণনা সে দিতে পারল?

টহল দেবার আসল উদ্দেশ্য হলো-মরুভূমিতে যাতায়াতের সরকারি রুটগুলো বিপদমুক্ত রাখা। যাতে ছাউনিতে রসদ পৌঁছতে পারে নির্বিঘ্নে, কিংবা স্টেজকোচের বহরগুলো এক মরু শহর হতে অন্য শহরে যাবার পথে আক্রান্ত না হয়। অথচ সেই নির্দিষ্ট পথ ছেড়ে-অনেক সরে এসেছিল লেফটেন্যান্ট। সরতে সরতে জীবন-মৃত্যুর সীমারেখা পার হয়ে গেল। বেচারা! আফসোস হয় ইয়াসীনের। কোনওদিনই হয়তো জানা যাবে না, কী খুঁজছিল তরুণ অফিসার।

ইবেক্স পাহাড়ে পৌঁছতে রাত পোহাল। চমৎকার ঝর্ণাটা খুঁজে পেতে কষ্ট হলো না বেশি। সবাই পেট আর বোতল ভরে নিল পানিতে। দ্রুত বাড়ছে মরুভূমির বেলা। পাহাড়ের ছায়ায় জিরোতে বসল ওরা।

একসময় অতিক্রান্ত হলো মরুভূমির অলস দুপুর। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। পড়ন্ত বিকেল। আবার শুরু হলো যাত্রা।

পাহাড়ের সারি হাতের ডানেই রয়েছে। ট্রাকের চিহ্ন পাওয়া গেল। সামনে ছোট্ট একটা মালভূমি। সেটা পার হয়ে পাহাড়ের পশ্চিমে এল ওরা। হারিয়ে গেল ট্র্যাকটা।

পাহাড়ের দক্ষিণপ্রান্তে পানির সন্ধান মিলল অযাচিত ভাবে। দলটাকে থামাল ইয়াসীন। কিছু বিশ্রাম প্রাপ্য হয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।

সন্ধ্যার পরপরই আবার শুরু হলো যাত্রা। ক্রমাগত দক্ষিণে চলেছে তারা। দশমাইল সামনে বাফেট স্প্রিং, জানে ইয়াসীন। তবে, একটা বিশাল ঢালের চড়াই বেয়ে উঠতে হবে তাদের। ভীষণ কষ্টকর কাজ।

বাফেট স্প্রিং পৌঁছে, থামল দলটা। এখানেও আছে প্রচুর পানি। তৃষ্ণা কোনও সমস্যা নয় আর। তাই খাবারের কথা ভাবছে ওরা!

‘আর কতদূর গেলে পাব খাবার?’ ভাবনাটাকে শব্দে রূপ দিল পাওয়েল। ‘অনেক তো হলো!’

কিছুই হয়নি। তবে হতে পারে যদি হাঁটো আরও মাইল বিশেক। বিটার স্প্রিং-এ পৌঁছে যাবে। বেশ বড় ঝর্ণা। হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে কোনও মরুকাফেলার সাথে। হাত পাতলে জুটেও যেতে পারে খাবার। যেন কিছুই হয়নি, এমন ভঙ্গিতে বাতাসের উদ্দেশে কথাগুলো ছুঁড়ে দিল ইয়াসীন।

মোকাটো বিড়বিড় করে শাপ দিল নির্লিপ্ত ইয়াসীনকে। এমনভাবে তাকাল পাওয়েল, যেন সব দোষ ইয়াসীনের। তার কাঁধ চাপড়ে দিল ইয়াসীন। ‘বিটার স্প্রিং থেকে ক্যাম্পকেডি খুব দূরে নয়,’ বলল।

‘তোমার কাছে দক্ষিণ মেরুও খুব দূরে নয়।’ আহত স্বরে জবাব দিল পাওয়েল।

কোনও কথা বলছে না হেনরী। শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইয়াসীনের দিকে।

সেটা লক্ষ করে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল পাওয়েল। সৈনিক হিসাবে সে সাহসী নয়। তাই বিপদের বার্তা সবার আগে পৌঁছা’য় তার কাছে। হেনরীর দৃষ্টিতে বিপদ দেখতে পেল সে।

অমন অদ্ভুত ভাবে ইয়াসীনের দিকে কেন তাকিয়ে আছে হেনরী? ষড়যন্ত্রে ভরা দুটো চোখ। শত্রুর দৃষ্টিতে যেন মেপে নিচ্ছে ইয়াসীনকে। ব্যাপারটা ভাল লাগল না পাওয়েলের। ইয়াসীনের দিকে ফিরল সে।

         ‘ঠিক আছে। আমি তোমার সাথে,’ জানাল পাওয়েল।

         এর দুদিন পর, ক্যাম্পকেডিতে পৌঁছা’ল ওরা অবশেষে। তখন গভীর রাত। ঢোকার মুখে সাবধান করল পাহারারত সৈনিক।

তা হলে ফিরে এলাম শেষপর্যন্ত! বিস্ময়কর ভাবনাটা নাড়াচাড়া করতে করতে নিজের কোয়ার্টারের দিকে এগোল ইয়াসীন। ক্ষুধায় ক্লান্তিতে অবশ হয়ে গেছে শরীর। এমন সময় পিছন থেকে তাকে ডাকল কেউ।

‘সিপাহী ইয়াসীন! কমান্ডিং অফিসার তোমাকে রিপোর্ট করতে বলেছেন। এক্ষুণি। তাঁর অফিসে’।

<

Super User