মনুসংহিতা
দ্বিতীয় অধ্যায়
ধর্মানুষ্ঠানপ্রকরণ
‘যঃ কশ্চিৎ কস্যচিদ্ধর্মো মনুনা পরিকীর্তিতঃ।
গ সর্বোহভিহিতো বেদে সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ।।’
ভগবান মনু যে কোনও ব্যক্তির যে কোনও (যেমন, বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম, সংস্কারধর্ম প্রভৃতি এবং ব্রাহ্মণাদি বিশেষ বিশেষ বর্ণের জন্য বিহিত বিশেষ বিশেষ ধর্ম) উপদেশ দিয়েছেন, সে সবগুলিই বেদে প্রতিপাদিত হয়েছে। কারণ, সেই বেদ হলো সকল প্রকার জ্ঞানের আকর (অর্থাৎ জ্ঞাপক কারণ)। (২/৭)।
‘স্ত্রীণাং সুখোদ্যমক্রূরং বিস্পষ্টার্থং মনোহরম্।
মঙ্গল্যং দীর্ঘবর্ণান্তমাশীর্বাদাভিধানবৎ।।’
স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন নাম রাখতে হবে- যে নাম সুখে উচ্চারণ করতে পারা যায় অর্থাৎ স্ত্রীলোক ও বালকেরাও যে নাম অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে (যেমন যশোদাদেবী; এই নাম দুরুশ্চারণাক্ষরহীন হবে, যেমন ‘সুশ্লিষ্টাঙ্গী’ এই রকম নাম হবে না), সে নাম যেন ক্রূরার্থের প্রকাশক না হয় (অর্থাৎ ডাকিনী, পরুষা প্রভৃতি নাম হবে না), যে নাম বিস্পষ্টার্থ হবে (অর্থাৎ অনায়াসে যে নামের অর্থবোধ হয়; ‘কামনিধা’, ‘কারীষগন্ধী’ প্রভৃতি যে সব নামের অর্থ স্পষ্ট নয় এমন নাম হবে না), যে নাম হবে মনোহর অর্থাৎ চিত্তের আহ্লাদজনক (যেমন শ্রেয়সী; কিন্তু ‘কালাক্ষী’ জাতীয় নাম মনের সুখ উৎপাদন করে না), যে নাম মঙ্গলের বাচক হয় (যেমন চারুমতী, শর্মমতী; বিপরীত নাম যেমন ‘অভাগা’, ‘মন্দভাগ্যা’ প্রভৃতি হবে না), যে নামের শেষে দীর্ঘ স্বর থাকে (যেমন ‘ঈ’কার, আ-কার যুক্ত নাম), যে নামের উচ্চারণে আশীর্বাদ বোঝায় (যেমন ‘সপুত্রা’, ‘বহুপুত্রা’ প্রভৃতি)। (২/৩৩)।
‘অমন্ত্রিকা তু কার্যেয়ং স্ত্রীণামাবৃদশেষতঃ।
সংস্কারার্থং শরীরস্য যথাকালং যথাক্রমম্।।’
পুরুষের মতো স্ত্রীলোকদেরও শরীরসংস্কার বা দেহশুদ্ধির জন্য এই সমস্ত আবৃৎ (অর্থাৎ জাতকর্ম থেকে আরম্ভ করে সংস্কারগুলির আনুষ্ঠানিক কর্মসমূহ) যথা-নির্দিষ্ট কালে এবং যথানির্দিষ্ট ক্রমে সম্পন্ন করতে হয়; কিন্তু তাদের পক্ষে ঐ সমস্ত অনুষ্ঠানে কোনও মন্ত্রের প্রয়োগ থাকবে না। (২/৬৬)।
‘বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিষ্ক্রিয়া।।’
বিবাহ-সংস্কারই স্ত্রীলোকদের উপনয়নস্থানীয় বৈদিক সংস্কার (অর্থাৎ বিবাহের দ্বারাই স্ত্রীলোকদের উপনয়ন সংস্কার সিদ্ধ হয়); বিবাহের পর স্ত্রীলোকেরা যে তাদের পতিদের সেবা করে (শুশ্রূষা বা সন্তোষ বিধান করে), তা-ই তাদের গুরুগৃহে বাসস্বরূপ (গুরুগৃহে বাস করা অবস্থায় বেদাধ্যয়ন কর্তব্য, কিন্তু স্ত্রীলোক তো সত্য-সত্য গুরুগৃহে বাস করে না, তাই তাদের বেদাধ্যয়নের প্রসঙ্গ আসে না); স্বামীর গৃহস্থালীর কাজই হলো (যেমন, অন্নরন্ধন, পোষাকাদি সাজিয়ে রাখা, টাকাকড়ি গুণে ঠিকমতো রাখা ইত্যাদি) স্ত্রীলোকেদের পক্ষে গুরুগৃহে (সায়ং ও প্রাতঃকালীন হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা [ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে থেকে সায়ং-প্রাতঃকালীন যে সমিৎ সংগ্রহ করে, তা স্ত্রীলোকদের পক্ষে গৃহস্থালীর কাজের দ্বারা সম্পন্ন হয়। আর স্ত্রীলোকেরা গৃহস্থালীর কাজকর্ম অর্থাৎ অগ্নির দ্বারা নিষ্পাদনীয় রন্ধনাদি যে সব কাজ করে, তার দ্বারা ব্রহ্মচারীর করণীয় যতকিছু যম-নিয়ম প্রভৃতি সেগুলিও পদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। অতএব, এখানে স্ত্রীলোকদের অগ্নিপরিষ্ক্রিয়াটি পুরুষদের যম-নিয়মাদি কর্তব্যগুলির উপলক্ষণ]। (২/৬৭)।
‘নাভিব্যাহারয়েদ্ব্রহ্ম স্বধানিনয়নাদৃতে।
শূদ্রেণ হি সমস্তাবদ্ যাবদ্বেদে ন জায়তে।।’
মৌজ্ঞীবন্ধন অর্থাৎ উপনয়নের পূর্ব পর্যন্ত (অর্থাৎ যতক্ষণ না বেদজন্মরূপ উপনয়ন প্রাপ্ত হয় ততক্ষণ) স্বধা অর্থাৎ শ্রাদ্ধসম্বন্ধীয় বেদমন্ত্র ছাড়া অন্য বেদবাক্য উচ্চারণ করাবে না (এটি পিতার প্রতি উপদেশ)। যতক্ষণ না উপনীত হয়ে বেদাধ্যয়নদ্বারা দ্বিতীয় জন্ম গ্রহণ করবে, ততক্ষণ (ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণ) শূদ্রেরই সমান। (২/১৭২)।
‘স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ্ দূষণম্।
অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ।।’
ইহলোকে (শৃঙ্গার চেষ্টার দ্বারা মোহিত করে) পুরুষদের দূষিত করাই নারীদের স্বভাব; এই কারণে পণ্ডিতেরা স্ত্রীলোকসম্বন্ধে কখনোই অনবধান হন না। (২/২১৩)।
‘অবিদ্বাংসমলং লোকে বিদ্বাংসমপি বা পুনঃ।
প্রমদা হ্যুৎপথং নেতুং কামক্রোধবশানুগম্।।’
ইহলোকে কোনও পুরুষ ‘আমি বিদ্বান্ জিতেন্দ্রিয়’ মনে করে স্ত্রীলোকের সন্নিধানে বাস করবেন না; কারণ, বিদ্বানই হোন বা অবিদ্বানই হোন, দেহধর্মবশতঃ কামক্রোধের বশীভূত পুরুষকে কামিনীরা অনায়াসে বিপথে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। (২/২১৪)
‘মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা না বিবিক্তাসনো ভবেৎ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি।।’
মাতা, ভগিনী বা কন্যার সাথে কোনও পুরুষ নির্জন গৃহাদিতে বাস করবে না, কারণ ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান্ (চঞ্চল) যে, এরা (শাস্ত্রালোচনার দ্বারা আত্মসংযম অভ্যাস করতে পেরেছেন এমন) বিদ্বান্ ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করে (অর্থাৎ কামক্রোধাদির বশবর্তী করে তোলে)। (২/২১৫)।
‘শ্রদ্দধানঃ শুভাং বিদ্যামাদদীতাবরাদপি।
অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি।।’
শ্রদ্ধাযুক্ত ব্যক্তি শূদ্রাদিজাতীয় লোকের কাছ থেকেও গারুড়াদি বিদ্যা অর্থাৎ সর্পমন্ত্র প্রভৃতি শ্রেয়স্করী বিদ্যা গ্রহণ করবে; অন্ত্যজ চণ্ডালাদি জাতির (যারা পূর্বজন্মে যোগাভ্যাসযুক্ত ছিল) কাছ থেকেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম (অর্থাৎ মোক্ষের উপায় আত্মজ্ঞানাদি) গ্রহণ করবে; এবং দুষ্কুলজাত অর্থাৎ নিজের থেকে নিকৃষ্ট কুল থেকেও উত্তমা স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করবে। (২/২৩৮)।
‘স্ত্রিয়ো রত্নান্যথো বিদ্যা ধর্মঃ শৌচং সুভাষিতম্।
বিবিধানি চ শিল্পানি সমাদেয়ানি সর্বতঃ।।’
স্ত্রী, রত্ন (মণি-মাণিক্য), বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতবাক্য এবং বিবিধ শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে। (২/২৪০)।