মমতাজ শ্বশুর বাড়িতে এসে বছর পাঁচেক বেশ সুখে-স্বচ্ছন্দে ছিল। তারপর তাদের সংসারে কালোছায়া নেমে এল। প্রথমে আসাদের চাকরি চলে গেল। আসাদ সৎ ও ধার্মিক। সহকর্মীরা ও নিম্নতম কর্মচারীরা তার জন্য ঘুষ খেতে পারত না। উপরওয়ালারাও এ ব্যাপারে তার উপর অসন্তুষ্ট। এবারে সে বসের বিরাট অংকের ঘুঘ খাওয়ার ব্যাপার নিয়ে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছিল। আর অফিসের দুএকজন ছাড়া সবাই তার উপর অসন্তুষ্ট ছিল। এই সুযোগে সবাই মিলে যুক্তি করে বসের ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে দিল। ফলে তার চাকরি চলে যায়। অন্য কোথাও অনেক চেষ্টা করেও কোনো কিছু জোগাড় করতে না পেরে বাড়ি ফিরে এল।
ঘটনাটা জেনে আসাদের মা বলল, আজকাল শিক্ষিত লোকেরা যদি এরকম হয় তা হলে অশিক্ষিত থাকাই ভালো। সরকার রেডিও-টিভিতে যে দেশের লোককে শিক্ষা গ্রহনের জন্য এত গলাবাজি করছে, এত স্কুল-কলেজ তৈরি করছে, সে সব করে কি লাভ হচ্ছে? দেশের সব লোক শিক্ষিত হলে তো সবাই চরিত্রহীন হয়ে দেশটাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাবে।
আসাদ বলল, তোমার কথাটা যদিও ঠিক নয়, তবু একেবারে অস্বীকার করতে পারছি না। আসল কথা কি জান আম্মা, যারা দেশের লোককে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে এতকিছু করছে তারাই চরিত্রহীন ও দুর্নীতিবাজ। আর তারা শিক্ষিত হলেও শুধু ডিগ্রী নেয়ার জন্য লেখাপড়া করেছে, শিক্ষা গ্রহন করার জন্য করেনি। সেই সঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা না পেয়ে এবং না মেনে আল্লাহ ও রসুলকে (দঃ) ভুলে গেছে।
আনোয়ারা বলল, তোর দাদাজী বলতেন, ছেলেমেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা ও সেইমতো অনুশীলন দিয়ে মানুষ না করলে শুধু স্কুল-কলেজের বিদ্যার্জন করালে ক্রমশ তারা বিজাতীয়দের দিকে ঝুঁকে পড়বে। তারা, চরিত্রবানও হতে পারবে না।
আসাদ বলল, দাদাজী খুব খাঁটি কথা বলেছিলেন।
আসাদ বাড়িতে থেকে চাষবাস দেখাশোনা করতে লাগল। কিন্তু তাতে করে সংসারে আগের মতো সচ্ছলতা রইল না। ছোট ভাই জাকির মাস্টার ডিগ্রী পড়ার সময় এক বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে গোপনে লাভ ম্যারেজ করেছিল। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে একটা ছোটখাট অফিসে চাকরি নিয়েছিল। শ্বশুর বিয়ের কথা জানতে পেরে এবং জাকিরের পরিচয় পেয়ে প্রথমে মেয়েকে রাগারাগি করে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলেন, মেয়ে কিছুতেই রাজি হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে তিনি জামাইকে একটা ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। জাকির স্ত্রীকে নিয়ে গুলশানের একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বেতন মোটামুটি বেশ ভালো হলেও স্ত্রীর সব খায়েশ মেটাতে পারে না। তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই কলহ লেগে থাকে। এরপর আর দেশে মা-ভাইকে পাঠাবে কি।
আসাদ জানতে পেরে ঢাকায় জাকিরের বাসায় একবার গিয়েছিল। জাকির ভুল স্বীকার করে বড় ভাইয়ের কাছে মাফ চেয়ে টাকা-পয়সা দেয়ার অপারগতার কারণ খুলে বলেছে। সেদিন জাকির ভালো ব্যবহার করলেও তার স্ত্রী আসাদের সঙ্গে কথাও বলেনি। তারপর আসাদ আর ছোট ভাইয়ের কাছে যায়নি।
আসাদের বাপ বাড়ি করার সময় দশ বিঘে জমি গ্রামের এক ধনাঢ্য লোকের কাছে দশ বছরের জন্য সাফকওলা রেখে বিশ হাজার টাকা নিয়েছিল। আসাদ সে খবর জানত না। সে তখন কলেজে পড়ে। সাফকওলার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে সেই লোক কাগজপত্র নিয়ে আসাদের বাড়িতে এসে সব কথা জানিয়ে বলল, গত বছর মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আমরা এ বছর জমির দখল নিয়ে চাষাবাদ করব। দলিল মোতাবেক আমরা এখন আপনাদের জমির মালিক। তবে আপনি যদি এক মাসের মধ্যে সব টাকা পরিশোধ করতে পারেন তা হলে আপনাদের জমি আপনাদের থেকে যাবে। আমি দলিল ফিরিয়ে দেব। আপনার বাবা খুব ভালো লোক ছিলেন, আপনিও শিক্ষিত। যা ভালো বুঝবেন করবেন।
এইসব শুনে আসাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কোনো কথা বলতে পারল না।
আসাদের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে ঐ লোক বলল, মনে হচ্ছে আপনার বাবা আপনাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি কাগজপত্র দেখুন, তারপর আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বলুন। উনি বোধ হয় সবকিছু জানেন।
আসাদ দলিল পড়ে ফেরত দেয়ার সময় বলল, আপনার অনুমান সত্য। আব্বা আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেননি। আপনি এখন যান, আমি আম্মার সঙ্গে কথা বলে পরে আপনাকে জানাব।
লোকটি চলে যাওয়ার পর আসাদ মাকে সব কথা জানাল।
আনোয়ারা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর আব্বা যখন দোতলা বাড়ি করতে চাইল তখন অত টাকা কোথায় পাবে জিজ্ঞেস করতে জমি সাফকওলা রেখে টাকা নেয়ার কথা বলেছিল। তবে কতটা জমি, কত বছরের জন্য, কত টাকা নিয়েছিল তা আমাকে বলেনি।
আসাদ বিষণ্ণ গলায় বলল, কিন্তু আম্মা, আব্বা মারা যাওয়ার পরও আমাকে জানাওনি কেন? এতদিনে হয়ত কিছু-একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। এখন কি হবে? কোল কাদালের বিঘে দেড়েক জমি ছাড়া সব জমি আব্বা সাফকওলা করে গেছে। এখন আমি কি করে এত টাকা জোগাড় করব?
আনোয়ারা ছেলের হতাশা দেখে বলল, এত ভেঙে পড়ছিস কেন? ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। তুই একবার জাকিরের কাছে যা। তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে টাকাটা জোগাড় করে দিতে বলবি।
আসাদ বলল, সে কোথা থেকে দেবে? চাকরি করে যা পায় তাতে বাসা ভাড়া দিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। এতদিনে হয়ত ছেলেমেয়ে হয়ে সংসার আরও বড় হয়েছে।
আনোয়ারা জাকির ছোট বলে তাকে বেশি ভালবাসত। প্রথম যখন তার কীর্তিকলাপ শুনে তখন মনে খুব আঘাত পেয়ে খোঁজ খবর করেনি। তবে মাঝে মাঝে তার কথা মনে পড়লে চোখের পানিতে বুক ভাসায়। এখন আবার তার কথা আমাদের মুখে শুনে চোখের পানি রাখতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, জাকির যে এরকম হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। তুই আমাকে নিয়ে চল, অনেক বছর তাকে দেখিনি।
আসাদ ছোট ভাইকে অত্যন্ত স্নেহ করত। আজও করে। যদিও সে বড় ভাইয়ের ও মায়ের কোনো খোঁজ-খবর রাখেনি। মায়ের কথা শুনে বলল, জাকিরের বৌ খুব বড়লোকের মেয়ে, তোমাকে সে সহ্য করতে পারবে না। জাকির হয়ত কিছু বলবে না, কিন্তু তার বৌ আমাদেরকে দেখলে খুব অসন্তুষ্ট হবে। তার উপর যখন জানবে আমরা টাকার জন্য এসেছি তখন আমাদেরকে কি বলবে জানি না, তবে জাকিরের সঙ্গে তার খুব মনোমালিন্য হবে। তার চেয়ে আল্লাহ ভাগ্যে যা রেখেছে তাই হোক।
আনোয়ারা দৃঢ়স্বরে বলল, বৌ যাই করুক না কেন আমি যাবই। আর টাকা দেবে নাই বা কেন? সে কি বাপের সন্তান নয়? আমি কি তাকে পেটে ধরিনি? তুই যদি নিয়ে যাস, তা হলে আমি খালেককে নিয়ে যাব।
আসাদ বলল, সেখানে গেলে তুমি দুঃখ পাবে। তাই নিয়ে যেতে চাইনি। একান্তই যখন যেতে চাচ্ছ তখন আমিই তোমাকে নিয়ে যাব। খালেককে বলতে হবে না।
পরের দিন আসাদ মাকে নিয়ে ঢাকায় জাকিরের বাসায় গেল। কিন্তু সেখানে তাকে পেল না। যারা সেই বাসায় আছে তারা তার কথা জানে না বলে বলল। আসাদ জাকিরের অফিসের ঠিকানা জানত। মাকে একটা হোটেলে রেখে অফিসে গিয়ে শুনল, সে আজ থেকে এক বছর আগে চাকরি নিয়ে ফ্যামিলিসহ আমেরিকা চলে গেছে।
হোটেলে ফিরে এসে মাকে জাকিরের আমেরিকা চলে যাওয়ার কথা বলল।
আনোয়ারা বলল,আমেরিকার ঠিকানা জেনেছিস?
আসাদ বলল, জিজ্ঞেস করেছিলাম, তারা জানে না বলল।
আনোয়ারা আবার বলল, ওর শ্বশুরের ঠিকানা জানিস না?
আসাদ বলল, না।
আনোয়ারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সব কিছু আল্লাহপাকের ইচ্ছা। একদিন হোটেলে থেকে আসাদ মাকে নিয়ে বাড়ি ফিলে এল। তারপর আসাদ মহাজনের বাড়িতে গিয়ে তাকে অপারগতার কথা জানিয়ে এল। এরপর থেকে আসাদের সংসারে চরম দুর্দিন নেমে এল। এতদিনে তার দুটো ছেলে ও একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে মমতাজ কঠিন অসুখে ভুগছে। আসাদ এতগুলো মুখের আহার জোটাবে, না স্ত্রীকে ভালোভাবে চিকিৎসা করাবে? শেষে অনেক চিন্তা-ভাবনা করে রাজশাহী টাউনে এসে চেষ্টা-চরিত্র করে একটা বড় লাইব্রেরীতে সেলসম্যানের কাজ নিল। নতুন বলে মাসে দেড় হাজার টাকা বেতন। সেই টাকাতেই থাকা-খাওয়া করতে হয়। তারপর যা বাঁচে, সেই টাকা নিয়ে মাসে মাসে বাড়িতে আসে।
মেয়ে জামাইয়ের ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা শুনে নাদিমের বাড়ির সকলে দুঃখ পেল। কিন্তু তাদের জন্য কিছু করারও তাদের ক্ষমতা নেই। তবু চাষের সময় যখন যে ফসল হয় তা থেকে কিছু কিছু মমতাজকে দেওয়া হয়।
নাদিম মাঝে মাঝে যতটা পারে ছোট বোনের হাতে টাকা-পয়সা দিয়ে আসে।
আফ্রিদা ছোট মেয়ে মমতাজকে সব থেকে বেশি ভালবাসে। সে মেয়ের সংসারের দুরবস্থার কথা জেনে এবং মেয়ের কঠিন অসুখের কথা শুনে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। গোপনে ছোট ছেলে আবুল খায়েরের হাতে চাল, ডাল, তরী-তরকারী মাঝে মাঝে পাঠায়।
একদিন সাজেদা শাশুড়ীর এই ব্যাপারটা জানতে পেরে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। ভাবল, অন্য শ্বশুর বা শাশুড়ীরা জানতে পারলে তারা কি সহ্য করবে?
ভয়ে শাশুড়ীকে যেমন কিছু বলতে পারল না, তেমনি স্বামীকেও বলতে পারল না।
একবার আফ্রিদা যখন বাড়ির চাকরের হাতে সের দশেক চাল পাঠাল তখন ছোট জা ফাহমিদা দেখে ফেলে। এক ফাঁকে সে কথাটা সাজেদাকে জানিয়ে বলল, এটা যদি মেজ বুবু দেখত তা হলে খুব খারাপ হত।
সাজেদা শুনে কোনো কথা বলল না। চিন্তা করল, এবার যখন অন্যের চোখে পড়েছে তখন নাদিমকে জানান উচিত। রাতে ঘুমাবার সময় সাজেদা স্বামীকে বলল, তুমি যদি সাহস দাও, তা হলে একটা কথা বলতে চাই।
নাদিম বলল, কি এমন কথা যার জন্য সাহস দিতে বলছ? বল কি বলবে?
তার আগে তুমি বল, কথাটা শুনে রেগে যাবে না।
নাদিম ভাবল, নিশ্চয় সাংসারিক ব্যাপারে কারো সঙ্গে কিছু হয়েছে। বলল, রাগের কথা বললে রেগে যাওয়াটা কি অন্যায় হবে?
না, তা কেন হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, রাগ করব না, এবার বল।
আম্মা যে গোপনে মমতাজকে প্রায়ই সবকিছু দিয়ে পাঠান, তা আমি অনেক আগে জেনেছি। কিন্তু আজ যখন চাকর জামালকে দিয়ে চাল পাঠাচ্ছিল তখন ছোট মা দেখে ফেলেছে।
নাদিম কথাটা শুনে খুব অবাক হল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আম্মা এরকম করবে সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে সাজেদা মনে করল, হয় সে খুব রেগে গেছে, নচেৎ ঘুমিয়ে পড়েছে। কারণ সাজেদা জানে, নাদিম রেগে গেলে চুপ করে রাগটা হজম করে। আর সে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই কথা ভেবে স্বামীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, কি হল, কিছু বলছ না যে?
নাদিম বলল, মমতাজকে যতটা সাহায্য করার আমরা করি। তারপরও আম্মা এ রকম করবে তা কল্পনাও করতে পারছি না। ছোটমা কাউকে বলবে না ঠিক। কিন্তু পরে অন্যেরা জানতে পারলে আম্মার মান-সম্মান এতটুকু থাকবে না। আম্মা মমতাজকে ভীষণ ভালবাসে। তাই তার অভাব দেখে সহ্য করতে না পেরে স্নেহের দুর্বলতার কারণে এই কাজ করছে। কথাটা বলে তুমি খুব ভালো করেছ। চিন্তা করে দেখি, কি করা যায়।
দুদিন পর নাদিম ছোটমাকে ঐ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হল তারপর আব্বা ও চাচাদেরকে মমতাজকে এনে চিকিৎসা করানোর কথা বলল।
সবাই তার কথায় সায় দিল।
নাদিম একদিন সুলতানগঞ্জ গিয়ে মমতাজকে নিয়ে এসে অলোক ডাক্তারকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে লাগল। প্রায় ছমাস চিকিৎসা করেও সম্পূর্ণ ভালো হল না। যতদিন ওষুধ খায় ততদিন একটু ভালো থাকে। ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলে যেইকে সেই। শেষে এক পীর সাহেবের তদবীর করাতে কিছুটা উন্নতি হল। কিন্তু পুরোপুরি ভালো হল না। এবার আসাদ রাজশাহী থেকে এসে মমতাজকে নিয়ে গেল।
মমতাজ চলে যাওয়ার মাস দুই পর আফ্রিদা গোপনে তাকে চাল পাঠাবার সময় মেজজা আয়মন দেখে ফেলল। দেখার পর বড় জাকে বলল, মমতাজকে যা দেয়ার তার বাপ চাচারা দেয়, তুমি আবার সবাইকে গোপন করে দাও কেন? কারটা দাও? এক সংসারের জিনিস দাও কি করে? এরকমভাবে আরও কত কি কতদিন ধরে দিচ্ছ তা আল্লাহই জানে। এই সব বলে ঝগড়া করতে চাইল।
কিন্তু আফ্রিদা তার একটা কথারও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
আয়মন কাউচাতে কাউচাতে এক সময় চুপ করে গেল। কিন্তু সব জায়েরা জেনে গেল।
রাতে আয়মন স্বামীকে কথাটা জানিয়ে বলল, এবার আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া দরকার। এক সংসারে থাকলে বড় বুবু মমতাজকে সব কিছু দিয়ে দিয়ে সংসারের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে।
সুলতান বলল, অত কথা বলছ কেন? যা বলছি শুন আমিও কিছুদিন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা ভাবছি। দেখি, অন্য ভাইদের সঙ্গে কথা বলে, তারা কি বলে। আমি একা প্রথমে বলে দোষী হতে যাব কেন?
সুলতানের এই রকম ভাবার কারণ আছে। তার বড় ছেলে ইলিয়াস এম. এ. পাস করে একটা ভালো চাকরি করছে। সংসার এক জায়গায় আছে বলে বেতনের টাকা ছোট মায়ের হাতে দিয়ে দিতে হয়। ছেলের টাকা পাচ্ছে না। তাই সে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করছে।
আবিদা যখন স্বামীকে ঘটনাটা জানাল তখন আজিজ স্ত্রীকে বলল, এ ব্যাপারে তুমি বড় ভাবিকে কিছু বলল না। চুপ করে দেখ, মেজ ভাই ও মেজ ভাবী কি করে।
কুদ্দুস স্ত্রীর কাছে শুনে সেজ ভাই আজিজের মতো বলল, মমতাজের খুব অভাব, তার উপর সে চিররুগ্ন। তাই হয়ত বড় ভাবি তাকে এটা-ওটা দিয়ে সাহায্য করে। কই, অন্য কোনো মেয়েকে তো দেয় না। খবরদার, এ নিয়ে তুমি, বড় ভাবিকে কিছু বলা তো দূরে থাক, মেজভাবি ও সেজ ভাবির সঙ্গে কখনও আলোচনাও করবে না। বড় ভাবি মায়ের মতো আমাদেরকে মানুষ করেছে। তার কোনোদিন কোনো দোষ ধরবে না।
ফাহমিদা এ বাড়িতে যখন বৌ হয়ে আসে তখন আফ্রিদা তাকে সবকিছু বুঝিয়ে পড়িয়ে শিখিয়েছে। কাজে-কামে দোষ করলে অন্য জায়েরা ট্যাক ট্যাক করলেও বড় জা কোনদিন কিছু বলেনি। বরং অন্য জাদের বলেছে, নতুন বৌ, তার উপর কতই বা বয়স, এরকম একটু-আধটু দোষ হবেই। তোরা যখন নতুন বৌ হয়ে এসেছিলি তখন তো আমি তোদেরকে কিছু বলিনি। তারপর ফাহমিদাকে কাঁদতে দেখে আপন বোনের মতো তাকে প্রবোধ দিয়েছে আর যাতে ঐরকম দোষ না হয়, সে জন্যে কত বুঝিয়েছে। বড় জা যে দেবরদের গু-মুত নেড়ে মানুষ করেছে তা ফাহমিদা জানে। আর দেবররা যে বড় ভাবিকে খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করে তাও জানে। এখন স্বামীর কথা শুনে বলল, বড় বুবু যে অনেকদিন থেকে মমতাজকে সবকিছু গোপনে দেয়, তা আমি অনেক আগে থেকে জানি। কই, কোনোদিন কি তোমাকে কিছু বলেছি? বড় বুবু কাকে কি দিল না দিল ওসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। আজ মেজ বুবু দেখে ফেলে তাকে অনেক কথা। শুনিয়েছে।
কুদ্দুস বলল, সে বলুক গে তাতে আমাদের কি? বড় অবিকে যখন মায়েরমতো জানি তখন সে যা খুশি করুন, আমি কোনো দিন কিছুকলবনা। আর তুমিও বলবেনা।
পরের দিন দুপুরে সাজেদা খিড়কী পুকুরে গোসল করতে গিয়ে দেখল, মেজ ও সেজ শাশুড়ী গোসল করে ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি-সব কথা বলাবলি করছে। সাজেদাকে দেখে তারা চুপ করে গেল।
এই পুকুরটা বাড়ির পিছন দিকে। পুরুষদের সেদিকে যাওয়া নিষেধ। যদি কোনো কারণে যেতে হয়, তা হলে সেদিকে মেয়েরা কেউ আছে কিনা জেনে তারপর যায়। তবু ঘাটের তিন দিকে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা।
সাজেদা ঘাটে আসার পর মেজ ও সেজ চলে গেল। সে হাতে-পায়ে সাবান মাখছিল এমন সময় ফাহমিদা গোসল করতে এল। প্রায় সময় তারা দুজনে একসঙ্গে গোসল করে।
সাজেদা তাকে জিজ্ঞেস করল, ছোট মা, কি ব্যাপার বল তো, মেজ মা ও সেজ মা কি-সব কথা বলাবলি করছিল; আমাকে দেখে আলাপ বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল।
ফাহমিদা অনুমান করে বলল, গতকালের ব্যাপারটা নিয়ে হয়ত বলাবলি করছিল।
আমার শ্বশুর কি শুনেছে?
তা বলতে পারব না। তুমি নাদিমকে কিছু বলেছ নাকি?
না বলিনি। ভাবছি আজ বলব।
তারপর তারা আর কোনো কথা না বলে দুজন দুজনের গায়ে সাবান মাখিয়ে গোসল করে ফিরে এল।
রাতে নাদিম ঘরে এলে সাজেদা ঘটনাটা তাকে জানাল।
নাদিম শুনে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, দেখছি। আমাকেই এর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
সেই রাতেই খাওয়া-দাওয়ার পর সব চাচা-চাচিরা চলে যেতে নাদিম আব্বা আম্মাকে বলল, একটা কথা তোমাদেরকে বলতে চাই। কথাটা বললে বেয়াদবি হবে, তাই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
রহিম কিছু না বলে চুপ করে রইল।
তাই দেখে আফ্রিদা বলল, কি বলবি বল।
এবার আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।
আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, কেন? তোকে কি কেউ এ কথা বলতে বলেছে?
না আম্মা, আমাকে কেউ বলেনি। আমি মনে করি, চাচা-চাচিদের সাথে আমাদের কোনো বিষয়ে গোলমাল হওয়ার আগে আলাদা হয়ে গেলে সবার ইজ্জত রক্ষা হবে। তা ছাড়া আজ হোক কাল হোক, একদিন না একদিন তো আলাদা হতেই হবে। চিরকাল কি কেউ এক সংসারে থাকে?
আজ এশার নামাযের পর রহিম যখন মসজিদ থেকে বেরোচ্ছিল তখন সুলতান তাকে গতকালের ঘটনাটা বলে। এখন নাদিম যা বলল ঠিক সেই কথাই বলেছে। রহিম তাকে তখন বলেছে, ঠিক আছে, একদিন সব ভাই বসে সে ব্যাপারে আলাপ করে যা করার করা যাবে।
এখন নাদিমের কথা শুনে রহিম তাকেও ঐ একই কথা বলল।
নাদিম বলল, তাই করেন আব্বা। তারপর সে নিজের রুমে চলে গেল।
ছেলের ও স্বামীর কথা শুনে আফ্রিদা ভাবল, আমি মমতাজকে মাঝে মাঝে এটা ওটা দিই বলে কি নাদিম জানতে পেরে ঐ কথা বলল? আর নাদিমের আব্বাও কি এ ব্যাপারে শুনে এই কথা বলল? না দেবররা তাদেরকে আলাদা হওয়ার কথা বলেছে? স্বামীকে চুপ করে ভাবতে দেখে বলল, কি ভাবছ, আমার মনে হয় নাদিম টিক কথাই বলেছে।
রহিম বলল, আমার কাছেও তাই মনে হল বলে তো ঐ কথা বললাম।
নাদিম নিজের রুমে এসে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, আম্মা কি আমার কথা শুনে মনে কষ্ট পেল? মনে মনে বলল, আম্মা আমাকে মাফ করে দিও। এছাড়া তোমার ইজ্জত বাঁচাবার অন্য কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
শ্বশুর-শাশুড়ীর কাছ থেকে ফিরে এসে স্বামীকে চুপ করে শুয়ে থাকতে দেখে সাজেদা মনে করল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবু ঘাড় তুলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, জেগে আছে। বলল, কিছু ভাবছ মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, ভাবছি।
কি ভাবছ?
সবাই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা আব্বা-আম্মাকে বললাম। কি, ঠিক করিনি?
হ্যাঁ, ঠিক করেছ। কিন্তু…বলে সাজেদা থেমে গেল।
কি হল, কিন্তু বলে থেমে গেলে কেন?
আমার মনে হয় আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আম্মা আরও বেশি মমতাজকে ঐ সব দিবে।
তাতে কি হয়েছে? তখন তো আর কারো কিছু বলার থাকবে না।
তা থাকবে না, তবে সংসারের কোনোদিন উন্নতি হবে না এই কথা শুনে নাদিম খুব রেগে গেল। রাগ সামলাবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
সাজেদা তা বুঝতে পেরে চিন্তা করল, কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ভয়ে ভয়ে বলল, কথাটা বলে বোধ হয়ে আমি ভুল করেছি, সে জন্যে মাফ চাইছি। নাদিম ততক্ষণে রাগ সামলে সাজেদার কথায় খুশি হয়ে বলল, ভুল করলেও কথাটা ঠিক বলেছ। তবে
এরকম কথা আর কোনোদিন মাথার মধ্যে এনো না। সংসারের উন্নতি-অবনতি মানুষের ভুল কাজের দ্বারা হলেও ভাগ্যের উপর তার চাবিকাঠি। আমাদের ভাগ্যে যদি উন্নতি থাকে, তা হলে যেমন করে হোক তা হবেই। আর যদি তা না থাকে, তা হলে আম্মাকে অসিলা করে আমাদের দুঃখ-কষ্ট হবে। সব কিছু আল্লাহপাকের ইশারা। বাবা মার দোষ কোনোদিন ধরবে না। যদি তারা দোষ করে থাকে, মনে করবে এটাই ভাগ্য। বাবা-মার দোষ ধরা কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গিতে নিষেধ। যদি তারা ইসলামের পরিপন্থী কোনো কাজে লিপ্ত থাকে, তবে তাদেরকে আলাদা করে দিয়ে তাদের ভরণপোষণ করে যেতে হবে। কোনো ব্যাপারেই তাদের মনে এতটুকু কষ্ট দেয়া চলবে না। জেনে রেখো, পিতামাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত। তাদেরকে সন্তুষ্ট রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় করতে পারলে আল্লাহপাক বেহেশতের ওয়াদা করেছেন। তোমাকে আবার বলছি, আব্বা-আম্মার দোষ যেমন কোনোদিন ধরবে না, তেমনি তা অন্য কাউকেও বলবে না। তারপর সে চুপ করে গেল।
সাজেদা বুঝতে পারল, এবার নাদিম ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সেও ঘুমিয়ে পড়ল।
কয়েকদিন পর একদিন রহিম সব ভাই ও ভাইদের বৌকে নিয়ে বসল। সেদিন স্কুল বন্ধ থাকায় নাদিম ঘরে ছিল। তাকেও ডাকা হল। সকলে আসার পর রহিম বলল, আল্লাহপাকের অসীম রহমতে আমরা বহুদিন সবাই মিলেমিশে এক সংসারে কাটালাম। এখন আমাদের প্রত্যেকের সংসার বড় হয়েছে। লোক-সংখ্যাও বেড়েছে। এতবড় সংসার সুষ্ঠ ভাবে চালানো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের বিয়ে-শাদি দিতে হবে। নুতন বাড়িঘর করাও দরকার। তা ছাড়া একদিন না একদিন তো আমাদেরকে আলাদা হতেই হবে। আব্বা সে কথা জানতেন। তাই তিনি নিজে সব জায়গা জমি আগান-বাগান, পুকুর-ডোবা বাড়ি-ঘর প্রত্যেকের নামে নামে ভাগ বাটোয়ারা করে খাতায় লিখে রেখে গেছে। আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নেবেন, সে কথা হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে যাতে আমাদের মধ্যে মনোমালিন্য না হয় সে ব্যবস্থা করে রেখে গেছেন। এমন কি বোনদের অংশও লিখে রেখেছেন। সেই খাতাটা সিন্দুকে ছিল। নাদিমের মা পেয়ে সেটা এতদিন নিজের কাছে রেখে দিয়েছে, আমি সে কথা জানতাম না। গতকাল আমার হাতে দিয়ে পড়তে বলে বলল, আমি এতদিন এটা গোপন রেখেছিলাম। কারন তখন সংসার ভাগাভাগি করতে আমার মন চায় নি। এখন আর এত বড় সংসার একসঙ্গে থাকলে ঝগড়াঝাটি সৃষ্টি হতে পারে। তাই এবার সবাইকে যে যার অংশ বুঝিয়ে দিয়ে আলাদা করে দেয়ার ব্যবস্থা কর। আমিও তাই চিন্তা করে সেই ব্যবস্থা করার জন্য তোমাদেরকে নিয়ে বসেছি। তারপর সে খাতাটা সুলতানের হাতে দিয়ে বলল, তোমরা একে একে সবাই পড়ে দেখ।
খাতাটা সবাই পড়ার পর রহিম বলল, আব্বা যেভাবে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন, তাতে কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?
সব ভাইয়েরা একসঙ্গে বলে উঠল, না। ইলিয়াস ঘরে ছিল না। সেও এক সময় সেখানে এসেছে। চাচারা পড়ার পর নাদিম পড়ে ইলিয়াসের হাতে দিল। সেও পড়ল।
রহিম নাদিম ও ইলিয়াসকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের কিছু বলার থাকলে বল।
ইলিয়াস শুধু না বলল।
নাদিম বলল, বিষয়-সম্পত্তি দাদাজীর। আপনারা সেই সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। আপনারা সবাই যখন একমত তখন আমরাও একমত। আমার মনে হয়, দাদাজী যেভাবে বাটোয়ারা করে দিয়ে গেছেন, আপনারা করলে এত নিখুঁতভাবে করতে পারতেন না।
রহিম বলল, সবার মতামত শুনে খুশি হলাম। কারণ আমাদের মধ্যে কেউ আপত্তি করলে ভাগ-বাটোয়ারা করতে বাইরের পাঁচজনকে ডাকতে হত। এখন আমি আব্বার লেখামতো তোমাদেরকে সবকিছু দিয়ে আলাদা করে দেব। এবার তোমরা তোমাদের সংসারপত্র গুছিয়ে চালাবার চেষ্টা কর। আর একটা কথা, এই ভাগ-বাঁটোয়ারার ব্যাপারে আমি অন্য কাউকে ডাকতে চাই না। আমরা নিজেরা করে নেব। এতে তোমাদের কোনো আপত্তি নেই তো?
সবাই বলল, না নেই। শুধু কুদ্দুস চুপ করে রইল।
রহিম ফাহমিদাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ছোট বৌ, তোমার হিসাবের খাতাটা নিয়ে এস। আর সেই সাথে সিন্দুকে যা টাকা আছে নিয়ে এস।
সিন্দুকটা বরাবর আব্দুস সোবহান চৌধুরীর রুমে ছিল উনি ও উনার স্ত্রী মারা যাওয়ার পরও ঐ রুমে আছে। ফাহমিদা উঠে গিয়ে হিসাবের খাতা ও সব টাকা পয়সা নিয়ে এসে বড় ভাসুরের সামনে রেখে দিল।
রহিম হিসাবের খাতায় চোখ বুলিয়ে ফাহমিদাকে জিজ্ঞেস করল, জমা-খরচের পর যে পরিমাণ টাকা লেখা আছে সব টাকা এখানে আছে?
ফাহমিদা বলল, জি আছে।
রহিম বলল, টাকাগুলো চার ভাগ কর।
ফাহমিদা বড় ভাসুরের কথামত চার ভাগ করল।
রহিম প্রত্যেক ভাইয়ের হাতে এক ভাগ টাকা তুলে দেয়ার সময় বলল, এখন এগুলো নাও, পরে সবকিছু ভাগ করার ব্যবস্থা করছি।
কুদ্দুসকে টাকা দিতে গেলে সে টাকা না নিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, টাকার ভাগ তো। দিচ্ছ, তারপর উঠে এসে বড় ভাবির দুপা জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, এর ভাগ দেবে না? বড় ভাবি আমাদের মায়েরমতো ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে। মায়ের ভাগ না দিলে আমি শুধু টাকা কেন সম্পত্তিরও ভাগ নেব না। কথা শেষ করে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কয়েক সেকেণ্ড পর আবার বলল, আমাদের আব্বার কথা মনে নেই। তুমিও আমাদেরকে আব্বার মতো শাসন করে, স্নেহ দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে, লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করেছ; তোমাকেও ভাগে পেতে চাই।
কুদ্দুসের কথা শুনে সবার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। রহিম হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, অত অবুঝের মতো কথা বলিস না ভাই। আমরা তো তোদেরই আছি এবং যতদিন বাঁচব ততদিন থাকব। এত বড় সংসার একসাথে থাকায় কত রকমের অসুবিধে হচ্ছে। এরকম যে হবে-আব্বা জানতেন। তাই তিনি সেইরকম ব্যবস্থা করে গেছেন। এবার নিজেদের সংসার নিজেরা গুছিয়ে নিয়ে উন্নতির চেষ্টা কর। আমরা তো তোদের কাছেই রয়েছি। তোদের সুবিধে-অসুবিধে হলে। আমরাই দেখব। নে টাকাগুলো নে।
কুদ্দুস বলল, না, আমার টাকার দরকার নেই; আমি তোমার সঙ্গে থাকব আলাদা হব না।
আফ্রিদা বলল, কুদ্দুস, তুই বড় ভাইয়ের কথা না শুনে বেয়াদবি করছিস। আমি কি তোকে সেইভাবে মানুষ করেছি? টাকা নে বলছি। কুদ্দুস চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বড় ভাইয়ের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে আফ্রিদার পায়ের কাছে রেখে বলল, তোমাদেরকে আমি আব্বা-আম্মা মনে করি। আমি মরে যাওয়ার পর ফাহমিদাকে আলাদা করে দিও। তারপর সে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে গেল।
<