টিকলীর উপর প্রচন্ড রাগ ও অভিমান করে টোপর সেই দিন রাতেই নাইট কোচে ঢাকা রওয়ানা দিয়ে পরের দিন বেলা দশটায় বাসায় পৌঁছাল।

শাফিয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কিরে এত শিগ্রী ফিরে এলি যে? তারপর তার মুখের অবস্থা দেখে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, অসুখ বিসুখ করেনি তো?

টোপর ফেরার পথে চিন্তা করেছে টিকলীর চিঠিটা যদি মা বাবা তার মা-বাবার কাছে না দিত, তা হলে টিকলীর মা রাজশাহী যেত না, আর টিকলীও বিয়েতে অমত করত না। এই কথা ভেবে টিকলীর চেয়ে নিজের মা বাবার উপর রাগটা বেশি হল। তাই এখন মায়ের কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ল। বলল, টিকলীর চিঠি তোমরা আমাকে দিয়ে তার মা-বাবাকে দিলে কেন?

শাফিয়া বেগম বললেন, তুই এসব কি বলছিস? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

যা বলছি তা বুঝেও না বোঝার ভান করছ কেন? টিকলী রাজশাহী যাওয়ার আগে তাদের বুয়ার মেয়ের হাতে আমাকে দেওয়ার জন্য যে চিঠি দিয়েছিল, সেটা তোমরা নিয়ে আমাকে না দিয়ে তার মা-বাবার কাছে দিয়েছ, এ কথা অস্বীকার করতে পারবে?

তোকে একথা কে বলেছে?

কে আবার বলবে? আমি কক্সবাজার বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে রাজশাহী গিয়ে টিকলীর সাথে দেখা করেছি। বাবা না হয় রাগি মানুষ। কিন্তু তুমি জেনে শুনেও এমন কাজ করতে পারলে? এ জন্যেই বোধ হয় লোকে বলে, সৎ মা কখনো আপন মায়ের মতো হয় না।

শাফিয়া বেগম আহত স্বরে ভিজে গলায় বললেন, এমন কথা তুই বলতে পারলি? আমি কি তোকে সৎ ছেলের নজরে দেখি? তোকে নিজের পেটের ছেলেমেয়ের চেয়ে বেশি ভালবাসি। যখন যা আবদার করেছিস, তোর বাবার বকুনী খেয়েও তা পূরণ করেছি। কথা শেষ করে আঁচলে চোখ মুছলেন।

তাই যদি হয়, তবে আজই বাবাকে বলে টিকলীর সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা কর।

তা না হয় করলাম, কিন্তু তুই তো জানিস ওদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিন থেকে মনোমালিন্য। ওরা কি রাজি হবে? তা ছাড়া টিকলী ডাক্তারী পড়ার জন্য মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে।

বিয়ের পরও টিকলী পড়বে। তোমরা ওর মা বাবার কাছে প্রস্তাব দাও। রাজি না হলে অন্য ব্যবস্থা করা যাবে।

ঠিক আছে, তোর বাবা ফিরে এলে বলব, এখন যা জামা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি নাস্তা রেডি করছি।

কাহহার সাহেব অফিস থেকে বিকেলে ফিরলেন।

শাফিয়া বেগম চা-নাস্তা দিয়ে বললেন, টোপর ফিরেছে।

কাহহার সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি ফিরল যে?

ও বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যায় নি।

কোথায় গিয়েছিল তা হলে?

রাজশাহী।

রাজশাহী?

হ্যাঁ আমাদের কাছে মিথ্যে করে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে হালিম সাহেবের মেয়ে টিকলীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তার কাছে চিঠির কথা জেনে এসে আমাদেরকে দোষি করে যা-তা বলল। আরো বলল, আমরা যেন হালিম সাহেবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিই।

কাহহার সাহেব রেগে উঠে চিৎকার করে বললেন, ওর এত বড় সাহস? দুষমনের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়? নিজেকে কি মনে করে? কোথায় মন দিয়ে লেখাপড়া করবে, তা না করে বিয়ে করতে চায়। আমি ওর বিয়ে করা বের করছি, ওকি এখন। বাসায় আছে?

তুমি অত চেঁচাচ্ছ কেন? যা বলার আস্তে বল।

কি বললে, আমি চেঁচাচ্ছি। তুমি, হ্যাঁ তুমিই তো ওর মাথা খেয়েছ। তোমার, আস্কারাতেই ওর এত সাহস। তারপর হন হন করে টোপরের রুমে গিয়ে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে বললেন, তুই নাকি হালিম সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করতে চাস?

টোপর উঠে বসে মাথা নিচু করে রইল।

 চুপ করে আছিস কেন উত্তর দে।

টোপর ভয় পেলেও সামলে নিয়ে বলল, মাকে তো সে কথা বলেছি।

ওদের সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের মনোমালিন্য। সে জন্য যখন তুই তার মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা করতিস তখন নিষেধ করেছি। তবু ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস?

প্রতিবেশির সঙ্গে মনোমালিন্য কি চিরকাল রাখতে হবে?

খুব তো উপদেশ দিচ্ছিস, এখন বিয়ে করলে বৌকে পালবি কি করে? মনে করেছিস, বাবার টাকা আছে চিন্তা কি? শোন, এখন বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে মাষ্টার্স শেষ কর। তারপর তোকে যে ফরেনে পাঠাব, সে কথা তো বলেছি। ফরেন থেকে ফিরে এসে উপার্জন করতে শেখ। তারপর বিয়ের ব্যাপারে চিন্তা করবি।

শোন বাবা, আমি কয়েক দিনের মধ্যে হালিম সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। বিয়ের পর সে যেমন পড়ছে পড়বে। আর আমার ব্যাপারে তুমি যা বললে তাই হবে। ফরেন থেকে এসে উপার্জন করতে শিখে ওকে ঘরে তুলব।

কাহহার সাহেব আরো বেশি রেগে গিয়ে বললেন, খুব সেয়ানা হয়ে গেছিস তাই? নিজেকে খুব বুদ্ধিমান মনে করেছিস। আরে মুখে বলা আর কাজে পরিণত করা যে। কত দুঃসাধ্য, তাতো জানিস না।

আমি দুঃসাধ্যকে সাধন করে দেখাব।

খুব বড় বড় কথা বলতে শিখেছিস দেখছি। তুই আমার কথা শুনবি, না আমি তোর কথা শুনব? লেখাপড়া করে বাবার সঙ্গে তর্ক করতে তোর লজ্জা করছে না? আমার শেষ কথা, এখন বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে লেখাপড়া কর। আর যদি নিজে কিছু কর, তা হলে এ বাড়িতে তোমার জায়গা হবে না। তারপর তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন।

শাফিয়া বেগম এতক্ষণ দরজার আড়ালে ছিলেন। এবার ভিতরে এসে বললেন, তুই পাগলামী করিসনি বাবা। তোর বাবাকে তো চিনিস, যা এক রোখা মানুষ, রাগের মাথায় কি করতে না কি করে বসে।

টোপর বলল, তুমি এখন যাও, তোমরা কেউ আমাকে বোঝার চেষ্টা করনি। আমিও বলে রাখছি, ঐ মেয়েকেই আমি এ বাড়ির বৌ করে নিয়ে আনবই।

তিন চার দিন টোপর বাসা থেকে বের হল না। শুয়ে বসে কি করবে না করবে ভেবে কাটাল। ভেবেছিল, বিয়ে করে টিকলীকে নিয়ে এক সপ্তাহ হোটেলে আনন্দ ফুর্তি করবে। তার বদলে, টিকলী তাকে ফিরিয়ে দিল?

শাফিয়া বেগম বার বার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর না পেয়ে স্বামীকে কথাটা জানাল।

কাহহার সাহেব ছেলের রুমে এসে বললেন, তোর কি হয়েছে? অসুখ বিসুখ হলে ডাক্তার দেখা। চুপচাপ বাসায় বসে শুয়ে থাকলে অসুখ সারবে।

টোপর মিথ্যে করে বলল, তেমন কিছু হয়নি, ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ এনে খাচ্ছি।

ওষুধে কাজ না হলে ডাক্তারকে রিপোর্ট দে।

ঠিক আছে যাব।

যাব বলছিস কেন? এক্ষুণী যা, তারপর তিনি চলে গেলেন।

বাবা চলে যাওয়ার পর টোপর ড্রেস চেঞ্জ করে সাগরের বাসায় গেল।

সাগর বাসায় ছিল। তাকে দেখে বলল, কি ব্যাপার, কদিন পাত্তা নেই যে? মনে হচ্ছে অসুখ-বিসুখ করেছিল।

টোপর বলল, না ওসব কিছু হয়নি। তোকে একদিন বলেছিলাম না, খুব শিঘ্রী আমি টিকলীকে গোপনে কাজি অফিসে বিয়ে করব।

হ্যাঁ, বলেছিলি তা হল না বুঝি?

হয়নি। টিকলী রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ছে। সেখানে যাওয়ার আগে এখানে করতে চাইলে বলেছিল, রাজশাহীতে করবে। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে এক সপ্তাহ আগে গিয়েছিলাম। তারপর যা কিছু ঘটেছে সব বলল।

সাগর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুই বড় বদরাগী। আরে বাবা, প্রেমের ব্যাপারে বদরাগী হলে সাকসেসফুল হওয়া যায় না। মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করতে হয়। টিকলীর কথা শোনার পর তার কথায় রাজি হয়ে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করা তোর উচিত ছিল। যদি করতিস, তা হলে বিয়েতে সে নিজেই রাজি হয়ে যেত। তোকে একটা কথা বলি শোন, আজকাল প্রায় সব ছেলেরই একাধিক প্রেমিকা থাকে। আরে এক টিকলীকে নিয়ে অত দুর্ভাবনা করছিস কেন? আরো কতো টিকলী রয়েছে। তাদের দিকে মন দে। দেখবি তখন আর আগের টিকলীর কথা মনে পড়ছে না। আর মেয়েরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। তাদেরও একাধিক প্রেমিক আছে। অবশ্য মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে চালাক। কয়েকজনের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে যার বাবার আর্থিক অবস্থা সব থেকে ভালো, তাকে বিয়ে করে।

টোপর বিরক্ত কণ্ঠে বলল, আমরা ওদের দলে নই। আমাদের ব্যাপারটা তো তোকে বলেছি।

ওদের দলে এতদিন ছিলি না তো কি হয়েছে? এখন হয়ে যা।

তা সম্ভব নয় সাগর।

তা হলে আর কি করবি, টিকলীর ডাক্তারী পাশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর তুই যদি চাস, তা হলে আমরা, মানে বন্ধু বান্ধবরা রাজশাহী গিয়ে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করে আসতে পারি।

ভেবে দেখি, তারপর তোকে জানাব।

তাই ভেবেই জানাস। এখন শোন, পরশু আমরা ভার্সিটিতে হরতাল ডেকেছি। ভিসির বাসাও ঘেরাও করা হবে। মিছিল মিটিং হবে। তুইও থাকবি। তারপর একটা পিস্তল এনে তার হাতে দিয়ে বলল, এটা রাখ, কাজে লাগতে পারে।

টোপর আতঙ্কিত স্বরে বলল, না না, এটা লাগবে না।

আরে রাখতো, কখন কি হয় বলা যায়। তারপর জোর করে প্যান্টের পকেটে দিয়ে বলল, তুই একদম কাপুরুষ।

সাগরের কথা শুনে টোপরের রক্ত গরম হয়ে গেল। বলল, দেখ কাপুরুষ বলবি।

কাপুরুষ নয় তো কি? তা না হলে প্রেমিকার কথা শুনে ফিরে আসতিস না। এখন দেখছি তোদের ব্যাপারটা আমাকেই মেটাতে হবে।

এমন সময় একটা কাজের মেয়ে চা-নাস্তা দিয়ে গেল। সাগর বলল, এখন ওসব কথা বাদ দিয়ে নাস্তা খেয়ে নিই আয়, আমাকে একটু বেরোতে হবে।

হরতালের দিন সাগরের পার্টির ছেলেরা ক্যাম্পাস ঘিরে রেখেছিল। বিপক্ষ পার্টির ছেলেরা হরতাল করতে দেবে না বলে শ্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করলে দুদলে যুদ্ধ বেধে গেল। বোমা ও গোলাগুলির শব্দের ভার্সিটি কেঁপে উঠল। পুলিশরা আগের থেকে পাহারায় ছিল। তারা প্রথমে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করল। শেষে রাঠি চার্জ শুরু করল। ছাত্ররা অনেকে আহত হয়ে ধরা পড়ল। পুলিশরাও অনেকে আহত হল। অনেক ছাত্র পালাতে পারলেও টোপর পারল না। কারণ সে আহত হয়ে পড়েছিল। পুলিশ তাকে এ্যারেস্ট করে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে গেল। সার্চ করে তার কাছে পিস্তল পেয়ে হাজতে পাঠিয়ে দিল।

সাগর তাকে ছাড়াবার জন্যে অনেক চেষ্টা করল। কাহহার সাহেবও অনেক চেষ্টা; করলেন। কিন্তু কোনো কাজ হল না।

অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে টোপরের তিন মাসের জেল হল।

শাফিয়া বেগম জানতে পেরে স্বামীর উপর খুব রেগে গেলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, লোক কৃপণ হয় শুনেছি, তাই বলে টাকা খরচের ভয়ে নিজের ছেলেকে থানা থেকে ছাড়াবার ব্যবস্তা করবে না, একথা কখনো শুনিনি।

শাফিয়া বেগমের অনুমান ঠিক, থানা কাহ্হার সাহেবের কাছে এক লাখ টাকা চেয়েছিল। কাহ্হার সাহেব রাজি হননি। তাই স্ত্রীর কথায় কিছু না বলে চুপ করে। রইলেন।

জেলে টোপরের সঙ্গে আসলাম নামে একটা ছেলের পরিচয় হল। সে বড় লোকের শিক্ষিত ছেলে। চাকরী না পেয়ে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে মিশে খুন, ছিনতাই ও রাহাজানী করে বেড়াত। কিছুদিন আগে ধরা পড়ে জেলে এসেছে। সে হিরোইনের নেশা করে। জেলের মধ্যেও গার্ডদের একজনকে হাত করে প্রতিদিন নেশা করে। আগে সন্ত্রাসী করে বেড়ালেও হিরোইনের নেশা ছিল না। একটা মেয়ে কয়েক বছর তার সঙ্গে প্রেম করে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে। তাকে ভুলে থাকার জন্য হিরোইন নেশা শুরু করে।

টোপর একদিন তাকে নেশা করতে দেখে ফেলে। সে কথা জানিয়ে আসলামকে নিষেধ করল।

আসলাম তাকে তার সব কথা বলল। তারপর টোপরের সবকিছু জানতে চাইল।

টোপরও অকপটে সব কিছু বলল।

আসলাম বলল, আপনার সঙ্গে আমার অনেক মিল। আপনার বাবার মত আমার বাবাও কৃপণ। আপনিও প্রেমে ছ্যাক খেয়েছেন, আমিও খেয়েছি। সব কিছু ভুলে থাকার জন্যে আমি হিরোইনের নেশা করি। আপনি একদিন একটু করে দেখুন, কিভাবে সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়।

টোপরের তখন টিকলীর কথা মনে পড়ল। সে কি সত্যি সত্যি আমাকে ছ্যাক দিবে। তার মন বলে উঠল, না না তা দিতে পারে না। টিকলী সেরকম মেয়েই নয়। আবার ভাবল, ডাক্তারী পাশ করতে পাঁচ-ছ-বছর সময় লাগবে। এতদিন তার অপেক্ষায় থাকব কি করে?

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আসলাম বলল, কি এত ভাবছেন? হিরোইনের নেশা করলে সব রকমের চিন্তা ভাবনা হারিয়ে যাবে। মনে অনাবিল শান্তি পাবেন।

টোপর কোন কথা না বলে তার কাছ থেকে চলে গেল। কয়েকদিন ধরে টোপর চিন্তা করল, বাবা ইচ্ছা করলে থানায় টাকা দিয়ে তাকে ছাড়াতে পারত; কিন্তু অনেক টাকা দিতে হবে ভেবে ছাড়ায়নি। আর সৎ মা না হয়ে যদি নিজের মা হত, তা হলে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে হলেও ছাড়াবার ব্যবস্থা করত। সে জন্যে মা বাবার ওপর প্রচণ্ড অভিমান হল। টিকলীও তার সঙ্গে বেইমানী করল। প্রাণের বন্ধু হয়েও সাগর তাকে ছাড়াল না। দিনের পর দিন এইসব চিন্তায় তার মনে ক্ষত বিক্ষত হয়ে অশান্তির আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। সেই জ্বল সহ্য করতে না পেরে একদিন আসলামকে বলল, আমি হিরোইনের নেশা করব।

আসলাম মৃদু হেসে তার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, আমাদের গ্রাম দেশে একটা কথা প্রচলন আছে, পেঁকি যতই মাথা চালাক, গড়ে তাকে পড়তেই হবে। আমি জানতাম, আপনি হিরোইনের নেশা করতে বাধ্য হবেন।

সেদিন থেকে টোপর হিরোইনের নেশা শুরু করলো। সেই সাথে আসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠল। মা-বাবা দেখা করতে এলেও দেখা করল না।

টোপর রাগ করে চলে যাওয়ার পর টিকলীর মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কয়েক দিন গোপনে কান্নাকাটি করল। তারপর সব কিছু জানিয়ে জিনিয়াকে চিঠি লিখল। সেই সাথে টোপরকে লিখল

প্রিয়তম টোপর,
হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা পাঠালাম, গ্রহণ করে ধন্য করো। সেদিন তুমি রাগ করে চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত যে অন্তরজ্বালায় জ্বলছি, তা কবে নিভবে জানি না। তুমি হয়তো মনে করেছ, আমি তোমার সঙ্গে বেঈমানী করেছি। এটা সত্য কিনা উপরের মালিক জানেন। তুমি আগেও যেমন আমার মন প্রাণ জুড়ে ছিলে, এখনো তেমনি আছ এবং আমৃত্যু পর্যন্তও থাকবে। তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কোনো ছেলের কথা ভাবা তো দূরের কথা, প্রয়োজন ছাড়া কারো দিক মুখ তুলে তাকাইনি। মায়ের কাছে ওয়াদা না করলে তোমাকে সেদিন ফিরিয়ে দিতাম না। বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। কারণ আমি আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তোমাকে ভালোবাসি। আমার বিশ্বাস তুমিও আমাকে একইরকম ভালবাস এবং আমাকে ছাড়া তুমিও বাঁচবে না। সেই বিম্বাসের জোরে আমি ক্ষমা চাইছি। আশা করি তা পাব। আবার বলছি তুমি বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করো না, পার্টির কাজও। করো না। ওসব বাদ দিয়ে মন দিয়ে পড়াশোনা কর। আর প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। বেশি কিছু লিখে তোমাকে বিরক্ত করব না। চিঠি পাওয়া মাত্র উত্তর দিবে। আর কবে আসবে জানাবে।

আল্লাহ পাকের দরবারে তোমার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে আর একবার হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা জানিয়ে ইতি টানলাম।
তোমার প্রিয়তমা
টিকলী

লেখা শেষ করে দুটো চিঠি একসঙ্গে একটা খামে ভরে পোস্ট করে দিল।

জিনিয়া যেদিন চিঠি পেল সেদিন ভার্সিটিতে গোলমাল হয়ে টোপর এ্যারেস্ট হয়েছে। পরের দিন কাগজে অন্যান্যদের সঙ্গে তার ছবি দেখে ও ঘটনা পড়ে যেমন অবাক হল, তেমনি দুঃখও পেল। ভাবল, টিকলীও নিশ্চয় কাগজে খবরটা পড়েছে। কয়েক দিন অপেক্ষা করা যাক। টোপর ভাইকে নিশ্চয় তার বাবা থানা থেকে ছাড়িয়ে আনবেন। তারপর তাকে চিঠি দেবে।

হালিম সাহেব কাগজে টোপরের কির্তীকলাপের কথা পড়ে স্ত্রীকে ডেকে কাগজে ছবি ও লেখাটা দেখিয়ে বললেন, পড়ে দেখ।

সাজেদা বেগম পড়ে আতঙ্কিত স্বরে বললেন, ভাগ্যিস আমি গিয়ে টিকলীকে বুঝিয়ে বলে এসেছিলাম। নচেৎ সর্বনাশ হয়ে যেত। শুনেছিলাম, কাহহার সাহেবের ছেলেটা ভালো ছাত্র। এটাই বুঝি তার প্রমাণ। তারপর বললেন, আল্লাহ যা করেন সবার ভালর জন্যই করেন। এবার টিকলীর ভুল ভাঙ্গবে।

টিকলী খবরটা পড়ে খুব দুঃখ পেলেও বিশ্বাস করল না। ভাবল, মিছিলে ছিল বলে আহত হয়ে এ্যারেস্ট হয়েছে। তার বাবা ছাড়িয়ে নেবে। মনে হয় চিঠিটা পাইনি। পেলে নিশ্চয় মিছিলে যেত না। জিনিয়া নিশ্চয় চিঠি দিয়ে সব কিছু জানাবে। এইসব চিন্তা করে তার চিঠির অপেক্ষায় রইল।

 বেশ কিছু দিনের জন্য ভার্সিটি বন্ধ দিয়েছে। টোপরকে চিঠি দেওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলি জিনিয়ার ধারে কাছে আসে না। জিনিয়া ভার্সিটিতে কয়েকবার তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু আলি তাকে পাত্তা না দিয়ে সরে গেছে। আজ থাকতে না পেরে জিনিয়া আলিদের বাসায় এল।

সাজেদা বেগম ছাড়া বাসায় কেউ নেই। হালিম সাহেব অফিসে চলে গেছেন। আলি বেশ কিছুক্ষণ আগে বেরিয়ে গেছে। সাজেদা বেগম জিনিয়াকে দেখে হাসিমুখে বললেন, বান্ধবী নেই বলে আসতে নেই বুঝি?

জিনিয়া সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, বাবা একা একা কোথাও যেতে দেন। আজ বাবাকে এখানে আসার কথা বলে গাড়ি নিয়ে এসেছি। টিকলীর চিঠি পেয়েছেন? ও কেমন আছে?

সাজেদা বেগম বললেন, চিঠি দেয় না। দুএকদিন ছাড়া ফোন করে। কালও করেছিল, ভালো আছে।

জিনিয়া আলির কথা জিজ্ঞেস করতে লজ্জা পেল। তাই বলল, খালুজান বুঝি অফিসে গেছেন?

হ্যাঁ মা, আলিও নেই। বেশ কিছুক্ষণ হল বাইরে গেছে।

এখন আসি খালাআম্মা।

 ওমা সেকি? আসতে না আসতে যাবে কি? বস, নাস্তা খেয়ে যাবে।

না খালাআম্মা, নাস্তা খেয়ে এসেছি।

খেয়ে এসেছ তো কি হয়েছে? খালাআম্মার কাছে এসে শুধু মুখে ফিরে যেতে নাই। এমন সময় আলিকে আসতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, টিকলী নেই বলে জিনিয়া এতদিন পরে এল। এখন আবার কিছু না খেয়ে চলে যেতে চাচ্ছে। তুই ওর সঙ্গে গল্প কর, আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কথা শেষ করে চলে গেলেন।

জিনিয়া সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ?

আলি গম্ভীর স্বরে সালামের উত্তর দিয়ে একটা সোফায় বসল।

জিনিয়া কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, কেমন আছ বললে না যে?

আমার ভালো মন্দ জেনে আর কি হবে? টোপরের তিন মাসের জেল হয়েছে। শুনেছ?

জিনিয়া চমকে উঠে বলল, না শুনিনি।

কি ব্যাপার চমকে উঠলে যে? মনে হচ্ছে টোপরের কথা শুনে খুব দুঃখ পেয়েছ?

তা পেয়েছি, তবে তুমি যা ভাবছ তা সত্য নয়। আচ্ছা, তুমি আমাকে এত নীচ ভাবতে পারলে কি করে? একটা কথা মনে রেখ, সেই ক্লাস নাইন থেকে তুমি আমার হৃদয়ে আসন গেড়ে বসে আছ। সেখানে আর কারো স্থান নেই। সেদিন টোপরকে যে চিঠিটা দিতে দেখেছ, সেটা আমার নয়। অন্য একটা মেয়ের। তারপরও তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারলে?

আলি চিন্তা করল, টোপর কি তা হলে টিকলীকে বাদ দিয়ে অন্য মেয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বলল, তাই যদি হয়, তা হলে মেয়েটির পরিচয় বল।

সে কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।

আমি কথা দিচ্ছি, এ ব্যাপারে সবকিছু গোপন রাখব।

 কিন্তু শুনে তুমি খুব রেগে যাবে।

তবু তুমি বল। টিকলীর সঙ্গে টোপরের সম্পর্কের কথা জেনেও গোপন করছ কেন? তুমি কি টিকলীর ভালো চাও না?

আগে কথা দাও রাগবে না।

ঠিক আছে রাগব না।

চিঠিটা টিকলীর। রাজশাহী থেকে আমার চিঠির সাথে টোপরকেও দেয়। আমাকে লিখেছে চিঠিটা যেন অবশ্যই তাকে দিই। টোপরের চিঠি তুমি পড়েছিলে?

না। টিকলী তোমাকে কি লিখেছে?

 জিনিয়া সব চিঠি সঙ্গে এনেছে। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নিজের দুটো বার করে তার হাতে দিয়ে বলল, টিকলী তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিল। তাই সেদিন বলিনি, আজ তুমি বলতে বাধ্য করালে।

আলি চিঠি দুটো পড়ে বুঝতে পারল, মা কেন তাকে নিয়ে রাজশাহী গিয়েছিল। সে ওদের সম্পর্কে একদম রাজি না থাকলেও ছোট বোনের মনে আঘাত লাগবে ভেবে জানা সত্ত্বেও বাধা দেয়নি। তবে এক্ষুণী তারা বিয়ে করতে চেয়েছিল জেনে রেগে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না।

জিনিয়া তা বুঝতে পেরে ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ, রাগ করবে না।

আলি রাগ সামলে নিয়ে বলল, টিকলী আমার একমাত্র বোন। আমিও যেমন তাকে ভালবাসি, সেও তেমনি আমাকে ভালবাসে। তাই ওদের ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে না পারলেও বাধা দিইনি। তা ছাড়া টোপরকে ভালো ছাত্র বলে জানতাম, কিন্তু সে যে পার্টির খারাপ ছেলেদের সঙ্গে এইসব করত, তা জানতাম না। এখন আর বাধা না দিয়ে থাকতে পারছি না। ভাবছি, রাজশাহী গিয়ে তার সবকিছু জানিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলে আসব। আর তুমিও চিঠি দিয়ে জানাও, টোপরের সঙ্গে যেন কোন সম্পর্ক না রাখে।

টিকলী যে চিঠিটা টোপরকে দিয়েছিল, সেটা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বার করার সময় বলল, টিকলী টোপরের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাকে আমিও ভালো ছাত্র হিসাবে জানতাম। তারপর চিঠিটা দিয়ে বলল, যে দিন এটা পায়, তার পরের দিন পেপারে টোপরের ঘটনা পড়ে সেই থেকে মনটা খুব খারাপ হয়ে আছে। এখন আবার তোমার কাছে তার তিন মাসের জেল হয়েছে শুনে আরো বেশী খারাপ লাগছে।

এমন সময় মাকে নাস্তা নিয়ে আসতে দেখে আলি চিঠিটা পকেটে রেখে দিল।

সাজেদা বেগম কিন্তু দেখে ফেলেছেন। ভাবলেন, ওরা হয়তো প্রেমপত্র বিনিময় করছে। মুচকি হেসে নাস্তা খেতে বলে আয়াকে নিয়ে চলে গেলেন।

আলি চিঠি পড়তে গেলে জিনিয়া বাধা দিয়ে বলল, আগে নাস্তা খেয়ে নাও তারপর পড়ো।

আমি নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তুমি খাও। আমাকে শুধু চা দাও বলে আলি চিঠি খুলে পড়তে লাগল।

 জিনিয়া তাকে চা দিয়ে অল্প নাস্তা খেয়ে চা খেল।

চিঠি পড়তে পড়তে আলি চা খাওয়ার কথা ভুলে গেল। পড়া শেষ করে টোপরের প্রতি বোনের গভীর ভালবাসার কথা জানতে পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।

জিনিয়া বলল, চা খেলে না যে, ঠান্ডা হয়ে গেল তো। তারপর সেই চা ফেলে দিয়ে কেতলী থেকে আর এক কাপ ঢেলে দিল।

আলি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টিকলীর কপালে দুঃখ আছে। আল্লাহ ওকে তুমি হেফাজত কর। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, টোপরকে আগে চিনতে পারলে টিকলীকে এতটা এগোতে দিতাম না। কি জানি, আল্লাহ ওর তকদিরে কি লিখেছে।

জিনিয়া ম্লান মুখে বলল, এতদিন টিকলী নিশ্চয় টোপরের কথা জেনেছে। তার মনের অবস্থাটা একবার চিন্তা করে দেখ।

হাঁ সেই চিন্তাই তো করছি। ও জেনে কি করছে কি জানি।

আমার মতে রাজশাহী গিয়ে ওকে শান্তনা দিয়ে আসা তোমার উচিত।

তুমি ঠিক কথা বলেছ। বাবাকে বলা যাবে না, মাকে বলে যাব।

অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি বলে জিনিয়া দাঁড়িয়ে পড়ল।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আলি বলল, বারটা বাজতে যায়, দুপুরে খেয়ে গেলে হত না?

প্লীজ আজ নয়, বাবা তাড়াতাড়ি ফিরতে বলেছিল। এমনি অনেক দেরি হয়ে গেছে।

তা হলে বল, আমাকে ক্ষমা করেছ। সেদিন তোমাকে ভুল বুঝে অন্যায় করেছি।

জিনিয়া মৃদু হেসে বলল, সেদিনের ব্যাপারে ভুল বোঝাই স্বাভাবিক। তোমার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। তবে একটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত, যে কোনো সন্দেহজনক ব্যাপার সত্য মিথ্যা যাচাই করা দরকার, তাই না?

আলিও মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ তাই। আর সে জন্যেই অপেক্ষায় ছিলাম। তবে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে অন্যায় করেছি। তাই ক্ষমা চাইছি।

ক্ষমা তুমি আগেই পেয়েছ। এর থেকে বড় কিছু অন্যায় করলেও পাবে। তবে আমার খুব কষ্ট হবে।

কথা দিচ্ছি, আর কখনো তোমাকে কষ্ট দেব না। তবে অজান্তে যদি দিয়ে ফেলি, তা হলে তুমিও কথা দাও, কষ্ট না পেয়ে আমার ভুল ভাঙ্গিয়ে দেবে।

দিলাম, এবার আসি হলে?

মায়ের সঙ্গে দেখা করবে না?

তোমার মতো উনিও খেয়ে যেতে বলবেন। তাই আমার হয়ে তুমি মায়ের কাছে। ক্ষমা চেয়ে নিও।

ঠিক আছে, চলো তোমাকে গাড়িতে তুলে দিই।

.

প্রায় পনের দিন অপেক্ষা করেও জিনিয়ার কোন চিঠি না পেয়ে টিকলী ঢাকা এল। একদিন মা-বাবার অগোচরে টোপরের সঙ্গে দেখা করতে গেল। টোপর তার সঙ্গেও দেখা করল না। টিকলী কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে জিনিয়াদের বাসায় গেল।

সালাম ও কুশল বিনিময় করে জিনিয়া বলল, টোপর ভাইয়ের কথা তুই পেপারে জেনেছিস ভেবে চিঠি দিইনি। শুনেছি, থানা তার বাবার কাছে এক লক্ষ টাকা চেয়েছিল। কারো বাবা যে এত কৃপণ হয় তা জানতাম না। টিকলী চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, এখন আমি কি করব বলতে পারিস? ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, করেনি।

তুই আবার কি করবি? তোর করারই বা কি আছে। তুই তো জানতিস, টোপর ভাই কলেজ লাইফ থেকে পার্টি করে, নিষেধ করিসনি কেন?

অনেক করেছি। করলে বলত, আমি পার্টির কাজ করলেও মিটিং, মিছিল কখনো করি না। কি জানিস, আমার মনে হয় বিয়েতে রাজি হইনি বলে আমার উপর রাগ করে এবারে মিছিলে গিয়েছিল। চিঠিটা ওকে দিয়েছিলি?

কি করে দেব। চিঠি পাওয়ার পরের দিনই তো ভার্সিটিতে গোলমাল হল।

 চিঠিটা দে।

জিনিয়া সেদিন আলিকে চিঠিটা পড়তে দিয়েছিল, ফেরৎ নিতে ভুলে গেছে। তাই চুপ করে রইল।

কই দে।

কাল তোদের বাসায় গিয়ে দিয়ে আসব।

কেন? এখনই দে না, কাল সকালের ট্রেনে আমি রাজশাহী চলে যাব।

সত্য মিথ্যা কিছু বলতে না পেরে জিনিয়া চুপ করে রইল।

 কি ব্যাপার বলতো, চিঠিটা দিচ্ছিস না কেন?

আমি তোর কাছে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি।

কি যা তা বলছিস, আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

 চিঠিটা এখন আমার কাছে নেই।

টিকলী খুব অবাক হয়ে বলল, কার কাছে আছে?

তোর ভাইয়ার কাছে।

কি বলছিস তুই? নিষেধ করা সত্ত্বেও দিলি? তোর সঙ্গে এত দিনের বন্ধুত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলি? ছিঃ ছিঃ ভাইয়াকে আমি মুখ দেখাব কি করে?

বিশ্বাস কর দিতে চাইনি, তোর ভাইয়া বাধ্য করিয়েছে।

থাক, আর সাফাই গাইতে হবে না। তোকে চিনতে আমারই ভুল হয়েছে বলে টিকলী চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।

জিনিয়া তার হাত ধরে বসিয়ে ভিজে গলায় বলল, কেন তোর ভাইয়াকে চিঠিটা দিতে বাধ্য হয়েছি, শোনার পর আমাকে যা কিছু বলতে পারিস। প্রথম চিঠিটা ভার্সিটিতে টোপর ভাইয়াকে দিতে তোর ভাইয়া দেখে ফেলে। তারপর সে আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি বললাম, একটা মেয়ে আমার হাতে টোপর ভাইকে দিতে দিয়েছিল। তোর ভাইয়া তোদের দুজনের সম্পর্কের কথা জানে। তাই মেয়েটার পরিচয় জানতে চায়। আমি বলিনি। ফলে টোপর ভাইয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে ভেবে আমাকে সন্দেহ করে খুব রেগে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে তোর দ্বিতীয় চিঠি পাই। পেপারে ভার্সিটির গোলমালের ঘটনার পড়ে চিঠিটা টোপর ভাইকে দেওয়া হল না। এদিকে আমার উপর তোর ভাইয়ার সন্দেহ আমাকে অস্থির করে তুলল। শেষে থাকতে না পেরে তিন দিন আগে তোদের বাসায় যাই। তারপর কিভাবে আলিকে চিঠিটা দিল এবং টোপরের সম্বন্ধে যা কিছু কথাবার্তা হয়েছিল সব বলে বলল, তোর ভাইয়া তোকে ভীষণ ভালবাসে। টোপর ভাইয়ের কার্যকলাপে খুব দুঃখ পেয়েছে। বলল, টোপর স্বাবলম্বি হওয়ার পর আমি মা-বাবাকে বুঝিয়ে ওদের বিয়ে দেওয়ার কথা বলব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন আর তার সঙ্গে টিকলীর সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। আরো বলল, রাজশাহী গিয়ে তোকে সে কথা জানিয়ে সান্তনা দিয়ে আসবে। কথায় কথায় চিঠিটা নিতে ভুলে গিয়েছি। তা তুই এসেছিস কবে?

কাল।

তোর ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি?

তোর সঙ্গে আলাপ করার পর করব বলে করিনি। তা ছাড়া ভাইয়া কাল কোথায় যেন গিয়েছিল। অনেক রাতে ফিরেছে। আজ সকালে তোর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। বলে শুধু মাকে বলে বেরিয়েছি।

আমার মনে হয়, আজ তোর ভাইয়া নিজেই তোর সঙ্গে আলাপ করবে। এরপরও যদি আমাকে দোষী মনে করিস, তা হলে মাফ চাইছি।

এক্ষেত্রে তোর অন্যায় হয়নি। তোর জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম। এবার

আসি রে।

থাক না, দুপুরে খেয়ে বিকেলে যাবি।

নারে, বাসায় সবাই চিন্তা করবে।

তা হলে সামান্য কিছু খেয়া যা।

চা-নাস্তা খেয়ে বিদায় নেওয়ার সময় টিকলী বলল, চিঠি দেব, উত্তর দিস।

<

Super User