মাগরিবের নামায পড়ে আলি পড়তে বসেছে, এমন সময় বুয়া চা নিয়ে এল। যখনই সে পড়তে বসে তখনই তার এক কাপ চা চাই। এটা তার ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। চা না খেলে পড়ায় মন বসে না। বুয়া চা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আলি তাকে বলল, টিকলীকে ডেকে দাও।
টিকলী মায়ের সঙ্গে কথা বলছিল। বুয়া এসে বলল, আপনাকে ভাইয়া ডাকছেন।
টিকলীর তখন জিনিয়ার কথা মনে পড়ল। আজ তোর ভাইয়া তোকে কিছু বলতে পারে। ভয়ে ভয়ে ভাইয়ার রুমে এল।
আলি পড়া শুরু না করে তার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে বলল, আয়। বস। কয়েকটা কথা বলব বলে ডাকলাম।
আলি পড়ার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসেছিল, টিকলী খাটে বসল।
আলি বলল, তোর আর টোপরের ব্যাপারটা জানি বলে তার পরিণতি দেখে খুব দুঃখ পেয়েছি। এবারে যে চিঠি তুই টোপরকে দেওয়ার জন্য জিনিয়াকে দিয়েছিলি, সেটা আমি পড়েছি। পড়ে তোদের গভীর সম্পর্কের কথা জানতে পেরে সেই দুঃখ আরও বেড়ে গেছে। শোন্, মানুষ তকদিরের হাতে বন্দী। তাকে কেউ রদবদল করতে পারে না। তাই বলছি, টোপর যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে শুধরে যায়, তা হলে আমি তোকে বাধা দেব না। কিন্তু তা না হয়ে যদি আরো খারাপ হয়ে যায়, তা হলে খুব শক্ত ভাবে বাধা দেব। আর তোকেও তকদিরের উপর সবর করে তাকে ভুলে যেতে হবে। তুই আমার একমাত্র বোন। তোকে কতটা ভালবাসি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তুইি ভবিষ্যৎ জীবনে দুঃখ কষ্ট বা অশান্তি পাবি, এটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। তারপর চিঠিটা তাকে দিয়ে ভিজে গলায় বলল, জিনিয়াকে দিতে বাধ্য করিয়েছিলাম। তাকে তুই ভুল বুঝিস না। এবার যা, আমার আর কিছু বলার নেই।
ভাইয়ার কথা শুনতে শুনতে টিকলীর চোখে পানি এসে গেছে। চোখ মুছে বলল, ভাইয়া, তুমি দোওয়া করো, আমি যেন তোমার দুঃখের কারণ না হই। তারপর গুটি গুটি পায়ে সেখান থেকে চলে গেল।
তিনমাস পরে যেদিন টোপর ছাড়া পেল, সেদিন কাহহার সাহেব ও শাফিয়া বেগম। তাকে সাথে করে বাসায় নিয়ে এলেন। টোপর কারো সঙ্গে কথা বলল না। বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে মায়ের কাছ থেকে যে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিল, তা থেকে রাজশাহী যাতায়াত বাবদ পাঁচ-ছশো টাকা খরচ হয়েছিল। বাকি টাকা তার রুমে ছিল। সেই টাকা থেকে প্রতিদিন হিরোইনের নেশা করতে লাগল। ভার্সিটিতে যাওয়ার। নাম করে সারাদিন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে অনেক রাতে বাসায় ফেরে। এভাবে কিছু দিন চলার পর টাকা ফুরিয়ে যেতে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে লাগল।
টোপর আগে টাকা নিলেও এত ঘন ঘন নিত না। জিজ্ঞেস করলে যদি সৎ মায়ের। তুলনা দেয়, তাই শাফিয়া বেগম একরকম বাধ্য হয়ে দেন।
জেলে থাকার সময় টোপর আসলামকে বলেছিল, সে যখন ছাড়া পাবে তখন হিরোইনের সব টাকা দিয়ে দেবে। তাকে বাসার ঠিকানাও দিয়েছিল।
ছয়মাস পর আসলাম ছাড়া পেয়ে একদিন তাদের বাসায় এসে টাকা চাইল।
টোপর আপ্যায়ন করিয়ে বলল, আপনার ঠিকানা দিন, গিয়ে দিয়ে আসব।
আসলাম ঠিকানা দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, দুদিন অপেক্ষা করব; না পেলে এখানে নিতে আসব।
শাফিয়া বেগম জেল থেকে আসার পর টোপরের পরিবর্তন দেখে সন্দেহ করেছিলেন, সে জেলে খারাপ লোকের সংস্পর্শে খারাপ হয়ে গেছে। আজ আয়া যখন তার এক বন্ধু এসেছে বলে নাস্তার কথা বলল, তখন তার হাতে নাস্তা পাঠিয়ে দিয়ে কেমন বন্ধু দেখার জন্য ড্রইংরুমের দরজার পর্দা ফাঁক করে তাদের কথাবার্তা শুনে সন্দেহটা আরো দৃঢ় হল। বন্ধুটা চলে যাওয়ার পর ভিতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটা কে?
আমার বন্ধু।
কেন এসেছিল?
ওর কাছে একবার কিছু টাকা নিয়েছিলাম, চাইতে এসেছিল।
কত টাকা?
আসলাম হিসাব দিয়েছিল দুহাজার। টোপর বেশি করে বলল, পাঁচ হাজার।
শাফিয়া বেগম অবাক হয়ে বললেন, এত টাকা কেন নিয়েছিলি? তুই তো ইচ্ছা মতো আমার কাছ থেকে টাকা নিস।
টোপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, অনেক আগে কিসের জন্য যেন নিয়েছিলাম। তুমি আজ টাকাটা দাও, ওকে দিয়ে আসতে হবে।
শাফিয়া বেগম রেগে উঠে বললেন, তুই যে পানির মতো টাকা খরচ করছিস, একটু চিন্তা করে দেখছিস, টাকাটা আসে কোথা থেকে? তোর বাবা দিন রাত পরিশ্রম করছে। আর তুই দরকারে অদরকারে ইচ্ছামতো খরচ করছিস। আমার কাছে যা ছিল, এতদিন তোকে দিয়েছি। আর নেই, দিতে পারব না। তোর বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিস। তোর ঐ বন্ধুকে দেখে ভালো বলে মনে হল না। তুইও যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিস।
টোপর মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, টাকাটা ওকে দুএক দিনের মধ্যে দিতে হবে। তুমি বাবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে দিও।
শাফিয়া বেগম আরো রেগে গিয়ে বললেন, আমি পারব না। তোর দরকার, তুই চেয়ে নিস। তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন।
টোপর চিন্তা করল, দুহাজার টাকা যেমন করে হোক জোগাড় করতেই হবে। তা না হলে আসলামের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। ছয় মাস হয়ে গেল জেল থেকে বেরিয়েছে, রাগে ও অভিমানে সাগরের সঙ্গে দেখা করেনি। ভাবল, ওর কাছ থেকে দু হাজার টাকা নিয়ে আসলামকে দিবে। সাগরকে দুএকমাস পরে ফেরৎ দেওয়ার কথা বলা যাবে। এই ভেবে সাগরের বাসায় যখন গিয়ে পৌঁছাল, তখন সে পার্টির ছেলেদের সঙ্গে বাসাতেই মিটিং করছিল। টোপরকে দেখতে পেয়ে ঈশারা করে বসতে বলল।
মিটিং শেষে সবাইকে বিদায় দিয়ে সাগর টোপরকে বলল, কি খবর? এতদিন পর। এলি যে? ভার্সিটিতে খোঁজ করেও তোকে পাওয়া যায় না। পড়াশোনা ছেড়ে দিলি নাকি?
টোপর বলল, হ্যাঁ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। তা তুইও তো কোন খোঁজ খবর নিসনি?
খোঁজ খবর যে নিই নি তা নয়। বললাম না, ভার্সিটিতে খোঁজ নিয়েছি। না পেয়ে তোদের বাসায় একজনকে পাঠিয়েছিলাম। তোর বাবা বললেন, তুই ভার্সিটি গেছিস। তা পড়াশোনা ছেড়ে দিলি কেন?
সে কথা পরে বলব। একটা দরকারে তোর কাছে এসেছি।
বল কি দরকার?
হাজার দুই টাকার খুব দরকার। কিছু দিনের মধ্যে দিয়ে দেব।
তোর বাবা বিরাট ব্যবসায়ী। আমার কাছে টাকা চাইছিস, কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না।
বাবার টাকা তো আমার টাকা না যে, ইচ্ছা মতো খরচ করব।
তা হলে আমার টাকা দিবি কোথা থেকে?
সে ম্যানেজ করে দেব। আজ কালের মধ্যে দরকার। তাই তোর কাছে এলাম। দিবি কিনা বল।
সাগর পার্টির একটা ছেলেকে টোপরের খোঁজ নিতে বলেছিল। সে কয়েক দিন ফলো করে টোপর হিরোইন ধরেছে জানতে পেরে সাগরকে জানায়। তাই টাকা চাওয়ার কারণ বুঝতে পেরে বলল, দেব, তবে কি দরকার না বললে দেব না।
একজন পাবে, সে খুব তাগিদ দিচ্ছে। তাকে দিতে হবে।
নিশ্চয় তাকেও কিছুদিন পর দিবি বলে নিয়েছিল? তাকে যখন দিতে পারিসনি, তখন আমাকে দিবি কি করে?
সাগর, মাত্র দুহাজার টাকার জন্য তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস?
হা করছি। কারণ তুই টাকাটা কখনো দিতে পারবি না। তবে টাকাটা কার কাছ থেকে কেন নিয়েছিলি বললে দিতে পারি।
তোকে আর দিতে হবে না বলে টোপর চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল।
আরে বস বস, যারা হিরোইনের নেশা করে তাদেরকে কেউ টাকা দেয় না।
টোপর চমকে উঠে বলল, তোকে একথা কে বলল?
যেই বলুক, কথাটা অস্বীকার করতে পারবি? পারবি না। তোর চেহারা, চোখ, মুখ তার প্রমাণ করছে। শোন, অন্য কোন কারণে যদি টাকা চাইতিস, তা হলে দুহাজার কেন, পাঁচ দশ হাজারও দিতে দ্বিধা করতাম না। কিন্তু হিরোইনের জন্য এক টাকাও দেব না। ছিঃ ছিঃ, তুই এই জঘন্য পথে পা বাড়ালি? জানিস না এর পরিণতি মৃত্যু? তোকে থানা থেকে ছাড়াইনি বলে তুই যে আমার উপর মনে কষ্ট পেয়েছিস এবং সেই কারণে জেলে দেখা করতে গেলেও দেখা করিসনি এবং জেল থেকে বেরিয়ে এতদিন আমার কাছে আসিসনি, তা আমি জানি। বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, সে সময় তোর বাবাকে বলেছিলাম, আমার পক্ষে এক লাখ টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। আমি পঁচিশ হাজার দিচ্ছি, বাকিটা আপনি ম্যানেজ করুন। তোর বাবা বললেন, তোমার জন্যই আমার ছেলের এই পরিণতি। তারপর আরো অনেক কিছু বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিলেন। যাক সেসব কথা, এখন যা বলছি শোন, টাকাটা আমি তোর হাতে দেব না। আমাকে নিয়ে চল, আমি পাওনাদারকে দেব। অন্যান্য বন্ধুদের মধ্যে তোর সঙ্গে আমার গভীর সম্পর্ক। তাই বলছি তুই হিরোইনের নেশা ছেড়ে দে। এ ব্যাপারে আমি তোকে সাহায্য করব। তা তোর টিকলীর খবর কি?
টোপর টিকলীর নাম শুনে জ্বলে উঠল। বলল, ওর কথা বলবি না, ও আমার সঙ্গে বেঈমানী করেছে। ওর জন্যেই আমার আজ এই পরিণতি।
সাগর বলল, তোর মত বুন্ধু দুনিয়াতে আর দ্বিতীয় নেই। আরে তোকে তো কতবার বলেছি, আরো হাজার টিকলী রয়েছে। তাদের মধ্যে যাকে পছন্দ তাকে বেছে নে। তুই তো আমার কথা শুনলি না। আরে বাবা, যৌবন আর কয় দিনের? যতটা পার মজা লুটে নাও। যাক বাদ দে ওসব কথা। এখন হিরোইন ছাড়বি কিনা বল।
টোপর বলল, আমি ছাড়তে চাইলেও হিরোইন আমাকে ছাড়বে না। আমার এখন এমন অবস্থা একদিন হিরোইন না নিলে পাগল হয়ে যাব। তুই টাকাটা দিবি কিনা বল, নচেৎ আমাকে অন্য চেষ্টা করতে হবে।
সাগর দৃঢ় কণ্ঠে বলল, যা বললাম, তা যদি মেনে নিস, তা হলে দেব।
টোপর কোন কথা না বলে হন হন করে চলে গেল। ফেরার পথে চিন্তা করল, মা টাকা না দিলে রাহাজানী, ছিনতাই করে জোগাড় করবে, মায়ের অথবা বাবার টাকা চুরি করবে। বাস থেকে শান্তিনগরের মোড়ে নেমে রাস্তা পার হয়ে ফুটপাতে উঠেছে এমন সময় টিকলীর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।
টোপর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর এই ছয় মাসের মধ্যে টিকলী প্রতিমাসে ঢাকায় এসে তার সঙ্গে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। সাগর নামে টোপরের যে একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু আছে তা টিকলী জানত। টোপরই তার কথা প্রায় বলত। কিন্তু তার বাসার ঠিকানা বলেনি। তাই জিনিয়াকে বলেছিল, সাগরের বাসার ঠিকানা জানতে। জিনিয়া অনেক বুদ্ধি খরচ করে সাগরের পার্টির এক মেয়ের দ্বারা ঠিকানা জোগাড় করেছে। টিকলী পরশু এসে কাল তার কাছ থেকে ঠিকানা এনেছে। আজ সাগরের কাছে টোপরের খোঁজ নেওয়ার জন্য যাচ্ছিল। নিউ বেইলী রোডের মাথায় দেখা হয়ে গেল।
কয়েক সেকেণ্ড কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। এক দৃষ্ট্রে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। এক সময় টিকলীর চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। তাই দেখে টোপর পাশ কেটে দ্রুত চলে যেতে লাগল। টিকলী চোখ মুছে তাকে অনুসরণ করে বলল, টোপর দাঁড়াও কথা আছে, যেওনা বলছি। তবু টোপরকে চলে যেতে দেখে আরো দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে বলল, প্লীজ টোপর দাঁড়াও, একটা কথা অন্তত শুনে যাও।
টোপর দাঁড়াল না, বাঁ দিকের গলিতে ঢুকে দৌড়ে পালাতে লাগল।
টিকলী গলির মুখে এসে তাকে দৌড়াতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
রাণু নামে তাদেরই মহল্লার একটা জানালোনা মেয়ে স্কুলে যাচ্ছিল। সে ক্লাস এইটে। পড়ে। টিকলীকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলতে দেখে বলল, কি হয়েছে আপা?
টিকলী তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বলল, না কিছু হয়নি, তুমি যাও। তারপর রাস্তা পার হয়ে বাস স্ট্যাণ্ডে এল।
রানু বেশ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, টিকলী আপার মতো মেয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিল কেন? কারণটা বুঝতে না পেরে স্কুলের পথে পা বাড়াল।
সাগরের বাসা যাত্রাবাড়ি। টিকলী বাস থেকে নেমে কিছুটা এসে একটা ভদ্র ও সুন্দর যুবককে ঠিকানা দেখিয়ে বলল, বাসাটা কোনখানে বলতে পারেন?
সাগর একজন পর্দানশীল মেয়ের হাতে নিজের নাম ঠিকানা দেখে খুব অবাক হল। বলল, এটা আমাদের বাসার ঠিকানা, আমিই সাগর। কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না।
টিকলী সালাম দিয়ে বলল, আমি টিকলী। টোপরের কাছে নিশ্চয় আমার কথা শুনেছেন?
সাগর টোপরের কাছে টিকলীর রূপের কথা শুনেছে, কখনো দেখেনি। মনে মনে তারিফ করে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, হ্যাঁ শুনেছি। আসুন কাছেই আমাদের বাসা।
যেতে যেতে টিকলী বলল, টোপরের কাছে আপনার কথা অনেক শুনেছি।
সাগর তাকে বাসায় নিয়ে এসে ড্রইংরুমে বসতে বলে ভিতরে গেল। একটু পরে ফিরে এস বলল, আপনি কেন এসছেন বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। টোপর আপনাকে আমার সম্বন্ধে তালো মন্দ যাই বলুক না কেন, একটা কথা বিশ্বাস করুন, আমি টোপরের কখনো খারাপ কিছু চিন্তা করিনি। বরং তার ভালোর চিন্তাই সব সময় করেছি। আমার পার্টির সঙ্গে সে জড়িত ছিল ঠিক কথা; কিন্তু কোনো দিন তাকে কোনো বিপদের মধ্যে জড়াইনি। ঐদিন পিস্তলটা ওকে আমিই দিয়েছিলাম আত্মরক্ষা করার জন্য। এভাবে যে দুর্ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনা করিনি। অবশ্য এজন্য আমি খুবই দুঃখিত।
টিকলী জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাদের সব কথা জানেন?
এমন সময় বুয়া চা-নাস্তা নিয়ে এলে সাগর বলল, বলছি। আগে নাস্তা খেয়ে নিন।
টিকলী বলল, মাফ করুন সাগর ভাই, এখন আমার পেটে কিছু যাবে না। অন্য। দিন এসে খাব। প্লীজ, কিছু মনে করবেন না।
সাগর বুয়াকে বলল, এগুলো নিয়ে যাও। বুয়া চলে যাওয়ার পর বলল, আপনাদের সব কথা আমি জানি। ও রাজশাহীতে গিয়েছিল আপনাকে বিয়ে করার জন্য। আপনি ফিরিয়ে দিয়ে খুব ভুল করেছেন। ভার্সিটির ঘটনাটা তেমন কিছু না। ওর এই পরিণতির জন্য আপনিই দায়ী। আপনাকে ও ভীষণ ভালবাসে। তাই আপনি ফিরিয়ে দিতে মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছে। সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে হিরোইনে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
টিকলী চমকে উঠে ভয়ার্ত স্বরে বলল, কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ, যা বলছি সত্য। ব্যাপারটা জেনে আমিও খুব মর্মাহত। কিছুক্ষন আগে আমার কাছে দুহাজার টাকা চাইতে এসেছিল, হিরোইন খাওয়ার বিল শোধ করার জন্য। আমি দিইনি। বলেছি হিরোইন ছেড়ে দিলে দুহাজার কেন পাঁচ দশ হাজার টাকা তোকে দেব। তাই রাগ করে চলে গেল। তাকে ভালো হওয়ার জন্য অনেক বুঝিছি; কিন্তু কোন কাজ হয়নি।
টিকলী ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যে সামলে নিয়ে বলল, আপনি ওর অন্তরঙ্গ বন্ধু, আপনি ওকে ঐ জঘন্য নেশা থেকে বাঁচান। আর আমাকে বলে দিন আমি কি করব। ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না। ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি সত্য। তারপর কেন ফিরিয়ে দিয়েছে সে কথা বলে বলল, এবার আপনিই বিচার করুন, আমার অন্যায় কতটা। ও বড় জেদী। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেমন কোনো কাজ করে না; তেমনি কারো ভাল কথাও শুনতে চায় না।
সাগর বলল, ওর এই স্বাভাবের কথা আমি জানি। আমি ওর এই জঘন্য নেশা ছাড়াতে পারব কিনা জানি না, তবে আমার বিশ্বাস, আপনিই একমাত্র ওকে ঐ পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন।
উপায়টা বলে দিন।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনারা বিয়ে করে ফেলুন।
টিকলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেশ, তাই করব। আমি কয়েক দিনের মধ্যে রাজশাহী চলে যাচ্ছি। সেখানে ওকে নিয়ে আপনিও আসুন।
সাগর বল, ঠিক আছে, তাই হবে। তবে এর মধ্যে টোপরকে আপনি কথাটা জানান। কি করে জানাব? ওকে পাওয়াই যায় না। এখানে আসার সময় বেলী রোডের মুখে হঠাৎ দেখা। কিছু বলার আগে ছুটে পালিয়ে গেল। অনেক কিছু বলেও ফেরাতে পারলাম না।
তবু যেমন করে হোক দেখা করে কথাটা ওকে বলুন। জেল থেকে বেরিয়েছে। ছমাস হল। একবারও আমার কাছে আসেনি। আজ এসেছিল টাকার জন্য।
আপনি একটু কষ্ট করে ওকে কথাটা জানিয়ে রাজশাহী নিয়ে আসুন। আমিও যাওয়ার আগে দেখা করে কথাটা জানাবার চেষ্টা করব। তারপর বিদায় নিয়ে ফিরে এল।
ঐদিন টোপর সাগরের কাছে টাকা না পেয়ে আসলামের সঙ্গে দেখা করে বলল, আপনি আর আমাদের বাসায় যাবেন না। দুচার দিনের মধ্যে টাকাটা পেয়ে যাবেন।
আসলাম বলল, ঠিক আছে, কিন্তু এর মধ্যে না পেলে বাসায় যেতে বাধ্য হব।
তার আগেই পেয়ে যাবেন বলে টোপর সেখান থেকৈ ফেরার পথে মৌচাক মার্কেট থেকে একটা বড় চাকু ও একটা খেলনা পিস্তল কিনল। বাসায় এসে চিন্তা করল, মা যদি টাকা না দেয় তা হলে কাল থেকে রাহাজানী করবে।
আজ সকালে নাস্তার টেবিলে শাফিয়া বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি তো শুধু ব্যবসা নিয়ে থাক। এদিকে টোপর ঘুম থেকে সকাল নয়টার সময় উঠে নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাত বারটার দিকে। পড়াশোনাও করে না। কারও সঙ্গে কথাও। বলে না। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকে। ওর দিকে তোমার লক্ষ্য করা উচিত।
কাহহার সাহেব তখন কিছু না বলে অফিসে চলে গেলেন।
রাতে খাওয়ার পর টোপরকে ডেকে পাঠালেন।
টোপর এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সেখানে শাফিয়া বেগমও ছিলেন। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন? বস।
টোপর বসার পর কাহহার সাহেব বললেন, তুই কি আর ভার্সিটি যাসনি?
টোপর চুপ করে রইল।
কি হল, উত্তর দিচ্ছিস না কেন?
না।
কেন?
আমি আর পড়াশোনা করব না।
কারণটা জানতে পারি?
ভালো লাগে না।
কি করবি তা হলে?
টোপর কিছু না বলে চুপ করে রইল।
কাহহার সাহেব এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললন, শত্রুর মেয়ের জন্য নিজের উজ্জল ভবিষ্যৎ নষ্ট করিস না। বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা না করে মন দিয়ে পড়াশোনা করে মাস্টার্স শেষ কর। আরো উচ্চ ডিগ্রী নেওয়ার জন্য তোকে তো ফরেনে পাঠাব বলেছি। আর হাত খরচের জন্য মাসে যা পাস তাই দিয়ে চল। অযথা বন্ধুদের সঙ্গে মিশে টাকা নষ্ট করিস না। সন্ধ্যের পর পর বাসায় ফিরবি। আর তোর মাকে যে দুহাজার টাকার কথা বলেছিস, তা এখন পাবি না। আমার কথা মতো চললে মাসখানেক পরে পাবি। যদি না চলিস, তা হলে ঐ টাকাতো পাবিই না, উপরন্তু হাত খরচের টাকাও পাবি না। এবার তুই যেতে পারিস।
কিন্তু বাবা, দুহাজার টাকাটা যে আমার ইমিডিয়েট দরকার।
তোর মায়ের কাছে সে কথা শুনেছি। বন্ধুর কাছে এক মাস সময় চেয়ে নে।
টাকাটা অনেক আগে নিয়েছি। সে আর এক মাস দেরি করবে না। দুএকদিনের মধ্যে দিতেই হবে।
তোর কোন কথাই শুনতে চাই না। যা যা বললাম তাই কর।
টাকাটা এখন না দিলে পরিণামের জন্য তোমরাই দায়ী হবে।
কাহহার সাহেব রেগে উঠে বললেন, কি? তোর এতবড় সাহস, আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস? চলে যা এখান থেকে, এক পয়সায়ও দেব না। দেখি তুই কি করিস।
কাজটা তুমি ভালো করলে না বাবা। বলে টোপর নিজের রুমে চলে এল। সারারাত ঘুমাতে পারল না। সাগরের কথা, টিকলীর কথা চিন্তা করে কাটাল। মায়ের উপরও খুব অভিমান হল। নিজের মা হলে এরকম করতে পারত না।
পরের দিন টোপর আসলামের কাছে গয়ে বলল, আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব। আপনারা যা করেন আমিও তাই করব।
আসলামের বাড়ি পটুয়াখালি। হলে থেকে ভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স করার সময় একটা মেয়ে সঙ্গে মন দেওয়া নেওয়া হয়। মাস্টার্স করার সময় মেয়েটার আমেরিকা প্রবাসী এক আত্মিয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। সেই থেকে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে হিরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। তার বন্ধুরাও শিক্ষিত বেকার। অনেক দিন চাকরির চেষ্টা করেও পায়নি। তাই হাইজ্যাক, রাহাজানী ও চাদাবাজী করে দিন কাটায়। ওরা চারবন্ধু কমলাপুরে একটা মেসে থাকে। খুন খারাপী না করলেও একবার চাঁদাবাজী করতে গিয়ে মারামারি করে। তাতে আসলামের পিস্তলের গুলিতে ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার আহত হন। আর আসলাম ধরা পড়ে যায়। এ্যাটেম টু মার্ডারের কেসে আসলামের দুবছরের জেল হয়। ছাড়া পাওয়ার নয় মাস আগে জেলে টোপরের সঙ্গে পরিচয় হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আসলাম পুরোনো বন্ধুদের দলে ভিড়েছে।
টোপরের কথা শুনে আসলাম বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় দিয়ে বলল, আজ থেকে আমাদের দলে আরো একজন বাড়ল। তারপর বলল, আমাদের দলে থাকতে হলে ওসব আপনি টাপনি বলা যাবে না। তুই তোকারী না হলে বন্ধু কিসের? তা আমার টাকার ব্যবস্থা কি করলি?
টোপর বলল, টাকা তুই সময় মতো পেয়ে যাবি। শোন, আমি সারাদিন তোদের সঙ্গে থাকলেও কয়েকটা দিন সন্ধ্যের পর বাসায় চলে যাব। তারপর এখানেই থাকব।
আসলাম বলল, তোর যা মর্জি। তবে টাকাটা যেন সময় মত পাই।
টোপর বলল, বললাম তো পাবি।
সেদিন থেকে টোপর মাকে ভার্সিটি যাওয়ার কথা বলে তাদের সঙ্গে সারাদিন সন্ত্রাসী করে বেড়ায়। আর সন্ধ্যের পর বাসায় এসে পড়াশোনা করার অভিনয় করতে লাগল। মাঝে মধ্যে বিকেলেও ফিরে এসে বই নিয়ে বসত।
শাফিয়া বেগম ছেলের মতিগতি ভালোর দিকে দেখে খুশি হলেন। তবু একদিন জিজ্ঞেস করলেন, ভার্সিটিতে সারাদিন কি করিস?
টোপর বলল, পড়াশোনার অনেক ক্ষতি হয়েছে। তাই লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করি।
শাফিয়া বেগম ছেলের মতি গতির কথা স্বামীকে একদিন জানালেন।
কাহহার সাহেব মনে মনে খুশি হয়ে বললেন, হাজার হোক আমারই রক্ত তো। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটু নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আরকি?
টোপর বাসায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষন ছোট ভাই বোনের পড়াশোনার খবর নিতে লাগল। মায়ের কাছে দশ বিশ টাকার আবদার করে। শাফিয়া বেগম খুশি হয়ে বলেন, দশ বিশ টাকা আবার টাকা? তারপর দুএকশো টাকা দিয়ে বলেন, বুঝে সুঝে খরচ করবি।
টোপরের প্ল্যান মা-বাবার মন জয় করে আলমারীর চাবির খোঁজ করা। সে জানে মায়ের রুমে স্টীলের আলমারীর সিন্দুকের মধ্যে বাবা টাকা রাখে। আর তার চাবি মায়ের কাছে থাকে। চার-পাঁচ দিনের মাথায় সুযোগ পেয়ে গেল। সেদিন রাতে পাশের বাড়ির ছেলের বৌভাত। টোপরদের সবাইয়ের দাওয়াত। কাজের মেয়ে ছাড়া সবাই পাশের বাড়িতে গেছে। টোপরও গিয়েছিল। সে না খেয়ে ফিরে এসে মায়ের ঘরে ঢুকে চাবি খুঁজতে লাগল।
শাফিয়া বেগম চাবির গোছা সব সময় আঁচলে বেঁধে রাখেন। আজ বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার জন্য আলমারী খুলে পছন্দ মতো শাড়ী ব্লাউজ ও গহনা বার করে পরে গেছেন। যাওয়ার সময় তাড়াহুড়ো করে চাবির গোছা নিতে ভুলে গেছেন। আলমারীতেই লাগান রয়ে গেছে।
টোপর চাবি খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ আলমারীর দিকে নজর পড়তে মুখে হাসি ফুটে উঠল। তারপর আলমারীর সিন্দুক খুলে যা টাকা ছিল সব বার করে বাবার একটা লুংগীতে বাঁধল। তারপর আলমারী বন্ধ করে চাবিটা নিয়ে নিজের রুমে এসে লুংগী সহ টাকাগুলো একটা কাগজে মুড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কাজের মেয়ে দুলারীর সামনে পড়ে গেল।
দুলারী বলল, আপনি বিয়ে বাড়ীতে যান নি?
টোপর বলল, গিয়েছিলাম, তারপর কাগজের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, প্রেজেন্টেশানটা নিয়ে যাওয়া হয়নি, নিতে এসেছিলাম। কথা শেষ করে বেরিয়ে এল। রাস্তায় এসে একটা স্কুটার নিয়ে ফকিরা পুলে আল হেলাল হোটেলে সিট নিল। তারপর দুহাজার টাকা নিয়ে আসলামের মেসে এসে টাকাটা দিয়ে বলল, আমার কথা আমি রেখেছি।
আসলাম বলল, আজ হঠাৎ টাকাটা পেলি কোথায়?
টোপর বলল, কাল সকালে এসে বলব, এখন আমাকে বাসায় যেতে হবে। কথা শেষ করে সেখান থেকে হোটেলে ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া করল। তারপর দরজা জানালা লাগিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে টাকাগুলো গুনে দেখল। এক লাখ আঠাশ হাজার। টাকাগুলো সব পাঁচ শো টাকার নোট। ভাবল, ঢাকায় থাকা ঠিক হবে না। সকালেই চিটাগাং চলে যাবে। ভয়ে সারা রাত ভালো ঘুম হল না। ভোরে উঠে কমলাপুরে এসে এস আলম লাক্সারী কোচের ফাস্ট ট্রিপে চট্টগ্রাম রওয়ানা দিল।
শাফিয়া বেগম ছেলে মেয়ে নিয়ে বিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় বারটার সময় ফিরলেন। জামা কাপড় ও গহনা খুলে আলমারীতে তোলার সময় চাবি খুঁজে পেলেন না। হঠাৎ মনে পড়ল, চাবির গোছা ভুলে আলমারীতেই লাগান রয়ে গিয়েছিল। সেখানে নেই দেখে বালিশের তলায়, গদীর নিচে, শোকেসের মাথায় ও অন্যান্য সবখানে খোঁজ করে না পেয়ে দুলারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এ ঘরে এসেছিলি?
দুলারী বলল, না বেগম সাহেব আসিনি। আপনি না ডাকলে তো এঘরে কখনো আসিনি। ঘন্টাখানেক আগে বড় ভাইজান এসেছিলেন। তিনি হয়তো এঘরে এসে থাকবেন। কেন বেগম সাহেব কি হয়েছে?
শাফিয়া বেগম বললেন, আলমারীর চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। ঠিক আছে তুই যা। ছেলে মেয়েদের ঘুমাতে যেতে বলে চিন্তা করতে লাগলেন, চাবির গোছা গেল কোথায়? টোপরই বা বিয়ে বাড়ী থেকে বাসায় এসেছিল কেন?
কাহহার সাহেব পরিচিতি একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তাই কিছুক্ষণ পরে আসছি বলে স্ত্রীকে ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে যেতে বলেছিলেন। প্রায় সাড়ে বারটার সময় বাসায় ফিরে স্ত্রীকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখে বললেন, কি ব্যাপার, কি ভাবছ?
শাফিয়া বেগম বললেন, ভুলে চাবির গোছা আলমারীতে লাগিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে পাচ্ছি না। আলমারীতেও চাবি দেওয়া।
কাহহার সাহেব বললেন, অন্য কোথাও রেখেছ হয় তো, ভালো করে খুঁজে দেখ।
সব জায়গায় খুঁজেছি, পাইনি।
কাহহার সাহেব কপাল কুঁচকে বললেন, দুলারী এঘরে আসেনি তো?
ওদের সে সাহস হবে না, তবু ডেকে জিজ্ঞেস করেছি। বলল, টোপর নাকি বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিল, কখন এসেছিল দেখেনি। বেরিয়ে যাওয়ার সময় দেখেছে।
কাহহার সাহেব চিন্তিত মুখে বললেন, সে আলমারী খুলে টাকা নেয়নি তো? ও ফিরেছে কিনা দেখেছ?
না বলে শাফিয়া বেগম নিজেই টোপরের রুমে গিয়ে ফিরে এসে বললেন, মা এখনো ফেরেনি।
কাহহার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, সে আর ফিরবে না।
কি বলছ তুমি?
হ্যাঁ, যা বলছি এখন না বুঝতে পারলেও পরে পারবে।
তুমি কি বলতে চাচ্ছ, টোপর টাকা নিয়ে আলমারী বন্ধ করে চাবি নিয়ে পালিয়ে গেছে?
হ্যাঁ তাই। তারপর চিৎকার করে বললেন, শুনে রাখ টোপরের মা, আমার অনুমান যদি সত্য হয়, তা হলে ওকে আমি আস্ত রাখব না।
অত জোরে কথা বলছ কেন? আশে পাশের লোকজন শুনলে কি ভাববে। উত্তেজিত না হয়ে আগে আলমারী খোলার ব্যবস্থা কর।
চাবি ছাড়া আলমারী খোলা গেলেও সিন্দুক তো আর ভোলা যাবে না। আচ্ছা সব চাবির তো দুসেট করে ছিল। আর এক সেট কোথায়?
আলমারীর ভিতরের ড্রয়ারে।
তুমি তো আচ্ছা বোকা। ডবল চাবি থাকে, একটা হারিয়ে গেলে অন্যটা কাজে লাগাবার জন্য। অন্য কোথাও রাখলে এই অবস্থায় পড়তে হত না।
তোমার কথা ঠিক, তবে অন্যে সে কথা জেনে গেলে কি হত ভেবে দেখ।
তাও ঠিক বলে কাহহার সাহেব পায়চারী করতে লাগলেন।
শাফিয়া বেগম বললেন, এখন কাপড় চোপড় পাল্টে ঘুমাও। কাল সকালে বাজার থেকে চাবি সারানওয়ালাকে ডেকে এনো।
পরের দিন বেলা নয়টার দিকে চাবি সারানওয়ালা এনে আলমারী খুলিয়ে বিদায়। দিলেন।
শাফিয়া বেগম ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে সিন্দুক খুলে দেখলেন, একটা টাকাও নেই।
কাহহার সাহেব দেখে মাথায় হ্রাত দিয়ে বসে পড়লেন। তারপর টোপর তোকে আমি কোনো দিন ক্ষমা করব না বলে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লেন।
শাফিয়া বেগম আগেই চিন্তা করেছিলেন, টোপর যদি টাকা নিয়ে যায়, তা হলে তার বাবা কি করতে না কি করে বসে। এখন অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখে দুলারীকে ডেকে মাথায় পানি ঢাকার ব্যবস্থা করলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর কাহহার সাহেবের জ্ঞান ফিরল।
শাফিয়া বেগম দুলারীকে বালতি বদনা নিয়ে চলে যেতে বলে মাথা মুছিয়ে দেওয়ার সময় বললেন, বেশি দুশ্চিন্তা করো না। নিজের ছেলে নিয়েছে। ওকে ফরেনে পাঠালে তো এর চেয়ে বেশি টাকা লাগত।
কাহহার সাহেব কিছু বললেন না। চুপচাপ নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে গেলেন।
কাহহার সাহেবের ছোট ছেলে শাহিনের সবকিছু বোঝার মতো বয়স হয়েছে। ভাইয়া যে, আলমারী থেকে বাবার অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে তা বুঝতে পারল। তাই মা-বাবার মন খারাপ দেখেও কোন কিছু জিজ্ঞেস করল না।
আর নিশাত ছেলে মানুষ বলে এসব কথা বুঝতে পারল না।
কয়েক দিন পর শাহিন মাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা ভাইয়ার খোঁজ করেনি?
শাফিয়া বেগম বললেন, তোর বাবা পুলিশ লাগিয়ে খুঁজে বার করতে চেয়েছিল। আমি করতে দিইনি। থানা পুলিশ করলে অনেক টাকা লাগবে, তা ছাড়া আমাদের মান সম্মানের হানি হবে। এইসব বলে বুঝিয়েছি।
শাহীন বলল, জান মা, ভাইয়া আগে কত ভালো ছিল। আমাদেরকে কত আদর করত। জেল থেকে ফিরে ভাইয়া যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল।
শাফিয়া বেগম বললেন, তোর ভাইয়া খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে গেছে। তুই কিন্তু কোন খারাপ ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবি না। আর তোর ভাইয়ার কথা কারো সঙ্গে আলাপ করবি না। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি, সে আমেরিকায় পড়তে গেছে।
শাহিন বলল, তাই হবে মা।
এদিকে টিকলীর দুমাস পরে ফাষ্ট ইয়ারের পরীক্ষা। তাই রাজশাহী ফিরে যাওয়ার জন্য মনে তাগিদ অনুভব করলেও টোপরের সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারছে না। কয়েক দিন রাস্তার মোড়ে সকাল থেকে বেলা দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তার দেখা পেল না। তিন দিনের দিন টোপরের ছোট ভাই শাহিনকে স্কুলে যেতে দেখে ডেকে জিজ্ঞেস করল, তোমার ভাইয়া বাসায় আছে? শাহিন জানে ওদের সঙ্গে তাদের মনোমালিন্য। আরো জানে প্রায় বছর খানেক আগে ভাইয়া টিকলীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল বলে বাবা রাগারাগি করেছিল। তাই মায়ের শেখান কথা বলল, ভাইয়া দুদিন হল আমেরিকায় পড়তে চলে গেছে। তারপর সে হাঁটতে শুরু করল।
কথাটা শুনে টিকলী অবাক হলেও বিশ্বাস করতে পারল না। তাকে চলে যেতে। দেখে দ্রুত হেঁটে এসে তার পথ আগলে বলল, কথাটা কি সত্য বললে?
শুধু শুধু মিথ্যা বলব কেন? তারপর পাশ কাটিয়ে শাহিন চলে গেল।
টিকলী তবু বিশ্বাস করতে পারল না। চিন্তা করল, যদি সত্যি হয়, তা হলে সাগর ভাই নিশ্চয় জানবে। তার সঙ্গে দেখা করার মনস্থ করে একটা স্কুটার নিয়ে রওয়ানা দিল। ফকিরাপুলে এসে ট্রাফিক জ্যামে পড়ল।
স্কুটার ড্রাইভার বলল, এই জ্যাম ছাড়তে এক ঘন্টা লাগবে। রাজারবাগ দিয়ে ঘুরে যাই আপা?
টিকলী বলল তাই চল।
রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি পার হয়ে এসেছে, এমন সময় সাগর ভাইকে একটা ছেলের সঙ্গে রিকশায় করে সামনের দিক থেকে আসতে দেখে ড্রাইভারকে বলল, স্কুটার ঘুরিয়ে নাও, কমলাপুর যাব না।
ড্রাইভার স্কুটার ঘুরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই যাবেন?
টিকলী হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ রিকশাটার পাশে চল। স্কুটার রিকশার পাশে এলে টিকলী বলল, সাগর ভাই, আপনার কাছে যাচ্ছিলাম।
সাগর টিকলীকে চিনতে পেরে রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল।
টিকলীও স্কুটার ড্রাইভারকে সাইড নিয়ে দাঁড়াতে বলল।
সাগর সঙ্গের ছেলেটাকে বলল, একটু বস, আসছি। তারপর টিকলীর কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, কি ব্যাপার?
টিকলীও স্কুটার থেকে নেমে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আপনি টোপরের কোনো। খোঁজ পেয়েছেন?
না, তবে কয়েক দিনের মধ্যে পেয়ে যাব। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি?
না, আজ আসার সময় তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। টোপর বাসায় আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে বলল, দুদিন আগে সে আমেরিকা চলে গেছে।
তাই নাকি? তা হলে তো ভালই হল। এবার মানুষ হয়ে যাবে।
কিন্তু কথাটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
কেন?
তা বলতে পারব না, এমনিই বিশ্বাস করতে পারছি না।
সাগর মৃদু হেসে বলল, অবিশ্বাস করার কি আছে, ওর তো যাওয়ারই কথা ছিল। আর সত্যি সত্যি যদি না গিয়ে থাকে, তবে আমি নিশ্চয় জানতে পারব। জানার পর আপনাকে চিঠি দিয়ে জানাব।
টিকলী ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, অনুগ্রহ করে ভালো মতো খোঁজ নেবেন। আমি আপনার চিঠির অপেক্ষায় থাকব।
সাগর বলল, আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব। আমার মনে হয়, আমেরিকায় গিয়ে থাকলে আপনাকে চিঠি দেবে।
আল্লাহ যেন তাই করেন বলে টিকলী বলল, আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি, মনে, কিছু নেবেন না।
সাগর বলল, কষ্ট আবার কি? বন্ধু হিসাবে আমারও কিছু কর্তব্য আছে। আর কিছু বলবেন?
না, এবার আসুন। বলে টিকলী সালাম বিনিময় করে স্কুটারে উঠে সিদ্ধেশ্বরী রোডে যেতে বলল।
বাসায় ফিরে এলে আলি বলল, সারাদিন কোথায় কোথায় যাস? তোকে তো বাসায় পাওয়াই যায় না। তার ধারনা টিকলী টোপরের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘুরে বেড়ায়, তাই কথাটা একটু রাগের সঙ্গে বলল।
টিকলী কিছু না বলে ছলছল চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
তাই দেখে আলি নরম সুরে বলল, তুই এখনো টোপরকে ভুলতে পারিস নি? টোপর হিরোইনের নেশা করে। টিকলী চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, তা আমিও জানি। কিন্তু কেন করে তুমি না জানলেও আমি জানি। আমার জন্যই আজ ওর এই পরিণতি। তারপর কান্না চাপতে চাপতে সেখান থেকে ছুটে চলে গেল।
বোনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আলির চোখেও পানি এস গেল। বিড় বিড় করে দোওয়া করল, আল্লাহ তোকে টোপরকে ভুলার তওফিক দিক। তোকে হেফাজত করুক।
পরের দিন রাজশাহী যাওয়ার জন্য আলি টিকলীকে কমলাপুর ট্রেনে তুলে দিতে এল। ট্রেন ছাড়ার আগে টিকলী বলল, শাহিনের কাছে শুনলাম, সে আমেরিকা চলে গেছে। কথাটা যদি ঠিক হয়, তা হলে শাহিনের কাছ থেকে তার ঠিকানাটা নিয়ে আমাকে জানাবে।
আলি বলল, ঠিক আছে জানাব।
প্রায় তিন ঘন্টা ডাঃ মাহাবুবা চেয়ারে হেলান দিয়ে নিজের আগের জীবনের স্মৃতিচারন করে চলেছেন। এমন সময় কারো ম্যাডাম ডাকে বাস্তবে ফিরে এলেন। তাকিয়ে ইয়াসমিনকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ঐ রুগী কেমন আছেন?
এখনো ঘুমাচ্ছেন।
আমি কোয়ার্টারে যাচ্ছি। ঘুম ভাঙ্গার পর চার্ট দেখে ঔষুধ খাওয়াবেন। কোন রকম অসুবিধা করলে আমাকে খবর দেবেন।
ইয়াসমিন জ্বি আচ্ছা বলে চলে গেল।
ডাঃ মাহবুবা বাসায় এসে ড্রেস চেঞ্জ করে আসরের নামায পড়লেন। তারপর বারান্দায় চেয়ারে বসে মাসিক মদিনা পত্রিকা পড়ার জন্য হাত বাড়ালেন। এমন সময় কাজের মেয়ে জোহরা চা-বিস্কুট নিয়ে এলে পত্রিকা রেখে দিলেন। তারপর দুটো বিস্কুট ও একগ্লাস পানি খাওয়ার পর চা খেয়ে পত্রিকাটা হাতে নিলেন। আরো দুতিনটে পত্রিকা ও দৈনিক পেপার রাখেন। মাসিক মদিনা তার খুব প্রিয়। এতে যেমন অতীত যুগের মুসলমানদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, তাঁদের উন্নত চরিত্রের কথা, মুসলিম মনীষীদের অমীয় বানী ও তাঁদের জীবন চরিতের সমালোচনা থাকে, তেমনি এমন কিছু প্রশ্ন উত্তর থাকে যা প্রত্যেক মুসলমানের জানা একান্ত জরুরী। পত্রিকা পড়ার জন্য খুললেন বটে, কিন্তু পড়তে পারলেন না। তখন তার মনের পাতায় আবার পূর্ব জীবনের কথা ভেসে উঠল।
টোপর আমেরিকা চলে গেছে শুনে টিকলী রাজশাহী চলে এসেছিল। তারপর দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর টোপরের চিঠির অপেক্ষা করছে। আর মাসে মাসে দুতিন খানা করে জিনিয়াকে ও সাগরকে চিঠি দিয়ে টোপরের আমেরিকায় ঠিকানা জানাতে বলেছে। চার-পাঁচ মাস পরপর ঢাকায় এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেছে। তারা কেউ টোপরের আমেরিকার ঠিকানা দিতে পারেনি। নিজেও কয়েকবার টোপরের ছোট ভাই শাহিনের সঙ্গে দেখা করে জানতে চেয়েছে। শাহিন জানে না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেছে। টিকলীর দৃঢ় ধারনা টোপর আমেরিকা যায়নি। সে দেশেই অন্য কোথাও আছে।
বোনের অবস্থা দেখে আলি তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য অনেক বুঝিয়েছে, টিকলী তাকে বলেছে, এ জীবনে তাকে ভুলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি আমাকে ওর ব্যাপার নিয়ে কিছু বলল না। আমি ওর জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব। তুমি শুধু আমাকে টোপরের ঠিকানা জোগাড় করে দাও। আমি আর কোনো দিন কোনো কিছু তোমার কাছে চাইব না।
প্রায় বছর তিনেক পর টিকলী একদিন ঢাকা নিউমার্কেটে বই কিনতে গিয়েছিল। ফেরার সময় গেটের বাইরে শাহিনের সঙ্গে দেখা, শাহিন তখন কলেজে পড়ে। সেও বই কিনতে গিয়েছিল।
শাহিন তাকে দেখে চিনতে পারল, বলল, কিছু বলবেন?
হ্যাঁ এদিকে এস। শাহিন এগিয়ে এলে বলল, আমাকে নিশ্চয় চিনতে পারছ?
শাহিন ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
একটা কথা জিজ্ঞেস করব সঠিক উত্তর দেবে?
শাহিন এখন বড় হয়েছে। ভালোমন্দ জ্ঞান হয়েছে। বলল, আপনি ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করবেন তো?
হ্যাঁ ঠিক বলেছ, তুমি ওর আমেরিকার ঠিকানাটা দাও তো।
শাহিন কিশোর বয়সে মায়ের কথা মত মিথ্যা বলেছিল। এখন তা পারল না, বলল, আপা, আমি আপনাদের সব কথা জানি। আপনি এখনো ভাইয়াকে ভুলতে পারেননি শুনে খুব দুঃখ হচ্ছে। আপনি ভাইয়াকে ভুলে যান আপা।
টিকলী খুব অবাক হয়ে বলল, আমি তোমার বড় বোনের মত। তুমি আমাকে একথা কেন বলছ বল তো?
শাহিন চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, প্রায় তিন বছর আগে আপনাকে যে কথা : বলেছিলাম, তা ঠিক নয়। ভাইয়াকে বাবা আমেরিকায় পাঠায়নি।
কি বললে আমেরিকা পাঠায়নি?
না আপা, সে সময় মা নিষেধ করেছিল বলে মিথ্যা বলেছিলাম। এখন আর কোনো কথা আপনার কাছে গোপন করব না। ভাইয়ার যে ছয় মাসের জেল হয়েছিল, তা নিশ্চয় শুনেছেন। জেলে কোনো কয়েদির পাল্লায় পড়ে হিরোইনের নেশায় ধরেছিল। ছাড়া পেয়ে মা বাবার কাছে দুহাজার টাকা চায়। না দিতে একরাতে আমরা সবাই পাশের বাসায় বিয়ে খেতে গিয়েছিলাম। সেই ফাঁকে ভাইয়া ষ্টীলের আলমারী থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
টিকলী কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ঠোঁট কামড়ে সামলাবার চেষ্টা করতে লাল।
তার অবস্থা দেখে শাহিনের চোখে আবার পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, যারা একবার হিরোইনের নেশা শুরু করে তারা মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ছাড়তে পারে না। বেশি দিন বাঁচেও না। ভাইয়া কি আর এত দিন বেঁচে আছে? আপনি তাকে ভুলে যান। আপা ভুলে যান। তারপর দ্রুত হেঁটে এসে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে যেতে বলল।
টিকলী স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল।
টিকলীও গাড়ি নিয়ে এসেছে ড্রাইভার বেশ বয়স্ক লোক। এতক্ষন মালিক কন্যাকে লক্ষ্য করছিল, তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে এসে বলল, বাসায় যাবেন না মা?
টিকলী তাড়াতাড়ি চোখ মুখ মুছে বলল, হ্যাঁ চাচা চলুন।
টিকলী বাসায় ফিরে এলে আলি বলল, কিরে এত দেরি করলি যে, তাড়াতাড়ী ফিরতে বলছিলাম না।
টিকলী জানে ভাইয়া জিনিয়াদের বাসায় যাবে। অন্য সময় হলে দুষ্টুমী করে বলত, বিয়ের আগে শ্বশুরবাড়ি যেতে তোমার লজ্জা করে না? আজ মন খারাপ থাকায় দুষ্টুমী করে বলল, সরি ভাইয়া, তারপর কান্না চেপে রাখতে না পেরে ছুটে ভিতরে চলে গেল।
আলি তার মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে, একটু আগে কেঁদেছে। আবার বেসামাল অবস্থায় চলে যেতে দেখে চিন্তা করল, তা হলে কি টোপরের কোনো খারাপ খবর পেয়েছে? এমনি দেরি হয়ে গেছে তাই ফিরে এসে জিজ্ঞেস করবে ভেবে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
টিভিতে রাত দশটার খবর সবাই এক সঙ্গে শোনে। আজ টিকলী নেই দেখে আলি তার রুমে গিয়ে দেখল, বালিশে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
ছোট বোনের জন্য আলির খুব মায়া হল। পাশে বসে মাথায় একটা হাত রেখে বলল, বিকেলে কান্না ভেজা মুখে বাসায় ফিরলি। এখন আবার কাঁদছিস, কি হয়েছে বল সাধ্যমত সাহায্য করব। টোপরের কি কোনো খবর পেয়েছিস?
টিকলী কান্না থামিয়ে উঠে বসে ভিজে গলায় বলল, টোপর আমেরিকায় যায়নি। তারপর শাহিনের কাছে যা শুনেছে সে সব বলে বলল, ও দেশের কোথাও না কোথাও আছে।
আলি বলল, এত ভেঙ্গে পড়িসনি বোন, সবর কর। জানিস না, আল্লাহ কোরআন পাকে সবর করতে বলেছেন। আমি তার অনেক বন্ধুবান্ধবদের কাছে খোঁজ করেছি। তারা কেউ তার খবর বলতে পারেনি। এমন কি আমেরিকা গেছে কিনা তাও বলতে পারেনি। তুই তো ডাক্তারী পড়িস, এটা নিশ্চয় জানিস, যারা হিরোইনের নেশা করে তারা বেশি দিন বাঁচে না। আমার মনে হয়, সে বেঁচে নেই। থাকলে এতদিনে নিশ্চয় খোঁজ পাওয়া যেত। তাকে তোর ভুলে যাওয়া উচিত।
ভাইয়া তুমি অমন কথা বলো না। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, আমার মন বলছে, সে বেঁচে আছে এবং দেশেই আছে। তুমি যাও ভাইয়া আমাকে একা থাকতে দাও।
আলি আর কিছু না বলে চলে এল।
এরপর আরো তিন বছর পার হয়ে গেল। টোপরের খোঁজ খবর নেই। ডাক্তারী পাশ করার পর এক বছর ইন্টার্নশিপ করে টিকলী রাজশাহী মেডিকেলে থেকে গেল।
হালিম সাহেব রিটায়ার্ড করেছেন, আলি মাষ্টার্স করে বাবার অফিসেই চাকরি পেয়েছে। জিনিয়ার সঙ্গে এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। টিকলীর জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। ভাইবোনের বিয়ে এক সঙ্গে হবে।
ইদানিং উচ্চ ধনী ঘরের এক ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সন্ধান পেয়ে হালিম সাহেব ফোন করে মেয়েকে বললেন, আমরা তোর জন্য ভালো পাত্র দেখেছি। তুই দুএক দিনের মধ্যে চলে আয়।
টিকলী বলল, আমি বিয়ে করব না তোমরা ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে দাও। তারপর সালাম বিনিময় করে ফোন ছেড়ে দিল।
হালিম সাহেব মেয়ের মতামত স্ত্রীকে ও ছেলেকে জানালেন।
আলি বলল, তুমি আম্মাকে নিয়ে যাও। খালা খালুর সঙ্গে পরামর্শ করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দেখ, যদি রাজি করাতে পারো।
মাজেদা বেগম বললেন, তুইও চল।
আলি নিশ্চিত, টিকলী টোপরকে ছাড়া বিয়ে করবে না। তাই বলল, অফিসে ছুটি দিবে কিনা ঠিক নেই, তোমরাই যাও।
হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম রাজশাহী গিয়ে মেয়েকে অনেক বোঝালেন। সাজেদা বেগমের বড় বোন ও দুলাভাই রাজি করাতে অনেক চেষ্টা করলেন; কিন্তু পারলেন না।
টিকলী তাদেরকে জানাল, আপনারা তো জানেন, টোপরকে আমি ছোটবেলা থেকে ভালবাসি। আমরা কবেই বিয়ে করে ফেলতাম। শুধু আম্মার কাছে ওয়াদা করেছিলাম বলে করিনি। তারপর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি আমার ওয়াদা রক্ষা করেছি। এবার তুমি তোমার ওয়াদা রক্ষা কর।
সাজেদা বেগম বললেন, সে তো আজ চার পাঁচ বছর নিখোঁজ শুনেছি, হিরোইনের নেশা করত। সে কি আর বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে নিশ্চয় তার খোঁজ পাওয়া যেত।
সে বেঁচে আছে কিনা তা আল্লাহ পাককে মালুম। বেঁচে থাক আর না থাক, আজীবন তার জন্য আমি অপেক্ষা করব। তোমরা যদি জোর করে কিছু করতে চাও, তা হলে তার পরিনতি ভালো হবে না। কথা শেষ করে তাদের কাছ থেকে টিকলী নিজের রুমে চলে গেল।
মাজেদা বেগম বললেন, জোর করে কিছু করা ঠিক হবে না তোমরা চেষ্টা চরিত্র করে টোপরের খোঁজ কর।
সাজেদা বেগম বললেন, কি বলছ বুবু তুমি? টোপর কি বেচে আছে যে, তার খোঁজ করব।
মাজেদা বেগম বললেন, বুঝতে পারছিস না কেন? ওদের সম্পর্ক ছোটবেলা থেকে। সারাজীবনে ও তাকে ভুলতে পারবে না। তাই বলছি, সে যে বেঁচে নেই, তার প্রমাণ ওকে জানাতে হবে। তা যদি পারিস, তা হলে হয়তো বিয়েতে রাজি হতে পারে।
মাজেদা বেগমের স্বামী রহমান সাহেব বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। বাল্যপ্রেম কেউ ভুলতে পারে না, তারপর ভাইরাকে বললেন, মাজেদা যা বলল, তা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
দুতিন দিন থেকে হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম ঢাকা ফিরে এলেন।
টিকলী একদিন পেপারে কক্সবাজারে একটা প্রাইভেট হাসপাতালের ডাক্তার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তী দেখে খালা খালুকে না বলে গোপনে কক্সবাজার চলে এল।
হাসপাতালের মালিক হামিদ সাহেব টিকলীর আচার-আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে সুপারিন্টেনডেন্ট পদে নিয়োগ করেন এবং দুতিন মাসের মধ্যে হাসপাতালের সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেন। একবছর হতে চলল টিকলী এখানে তার আসল নামে (ডাঃ মাহবুবা)। কাজ করছে। আজ পর্যন্ত মা-বাবা বা খালা খালুকে জানায়নি। তবে এখানে আসার মাস দুয়েক পর জিনিয়াকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, সে দেশেরই কোনো এক হাসপাতালে চাকরী করছে। মা-বাবা ও ভাইয়াকে আমার জন্য দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করবি। বলবি আমি ভাল আছি। তারা যেন আমার খোঁজ না করে। আমি মাঝে মাঝে চিঠি দেব। খামের উপর ঠিকানা না দিয়ে, চিঠিটা হাসপাতালের একজন অফিস স্টাফের হাতে দিয়ে ঢাকাতে পোষ্ট করে দিতে বলেছিল। অফিসের ডাকে তিনি ঢাকা গিয়েছিলেন।
যে দিন টিকলী কক্সবাজার রওয়ানা দেয়, সে দিন সন্ধ্যে পর্যন্ত বাসায় না আসায় মাজেদা বেগম স্বামীকে বললেন, তুমি মেডিক্যালে ফোন করে দেখ, টিকলী কেন এখনো আসছে না।
রহমান সাহেব ফোন করে জানতে পারলেন টিকলী আজ ডিউটিতে আসেনি।
সে কথা মাজেদা বেগম শুনে খুব চিন্তিত হলেন। বললেন, এখন কি হবে তা হলে।
রহমান সাহেবও খুব চিন্তিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কখন বাসা থেকে বেরিয়েছে?
তা জানি না। বেলা আটটা বেজে যাওয়ার পর নাস্তা খেতে আসছে না দেখে বুয়াকে বললাম, দেখতো টিকলী ঘরে কি করছে?
বুয়া বলল, আপাকে তো ফজরের নামাজ পড়ে সুটকেস হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। তারপর বলল, ঢাকা গেল কিনা ফোন করলে হত না?
আজ করার দরকার নেই। রাতটা দেখা যাক, না ফিরলে কাল করা যাবে।
পরের দিন বেলা নটার সময় মাজেদা বেগম ঢাকায় ফোন করে বললেন, টিকলী কি ওখানে গেছে।
সাজেদা বেগম বললেন, না তো। কেন তোমরা কি ওকে তেমন কিছু বলেছ?
সাজেদা বেগম বললেন না। কাল সকালে সুটকেস হাতে করে বেরিয়ে যেতে আমাদের কাজের বুয়া দেখেছে। আমরা মনে করেছি, ঢাকা গেছে।
সাজেদা বেগম বললেন, ওকি আসার কথা দুএকদিন আগে বলেছিল?
মাজেদা বেগম বললেন, না।
সাজেদা বেগম আতঙ্কিত স্বরে বললেন, তা হলে কোনো বিপদে পড়ে নি তো?
কি করে বলব? তোর দুলাভাই এখানকার সব ক্লিনিকে খোঁজ নিয়েছে তারা ওর বান্ধবীদের বাসায় খোঁজ নে। আমরাও এখানে ভালো করে খোঁজ নিচ্ছি।
ঠিক আছে, রাতে ফোন করে জানাব; এখন রাখি তাহলে?
রাখ বলে মাজেদা বেগম ফোন ছেড়ে দিলেন।
সাজেদা বেগম কথাটা ছেলে ও স্বামীকে জানিয়ে খোঁজ নিতে বললেন।
আলি বলল, তা নিচ্ছি; কিন্তু আমার মনে হয়, তোমরা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছ বলে কোনো হাসপাতালে চাকরি নিয়ে চলে গেছে।
সাজেদা বেগম বললেন, তোর যেমন কথা, কোথাও চাকরি নিয়ে গেলে আমাদেরকে নিশ্চয় জানাত। তুই ওর বান্ধবীদের বাসায় খোজঁ কর। না পেলে তোর মামাদের বাসায় যাবি। সেখানে অনেক দিন থেকে যাবে যাবে করছিল।
হালিম সাহেব ছেলেকে বললেন, তোমার মা যা বলল, তাই কর।
সব জায়গায় খোঁজ নিয়েও টিকলীকে পাওয়া গেল না। হালিম সাহেব বিজ্ঞপ্তী দিলেন,
মা টিকলী, তুমি যেখানেই থাক ফিরে এস। তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কিছু করব না। যদি কোথাও চাকরি নিয়ে নিয়ে থাক, অতি সত্বর পত্র দিয়ে জানাবে। আমরা তোমার জন্য খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
–তোমার মা ও বাবা
বিজ্ঞপ্তী দেওয়ার প্রায় দেড় মাস পর জিনিয়া টিকলীর চিঠি পেল মা-বাবাকে সে কথা জানিয়ে আলিকে অফিসে ফোন করে বলল, টিকলী আমাকে চিঠি দিয়েছে, তুমি তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় এস।
আলি বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে জিনিয়াদের বাসায় এল।
সালাম ও কুশল বিনিময় করে জিনিয়া চিঠিটা আলির হাতে দিল।
আলি পড়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর ঠিকানা দেয়নি দেখে বলল, খামের উপর জি.পি.ওর সীল। মনে হয়, ঢাকায় অথবা কাছাকাছি কোন ক্লিনিকে আছে।
জিনিয়া বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু এমনও তো হতে পারে, দুরে কোনো মফস্বলের হাসপাতালে বা ক্লিনিকে আছে। ঠিকানা জেনে যাব বলে কারো হাতে ঢাকায় পোষ্ট করতে দিয়েছে।
তাও হতে পারে, তবু তুমি ঢাকার আশপাশের ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নাও।
খোঁজ নিয়েছি, আবার না হয় নেব। এখন যাই, আম্মা-আব্বাকে জানাতে হবে। তরপর বিদায় নিয়ে আলি বাসায় এসে তাদেরকে জানাল। হালিম সাহেব ও সাজেদা বেগম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন।
ঠিকানা দেয়নি শুনে সাজেদা বেগম চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ছেলেকে বললেন, তুই আবার সব ক্লিনিকে খোঁজ কর।
আলি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারপর কয়েক দিন ধরে খোঁজ করেও পেল না। প্রায় একবছর খোঁজ করেও যখন পাওয়া গেল না তখন জিনিয়ার সঙ্গে আলির বিয়ে হয়ে গেল। এর মধ্যে টিকলী মা-বাবাকে দুটো চিঠি দিয়েছে। কিন্তু ঠিকানা দেয়নি।
বিয়ের মাসখানেক পর আলি জিনিয়াকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে এল। এখানকার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারল, সমুদ্র। সৈকতের কাছে রহিম-আফরোজা নামে নতুন একটা হাসপাতাল হয়েছে।
একদিন সকালে নাস্তা খেয়ে সেখানে গিয়ে টিকলীর দেখা পেল।
সালাম ও কুশল বিনিময় করে টিকলী তাদেরকে বসতে বলল। তারপর বলল, তোমরা নিশ্চয় বিয়ে করেছ?
আলি বলল, আমি চেয়েছিলাম তোকে খুঁজে বের তারপর বিয়ে করব। জিনিয়ার। মা-বাবা বললেন, তোমার মা-বাবা জিনিয়াকে কাছে পেলে টিকলীর শোক কিছুটা অন্ততঃ ভুলতে পারবেন। একরকম বাধ্য হয়ে মাসখানেক আগে করতে হল। তা তুই আত্মগোপন করলি কেন? পেপারে আব্বা যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, পড়িসনি?
পড়ার পর জিনিয়াকে তো দুটো চিঠি দিয়েছি। তারপরও আব্বা-আম্মাকে দুটো দিয়েছি।
কিন্তু ঠিকানা দিসনি কেন? আম্মা তোর জন্য কত কাঁদে জানিস? টিকলীর চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে বলল, ওসব কথা থাক, এটা অফিস, এখানে ব্যক্তিগত ব্যাপারে বেশী সময় দিতে পারব না। তোমরা আমার কোয়ার্টার গিয়ে অপেক্ষা কর। আমি ঘন্টা খানেক পরে আসছি। তারপর একজন পিয়নকে ডেকে বলল, ইনাদেরকে আমার কোয়ার্টারে দিয়ে এস।
একঘন্টা পরে টিকলী কোয়াটারে এসে ভাইয়ার কাছ থেকে সে চলে আসার পর যা কিছু ঘটেছে সব শুনল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা ফিরবে কবে?
আলি বলল, এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছিলাম, কাল চলে যাব।
আজ দুপুরে ও রাতে তোমরা এখানে খাবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বিদায় নেওয়ার সময় আলি টিকলীর ফোন নাম্বার নিয়ে বলল, কয়েক দিনের জন্য তুইও আমাদের সঙ্গে চল।
টিকলী বলল, পুরো হাসপাতালের দায়-দায়দায়িত্ব আমার উপর। এখন থেকে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। আব্বা-আম্মাকে আমার ছালাম দিয়ে বললো, তারা যেন। আমাকে মাফ করে দেয়।
তুই কি সারাজীবন বিয়ে করবি না?
সেকথা আল্লাহপাক জানেন। তোমাকে তো অনেক আগেই বলেছি, টোপরের জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করব।
কিন্তু সে যদি মারা গিয়ে থাকে?
টিকলী চমকে উঠে ভাইয়া বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বলল, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রাগ করবে না বল?
না, বল কি জিজ্ঞেস করবি।
কোনো কারণে জিনিয়া যদি হারিয়ে যেত, তা হলে তুমি কি অপেক্ষা করতে না?
আলিও চমকে উঠে একবার জিনিয়ার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে কিছুক্ষন চুপ করে রইল। তারপর ভিজে গলায় বলল, হ্যাঁ করতাম। তোকে আর এ ব্যাপারে কোনো দিন কিছু জিজ্ঞেস করব না।
জিনিয়া টিকলীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
টিকলী চেখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, কাঁদছ কেন ভাবী? জীবন আর কয় দিনের। এ দেশের মানুষের গড় আয়ু চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। তার অর্ধেক তো পার হয়ে গেছে। বাকিটা রুগীদের সেবা করে কাটিয়ে দেব। তারপর তাদেরকে গাড়িতে তুলে দিল।
এর কয়েক দিন পর কে বা কারা আজ টোপরকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
এইসব চিন্তা করতে করতে কখন যে মাগরিবের আযান হয়ে গেছে ডাঃ মাহবুবা জানতে পারলেন না। বুয়া যখন এসে বলল, আপামনি আযান হয়ে গেছে, নামায পড়বেন না তখন হুশ হল। বললো, হ্যাঁ পড়ব।
নামাজ পড়া শেষ হয়েছে, এমন সময় নার্স ইয়াসমীন এসে বলল, ম্যাডাম, রুগীর ঘুম ভেঙ্গেছে। আমাকে হিরোইন দাও, নচেৎ এখান থেকে চলে যাব, বলে বেড থেকে নেমে পড়েছিলেন। আমরা দুতিন জন মিলে বেডের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে রেখে আপনাকে জানাতে এলাম।
ডাঃ মাহবুবা বললো, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে বোরখা পরে আসার সময় জিজ্ঞেস করলেন, ওঁকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?
ইয়াসমীন বলল, জ্বী
ডাঃ মাহবুবা এখানে মাদকে আসক্ত রুগীর সংখ্যাধিক্য দেখে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ সারওয়ার কে ঢাকা থেকে আনিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি কয়েক জন রুগীকে চিকিৎসা করে ভালোও করেছেন।
কেবিনের দরজার কাছে এসে ডাঃ মাহবুবা বললেন, আপনি ডাঃ সারওয়ারকে ডেকে নিয়ে আসুন। তারপর কেবিনে ঢুকে বেডের কাছে এগিয়ে এলেন।
টোপর তাকে চিনতে পারল না। কারণ ডাঃ মাহবুবার চোখ দুটো ছাড়া সারা শরীর ও মুখ বোরখা দিয়ে ঢাকা। জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
ডাঃ মাহবুবা বললেন, তা জানার আপনার দরকার নেই। আপনি ওষুধ খাচ্ছেন না কেন?
টোপর চিৎকার করে বলল, আমি ওষুধ খাব না, আমাকে হিরোইন দিন। তারপর বলল, আমি এখানে কেন? শালা কায়সার নিশ্চয় এখানে নিয়ে এসেছে। শালাকে পেয়ে নিই একবার, মজা দেখাব।
ডাঃ মাহবুবা বললেন, তা পরে দেখাবেন, এখন ওষুধ খেয়ে নেন।
টোপর নরমস্বরে বলল, আগে আমার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিন।
উঁহু, আগে ওষুধ খেয়ে নিন, তারপর খুলে দেব।
ওষুধ খাইয়ে আমাকে ভালো করতে চান? কিন্তু আমি তো বাঁচতে চাই না। প্লীজ, হয় আমাকে ছেড়ে দিন, নচেৎ হিরোইন দিন।
আমার কথা না শুনলে, আমিও আপনার কথা শুনব না। তারপর দুটো ট্যাবলেট ও এক গ্লাস পানি এনে বলল, নিন হাঁ করুন।
না, আমি খাব না। আমাকে হিরোইন দিন।
এটা হাসপাতাল, এখানে চিকিৎসা করে রুগীদের ভালো করা হয়। ইনশাআল্লাহ আপনিও ভালো হয়ে যাবেন।
আমার চিকিৎসা করার দরকার নেই। আমি ভালো হতে চাই না।
কেন চান না বলুন তো?
সে কথা শুনে আপনার কি লাভ?
লাভ আছে বলেই জিজ্ঞেস করছি।
বলার পর হিরোইন দেবেন বলুন।
হাসপাতালে তো হিরোইন থাকে না, দেব কি করে?
তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন প্লীজ, আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।
ডাঃ মাহবুবা একটু চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, বাইরে থেকে আনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব। এবার বলুন, কেন আপনি এই মরণনেশায় আসক্ত হলেন?
সে কথা বলতে আমার খুব কষ্ট হবে। সে সময় হিরোইন না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব। আগে ব্যবস্থা করে আসুন।
ডাঃ মাহবুবা চালাকি করে বাইরে থেকে ঘুরে আসার জন্য কেবিন থেকে বেরিয়ে ইয়াসমীনকে একা আসতে দেখলেন। কাছে এলে জিজ্ঞেস করলেন, ডাঃ সারওয়ার এলেন না?
উনি একটা রুগী নিয়ে খুব ব্যস্ত আছেন। বললেন, কিছুক্ষণ পরে আসবেন।
আপনি সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করুন। রুগী দেখা হয়ে গেলে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
ইয়াসমীন জ্বী ম্যাডাম বলে চলে গেল।
ডাঃ মাহবুবা বেরিয়ে যাওয়ার পর টোপরের হঠাৎ মনে হল, এই মহিলা ডাক্তারের গলার স্বর ঠিক টিকলীর মতো। ভাবল, সে নয় তো? সে নিশ্চয় এতদিনে ডাক্তার হয়ে। গেছে। আবার ভাবল, ডাক্তার হলে ও এখানে আসবে কেন? ঠিক করল, ফিরে এলে পরিচয় জানতে চাইবে।
ডাঃ মাহবুবা মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এসে বললেন, ব্যবস্থা করে এলাম, এবার বলুন।
তার আগে আপনার পরিচয় বলুন।
আমি এখানকার ডাক্তার।
তাতো বুঝেছি, আপনার বায়োডাটা বলুন।
আগে আপনার কথা শেষ করুন, তারপর বলব।
তাহলে আপনার মুখের নেকাবটা খুলুন।
ডাঃ মাহবুবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনি কিন্তু ভদ্রতা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
প্লীজ, রাগ করবেন না। একটা মৃত্যু পথযাত্রির অনুরোধ রক্ষা করুন।
ডাঃ মাহবুবা এতক্ষণ সামলে থাকতে পারলেও আর পারলেন না। মুখের নেকাব সরিয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগল।
টোপর চমকে উঠে রাগ ও ঘৃনাপূর্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর হাত পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে ফেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে হাপরের মতো ফুসতে ফুসতে বলল, আমি আর একদন্ড এখানে থাকব না। কে কোথায় আছ, আমার বাঁধন খুলে দাও।
ডাঃ মাহবুবা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, প্লীজ টোপর, একটু শান্ত হও। তোমার টিকলীর কথা আগে শোন, তারপর যা ইচ্ছা তাই করো।
কে টোপর? কে টিকলী? কাউকেই আমি চিনি না। আমি হাসান। আমি কিছুই শুনতে চাই না। তারপর নিজেকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করতে লাগল।
ডাঃ মাহবুবার মনে হল, হার্টফেল করতে পারে। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমের ইনজেকশন রেডি করে পুশ করতে এলেন।
টোপর চিৎকার করে উঠল, কে কোথায় আছেন, আমাকে বাঁচান। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে চাচ্ছেন?
এমন সময় ডাঃ সারওয়ার ও ইয়াসমীন কেবিনে ঢুকলেন।
তাদের দেখে টোপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আপনারা ঐ পিশাচীনির হাত থাকে আমাকে বাঁচান। আমাকে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলতে চাইছেন। ওঁকে এখান থেকে চলে যেতে বলুন। ওঁর মুখ আমি দেখতে চাই না।
ডাঃ মাহবুবা ডাঃ সারওয়ারকে বললেন, উনি হিরোইনের জন্য খুব অস্থির হয়ে উঠে ছিলেন। তাই এই ইনজেশন দিতে চাচ্ছি বলে চিৎকার করছেন।
ডাঃ সারওয়ার মাস চারেক হল, এখানে এসেছেন। ডাঃ মাহবুবাই যে এখানকার সর্বেসর্বা তা জানেন। ওঁর মুখ কোনো দিন দেখেন নি। আজ দেখে কিছু একটা অনুমান করলেন। বললেন, আপনি চলে যান, আমি দেখছি।
ডাঃ মাহবুবা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ নার্সের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাইরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ডাঃ সারওয়ার টোপরকে বললেন, ভয় নেই উনি আপনার কাছে আসবেন না। তারপর তার একটা হাত শক্ত করে ধরে নার্সকে ইনজেকশন পুশ করতে বললেন।
টোপর বলল, প্লীজ ইনজেকশন দেবেন না, আমাকে ছেড়ে দিন।
নার্স ইনজেকশন পুশ করার পর ডাঃ সারওয়ার হাত ছেড়ে দিয়ে বললেন, আগে ঠিক মতো ওষুধ পত্র খান, আমাদের কথা মতো চলুন। ভালো হয়ে গেলে আমরাই আপনাকে রাখব না। তারপর নার্সকে বললেন, এখানে সব সময় একজন থাকবেন। প্রয়োজনে আমাকে খবর দেবেন। কথা শেষ করে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে ডাঃ মাহবুবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।
বেশ তো চলুন বলে ডাঃ মাহবুবা এগোলেন। কোয়ার্টারের বারান্দায় এসে দুজন দুটো চেয়ারে বসে ডাঃ মাহবুবা বললেন, কি আলাপ করতে চান বলুন।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, যদি অনুমতি দেন, কয়েকটা প্রশ্ন করব।
করুন।
এই রুগী কী আপনার পরিচিত?
হ্যাঁ।
কিছু হয় কী আপনার?
ডাঃ মাহবুবা কি বলবে ঠিক করতে না পেরে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
প্লীজ ম্যাডাম, চুপ করে থাকবেন না। আমি মনে করি, ওঁকে বাঁচাতে হলে আপনার সাহায্য খুব দরকার। ডাক্তার হিসাবে কথাটার গুরুত্ব নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?
বুয়াকে চা নিয়ে আসতে দেখে ডাঃ মাহবুবা বললেন, চা খেয়ে নিন, বলছি। চা খাওয়ার পর ডাঃ মাহবুবা প্রথমে নিজের ও টোপরের বায়োডাটা বললেন। তারপর ছোটবেলার সম্পর্ক থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সব বলে বললেন, এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আমার কারণেই ওঁর আজ এই অবস্থা। ওঁকে বাঁচাবার জন্য আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, যারা হিরোইনের নেশা করে, তারা চার পাঁচ বছরের বেশি বাঁচে না। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনি প্রায় ছয় বছর ধরে নেশা করছেন। এখনো যে বেঁচে আছেন, ভাবতেই খুব অবাক লাগছে। এই জন্যেই বোধ হয় কথায় আছে, রাখে আল্লাহ মারে কে? অবশ্য কোরআনপাকেও আছে, আল্লাহ হায়াৎ মউতের মালিক।
ডাঃ মাহবুবা ভিজে গলায় বললেন, এ কথা মুসলমান মাত্রেই জানে। আপনি আপনার সাধ্যমতো চিকিৎসা করুন। আমি আমার সাধ্যমত সব কিছু করব।
ডাঃ সারওয়ার বললেন, কি সাহায্য দরকার, তা ডাক্তার হিসাবে আপনি নিশ্চয় জানেন। তবু বলছি, আপনার প্রতি ওর ঘৃণা বা বিদ্বেষ দূর করার চেষ্টা করবেন। আপনার ও ওঁর মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই যে তাদের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত এবং সেই জন্যে ওঁকে যে তারা এখনো খুঁজছেন, সে কথা বিশ্বাস করাতে হবে।
ডাঃ মাহবুবা বললেন, আমি ওঁর জন্য সবকিছু করব। আপনি শুধু একটু ভালো করে কেয়ার নেবেন।
এটা আমার কর্তব্য, আপনি না বললেও নিতাম। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে ডাঃ সাওয়ার বললেন, রাত একটার দিকে ওঁর ঘুম ভাঙ্গবে। আমি নার্সকে থাকতে বলেছি। কোনো রকম অসুবিধা হলে আমাকে খবর দিতেও বলেছি। আমি না বলা পর্যন্ত আপনি ওঁর কাছে যাবেন না। তবে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আসতে পারেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
ডাঃ মাহবুবা এশারে নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করলেন। তারপর টোপরের কেবিনে এলেন।
ইয়াসমীন টুলে বসে ছিল। দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
ডাঃ মাহবুবা সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আপনি যান। নামায পড়ে খেয়ে দেয়ে আসুন। আমি ওঁর ঘুম ভাঙ্গার আগে পর্যন্ত আছি।
ইয়াসমিন চলে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ টোপরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর টুলটা বেডের কাছে এনে বসে তার মাথায় কয়েকবার হাত বুলিয়ে দুহাত তুলে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ফরিয়াদ করলেন, হে রাবুল আলামিন, তুমি বিশ্বব্রহ্মান্ডের একমাত্র মহান প্রভু। তোমার সমকক্ষ কেউ নেই। তুমি অসীম দয়ালু। তাই যারা তোমাকে অস্বীকার করে এবং যারা তোমার আদেশ নিষেধ অমান্য করে। তাদেরকে ও তুমি জীবন-যাপন করার অবসর দিয়েছ। আমি তোমার একজন নাদান। বান্দী হলেও তোমার পেয়ারা হাবিব হযরত মুহম্মদ (দঃ)-এর উম্মত। সেই হাবিবে পাকের উপর শত কোটি দরূদ ও সালাম পেশ করে ফরিয়াদ করছি, তুমি টোপরকে ভালো করে আমাকে তার স্ত্রী হিসাবে কবুল কর। তুমি অন্তর্যামী। আমাদের দুজনের অন্তরের সব কিছু জান। তোমার মনোনীত প্রিয় বান্দারা ছাড়া প্রত্যেক মানুষই কিছু না কিছু গোনাহ করে থাকে। আমিও করেছি। তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাস, আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে ও টোপরকে ক্ষমা করে আমাদের মনের নেক মকসুদ পূরণ কর। তুমি ক্ষমা না করলে মানুষের পরিত্রানের কোনো উপায় নেই। তুমি কোরআন পাকে বলেছ, হে আমার বান্দাগণ যাহারা নিজের উপর অত্যাচার করিয়াছ, তোমরা আল্লাহতায়ালার রহম হইতে নিরাশ হইও না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ (অতীতের) সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করিবেন; নিশ্চিয় তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু। [সূরা-যুমার, ২৪-প্যারা, ৫৩ নং আয়াত।] তোমার পবিত্র বানী মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাসের জোরে তোমার কাছে ফরিয়াদ করছি, তোমার হাবিবে পাকের অসিলায় আমাকে ক্ষমা করে আমার দোওয়া কবুল কর। আমিন, সুম্মা আমিন।
মোনাজাত শেষ করে চোখ মুখ মুছে টোপরের মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলেন। এগারটার সময় ইয়াসমীন ফিরে এলে বললেন, আমি স্যুপ পাঠিয়ে দিচ্ছি, ওঁর ঘুম ভাঙ্গলে খাওয়াবেন। যদি খেতে না চান অথবা তেমন কিছু উৎপাত করেন, তা হলে ডাঃ সারওয়ারকে খবর দেবেন।
ইয়াসমীন প্রথমেই বুঝতে পেরেছে, ইনি নিশ্চয় ম্যাডামের আপনজন। বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। ডাঃ সারওয়ার আমাকে সবকিছু নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ডাঃ মাহবুবা ভারাক্রান্ত মনে কোয়ার্টারে ফিরে এসে ফ্রীজ থেকে মুরগীর মাংস নিয়ে স্যুপ তৈরী করে বুয়ার হাতে পাঠিয়ে দিলেন।
পরের দিন সকালে ডাঃ মাহবুবা ঢাকায় ফোন করলেন।
আলি ড্রইংরুমে বসে পেপার পড়ছিল। ফোন ধরে সালাম দিয়ে বলল, কাকে চান?
ডাঃ মাহবুবা ভাইয়ার গলা বুঝতে পেরে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভাইয়া, আমি টিকলী, কক্সবাজার থেকে বলছি। তোমরা সব কেমন আছ?
আল্লাহরপাকের দোওয়ায় ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
আমিও আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছি। ভাইয়া শোন, টোপরের দেখা আল্লাহ মিলিয়েছে। ওর অবস্থা খুব খারাপ।
তাই নাকি? ওর সঙ্গে দেখা হল কি করে।
গতকাল একটা লোক ওকে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল। এখানে আছে। আমি তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। হিরোইনের নেশা করে করে কঙ্কাল হয়ে গেছে। তোমরা সবাই ওর জন্য দোওয়া করো।
তা তো করবই। ধর, আম্মা-আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসি।
না ভাইয়া, আমার মনের অবস্থা এখন কি রকম তা নিশ্চিয় বুঝতে পারছ। তুমি সবাইকে নিয়ে দুএকদিনের মধ্যে চলে এস। আর টোপরের মা-বাবাকে খবরটা দিয়ে তাদেরকেও সঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। সায়কিয়াট্রিস্ট ডাঃ সারওয়ার ওর চিকিৎসা করছেন। উনি বলেছেন, ওকে বাঁচাতে হলে আমাদের ও ওর গার্জেনদের উপস্থিতি খবর দরকার।
আলি বলল, আমি পরশু আমাদের সবাইকে নিয়ে আসছি; কিন্তু আমার কথায় টোপরের মা-বাবা যেতে মনে হয় রাজি হবেন না। তুই নিজে তাকে ফোন করে বল।
টিকলী বলল, ঠিক আছে, তুমি ফোন রেখে দাও। আমি এক্ষুণী করছি।
আলি ফোন রেখে দেওয়ার পর টিকলী টোপরদের বাসায় ফোন করল।
কাহহার সাহেব বাসায় ছিলেন, ফোন ধরে বললেন, হ্যালো, কাহহার সাহেব বলছি।
টিকলী সালাম দিয়ে বলল, আমি কক্সবাজার রহিম আফরোজা হাসপাতালের ডাক্তার বলছি। এখানে আপনার ছেলে টোপর মুমূর্ষ অবস্থায় রয়েছেন। আপনাদের সবাইকে একবার দেখতে চাচ্ছেন।
প্রথম সন্তানের উপর সব মা-বাবার স্নেহ ভালবাসা একটু বেশি থাকে। তাই টোপরের অধঃপতনে রেগে গেলেও পাঁচ-ছ বছর পর খোঁজ পেয়ে পিতৃস্নেহ উথলে উঠল। তার মুমূর্ষ অবস্থার কথা শুনে চোখে পানি ধরে রাখতে পারলেন না। কথা বলতে গেলে কেঁদে ফেলবেন ভেবে চুপ করে সামলাবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
টিকলী মনে করল, এখনো উনি ছেলেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। বলল, বান্দা অন্যায় করে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আর আপনি বাবা হয়ে মুমূর্ষ ছেলেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। তা ছাড়া ভুল যে আপনারাও করেছেন, তা ভালো করে চিন্তা করলে বুঝতে পারতেন।
কাহহার সাহেব চিন্তা করলেন, টোপর নিশ্চয় ডাক্তারকে সব কথা বলেছে। নচেৎ উনি এরকম কথা বলছেন কেন। ভিজে গলায় বরলেন, হ্যাঁ মা, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমরাও ওর প্রতি অবিচার করেছি। আমি সবাইকে নিয়ে দুএকদিনের মধ্যে আসছি। টোপর কেমন আছে মা?
টিকলী বলল, অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমরা চিকিৎসার ত্রুটি করছি না। আপনারা দোওয়া করুন, আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ করে দেন। এবার রাখি বলে সালাম বিনিময় করে ফোন রেখে দিল।
ডাঃ সারওয়ারের তত্ত্বাবধানে ও চিকিৎসায় দুতিন দিনের মধ্যে টোপর কিছুটা নরম্যালে এল। মাঝে মাঝে হিরোইনের দেওয়ার কথা বললেও তেমন উত্তেজিত হয় না। তিন দিনের দিন ডাঃ সারওয়ার ডাঃ মাহবুবাকে বললেন, আজ রাত থেকে আপনার তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিলাম। হাত পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়ার ব্যাপারটা আপনার উপর নির্ভর করছে। কিন্তু খুব সাবধান, আপনাকে দেখে যদি আগের মতো উত্তেজিত হয়ে পড়েন, আর আপনি যদি সামলাতে না পারেন, তাহলে আমাকে কাউকে দিয়ে খবর দেবেন।
ডাঃ মাহবুবা শুধু ধন্যবাদ বলে চুপ করে রইলেন।
এশার নামায পড়ে খাওয়া দাওয়ার পর ডাঃ মাহবুবা যখন টোপরের কেবিনে এল তখন সে ঘুমাচ্ছে। বোরখা খুলে টুলে বসে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন। সাড়ে তিনটার সময় টোপরের ঘুম ভেঙ্গে যেতে বুঝতে পারল, হাত পায়ের বাঁধন খোলা। পাশ ফিরে শুয়ে টিকলীকে দেখে রেগে উঠে চিৎকার করে বলল, আপনি আবার এসেছেন? বেরিয়ে যান, নচেৎ আমিই চলে যাব। তারপর বেড থেকে নামতে গেল।
টিকলী তাকে ধরে ফেলে বলল, তুমি খুব দুর্বল টোপর, যেতে পারবে না। আমি তোমার টিকলী। আমাকে চিনতে পেরেও না চেনার ভান করছ কেন? আজ ছয় বছর পর তোমাকে পেয়েছি, কিছুতেই যেতে দেব না।
টোপর চিৎকার করেই বলল, কে টোপর? তাকে আমি চিনি না। টিকলী নামেও কাউকে চিনি না। আমি হাসান। আপনি আমাকে ছেড়ে দিন; আমি এখান থেকে চলে যাব।
টিকলী তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে যেতে দিলে তো যাবে। আমার একটু ভুলের জন্য তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেই ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে আজ ছয় বছর কি যে অশান্তির আগুনে জ্বলছি, তা উপরের মালিক জানেন। তারপর টোপর রাজশাহী থেকে চলে আসার পর যা কিছু ঘটেছে, কি ভাবে তাকে খুঁজেছে বলল। তারপর মা-বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করার কথা, গোপনে এখানে চলে আসার কথা এবং টোপরকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে জিনিয়ার মারফত যে সব চিঠি টোপরকে দিয়েছিল সেগুলো তার হাতে দিয়ে বলল, আমার কথা সত্য না মিথ্যা এগুলো পড়লেই জানতে পারবে। তোমার বন্ধু সাগরও সবকিছু জানে। তাকেও জিজ্ঞেস করে যাচাই করতে পারবে। আমার মা-বাবা ভাইয়া সবাই তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। আর তোমার মা-বাবা ও ভাইবোন ভুল বুঝতে পেরে তোমাকে অনেক খুঁজেছে। একটা কথা শুনে রাখ, তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস না কর, তা হলে আমিও তোমার মতো হিরোইনের নেশা করতে বাধ্য হব।
চিঠিগুলো পড়ে ও টিকলীর কথা শুনে টোপর নিথর হয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, ঐ জঘন্য নেশার নাম মুখে এনো না। ঐ নেশা করে আমি মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি। তুমি ওর ধারে কাছেও যেও না। আমাকে এবার যেতে দাও টিকলী; মৃত্যু আমাকে ডাকছে। পারলে ক্ষমা করো।
টোপরের মুখে টিকলী ডাক শুনে তার অন্তরে শীতল বাতাসের পরশ বয়ে গেল। ভিজে গলায় বলল, হায়াত মউত আল্লাহ পাকের হাতে। আমি তোমাকে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ইনশাআল্লাহ ফিরিয়ে আনবোই। সে জন্য যদি জীবন দিতে হয়, তাও দেব।
অনেক দেরী হয়ে গেছে টিকলী; আমি আর বেশি দিন বাঁচব না। আমার জন্য জীবনটা নষ্ট করো না।
এ জীবন শুধু তোমার জন্য আগে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। ডাঃ সারওয়ার ফরেন থেকে সাইকিয়াট্রিস্টে ডিগ্রী নিয়ে এসেছেন। তিনি তোমার চিকিৎসা করছেন। তার হাতে তোমার মতো অনেক মাদকে আসক্ত রুগী ভালো হয়েছে। তুমি কোনো দুঃশ্চিন্তা করো না। ইনশাআল্লাহ তিনি তোমাকে খুব শিঘ্রী ভালো করে তুলবেন। এবার বল, তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ?
টিকলীর কথা শুনতে শুনতে টোপরের বেঁচে থাকার ইচ্ছা প্রবল হল। বলল, তোমার প্রতি অবিচার আমিও কম করিনি। তুমি আগে বল আমাকে ক্ষমা করেছ?
টিকলী কেঁদে ফেলে বলল, আল্লাহ আমাদের দুজনকে মাফ করুক।
টোপর বলল, সত্যি করে বল তো টিকলী, আমি কি বাঁচব?
টিকলী বলল, ইনশাআল্লাহ নিশ্চয় বাঁচবে। যদি তোমার হায়াত না থাকে, তবে আমি আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে আমার অর্ধেক হায়াত দিয়ে তোমাকে বাঁচাবার ফরিয়াদ করব।
টোপর তাকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, তোমার মতো আল্লাহর নেক বান্দীর কথা না শুনে যে অন্যায় করেছি, আল্লাহ কি ক্ষমা করবেন? কথা বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
টিকলী তার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, আল্লাহ বহুৎ দয়াবান ও ক্ষমাশীল। কোনো বান্দা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইলে তাকে ক্ষমা না করে থাকতে পারেন না। তারপর বলল, আমি ঢাকায় ফোন করে তোমার কথা আমাদের ও তোমাদের বাসায় জানিয়ে সবাইকে আসতে বলেছি। আজ কালের মধ্যে হয়তো এসে পড়বে। আসার পরপরই বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব ঠিক করেছি। আশা করি, ইনশাল্লাহ এবার আমাদের ও তোমাদের বহুদিনের পারিবারিক মনোমালিন্যে অবসান হবে।
টোপর চমকে উঠে বলল, সত্যি বলছ?
আমি কখনো মিথ্যা বলি না। তা ছাড়া এতবড় সুসংবাদ কেউ কি মিথ্যা করে বলতে পারে?
কিন্তু আমি তো বেশি দিন বাঁচব না। আবার বলছি, এতবড় ভুল করো না টিকলী।
টিকলী তার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, ওরকম কথা আর কখনো বলবে না। জান না, তুমি না বাঁচলে আমিও বাঁচব না? এত বছর সবর করে তোমাকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে ফরিয়াদ করেছি। তিনি যখন ফরিয়াদ কবুল করে তোমাকে পাইয়েছেন তখন তিনিই তোমাকে সুস্থ করে আমাদের জোড়া কবুল করবেন।
টোপর ভিজে গলায় বলল, এই পাপী বান্দার দোওয়া আল্লাহ কবুল করবেন কিনা জানি না; তবু করছি, তিনি যেন তোমার বাসনা পূরণ করেন।
টিকলী কান্না মুখে মৃদু হেসে বলল, উঁহু, হল না, আল্লাহ যেন আমাদের দুজনেরই মনের বাসনা পূরণ করেন। তারপর দুজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, আমিন।
এমন সময় হাসপাতালের মসজিদ থেকে ফজরের সুমধুর আযান ভেসে এল, আল্লাহু আকবার– আল্লাহু আকবার।
<