পরের বছর টোপর অনার্স পাশ করার পর কাহহার সাহেব বললেন, ভার্সিটি থেকে মাস্টার্সটা কমপ্লীট কর, তারপর ফরেনে পাঠাবার ব্যবস্থা করব।

টোপর বলল, তুমি তো বলেছিলে অনার্স নেওয়ার পর পাঠাবে?

তা বলেছিলাম, এখন চিন্তা করে দেখলাম, মাষ্টার্স করে যাওয়াই ভাল।

টোপর খুব অসন্তুষ্ট হলেও প্রতিবাদ করল না। ভাবল, ভালই হল, এর মধ্যে টিকলীকে বিয়ে করে ফেলবে।

ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একদিন টিকলীকে ঘটনাটা বলে বলল, মাষ্টার্স নিতে এক বছরের কোর্স হলেও সেশন জটের কারণে দুই আড়াই বছর লেগে যাবে। তারপর ফরেনে গিয়ে তোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে আরো দুতিন বছর লেগে যাবে। এতদিন তোকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না। তার চেয়ে আমরা গোপনে কাজি অফিসে বিয়ে করে ফেলি চল। ব্যাপারটা গোপন রাখব। কোথাও কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার নাম করে হানিমুনের কাজটা সেরে ফেলব।

টিকলী এইচ, এস, সিতে ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা ও রাজশাহী মেডিকেলে এ্যাডমিশান টেষ্ট দিয়েছিল। ঢাকায় না টিকলেও রাজশাহীতে টিকেছে। সেও টোপরকে আপন করে পেতে চায়। কিন্তু টোপর যেভাবে চাইছে, সেভাবে নয়। তাই কি বলবে চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করতে লাগল।

কিরে কিছু বলছিস না কেন?

এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? ছেলেরা চট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও মেয়েরা পারে। আমাকে কিছুদিন ভাববার সময় দে।

এতে ভাববার কি আছে?

তোকে তো আসল কথাটাই বলা হয় নি। আমি রাজশাহী মেডিকেলে এ্যাডমিশান টেস্টে টিকে গেছি। কয়েকদিনের মধ্যে ভর্তি হব। আমার বড় খালা খালু ওখানে থাকেন। তাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করব।

তাই নাকি? তা হলে তো ভালই হল। যখনই মন চাইবে তখনই তোর কাছে যেতে পারব। এখন বল, কবে কাজি অফিসে যাবি?

কাজি অফিসের কাজটা রাজশাহীতে হবে। আমি তোকে চিঠি দিয়ে জানাব।

কথাটা ঠিকই বলেছিস, ওখানে করলে কোনো হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে পারব।

টিকলী হেসে উঠে বলল, তুই তো দেখছি মধুচন্দ্রিমার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিস।

আর তুই বুঝি হসনি? ঠিক আছে, বিয়ের রাতে আমি একাই মধুচন্দ্রিমা যাপন করব।

টিকলী হেসে উঠে বলল, একা একা আবার মধুচন্দ্রিমা রাত যাপন করা যায় বুঝি?

টোপর বলল, যায় কিনা যায়, সেই রাতে দেখিয়ে দেব।

টিকলী হাসতে হাসতেই বলল, তাই দেখাস, কিন্তু বাছাধন, আমি তো বড় খালাদের বাসায় থাকব। হোটেলে মধুচন্দ্রিমা যাপন করবি কি করে?

তোর খালাদের বাসা থাকতে হোটেলে থাকব কোন দুঃখে। কাজি অফিসে বিয়ে করে এসে খালা-খালুকে সালাম করে দোওয়া নিতে যাব। দেখবি তখন তারাই বাসাতে মধুচন্দ্রিমা যাপনের ব্যবস্থা করে দেবেন।

আর যদি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেন?

তা হয় তো দিতে পারেন; তবে আমার মনে হয় তা করবেন না। হাজার হোক। ভাগ্নি জামাই তো। তারপর বলল, আগে সেই সময় আসুক তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে।

টিকলী বলল, ঠিক আছে, এমন বাসায় ফিরি চল।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজে এ্যাডমিশান নিয়ে টিকলী বড় খালাদের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে লাগল। আসার আগে অনেক চেষ্টা করেও টোপরের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। কারণ সে তার মাকে নিয়ে দেশের বাড়ি মনোহরদি গিয়েছিল। তাই আসার আগের দিন একটা চিঠি লিখল

টোপর,
প্রথমে আমার সালাম ও ভালবাসা নিবি। পরে জানাই যে, তোর সাথে দেখা না করে চলে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কোনো উপায় নেই। তাই আমাদের বুয়ার মেয়ে আসমার হাতে এই চিঠি দিলাম। চিঠি পেয়ে তুইও যে খুব কষ্ট পাবি, তা জানি। আমি কয়েক দিনের মধ্যে তোকে চিঠি দেব। তাতে ঠিকানা থাকবে। চিঠি পেয়ে অতি অবশ্যই আসবি। আর বিয়ের ব্যাপারে যদি প্রস্তুতি নিয়ে আসতে গিয়ে দেরি হয়, তা হলে আমার চিঠি পাওয়া মাত্র একদিনের জন্য হলেও দেখা দিয়ে আসবি। তারপর তোর সময় সুযোগ মতো মধুচন্দ্রিমা যাপন করার জন্য আসবি। আর বেশি কিছু লিখতে পারছি না, শুধু কান্না পাচ্ছে। তাই এখানেই শেষ করছি।
–তোর টিকলী

চিঠিটা একটা সাদা খামে ভরে গাম দিয়ে মুখ এঁটে দিল। তারপর আসমাকে ডেকে তার হাতে দিয়ে বলল, এটা ও বাড়ীর টোপরকে দিবি। সে দেশের বাড়ি গেছে। ফিরে এলে গোপনে দিবি। আর শোন, এখন এটা তোর সুটকেসে রেখে দে। খবরদার, কেউ যেন না জানে। তোর মাও যেন জানতে না পারে।

স্বামী পরিত্যাক্তা আনোয়ারা এক বছরের আসমাকে নিয়ে এ বাড়িতে কাজ করছে। আসমার বয়স এখন প্রায় দশ বছর। বেশ চালাক চতুর মেয়ে। টিকলী তাকে কোরান ও নামাজ পড়তে শিখিয়েছে। বাংলা-ইংরেজীও এখন পড়ায়। তাই আসমা টিকলীর খুব বাধ্য। এখন তার কথা শুনে বলল, ঠিক আছে আপা, চিঠির কথা কেউ জানবে না।

টিকলী রাজশাহী চলে যাওয়ার তিন দিন পর টোপর ফিরল। পরের দিন আসমা জানতে পেরে চিঠিটা দিতে যাওয়ার সময় টোপরদের গেটের ভিতরে ঢুকে কাহহার সাহেবের সামনে পড়ে গেল। কাহহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি?

আসমা কাহহার সাহবেকে দেখেই চিঠিসহ হাতটা জামার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বলল, আমি হালিম সাহেবের বাসার কাজের বুয়ার মেয়ে।

কাহহার সাহেব বললেন, এখানে কেন এসেছ? তারপর হঠাৎ তার একটা হাত জামার ভেতরে দেখে বললেন, তোমার হাতে কি আছে দেখি?

আসমা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল।

কাহহার সাহেবের কেমন যেন সন্দেহ হল। বললেন, হাতে কি আছে দেখাও।

তবু আসমা চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রইল।

কাহহার সাহেবের সন্দেহটা দৃঢ় হল। এগিয়ে এসে জামার ভেতর থেকে হাতটা বের করতে সাদা খাম দেখে অবাক হয়ে বললেন, এটা কাকে দিতে যাচ্ছিলে? তাকে ভয়ে কাঁপতে দেখে খামটা হাতে নিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, এটা নিয়ে তোমাকে কে পাঠিয়েছে?

আসমা কেঁদে ফেলল।

কাহহার সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কাঁদছ কেন? তোমার কোনো ভয় নেই। এটা দিতে কে পাঠিয়েছে? আর কাকে দিতে বলেছে বলতো।

আসমা চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপা রাজশাহী যাওয়ার আগের দিন ওটা আমাকে দিয়ে বলল, ও বাড়ির টোপর ভাই গ্রামের বাড়িতে গেছে, ফিরে এলে দিস। কাল টোপর ভাইকে দেখলাম, তাই দিতে এসেছি।

কাহহার সাহেব বললেন, ঠিক আছে তুমি যাও, আমি টোপরকে এটা দিয়ে দিব। তারপর রুমে এসে চিঠি পড়ে খুব রেগে গেলেন।

নাস্তা খাওয়ার সময় শাফিয়া বেগম স্বামীর গম্ভীর মুখ দেখে বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। তাই নাস্তা সামান্য খেয়ে চা দিতে বলায় কিছু বললেন না।

কাহহার সাহেব অফিসে চলে গেলেন।

দুপুরেও ভাত খাওয়ার সময় সামান্য খেয়ে উঠে যেতে দেখে বললেন, তোমার কি শরীর খারাপ?

কাহহার সাহেব কোনো কথা না বলে হাত মুখ ধুয়ে চলে গেলেন।

কাহহার সাহেবের সিগারেট খাওয়ার নেশা না থাকলেও কিছু খাওয়ার পর পান খান।

শাফিয়া বেগম পান সেজে স্বামীর রুমে এসে দেওয়ার সময় বললেন, শরীর খারাপ কিনা কিছু বললে না যে?

কাহহার সাহেব বালিসের তলা থেকে চিঠিটা বার করে স্ত্রীর হাত দিয়ে বললেন, হালিম সাহেবের বাসার কাজের মেয়ে টোপরকে দিতে এসেছিল।

শাফিয়া বেগম চিঠি পড়ে মনে মনে খুশি হলেন। কারণ উনি চান না প্রতিবেশির সঙ্গে শত্রুরা রাখতে। ওদের বিয়ের মাধ্যমে যদি শত্রুতার অবসান হয়, তা হলে ভালই হয়। সেই জন্য প্রথম যখন ওদের মেলামেশা নিয়ে স্বামী ছেলেকে রাগারাগি করে তখন তিনি ছেলেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, তুই এখন মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সময় মতো তোর বাবাকে বুঝিয়ে বিয়েতে রাজি করাব। কিন্তু ওরা যে এত শিঘ্রী বিয়ে করবে এটা মেনে নিতে পারলেন না। আতঙ্কিত স্বরে বললেন, কি সর্বনাশ, ওরা এতদূর এগিয়েছে?

কাহহার সাহেব গম্ভির স্বরে বললেন, টোপর যে এরকম হবে তা ভাবতেই পারছি না। তুমি আস্কারা দিয়ে ওর সাহস বাড়িয়ে দিয়েছ।

শাফিয়া বেগম একটু রাগের সঙ্গে বললেন, তা না হয় স্বীকার করলাম; কিন্তু তুমি তো তার বাবা, আমাকে শুধু দোষ দিচ্ছ কেন?

দোষ দিচ্ছি এই জন্যে যে, ছেলে-মেয়েদেরকে লালন-পালন করার দায়িত্ব মায়ের। মা যেভাবে তাদেরকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে মানুষ করবে, তারা সেই ভাবে মানুষ হবে।

শাফিয়া বেগম বললেন, আমি আমার দায়িত্ব যথাসাধ্য পালন করেছি। এখন সে বড় হয়েছে, ভার্সিটিতে পড়ছে, বাইরে কি করছে না করছে তা জানব কি করে?

কাহহার সাহেব বললেন, ওসব কথা রেখে এখন কি করা যায় তাই বল। আমি ভাবছি, চিঠিটা হালিম সাহেবকে দিয়ে এর একটা বিহিত করতে।

সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না। উনি হয়তো বলবেন, আপনারা আপনাদের ছেলেকে সামলান। আপনার ছেলেই আমার মেয়েকে নষ্ট করেছে। শেষ-মেস ঝগড়ার সৃষ্টি হবে।

তা বলতে পারেন, তবু আমি চিঠিটা দিতে চাই। বুঝতে পারছ না কেন, চিঠি তো টোপর দেয় নি, দিয়েছে তার মেয়ে। চিঠি পড়ে তারা তাদের মেয়ের ব্যাপারটা জানতে পারবেন।

ঠিক আছে, তা হলে দাও। তবে তুমিও একটা কাগজে লিখে দাও, কিভাবে চিঠিটা পেলে। আরো লিখে দাও, আমরা আমাদের ছেলেকে সামলাব, আপনারা আপনাদের মেয়েকে সামলাবেন। নচেৎ পরিণতির জন্য আপনারাই দায়ী হবেন।

তুমি খুব ভালো কথা বলেছ বলে কাহহার সাহেব একটা কাগজে কথাগুলো লিখে নিজের নামও লিখলেন। তারপর খামের ভিতর দুটো চিঠি ভরে কাজের মেয়ে দুলারীকে ডেকে বললেন, এটা টিকলীর বাঘা হালিম সাহেবকে দিয়ে এস। তাকে যদি না পাও, তার স্ত্রীর হাতে দিবে। খবরদার, অন্য কাউকে দেবে না।

দুলারী যখন চিঠিটা দিতে এল তখন হালিম সাহেব সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন। দুলারী খামটা তার হাতে দিয়ে বলল, আমার সাহেব এটা দিয়েছেন।

হালিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন বাসায় কাজ কর?

দুলারী বলল, টোপরদের বাসায়।

ঠিক আছে, তুমি যাও।

দুলারী ফিরে এলে কাহহার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিরে হালিম সাহেবের হাতে দিয়েছিস তো?

জ্বী।

দুলারী চলে যাওয়ার পর শাফিয়া বেগম বললেন, মেয়েটা তো কয়েক দিনের মধ্যে ডাকে চিঠি দেবে। তখন যদি টোপর এই চিঠির কথা জানতে পেরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কি বলব?

টোপর তার চিঠি যাতে না পায়, সে ব্যবস্থা করব

 শাফিয়া বেগম আর কিছু বললেন না।

কাহহার সাহেব ঐদিন ডাকঘরে গিয়ে পিয়নকে কিছু টাকা দিয়ে বললেন, টোপরের নামে কোনো চিঠি পত্র এলে তাকে না দিয়ে আমাকে দেবেন।

পিয়ন বলল, ঠিক আছে সাহেব তাই হবে।

হালিম সাহেবও চিঠি পড়ে মেয়ের উপর খুব রেগে গেলেন।

সাজেদা বেগম চা-নাস্তা নিয়ে এসে স্বামীর মুখ গম্ভীর দেখে বললেন, কি ব্যাপার কিছু হয়েছে না কি?

হালিম সাহেব চিঠিটা তার হাতে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখ তোমার মেয়ের কান্ড। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করে সোফায় বসে স্ত্রীর দিকে রাগের সঙ্গে তাকিয়ে রইলেন।

সাজেদা বেগম চিঠি পড়ে যেমন অবাক হলেন তেমনি রেগেও গেলেন। তিনিও প্রতিবেশীর সঙ্গে শত্রুতা রাখতে চাননি; কিন্তু তাই বলে তাদের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন একথা কখনো চিন্তা করেন নি। স্বামীকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রাগ সামলালেন, তারপর চিঠিটা খামে ভরে বুকসেলফে রেখে বললেন, টিকলী ছেলেমানুষি বুদ্ধিতে যে ভুল করছে, তা আমাদেরকে কৌশলে সংশোধন করে দিতে হবে। রাগের বশে কিছু করা ঠিক হবে না। মেয়ে বড় হয়েছে, লেখাপড়া করছে। আমরা বাধা দিলে ওরা অন্য পথ বেছে নেবে। এখন নাস্তা খেয়ে নাও। পরে ভেবে চিন্তে যা হয় করা যাবে।

হালিম সাহেব খেতে শুরু করে বললেন, আমার মাথায় তো, কিছু আসছে না। টিকলী চিঠিতে লিখেছে কয়েক দিনের মধ্যে আবার টোপরকে দেবে। চিঠি পেয়ে টোপর গিয়ে যদি সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফেলে, তা হলে কি হবে?

 সাজেদা বেগম বললেন, আমি আলীকে নিয়ে দুএক দিনের মধ্যে টিকলীর সঙ্গে দেখা করে যা বলার তাকে বুঝিয়ে বলব।

আলীকে নিয়ে যাবে কেন? আমিই তোমার সঙ্গে যাব।

তুমি পরে এক সময় যেও। এবারে আলীকে নিয়ে যাব। আমি বুবু ও দুলাভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ওকে বোঝাব।

ঠিক আছে, তা হলে কালই তোমরা যাও।

ঐদিন রাত্রে সাজেদা বেগম রাজশাহীতে বোনকে ফোন করলেন। সাজেদা  বেগমের বড় বোনের নাম মাজেদা বেগম। আর দুলাভাইয়ের নাম রহমান সাহেব। তিনি নাটোরের লোক। কন্ট্রাকটারী করেন। রাজশাহী টাউনে বাড়ি করেছেন। বেশ ধনী ব্যক্তি। গাড়িও আছে। ওঁদের এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়। বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে ইকবাল আমেরিকায় বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকে।

মাজেদা বেগম এশার নামায পড়ে উঠেছেন, এমন সময় ফোন বাজতে ধরে বললেন, হ্যালো, কে বলছেন?

বুবু আমি ঢাকা থেকে সাজেদা বলছি।

সাজেদা, কি খরব রে? তোরা সব ভালো আছিস?

সাজেদা বেগম সালাম দিয়ে বললেন, হ্যাঁ বুবু আমরা সবাই ভালো। তোমরা কেমন আছ?

মাজেদা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আমরা ও ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ফোন করেছিস কেন?

আমি আলীকে নিয়ে কাল আসছি। দুলাভাই নেই?

না, এখনো ফেরেনি। হঠাৎ আসছিস যে। এইতো কয়েক দিন আগে টিকলীকে নিয়ে হালিম এসেছিল?

তোমাদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করার জন্য যাব। এখন রাখি তা হলে?

 টিকলীর সঙ্গে কথা বলবি না?

না, কাল তো আসছি।

পরামর্শ করার জন্য আসবি বললি, হালিমকে না নিয়ে আলীকে নিয়ে আসছিস কেন?

সে কথা কাল গিয়ে বলব। এখন রাখছি। তারপর সালাম বিনিময় করে সাজেদা বেগম ফোন ছেড়ে দিলেন।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পর মাজেদা বেগম স্বামীকে বললেন, কিছুক্ষণ আগে সাজেদা ফোন করেছিল। কাল আলীকে নিয়ে আসছে।

রহমান সাহেব বললেন, তিন চার বছরেও যার আসার সময় হয় না, সে কিনা মেয়ে আসতে না আসতেই আসছে। কেন আসছে কিছু বলেছে?

মাজেদা বেগম বললেন, আমাদের সঙ্গে কি ব্যাপারে যেন পরামর্শ করবে।

পরের দিন সাজেদা বেগম আলীকে নিয়ে নিজেদের গাড়িতে করে এলেও ফেরীর গোলমালের জন্য রাজশাহী পৌঁছতে সন্ধ্যে হয়ে গেল।

টিকলী মাগরিবের নামায পড়ার জন্য অজু করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে মা ও ভাইয়া এসেছে দেখে বেশ অবাক হলেও আতঙ্কিত হল। তা প্রকাশ না করে সালাম দিয়ে মাকে কদমবুসি করে বলল, তোমরা হঠাৎ এলে যে?

সাজেদা বেগম জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে দোওয়া করে বললেন, পরে শুনিস। এখন নামাযের সময় হয়ে গেছে, নামায পড়ে নিই চল।

নামাযের পর চা-নাস্তা খাওয়ার সময় সাজেদা বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোকে ছেড়ে কখনো থাকিনি, তাই হঠাৎ চলে এলাম।

টিকলী মায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারল না। ভাইয়াকে তার রুমে আসার জন্য ঈশারা করে মাকে বলল, তোমরা গল্প কর, আমার পড়া আছে বলে চলে গেল।

একটু পরে টিকলীর রুমে যাচ্ছি বলে আলী ও চলে গেল।

এমন সময় রহমান সাহেব বাসায় ফিরলেন।

সাজেদা বেগম সালাম দিয়ে বললেন, দুলাভাই কেমন আছেন?

রহমান সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তবু যা হোক, মেয়েটার অছিলায় শ্যালিকা এসে দুলাভাইয়ের খোঁজ খরব নিচ্ছে। তা ভাইরা ভাইয়ের খবর কি?

ভালো আছে।

এল না কেন?

কয়েক দিন আগে টিকলীকে নিয়ে যখন এসেছিল তখন আমাকে আনেনি। তাই আমিও তাকে আনিনি।

এই কথায় তিন জনেই হেসে উঠল।

মাজেদা বেগম স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি জামা কাপড় পাল্টে হাত মুখ ধুয়ে এস, আমি চা নাস্তা নিয়ে আসছি।

নাস্তা খেয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে রহমান সাহেব শ্যালিকাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হঠাৎ আগমনের কারণটা শুনিয়ে এ্যাংজাইটি দুর কর।

সাজেদা বেগম বললেন, আপনাদের রুমে চলুন, কথাটা গোপনীয়।

মাজেদা বেগম বললেন, তা হলে তাই চল।

রুমে এসে সাজেদা বেগম চিঠিটা মাজেদা বেগমের হাতে দিয়ে বলল, বুবু তুমি পড়ে দুলাভাইকে দাও।

চিঠি পড়ে রহমান সাহেব শ্যালিকাকে বললেন, ছেলেটার পরিচয় বল।

সাজেদা বেগম বললেন, প্রতিবেশীর ছেলে। নাম হাসান। ডাক নাম টোপর। বি.এস.সিতে অনার্স নিয়ে মাষ্টার্স করছে।

তা হলে তো ভালই, তোমরা চাচ্ছ না কেন? ছেলেটা কি দেখতে শুনতে ভালো না, গরিবের ছেলে?

ওসব কিছু নয়।

তা হলে বাধা কোথায়?

আমরা যে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছি। তার পাশের বাড়ির ছেলে। তার বাবা বাড়ি করার সময় থেকে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা।

তোমরা কি জান না, রাসুলুল্লাহ (দঃ) এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে শত্রুতা রাখতে নিষেধ করেছেন। আর প্রতিবেশীর সম্বন্ধে বলিয়াছেন, প্রতিবেশীর কি হক তাহা কি জান? সে তোমার সাহায্য চাহিলে তাহাকে অভয় দিবে, সে ঋণ চাহিলে তাহাকে ঋণ দিবে, সে নিঃস্ব হইলে তাহাকে দান করিবে, সে পিড়িত হইলে তাহার শুশ্রূষা করিবে, তাহার মৃত্যু হইলে জানাজাতে যোগ দিবে, তাহার সুসংবাদে সন্তোষ প্রকাশ করিবে, তোমার অট্টালিকা তাহার অনুমতি ব্যাতীত এত দূর উঁচু করিও না। যাহাতে বায়ু চলাচল বন্ধ হয় এবং তাহার কষ্ট হয়, তাহার বিপদে আপদে সহানুভূতি প্রকাশ করিবে। যখন তুমি কোনো ফল ক্রয় কর তাহাকে কিছু দিবে, যদি না দাও তবে গোপনে তাহা ঘরে আনিবে এবং তোমার সন্তানগণ, তাহার সন্তানগণের বিরক্তি উৎপাদনের জন্য যেন বাহিরে না আসে। [বর্ণনায় ও হ্যরত অমর (রাঃ) মেশকাত]

সাজেদা বেগম বললেন, প্রতিবেশীর সম্বন্ধের হাসিটা না জানলেও এক মুসলমান অন্য মুসলমানের সঙ্গে যে শত্রুতা রাখতে নেই তা জানি। আপনার ভাইতো টোপরের বাবার সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেয়। কিন্তু লোকটা ভালভাবে সালামের উত্তরও দেন না। শুধু একটু মাথা নেড়ে দেন। ওদের বাসার কেউ নামায রোযাও করে না। আপনিই বলুন ওদের সঙ্গে কি আমরা সম্বন্ধ করতে পারি? সব থেকে বড় কথা টিকলী, এ বছর মেডিকেল ভর্তি হয়েছে। এখন ওর বিয়ের কথা চিন্তাই করা যায় না। ওর আব্বা তো চিঠি পড়ে রেগে আগুন। আমি অনেক বুঝিয়ে ঠান্ডা করে আপনাদের কাছে পরামর্শ করতে এসেছি।

রহমান সাহেব বললেন, আমার ধারণা ওদের ব্যাপারটা অনেক দিনের। তোমরা আগে টের পাও নি?

আপনার ধারণা ঠিক। ছেলে বেলায় ওরা এক সাথে স্কুলে যাতায়াত করত, খেলা ধুলা করত। তখন অতটা আমরা খেয়াল করিনি। চার পাঁচ বছর আগে টের পেয়ে টিকলিকে আমরা অনেক বুঝিয়েছি, শাসনও করেছি। তারপর থেকে ওরা চালাক হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে মেলামেশা না করে গোপনে করত। তখন আমরা মনে করেছিলাম, ওদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক নেই। এত বছর পর এই চিঠি পেয়ে জানতে পারলাম, ওরা তলে তলে ঠিকই মেলামেশা করেছে।

আচ্ছা, চিঠিটা তো টোপরকে দিয়েছে, তোমরা পেলে কি করে?

কি ভাবে পেলেন, সাজেদা বেগম খুলে বললেন।

 রহমান সাহেব বললেন, তা হলে বোঝা যাচ্ছে, চিঠির কথা ছেলেটা জানে না।

না, জানে না। তাইতো টিকলী ছেলেটাকে আবার চিঠি দেওয়ার আগেই এলাম আপনার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য।

রহমান সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমার মনে হয় ওদের বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে কোনো কাজ হবে না। তার চেয়ে তুমি একাকি টিকলীকে বুঝিয়ে বল, টোপর লেখাপড়া শেষ করে কিছু করুক। ততদিনে তুই ডাক্তারী পাশ করে ফেল। তারপর আমরাই তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। এখন বিয়ে করলে তোদের দুজনেরই যেমন পড়াশোনার ক্ষতি হবে, তেমনি ভবিষ্যৎ জীবনে অন্ধকার নেমে আসবে।

সাজেদ বেগম বললেন, আপনি ঠিক কথা বলেছেন। আমিও ঐ রকম ভেবেছি।

মাজেদা বেগম এতক্ষণ কোনো কথা বলেন নি। এবার সাজেদাকে উদ্দেশ্য করে। বললেন, ছেলের মা-বাবা কি বলেন?

সাজেদা বেগম বললেন, ছেলের মায়ের কথা বলতে পারব না। তিনি খুব ভালো। শিক্ষিতাও। ছেলের বাবা এমন অদ্র, স্ত্রীকে পাড়া প্রতিবেশীর বাসায় যেতে দেন না। তিনি এ ব্যাপারে ছেলেকে বলেই দিয়েছেন, টিকলীকে বিয়ে করলে ঘর থেকে বার করে দেবেন। চিঠিটা ছেলের বাবার হাতে পড়েছিল। তিনিই কাজের মেয়ের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেই সাথে কি লিখেছেন, তা তো পড়েছ।

রহমান সাহেব বললেন, আমি যা বললাম তাই কর। যদি ছেলেটা এখানে আসে, তা হলে যা বলার আমি তাকে বলব।

টিকলী রুমে এসে ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। একটু পরে আসার পর বলল, তোমরা কেন এসেছে বলত ভাইয়া। আম্মা যা বলল, তা আসল কারণ নয় বলে আমার মনে হচ্ছে।

আলী বলল, আম্মা তো আমাকে ঐ কথাই বলে নিয়ে এল। আসল কারণ আবার কি থাকবে? তারপর তার একটা বই নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগল।

 খাওয়া দাওয়ার পর সাজেদা বেগম মেয়ের রুমে এলেন।

মা ও ভাইয়ার আসার পর থেকে টিকলীর মনে হচ্ছে চিঠির কথা ফাঁস হয়ে গেছে। এখন মাকে আসতে দেখে ভয়ে ভয়ে বলল, কিছু বলবে আম্মা?

সাজেদা বেগম বললেন, তুই এখানে আসার আগে যে চিঠিটা টোপরকে দিয়েছিলি, সেটা তার বাবার হাতে পড়ে। তিনি খুব রেগে গেছেন। তোর চিঠির সঙ্গে এটা লিখে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারপর কাহহার সাহেবের লেখাটা তার হাতে দিলেন।

টিকলী চিঠির কথা ভেবে এমনিই ভয় পেয়েছিল। তারপর কাহহার সাহেবের লেখাটা পড়ে আরো বেশি ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে রইল।

সাজেদা বেগম বললেন, তোর বাবা কি রকম লোক তা তো জানিস। চিঠি পড়ে ভীষণ রেগে গিয়েছিল। আমি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এসেছি। এখন যা বলছি শোন, তোদের ভালবাসায় বাধা দেব না। তবে এখন বিয়ের কথা একদম ভুলে যা। তুই মন দিয়ে পড়াশোনা করে ডাক্তারীটা পাশ কর। টোপরও ততদিনে লেখাপড়া শেষ করে কিছু উপার্জন করুক। তারপর আমি তোর বাবাকে ম্যানেজ করে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। আর তোর বাবা যদি একান্ত রাজি না হয় অথবা টোপরের মা-বাবাও যদি রাজি না হন, তা হলে তোরা নিজেরা নিজেদের কাজ সমাধান করবি। তখন টোপরের বাবা তোকে ঘরে না তুললেও তোদের ব্যবস্থা তোরা করে নিতে পারবি। তারপর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, লক্ষী মা আমার, এখন বিয়ে করলে তোদের দুজনেরই লাইফটা নষ্ট হয়ে যাবে। তুই টোপরকে আমার কথাগুলো বুদ্ধি করে গুছিয়ে লিখে চিঠি দিয়ে জানা। সে তোকে যদি সত্যিকার ভালবেসে থাকে, তা হলে তোর চিঠি পেয়ে খুশি হবে। আর তা যদি না হয়, তা হলে বুঝবি তার ভালবাসায় খাদ আছে।

টিকলী ভেবেছিল, মা তাকে চিঠির কথা বলে খুব রাগারাগি করবে। তাই প্রথমে খুব ভয় পেয়েছিল। এখন মায়ের কথা শুনতে ভয় কেটে গিয়ে মনে মনে খুশি হল। কি বলবে না বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।

সাজেদা বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, ওয়াদা কর, আমার কথা রাখবি?

টিকলী মাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

সাজেদা বেগম বললেন, কাঁদছিস কেন? যা কিছু বললাম, তোর ভালোর জন্য বললাম। ওয়াদা কর, এখন কিছু করবি না।

টিকলী জানে এখন বিয়ে করলে তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তাই সেও এখন বিয়ে করতে চায় না। শুধু টোপরের জিদে রাজি হয়েছিল। মায়ের কথা শুনে চোখ মুছে সে কথা জানিয়ে বলল, ঠিক আছে আম্মা, আমি ওয়াদা করলাম তোমার কথা রাখব। তুমি দোওয়া কর, আল্লাহ যেন আমাকে ওয়াদা পূরণ করার তওফিক দেন।

সাজেদা বেগম আলহামুলিল্লাহ বলে বললেন, আল্লাহ তোর সমস্ত নেক বাসনা পূরণ করুক, তোকে ওয়াদা পূরণ করার তওফিক দিক।

পরের দিন সাজেদা বেগম বুবু ও দুলাভাইকে মেয়ের সঙ্গে যে সব কথা-বার্তা হয়েছে বললেন।

রহমান সাহেব বললেন, টিকলী খুব বুদ্ধিমতী। মনিষিরা বলেছেন, আকেলমন্দ কো ঈশরাই কাফি, অর্থাৎ যারা বুদ্ধিমান, অল্প কথাতেই তারা সব কিছু বুঝতে পারে।

দুদিন থেকে সাজেদা বেগম আলীকে নিয়ে ঢাকা ফিরে এসে স্বামীকে সব কিছু বললেন।

হালিম সাহেব শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এই বয়সটা ছেলে মেয়েদের জন্য খুব ডেঞ্জারেস। টোপর যোগাযোগ করলে টিকলী কি ঠিক থাকতে পারবে?

সাজেদা বেগম বললেন, টিকলীর পেটে দ্বিনী এলেম আছে, আর যাই করুক ওয়াদা খেলাপ করবে না। দুলাভাই বলেছেন, তোমরা কোনো দুশ্চিন্তা করো না। আমি টিকলীর দিকে লক্ষ্য রাখব।

কিন্তু তুমি যে তাকে বলে এলে, ভবিষ্যতে আমরা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব, তার কি হবে?

ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা আল্লাহ জানেন। তা ছাড়া একটা কথা ভুলে যাচ্ছ। কেন, আল্লাহ ওদেরকে জোড়া করে পয়দা করে থাকলে আমরা বাধা দিয়ে কি কিছু করতে পারব? ভবিষ্যতের কথা নিয়ে দুচিন্তা করার কোনো মানে হয় না। আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে।

<

Super User