০৫.

মাতব্বর দু’দিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে তিনচার দিন থানায় লোক পাঠিয়েছিলেন। দারোগাকে নিয়ে আসার জন্য। আট দিন হয়ে যাওয়ার পরও যখন এল না তখন একদিন হাসপাতালে ছেলেকে দেখতে যাওয়ার পথে থানায় গেলেন।

দারোগা সালাম বিনিময় করে বললেন, আপনার ছেলের খবর কি বলুন।

মাতব্বর তার কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, কয়েকদিন লোক দিয়ে ডেকে পাঠালাম, গেলেন না কেন?

কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তা ছাড়া আপনি ডাকলেই যেতে হবে, এরকম নির্দেশ সরকার আমাকে দেয় নি। ওসব কথা বাদ দিয়ে ছেলের খবর বলুন।

মাতব্বর আরো রেগে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিরক্ত স্বরে বললেন, ছেলের আর খবর কি। একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়ে তার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে। আপনি কি খোঁজ খবর করেছেন তার এরকম অবস্থা কে করল?

দারোগা বললেন, তা আবার করি নি। দু’জন লোকও লাগিয়েছি। কিন্তু আজও কোনো হদিস পাচ্ছি না।

মাতব্বর বললেন, সেদিন ছেলের অবস্থা দেখে আমার মাথার ঠিক ছিল না। তাই কথাটা আপনাকে জানাতে পারি নি। আমার কাজের লোক জয়নুদ্দিন ঐ সময় একটা লোককে ওখান থেকে মাঠের রাস্তার দিকে চলে যেতে দেখেছে। লোকটা বেশ লম্বা চওড়া, ইয়া বড় পাকা দাড়ি, মাথায় গোল টুপি। দেখলে মনে হবে হুজুর মানুষ।

দারোগা বললেন, রাস্তা দিয়ে কত লোক যাতায়াত করে, হুজুর যে ঐ কাজ করেছে তা কি জয়নুদ্দিন দেখেছে?

না, তা দেখে নি।

লোকটা নিশ্চয় আপনাদের গ্রামের নয়?

না, ওরকম লোক আমাদের গ্রামে নেই। অন্য গ্রামের হতে পারে?

আচ্ছা, আশ পাশের গ্রামের কোনো লোকের সঙ্গে আপনার শত্রুতা আছে?

না।

জয়নুদ্দিন যে লোককে দেখেছে, সে রকম কোনো লোককে কখনো আপনি দেখেছেন?

না। তবে দু’দিন আগে শুনলাম, পাশের গ্রামে নাকি ঐ রকম একজন লোককে দেখা গেছে। ক্ষেতে যারা কাজ করছিল, তাদেরকে ছেলের বিয়ে দেয়ার সময় যৌতুক না নেয়ার জন্য ওয়াজ করেছেন।

কার কাছে কথাটা শুনেছেন?

ঐ গ্রামে আমার এক আত্মীয় আছে, সে আমার ছেলের খবর জানতে এসেছিল। তার কাছে শুনেছি।

তারা লোকটাকে চেনে কিনা জিজ্ঞেস করেন নি?

করেছিলাম। বলল, চেনে না। আরো বলল, তারা ওনার পরিচয় জানতে চেয়েছিল, উনি বলেন নি।

আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, উনি আলেমলোক। উনি শুধু শুধু আপনার ছেলের ঐ রকম অবস্থা করতে যাবেন কেন?

তা অবশ্য ঠিক। আপনি একটু ভালো করে সন্ধান করুন। সেদিন বললাম না, অপরাধীকে ধরতে পারলে মোটা টাকা পুরস্কার দেব?

অপরাধীকে খুঁজে বের করাই আমাদের কাজ। আর এই কাজ করার জন্য সরকার বেতন দেয়। এখানে পুরষ্কার দেয়ার কথা বলছেন কেন?

অপরাধীকে ধরলে আমি খুশী হব। তাই পুরস্কার দেয়ার কথা বলছি।

শুনুন মাতব্বর সাহেব, পুরস্কারের লোভে আমি কিছু করব না। যা কর্তব্য তাই করব। এবার আপনি আসুন, আমার জরুরি কিছু কাজ আছে।

আগে যিনি দারোগা ছিলেন তিনি মাতব্বরকে খুব তোয়াজ করে চলতেন, মাতব্বর থানায় এলে চা-নাস্তা খাওয়াতেন। এই নতুন দারোগা তাকে পাত্তা দিচ্ছেন না দেখে মাতব্বর প্রথম থেকে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এখন তাকে চলে যেতে বলায় আরো বেশী অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন, নতুন এসেছেন তো, তাই এই এলাকার কে কেমন লোক জানেন না। জানলে আমার কথাকে অপগ্রাহ্য করতে পারতেন না। ঠিক আছে, এখন আসি। তারপর থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।

রশিদ প্রায় দেড় মাস পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এল। একদিন আব্বাকে। জিজ্ঞেস করল, যে লোক আমার এই অবস্থা করেছে, সেই লোকের কি খোঁজ পাওয়া গেছে?

মাতব্বর বললেন, কয়েকজন লোক লাগিয়েছি, তারা আজও কোনো খোঁজ পায় নি। এমন কি থানায় কেস করে দারোগাকে খুঁজে বের করতে বলেছিলাম; তিনিও পারেন নি।

শুনলাম, সাফিয়ার শ্বশুর শাশ্বড়ি এসে নাকি তাকে নিয়ে গেছে?

ঘটনার কয়েকদিন পর জয়নুদ্দিন একটা কাগজ মাতব্বরের হাতে দিয়ে বলেছিল, এটা মিয়া ভাইদের বুকের উপর ঢিল চাপা দেয়া ছিল। সেদিন মিয়া ভাইয়ের অবস্থা দেখে আপনাকে দিতে ভুলে গেছি। কাগজটা পড়ে মাতব্বর বুঝতে পারেন, বুড়ো লোকটা কেন রশিদের একটা হাতও একটা চোখ নষ্ট করে দিয়েছে।

এখন রশিদ সাফিয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে ভাবলেন, তা হলে ও কি সেদিন সাফিয়ার ইজ্জত লুঠতে চেয়েছিল?

বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে রশিদ আবার বলল, সাফিয়াকে ওর শ্বশুর শ্বাশুড়ী এসে নিয়ে গেছে কিনা বললে না যে?

মাতব্বর বললেন, হ্যাঁ, নিয়ে গেছে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি সাফিয়ার স্বামী শ্বশুরকে সন্দেহ করিস?

না, তাদেরকে সন্দেহ করি না। আচ্ছা, দবির সেখ তাদেরকে যৌতুকের বাকি টাকা দিয়েছে কি না জান?

দবির টাকা কোথায় পাবে যে দেবে। শুনেছি, তারা এসে যৌতুকের বাকি টাকা ছাড়াই সাফিয়াকে নিয়ে গেছে। বলেছে, ঐ টাকা আর দিতে হবে না।

হঠাৎ তারা এত ভালো মানুষ হয়ে গেল কেন খোঁজ নিয়েছ?

তা আবার নিই নি। কিছুদিন আগে ওদের গ্রামে একজন হুজুর এসে সবাইকে যৌতুক নিতে নিষেধ করে বলেছেন, এটা হারাম। আরো বলেছেন, ছেলের বাবারা যেন বিয়ের সময় মেয়ের বাবাদের কাছে যৌতুক দাবি না করে, আর মেয়ের বাবারাও যেন যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে না দেয়। এর কয়েকদিন পর থানার নতুন দারোগাও আশ-পাশের গ্রামের লোকজনদের ঐ কথা জানিয়ে বলেছেন, কেউ যদি ছেলের বিয়েতে যৌতুক দাবি করে, তা হলে থানায় খবর দিতে। সরকার নাকি যৌতুকের বিরুদ্ধে আইন করেছে, যৌতুক নিয়ে যে বিয়ে করবে তার জেল-জরিমান হবে। মনে হয়, সেই ভয়ে সাফিয়ার শ্বশুর-শাশুড়ি এসে যৌতুক ছাড়াই নিয়ে গেছে।

রশিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, আমাদের গ্রামে সেই হুজুর বা দারোগা এসে সে কথা লোকজনদের বলে নি?

হুজুর এসেছিলেন কিনা জানি না। তবে দারোগা নাকি একদিন এসে বলেছেন। আরো বলেছেন, সবাই যেন ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠায়। নচেৎ ছেলেমেয়েদের মুগ্ধ করে রাখার জন্য এ্যাকসান নেবেন। সেদিন আমি হাসপাতালে তোর কাছে গিয়েছিলাম। এসে লোকজনের মুখে এসব কথা শুনেছি। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, যে তোর এই অবস্থা করল, তাকে দেখলে কি চিনতে পারবি?

না। সে পেছন থেকে চুপিচুপি এসে এত জোরে আমার ঘাড় ধরেছিল যে, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখার ক্ষমতা আমার ছিল না। আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে ছাড়াবার; কিন্তু পারি নি। লোকটার গায়ে কি দারুণ শক্তি। কানের গোড়ায় ধরা হাতটা চাপ দিয়ে আমাকে অজ্ঞান করে ফেলল। তারপর কি হয়েছিল জানি না।

কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, তুই ঐ সময়ে পুকুর পাড়ে গিয়েছিলি কেন? আর কেনই বা লোকটা তোর এরকম অবস্থা করল?

রশিদ সত্য কথা বলতে না পেরে মিথ্যে করে বলল, এমনি একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ লোকটা আমার পিছন থেকে ঘাড় ধরে ফেলল। তারপরের ঘটনা একটু আগে তো বললাম।

লোকটা শুধু শুধু তোর ঘাড়ই বা ধরবে কেন? আর তোর এই অবস্থাই বা করবে কেন? আমার তো মনে হচ্ছে, এর পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, যা তুই গোপন করছিস।

রশিদ বিরক্তি কণ্ঠে বলল, কি আবার গোপন করব? যা সত্য তাইতো বললাম। এই কথা বলে সেখান থেকে চলে গেল।

মাতব্বর ছেলের গমন পথের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, কাগজটার লেখা পড়েই বুঝেছি, তুই সাফিয়ার ইজ্জত লুঠতে গিয়েছিলি।

.

বাহেরচর গ্রামে এবছর হাইস্কুল হবে। সে ব্যাপারে আজ তিনজন সরকারী লোক এসেছেন মাতব্বরের কাছে।

মাতব্বর সে কথা দু’তিনজন লোকের দ্বারা গ্রামবাসীকে জানিয়ে তার বাড়ির সামনে ডেকে পাঠালেন।

গ্রামের লোকজন এসে কোথায় স্কুল হবে, সে ব্যাপারে পরামর্শ করে মাতব্বরকে জায়গা দিতে বললেন।

মাতব্বর মরহুম মঈন সেখের যে বাস্তু দখল করে নিয়েছেন, সেখানে স্কুল করার কথা জানিয়ে বললেন, ঐ জায়গাটা গ্রামের মাঝখানে। ওখানে স্কুল হলে সবার জন্য সুবিধে।

গ্রামের সবাই জানে, ওটা মরহুম মঈন সেখের বাস্তু। তার বৌ সায়রা ছেলেকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর মাতব্বর ভোগ-দখল করেছেন। তবু কেউ সাহস করে কোনো প্রতিবাদ করতে পারল না।

কেউ কিছু বলছে না দেখে করিম সেখের ভাই আযীয সেখ বললেন, ওটাতো মরহুম মঈন সেখের বাস্তু। তার একটা এতিম ছেলে আছে। এতিমের জায়গায়। স্কুল করা ঠিক হবে না।

সায়রা মাতব্বরের পুরুষাঙ্গ কেটে দেয়ার ঘটনাটা গ্রামের লোকজন জেনে যাওয়ার পর থেকে মাতব্বরকে সবাই ঘৃণার নজরে দেখলেও ধনীলোক বলে তার মাতব্বরী ছাড়াতে পারে নি। কিন্তু আযীয সেখ কোনো ব্যাপারেই মাতব্বরের সঙ্গে কখনও যোগাযোগ রাখে নি। আজ হাইস্কুলের ব্যাপারে সরকার থেকে লোক এসেছে শুনে এসেছেন। ওনার অবস্থা আগে ভালো না থাকলেও এখন খুব ভালো। পাঁচ-পাঁচটা জোয়ান ছেলে। সবাই রুজী রোজগার করে। তাই মাতব্বর ও আযীয সেখের এরকম ব্যবহার দেখেও তাকে ঘাটায় নি।

এখন তার কথা শুনে মাতব্বর বললেন, মঈন সেখ অসুখে পড়ে আমাকে তার বাস্তু বিক্রি করে সেই টাকায় চিকিৎসা করিয়েছে।

আযীয সেখ বললেন, আমি তো জানি মঈন সেখ একরকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। তার বৌ আমার কাছ থেকে কিছু কিছু টাকা নিয়ে এসে যতটুকু সম্ভব চিকিৎসা করিয়েছে। তবে তার বৌ-এর কাছে শুনেছি, আপনিও তাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়েছেন। আপনার কাছে বাস্তু বিক্রি করলে তার বৌ নিশ্চয় আমাকে জানাত।

মাতব্বর বললেন, মঈন সেখের বৌ সে কথা জানে না।

এমন সময় একটা বোরখা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, মাতব্বর সাহেব, আপনার কথা সত্য নয়। আযীয চাচা সত্য কথা বলেছেন।

মাতব্বর খুব রেগে গিয়ে বললেন, কে তুই? তোকে এখানে কথা বলতে বলেছে কে?

বোরখাপরা মেয়েটি বলল, আমি কে সে কথা পরে বলছি। আপনি গ্রামের মাতব্বর, সবার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলাইতো উচিত। আশা করি, এরপর কারো সঙ্গে অভদ্র ভাষায় কথা বলবেন না। যাই হোক, আমি কে জানতে চান? আমি মরহুম মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রা বানু। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যাকে আপনি ল্যাংড়া ফকির ফজলুর সঙ্গে মিথ্যে দুর্নাম দিয়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এবার চিনতে পেরেছেন? না প্রতিহিংসা নেয়ার কারণও বলা লাগবে?

বিনা মেঘে বজ্রপাত হলে মানুষ যেমন অবাক হয় অথবা ভয় পেয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, সায়রার কথা শুনে সবাই-এর অবস্থা সেইরকম হল। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।

প্রথমে সায়রা সরকারী লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল, আপনারাই বলুন, একজন বিধবা ও তার এতিম ছেলের বাস্তুতে কি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা উচিত? আমার ছেলের ইচ্ছা, ওখানে বাবার নামে একটা মাদ্রাসা করার। সেই অসিলায় আল্লাহ তার বাবাকে বেহেশত নসীব করবেন। আর ছেলের মতো আমিও তাই চাই।

সরকারী লোকদের একজন বললেন, আমরা জেনেশুনে ঐ জায়গায় স্কুল করব না।

ততক্ষণে মাতব্বর সামলে নিয়েছেন। বললেন, আপনারা ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ওযে মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী তার প্রমাণ কি? মুখ ঢেকে রেখেছে কেন? খুলে দেখাক।

সায়রা বলল, মাতব্বর সাহেব, আপনার এত বয়স হল, নামায কালামও পড়েন, আর এটা জানেন না, পর-পুরুষদের সামনে মুখ দেখান মেয়েদের জন্য হারাম?

সরকারী লোকদের একজন বললেন, আপনার কথা ঠিক। তবে প্রমাণ করার জন্য শুধু মুখ দেখান যায়েজ।

সায়রা মুখের নেকাব সরিয়ে মাতব্বরকে উদ্দেশ্য করে বলল, এবার চিনতে পারছেন? তারপর আযীয সেখের কাছে গিয়ে বলল, আপনি বলুন তো চাচা, আমি সায়রা কিনা।

মাতব্বর চিনতে পেরে মুখ নিচু করে নিলেন। কোনো কথা বলতে পারলেন না।

আযীয সেখ বললেন, হ্যাঁ মা, তুমি মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রা।

রশিদ এতক্ষণ কিছু বলে নি। এবার বলল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? আজই বা হঠাৎ এলে কেন?

সায়রা মুখে নেকাব ঢাকা দিয়ে বলল, এতদিন কোথায় ছিলাম সে কথা আপনাদের জানার দরকার কি? আর এসেছি স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা করার জন্য।

রশিদ জিজ্ঞেস করল, তোমার ছেলে কোথায়?

সায়রা বলল, সেকথাও আপনাদের জানার দরকার নেই। তা আপনার এরকম অবস্থা হল কি করে? নিশ্চয় পাপের ফল।

এই কথা শুনে রশিদ রাগ সামলাতে পারল না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে গর্জে উঠল, এই মাগি বড় বড় বেড়েছিস দেখছি। তোর বাড় যদি না কমিয়েছি তো আমি দিলদার মাতব্বরের ছেলেই না।

সায়রাও রাগের সঙ্গে বলল, মুখ সামলে কথা বলুন। দিলদার মাতব্বরের ছেলে বলেই তো বাবার স্বভাব পেয়েছেন। একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েও স্বভাব পাল্টায় নি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমিও হাত পা হারাবার কাহিনী সবার সামনে ফাঁস করে দেব।

রশিদ আরো রেগে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, দু’জন পুলিশসহ দারোগাকে আসতে দেখে মাতব্বর ছেলেকে বললেন। চুপ কর, দারোগা সাহেব আসছেন।

দারোগা কাছে এসে মাতব্বরের সঙ্গে সালাম বিনিময়ে করে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? এত লোকজন কেন?

মাতব্বর তাদের বসার ব্যবস্থা করে সরকারী লোকদের দেখিয়ে বললেন, ওনারা এই গ্রামে হাই স্কুল করার জন্য এসেছেন। তাই লোকজন ডাকা হয়েছে কোথায় স্কুল হবে পরামর্শ করার জন্য।

তা কোথায় হবে ঠিক হয়েছে?

মাতব্বর বলার আগে সায়রা বলল, উনি আমার বাস্তুতে স্কুল করার কথা বলছেন, আমি আপত্তি করে বলেছি, ওখানে মাদ্রাসা করব।

সায়রা থেমে যেতে মাতব্বর বললেন, ওর স্বামী মারা যাওয়ার আগে আমার কাছে বাস্তু বিক্রি করেছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর ও প্রায় বিশ বাইশ বছর আগে ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আজ হঠাৎ এসে বাস্তুর দাবি করছে। আপনিই বলুন, এটা করা কি ওর ঠিক হচ্ছে?

মাতব্বরের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে দারাগো সরকারী লোকদের বললেন, স্কুল করার জন্য আপনারা তো জমি কিনবেন তাই না?

তাদের একজন বললেন, তাতো বটেই। আমরা ন্যায্য দাম দিয়ে জমি কিনবো।

ঠিক আছে, আপনারা সপ্তাহখানেক পরে আসুন। এরমধ্যে আমি গ্রামের সবার সঙ্গে আলাপ করে রাখব, কে স্কুলের জন্য জমি বিক্রি করবে। আপনারা প্রথমে থানায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। আমি আপনাদের এখানে নিয়ে আসব।

সরকারী লোকেরা বললেন, সেটাই ভালো হবে। তা হলে আজ আমরা আসি বলে সালাম বিনিময় করে চলে গেলেন।

দারোগা এবার মাতব্বরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই মহিলা বিশ বা পঞ্চাশ বছর আগে চলে গেলেও জায়গাটাতো ওনার স্বামীর। আর তিনি যে আপনার কাছে বাস্তু বিক্রি করেছেন, তার দলিল নিশ্চয় আছে?

মাতব্বর আমতা আমতা করে বললেন, দলিল করার আর সময় পেলাম কোথায়? তার আগেই তো মঈন সেখ মারা গেল।

দারোগা বললেন, এরকম ক্ষেত্রে ইসলামের হুকুম হল, দু’জনকেই কুরআন শরীফ মাথায় রেখে শপথ করতে হবে। প্রথমে আপনি বলবেন, আমি মঈন সেখের বাস্তু কিনেছি। যদি এই কথা মিথ্যে বলে থাকি, তা হলে আল্লাহর গযব আমার মাথায় পড়বে।

আপনি শফত করার পর ঐ মহিলা বলবেন, আমার স্বামী বাস্তু বিক্রি করেন নি। এই কথা যদি মিথ্যে বলে থাকি, তা হলে আল্লাহর গযব আমার মাথায় পড়বে।

দারোগার কথা শুনে প্রথমে সায়রা বলে উঠল, আমি শপথ করতে রাজি।

দারোগা মাতব্বরকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি শপথ করতে রাজি আছেন?

কুরআন শরীফ মাথায় নিয়ে শপথ করলে অল্প দিনের মধ্যেই তার উপর আল্লাহর গযব নাজিল করবেন, সেকথা মাতব্বর জানেন। তাই বললেন, সায়রা যখন ওখানে মাদ্রাসা করবে বলছে তখন আর ঐ জায়গা আমি দাবি করব না।

মাতব্বর থেমে যেতে সায়রা বলল, দারোগা সাহেব, আমার স্বামীর যদি আরো জায়গা থাকত, তা হলে সেই জায়গা স্বেচ্ছায় দিয়ে দিতাম। তার দামও নিতাম না। স্বামীর রুহের মাফফেরাতের জন্য আমি ওখানে একটা দ্বিনী প্রতিষ্ঠান করে এই গ্রামের ছেলে মেয়েদের ও বড়দের মধ্যে শিক্ষা প্রচার করতে চাই। আমার ছেলেরও তাই ইচ্ছা।

দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে কোথায়?

সে সরকারী চাকরি করে। এখানে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছে। ছুটির জন্য দরখাস্ত করেছিল, পায় নি। ছুটি পেলে কিছু দিনের মধ্যে আসবে বলেছে। আমি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পর মাতব্বর সাহেব আমার স্বামীর বাস্তু দখল করেছেন। ওনাকে দখল ছেড়ে দিতে বলুন। আমি মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করব।

দারোগা আসার আগে সায়রাকে দেখে ও তার কথা শুনে মাতব্বরের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে উঠেছিল। এখন আবার সে দারোগা যে সব কথা বলল, সেসব শুনে সেই আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিল। মনে মনে বললেন, কি করে মাদ্রাসা করিস, দেখে নেব। সুযোগ মতো চামচাদের দিয়ে ইজ্জৎ মেরে তোর লাশ শিয়াল কুকুর দিয়ে না খাইয়েছি তো আমার নাম দিলদার মাতব্বর না।

মাতব্বরকে চুপ করে থাকতে দেখে দারোগা জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে আপনি কি কিছু বলবেন?

ওখানে আমি নানারকম ফলের গাছ লাগিয়েছিলাম। সে সব এখন ফলছে। কয়েকদিনের মধ্যে বিক্রি করে দেব। তারপর সায়রা মাদ্রাসা তৈরির কাজ শুরু করবে।

সায়রা বলল, আমার জায়গা এতদিন অন্যায়ভাবে ভোগ দখল করেছেন। একটা গাছও বিক্রি করতে দেব না। যতটুকু জায়গায় মাদ্রাসার ঘর হবে, সেইটুকু জায়গার গাছ কেটে আমি বিক্রি করব। বাকি জায়গার গাছ থাকবে।

সায়রাকে দেখে ও তার কথা শুনে বাপের মতো রশিদও রাগে ফুলতেছিল। এবার তার কথা শুনে চিৎকার করে বলল, গাছ আমরা লাগিয়েছি, ওসব আমাদের, আমরা বিক্রি করবই। কি করে বাধা দাও দেখব।

দারোগাকে উদ্দেশ্য করে সায়রা বলল, মাতব্বরের ছেলের কথা শুনলেন তো, এখন আপনিই এর ফায়সালা করে দিন।

দারোগা বললেন, আমি আইনের লোক। আইন মোতাবেক মাতব্বর সাহেব আপনার জায়গা দখল করে অন্যায় করেছেন। ওনার ছেলে গায়ের জোরে যে কথা। বললেন, তাও আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। ওনারা বাড়াবাড়ি করলে আপনি আইনের আশ্রয় দিতে পারেন। সে ব্যাপারে আমি আপনাকে সাহায্য করব। কারণ অত্যাচারিতকে সাহায্য করাই মানবতা। তা ছাড়া আইনের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে আইনের লোক হয়ে কিছু না করা অমানুষের কাজ। যাতে আপনি মাদ্রাসা তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, সে ব্যাপারে আমি মাতব্বর সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে পরে আপনাকে জানাব। আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। এখন এসব কথা থাক, গ্রামের লোকজন যখন রয়েছেন তখন স্কুলের ব্যাপারে আলাপ করা যাক। তারপর আযীয সেখকে দেখিয়ে বললেন, উনি হাই স্কুল করার ব্যাপারে বেশ কিছু দিন আগে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। সে সময় জায়গাও দেবেন বলেছিলেন। আমি ওনার কথা মতো সরকারের কাছে আবেদন করেছিলাম। সরকার আবেদন মঞ্জুর করে আজ লোক পাঠিয়েছে। আযীয সেখ স্কুলের জন্য যে জমিটা আমাকে দেখিয়েছেন, সেটা গ্রামের মাঝামাঝি ও মাঠের ধারে। উনি জমির দামও নেবেন না। সেই টাকা স্কুলঘর তৈরির কাজে লাগাতে বলেছেন। এখন আপনারা যদি আযীয সেখের জমিতে স্কুল করতে রাজি থাকেন, তা হলে বলুন। আমি সরকারী লোকদের সেকথা জানাব।

গ্রামের সব লোকজন একসঙ্গে বলে উঠল, আমরা রাজি। শুধু মাতব্বর ও রশিদ চুপ করে রইলেন।

তাই দেখে দারোগা ওনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কিছু বললেন না যে?

আযীয সেখের অবস্থা আগে খারাপ থাকলেও এখন অনেক ভালো। ছোট ছেলে ইয়াসীর শহরে লেখাপড়া শেষ করে কুয়েতে চাকরি করে। তার পাঠান টাকায় অনেক জমি-জায়গা কিনেছেন।

কিছুদিন থেকে মাতব্বর লক্ষ্য করছেন, গ্রামের লোকজন তাকে আগের মতো মান্য করে না, ভক্তি শ্রদ্ধাও করে না। করে আযীয সেখকে। ইদানিং তারা তাকে মাতব্বর করতে চায়, সেকথা চামচাদের মুখে শুনেছেন। তাই মাতব্বর আযীয সেখের প্রতি খুব অসন্তুষ্ট। তাকে খুব হিংসাও করেন। স্কুলের জন্য টাকা না নিয়ে জমি দেবে শুনে অপমান বোধ করে তার উপর খুব রেগে গেলেন এবং হিংসা আরো বেড়ে গেল। দারোগার কথা শুনে সামলে নিয়ে বিদ্রূপ কণ্ঠে বললেন, আজকাল আযীয সেখের অনেক টাকা হয়েছে। সেতো বিনামূল্যে স্কুলের জন্য জমি দেবেই। আমি আর কি বলব? গ্রামের লোকজন যখন রাজি তখন আমিও রাজি।

দারোগা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে লোকজনদের চলে যেতে বললেন। সবাই চলে যাওয়ার পর সঙ্গের পুলিশ দু’জনকে বললেন, আপনারা এগোন, আমি একটু পরে আসছি।

পুলিশ দু’জন চলে যাওযার পর মাতব্বর ছেলেকে বললেন, দারোগা সাহেবের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা কর।

রশিদ যেতে উদ্দ্যত হলে দারোগা তাকে নিষেধ করে বললেন, আমি বাইরে কারো বাড়িতে খাই না। দু’একটা কথা বলে চলে যাব। শুনুন, যে লোকটা আপনার ছেলের এই অবস্থা করেছে, তার সন্ধান পাওয়া গেছে।

কথাটা শুনে মাতব্বর আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তাকে এ্যারেস্ট করেছেন?

খবর পেয়ে দু’জন পুলিশ নিয়ে সেখানে গিয়ে লোকটাকে পেয়েও এ্যারেস্ট করতে পারি নি।

এ্যারেস্ট করতে পারলেন না কেন?

ঘটনাটা বলছি শুনুন। লোকটার সন্ধান করার জন্য আমি যে কয়েকজন লোক লাগিয়েছি, তাতো আপনাকে বলেছি। আজ সকাল আটটার সময় তাদের একজন এসে জানাল, আপনার বর্ণনা মতো একজন লোককে এই গ্রামের পাশের গ্রামের দিকে যেতে দেখেছে। আমি দু’জন পুলিশ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা দিলাম।

গ্রামের কাছাকাছি গেছি, এমন সময় লোকটাকে ফিরে আসতে দেখে আমরাও তার দিকে এলোলাম। কাছাকাছি হতে লোকটা আমার সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, দারোগা সাহেব যে? কেমন আছেন?

ভালো আছি বলে আমি তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম।

লোকটা বলল, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা। আমার আর কোনো পরিচয় নেই।

বললাম, আপনার পরিচয় জানা আমার খুব দরকার।

 কেন?

 আপনার মতো একজন লোককে আমরা খুঁজছি।

 কেন বলুন তো?

লোকটা বহেরচর গ্রামের মাতব্বরের ছেলে রশিদের একটা হাত কেটে দিয়েছে, আর একটা চোখও তুলে নিয়েছে।

লোকটা মৃদু হেসে বলল, আমাকে দেখে কি মনে হয়, আমিই সেই লোক?

বললাম, নোকমুখে লোকটার যে বর্ণনা পেয়েছি, সেসব আপনার সঙ্গে মিলে গেছে।

লোকটা বলল, ঠিকই বলেছেন। লোকটা অবশ্য আমারই মতো দেখতে। আমি তাকে চিনি এবং কেন সে ঐরকম জঘন্য কাজ করেছে তাও জানি। তবে তার সম্পর্কে যদি কিছু জানতে চান, তা হলে আমি যা করতে বলব, তা করার পর বলব।

বললাম, ঠিক আছে, বলুন কি করতে হবে।

বলল, আপনি একজন শিক্ষিত লোক হয়ে এটা বুঝতে পারছেন না কেন, কেউ শুধু শুধু এরকম জঘন্য কাজ করতে পারে না। নিশ্চয় এর পিছনে বড় কোনো কারণ আছে। আর প্রায় বিশ বাইশ বছর আগে সেই রকম কোনো বড় কারণে মাতব্বর সাহেব পুরুষাঙ্গ হারিয়েছেন। সেই কারণগুলো ওনাদের কাছে থেকে জানুন। তারপর আমিই আপনাকে সেই লোককে এ্যারেস্ট করার জন্য সন্ধান দেব।

তার কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কে আপনি? এর আগে আপনাকে তো কখনও দেখি নি।

বলল, বললাম না, আমি আল্লাহর এক নাদান বান্দা?

আমার ধারণা হল, এই লোকই সেই লোক। তাই সঙ্গের পুলিশ দু’জনকে লোকটাকে এ্যারেস্ট করতে বললাম।

তখন লোকটা ঝোলা থেকে একমুঠো বালি নিয়ে আমাদের চোখে মুখে ছুঁড়ে দিয়ে হো হো করে হাসতে লাগল।

আমরা চোখ মুখ পরিষ্কার করে দেখি লোকটা নেই। মনে হল বাতাসে মিলিয়ে গেছে। হতভম্ব হয়ে চারদিকে দেখতে লাগলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম, অনেক দূর থকে লোকটা যেন বলছে, যা জানতে বললাম জানুন, জানার পর আমি নিজে এসে অপরাধীকে ধরার ব্যবস্থা করে দেব।

শব্দটা আসছিল মাঠের দিক থেকে। আমরা সেদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু তার গলার শব্দ পেলাম, আহত রশিদের বুকের উপর ঢিল চাপা দেয়া একটা কাগজ ছিল। সেই কাগজটা মাতব্বর সাহেবের কাছে। আছে। তাতে লেখা আছে কেন লোকটা রশিদের এরকম অবস্থা করল।

এখন আপনারা যদি ঘটনার কারণটা বলেন ও সেই কাগজটা দেন, তা হলে আসামীকে ধরতে পারতাম।

মাতব্বর চিন্তা করলেন, আসামীকে ধরার জন্য থানায় কেস করা উচিত হয় নি। তাড়াতাড়ি বললেন, ঘটনার কারণ জানা থাকলে থানায় কেস দিতাম না। আমি নিজেই আসামীকে ধরে যা করার করতাম। আপনারা আসামীকে ধরে তার কাছ থেকে যা কিছু জানার জানবেন। আর কাগজের কথা যে বললেন, তা ঠিক নয়। আমার কাছে কোনো কাগজ নেই। আমার বিশ্বাস যে লোক আপনাদের চোখে বালি ছুঁড়ে পালিয়ে গেল, সেই আসামী। ভালো করে খুঁজলে তাকে ধরতে পারতেন।

দারোগা বললেন, বললাম না, আমারও মনে হয়েছিল ঐ লোকটা আসামী? তাইতো পুলিশ দু’জনকে এ্যারেস্ট করতে বলেছিলাম। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, এ্যারেস্ট করতে পরি নি। তবে একথা ঠিক, কতদিন আর পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে থাকবে? একদিন না একদিন ধরা পড়তেই হবে। ঐ যে কথায় আছে, চোরের দশদিন আর গৃহস্থের একদিন। আচ্ছা, এখন আসি তা হলে বলে সালাম বিনিময় করে দারোগা চলে গেলেন।

বাপবেটা দু’জনেই দারোগার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আড়াল হয়ে যেতে মাতব্বর বললেন, মনে হচ্ছে দারোগা গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছে।

রশিদ বলল, গ্রামের কারো সাহস হবে না আমাদের কথা দারোগাকে জানাতে। তবে আযীয সেখের সঙ্গে দারোগার খুব খাতির শুনেছি। সে হয়তো জানাতে পারে।

হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। শুনলাম, লোকজন তাকে মাতব্বর করার জন্য শলাপরামর্শ করছে।

কথাটা শুনে তুমি চুপ করে রয়েছ কেন? থানায় গিয়ে টাকা দিয়ে দারোগাকে হাত করো। তাকে দিয়েই আযীয সেখকে ঢিড করতে হবে।

দারোগা যখন লোকজনকে চলে যেতে বলেন তখন মাতব্বর চামচা শাকিলের কানে কানে বলেছিলেন, “সায়রা কোথায় যায় জেনে এসে বলবি।” তাকে আসতে দেখে ছেলেকে বললেন, চুপ কর, শাকিলকে একটা কাজে পাঠিয়েছিলাম, কি বলে শুনি।

শাকিল কাছে এসে বলল, সায়রা আযীয সেখের সঙ্গে তাদের ঘরে গেল। এতক্ষণ অপেক্ষা করেও বেরোতে দেখলাম না। মনে হয় ওখানে থেকেই স্বামীর ভিটেয় মাদ্রাসা তৈরির কাজ করবে।

মাতব্বর বললেন, ঠিক আছে, তুই এখন যা।

শাকিল চলে যাওয়ার পর রশিদ দাঁতে দাঁতে চেপে খুব রাগের সঙ্গে বলল, সায়রা, তখন আমি ছোট ছিলাম বলে পালাতে পেরেছিলি, এবার তোকে জ্যান্ত করব দেব।

মাতব্বর রেগে উঠে বললেন, এসব কি বলছিস? সাফিয়ার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়ে একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েছিস, সায়রার কিছু করতে গেলে বাকি হাত ও চোখ হারাবি। আর দারোগা জানতে পারলে তোকে ফাঁসিতে ঝোলাবার ব্যবস্থা। করবে।

তুমি টাকা দিয়ে দারোগাকে আগে বস করো, তারপর দেখ, আমি সায়রার কি করি।

এতদিনে দারোগাকে যতটা বুঝেছি তাতেই মনে হয়েছে বিশ পঞ্চাশ হাজার নয়, লাখ টাকা দিলেও বসে আসবে না। তুই মাথা গরম করিস না। আমাকে চিন্তা করতে দে।

তোমাকে সাফিয়ার ব্যাপারটা কে বলেছে?

কেউ বলে নি। ঘটনার কয়েকদিন পর জয়নুদ্দিন একটা কাগজ আমার হাতে দিয়ে বলল, এটা মিয়া ভাইয়ের বুকের উপর একটা ঢিল চাপা দেয়া ছিল। কাগজটায় তোর অপকীর্তির কথা লেখাছিল।

তাই না কি? তা হলে ঐ লোকটা দারোগাকে ঠিক কথাই বলেছে?

হ্যাঁ, ঠিক কথাই বলেছে। তাইতো দারোগাকে উল্টো সিধে বলে বোঝালাম।

এখন তা হলে কি করবে? আযীয সেখ ও সায়রা আমাদের মান-ইজ্জৎ ডুবিয়ে দেবে আর আমরা চুপ করে বসে থাকব?

তা থাকব না, কিছু একটাতো করতেই হবে। তবে খুব ভাবনা-চিন্তা করে করতে হবে। তাই তো তোকে মাথা গরম করতে নিষেধ করলাম।

দারোগাকে হাত করতে না পারলে আমাদের কোনো আশাই পূরণ হবে না। কাল সকালে থানায় গিয়ে মোটা টাকা দিয়ে হাত করার চেষ্টা করো।

কথাটা অবশ্য তুই ঠিক বলেছিস; কিন্তু দারোগার টাকার লোভ নেই।

তবু তুমি চেষ্টা কর। যদি একলাখ চায়, রাজি হয়ে যেও। কথা শেষ করে রশিদ সেখান থেকে চলে গেল।

মাতব্বর সারাদিন চিন্তা করেও কি করবেন না করবেন ঠিক করতে পারলেন না। একলাখ টাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তাতেও যদি দারোগা রাজি না হয় তখন কি করবেন?

রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর বারান্দায় বসে ছেলের সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলেন, কাল থানায় গিয়ে একলাখ টাকা দিয়ে দারোগাকে হাত করবেন। আলাপ করতে করতে এগারটা বেজে গেল।

আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোতে চারপাশ দিনের মতো হয়ে আছে। আলাপ শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য বাপ বেটা উঠে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় রশিদ দেখতে পেল, উঠোনের মাঝখানে লম্বা চওড়া সাদা পোশাকে ঢাকা একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে?

লোকটা কোনো সাড়া না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ছেলের কথা শুনে মাতব্বরও তাকে দেখতে পেয়ে বললেন, কথা বলছ না কেন? কে তুমি?

লোকটা বলল, আমি জিন।

জিন শুনে রশিদ খুব ভয় পেয়ে কাঁপতে লাগল। সে শুনেছে, জিনেরা মানুষের ক্ষতি করে বেড়ায়।

মাতব্বর বয়স্কলোক। ভয় পেলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, এখানে এসেছ কেন?

আপনাদের বাপ বেটাকে কঠিন শাস্তি দিতে।

আমরা তো তোমার কোনো ক্ষতি করি নি, তবু শাস্তি দিতে এসেছ কেন?

 আমার ক্ষতি না করলেও গ্রামের গরিবদের অনেক ক্ষতি করেছেন।

না, আমরা কারো কোনো ক্ষতি করি নি। বরং দুঃসময়ে টাকা পয়সা দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করি।

যতটুকু সাহায্য করেন তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি করেন।

কার কি ক্ষতি করেছি বলতে পারবে?

কেন পারব না? মঈন সেখের বিধবা স্ত্রী সায়রার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়েছিলেন, সেটা বুঝি ভালো কাজ? অবশ্য সেজন্য আপনাকে পুরুষাঙ্গ হারাতে হয়েছে। সুস্থ হয়ে ল্যাংড়া চামচিকা ফজলু ভিখেরির সাথে সায়রার দুর্নাম রটিয়ে তার সাথে নিকে দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্য সায়রা সাত বছরের ছেলে হালিমকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। মঈন সেখের ভিটে দখল করে গাছপালা লাগিয়ে ভোগ করছেন। গ্রামের সুন্দরী বৌ, ঝি নজরে পড়লে তাদের ইজ্জৎ লুটেছেন। আপনার ছেলে ঐ রশিদও অনেক বৌ-বেটির ইজ্জৎ নষ্ট করেছে। সাফিয়ার ইজ্জৎ লুঠতে গিয়ে একটা হাত ও একটা চোখ হারিয়েছে। এখন আবার দারোগাকে একলাখ টাকা দিয়ে হাত করে সায়রা ও আযীয সেখকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাপ বেটায় আরো যে কতকিছু করেছেন, সেসব বলতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। এতদিন আপনাদের অত্যাচার সহ্য করলেও আর পারছি না। তাই যাতে আর কারো কোনো ক্ষতি করতে না পারেন, সেজন্য বাপ বেটার ঘাড় মটকে দিতে এসেছি।

জিনের কথা শুনে রশিদ ভয়ে বাপকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এবারের মতো মাফ করে দাও। আমরা আর কারো এতটুকু ক্ষতি করব না।

জিনের কথা শুনে মাতব্বরও এবার খুব ভয় পেলেন। তিনি কাকুতি মিনতি করে ছেলের মতো একই কথা বললেন।

জিন বলল, মানুষ খুব বেঈমান। তারা কথা দিয়ে কথা রাখে না। আমি আপনাদের কথা বিশ্বাস করি না। এখন জান বাঁচাবার জন্য যে কথা বলেছেন, কয়েকদিন পর তা ভুলে যাবেন। তাই আপনাদের ঘাড় মটকে দিয়ে চলে যাব।

এই কথা শুনে রশিদ জ্ঞান হারিয়ে বারান্দার মেঝেয় পড়ে গেল। আর মাতব্বর কাকুতি মিনতির সঙ্গে আল্লাহর কসম খেয়ে বললেন, ওয়াদা করছি, আমরা আর কোনো দিন কারো এতটুকু ক্ষতি করব না। যদি যদি করি, তা হলে তোমার যা ইচ্ছা তাই করো।

জিন বলল, আল্লাহর কসম খেয়ে যখন ওয়াদা করলেন তখন মাফ করে দিলাম। কিন্তু মনে রাখবেন, ওয়াদা ভঙ্গ করলে আপনাদের ঘাড় মটকে দেবই। সেদিন কোনো অজুহাত শুনব না। তারপর সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় বলল, রশিদের এই অবস্থা আমিই করেছি। দুনিয়া চষে ফেললেও কেউ আমার খোঁজ পাবে না।

.

০৬.

বিশ বাইশ বছর আগে সায়রা সাত বছরের হালিমকে নিয়ে গ্রাম থেকে পালিয়ে আসার সময় ভাবল, ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকবে। গতর খাঁটিয়ে ছেলেকে মানুষ করবে। হঠাৎ তার মনে হল, ভাইয়ের বাড়ি বেশি দূরে নয়। মাতব্বর জানতে পারলে লোক পাঠিয়ে ধরে নিয়ে এসে হয় ফজলুর সঙ্গে নিকে দেবে। আর তা না হলে সেই লোকদের বলবে ইজ্জৎ লুঠে নিয়ে গলাটিপে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। কথাটা মনে হতে ভাইয়ের বাড়ির পথ বদলে বাস বাস্তার পথ ধরল। ঘণ্টা দুই হাঁটার পর বাস রাস্তায় উঠে পটুয়াখালী শহরের দিকে হাঁটতে লাগল। যখন শহরে এসে পৌঁছাল তখন মসজিদে ফজরের আজান হচ্ছে।

আসার সময় ক্লান্ত হয়ে পথে অনেক জায়গায় বিশ্রাম নিয়েছে। এক জায়গায় বিশ্রাম নেয়ার সময় হালিমতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। সায়রা তাকে জাগিয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করে এসেছে। তাই শহরের পৌঁছে রাস্তার ধারে একটা বাড়ির খোলা বারান্দায় বিশ্রাম নিতে গিয়ে মায়ে পুতে ঘুমিয়ে পড়ল।

কারো ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে যেতে সায়রা দেখল, একজন বয়স্ক মহিলা ঝাড় হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

তাকে জাগতে দেখে মহিলাটি বলল, কে তুমি? এখানে ঘুমিয়েছিলে কেন? যাও এখান থেকে।

সায়রা বলল, আমি গ্রাম থেকে এসেছি কারো বাড়িতে কাজ করব বলে।

 মহিলা জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কে?

 আমারই ছেলে।

 ওর বাবা নেই?

না, পাঁচ ছ’মাস হল মারা গেছে। মারা যাওয়ার পর খুব কষ্টে দিন কাটছিল। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ছেলেকে নিয়ে কাজের চেষ্টায় এসেছি। আমাকে আপনি রাখবেন? সংসারের সবকাজ আমি করব।

মহিলা মুখ ঝামটা মেরে বলল, না রাখব না। তোমার মতো সুন্দরী স্বাস্থ্যবতী কাঁচা বয়সের মেয়েকে ঘরে রাখা মানে খাল কেটে কুমীর আনা। তোমাকে দেখলেই আমার স্বামীর মাথা ঘুরে যাবে। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।

আমরা কাল থেকে কিছু খাই নি। বাসি কিছু থাকলে ছেলেটাকে অন্তত কিছু দিন। আল্লাহ আপনার ভালো করবে।

মহিলার স্বামী ডায়বেটিস রুগী। ডাক্তারের কথামতো প্রতিদিন ভোরে এক দেড় ঘণ্টা হাঁটেন। আজও হাঁটতে গেছেন। সায়রা বাসি খাবার চাইতে ভাবল, স্বামীর ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফিরে এসে এর কথা জেনে যদি কাজ করার জন্য রাখতে চায়। তাই বাসি খাবার দেয়ার ইচ্ছা থাকলেও বলল, না, ঘরে বাসি খাবার কিছু নেই। তুমি ছেলেকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও।

সায়রা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে হালিমকে জাগাল। তারপর একটা হাত ধরে অন্য হাতে কাপড়ের পুঁটলি নিয়ে বাড়িবাড়ি ঘুরতে লাগল কাজের চেষ্টায়। কিন্তু তার রূপ ও কাঁচা বয়স, তার উপর সাত বছরের ছেলেসহ কেউ কাজে রাখতে চাইল না। তবে কেউ কেউ তাদেরকে খেতে দিয়েছে।

এভাবে দিনের বেলা কাজের চেষ্টা করে আর রাতে কারো বাড়ির বারান্দায় ঘুমায়। আজ যে বাড়ির বারান্দায় ঘুমিয়েছিল, সেই বাড়ির মালিক আবু তাহের। উনিই বাহেরচর গ্রামের মুসার ভাইরা। তিনি মসজিদে ফজরের নামায পড়তে যাওয়ার সময় তাদেরকে দেখে ভাবলেন, আল্লাহর কুদরত বোঝা মানুষের অসাধ্য। কেউ পাকা বাড়িতে খাটের উপর গদীতে ঘুমায়, আবার কেউ রাস্তা ঘাটে মাটিতে ঘুমায়। কেউ মাছ-গোস, পোলাও-কোর্মা খাচ্ছে, আবার কেউ না খেতে পেয়ে অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছে। আবার কেউ না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। প্রায় প্রত্যেক দিন তিনি কোনো না কোনো ভিক্ষুককে এখানে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন। আজও সেরকম মনে করে মসজিদে চলে গেলেন। রাস্তার লাইট পোেস্ট বেশ দূরে। তা ছাড়া ওনার বাড়ির সামনে একটা বড় লিচু গাছ থাকায় বারান্দাটা অন্ধকার। তাই ভিক্ষুকের জায়গায় একটা মেয়ে যে তার ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে, তা বুঝতে পারলেন না।

আবু তাহের নামাযের পর কুরআন তেলাওয়াত করেন। তারপর এশরাকের নামায পড়ে ফেরেন। প্রতিদিনকার মতো আজও ফিরে এসে ভিক্ষুককে জাগাতে গিয়ে সায়রাকে চিনতে পারলেন।

এখন বেশ একটু বেলা হয়েছে। তাছাড়া সায়রা মুখে কাপড় ঢেকে ঘুমালেও ঘুমের ঘোরে খুলে গেছে।

বিচারের দিন ঘরে এসে ভাইরা মুসার মুখে মাতব্বরের স্বভাবের কথা ও সায়রা যে তার পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছিল এবং প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মাতব্বর যে বিচারের প্রহসন করেছিলেন, সেসব শুনেছিলেন। প্রমাণ করার জন্য সায়রা যখন মুখের নেকাব খুলেছিল তখন তাকে দেখেছিলেন। ঐ দিন যে ছেলেকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে, তাও পরের দিন ভাইরার মুখে শুনেছেন। তাই তাকে চিনতে না পেরে ভাবলেন, তা হলে মেয়েটা ছেলেকে নিয়ে এখানে পালিয়ে এসেছে? মা ও ছেলের মলিন মুখ দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। ছেলেটার গায়ে হাত দিয়ে জাগিয়ে বললেন, তোমার মাকে জাগাও।

হালিম মাকে জাগিয়ে বলল, আম্মা ওঠো, অনেক বেলা হয়ে গেছে।

সায়রা একজন দাড়ি টুপিওয়ালা লোককে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে উঠে বসল। তারপর পুঁটলিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, চল।

আবু তাহের বললেন, তুমি আমাকে না চিনলেও আমি তোমাকে চিনি। বাহেরচরের মরহুম মঈন সেখের স্ত্রী না তুমি?

সায়রা বলল, জি।

তোমাদের গ্রামের মুসা আমার ছোট ভাইরা। তোমার বিচারের সময় আমি তার সঙ্গে ছিলাম। ঐ রাতেই তুমি গ্রাম ছেড়েছ, তা পরের দিন শুনেছি। মুসার কাছে তোমার ও তোমার প্রতি মাতব্বরের অত্যাচারের কথাও শুনেছি। মাতব্বর মানুষ নয় পশু। গ্রাম ছেড়ে এসে ভালই করেছে। এখানে এসে যে বিপদে পড়েছ, তা বুঝতে পারছি। মানুষের বিপদে সাহায্য করা প্রত্যেকের উচিত। তুমি মেয়ে মানুষ, তোমার বয়স কাঁচা। এখানে পদে পদে বিপদ। বিপদগ্রস্থ মানুষকে সাহায্য করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) খুশী হবেন। তাই আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। আমাকে বাপ-চাচার মতো মনে করে আমাদের বাড়িতে থাক। মনে হচ্ছে, এই তিন চার দিন তোমাদের তেমন খাবার জোটে নি। ঘরে চল, কিছু খাওয়ার পর যা বলার বলল।

আবু তাহেরের কথা শুনে সায়রা মুখ নিচু করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে ভাবল, বিচারের সময় পাথর মারার বিরুদ্ধে ইনিই তা হলে প্রতিবাদ করেছিলেন। শহরে এরকম লোক আছে ভেবে অবাক হল।

মাকে চুপ করে কাঁদতে দেখে হালিম বলল, চল না মা, লোকটা খেতে দেবে বলছে। আমি যে আর ভুখ সহ্য করতে পারছি না।

আবু তাহের হালিমকে বললেন, আমি তোমার নানা হই। মাকে সাথে করে নিয়ে এস। তারপর ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে সংক্ষেপে সায়রা ও হালিমের পরিচয় বলে বললেন, ওদেরকে ডেকে নিয়ে এসে কিছু খেতে দাও।

আবু তাহেরের স্ত্রী ফারযানা বেগম এস,এস, সি পাশ হলেও আলেম স্বামীর সংস্পর্শে আলেমা হয়ে গেছেন। তাই স্বামীর কথা শুনে বেরিয়ে এলেন। সায়রাকে কাঁদতে দেখে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেঁদে আর কি করবি মা, সবই তকুদীর। তারপর তাদেরকে ঘরে নিয়ে এসে কলতলা দেখিয়ে বললেন, হাত মুখ ধুয়ে আয়, আমি তোদের খাওয়ার ব্যবস্থা করি।

ফারযানা বেগম স্বামীর কাছে সায়রার সম্পর্কে অল্প কিছু শুনে তার বিপদের কথা আঁচ করতে পেরেছিলেন। খাওয়ার পর সায়রার কাছে বিস্তৃত শুনে বললেন, আমাদের কোনো ছেলে সন্তান আল্লাহ দেন নি। দু’টো মেয়ে দিয়েছিলেন। বড়টা ছোট বেলায় পানিতে ডুবে মারা গেছে। ছোটটা বিয়ের পর ছেলেপুলে হওয়ার আগে মারা গেছে। এটা গ্রাম নয় যে কারো বাড়িতে কাজ করে পেটের ভাত জোগাবি। এটা শহর। এখানকার মানুষের দয়া মায়া কম। তা ছাড়া শহরের লোকজনের চরিত্রও ভালো না। কারো বাড়িতে কাজ পেলেও সুযোগ পেলে তোর ইজ্জতের উপর হামলা করবে। আল্লাহ যখন তোদেরকে আমাদের কাছে এনে দিয়েছে তখন এখানেই থাক। আমাদের কাছে মেয়ের মতো থাকবি। তোর ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করব।

অকূল সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে ডুবে যাওয়ার আগে পায়ে মাটি ঠেকলে যেমন বাঁচার আনন্দে আনন্দিত হয়, ফারনা বেগমের কথা শুনে সায়রারও তাই হল। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে তার দু’পা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল; কোথায় আর যাব আম্মা, আপনারা ছাড়া আমার যে আর জায়গা নেই। আমি আপনাদের মেয়ে হয়েই থাক।

তার কথা শুয়ে ফারযানা বেগমের চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তোদেরকে পেয়ে কত যে খুশী হয়েছি তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তারপর সায়রার চোখ মুছে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলের কি নাম রেখেছিস?

হালিম।

হালিম আল্লাহর গুণবাচক নাম। শুধু ঐ নাম রাখতে নেই। তাই আজ থেকে ওর নাম আব্দুল হালিম। যার অর্থ হল আল্লাহর গোলাম। তারপর হালিমকে বললেন, তুই আমাকে নানি ডাকবি আর ওনাকে নানা ডাকবি। আমরা তোকে লেখাপড়া করাব।

হালিম যখন পাড়ার ছেলেমেয়েদের বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেত দেখত তখন তারও খুব ইচ্ছা হত বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যেতে। একদিন মাকে সেকথা বলেছিল। সায়রা বলেছিল, গরিবের ছেলের আবার লেখাপড়া। তোর বাপ দু’বেলা পেটের ভাত যোগাড় করতে পারে না, তোর বই খাতা কিনে দেবে কি করে?

এখন লেখাপড়া করাবার কথা শুনে হালিম খুশী হয়ে বলে উঠল, সত্যি বলছ নানি?

ফারযানা বেগম বললেন, হ্যাঁরে সত্যি। তোর নানাকে বলব তোকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিতে।

সায়রা বলল, আমি আপনাদের আম্মা আব্বা বলে ডাকব। আপনাদের কাছে। আমিও লেখাপড়া করব।

তার কথা শুনে ফারনা বেগমের চোখে আবার পানি চলে এল। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বললেন, মেয়ে হিসাবে যখন গ্রহণ করেছি তখন তো আমাদেরকে আম্মা আব্বা বলবি। মেয়েকে কি আর আমরা মুগ্ধ করে রাখব? তোকে আমরা সব বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলব।

সায়রা ফারযানা বেগমের পায়ে হাত ছুঁয়ে সালাম করে বলল, দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমাকে আপনাদেকে আজীবন সেবা করার সুযোগ দেন।

.

আবু তাহের ও ফারযানা বেগমের হৃদয়ে সন্তানের জন্য যে আগুন জ্বলছিল, সায়রা ও হালিমকে পেয়ে আল্লাহ সেই আগুনে যেন পানি ঢেলে দিলেন।

আবু তাহের হালিমকে মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিলেন। আর ফারযানা বেগম অবসর সময়ে সায়রাকে আরবি, বাংলা ও ইংরেজি শেখাতে লাগলেন। সেই সাথে মা বেটাকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে অনুসরণ করাতে লাগলেন।

মা ও ছেলের মেধা ভালো। তাই সায়রা ফারযানা বেগমের কাছে লেখা পড়া করে ক্রমশ আলেমা হয়ে উঠতে লাগল। আর আবু তাহেরের প্রচেষ্টায় হালিম প্রতি বছর ফাস্ট হয়ে একের পর এক উপরের ক্লাসে উঠতে লাগল।

সায়রা ছোটবেলা থেকে সুন্দরী। পনের ষোল বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর আরো সুন্দরী হয়ে ওঠে। বিয়ের দু’বছরের মধ্যে হালিম জন্মাবার পর ও সংসারের অভাব অনটের জন্য চেহারার জৌলুস কমে গিয়েছিল। আবু তাহেরে বাড়িতে ভালো খেয়ে ভালো পরে ও নিশ্চিতে থাকার ফলে বছর খানেকের মধ্যে তার চেহারার জৌলুস অনেক বেড়ে গেল। এখন তার বয়স পাঁচিশ ছাব্বিশের মতো। কিন্তু অচেনা কেউ দেখলে মনে করবে এখনও তার বিয়ে হয় নি।

সবকিছু দেখে শুনে ফারযানা বেগম একদিন স্বামীকে বললেন, সায়রার আবার বিয়ে দেয়া উচিত। কতই বা বয়স? আজকাল ওর বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে।

আবু তাহের বললেন, আমার মনের কথা আল্লাহ তোমার মুখ দিয়ে বলালেন। কথাটা আমিও তোমাকে বলব বলব করেও বলা হয় নি। তুমি ওকে বলে দেখ কি বলে। হালিম আমাদের কাছেই থাকবে। ওকে মস্ত বড় আলেম করার ইচ্ছা করেছি, বাকি আল্লাহর মর্জি।

ফারযানা বেগম একদিন সায়রাকে স্বামীর ইচ্ছার কথা জানিয়ে বললেন, আমারও তাই ইচ্ছা। আমাদের ভুল বুঝবি না। আমরা তোর ভালোর জন্য কথাটা বললাম, নিজের পেটের মেয়ে হলেও তাই করতাম।

সায়রা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল, কোনো কারণেই আমি আপনাদের ভুল বুঝব না। আপনারা যে আমার ভালো চান, তা জানি। কিন্তু আম্মা কিছুতেই আমি আর বিয়ে করব না। আপনারা আশ্রয় দিয়ে যে উপকার করেছেন, সারাজীবন আপনাদের সেবা যত্ন করলেও তার। প্রতিদান হবে না। তবু আজীবন তাই করে যাব। এখানে আসার পর হালিমকে। নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না। আপনারা দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার স্বপ্ন পূরণ করেন। আপনারা যা বলবেন, জান দিয়ে হলেও তা করব। শুধু বিয়ের কথা বলবেন না। আপনি আব্বাকে আমার কথাগুলো জানিয়ে বলবেন, আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারলাম না বলে মাফ চাইছি। তারপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

ফারজানা বেগম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কাঁদিস না মা, কাঁদিস না। তোর কাঁচা বয়সের কথা চিন্তা করে আমরা তোর আবার বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। তুই যখন চাচ্ছিস না তখন আর তোর অমতে কিছু করব না। হালিমকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখেছিস বলতো শুনি।

হালিমকে আমি এমনভাবে মানুষ করতে চাই, যেন বাহেরচর গ্রামের মাতব্বর বা তার মতো আর কেউ যেন গরিবদের উপর এতটুকু অত্যাচার করতে না পারে, কোনো বৌ-বেটি যেন তাদের হাতে ইজ্জৎ না হারায়। সবাই যেন শান্তিতে বাস করতে পারে। বলুন আম্মা, আপনারাও কি তাই চাইবেন না?

ফারযানা বেগম বললেন, নিশ্চয় চাইব। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোর মনের আশা পূরণ করেন। তোর আব্বাকেও দোয়া করতে বলব।

রাতে ঘুমাবার সময় ফারযানা বেগম স্বামীকে সায়রার বিয়েতে অমতের ও তার স্বপ্নের কথা বললেন।

আবু তাহের বললেন, ওর উদ্দেশ্য মহৎ। আল্লাহ বান্দাদের মহৎ উদ্দেশ্য পূরণ করেন। দোয়া করি, তিনি যেন ওর স্বপ্ন সফল করেন।

.

হালিম কামিলে খুব ভালো রেজাল্ট করে একদিন মা ও নানা-নানিকে জানাল, ঢাকায় গিয়ে ইংলিশে অনার্স করবে।

সায়রা ছেলেকে তার স্বপ্নের কথা আগেই জানিয়েছিল। তাই ঢাকায় পড়তে যাওয়ার কথা শুনে সবার আগে বলে উঠল, আর পড়াশুনা করার দরকার নেই। এবার আমার স্বপ্ন পূরণ করার কথা চিন্তা কর কিভাবে কি করবি।

হালিম বলল, আম্মা স্বপ্ন শুধু তুমি দেখ নি, আমিও দেখেছি। তখন ছোট ছিলাম, তবু কিছু বুঝতে শিখেছিলাম। তাই গ্রাম ছেড়ে আসার সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, বড় হয়ে যেমন করে তোক তোমার প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নেব। আর গ্রামের গরিব লোকদের মাতব্বরের অত্যাচার থেকে রক্ষা করব। গ্রামে ফিরে সে সব করার উপযুক্ত এখনও হই নি। উপযুক্ত হওয়ার জন্য আমাকে অনেক কিছু শিখতে হবে। ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনার সাথে সাথে সেসব শিখব। সবাই দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকে কামিয়াব করেন।

ফারযানা বেগম বললেন, আর নানা-নানির স্বপ্ন পূরণ করিব না?

হালিল বলল, নিশ্চয় করব। আপনারা মুরুব্বী। আপনাদের স্বপ্ন পূরণ করলে আল্লাহ খুশী হবেন। আপনাদের কি স্বপ্ন বলুন।

আমরা কতদিন থেকে স্বপ্ন দেখছি। কামিল পাশ করার পর তুই উপার্জন করবি, আমরা তোর বিয়ে দিয়ে লাল টুকটুকে নাতবৌ নিয়ে আসব।

কথাটা শুনে সায়রা ও আবু তাহেবের মুখে হাসি ফুটে উঠল।

আর হালিম লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেন্ড মুখ নিচু থেকে বলল, আপনাদের স্বপ্নও ইনশাআল্লাহ পূরণ করব। তবে তার আগে আম্মার স্বপ্ন পূরণ করার সময় পর্যন্ত আমাকে সময় দিতে হবে।

ফারযানা বেগম মেকী একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) যখন সবার থেকে মায়ের আদেশ মানার প্রধান্য দিয়েছেন তখন সময় তো দিতেই হবে। দোয়া করি, মায়ের স্বপ্ন সফল করার পর আমাদের স্বপ্ন পূরণ করার তওফিক আল্লাহ তোকে যেন দেন। সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, আমিন।

<

Super User