নাদিম তার চাচাত ছোট মামা ফজলুলের সঙ্গে পড়ে। ফজলুল নাদিমের চেয়ে তিন-চার বছরের বড়। কিন্তু সে প্রতি ক্লাসে এক বছর করে ফেল করে করে যে বছর। ক্লাস এইটে ফেল করল, সেই বছর নাদিম ক্লাস এইটে উঠল। মামা ভাগ্নে হিসাবে আগে যতটা সুসম্পর্ক ছিল, ক্লাস এইটে উঠে সেটা আরো বেড়ে গেল। তার মুখে নাদিম নওশের খালুর পরিবর্তনের কথা শুনে ফজলু মামার সাথে দুতিন বার তাদের বাড়িতে তাকে দেখতে গিয়েছিল। নাদিম যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন তার এই নওশের খালু একবার তাদের বাড়িতে এসেছিল। সেদিন নাদিম স্কুল থেকে ফিরে নওশের খালুকে দেখে কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, খালু কেমন আছেন?

নওশের সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। তা বাবাজী স্কুল থেকে এলে মনে হচ্ছে, কোন ক্লাসে পড়?

ক্লাস নাইনে।

আলহামদুলিল্লাহ, বেশ ভাল, শুনে খুশি হলাম। এমন সময় আযান শুনে বলল, তুমি তো নামায পড়; মসজিদে চল-আযান হচ্ছে।

নামায পড়ে নাদিম তাকে বলল, খালু, আমি আপনাদের ওখানে দুতিনবার গিয়েছি। আপনার ডিসপেনসারীতে অনেক বাংলায় হাদিসের বই দেখেছি। আমাকে পড়তে দেবেন?

নওশের বলল, হাদিস পড়বে এটা তো খুব ভাল কথা, দেব না কেন? তুমি মাঝে মাঝে গিয়ে নিয়ে এসে পড়।

তারপর থেকে নাদিম স্কুলে যাওয়ার নাম করে খালুর কাছে গিয়ে সারাদিন ডিসপেনসারীতে বসেবসেহদিস পড়ত। বিকেলে স্কুল ছুটির সময় নিয়মিত ঘরে ফিরে আসত।

নাদিমের বাড়ি থেকে প্রায় পনের-বিশ মাইল দূরে মহেশবাথানে নওশেরের ডিসপেন্সারী। বাসে করে নাদিম যাতায়াত করে। সারেংপুর গ্রামের ভিতর থেকে বাস রাস্তা গেছে। প্রথম প্রথম নাদিম মায়ের কাছ থেকে বাস ভাড়া চেয়ে নিত তখন বাসের ভাড়া কম ছিল।

প্রতিদিন ছেলেকে পয়সা চাইতে দেখে তার মা আফ্রিদা একদিন জিজ্ঞেস করল, রোজ রোজ পয়সা দিয়ে কি করিস?

নাদিম কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে রইল।

আফ্রিদা বলল, কি রে, কিছু বলছিস না কেন? স্কুলে যা, আজ পয়সা হবে না।

এরপর থেমে নাদিম স্কুলের বেতন না দিয়ে সেই টাকায় বাস ভাড়া দিয়ে নওশের খালুর কাছে হাদিস পড়তে যেত। বছরের শেষে বার্ষিক পরীক্ষার সময় গভীর রাতে গোপনে গোলা থেকে ধান পেড়ে পাড়ার একজনের কাছে বিক্রি করে স্কুলের বেতন পরিশোধ করল। কিন্তু পরীক্ষায় পাস করতে পারল না। সারা বছর স্কুলে যায়নি। তার উপর ভাল করে পড়াশোনাও করেনি, পাস করবে কি করে। নাদিমের রেজাল্ট শুনে ঘরের সবাই অবাক হয়ে গেল। সে ফেল করবে এটা কেউ ভাবতে পারল না। বাপ চাচারা রাগারাগি করল।

আফ্রিদা ছেলেকে তেমন কিছু বলল না। বরং ছেলের মন খারাপ দেখে বলল, ফেল করেছিস তো কি হয়েছে, এবার ভাল করে লেখাপড়া কর, যাতে করে সামনের বছর স্ট্যান্ড করতে পারিস।

নাদিম কিন্তু ঘরের কারুর কথায় কান দিল না। এ বছরও স্কুলে যাওয়ার নাম করে নওশের খালুর কাছে গিয়ে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে লাগল। ফলে এ বছরও সে ফেল করল।

এবার তার বাপ চাচারা তার সাথে ভীষন রাগারাগি করল, শুধু মারতে বাকি রাখল। নাদিমের ছোট চাচা স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতা দেখে এসে ভাইদের জানাল, নাদিম গত দুবছর স্কুলে যায়নি বললেই চলে। তারা তখন নাদিমকে জিজ্ঞেস করল, তুই স্কুলে যাওয়ার নাম করে কোথায় যাস?

নাদিম কোন উত্তর করল না।

অনেক বকাবকি করেও যখন তার কাছে কোন উত্তর পেল না। তখন তারা খোঁজ নিতে লাগল, নাদিম তা হলে কোথায় যায়?

এর মধ্যে নাদিমের সমস্ত শরীরে চাকাঁচাকা দাগ ও খোস-পাঁচড়া হল। সকলের ধারণা হল সে নিশ্চয় কোন নিষিদ্ধ পল্লীতে যায়। তাই তার শরীরে পার ফুটেছে। তার মা আফ্রিদা কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করল না। একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করল, তুই স্কুলে না গিয়ে কোথায় যাস আমাকে বল, আমি তোকে কিছু বলব না। তাকে চুপ করে। থাকতে দেখে আবার বলল, তুই যদি আমার পেটে হয়ে থাকিস, তা হলে আমার কথার। জবাব দে।

নাদিম বলল, নওশের খালুর কাছে।

আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে বলল, কেন?

কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে।

কি বলছিস তুই।

হ্যাঁ আম্মা, খালুর আলমারী ভর্তি হাদিসের বই। আমি এই দুবছরের মধ্যে বহু হাদিস পড়ে ফেলেছি।

হাদিস পড়া ভালো। কিন্তু তোকে স্কুল কামাই করে স্কুলের পড়া না পড়ে হাদিস পড়তে কে বলেছে?

কেউ বলেনি, আমি নিজেই তার কাছে গিয়ে পড়ি।

তুই যে স্কুল কামাই করে যাস, তোর খালু কিছু বলে না?

না।

আফ্রিদার চাচাতো বোনের স্বামীর উপর খুব রাগ হল। চিন্তা করল, অমন জ্ঞানী গুণী আল্লাহওয়ালা লোক হয়ে নাদিমকে কিছু বলেনি কেন? তা হলে এর ভিতরে কি কোন রহস্য আছে? নাদিমকে বলল, আর কোনদিন যাবি না। আগে লেখাপড়া শেষ। কর তারপর হাদিস-কালাম পড়বি।

নাদিম প্রায় দুমাস ভুগে ভাল হল। তারপর আবার নওশের খালুর কাছে যাতায়াত আরম্ভ করল। এবারে ইমাম গাজ্জালী (রঃ)-এর একটা বইয়েতে রেযেক সম্বন্ধে একটা ঘটনা পড়ে তার মাথা খারাপের মতো হয়ে গেল। সব সময় একটা কথা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল, রেযেক যখন আল্লাহপাকের হাতে তখন শুধু মানুষ কেন রুজী রোজগারের জন্য হালাল হারাম বিচার না করে পরিশ্রম করছে? সে সিদ্ধান্ত নিল-স্কুলে পড়ে মাদ্রাসায় পড়বে। রেযেক সম্বন্ধে যে ঘটনাটা নাদিম পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিল, সেটা হল

হযরত মুসা (আঃ) শফর শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে মৃত্যুর ফেরেশতা আজরাইল (আঃ) তাঁকে সালাম দিয়ে পরওয়ানা শোনালেন। হযরত মুসা (আঃ) তখন স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের রিযিকের কথা ভেবে একটু চিন্তিত হলেন। আল্লাহপাক হযরত মুসা (আঃ) এর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। সেই জন্য হযরত মুসা (আঃ)-কে কলিমুল্লাহ বলা হয়। আল্লাহ হযরত মুসা (আঃ) এর চিন্তার কারণ বুঝতে পেরে বললেন, হে মুসা! তোমার হাতে ওটা কি?

হযরত মুসা (আঃ) বললেন, একটা আসা (লাঠি)। আল্লাহ বললেন, তোমার সামনে যে পাহাড়টা রয়েছে তাতে তোমার হাতের আসাটা ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) আসাটা পাহাড়ে ঠেকাতে সেখানে একটা কূয়া হয়ে গেল। আল্লাহ বললেন, আসাটা কূয়ার পানিতে ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) তা করতেই একটা সিন্দুক উঠে এল। আল্লাহ বললেন, সিন্দুকের উপর আসা ঠেকাও। উনি তাই করতে সিন্দুক খুলে গেল, আর তার ভিতরে একটা ছোট পাথর দেখা গেল। আল্লাহ বললেন, ঐ পাথরে আসাটা ঠেকাও। হযরত মুসা (আঃ) পাথরে আসাটা ঠেকাতে দুভাগ হয়ে গেলে সেখানে একটা জীবন্ত ফড়িং দেখা গেল। আর সেই ফড়িং-এর মুখে একখন্ড সবুজ ঘাস। আল্লাহ বললেন, তুমি মৃত্যুর পরওয়ানা পেয়ে স্ত্রী-ছেলেমেয়ে কি খাবে চিন্তা করছ, জেনে নাও, এই ফড়িংটা সাত তবক জমিনের নিচে ছিল। দেখ, তাঁকেও আমি কিভাবে আহার দান করি। এই কথা শুনে হযরত মুসা (আঃ) সিজদায় গিয়ে আল্লাহ পাকের শুকরিয়া আদায় করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

এই ঘটনাটা পড়ে নাদিম ঐ রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবল, আল্লাহ ও তার রসুলকে (দঃ) চিনতে হলে ধর্মীয় বড় বড় বই পড়তে হবে। সে সব বই আরবি ভাষায়। আরবি ভাষা শিখতে হলে মাদ্রাসায় পড়তে হবে। সে এই সিদ্ধান্ত নিলেও সাহস করে কাউকে জানাতে পারল না।

সেই সময় আফ্রিদা অনেকদিন জ্বরে ও পায়খানায় ভুগে দুর্বল হয়ে পড়ে। নাদিমের নানা আকবর আলী বছর পাঁচেক আগে হজ্ব করে আসার মাস খানেক পরে মারা গেছেন। ওনার চার ছেলে, ছয় মেয়ে। মেজ ও সেজ ছেলে এবং এক মেয়ে ছোটবেলায় মারা গেছে। বড় ও ছোট বেঁচে আছে। আকবর আলী খুব ধনী লোক। ছিলেন। তিনি ছেলেদেরকে বি.এ. পর্যন্ত পড়িয়েছেন। আর মেয়েদেরকে ম্যাট্রিক পর্যন্ত। পড়িয়ে বিয়ে দিয়েছেন। দুছেলেই চাকরি করে। ভাইয়েরা বোনের অসুখের কথা শুনে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসে ভালো করে চিকিৎসা করাতে লাগল। নাদিমরা সব ভাইবোন মায়ের সঙ্গে মামাদের বাড়িতে এসেছে। তারা সেখানে থেকে স্কুলে যাতায়াত করতে লাগল।

নাদিম মামা বাড়িতে আসার পর একদিন মাকে বলল, আমি আর স্কুলে পড়ব না; মাদ্রাসায় পড়ব।

আফ্রিদা খুব অবাক হয়ে বলল, সে কি রে? আর দুবছর পড়লে তুই ম্যাট্রিক পাস করবি। এ রকম কথা মুখে আনবিনা। তোর বাপ-চাচারা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না।

নাদিম সে কথা জানে। তাই ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি আব্বাকে ও চাচাদেরকে বুঝিয়ে বললে, তারা কিছু বলবে না।

আফ্রিদা বেশ রেগে গিয়ে বলল, আমি তাদেরকে বলতে পারব না। তোকে এই যুক্তি কে দিয়েছে বল তো?

নাদিম বলল, কেউ দেয়নি। আমি হাদিস পড়ে বুঝেছি, স্কুল-কলেজে পড়ে আল্লাহ ও রসুল (দঃ)-কে চেনা যায় না। তাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আফ্রিদা বলল, তুই এখন ছেলেমানুষ। তোর বুঝশক্তি কম। আমি যা বলছি শোন, দুবছর মন দিয়ে পড়ে ম্যাট্রিক পাস করে নে। তারপর আমি তোকে মাদ্রাসায় পড়বার ব্যবস্থা করে দেব।

নাদিম বলল, ম্যাট্রিক পাস করে কোন লাভ নেই। কত বি.এ. এম.এ. পাস ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না। শুধু শুধু দুটো বছর নষ্ট করব না।

আফ্রিদা ছেলেকে আরো অনেক কিছু বলে বোঝাল, তাতে ফল না হতে শেষে বাপ-চাচাদের মারধর করার কথা বলে ভয়ও দেখাল। কিন্তু নাদিমের এক কথা, সে আর স্কুলে পড়বে না-মাদ্রাসায় পড়বে।

নাদিম আর স্কুলে যায় না খবর পেয়ে তার বাপ রহিম একদিন শ্বশুর বাড়ি এসে স্ত্রীকে ছেলের স্কুলে না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করল।

রহিমের শ্বশুর বাড়ি একই গ্রামের অন্য পাড়ায়।

আফ্রিদা নাদিমের মতামত জানাল।

স্ত্রীর মুখে ছেলের কথা শুনে রহিম খুব রেগে গেল। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না করে বাড়ি ফিরে গেল।

রহিম ভাইদের মধ্যে বড়। গম্ভীর ও শান্ত ধরনের লোক। পাড়ার বা গ্রামের সাথে পাঁচে নেই। তাকে রেগে যেতে কেউ কোনোদিন দেখেনি। কথা খুব কম বলে। অন্যান্য ভাইদের চেয়ে একটু বেশি ধার্মিক। পাড়ার ছোটবড় ছেলেমেয়েরা তাকে দেখে রাস্তা থেকে সরে যায়। তার সামনে কোনো ছেলেমেয়ে দুষ্টুমি করে না। খেলাধুলা করতেও সাহস পায় না। সে কোনোদিন কোনো ছেলে মেয়েকে বকাবকি না করলেও তার চেহারা ও বড় বড় লাল চোখ দেখে তারা ভয় পায়। রহিমরা চার ভাই ও তিন বোন। সব ভাইবোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মেজ ভাইয়ের নাম সুলতান। সেজ ভাইয়ের নাম আজিজ। আর ছোটর নাম কুদ্দুস। রহিম ও কুদ্দুস ম্যাট্রিক পাস। আর আজিজ ও সুলতান নাইনে উঠে আর পড়েনি। আব্দুস সোবহান চৌধুরীর অনেক না হলেও জমি জায়গা যা ছিল তাতে চার ভাই মিলেমিশে বেশ স্বচ্ছন্দে সংসার চালিয়ে যাচ্ছে। চার ভাইয়ের একান্নবর্তি পরিবার। সবাই চাষবাস করে। রহিম যে বছর ম্যাট্রিক পাস করে, সে বছর আব্দুস সোবহান চৌধুরী মারা যান। সংসারের হাল বড় ছেলে হিসাবে রহিমকে ধরতে হয়। তাই আরো পড়াশুনার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। সে ভাইদের ও বোনদের মানুষ করেছে। তাদের মা কবিরন বিবি বেঁচে আছেন। তিনি ছেলেদের বিয়ে হওয়ার পর সংসারের সব দায়-দায়িত্ব ছেলে-বৌদের হাতে বুঝিয়ে দিলেও সংসারে ভাঙ্গন যাতে না ধরে সেদিকে খুব লক্ষ্য রাখেন।

সেদিন রাতে রহিম তিন ভাইকে নাদিমের কথা জানাল। ততদিনে তারা নাদিম গত দুবছর স্কুলে না গিয়ে নওশেরের কাছে হাদিস পড়তে যেত তা জেনে গেছে।

সুলতান বলল, ওর নওশের খালু ওকে নষ্ট করেছে। নাদিমকে শাসন করা দরকার। আর নওশেরকেও বলা দরকার, সে যেন ওকে প্রশ্রয় না দেয়।

রহিম বলল, ঠিক আছে, দেখি কি করা যায়।

পরের দিন সকালে রহিম পাড়ার দূর-সম্পর্কের চাচাতো ভাই হানিফের কাছে গিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে তো নাদিমের খুব ভাব। তুমি আজ জোহরের নামাযের পর তাকে তার মামার বাড়ি থেকে ডেকে আমার কাছে নিয়ে আসবে। সে স্কুলে আর পড়বে না, মাদ্রাসায় পড়বে। সে ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলব।

হানিফ সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ও খুব কর্মঠ ছেলে। ধর্মকর্মও বেশ মেনে চলে। সেই জন্যে নাদিম চার-পাঁচ বছরের ছোট এবং চাচা-ভাইপো সম্পর্ক হলেও বন্ধুর মতো তাদের দুজনের সম্বন্ধ। হানিফরা দুভাই। ছোট হালিম স্কুলে পড়ে। হানিফদের সংসারে অভাব। তাই সে ক্লাস নাইনে উঠে আর পড়েনি। অন্যের চাষবাসে কাজ করে বাপকে সাহায্য করে। যখন দেশ-গ্রামে কাজ থাকে না তখন শহরে গিয়ে রং-এর কাজ করে। সে একা দুতিন জনের কাজ করতে পারে। সেই জন্য যে কোনো কাজ সে রোজে করে না। ফুরোনে করে। যেমন খাটতে পারে তেমনি খেতেও পারে। শারীরে শক্তিও প্রচুর। অবসর সময়ে সে নাদিমের কাছে কুরআন-হাদিসের কথা শুনে এবং সেগুলো যথাসম্ভব মেনে চলে। সেও শুনেছে, নাদিম স্কুলে না পড়ে মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছে। রহিমের কথা শুনে বলল, আপনি যদি কথা দেন, নাদিমকে মারধর করবেন না, তা হলে আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসতে পারি।

রহিম বলল, না মারধর করব না। তোমাকে তো বললাম, তার সঙ্গে মাদ্রাসায় পড়ার ব্যাপারে কথা বলব।

হানিফ বলল, ঠিক আছে, আমি তাকে নিয়ে আসব।

নাদিম দুপুরে খেয়েদেয়ে মসজিদে নামায পড়তে যাওয়ার জন্য পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়েছে, এমন সময় হানিফ এসে নাদিমকে ও তার মাকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, বড় ভাবি কেমন আছেন?

আফ্রিদা সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? চাচা চাচী ভালো আছেন?

হানিফ বলল, আল্লাহপাকের রহমতে আমরা ভালো আছি।

আফ্রিদা বলল, তা এমন সময় কি মনে করে? ভাত খেয়েছো? না খেয়ে থাকলে একমুঠো খেয়ে নাও।

হানিফ বলল, ভাত খেয়েই এসেছি আর খাব না। বড় ভাই নাদিমকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠালেন।

আফ্রিদা যেদিন স্বামীকে নাদিমের মতামত জানিয়েছিল, সেদিন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিল খুব রেগে গেছে। তাই আজ হানিফের কথা শুনে বলল, আমি ওকে যেতে দেব না। ওর বাপ-চাচারা মারধর করবে।

হানিফ বলল, বড় ভাবি আপনি এ কথা ভাবতে পারলেন, আমি নাদিমকে মার খাওয়াবার জন্য নিয়ে যেতে এসেছি? নাদিমকে মারলে ও যত না কষ্ট পাবে, তার চেয়ে যে আমি বেশি কষ্ট পাব, একথা নিশ্চয় জানেন?

আফ্রিদা ওদের দুজনের গভীর সম্পর্কের কথা জানে। বলল, জানি, কিন্তু তবু আমার যেন কেমন ভয় করছে। তুমি তো জান, তোমার বড় ভাই রেগে গেলে কি রকম হয়।

হানিফ বলল, তা জানি বড় ভাবি। তবু একথা জোর গলায় বলতে পারি, আমার গায়ে এক বিন্দু রক্ত থাকতে নাদিমের গায়ে কাউকে হাত তুলতে দেব না। শুধু বড় ভাই কেন, তারা চার ভাই একসঙ্গে যদি মারতে চায় তবু পারবে না, এ বিশ্বাস রাখবেন।

আফ্রিদা বলল, সে বিশ্বাস আমার আছে। তবু তোমাকে ওয়াদা করতে হবে, যে অবস্থায় নাদিমকে নিয়ে যাবে সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনবে।

হানিফ বলল, তা তো নিশ্চয়। তারপর নাদিমকে বলল, চল, তোর কোনো ভয় নেই। নাদিমকে ওর মামাদের পাড়ার মসজিদের দিকে যেতে দেখে হানিফ বলল, আমাদের মসজিদে নামায পড়ব।

চাচা-ভাইপো জোহরের নামায পড়ে হানিফ নাদিমকে সঙ্গে নিয়ে তাদের ঘরে এসে উঠোন থেকে বড় ভাই বলে ডাকল।

তখন বৈশাখ মাস। রোদের প্রচণ্ড তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাই ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। রহিমদের বাড়িটা দোতলা। সে দোতলার সিঁড়ির দিকের রুমে থাকে।

রহিম দরজা অল্প ভিড়িয়ে ঘরের ভিতর দরজার পাশে বসে জাল বুনছিল। হানিফের গলা শুনতে পেয়ে বলল, এস, উপরে এস।

হানিফ নাদিমকে নিয়ে উপরে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকে ভিতরে যেতে বলল। আসবার সময় সে তাকে সাহস দিয়ে বলেছে, আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই। সে দাঁড়িয়ে রইল।

তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হানিফ তার একটা হাত ধরে ভিতরে ঠেলে দিয়ে বলল, বড় ভাই নাদিম এসেছে।

রহিম জাল বুনতে বুনতে নাদিমের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্কুলে পড়তে চাচ্ছনা কেন? রহিম ছোটবড় সব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুমি করে কথা বলে।

আব্বার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে ভয়ে নাদিমের গলা শুকিয়ে গেল। কোনো কথা বলতে পারল না।

কয়েক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে রহিম বলল, কি হল কিছু বলছ না কেন?

আমি মাদ্রাসায় পড়ব।

 এ যুক্তি তোমাকে কে দিয়েছে?

কেউ দেয়নি।

দুবছর পড়ে ম্যাট্রিক পাস করে নাও, তারপর মাদ্রাসায় পড়।

নাদিম এর আগে আব্বার সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা সামনে যেতে খুব ভয় পেত। আজ এত কথা বলার পরও আব্বা কিছু করছে না দেখে তার সাহস হল। বলল, আমি আর স্কুলে পড়ব না।

নাদিমের কথা শুনে রহিম জাল থেকে ছড়িটা টেনে নিয়ে নাদিমকে মারতে মারতে বলল, এত বড় বেয়াদব হয়েছ, বাপের কথা অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল মতো চলতে চাচ্ছ?

দুতিন ঘা মার খেয়ে নাদিম ছুটে বারান্দায় বেরিয়ে এল।

রহিম তাকে মারার জন্য বেরিয়ে এলে হানিফ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বড় ভাই, আপনি ওকে মারবেন বলে তো ডেকে আনতে বলেননি।

রহিম তখন রাগে কাঁপতে কাঁপতে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও হানিফ, নাদিম নষ্ট হয়ে গেছে; শাসন না করলে আরো নষ্ট হয়ে যাবে।

হানিফ তাকে ছাড়ল না। বলল, আমি বেঁচে থাকতে ওর গায়ে আর একটা চাবুকও মারতে পারবেন না।

কুদ্দুস নিচের তলার একটা রুমে থাকে। সে হানিফের গলা পেয়ে দরজা ফাঁক করে নাদিমকে হানিফের সাথে আসতে দেখেছে। তারা উপরে চলে যেতে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির উপরের ধাপে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। হানিফ বড় ভাইকে ছাড়ছে না দেখে তাড়াতাড়ি এসে হানিফকে ধরে বড় ভাইকে মুক্ত করে দিল।

রহিম ছাড়া পেয়ে নাদিমকে মারতে গেল।

নাদিম ঘর থেকে বারান্দায় এসে পালাবার জন্য সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে ছোট চাচাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ছোট চাচা যখন হানিফকে ধরে আব্বাকে মুক্ত করে দিল এবং আব্বা তাকে মারতে এল তখন সে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর গেটের দিকে ছুট দিল। গেটের কাছে এসে দেখল, মেজ চাচা গেট লাগিয়ে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিম মেজ চাচার কিছু দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ততক্ষণে রহিম এসে জালছড়ি দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করে চলল।

নাদিম মারের আঘাত সহ্য করতে না পেরে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে বলতে লাগল, আব্বাগো আর মারবেন না, আমি মরে যাব।

রহিম তবু মেরে চলেছে। শেষে নাদিমের যখন জ্ঞান হারাবার উপক্রম হল তখন তার কানে দাদির গলা ভেসে এল, আর মারিস না রহিম, মরে যাবে যে। তারপর নাদিমের কিছু মনে নেই।

আজিজ সেদিন ঘরে ছিল না। দুদিন হল ছোট বোনের বাড়ি গেছে। নাদিমের দাদি কবিরন বিবি মেজ বৌ আয়মনের অসুখ বলে তার কাছে ছিলেন। নাদিমের কান্নার চিৎকার শুনে যখন বেরিয়ে এসে ঐ কথা বলতে বলতে তার কাছে এলেন তখন নাদিম অজ্ঞান হয়ে গেছে।

এদিকে হানিফ কুদ্দুসের সঙ্গে লুটোপুটি খাচ্ছে। কিছুতেই তার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিল না। কারণ কুদ্দুসও খুব শক্তিশালী যুবক। রোজ ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ে দুটো সাড়ে সাত সের করে পনের সের ওজনের মুগুর নিয়ে ব্যায়াম করে। শেষমেশ হানিফ যখন কুদ্দুসের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নাদিমের কাছে এল তখন নাদিম জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। তার রক্তাক্ত অজ্ঞান দেহটা দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বলল, বড় ভাই, মেজ ভাই, আপনারা যে নাদিমকে এভাবে শাসন করবেন, তা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম, তা হলে নিয়ে আসতাম না। তারপর চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ভিজে গলায় বলল, এর কিছু হলে আল্লাহ আপনাদের ক্ষমা করবেন না। কথা শেষ করে সে গেটের দিকে যেতে লাগল।

কবিরন বিবি বললেন, ওকে তুই কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?

হানিফ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, এর মাকে কথা দিয়েছিলাম; ওকে যে অবস্থায় নিয়ে এসেছি সেই অবস্থায় তার কাছে ফিরিয়ে দেব। আমি সেই ওয়াদা রাখতে পারলাম না। জানি না আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন কিনা, আর এর মাও হয়ত আমাকে ক্ষমা করবেন না। তবু যার কাছ থেকে এনেছি তার কাছেই নিয়ে যাচ্ছি। তারপর সে হনহন করে চলে গেল।

ছেলেকে হানিফের সাথে পাঠিয়ে দিয়ে আফ্রিদা তাদের ফিরে আসার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। যত দেরি হচ্ছে তত তার মন বিপদের আশংকায় ছটফট করছে। তার কেবলই মনে হচ্ছে-নাদিমকে নিশ্চয় মারধর করছে। দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে জানাতে লাগল, আল্লাহ তুমি আমার নাদিমকে হেফাজত করো, তাকে আমার কোলে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে এনে দাও। রক্তাক্ত নাদিমকে পাঁজাকোলা করে হানিফকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখে তার মন আতঙ্কে ধক করে উঠল। তাড়াতাড়ি নেমে এসে নাদিমের অবস্থা দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে হানিফকে বলল, তুমি আমার জ্যান্ত ছেলে নিয়ে গিয়ে মরা ছেলে ফেরত দিতে এসেছ কেন? তুমি এত বড় ধূর্ত ও নাদান, আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে চালাকি করে মেরে ফেলতে নিয়ে গিয়েছিলে। নাদিমের কিছু হলে তোমাকে ছেড়ে কথা বলব না।

হানিফের চোখ দিয়ে তখনও পানি পড়ছিল। বলল, বড় ভাবি আপনি আমাকে যা শাস্তি দেন দিবেন, আগে নাদিমের চিকিৎসা করা দরকার। ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। ততক্ষনে বাড়ির অন্যান্য মেয়ে-পুরুষ ও ছেলেমেয়েরা এসে ভীড় করেছে। হানিফ তাদেরকে পাশ কাটিয়ে উপরে এসে বারান্দার চৌকিতে শুইয়ে দিয়ে বলল, আপনারা ওর মাথায় পানি ঢালুন, আমি ডাক্তার আনতে যাচ্ছি। তারপর সে ছুটে চলে গেল।

হানিফ চলে যাওয়ার পর আফিদা কঁদতে কাঁদতে নাদিমের মাথায় পানি ঢালতে লাগল।

নাদিমের নানি সুরাতন বিবি সব নাতি-নাতনিদের চেয়ে নাদিমকে বেশি ভালোবাসেন। নাদিমের অবস্থা দেখে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলেন। সবাই বলাবলি করতে লাগল, বাপ হয়ে যে ছেলেকে এভাবে মারে তা আমরা কখনও দেখিনি ও শুনিনি।

নাদিমের মামারা অফিস থেকে ফিরে নাদিমকে দেখে ও মারার কথা শুনে বলল, কোনো মানুষ কখনো কোনো জন্তু-জানোয়ারকেও এভাবে মারেনি।

ডাক্তার এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে গেল। সন্ধ্যের পর নাদিমের জ্বর একশ পাঁচ ডিগ্রীতে উঠল। ডাক্তারের নির্দেশ মতো মাথায় বরফ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। জ্বর একটানা তিন দিন তিন রাত রইল। এর মধ্যে নাদিমের জ্ঞান ফিরল না। চার দিনের দিন জ্বর কমার পর নাদিমের জ্ঞান ফিরল। এই কদিন আফ্রিদা ও সুরাতন বিবি খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করে রোযার উপর রোযা রেখে নাদিমকে ভালো করে দেওয়ার জন্য আল্লাহপাকের কাছে দোয়া চেয়েছে। নাদিমের মামীরা অনেক বলে-কয়ে শুধু ইফতারের সময় কিছু নাশতা খাওয়াতে পারলেও ভাত খাওয়াতে পারেনি।

প্রায় দশ-বারো দিন পর নাদিম সুস্থ হল। এ পর্যন্ত নাদিমের বাপ চাচারা কেউ দেখতে আসেনি।

ঐদিন ডাক্তার নাদিমকে দেখে চলে যাওয়ার পর আফ্রিদা হানিফের কাছে সবকিছু শুনে স্বামী ও দেবরদের ব্যবহারে ভীষণ মনে কষ্ট পেল।

হানিফ আফ্রিদার পায়ে হাত দিয়ে কেঁদে কেঁদে মাফ চেয়েছে। আফ্রিদা তাকে মাফ করে পারেনি।

মাসখানেক পর নাদিম নওশের খালুর কাছে গিয়ে সবকিছু জানিয়ে বলল, আমি মাদ্রাসায় পড়তে চাই, আপনি ব্যবস্থা করে দিন।

নওশের বলল, তা না হয় করে দেব, কিন্তু থাকা-খাওয়ার খরচ দেবে কে? তুমি যা বললে, তাতে তো মনে হচ্ছে, তোমার বাপ-চাচারা খরচপত্র দেবে না।

নাদিম বলল, আমি ওসব নিয়ে চিন্তা করি না। আপনি শুধু ভর্তি করে দিন, আমি লজিং খুঁজে নেব।

নওশের বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার মাকে বলে বেডিংপত্র নিয়ে এস।

নাদিম ফিরে এসে মাকে নিজের মতামত বলে খালুর কথা বলল।

আফ্রিদা বলল, মাদ্রাসায় যে পড়বি বলছিস, খরচপত্র দেবে কে? তোর বাপ-চাচারা তো দেবে না।

সে কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি কারো বাড়িতে লজিং থাকব।

 তা না হয় থাকলি, কিন্তু আরও খরচ আছে।

আল্লাহ সে সব চালিয়ে দেবে।

আফ্রিদা ভেবেছিল, এত মারধর খাওয়ার পর সে আর মাদ্রাসায় পড়তে চাইবে না, স্কুলেই মন দিয়ে পড়বে। কিন্তু তাকে মাদ্রাসায় পড়ার কথা বলতে শুনে বেশ অবাক হলেও বিরোধিতা করল না। বলল, তুই এক কাজ কর, তোর দাদিকে গিয়ে বল; তিনি যেন তার ছেলেদের বলে খরচপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

নাদিম সেই দিনই বাড়িতে গিয়ে দাদিকে সালাম দিয়ে কদমবুসি করে আম্মা যা বলতে বলেছিল বলল।

কবিরন বিবি বললেন, এতকিছু হওয়ার পরও যখন তুমি মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছ। তখন আর কি করা। তারপর ছেলেদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি নাদিমের মাদ্রাসায় পড়ার কথা বলে খরচের ব্যাপারে কি করবে জিজ্ঞেস করলেন।

বড় ভাই কিছু বলছে না দেখে সুলতান বলল, নাদিম যখন আমাদের অমতে মাদ্রাসায় পড়তে চাচ্ছে তখন আমরা তার খরচ দেব না। দেখি ও কি করে পড়ে। তারপর ভাইদের উদ্দেশ্যে বলল, তোমরা কি বল?

রহিম বলল, তোমার কথা ঠিক। যে ছেলে মুরুব্বিদের কথা শুনে না, সে ছেলের জন্যে আমরা টাকা খরচ করব না। ও যদি নিজে পড়তে পারে পড়ুক, তাতে আমাদের। কোনো আপত্তি নেই।

কবিরন বিবি বললেন, তা কি করে সম্ভব? বিদেশে টাকা-পয়সা না হলে ওর খুব কষ্ট হবে।

আজিজ বলল, ও নিজে যদি কষ্টের পথে পা বাড়ায় তাতে আমরা কি করব? কিছুদিন কষ্ট করলে আপনা-আপনি ফিরে আসতে পথ পাবে না।

কবিরন বিবি চিন্তা করলেন, এখন নাদিমের উপর জোর খাটালে কিছু হবে না। ও নিজে যতক্ষণ না নিজের ভুল বুঝতে পারবে ততক্ষণ কারো কথা শুনবে না। তাই তিনি নাদিমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার বাপ-চাচাদের কথা তো শুনলে; আর তোমাকে সাহায্য করার মতো আমার কিছু নেই। তারপরও যদি তুমি মাদ্রাসায় পড়তে চাও, তা হলে পড়তে পার।

নাদিম ফিরে এসে মাকে তাদের কথা জানাল।

আফ্রিদা শাশুড়ী, স্বামী ও দেবরদের কথা শুনে তাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। বলল, আমার কাছে মাত্র ত্রিশ টাকা আছে, তোকে দিতে পারি।

নাদিম মায়ের কাছ থেকে সেই ত্রিশ টাকা নিয়ে নওশের খালুর কাছে এল।

নওশের নাদিমকে খরচপত্রের কথা জিজ্ঞেস করে সবকিছু জেনেও কিছু বলল না। পরের দিন তাকে নিয়ে রাজশাহী টাউনে এসে একটা মাদ্রাসায় সোমে (ক্লাস থ্রিতে) ভর্তি করে দিয়ে আপাতত মাদ্রাসার এতিমখানায় থাকার ব্যবস্থা করে ফিরে এল।

এতিম খানায় থেকে নাদিম পড়াশুনা করতে লাগল, আর লজিং খুঁজতে লাগল। এদিকে এতিমখানার সীমিত খাবার খেয়ে নাদিম দিনের পর দিন শুকিয়ে যেতে লাগল। যারা এতিমখানায় থাকে তাদের গার্জেনরা মাঝে মাঝে এসে তাদেরকে মুড়ি, চিড়ে, মুড়কী কিনে দিয়ে যায়। কেউ কেউ ঘর থেকে ঐসব জিনিস দিয়ে যায়। আবার অনেকে টাকা-পয়সা দিয়ে যায়। নাদিমের কাছে যা ছিল তা দিয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটা মশারি কিনতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে।

এতিম খানায় শুধু দুবেলা ভাত দেয়া হয়। তাও আধপেটা, তার উপর কোনো ছাত্রের যদি কোনো মেহমান আসে তা হলে ভাগে আরো কম পড়ে। কারন মেহমানের জন্যে বেশি করে রান্না হয় না। অন্য ছেলেরা যখন নাশতা খায় তখন নাদিমের ক্ষিধের চোটে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। সে তখন বাইরে চলে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বাড়িতে লজিং পেল না।

ওদের ক্লাসচিটার, নাদিম ভালো পড়াশুনা করে বলে একটু স্নেহের চোখে দেখেন। দিন দিন তার চেহারা শুকিয়ে যাচ্ছে এবং সব সময় মনমরা হয়ে থাকে দেখে একদিন তিনি নাদিমকে জিজ্ঞেস করে সব কিছু জানতে পেরে তার মনে নাদিমের জন্য দুঃখ হল। তিনি নাদিমকে বুঝিয়ে বললেন, বাপ-চাচাদের মনে কষ্ট দিলে কোনো কাজে সফলতা আসে না। আল্লাহপাকও অসন্তুষ্ট হন। তুমি তাদের কথামতো ম্যাট্রিক পাস করে মাদ্রাসায় ভর্তি হলে ভালো করতে। মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতে হলে বই-খাতা কেনার জন্য টাকা লাগবে। সেসব তোমাকে কে দেবে? তারপর তাকে আরো অনেক কথা বলে বুঝিয়ে তার গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বললেন।

সেদিন রাতে নাদিম ক্লাসটিচারের কথা চিন্তা করে নিজের ভুল বুঝতে পারল। পরের দিন সে মামাদের বাড়িতে ফিরে এল।

আফ্রিদা ছেলেকে কাঁথা-বালিশ নিয়ে ফিরে আসতে দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন। তবু জিজ্ঞেস করলেন, কি রে সব কিছু নিয়ে এলি কেন?

নাদিম ক্লাসটিচারের কথা বলল, আমি স্কুলে পড়ব।

আফ্রিদা বলল, ঠিক আছে, তোর দাদিকে সে কথা বলবি।

নাদিম বলল, এখন অক্টোবর মাস, ভর্তি হয়ে কোনো কাজ হবে না। সামনের বছর জানুয়ারিতে ভর্তি হব।

আফ্রিদা বলল, তাই হবে।

নাদিম মাদ্রাসায় পড়তে চলে যাওয়ার পর রহিম স্ত্রীকে আনার জন্য ছোট ভাই কুদ্দুসকে পাঠিয়েছিল। ভাইয়েরা সাবই মিলে নাদিমকে মেরেছিল এবং মারার পর কেউ একজনও দেখতে আসেনি। বলে স্বামী দেবরদের প্রতি আফ্রিদার প্রচণ্ড অভিমান। তাই আফ্রিদা কুদ্দুসকে ফিরিয়ে দেয়।

এরপর সুলতান ও আজিজ একে একে নিয়ে যেতে এলে আফ্রিদা তাদেরকেও ফিরিয়ে দেয়।

এর মধ্যে কবিরন বিবির খুব জ্বর হল। ছেলেরা ডাক্তার নিয়ে এল। রাতে ছেলেদেরকে বললেন, বড়মাকে তোমরা আনছ না কেন? তিনি আফ্রিদাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাই অন্য বৌদেরকে মেঝ বৌ, সেজ বৌ ও ছোট বৌ বলে ডাকলেও আফ্রিদাকে বড়মা বলে ডাকেন।

মায়ের কথার জবাবে সুলতান বলল, আমরা বড় ভাবিকে আনতে গিয়েছিলাম, সে আসেনি।

কবিরন বিবি বললেন, তোমরা নাদিমকে ঐভাবে মেরেছ বলে বড়মার মনে কষ্ট হয়েছে, তাই আসেনি। তারপর রহিমকে বললেন, তুমি গিয়ে আমার অসুখের কথা বলে বলবে, আমি তাকে নিয়ে আসার জন্য তোমাকে পাঠিয়েছি।

পরের দিন রহিম নাশতা খেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেল।

আফ্রিদা স্বামীকে কমদবুসি করে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ, আম্মা কেমন আছেন? আমি ভালো, তুমি কেমন আছ?

আমার খবর এতদিন যখন নাওনি তখন আর জানার দরকার নেই। আম্মা কেমন আছেন বললে না যে?

আজ দুদিন আম্মার খুব জ্বর। ডাক্তার এনে দেখান হয়েছে। আম্মা তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠালেন।

আফ্রিদা নাস্তা, শরবত ও পান দিয়ে বলল, আম্মার কথায় নিয়ে যেতে এসেছ? নিজের ইচ্ছায় আসনি তা হলে?

তা কেন? আমি তো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওদেরকে বারবার পাঠিয়েছি।

তাদের আসা আর তোমার আসা কি এক?

তুমি এত জ্ঞানী হয়েও স্বামীর ভুল ক্ষমা করতে পারলে না?

আফ্রিদা ছলছল নয়নে বলল, তুমিই বা কি করে ভাইদের সঙ্গে যুক্তি করে সবাই মিলে নিজের ছেলেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলে? সেটা বুঝি খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছ? বাপ হয়ে ছেলের অন্যায় ক্ষমা করতে পারলে না কেন? শাসন করবে ভালো কথা, তাই বলে মেরে ফেলার মতো শাসন কোনো বাপ কোনো দিন করেছে কিনা জানি না। এই কথা বলার পর মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে আবার বলল, ছেলেটা মরল না বাঁচল একবার দেখতেও এলে না।

রহিম বলল, দেখতে না এলেও খবর ঠিকই নিয়েছি। তুমি তো জান, আমি হঠাৎ কখনও রাগি না। দুবছর ছেলেটা লেখাপড়ায় ফাঁকি দিয়ে ফেল করল। তারপর মাদ্রাসায় পড়ার কথা শুনে সামলাতে পারলাম না। আর মানুষ রেগে গেলে শয়তান ঘাড়ে চাপে। তাই সেদিন ঐ রকম একটা কাণ্ড করে ফেলেছি। আমিও তো মানুষ। আমারও পিতৃস্নেহ আছে। সেদিন রাগ পড়ে যাওয়ার পর মনে যে কত ব্যাথা অনুভব করেছি তা আল্লাহপাক জানেন। আজও সে কথা মনে হলে নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাই। স্ত্রীকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে বলল, আমাকে কি তুমি ক্ষমা করে দিতে পার না?

আফ্রিদা আঁচলে চোখ মুছে স্বামীকে আর একবার কদমবুসি করে বলল, বারবার ক্ষমা চেয়ে আমাকে গোনাহগার করো না। আমাকে নিয়ে যেতে তুমি ভাইদেরকে পাঠিয়েছিলে। আমি তোমার উপর অভিমান করে না গিয়ে অন্যায় করেছি, তুমি বরং আমাকে মাফ করে দাও।

রহিম বলল, আল্লাহপাক আমাদেরকে মাফ করুন। আচ্ছা, নাদিম তো মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েছে, চিঠিপত্র দিয়েছে? নাদিম যে কয়েক দিন আগে ফিরে এসেছে রহিম তা জানে না।

আফ্রিদা বলল, সে চার-পাঁচদিন হল ফিরে এসেছে। তারপর তার ফিরে আসার কারণ ও স্কুলে পড়ার ইচ্ছার কথা জানাল।

রহিম শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, আমরা সবাই চেয়েছিলাম সে তার নিজের ভুল নিজে বুঝুক। তাই আম্মা যখন মাদ্রাসায় পড়ার খরচের কথা বললেন তখন আমরা তাকে পড়ার অনুমতি দিলেও খরচপত্র দিতে চাইনি। আল্লাপাকের কাছে শুকরিয়া জানাই, তিনি ওকে তাড়াতাড়ি ভুল বোঝার তওফিক দিলেন। নাদিম কোথায়? ওকে কাউকে দিয়ে ডাক তো, অনেক দিন দেখিনি।

আফ্রিদা রুম থেকে বেরিয়ে ভাইপো সাইদুলকে দেখতে পেয়ে নাদিমকে ডেকে দিতে বলল।

নাদিম জানে না তার আব্বা এসেছে, সাইদুল ডেকে দিতে ঘরে ঢুকে আব্বাকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আফ্রিদা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি হল, বেয়াদবের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? সালাম দিয়ে কদমবুসি কর।

নাদিম সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।

রহিম সালামের উত্তর দিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে ভিজে গলায় বলল, তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ শুনে খুশি হয়েছি। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা কর।

ঐদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর আফ্রিদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে বাড়ি ফিরল।

বাড়িতে এসে আফ্রিদা যখন শাশুড়ীর কাছে এসে কদমবুসি করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছিল তখন রহিম ছাড়া অন্য তিন ভাই সেখানে ছিল।

কবিরন বিবি বড় বৌকে দোয়া করে বললেন, তুমি তোমার দেবরদেরকে ছোট ভাই মনে করে মাফ করে দাও। ওদেরকে তো তুমি ছেলের মতো মানুষ করেছ। তারপর ছেলেদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা বড়মার পা ধরে মাফ চেয়ে নাও।

আফ্রিদা যখন এ বাড়িতে বৌ হয়ে আসে তখন সুলতারে বয়স আট, আজিজের পচ আর কুন্দুসের দুবছর। আফ্রিদাই তাদেরকে এক রকম মানুষ করেছে। তারাও বড় ভাবিকে মায়ের মতো জ্ঞান করে। মা না বললেও তারা বড় অব্রি পা ধরে ক্ষমা চাইত।

শাশুড়ীর কথা শুনে আফ্রিদা বলল, না না আমাকে কদমবুসি করতে হবে না। এদেরকে মাফ করে দিয়েছি।

তিন ভাই তা শুনল না। একে একে কদমবুসি করে মাফ চাইল। আফ্রিদা তাদের মাথায় হাত দিয়ে চুমো খেয়ে বলল, আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাফ করুক।

পরের বছর নাদিম স্কুলে ভর্তি হয়ে মন দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগল। ম্যাট্রিক চার বিষয়ে লেটার নিয়ে পাস করে চাঁপাই নবাবগঞ্জ কলেজে ভর্তি হল। সেখান থেকে ভালোভাবে বি.এ. পাস করে কিছুদিন বেকার ছিল। তারপর গোদাগাড়ি হাইস্কুলে মাস্টারি করছে। ম্যাট্রিক পাস করার পর কলেজে পড়লেও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে তার কখনও শিথিলতা আসেনি। সেই সঙ্গে পাড়ার ও গ্রামের অশিক্ষিত লোকদের কুরআন হাদিসের জ্ঞান ছড়িয়ে দিয়েছে। তার সাহচর্যে এসে গ্রামের অনেকে যারা তাড়ি খেত, চুরি করত, নামায-রোযা করত না, তারা এই সব গর্হিত কাজ ছেড়ে দিয়ে নামায-রোযা করছে। মাস্টারিতে জয়েন করার এক বছর পর আজ নাদিমের বিয়ে হল।

<

Super User