১১.
ওই কুত্তার বাচ্চাকে গাড়িচাপা দিতে! রাগ করে বলল নিক বেণ্ডার। সময় নষ্ট করছিল!
নিক…।
আবার কী? ত্যাড়া চোখে বড়ভাইকে দেখল দানব।
এইমাত্র গ্রাউণ্ড-ফ্লোরে উঠেছে এসইউভি। হেডলাইট বন্ধ করল না রিক। গাড়ি থেকে নেমে দেয়ালের সুইচ টিপল নিক। শক্তিশালী বৈদ্যুতিক আলোয় ঝকঝক করে উঠল বারো শ স্কয়ার ফিটের ওঅর্কশপ।
গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে অভ্যেসবশে ড্যাশবোর্ড হাতড়াল রিক। কোথাও নেই ম্যাগনাম। তিক্ত মনে ভাবল, ভালই হলো। নইলে হয়তো সত্যিই একটা বুলেট গেঁথে দিত নিকের মগজে!
গাড়ি থেকে নেমে রিক দেখল, তার জ্যাকেটের আস্তিনে রক্তমাখা এক টুকরো মগজ। ভীষণ বিরক্ত হয়ে এসইউভির হুডে থকথকে জিনিসটা মুছল সে।
আশ্চর্য, রিক! ত্যাড়া চোখে ওকে দেখল নিক। এমনিতেই যথেষ্ট নোংরা, আরও মাখাতে হবে গাড়িতে!
অ্যাই, চুপ, নিক! দূরের দেয়ালে টুল-বেঞ্চ, ওদিকে চলল রিক। ওখানে কোনও বাক্সে আছে মরফিন। ব্যথায় টনটন করছে মাথা। তার ওপর পোশাক থেকে আসছে তাজা রক্ত, মগজ ও মাংসের রোটকা গন্ধ। যে-কোনও সময়ে পেট থেকে সব উগরে দেবে। এরচেয়ে খারাপ আর কী হবে!
হতেও তো পারে! বলে উঠল কে যেন।
ঝট করে ঘুরে রানার দিকে তাকাল রিক ও নিক।
এত বিশালদেহী লোক কমই দেখেছে রানা। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পেছনের দেয়াল আড়াল করে ফেলেছে দুই ভাই। রানার বন্ধু সোয়া ছয় ফুটি জন প্রায় পাহাড়ের মত, কিন্তু এই দুজনের তুলনায় সে হচ্ছে কোলের শিশু।
অবশ্য, ওর আর এদের মাঝে আছে বিরাট ফারাক। ওই দুজনের কাছে অস্ত্র নেই, কিন্তু রানার হাতে ওয়ালথার। ক্ষমতার পাল্লায় বিসিআই এজেন্টের ওজন বেশি।
কড়া চোখে ওকে দেখল দুভাই। কসেকেণ্ড পর তাদের চোখ স্থির হলো ওয়ালথার পিস্তলের ওপর।
বাড়াবাড়ি করলে মরবে! ত্যাড়া-চোখ দানবের নাক লক্ষ্য করে ওয়ালথার তুলল রানা। দুশত্রুর মধ্যে কথা বেশি বলে দৈত্য। হামলা হলে খুব সম্ভব আগে হবে তার তরফ থেকেই।
তুই শালা নিজেই বাড়াবাড়ি করছিস, রানার বুকের দিকে তর্জনী তুলল নিক। পাঞ্জাটা প্রমাণ সাইজের বেলের সমান। গালি দিয়েছি বলে মরতে এসেছিস, নাকি?
অপেক্ষাকৃত ছোট দানব সামান্য সরে বলল, নিক! জঙ্গলের সেই লোক!
ঠিক বলেছ, ওঅর্কশপে ঢুকল রানা।
একদিকের দেয়ালে অসংখ্য যন্ত্রপাতি।
ঘরের মাঝে এসইউভি।
মেঝেতে মোবিলের দাগ।
একই তেল দেয়াল ও আসবাবপত্রে।
চিনেছি গলা, বলল রিক বেণ্ডার, কে তুমি?
জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তুলল রানা, কী কারণে নিনা ভেঞ্চুরাকে খুঁজছ তোমরা?
পরস্পরকে দেখল দুই দানব।
চেহারায় দেখে রানা বুঝল, এরা একই মায়ের পেটে জন্মেছে। যেন বর্তমান পৃথিবীতে ফিরেছে দুই নিয়ানডারথাল ভাই!
তোমরা আপন ভাই, ঠিক? এক পা এগোল রানা। কোজন বয়সে ছোট?
আমরা যমজ, গম্ভীর হয়ে গেল ত্যাড়া চোখ।
তাকে নিক বলে ডেকেছে অন্যজন, মনে আছে রানার। ও, তো তুমি ছোট? আপত্তি ফুটল দানবের চেহারায়। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে বড়জনের দিকে তাকাল রানা। ঠিক আছে, যা জানতে চাইব, দেরি না করে জানাবে, নইলে গুলি করব তোমার ছোটভাইকে। বুঝতে পেরেছ?
অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওকে দেখছে রিক বেণ্ডার।
রানা বুঝল, ওর হুমকি শুনে ভীত নয় লোকটা।
কাঁধ ঝাঁকাল রিক। নিজের দেখভালের বয়স হয়েছে ওর। তুমি ওকে গুলি করতে চাইলে আমি ঘাবড়াব কেন?
ভুরু কুঁচকে তাকে দেখল নিক, তারপর রানার দিকে চেয়ে হাসতে শুরু করে ধমকে উঠল, আরে, শালা…
তুমি বেশি কথা বলো, পাল্টা ধমক দিল রানা। ওর প্রথম গুলি ফুটো করল নিকের বাম হাঁটুর বাটি। যত শক্তিশালীই হোক, কলা গাছের মত মেঝেতে পড়ে লাথি খাওয়া কুকুরের মত কেউ করে উঠল সে।
শুয়োরের বাচ্চা! খানিকটা টলতে টলতে রানার দিকে এগোল রিক বেণ্ডার। কিন্তু থেমে গেল বুকে পিস্তলের নল স্থির দেখে।
সামনে বাড়লে গুলি ঢুকবে বুকে, আরেক পা এগোল রানা।
থেমে গেছে রিক। মুখ বিকৃত হয়েছে রাগে। তুই যা করেছিস, ঘাড় থেকে উপড়ে নেব তোর মাথা!
ফালতু বকবক না করে মুখ খোলো, আবারও নিক বেণ্ডারের দিকে ঘুরল ওয়ালথার। নইলে দেখবে হলো পয়েন্ট বুলেট কতটা ক্ষতি করে তোমার ভাইয়ের মুখের।
হলো-পয়েন্ট .৩৮ বুলেট রুখে দেবে ছুটন্ত গণ্ডার। মাত্র একটা গুলি চুরমার করবে বয়সে ছোট দানবের আস্ত মাথা ও মুখ। আরও এক পা বাড়ল রানা।
দুহাত ওপরে তুলল রিক বেণ্ডার। ওকে, ওকে, গুলির দরকার নেই। অস্বীকার করব না, নিরেট গাধা ভাইটার জন্যে বহু কিছুই করব।…আসলে কী জানতে চাও তুমি?
শুরু করো তোমার নাম দিয়ে, বলল রানা।
রিক। আর ও নিক।
বংশ পরিচয়?
শুয়োরটাকে কিছুই বোলো না, গুঙিয়ে উঠল নিক। কাত হয়ে বসেছে মেঝেতে। কমেছে শক, কিন্তু তার জায়গায় এখন তীব্র ব্যথা।
যন্ত্রণা পাত্তা দেবে না এরা, মানুষ খুনেও দ্বিধা নেই, বুঝে গেছে রানা। শান্ত মাথায় আরেক গুলিতে নিকের ডান হাঁটুর বাটি ফুটো করল ও।
এহূহে, দুঃখ পেয়ে মাথা নাড়ল রিক বেণ্ডার। চেয়ে আছে ভাইয়ের ব্যথা-বিকৃত মুখের দিকে।
হেঁড়ে গলায় হুক্কা-হুয়া বোল তুলেছে নিক বেণ্ডার।
এখন থেকে স্রেফ প্রশ্নের জবাব দেবে, জানাল রানা।
আমরা বেণ্ডার, প্রায় চিৎকার করল রিক। বেণ্ডার ভাই, বুঝতে পেরেছ? …ঠিক আছে?
বুঝেছি। এবার বলো, কার হয়ে কাজ করছ।
খুনির চোখে রানাকে দেখল রিক। বাধ্য হয়েই দানবের মাথার পেছন দেয়ালে গুলি করল রানা।
তপ্ত ধাতু কানের পাশ কাটিয়ে যেতেই চমকে গেছে লোকটা।
ন্যাশ ময়নিহান।
এই শহরের লোক?
না, ডালাসের। টেক্সাস। হেড অফিস ওখানে।
এখানেও অফিস আছে?
হ্যাঁ।
রিকের মাথার অন্যপাশ দিয়ে গেল রানার গুলি। আবারও ফুটো হয়েছে দেয়াল। জলদি জবাব দেবে। ময়নিহানের অফিসের ঠিকানা কী?
ভুরু কুঁচকে জানাল দানব, শহরের অভিজাত এলাকায় ন্যাশ ময়নিহানের অফিস। ওটা আছে একটা রেস্তোরাঁর ওপরতলায়।
নিনা ভেঞ্চুরাকে কী কারণে দরকার তার?
মিথ্যা বলে লাভ হবে না জানে রিক বেণ্ডার। চাপা কণ্ঠে বলল, কেন মেয়েটাকে খুঁজছে ময়নিহান। কথা শেষ করে তাকাল ছোটভাইয়ের দিকে।
তার চোখে হে ও মমতা দেখল রানা।
আশা করি আমাদের বাঁচতে দেবে? জানতে চাইল রিক।
আমার বদলে তোমরা হলে দিতে? জানতে চাইল রানা।
নিশ্চয়ই! চওড়া হাসল দানব।
ক্ষণিকের জন্যে রানার মনে হলো, ওর পেছনে কাউকে দেখছে লোকটা। নইলে এত হাসি কীসের?
একটু সরে দাঁড়াল রানা।
না, ওঅর্কশপে অন্য কেউ ঢোকেনি।
মুচকি হাসল রিক। আমি হলে বাঁচিয়ে রাখতাম। তারপর একটা একটা করে ছিড়তাম তোমার হাত-পা। লাথি মেরে ফাটিয়ে দিতাম পেট। ওঅর্কশপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত তোমার লাশ।
শুনে খুব খুশি হলাম শুকনো গলায় বলল রানা। বুঝে গেছে, কী ঘটবে এবার।
রিকের চোখের কোণে বাড়তি ভাঁজ। ধরে নিয়েছে: মরবে, কাজেই উচিত শেষ চেষ্টা করা। এবার কুঁজো হয়ে তেড়ে আসবে রানার দিকে।
রিকের চোখ বিস্ফারিত হতেই একই সময়ে তার বুকে ওয়ালথার তাক করল রানা। কিন্তু চোখের কোণে দেখল,
উঠে বসেছে নিক, ডানহাতে মেঝে থেকে ভারী একটা রেঞ্চ তুলেই ছুঁড়ল রানার মাথা লক্ষ্য করে।
যন্ত্রটা এল ঘুরতে ঘুরতে।
রানা চট করে বসতেই মাথার এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে গেল রেঞ্চ। নিশানা নড়ে গেলেও ট্রিগার টিপল রানা।
রিক বেণ্ডারের বাম কাঁধের ওপরের মাংস ফুটো করেছে। বুলেট। তাতে থামল না দানব। যেন ছুটন্ত ট্রাক। রানার মনে হলো, আকাশ থেকে ঝুঁকল বিশাল দৈত্য! থাবা বাড়িয়ে খপ করে পিস্তল কেড়ে নিতে চাইল সে। অন্য হাতে চেপে ধরেছে রানার গলা। ঘুরিয়ে নেয়া হলো ওকে, পরক্ষণে দড়াম করে ফেলল এসইউভির ছাতের কিনারায়। থরথর করে কেঁপে উঠেছে গোটা গাড়ি।
শুয়োরের বাচ্চা! রানার চোখের কাছে নাক নিল রিক বেণ্ডার। তোর উচিত ছিল আগেই খুন করা! এবার মরবি তুই!
পিঠে বেদম খোঁচা দিচ্ছে গাড়ির ছাত, ব্যথায় চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলেছে রানা। চাপা স্বরে বলল, কথা… ঠিক!
খল-খল করে হাসল রিক বেণ্ডার, পরক্ষণে রানাকে সরিয়ে আবারও ধুম করে ফেলল গাড়ির পাশে।
রানার মনে হলো ফেটে গেছে কিডনি। ব্যথা এতই বেশি, চোখে দেখল গাঢ় অন্ধকার। দানবের হাত দীর্ঘ, তার মুখ আছে আওতার বাইরে। শক্তহাতে ধরেছে রানার গলা।
শ্বাস আটকে যেতেই বামহাতে লোকটার বাহুর নার্ভে চাপ দিল রানা। কিন্তু ওক গাছের মত কঠিন হাতে ডাবতে চাইল না ওর আঙুল।
আবারও হাসল রিক। তুই আমার কাছে শিশু! আরও শক্তভাবে চেপে ধরল ওর গলা।
রানার কপাল ভাল, দানবের হাত এতই বড় যে ঠিকভাবে চাপ দিতে পারছে না শ্বাসনালীতে, নইলে মটু করে ভাঙত কার্টিলেজ; নিজের রক্তে ডুবে মরত রানা। না মরলেও প্রচণ্ড ব্যথা ও শ্বাসকষ্টে জ্ঞান হারাচ্ছে ও। মগজে আটকা পড়া রক্তের ধুপ-ধুপ শব্দ।
প্রাণে বাঁচতে হাঁটু তুলে দানবের ঊরুসন্ধিতে গুঁতো দিল রানা। এখন চাই দূরত্ব, ঠেলে সরাতে হবে পাহাড়টাকে। আবছাভাবে রানা শুনল নিকের কন্ঠ: খুন করো, রিক! খুন করো! মাদারচো…কে!
বড় দানবের চিৎকার কাজে এল রানার।
রিক বেণ্ডার বুঝে গেল, বেশি দ্রুত খুন করছে সে।
তা হতে পারে না!
আগেই বলেছে, এক এক করে ছিঁড়বে রানার হাত-পা। কথাটা মনে পড়তেই ওকে কাঁধে তুলে দূরে ছুঁড়ল সে।
উড়ে চলল রানা, তবে দুসেকেণ্ড পর ভারী পাথরের মত চিত হয়ে পড়ল মেঝেতে। ঠাস্ করে ঠুকে গেল মাথা। দাঁতের কামড় লেগে কেটে গেছে জিভ। তবুও খুশি, অন্তত বুক ভরে পাচ্ছে অক্সিজেন। তা ছাড়া, হাতে এখনও রয়ে গেছে ওয়ালথার।
ধুপ-ধাপ পায়ে ওর দিকে আসছে রিক বেণ্ডার।
তার দিকে পিস্তল তুলল রানা।
বসে নেই নিক। ঝাঁপিয়ে পড়ে খপ করে ধরল রানার বাহু। টানল নিজের দিকে। পুরক্ষণে বুলডোরের মত উঠে এল ভারী ওজন নিয়ে বুকের ওপর। ছোটভাই ঢেকে ফেলার আগেই রানার অরক্ষিত পাঁজরে কষে দুটো লাথি দিয়েছে রিক। কিন্তু নিজে খুন করবে বলে বাঁদর সাইযের লোকটাকে বড়ভাইয়ের বুট থেকে আড়াল করেছে নিক। প্রচণ্ড কিল বসাল রানার মাথার তালুতে। একটু পিছিয়ে বসল ভালভাবে মুখে ঘুষি মারতে।
রানার মনে হলো বুকে বিশাল পাহাড়। কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। বামহাত তুলে নিকের মুখ কোথায় খুঁজতে লাগল ও। ওর বুড়ো আঙুলটা পেয়ে গেল লোকটার নীল চোখ। দেরি না করে গায়ের জোরে বুড়ো আঙুল ইসল চোখের ভেতর। আকারে যত বড়ই হোক, চোখ গলে যেতেই স্বস্তিতে থাকল না দানব। জেলির মত কী যেন নামছে রানার আঙুল বেয়ে। ঝটকা দিয়ে সরে বেসুরো আর্তনাদ ছাড়ল নোকটা। তারই ফাঁকে খপ করে ধরল রানার গলা, ছিঁড়বে কণ্ঠনালী।
নিকের বুকে পিস্তলের নল তাক করল রানা, পরক্ষণে টিপল ট্রিগার। দানবের পিঠ থেকে বেরোল রক্তের ফোয়ারা। লাল একটা ধারা ফিনকি দিয়ে গিয়ে লাগল ছাতে। গুঙিয়ে উঠে কাত হয়ে পড়ছে দানব। মানসিক কষ্টে চিৎকার করে উঠল রিক বেণ্ডার। আবারও ট্রিগার টিপল রানা।
দুটো গুলিই ফুটো করেছে নিকের হৃৎপিণ্ড। মুহূর্ত পর রানার ওপর আবারও নামল পাহাড়। দুহাতে ধাক্কা দিয়ে ওজন সরাতে চাইল ও। নিক ছিল ওর আর রিকের মাঝে। লাশ সরলেই হামলে পড়বে অপেক্ষাকৃত ছোট দানব। পিস্তল হাতে ধড়মড় করে উঠে বসে তাকে খুঁজল রানা।
এসইউভির মুখ আড়াল করেছে ওঅর্কশপের একদিক। আশপাশে নেই রিক। চারপাশ দেখল সতর্ক রানা। ভেবেছিল তেড়ে আসবে লোকটা। কিন্তু প্রতিশোধের জন্যে অপেক্ষা করছে না সে। পালিয়ে গেছে ওঅর্কশপ ছেড়ে।
পিছু নেব না, ভাবল রানা।
আগে চাই সুস্থতা। মনে হচ্ছে চাপা পড়েছে গাড়ির নিচে। পরে দরকার হলে খুঁজে নেবে দানবটাকে। তা ছাড়া, যেজন্যে আসা, সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। এখন জানে, কে শত্রু এবং কেন খুন করতে চাইছে নিনা ভেঞ্চুরাকে।
গুলির শব্দে যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে পুলিশ। যদিও এখনও নেই সাইরেনের আর্তচিৎকার। এর কারণ বোধহয়, ওদের ওঅর্কশপ ইণ্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার একেবারে শেষমাথায়। নিয়মিত হাতুড়ির আওয়াজ ও চেঁচামেচি এখানে স্বাভাবিক।
সামান্য খুঁড়িয়ে হেঁটে ওঅর্কশপ ত্যাগ করল রানা। গিয়ে থামল সদাইয়ের ব্যাগের সামনে। ওটা তুলে বেরিয়ে এল গলি ছেড়ে। জুডি নিশ্চয়ই ভাবছে কেন এত দেরি। রেগেও গেছে বোধহয়। মোটেলের দিকে পা চালাল রানা।
.
১২.
নিনা ভেঞ্চুরাকে খুন করতে চেয়েছে দুই বেণ্ডার ভাই। সুযোগ পেলে খুন করত জুডি ও রানাকেও। এদের মত লোক যতদিন বাঁচবে, খুন হবে নিরীহ মানুষ। কাজেই রানার দায় নেই এদের প্রতি। কিন্তু আইনের লোক দেখবে অন্য দৃষ্টিতে। প্রথম সুযোগে চাইবে ওকে গ্রেফতার করতে। সুতরাং, এখন থেকে আরও সতর্ক হতে হবে ওকে।
সামনে হয়তো পড়বে আরও লাশ। আগেই কোথাও সরিয়ে দিতে হবে মাইকের দুই বোনকে, নইলে যখন-তখন খুন হবে তারা।
মোটেলের পার্কিং লটের হ্যালোজেন আলোয় রানা দেখল কাত হয়ে পড়ছে তুষারের তুলল। উঠানে পৌঁছে ওদের ঘরের দিকে তাকাল। জানালায় আবছা আলো।
লবি পেরিয়ে সংসারী লোকের মতই ঘরের সামনে হাজির হলো রানা, বামহাতে সদাইয়ের ব্যাগ। ডানহাতে টোকা দেয়ার আগে ভাবল: ভুললে চলবে না, জুডি পুলিশ অফিসার। সহজে মানবে না ও খুনোখুনি করে এসেছে। হয়তো এজন্যে তীব্র ঘৃণা করবে ওকে। সেক্ষেত্রে আরও কঠিন হবে ওর কাজ। মেয়েটার জন্যে মনোযোগ নষ্ট হলে হয়তো খুন হবে ওরা দুজনেই। এত রূপসী মেয়ে খুব কমই দেখেছে রানা। জুডি চুমু দেয়ায় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্টই হয়েছে ওর।
ঠিক করে ফেলল রানা, আপাতত কিছুই জানাবে না। ভাল হতো মাথার পাশে হাঁসের ডিমের মত ফোলা জায়গাটা জাদু দিয়ে হাওয়া করে দিতে পারলে। নব ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা। ভেজা পরিবেশ ঘরে। জুডি, আমি, রানা!
বেডরুমে নেই জুডি।
বিছানা এলোমেলো। চলছে টিভি। ধরা হয়েছে স্থানীয় স্টেশন। ভলিউম নিচু করা। বাথরুমের দরজা বন্ধ। তিরতির করে পানি পড়ছে শাওয়ার থেকে।
চেয়ারে সদাইয়ের ব্যাগ রেখে ওটা থেকে চকোলেট নিয়ে বিছানায় রাখল রানা। ওটা শান্তি চেয়ে সাদা পতাকা ওড়ানোর মত। জ্যাকেট খুলে রাখল চেয়ারের পিঠে। চেস্ট অভ ড্রয়ারের ওপরে আয়না দেখে চলে গেল ওখানে। ঘুষি পড়েছে চুলের আড়ালে। মুখে মারধরের চিহ্ন নেই। তবে ঘাড় ফুলেছে হাতির গর্দানের মত। শার্ট তুলে টিপেটুপে দেখল বুক। না, চিড় ধরেনি হাড়ে। বুটের ডগা ব্যবহার না করে ফুটবল প্লেয়ারের মত লাথি মেরেছে লোকটা। শার্ট ঠিকঠাক করে সব প্রমাণ লুকিয়ে ফেলল রানা।
মেয়েটা উলঙ্গ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিব্রত হোক, তা চায় না, তাই গলা উঁচু করে ডাকল, জুডি? আমি এসে পড়েছি!
জবাব নেই ভেতর থেকে।
রানার মেরুদণ্ড বেয়ে নামল শিরশিরে ঠাণ্ডা অনুভূতি।
জুডি!
সাড়া দিল না কেউ।
হ্যাণ্ডেল মুচড়ে বাথরুমের দরজা খুলল রানা।
কেউ নেই ভেতরে। বাতাসে জলীয় বাষ্প। শাওয়ার হেড থেকে পড়ছে সরু রেখায় পানি। একটু আগেও এখানে ছিল মেয়েটা। তা হলে গেল কোথায়?
হয়তো চিন্তার কিছু নেই, নিজেকে বুঝ দিল রানা।
নিরীহ মেয়ে নয় জুডি। জানে কীভাবে রক্ষা করতে হয় নিজেকে। ফ্লোরিডা থেকে রওনা হওয়ার পর বিমানে দেয়া সামান্য খাবার ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি ওদের। হয়তো বাইরে গেছে খাবার কিনতে।
এসব ভাবলেও কু ডাকছে রানার মন।
গেল কোথায় মেয়েটা?
প্রত্যাখ্যাত হয়ে রেগে গিয়েছিল?
সেজন্যে চলে গেছে?
মনে হয় না!
ঝুঁকে ম্যাট্রেস তুলল রানা। নিচে রয়ে গেছে ম্যাগনাম। ওয়ালথারের পাশে কোমরে জল ওটা। সরে দাঁড়াতেই বিছানার পাশে কীসের সঙ্গে যেন খট শব্দে পা লাগল ওর।
জুডির মোবাইল ফোন!
ওটার ফ্লিপ খুলতেই দেখল স্ক্রিন সেভার। এক মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে জুডি। বয়সে ওর চেয়ে কয়েক বছরের বড় মেয়েটা। চুল সোনালি। গড়ন মাঝারি হলেও ভারীর দিকে। চেহারা দেখে বোঝা যায়, ওরা দুই বোন। হাসিখুশি।
কারও মোবাইল ফোন আজকাল হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত ডায়রির মত। অন্যের জিনিস অনুমতি ছাড়া ধরা অপরাধ। পরিবেশ স্বাভাবিক থাকলে মোবাইল ফোনটা ছুঁয়েও দেখত না রানা। কিন্তু পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্বাভাবিক।
ওকে সংকেত দিতে মোবাইল ফোন রেখে গেছে জুডি। যে বা যারা কিডন্যাপ করেছে, হয়তো তুলেছে তাদের ছবি। ফোটোগ্রাফ ফাইল ঘেঁটে ডজনখানেক ছবি পেল রানা। বেশিরভাগই নিনা ও জুডির। একটা ছবিতে পুলিশ ইউনিফর্মে ফুলের মত সুন্দর জুডি। এ ছাড়া আছে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ছবি ও প্রাকৃতিক দৃশ্য। একটা ছবি নিনার পাহাড়ি বাড়ির সামনে।
কল রেজিস্টার ও ডায়াল করা নম্বর দেখল রানা। কদিন আগে ছবার কল করা হয়েছিল জন হার্বার্টের কাছে। তবে ওসবের পর কল করেছে আরও দুটো নম্বরে। প্রথম কলটি নিনা ভেঞ্চুরাকে। অন্তত বারোবার কল দিয়েছে জুডি। তারপর ঘন্টাখানেক আগে কল করেছে জন হার্বার্টের কাছে। এরপর বোনের ফোনে। শেষের কলটি ছিল ত্রিশ মিনিট আগে। সংখ্যাগুলো আরেকবার দেখে ভিউ বাটন টিপল রানা। মাত্র দুমিনিট কথা বলেছে জুডি। মেয়েটা কল দিয়েছিল কাকে?
সবুজ কল বাটন টিপল রানা।
কয়েক সেকেণ্ড পর ওদিক থেকে রিসিভ হলো কল। মহিলা কণ্ঠ জানাল: লিটল ফোর্ক শেরি ডিপার্টমেন্ট। কী সহায়তা দিতে পারি?
যা জানার জানা হয়েছে। লাল বাটন টিপে কল কেটে দিল রানা। আস্তে করে শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করল, মস্ত ভুল করে ফেলেছ, জুডি!
কথা রাখেনি মেয়েটা। পুলিশ অফিসার। এড়াতে পারেনি দায়িত্ব। সেজন্যে ওকে দোষও দিল না রানা।
বড় কোনও ভুল করলে শেষ হবে ওর ক্যারিয়ার, তাই পাহাড়ে কী হয়েছে, শেরিফের অফিসে জানাতে চেয়েছে জুডি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নিজের ক্যারিয়ার রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে বসেছে সে।
রানাকে সব কথা খুলে বলেনি রিক বেণ্ডার।
কিন্তু যতটুকু বলেছে, তা-ও কম নয়।
শহরের আণ্ডারওঅর্ল্ডের সর্বোচ্চ নেতা ন্যাশ ময়নিহানের হয়ে কাজ করছে শেরিফ অস্টিন ম্যাকলাস্কি। তার আগের শেরিফকে যখন পিটিয়ে মারছে রিক ও নিক, তখন ওখানে উপস্থিত ছিল লোকটা। একবারের জন্যেও বাধা দেয়নি। তার চোখের সামনেই শেরিফের কান ছিঁড়ে নিয়েছিল নিক।
পুরো খেলা চালাচ্ছে ন্যাশ ময়নিহান।
তার দলে আছে অস্থায়ী শেরিফ।
জুডি ফোন দিতেই ওর কল গেছে ম্যাকলাস্কির কাছে। এরপর দেরি না করে এখানে এসেছে লোকটা। কিছুই সন্দেহ করে দরজা খুলেছে জুডি। অস্ত্রের মুখে ওকে তুলে নিয়ে গেছে শেরিফ। সেসময়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে মোবাইল ফোন ফেলে গেছে জুডি। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, এ মুহূর্তে এই ঘর রানার জন্যে মরণফাঁদ। দেরি না করে বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।
সেরেছে! বিড়বিড় করল রানা। হাতে উঠে এসেছে দুই আগ্নেয়াস্ত্র। দরজার দিকে পা বাড়াবার আগেই হঠাৎ ঝনঝন করে জানালার কাঁচ ভেঙে মেঝেতে পড়ল কী যেন! দেখতে ওটা ছোট সিলিণ্ডারের মত। মুখে ধূসর ধোঁয়া।
সতর্ক করেনি কেউ। নীরবে কাজে নেমেছে লিটল ফোর্কের শেরিফ ডিপার্টমেন্ট। আগে ঘরে ফেলেছে টিয়ার গ্যাসের ক্যানিস্টার। এরপর পাঠাবে গুলি।
বুকের মাঝে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের গম্ভীর কণ্ঠ শুনল রানাঃ জলদি পালাও, রানা!
.
১৩.
সামনে আছে মাত্র দুটো পথ। আত্মসমর্পণ করতে হবে, নইলে ঠেকাতে হবে গ্রেফতার।
পারতপক্ষে আত্মসমর্পণ করবে না রানা। সেক্ষেত্রে একমাত্র পথ আইনের লোক এড়িয়ে যাওয়া। খুনিদের নেতা ময়নিহানের লোক শেরিফ ম্যাকলাস্কি। কিন্তু অধীনস্থদের ওপর তার কতটা প্রভাব আছে, জানার উপায় নেই। জুনিয়ররা পালন করে ঊর্ধ্বতন অফিসারের নির্দেশ। ম্যাকলাস্কির লোকদের কাছে রানা পিস্তল হাতে এক অপরাধী, ঝামেলা তৈরি করছে শহরে এসে। কাজেই তারা চাইবে ওকে গ্রেফতার করতে। তা যদি না পারে, প্রয়োজনে দেরি করবে না গুলি করে মারতে।
রানা চাইছে না, আইনের কেউ আহত বা নিহত হোক। কিন্তু আত্মসমর্পণ করলেই হারাবে অস্ত্র। সাইডওঅকে উপুড় করে শুইয়ে হাতদুটো আটকে দেবে হ্যাণ্ডকাফে। নিয়ে ভরে দেয়া হবে সেল-এ। ওখানে রানা হবে ম্যাকলাস্কির অসহায় শিকার। পরে ওকে সরিয়ে নেয়ার সময় কোনও দুর্ঘটনায় মরবে ও। হতে পারে, ওই সেল-এ ওর প্রথম দর্শনার্থী হবে রিক বেণ্ডার। সেক্ষেত্রে খুব দ্রুত আসবে মৃত্যু। হয়তো মোটেল কক্ষ ছাড়লেই খুন হবে শেরিফের গুলিতে।
যা করার করতে হবে এখনই!
শেরিফের লোক চাইছে টিয়ার গ্যাস সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসুক রানা। যদি তা না করে, গ্যাসের মুখোশ পরে ঘরে রেইড দেবে তারা। আশা করছে শ্বাস আটকে কাশছে বলে কিছুই করতে পারবে না ও। বাইরে নির্দেশ দিচ্ছে কারা যেন। ওদিকে মনোযোগ দিল না রানা। দরজা খুললেই খেলা শেষ ওর।
নিশ্চয়ই এই ঘরের দরজা বা বাথরুমের জানালা কাভার করেছে কয়েকজন অফিসার। ভাল অবস্থানে সন্তুষ্ট। ভাবছে বেরোবার কোনও পথ নেই। রানা ভাবছে, হয়তো জুডির কাছ থেকে এরা জানতে পারেনি, ও বাংলাদেশ মিলিটারির স্পেশাল ফোর্সের কমাণ্ডো ছিল। জানার কথা নয়, বিপদে পড়লে আমৃত্যু লড়াইয়ের ট্রেনিং আছে ওর। টিয়ার গ্যাস, সিএস, পাভা, নন-লিথাল কেমিকেল বা ইরিট্যান্ট বিষয়েও বিশেষ ট্রেনিং আছে।
ছোট ঘর ভরে গেছে গ্যাসে।
চেয়ারের পিঠ থেকে জ্যাকেট তুলে মুখে পেঁচিয়ে নিল রানা। ওটা কাজ করবে মুখোশের মত। তাতে ফুসফুস রক্ষা পেলেও ভীষণ জ্বলছে চোখ। পাতাদুটো বুজে চেস্ট অভ ড্রয়ারের কাছে গেল রানা। জোর একটানে মেঝেতে ফেলল টিভি। খাটের নিচের দিকে চেয়ে বকবক করছে আবহাওয়া বার্তা প্রচারক।
টিভিটাকে সিঁড়ির ধাপ হিসেবে ব্যবহার করে চেস্ট অভ ড্রয়ারে উঠল রানা। মোটেলের বাইরে শুনল অ্যাসল্ট টিমের বুটের আওয়াজ। চেঁচিয়ে বলছে কে কোথায় থাকবে। প্রায় সিধে হয়ে ছাতের সার্ভিস হ্যাঁচ খুলল রানা। দুহাতের জোরে উঠে এল নিচু ছাতের অ্যাটিকে। দেহ গড়িয়ে দেয়ার ফাঁকে লাথি মেরে আটকে দিল হ্যাঁচ। চিৎকার ও বুটের শব্দের নিচে চাপা পড়ল ধুপ শব্দ। এক সেকেণ্ড পর ধুম আওয়াজে ভেঙে পড়ল দরজা। নিচের ঘরে চিৎকার করছে কজন অফিসার। টেনে সরিয়ে দিচ্ছে আসবাবপত্র। মুখে মুখোশ, কিন্তু পরিষ্কার দেখছে না ধোয়ায়। আরও কসেকেণ্ড পর বুঝল, কেউ নেই ঘরে। লাথি মেরে খুলল বাথরুমের দরজা।
ওদিকে ওপরের ঘরে উঠে ডানদিকে ছুটল রানা। মোটেল তৈরির সময় অ্যাটিকে বসানো হয়নি দামি ফিটিং। মাঝেও নেই দেয়াল। একদৌড়ে দালানের আরেক মাথায় পৌঁছুল ও। জানা নেই নিচের ঘরে কী দেখবে। সাবধানে তুলল বৃত্তাকার হ্যাঁচ। নিঃশব্দে ভারী পাথরের মত খসে পড়ল নিচের অন্ধকারে।
ঘর খালি।
সরিয়ে রাখা হয়েছে জানালার পর্দা। বাইরে শেরিফ ডিপার্টমেন্টের গাড়িগুলোর উজ্জ্বল সাদা আলো। ঝরঝর ঝরছে তুষার। মুখ থেকে জ্যাকেট সরিয়ে গায়ে পরে নিল রানা, চলে গেল দরজার কাছে। কবাট এক ইঞ্চি ফাঁক করে উঁকি দিল বাইরে। সারি দেয়া পেছনের ঘরগুলোর কাছে অফিসাররা। বড় শহরের আইনরক্ষাকারী বিভাগের সোয়্যাট টিমের মত নয়। বাইরে তিনটে স্কোয়াড কার। দলে ডেপুটিরা বড়জোর দশ বা বারোজন। বেশিরভাগই গিয়ে ঢুকেছে রানা ও জুডির ছোট্ট ঘরে। মোটেলের বাইরে মাত্র দুজন। তাদের মাত্র একজনকে নিয়ে ভাবতে হবে, বুঝে গেল রানা। বেঁটে, মোটা লোকটার পরনে পুলিশ ইউনিফর্ম। দাঁড়িয়ে আছে শেরিফের গাড়ির পাশে।
আগে কখনও অস্টিন ম্যাকলাস্কিকে দেখেনি রানা, তার দৈহিক বর্ণনাও দেয়নি রিক বেণ্ডার, তবে পিপের মত বুকের লোকটাকে চিনতে দেরি হলো না ওর। এ ধরনের খুনি কাপুরুষ আগেও দেখেছে। গোলাগুলি হবে ভেবে পেছনে রয়ে যায় এরা। বিশেষ করে যখন বিপজ্জনক কাজে ঝাঁপ দেয়ার জন্যে রয়ে গেছে অধীনস্থ, নিরীহ কেউ।
ডেপুটিদের বুঝতে সময় লাগবে না কীভাবে বেরিয়ে গেছে রানা। দুমিনিট পরেই সার্চ শুরু করবে মোটেলের প্রতিটি ঘর। কাজেই উচিত সরে যাওয়া। পালিয়ে যাচ্ছে, তা নয়। তৈরি করবে কার্যকর প্ল্যান। এ মুহূর্তে কী করবে, স্থির করে নিল রানা। পরক্ষণে দরজা পেরিয়ে ছুটে গেল লবিতে। মেইন গেট পার হয়ে উড়ে চলল মোটা শেরিফকে লক্ষ্য করে।
জানালার দিকে চেয়ে আছে হোঁৎকা লোকটা। দেখছে না লবি থেকে উড়ে আসছে কে যেন। লম্বাটে চাঁদের মত চেহারা ম্যাকলাস্কির। সামান্য হাঁ হয়ে আছে মুখ। এই বুঝি ধরা পড়ল কালপ্রিট! ঊরুর পাশে রেখেছে রিভলভার। হয়তো প্রথম সুযোগেই খুন করবে রানাকে।
শেরিফ অপদার্থ হলেও চোখের কোণে ছুটন্ত রানাকে দেখেছে তার ডেপুটি, ঝট করে ঘুরে তাকাল সে। বিস্মিত, কেন হঠাৎ ছুটে আসছে লোকটা! তবে দুসেকেণ্ড পর তার চোখ পড়ল রানার হাতের উদ্যত দুই আগ্নেয়াস্ত্রের ওপর। দেরি হলো না বিপদ বুঝতে। ঝট করে রানার দিকে শটগান ঘোরাল সে। কিন্তু ততক্ষণে তার গায়ের কাছে পৌঁছে গেছে। রানা, ওপরে তুলল ওয়ালথারের নল।
ডেপুটি ট্রিগার টেপার আগেই তার বুকে লাগল রানার গুলি। গাড়ির দরজার পেছনে পিছলে পড়ল সে। লোকটাকে খুন করতে চায় না, তাই জেনেবুঝেই বুলেটপ্রুফ ভেস্টে গুলি করেছে রানা। ঠিকই ঠেকিয়ে দিয়েছে কেভলার, কিন্তু বুকের ব্যথায় তার মনে হবে আকাশ ছুঁড়ে পৌঁছে গেছে নরকে।
গতি হ্রাস না করে কোনাকুনিভাবে শেরিফের দিকে ছুটছে রানা। ওকে দেখল লোকটা। ঘুরে ওপরে তুলছে রিভলভার। তার পরনেও কেভলার ভেস্ট। রানার মন চাইল মাথাটা উড়িয়ে দিতে। কিন্তু উচিত হবে না সেটা। তাকে জীবিত চাই ওর। মোটকু বলতে পারবে কোথায় আছে জুডি।
রানাকে খতম করতেই এখানে এসেছে ম্যাকলাস্কি, নিজে খুন হতে নয়। রিভলভার তুলেই গুলি পাঠাল সে। কিন্তু তার লাইন অভ ফায়ারের তলে রয়ে গেল রানা। শরীর পিছলে তুষারে পা হড়কে সরসর করে চলেছে শেরিফের দিকে। মুহূর্তে পেরোল দুজনের মাঝের দশ ফুট দূরত্ব। সরে না গিয়ে রানাকে ফুটো করতে চাইছে লোকটা। কিন্তু রানার ডান পা সোজা লাগল তার হাঁটুর নিচের হাড়ে।
রানার ওপর ধুপ করে পড়ল ভারী লোকটা। হাত থেকে ছুটে গেছে রিভলভার। শেরিফকে নিয়ে এক গড়া দিয়ে তার বুকে উঠে এল রানা। থলথলে মাংসে গেঁথে গেছে হাঁটু। লোকটার থুতনির নিচে ম্যাগনামের নলের খোঁচা দিল ও। অন্যহাতের ওয়ালথার তাক করেছে মোটেলের দিকে।
গুলির শব্দে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে মোটেলের অফিসাররা। দৌড়ে উঠানে বেরোল এক অফিসার, মুখে মুখোশ। হাতে পাম্প-অ্যাকশন শটগান। ওটা তাক করল রানার দিকে।
ভাল লোক হোক বা মন্দ, তার গুলিতে মরতে আপত্তি আছে রানার। ওয়ালথার ঘুরিয়েই ডেপুটির বাম উরু ফুটো করল ও। করুণ আর্তনাদ ছেড়ে মাটিতে পড়ল লোকটা।
মোটেল থেকে কেউ বেরোলে খুন হবে! গলা ফাটিয়ে সতর্ক করল রানা। হুমকি হিসেবে জানালা দিয়ে পাঠিয়ে দিল দুটো গুলি। ছাতে গিয়ে লাগল ওগুলো।
অ্যাই, ওঠো! শেরিফ ম্যাকলাস্কিকে ধমক দিল রানা।
ধড়মড় করে উঠে বসল লোকটা। দুহাত তুলেছে মাথার ওপর। সাবধান, বাছা! গুলি কোরো না! আমার কাছে অস্ত্র নেই!
আমি তোমার বাছা নই! ওয়ালথার নেড়ে গাড়ি দেখাল রানা। ওঠো! ড্রাইভ করবে!
মস্তবড় ভুল করছ…
ম্যাগনাম রিভলভারের ব্যারেলের বাড়িতে লোকটার চোয়ালের মাংস ফাটিয়ে দিল রানা। একমাত্র ভুল হচ্ছে যে তোমাকে এখনও খুন করিনি। ড্রাইভিং সিটে ওঠো। নইলে ফুটো হবে মগজ।
দ্বিতীয়বার বলতে হলো না ম্যাকলাস্কিকে। লাফ দিয়ে উঠল ড্রাইভিং সিটে। এক সেকেণ্ড পর দরজা খুলে পেছনের সিটে চাপল রানা। শেরিফ আর ওর মাঝে স্টিলের জালের দেয়াল। কিন্তু ওটা ঠেকাতে পারবে না গুলি। রওনা হও! ধমক দিল রানা।
কোথায়? ব্যাক গিয়ার ফেলে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে এল ম্যাকলাস্কি।
বুকে গুলি খেয়েছে যে, এইমাত্র উঠে বসল সে-লোক।
রানা খুশি, আহত নয় ডেপুটি। আরেক ধমক দিল ম্যাকলাস্কিকে: গাড়ি নিয়ে রওনা হও। ভুলেও ফাঁদ পাতবে না। নইলে তোমার সামনে সত্যিকারের শেরিফের যা করেছিল বেণ্ডাররা, তেমনই কিছু করে ছাড়ব তোমার।
এ কথায় পুরু গর্দানটা কাঁধে ডেবে বসল ম্যাকলাস্কির।
হ্যাঁ, সবই জানি, বলল রানা। এ-ও অজানা নেই কী করছ ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে যোগ দিয়ে। পেছনের মোটেলে পার্কিং লটের দিকে ছুট দিয়েছে ডেপুটিরা। গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করবে। রেডিয়ো চালু করো, ম্যাকলাস্কি। ওদের বলে দাও যেন পিছু না নেয়। নইলে খুন হবে তুমি।
রেডিয়ো হাতে নিল ম্যাকলাস্কি। অনুসরণ করতে নিষেধ করল ডেপুটিদের। ঝড়ের গতি তুলে ছুটছে গাড়ি। পেছনের তুষার ঝড়টাকে যেন টেক্কা দেবে।
শহর থেকে বেরিয়ে যাও, নির্দেশ দিল রানা।
যাব কোথায়?
পছন্দমত জায়গা দেখলে বলব কোথায় থামতে হবে।
তারপর কী হবে? মেরে ফেলবে আমাকে?
এখনও জানি না। তবে আগে জানব কী করেছ জুডির। ওর ক্ষতি না হলে খুন তোমাকে না-ও করতে পারি।
ঈশ্বরের শপথ, ওর ক্ষতি করিনি। নিরাপদেই আছে।
সেক্ষেত্রে বেঁচেও যেতে পারো, বলল রানা, তবে তোমার বলতে হবে ও এখন কোথায়।
মিথ্যা বলব না। ও আছে এখন ময়নিহানের ওখানে।
জায়গাটা কোথায়?
জানি না।
দুবার ক্লিক-ক্লিক শব্দে কক হলো ম্যাগনামের হ্যামার।
মনে মনে কুঁকড়ে গেল ম্যাকুলাস্কি। ঈশ্বরের শপথ… যিশুর কসম… জানি না ওকে কোথায় নিয়ে গেছে সে।
ভেবে বের করো কোথায় থাকবে, স্টিলের জালে ম্যাগনামের নল দিয়ে খড়-খড় আওয়াজ তুলল রানা। তোমাকে থামতে বলার আগপর্যন্ত সময় পাচ্ছ। এমনিতেই বেঁচে আছ খামোকা। ঠিক তথ্য না দিলে ধরে নেব আর বাঁচার আগ্রহ নেই তোমার।
.
১৪.
হারামজাদি কুত্তী! বল ওই শুয়োরের বাচ্চা কে! নইলে ভাবতেও পারবি না কী পরিমাণ ব্যথা পাবি!
বুলেটের ক্ষতে কোমর থেকে কাঁধ পর্যন্ত ব্যান্ডেজ করা হয়েছে রিক বেণ্ডারের। দাঁত খিঁচিয়ে জুডিকে দেখছে সে।
জুডির মনে হচ্ছে সামনে হাজির হয়েছে রূপকথার ভয়ঙ্কর কোনও রাক্ষস। প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ঘরে ধাতব এক চেয়ারে বসে আছে ও। চেয়ারের পেছন পায়ে হ্যাণ্ডকাফে আটকে রাখা হয়েছে ওর হাতদুটো। কেড়ে নেয়া হয়েছে লিনেন জ্যাকেট। খানিকটা ছিঁড়ে গেছে ঘি রঙা ব্লাউস। দেখা যাচ্ছে ব্রা। পায়ে বুট নেই। খালি পা স্পর্শ করছে বরফ শীতল মেঝে। রিক বেণ্ডারের প্রতিটি কথায় শিউরে শিউরে উঠছে জুডি।
কে ওই কুত্তার বাচ্চা! আবারও জানতে চাইল রিক।
চোখে জেদ নিয়ে তার দিকে চেয়ে রইল জুডি।
চড়াৎ করে ওর গালে কষে একটা চড় দিল রিক। কড়া পড়ে যাওয়া হাতের আঘাতে প্রায় ফেটে গেছে জুডির গালের গোলাপি বৃক। ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেছে মাথা। আপাতত চোখের সামনে দেখছে ঝিলমিলে সব নক্ষত্র।
কে খুন করেছে আমার ভাইকে? আবারও হাত ওপরে তুলল রিক।
বাদ দাও, ডেস্ক ঘুরে এগিয়ে এল ন্যাশ ময়নিহান। তুমি তো দেখছি খুন করবে মেয়েটাকে!
হ্যাঁ, তা-ই করব, যদি মুখ না খোলে! বল, কুত্তী! আবারও উল্টো হাতের চড় দিল রিক।
এবার ঠোঁটের পাশে রক্ত বেরোলেও জোর খাঁটিয়ে মাথা উঁচু করে বসল জুডি। শক্ত মেয়ে, ভাল পুলিশ, তবুও মুখ থেকে বেরোল মৃদু গোঙানি।
যথেষ্ট হয়েছে, রিক!
ন্যাশ ময়নিহানের কথা না মেনে মুঠো করে জুডির চুল ধরল রিক। হ্যাঁচকা টানে আরেক দিকে সরিয়ে দিল মাথা। ডানহাত মুঠো করেছে ঘুষি মারতে। কিন্তু তার বাইসেপ চেপে ধরল ন্যাশ ময়নিহান। যথেষ্ট, রিক! এবার নরম সুরে বলেছে। হাত সামলে, নইলে ভাল হবে না।
অন্য কেউ গায়ে হাত দিলে মটমট করে তার আঙুল ভাঙত রিক বেণ্ডার, কিন্তু অন্য জিনিস ময়নিহান। আস্তে করে মাথা দোলাল রিক।
খুন করলে লাভ নেই, বলল ময়নিহান, তাতে ফিরবে না নিক।
না, তা ঠিক। কিন্তু রাগ কমবে আমার।
ছোটবেলা থেকেই হাজারবার ছোটভাইকে খুন করতে চেয়েছে সে। কীভাবে করবে রীতিমত গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছিল ওটা। কখনও ভাবত পাথর দিয়ে খুঁড়িয়ে দেবে ওর মাথা। কিন্তু বড় হওয়ার পর ভাবতে লাগল ঠিক কী অস্ত্র দিয়ে খতম করবে নিককে। বারবার ভেবেও স্থির করতে পারেনি খুনের সময় ছোরা, কুঠার বা রিভলভার কোটা ব্যবহার করবে। কিন্তু সত্যিই যখন ওকে ফেলে মরেই গেল নিক, ভীষণ খারাপ লাগল তার।
নিকের হাঁটু ফুটো করেছে বাদামি লোকটা। গলিয়ে দিয়েছে নীল চোখ। তারপর ফুটো করে দিয়েছে হৃৎপিণ্ড। গুলি যেখান দিয়ে বেরিয়েছে সেই গর্তে অনায়াসেই মুঠো ঢুকবে রিকের। কখনও ভাবেনি এভাবে শেষ হবে ওর ছোটভাই। জীবনের বড় আনন্দ ছিল, ভেবেছে কীভাবে খুন করবে নিককে। কিন্তু সেই আনন্দ থেকে ওকে বঞ্চিত করেছে বাদামি কুকুরের বাচ্চা। ঠিক সেজন্যেও নয়, অন্য কারণে শীতল রাগে কুত্তাপাগল হয়ে গেছে সে।
একটু পর পর খুন করতে চাইলেও সারাজীবনেও কখনও নিকের ক্ষতি করেনি রিক। কাউকে যদি সত্যিই ভালবেসে থাকে, সে মানুষ ওই নিক বেণ্ডার। রিক আর নিক যমজ ভাই, ছিল অদ্ভুত এক বাঁধন। হ্যাঁ, এটা ঠিক, ট্যাড়া ছিল নিক, মগজটাও ছিল বিকৃত, কিন্তু তবুও সে ছিল ওরই ছোটভাই। বড়ভাই হিসেবে ভেবেচিন্তে ওকে পরিচালনা করত সে। ওদের মা ছিল বাজে মেয়েলোক। সর্বক্ষণ মগজে খেলত কোথায় পাবে আরেকটা ড্রিঙ্ক। একদিন লিউইসভিলের পতিতালয়ে গিয়ে ভর্তি হলো সে। তারপর আর খোঁজ পাওয়া গেল না তার। আর বাবা? সে ছিল রাগী বাইসন। সুযোগ পেলেই পিটিয়ে খুন করতে চাইত ওদের দুভাইকে। তারপর একদিন ধর্ষণ করে দুই মহিলাকে মেরে ফেলল লোকটা। তখন চড়িয়ে দেয়া হলো ইলেকট্রিক চেয়ারে। খেল খতম। নানান এতিমখানায় কাটল কবছর। তারপর পালিয়ে গিয়ে অপরাধ জগতে ঠাই নিল রিক ও নিক। কিছু দিন পর ভরে দেয়া হলো কিশোর কারাগারে। এভাবেই বড় হয়েছে ওরা। বারবার গেছে জেলখানায়। তবে বছরের পর বছর ধরে ছোটভাই নিকের সব দায় ছিল রিকের কাঁধে।
এতদিন ওকে বাঁচিয়ে রেখেছে রিক।
কিন্তু এবার আর পারেনি।
মেয়েটা বাঁচলে কাজে লাগবে, রিককে জানাল ময়নিহান, ওর মাধ্যমে পাওয়া যাবে নিনা ভেঞ্চুরাকে।
আমাদেরকে কিছুই বলবে না এই মেয়ে, বস্, জুডির চুল ছেড়ে দিল রিক।
বুকে নেমে গেল জুডির মাথা। মার খেয়ে এবং ভয়ে প্রায় অচেতন।
সত্যিই হয়তো কাজে আসবে না, বলল ময়নিহান। তবে হয়তো ওর কারণে গর্ত থেকে বেরোবে ওর বোন। রিকের সুস্থ কাঁধ চাপড়ে দিল টপ টেরর। তা ছাড়া, এর কারণে হাজির হবে ওই লোক। খুঁজতে যাব কেন, নিজে এসে আমাদের হাতে ধরা দেবে সে।
এই বেটি মরলে ভাল লাগবে আমার, জোর দিয়ে বলল রিক। পেছনে ঠেলে দিল জুডির মাথা। শক্ত করে ধরল বেচারির চোয়াল।
এক পা সরে রিক ও জুডির মাঝে থামল ময়নিহান। বিরক্ত হয়ে সরে গেল দানব।
আগেই বলেছি, রিক, বাড়াবাড়ি নয়, আবারও বলল ময়নিহান। কণ্ঠস্বরে কী যেন। মুখে প্রকাশ না করেও বুঝিয়ে দিয়েছে, এরপর আর সাবধান করবে না সে।
বসের দিকে তাকাল রিক।
স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখছে ময়নিহান, ঠোঁটের কোণে আবছা হাসি।
মানুষকে ব্যথা দিতে ওস্তাদ রিক।
কিন্তু তার চেয়েও অনেক দক্ষ বস্ ন্যাশ ময়নিহান। এমনি এমনি ভূমিদস্যু হয়নি সে।
চোখ সরিয়ে নিল রিক। হাত বোলাল মাথার চুলে। হাতে লাগল কীসের ছোট্ট গুটলি। ওই রক্ত ওর না নিকের, ভাবল সে। বাদামি লোকটা খুনের সময় ওর ছোটভাইয়ের বুক থেকে ছিটকে উঠেছিল রক্ত। আবার এমনও হতে পারে লোকটা জঙ্গলে মাথা ফাটানোর সময় জমেছে রক্তের এই মার্বেল। করুণ অবস্থা ওর। এটা পিছিয়ে যাওয়ার ভাল অজুহাত। মুখ রক্ষা হবে তাতে। আমি চললাম, গোসল করতে হবে।
পিঠটান না দিয়ে উপায় নেই রিকের। ন্যাশ ময়নিহান সম্পর্কে যা শুনেছে, তার অর্ধেক সত্যি হলেও তা ভয়ঙ্কর আতঙ্কজনক। তা ছাড়া, ন্যাশ ময়নিহান আগেই ওর হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিলে উপায় থাকবে না বাদামি কুকুরটাকে খতম করার। দরজার দিকে রওনা হলো সে।
পেছন থেকে ওকে দেখছে ন্যাশ ময়নিহান। ঘর ছেড়ে দানবটা বিদায় নেয়ায় জুডির দিকে তাকাল সে।
চোখ তুলে তাকেই দেখছে মেয়েটা।
ময়নিহানের তালু থেকে কবজির খাপে সড়াৎ করে ফিরল ক্ষুর। ঠিক করে নিল ভারস্যাক সুটের হাতা। ঠোঁটে শীতল হাসি। জুডির চোখ দেখে বুঝল, বেচারি ভাবছে ভালই হত ঘরে রিক বেণ্ডার রয়ে গেলে।
.
১৫.
আবারও বলছি… ভুলেও পিছু নেবে না, পুলিশ রেডিয়ো চ্যানেলে বলছে শেরিফ ম্যাকলাস্কি। আমাকে উদ্ধার করতে কোনও ধরনের চেষ্টা করবে না। নিজেই সমাধান করব এই সমস্যা। আবারও বলছি…
ডেপুটিরা হয়তো উল্টে ব্যস্ত হবে তাকে খুঁজতে। যোগাযোগ করবে স্টেট ট্রুপার ও ফ্র্যাঙ্কফোর্টের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে। বাদ পড়বে না এফবিআই ফিল্ড অফিস। ফলে কঠিন হবে জুডিকে উদ্ধার করা।
রানার পিস্তলের ভয় করছে না ম্যাকলাস্কি। তার মূল ভয় উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত নেবে ডেপুটিরা। প্রথমে দলের সবাইকে পিছিয়ে যেতে বলেছে সে। এরপর শুরু করেছে হুমকি দিতে। খবরদার, পিছু নেবে না কেউ!
বেশিরভাগ পুলিশের গাড়িতে থাকে ট্র্যান্সপণ্ডার ও জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম, কিন্তু বাজেট নেই বলে ওগুলো ব্যবহার করে না লিটল ফোর্কের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুরু হয়েছে মাঝারি তুষারপাত। আকাশ থেকে চোখ রাখবে কপ্টার বা হালকা বিমান, তা হবে না। তবে রানাদের গাড়ি দেখে পুলিশে জানাতে পারে স্থানীয় কেউ। অবশ্য সে সম্ভাবনা কমই। আরও বাড়ছে তুষার ঝড়। শহর থেকে পাঁচ মাইল সরে এসেছে রানারা। এখন আছে খনি এলাকায়। দশ বছর আগে এখান থেকে তল্পি গুটিয়ে নিয়েছে শেষ খনি কোম্পানির মালিক।
পাহাড়ি এক তাকের নিচে অযত্নে পড়ে থাকা কাঠের কেবিন দেখে ওটার পাশেই গাড়ি রাখতে বলল রানা।
তুষারে ছাওয়া কেবিনের ছাত ও দেয়াল। পিস্তলের মুখে শেরিফকে কেবিনে ঢোকাল-রানা। আবছা আলোয় দেখল ভেতরে কটা ভাঙা চেয়ার ও একটা মাঝারি টেবিল। টেবিলের পাটাতনটা তুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল রানা। লাথি দিয়ে ভাঙল মাঝখান থেকে। দেয়ালে খাড়াভাবে রাখল দুই তক্তা। শেরিফের হাতদুটো তক্তার পেছনে নিয়ে আটকে দিল হ্যাণ্ডকাফে। রানা চলে যাওয়ার পর লোকটা পালাতে চাইলে সেটা কঠিন হবে তার জন্যে।
ওই তক্তা মেঝেতে পড়লেই গুলি করব তোমার বুকে, দুশ্চিন্তার ভেতর ম্যাকলাস্কিকে রাখতে চাইছে রানা।
তক্তা যেন কাত হয়ে পড়ে না যায়, সেজন্যে সাবধানে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল শেরিফ।
কোমরে ওয়ালথার খুঁজে হাতে রিকের ম্যাগনাম রিভলভারটা নিল রানা। চকচকে স্টিলের অস্ত্রটা দেখতে ভয়ঙ্কর।
এবার মুখ খোলো, ম্যাকলাস্কি। প্রমাণ করো তোমার জীবনের কোনও মূল্য আছে আমার কাছে।
আগেই বলেছি, জানি না মেয়েটা এখন কোথায়। নিয়ে তুলে দিয়েছি ন্যাশ ময়নিহানের হাতে। তারপর ওরা কোথায় গেছে, জানা নেই। তখন মোটেল থেকে খবর এল, তুমি ফিরেছ। তারপর দেরি না করে ওখানে গেলাম।
কোথায় পৌঁছে দিয়েছ মেয়েটাকে?
শহরে একটা রেস্তোরাঁ আছে, ওটার নাম…
ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁ? জুডির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছিল রানার। তখন বিষয়টি খুব গুরুত্ব দেয়নি। পুরনো মালিকের কাছ থেকে ওই রেস্তোরাঁ কিনেছে ন্যাশ ময়নিহান। লিটল ফোর্কের বহু সম্পত্তিই কিনছে সে। নিজের জন্যে শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে ওই রেস্তোরাঁ।
হ্যাঁ… অবাক চোখে ওকে দেখল ম্যাকলাস্কি। ভিলাজ ও-সঁও।
জায়গাটা কোথায়?
এলাকাটা কোথায় তার বর্ণনা দিল ম্যাকলাস্কি।
ন্যাশ ময়নিহান। তার সম্পর্কে জানাও।
কী জানাব?
প্রথমে বলো দেখতে কেমন সে।
যাতে চিনলেই খুন করতে পারো?
হয়তো।
পুলিশী বর্ণনা দিল ম্যাকলাস্কি: শ্বেতাঙ্গ, পুরুষ। লম্বায় তোমার সমানই। ওজন দু শ পাউণ্ড। অ্যাথলেটিক শরীর। বয়স পঞ্চাশ মত। মাথায় হেঁটে রাখা ধূসর চুল। খুব ভাল করে আঁচড়ানো। পরনে ডিযাইনার, সুট। বুঝতেই পারছ, টাকার অভাব নেই।
বুঝলাম। এবার এমন কিছু বলো, যেগুলো চট করে বোঝা যায় না।
যেমন? আসলে কী জানতে চাও?
কথা বললে গুলি খেয়ে মরবে না, সেটা মাথায় রাখো, ম্যাকলাস্কি, ম্যাগনামের নল দিয়ে শেরিফের বুকে মাঝারি এক খোঁচা দিল রানা।
ওর বক্তব্য বুঝতে পেরেছে লোকটা। আন্দাজ তিন বছর আগে এসেছে সে, সঙ্গে এনেছে প্রচুর টাকা। ভাল বিনিয়োগকারীদের মত কিনেছে শহরের এবং বাইরের অনেক জমি। এসেছে টেক্সাস থেকে। ওখানে তার বড় ব্যবসা আছে।
কী ধরনের ব্যবসা?
উদাস হয়ে অন্যদিকে তাকাল ম্যাকলাস্কি।
রানা কক করল ম্যাগনামের হ্যামার।
বুঝতেই পারছ কী ধরনের ব্যবসা।
অর্গানাইযড ক্রাইম?
ওই ধরনেরই, ঠোঁট বাঁকা করল শেরিফ। জানোও না কীসে নাক খুঁজেছ। একা মানুষ। বোকার মত ভাবছ লড়বে ন্যাশ ময়নিহানের বিরুদ্ধে! ওর আণ্ডারে আছে অনেক গুণ্ডা।
যা দরকার, সেটা করব।
খুন হবে।
হয়তো।
তাতে ভুল নেই। রাগ নিয়ে মাথা নাড়ল ম্যাকলাস্কি। শুনেছি অনেকেই চেয়েছে ওকে খুন করতে। কিন্তু কিছুই হয়নি তার। তবে যারা খুন করতে চেয়েছে, তারা এখন দুনিয়ায় নেই।
বাধ্য হয়ে আমারও অনেককে খুন করতে হয়েছে।
রাগের জায়গায় ম্যাকলাস্কির মুখে ফুটল ভয়। তবুও বলল, তোমার উচিত ন্যাশ ময়নিহানের কথা ভুলে যাওয়া। মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাও। ভাল হবে তোমার।
আগে চাই জুডিকে, বলল রানা, আপাতত কতজন লোক আছে ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে?
স্থানীয় ছোকরা? আট-দশজন। নাক দিয়ে ঘোঁৎ শব্দ করল শেরিফ। তুমি আসার আগে ছিল বারো-চোদ্দজন।
মৃদু মাথা দোলাল রানা। তা ঠিক।
কিন্তু এরা পাতি মস্তান। এবার তোমাকে খতম করতে বাইরে থেকে তোক আনছে সে। তারা হবে অন্যরকম।
বেশ্যার ভাইদের মত? বেণ্ডাররা? ওরা কিছুই না। এবার আসবে একদল আসল খুনি। তাদের কাছে বেণ্ডাররা দুধের শিশু।
বেণ্ডারদের নিক আর নেই, বলল রানা।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল শেরিফের। ফাঁক হতেই লালা দেখা গেল ঠোঁটের কশে। খুন করেছ নিক বেণ্ডারকে? হায়, ঈশ্বর! এবার…।
আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। পাহাড়েও চেষ্টা করেছে কজন। এমনকী তুমিও চেষ্টার ত্রুটি করোনি। ম্যাকলাস্কির ফোলা বুকে ম্যাগনামের নল দিয়ে হালকা একটা খোঁচা দিল রানা। হ্যাঁ, তুমিও!
খুন করে দায় এড়াতে চাইছ? মাথা নাড়ল শেরিফ। হয়তো উপায় আছে তোমাকে সাহায্য করার। একটা চুক্তি করতে পারি আমরা। …তুমি কী বলে?
আমি কোনও দায় এড়াচ্ছি না, ম্যাকলাস্কি। কথাগুলো বলেছি তোমাকে অবস্থার গুরুত্ব বোঝাতে। লোকটার পেটে নল দিয়ে গুতো দিল রানা। যাতে বুঝতে পারো, হাল ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্যে আসিনি আমি। কথাটা বুঝতে পেরেছ?
ভুরু কুঁচকে মেঝে দেখল ম্যাকলাস্কি। হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।
কাজেই সময় নষ্ট না করে বলতে থাকো ময়নিহানের ব্যাপারে।
তুমি তো এমনিতেই আমাকে খুন করবে, কর্কশ স্বরে ফিসফিস করল ম্যাকলাস্কি। তা হলে মুখ খুলে লাভ কী?
সহজে মরার পথ আছে, আবার আছে কঠিন উপায়ও, যখন মনে হবে মরে গেলেই ভাল হতো, বলল রানা। রিক বেণ্ডার বলেছে কীভাবে খুন করেছ তোমরা শেরিফ ফ্র্যাঙ্ক। ম্যালভিকে। আমি হয়তো তোমার ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি কিছু করতে চাইব।
ফ্র্যাঙ্কের খুনের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।
তাকে বাঁচাবার কোনও চেষ্টাই করোনি তুমি। এটাও সমান অপরাধ। তুমি খুনির সহযোগী, মাফ পাবে না আদালতে।
নিজ দোষে মরেছে ফ্র্যাঙ্ক, বুকের কাছে ঝুলে গেছে ম্যাকলাস্কির থুতনি। বুঝতে পারছে, মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে লাভ নেই। যদি আমাদের মত টাকা নিয়ে মুখ বুজে থাকত, বা টাকা নিয়ে চলে যেত, কিছুই হতো না ওর। ময়নিহানের কথা শুনল না সে।
ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভি চায়নি শহরে অপরাধের রাজত্ব তৈরি করুক ময়নিহান। নিজ দায়িত্ব পালন করছিল সে। ওই একই দায়িত্ব তোমারও।
তুমি প্রায় কিছুই জানে না।
কী জানি না?
একটা চুক্তি করেছে ন্যাশ ময়নিহান আর জাজ হোল্ড।
বিচারক জড়িয়ে গেছে অপরাধে?
হ্যাঁ। জাজ এসবে জড়িয়ে না গেলে একা কিছুই করতে পারত না ময়নিহান।
ওদের চুক্তিটা কীসের, খুলে বলো।
শহরে বিনিয়োগ করতে লাগল ময়নিহান। তারপর টুরিযমের জন্যে সাড়া পড়তেই নিজেই কিনতে লাগল শহরে জমি আর বাড়ি। প্রতিযোগিতা করতে আসেনি কেউ। যে সম্পত্তি পছন্দ করেছে ময়নিহান; রাবার স্ট্যাম্পে সই করে সেটা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে জাজ হোল্ড। নিজেরা নিয়েছে সেরা দর্শনীয় সব জায়গা। পরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করবে। কিন্তু এসব টের পেয়ে গেল শেরিফ ম্যালভি। জাজ হোল্ড আর ময়নিহানকে হুমকি দিল, জেলের রুটি খাইয়ে ছাড়বে সে।
তদন্ত করতে শুরু করেছিল?
নাক দিয়ে আবারও ঘোৎ আওয়াজ করল ম্যাকলাস্কি। কীসের তদন্ত! সে ব্ল্যাকমেইল করছিল ওদেরকে।
জাজ ও ময়নিহানের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইল, যাতে টাকা বা সম্পত্তির ভাগ পায়?
তার দাবি ছিল নগদ টাকার। সেসব দেবে বলল ওরা। ম্যালভি বলেছিল দূরে কোথাও চলে যাবে।
কিন্তু তাকে বাঁচতে দিল না ময়নিহান। টাকা দেয়ার বদলে দুই বেণ্ডার আর তোমাকে পাঠাল খুন করতে।
না, ভুল ভাবছ। চুক্তি মত টাকা দিয়েছিল ময়নিহান। যাতে ম্যালভি চলে যায়। কিন্তু বোকা শুয়োরের মত লোভী হয়ে উঠল ম্যালভি। শেরিফ হিসেবে এসবে গলাতে গেল নিজের নাক। যাতে আরও টাকা আদায় করতে পারে। হয়তো ভেবেছিল হুমকি দিয়ে ওদেরকে কাত করে দেবে। এরপরই ম্যালভির সঙ্গে কথা বলতে গেল বেণ্ডাররা।
এই চুক্তি থেকে তুমি নিজে কী পাচ্ছ?
হোয়াইট র্যাপিডে পারিবারিক জমি আছে, সেজন্যে ভাল টাকা দিচ্ছে ময়নিহান। বাঁকা হয়ে বেকায়দাভাবে কাঁধ ঝকাল ম্যাকলাস্কি। তা ছাড়া, ম্যালভি পথ থেকে সরে যাওয়ায় আমাকে দেয়া হয়েছে শেরিফের পদ।
অর্থাৎ, সবই করা হচ্ছে টাকার জন্যে?
শুধু তা নয়, প্রায় ফিসফিস করল ম্যাকলাস্কি, আমার স্ত্রী বা ছেলেটা বাঁচবে না ময়নিহানের কথামত না চললে। আমার ছেলের বয়স মাত্র বারো বছর। মাঝে মাঝেই ময়নিহান জিজ্ঞেস করে, ওরা কেমন আছে। আসলে বুঝিয়ে দেয়, তেড়িবেড়ি করলে দুনিয়ায় রাখবে না ওদেরকে।
চুপ করে রানার দিকে চেয়ে রইল লোকটা! নীরবতা নেমেছে কেবিনে।
তুমি তো পুলিশ অফিসার, হুমকি দেয়া হচ্ছে জানাতে পারতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। তা করোনি কেন?
ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভির কাছে যাব? মুখের ওপর হাসত। আমাদের মতই সমান দুর্নীতিপরায়ণ ছিল সে।
ছোট শহরের রাজনীতি, অবল রানা। এসবে জড়িয়ে গিয়ে বিরক্তি বোধ করছে এখন। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, তার মানে, শেরিফের কাছে গেলে লাভ হতো না। ময়নিহানের মতই অপরাধে নাক ডুবিয়ে রেখেছে জাজ হোল্ড। সেক্ষেত্রে বাইরে থেকে সাহায্য চাইলে না কেন? বসে থাকত না এফবিআই।
কিন্তু তারা আসার আগেই মরত আমার স্ত্রী ও ছেলে। চাইনি বাড়ি ফিরে ওদের গলা কাটা লাশ দেখতে।
আরও বাড়ছে তুষার ঝড়ের প্রকোপ। বরফের মত ঠাণ্ডা হাওয়ার তোড়ে ধুপ-ধাপ শব্দে বাড়ি খাচ্ছে ভাঙা জানালার কবাট। ম্যাকলাস্কির জন্যে মনে করুণা এল না রানার। লোকটা সত্যিকারের কাপুরুষ। কোনও চেষ্টা বা প্রতিরোধ না করেই অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতাকে। সাধারণ মানুষ উপায় না পেলে ভেগে যেত স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। বা, গেঁথে দিত ময়নিহানের মগজে বুলেট। না, আসলে পয়সার লোভ পেয়ে বসেছে একে। জমি বিক্রি করে পাবে লাখ লাখ ডলার। এমন এক লোক, যে কি না নিজ বিপদ দেখলে শত্রুর হাতে তুলে দেবে স্ত্রী-পুত্রকে। অন্যরা মরলে মরুক, যেন ফুলের টোকাও না দেয়া হয় তার গায়ে।
নিনা ভেঞ্চুরা সম্পর্কে বলো, বলল রানা। ওর পেছনে লেগেছে ময়নিহান। কেন? শেরিফ ম্যালভির মৃত্যুর সময় সব দেখে ফেলে, ঠিক?
হ্যাঁ, ওখানেই ছিল। কিন্তু শুধু সেজন্যে তাকে খুঁজছে না।
ভুরু কুঁচকে ম্যাকলাস্কিকে দেখল রানা।
মুখ তুলে ওকে দেখছে লোকটা। রানা অনেক কিছুই জানে না বুঝে খুশিতে চকচক করছে চোখ। মাথা নাড়ল। ভেবেছিলে সবই জেনে গেছ, তাই না? তা নয়, পুরো ঘটনার অর্ধেকও বুঝতে পারোনি এখনও।
কড়া চোখে তাকে দেখল রানা। তুমি জানাবে বলে অপেক্ষা করছি।
তুমি তো চিনতে ওই মেয়েলোকটাকে, ঠিক? জানো ডিভোর্স হওয়ার পর কী হয়েছে?
চুপ করে আছে রানা।
নতুন নাগর জুটিয়ে নিয়েছিল।
সে-লোক বোধহয় ময়নিহান নয়? জানতে চাইল রানা।
মাথা নাড়ল ম্যাকলাস্কি। ফ্র্যাঙ্ক ম্যালভি। ময়নিহান বা আমাদেরকে ব্ল্যাকমেইলিঙের সময় তাকে সাহায্য করেছে নিনা ভেঞ্চুরা।
হতবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল বিস্মিত রানা।
এখনও চাইছে ব্ল্যাকমেইল করতে। তার চাই কমপক্ষে দুই মিলিয়ন ডলার।
.
১৬.
আবার শেরিফের গাড়িতে চাপল রানা বিশ মিনিট পর। এখন সঙ্গে নেই অস্টিন ম্যাকলাস্কি। তার কথা শুনে চমকে গেছে ও। লিটল ফোর্কের দিকে রওনা হয়ে ভাবছে।
জানত না নিরপরাধ নয় নিনা ভেঞ্চুরা। ওর ধারণা হয়েছিল, বিপজ্জনক ক্রিমিনালদের এড়াতে প্রাণ ভয়ে লুকিয়ে আছে সে। কিন্তু ওই মহিলা এ শহরের অন্য ক্রিমিনালদের মতই। ঘটনা শুরু হয়েছিল ভিলাজ-ও-সঁওর ছোট এক কাজ হাতে নিয়ে, তারপর একসময়ে নিনা ভেঞ্চুরা জানল অপরাধে জড়িয়ে গেছে জাজ হোল্ড ও ন্যাশ ময়নিহান। আইনের সহায়তা না নিয়ে ওই গোপন তথ্য ব্যবহার করতে গিয়ে জড়িয়ে নিল নিজের নতুন প্রেমিক শেরিফ ম্যালভিকে। তারা ঠিক করল, এই সুযোগে হাতিয়ে নেবে অনেক টাকা। ময়নিহান জানত না এসবে জড়িয়ে গেছে নিনা। সে চিরকালের জন্যে বন্ধ করল শেরিফ ম্যালভির মুখ। এরপর নিজেই নিনা চেয়ে বসল বিশাল অঙ্কের টাকা। বিশ হাজার ডলার চেয়েছিল শেরিফ ম্যালভি। নিনা চাইল দুমিলিয়ন ডলার। চাহিদা পূরণ করলে চলে যাবে এ শহর ছেড়ে। কিন্তু যদি দেয়া না হয়, সব প্রমাণ তুলে দেবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের হাতে। স্বাভাবিকভাবেই বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা নিনার কারণে হাতছাড়া করতে চাইল না ময়নিহান।
তিক্ত হয়ে গেছে রানার মন। এসেছিল অসহায় এক মহিলার হয়ে লড়তে। আগে যদি জানত এখানে কী হচ্ছে, ভুলেও আঙুল নাড়ত না। এমন নয় মহিলার ক্ষতি হোক তা চাইত, কিন্তু দেখত গোটা ব্যাপারটা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে।
এসেছে জুডির কথায়। এজন্যেই বুকের ভেতর অস্বস্তি। জানতে হবে কতটুকু জানে মেয়েটা।
এখানে যা ঘটেছে, সেটা কি আগেই জানত জুডি?
হয়তো জানত বহু কিছুই। আর তাই পুলিশের সাহায্য না নিয়ে গেছে ওর কাছে। সেক্ষেত্রে গোপন করেছে জরুরি তথ্য। এ-ও জানত, মুখোমুখি হবে বিপজ্জনক লোকদের, তাই জড়িয়ে নিয়েছে ওকে।
রানাকে ব্যবহার করেছে জুডি?
অপরূপ মুখ দেখে রানার হুঁশ ছিল না, ওর দিকেই তাক করা হচ্ছে গুলি ভরা পিস্তল।
প্রতিটি তথ্য এখন চোখের সামনে পরিষ্কার।
তবে ওর নিজের যুক্তির মাঝেও রয়েছে বড় গলদ।
বড়বোনের ধনী হওয়ার পরিকল্পনায় জড়িত হলে জুডির কীসের ঠেকা পড়েছিল খুঁজতে আসার?
ওর মোবাইল ফোন প্রমাণ করছে গত চারদিনে বহুবার কল করেছে বোনকে। জুডি, ব্ল্যাকমেইলের সঙ্গে জড়িত হলে ভাল করেই জানত কারা বোনের শত্রু। সেক্ষেত্রে ভুলেও ফোন দিত না অস্টিন ম্যাকলাস্কিকে।
সব তথ্য রানাকে দেয়নি জুডি। আবার এ-ও ঠিক, জানত না কীসে জড়িয়ে গেছে ওর বড়বোন। কিছুই না বুঝে পা দিয়েছে ময়নিহানের পাতা ফাঁদে। এবার ওকে ব্যবহার করে নিনাকে আড়াল থেকে বেরোতে বাধ্য করবে লোকটা।
মস্তবড় বিপদে আছে মাইকের দুই বোনই।
প্রথম কাজ জুডিকে এ শহর থেকে সরিয়ে দেয়া, ভাবছে রানা। ম্যাকলাস্কি বলেছে, রেস্তোরাঁয় নিয়ে মেয়েটাকে তুলে দিয়েছে ময়নিহানের হাতে। খুঁজতে হলে প্রথমেই যাওয়া উচিত ওখানে।
প্রবল ঝড়ের প্রকোপে অ্যাপলেচিয়ার এদিকে জমছে প্রচুর তুষার। ঝামেলা ছাড়াই শেরিফের গাড়িতে চেপে শহরে পৌঁছে গেল রানা। অবশ্য, প্রথম বাড়িটা চোখে পড়তেই গভীর এক নালায় নামাল গাড়ি। ওটা দেখা যাবে না রাস্তা থেকে।
হেঁটে শহরে ঢুকল রানা। এবার চাই আরেকটা গাড়ি। জানা আছে, কোথায় পাবে ওই জিনিস।
পৌঁছে গেল রানা লুকিয়ে রাখা বাইসন গাড়িটার কাছে। রিক বেণ্ডার অন্যান্য কাজে ব্যস্ত, তাই ওটা খুঁজতে বেরোবার সময় পায়নি। সামনের চাকার ওপরই পেল চাবি। ইঞ্জিন চালু করে ওয়াইপার দিয়ে পরিষ্কার করল তুষার ভরা উইণ্ডস্ক্রিন। গাছের জটলা থেকে বেরিয়ে ফিরল শেরিফের গাড়ির কাছে। তুষারে আর কোনও গাড়ির চাকার চিহ্ন নেই। শেরিফের গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলে তাড়া দিল রানা, ভাবছ হাইপোথারমিয়ায় মরবে? নাও, বেরোও!
ট্রাঙ্ক থেকে চোখ পিটপিট করে ওকে দেখছে শেরিফ। শার্ট পেঁচিয়ে তার মুখ বেঁধেছে রানা। বাকি আছে শুধু চোখদুটো। শার্টের বাঁধন খুলল ও।
কী যেন বলল লোকটা, কিন্তু মুখে রুমাল আছে বলে জাবড়ে গেল কথা।
বগলে হাত ভরে তাকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল রানা। খিচ ধরেছে ছোট জায়গায় বন্দি হয়ে টলে পড়ছিল লোকটা। কাঁধ ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল রানা। একমিনিট পর ঠেলে নিয়ে তুলল বাইসন গাড়িতে। পকেট থেকে নিল চাবি। খুলে দিল হ্যাণ্ডকাফের একটা কড়া। চট করে ওটা আটকে দিল প্যাসেঞ্জার সিটের পাশের হাতলে। নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে বলল, হয়তো ভাবছ লোকটা কী করছে, তাই না?
স্থির দৃষ্টিতে ওকে দেখল ম্যাকলাস্কি।
আগেই বলেছি, তুমি কাজে না এলে মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম অন্য কাজে আসবে। ট্রাক চালু করে আবারও শহরের কেন্দ্রের দিকে চলল রানা।
.
লিটল ফোর্কের প্রধান সড়কে ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁ ভিলাজ-ও-সঁও। নিচতলায় লোভনীয় খাবারের ডাইনিং রুম। ওপরের দোতলা ও তৃতীয়তলায় ন্যাশ ময়নিহানের অফিস। ঝড়ের কারণে আপাতত বন্ধ রেস্তোরাঁ। শহরের প্রায় সবাই ফিরেছে যে-যার বাড়িতে, রাস্তা জনশূন্য। দোতলা অন্ধকার হলেও তৃতীয়তলায় শাটারের ওদিকে রয়েছে আলো।
ময়নিহানের অফিস কয়তলায়? জিজ্ঞেস করল রানা।
থুতনি বাঁকা করে তৃতীয়তলা দেখিয়ে দিল ম্যাকলাস্কি।
নিচতলায় বারো ফুট উঁচু কাঁচের তৈরি চওড়া দরজা। দালানের সামনে রয়েছে টিনটেড কাঁচের দেয়াল। বাইরে থেকে গরিব-গুরবো কেউ দেখতে পাবে না কী দারুণ খাবার সাঁটাচ্ছে বড়লোক খদ্দেররা। সদর দরজাটা আরেকবার দেখল রানা।
না, ওই পথে ঢুকবে না ও।
গাড়ি নিয়ে প্রধান সড়ক থেকে বামের গলিতে ঢুকল রানা। কিছুটা দূরে ইন্টারসেকশন। ভিলাজ-ও-সঁওর পেছনে সরু গলি পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তায় গাড়ি রাখল রানা। চোখ রেখেছে রেস্তোরাঁর ওপর। এদিকের রাস্তায় সাধারণ সব দোকান, কয়েকটা বার ও রেস্তোরাঁ। এরা ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁর মত জমজমাট ব্যবসা করে না। পথের শেষমাথায় সেভেন-ইলেভেন থেকে বেরোচ্ছে আলো। তুষার ঝড়ের জন্যে ওটা ছাড়া বন্ধ হয়েছে সব দোকান। রাস্তায় একজন পথচারীও নেই।
হাতঘড়ি দেখল রানা।
একটু পর বন্ধ হবে সেভেন-ইলেভেন দোকানও।
রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা ময়নিহানের অপরাধে জড়িত? জানতে চাইল রানা।
মুখে রুমাল, বিড়বিড় করে কী যেন বলল ম্যাকলাস্কি। তার মুখ থেকে রুমাল সরিয়ে নিল রানা। তাতে বার কয়েক চোয়াল এদিক-ওদিক নাড়ল লোকটা। জবাব দিতেই হবে বুঝে বলল, তারা স্থানীয় সাধারণ মানুষ। অল্প বেতন পায়। মালিক কী করছে জানলেও নাক গলাবে না।
তাদের কেউ ভেতরে থাকতে পারে?
এত রাতে? না। তা ছাড়া, আলো নেই কিচেনে। নিচতলার সরু এক জানালা দেখাল ম্যাকলাস্কি।
হুম।
ভেতরে ঢুকবে ভাবছ?
ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে কারা আছে?
জানি না। নিক… ও… মানে রিক থাকতে পারে। এ ছাড়া দুচারজন পাতি মস্তান।
পাহাড়ে জুডি আর আমার ওপর যারা হামলা করেছিল, তারা নেই ভেতরে?
অনেক আগেই বাড়ি ফিরেছে। এতক্ষণে মরা বন্ধুদের শোকে বিয়ার গিলছে।
গম্ভীর হয়ে গেল রানা।
কাঁধ ঝাঁকাল ম্যাকলাস্কি, তা দুঃখপ্রকাশের জন্যে নয়।
তুমি বলেছিলে মনিহান আঁরও লোক আনছে। তারা কি ভেতরে আছে?
হয়তো, ঠোঁট চাটল ম্যাকলাস্কি।
রানা বুঝে গেল মিথ্যা বলছে সে। একটু সরে তার মুখে আবারও গুজল ভেজা রুমাল। কথা বলা সময় নষ্ট।
দুএক মিনিটের জন্যে দূরে গেলে ঝামেলা করবে না তো? নির্মল হাসল রানা।
আগ্রহ নিয়ে বারকয়েক মাথা ঝাঁকাল শেরিফ।
মাথা নাড়ল রানা। কিন্তু আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করি না? ওর ডানহাতি ঘুষি পড়ল ম্যাকলাস্কির চোয়ালে। ভালভাবে ব্যথা বোঝার আগেই জ্ঞান হারাল লোকটা। বুকে নেমে এল থুতনি। ভেস-ভোস শব্দে ডাকছে লালচে নাক।
জুডির মোবাইল ফোন বের করে কললিস্ট থেকে নির্দিষ্ট নম্বরে কল দিল রানা।
ওদিক থেকে রিসিভ করল জন হার্বার্ট। জুডি?
না, আমি, রানা।
জুডির ফোন তোর কাছে কেন?
পরে সব বলব। সংক্ষেপে পরিস্থিতি জানাল রানা। শেষে বলল, বদমাশটার হাত থেকে ছুটিয়ে নিতে হবে জুডিকে।
আমার মালপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি। পৌঁছে যাব কয়েক ঘণ্টার ভেতর। একটু অপেক্ষা কর।
না, আগে জেলে পুরে নে টম কোয়োর্ককে।
আদালত ওকে ছেড়ে দিলেও আবার বাগে পাব। তোর ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। একা তুই এতজনের বিরুদ্ধে…
মাথা ঠাণ্ডা রেখে শেষ কর নিজের কাজ, বলল রানা।
পরেও কোয়র্কের বারোটা বাজাতে পারব। অপেক্ষা কর। তিন বা চারঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল জন, কিন্তু বাধা দিল রানা।
সে-সময় আমার হাতে নেই, জন। ময়নিহান কোথাও সরিয়ে ফেলতে পারে জুডিকে। ঘড়-ঘড় শব্দে নাক ডেকে নড়ে উঠল ম্যাকলাস্কি। জেগে উঠছে। চোখ খুলেই জুলজুল করে চাইল রানার দিকে। একমিনিট, জন।
ফোলা চোয়ালে কঠিন আরেকটা ঘুষি মেরে লোকটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল রানা। নরম সুরে বলল, আপাতত তোর আসতে হবে না। তবে আমার চাই জরুরি কিছু তথ্য।
বল কী জানতে চাস।
এ শহরের হেডম্যান এক লোক, নাম ন্যাশ ময়নিহান। ডালাস থেকে এসেছে। ওখানে অর্গানাইড় ক্রাইমের চিফ। জানাবি কত বড় চাই আর মেশে কাদের সঙ্গে।
ঠিক আছে। এখনও জানতে চাস ডজ র্যামের মালিক কে?
রিক বেন্ডার?
হ্যাঁ। ব্যাটা ভয়ঙ্কর হারামি, রানা। দুই যমজ তারা। অন্য ভাই নিক বেণ্ডার। ওটা আরও খারাপ।
নিক আর আসবে না।
কোথায় গেছে?
সংক্ষেপে ওঅর্কশপের লড়াইয়ের বর্ণনা দিল রানা।
সব শুনে আঁৎকে উঠল জন, সর্বনাশ, রানা! তুই দেখি খুন হয়ে আমাকে এতিম করবি! আবার খুঁজতে হবে চাকরি!
মৃদু হাসল রানা। জায়গাটা সুবিধের নয়, তবুও আসতে চাস?
আবার জিগায়! পরের ফ্লাইটেই!
তা হলে এয়ারপোর্ট নেমে ফোন দিস।
দেব, বাপ, কিন্তু দেখিস ফোনটা যেন ধরতে পারিস, বলল জন, অন্তত সেই পর্যন্ত টিকে থাকিস।
প্রিয় বন্ধু দুশ্চিন্তা করছে বুঝে গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা, আপাতত ঠিক করেছি মরব না।
জন হার্বার্ট ওর ঘনিষ্ঠ বুন্ধুদের একজন, ভাইয়ের মতই। একে অপরের জন্যে মরতেও দ্বিধা করবে না ওরা।
ধমক দিল জন, চাপা বনধ! কাজে নামছি!
কল কেটে পকেটে ফোন রাখল রানা।
নিভে গেছে সেভেন-ইলেভেনের বাতি। কুঁজো, বয়স্ক এক লোক বাড়ি ফিরছে তুষার ঝড় ঠেলে। সে যাওয়ায় আশপাশে রইল না আর কেউ।
ডজ গাড়ির ইঞ্জিন চালু করল রানা। কষে ঠা-ঠাস্ করে গালে কটা চড় মেরে স্বপ্নের মায়াবী, রঙিন জগৎ থেকে ডাউনলোড করল শেরিফ ম্যাকলাস্কিকে। মিষ্টি স্বরে বলল, ওঠো, বাবু সোনা! দেখি তো তুমি কতটা ভাল!
.
১৭.
মাতাল হলে চূড়ান্ত বদ হয়ে ওঠে রিক বেণ্ডার। বিশেষ করে উইস্কি তাকে করে ফেলে সত্যিকারের হিংস্র পশু এ কারণে গত বারো বছর অ্যালকোহল ছুঁয়ে দেখেনি। শেষবার গিলেছিল এক পাইন্ট জে.ডি। সেসময় নিক আর সে মিলে চুরমার করে ছয়টি বার। হাসপাতালে ভর্তি হয় নয়জন লোক। তাদের একজন আর কখনও হাঁটতে পারবে না। আরেকজন ছয় মাস নাক দিয়ে খেয়েছে তরল খাবার। চুরচুর হওয়ায় চোয়ালটা মেরামত করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিল একদল ডাক্তার। মেডিকেল রিটায়ারমেন্টে যায় যুবক এক পুলিশ অফিসার। কখনও বাবা হবে না সে। এক লাথিতে তার প্রিয় থলেটা ফাটিয়ে দিয়েছিল রিক। এসব করার জন্যে নিক আর ওকে আঠারো মাস সাজা দেয়া হয় এডিভিলের রাষ্ট্রীয় কারাগারে।
মদের জন্যে বন্দি হয়েছিল ওরা। ওই একই জিনিস খুন করেছে ওর বাবাকে। তাই আর কখনও মদ ছুঁয়ে দেখেনি রিক।
প্রিয় ভাইয়ের স্মৃতি রোমন্থন থেকে বাঁচতেই আজ গিলতে বসেছে সে। তরল গরল রাগিয়ে তুলছে তাকে। প্রথম পনেরো মিনিটে গিলেছে ছয় পেগ উইস্কি। আধঘণ্টা পর বোতল তুলে গলায় ঢেলেছে আরও দুপেগ। তারপর গুলিয়ে গেছে সব হিসাব। মনে নেই পেটে গেছে মোট কয় আউন্স।
আরও দুই আঙুল পরিমাণের উইস্কি গলায় চালান দিল রিক। ওই পরিমাণ শুনলে যে-কেউ বলবে, ওটা বেশি নয়। কিন্তু সাধারণ নয় রিকের আঙুল। একেকটা সাগরকলা সাইযের। হাতের দিকে তাকাল রিক। ভাবতে লাগল, শালা, পারলাম না কুত্তাটার গলা ছিঁড়ে নিতে? মাথাটা ছিঁড়ে নিলে এখনও বেঁচে থাকত নিক! আমি কী করলাম? পালিয়ে গেলাম! আমি শালা দেখছি পুরোপচা বাতিল মাল!
কাউন্টারে গ্লাস রাখল রিক। তুলে নিল ইমপোর্ট করা অ্যাবেরলৌর স্কচ উইস্কির বোতল। চোখের সামনে নিয়ে দেখল ওটাও খালি। একেক বোতলের দাম আশি ডলার। তাতে ক্ষতি নেই। শেরিফকে খুনের জন্যে নিকের প্রাপ্য টাকা থেকে কেটে নেবে ময়নিহান। বারের পেছন থেকে নতুন বোতল নিতে ঝুঁকল সে। বিলাসবহুল বার। চকচক করছে বার কাউন্টারের পালিশ করা ওয়ালনাট। কোনও দাগ নেই। তরুণ বয়সে যেসব বারে চুকত ওরা, তেমন নয়। তাকের ব্র্যাণ্ড বেশিরভাগই চিনল না রিক। শালার হয়েছেটা কী কুত্তার বাচ্চাগুলোর, রাখে না কেন কেন্টাকি সাওয়ার ম্যাশ?
একটা বোতল ওয়ালনাট কাউন্টার থেকে নেবে রিক, তখনই শুনল ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ।
কান ভনভন করছে অ্যাবেরলৌরের নেশায়।
তবুও চিনল ওই শব্দ।
দ্য বাইসন!
ওদের গাড়ি!
ঘাড় কাত করে বারকাউন্টারের ওদিকে তাকাল রিক। আওয়াজ আসছে রেস্তোরাঁর দিকেই। বিশেষ কোটিং করা জানালার কাঁচের ওদিকে অত্যুজ্জ্বল আলো!
আরও বাড়ল ইঞ্জিনের গর্জন!
শালা করেটা কী?
পরক্ষণে দরজা-জানালা ভেঙে ঢুকল ডজ। নানাদিকে ছিটকে গেল কাঁচের হাজারো টুকরো। জোর গুঁতো খেয়ে সূরছে চেয়ার, টেবিল ও ফুলের টব! আসবাবপত্র ঠেকাতে পারল না দানবীয় ট্রাকটাকে। প্রকাণ্ড চাকার নিচে চাপা পড়ছে। বা ঠেলা খেয়ে ছিটকে যাচ্ছে সব।
গোঁ-গোঁ আওয়াজে তেড়ে এল ঠিক রিকের দিকেই!
টরর হয়ে আছে রিক। উঠে দাঁড়াতে কুঁজো হলো। বুঝল ডানে নাকি বামে ঝাঁপ দেবে। হতবাক হয়ে দেখছে ছুটন্ত যান্ত্রিক দানব! ক্যাবের ওপরে লাগানো চোখ ধাঁধানো সাদা আলো পড়ছে তার চোখে। ঝট করে হাত বাড়িয়ে দিল রিক। কিন্তু এত শক্তি নেই যে ঠেকাবে প্রকাণ্ড ট্রাক। মড়মড় শব্দে ওয়ালনাটের বার উপড়ে নিল ওটা। হুড়মুড় করে পেছন দেয়ালে গিয়ে পড়ল ভারী কাউন্টার। শত বোতলের ভাঙা কাঁচের মধ্যে কী যেন চেপে বসল রিকের ওপর। ভালমত কিছু বুঝবার আগেই জ্ঞান হারাল সে।
.
১৮.
আজ মানব-হত্যা করেছে মাসুদ রানা। অস্ত্রের মুখে বন্দি করেছিল দানবীয় দুই লোককে। বাধ্য হয়ে খুন করেছে। তাদের একজনকে। মোটেলে ওকে মেরে ফেলতে চেয়েছে পুলিশের লোক। তাই তাদের দিকে গুলি ছুঁড়েছে ও। কিডন্যাপ করেছে শহরের শেরিফকে। তার পেট থেকে বের করেছে জরুরি তথ্য। সুতরাং, আরও কিছু বেআইনী কাজ করলেও কিছু যায় আসে না ওর।
এইমাত্র ডজ র্যাম ট্রাক পাঠিয়ে দিয়েছে রেস্তোরাঁর দরজার দিকে। ড্রাইভিং সিটে বসে আছে শেরিফ অস্টিন ম্যাকলাস্কি। আপত্তি তোলেনি সে। তবে স্বেচ্ছায় ড্রাইভ করছে না। স্টিয়ারিং হুইলে তার হাত হ্যাণ্ডকাফে আটকে দিয়েছে রানা। ব্যবহার করেছে ক্যাবে পাওয়া লম্বা রেঞ্চ। ওটার চাপ খেয়ে পুরো ডেবে গেছে অ্যাক্সেলারেটর পেডাল। গাড়ি থেকে নেমে গিয়ারস্টিক ফেলেছে ড্রাইভ স্লটে। সরাসরি কাঁচের দেয়াল লক্ষ্য করে ছুটে গেছে দানবীয় ট্রাক। ম্যাকলাস্কি জানে, গন্তব্য থেকে গাড়ি সরালে কপালে খারাবি আছে তার। তাই চুপ করে বসে আছে সে।
কাঁচ উড়িয়ে রেস্তোরাঁয় ট্রাক ঢুকছে, এমনসময় পেছন গলিতে পৌঁছুল রানা। শুনল কাঁচ ও কাঠ ভাঙার বিকট শব্দ। কসেকেণ্ড পর কোথাও আটকে গিয়ে ক্রুদ্ধ, চাপা গর্জন ছাড়তে লাগল ট্রাকটা।
ভিলাজ-ও-সঁওর কিচেনের দরজার হ্যাণ্ডেলে চাপ দিল রানা। ওটা লক করা। ম্যাগনামের গুলিতে উড়িয়ে দিল ওটা। পরের গুলি লাগল দরজা ও চৌকাঠের মাঝের মেকানিযমে। এবার সহজেই খুলল দরজা। ঠুং-ঠুং শব্দে ধাতব, ভাঙা মেকানিযম পড়ল রানার পায়ের কাছে।
সামনে অন্ধকার প্যাসেজ। একটু দূরে আরেক দরজা। কসেকেণ্ড রেস্তোরাঁর ভেতরের আওয়াজ শুনল রানা। মনে হলো, মৃদু কাঁপছে মেঝে। গিয়ে খুলল সামনের দরজা, হাতে ম্যাগনাম। চট করে দেখল ওদিকের ঘরটা।
কিচেন।
কেউ নেই।
ঘরে জ্বলছে যিরো পাওয়ারের বাবু।
তবে সে আলোতেও দেখা গেল চারপাশ। বিশাল এক স্টিলের ওঅর্ক-টেবিলে হাঁড়ি, কড়াই, চামচ, ছুরি ইত্যাদি।
এ ঘরের ভাল বর্ণনা দিয়েছে ম্যাকলাস্কি।
ডানে ডাবল সুইং-ডোর। ওপাশে ডাইনিং রুম। ওখানে না গিয়ে রানা চলে গেল বামের দরজার কাছে। কবাট খুলল। কফুট দূরেই ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি।
দালানে আরও আছে সিঁড়ি, তবে দোতলা পর্যন্ত। ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ। তবে এটা গেছে তিনতলায়। বিপদ হলে বা পালাতে চাইলে ওপরতলার কেউ ব্যবহার করবে এই সিঁড়ি।
এখন নেই চেয়ার-টেবিল সরে যাওয়ার খড়-খড় শব্দ। সামনে কোথাও বাধা পেয়ে রাগী ষাড়ের মত গর্জন তুলছে ট্রাক। ওপরতলার কেউ সিঁড়ি বেয়ে নামলে ওই আওয়াজে পদশব্দ শুনতে পাবে না রানা। পেছনে দরজা বন্ধ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল ওয়ালথার হাতে। কোমর থেকে তাক করেছে অস্ত্রের নল। পরের বাঁক ঘুরে ওঠার সময় কেউ পিস্তল কেড়ে নিতে চাইলে তা হবে তার জন্যে প্রায় অসম্ভব কাজ।
প্রথম ল্যাণ্ডিঙে থেমে আবারও কান পাতল রানা।
চলন্ত ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে এল ওপরতলায় কারও দৌড়ের আওয়াজ। লোকটার পরনে বুট জুতো।
সিঁড়ির পাশ দিয়ে উঁকি দিল রানা। ওপরে জ্বলছে হলদে বাতি, দেয়ালে বাদুড়ের মত বিদঘুটে ছায়া। সিঁড়ির বাঁক ঘুরে দুদ্দাড় করে নেমে এল মাঝারি গড়নের লোকটা, পরনে শার্ট ও প্যান্ট। খাটো করে ছাঁটা ধূসর চুল। রেস্টুরেন্টের কর্মচারী নয়, হাতে পিস্তল। রানাকে দেখে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হলো চোখ। বেঁকে গেল ঠোঁট। রানার বুকের দিকে তুলছে। পিস্তলের নল। সে ট্রিগার টেপার আগেই কোমরের কাছ থেকে গুলি করল রানা। লোকটার তলপেট দিয়ে ঢুকে শোল্ডার ব্লেডে গিয়ে বিঁধল বুলেট। সিঁড়িতে দর্শনীয় ডিগবাজি দিয়ে থ্যাপ-থ্যাপ শব্দে কয়েক ধাপ নেমে রানার পায়ের কাছে থামল লাশ।
এ ময়নিহান নয়। পোশাক সাদামাঠা, জুতো কমদামি। এর তিন মাসের বেতনের চেয়ে টপ টেররের তিন মিনিটের রোজগার অনেক বেশি।
লাশ টপকে পিস্তলটা তুলে নিল রানা। গ্লক সতেরো। অর্থাৎ, জুডিরটা নয়। ওরটা ছিল গ্লক নাইন্টিন। আকারে একটু ছোট। কোমরে ম্যাগনামের পাশে অস্ত্রটা গুঁজে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা। স্থানীয় মস্তানদের ওপর ভরসা না করে বাইরে থেকে লোক এনেছে ময়নিহান। রানার ধারণা: সংখ্যায় বেশি নয় তারা। তবে সতর্ক না হলে মাত্র একটা বুলেট ওপারে পাঠাতে পারবে ওকে।
সিঁড়ির শেষধাপে থামল রানা। একটু দূরেই বন্ধ দরজা। হয়তো এগোলেই ওদিক থেকে আসবে গুলি। কয়েক কদমে দরজার কবজার পাশে পৌঁছুল ও। হাত বাড়িয়ে চাপ দিল, হ্যাণ্ডেলে। ভেতর দিকে খুলল দরজা। গুলি করল না কেউ।
সামনে গোছানো অফিস। ডেস্কের ওদিকে আরামদায়ক চামড়ার চেয়ার। ল্যাম্পের আলো পড়েছে কটা ফাইলের ওপর। দেয়ালে তৈলচিত্র। হামলার জন্য লুকিয়ে নেই কেউ। ঘরে ঢুকে সতর্ক চোখে চারপাশ দেখল রানা। কোণে আরেকটা খোলা দরজা দেখে চলল ওদিকে।
পরের ঘরের একপাশে চওড়া জানালা। ওদিক দিয়ে দেখা যাবে নিচের রাস্তা। ঝরঝর করে ঝরছে তুষার। নিচতলা থেকে এল পোড়া পেট্রলের ঝঝ। ডাইনিংরুম ভেঙে বেরোতে চাইছে ডজ ট্রাক। বনবন ঘুরছে চাকা। মৃদু কাঁপছে গোটা কাঠের বাড়ি। কিন্তু ইঞ্জিনের গর্জন ছাপিয়ে এল একলোকের কণ্ঠস্বর। হড়বড় করে কী যেন বলছে কাউকে।
কে জানে, হয়তো মস্তান বা পুলিশ ডাকছে।
দরজা পেরিয়ে রানা দেখল ঘরের মাঝে এক লোক। কানে মোবাইল ফোন। পরনে দামি পোশাক। কিন্তু তাকে ন্যাশ ময়নিহান বলে মনে হলো না ওর।
এর বয়স ষাটমত। কুঁচকে গেছে গালের চামড়া। মাথার তালুতে মস্ত টাক। চোখের নিচে বড় বড় দুটো টোপলা। মণির চারপাশটা হলদে। পাকা ডাক্তারের ভঙ্গিতে ভাবল রানা, এর কঠিন কিডনি সমস্যা আছে!
মোবাইল ফোনে বলল লোকটা, হ্যাঁ, পৌঁছে গেছে। রানার দিকে বাড়িয়ে দিল ফোনটা।
তার বুকে পিস্তল তাক করে ফোন নিল রানা। কানে ঠেকিয়ে বলল, ন্যাশ ময়নিহান?
বেশ ঝামেলায় ফেললে, খুশি-খুশি স্বরে বলল ওদিকের লোকটা। কথায় টেক্সাসের মৃদু টান। কী নামে ডাকব তোমাকে?
তুমি জুডির কোনও ক্ষতি করলে আমাকে বলতে পারো তোমার যম বা মৃত্যুদূত, জানাল রানা।
মৃদু হাসল ময়নিহান। ক্লিন্ট ইস্টউডের সিনেমা বেশি দেখো?
পাল্টা জিজ্ঞেস করল রানা, জুডি এখন কোথায়?
কোথায় থাকবে ভাবছ?
তোমার ওখানে?
ভাবছ বলব কোথায় আছি? হাসল ময়নিহান। ভেবো না, নিরাপদেই আছে। যা চাই, সেটা পেলে বিপদ হবে না ওর।
কী চাও? জানতে চাইল রানা। ভাল করেই মনে আছে, কাউন্টার-টেরোরিযমের প্রথম শর্ত: কখনও মেনে নেবে না সন্ত্রাসীর কোনও দাবি।
আগে বলো তুমি কে।
পরিচয় গোপনের কারণ নেই। জুডিকে অত্যাচার করে এসব তথ্য জেনে নিতে পারবে ময়নিহান। আমার নাম মাসুদ রানা। একটু আগে বলছিলে কী যেন চাই। সেটা জানাও। আমি ফেরত চাই জুডিকে। প্রয়োজনে চুক্তি করতে আপত্তি নেই।
জুডি সত্যিই সুন্দরী। বুঝেছি কেন ওকে ফেরত পেতে তুমি এত ব্যস্ত। ঠিক আছে, তো এসো চুক্তি করা যাক।
তুমি চাও জুডির বদলে নিনা ভেঞ্চুরাকে?
ঠিক।
আমার জানা নেই ওই মেয়েটা কোথায় আছে।
তা হলে খুঁজে বের করো। ধরে আনো আমার কাছে। সেক্ষেত্রে ফেরত পাবে জুডিকে।
ঠিক কোথায় পৌঁছে দেব নিনা ভেঞ্চুরাকে?
ভালই বলেছ। নিনাকে খুঁজে আনতে রাজি হয়েছ এককথায়। তর্কও করবে না? হাহ্, সন্তুষ্ট হলাম! তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে উপযুক্ত লোকই তুমি। হয়তো সত্যিই পারবে কাজটা করতে।
কোথায় নিয়ে যাব ওকে?
সেটা পরে জানাব।
তুমি তো বোধহয় এখন লিটল ফোর্কে নেই?
একটু পরেই পেরোচ্ছি কেন্টাকি বর্ডার। যাক গে, একটা কথা, তোমার মাথার ওপরে ঘোষণা করেছি পুরস্কার। তাই রয়ে গেছে আমার কজন।মাথাটা সামলে রেখো।
আমার জন্যে দুশ্চিন্তা করছ বলে বড় খুশি হলাম।
আমার ছেলেরা ব্যস্ত রাখবে তোমাকে। আর তুমি খুন হলে বাতিল হবে চুক্তি। অবশ্য, তাতে কিছুই যায় আসে না আমার। হাতের মুঠোয় জুডি, কাজেই আসতে হবে নিনা ভেঞ্চুরাকে। যা খুশি করব ওই দুই বোনকে নিয়ে। নিনাকে এনে দিলে অবশ্য সত্যিই ফেরত পাবে জুডিকে।
বুঝলাম।
তবে কিছু করার আগেই হয়তো লাশ হবে।
তা মনে হয় না। অপেক্ষা করো, নিজেই হয়তো দেখবে বডিব্যাগে করে পৌঁছাচ্ছে তোমার ছেলেরা।
গুড! এ-ই তো সঠিক স্পিরিট! জানতাম তোমার ওপর ভরসা রাখা যায়।
বেশি দেরি হবে না তোমার সঙ্গে দেখা হতে।
আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি, হালকা হুমকির সুরে বলল ন্যাশ ময়নিহান। কসেকেণ্ড পর বলল, ওই ফোনটা নিজের কাছে রেখো, কাজে আসবে নিনাকে পাওয়ার পর।
পরে কথা বলব, অন্য ফোনে। ময়নিহানের নাম্বারটা দেখে নিয়ে জাজের দামি মোবাইল ফোনটা মেঝেতে ফেলে পা দিয়ে চুরমার করল রানা। ফলে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে একটা জোরালো প্রমাণ নষ্ট হলো বটে, কিন্তু রানাকে ট্র্যাক করার মতলবটা বানচাল করা গেল।
আলাপের সময় নড়েনি অসুস্থ লোকটা। কষ্টের দৃষ্টিতে দেখল ভাঙা মোবাইল ফোন।
আপনার নামটা বোধহয় প্যাট্রিক হোল্ড?
জণ্ডিস রোগীর হলদে চোখ পিটপিট করল দুতিন বার।
ন্যাশ ময়নিহান এখন কোথায়?
ডালাসের পথে, লোকটার কণ্ঠে হতাশা। হঠাৎ বুঝতে পেরেছে, ভয়ঙ্কর এক লোকের মুখোমুখি হতে তাকে ফেলে গেছে ব্যবসায়িক পার্টনার।
আপনিও ন্যাশ ময়নিহানের চাপে অন্যায় করতে বাধ্য হয়েছেন? জানতে চাইল রানা।
মাথা নাড়ল জাজ। না। আমার জানা আছে কী করছি। মরব কদিন পর। তার আগে স্ত্রী, ছেলে ও নাতি-পুতির জন্যে রেখে যাচ্ছি প্রচুর টাকা, বিশাল সম্পত্তি। এ সুযোগ দিয়েছে ময়নিহান।
তুমি না বিচারক? বলল বিরক্ত রানা, অপরাধী থেকে বাঁচাবে সাধারণ মানুষকে, তা না করে পড়ে গেছ লোভের ফাঁদে। উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত তোমার।
কাঁপা গলায় বলল হোল্ড, তুমি আমাকে খুন করবে?
না, তবে যাদের প্রতি অন্যায় করেছ, বিচার করবে তারাই। সামনে বেড়ে লোকটার মাথার পাশে আদর করে ওয়ালথারের একটা টোকা দিল রানা। ধুপ করে ওর পায়ের কাছে পড়ল, জাজ হোল্ড। বিড়বিড় করল রানা, আমার ধারণা, তোমার চেয়ে ভাল বিচারক হবে ওরা।
রিক বেণ্ডারের ট্রাক রেস্টুরেন্টে পাঠিয়ে সুবিধা হয়নি। রানা ভেবেছিল, ডাইনিংরুমে থাকবে ন্যাশ ময়নিহানের বেশিরভাগ বডিগার্ডরা। তাদের ঘাবড়ে দিয়ে ওই সুযোগে অন্য পথে ঢুকবে নিজে। কিন্তু যেন নিশ্চিন্তে ঢুকতে পারে, সে ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে লোকটা। টোপ হিসেবে ব্যবহার করেছে নিজের এক লোককে। মরলে মরুক সে!
তাকে খুন না করে উপায় ছিল না রানার। প্রথম কথা: বাঁচাতে হবে নিজেকে। খুঁজে নিতে হবে নিনা ভেঞ্চুরাকে।
নইলে খুব কঠিন হবে জুডিকে উদ্ধার করা।
জাজের কাছ থেকে নতুন কিছু জানতে পারেনি রানা। তবে ফোনে ময়নিহানের সঙ্গে কথা বলে এটা বোঝা গেছে, একপাল নেকড়ে লেলিয়ে দিয়েছে সে। বলেছে, নিনাকে তার হাতে তুলে দিলে ছেড়ে দেবে জুডিকে। সবই মিথ্যার ফুলঝুরি। দলের লোক মরলেও কিছুই পাত্তা দেয় না সে। খুশিই হবে রানা এবং তার লোক লড়ে মরলে।
জুডি বা নিনাকে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে নেই ময়নিহানের, এটা পরিষ্কার। অন্তর থেকে চায়, খুন হোক রানা। সেক্ষেত্রে ছেঁড়া কোনও সুতোই থাকবে না।
এবার খুঁজতে হবে নিনা ভেঞ্চুরাকে। হাতে সময় নেই। এখন প্রথম কাজ হওয়া উচিত রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়া। যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে ময়নিহানের খুনির দল।
কেন্টাকিতে এসে প্রথমে এয়ারপোর্টের কাছে যে হোটেলে উঠেছিল রানা ও জুডি, এখন যাবে ওখানে। নেবে বাড়তি পোশাক ও অন্যান্য জিনিস। এ ছাড়া রয়েছে নকল ডকুমেন্ট। ওসব লাগবে বিমানে উঠতে।
অচেতন জাজ হোল্ডকে মেঝেতে রেখে সিঁড়ির কাছে ফিরল রানা। পকেট থেকে বের করল জুডির মোবাইল ফোন। ময়নিহানের মোবাইল নম্বরটা সেভ করল জুডির ফোনে।
নিনা ভেঞ্চুরাকে কল দিয়ে ভাবল, রিসিভ করবে না কেউ। কবার বাজার পর কেটে গেল লাইন। ট্র্যাক করা হবে ভেবে নেটওঅর্ক ব্যবহার করবে না মেয়েটা। কিন্তু ফোন মাঝে মাঝে চেক করবে না, তা না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভয়েস মেসেজ পাবে সে।
এবার ভয়েসমেইলে মেসেজ পাঠাল রানা। নিনা, আমি মাসুদ রানা। আপনার বড়ভাইয়ের পরিচিত। হয়তো শুনেছেন আমার কথা। যাদের কাছ থেকে লুকিয়ে আছেন, সেই দলের লোক তুলে নিয়ে গেছে জুডিকে। চেষ্টা করছি ওকে উদ্ধার করতে। কিন্তু সেজন্যে আপনার সাহায্য দরকার। প্রথম সুযোগে কল করবেন আমাকে।
এবার জন হার্বার্টকে কল দিল রানা। শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
তাই? কেন? অবাক হলো ওর বন্ধু।
ন্যাশ ময়নিহানের সঙ্গে যে-কথা হয়েছে, খুলে বলল রানা।
সে চুক্তি করল তোর সঙ্গে? বিস্ময় বাড়ল জনের।
হ্যাঁ। বাধ্য হয়ে ধরে নিচ্ছি মিথ্যা বলছে না।
ভয় দেখাতে চেয়েছে, বলল জন, যাতে দেরি না করে নিনা ভেঞ্চুকে খুঁজে তুলে দিস্ তার হাতে। লোকটা জানে না, ঘাবড়ে যাওয়ার লোক নয় আমরা নই।
আমারও ধারণা ভয় দেখাচ্ছে। তবে পেছনে খুনি লেলিয়ে দেয়া হলে স্বস্তি পাওয়া কঠিন।
এখন কী করবি?
ময়নিহান চলেছে ডালাসে। আমিও যাচ্ছি।
তা হলে ফ্লাইট প্ল্যান পাল্টে নিচ্ছি, বলল জন। ওখানেই দেখা হবে তোর সঙ্গে।
দুবন্ধু ঠিক করল ডালাসের ফোর্ট ওঅর্থ এয়ারপোর্টে আগামীকাল সকালে দেখা করবে ওরা।
তুই আপত্তি না তুললে সঙ্গে নেব বাড হিগিন্সকে, বলল জন হার্বার্ট। ও অস্থির হয়ে আছে।
মন্দ হয় না ওকে নিলে, বলল রানা, বাড়তি হাত আর অস্ত্র কাজে আসতে পারে।
রানার কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছে বলে কৃতজ্ঞ বাড হিগিন্স। সে-ও রানা এজেন্সিতে কাজ করে এবং রানার বন্ধু।
একবছর হলো অ্যাকটিভ অ্যাসাইনমেন্টে নেই, ওকে সঙ্গে নিবি শুনলে খুশি হবে, বলল জন। এরই ভেতর খুঁজে বের করুক ন্যাশ ময়নিহান সম্পর্কে তথ্য।
বিদায় নিয়ে ফোন রাখল রানা। ভাবছে, ও খুন হলে বাঁচবে না জুডিও। পেছনে লেগেছে চুক্তিবদ্ধ একদল খুনি। ভাল হলো, পাশে পাবে দক্ষ দুজন বন্ধু।
নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নামল রানা। কিচেনের দরজার কাছে পৌঁছে শুনল টিকটিক আওয়াজ। ঠাণ্ডা হচ্ছে ডজের তপ্ত ইঞ্জিন। ম্যাকলাস্কি বা অন্য কেউ অফ করে দিয়েছে ওটা।
ডাইনিং রুমে থাকুক শেরিফ। হয়তো জাজ বা শেরিফকে গ্রেফতার করবে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কেউ।
ডজ ট্রাক ব্যবহার করে এয়ারপোর্টে গেলে রানা হয়ে উঠবে টার্গেট। কিচেন কাউন্টারে ম্যাগনাম রেখে কোমরে ওয়ালথার ও গ্লক সতেরো গুঁজে দালান থেকে বেরিয়ে এল ও।
নির্জন রাস্তা। কেউ নেই। আরও বেড়েছে তুষারপাত। জোরালো ঝরঝর শব্দে চাপা পড়ছে আর সব আওয়াজ।
ফুটপাথে উঠল রানা। একটু পর হারিয়ে যাবে পদচিহ্ন। জ্যাকেটের কলার তুলে হেঁটে চলল এয়ারপোর্ট লক্ষ্য করে। আশা করছে, প্রবল তুষারঝড়ে বন্ধ হবে না বিমানবন্দর।
.
১৯.
মাঝে মাঝে নেকড়ের মত একপাল লোকের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মার খেয়েছে রিক বেণ্ডার, কিন্তু শেষে দেখা গেছে তাদের হাড়গোড় ভেঙে বেরিয়ে এসেছে বিপদ থেকে। জীবনে প্রথম এবং দ্বিতীয়বারের মত জ্ঞান হারিয়ে এখন রীতিমত লজ্জা হচ্ছে ওর।
ছি-ছিহ্! সারাজীবন দুনিয়ার মানুষকে পিটিয়ে অজ্ঞান করল, আর আজ তার নিজেরই এই হাল!
এজন্যে দায়ী ওই বাদামি বদমাস হারামজাদাটা!
অবশ্য এ-ও ঠিক, কপাল ভাল যে খুন হয়নি সে!
জঙ্গলে জ্ঞান ফিরলে পাশে ছিল নিক। এবার চেতনা ফিরতে দেখছে পাশে নেই ছোটভাই।
নিক নেই তা দগদগে ক্ষতের মত জ্বলছে বুকের ভিতর। কাঁদতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু ঠিক সে-ধরনের লোক নয় রিক। দুঃখের কারণে এল মনে প্রচণ্ড ক্রোধ। তা ছাড়া, পেটে কুলকুল করছে অন্তত এক বোতল উইস্কি।
বারকাউন্টারের তলা থেকে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ বিস্ফোরণের মত উঠে এল সে। ডজ ট্রাক ভেঙেচুরে হাজির হতেই ভাবছিল ঝাঁপ দেবে কোন্দিকে। কুঁজো হয়েছে, এমনসময় ওকে উড়িয়ে নিয়ে কাউন্টারের আরেকদিকে ফেলেছে যান্ত্রিক দানব। ভারী ওয়ালনাট কাঠের কাউন্টার আড়াল দিল বটে কিন্তু কী যেন লাগল মাথায়।
বারকাউন্টারটাকে ভাঙতে পারেনি ট্রাক, নইলে নির্ঘাত খুন হতো ও। তবে এখন ওয়ালনাটের এই মোড়ক চাই না তার। কাঁধ দিয়ে ঠেলে ভারী কাউন্টার সরিয়ে দিল রিক। রাগে গর্জন ছাড়ছে ক্ষিপ্ত ভালুকের মত। কপা সরে দেখল সর্বনাশ হয়েছে বিলাসবহুল ভিলাজ-ও-সঁও রেস্টুরেন্টের।
একটু দূরে দেয়ালের কোণে নাক ঠেকিয়ে ওরই মত কর্কশ গর্জন ছাড়ছে ট্রাকটা। আকাশে উঠেছে মুচড়ে যাওয়া হুড। ভাঙা কিছু টেবিল-চেয়ারের মধ্যে বনবন ঘুরছে সামনের দুচাকা।
রিক বেণ্ডার চোখে অস্পষ্ট দেখলেও টের পেল ক্যাবের ভেতর বসে আছে কে যেন। ওর মনে হলো, ওই লোক নিশ্চয়ই নিকের খুনি! পরক্ষণে ভাবল: সেক্ষেত্রে রেস্টুরেন্ট ভেঙেছে কেন? আরও বড় প্রশ্ন: চুপ করে বসে আছে কেন ব্যাটা?
চুরমার হওয়া আসবাবপত্র সরিয়ে গাড়ির দিকে চলল রিক। গা থেকে টুপটাপ ঝরছে কাঁচের টুকরো। চুল ঝাড়তে গিয়ে টের পেল, কপাল আর গালে চটচট করছে আঠালো কিছু। গা থেকে ভুরভুর করে বেরোচ্ছে মদের দুর্গন্ধ। ভীষণ জ্বলছে হাতের পিঠ। যেন কামড়ে দিয়েছে কাঠ পিঁপড়ে। আগুনের মত ঘঁাৎ-ঘঁাৎ করছে কাঁধের ক্ষত। এ ছাড়া ঠিকই আছে সে।
সর্বনাশ হয়েছে তার ট্রাকের। আগেই রিক ভেবেছে, যে খুন করেছে ওর ভাই নিককে, তাকে ছাড়বে না সে। কিন্তু এখন দ্য বাইসনের করুণ হাল দেখে বিড়বিড় করে রানাকে শাপ-শাপান্ত করল। নিজ হাতে বাদামি কুত্তার বাচ্চাটার দুই পা দুদিকে টেনে ছিঁড়ে ফেলবে সে।
কে ওখানে? ক্যাব থেকে জানতে চাইল কেউ।
ম্যাকলাস্কি?
রিক? …রিক… তুমি?
ভাঙা টেবিলের মাঝ দিয়ে চলতে গিয়ে পিছলে থামল রিক। পায়ের নিচে তেলতেলে মোবিল। কপা সরে ড্রাইভারের দরজায় পৌঁছুল সে। জানালা দিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। গাট মেরে বসে আছে শেরিফ অস্টিন ম্যাকলাস্কি। ছড়ে গেছে চোয়াল। কপালে ছোট ক্ষত। বাড়ির ভেতরে ট্রাক ঢোকার সময় উইণ্ডস্ক্রিনের বাড়ি লেগে ব্যথা পেয়েছে লোকটা।
আমার ট্রাকের এই অবস্থা করেছ কেন?
আমি না, রিক, স্টিয়ারিং হুইল থেকে হাত সরাবার ভঙ্গি করল ম্যাকলাস্কি। রিক দেখল তার হাতে হ্যাণ্ডকাফ। এবার বুঝতে পেরেছ?
গাড়ি নিয়ে অন্যদিকে সরে যেতে পারতে।
মাথায় পিস্তল তাক করেছিল ওই লোক, কাফ দিয়ে ঠুং টুং শব্দ তুলল শেরিফ। বের করো এখান থেকে।
ওই লোক এখানে এসে ঢুকেছিল তোমার সঙ্গে?
না, মাথা নাড়ল ম্যাকলাস্কি। শেষ সময়ে নেমে গেছে লাফ দিয়ে। বোধহয় কিচেন দিয়ে ঢুকেছে ভেতরে। সুযোগ পেলেই খুন করবে ময়নিহানকে। বুঝলে, রিক, কিছুই করার ছিল না। বাদ দাও, পরে এই ফালতু ট্রাকের চেয়ে অনেক ভাল একটা কিনে নিতে পারবে।
এটা ফালতু ট্রাক? রাগ বাড়ল রিকের। এমনিতেই ভণ্ড শেরিফকে পছন্দ করে না। লোভী পাঁঠা একটা। ওকেও সমান অপছন্দ করে সে। তা ছাড়া, নিককে ঘৃণা করত শুয়োরটা।
অ্যাক্সেলারেটর থেকে পা সরিয়ে নিতে পারতে।
রেগে গিয়ে চেঁচাল ম্যাকলাস্কি, পারতাম না! আরে, প্যাডেলে রেঞ্চ আটকে দিয়েছে! হতাশার কারণে গায়ের জোরে হ্যাণ্ডকাফে টান দিল সে। ছুটিয়ে নেবে, না কি?
হ্যাঁ, ছুটিয়ে নেব। একটু রোসো। তারপর দেখো কী করি। ক্যাবের ভেতর দুই মস্ত হাত ভরল রিক।
যাক, এতক্ষণে তোমার আক্কেল…।
দুহাতে ম্যাকলাস্কির মাথা চেপে ধরল রিক, পরক্ষণে মারাত্মকভাবে মুচড়ে দিল গায়ের জোরে। শেরিফের ঘাড়ের হাড় মড়াৎ শব্দে ভেঙে যাওয়ায় মনে হলো এইমাত্র গুলি করা হয়েছে ছোট ক্যালিবারের পিস্তল থেকে।
কুত্তার বাচ্চা, তোর উচিত ছিল রেঞ্চটা লাথি মেরে ফেলে দেয়া, মৃত শেরিফের উদ্দেশে নরম সুরে বলল রিক। রওনা হলো চুরমার হওয়া আসবাবপত্রের মাঝ দিয়ে। পরিষ্কার মেঝেতে পৌঁছে কার্পেটে ঘষে নিল বুটের হিল। ভাবছে, এবার কী করবে। মনেই নেই এইমাত্র খুন করেছে অসহায় এক লোককে।
একবার দেখল দালানের সামনের ভাঙা অংশ। খসে পড়েছে কাঁচের দেয়াল। মেঝেতে তার হাজার টুকরো। দমকা হাওয়ায় ঢুকছে ভারী তুষার। সাদা হয়ে উঠছে শহরের চারপাশ। অ্যাপলেচিয়ান এলাকায় এমন ভারী তুষারপাত অস্বাভাবিক নয়। তবে বহুদিন পর রিক দেখছে এমন ঝোড়ো পরিবেশ। আরও বাড়ছে হাওয়ার বেগ। এভাবে তুষারপাত হলে অন্তত কদিনের জন্যে আটকে যাবে গিরিপথ। তখন বেরোবার জন্যে থাকবে মাত্র দুটো পথ। হয় যেতে হবে বিমানে বা হেলিকপ্টারে, নয় হেঁটে। থাকুক তা হলে ওর ভাঙা বাইসন গাড়ি।
কিচেনের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে ঢুকল রিক। সার্ভিস এরিয়া থেকে এল মৃদু আলো। ওই পথেই এসেছিল নিকের খুনি। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রিক। কান পাতল প্রথম ল্যাণ্ডিঙে থেমে। ভাবছে, কতক্ষণ অজ্ঞান ছিল সে?
মন বলল, বাদামি ওই লোক এখন এ দালানে নেই।
আরও কধাপ উঠতেই পেল হেনরি রাইডারকে। সে পড়ে আছে দ্বিতীয়তলার সিঁড়ির গোড়ায়। পেটে গোলাপের কুঁড়ির সমানলাল গর্ত। গোলাপ ফুটেছে পিঠে।
লাশ সার্চ করল রিক।
লোকটার কাছে অস্ত্র নেই। অথচ, সবসময় ময়নিহানের এই স্যাঙাৎ কাছে রাখত গ্লক সতেরো পিস্তল।
একটার পর একটা অস্ত্র সংগ্রহ করছে নিকের খুনি শালা। ব্যাটা করবেটা কী এতগুলো নিয়ে? লাশ টপকে তৃতীয়তলায় উঠল রিক। মাথার ওপর জ্বলছে হলদে বাতি। ছায়ায় কেউ নড়বে ভেবে অপেক্ষা করল সে। কেউ নেই। সাবধানে ঢুকল প্রথম অফিসে। পরের অফিসের দরজা খোলা। ওখান থেকে এল ভেস-ভোস শব্দ। পানি থেকে ওঠা পরিশ্রান্ত ভোঁদড় যেন।
কসেকেণ্ড পর রিক বুঝল, ওটা কে হতে পারে।
ওই ঘড়-ঘড় ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।
সতর্ক পায়ে পরের অফিসে ঢুকল রিক। হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে সিলমাছের মত মেঝেতে পড়ে আছে অচেতন জাজ হোন্ড। কাত হয়ে আছে মাথা। হাঁ করা মুখ থেকে বেরোচ্ছে বিশ্রী ওই আওয়াজ। মাথার একপাশে বেগুনী দাগ। বাদামি বদমাসের কথা মনে পড়ল রিকের। ওই শালা সুযোগ পেলেই যার-তার মাথায় পিস্তলের বাড়ি মারছে!
শেরিফ ম্যাকলাস্কির মতই জাজ হোল্ডকেও পছন্দ করে না রিক। এই শালাও পাকা ভণ্ড! লোভী কুত্তা!
ময়নিহানের অফিসে আবার ফিরল রিক। লুকিয়ে নেই কেউ। যে চেয়ারে ছিল সুন্দরী মেয়েটা, সেটা এখন খালি।
ভুরু কুঁচকে চারপাশ দেখল রিক। ময়নিহান সঙ্গে নিয়ে গেছে মেয়েটাকে। এখানে থাকলে এতক্ষণে বাদামি বদমাস বা ময়নিহান, যে-কোনও একজন লাশ হয়ে পড়ে থাকত মেঝেতে। আশপাশে নেই রক্তের চিহ্ন। হাতাহাতি হয়নি কোনও।
আবার জাজ হোন্ডের পাশে ফিরল রিক। ঝুঁকে বারকয়েক চড়িয়ে দিল বয়স্ক লোকটাকে। আগের চেয়েও হলদে দেখাচ্ছে জাজের মুখ।
হোল্ড! ওঠো তো, বাপু! আরেহ, কী হল? ওই, শালার পো! আবারও জাজের গালে চড় দিল রিক।
সামান্য নড়ল, লোকটা। তিরতির করে কাঁপল পাপড়ি, তারপর খুলল চোখ। মনে হলো না দেখছে কিছু। অবশ্য কসেকেণ্ড পর হাত তুলে ঠেলে সরাতে চাইল রিককে।
হাতটা ধরে একটানে তাকে বসিয়ে দিল রিক।
আচমকা ঘুম ভেঙে হতভম্ব হয়েছে হোল্ড। আধ মিনিট লাগল নিজেকে ফিরে পেতে। চারপাশ দেখল আতঙ্কের চোখে। যাক, বিদায় নিয়েছে ওই পিস্তলওয়ালা লোকটা!
দাঁড়িয়ে আছে রিক। বুকে আড়াআড়িভাবে রেখেছে দুহাত। লালচে দুই চোখে তাকে দেখছে দানব।
রিক? প্রায় ফিসফিস করল জাজ হোল্ড।
হ্যাঁ। আমি। এখানে কী হয়েছে, হোল্ড?
দুপেগ উইস্কি এনে দাও। গলা শুকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে মরেই যাব!
আগে বলো কী হয়েছে। ন্যাশ ময়নিহান কোথায়?
মুখের ভেতরটা শিরিষ কাগজ, জিভ নেড়ে লালা তৈরি করতে চাইল হোল্ড। চেয়ে আছে রিকের দিকে। কসেকেণ্ড পর বলল, বাড়ি ফিরে গেছে ময়নিহান।
ডালাস?
হ্যাঁ। মেয়েটাকে নিয়ে। পিস্তলের নলের বাড়ি খেয়ে ব্যথায় টিসটিস করছে জাজের মাথা। বলেছে, সামলে নেবে পরিস্থিতি।
বলতে পারো যে পালিয়ে গেছে। মাঝখান থেকে ধরা খেয়েছি আমরা।
মাথা দোলাল হোন্ড। কখনোই আমাদের ভালমন্দ নিয়ে ভাবেনি। ব্যাপারটা সবসময় এমনই ছিল।
অথচ আমরা না থাকলে এ পর্যায়ে আসতে পারত না! রেগে গিয়ে হাতের মুঠো পাকাল রিক। ব্যাণ্ডেজের ভেতর কুলকুল করে পড়ছে রক্ত। শার্টে তৈরি হচ্ছে বড় একটা ফুল। ওর কারণে মারা গেছে নিক।
টাকা পেতে হলে ঝুঁকি না নিয়ে উপায় নেই কারও, রিক। আমরা ময়নিহানের হাতের ময়লা। কথাটা মেনে নেয়াই ভাল। সামনে ঝুঁকল হোল্ড। কনুই রেখেছে হাঁটুর ওপর। দুহাতে চেপে ধরল মাথা।
আমার ভাই ওর খেলনা ছিল না, ধমকের সুরে বলল রিক। আমি নিজেও কারও পুতুল নই।
হাতের ইশারায় কথাটা উড়িয়ে দিল হোল্ড। পরিকল্পনা তৈরি করে কাজে নেমেছে ময়নিহান। এরার হাতের মুঠোয় পাবে নিনা ভেঞ্চাকে। টোপ হিসেবে আছে ওর বোন। সব শেষ হলে আবারও লিটল ফোর্কে ফিরবে রাজার মত।
নিশ্চয়ই এখানে এসেছিল জুডি ব্ল্যাকউডের বডিগার্ড? নাম কী লোকটার?
নাম বলেছে মাসুদ রানা। মিথ্যা নামও হতে পারে।
মাসুদ রানা, বিড়বিড় করল রিক। নামটা ভাল লাগল না তার। থুতু ফেলল কার্পেটে। ওকে যেভাবে পারি খুঁজে বের করব। খতম করে দেব চিরতরে।
তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছে ময়নিহান। বলে দিয়েছে, যেন নিনা ভেঞ্চুরাকে নিয়ে ওর কাছে যায়।
চুপ করে থাকল রিক। ভাবছে, কীভাবে খুন করবে বাদামি লোকটাকে।
অবাক কাণ্ড কী, সেটা জানো? বলল জাজ। ময়নিহান সতর্ক করেছে, তাকে খুন করতে লোক পাঠাবে সে।
জাজ হোন্ডের দিকে তাকাল রিক। মনে পড়েছে, নিককে বলেছিল, আরও লোক ডাকছে ময়নিহান। তবে তার লোক লাগবে না আমাদের, বলেছিল নিক। তখন ওর সঙ্গে একমত হয়েছিল রিক। এখনও একই কথা বলবে। চাপা স্বরে জানাল, মাসুদ রানা আমার!
মাথা নাড়ল জাজ হোল্ড। এসব থেকে বাইরে থাকো, রিক। নইলে খুন হয়ে যাবে।
আমার ভাইকে খুন করেছে ওই লোক!
ব্যাপারটা তুলে দাও পেশাদারদের হাতে, বলল হোল্ড, নইলে বাঁচবে না। ওসবে না জড়িয়ে আমাকে সাহায্য করো, যাতে সামলাতে পারি এদিকের বিপদ।
হঠাৎ কেন তোমার মনে হচ্ছে যে আমি তোমাদের পরিচ্ছন্নকর্মী? ত্যাড়া সুরে জানতে চাইল রিক। ভাবছ আমি ময়নিহানের হাতের পুতুল?
রেগে লাভ নেই, রিক, বলল হোল্ড, সব গুছিয়ে না নিলে ফেঁসে যাব আমরা। তাতে ডুববে তুমিও। এখন প্রথম কাজ পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে আনা। খুঁজে বের করতে হবে অস্টিন ম্যাকলাস্কিকে।
ম্যাকলাস্কি মারা গেছে, জানাল রিক।
মারা গেছে? কী করে? মাসুদ রানার কাজ?
জবাব দিল না রিক।
পেশায় প্যাট্রিক হোল্ড বিচারক। থমকে গিয়ে দেখছে। দানবটাকে। থমথম করছে চেহারা। কসেকেণ্ড পর জানতে চাইল, তুমি খুন করেছ ওকে? কী কারণে?
কারণ সে ছিল ময়নিহানের পুতুল। তুমি যেমন বলেছ, আমরা সবাই ছিলাম তার খেলনা।
কড়া চোখে তাকে দেখল হোন্ড। তুমি গাধা নাকি!
আবারও ঝুঁকল রিক। দুহাতে তুলে নিল ভগ্ন দেহের জাজকে। সোজা চলে গেল জানালার সামনে।
আর্তচিৎকার ছাড়ল হোন্ড: আরে… আরে… এসব কী? পাগল হয়ে গেলে?
ঝাড়দারের কাজ করছি, বলল রিক, নইলে ন্যাশকে জানিয়ে দেবে আমি যাচ্ছি ডালাসে। দুর্বল শরীরের জাজকে দুহাতে মাথার ওপর তুলল সে, পরক্ষণে ছুঁড়ে ফেলল চওড়া জানালার ওপর। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাঁচ। জাজের সঙ্গে চলল চৌকাঠের হালকা, ভাঙা একটা অংশ। তবে ওটা পড়ার আগেই হাত-পা ছড়িয়ে ধুপ শব্দে রাস্তায় ভূপাতিত বিমানের মত পড়ল হোল্ড। ভোঁতা শব্দটা শুনে তিনতলা থেকে উঁকি দিল রিক। সন্তুষ্ট হয়ে ভাবল, ভাগ্যিস তুষার ঠিক তুলোর বাণ্ডিল নয়!
মেনে নেব পেশাদার খুনিদেরকে, তাই না, হোল্ড? হাসল রিক। মরুক শালারা! রানা শুধু আমার! কোনও কুত্তার বাচ্চাকে দেব না ওকে খুন করতে! ওকে খতম করব আমি, নিজের হাতে!
.
২০.
খুব ছোট লিটল ফোর্কের এয়ারপোর্ট। ওখান থেকে বিমানে ওঠে না আন্তর্জাতিক যাত্রীরা। গত দুবছর হলো কিছু আমেরিকান যাত্রীবাহী বিমান এলেও আগে আসত শুধু মালবাহী। হঠাৎ করেই এদিকের জমির দাম এবং টুরিস্টের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় সার্ভিস ভাল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
অনেকক্ষণ আগে তুষারপাত মাথায় নিয়ে টার্মিনালে পা রেখেছে রানা। এখন চেয়ারে বসে দেখছে দূরে প্রকাণ্ড, নির্মাণাধীন দোতলা দালান। বাইরের বিলবোর্ডে লেখা: নতুন টার্মিনাল চালু হবে আগামী বসন্তে।
আপাতত পুরনো, ছোট এবং চৌকো একতলা টার্মিনাল দিয়েই কাজ চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ওটার চারপাশে কাঁচের দেয়াল। ছাত টিনের। তবে মেঝে কংক্রিটের। দালানের একদিক আগত যাত্রীদের জন্য, অন্যপাশ বহির্গমন যাত্রীদের। একই দরজা ব্যবহার করছে সবাই। নেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বহির্গমন এলাকায় আছে মাত্র কজন যাত্রী। একটু পর পর মাথা তুলে দেখছে অ্যানাউন্সমেন্ট বোর্ড। কারও মনোযোগ নেই রানার দিকে।
বিলম্বিত করা হয়েছে ফ্র্যাঙ্কফোর্টের বিমান। একইভাবে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে লেক্সিংটন, জ্যাকসন ও হার্ডিংস্বার্গের বিমানের শেজিউল। তুষার ঝড়ের কারণে একই হাল এ রাজ্যের প্রতিটি বড় বড় এয়ারপোর্টের। দীর্ঘ সময়ের জন্যে আটকা পড়েছে রানা।
একটা ভেণ্ডিং মেশিন থেকে কফি নিয়েছে, আরেকটা থেকে স্যাণ্ডউইচ। ঘরের কোণে বসে দেখছে একটু দূরের আগমন ও নির্গমন দরজা। বড় বিমানবন্দর হলে ওকে সার্চ করত কর্তৃপক্ষ, কিন্তু অভ্যন্তরীণ বিমানযাত্রী ভেবে নজর দেয়নি কেউ। রানার কাছে রয়ে গেছে ওয়ালথার। ব্যাগেজে রেস্টুরেন্টে মৃত লোকটার গ্লক পিস্তল। কর্তৃপক্ষ জিজ্ঞাসাবাদ করলে ও দেখাবে নকল ইউএস এয়ার মার্শালের কাগজপত্র।
হোটেল থেকে ব্যাগ সংগ্রহের সময় ফোন করে ফ্লাইট বুক করেছে রানা। কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে, দেরি হবে বিমানে উঠতে। তবে আবহাওয়া দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, আশা করা যায় আগামী এক থেকে দেড় ঘণ্টার ভেতর থামবে ব্লিযার্ড। কিন্তু সেটা তিন ঘণ্টা আগের কথা। রওনা হতে না পেরে বিরক্ত রানা। কিন্তু কিছু করারও নেই।
পেরোল আরও দুঘণ্টা, লিটল ফোর্ক এয়ারপোর্ট ছেড়ে গেল না কিংবা নামলও না কোনও বিমান। এর ভাল দিক: তুষার ঝড়ের কারণে ও যেমন চলে যেতে পারছে না, তেমনি এখানে পৌঁছুতে পারবে না ময়নিহানের খুনিরাও।
নিনা মেসেজ দিয়েছে কি না দেখতে জুডির ফোন অন করল রানা। না, যোগাযোগ করেনি মেয়েটা। আবারও পকেটে মোবাইল ফোন রাখল ও। চেয়ার ছেড়ে গেল টার্মিনালের আরেক প্রান্তে। প্রতিটি বিমান ছাড়তে বা আসতে দেরি হবে, জানিয়ে দেয়া হয়েছে বোর্ডে। আজ সারাদিন জার্নি শেষে নানান বিপদে জড়াতে হয়েছে পাহাড়ে ও শহরে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। নতুন করে কফি কিনল রানা।
আবার আগের সিটে ফিরে চোখ রাখল দরজার ওপর। ভাবছে, যে-কোনও সময়ে পৌঁছুবে ম্যাকলাস্কি ও তার ডেপুটি শেরিফরা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই হ্যাণ্ডকাফ খুলে ফেলেছে লোকটা। খুঁজছে ওকে। এদিকে জ্ঞান ফিরতেই খেপে গেছে জাজ হোল্ড। ম্যাকলাস্কিকে জানাবে ওর নাম। ফ্লাইট বুকিং চেক লিস্ট দেখবে তারা। ওখানে পাবে না মাসুদ রানা নামটা। ও এখন মরিস রেনার। এই নাম ব্যবহার করেও সুবিধা হবে না, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলবে তারা।
এখনও পুলিশ হাজির হয়নি দেখে বিস্মিত রানা। খোঁজ নেয়ার কথা এয়ারপোর্টে। নাকি ন্যাশ ময়নিহান মানা করে দিয়েছে জাজ হোল্ড ও শেরিফ ম্যাকলাস্কিকে? রানা জেলে গেলে লড়তে পারবে না খুনিদের বিরুদ্ধে। তাতে মাটি হবে লোকটার আনন্দ? জেলে থাকলে খুঁজতে পারবে না নিনা, ভেঞ্চুরাকে। ময়নিহান চায় ও খুন হোক, তবে তার আগে খুঁজে বের করুক নিনা মেয়েটাকে।
চতুর্থ কাপ কফি শেষ করেছে রানা, এমনসময় সত্যিই থামল ব্লিযার্ড। তবে আরও দুঘণ্টা পর ডিসপ্লে বোর্ডে লেখা ফুটল: ফ্লাইট টু ফ্র্যাঙ্কফোর্ট উড বি লিভিং অ্যাট ০৯:৫৫ এ.এম.। অর্থাৎ পঁচিশ মিনিট পর রওনা হবে বিমান। বাইসন ট্রাক দিয়ে ভিলাজ-ও-সঁও রেস্টুরেন্টের কাঁচের দেয়াল ধসিয়ে দেয়ার প্রায় এগারো ঘণ্টা পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ও।
যাত্রীদের সবার শেষে ছোট্ট বিচক্ৰা ১৯০০ এয়ার ট্যাক্সিতে উঠল রানা। সিট সব মিলে উনিশটি। নেই ফ্লাইট অ্যাটেণ্ড্যান্ট। সে কাজ করবে কো-পাইলট। দরজা বন্ধ করে ককপিটে ফিরল সে। সবাইকে লক্ষ করে দেখেছে রানা, বিপজ্জনক মনে হয়নি কাউকে। পেছনের সিটে বসে মুদে ফেলল চোখ।
বারকয়েক টেনিসবলের মত লাফিয়ে আকাশে ভাসল পিচ্চি বিমান। কিছুক্ষণ পর তুষারভরা মেঘ ফুঁড়ে উঠল ওপরে। এরপর যাত্রা হলো মসৃণ। গতকাল ভোর থেকে টীম। অর্থাৎ পঁচিশফট উড বি লিপপ্লে বোর্ডে লেখা চলেছে রানার কায়িক পরিশ্রম। আর জেগে থাকতে পারছে না। চোখে আধো ঘুম আর আধো জাগরণ নিয়ে নামল ফ্র্যাঙ্কফোর্টে।
প্রবল তুষার ঝড়ের আওতার বাইরে শহরটি রয়ে গেলেও আকাশ ধূসর মেঘে ভরা। ক্যাপিটাল সিটি এয়ারপোর্টে পড়ছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। বিমান ত্যাগ করে অ্যারাইভাল টার্মিনালে ঢুকল সবাই। সঙ্গী যাত্রীদের পরনে ভারী কোট, ব্যতিক্রম শুধু রানা। যে কারও চোখে পড়বে ওর হালকা জ্যাকেট। নকল আইডি ব্যবহার করে ডালাসের টিকেট কিনল ও। নতুন করে যাত্রার জন্যে পরিষ্কার করা হচ্ছে বিমান। সময় লাগবে।
লিটল ফোর্কের চেয়ে ক্যাপিটাল সিটির এয়ারপোর্ট বড় হলেও এটাও আন্তর্জাতিক মানের নয়। ভেণ্ডিং মেশিন থেকে আবার নিল কফি-স্যাণ্ডউইচ। আধঘণ্টা পর রানা দেখল লাইন দিয়ে ছেড়ে আসা বিচক্রাফটে উঠছে আবার যাত্রীরা। তাদের কাউকে মনে হলো না পেশাদার খুনি। অবশ্য, পেশাদার খুনি মোটেই দেখতে খুনির মত হয় না। যে-কেউ বলবে রীতিমত ভদ্রলোক, পাশের বাড়ির বাসিন্দা। জানার উপায় নেই এই প্লেনে করে ওরা লিটল ফোর্কে যাবে কি না। তবে সম্ভাবনা বেশি, সামান্য সময়ের ব্যবধানে সরাসরি মুখোমুখি হলো না ওরা।
বারকয়েক রানার এ-ও মনে হলো, খুনির দলের সঙ্গে দেখা হলেই ভাল ছিল। তাহলে এখন আর থাকত না মানসিক চাপ। নিজেকে ওর মনে হচ্ছে যেন তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে।
একঘণ্টা পর কর্পোরেট জেটস্ট্রিম ৪১ বিমানে চেপে দক্ষিণ-পশ্চিমের ডালাস লক্ষ্য করে উড়ে চলল রানা। একসময় পেছনে পড়ল শীতার্ত আর্কানসাস। বিমান চলেছে টেক্সাসের সোনালি রোদ ভরা আকাশে। সামনে আসছে শত্রু এলাকা। আরও সতর্ক হতে হবে রানাকে।
বিমান অবতরণের পর প্রথমেই জুডির ফোন চেক করল ও। এখনও নেই কোনও মেসেজ। কল দিল জন হার্বার্টকে।
তুই কই, রানা? জানতে চাইল জন।
ডালাস ফোর্ট ওঅর্থে।
এত দেরি?
তুষার ঝড়ের কথা জানাল রানা। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায়?
এয়ারপোর্টের বাইরে, সঙ্গে বাড। মালামাল নিতে আসব?
না। কেউ জানে না তোদের কথা, ব্যাপারটা তেমনই থাকুক। আমি ট্যাক্সি নিলে পিছু নিবি। লেজ থাকতে পারে।
কিছুক্ষণ পর রানার ট্যাক্সিটাকে অনুসরণ করল জন ও বাড। রুট আশি থেকে নেমে পৌঁছুল আর্লিংটন শহরের প্রান্তে। যখন বুঝল পিছু নেয়নি কেউ, ট্যাক্সি ছেড়ে দিল রানা। ড্রাইভার বিদায় নেয়ার পর ওকে নিজেদের গাড়িতে তুলল জন হার্বার্ট ও বাড হিগিন্স।
ভাবতেও পারবি না কী জেনেছে বাড, বলল জন। দারুণ এক ক্যারেকটার ন্যাশ ময়নিহান। একদম পচা মাল!
মোটেলে উঠি, তারপর বলিস, সিটে হেলান দিল ক্লান্ত রানা।
<