২৬.

প্রচণ্ড শক্তিশালী মহিলা-র ঘরে দাঁড়িয়ে আছে মিশরীয় আর্মির জেনারেল খালিদ আসির। তার উদ্দেশে বলল লাবনী, ওই লোক উন্মাদ, নিশ্চয়ই ভাবছেন না সত্যিই নতুন করে জন্ম নিয়েছে সেট?

কী বিশ্বাস করি, তাতে কিছুই যায় আসে না, জবাবে বলল আসির, বড় কথা, কী বিশ্বাস করে সে। তা ছাড়া, প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছি বলে ও আমার কাছে কৃতজ্ঞ। ওর ধারণা, আমাকে দেয়া উচিত কোটি কোটি ডলার। কথা দিয়েছে, ওর পরিকল্পনা সফল হলে বড় পদে নিয়োগ দেবে। তা যদি না-ও হয়, টাকার অভাব হবে না আমার। কাজেই ভেবে দেখেছি, ও সেট হলেই বা কী ক্ষতি হচ্ছে আমার!

কিন্তু ওই লোক তো সাইকোপ্যাথ, বলল লাবনী। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে মরবে কোটি কোটি মানুষ!

চুপ করে শুনছে রানা। পেছনে অস্ত্র হাতে ট্রেইণ্ড কজন। উপায় নেই যে নিজেদেরকে মুক্ত করবে ও।

লাবনীর কথায় কাঁধ ঝাঁকাল জেনারেল। আজকাল তো অতিরিক্ত জনসংখ্যার কথা বলছে সবাই। ওই সংখ্যা কমলে ক্ষতি কী!

ঝড়-বৃষ্টির ঘরের নিচে নেই প্যাসেজ। পিঁপড়ে চ্যাপ্টা করে দেয়া মহিলার ঘরে লাগানো হয়েছে স্প্রিং লোডেড ক্লাইমিং ক্ল্যাম্প! প্যাসেজের মেঝে ও ছাত গায়েব হওয়ায়, নিচে ও ওপরে দীর্ঘ এক বিশাল শার্ট।

এবার কী করব? প্রায় ফিসফিস করল বেলা। ভীষণ ভয় লাগছে ওর। প্রায় উঠে এসেছি। একটু পর গুলি করে মেরে ফেলবে।

খুন হব না, বলল রানা, কোনও উপায়ে বেরিয়ে যাব। বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য লাগল না ওর নিজের কাছেই। অস্ত্র নেই। সংখ্যায় শত্রুরা অনেক।

রানার দিকেই চেয়ে আছে লাবনী। চোখে হেরে যাওয়া দৃষ্টি।

সবাই জড় হয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী মহিলার ঘরে। শুকিয়ে গেছে ফাটল ধরা রোলারদুটো। সবার আগে দড়ি বেয়ে সামনের প্যাসেজে গেল ট্রুপার হাতেম। তার কাছে রয়ে গেছে জারের কেস। হাতেমের পর দড়ি বেয়ে একে একে ঝুলতে ঝুলতে গহ্বর পেরোল অন্যরা।

ঢালু প্যাসেজ ধরে উঠল সবাই।

দড়িতে ঝুলে ঝড়-বৃষ্টির ঘর পেরোবার পর, ঢালু প্যাসেজ ধরে হেঁটে পৌঁছে গেল সেতুর কাছে।

কূপ পেরোলে আবারও প্যাসেজ, ওই খাড়াই পথে যাওয়ার পর সামনে পড়বে হায়ারোগ্লিফিক্স ভরা প্রথম ঘর।

জলদি! সবাইকে তাড়া দিল নাদির। অনিশ্চিত চোখে তাকে দেখল ডক্টর ব্রনসন। পিছিয়ে গেল কয়েক পা।

লাবনী ও বেলার পিঠে দুবার অস্ত্রের নলের খোঁচা দিল ভগলার। দ্বিধা নিয়ে সরু সেতুতে পা রাখল দুই মেয়ে। অতিরিক্ত চাপ পড়তেই ঠং-ঠনাৎ শব্দ তুলল শেকল। লাবনী ও বেলার পেছনে সেতুতে চাপল নাদিরের কয়েকজন ট্রুপার।

সেতুর ওপর পা রাখতে গিয়েও চট করে শেকল দেখল রানা। চোখ গেল দাঁতওয়ালা চাকার নিচে। ওখানে আছে ওর গুঁজে রাখা পাথরখণ্ড।

লাবনী, মনে আছে এখানে এসে কী জেনেছি? বলল রানা, এবার কিন্তু সত্যিই খুব দুলবে সব।

চোখ বিস্ফারিত করে চেঁচিয়ে উঠল লাবনী, বেলা, জলদি সেতু জাপটে ধরো!

এক লাথিতে পাথরখণ্ড সরিয়ে দিল রানা।

ছাড়া পেতেই ভারী ওজনের জন্যে ঘুরল সিলিণ্ডারের মত পাথরের রোলার, পুলির মাধ্যমে টেনে নিচ্ছে চেইন। ঘুরছে দাঁতওয়ালা চাকা।

শুয়ে দুই হাতে সেতু জড়িয়ে ধরেছে লাবনী ও বেলা। খটাং-খট-খটাং-খট শব্দে সেতুর বাড়তি অংশকে ভীষণভাবে ঝাঁকি দিতে লাগল দাঁতওয়ালা চাকা। সেইসঙ্গে সি-সওর মত দুলছে গোটা সেতু। হাতেম ছিল সবার আগে, টলমল করতে শুরু করে হাত থেকে ফেলে দিল অস্ত্র। ডাইভ দিল ওপারের মেঝেতে পড়তে। কিন্তু ভুল হয়েছে হিসাব, পতন শুরু হতেই খামচে ধরল মেঝের কিনারা। ঝুলতে লাগল গহ্বরের পাশে।

কপাল এত ভাল নয় ডক্টর ব্রনসনের। প্রস্তুত ছিল না, সেতু থেকে পড়ে সাঁই করে নেমে গেল। চারপাশে থাকল তার প্রলম্বিত আর্তচিৎকার। বেলার পেছনে দুই ট্রুপার পড়ল গহ্বরে। সেতুর ওপর টিকে থাকতে চাইল তৃতীয়জন, কিন্তু দুসেকেণ্ড পর রওনা হলো আঁধার নরকের দিকে।

সেতুর ওপর দাঁড়ানো শেষ ট্রপার ডাইভ দিয়ে পড়ল পেছনের পাথুরে মেঝেতে। রানা ও ভগলারের সঙ্গে ধাক্কা লাগল তার। ওরা তিনজন পড়ল অন্যদের ওপর। ঢালু প্যাসেজে গড়িয়ে গেল ওরা। গায়ের ওপর থেকে লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল রানা। পরক্ষণে কষে একটা লাথি লাগিয়ে দিল ভগলারের পেটে। উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, লাবনী! সেতু পেরিয়ে যাও! ওপরে উঠে পালাও!

তিলতিল করে এগোচ্ছে লাবনী। ওকে অনুসরণ করছে বেলা। চিৎকার করে জানতে চাইল লাবনী, তোমার কী হবে? তুমিও এসো!

কিন্তু অনেক বেশি দুলছে সেতুর ওদিকটা। উঠতে পারবে না কেউ। তাই বলে বসে থাকল না রানা, ঘুরেই বুটের শক্ত ডগা দিয়ে জোর এক লাথি ঝেড়ে দিল নাদির মাকালানির বুকে। ওর চোখ খুঁজছে আগ্নেয়াস্ত্র। কূপের কিনারায় আছে একটা এমপি-সেভেন সাবমেশিন গান। ওটা পাওয়ার জন্যে সামনে ঝাঁপ দিল রানা।

বদ্ধ জায়গায় বিকট বুম! আওয়াজ তুলল ভগলারের রিভলভার। লক্ষ্যহীন বুলেট চেঁছে নিল রানার বাহুর সামান্য মাংস। মুখ কুঁচকে গেল রানার। অন্যহাতে চেপে ধরল ক্ষত। তীব্র ব্যথায় ভুলে গেছে অস্ত্রের কথা।

রানা, এসো! চিৎকার করে উঠল লাবনী।

ওই জারটা নিয়ে বেরিয়ে যাও! পাল্টা চেঁচাল রানা।

ঘুরেই লাবনী দেখল, কিনারায় বস্তার মত ঝুলছে হাতেম। কাঁধ ওপরে তুলেছে, কিন্তু পিঠে ভারী কেস, তাই আর পারছে না উঠতে।

শক্ত মেঝেতে পা রেখে হাতেমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল লাবনী, ওই কেস দাও, তা হলে টেনে তুলব! ঝুঁকে নিতে গেল জারের কেস। কিন্তু ওটা আছে ইকুইপমেন্ট ওয়েবিঙের ক্লিপে আটকানো।

লাবনী ভাবল, যে অবস্থায় ঝুলছে লোকটা, এখন বাধা দেবে না। কেস ধরে টান দিল ও… কিন্তু, খন্ করে ওর ডান গোড়ালি খামচে ধরল হাতেম।

ছাড়! ভীষণ ভয় পেল লাবনী।

মুখ তুলে বাঁকা হাসল হাতেম। কিনারায় কনুই বাধিয়ে ঝুলছে, অন্যহাতে হ্যাচকা টান দিল লাবনীর গোড়ালি ধরে।

পা পিছলে চিত হয়ে মেঝেতে পড়ল লাবনী। ওর কাফ মাসল শক্তভাবে ধরেছে হাতেম। এদিকে সেতু পেরিয়ে গেছে বেলা, মেঝেতে পা রেখেই লাথি মারল হাতেমের কনুইয়ে। ছেড়ে দে, শয়তান!

না, ওই কেসটা নাও! বলল লাবনী। হেঁচড়ে পিছিয়ে যেতে চাইছে। ওর চোখ পড়ল হাতেমের চোখে। চাপা গলায় বলল ও, বাধ্য কোরো না!

জবাবে আরও কঠোর হলো হাতেমের চোখ। উঠে আসছে। আরও জোরে চেপে ধরেছে কাফ মাসল। ব্যথায় অস্থির লাগল লাবনীর।

পারলে কিছু কর! দাঁতে দাঁত চেপে বলল হাতেম।

অন্য পায়ে তার মুখে সবুট লাথি মারল লাবনী। ঝটকা খেয়ে পিছিয়ে গেল হাতেমের মাথা। হাত পিছলে গেল কাফ মাসল থেকে। তবে আবারও চেপে ধরতে পারল গোড়ালি। তার ওজন বইতে গিয়ে কিনারার দিকে পিছলে যাচ্ছে লাবনী।

ওদিকে ওয়েবিং থেকে কেস ছুটিয়ে নিতে পারছে না বেলা। প্রাণপণে টান দিল স্ট্রাপ ধরে।

আবারও লাথি ছুঁড়ল লাবনী। সেতুর বুবি ট্র্যাপের জোরালো শব্দের ওপর দিয়েও এল ফটাস আওয়াজ। ফেটে গেছে হাতেমের নাক। চিৎকার করল লাবনী, ছেড়ে দে! ছাড়! ছেড়ে দে!

প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করেও ঝুলছে হাতেম। মুচড়ে দিতে চাইল লাবনীর গোড়ালি। কূপে পড়তে শুরু করে সঙ্গে নিচ্ছে শিকার।

আরেক লাথি খেয়ে হাত ছুটে গেল তার। ঝুলছে কিনারা থেকে। অন্যহাতে বুকের ওয়েবিঙের খাপ থেকে নিল ধারালো ছোরা। এবার ওটা গেঁথে দেবে লাবনীর পায়ে…

আবারও লাথি মারল লাবনী। তবে এবার মুখ লক্ষ্য করে নয়। সরাসরি লাগল হাতেমের কিনারা ধরা হাতে।

থুতনিতে লাথি ভীষণ ব্যথা দিয়েছে, কিন্তু সে-তুলনায় আঙুল ভাঙার যন্ত্রণা বহু গুণ বেশি! হাত থেকে মেঝেতে পড়ল ছোরা। করুণ আর্তনাদ ছাড়ল সে। ছুটে গেল কিনারা থেকে হাত। মাধ্যাকর্ষণের টানে গভীর কূপে পড়ল হাতেম। ওই একই সময়ে ওয়েবিঙের ক্লিপ খুলেছে বেলা। হার্নেস থেকে ছুটে সই করে রওনা হয়ে গেল লোকটা নিশ্চিত মৃত্যুর পথে।

বুঝে গেছে লাবনী, রানাকে জিম্মি করতে চাইবে নাদির মাকালানি। ওর কাছ থেকে আদায় করবে ক্যানোপিক জার। শেষে মরতে দেবে না ওদের কাউকেই। ওই একই পরিণতি হবে কূপে কেসটা ফেললে।

একমাত্র উপায় ক্যানোপিক জার নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে রানাকে বাঁচিয়ে রাখবে নাদির। প্রয়োজনে মিথ্যা আশ্বাস দেবে, জার পেলে ছেড়ে দেবে ওদেরকে। ঘটনা যাই হোক, আপাতত রানাকে ছেড়ে সরে যেতে হবে ওর।

ছোরা ও কেসসহ হার্নেস নিয়ে উঠে দাঁড়াল লাবনী। চলো, বেলা!

অবাক চোখে ওকে দেখল বেলা। কিন্তু, মাসুদ ভাই…

দৌড় দাও! ওপরের ঘরে যেতে ছুট দিল লাবনী, হাতে কেস। শত্রুপক্ষের হাতে বেরিয়ে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র। একবার করুণ চোখে রানাকে দেখে নিয়ে লাবনীর পেছনে দৌড় দিল বেলা। ওর পাশের দেয়ালে পিছলে গেল বুলেট।

রাগে লালচে হয়েছে নাদির মাকালানি। খুন করো! খুন করো! চিৎকার করে উঠে এক লোকের হাত থেকে কেড়ে নিল সাবমেশিন গান। গুলি করে খালি করল ম্যাগাযিন। কিন্তু প্যাসেজ পেরিয়ে দূরে চলে গেছে লাবনী ও বেলা। প্রচণ্ড ক্রোধে আহত হিংস্র জানোয়ারের মত গর্জন ছাড়ল নাদির। এত জোরে অস্ত্রটা মেঝেতে আছড়ে ফেলল, ঠাস্ করে ফেটে গেল প্ল্যাস্টিকের হ্যাণ্ডগ্রিপ। হাত মুঠো করে বাঘের চোখে দেখল রানাকে।

রানার ধারণা হলো, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না বদমেজাজি লোকটা। গভীর কূপে ফেলবে ওকে। গুলি করো একে! চিৎকার করে উঠল নাদির। গুলি করো!

বোয়াল মাছের মত চওড়া ঠোঁটের বিস্তৃত হাসি দিল। কিলিয়ান ভগলার।

নাদির, একটু অপেক্ষা করো! বাদ সাধল জেনারেল আসির। কর্তৃত্বের সঙ্গে বলেছে। দ্বিধায় পড়ে গেল ভলার। ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে আকস্মিক বাধা পড়তেই ঝট করে ঘুরে তাকাল নাদির। একে ব্যবহার করে ফিরে পাবে ওই জার। ওটা নষ্ট করবে না ওই মেয়ে। ওটার বদলে চাইবে মাসুদ রানাকে ফিরে পেতে।

বড় করে কয়েকবার দম নিল নাদির, এখনও থরথর করে কাঁপছে রাগে। একটু পর বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। বাধা দিলে বলে ধন্যবাদ, দোস্ত!

আমি সবসময় তোমার ভাল চেয়েছি, সেইসঙ্গে নিজের, মৃদু হাসল জেনারেল খালিদ আসির।

আমরা তা হলে একে খুন করব না? খুব হতাশ হয়েছে। ভগলার। ভুলতে পারেনি, তার মত ভয়ঙ্কর লোকের পাছায় লাথি দিয়েছিল ওই বাঙালি যুবক।

না, আপাতত নয়, বলল নাদির। তবে জার পাওয়ার পর…কঠোর চোখে রানাকে দেখল সে।

ওই জার আর পাবে না, আহত বাহু অন্যহাতে ধরেছে রানা। লাবনী বা বেলাকে ধরতে পারবে না। ফিরবে ওরা অ্যাবাইদোসে। মিশরের কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেবে কী করছ তোমরা। তোমাদের খেলা খতম।

আমার তা মনে হয় না, বলল নাদির। বিস্মিত চোখে দেখল, বড় একটা ঝাঁকি দিয়ে থামল চেইন। সেতু স্থির হতেই কূপ পেরিয়ে গেল অবশিষ্ট কজন ট্রুপার। রানা, তুমি বোধহয় জানো না কীভাবে এখানে এলাম আমরা?

.

মাথার ওপরের ম্যান হোল থেকে নেমে এসেছে দড়ির মই। একটু আগে প্রথম ঘরে ঢুকেছে লাবনী ও বেলা। মই বেয়ে উঠে এসেছে মরুভূমির পাথুরে কুটিরে। কয়েক সেকেণ্ড চোখ রেখেছে হোভারক্রাফটের ওপর। ওটা প্রকাণ্ড মিলিটারি ক্রাফ্ট। নিচু করে রাখা হয়েছে ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্প। মস্ত হাঁ করে আছে যন্ত্রটা। তবে দেখা যায়নি কাউকে।

জিনিসটা কী? লাবনীর কাছে জানতে চেয়েছে বেলা।

ওটা আছে বলেই আমরা আছি বিপদে, বলেছে লাবনী। কিন্তু একবার জিপ নিয়ে ক্যানিয়নে ঢুকতে পারলে আর পিছু নিতে পারবে না।

তা হলে চলুন, দেরি করা ঠিক হচ্ছে না।

 পরিত্যক্ত দালান থেকে বেরিয়ে সোজা সিকি মাইল দূরের ওই নালার দিকে দৌড় দিল লাবনী ও বেলা।

পেছন থেকে ধাওয়া করে এল না কেউ।

বালিতে দৌড়ে চলা কঠিন, তবে মাত্র পাঁচ মিনিটে তুবড়ে যাওয়া ল্যাণ্ড রোভারের পাশে পৌঁছে গেল ওরা।

স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসল লাবনী। মাঝের সিটে থাকল ক্যানোপিক জারের কেস। ছোরা রেখে দিল হার্নেসের খাপে।

ওপাশের দরজা খুলে সিটে উঠল বেলা। লাবনী ইঞ্জিন চালু করতেই আপত্তির সুরে বলল, মাসুদ ভাইয়ের কী হবে? তাকে তো মেরে ফেলবে ওরা! হয়তো মেরেই ফেলেছে!

পুবে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে রওনা হলো লাবনী। ওকে খুন করবে না। আমাদের কাছে ক্যানোপিক জার। এটা ফেরত চাইবে নাদির মাকালানি।

তারপর হতাশ হলেই মেরে ফেলবে মাসুদ ভাইকে। খুব খারাপ লাগছে। বড়ভাইয়ের মত আগলে রেখেছিলেন। সত্যিকারের বড়ভাই হলে, এমন করেই…

আরে, ভাবছ কেন যে মরবে ও, সান্ত্বনা দিল লাবনী। ওকে উদ্ধার করার একটা না একটা পথ বেরোবে।

চুপ হয়ে গেল বেলা। চোখ বোলাল কেসের ওপর। ক্ষতি হয়নি ওটার। সিটবেল্ট দিয়ে আটকে নিল। কাজটা শেষ করেই চমকে গেল। ওয়েবিঙে ঝুলছে ওই জিনিস। লাবনী আপু… প্রায় কেঁদে ফেলল ও। দুইটা গ্রেনেড! গায়ের কাছে!

থাকুক, ভুলেও ধরতে যেয়ো না, সতর্ক করল লাবনী।

কিন্তু গাড়ি চলছে বলে ঠুক-ঠাক টোকা লাগছে দুটোয়! সত্যিই এবার খুন হয়ে গেলাম!

পিন টেনে না খুললে মরবে না, শুকনো হাসল লাবনী। চোখ রেখেছে হলদে মরুভূমিতে।

ঝড়ের বেগে চলেছে ল্যাণ্ড রোভার ডিফেন্ডার।

পিরামিড ছেড়ে মরুভূমির মেঝেতে উঠে এসেছে নাদির মাকালানি। সঙ্গেই আছে জেনারেল আসির। তার উদ্দেশে এগিয়ে এল যুবরের পাইলট। আরবি ভাষায় জানাল, কী দেখেছে। আঙুল তুলল পুবদিকে।

টলমল করা প্রচণ্ড তাপের মাঝে দূরে ধুলো উড়তে দেখল রানা। জানতাম, ওদেরকে ধরতে পারবে না।

যে-কোনও জমিতে চল্লিশ নট বেগে চলে হোভার ক্রাফট, প্রকাণ্ড যুবর দেখিয়ে গর্বের সঙ্গে বলল জেনারেল আসির, ওদের জিপ দৌড়ে হারবে।

মাথা নাড়ল রানা। হয়তো, তবে কীভাবে যাবে সরু ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে?

যুবরকে কিছু করতে হবে না, সঙ্গে আরও অন্য জিনিস আছে, জানাল ভগলার।

নাদির নির্দেশ দিতেই যুবরের দিকে ছুট দিল ট্রুপাররা। অন্যদের উদ্দেশে বলল সে, আগে ওদেরকে ধরে, তারপর খতম করব। একবার রানাকে দেখে নিয়ে যুবরের দিকে চলল সে। পেছনে অন্যরা। রানা, ভাল করেই দেখবে, কীভাবে কী করছি।

রিভলভারের নল দিয়ে রানার পিঠে খোঁচা দিচ্ছে ভগলার। তার দরকার ছিল না। নিজে থেকেই হাঁটছে রানা। যুবরের কাছে যাওয়ার আগেই ওটার পেট থেকে এল ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ। হোন্ড থেকে ছিটকে বেরোল দুটো ছোট ভেহিকেল। প্রায় উড়তে উড়তে নেমে এল র‍্যাম্প বেয়ে। মরুভূমিতে পড়ে ধুপ করে ছিটিয়ে দিল বালি। ঘুরেই রওনা হয়ে গেল পুবে। ধাওয়া করছে ল্যাণ্ড রোভারটাকে। গলা শুকিয়ে গেছে রানার। ওই দুই যন্ত্র লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল। মিলিটারাইড় ডিউন বাগি। হালকা ওজন, ফ্রেম, চারটে চাকা ও ইঞ্জিন। ড্রাইভারের মাথার ওপরে টারেটে মেশিন গান। দেখলে পছন্দ করবে না কেউ, আরামও নেই চেপে, কিন্তু মরুভূমিতে চলতে পারে সাইমুমের বেগে।

ডিফেণ্ডার জিপগাড়ির চেয়ে অনেক দ্রুত চলছে লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল।

শুরু হলো ধাওয়া, গম্ভীর কণ্ঠে বলল নাদির। টিটকারির চোখে দেখল রানাকে। অবশ্য, দুঃখের কথা, বেশিক্ষণের জন্যে নয় ওই ধাওয়া।

এরা ট্রেইণ্ড, অস্ত্রের মুখে বন্দি রানা। পিঠে রিভলভারের খোঁচা খেয়ে র‍্যাম্প বেয়ে যুবরের হোন্ডে উঠল ও। বিশাল এক বাক্সের মত জায়গা এই হোল্ড। রাখা যাবে তিন-তিনটে ব্যাটল ট্যাঙ্ক অথবা তিন শ সশস্ত্র সৈনিক। আপাতত হোল্ডে আছে হলদে রঙের নোংরা কয়েকটা এক্সকেভেটর ও আর্থমুভার। পাশেই তৃতীয় ডিউন বাগি। উঁচু প্ল্যাটফর্মে মরুভূমিতে অপারেশনের জন্যে ইকুইপমেন্ট। রানা বুঝল, ওসাইরিয়ান টেম্পলের কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল খুঁড়ে নিতে হবে পিরামিড।

কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে গিয়ে ফোন হেডসেট নিল জেনারেল খালিদ আসির। নির্দেশ দিল ব্রিজের অপারেটরকে। কসেকেণ্ড পর চালু হলো যুবরের মেইন ইঞ্জিন। বাড়ছে টারবাইনের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। সেইসঙ্গে জোরালো ফিসফিস শব্দ। হোল্ডের পেছনে দীর্ঘ বাল্কহেডে কাজ করছে প্রকাণ্ড চারটে লিটু ফ্যান। স্কার্ট-এ হুড়মুড় করে বাতাস ঢুকতেই মেঘের মত ভাসল একরাশ বালি। পুরু রাবারের বেল্টে ভর করে উঠে পড়ল বিশালাকার ভেহিকেল।

আসির বাটন টিপে দেয়ায় উঠে এল র‍্যাম্প। হাইড্রোলিক কাজ করতেই জোর আওয়াজে ধুম করে বন্ধ হলো স্টিলের কবাট। থেমে গেল বালিঝড়, কিন্তু কান প্রায় ফাটিয়ে দিল ফুল পাওয়ারের ইঞ্জিনের গর্জন।

হোল্ডের মাঝের মই বেয়ে উঠে গেল ভগলার। চেয়ে আছে ওপর থেকে। এবার উঠতে হবে রানাকে। সশস্ত্র গার্ডদের অস্ত্রের ইশারায় মই বেয়ে উঠল ও। বুকে ধাক্কা দিয়ে। একটা দেয়ালে ওকে ফেলল ভগলার। উঠল আরও কয়েকজন গার্ড। একজন হ্যাচকা টানে পেছনে নিয়ে ওপরে তুলল রানার হাতদুটো। বুলেটের ক্ষতে লাগতেই তীব্র ব্যথায় মৃদু আওয়াজ বেরোল রানার মুখ থেকে।

পিরামিডেই শেষ করতে পারলে ভাল হতো! আফসোস করল ভগলার। প্ল্যাস্টিকের যিপ-টাই দিয়ে আটকে দিল। রানার দুই কবজি। ঠেলে নিয়ে চলল সামনের ঘরের দিকে।

হাঁটতে হাঁটতে হাত নাড়ল রানা। এত আঁটো হয়ে বসেছে যিপ-টাই, কেটে যাচ্ছে ত্বক-মাংস। বুঝে গেল, জরুরি ভিত্তিতে খুঁজতে হবে মুক্তির কোনও উপায়।

সর্বনাশ! ল্যাণ্ড রোভারের রিয়ার উইণ্ডো দিয়ে চেয়ে আছে বেলা। হামলা করতে আসছে ডিউন বাগি!

আয়নায় পেছনের মরুভূমিতে কালো দুটো জিনিস দেখল লাবনী। প্রচণ্ড গতি ওগুলোর। দ্রুত চলে আসছে কাছে। আবার সামনের মরুভূমিতে চোখ রাখল ও। কাজে আসবে। এমন কিছুই দেখল না। সমতল বালিজমি আর ঢেউ খেলানো ঢিবি। এখনও অনেক দূরে ওই ক্যানিয়ন।

কেসের ইকুইপমেন্ট ওয়েবিং দেখল লাবনী। অস্ত্র বলতে ওদের কাছে বড়জোর একটা ছোরা আর দুটো গ্রেনেড। ছোরা দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। কাছে পাবে না কাউকে। আগে নিজেই খুন হবে। অবশ্য, গ্রেনেড ছুঁড়তে পারে ডিউন। বাগির দিকে। কিন্তু ওয়েবিং হার্নেস দেখলে, গ্রেনেড ছোঁড়ার আগেই সরে যাবে ওগুলোর চালক।

একটা বুদ্ধি এল লাবনীর মনে। ওটা এতই সহজ, কেউ ভাববে না তাতে কাজ হবে। তবুও ওটাই বাঁচার একমাত্র উপায়।

আবারও মরুভূমির বুকে চোখ বোলাল লাবনী। এবার আরও সতর্ক। বড় একটা ঢিবি চাই ওর।

হঠাৎ আঁৎকে উঠল বেলা। নিচু করে নিয়েছে মাথা।

বিশ্রী খ্যাট-খ্যাট আওয়াজ। গাড়ির একপাশে বালি খুঁড়ে উষ্ণপ্রস্রবণ তৈরি করছে মেশিন গানের বুলেট। সিটে নিচু হয়ে বসল লাবনী। আরেক দিকে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি, কিন্তু যথেষ্ট দ্রুত কাজটা করতে পারেনি। চুর-চুর হয়ে ভেঙে পড়ল পেছনের জানালা, খটখট শব্দে বুলেট লাগল ডিফেণ্ডারের অ্যালিউমিনিয়ামের পাতলা দেহে।

মেশিন গানের গুলি পাঠাতে শুরু করেছে দ্বিতীয় গানারও। জিপগাড়ির পাশ দিয়ে গেল কমলা-একসারি তপ্ত ট্রেসার বুলেট। তাড়া খেয়ে আরেক দিকে ছুটল লাবনী। বুঝে গেছে, অধরা থাকতে পারবে না বেশিক্ষণ।

আরেক পশলা গুলি ছিঁড়েখুঁড়ে দিল জিপগাড়ির দেহ। ফাটল ধরল সামনের উইণ্ডশিল্ডে। লাবনীর পাশের জানালা ভেঙে ঢুকল একটা ট্রেসার বুলেট। দুই ইঞ্চি নিচে দিয়ে গেলে বিস্ফোরিত হতো ওর মাথা।

বনবন করে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে আরেক দিকে চলল লাবনী। বালির ভেতর এতই দ্রুত বাঁক নিয়েছে, আরেকটু হলে কাত হয়ে পড়ত গাড়ি। বুলেট লেগে বিস্ফোরিত হলো মাঝের সিটের পেছনে ফোলা ফোম। একটুর জন্যে রক্ষা পেল ক্যানোপিক জারের কেস।

ভীষণ ভয়ে ফোঁপাতে শুরু করেছে বেলা।

গাড়ি সোজা করে নিল লাবনী। অনায়াসেই পিছু নিল এলএসভি। সামনে চেয়ে লাবনী দেখল, দীর্ঘ এক বালির ঢিবি।এঁকেবেঁকে গেছে ওটা। পাশেই বায়ুস্রোতে ক্ষয় হওয়া হাজার হাজার বছরের উঁচু শৈলশিরা। এমন জায়গাই খুঁজছিল ও। এবার…,

আয়না দেখল লাবনী। সরাসরি ওর দু শ ফুট পেছনে এক ডিউন বাগি। অনুসরণ করছে অন্ধের মত। স্টিয়ারিং হুইল ধরো! মৃদু কাঁপা গলায় বলল লাবনী।

ওর দিকে অবাক হয়ে তাকাল বেলা। কী করতে হবে?

ড্রাইভ করবে! সরে আসতে ইশারা করল লাবনী।

আপনি কী করবেন? পাশে চলে এল বেলা।

অ্যাক্সেলারেটরে পা রেখে হেঁচড়ে বেলার ওপর দিয়ে এদিকে চলে এল লাবনী। আয়নায় দেখল গতি বাড়িয়ে তেড়ে আসছে কাছের এলএসভি। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছুবে জিপগাড়ির ঠিক পেছনে। সঙ্গীদের গায়ে লাগবে ভেবে গুলি বন্ধ করেছে অন্য ডিউন বাগির গানার।

বেলা, অ্যাক্সেলারেটর চেপে রেখে সোজা যাও! লাবনীর দেহের বেশিরভাগ ওজন সহ্য করেও কথামত কাজ করছে বেলা। একটা বুদ্ধি এসেছে!

.

যুবরের ওয়েপন্স রুমে ওয়েপন্স অফিসারের কাঁধের ওপর দিয়ে মনিটরে জিপগাড়ির পলায়ন দৃশ্য দেখছে মাসুদ রানা।

প্রায় শেষ হয়ে এল ধাওয়া। যুবরের ফায়ার-কন্ট্রোল কমপিউটার দেখিয়ে দিচ্ছে শত্রুর রেঞ্জ, বেয়ারিং ও স্পিড। তিন গাড়ির পাশেই তিন কার্সার। যে-কোনওটা উড়িয়ে দিতে পারবে যুবরের কামানের গোলা। তবে সামনের এলএসভি প্রায় পৌঁছে গেছে ল্যাণ্ড রোভারের লেজের কাছে।

রানার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নাদির মাকালানি। সামনের ডিউন বাগি থেকে গুলি চলতেই খুশি হয়ে কন্সেলের ওপর ধমাস করে একটা ঘুষি নামাল সে। ওয়েপন্স অফিসারের উদ্দেশে চেঁচিয়ে উঠল, গানারকে জানাও, জিপের ড্রাইভারের মাথার দিকে গুলি করতে! ভুলেও যেন জারের কেসের দিকে গুলি না করে!

সিটে নড়েচড়ে বসে আদেশ পাচার করল অফিসার।

নার্ভাস লুকমান বাবাফেমি জানতে চাইল, ওই বাক্স বুলেটপ্রুফ না?

হ্যাণ্ডগানের গুলিতে কিছু হবে বলে মনে হয় না, বলল জেনারেল আসির, তবে… মেশিন গানের… জানি না!

কেস আর জার ফেরত পেলে সব ঠিক আছে কি না, সেটা দেখে নেবেন, বাবাফেমি, বলল নাদির। কড়া চোখে দেখল ম্যান মেটযকে। ডক্টর মেটযের হাত বেশি কাঁপবে।

ম্যান মেটয-এর দিকে তাকাল রানা। কোনায় দাঁড়িয়ে আছে সে। ফ্যাকাসে। অসুস্থ চেহারা। ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা, চেনা কাউকে গুলি করছে, ভাবতে ভাল লাগে না। ভাবছ, এসবে জড়িয়ে যাওয়া উচিত হয়নি, তাই না? তো এসব ভাবার দরকারই বা কী? তুমি তো মোটা অঙ্কের টাকা পাবে!

মুখটা বন্ধ রাখো, মাসুদ রানা! কলোলের ওপর ঠেলে ওকে ফেলল কিলিয়ান ভগলার।

স্ক্রিনে দেখল রানা, বালির ঢিবিতে উঠছে ল্যাণ্ড রোভার ডিফেণ্ডার। একটু পেছনেই এলএসভি। মেশিন গানের নল তাক করছে গানার।

হাঁচড়েপাঁচড়ে ল্যাণ্ড রোভারের পেছনে চলে এসেছে লাবনী। এখন হাতে একটা গ্রেনেড। সোজা যাবে! বেলাকে জানাল। নিজে গেল পেছনের দরজার কাছে। বালির ঢিবির ওপরে উঠলেই চিৎকার করে জানাবে!

কী করবেন? পেছনে চেয়ে জানতে চাইল বেলা। খাড়া পথে জিপ উঠছে বলে কাছে চলে এসেছে ডিউন বাগি। দুই পা দিয়ে অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল চেপে ধরল ও।

ঢিবিতে উঠলেই বলবে! পেছনের ভাঙা জানালা দিয়ে চেয়ে আছে লাবনী। গর্জন ছাড়তে ছাড়তে আসছে সামনের এলএসভি। বড়জোর দু শ ফুট দূরে। দেড় শ ফুট…

যাতে টলে না পড়ে, তাই পাশের দরজার হ্যাণ্ডেল ধরেছে লাবনী। অন্যহাতের বুড়ো আঙুল ঢুকেছে গ্রেনেডের রিঙের ভেতর। টান দিলেই খুলে আসবে পিন। আসছে, তারা! অনেক কাছে ডিউন বাগি। ড্রাইভার ও গানারের চেহারা পরিষ্কার দেখল লাবনী। তাদের ঠোঁটে ফুটে উঠেছে বিজয়ের হাসি। বেলা, কত দূরে চূড়া!

চিৎকার করে বলল বেলা, উঠে পড়ছি!

বুড়ো আঙুলের টানে গ্রেনেডের স্প্রিং লোডেড পিন খুলল লাবনী। আমড় হয়ে গেছে জিনিসটা।

শুকনো কাঠের মত খরখর করছে লাবনীর গলা। ভাবল, আশা করি এই গ্রেনেডে আছে পাঁচ সেকেণ্ডের ফিউয। নইলে গেছি!

বালিটিবির ওপরে উঠে প্রায় হুমড়ি খেল ল্যাণ্ড রোভার, তারপর চেপে বসল পাশের শৈলশিরায়। চূড়ার নিচে রয়ে গেছে এলএসভি।

ভাঙা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ল্যাণ্ড রোভারের ফেলে আসা, পথে গ্রেনেড ফেলল লাবনী। গড়ান দিয়ে সরে গেল কার্গো বেড পেরিয়ে সিটের ওদিকে। ততক্ষণে আবারও বালির ঢিবি বেয়ে নামতে শুরু করেছে ল্যাণ্ড রোভার। বাড়ছে গতি। লাবনীর জানা নেই পেছনের দরজা- ওকে নিরাপদ রাখবে কি না। ঝুঁকি না নিয়ে উপায়ও ছিল না।

ছিটকে চূড়ায় উঠে এল এলএসভি। গর্জন ছাড়ছে ইঞ্জিন। সোজা চাকা তুলে দিল গ্রেনেডের ওপর। একইসময়ে ফাটল শক্তিশালী বোমা।

আকাশে ছিটকে উঠে বারকয়েক পাক খেয়ে পিছনে গিয়ে পড়ল এলএসভি। ঝাঁঝরা হয়ে গেছে প্রচণ্ড গতি এ্যাপনেলের আঘাতে। ধুপ করে উল্টো হয়ে পড়ল ওটা. তাঁবুর খুঁটির মত বালির ভেতর গেঁথে গেল গান টারেট। পাশেই ক্ষত-বিক্ষত দুই লাশ।

চোখ থেকে হাত সরিয়ে পেছনে দেখল লাবনী।

দাউদাউ আগুনে পুড়ছে এলএসভির ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু বালির ঢিবিতে উঠেছে দ্বিতীয় ডিউন বাগি। নতুন করে তেড়ে এল ওটা।

মন খারাপ হয়ে গেল লাবনীর।

দ্বিতীয়বার একই কৌশলে কাজ হবে না!

.

২৭

মনিটরে ধোঁয়ার কালো স্তম্ভ দেখে হতভম্ভ হয়েছে নাদির মাকালানি। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, কী হয়েছে? কী হলো ওটা?

লাবনী নষ্ট করে দিয়েছে তোমার একটা খেলনা, বলল রানা।

রাগে বিকৃত হলো মাকালানির চেহারা। ঘুরেই রানার পেটে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসল সে। চিৎকার করে উঠে ব্রিজে পাইলটকে বলল, পিছু নাও! ঘুরল ওয়েপন্স অফিসারের দিকে। ওদের বলো, যেন নল তাক করে ড্রাইভারের মাথার দিকে। জার যদি নষ্ট হয়, নিজ হাতে ওদেরকে খুন করব আমি!

অফিসার বড় করে দম নিয়ে ভাবল, কপাল ভাল জেনারেল আসিরের চাকরি করি, নাদির মাকালানির নয়। ডিউন বাগির ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতে লাগল সে।

হোঁচট খেল সবাই।

ল্যাণ্ড রোভারের পিছু নিয়েছে হোভারক্রাফট।

কর্কশ চিৎকার ছাড়ল নাদির, ফুল স্পিড! ফুল স্পিড! ধরো ওদেরকে!

আবারও সামনের সিটে ফিরেছে লাবনী। আপাতত সমান্তরাল ভাবে আসছে দ্বিতীয় এলএসভি। সরাসরি গুলি করতে পারবে গানার, কিন্তু কেন যেন তা করছে না। ওরা গুলি করছে না।

আপনি যেন তাতে খুশি নন? জানতে চাইল বেলা।

গুলি ঠিকই করবে, বলল লাবনী। বুঝে গেছে কারণটা। ওরা যখন বাগে পাবে, নির্ঘাত খুন হব। তার আগে ওই কেস চাই ওদের।

বাহ্, দারুণ খুশির কথা!

লাবনী দেখল, পেছনে আসছে প্রকাণ্ড হোভারক্রাফট। তবে ওটাকে আপাতত পাত্তা না দিলেও চলে। সামান্য দূরত্ব রেখে পাশাপাশি ছুটছে এলএসভি। বড় বিপদ ওটা। ওদের দিকেই ঘোরাচ্ছে মেশিন গানের নল।

টার্গেটিং মনিটরে পরিষ্কার দেখল রানা, প্রায় পাশে ছুটছে ল্যাণ্ড রোভার ও এলএসভি। জয়স্টিক সামান্য নাড়ল ওয়েপন্স অপারেটর। লাবনী-বেলার গাড়ির ওপর গেল কার্সার। লাল হয়ে উঠেছে ওটা। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ল্যাণ্ড রোভারকে ট্র্যাক করছে আধুনিক রেইডার।

মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে উপস্থিত সবার দিকে তাকাল রানা। মনিটরের দৃশ্যে আঠার মত লেগে আছে নাদির মাকালানির প্রত্যাশাভরা চোখ। ভাব দেখে মনে হলো আমেরিকান ফুটবল দেখছে কিলিয়ান ভগলার। এইমাত্র প্রতিপক্ষকে পার করে টাচ লাইনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার প্রিয় কোয়ার্টারব্যাক। খুব চিন্তিত চেহারা লুকমান বাবাফেমির। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে ম্যান মেটয। দেখবে না শেষদৃশ্য। পেশাদার অলস চোখে মনিটর দেখছে খালিদ আসির ও ওয়েপন্স অফিসার।

তার মানে, কেউ চেয়ে নেই রানার দিকে! হাতদুটো ওর পিঠের কাছে বাঁধা। কেউ ভাবছে না হুমকি হয়ে উঠবে ও। ওয়েপন্স রুমের অপরিসর জায়গায় বাধ্য হয়ে রিভলভারের নল নিচু করতে হয়েছে ভগলারকে। সবার চোখ মনিটরের দৃশ্যে।

আরেকবার ভগলারকে দেখল রানা, তৈরি হয়ে নিল।

বেলা যতই অন্তর থেকে কামনা করুক, অনেক জোরে ছুটবে ল্যাণ্ড রোভার, কিন্তু তা হওয়ার নয়। লাইট স্ট্রাইক ভেহিকেল অনেক বেশি দ্রুতগামী। আপাতত মাত্র এক শ ফুট দূরে। চলে আসছে আরও কাছে। সামনের গাড়ির ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে এম-সিক্সটি মেশিন গান তাক করছে গানার…

মরুভূমির হলদে পটভূমিতে এলএসভির গানারকে দেখা যাচ্ছে স্ক্রিনে। অস্ত্র তাক করছে সে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজ জানিয়ে দিল, এবার যে-কোনও সময়ে গুলি করবে।

হঠাৎ করেই দুহাত মুঠি পাকিয়ে পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়ল রানা। ওর শক্ত মুঠো লাগল অপ্রস্তুত ভগলারের পেটে। কোৎ করে উঠল লোকটা। কাত হয়ে পড়ল এক টুপারের ওপর। এদিকে কেউ কিছু করার আগেই রানার হাঁটু লাগল ওয়েপন্স অফিসারের মাথার পাশে। সিট থেকে ছিটকে গেল সে। ঘুরেই দুহাতে জয়স্টিক ধরে একসারি বাটনের ওপর কপাল ঠুকল রানা।

এসব বাটন যুবরের একে-সিক্স হান্ড্রেড থার্টি গ্যাটলিং গানের। ল্যাণ্ড রোভারের ওপর থেকে টার্গেটিং কার্সার সরিয়ে নিয়ে এলএসভির ওপর স্থির করল রানা, পরক্ষণে টিপে দিল জয়স্টিকের বাটন। চওড়া মেইন ডেকে ঘুরে নতুন শিকারের ওপর স্থির হলো টারেট।

পরক্ষণে শুরু হলো তিরিশ এমএম মেশিন গানের বিশ্রী ভ্যার-ভ্যার-ভ্যার আওয়াজ। কানে তালা লেগে গেল সবার। মনে হলো খুব কাছে চালু হয়েছে চেইন সও। ছয় ব্যারেল থেকে প্রতি সেকেণ্ডে বেরোল আশিটি বিস্ফোরক শেল। ধাতব বজ্র-বৃষ্টির তোড়ে প্রায় উড়ে গেল এলএসভি। কিমা হয়েছে ড্রাইভার ও গানার। টার্গেট ধ্বংস হয়েছে না জানালে গুলি শেষ হওয়া পর্যন্ত চলবে একে-সিক্স হান্ড্রেড থার্টি মেশিন গান।

এদিকে ঝট করে ঘুরেই এক টুপারের পাছায় কষে এক লাথি মেরেছে রানা। পরক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাশেরজনের ওপর। হুলুস্থুল লেগে গেছে ছোট্ট, ধাতব ঘরে। তবে সবার আগে সামলে নিল কিলিয়ান ভগলার, লাফিয়ে এসেই প্রচণ্ড এক ঘুষি বসাল রানার বুকে। পিছিয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে ছিটকে এক কন্সেলের ওপর পড়ল রানা। ঠাস করে ঠুকে গেল মাথা। চোখে দেখছে হাজার হাজার লাল-হলদে-নীল নক্ষত্র। ব্যথায় আটকে গেল দম।

থেমে গেল গ্যাটলিং গানের জোরালো গুঞ্জন। আবার সব নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে ওয়েপন্স অফিসার।

রানা সামলে নেয়ার আগেই ওর শার্টের কলার চেপে ধরল ভগলার। থুতনির নিচে ঠেসে ধরেছে রিভলভার। রানা কিছু বোঝার আগেই চোয়ালে লাগল নাদিরের জোরালো তিনটা ঘুষি। চতুর্থটা আরও প্রচণ্ড, মুঠো গেঁথে গেল ওর পেটে। ঝুঁকে গিয়ে ওর অবস্থা হলো আজন্ম কুঁজোর মত। হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ঘাড় ধরে দরজা পার করিয়ে দিল নাদির। বেতাল হয়ে বাইরের ডেকে ধুপ করে পড়ল রানা।

ঘর ছেড়ে পিছু নিয়ে তেড়ে এসেছে ক্রোধান্ধ নাদির। তার জোরালো কটা লাথি বুকে লাগতেই আবারও দম আটকে গেল ওর। সাধ্য থাকল না যে সরবে বা উঠবে। জানালার দিকে হাত তুলে চেঁচাল নাদির: ল্যাণ্ড রোভারের পিছু নাও!

বিস্মিত চোখে বিধ্বস্ত এলএসভি দেখছে বেলা। বলুন তো, এটা কী হলো?

ঘাড় ফিরিয়ে ছুটন্ত হোভারক্রাফট দেখল লাবনী। মনে জেগে উঠেছে সাহস। রানা! বেঁচে আছে এখনও।

এদিকে তাক করা হয়নি যুবরের মেশিন গান। ওরা বুঝে গেল, নাদির মাকালানি চায় না ধ্বংস হোক ক্যানোপিক জার। এখনও সুযোগ আছে রানা বা ওদের বাঁচার।

কিন্তু আগে চাই রানাকে ছুটিয়ে নেয়া, ভাবছে লাবনী। বেলাকে বলল, ঘুরে হোভারক্রাফটের দিকে চলো।

অবাক হয়ে ওকে দেখল বেলা। হা হয়ে গেছে মুখ। বলেন কী! দেখেননি কী করেছে ওই ন্যাংটো গাড়ির? খুন হব তো!

আমাদের দিকে গুলি করবে না, বলল লাবনী। মনে মনে ভাবছে, আমার কথা ঠিক হলেই হয়! ফিরে চলো!

বাঁক নিল ল্যাণ্ড রোভার। খুব অখুশি বেলা। আপনার মনে আছে, আপনাকে খুব বুদ্ধিমতী ভাবতাম? আশা করি আমার ধারণা ভুল নয়!

কীসের পর কী করবে ভাবছে লাবনী। একবার দেখল গ্রেনেড, তারপর খাপে রাখা ছোরা। এবার হার্নেস থেকে কেস ছুটিয়ে নিল ও।

এবার কী করবেন? জানতে চাইল বেলা।

কেস খুলে মেমোরি ফোমে শুয়ে থাকা জার দেখল লাবনী। ঢাকনি খোলা বলে একটু উঠে এসেছে জার। আবারও আগের মত হয়ে গেছে নিচের ফোম। ছোরা দিয়ে ফোমের কোনা থেকে কেটে নিল চার ইঞ্চি চতুর্ভুজ এক অংশ, তারপর বলল লাবনী, এবার দেখা যাক।

যুবরের বিস্মিত পাইলট জানাল, আবারও আমাদের দিকে ফিরছে।

বলো কী! ব্রিজের জানালা দিয়ে তাকাল নাদির। সত্যিই হোভারক্রাফটের দিকে সরাসরি ছুটছে ল্যাণ্ড রোভার। হামলা করতে চায়? পাগল নাকি!

ওই জিপগাড়ি নিয়ে? হাসল জেনারেল আসির।

 হাতেমের কাছ থেকে গ্রেনেড পেয়েছে!

মাকালানির কথায় টিটকারির হাসি হাসল পাইলট। একটা গ্রেনেডে কিছুই হবে না। এই গাড়ি আর্মার্ড। বড়জোর ক্ষতি করবে রাবারের স্কার্টের। কিন্তু ওটা অনেকগুলো ভাগে ভাগ করা। একটা সেকশন চুপসে গেলেও ক্ষতি হবে না।

তা হলে ফিরছে কেন?

দরজায় কবাটে হেলান দিয়ে বলল লুকমান বাবাফেমি, হয়তো হুশ ফিরেছে। ভাবছে, আত্মসমর্পণ করলে বাঁচবে।

বেধড়ক মার খেয়ে কুঁকড়ে আছে রানা। হাতদুটো মুক্ত থাকলে তবুও, লড়ত। দুপাশে দুই গার্ড। নাদির বলে দিয়েছে: তেড়িবেড়ি করলে লাথি মেরে হাগিয়ে দিতে হবে। কঠোর চোখে রানাকে দেখছে নাদির। একে যা বুঝেছি, মনে হয় না এর প্রেমিকা হার মানবে। বদমাশটাকে টেনে তোলো।

শার্টের কলার চেপে ধরে রানাকে দাঁড় করাল ভগলার। প্রচণ্ড এক ধাক্কা মেরে ফেলল পেছনের বালকহেডের ওপর।

অগ্রসরমান জিপ দেখল খালিদ আসির। ইঞ্জিনে গুলি করে থামিয়ে দিতে পারি।

মাথা নাড়ল নাদির। তাতে হয়তো নষ্ট হবে জার। খুশি মনে যখন আসছে, দেখাই যাক না কী করে। অশুভ চোখে রানাকে দেখল। তারপর কাজ ফুরালে খুন করব ওদের।

ল্যাণ্ড রোভার থেকে কালো-ধূসর পাথরের চাপড়ার মত দেখাল হোভারক্রাফট। সমতল ডেক থেকে সাবমেরিনের কনিং টাওয়ারের মত উঠেছে সুপারস্ট্রাকচার। ক্রমেই আরও বড় হয়ে উঠছে বিশাল যান।

হায়, ঈশ্বর! কী করতে চান? অস্ত্রের নল দেখে গলা শুকিয়ে গেছে বেলার।

লাবনীর পিঠে ব্যাকপ্যাকের মত করে ওয়েবিঙে ঝুলছে কেস। কুঁজো হয়ে বসেছে প্যাসেঞ্জার সিটে। সরে যেতে বললেই তা-ই করবে। রেডি হও…

ওই হোভারক্রাফট কিন্তু বিশাল! আপত্তির সুরে বলল বেলা। চ্যাপ্টা করে দেবে।

সেটা যেন না হয়, তা দেখার দায়িত্ব তোমার।

ও। উঁচু দালানের মত আসছে যুবর। যে-কোনও সময়ে চেপে বসবে ল্যাণ্ড রোভারের ওপর। প্রপেলারের গর্জনে থরথর করে কাঁপছে বাতাস।

ছোরা বের করেছে লাবনী। সরাসরি ওদের দিকে ছুটে আসছে হোভারক্রাফট। চারপাশে তুমুল বালিঝড়। রেডি… ওয়ান… টু… থ্রি… এবার!

স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে হোভারক্রাফটের পাশে চলে গেল বেলা। বামেই ওই ছুটন্ত দানব।

যে-কোনও সময়ে গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, সেজন্যে অপেক্ষা করছে লাবনী।

হোভারক্রাফটের একেবারে সামনে এসেও ঝড়ের বেগে সরে গেল ল্যাণ্ড রোভার। নাদিরের মনে হলো, জেনেবুঝে আত্মহত্যা করতে গিয়েও পরে ভয় পেয়েছে মেয়েদুটো। বালিঝড়ে হারিয়ে গেছে তারা। ঘোরো! ধাওয়া করো! চিৎকার করল নাদির।

স্টারবোর্ড উইঙে ব্রিজের হ্যাচ খুলল খালিদ আসির। ইশারা করল এক সৈনিককে। একই ইশারা পেল পোর্ট সাইডের সৈনিক। যাতে ঘুরে এসে হামলা না করে দুই মেয়ে, তা দেখবে তারা। দেখছি না, নাদির! গেছে বালির তুফানের ভেতর! জানাল আসির।

খুঁজে বের করো! পাল্টা চেঁচাল নাদির।

স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাল পাইলট।

রাডার স্টার্নের তিন বিশাল প্রপেলার সরাতেই সাঁই করে ডানে গেল হোভারক্রাফট।

ভাঙা জানালা দিয়ে তুমুল বেগে ঢুকছে বালিকণা, পিনের মত বিঁধছে লাবনীর গোলাপী মোলায়েম তৃকে। তৈরি হয়ে বালিমেঘের ভেতর দূরে চেয়ে আছে ও।

ডানে কালো বড় কিছু। ওটা হোভারক্রাফট। ঘুরেই তেড়ে এল ল্যাণ্ড রোভারের দিকে। তুমিও চক্কর কাটো! নির্দেশ দিল লাবনী। চলে যাবে ওটার একেবারে পাশে!

বালিঝড়ে প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে বেলা। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে গাড়ি আবারও নিল যুবরের দিকে। দানবীয় হোভারক্রাফটের চেয়ে অনেক কম জায়গায় ঘুরতে পারছে। তীরের মত ছুটে গিয়ে পৌঁছে গেল ঘুরন্ত যানের পাশে।

প্রচণ্ড আওয়াজ তুলছে হোভারক্রাফটের মস্তবড় ফ্যান। তাড়া খেয়ে নানাদিকে ছুটছে বালিকণা। শোঁ-শোঁ আওয়াজ তালা লাগিয়ে দিচ্ছে লাবনী ও বেলার কানে। বাড়ছে খুন হওয়ার ঝুঁকি। কিন্তু যেতে হবে হোভারক্রাফটের আরও কাছে। একটু দূরেই ওটার স্কার্ট- রিইনফোর্সড় রাবারের কালো দেয়াল। গাড়ির দরজা খুলতেই তুমুল বাতাসের মুখে পড়ল লাবনী। প্রায় বেরিয়ে গেল ল্যাণ্ড রোভার ছেড়ে। হাতে উদ্যত ছোরা।

বাল্কহেডে চেপে ধরা হয়েছে রানার মুখ। পেছনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে রিভলভারের নল ঠেসে ধরেছে ভগলার। যিপ-টাইখোলা সম্ভব হলেও কিছুই করতে পারবে না রানা। এত ব্যথা সহ্য করেও মৃদু হাসল নাদিরের হতাশাভরা কথা শুনে: গেল কই দুই শালী! দৌড়ে গিয়ে একবার ব্রিজের এ জানালা, আবার ও জানালায় উঁকি দিচ্ছে নতুন ধর্মগুরু।

বালিঝড়ের মধ্যে হোভারক্রাফটের পাশে ছুটছে ল্যাণ্ড রোভার। প্রকাণ্ড উভচর যানের তলা থেকে ছিটকে আসছে প্রচণ্ড বেগের হাওয়া, সেইসঙ্গে বালি। পাঁচ ফুট দূরে কালো রাবারের স্কার্ট দেখল লাবনী।

ওটা চলে এল তিন ফুট দূরে।

তারপর দুই ফুট।

একরার সামনের দিক দেখে নিয়ে ডিফেণ্ডার থেকে লাফ দিল লাবনী, সরাসরি বাড়ি খেল স্কার্টের গায়ে। পুরু রাবারের গভীরে গেঁথে দিয়েছে ছোরা।

ওই গর্ত থেকে এল হাওয়া বেরোবার তীক্ষ্ণ হুইস। দুই হাতে ছোরার বাঁট ধরে ঝুলছে লাবনী। এরই ভেতর বাহুতে শুরু হয়েছে টনটনে ব্যথা। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পেছনে। ওর পরিকল্পনা শুনে আপত্তি তুললেও বাধা দেয়নি বেলা। আবার ঢুকে পড়েছে বালিঝড়ের মাঝে। প্রথম সুযোগে হোভারক্রাফট থেকে সরে যাবে দূরে।

লাবনীর পায়ের একটু নিচে সই-সাঁই করে পিছিয়ে যাচ্ছে হলদে মরুভূমি। ঘুরতে গিয়েও ঘণ্টায় অন্তত তিরিশ মাইল বেগে চলছে হোভারক্রাফট। এখন ছোরা খুলে এলে ছিটকে নিচে পড়বে লাবনী। রাবারের দেয়ালে পা বাধিয়ে উঠে যেতে চাইল। ওর ওজন রাখতে গিয়ে পায়ের নিচে কুঁকড়ে যাচ্ছে রাবার। মাথার মাত্র দুফুট ওপরেই খোল। হোভারক্রাফটের ইস্পাতের খোলের মাঝামাঝি জায়গায় রাবার থেকে ঝুলছে ও। তিন ডেক ওপরে ব্রিজ। ওর কাছ থেকে ছয় ফুট দূরে ধাতব রাং ল্যাডার উঠেছে:সংকীর্ণ এক ডেকে।

আরও শক্তভাবে বামহাতে ছোরার বাঁট ধরল লাবনী। ডানহাত তুলল ওপরে। ধরতে হবে খোলের নিচের অংশ। কিন্তু ছয় ইঞ্চি নিচে রয়ে গেল আঙুলের ডগা। দুহাতে ছোরার বাট শক্তভাবে ধরল লাবনী। রাবারের দেয়ালে পায়ের চাপ বাড়িয়ে পরক্ষণে উঠতে চাইল বাহুর জোরে। তাতে নড়ে গেল ছোরার ফলা। কাটা পড়ছে পুরু রাবারের স্কার্ট।

সর্বনাশ! বিড়বিড় করল লাবনী। ভয়ে ধড়ফড় করছে বুক। গর্ত থেকে বেরোচ্ছে আগের চেয়ে বেশি বাতাস। ওই গর্ত আরও বড় হলে খসে পড়বে ছোরা।

ফলাফল: ওর নিশ্চিত পতন!

সাহস করে আবারও খোলের দিকে হাত বাড়াল লাবনী, কিন্তু দুইঞ্চি দূরে রয়ে গেল মধ্যমার ডগা।

ওই যে! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল পাইলট। আঙুল তাক করেছে বালিঝড়ের দিকে। ল্যাণ্ড রোভার! ক্রমেই দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে জিপগাড়ি!

এবার দেখতে পেয়েছে নাদির মাকালানি। বাঘের মত গর্জে উঠল, পিছু নাও!

গতিপথ পাল্টে ল্যাণ্ড রোভারের দিকে ছুটল যুবর। নড়েচড়ে বসেছে পাইলট। এবার বাগে পাবে শিকার।

হোভারক্রাফট বাঁক নিচ্ছে বলে তিরতির করে কাঁপছে ওটার স্কার্ট। আবারও ঝাঁকি খেল ছোরা। গর্তের নিচে তৈরি করছে। চেরা একটা ফাটল। লাবনী টের পেল, খুলে আসছে ছোরার ফলা।

বাঁটে দুহাতের চাপ তৈরি করে নিজেকে টেনে তুলতে চাইল লাবনী। পরক্ষণে ডানহাত ঝটকা দিয়ে বাড়িয়ে দিল ওপরে। ডেকের ধাতব স্পর্শ পেল ওর আঙুল। প্রাণপণে খামচে ধরল ইস্পাতের কিনারা। দেরি না করে ছেড়ে দিল ছোরার বাট। বামহাত বাড়িয়ে দিল ওপরে। জোর বাতাসের তোড়ে গর্ত থেকে মরুভূমিতে পড়ে গেল ছোরা। দুহাতে ডেকের কিনারা ধরে একটু দূরের মইয়ের দিকে দুলতে দুলতে চলল লাবনী। ভাবছে, কে বলেছে রানার সঙ্গে মিশে কিছুই শিখিনি!

কয়েক সেকেণ্ড পর ওর হাত পড়ল মইয়ের সবচেয়ে নিচের রাং-এর ওপর।

দপ-দপ্ করা লাল এক ওয়ার্নিং লাইট জ্বলছে। ওটা দেখে সতর্ক হলো কো-পাইলট। স্যর! লিক হয়েছে স্কার্টে!

কোথায়? জানতে চাইল পাইলট।

স্টারবোর্ড সাইড, স্যর। সেন্টার সেকশন।

উইং ব্রিজের জানালা দিয়ে নিচে তাকাল খালিদ আসির। ওই যে একপাশের ডেকের মই বেয়ে উঠছে সুন্দরী লাবনী আলম! ওই মেয়ে উঠে এসেছে! পিস্তল বের করল সে।

একদৌড়ে তার পাশে পৌঁছুল নাদির। গুলি কোরো না! অবাক চোখে তাকে দেখল আসির। ওর সঙ্গে ক্যানোপিক জারের কেস! ওই মেয়ে পড়লে ভাঙবে জার! তোমার ক্রুদের পাঠাও ওকে ধরে আনতে!

মইয়ের শেষ ধাপ পেরিয়ে নিচের ডেকের কোণে হারিয়ে গেল লাবনী। কাকে যেন অভিশাপ দিল খালিদ আসির, তারপর সরে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে বলল, ইট্রডার! ইনট্রডার! ক্যাচ দ্য গার্ল, অ্যাণ্ড ব্রিং হার টু মি!

বিস্ময় নিয়ে রানার দিকে ঘুরে তাকাল নাদির মাকালানি। ওই মেয়ে সত্যিই ভাবছে, তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে?

পারলেও পারতে পারে, তোমার চেয়ে মাথায় বুদ্ধি ওর বেশি, জবাবে বলল রানা।

না, অত বুদ্ধি নেই, ঘোঁৎ করে উঠল ভগলার। ওর বুদ্ধি থাকলে জীবনেও আসত না! জানেও না, প্রাণ নিয়ে নামতে পারবে না এখান থেকে।

অন্তত তোমার চেয়ে বুদ্ধি বেশি, তা যে কেউ বুঝবে, জানাল রানা। তাতে অর্জন করল কিডনির ওপর ভগলারের মাঝারি এক ঘুষি।

ব্যথা পাত্তা দিল না রানা। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।

 লাবনীর সঙ্গে অস্ত্র বলতে কিছুই নেই।

শত্রুরা সংখ্যায় অনেক।

এতবড় ঝুঁকি নিয়ে হয়তো মস্তবড় ভুলই করেছে লাবনী।

.

সাইড ডেকে থেমে কোথায় আছে বুঝতে চাইছে লাবনী। এই ক্রাফটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গেছে সরু ওয়াকওয়ে। মাঝে ভেতরে যাওয়ার মত কয়েকটা হ্যাচ। ডানদিকে কাছেরটা। আরেকটা মই উঠেছে যুবরের প্রকাণ্ড মেইন ডেকে। কিন্তু ওটা ফাঁকা ধাতব মাঠের মত। আকারে ফুটবল মাঠের অর্ধেক। রানার সঙ্গে মিশে অন্তত শিখেছে, ওখানে কোনও কাভার পাবে না। এখন উচিত কারও চোখে না পড়ে লুকিয়ে থাকা। কাজেই…।

স্টার্নে খুলে গেল একটা দরজা, ইঞ্জিন রুম থেকে বেরিয়ে লাবনীকে ধরতে তেড়ে এল দুই লোক।

হয়েছে আমার লুকিয়ে পড়া, বিড়বিড় করে বলেই কাছের হ্যাচ খুলে ঢুকে পড়ল লাবনী। দড়াম করে বন্ধ করল হ্যাচ। আছে খুব সরু এক ভীষণ আওয়াজ ভরা হলওয়েতে। হ্যাচের ভেতরে লকিং মেকানিযম আছে, রঙ মাখা ধাতব দেহে স্টেনসিল করা সাইক্রিলিক ইন্সট্রাকশন। একবার আরবিতে, আরেকবার ইংরেজিতে: এনবিসি সিল বিলো।

লাবনী জানে, এ লেখার অর্থ: নিউক্লিয়ার, বায়োলজিকাল, কেমিকেল দূষণ থেকে বাঁচা যারে এসব সিল করা ধাতব কক্ষে। এক কথায় ম্যাস ডেস্ট্রাকশন ওয়েপন্স ব্যবহার হলেও কিছুই হবে না ভেতরে রয়ে যাওয়া মানুষের।

লিভার টেনে দিল লাবনী। ঘটাং আওয়াজে আটকে গেল ভারী বোল্ট। নিচেই লাল রঙের অপেক্ষাকৃত ছোট এক হ্যাণ্ডেল, টান দিতেই লক হলো ওটা।

বজ্রপাতের মত আওয়াজ ওকে জানিয়ে দিল, পেছনের বাল্কহেডেই রয়েছে হোভারক্রাফটের লিফট ফ্যান। প্যাসেজের শেষমাথায় পৌঁছে গেল ও। সামনের বাহেডে এক দরজার ওদিকে সারি সারি বাঙ্ক বেড়। ক্রু কোয়াটার। আর যাই হোক, ঘুমাবার জন্যে ভাল জায়গা নয়, ভাবল লাবনী। তাতে ওর কিছু যায় আসে না। ভাল দিক হচ্ছে, ওদিকে আছে সাইড ডেকে যাওয়ার একটা হ্যাচ।

পেছনে দমাদম ঘুষি পড়ছে হ্যাচের ওপর। ওই পর্যন্ত পৌঁছে গেছে ক্রুরা। দরজা খুলতে চাইলেও কাজটা অসম্ভব। অবশ্য, চট করেই বুঝবে, হ্যাচ লক করা। তখনই ঢুকবে পরের হ্যাচ ধরে।

বাঙ্ক ভরা ঘর পেরিয়ে ওদিকের হ্যাচ বন্ধ করল লাবনী। এক সেকেণ্ড পর বাইরে থেকে ধুম-ধাম শুরু করল কে যেন!

পাশের হ্যাচের ওদিকেই ইঞ্জিন রুম। লক করা নয়। এবার যা করার দ্রুত করতে হবে। পিঠ থেকে ওয়েবিং খুলে একটা বেডের ওপর কেস রাখল লাবনী। খুলে ফেলল ডালা।

ইন্টারকমের মাধ্যমে রিপোর্ট শুনছে খালিদ আসির। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, নাদির, ওই মেয়ে স্টারবোর্ড কেবিনের ভেতরে। লক করে দিয়েছে হ্যাচ। ঢুকতে পারবে না কেউ। তবে ওই মেয়ে নিজেও কোনও দিকে যেতে পারবে না।

লুকমান বাবাফেমির দিকে তাকাল নাদির মাকালানি। বাবাফেমি, ওই কেস আমরা পেলেই ওটার ভেতরের জার পরীক্ষা করবেন।

তাতে একটু বাড়তি জায়গা লাগবে, ঘরে ঢুকল ভ্রষ্ট আর্কিওলজিস্ট।

দুই পাইলটের পেছনে রয়েছে ছোট ধাতব প্লটিং টেবিল, হাতের ঝাপটায় ওটার ওপর থেকে ম্যাপ ফেলল নাদির মাকালানি। ঘুরে তাকাল কিলিয়ান ভগলারের দিকে। যাও, ধরে আনো হারামজাদী বেটিকে! এমন কিছু করতে যেয়ো না, যে কারণে ক্ষতি হবে জারের। গুলি করা চলবে না।

এ কথা শুনে অখুশি হলো ভগলার, তবে মাথা দোলাল। বন্দি রানাকে পাহারা দেয়ার জন্যে হাতের ইশারা করল এক সৈনিককে। নিজে বেরিয়ে গেল ব্রিজ ছেড়ে।

পিএ সিস্টেমের হ্যাণ্ডসেট নিল নাদির, বাটন টিপে চিৎকার করে বলল, ডক্টর আলম!

পিঠে ক্যানোপিক জারের কেস ঝুলিয়ে নিয়েছে লাবনী, সাবধানে হ্যাচ খুলে উঁকি দিল হোন্ডে। সামনেই কাদামাটি মাখা দুটো ক্যাটারপিলার এক্সকেভেটরের মাঝে তৃতীয় ডিউন বাগি। ওটা সিভিলিয়ানদের জন্যে তৈরি, সঙ্গে অস্ত্র নেই।

ঘর ছেড়ে বেরোবে লাবনী, এমনসময় গমগমে কণ্ঠে লাউড স্পিকারে এল নাদিরের কণ্ঠ: ডক্টর আলম! ভাল করেই জানি, কথা শুনতে পাচ্ছেন। আত্মসমর্পণ করে আমাদের হাতে তুলে দিন ওই জার। তা যদি না করেন, খুন হবে মাসুদ রানা!

খচ-মচ আওয়াজ হলো। কয়েক সেকেণ্ড পর এল রানার কণ্ঠ: ভুলেও নাদিরের কথা শুনো না, লাবনী!

মৃদু হেসে ফেলল লাবনী।

বেঁচে আছে রানা!

 ওর এত বড় ঝুঁকি নেয়া বিফল হয়নি।

পাহারা দিয়ে রানাকে আটকে রেখে ওর মাধ্যমে এখন জার ফেরত চাইছে নাদির। ভালই!

অবশ্য নাদির মাকালানি কতটা রেগে যাবে, তার ওপর নির্ভর করছে রানা আর ওর জীবন রক্ষা পাবে কি না। জার পাওয়ার আগেই রানাকে মেরে ফেললে…

গলা ভীষণ শুকিয়ে গেল লাবনীর। ভালবেসেছে জীবনে মাত্র একবার। ওই লোক স্বপ্নের নায়ক মাসুদ রানা। তাকে হারালে বাঁচার আর কোনও উদ্দেশ্য থাকবে না ওর।

আমার কথা বাদ দাও, লাবনী, চুরমার করো নরকের জার। তারপর দেরি না করে নেমে পড়বে… মাঝপথে থেমে গেল রানার বক্তব্য। শোনা গেল ঘুপ! করে একটা আওয়াজ।

রাগে-দুঃখে কেঁপে উঠল লাবনীর বুক।

রানা অসহায়!

ওকে বন্দি করে পেটাচ্ছে অমানুষের দল!

ওই জার আনুন, ডক্টর আলম, নইলে খুন হবে রানা! ক্লিক আওয়াজে থেমে গেল পিএ সিস্টেম।

রানার ক্ষতি হবে ভাবতে গিয়ে হাত-পা কাঁপছে লাবনীর। পা রাখল হোল্ডে। কফুট এগিয়ে থামল। বুঝতে পারছে না এখন কী করবে। একইসময়ে একটা হ্যাচ খুলে ঢুকে পড়ল হোভারক্রাফটের কজন ক্রু। হাতে অস্ত্র। তাদের নেতা খপ করে ধরে পিঠের ওপরে নিল লাবনীর হাত।

গুহার মত হোন্ডের মই বেয়ে নামছে কেউ। ওই কাউবয় বুটের আওয়াজ চেনে লাবনী।

কিলিয়ান ভগলার!

মই বেয়ে নেমে এল সে, ঠোঁটে নিষ্ঠুর হাসি। লাবনীকে বলল, আগেই ধরা পড়েছ। নইলে বুঝিয়ে দিতাম কত গমে কত রুটি! রিভলভার তাক করল সে লাবনীর বুকে। এবার চলো, উঠবে ওপরে।

সৈনিকরা প্রায় ঘিরে ফেলেছে লাবনীকে।

ওকে নিয়ে যাওয়া হলো মইয়ের সামনে।

তবে আগে উঠে গেল ভগলার, তারপর ওপর থেকে ইশারা করল উঠতে।

লাবনী পরের ডেকে উঠতেই একসারি রাং মই দেখাল ভলার। দোতলা পেরিয়ে মেইন ডেকে উঠল ওরা।

জানালাহীন এক প্যাসেজ পার করে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো ব্রিজে।

অপেক্ষায় ছিল নাদির মাকালানি। ঘরে আছে রানাও। ওকে পেছনের দেয়ালে পোর্ট উইং ব্রিজের হ্যাচের কাছে আটকে রেখেছে এক সৈনিক। হাল ছেড়ো না, বলল রানা। তবে তখনই দেখল লাবনীর সঙ্গে ক্যানোপিক জারের কেস। গম্ভীর হয়ে গেল রানা। হয়তো ভাল হতো ওই জার আগেই ভেঙে ফেললে।

চেয়েছি, তুমি যেন সুস্থ থা… চুপ হয়ে গেল লাবনী।

লোলুপ দৃষ্টিতে কেসটা দেখছে নাদির মাকালানি। ওটা সাবধানে নামিয়ে রাখুন, ডক্টর আলম। প্লটিং টেবিল দেখাল সে। খুব সাবধানে। ডক্টর বাবাফেমি!

বুক ফুলিয়ে সামনে বাড়ল লুকমান বাবাফেমি। বোকা লোক, নিজ গুরুত্ব নিজেই বাড়িয়ে নিয়েছে। দুই পাইলটের মাঝ দিয়ে সংকীর্ণ পথে এগোল সে।

এদিকে কাঁধের স্ট্র্যাপ থেকে কেস খুলেছে লাবনী।

ওটা হাতে পেয়ে টেবিলে রাখল বাবাফেমি। মাথা দোলাল। দেখে তো মনে হচ্ছে না ক্ষতি হয়েছে।

পিছিয়ে আনো ওই মেয়েকে, নির্দেশ দিল নাদির। স্টারবোর্ড বালকহেডের সামনে লাবনীকে নিল ভগলার।

লাবনী দেখল, ওয়েপন্স রুমে দাঁড়িয়ে আছে ম্যান মেটয। তাকে কড়া চোখে দেখল ও। লজ্জায় ফ্যাকাসে মুখ অন্যদিকে সরিয়ে নিল মিশরীয় আর্কিওলজিস্ট।

এবার খুলুন ওই কেস! নির্দেশ দিল নাদির।

 রানা, তৈরি থেকো! বলল লাবনী।

সতর্কতার সঙ্গে কেসের ল্যাচ খুলল লুকমান বাবাফেমি। তার দিকে ঝুঁকে এল অন্যরা। ব্রিজের আরেক প্রান্ত থেকে রানার দিকে তাকাল লাবনী। আশা করছে চোখে চোখ পড়বে দুজনের। সেক্ষেত্রে নীরবে ও বুঝিয়ে দেবে কী হয়েছে। কিন্তু তা হওয়ার নয়, মাঝে আছে এক সৈনিক।

কেসের ঢাকনি নাটকীয় ভঙ্গিতে খুলল বাবাফেমি। টুং আওয়াজে কেস থেকে ছিটকে এল বাঁকা, ধাতব এক টুকরো। টেবিলে পড়ে বার কয়েক ঘুরল ওটা।

ওটা কী, বুঝতে পেরে হতবাক হয়ে গেল সবাই।

হ্যাণ্ড গ্রেনেডের সুন!

এতক্ষণ ফোম ও কেসের ডালার মাঝের চাপে ঠিক জায়গায় বসে ছিল ওটা। বন্ধ করার আগে গ্রেনেড থেকে পিন সরিয়ে তারপর কেস আটকে নিয়েছে লাবনী।

কিন্তু এখন…

মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড পর ফাটবে গ্রেনেড!

চার সেকেণ্ড!

ব্রিজের ভেতর হঠাৎ করেই যেন শুরু হলো হুলুস্থুল। কেসের সবচেয়ে কাছে ছিল নাদির মাকালানি। সে-ই আগে চরকির মত ঘুরে একদৌড়ে সামনের দরজা পেরিয়ে পালিয়ে গেল। ধাতব, ভারী টেবিলের নিচে লুকিয়ে পড়ল এতবড় জেনারেল খালিদ আসির। দুহাতে চেপে ধরেছে দুকান। সিঁড়ির দিকে ছুট দিল এক সৈনিক। রানাকে পাহারা দেয়া ফেলে দূরের মেঝেতে ঝাঁপিয়ে পড়ল দ্বিতীয় সৈনিক।

পেরোল তিন সেকেণ্ড…

ঘরের দুপ্রান্তে চোখে চোখে কথা হলো লাবনী ও রানার।

পরক্ষণে যে যার মত ঝেড়ে দৌড় দিল ওরা।

সামনেই উইং ব্রিজের দুই হ্যাচওয়ে।

গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে বাকি মাত্র দুই সেকেণ্ড!

এতক্ষণ ক্যানোপিক জার দেখবে বলে হাঁ করে চেয়ে ছিল লুকমান বাবাফেমি। এবার দেখল, ওই জিনিসের বদলে কেসের ভেতরে ভোতা সবুজ রঙের কী যেন! আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল তার। ও রে, মা! বলেই ঘুরে পালাতে গেল সে। কিন্তু লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে পথ আটকে ভাগছে দুই পাইলট!

বাকি রইল মাত্র এক সেকেণ্ড!

উইং ব্রিজের রেলিং টপকে যেতে গিয়ে রানা দেখল, নিচেই লিফট ফ্যানের বৃত্তাকার ভেন্ট। বনবন করে ঘুরছে ফ্যান। ওখানে পড়লে কি হবে! ওদিকে ঝাঁপ না দিয়ে এক লাফে পেছন ব্যারিয়ার সেকশনে ডাইভ দিল রানা। হাতদুটো প্ল্যাস্টিকের টাই দিয়ে বাঁধা। পতন এল হাড় গুঁড়ো হওয়ার মত ব্যথা নিয়ে।

ব্রিজের ওপাশের রেলিং টপকে ঝাঁপ দিয়েছে লাবনী।

তখনই বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড!

.

২৮.

 রিইনফোর্সড কেসে রাখা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতেই ছাত ও কোমর উচ্চতায় ছিটকাল ক্ষুরের মত ধারালো শাপনেল। মুহূর্তে খুন হলো দুই পাইলট। শূন্যে তিন ডিগবাজি দিয়ে পেছন জানালা ভেঙে নিচের মেইন ডেকে পড়ল লুকমান বাবাফেমির দুভঁজ হওয়া লাশ।

সিঁড়ির দিকে ছুটন্ত সৈনিক পৌঁছে গিয়েছিল দরজার কাছে, ওখানেই ঝাঁঝরা হয়েছে পিঠ ও ফুসফুস। লাশ পড়ে আছে রক্তের পুকুরের ভেতর। গ্রেনেড বিস্ফোরণের সরাসরি হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছে ঘরের অন্যরা। তবে আপাতত ওই বিকট আওয়াজের কারণে প্রায় কালা হয়েছে সবাই।

কবজা থেকে ছিটকে গেছে পোর্ট উইং হ্যাচ। কয়েক পল্টি খেয়ে গিয়ে পড়েছে নিচে মস্তবড় লিফট ফ্যানের ভেতর। তাতে হ্যাচ চিবিয়ে নিজেই চুরমার হয়েছে জেট ইঞ্জিনের পাখার মত ব্লেড। গড়াতে শুরু করেও থেমে মেঝেতে মুখ চেপে রেখেছে রানা। ওর ওপর দিয়ে সুপারস্ট্রাকচারে লাগল ভাঙাচোরা ধাতব সব টুকরো। ভীষণ এক ঘুরপাকে পড়ে খাড়া শাফটে ছিটকে ঢুকল,হ্যাচ। দুই সেকেণ্ড পর থরথর করে ডেক কাঁপিয়ে দিয়ে বিকট এক আওয়াজ হলো। আটকে গেছে ফ্যানের ড্রাইভশা। প্রতি মিনিটে জটিল মেশিনের চলার কথা চল্লিশ হাজার বার, কিন্তু থামতে হয়েছে মুহূর্তে। ফলে ছিঁড়েখুড়ে যাচ্ছে ওটা।

শুধু ফ্যানেরই ক্ষতি হয়নি, নষ্ট হয়েছে ড্রাইভশাফটের সঙ্গে সংযুক্ত পোর্ট সাইড ইঞ্জিন রুমের এক গ্যাস টারবাইন পাওয়ার প্লান্ট। এ কারণে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকুনি খেয়েছে গোটা হোভারক্রাফট। উপড়ে গিয়ে নানাদিকে ছিটকে পড়েছে ইঞ্জিন রুমের যন্ত্রপাতি। টারবাইন বিস্ফোরিত হতেই হ্যাচ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে কমলা আগুনের গোলা।

ভেসে থাকার চার ভাগের এক ভাগ শক্তি হারিয়ে বসেছে যুবর। পোর্টসাইডে ঝুঁকে পড়েছে না। তাই বদলে গেছে গতিপথ। বেঁচে নেই পাইলট। গ্রেনেড বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কন্ট্রোল। বিশাল যন্ত্রটা চালাবার কেউ নেই।

ওপর থেকে আছড়ে পড়ে সারাশরীরে ব্যথা রানার। দুহাতে ভর করে উঠে বসল। এখন কারও বন্দি নয় ও। অবশ্য, এখনও পিঠের কাছে হাতে বাঁধা যিপ-টাই। বুঝতে পারছে, প্রথম কাজ হওয়া উচিত হাতদুটো খুলে নেয়া।

একটু দূরেই দেখল চোখা এক ধাতুর টুকরো। এক প্রান্তে আগুনে জ্বলছে ইনসুলেশন রাবার। সামনে বেড়ে বামহাতে ওটা তুলে নিল রানা। টের পেল, পুড়তে শুরু করেছে ত্বক। স্টিলের টুকরো এখনও আগুনের মত গরম। ভুরু কুঁচকে প্ল্যাস্টিকের টাই-এর ওপর জ্বলন্ত রাবার ঠেসে ধরল রানা।

ওয়েপন্স রুমে বস এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাদির মাকালানির ওপর থেকে সরে গেল কিলিয়ান ভগলার। ঘরের কোণে দুহাতে কান চেপে বসে আছে ম্যান মেটয। কন্সেলের ওপর মুখ থুবড়ে আছে ওয়েপন্স অফিসারের লাশ। উড়ন্ত সব জঞ্জাল ছিটে যাওয়ার সময় গভীর ক্ষত তৈরি করেছে তার ঘাড়ে।

মেঝেতে খুঁজে নিজের রিভলভার পেয়ে একহাতে ওটা রেখে অন্য হাতে নাদির মাকালানিকে তুলল ভগলার। আপনি ঠিক আছেন তো?

বোধহয় ঠিকই আছি, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল নাদির। পরক্ষণে রাগে কুঁকড়ে গেল পোড়া মুখ। আমাকে খুন করতে চেয়েছিল ওই ডাইনী! যাও! শেষ করো ওই হারামজাদীকে!

জারের কী হবে? ওর কাছে রয়ে গেছে ওই…

 চিৎকার করে উঠল নাদির, আগে খুন করো শালীকে!

ভুরু কুঁচকে ব্রিজে গিয়ে ঢুকল ভগলার।

ঘরে এখনও ঘন ধোয়া। আগুনে জ্বলছে কটা কোেল। কাশতে শুরু করে টেবিলের তলা থেকে বেরোল জেনারেল খালিদ আসির। বাঁকা হয়ে গেলেও পুরু স্টিলের তৈরি টেবিল ঠেকিয়ে দিয়েছে বিস্ফোরণ। পোর্ট হ্যাচের কাছে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে এক সৈনিক। এগিয়ে তার ক্ষত পরীক্ষা করল আসির। কিন্তু তাকে আঙুল তুলে ডেক দেখাল ভগলার। মাসুদ রানার পেছনে যান। আমি ধরে আনছি ওই মেয়েলোকটাকে।

কিন্তু এই আহত সৈনিকের…।

দরজার কাছ থেকে বলল নাদির, খালিদ, দ্বিগুণ টাকা পাবে। ওই দুই ইবলিশকে খুন করো!

দ্বিধা নিয়ে উঠে দাঁড়াল আসির। একবার বন্ধুকে দেখে নিয়ে পা বাড়াল হ্যাচের দিকে। স্টারবোর্ড উইং ব্রিজের দিকে ছুটে গেল ভগলার। রেলিঙে পৌঁছে দেখল নিচে।

ওপর থেকে লিফট ফ্যানের পাশে পড়েছে লাবনী। রিভলভার তুলে তাক করার আগেই ভগলারকে দেখল, তাই চাইল দৌড়ে পালিয়ে যেতে। পেছনে বৃত্তাকার দুফুট উঁচু এয়ার ইনটেকে লাগল ম্যাগনাম গুলি।

নিচের ধাতব ডেকে কাভার বলতে কিছুই নেই। অবশ্য, বো-র কাছে গ্যাটলিং গানের টারেট। কিন্তু ওই পর্যন্ত যাওয়ার আগেই পিঠে গুলি খেয়ে মরবে লাবনী।

এখন বাঁচার একমাত্র উপায়…

ডেকের রেলিঙের দিকে ঝাঁপ দিল লাবনী। একইসময়ে গুলি করল, ভগলার। কিন্তু রেলিঙের নিচে সেঁধিয়ে গেছে। লাবনী। ধাতব মেঝেতে লেগে রঙ চল্টে আরেক দিকে গেল বুলেট। শুকনো রঙ লেগেছে লাবনীর মুখে। আরেক গড়ান দিয়ে পড়ল একটু নিচের সরু ওয়াকওয়েতে। কানের কাছ দিয়ে গেল একটা বুলেট। শরীর সরিয়ে ওয়াকওয়ের আড়াল নিল লাবনী।

এখন আর ওকে দেখতে পাচ্ছে না ভগলার। যাশশালা! বলে নিচে যাওয়ার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল সে।

ওদিকে পোর্ট উইঙে তাকাল খালিদ আসির। দানবের ফোকলা মুখের মত হাঁ হয়েছে লিফট ফ্যানের ভেণ্ট। কাছেই মাসুদ রানা। অস্ত্র বের করতে হোলস্টারে ছোবল দিল আসির।

ত্বক পুড়ে যাচ্ছে রানার। ধাতুর জ্বলন্ত টুকরো ঠেসে ধরেছে যিপ-টাইয়ের ওপর। টের পাচ্ছে, আগুনের তাপে গলছে প্ল্যাস্টিক। টান পড়তেই লম্বা হয়ে পরক্ষণে ছিঁড়ে গেল ওটা। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। একইসময়ে চোখের কোণে দেখল, ওপরের ব্যালকনিতে কে যেন! ওর দিকে তাক করছে আগ্নেয়াস্ত্র!

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ও ট্রেনিং একইসঙ্গে কাজ করল রানার মগজে। তপ্ত স্টিলের টুকরো ছুঁড়ে দিল ওপরে। পরক্ষণে চিতার বেগে দৌড় দিল স্টার্নের দিকে। বিস্মিত এক আর্তচিৎকার শুনে বুঝল, ভ্রষ্ট হয়নি লক্ষ্যভেদ!

খালিদ আসির সামলে নেয়ার আগেই সুপারস্ট্রাকচারের কোনা ঘুরে সরে যেতে পারলেই বাঁচবে ও!

কিন্তু বুম করে উঠল পিস্তল!

সামনের ডেকে লেগে পিছলে গেল বুলেট। ওদিকে যাওয়ার উপায় নেই, বুঝে গেল রানা। বাধ্য হয়ে পেছনের লিফট ফ্যানের পাশে ঝাঁপ দিল ও। উঠে বসেই হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল ইনটেকের ওদিকে। কিন্তু ওটা ওর জন্যে ভাল কাভার নয়। বড় বেশি নিচু।

অর্ধেক বেরিয়ে আছে রানার দেহ।

 অস্ত্র তাক করে ট্রিগার টিপে দিল আসির।

রানার দিকে ছুটল বুলেট, পরক্ষণে হ্যাচকা টান খেয়ে নেমে গেল নিচে। খপ করে ওটাকে গিলে ফেলল বিশাল ফ্যান। মাথা উঁচু করে রানা বুঝল, প্রচণ্ড বেগে বাতাস নিচ্ছে শাট। খালিদ আসির আর ওর মাঝে ওই ঘূর্ণিপাক রয়ে গেলে কোনওভাবেই ওকে গুলি করতে পারবে না লোকটা।

একই সময়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে জেনারেল আসির, লাফিয়ে নেমে এল নিচের ডেকে। ঘূর্ণিপাকের সুযোগ নিয়ে সুপারস্ট্রাকচারের আড়ালে যাবে ভেবেছিল রানা, কিন্তু পিস্তল উঁচু করে মাঝের জায়গাটা কাভার করল লোকটা।

রানা বুঝল, মরণ ফাঁদে পড়েছে এবার।

ওয়াকওয়েতে পড়ে ব্যথায় গুঙিয়ে উঠেছে লাবনী। তবুও ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। একটু দূরেই এক হ্যাচ। প্রথমে ওটা দিয়েই হোভারক্রাফটে ঢুকেছিল। আবারও হ্যাচ খুলে দিয়েছে কেউ। অলসভাবে ঝুলছে ভারী দরজা।

 চারপাশ দেখে নিয়ে লাবনী বুঝল, এ প্যাসেজে কেউ নেই। হ্যাচ গলে ঢুকে পড়ল ও। ক্রু কোয়ার্টার, এখনও ফাঁকা। যে বেডের নিচে ক্যানোপিক জার লুকিয়ে রেখেছিল, ওখানে চলে গেল লাবনী। রানা মুক্ত, কাজেই ওর হাতে এখন আছে জেতার জন্যে প্রয়োজনীয় বেশকিছু তাস। এবার যুবর থেকে নেমেই নষ্ট করবে ওই জার। নাদির মাকালানির উপায় থাকবে না জেনেটিক্যালি ইস্ট তৈরি করে দুনিয়ার মানুষের সর্বনাশ করার।

এখন প্রথম কাজ হচ্ছে রানাকে খুঁজে বের করা।

ক্যানিয়নের দিকে যেতে যেতে ঘুরে তাকাল বেলা। অবাক হয়ে দেখল, এখন আর ওর দিকে আসছে না কালান্তক হোভারক্রাফট! ওটা চলেছে তেরচাভাবে। মারাত্মক কোনও ক্ষতির কারণে ভকভক করে উঠছে ঘন কালো ধোঁয়া। স্টার্নে লকলক করছে লালচে আগুন।

নিশ্চয়ই ওটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন মাসুদ ভাই আর লাবনী আপু মিলে, ভাবল বেলা।

কিন্তু ছুটন্ত ওই দানব থেকে তারা নেমে গেছেন, এমন কোনও লক্ষণ নেই মরুভূমিতে। বেলা বুঝল, যে পথে ছুটছে হোভারক্রাফট, ক্যানিয়নের দিকে যাবে না ওটা। সোজা ছুটবে সমতল মরুভূমির বুক চিরে।

আর মরুভূমির ওই সমতল জমি ফুরিয়ে গেলে পড়বে উঁচু শৈলশিরা থেকে অনেক নিচে!

সেরেছে! বিড়বিড় করল বেলা।

ব্রিজে ঢুকে হতবাক হয়েছে ম্যান মেটয। আতঙ্ক নিয়ে দেখছে দুই পাইলটের রক্তাক্ত লাশ। কয়েক সেকেণ্ড পর ভাষা ফিরল তার: জিযাস! হঠাৎ কী হয়ে গেল?

বাদ দিন, বলল নাদির, এখন খুঁজে বের করতে হবে লাবনী আলমকে। সঙ্গে ওই জার। এরই ভেতর বুঝেছে, ল্যাণ্ড রোভার থেকে নামার আগে বা পরে গ্রেনেডের স্পন খোলেনি লাবনী, নইলে লাফিয়ে হোভারক্রাফটে ওঠার সময় বোমা ফাটার সম্ভাবনা ছিল। হোভারক্রাফটে ওঠার পর জার সরিয়ে গ্রেনেড রেখেছে। তার মানে… এখানেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে ওই জার। আসুন আমার সঙ্গে।

ইয়ে… আমি…রক্তাক্ত লাশ থেকে চোখ সরাতে পারছে না মেটয। আমার কেমন যেন বমি আসছে।

ঠেলে বাহেডে তাকে ফেলল নাদির। পরক্ষণে কাঁধ খামচে ধরে সিঁড়ির দিকে রওনা হলো। ধমকের সুরে বলল, বাঁচতে চাইলে যা বলি, তাই করুন। নইলে খুন হবেন।

লিফট ফ্যানের আড়ালে রয়ে গেছে রানা। ডেকের এদিক ওদিক দেখল। না, উপায় নেই সরে যাওয়ার। সামনে একটা হ্যাচ। কিন্তু ওটা থেকে আসছে জ্বলন্ত ইঞ্জিন রুমের আগুনের হলকা। ওদিকের ওয়াকওয়ে ধরেও ভেসেলের অন্য কোনও দিকে যেতে পারবে না।

জগিঙের ভঙ্গিতে আসতে আসতে অটোমেটিক পিস্তল উঁচু করল জেনারেল খালিদ আসির। মাত্র কয়েক সেকেণ্ড পর গুলি করে মারবে রানাকে।

কোনও উপায় নেই রানার সামনে। কিন্তু অপেক্ষা করে খুন হওয়ার চেয়ে অন্য কোনও পথ খোঁজা অনেক গুণে ভাল।

ঘুরেই স্টার্নের দিকে দৌড় দিল রানা। মাথার ওপরে জোরালো গুঞ্জন তুলে বনবন করে ঘুরছে তিনটে বিশাল প্রপেলার। অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে বৃত্তাকার পাখা। ইঞ্জিনের পাইলনের পেছনে লুকালে হয়তো সুযোগ বুঝে ঢুকতে পারবে হোভারক্রাফটের সুপারস্ট্রাকচারের ভেতর। সেক্ষেত্রে হয়তো খুঁজেও পাবে লাবনীকে…

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে রানার!

লিফট ফ্যান ঘুরে হাজির হয়েছে খালিদ আসির। পিস্তল তাক করল রানার দিকে।

কিন্তু তখনই প্রচণ্ড তীক্ষ্ণ এক সাইরেনের আওয়াজ এল সুপারস্ট্রাকচার থেকে। কারও মনে হয়েছে, নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে ইঞ্জিন রুমের আগুন। ওই সাইরেন জানিয়ে দিচ্ছে, দেরি না করে নেমে পড়তে হবে হোভারক্রাফট থেকে। প্রচণ্ড আওয়াজে চোখ কুঁচকে ফেললেও গুলি করল আসির। রানার কানের এতই কাছ দিয়ে গেল বুলেট, ওটার তপ্ত হাওয়া লাগল ওর মাথার পাশে।

কটাস আওয়াজে লক হলো অস্ত্রের স্লাইড। গুলি নেই অটোমেটিক পিস্তলে। আরেকটা ম্যাগাযিন বের করতে গেল আসির, কিন্তু তার দিকে তেড়ে গেল রানা। এখন রিলোডের সময় নেই মিশরীয় নোকটার। অবশ্য, ঝটকা দিয়ে বের করল আরেকটা অস্ত্র।

আসিরের খুব কাছে পৌঁছেও কড়া ব্রেক কষল রানা। ওর বুকে ছোরা গাঁথতে চাইল লোকটা। কিন্তু পিছিয়ে গেছে। রানা। সামনে বেড়ে একপাশ থেকে ওর পেট লক্ষ্য করে ফলা চালাল আসির।

খপ করে তার কবজি ধরতে চাইল রানা। কিন্তু বাঁকা পথে ছোরা নামাল সে। চিরচির করে কাটল রানার শার্টের কবজি, ত্বক ও মাংস। ঝুঁকে এসেছে লোকটা। রানা তীব্র ব্যথায় হাত টেনে নিতে গিয়েও দুহাতে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল শত্রুর অ্যাডাম্স্ অ্যাপলে।

দম আটকে যেতেই পেছনে সরল আসির। কিন্তু কোমর উচ্চতায় কী যেন। লোকটা তাল সামলে নেয়ার আগেই সামনে বেড়ে তার বুকে প্রচণ্ড দুটো ঘুষি বসাল রানা।

প্রায় বসে পড়েছে আসির, কিন্তু প্রচণ্ডবেগী হাওয়ার ভয়ঙ্কর টানে সড়াৎ করে ঘুরন্ত প্রপেলারে ঢুকল তার মাথা ও গলা। বিস্মিত রানা দেখল, মুহূর্তে কুচি-কুচি হলো লোকটার আস্ত মাথা। ভুস করে শাফটের মাঝে হারিয়ে গেল লাল কুয়াশা। ধপ্ করে রানার পাশেই ডেকে পড়ল কবন্ধ লাশ।

দুসেকেণ্ড পর রানা বুঝল, আসিরের লাশের কোমরে হোলস্টার। ভেতরে পিস্তলও আছে। ছোরা বের করার আগে ঠিক জায়গায় খুঁজে রেখেছিল। পিস্তল বের করে নিয়ে বাড়তি একটা ম্যাগাযিন রিলোড করল ও, সতর্ক।

ডেকে বেরিয়ে এসেছে কজন ক্রু। কিন্তু জেনারেলের লাশ বা ওর দিকে মনোযোগ নেই তাদের। একমাত্র ইচ্ছে হোভারক্রাফট থেকে নামবে। স্কার্ট থেকে মরুভূমিতে পিছলে নেমে যেতে চাইল তাদের একজন। কিন্তু ফোলা রাবারের কারণে দুই ডিগবাজি দিয়ে পড়ল বালিঝড়ের ভেতর। মটকে গেছে ঘাড়। তার সঙ্গীরা বুঝল, এই ছুটন্ত, নষ্ট হোভারক্রাফট থেকে নামতে হলে খুঁজতে হবে অন্য উপায়। আবারও সুপারস্ট্রাকচারে ঢুকল তারা।

পিস্তল হাতে সামনে বাড়ল রানা। এবার নিজেও ঢুকবে ভেতরে। খুঁজে বের করতে হবে লাবনীকে।

হোভারক্রাফটের সঙ্গে তাল রেখে ছুটছে বেলা। প্রচণ্ড তাপ প্রবাহে দূরে দেখল এবড়োখেবড়ো, আঁকাবাঁকা শৈলশিরা।

মাত্র কমিনিট পর ওই শৈলশিরা টপকে বহু নিচে গিয়ে পড়বে যুবর হোভারক্রাফট।

ওটার ডেকে লোকজন দেখেছে বেলা। তবে তারা কেউ মাসুদ রানা বা লাবনী আলম নয়।

হোভারক্রাফটের আরও কাছে সরে এল বেলা। বিড়বিড় করল, আসুন! দেরি করবেন না! নইলে বাঁচবেন না!

ক্যানোপিক জার হাতে হোল্ডের কাছে দাঁড়িয়ে আছে লাবনী। চারপাশ দেখে গলা শুকিয়ে গেল ওর। আগুন জ্বলছে হোন্ডে। পোর্ট সাইডের পেছনের এক দরজা থেকে ক্রমেই কমলা শিখা ছড়িয়ে পড়ছে নানাদিকে। প্রশস্ত ডেকে তাপ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে কজন ক্রু। একজন অপারেট করল কন্ট্রোল প্যানেল। নামিয়ে দেয়া হলো ফ্রন্ট ও রিয়ার র‍্যাম্প। বালিভরা হু-হু হাওয়া ঢুকল হোল্ডে। তাতে বেরিয়ে গেল ধোয়া। কিন্তু বাড়ল আগুনের হলকা।

হোল্ডের পেছনে ছুটে গিয়ে হোভারক্রাফট থেকে লাফ দিতে চাইল এক লোক। সহজ হতো স্টার্ন থেকে লাফিয়ে নেমে গেলে, কিন্তু ওদিকে জ্বলছে দাউদাউ আগুন। হোল্ডের চেয়ে অনেক সংকীর্ণ দুই র‍্যাম্প, তার ওপর কাত হয়ে আছে। পোর্টসাইড। ওই ইস্পাতের দেহ চাটছে বাড়ন্ত আগুন। লোকটা মুখ ঢেকে রেখে দৌড়ে পৌঁছে গেল সোনালি রোদের চৌকো অংশে।

কিন্তু হিসাবে ভুল হয়ে গেছে তার। হ্যাচওয়ে থেকে এল গনগনে আগুনের হলকা। মুহূর্তে জ্বলে উঠল গায়ের পোশাক। জ্বলন্ত মশালের মত বালিঝড়ে হারিয়ে গেল সে।

সহজে নেমে পড়া অসম্ভব, বুঝল অন্যরা। সাহসী বা বোকা এক সৈনিক নেমে পড়ল র‍্যাম্পে। ভাবল, পৌঁছে যাবে স্কার্টে, তারপর সাবধানে নামবে মরুভূমিতে। দুসেকেণ্ড পর অন্যদের চেহারা দেখে লাবনী বুঝল, খুব বিমর্ষ হয়েছে তারা। প্রকাণ্ড হোভারক্রাফটের নিচে পিষে গেছে তাদের সঙ্গী। কিন্তু তা-ও ভাল আগুনে পুড়ে মরার চেয়ে। একে একে র‍্যাম্প থেকে লাফ দিল তারা।

শেষ লোকটা বিদায় নেয়ায় হোল্ডে ঢুকল লাবনী। গেল ডিউন বাগির পাশে। পরীক্ষা করে দেখল, ওটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে স্ট্র্যাপ দিয়ে। ওগুলো খুললে হয়তো আগুনে পুড়ে মরার আগেই রিয়ার র‍্যাম্প বেয়ে নেমে যেতে পারবে ও।

মইয়ের ধাপে পায়ের আওয়াজ শুনে আবারও হ্যাচের কাছে ফিরল লাবনী। ঢুকে পড়ল ডিউন বাগির পাশে এক আর্থমুভারের নিচে। তলা থেকে উঁকি দিয়ে দেখল, মই বেয়ে হোল্ডে নেমেছে ম্যান মেটয ও নাদির মাকালানি।

আঙুল তুলে স্টার্ন দেখিয়ে মেটকে নির্দেশ দিল ধর্মগুরু, খুঁজে বের করুন ওই জার।

কথা শুনে চমকে গেছে ম্যান মেটয। ইতস্তত করে বলল, কিন্তু ওদিকে তো দাউদাউ আগুন!

তা হলে ওটার ভেতরে ঢুকতে যাবেন না! এবার নির্দেশ দিল মাকালানি, খুঁজে দেখুন বুলডোরের ভেতর। হয়তো এখানেই কোথাও লুকিয়েছে জার। নিচেও রাখতে পারে।

আপনি কী করবেন? জানতে চাইল মেট। ডিউন বাগির দিকে চলেছে নাদির।

ওটাতে চেপেই যেতে হবে। দেরি না করে খুঁজে বের করুন জার!

ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল লাবনী। তবে কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, হোল্ডের অন্যদিকের আর্থমুভার দেখবে মেট। মাথার ওপরে যন্ত্রদানব, ওটার তলা থেকে বেরিয়ে এল লাবনী। একটু দূরেই আরেকটা খোলা হ্যাচ। একবার কারও চোখ এড়িয়ে ওই পর্যন্ত পৌঁছুতে পারলেই…

হোল্ডের আগুন লেগে জ্বলে উঠছে ডেকে পড়া গ্রিয় ও তেল। ভুসভুস করে তৈরি হচ্ছে ধোয়া। প্রথম বুলডোর পরীক্ষা করা শেষ করে পেছনেরটা দেখতে লাগল মেট।

দরজা থেকে পনেরো ফুট দূরে লাবনী। ঘুরে দেখল, ডিউন বাগির পাশে মাকালানির পা। খুলে ফেলেছে শেষ স্ট্র্যাপ। অন্যদিকে চোখ। ম্যান মেটয এখন লাবনীকে দেখতে না পেলে; হয়তো পা টিপে টিপে দরজা পেরোতে পারবে ও।

ক্যাব পরীক্ষা করতে পাশের ধাপে পা রেখে ভেতরে উঁকি দিল মেট। তার পিঠ এখন লাবনীর দিকে।

এই হচ্ছে সঠিক সময়!

যন্ত্রদানবের তলা থেকে পিছলে বেরিয়ে এসেই উঠে বসল লাবনী। এবার দৌড় দেবে দরজার দিকে। কিন্তু ঠিক তখনই ঘুরে তাকাল ম্যান মেটয।

দেখে ফেলেছে সে!

পরস্পরের চোখে চোখ রাখল লাবনী ও মেট্য। পাথরের মূর্তি হয়েছে দুজন। এখন একবার মেট বলে দিলেই সব জেনে যাবে ধর্মগুরু!

কিন্তু একটা কথাও বলল না ম্যান মেট্য। চোখ পিটপিট করল, তারপর উদাস চোখে দ্বিতীয়বার তাকাল বুলডোয়ারের ক্যাবের ভেতর।

নীরবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দৌড়ের জন্যে তৈরি হলো লাবনী।

কী দেখলেন? চিৎকার করে জানতে চাইল নাদির। গাল কুঁচকে গেল লাবনী ও মেট-এর।

খুনে লোকটার চোখে পড়েছে বিজ্ঞানীর দ্বিধা।

ইয়ে… ঠিক বুঝতে পারছি না, বিড়বিড় করল মেট। এরই ভেতর গটগট করে লাবনীর দিকে আসছে মাকালানি।

ধরা যখন পড়বেই, তো ভয় কীসের, এই ভেবে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লাবনী। এক হাতে উঁচু করে ধরল জার। নড়বে না! খবরদার! নইলে চুরমার করে দেব জার!

থমকে গেল মাকালানি। উঁচু করল দুহাত। পাগলামি করবেন না, ডক্টর আলম। ওটা দিয়ে দিন।

জীবনেও না! পিছিয়ে যেতে লাগল লাবনী। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখল ছড়িয়ে পড়া আগুন। কেমন হয় আপনার জন্যে পাউরুটি তৈরি করে দিলে?

না! একপা সামনে বাড়ল নাদির। একবার ভাবছে, ছুটে এসে কেড়ে নেবে জার। আবার ভাবছে, ওটা নষ্ট হলে জীবনেও তৈরি হবে না জেনেটিক বিষ। ওটা আমাকে দিয়ে দিন… বদলে বাঁচতে দেব আপনাকে।

পিছিয়ে চলেছে লাবনী। এটা তোমার চাই, কারণ কোটি কোটি মানুষকে খুন করবে, তাই না? সেই সুযোগ তোমাকে দেব না, শয়তান! ধ্বংস করে দেব জার!

লাবনীকে একবার দেখল নাদির, তারপর তাকাল হোন্ডের অন্যদিকে। চোখ আবার ফিরল লাবনীর ওপর। হ্যাঁ, খেলা শেষ হয়ে এল। ঠিকই বলেছেন!

লাবনী! সতর্ক করতে চাইল ম্যান মেটয। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

খোলা হ্যাচ থেকে ডাইভ দিয়েছে কিলিয়ান ভগলার। তার দেহের ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ল লাবনী। হাত থেকে ছুটে গেছে জার। তবে মেঝেতে পড়ে ঠুং করে ভাঙল না জার। একহাতে ওটার পতন ঠেকিয়ে দিয়েছে ভগলার। কিন্তু ধরেও রাখতে পারল না একহাতে। গড়িয়ে আগুনের দিকে চলল জার। অবশ্য, কয়েক সেকেণ্ড পর বাড়ি খেল একটা কার্গো রিঙের গায়ে।

বিশাল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল নাদির। বুঝে গেছে, ওই জার এখন নিরাপদ। ওদিকে পা বাড়িয়ে ধমকের সুরে বলল, খুন কররা ওই শুয়োরনীটাকে!

খুশির সঙ্গে, বলল ভগলার। পনিটেইল ধরে হ্যাচকা টানে লাবনীর মাথা তুলল। সাপের চামড়ার জ্যাকেট থেকে বের করল প্রিয় রিভলভার…

কিন্তু থমকে যেতে হলো ওকে। এইমাত্র দড়াম করে খুলে গেছে আরেকটা দরজা। ওদিকে তাকাল সবাই।

বেরিয়ে এসেছে মাসুদ রানা। হাতে আসিরের পিস্তল। হোল্ডের সবচেয়ে বড় হুমকির দিকেই তাক করল অস্ত্র।

কিন্তু টান দিয়ে নিজের সামনে লাবনীকে আনল ভগলার। শক্ত হাতে ধরেছে ঘাড়। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল লাবনী। কাছের আর্থমুভারের আড়ালে সরল নাদির মাকালানি। ঘুপচি এক জায়গায় হোল্ডের আরেকদিকে একই কাজ করল ম্যান মেটয।

রানা! প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী। রক্তে মেখে আছে। রানার মুখ-হাত। একই অবস্থা শার্টের। হায়, আল্লা…

কিছুই হয়নি, বলল রানা। চোখ স্থির ভগলারের চোখে। পাফ অ্যাডার, তিন গোনার আগেই সরো লাবনীর কাছ থেকে! নইলে জানে বাঁচবে না!

লাবনীর মাথায় রিভলভারের নল ঠেকাল ভগলার। আমি গুনব দুই, এর ভেতর অস্ত্র না ফেললে খুন হবে তোমার ডার্লিং!

রানা, গুলি করো ওই জারে! বলল লাবনী। চোখের কোণে ক্যানোপিক জার দেখল রানা। জারই যদি না থাকে, হাতে ওদের কোনও তাসই থাকবে না!

জারে গুলি করলে সঙ্গে সঙ্গে খুন হবে ওই মেয়ে! আড়াল থেকে গলা ফাটাল নাদির। ইশারায় বডিগার্ডকে বলছে গুলি না করতে।

লাবনীর ঘাড় চেপে ধরল ভগলার। ইশারা করল হাঁটুতে ভর দিতে। লাবনী নির্দেশ পালন করতেই নিজে লুকিয়ে পড়ল পেছনে। অসহায় মেয়েটাকে সামনে রেখে হাঁটু ঘষে সরছে। রানার কাছ থেকে।

ভগলারের দিকে পিস্তল তাক করে নিজেও সরছে রানা। চালমাত অবস্থা। ভগলার ভাল করেই জানে, লাবনীকে খুন করার পরের সেকেণ্ডে লাশ হবে নিজে। কিন্তু লাবনীর গায়ে লাগবে না, এত নিশ্চিত হয়ে গুলি করতে পারবে না রানা।

অনুসরণ করছে ও। খোলা দরজার কাছে চলে গেল লাবনী ও ভগলার।

বস্! হাঁক ছাড়ল আমেরিকান খুনি, আর্থমুভারের ইগনিশনে চাবি আছে?

কী বলা হয়েছে বুঝে গেছে নাদির মাকালানি। দেরি না করে আর্থমুভারের ক্যাবে উঠল সে। নিচু করে রেখেছে মাথা, গুলি করতে পারবে না রানা। খুকখুক করে স্টার্টার মোটর কেশে উঠতেই জোরালো খ্যার-খ্যার শব্দে চালু হলো ইঞ্জিন।

ধমক দিতে গিয়েও চুপ থাকল রানা। ওর নিয়ন্ত্রণে নেই। কিছুই। লাবনীর মাথার পেছনে রিভলভারের নল ঠেসে ধরেছে ভগলার। আরেক হাতে পকেট থেকে বের করল যিপ টাই। পাশের কার্গো রিঙে ঘুরিয়ে এনে লাবনীর কবজিতে পেঁচিয়ে মুচড়ে দিল। ব্যথা পেয়ে মুখ বিকৃত করেছে লাবনী। রিঙের সঙ্গে আটকা পড়েছে কবজি। ওর কানের কাছে মধুর স্বরে বলল ভগলার, এবার কোথাও যেতে পারবে না, সুন্দরী।

আর্থমুভারের কন্ট্রোল নেড়েচেড়ে বুঝে নিল নাদির। একটা লিভার দিয়ে উঁচু করল কোদালের মত সামনের স্কুপ। টুলবক্স থেকে বড় এক স্প্যানার নিয়ে আটকে দিল গ্যাস প্যাডেলে। গর্জে উঠল ইঞ্জিন। একস্ট পাইপ দিয়ে বেরোল তেলতেলে বাদামি ধোঁয়া। কিন্তু সামনে বাড়ল না আর্থমুভার। গিয়ার ফেলা হয়নি।

সামনের র‍্যাম্পের ওদিকে চোখ যেতেই, চমকে গেছে। নাদির। দূরে শৈলশিরার শেষ কিনারা। ওটা মাত্র এক মাইল দূরে!

আর বড়জোর দুমিনিট, তারপর ওখান থেকে বহু নিচে গিয়ে পড়বে হোভারক্রাফট।

ভগলার ও নাদিরকে দেখছে রানা। বুঝে গেছে, ভয়ঙ্কর কোনও পরিকল্পনা এঁটেছে এরা। এখন চাইলে ড্রাইভিং সিটে বসা নাদিরকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারবে ও। কিন্তু তাতে পিস্তলের নল ঘোরাতে হবে, সে-সুযোগে লাবনী বা ওকে খুন করবে ভগলার।

ওদিকে রিঙে লেগে ঠুকঠুক আওয়াজে নড়ছে জার। লাবনী থেকে একটু দূরেই ওটা।

রানাকে দেখছে নাদির। কী; রানা? আমাকে ঠেকাবে, না বাঁচাবে লাবনী আলমকে? যে-কোনও একটা করতে হবে।

ইঞ্জিন রিভার্স গিয়ারে নিল নাদির। আর্থমুভার হোঁচট খেয়ে পেছাতে শুরু করতেই লাফ দিয়ে নেমে পড়ল সে।

মাত্র একফুট যেতেই ডেকে নিরাপদে রাখার চেইনে বাধা পেল আর্থমুভার। টানটান হয়ে উঠল চেইন। ওটা রয়েছে গাড়ির জায়গা স্থির করতে, কয়েক শ ঘোড়াশক্তির চলন্ত গাড়ি ঠেকাতে নয়। মেঝেতে বিশ্রী ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলল স্টিলের ট্র্যাক। চেইন ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে আর্থমুভার। কর্কশ কড়-কড় আওয়াজ তুলছে কার্গো রিং।

লাবনীর পেছনে রয়ে গেছে ভগলার। এক চোখ রেখেছে বারো ফুট দূরে সগর্জন আর্থমুভারের ওপর। রানার উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, যাও! ঠেকাও ওটা!

জারের দিকে তাকাল রানা। ভাবছে, লাথি মেরে আগুনে জার ফেলতে পারবে? আবার পরক্ষণে গিয়ে ঠেকাতে পারবে আর্থমুভার?

না, পারবে না।

যে-কোনও একটা করতে হবে। রানা জানে, এই অবস্থায় কী করবে ও।

ঝটাং করে ছিঁড়ে গেল চেইন।

সোজা লাবনীর দিকে পিছিয়ে আসতে লাগল আর্থমুভার!

অসহায় লাবনীকে রেখে এক লাফে আর্থমুভারের ওদিকে গিয়ে পড়ল ভগলার। পরপর দুবার গুলি করল রানা, কিন্তু লোহার মেশিনে লেগে ছিটকে গেল চ্যাপ্টা বুলেট।

ঝটকা দিয়ে সামনে বাড়ল রানা। আগে এত জোরে দৌড়ায়নি কখনও। রিং বা কবজি থেকে ছোটাতে হবে যিপ টাই, নইলে স্রেফ খুন হয়ে যাবে লাবনী!

ইঞ্জিনের ধক-ধক শব্দ তুলে পিছিয়ে আসছে আর্থমুভার। লাবনীর থেকে মাত্র পাঁচ ফুট দূরে। চার…

লাবনীর পাশে পৌঁছে গেলেও রানা বুঝল, খুলতে পারবে না যিপ-টাই। পিস্তল তাক করেই ট্রিগার টিপে দিল ও। টাশ করে ছিঁড়ে গেল যিপ-টাই। রিঙে বুলেট লেগে ছিটকে এসে লাগল রানার হাতের পিস্তলের নলে। মাযলের আগুনে আরেকটু হলে পুড়ত লাবনীর বাহু। ওকে জাপ্টে ধরে ডাইভ দিয়ে আর্থমুভারের ওপারে গিয়ে পড়ল রানা। এক সেকেণ্ড পর ওই রিঙের ওপর দিয়ে গেল আর্থমুভার। তাতে শেষ হয়নি বিপদ। ক্যানোপিক জারের দিকে ছুটছে ভগলার। দুফুট পেছনেই উদ্যত পিস্তল হাতে নাদির। নিজের পিস্তলের খোঁজে পেছনে তাকাল রানা।

আর্থমুভারের নিচে পড়ে চ্যাপ্টা হয়েছে ওটা!

ধক-ধক আওয়াজে পিছিয়ে চলেছে যন্ত্রদানব। লাবনীকে নিয়ে ওটার কাছ থেকে সরে গেল রানা। গুলি করল ভগলার, কিন্তু সেটা লাগল হলদে আর্থমুভারের গায়ে। রানা ও লাবনীকে শেষ করতে পিছু নিতে গিয়েও অন্য বুদ্ধি করল ভগলার। লাফিয়ে উঠল ক্যাবে। এবার ওদিকে নেমেই…

ক্যাবের ওদিক থেকে উঠে এল রানা। সিটের ওদিক থেকে ডাইভ দিল ভগলারের ওপর। ক্যাব থেকে হুড়মুড় করে ডেকে পড়ল ওরা দুজন। খটাং-খট আওয়াজে ডেকে পিছলে দূরে সরে গেল রিভলভার।

ততক্ষণে ক্যানোপিক জারের সামনে পৌঁছে গেছে নাদির, খপ করে ওটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। চেহারায় ফুটল তৃপ্তি। ক্ষতি হয়নি জারের সিলের। আরেক দৌড়ে ডিউন বাগির পাশে পৌঁছে গেল সে। এখনও লুকিয়ে আছে। ম্যান মেটয, উঁকি দিল। তার দিকে ভুরু কুঁচকে দেখল নাদির। ভয়ঙ্কর দৃষ্টি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে গেল আর্কিওলজিস্ট।

ওদিকে ভগলারের চোয়ালে ঘুষি মেরেছে রানা। গাল কুঁচকে ফেলল নিজেই। ভীষণ ব্যথা লেগেছে গুলিতে আহত হাতে। ঘুষি খেয়ে আমেরিকান খুনি বুঝেছে, রানা এখন ওর চেয়ে দুর্বল। তার ওপর বাহুতে রক্ত। গুলিতে আহত বাহু খামচে ধরল ভগলার। ব্যথায় কুঁকড়ে গেল রানার মুখ। পিছিয়ে যেতে চাইলেই প্রচণ্ড এক লাথি পড়ল ওর পেটে। মাথার পাশ দিয়ে ধক-ধক আওয়াজে চলেছে আর্থমুভার।

যন্ত্রদানবের ক্যাবে উঠেছে লাবনী। লাথি মেরে অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল থেকে সরিয়ে দিল স্প্যানার। নিউট্রাল করল গিয়ার স্টিক। হোল্ডের পেছনের দিকে ছড়িয়ে যাওয়া আগুন থেকে এক ফুট আগে থামল আর্থমুভার। যন্ত্রের সামনের দিকে ভগলারকে দেখল লাবনী। এইমাত্র রানাকে ল্যাং মেরে ফেলে ওর বুকে কনুই নামিয়ে এনেছে সে। একটু দূরে ডিউন বাগিতে উঠছে নাদির মাকালানি। খোলা র‍্যাম্প দিয়ে দেখা গেল আতঙ্ককর দৃশ্য!

এগোচ্ছে যুবর, দ্রুত চলে আসছে শৈলশিরার কিনারা!

রানা হেঁচড়ে সরে গিয়েই ঘুষি মারল ভগলারের চোয়ালে। কিন্তু কাত হয়ে শরীর গড়িয়ে দিয়েই হাতের কাছে রিভলভার পেয়ে গেল লোকটা। তুলে নিল অস্ত্রটা, ঘুরেই তাক করল রানার দিকে। কিন্তু তখনই ক্রিচ-ক্রিচ আওয়াজ তুলে রওনা হলো ডিউন বাগি। একহাতে ক্যানোপিক জার বুকের কাছে রেখেছে নাদির মাকালানি।

মাকালানি! ঝোড়া হাওয়ার ওপর দিয়ে চিৎকার করল ভগলার। একমিনিট!

উঠে বসেছে রানা। ওর দিকে ঘুরেই রিভলভার তাক করল ভগলার।

একইসময়ে আর্থমুভারের গিয়ার ফেলে সামনে বেড়েছে লাবনী। যন্ত্রদানবের স্কুপ লাগল ভলারের হাতে। ছিটকে কোদালের গর্তে পড়ল রিভলভার। ওদিকে উঠে পড়েছে রানা, থুতনিতে ওর জোরালো এক আপারকাট খেয়ে বেসামাল হলো ভগলার। মুখ থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত। স্কুপের কিনারার ধাতব দাঁত কামড়ে ধরল সাপের চামড়ার জ্যাকেট।

ঘাবড়ে যায়নি ভগলার। কোদালের গর্তে রিভলভার দেখেই ঝুঁকল তুলে নিতে। কিন্তু স্কুপ উঁচু করে নিয়েছে লাবনী। ধাতব দাঁতে ঝুলছে জ্যাকেট। ওটার কারণে আটকা পড়ল ভগলার। জ্যাকেট থেকে বের করে নিতে চাইল কাঁধ, কিন্তু হাতদুটো ছুটিয়ে নেয়া অসম্ভব। পেটে খেল রানার পর পর দুটো প্রচণ্ড ঘুষি। তখনই হোঁচট খেয়ে থামল আর্থমুভার। হোভারক্রাফটের বো-র দিকে চোখ গেল তার।

ডিউন বাগি নিয়ে র‍্যাম্প থেকে নামছে নাদির। শক্ত মরুভূমিতে পড়েই লাফিয়ে উঠল গাড়িটা। আগেই সিটবেল্ট বেঁধে নিয়েছে ধর্মগুরু, একহাতে চালাচ্ছে হালকা ভেহিকেল। কসেকেণ্ডের জন্যে ওটার ওপর চেপে বসতে চাইল হোভারক্রাফট। আরেকটু হলে র‍্যাম্প কাজ করত বিশাল এক কোদালের মত, আবার তুলে নিত ডিউন বাগিটাকে; কিন্তু সামনে বেড়ে বাঁক নিয়ে সরে গেল নাদির মাকালানি। সাঁই করে তাকে পাশ কাটিয়ে সোজা শৈলশিরার দিকে ছুটল হোভারক্রাফট।

এইমাত্র ডিউন বাগিটাকে বাঁক নিয়ে সরে যেতে দেখল বেলা। এটাও বুঝে গেল, কে চালাচ্ছে ওই গাড়ি।

ছাড়া পেয়ে গেছে নাদির মাকালানি। আর আটকা পড়েছে। মাসুদ ভাই আর লাবনী আপু!

তারা মারা গেছে, মেনে নিতে পারছে না বেলা।

বিপদের সময় ওর পাশে ছিল মানুষদুটো।

এখন তাদের ফেলে চলে যাবে?

চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ করে অ্যাক্সেলারেটর টিপে ধরল বেলা।

এমনিতেই টেম্পারেচার গেজ আছে লাল সীমায়, তবুও ওভারহিটেড পুরনো ল্যাণ্ড রোভার নিয়ে ছুটল হোভার ক্রাফটের দিকে।

.

আর্থমুভার থেকে নেমেই দৌড়ে গিয়ে রানাকে জড়িয়ে ধরল লাবনী। তুমি ঠিক আছ তো, রানা?

হ্যাঁ, তুমি? বলল রানা। বাহু বেয়ে পড়ছে রক্ত। ঘুরে স্টারবোর্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পার্টমেন্টের দিকে তাকাল।

ওর দেখাদেখি ওদিকে তাকাল লাবনী। থামাতে হবে হোভারক্রাফট। একবার ইঞ্জিন বন্ধ করতে পারলে…

সময় নেই! বলল রানা। দেখিয়ে দিল সামনের র‍্যাম্প। একটু পর শৈলশিরা থেকে পড়ব! পেছনে চোখ বোলাল ও। ওদিকে জ্বলছে দাউদাউ আগুন। এদিকে সামনের র‍্যাম্প থেকে ঝাঁপ দিলে ওদেরকে পিষে দেবে হোভারক্রাফট।

কোথাও যাওয়ার উপায় নেই!

ধাতব ঘটাং আওয়াজে ঘুরে তাকাল ওরা।

হোঁচট খেয়ে র‍্যাম্পে উঠে এসেছে তুবড়ে যাওয়া এক ল্যাণ্ড রোভার!

সরাসরি ওদের দিকেই আসছে বেলা!

যুবর পিষে মেরে ফেলবে, সেই ভয় কাটিয়ে এসেছে প্রিয় মানুষগুলোকে বাঁচাতে!

কড়া ব্রেক কষে থামল বেলা। চোখে-মুখে ভীষণ ভয়। অবশ্য, গাড়ির পাশেই রানা ও লাবনীকে দেখে মিষ্টি হাসল। আসুন! মাসুদ ভাই! লাবনী আপু!

গুলির গর্তভরা জিপগাড়ির প্যাসেঞ্জার দরজা খুলে ফেলল রানা। লাবনী গলা ছাড়ল, মেট! জলদি!

তাড়া খাওয়া তেলাপোকার মত পিছলে বেরিয়ে ছুটে এল আর্কিওলজিস্ট। গাড়িতে উঠে পড়ল রানার ইশারায়। লাবনী উঠতে নিজেও উঠল রানা। ধক্ করে উঠল ওর বুক। খুব কাছে শৈলশিরার কিনারা। অনেক নিচে কঠিন জমিন!

রিয়ার র‍্যাম্প দিয়ে নামো, বেলা! দড়াম করে দরজা বন্ধ করল রানা।

কিন্তু ওদিকে তো আগুন!

আপত্তি তুলল মেটয।

আগুনই সই! বেলা, জলদি! তাড়া দিল রানা।

 ক্লাচ ছেড়ে গিয়ার ফেলেই অ্যাক্সেলারেটর দাবাল বেলা। দুসারি ভারী আর্থমুভারের মাঝ দিয়ে ছুট দিল ল্যাণ্ড রোভার। সরাসরি চলেছে লেলিহান আগুন লক্ষ্য করে। চেঁচিয়ে উঠল ম্যান মেটয: হায়, যিশু!

থেমো না, বেলা! সতর্ক করল রানা। আর্থমুভারের দাঁত থেকে ঝুলছে কিলিয়ান ভগলার। কাত হয়ে তুলে নিল রিভলভার। নাকের ডগার কাছেই ল্যাণ্ড রোভার। তাক করল চালকের দিকে, কিন্তু ভীষণ ভয়ে ভুলে গেল ট্রিগার টিপতে। আগে ভাল করে দেখেনি কতটা কাছে শৈলশিরার কিনারা!

এক সেকেণ্ড পর ভয় কাটিয়ে গুলি করল ভগলার। কিন্তু দেরি হয়েছে ওই এক সেকেণ্ডেরই। বুলেট বিঁধল বেলার মাথার ওপরে ল্যাণ্ড রোভারের ছাতে। সাঁই করে ভগলারকে পাশ কাটিয়ে গেল প্রাচীন গাড়ি।

ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল লাবনী। আমরা বাঁচব না!

দ্রুতগতি নয়, তবে টেকসই বলে নাম আছে ল্যাণ্ড রোভারের।

দেখো, নেমে পড়ব, বলল রানা। শেষ আর্থমুভার পাশ কাটিয়ে গেল ওরা। আগুন থেকে বাঁচতে কোনাকুনিভাবে র‍্যাম্পের দিকে চলল বেলা। সবাই মাথা নিচু করে নাও!

পরক্ষণে অগ্নিশিখায় ঢুকল ল্যাণ্ড রোভার। লকলক করে ওটাকে গিলে ফেলল লেলিহান হলকা। ভাঙা জানালা দিয়ে ঢুকল আগুনের কমলা সব ক্ষুধার্ত জিভ।

র‍্যাম্প থেকে নামল ল্যাণ্ড রোভার, ওই একইসময়ে শৈলশিরার কিনারায় পৌঁছে গেল হোভারক্রাফট।

নিচে পাথুরে জমিন হারাতেই স্কার্টের তলা থেকে নানা দিকে ছিটকে গেল টনকে টন বালি ও পাথর। নিরেট পাথরে ঘষা লাগতেই ভীষণ কেঁপে উঠল হোভারক্রাফট। বিশাল প্রপেলার কাজ করছে বলেই সি-সওর মত দুলল প্রকাণ্ড যান, তারপর ঝুপ করে নামাল নাক। ভেতরের আর সবকিছুর মতই ঝুলন্ত ভগলারকে নিয়ে সামনে পিছলে গেল ভারী আর্থমুভার। করুণ চিৎকার জুড়ল ভগলার। সামনের র‍্যাম্প পেরিয়ে সোজা নিচে চলল আর্থমুভার। দাঁত থেকে ঝুলছে বেসুরো কণ্ঠের ভগলার। ওই প্রাণপণ আর্তচিৎকার শোনার কেউ নেই!

সাঁই করে নেমে শৈলশিরার গোড়ায় আছড়ে পড়ল তিরিশ টনি আর্থমুভার। পরক্ষণে ওটার ওপর নামল পাঁচ শ টন ওজনের হোভারক্রাফটু। প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে চুরমার হলো ওটা। থরথর করে কাঁপতে লাগল জমিন। ছিটকে আকাশে উঠল ধুলোভরা আগুনের মস্ত এক মেঘ।

আরেকটু হলে আগুনের দীর্ঘ জিভ চেটে দিত ল্যাণ্ড রোভারটাকে। হোভারক্রাফটের অগ্রসরমান গতিকে টপকে যেতে পারেনি ছুটন্ত জিপগাড়ি। স্টার্ন থেকে নেমেই গেছে পিছলে। নতুন করে এগোবার আগেই শৈলশিরার কিনারা থেকে ধুম্ করে নিচে পড়েছে পেছনের দুই চাকা। বনবন করে ঘুরছে সামনের দুই চাকা, কিন্তু পেছনের দিক ভারী বলে সাধ্য নেই যে এগোবে। এবার গাড়ি নামবে মাধ্যাকর্ষণের টানে বহু নিচে।

ধুপ করে শৈলশিরায় পড়ে ভীষণ ঝাঁকি খেয়েছে রানা, বুঝেও গেছে কী বিপদে পড়ছে। সামনের ড্যাশবোর্ডের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল ও। কড়া গলায় বলল, সামনের দিকে ঝুঁকে এসো সবাই!

অন্যরা কিছু করার আগেই রানার একার ওজনেই নিচে জমিন খুঁজে পেল সামনের চাকা। ঝটকা দিয়ে এগোল পুরনো জিপগাড়ি। ধুমাস্ আওয়াজে চারপাশ কাঁপিয়ে উঠে এসেছে পেছনের চাকা। কিন্তু তিরিশ ফুট যেতে না যেতেই বুম্ করে ফাটল জ্বলন্ত দুই পেছনের চাকা। হোঁচট খেয়ে থামল ল্যাণ্ড রোভার।

চারপাশে শুধু ধুলোবালির মেঘ। কাশতে কাশতে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। থরথর করে কাঁপছে ম্যান মেটয। হাত ধরে ফেলল লাবনীর। অনেক… ধন্যবাদ! তোমরা অপেক্ষা না করলে…।

হাত ছুটিয়ে নিয়ে সন্দেহের সঙ্গে বলল লাবনী, তুমিও শেষদিকে সাহায্য করতে চেয়েছিলে বলে মনে হয়েছে।

মাথা দোলাল মেট। তা হলে যা হয়েছে, সেসব মাফ করে দিয়েছ তো?

নিশ্চয়ই, তবে এটা তুমি আমার কাছ থেকে পাও! ম্যান মেটযের গালে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিল লাবনী। তুমি ঘোড়ার ডিমের আর্কিওলজিস্ট!

গাল চেপে ধরে বসে পড়ল লোকটা। এখন গর্ব বলতে কিছুই নেই মনে।

নাদির মাকালানির কী হবে? জানতে চাইল বেলা। দূর মরুভূমির দিকে চেয়ে আছে। ডিউন বাগি নিয়ে অনেক আগেই হাওয়া হয়েছে ওই লোক।

রানার দিকে তাকাল লাবনী। সর্বনাশ হয়েছে! বদমাশটা নিয়ে গেছে জার! আমরা তাকে ধরব কীভাবে?

এখন ধরার উপায় নেই, বলল রানা, দূরে কোথাও গিয়ে উঠবে হেলিকপ্টারে। ওর কাছে স্যাটেলাইট মোবাইল ফোন দেখেছি।

তা হলে আমরা হেরে গেলাম? বিমর্ষ চেহারা করল বেলা। এবার কোনও ভাইরাস ছড়িয়ে দেবে। সর্বনাশ হবে সবার। তাই না?

উঁহু, অন্য উপায় বেরোবে, হাল ছাড়ছি না, বলল রানা। ফোন দেব কর্তৃপক্ষের কাছে। তারপর যাব অ্যাবাইদোসে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সবার মুখ। ভাবছে, এই মরুভূমিতে মাইলের পর মাইল হাঁটবে কী করে? মৃদু হাসল রানা। কিছু ভেবো না, গল্প করতে করতে অ্যাবাইদোসে চলে যাব।

চাকা পাল্টে নিলে হয় না? জানতে চাইল লাবনী।

মাথা নাড়ল রানা। পাল্টাতে হলে দুটো চাকা লাগবে। পাব কোথায়?

ও, ভীষণ মুষড়ে পড়ল ম্যান মেটয।

হাঁটতে শুরু করো, গাধা! তাড়া দিল লাবনী, পথ বহু দূর!

 রানার পাশে চলল লাবনী ও বেলা। অনেকটা দূরে ক্যানিয়ন। কয়েক সেকেণ্ড পর পিছু নিল ম্যান মেট্য।

.

প্রথমে শোনা গেল ইঞ্জিনের গর্জন, তারপর লাল পশ্চিম দিগন্ত থেকে এল মিশরীয় মিলিটারি এমআই-এইট হেলিকপ্টার। দুমিনিট পর প্রচুর বালি উড়িয়ে নেমে পড়ল ওটা অ্যাবাইদোসে ওসেইরেনের সামনে।

অনেক টাকা খরচ করে আরেকটা জিপগাড়ি জোগাড় করেছে রানা। ওটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। তবে গরমের ভেতরেও জানালা সব বন্ধ করে পেছনের সিটে থম মেরে বসে আছে ম্যান মেটয।

হেলিকপ্টারের হ্যাচ খুলে যেতেই নেমে এল ছয়জন লোক। পাঁচজনই সৈনিক, তবে পরনের ইউনিফর্ম সাধারণ সৈনিকদের মত নয়। কালো ক্যামোফ্লেজুড় ওই প্যাটার্ন শুধু ব্যবহার করে স্পেশাল ফোর্স টিম।

ষষ্ঠ লোকটি অ্যান্টিকুইটির সুপ্রিম কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল, ডক্টর শরিফ হামদি। রানাদের সামনে এসে থামলেন তিনি। হাত বাড়িয়ে দিলেন রানার দিকে। আশা করি ভাল আছেন, মিস্টার রানা।

কী করে ভাবলেন এই অবস্থায় ভাল থাকবে কেউ? মুখ ফস্কে বলে ফেলল বেলা।

ভদ্রলোকের সঙ্গে করমর্দন করল রানা। ডক্টর হামদি, গুড ইভিনিং। মরুভূমি দেখাল। আশা করি আপনাকে দেয়া জিপিএস কোঅর্ডিনেট অনুযায়ী আগেই ওদিকটা দেখেছেন?

জী। ভাবতেও পারিনি ওখানে ওরকম কিছু দেখব। মাথা নাড়লেন ডক্টর হামদি। শুধু এন্ট্রান্স চেম্বার দেখেছি। নিচে আরও কিছু আছে?

একেবারে নেমে গেলে পাবেন ওসাইরিসের সমাধি, গর্ব নিয়ে বলল বেলা।

ভাবা যায় না, বললেন হামদি। ওখানে রেখে এসেছি অ্যান্টিকুইটির স্পেশাল প্রোটেকশন স্কোয়াড। আগামী দুচার দিন পরেই ফুল এক্সপিডিশন শুরু করবে এসসিএ।

তবে ধারে-কাছে থাকবে না নাদির মাকালানি, বলল। লাবনী, যা চেয়েছে, পেয়ে গেছে সে।

মিস্টার রানা বলেছেন, বললেন হামদি। কিন্তু সত্যিই কি বায়োলজিকাল অস্ত্র তৈরি করবে ওই লোক?

সে ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন, বলল রানা, সুইটহার ল্যাণ্ডের ওসাইরিয়ান টেম্পলে সে ধরনের রিসোর্স আছে তার।

নামও পাল্টে যাবে ওই টেম্পলের, বলল লাবনী। এখন থেকে হবে সেটিয়ান টেম্পল। দলে নাদির মাকালানি পাবে অনেক শয়তানকে। যা খুশি করতে পারবে।

ভুরু কুঁচকে গেল ডক্টর হামদির। হয়তো। কিন্তু ম্যাস ডেস্ট্রাকশন ওয়েপন্স আমার বিষয় নয়। তা ছাড়া, হাতে প্রমাণ না পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করতে পারব না।

আপনার পছন্দের বিষয়ে নজর দিতে পারেন, বলল রানা, স্ফিংস থেকে নেয়া যোডিয়াক এখন তার দুর্গে। ওটা সুইটযারল্যাণ্ডে মেমোরাবিলিয়া হিসেবে রেখে দিতে চেয়েছিল কাদির ওসাইরিস।

নাদির সত্যিই ওখানে যোডিয়াক রেখে থাকলে, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব, বললেন হামদি, সে একজন মিশরীয় নাগরিক। আর মিশরীয় সরকার পুরাকীর্তি, চোরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর।

সেক্ষেত্রে অন্য দেশে নিজেদের সৈনিক নেবেন আপনারা? জানতে চাইল রানা।

এটা বলতে পারব না যে আগে কখনও এএসপিএস অন্য দেশে মিশনে যায়নি, মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন ভদ্রলোক।

এবং ওই মিশনে যদি প্রমাণ হয় বায়োলজিকাল অস্ত্র তৈরি করছে নাদির মাকালানি, সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেবেন আপনারা, তাই তো? জানতে চাইল রানা।

সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেব। তবে আগে প্রমাণ লাগবে যে ওই দুর্গে যোডিয়াক আছে।

রানার দিকে চেয়ে আছে লাবনী। তা হলে যাবে ওসাইরিয়ান টেম্পলের হেডকোয়ার্টারে?

আমার কোনও আপত্তি নেই, বলল রানা, নাদির মাকালানির সঙ্গে ব্যক্তিগত বোঝাঁপড়াও আছে আমার।

কিন্তু ওটা তো সত্যিকারের দুর্গ, কী করবেন একা? চিন্তিত হয়ে পড়েছে বেলা। ওরা তো ঢুকতেই দেবে না আপনাকে!

দিতেও তো পারে। মৃদু হাসল রানা। অবশ্য, সেজন্যে সঙ্গে লাগবে নামকরা কাউকে!

.

২৯.

শুভ্র-তুষার ছাওয়া অ্যালপাইন পর্বতমালার ওদিকে সূর্য ডুবে যেতেই দুর্গের উঁচু দেয়াল থেকে মুছে যাচ্ছে নরম আলো। উঠানে কালো কাঁচের বিশাল পিরামিডের নিচে জ্বলে উঠেছে নীল এলইডি বাতি। পিরামিড-শীর্ষে অত্যুজ্জ্বল আলো গেছে সপ্তাকাশে ধ্রুবতারা লক্ষ্য করে। ওই নক্ষত্র মিশরীয় প্রাচীন এক দেবতা।

লেকের পারের সংক্ষিপ্ত শাখা পথে দুর্গের দিকে চলেছে একটি গাড়ি। একটু পর কালো রঙের মার্সিডিয এস-ক্লাস গাড়িটি থামল গেটহাউসে। টিন্টেড কাঁচও কালো। ড্রাইভারের জানালার কাঁচ বন্ধ হলেও নেমে গেল পেছন জানালার কাঁচ। গাড়ির মালিক একাই আছেন। ভরাট কণ্ঠে ইন্টারকমের উদ্দেশে বললেন: হাই! আমি গিবন মুর। ক্যামেরার দিকে দুর্দান্ত এক হাসি দিল নায়ক। ওসাইরিয়ান টেম্পল ঘুরিয়ে দেখাতে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন কাদির ওসাইরিস। তো চলেই এলাম!

হঠাৎ আপনার আগমনের কারণ, মিস্টার মুর? ভদ্রতার সুরে জানতে চাইল নাদির মাকালানি। রাগ লাগছে তার। ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে সুদর্শন লোকটাকে।

কাদির ওসাইরিসের লাউঞ্জে চামড়ার কাউচে আরাম করে রসেছে মুর। পরের মুভির প্রচারণায় এসেছি সুইটয়ারল্যাণ্ডে। ভাবলাম দেখা করে যাই! মিষ্টি হাসল। তাই চলেই এলাম। মিস্টার ওসাইরিস বলেছিলেন ঘুরিয়ে দেখাবেন আপনাদের টেম্পল। সেইসঙ্গে গল্প হবে পুরনো আমলের সিনেমা নিয়ে।

আমার ভাই… এখন দেশের বাইরে, বলল নাদির।

ছিহ! কপালটাই মন্দ। তা কবে ফিরবেন তিনি?

দুষ্ট হাসল নাদির মাকালানি। আপাতত আর ফিরছেন না এখানে। তবে তাতে আপনার সময় নষ্ট হয়েছে, তা ভাববেন না। আজ টেম্পলে বিশেষ অনুষ্ঠান আছে। আপনি আমন্ত্রিত। সত্যি যদি প্রমাণ হয় আপনি এ ধর্মে বিশ্বাসী, পুরস্কারও দেয়া হবে আপনাকে।

বাহ্! গুড! নড়েচড়ে বসল মুর। ও, তা হলে আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন না আপনার ভাই?

না, সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে আমার ওপর, আরও চওড়া হলো নাদির মাকালানির ঠোঁটে হাসি।

দরজায় টোকা দিল কে যেন।

ধূসর চুলের এক বিশালদেহী লোক ঢুকল ঘরে। মুখে হল অভ রেকর্ডসসের মারপিটের চিহ্ন। প্রায় পৌঁছে গেছে প্রথম বাস।

মাথা দোলাল নাদির। ঘুরে দেখল মুরকে। অনুষ্ঠানের জন্যে তৈরি হতে হবে আমাকে। একটু অপেক্ষা করুন। সঠিক সময়ে আপনাকে অনুষ্ঠানে পৌঁছে দেবে কেউ।

খুশি মনে অপেক্ষা করব, বলল গিবন মুর। লোকদুজন চলে যেতেই পকেট থেকে নিল সেল ফোন। চালুই আছে ওটা। নিচু স্বরে বলল, অবস্থা বুঝলেন তো?

না বুঝে উপায় আছে? ওয়্যায়ারলেস হেডসেট-এ বলল লাবনী।

উপত্যকার আধমাইল দূরে দুটো মিতসুবিশি শোগান জিপগাড়ি রেখে দুর্গের দিকে চেয়ে আছে কজন মানুষ। গাড়ি দুটোর, ভেতর যথেষ্ট জায়গা, রাখা যাবে ছয় ফুট ডায়ামিটারের যোডিয়াক। আপাতত গাড়িদুটো কাজ করছে দুদল লোকের হেডকোয়ার্টার হিসেবে। প্রথম দল ইজিপশিয়ান সরকারের অ্যান্টিকুইটি স্পেশাল প্রোটেকশন স্কোয়াডের লোক। সংখ্যায় ছয়জন। দ্বিতীয় দলে মাত্র চারজন। তারা তরুণ। বাদামি ত্বক। হাতের কাছে অস্ত্র। রানা এজেন্সি থেকে এসেছে এই মিশনে।

কী ধরনের অনুষ্ঠান? জানতে চাইলেন ডক্টর হামদি। তিনি আছেন মিশরীয় দলের নেতৃত্বে।

কাঁধ ঝাঁকাল লাবনী। জানে না।

বেলাও মাথা নাড়ল।

ভুরু কুঁচকে নিজের দলের একজনের দিকে ফিরলেন ডক্টর হামদি। একটা বাসের কথা বলেছে। ওটা যাচ্ছে দুর্গের দিকে। মাথা দোলাল সৈনিক। তার সঙ্গে নেমে গেল রানা এজেন্সির জেনেভা শাখার চিফ শাহেদ কামাল। লাবনীর দিকে ফিরলেন হামদি। এএসপিএস শুধু সারপ্রাইস রেইড করে। শত্রু অনেক বেশি হলে…

লাবনী কিছু বলার আগেই জানতে চাইল গিবন মুর, আমাকে কী করতে বলেন? ওই যোডিয়াক থাকলে থাকবে ইজিপশিয়ান পুরনো আমলের মালপত্রে ভরা ঘরে। এখানে আসার সময় পেরিয়ে এসেছি ওই জায়গা।

মাথা নাড়লেন হামদি। চাক্ষুষ প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই করব না। তেমনই কথা হয়েছে সুইস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। এ দেশে যে-কোনও কাল্টকে গজিয়ে উঠতে দেয়া হয়। সত্যিই নাদির মাকালানির কাছে যোডিয়াক থাকলে কেবল তখনই হামলা করব আমরা।

তা হলে গিবন মুরের কাছে ক্যামেরা দেয়া উচিত ছিল, বলল বেলা।

প্রথমেই সন্দেহ পড়ত তার ওপর, বলল লাবনী। ওয়্যায়ারলেস হেডসেট-এ জানাল, মুর, আপাতত অপেক্ষা করুন।

ফোন চালু রাখুন, কোনও গোলমাল হলে আমাদের জানাবেন, ফিরে এসেছে কামাল। সেক্ষেত্রে আমরা আপনাকে বের করে আনব।

দুর্গ থেকে বের করে আনবেন? হাসল নায়ক, সিনেমায় ওই কাজ করেছি আগে। নায়িকাকে নিয়ে ভেগে গেছি।

হয়তো মাত্র একবার সুযোগ পাব, কাজেই তৈরি থাকুন, বলল শাহেদ কামাল।

ঠিক আছে, খসখস শব্দে পকেটে মোবাইল ফোন রাখল মুর।

এইমাত্র জিপে উঠেছে মিশরীয় সৈনিক। ডক্টর হামদির উদ্দেশে বলল, এইমাত্র পৌঁছুল বাস। নামাতে শুরু করেছে দুর্গের ড্র-ব্রিজ। লেকের পাশের রাস্তা ঘুরে এসেছি। আরও বাস আসছে।

বড় অনুষ্ঠান, বলল লাবনী। আমাদের কী করা উচিত?

ভুরু কুঁচকে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন ডক্টর হামদি, যদি প্রমাণ হয় নাদির মাকালানির কাছেই আছে যোডিয়াক, সেক্ষেত্রে অ্যাটাকে যাব আমরা।

মাথা দোলাল লাবনী।

নিজের হেডসেটে বলল শাহেদ কামাল, মাসুদ ভাই?

.

পিরামিড থেকে একটু দূরে উঠানের দেয়ালের পাশে পার্ক করা হয়েছে কালো কাঁচের লোভনীয় বিলাসবহুল মার্সিডিয। একটু আগে নাদির মাকালানির লোক নিয়ে গেছে নায়ক গিবন মুরকে। তখন গাড়ি থেকে না নেমে সামনের সিটে চুপ করে বসে ছিল গাড়ির গম্ভীর ড্রাইভার। এ মুহূর্তে তার কানে ক্লিপ-অন ইউনিট। ওটাকে হেডসেট না বলে ব্লুটুথ ইয়ারপিস বলাই ভাল। একপাশে খুদে ভিডিয়ো ক্যামেরা।

শুনছি, বলল মাসুদ রানা। কী অবস্থা, কামাল?

নায়ক গিবন মুরের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য রানাকে জানাল জেনেভা শাখা প্রধান শাহেদ কামাল। দুর্গের গেট দেখল রানা। নিচে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে ড্র-ব্রিজের দুই প্রান্ত। ভোতা ভুম্ আওয়াজ হলো। ঝনঝন করে উঠল পুরু শেকল। ধীর গতিতে তীর থেকে ড্র-ব্রিজে উঠল একটা বাস। ভেতরে অনেক মানুষ। পার্কিং লটের আরেকপ্রান্তে গিয়ে থামল বাসটা। ওদিকে চেয়ে আছে রানা।

ভিডিয়ো লিঙ্কের মাধ্যমে যাত্রীদেরকে বাস থেকে নামতে দেখে বলল লাবনী, বোধহয় অনেকে আসছে।

আরও বাস আসছে, বলল শাহেদ কামাল।

রানা, এত লোক, ভেতরে ঢুকতে পারবে? বলল লাবনী, বিপদ হবে না?

মনে হচ্ছে কাজটা কঠিন হবে না, বলল রানা। চওড়া দেয়ালের ব্যাটলমেন্টে দেখছে সশস্ত্র গার্ড। তবে তাদের সব মনোযোগ বাসের যাত্রীদের দিকে। পিছলে পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে সরল রানা। দরজা খুলে আস্তে করে বেরিয়ে এল। ইচ্ছে করেই বড় একটা এসইউভির পাশে পার্ক করেছে মার্সিডিয। নিজে আছে ছায়ার ভেতর। পাথরের মূর্তির মত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর বুঝল, কেউ দেখেনি গাড়ি থেকে নামতে। সন্তুষ্ট হয়ে কয়েক পা সামনে বাড়ল রানা। এখন পরিষ্কার দেখছে পুরো উঠান।

সামনেই আকাশছোঁয়া, কাঁচের বিশাল পিরামিড। বামে বাস। এখন আশপাশে কেউ নেই। ডানদিকে দারুণ সুন্দর ছোট এক বাগান। ওটার ঝোপঝাড় ও গাছের আড়াল নিয়ে যেতে পারবে পিরামিডের কাছে। ঠিক আছে, মনে হয় কারও চোখে না পড়ে ঢুকতে পারব পিরামিডে। যোডিয়াক কত তলায়?

কাদির ওসাইরিসের কাছে শুনেছি, রাখবে দোতলায়, বলল লাবনী, তবে মাকালানি কী করবে…।

ঠিক আছে। দুই গাড়ির মাঝের সরু পথে সরে এল রানা। একবার দেখল ব্যাটলমেন্ট। তারপর উঠান। বরফের মূর্তি হয়ে গেল ও।

 এইমাত্র দুর্গের দরজা পেরিয়ে পিরামিডের দিকে চলেছে নাদির মাকালানি। তাকে পাহারা দিচ্ছে তিনজন লোক। তাদের দুজনকে চিনল রানা। আবু আর ভার্নে। কিলিয়ান ভগলারের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বোধহয় হয়ে উঠেছে প্রধান দুই বডিগার্ড। তৃতীয় লোকটাকে চিনল না রানা। তার হাতে সিলিণ্ডারের মত ধাতব কন্টেইনার।

রানা, কন্টেইনার হাতে ওই লোকটাকে দেখেছি ল্যাবে, বলল লাবনী। বিজ্ঞানী।

লোকটার হাতের সিলিণ্ডারে মন দিল রানা। স্টেইনলেস স্টিলে সিম্বল। চোখ সরু করে পড়তে চাইল। পিরামিডের কোনা ঘুরে চলে গেল তারা। তবে যা জানার জানা হয়ে গেছে রানার। তিনটে বাঁকা শিং এক বৃত্তের ভেতর। বায়োহ্যায়ার্ড। ওই সিলিণ্ডার কনটেইনমেন্ট ফ্লাস্ক।

তার মানেই, ভেতরের জিনিস বায়োলজিকাল এজেন্ট।

শিরশির করে উঠল রানার ঘাড়ের ছোটসব রোম।

সিলিণ্ডারের জিনিস এখনই বিপজ্জনক হবে, সে-সম্ভাবনা কম। নইলে হ্যাঁযমেট সুট পরে ঘুরত নাদির ও তার অনুগতরা। রানার মনে পড়ল, ওসাইরিসের পিরামিডে কী বলেছে লোকটা। তার কথামত না চললে লাশ হবে কোটি কোটি মানুষ! এখন ওই কন্টেইনারের জিনিস থেকে নিরাপদ ওই চার লোক। হয়তো নিয়েছে প্রতিষেধক।

রানা এসইউডির ছায়ায় ফিরতেই জিজ্ঞেস করল লাবনী, কী করছ, রানা?

উড়িয়ে দেব এদের ল্যাব। ওটা তো কাঁচের পিরামিডের ওপরের দিকে, তাই না?

হ্যাঁ।

কিন্তু আমরা অন্য কাজে এসেছি, মিস্টার রানা, প্রায় হায়-হায় করে উঠলেন ডক্টর হামদি। আমাদের প্রথম কাজ যোডিয়াক উদ্ধার করা।

সেটা আপনাদের কাজ, বলল রানা, আমার আলাদা। কোনও নরপিশাচ খুনে ভাইরাস ছড়াবে জানার পরেও চুপ করে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। পিরামিডের দিকে তাকাল। একটু আগে কাঁচের দালানের সদর দরজা দিয়ে ঢুকেছে নাদির মাকালানি। এখন প্রবেশ করছে তার অনুসারীরা। কিন্তু এরা কেন ড্র-ব্রিজের কাছের সাইড ডোর ব্যবহার করছে না, বুঝল না রানা। ঠিক করে ফেলেছে, ওদের সঙ্গে মিশে ঢুকে পড়বে পিরামিডে। এ কথা বলতেই আপত্তি তুলল ডক্টর হামদি ও লাবনী। চুপ থাকল রানা এজেন্সির ছেলেরা।

তর্কে গেল না রানা, মন দিয়ে দেখছে উপস্থিত সবাইকে। নিউ ইয়র্ক ও প্যারিসের অনুষ্ঠানে ছিল নানা বয়সের অনুসারী, কিন্তু হেডকোয়ার্টারের এ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতরা বয়সে তরুণ। নানান দেশের নাগরিক। হয়তো পছন্দের অনুসারীদেরকে দুনিয়ার বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে বলেছে মাকালানি।

ছায়ার আড়াল নিয়ে সাবধানে এগোল রানা। পৌঁছে গেল পিরামিডের কাছে এক গাড়ির পাশে। হেডসেটে নিচু স্বরে বলল, ঠিক আছে, অফ করছি মাইক। কপালের পাশে ক্যামেরা নিয়ে সবার সামনে হাজির হতে পারব না।

কিন্তু, রানা… বলতে শুরু করেছিল লাবনী, কিন্তু ইয়ারপিস খুলে ফেলেছে রানা। ওটা আটকে নিল জ্যাকেটের তলের অংশে।

অনুষ্ঠানে আপাতত এসেছে জনাপঞ্চাশেক তরুণ-তরুণী। আলাপ চলছে সবার ভেতর। প্রায় সবাই উত্তেজিত। দারুণ কিছু পাবে, এমন ভাব। উল্লসিত। যেন জয় করেছে গোটা দুনিয়া। তাদের পেছনে হাঁটছে সবুজ ব্লেযার পরা গার্ডরা।

একবার ব্যাটলমেন্টের দিকে তাকাল রানা। এমন ভঙ্গি নিয়েছে, এইমাত্র নেমেছে কোনও গাড়ি থেকে।

এদিকে চেয়ে নেই গার্ডরা। হনহন করে হেঁটে ভিড়ে মিশে গেল রানা। নিজেও উত্তেজিত। লড়তে বা দৌড়াতে হতে পারে, তাই তৈরি। বুঝতে পারছে, দুর্গের আঙিনায় আছে বলে কেউ জানতে চাইবে না কেন ও এখানে। তবুও সবুজ ব্লেযারের কারও সন্দেহ হলে, সেক্ষেত্রে চেষ্টা করবে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যেতে।

চিৎকার করে থামতে বলল না কেউ। একবার কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখল এক তরুণ, তারপর আবার মনোযোগ দিল পাশের তরুণের কথায়। বড় করে শ্বাস ফেলল রানা। আর সবার সঙ্গে ঢুকে পড়ল পিরামিডের ভেতর।

নাদির ও তার দলের কাউকে লবিতে দেখল না।

গার্ড এদিকে বেশি।

আপনারা দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন, সবার কথার ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে বলল এক গার্ড। একটু পরেই খুলে দেয়া হবে মন্দির। ওই একই কথা বলা হলো ফ্রেঞ্চ ও আরবি ভাষায়। ভিড়ের বাইরের কিনারায় রয়ে গেল রানা। চট করে বেরোতে হলে কোন দিকে যাবে, দেখে নিয়েছে। একটু সামনেই কাঁচের এলিভেটর। সামান্য দূরে ফ্রস্টেড কাঁচের বিশাল দুই কবাটের গেট। বোধহয় ওদিক দিয়ে ঢুকতে হয় মন্দিরে। দূরপ্রান্তে দুপাশে ছোট দুটো দরজা। এলিভেটর ছাড়াও কোনও সিঁড়ি থাকবে, ভাবল রানা। ওটা খুঁজতে হবে।

কয়েক মিনিট পর এল আরও একদল তরুণ-তরুণী। তার পর পরই এল আরও অনেকে। লবিতে গিজগিজ করছে অন্তত দু শজন তরুণ-তরুণী। মানুষের চাপ কমাতে প্রথমে আসা দলের সবাইকে নেয়া হলো একপাশের এক দরজা দিয়ে। তাদের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে নেই রানার। একটু দূরেই এক গার্ড। সে একবার সামান্য সময়ের জন্যে চোখ সরিয়ে নিলেই…

পেরিয়ে গেল দুমিনিট, তারপর ভোলা হলো মন্দিরের প্রশস্ত দরজা। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির কারণে ওদিকে ঘুরে তাকাল সবাই। ওই সুযোগে ভিড় থেকে সরে পাশের ঘোট দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল রানা। যা ভেবেছে, করিডরের শেষমাথায় স্টেয়ারওয়েল। প্রতিতলা অ্যাশার পেইন্টিঙের মত বিদঘুটে অ্যাংগেলে। নতুন করে হেডসেট পরে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল রানা।

রানা! কী হচ্ছে ওদিকে? স্ক্রিনে সিঁড়ি দেখে জানতে চাইল লাবনী। এতক্ষণ রানার জিন্সের প্যান্ট ছাড়া কিছুই দেখতে পায়নি ওরা।

অনুসারীদের নিয়ে সম্মেলন করছে নাদির।

জানি। তিনটে বাসে করে গেছে। কিন্তু তুমি কী করছ? বা কী করবে এখন?

আগেই বলেছি, উড়িয়ে দেব ওদের ল্যাব।

কী দিয়ে? তোমার সঙ্গে তো বিস্ফোরক নেই। এমন কী পিস্তলও নেই!

দরকার হলে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

ওই বাঙালি যুবক কিছুই তোয়াক্কা করে না, এটা বুঝতে পেরে গাল কুঁচকে ফেললেন ডক্টর হামদি। তার পাশে এসে থামল এএসপিএস সৈনিকদের একজন। খুব চিন্তিত চেহারা তার। কিছু বলবে? জানতে চাইলেন হামদি।

ভ্যানের ইকুইপমেন্ট কেসের তূপের দিকে আঙুল তাক করল লোকটা। স্যর, গায়েব হয়েছে আমাদের দুই প্যাক সি-ফোর!

সি-ফোর? জানতে চাইল বেলা।

সৈনিকের দিকে হাঁ করে চেয়ে আছেন হামদি।

সি-ফোর এক ধরনের এক্সপ্লোসিভ, জানাল লাবনী। ওই কেস থেকে সরে বসল বেলা।

সেট-আপ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তখন ওগুলো নিয়েছি, হামদিকে জানাল রানা। এতই স্বাভাবিকভাবে বলেছে, যেন চেয়ে নিয়েছে একটা পেন্সিল ব্যাটারি।

মিস্টার রানা! পাগল হয়েছেন? প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন হামদি। ওখানে বিস্ফোরণ হলে, মিশরের সরকারের ঘাড়ে চাপবে সব দোষ!

তা হলে সঙ্গে সি-ফোর এনেছেন কেন? নিরীহ সুরে জানতে চাইল রানা।

চোর-চোর চেহারা করলেন ডক্টর হামদি। বিকল্প হিসেবে এনে থাকতে পারে সৈনিকরা।

আমিও ব্যবহার করব একই বিকল্প, মৃদু হেসে বলল রানা, আপনাদের কূটনীতির বারোটা বাজবে বায়োওয়েপন নাদির ছড়িয়ে দিলে। সে কারণেই সি-ফোর ধার নিয়েছি। দুটো চার্জেই কাজ হওয়ার কথা। ওপরে গিয়ে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দেব। মুরকে নিয়ে বেরিয়ে আসব। উড়ে যাবে পিরামিডের ওপরের অংশ। আমরা সরে গেলে কেউ দোষ দেবে না আপনাদেরকে…

সবাই স্ক্রিনে দেখল, একটা ল্যাণ্ডিঙে পৌঁছে গেছে রানা। সামনেই অফিস লেভেল। এইমাত্র খুলে গেছে দরজা।

রানাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে এক গার্ড!

লোকটাকে দেখে মোটেও বিস্মিত নয় রানা।

সামলে নেয়ার আগেই গার্ডের কণ্ঠার ওপর ঘুষি বসাল বিসিআই এজেন্ট। এক পা পিছিয়ে গেল লোকটা, তখনই নাকে নামল মারাত্মক আরেক ঘুষি। ঠাস করে দরজার কবাটে বাড়ি খেল গার্ডের মাথার পেছনদিক। এতই জোরে লেগেছে, ধুপ করে মেঝেতে পড়ল সে। এক সেকেণ্ড পর রানার বাম পায়ের লাথি পড়ল তার মুখের ওপর। খটাং করে মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল বেশ কটা দাঁত। বোধহয় সেই ব্যথাতেই অজ্ঞান হলো গার্ড।

দুপা ধরে তাকে অফিসে টেনে নিল রানা।

অফিসে কেউ নেই। জ্বলছে অল্প ওয়াটের বাতি। কাঁচের দেয়ালের ওদিকে স্ক্রিন সেভারের আলো। আগেই আজকের মত কাজ শেষ করে বিদায় নিয়েছে ওসাইরিয়ান সাবসিডিয়ারি কোম্পানির লোক। অথবা, আছে টেম্পলের অনুষ্ঠানে। আপাতত কারও এদিকে আসার কথা নয়।

রানা! তুমি ঠিক আছ… বলতে শুরু করেছিল লাবনী…

কিন্তু সুযোগ না দিয়ে বলল রানা, আমি ভাল থাকব না তো কে থাকবে? দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে গার্ডকে দেখছে ও। ওই লোক উচ্চতায় ওর চেয়ে ইঞ্চি খানেক বেশি।

.

ছিহ, মাসুদ ভাই? আপত্তির সুরে বলল বেলা। জানতাম না আপনি এমন বাজে চোর! মানুষকে উলঙ্গ করে সব নিয়ে যান! অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ফেলল ও।

কয়েক টানে অচেতন গার্ডের পোশাক খুলে ফেলেছে রানা। তারপর মনে পড়েছে লাবনী ও বেলার কথা। তখন আপত্তিকর দৃশ্য থেকে মেয়েদেরকে রক্ষা করতে সরিয়ে দিয়েছে ক্যামেরার চোখ। ওটা এখন দেখছে ছাত।

এবার কী করবে? জানতে চাইল লাবনী।

সেটাই ভাবছি। খস্-খস্ আওয়াজে পোক ছাড়ছে রানা। পুরো দেড় মিনিট পর আবার দৃশ্য দেখাল ক্যামেরা। এখন রানার পরনে গার্ডের পোশাক, হাতে পিস্তল।

ধরতে পারলে কিন্তু খুন করে ফেলবে, কেঁপে গেল লাবনীর কণ্ঠ।

আগে ধরুক তো!

 ঝুঁকি নিয়ো না, রানা!

তুমি তো জানো, কক্ষণো ঝুঁকি নিই না। ক্যামেরায় দেখা দিল রানার হাসিমুখ। ডক্টর হামদি, আপনার ছেলেদের বলুন রেডি হতে। ধরে নিন, ঝামেলা হবেই। শুধু টিয়ার গ্যাস বা মরিচের ঝাঁঝ দিয়ে কাজ হবে না।

বুঝেছি, বললেন অসন্তুষ্ট ডক্টর হামদি। এক সৈনিকের দিকে মাথার ইশারা করলেন। কেস থেকে বের করতে লাগল সৈনিকরা এফএন পি-নাইন্টি সাবমেশিন গান। লাবনী ও বেলার উদ্দেশে বললেন হামদি, এটাও বিকল্প। আশা করি ব্যবহার করতে হবে না।

নির্ভর করে নাদিরের ওপর, বলল রানা। নতুন পাওয়া সবুজ ব্লেযারের পকেটে রেখে দিল পিস্তল। পাশের পকেটে গেল সি-ফোর ও রেডিয়ো ডেটোনেটর। এবার রানা এজেন্সির ছেলেদের উদ্দেশে বাংলায় বলল, আমি রেডি। তোমরাও রেডি হও।

আগেই দলের সবাইকে নিয়ে পাশের গাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে শাহেদ কামাল। হাতের কাছেই এমপি-সেভেন সাবমেশিন গান। মনিটরে দেখছে রানাকে। জানিয়ে দিল, আপনি সিগনাল দিলেই মাঠে নামব আমরা, মাসুদ ভাই।

আবার স্টেয়ারওয়েলে ফিরেছে রানা। ওপর বা নিচ থেকে আসছে না কোনও আওয়াজ। জানার উপায় নেই ঠিক কতক্ষণ পর গার্ডকে খুঁজবে কেউ। জলদি কাজ সেরে বেরিয়ে যেতে হবে, তাই দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল পিরামিডের ওপরতলায়।

সামনের করিডরে এলিভেটরের জন্যে অপেক্ষা করছে এক লোক। স্টেয়ারওয়েল ডোর পেরিয়ে রানা আসতেই অলস চোখে ওকে দেখল সে। দ্বিতীয়বার তাকাল। রানার মনে হলো না সে খুব সতর্ক। তবে, ওকে দেখে যে কারণেই হোক, চিন্তায় পড়ে গেছে। মৃদু মাথা দোলাল রানা। ইয়ারপিস আড়াল করতে একদিকে সরিয়ে রেখেছে মুখ। এলিভেটর পৌঁছে যেতেই উঠে পড়ল লোকটা, ফিরেও পেছনে তাকাল না।

পরের ঘরে ঢুকে ইস্টের কড়া গন্ধ পেল রানা। একটু দূরেই কাঁচের দেয়াল। পিরামিডের চূড়া থেকে সামান্য নিচেই এই ল্যাব। চোখা ছাতের শীর্ষে আকাশের ধ্রুবতারার দিকে তাক করা হয়েছে শক্তিশালী এক স্পটলাইট।

ল্যাবে মানুষ বলতে মাত্র একজন। রানার দিকে পিঠ দিয়ে দেখছে ওয়ার্কবেঞ্চে রাখা স্টেইনলেস স্টিলের কনটেইনমেন্ট ফ্লাস্ক। ঘরে একইরকম অনেক সিলিণ্ডার। প্রতিটার গায়ে সিল করা বায়োহ্যায়ার্ড সিম্বল।

অন্তত পঞ্চাশটা ওই জিনিস, চাপা স্বরে বলল রানা।

হায়, আল্লা! বিড়বিড় করল লাবনী, অনুষ্ঠান নয়, মস্তবড় পরিকল্পনা করেছে নাদির মাকালানি। দুনিয়ার নানান দেশ থেকে নিজের অনুসারীদের ডেকে এনেছে। তারা আবার সঙ্গে করে নিয়ে যাবে বিষাক্ত বীজগুটি!

এত তাড়াতাড়ি এসব করা সম্ভব? বিস্ময় নিয়ে বললেন ডক্টর হামদি। মাত্র চারদিন হলো ওসাইরিসের পিরামিড থেকে ফিরেছে নাদির মাকালানি!

ল্যাবে চোখ বোলাল রানা। ইস্ট উৎপাদনের জন্যে ওদিকে বড় বড় ভ্যাট। আরেক পাশে ইস্ট শুকিয়ে বীজগুটি পাওয়ার জন্যে আভেন। একদিকে কাঁচের কেবিনেটে রাখা ক্যানোপিক জার। মুখ এখন ভোলা। ক্ষমতা আর টাকার জন্যে উন্মাদ হয়ে গেছে নাদির। আভেনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে কমপ্রেস গ্যাসের ট্যাঙ্ক। বিস্ফোরণের জন্যে ওই জায়গাটা ভাল।

কিন্তু সেক্ষেত্রে আগে ঢুকতে হবে ওদিকের ঘরে।

ল্যাবের দরজায় কি-কার্ড লক। দুর্ঘটনা হলে আটকে রাখবে বায়োহ্যায়ার্ড ম্যাটার। পিস্তলের গুলিতে দাগও পড়বে না ওই কাঁচে।

মাসুদ ভাই, ঢুকবেন কী করে? বেলার কণ্ঠ শুনল রানা। ততক্ষণে দরজার কাছে পৌঁছে গেছে ও। একহাতে হ্যাণ্ডেল ধরে আরেক হাতে নক করল।

পুরু কাঁচের ওদিকে গেল না আওয়াজ।

আগের চেয়ে জোরে টোকা দিল রানা।

 এবার ওর দিকে মনোযোগ দিল বিজ্ঞানী।

দরজা খুলুন, নীরবে মুখ নাড়ল রানা। লোকটা যেন এগিয়ে আসে, সেজন্যে হাতের ইশারা করছে।

ভুরু কুঁচকে ফেলল বিজ্ঞানী। কী যেন বলল। কণ্ঠ প্রায় শোনাই গেল না মোটা কাঁচের কারণে। লিপ রিডিং জানে রানা, কিন্তু বুঝল না কোন ভাষায় কথা বলছে লোকটা। তাতে হাল ছেড়ে না দিয়ে হাসল রানা। বারকয়েক মাথা দোলাল।

আরও কুঁচকে গেল বিজ্ঞানীর ভুরু। ভীষণ বিস্মিত সে। লকের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিল কি-কার্ড। পিছলে আরেক পাশে সরল দরজা। হ্যাঁ, কেমন আছ, দোস্ত! খাস বাংলায় বলল রানা।

এবার ইংরেজিতে বলল বিজ্ঞানী, কী বললে? কথায় জার্মান সুর।

বলেছি, তুমি শালা ভুল করে ফেলেছ, বলল রানা। লোকটাকে বিস্মিত হওয়ারও সুযোগ দিল না ও। দুহাতে মাথাটা ধরে নামিয়ে এনে ঠাস্ করে ঠুকে দিল দরজার হুড়কোর ওপর। নিশ্চিন্তে অচেতন হয়েছে বিষ-বিজ্ঞানী।

ওই লোককে ফেলে সরে যাবে? জানতে চাইল লাবনী। ল্যাব বেঞ্চের পেছনে অজ্ঞান বিজ্ঞানীকে গুঁজে দিল রানা। তুমি না উড়িয়ে দেবে ল্যাব?

কঠোর শোনাল রানার কণ্ঠ, বায়োওয়েপন তৈরি করছিল, কাজেই ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার মানসিকতা নেই আমার। তবুও যাওয়ার আগে একতলা নিচে ফেলে যাব। খুশি হয়েছ?

খুশি হব তুমি আস্ত শরীরে বেরোলে, বলল লাবনী।

গ্যাস ট্যাঙ্কের দিকে মনোযোগ দিল রানা। ওগুলোর মাঝে সরু সব জায়গা। ডেটোনেশন সার্কিট চালু করে সিগারেটের প্যাকেট আকৃতির একটা সি-ফোর রেখে দিল সরু একটা জায়গায়। কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা নাড়ল।

কী হলো? জানতে চাইল লাবনী।

প্রথমেই যে-কারও চোখ পড়বে, বলল রানা। দেখছে ট্যাঙ্কের পাশে খোলা বিশাল স্টিলের আভেন। একটার পেছনে হাত দিয়ে পেল ফুটোওয়ালা গ্যাস পাইপ। ওদিকটা কাদাটে ও তেলতেলে। সি-ফোর রাখার জন্যে যথেষ্ট জায়গা আছে ওখানে। সার্কিট চালু করে দ্বিতীয় বোমাটা রাখল রানা। কাজ শেষ।

এবার তবে বেরিয়ে এসো? অনুরোধের সুরে বলল লাবনী।

আপত্তি নেই, বলল রানা। বেঞ্চের পাশে গিয়ে তুলল বিজ্ঞানীর দুহাত, তারপর টেনে নিয়ে চলল। এবার পিরামিড থেকে বেরিয়ে উড়িয়ে দেব ব্যাটাদের ল্যাব।

কিন্তু টেম্পলে যারা রয়ে যাবে? জানতে চাইল বেলা। খুন হয়ে যাবে না তারা?

কষ্ট পেতাম না এরা খুন হলে, বলল রানা, ভয় পেয়ে, কয়েক তলা নিচে আছে বলে ক্ষতি হবে না তাদের। হেঁচড়ে দরজার কাছে বিজ্ঞানীকে নিল। অবশ্য, এখান থেকে বেরিয়ে দেখবে, সাধের পিরামিডের বুক-মাথা নেই।

দেরি না করে বেরিয়ে এসো, বলল লাবনী। আসার সময় তোমার বন্ধু গিবন মুরকে আনতে ভুল কোরো না।

ওকে ভুলিনি। বিজ্ঞানীর কি-কার্ড ব্যবহার করে দরজা খুলল রানা। টেনে বের করল অচেতন লোকটাকে। তবে বড় বেশি ভারী। ফেলে গেলেই বাঁচত আমার কাঁধদুটো! সামনের দরজার কাছে পৌঁছে একহাতে কবাট খুলে লবিতে বেরোল। কিন্তু তখনই শুনল মিষ্টি একটা আওয়াজ।

এলিভেটর!

বিজ্ঞানীকে ফেলেই পিস্তল বের করতে গেল রানা, কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ওর।

সিঁড়িঘর থেকে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দুই গার্ড। মাল তাক করেছে রানার বুকে। এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই বেরোল আরও দুজন সশস্ত্র লোক।

আবু তালাত আর লা ভার্নে!

চারজনের বিরুদ্ধে গোলাগুলি করতে গেলে খুন হবে, বড় করে একবার দম নিয়ে পিস্তল হাত থেকে ফেলে দিল রানা।

এবার এলিভেটর থেকে বেরোল নাদির মাকালানি। রাগে তিরতির করে কাঁপছে মুখের ক্ষতচিহ্ন। ভয়ঙ্কর হাসি ফুটল তার মুখে। মাসুদ রানা… একেবারে ঠিক সময়ে চলে এসেছ আমাদের অনুষ্ঠানে… গুড!

.

একটু আগে আবারও এই জিপগাড়িতে এসে বসেছে শাহেদ কামাল। কালো হয়ে গেছে মুখ। আতঙ্ক নিয়ে মনিটরের দিকে চেয়ে আছে লাবনী। ক্যামেরার ফিল্ড অভ ভিউ হাত দিয়ে বন্ধ করল নাদির মাকালানি। কেটে গেল লিঙ্ক।

শাহেদ ভাই, ওরা ধরে ফেলেছে রানাকে! প্রায় কেঁদে ফেলল লাবনী।

আপনারা আমাদের সঙ্গে আসবেন? ডক্টর হামদির দিকে তাকাল শাহেদ।

সম্ভব নয়, হতাশ সুরে বললেন ডক্টর, যোডিয়াক আছে না জানা পর্যন্ত ওখানে হামলার অনুমতি নেই এএসপিএস এর।

গিবন মুর বলেছেন ওটা ওখানেই আছে, জোর দিয়ে বলল বেলা। ওটাই তো যথেষ্ট প্রমাণ।

যথেষ্ট নয়, বললেন হামদি। মিস্টার রানা বলেছিলেন দেখবেন ওটা সত্যিই ওখানে আছে কি না। সেক্ষেত্রে হামলা করব আমরা।

জিপগাড়ি থেকে নেমে চিন্তিত চোখে লেকের দিকে চেয়ে আছে শাহেদ কামাল। আগেও বহুবার মস্তবড় সব বিপদ থেকে একা বেরিয়ে এসেছে মাসুদ রানা। সুযোগ্য বিসিআই এজেন্ট। শাহেদকে বলে গেছে, একেবারে বাধ্য না হলে সিগনাল দেবে না। সঙ্গে আছে গোপন মাইক্রোফোন। চাইলে ওদেরকে ডাকতে পারে।

শাহেদ কামালের পাশে থামল লাবনী। এখন কী করবেন ভাবছেন?

মাসুদ ভাই সিগনাল দেবেন, কথা সেরকমই হয়েছে, আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল কামাল, তবে তিনি কিছুক্ষণের ভেতর বেরিয়ে না এলে আমরা ঢুকব ওখানে।

লাবনী চট করে হেডসেটের চ্যানেল পাল্টে নিল। মিস্টার মুর! শুনতে পাচ্ছেন? মিস্টার মুর!

কাপড়ের খসখস আওয়াজ হলো। হ্যাঁ, বলুন।

ওরা ধরে ফেলেছে রানাকে! বেরিয়ে আসুন ওখান থেকে! অন্য চিন্তা আসতেই বলল লাবনী, আপনার কাছে তো ফোন আছে! পারবেন যোডিয়াকের ছবি তুলতে? সেক্ষেত্রে হামলা করবে ইজিপশিয়ান ফোর্সও।

আতঙ্কে কাঁপল নায়কের কণ্ঠ, একমিনিট! মাই গড! মিস্টার রানাকে ধরে ফেলেছে? তা হলে তো আমিও গেছি!

আমার কথা শুনুন, মিস্টার মুর! গলা শান্ত রাখতে চাইল লাবনী। আপনি যান মিশরীয় আর্টিফ্যাক্টের ঘরে। যোডিয়াকের ছবি তুলে পাঠান। তা হলে আপনাকে আর রানাকে বের করে আনবে রানা এজেন্সির এজেন্ট ও মিশরীয় সৈনিকরা। ঘুরে মিশরীয় জিপগাড়ির দিকে তাকাল লাবনী। গলা উঁচু করে জানতে চাইল, ফোনের ছবি হলে চলবে?

শোগান থেকে নেমে এসেছেন ডক্টর হামদি। হেডসেটে শুনছিলেন কথা। মাথা দোলালেন।

হ্যাঁ। ছবি পেলেই হবে।

জুতোর আওয়াজ শুনল লাবনী। পরক্ষণে হুম্ শব্দ হলো। কাপড় লেগেছে মুরের মাউথ পিসে। চমকে গিয়ে প্যান্টের পকেটে ফোন রেখে দিয়েছে সে। কে যেন আসছে!

 খট করে খুলে গেল দরজা। বলে উঠল কেউঃ মিস্টার মুর?

ই-ইয়েস?

এখুনি অনুষ্ঠান শুরু হবে, আমাদের সঙ্গে আসুন।

আপনাদের তিনজনের সঙ্গে যেতে হবে? ঠিক আছে। ব্যক্তিগত এসকোর্ট? সম্মানিত বোধ করছি!

লাবনী ও শাহেদ বুঝল, কৌশলে নায়ক জানিয়ে দিল, তাকে নিয়ে যাচ্ছে তিন গার্ড। উপায় নেই যে যযাডিয়াকের ছবি তুলবে সে।

আপনাদের মাসুদ ভাই সিগনাল দেবেন, সেজন্যে অপেক্ষা করবেন? উচিত হবে সেটা? বলল লাবনী।

দ্বিধায় পড়ে দুর্গের দিকে তাকাল শাহেদ কামাল। আসতে পারল না কোনও সিদ্ধান্তে। ওর দিকে চেয়ে আছে জামিল হোসেন, টগর চৌধুরি ও নাফিস আহমেদ।

.

ল্যাব থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এল এক গার্ড, হাতে সি ফোর প্যাক। আমরা এটা পেয়েছি।

রানার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া রেডিয়ো ডেটোনেটর দেখল নাদির মাকালানি। এক্সপ্লোসিভ? বাজে জিনিস। তোমার মত লোকের কাছ থেকে এর চেয়ে ভাল কিছু আশা করিনি, মাসুদ রানা।

বলতে পারো হাল ছাড়ার লোক নই, দূরের দেয়াল দেখছে রানা। ভুলে যেতে চাইছে ওই ঘরে আভেন আছে। দ্বিতীয় বোমা খুঁজে বের করা কঠিন। তবে ডেটোনেটর মাত্র একটা, নাদির হয়তো ভাববে, বোমাও মাত্র একটা।

কিন্তু এরা বোমা খুঁজে না পেলেও বাড়তি সুবিধা পাবে না রানা। সি-ফোর ভাল বোমা। ভেতরের ব্লাস্টিং ক্যাপে প্রচণ্ড তাপ ও ঝাঁকি না লাগলে চট করে ফাটবে না। ল্যাব ধ্বংস করতে হলে চাই ওই ডেটোনেটর। কিন্তু আপাতত নাদিরের কাছ থেকে ওটা আদায় করতে পারবে না।

জানলে কী করে যে আমি এখানে? মিশরীয় ধর্মগুরুর মন ডেটোনেটরের দিক থেকে সরাতে চাইল রানা। নষ্ট না হলে প্রথম সুযোগেই জিনিসটা ব্যবহার করবে ও।

রানার সবুজ ব্লেযার দেখাল নাদির। গায়ে ঠিকভাবে লাগেনি। কাদির সবসময় পোশাক ঠিকঠাক রাখত। বলত, যাতে টেম্পলের সিকিউরিটি ফোর্সের ইউনিফর্ম সবসময় ফিটফাট থাকে। আরও সব সুবিধা আছে ভাল পোশাকের। তোমার গায়ে ব্লেযার দেখেই যে-কেউ বুঝবে, ওটা তোমার নয়।

মাথা দোলাল রানা। ঠিক কথাই বলেছ, দুমুখো।

চোয়াল দৃঢ়বদ্ধ হলো নাদিরের। অবশ্য, সামলে নিল নিজেকে। আবুর দিকে তাকাল। তাতে রানার কাঁধের ওপর সজোরে পিস্তলের নল নামাল লোকটা। তীব্র ব্যথা পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল রানা।

ওকে বলতাম তোমাকে খুন করতে, কিন্তু আরও ভাল বুদ্ধি এসেছে।

কথাটা শুনে ঘাড়ের কাছে শিরশির করে উঠল রানার।

তিনজন মিলে সার্চ করল ওকে।

জুতো খুলে নিয়ে ভালভাবে ঝাঁকিয়ে দেখল। টোকা দেয়া হলো সোলে। গোড়ালির দিকে ফাপা আওয়াজ পেয়ে রানার দিকে চেয়ে হাসল ভার্নে। ওখানে গুঁজে রাখা হয়েছে প্লগের মত কিছু একটা। ওটা খুলতেই পেল মাইক্রোফোন। নাদিরকে ওটা দেখাল গণ্ডার, তারপর নীরব নির্দেশ পেয়ে বুটের নিচে পিষে দিল মাইক্রোফোন। হাসছে। সিআইএতে ছিলাম। তোমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানি, বুঝলে?

শাহেদ কামালের সঙ্গে যোগাযোগের আর উপায় নেই।

দুহাত ধরে রানাকে টেনে তোলা হলো। ল্যাব থেকে বেরোল আরেক গার্ড। আর কিছু পেলাম না, বস্।

সি-ফোরের ঢেলা দেখল নাদির। এই একটাই যথেষ্ট ছিল। আবারও ডেটোনেটরের দিকে তাকাল। ডিভাইস থেকে ব্যাটারি নিয়ে বুটের নিচে ফেলে চুরমার করে দিল ওটাকে।

মাস্টারের হোমওয়ার্ক না করা ছাত্রের মত মুখ কালো করেছে রানা। এখন বোমা ফাটাতে হলে তা করতে হবে নিজ হাতে। সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণে মরবৈ ও। কারণ, ওই প্যাকে কোনও টাইমার নেই।

রানার বিমর্ষ চেহারা দেখে বলল ধর্মগুরু, ব্যাকআপ প্ল্যান নেই, না? শীতল হাসল। আমার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বহু দূর থেকে এসেছ, রানা। তাই আপত্তি নেই তুমি অনুষ্ঠানে অংশ নিলে।

.

৩০.

হাতদুটো পেছনে যিপ-টাই দিয়ে আটকে, ঘাড়ে অস্ত্রের খোঁচা মারতে মারতে রানাকে নিয়ে যাওয়া হলো টেম্পলে।

প্যারিসের অডিটোরিয়ামের চেয়ে বহু গুণ সুন্দর এই টেম্পলের ভেতরটা। দরজা পেরিয়ে কাঁচ ও স্টিলের স্টেয়ারকেসের মাধ্যমে কূপের মত গভীর এক জায়গায় জড় হয়েছে নাদির মাকালানির অনুসারীরা।

রানার মনে হলো ওটা ষাঁড়ের লড়াইয়ের এরিনা। গুঞ্জন তুলছে অন্তত তিন শ তরুণ-তরুণী। তাদেরকে দুভাগে ভাগ করেছে একটা পথ। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ ব্লেযার পরা একদল গার্ড। দূরে সরু সিঁড়ি উঠেছে চওড়া ক্যাটওয়াকে। সামনে বেড়ে আছে উঁচু এক কালো মার্বেলের স্টেজ। চার কোণে চকচক করছে ক্রোম পালিশ করা চারটে ইজিপশিয়ান দেবতার মূর্তি। ফ্রস্টেড গ্লাসের প্যানেলে তৈরি চারপাশের দেয়াল। তাতে লেসার দিয়ে খোদাই করা হায়ারোগ্লিফিক্স।

জায়গাটা রক স্টেডিয়ামের মত, তবে কেন যেন অশুভ মনে হলো রানার। কয়েকজন গার্ড রানাকে ঠেলে নামিয়ে দিল গভীর কূপের মেঝেতে। অস্ত্রের নলের গুঁতো খেয়ে এগোল রানা। সামনের রেলিংহীন সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠল স্টেজে। সামনে বন্দি দেখে হৈ-হৈ করে উঠেছে তরুণ তরুণীরা। জোর দাবি জানানো হলো, যেন প্রাণ নেয়া হয় অবিশ্বাসী যুবকের। স্টেজে ক্রোম ও কাঁচের তৈরি বলির বেদি। রানা টের পেল, হঠাৎ করেই শুকিয়ে গেছে ওর বুকের ভেতরটা।

ওকে একপাশে সরিয়ে নিল গার্ডরা। সুযোগ এলে কোন্ পথে পালাবে, সেজন্যে চারপাশ দেখছে অসহায় রানা। বেরোবার উপায় হতে পারে ওই কূপে নেমে যাওয়া, অথবা স্টেজের পেছনের জোড়া কবাটের দরজা ব্যবহার করা। দুই কবাটের পাশে দুটো করে বড় মূর্তি। দেখলে প্রথমে মনে হয় ওসাইরিসের, কিন্তু মূর্তির ঘাড়ে মানুষের বদলে ঘোড়া ও শেয়ালের মিশ্রণে অদ্ভুত কোন জন্তুর মাথা। ভয়ঙ্কর চেহারা।

ওই মূর্তি দেবতা সেট-এর।

মাত্র চারদিনে টেম্পলের সবই বদলে নিয়েছে নাদির মাকালানি। কেন দূরের দরজা দিয়ে ভক্তদের এখানে আনা হয়েছে, তা বুঝে গেল রানা। উত্তরদিকের জোড়া কবুটের দরজা শুধু রাজপুরুষের জন্যে। এটাই ছিল প্রাচীন মিশরের নিয়ম। নিজ মন্দিরে একই আইন জারি করেছিল কাদির ওসাইরিস। যেহেতু নিজেকে রাজপুরুষ বলে মনে করে, তাই এই নিয়ম বদল করেনি নাদির।

পেরোতে লাগল সময়। অধৈর্য হয়ে উঠছে ভক্ত অনুসারীরা। তারপর কমল সব বাতির প্রভা।

খুলে গেল দরজার দুকবাট। পিরামিডের আলাদা তিনটে পথে হাজির হলো নাদির মাকালানি, আবু ও ভার্নে। তাদেরকে দেখে সবাইকে চুপ করতে ইশারা করল গার্ডরা।

কিন্তু সেট! সেট! সেট! বলে চিৎকার করতে করতে হাতদুটো মাথার ওপরে তুলল ভক্তরা। বাতাসে ঘুষি চুড়ছে অনেকে। সেট! সেট! সেট!

স্পটলাইট পড়ল নাদিরের ওপর। থমকে দাঁড়িয়ে গেছে সে। তিন সেকেণ্ড পর উঠল স্টেজে। কিছুক্ষণ আগে রানার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছে তার, তখন পরনে ছিল দামি কিন্তু সাধারণ সুট- কিন্তু এখন পরনে ইজিপশিয়ান রাজকীয় পোশাক- সবুজ-কালো আলখেল্লা। মাথায় বিশাল এক মুকুট। এ জিনিসই ব্যবহার করত ফেরাউনরা। নাদিরের পেছনে আঘোছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে আবু আর ভার্নে।

নাদিরকে দেখে পাগল হয়ে উঠেছে তরুণ-তরুণীরা। আকাশে ছুঁড়ছে হাত, পা ঠুকছে মেঝেতে। মৃদু কাঁপছে স্টেজ। সেট! সেট! সেট!

বড়ভাইয়ের মতই পীর-দরবেশের ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলল নাদির। কয়েক সেকেণ্ডে কমল সব আওয়াজ। সেটের ভক্তরা! লাউড স্পিকারে গমগম করে উঠল নাদিরের কণ্ঠ। এমন কী তার মুকুটেও আছে মাইক্রোফোন। স্বাগতম! শেষ হয়েছে ওসাইরিসকে তোষণ। সত্যিই এসেছে নতুন শুভ দিন। এখন পৃথিবীতে নেই ওসাইরিস। ফিরেছি আমি, সত্যিকারের নেতা! আবারও ফিরে এসেছি! আমি পরাক্রমশালী সেট! এবার দেখিয়ে দেব দুনিয়াকে, আসলে কত ক্ষমতাশালী হয় সত্যিকারের দেবতা!

এ কথা শুনে খুশিতে প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠল তরুণ তরুণীরা। এমন কী খেপে উঠল গার্ডরা। কী কারণে ওকে স্টেজে আনা হয়েছে, সেটা ভুলে যেতে চাইছে রানা। এই সুযোগে হাতের বাঁধন পরীক্ষা করল। বুঝল, দশ মিনিটেও খুলতে পারবে না ওই জিনিস। এইমাত্র ওর পিঠে জোর এক খোঁচা দিয়েছে এক গার্ড। হুঁশ টনটনে তার।

আবারও সবাইকে নীরব হতে ইশারা দিল নাদির মাকালানি। উঠানে তার সঙ্গে যে বিজ্ঞানী ছিল, সে উঠে এল মঞ্চে। হাতে কনটেইনমেন্ট ফ্লাস্ক। কুর্নিশ করল নাদিরকে, তারপর জিনিসটা তুলে দিল মনিবের হাতে। পিছিয়ে চলে গেল আঁধারে।

এই জিনিস, নিচু গলায় বলল নাদির, আমাদেরকে দেবে প্রচণ্ড ক্ষমতা। এটাই ছড়িয়ে দেবে সেট-এর মন্দিরের বাণী। এই কন্টেইনারের ভেতর… মাথার ওপর ফ্লাস্ক তুলল সে। আছে সাক্ষাৎ মৃত্যু! যারা আমার বিরুদ্ধে যাবে, এ মৃত্যু তাদের! অবিশ্বাসীরা বাঁচবে না প্রাণে! যারা প্রতাপশালী সেটের সামনে মাথা নিচু করবে না, মৃত্যু তাদের!

আবারও পাগল হয়ে উঠল তরুণ-তরুণীরা।

রানা টের পেল, আগের চেয়ে কমেছে উৎসাহ। অন্তত চারভাগের একভাগ ভক্ত চাইছে না দুনিয়া জুড়ে গণহত্যা চালানো হোক।

ফ্লাস্ক নিচে নামিয়ে নিল নাদির। এই কন্টেইনার প্রথম লটের। তোমরা যখন এখান থেকে বিদায় নেবে, সঙ্গে থাকবে একটা করে এই জিনিস। দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে দেবে এটা। আর আমাদের শত্ররা যখন টের পাবে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে তাদের। পরে বুঝবে, তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। সাক্ষাৎ মৃত্যু। বাঁচার একমাত্র উপায় সেটের কাছে জীবন ভিক্ষা চাওয়া! একমাত্র সেট পারে সবাইকে বাঁচাতে! তবে তোমরা, সেটের অনুরক্তরা, কিছুই হবে না তোমাদের! সেটের পাউরুটি রক্ষা করবে বিশ্বাসীদের! গলা চড়ে গেল নাদিরের। এখন চিৎকার করছে, যাদেরকে উপযুক্ত বলে মনে করব, শুধু তারাই পাবে ওই পাউরুটি অন্যরা মরবে ক্ষুধার্ত কুকুরের মত! সত্যিই দুনিয়া জুড়ে শুরু হচ্ছে সেটের রাজত্ব!

কূপ থেকে এল প্রশংসাসূচক চিৎকার। কিন্তু আরও কমে গেছে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ। জায়গায় জায়গায় নীরব হয়েছে অনেকে। বিজ্ঞানী এগিয়ে আসতেই তার হাতে ফ্লাস্ক দিল নাদির। আবারও ফিরল অনুসারীদের দিকে। লোকটার মুখে উত্তেজনা ও রাগের ছাপ দেখল রানা।

জানি, তোমাদের কেউ কেউ ভাবছ, উচিত হবে না ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া, ভেলভেটের মত মসৃণ কণ্ঠে বলল নাদির। বড়ভাইয়ের মত মানুষের মন জয়ের শিক্ষা তার নেই। কিন্তু দ্রুত শিখছে সে। কারও আপত্তি থাকলে এখনই তা জানিয়ে দেয়া উচিত। স্টেজে ওঠার সরু সিঁড়ি দেখাল নাদির। এসো, এগিয়ে এসো এক পা। দূর করে দেব তোমাদের সব ভয়।

মিষ্টি হাসছে সে, কিন্তু চোখ কুমিরের চোখের মত শীতল, অভিব্যক্তিহীন।

কয়েকজন নড়ে উঠেছে দেখে চিৎকার করে উঠল রানা, ওকে বিশ্বাস কোরো না! নির্ঘাত খুন হবে! ওর ঘাড়ের ওপর নামল পিস্তলের নল। প্রচণ্ড ব্যথা পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও। নিচের ভিড়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। নাদির মাকালানিকে সন্দেহের চোখে দেখছে কেউ কেউ। কারও কারও চোখে রাগ ও অভিযোগ।

রানার কথা শোনার পরেও জটলা থেকে বেরিয়ে এসেছে। তেরোজন তরুণ-তরুণী। তাদেরকে মাঝের পথে সরিয়ে আনল গার্ডরা।

আর কেউ নেই? নরম সুরে জিজ্ঞেস করল নাদির। ঠোঁটে হাসি। চেপে রেখেছে আবেগ ও অনুভূতি। অনুসারীদের ওপর ঘুরছে তার চোখ। কারও আপত্তি দেখলেই আলাদা করে নেবে তাকে। কিন্তু সবার মুখ নির্লিপ্ত। কয়েক সেকেণ্ড পর গর্জে উঠল নাদির, ওই তেরোজনকে নিয়ে এসো আমার কাছে!

এই নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করছিল সবুজ ব্লেযার পরা গার্ডরা। ঘিরে ফেলল তেরোজন অবিশ্বাসীকে। পরক্ষণে শুরু হলো বেধড়ক লাথি, ঘুষি ও কিল। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে মেঝেতে শুইয়ে ফেলা হলো রক্তাক্ত তরুণ-তরুণীদেরকে।

থেমে গেল সব আওয়াজ।

থমথম করছে চারপাশ।

একেকবারে তিনজন করে আহত তরুণ-তরুণীকে টেনে তোলা হলো মঞ্চে।

মার খাওয়া মানুষগুলোর উদ্দেশে বু! বু! আওয়াজে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছে একদল নিষ্ঠুর তরুণ। আহত তরুণ তরুণীর মুখ থেকে গোঙানি শুনে হাসছে কেউ কেউ।

তাদেরকে জানোয়ার বলে মনে হলো রানার।

বেদিতে প্রথমে তোলা তিন তরুণকে। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে তাদেরকে দেখল নাদির মাকালানি। ঘুরে তাকাল ভক্তদের দিকে। আমাকে নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছ স্বীকার করেছ আমি তোমাদের দেবতা! এখন কারও উচিত নয় সন্দেহ করা! ভয় পাওয়ার অধিকারও নেই! আমিই দেব চিরকালীন জীবন! বদলে চাই চিরকালীন আনুগত্য! আমি তোমাদের দেবতা! আমি সেট!

সেট! সেট! সেট! প্রতিধ্বনি তুলল ভক্তরা।

বেদির পেছনে গেল নাদির। বেছে নিল বাঁকা ফলার বিশাল এক ছোরা। কাছের গার্ডদের উদ্দেশে মাথা দোলাল। তিন বন্দিকে বেদির ওপর আনল তারা। পুরু কাঁচের ব্লকে রাখা হলো তিন তরুণের বুক। ভীষণ ভয়ে কাঁদতে শুরু করেছে কমবয়সী ছেলেগুলো। কিন্তু কূপ থেকে এল অন্তত এক শ তরুণের দাবি খুন করা হোক, খুন!

স্পটলাইটের উজ্জ্বল আলোয় ঝিকঝিক করছে, ছোরা। ওটা ওপরে তুলল নাদির। শুরু হলো গুনগুন করে অশুভ প্রার্থনা। কিন্তু মাইক্রোফোন ছড়িয়ে দিল তা মস্তবড় কক্ষে।

হে প্রভু, রা, স্বর্গের মালিক, সম্মান নিন! আমি আপনার বীরযোদ্ধা, হে, প্রভু! আপনিই তো পৃথিবীর বুকে আমাকে করেছেন দেবতা! যাতে শাসন করি নগণ্য মানুষকে! আপনার আলো পড়েছে বিজয়ী মা নাটের ওপর, নইলে উনি তুলে রাখতে পারতেন না মস্তবড় আকাশ! জন্ম দিতে পারতেন না আমাদেরকে মহান পিতা জেব! তার দেহ আজও রয়ে গেছে। পৃথিবীর মাটির নিচে। আর আমি আপনার পুত্র, আপনার ভৃত্য… আপনার যোদ্ধা!

ছোরা আরও ওপরে তুলল নাদির। রক্তের মাধ্যমেই জানিয়ে দিচ্ছি: আপনার পথ থেকে বিচ্যুত হইনি! রক্তের অধিকারে হয়েছি পৃথিবীর মালিক! এ জীবন এবং পরজগৎ হবে আমার অধীন! যারা বিশ্বাস করবে না আপনাকে, তাদের জন্যে রয়েছে ভয়ঙ্কর শাস্তি! আমি সেট, মরুভূমি ও অন্ধকারের মালিক, আবার আমিই মৃত্যুদেবতা! আমি সেট!

গুঞ্জন তুলে প্রার্থনা করছে ভক্তরা। কেউ কেউ আকাশে মুঠি পাকিয়ে চিৎকার করছে। তাদের মাঝে গিবন মুরকে দেখল রানা। ভীষণ ভয় নিয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছে নায়ক। বুঝে গেছে, এবার গণহত্যা হবে এখানে। না পারবে লড়তে, না পালাতে। আসলে কিছুই করার নেই তার।

আমি সেট! আবারও চিৎকার করে উঠল নাদির। নিজ হাতে খতম করেছি কাপুরুষ ওসাইরিসকে! বুঝে নিয়েছি নিজের অধিকার! কারণ আমি সেট! সেট! সেট!

সাঁই করে ছোরা নামাল সে।

এক তরুণের বুক থেকে ছিটকে উঠল রক্ত। ছোরা বের করেই আবারও বুকে গাঁথল নাদির। আবারও।

শক্ত হাতে তরুণের হাত-পা আটকে রেখেছে দুই গার্ড।

মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে তরুণ। মিনিট খানেক পর একদম স্থির হয়ে গেল সে।

তিক্ত চোখে নাদিরকে দেখছে রানা।

কিন্তু কাজ শেষ হয়নি নাদির মাকালানির। পোশাকে লাগা রক্ত টপটপ করে পড়ছে মেঝেতে। প্রায় ছুটে গিয়ে পরের বন্দির সামনে পৌঁছুল সে। চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। আমিই এনে দিই ভয়ঙ্কর মৃত্যু! চিৎকার করে উঠল নাদির। ঝুঁকে পড়ে জবাই করল তরুণকে। রক্তের ফোয়ারা ছিটকে লাগল তার বুকে। ছুটে যেতে চাইছে অন্য তরুণ-তরুণীরা। প্রাণের ভয়ে জুড়েছে আর্তচিৎকার। কিন্তু কঠিন হাতে ধরা হয়েছে তাদেরকে।

একের পর এক তরুণ-তরুণীর গলা জবাই করছে নাদির! কখনও কখনও বুকে গাঁথছে তীক্ষ্ণধার ফলা। বিশ্বাসঘাতকের এ-ই হয়! কারণ আমি সেট! কারও সাধ্য নেই আমার কাজে প্রশ্ন তোলে! যারা অনুসরণ করবে আমাকে, কখনও মৃত্যু হবে না তাদের! চিরকাল বাঁচবে তারা! কারণ, আমিই সেট! অন্যরা মরবে! কারণ, আমি সেট!

.

গিবন মুরের ফোনের মাধ্যমে সব শুনছে লাবনীরা। দুহাতে মুখ চেপে ধরেছে বেলা। বড় বড় হয়ে উঠেছে দুই চোখ।

হায়, আল্লা! করুণ সব আর্তনাদ শুনে প্রায় কেঁদে ফেলেছে লাবনী। ওই লোক মানুষ খুন করছে! ঝট করে হামদির দিকে ফিরল ও। এক্ষুণি সৈনিক পাঠান!

শীতের ভেতরেও দরদর করে ঘামছেন হামদি। নিজেও কাঁপছেন ভয়ে। আমার… আমার যে সেই অথোরিটি নেই! ফোন করতে হবে মন্ত্রী সাহেবের কাছে!

সেই সময় নেই! যা করার এখনই… নাদির আবারও কথা বলে উঠতেই থেমে গেল লাবনী।

.

গিবন মুর, ডাকল নাদির মাকালানি। মন্দিরে জোরালো প্রতিধ্বনি তুলল তার কণ্ঠ। এগিয়ে আসুন, গিবন মুর! মিস্টার মুর?

জিভ শুকিয়ে গেছে বলে ব্যাঙের ডাকের মত শোনাল মুরের কণ্ঠ: আ… আমি… এখানে!

ভেরি গুড, টিটকারির সুরে বলল নাদির। আমার ভুল না হলে তোমরা সবাই চেনো মিস্টার মুরকে। কিন্তু… ভয়ঙ্কর চেহারায় হাসল সে। সে ছিল আমার বড়ভাই ওসাইরিসের ভক্ত। কাজেই দেখে নিতে হবে, সে এখন তার নতুন দেবতা খুঁজে পেয়েছে কি না।

আঁ… আমি… হ্যাঁ, তা তো ঠিকই! আমি আপনার ভক্ত, ও, সেট! বেসুরো কণ্ঠে বলল গিবন মুর, এতই বিশ্বাস করি, মরে যেতেও আপত্তি নেই!

আরও প্রমাণ চাই, বলল নাদির। উঠে আসুন মঞ্চে।

দ্বিধায় পড়ে গেছে মুর, কিন্তু পেছন থেকে তাকে ঠেলে দিল দুই পাষণ্ড তরুণ। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল নায়ক। মঞ্চে উঠে তাকাল চারপাশে। একটু দূরে মাসুদ রানা। প্রকাণ্ড মূর্তি। ছাত। সবই দেখতে রাজি মুর, কিন্তু সাহস নেই নাদিরের শীতল চোখে তাকাবে। চোখ সরিয়ে রেখেছে রক্তাক্ত লাশ ও বলির জায়গাটা থেকে।

এবার মস্তবড় সম্মান দেব আপনাকে। এগিয়ে আসুন, মিস্টার মুর, নায়কের দিকে কয়েক পা এগোল নাদির। হাতের ছোরা থেকে টপটপ করে পড়ছে রক্ত। ওটা দেখে শিউরে উঠল মুর। আপনি দেখেছেন, যারা বেঈমান, কী হয়েছে তাদের। আমার নির্দেশের এদিক ওদিক হলে কী হয়, আপনি এখন জানেন। এবার… রানার দিকে ফিরল সে। ঠোঁটে ফুটে উঠল নিষ্ঠুর হাসি। আপনি দেখবেন, সেটের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে তার পরিণতি কী হয়।

মরতে হবে সবাইকেই, নির্বিকার সুরে বলল রানা।

কথাটা পাত্তা দিল না নাদির। বাঁকা হাসল। আঙুল তুলে দেখাল রানাকে। এই লোক দাঁড়িয়েছে আমার বিরুদ্ধে! অবিশ্বাস করেছে যে চিরকালীন জীবন দিতে পারি না আমি!

এ কথা শুনে হৈ-হৈ করে উঠল একদল তরুণ।

আর তোমরা জানো, এই অপরাধের শাস্তি মাত্র একটি ভয়ঙ্কর মৃত্যু! ঝট করে গিবন মুরের দিকে ঘুরল নাদির। বেচারার নাকের কাছে তুলল ছোরা। এবার, মিস্টার মুর, আপনি প্রমাণ করবেন যে আপনি বিশ্বাসী! সেটের মন্দিরের পূজারী হলে এক্ষুণি খুন করবেন ওই লোককে!

হাঁ করেও কিছু বলতে পারল না মুর। কয়েক সেকেণ্ড পর ভয় পেয়ে বলল, ইয়ে… হা… কিন্তু… সত্যিই অনেক সম্মান দিয়েছেন, প্রভু।

এই সম্মান আপনাকে নিতেই হবে, শীতল কণ্ঠে বলল নাদির মাকালানি। আপনি তো জানেন, যারা সেটের বিরুদ্ধে যায়, তাদের জীবনে কীভাবে আসে মৃত্যু।

অভিনেতার হাতে ছোরার বাঁট গুঁজে দিল নাদির। পিছিয়ে গেল দুফুট। যেসব গার্ড ধরে রেখেছে রানাকে, ইশারা করল তাদেরকে। বেদিতে চিত করে শুইয়ে দাও মাসুদ রানাকে!

<

Super User