এক্সেলশিয়র হোটেলের চটকদার জানালার বাইরে তখনও সগর্জনে তড়পাচ্ছে ঝড়।
নাকাতার ব্যবহৃত পথটা দিয়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। ঘরের ভেতর জমাট শীতলতা। ক্লান্ত দেহে সোজা বিছানায় গিয়েছে ব্যারোনেস। রানা বাথরূম থেকে পরিচ্ছন্ন হয়ে বেরিয়ে এইমাত্র সিলিং লাইট জ্বেলেছে। ড্রেসার আয়নায় যুবতাঁকে দেখল ও। বড় বড় চোখ মেলে অবাক নয়নে রানাকে দেখছে সে।
চেকরূম থেকে সুটকেসটা ছাড়িয়েছে রানা। পরিষ্কার শার্ট ও টাই পরনে ওর। জ্যাকেট গায়ে চাপাল এবার।
রানা, ডার্লিং! এত তাড়াতাড়ি কোথায় চললে?
লুগার, স্টিলেটো ও গ্যাস বোমাটা চেক করে নিল রানা। সহি-সালামতে আছে সব কটা জিনিস। নিজের পথে, বলল রানা। এবং তোমাকেও উপদেশ দেব তাই করতে। রাস্তা দেখো, জুলি। তোমাকে একটা সুযোগ দেব আমি–তুমি ডিজার্ভ করো বলে নয়, তোমার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল বলে। বাঁকা হাসি ওর ঠোঁটে। বন্ধুত্ব-হাঃ! বন্ধুত্বের সঙ্গে সঙ্গে তুমি আরও অনেক কাজেই এক্সপার্ট। বিশেষ করে মিথ্যে বলাতে।
তড়াক করে বিছানায় সিধে হয়ে বসল ব্যারোনেস। ওর মুখের চেহারা কঁদো কাঁদো, বিস্ময়ের ও আঘাতের ধাক্কায়।
তুমি এসব কি বলছ? তোমার কি মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
গেছিল, বেবি, অল্পের জন্যে রক্ষা পেয়েছি! ভালই ঘোল খাইয়েছিলে আমাকে! কিন্তু এখন আর অভিনয় না করলেও চলবে-তোমার খেল খতম জুলি।
মৃণাল দুই বাহু বাড়িয়ে ধরল ব্যারোনেস। এসো, রানা, আমার কাছে। এসো। কি হয়েছে আমাকে খুলে বলো।
নিষ্ঠুর হাসল রানা। হ্যাঁ, আসব বৈকি। বিদ্রূপ ঝরল ওর কণ্ঠে। প্রথম। থেকেই রুডলফ ব্রিগলের সঙ্গে কাজ করছ তুমি, বলে চলল রানা। হয়তো অনেক বছর ধরেই। সঠিক জানা নেই আমার। কোনভাবে তুমি ঢুকে পড়ো জার্মান ইন্টেলিজেন্সে। ভান ধরো ঘৃণা করো তুমি ব্রিগলকে। ওই লকেটটা পরে থাকার একটাই কারণ, মিথ্যেটাকে ভিত্তি দেয়া।
প্রতিবাদ করবে বলে মুখ খুলেছিল ব্যারোনেস, কিন্তু হাত তুলে ওকে অফ করে দিল রানা। আমাকে শেষ করতে দাও। তারপর বোলো কোথায় কোথায়। ভুল করেছি। তো ব্রিগল আর তুমি পুরানো দোস্ত। কেন এবং কিভাবে, জানি না। আমি। হাল নাগাদ সব খবর ওকে জানাতে তুমি। তাই সে বুঝে যায় কড়াইতে তেল ঢালা হচ্ছে। আবারও বিচারের সম্মুখীন হতে হবে ওকে! এবং এভাবেই জানতে পারে বিসিআইয়ের এক এজেন্ট জেনেভা আসছে সোনার চিতাবাঘটা। ওর কাছ থেকে উদ্ধার করতে। ব্রিগল প্লাস্টিক সার্জারি করাতে যাচ্ছে জানতে তুমি, কিন্তু ইন্টেলিজেন্সকে জানাওনি, যদ্দিন পর্যন্ত না ভেবে বের করলে নিজেদের স্বার্থে কিভাবে এটাকে কাজে লাগানো যায়।
ঘরে পায়চারি করছে এখন রানা, ব্যারোনেসের দিকে ক্ষণে ক্ষণে চাইছে। হয় তুমি আর নয়তো ব্রিগল বুদ্ধি বের করো নকল ব্রিগল পয়দা করবে। ওই অ্যাক্টর, কি যেন নাম অ্যালফস না কি, হবে বলির পাঠা। ওকে চিনিয়ে দেবে তুমি আমাকে। বলবে ও-ই রুডলফ ব্রিগল। ওদিকে ব্রিগল, আর নাকাতা আরামে গিয়ে ব্যাঙ্কের ভল্ট সাফ করে দেবে, আমি যেহেতু ধাওয়া করছি বুনো হাঁসের পেছনে। তবে অভিনেতাটি বড় জব্বর বাছাই করেছিলে কিন্তু। পুরো নামটা কি ওর?
অ্যালফস। ক্লাউস অ্যালফস। পুরানো দিনের অভিনেতা। না খেয়ে মরছিল বুড়ো। ভুলক্রমে নয়, স্বেচ্ছায় ধরা দিল জুলি গ্রাফ। মুখের চেহারা। গোমড়া ওর।
এই তো, গুড গার্ল, হেসে বলল রানা। পুরোটা খুলে বলো দেখি এবার।
ঠোঁট কামড়াচ্ছে ব্যারোনেস। কি করবে তুমি আমাকে নিয়ে?
শ্রাগ করল রানা। আমি? কিছুই করব না। বলেছিই তো, তোমাকে একটা হেড স্টার্ট দেব। পালাতে পারবে কিনা, কোথায় পালাবে সে তুমি জানো, তবে চেষ্টা করে দেখতে দেয়ায় ক্ষতি কি?
ব্যারোনেসের চোখ ছলছল করছে। ওহ, রানা, বিশ্বাস করো আমার সব কিছু মিছে নয়। তোমাকে আমি সত্যি সত্যি ভালবেসে ফেলেছি। তুমিও কি আমাকে ভালবাসনি? একটুও না?
আমার প্রফেশনে, বলল রানা, এসব কথার কোন অর্থ বা মূল্য নেই। এবার নিজেই মিথ্যে বলল রানা। জীবনে কতবারই তো প্রেম এসেছে, কিন্তু বাঁধনে জড়ায়নি ও। হাতঘড়িতে চোখ রাখল। নাও, শুরু করো। অনেক কাজ পড়ে আছে আমার।
বেডসাইড টেবিল থেকে সিগারেট নিয়ে জ্বালল ব্যারোনেস। ধোয়া ভেদ করে চেয়ে আছে রানার দিকে। হ্যাঁ, মিথ্যুক আমি। হতেই হয়েছে। টিকে থাকার জন্যে।
আমি বিশেষ পছন্দ করতাম না আমার বাবাকে। ছোটবেলা থেকেই ছিলাম হিটলারের উগ্র সমর্থক। কিন্তু বাবা দুচোখে দেখতে পারত না। নাজীদের। কাজেই ওরা বাবাকে খুন করায় তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি আমার। ব্রিগল আমাকে নিয়ে গেছিল বাবার হত্যাকাণ্ড দেখাতে। হ্যাঁ, আমি নিও-নাজীদের সঙ্গে পরে জড়িত হয়েছি। আরেকটু বড় হয়ে বুঝলাম, আসলে বাবা ছিল বেঈমান। নিও-নাজীদের মহান নেতা উয়ে সিলারকে ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিল সে! কাজেই তাকে খুন না করে কোন উপায় ছিল না এদের।
দুঃখের ও ক্রোধের দ্বৈত অনুভূতি হলো রানার। একভাবে দেখলে, এ মেয়ের দোষ নেই। হিটলার বলেছিল-গিভ মি দ্য চিলড্রেন! এই মেয়ের ব্রেন ওরা ভালই ওয়াশ করেছে বলতে হবে।
বিছানার স্ট্যান্ডের কাছে এসে দাঁড়াল রানা। তারপর?
আমাকে ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করতে বলা হলো। ওরা বলল সময় হলেই সংগঠন আমাকে কাজে লাগাবে। বড় হয়ে কাজে আর কি লাগলাম, তার বদলে হলাম বুড়ো রুডলফ ব্রিগলের মিসট্রেস। ওকে ভালবাসিনি। আমি-কোনদিনও না। ওকে সহ্য হত না আমার-শারীরিকভাবে। কিন্তু কি আর করা, ওটাই আমার ডিউটি যে! লোকটা নিও-নাজীদের একজন বড় মাপের নেতা হাজার হলেও।
কন্টেসা? জবাব চাইল রানা। সে-ও কি জড়িত তোমাদের সাথে?
দুপাশে প্রবল ভাবে মাথা নাড়ল ব্যারোনেস। না, না, সে বেচারী এসবের। মধ্যে নেই।
বস এতক্ষণে নিশ্চয়ই পরীক্ষা করে দেখেছেন কন্টেসার ব্যাপারটা। মাথা ঝাঁকাল রানা। বেশ, ব্রিগলকে ফাঁকা মাঠ করে দেয়ার জন্যে আমাকে ভুল। পথে চালনা করতে তুমি। কিন্তু থনন থেকে স্টীমারে করে আসার সময় গুবলেট হয়ে যায় সব। তুমি শিয়োর ছিলে না, আমি বিসিআইয়ের লোক কিনা। কিন্তু ব্রিগলের লোকেরা তারপরও হোটেল হিলসনে ফলো করে যায় আমাদের। যখন তুমি নিশ্চিত হলে আমার ব্যাপারে, অনেক দেরি হয়ে গেছে তখন, নাকাতা তার বাধানো দাঁত খুইয়ে বসেছে। আমার কাছে তখন ওটা, খুব কনফিউযড হয়ে পড়েছিলে, তাই না?
অনেকখানি স্বচ্ছন্দ বোধ করছে এখন জুলি। রানার দিকে চেয়ে দু। হাসল। ওটা আমার কোন ব্যাপার ছিল না। আমার কাজ ছিল তোমাকে ভুল লোক চেনানো–ক্লাউস অ্যালফসের পেছনে তোমাকে লেলিয়ে দেয়া।
আর ফ্রেঞ্চ কী-র ব্যাপারটা? জবাব চাইল রানা। ব্রিগল বলেনি তোমাকে ওটা হাত করতে?
না তো, অবাক হয়ে গেল জুলি। আমি তো ওটার কথা কিছুই জানি।
করুণার হাসি হাসল রানা। তাহলে ভিলা থেকে সে রাতে সিগন্যাল পাঠিয়েছিল কে, ব্যারোনেস?
আমি কি জানি? জীবনেও যেন এমন অদ্ভুত কথা শোনেনি ব্যারোনেস এমনি মুখভঙ্গি করল।
জানবে তো তুমিই, বলল রানা। ফ্রেঞ্চ কী আমার কাছে আছে সেটা তো একমাত্র তুমিই জানতে। কি, জানতে না? ব্রিগলের লোককে মোর্স সিগন্যালে জবাব দাওনি তুমি? তবে তোমার দুর্ভাগ্য, সতর্ক ছিলাম আমি। ওটা হাতানোর সুযোগ দিইনি তোমাকে।
চোয়াল ঝুলে পড়ল ব্যারোনেসের। পরাজয় স্বীকারের ছাপ ওর মুখের চেহারায়।
ফেঞ্চ কী আমার হাতে আসতে দেখে কন্টেসার ভিলায় আমাকে নিয়ে যাও তুমি, বলছে রানা। ব্রিগলের লোকজন যাতে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে ওটা। কি, ঠিক না?
ব্যারোনেস লা জবাব। বলার আছেটাই বাকি? রানা যা বলছে সবই তো সত্যি।
আচ্ছা, ওমর যে ব্রিগলের লোক তা তো তুমি জানতে?
ভ্রূ কোঁচকাল জুলি। না। ও যে ওখানে লোক প্ল্যান্ট করেছে জানা ছিল।
ও আসলে তোমাকেও বিশ্বাস করত না। ওমরকে প্ল্যান্ট করে ও তোমার ওপর চোখ রাখার জন্যে। চিতাবাঘের ঘটনার অনেক আগে থেকেই। তোমার কপাল ভাল, ব্যারোনেস। ব্রিগল মূর্তিটা হাত করতে পারলে, আমার ধারণা, তোমার দশাও হত নাকাতার মত।
শিউরে উঠল যেন যুবতী। চিন্তাটা আমার মাথাতেও এসেছিল। ওকে শেষদিকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সংগঠনের প্রতি আনুগত্য কমে এসেছিল ওর। লোভী হয়ে উঠেছিল ভীষণ রকম!
তারপরও তাল মিলিয়েছ তুমি ওর সাথে। যেই চান্স দিয়েছি অমনি চলে গেছ ওর কাছে-কালকে সিভিক গার্ডেনসে। ভান করেছ অ্যালফাই ব্রিগল, ভঙ্গি নিয়েছ ভয়ানক বিপদে পড়ে গেছ-ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে গেছে যেন। দারুণ অভিনয়, স্বীকার করতেই হবে। টর্চার চেম্বারে কী খেলাটাই না দেখালে! আমাকেও প্রায় কিনে ফেলেছিলে। খুব সহানুভূতি বোধ করছিলাম। তোমার প্রতি। কিন্তু চেম্বারে না গিয়ে উপায় ছিল না আমার, কারণ অস্ত্রপাতিগুলো সব ওখানেই রেখে এসেছিলাম যে।
ধূসর চোখে অদ্ভুত এক চাহনি নিয়ে রানাকে লক্ষ করছে যুবতী। তাহলে কখন-কখন আমার মিথ্যে ধরে ফেললে?
কর্কশ হাসল রানা। তুমি যখন ব্রিগলরূপী অ্যালফসকে বাগে পেয়েও খুন করলে না। লোকটা তোমার জানের দুশমন অথচ দিব্যি বাঁচিয়ে রাখলে তাকে। আর তুমি যদি ব্রিগলের শত্রুই হবে তাহলে তোমার সঙ্গে পিস্তল থাকে কি করে? আমাকে তো ওরা তন্ন তন্ন করে তল্লাশী করে তারপর দুর্গে ঢুকতে দিয়েছে। কিন্তু তার আগে অভিনেতাটিকে বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। কাঁদতে দেখি। অনেকটা শিয়োর হয়ে যাই তখনই। তোমাকে আসলে প্রথম থেকেই বিশ্বাস করতে পারিনি আমি। তুমি আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছ। অ্যালফসই ব্রিগল। তখনই আসলে ফাঁদে পড়েছ তুমি। নিজেও জানতে সেটা, তাই পিস্তল হাতে এসেছিলে আমার পেছন পেছন। তুমি বুঝতে চাইছিলে সত্যিটা আমি জানি কিনা। ব্রিগল মনে করে অ্যাক্টরটাকে খুন করেছি কিনা। যদি করতাম, এবং সত্যটা জেনে ফেলতাম, তাহলে আমাকে খুন করতে তুমি। কিন্তু তোমাকে বোকা বানাই আমি। ব্রিগলের মুখের চেহারা থেঁতলে। দিই যার ফলে ওকে চিনতে পারোনি তুমি-প্রথম দেখায় বুঝতে পারোনি কাকে খুন করেছি আমি। ব্রিগলকে নাকি অ্যালফসকে। আর সত্যিই যদি ওর মুখে গুলি করতাম, তোমাকে যেমনটা বলেছিলাম, তাহলে আমি নিজেও বুঝতে পারতাম না। তাই তুমি ভাবলে তোমার চালবাজি ধরতে পারিনি আমি।
খেলে চললে তুমি আর তাই এখন বসে আছ আমার ঘরে।
সুটকেসটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল রানা। এখনও সময় আছে-পালাও। আমি চাই না বাকি জীবন জেলে পচে মরো তুমি।
রানা! মিষ্টি, অনুচ্চ কণ্ঠে ডাকল যুবতী। ঘুরে দাঁড়াল রানা। ব্যারোনেসের মুখে মৃদু হাসি, হাতে পিস্তল।
বসো, রানা, প্লীজ। তোমাকে খুন করতে চাই না। কিন্তু এখন তোমাকে যেতেও দিতে পারি না আমি। একটা বোঝাপড়া করা যায় না?
কটমট করে চাইল রানা। না।
তাহলে তোমাকে খুন না করে উপায় নেই আমার, রানা। আমার খুদে বন্ধু খুব অল্প আওয়াজ করে। কিন্তু কাজ করে মোক্ষম। আমি দুঃখিত, ডার্লিং, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে দেব আর তুমি হাটে হাঁড়ি ভাঙবে সেটি হয় কি করে? তোমার মৃত্যুর একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে আবার বনের কাজে জয়েন করব আমি।
তুমি একটা গাধা, রুক্ষ স্বরে বলল রানা। আমার ধৈর্যের বাধ কিন্তু ভেঙে যাচ্ছে।
রানার বুক লক্ষ্য করে ধরেছে ব্যারোনেস পিস্তলটা। ট্রিগারে চেপে বসেছে আঙুল। আমি দুঃখিত, রানা।
ট্রিগার টিপল ব্যারোনেস। মুচকি হাসল রানা।
কাজ হবে না, ব্যারোনেস। ভিলায় সেই প্রথম রাতেই পিস্তলটা অকেজো করে রেখেছিলাম আমি।
অবিশ্বাস আর ক্ষোভে বিকৃত জুলির মুখের চেহারা। রানাকে উদ্দেশ্য করে কয়েকবার ট্রিগার টিপল ও। ভোতা টিক শব্দ ছাড়া আর কোন কাজ হলো না।
গট ভেরড্যামপট। খুদে পিস্তলটা রানার দিকে ছুঁড়ে মারল ব্যারোনেস। কনুইয়ের গুতো মেরে সরিয়ে দিল ওটাকে রানা। ব্যারোনেস ফ্যাকাসে মুখে রানার দিকে একবার চাইল। তারপর গলার ভেতর কান্নাবোজা এক শব্দ করে মুখ গুজল বালিশে।
এখনও সময় আছে, ব্যারোনেস, পালাও। নইলে তোমার লোকেরাও তোমাকে ছাড়বে না, খুঁজে বের করে শাস্তি দেবে। আমি তোমাকে কিছুই বলছি না। মেয়েদের ওপর ক্ষোভ পুষে রাখি না আমি। পালাও। বেরিয়ে গেল রানা।
.
১৬.
মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা। ঢাকা। বিসিআই হেডকোয়ার্টার।
মেজর জেনারেলের ডেস্ক ল্যাম্পের আলোয় নিষ্প্রভ দ্যুতি ছড়াচ্ছে সোনার চিতাবাঘটা। জ্বলজ্বলে রুবির চোখজোড়া রানাকে, জমাট রক্তের কথা মনে হয়তো আরও ঝরবে ভবিষ্যতে। রানার অবশ্য ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।
সিগারের ধোঁয়ার ওপাশ থেকে কথা বললেন বস। শেষবারের মত ভাল করে দেখে নাও, রানা। বিশেষ পাহারায় আজ রাতেই ইন্দোনেশিয়া চলে যাচ্ছে এটা।
সোনার মূর্তিটার গায়ে হাত বুলাল রানা। ওটাকে তুলে নিয়ে তলপেটের কাছটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে, বুক থেকে নিয়ে লেজ পর্যন্ত সরু এক চেরা দাগ আবিষ্কার করল।
মূর্তিটা ডেস্কে নামিয়ে রাখল ও। পেটের ভেতরের জিনিসটাই চাইছিলেন তারমানে, স্যার? কিছু একটা ছিল ওটার পেটে।
মাথা ঝাঁকালেন মেজর জেনারেল। গতকাল জেনেভা উড়ে গেছিলেন বস। ল্যাক লেম্যানের পানি থেকে নাকাতার চাবির অংশটা রানা উদ্ধার করার পর তিনি, রানা ও জার্মান সরকারের এক প্রতিনিধি গোয়েরিঙের ব্যাঙ্ক ভল্ট খোলন। তারপর চার্টার করা প্লেনে, বিশেষ প্রহরাধীনে ঢাকা নিয়ে আসেন বাক্সে ভরা চিতাবাঘের মূর্তি।
হারম্যান গোয়েরিঙের ভল্টে পাওয়া লুটের বাকি মাল দাবি করে জার্মান সরকারের প্রতিনিধি। কিন্তু অটল থাকেন রাহাত খান। তাঁর বক্তব্য, চাবি যার ভল্ট তার। শাসিয়ে দেন প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে যাবেন। ফলে জার্মান প্রতিনিধি আর বাড়াবাড়ি করতে সাহস পায়নি। সমস্ত সম্পত্তি ঢাকা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন রাহাত খান। তবে নিশ্চয়তা দেন, বাংলাদেশ ফিরিয়ে দেবে যার যা প্রাপ্য জার্মানীর দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
উড়ো টেলিফোন পেয়ে ব্রানহিল্ড দুর্গে ছুটে যায় সুইস পুলিস, কিন্তু গোটা কয়েক লাশ ছাড়া আর কিছুই পায়নি তারা। ভিলা রিকোর ক্ষেত্রেও তাই। সুইস প্রচার মাধ্যমে চরম ব্যঙ্গ করা হয়েছে সে দেশের পুলিস বিভাগকে। তাদের নাকের ডগা দিয়ে সুইস ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক খেলা সাঙ্গ করে, কারা যেন এক গাদা মৃতদেহ রেখে চলে গেছে। কিন্তু কিছুই টের পায়নি তারা।
আমি খুশি হয়েছি, রানা, বললেন বস্।
বুকের ভিতর পুলক অনুভব করল রানা। মাথা নিচু করে সবিনয়ে বলল, আমিও, স্যার। নিজ হাতে শাস্তি দিয়েছি বন্ধুর হত্যাকারীকে। চিতাবাঘ আর। অন্যান্য সব উপরি পাওনা। তবে, স্যার, একটা কথা অজানা রয়ে গেল।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে চাইলেন বস। চাহনিতে প্রশ্রয়।
জানার ইচ্ছে ছিল, ওটার পেটে কি পেলেন।
আধো হাসি রাহাত খানের মুখে। অপারেশন ফোর্থ রাইখের মাস্টার প্ল্যান বলতে পারো। মোটা হলেও গোয়েরিং ছিল আর সবার চাইতে বুদ্ধিমান। অন্যদের অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য। কাজেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা শুরু করে দেয় সে। বাঘটার পেট চিরে মাস্টার পেপার ভরে দেয়। ভয়ঙ্কর এক প্লেগ ব্যাসিলির ফর্মুলা আবিষ্কার করেছিল এক জার্মান বৈজ্ঞানিক। তিন ধরনের প্লের্গের সংমিশ্রণ ছিল ওটা-বিউবোনিক, নিউমোনিক আর সেপ্টিকামিক। এই ভাইরাস পানিতে আর মাটিতে টিকে থাকবে বহু বছর পর্যন্ত-অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলাসের মত। সংক্রমণশীল অবস্থায় একশো বছরের বেশি সারভাইভ করতে পারবে ভাইরাসটা। এবং এ ধরনের প্লেগ ডায়াগনোস। করা প্রায় অসম্ভব। এ জিনিস হাতে থাকলে যুদ্ধ করতে হবে না, কোটি কোটি মানুষকে ভাইরাস ছড়িয়ে সাফ করে দেয়া যাবে। রুডলফ ব্রিগল জানত এটার কথা। আরও জানত জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্স। ওদের কাছে ব্রিগল ফর্মুলা বিক্রি করে দিচ্ছে জানতে পেরে আঁতকে ওঠে গোটা আরব বিশ্ব আমাদেরকে ও.আই.সি অনুরোধ করে ফর্মুলাটা কিছুতেই যাতে ইসরাইলের হাতে না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে। আর সেই ব্যবস্থাই করেছ তুমি।
উঠে দাঁড়াল রানা, বিনীত কণ্ঠে বলল, এবার আসি, স্যার? অনুমতি পেয়ে পা বাড়াল দরজার উদ্দেশে।
রানা!
দরজার কাছে থমকে দাঁড়াল রানা। ঘুরল। স্যার?
ডেস্কে রাখা তারের বাস্কেট থেকে একটা ফ্লিমজি তুলে নিয়ে বাড়িয়ে ধরলেন মেজর জেনারেল। সংক্ষিপ্ত ফ্রিমজিটায় এক ঝলক নজর বুলাল রানা। প্যারিসের এক হোটেল রূমে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে ব্যারোনেস জুলি গ্রাফকে। খুদে এক ছুরি ওর বুকে সেঁধিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্যারিস পুলিসের ধারণা আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা? আপনার কি ধারণা, স্যার? জার্মান ইন্টেলিজেন্সকে ঘোলা পানি খাইয়ে ছেড়েছিল ও। বদলা নেয়নি তো ওরা?
আমারও তাই ধারণা, রানা।
মাথা ঝাঁকাল রানা। পুরানো বান্ধবী কন্টেসার কাছে কি সাহায্যের জন্যে গিয়েছিল ব্যারোনেস? হয়তো গিয়েছিল, কিন্তু সাহায্য পায়নি। তারপর আর কি, জার্মান ইন্টেলিজেন্সকে এড়াতে পারেনি কিছুতেই।
বসের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লিফটে চড়ল রানা। রাস্তায় বেরিয়ে এল একটু পর। শরতের চনমনে দুপুর। ট্রাফিক গিজগিজ করছে মতিঝিল এলাকায়। হর্নের উৎকট শব্দ। সিগারেট ধরাল রানা, ফুটপাথে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জনতার ঢল দেখল। কারা যেন স্লোগান দিতে দিতে চলে যাচ্ছে। মুচকি হাসি ফুটল ওর ঠোঁটে।
ওর গাড়িটা পৌঁছে দেয়া হলো ফুটপাথের ধারে। ওতে উঠে চেনাজানা রাস্তা ধরে এগোল রানা অজানা-অচেনা ভবিষ্যতের পথে।
<