০৯.
পরদিন আবার পাইনভিউ লেকে এল তিন গোয়েন্দা। জ্যাকসনের সঙ্গে কথা বলবে। সুযোগ পেলে বাড়ির ভেতর খুঁজে দেখবে। আর যদি আপনাআপনি সুযোগ না আসে, তাহলে সুযোগের ব্যবস্থা করবে।
দোকানের সামনের খোয়া বিছানো বিরাট আঙিনাটায় গাড়ি রাখল মুসা।
দোকানের দরজার পাশে রাখা জ্যাকসনের পিকআপ। নীল রঙের বডি।
উঁকি দিয়ে দেখে ফিসফিস করে বলল কিশোর, জ্যাকসনকে কেবল দেখা যাচ্ছে। কোন ভাবে বের করে দিতে পারলে, খোঁজাখুঁজিটা করা যেত। দেখি, কি করা যায়। আমি আর মুসা ওকে বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। রবিন, তুমি খোঁজ চালাবে।
ঘাড় কাত করল রবিন। ঠিক আছে।
দোকানে ঢুকল ওরা।
কাউন্টারের ওপাশে কতগুলো ফাত্না নিয়ে কি যেন করছে জ্যাকসন। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করছে কোনটা ভালমত ভেসে থাকবে।
অ, তোমরা, মুখ তুলে দেখে বলল জ্যাকসন।
কেমন আছেন? আন্তরিকতার ভঙ্গি করল কিশোর।
তোমরা আসার আগে পর্যন্ত তো ভালই ছিলাম, মুখ গোমড়া করে জবাব দিল জ্যাকসন।
রেগে আছেন মনে হচ্ছে আমাদের ওপর? হাসল কিশোর। কারণটা কি?
হিগিনসদের বাড়িতে ঢুকতে দেখলাম তোমাদের, জ্যাকসন বলল।
তাতে অসুবিধেটা কি? প্রায় জিজ্ঞেস করে ফেলতে যাচ্ছিল মুসা। চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করল কিশোর।
জ্যাকসনের কথাটা যেন শুনতেই পায়নি কিশোর এ রকম ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাতে শুরু করল। অবাক হওয়ার ভান করে আনমনে বিড়বিড় করল, বাপরে, জিনিসপত্রে একেবারে বোঝাই।
মিথ্যে বলেনি সে। তাক বোঝাই জিনিসপত্র। বেশির ভাগই মাছ ধরার সরঞ্জাম। ছিপ, সুতো, বঁড়শি, ফাৎনা থেকে শুরু করে মাছ ধরার পর তোলার জন্যে বড় হাতলওয়ালা নেট, যা যা প্রয়োজন সবই আছে।
প্রচুর বিক্রি নাকি এ সব জিনিসের? জিজ্ঞেস করল কিশোর। হেঁটে গেল স্তূপ করে রাখা মাছ ধরার আধুনিক সরঞ্জামগুলোর মাঝখানের সরু গলিপথ ধরে। দেখল বোটে লাগানোর ছোট আউটবোর্ড এঞ্জিন আছে। আছে ইলেকট্রনিক ফিশ ফাইন্ডার, তাতে কম্পিউটারের ছোট স্ক্রীন লাগানো, লেকের তলায় কোথায় কি আছে দেখা যায় ওটার সাহায্যে। এক ধরনের স্যাটেলাইট সিসটেমও আছে। যন্ত্রটা আগেও দেখেছে কিশোর। কিন্তু কখনও ব্যবহার করেনি। গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইট সিসটেম বলে এগুলোকে। হাতে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে মাছের অবস্থান নির্ণয় করা যায়। একটা মেটাল ডিটেক্টরও দেখা গেল একধারে রাখা।
ওসব পচা যন্ত্র নবিসদের জন্যে, যন্ত্রগুলোর প্রতি কিশোরের কৌতূহল লক্ষ করে জ্যাকসন বলল।
তাই? কিশোর বলল, আমি তো আরও ভাবলাম অতিমাত্রায় পেশাদারদের জন্যে ওসব যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে।
দূর। পেশাদাররা ফালতু যন্ত্রের সাহায্য নিতে যাবে কি করতে? মাছ খুঁজে বের করার জন্যে ওদের স্যাটেলাইট দরকার হয় না। এ ভাবে মাছ খুঁজে বের করে ধরার মধ্যে মজাও নেই।
তাহলে রেখেছেন কেন?
নবিসদের কাছে বিক্রি করি না আমি তা তো বলিনি। এ সব আলতু-ফালতু জিনিস ওরাই কেনে। হেসে উঠল জ্যাকসন।
মুসা আর রবিনও কিশোরের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে লাগল। একটা বাক্স দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন, এটা কিসের জন্যে?
তোমরা তো দেখা যাচ্ছে একেবারেই আনাড়ি, জ্যাকসন বলল। কিছুই চেনো না।
সে-জন্যেই তো চিনতে চাইছি, মুখে হাসি টেনে এনে জবাব দিল কিশোর।
ওটা স্লেড বক্স। মাছ ধরার সমস্ত সরঞ্জাম ভরে নিয়ে বরফের ওপর দিয়ে টেনে নিতে পারবে। বয়ে নেয়ার ঝামেলা নেই। পিঠটা বাঁকা হওয়া থেকে বাঁচবে। মাছ ধরার সময় ওটাতে বসতেও পারবে। এক জিনিসে কত সুবিধে, তাই না?
কোত্থেকে আনেন এগুলো? জানতে চাইল মুসা।
নিজেই বানাই, গর্বের সঙ্গে জবাব দিল জ্যাকসন। এ মৌসুমেই গোটা আষ্টেক বিক্রি করে ফেলেছি।
সবগুলোই কি এক রকম? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বাজারে যেগুলো কিনতে পাওয়া যায়, আলাদা আলাদা ডিজাইন, সেগুলোর মত কিনা যদি জিজ্ঞেস করো, তাহলে বলব, না। আমারগুলো কাজের জিনিস, এটাই হলো আসল কথা।
অ, হঠাৎ করে যেন মনে পড়ে গেল কিশোরের, আপনার নাতিরা কোথায়?
মাছ ধরতে গেছে।
মনে মনে পুলকিত হলো কিশোর। ভাগ্যটা ভালই। এখন কোনমতে বুড়োটাকে সরিয়ে নিতে পারলেই পুরো বাড়ি খালি পাওয়া যাবে। ভাল মাছ কোনখানে পাওয়া যায়, জানে নিশ্চয় ওরা?।
শিখছে। প্রায়ই তো দেখি যন্ত্রপাতি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। আমিও বাধা দিই না। শিখতে চায় শিখুক। নবিস থাকার কোন মানে হয় না।
আমাদের কি ওরকম ভাল জায়গা চেনাতে পারবেন?
বাহ! তোমাদেরও দেখছি আইস ফিশিঙের শখ? অবাক মনে হলো জ্যাকসনকে।
হয়েছে আপনার কথা শুনে। আমরাও নবিস থাকতে চাই না, হাসল কিশোর। আইস ফিশিং দেখতে দেখতে ক্রমেই শখ বাড়ছে। কৌতূহলটাও ঠেকাতে পারছিনা। আর মুসা তো সেদিন আপনার সঙ্গে শ্যান্টিতে দেখা হওয়ার পর থেকে আমাকে ধরে মারে আর কি। আপনি ওকে মাছ ধরা শেখাতে চেয়েছিলেন, আমি টেনে বের করে নিয়ে গিয়েছিলাম বলে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আমার শখটাও চাগিয়ে উঠেছে। ভাবলাম, একবার চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি? বঁড়শি-টড়শি কিনতে কিছু টাকা খরচ হবে আরকি।
খরচও তেমন বেশি কিছু না, আগ্রহী মনে হলো জ্যাকসনকে। দামী যন্ত্রপাতিগুলো ভাড়া নিতে পারো আমার কাছ থেকে। ভাল কমিশন দেব। কারণ তোমাদেরকে আমার পছন্দ হয়েছে।
টোপ গিলেছে। মনে মনে হাসল কিশোর। এখন খেলিয়ে ডাঙায় তুলতে পারলেই হয়। বলল, কিন্তু আমরা কি পারব এত তাড়াতাড়ি?
পারবে। একেবারে পানির মত সহজ। যদি ঠাণ্ডাটা কেবল মেনে নিতে পারো।
কোনখান থেকে শুরু করব?
জায়গা তো বেশ কয়েকটাই আছে। কাউন্টারের ওপাশ থেকে বেরোল না জ্যাকসন। তবে কিশোর বুঝল, আর সামান্য চাপ দিলেই বেরোবে।
জায়গাগুলো কি দেখাতে পারবেন? সময় হবে আপনার? অনুরোধের ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল সে।
বোঝা যাচ্ছে, না দেখানো পর্যন্ত শান্তিতে থাকতে দেবে না আমাকে, হাসল জ্যাকসন।
যাক, তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলেন, হেসে জবাব দিল কিশোর।
চেয়ার থেকে উঠে এল জ্যাকসন।
মুসার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল কিশোর। জ্যাকসনের পেছনে পেছনে দরজার দিকে এগোল সে। রবিনকে বলল, তোমার আর আসার দরকার নেই। তুমি এখানেই থাকো বরং। দোকান পাহারা দাও।
হ্যাঁ। সে-ই ভাল, জ্যাকসন বলল। যে রকম চোরের উৎপাত এখানে। দেখা গেল, দিনের বেলাতেও চুরি শুরু করল। সুযোগ দেয়ার দরকার কি?
কিশোর আর মুসাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল জ্যাকসন।
ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাজে নামল রবিন। একটা সেকেন্ডও দেরি করল না। দোকানের পেছনে একটা দরজা আছে। জ্যাকসনদের বেডরূমে ঢোকার। দৌড়ে এসে সেটা দিয়ে ঢুকে পড়ল সে।
বড় একটা ঘর। আসবাবপত্রে ঠাসা। এক পাশে রান্নাঘর আরেক পাশে বাথরূম। জানালার কাছে জ্যাকসনের বিছানা। দুটো চারপায়ার ওপর রাখা দুটো স্লীপিং ব্যাগ। জ্যাকি আর রকির জন্যে। ওদের ব্যাগ আর কাপড়-চোপড় মেঝেতে স্তূপ করা। ধোয়াধোয়ির আর ধার দিয়ে যায় না। অপরিচ্ছন্ন। নোংরা।
জ্যাকসনকে বাইরে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবে কিশোররা, বলা যাচ্ছে না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। দুটো চারপায়ার মাঝখানে রাখা ছোট টেবিলটার দিকে নজর দিল সে। কিন্তু সন্দেহ করার মত কোন জিনিস দেখল না।
দ্রুত জ্যাকসনের ড্রেসারের ড্রয়ার পরীক্ষা করে দেখল। তারপর ঢুকল রান্নাঘরে। কেবিনেটগুলো খুলে দেখল। কোথাও চোরাই মাল আছে কিনা। নেই। এত সাধারণ জায়গায় থাকবে, আশাও করেনি। তবু দেখল। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। মাল থাকলে হয় দেয়ালের ফাপা কোন জায়গায় থাকবে, নয়তো মেঝের তক্তার নিচে, মনে হলো তার।
পাঁচ মিনিট খোঁজাখুঁজি করে কোন কিছুই পাওয়া গেল না। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, এখনও লেকের বরফের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে কিশোররা। সময় নষ্ট না করে সরে এল রবিন।
সারা ঘরে নতুন করে আবার চোখ বোলাল সে। বোঝার চেষ্টা করল কেন জায়গায় থাকতে পারে জিনিসগুলো। স্লীপিং ব্যাগগুলো উঁচু করে দেখল। তারপর মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে চারপায়াগুলোর নিচে উঁকি দিল। চোখে পড়ল ছোট এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ। একটা চারপায়ার ক্যানভাসের নিচে গোঁজা।
কৌতূহল হলো।
বের করে এনে দেখল, তাতে দুই সারি নম্বর লেখা। তালিকার মত। তবে কোন জিনিসের নাম লেখা নেই নম্বরগুলোর বিপরীতে।
কি মানে এগুলোর, বুঝতে পারল না কিছু। কিন্তু মনে হতে লাগল, এর মধ্যে সূত্র আছে। নইলে এত যত্ন করে ওখানে লুকিয়ে রেখেছে কেন?
পকেট থেকে নোটবুক বের করে তার ভেতর থেকে কাগজ বের করল। পেন্সিল দিয়ে দ্রুত নকল করে নিল নম্বরগুলো। ঠিক যে ভাবে লেখা রয়েছে, সে ভাবে সাজিয়ে। আসল কাগজটা রেখে দিল আগের জায়গায়।
বাইরে কথা শোনা গেল। জোরে জোরে কথা বলছে কিশোর। বুঝল, সাবধান করে দিচ্ছে।
এ ঘরে আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। আর থাকলেও সময় নেই। তাড়াতাড়ি দোকানে ফিরে এল রবিন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকল জ্যাকসন। পেছনে কিশোর আর মুসা। বাপরে, বড় বাঁচা বেঁচেছে!-বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে রবিনের। আর সামান্য দেরি করলেই যেত ধরা পড়ে।
তারমানে তো মাছ ধরার সরঞ্জাম লাগবে এখন তোমাদের, জ্যাকসন জিজ্ঞেস করল। দেব?
এখন দেবেন? রবিনের দিকে তাকাল কিশোর।
মাথা ঝাঁকিয়ে ইঙ্গিতে বোঝাল রবিন, কাজ হয়ে গেছে।
জ্যাকসনকে বলল কিশোর, থাক পরেই দেন। আজকে মেরিন ডগলাসের সঙ্গে এক জায়গায় যাওয়ার কথা আছে আমাদের।
শুধু শুধু আমাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে আমার সময় নষ্ট করলে কেন তাহলে? রেগে উঠল জ্যাকসন। কাউন্টারের ওপাশের চেয়ারে গিয়ে বসল।
কারণ আপনি ছাড়া মাছের সবচেয়ে ভাল জায়গাগুলো আর কেউ দেখাতে পারত না, তেলানোর ভঙ্গিতে জবাব দিল কিশোর।
তাতে অবশ্য কাজ হলো। নরম হলো জ্যাকসন। একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল।
ও, ভাল কথা, কিশোর বলল, আপনার দুই নাতির সঙ্গে একটু দেখা করার দরকার ছিল। কোথায় ওরা?
কেন, লেকে দেখোনি ওদের? ম্যাগাজিনটা জানালার দিকে নাড়ল জাকসন।
না তো। ঠিক আছে। এখন যাচ্ছি। দেখি পাওয়া যায় নাকি, বলে আর দাঁড়াল না কিশোর। দরজার দিকে রওনা দিল। বেরিয়ে এল দুই সহকারীকে নিয়ে।
পাহাড়ের গা বেয়ে লেকের দিকে নামতে নামতে ফিরে তাকাল একবার কিশোর। দেখল, জানালা দিয়ে ওদের দিকে নজর রাখছে কিনা জ্যাকসন।
দেখা গেল না তাকে।
রবিনকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কিছু পেলে?
নোটবুক থেকে কাগজটা বের করে দিল রবিন। এটা দেখো, কিছু বুঝতে পারো নাকি।
কতগুলো নম্বর, দেখতে দেখতে বলল কিশোর।
পাশ থেকে দেখার জন্যে কাত হয়ে এল মুসা।
নম্বরগুলোর মানে কি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
বুঝতে পারছি না, জবাব দিল কিশোর। থাক, এটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে। হাত তুলে দুজন মানুষকে দেখাল, জ্যাকি আর রকি না ওরা? মুসা, ডাক দাও তো।
অ্যাই, শুনছেন! চিৎকার করে ডাকল মুসা।
ফিরে তাকিয়ে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল দুই ভাই। কিন্তু কাছে এল না। কিশোররা ওদের দিকে এগোল। ওরা সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। লেক পার হয়ে ওপারে চলে যাবে মনে হচ্ছে।
তিন গোয়েন্দাও গতি বাড়িয়ে দিল। বুটের নিচে কাঁটা থাকায় পিছলে পড়া থেকে বাঁচল।
এত তাড়াহুড়া করছে কেন? রবিনের প্রশ্ন। দেখছে না ওদের কাছে যেতে চাইছি আমরা?
আগে আগে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ টের পেল রবিন, পায়ের নিচে পাতলা হয়ে এসেছে বরফ। চাপ পড়তেই চড়চড় করে উঠল।
এগিয়ো না! এগিয়ে না! দুই বন্ধুর উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল সে।
ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল যেন কিশোর। তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা। কি হয়েছে?
পাতলা বরফ, স্থির দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দিল রবিন। তোমরা যেখানে আছে, ওখানেও পাতলা। নোড়া না।
পাতলা বরফে কি করতে হয় জানা আছে মুসার। এক মুহূর্ত দেরি না করে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরের ভার বিশেষ এক জায়গায় না রেখে ছড়িয়ে দিল। মাত্র কয়েক ফুট সামনে দাঁড়ানো রবিনকে বলল, শুয়ে পড়ো। খুব ধীরে ধীরে।
মুসার দেখাদেখি কিশোরও একই ভঙ্গিতে বরফের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ রবিনের দিকে।
সামনের দিকে দুই হাত লম্বা করে দিল মুসা। রবিনকে ধরার জন্যে।
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বরফ ভেঙে জোরাল একটা ঝপাৎ শব্দ করে পানিতে পড়ে গেল রবিন।
ভাসল না আর।
.
১০.
রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। ভাবল, ডাক শুনে বরফের গর্তটা দিয়ে মাথা তুলবে রবিন। কিন্তু ঝপাৎ শব্দটার পর আর কোন শব্দই কানে এল না তার।
হামাগুড়ি দিয়ে গর্তটার দিকে এগোল সে।
বরফ-শীতল পানিতে শুধু বরফের টুকরো ভেসে থাকতে দেখল।
গর্তটার মধ্যে রবিনকে ভেসে ওঠার জন্যে কয়েক সেকেন্ড সময় দিল। কিশোর। তারপর চেঁচানো শুরু করল, আপনারা জলদি আসুন! রবিন পড়ে গেছে! পড়ে গেছে!
মুহূর্তের মধ্যেই চতুর্দিক থেকে দৌড়ে আসতে শুরু করল মাছ শিকারীরা। কারও হাতে ইস্পাতের ভারী শিক, কারও হাতে বরফ ছিদ্র করার ড্রিল মেশিন। অবাক হয়ে দেখল কিশোর, উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে আসছে না। বরং ৬জনখানেক দূরের কয়েকটা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে এসো! কিশোরদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল একজন শিকারী। স্রোতের টানের মধ্যে পড়েছে সে। দ্রুত সরে যাচ্ছে।
স্রোত!
তারমানে ওপরটা জমাট বরফ হয়ে গেলেও নিচের পানিতে ঠিকই স্রোত প্রবাহমান। এতক্ষণে বোঝা গেল কেন পানিতে পড়ে মাথা তোলেনি রবিন। তুলতে পারেনি আসলে। বরফের নিচে চলে গেছে সে।
পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে শিউরে উঠল কিশোর। দম নিতে পারছে না রবিন। সেই সঙ্গে মারাত্মক ঠাণ্ডা পানি।
ওসব ভাবনা-চিন্তার ধার দিয়ে গেল না মুসা। যা করার, সেটাই করল। পাতলা বরফের কাছ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত পিছিয়ে গেল সে। লাফ দিয়ে উঠে দৌড় দিল শিকারীদের দিকে।
মরিয়া হয়ে ততক্ষণে বরফকে আক্রমণ করেছে ওরা। আইস বার দিয়ে খোঁচাচ্ছে কেউ, কেউ কোপাচ্ছে কুড়াল দিয়ে, বাকিরা ব্যবহার করছে ড্রিল মেশিন।
বরফের নিচে রবিনের হলুদ রঙের পার্কাটা সরে যেতে দেখা গেল পলকের জন্যে।
এই যে এখানে। এখানে! চিৎকার করে উঠল মুসা।
কোন দিকে ভেসে যাচ্ছে রবিন, হাত তুলে দেখাল সে। রবিনের যাত্রাপথে যাতে গর্ত খুঁড়তে পারে শিকারীরা।
কিশোরও উঠে এসেছে। মুসার পাশে দাঁড়িয়ে বরফের নিচে তাকাল। মুখ। তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল রবিন যেদিকে সরছে সেদিকে কোন গর্ত আছে কিনা।
মুসা দৌড় দিল নয় ইঞ্চি গোল একটা সদ্য কাটা গর্তের দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে হাত ঢুকিয়ে দিল গর্তের ভয়ানক ঠাণ্ডা পানিতে। ওখান দিয়ে ভেসে গেলেই খপ করে ধরবে রবিনকে। ওর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল মাছ শিকারীরা। যে কোন সাহায্যের জন্যে তৈরি।
এই যে আসছে চিৎকার করে বলল একজন শিকারী।
হলুদ রঙের পার্কাটা ভেসে আসতে দেখল মুসাও। হাত আরও খানিকটা পানিতে ঢুকিয়ে দিল। ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আসছে হাত। রবিনের কষ্টটা আঁচ করতে পারল। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল মুসা। বাঁচবে তো রবিন!
এল অবশেষে রবিন। সঙ্গে সঙ্গে তার আস্তিন খামচে ধরল মুসা। টান দিয়ে পানির ওপর তুলে নিয়ে এল রবিনকে। মাথাটা ভেসে উঠল। নাক উঁচু করে লম্বা দম নিতে লাগল রবিন।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। বেঁচে তো আছেই। হুঁশও হারায়নি এখনও রবিন।
তবে বুঝতে পারছে বিপদটা কেবল শুরু। আসল বিপদ আসছে।
উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিকারীরা। গর্তের চতুর্দিকের কিনারা কেটে বড় করতে শুরু করল। রবিনকে টেনে তুলে আনার জন্যে।
রবিন, তুমি ঠিক আছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
ভীষণ ঠাণ্ডা… রবিন জানাল।
আর সামান্য একটু সহ্য করো, মুসা বলল। নিয়ে আসব বের করে।
কিন্তু সে বুঝতে পারছে একটুতে হবে না, গর্তের মুখ বড় করতে অনেক সময় লাগবে। ইতিমধ্যেই প্রায় মিনিট দুয়েক পানিতে কাটিয়ে ফেলেছে রবিন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এর একটা কারণ, মারাত্মক ঠাণ্ডা পানি তার পেশী শক্ত করে ফেলছে।
গর্তের মুখ বড় করছে শিকারীরা। কিশোর আর মুসা রবিনকে ধরে রেখেছে। টান দিয়ে দেখল, তুলে আনার মত এখনও যথেষ্ট বড় হয়নি ফোকরটা।
ওকে তুলে এনে বরফের ওপর শোয়াতে আরও মিনিটখানেক লাগল।
উফ, ভয়ানক ঠাণ্ডা! কথা বলতে গিয়ে দাঁতে দাতে বাড়ি খাচ্ছে রবিনের। যে বিপদের ভয়টা পাচ্ছিল মুসা, সেটা এসে গেছে। পেশী ঠাণ্ডা হয়েছে। একে একে এখন শরীরের সমস্ত অঙ্গ ঠাণ্ডা হতে থাকবে। কাজ করতে পারবে না। রক্ত চলাচল ব্যহত হবে। দেহের তাপমাত্রা কমে যাবে। এবং সবশেষে দেহ অসাড় হয়ে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যু।
বাঁচানোর একটাই উপায়। যত দ্রুত সম্ভব গা গরম করা।
ওর গা গরম করা দরকার, মুসা বলার আগেই বলে ফেলল কিশোর।
একজন বলল, জ্যাকসনের ওখানে নিয়ে যাই। সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই ধরো তো। জলদি করো।
না না, মিস্টার মরগানের বাড়িতে নিয়ে চলুন। ওখানেই ভাল হবে। মিসেস মরগান নার্স, সেবাটা ঠিকমত হবে। কিশোর বলল। জ্যাকসনদের বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
গ্র্যাহাম গুন নামে একজন মাছ শিকারী গিয়ে তাড়াতাড়ি করে তার স্নোমোবাইলটা নিয়ে এল। পেছনে টেনে নিয়ে এল জ্যাকসনের হাতে বানানো একটা শ্লেড। রবিনের পাশে এনে রাখল। রবিনকে শ্লেডে তুলে দেয়া হলো। মুসা উঠে বসল তার মাথার কাছে। গরম রাখার জন্যে রবিনের মাথাটা দুই হাতে চেপে ধরে রাখল।
স্নোমোবাইল চালানো শুরু করল গ্রাহাম।
রবিন? জেগে আছ তত? রবিনের নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
বিড়বিড় করে কিছু বলল রবিন, স্নোমোবাইলের এঞ্জিনের গর্জনে বোঝা গেল না।
তার ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে এল মুসা।
পায়ের তালুতে কোন সাড়া নেই, রবিন জানাল।
মুসা জানে, রবিনের জন্যে এ সময়টা এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। ঠাণ্ডা পানিতে কাটিয়ে এসে দেহ ঠাণ্ডা। তার ওপর গায়ের সমস্ত কাপড়-চোপড় ভেজা। বরফ-ঠাণ্ডা বাতাসের সংস্পর্শে এসে সেগুলো জমে যেতে আরম্ভ করেছে। তাতে দেহটা আরও দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
জেগে থাকো, রবিন, মুসা বলল। খবরদার, ঘুমিয়ে না। এসে গেছি আমরা।
.
স্নোমোবাইলের পেছন পেছন দৌড়ে চলেছে কিশোর। কি মনে হতে থেমে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। লেকের কোনখানে দেখতে পেল না জ্যাকি কিংবা রকিকে। সন্দেহটা জোরালো হলো তার। ইচ্ছে করে ওদেরকে পাতলা বরফের দিকে টেনে নিয়ে গেছে, দুই ভাই। একটাই উদ্দেশ্য। পানিতে ফেলে খুন করা। লোকে ব্যাপারটাকে দেখবে অ্যাক্সিডেন্ট হিসেবে। শত্রুকে শেষ করে দেয়া হবে। নিজেদেরও কিছু হবে না।
চমৎকার পরিকল্পনা।
কিন্তু কেন করল?
কারণ, সঠিক পথেই এগোচ্ছে তিন গোয়েন্দা।
তার মানে, চুরিগুলোর পেছনে যে জ্যাকি আর রকির হাত আছে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকল না আর।
*
মুখ তুলে শার্লিদের বাড়ির দিকে তাকাল মুসা।
হাত নাড়তে দেখল শার্লিকে।
বাড়ির পেছনের দরজার কাছে এনে স্নোমোবাইল থামাল গ্র্যাহাম।
পানিতে পড়ে গিয়েছিল রবিন, শার্লিকে জানাল মুসা।
শ্লেড থেকে রবিনের প্রায় জমে যাওয়া দেহটা গ্রাহামের সহায়তায় তুলে নিল সে।
ওকে যে তোমরা তোলার চেষ্টা করেছ, দেখেছি আমরা, শার্লি জানাল। রেডি হয়ে আছে মা।
রবিনকে বয়ে নিয়ে আসা হলো।
জরুরী কণ্ঠে বেলী আন্টি বললেন, সোজা ওকে বাথরুমে নিয়ে যাও। কাপড়-চোপড় সব খুলে ফেলো। শার্লি, চুলায় গরম পানি হয়ে গেছে। যা, নিয়ে। আয়। আমি আসছি।
ধরাধরি করে রবিনকে নিয়ে চলল মুসা আর গ্রাহাম। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগল।
দোতলায় এসে সোজা বাথরূম।
গরম পানি দিয়ে টাবটা ভর্তি করে রেখেছেন বেলী আন্টি। মুসা আর গ্রাহাম মিলে দ্রুত হাতে রবিনের গায়ের সমস্ত জামা-কাপড় খুলে দিল। শুধু আন্ডারওয়্যার বাদে। বাথরূমে ঢুকলেন বেলী আন্টি।
লজ্জা-শরমের সময় নেই এখন, বললেন তিনি। প্রাণ বাঁচানোটাই আসল কথা। এগুলোও খোলো। তারপর গরম পানিতে শোয়াও।
যে ভাবে যা করতে বলা হলো, অক্ষরে অক্ষরে পালন করল মুসা আর গ্রাহাম।
ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া দেহ গরম পানিতে রাখতেই কেঁপে উঠল রবিন।
ওর দিকে চোখ রাখো, বেলী আন্টি বললেন। আমি গরম কিছু নিয়ে আসিগে অ্যামবুলেন্সকে ফোন করে দেয়া হয়েছে। চলে আসবে যে কোন সময়।
কিশোর ঢুকল এ সময়। শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকাল রবিনের দিকে। ও ভাল হবে। তো?
পানিতে খুব বেশিক্ষণ ছিল নাকি? জানতে চাইলেন বেলী আন্টি।
হিসেব রাখতে পারিনি। মিনিট তিনেক হবে বড় জোর। পানি থেকে যখন তুললাম, তখন জ্ঞান ছিল ভালমতই।
তাহলে চিন্তা নেই। ভাল হয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে জেগে উঠতে শুরু করল রবিন।
রঙ ফিরতে লাগল শরীরে।
ওকে খাওয়ানোর জন্যে এক মগ গরম পানি নিয়ে এলেন বেলী আন্টি। বললেন, ওর ভেতরটাও গরম করা দরকার।
ডাক্তার আসতে আসতে রীতিমত সুস্থ হয়ে গেল রবিন। উঠে বসল টাবের মধ্যে। বিমূঢ়ের মত তাকাতে লাগল।
বাথরূমে ঢুকলেন ডাক্তার। কেমন আছ এখন?
ভাল, দুর্বল কণ্ঠে জবাব দিল রবিন।
তার দেহের তাপমাত্রা দেখলেন ডাক্তার। নাড়ি দেখলেন। ব্লাড প্রেশার মাপলেন। তোমার কপাল ভাল, তাড়াতাড়ি তুলে ফেলেছে। গা ভালমত গরম করতে হবে এখন। তবে বিপদ কেটে গেছে।
কত রকম ভুল কথা বলে মানুষ। এত ভোগান্তির পর কপাল ভাল হয় কি করে? ভাল তো হত যদি একেবারেই না পড়ত, মুসা বলল। রবিন বেঁচে যাওয়াতে অতি আনন্দে দিশেহারা।
হেসে ফেললেন ডাক্তার। পরিস্থিতির আড়ষ্ট ভাবটা কেটে গেল। হাসিটা সংক্রমিত হলো উপস্থিত সবার মাঝে।
পুরোপুরি ভাল হতে কত সময় নেবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভাল মোটামুটি হয়েই গেছে। প্রাণশক্তি খুব বেশি। আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি আমরা ওকে। তবে তার বোধহয় আর প্রয়োজন হবে না। যা করার মিসেস মরগানই করতে পারবেন। ওকে বিছানায় রেখে মাঝে মাঝে টেম্পারেচার পরীক্ষা করা আর গরম তরল খাবার খাওয়ানো ছাড়া কিছুই করা লাগবে না।
ফিরে তাকাল কিশোর। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন বেলী আন্টি। আপনি কি বলেন, আন্টি? হাসপাতালে পাঠাব?
ডাক্তারের সঙ্গে আমিও একমত। আমার মনে হয় না আর নেয়ার কোন প্রয়োজন আছে।
তাহলে আমি বরং থেকেই যাই, রবিন বলল। এখানে সবার সামনে হাসপাতালের চেয়ে ভাল থাকব।
থাকতে পারো, হেসে বললেন বেলী আন্টি, এক শর্তে। আমার কথা সব শুনতে হবে। ইচ্ছে করলেই উঠে বেরিয়ে যাওয়া চলবে না।
না না, যাব না, রবিন এক কথায় রাজি। হাসপাতালে যাওয়ার চেয়ে যে। কোন শর্ত মেনে নেয়া অনেক ভাল। যা বলবেন তাই করব। পথ্য যা খেতে দেবেন, খাব।
হেসে বেরিয়ে গেলেন ডাক্তার।
রবিনকে একটা মেয়েদের বাথরোব এনে দিলেন বেলী আন্টি। পশমী মোজা দিলেন। ভেজা কাপড়-চোপড়গুলো ড্রাইয়ারে ঢোকালেন শুকানোর জন্যে। রবিনকে বললেন, আগুনের কাছে গিয়ে বসে থাকোগে।
রোবটা গায়ে দিল রবিন। উসখুস করতে লাগল।
কি হলো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এ রকম একটা বাথরোব পরে এখানে মেয়েমানুষদের সামনে ঘোরাফেরা করতে লজ্জা লাগছে আমার, আড়চোখে শার্লির দিকে তাকাল রবিন।
তাতে কি হয়েছে? গায়ে কাপড় তো আছে, কিশোর বলল।
খানিক আগে বাথরূমে যে অবস্থায় ছিলে সে ভাবেই যে থাকতে বলেননি, এটাই বরং তোমার ভাগ্য, মুসা বলল।
মুচকি হাসলেন বেলী আন্টি। হাসিটা বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ঠেকানোর জন্যে কৃত্রিম ধমক লাগালেন, এখনই কিন্তু কথা না শোনা শুরু করেছ তুমি।
আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আর দ্বিধা করল না রবিন। তাড়াতাড়ি গিয়ে আগুনের কাছে বসে পড়ল।
মুসা আর কিশোর বসল তার কাছাকাছি।
গরম চকলেট ড্রিংক এনে দিল শার্লি।
আগুনের উত্তাপ শোষণ করতে লাগল রবিনের শরীর। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করল। কিশোরের দিকে তাকাল সে। লেকে আসলে কি ঘটেছিল তখন, বলো তো?
জ্যাকি আর রকি এ রকম করল কেন জানতে চাইছ তো?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল রবিন।
আমার বিশ্বাস, ইচ্ছে করেই আমাদেরকে পাতলা বরফের ওপর টেনে নিয়ে। গিয়েছিল ওরা, কিশোর বলল।
শেষ দিকে আমারও তাই মনে হচ্ছিল, রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল মুসার কণ্ঠে। রবিন পড়ে যাওয়ার পর ওর দিকে ছাড়া আর কোনদিকে তাকানোর সুযোগ ছিল না। কিশোরের দিকে তাকাল সে। ওরা কি করেছে দেখেছ নাকি?
নাহ্, মাথা নাড়ল কিশোর। আমার নজরও রবিনের দিকেই ছিল। পরে যখন খেয়াল হলো, ফিরে তাকালাম, দেখি ওরা দুজন চলে গেছে।
অ, ওরা আর সবার মত ছুটে আসেনি?অবাক হলো রবিন।
না।
এ সময় শার্লি ঢুকল ঘরে। রবিনের কাছে এসে বলল, তোমার পকেটের জিনিসপত্র। একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ পাওয়া যায় কিনা দেখি, ভরে রাখার জন্যে।
তাহলে তো ভালই হয়, শার্লির হাত থেকে মানিব্যাগটা নিয়ে আগুনের সামনে রাখল রবিন। থাক এখানে। শুকাক।
আর এই যে তোমার হিসেবের কাগজ, জ্যাকসনের ঘর থেকে নকল করে। আনা কাগজটা রবিনের হাতে দিল শার্লি।
ওহহো, ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা। সাবধানে ভেজা কাগজটার ভাজ খুলল সে, যাতে ছিঁড়ে না যায়। কালি জাবড়ে গেছে। তবে পড়া যায় নম্বরগুলো।
জিনিসপত্রগুলো দিয়ে চলে গেল শার্লি।
বেলী আন্টি রান্নাঘরে।
নম্বরগুলো দেখতে দেখতে কিশোর বলল, কি ভাবে পড়তে হবে? ওপর থেকে সারি দিয়ে নিচের দিকে, না পাশের দিকে জোড়ায় জোড়ায়?
কি জানি, হাত ওল্টাল রবিন।
মুসার দিকে তাকাতেই মাথা নাড়ল মুসা, আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই, যেটা তুমি বুঝতে পারছ না, সেটা আমি কি করে বুঝব?
খানিকক্ষণ নম্বরগুলো নিয়ে মাথা ঘামাল ওরা। কিন্তু কি ভাবে পড়লে বা মানে কি এগুলোর– কোন সমাধান করতে পারল না।
হঠাৎ তুড়ি বাজাল রবিন। কে পারবে জানো? রয় কভারলি।
ভুরু কুঁচকাল কিশোর। কভারলিটা কে?
কম্পিউটারের জাদুকর। শার্লির মামাত ভাই। ওর কাছে এ ধরনের যে সমস্যা নিয়ে যাবে, সমাধান করে দেবে। সেবার কিডন্যাপ করা বাচ্চাটাকে? বের করতে আমাকে অনেক সাহায্য করেছিল সে।
কিশোর বলল, তোমার যখন এত আস্থা, তার কাছেই যাওয়া দরকার
ফোন বাজল।
রান্নাঘরের এক্সটেনশন থেকে ধরলেন বেলী আন্টি। ডেকে বললেন, কিশোর, তোমাদের চায়। যে কেউ একজন আসো।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। তোমরা বসো। আমি দেখে আসি, কে।
রান্নাঘরে ঢুকে বেলী আন্টির হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে কানে ঠেকাল কিশোর।
ওপাশের কথা শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে গেল সে। বেলী আন্টি লক্ষ করলো। ব্যাপারটা। রিসিভারটা রেখে দিয়ে যখন ঘুরল কিশোর, জিজ্ঞেস করলেন, কি?
আসুন, ফায়ারপ্লেসের কাছে। সবাইকে একবারেই বলি।
কিশোর বসার ঘরে ঢুকতেই মুসা জিজ্ঞেস করল, কার ফোন?
জানি না, জবাব দিল কিশোর। শার্লির দিকে তাকাল। ওপর থেকে কাজ সেরে এসে সে-ও বসেছে এখন ফায়ারপ্লেসের কাছে। একটা অচেনা পুরুষ কণ্ঠ। আমার মাধ্যমে মরগান আঙ্কেলদেরকে একটা মেসেজ দিতে চায়।
দুঃসংবাদ। বুঝতে পারলেন আন্টি। কি মেসেজ?
হুমকি দিল আপনাদেরকে…
কি হুমকি? চিৎকার করে উঠল শার্লি।
আস্তে! কিশোরের দিকে তাকালেন আবার বেলী আন্টি। কি বলল?
বলল, তিন গোয়েন্দাকে সাহায্য করেছেন। এখন বিপদের জন্যে প্রস্তুত হোন।
কিশোরের কথা শেষ হতে না হতেই তীক্ষ্ণ, জোরাল একটা শব্দ হলো।
গুলির শব্দের মত।
.
১১.
মাথা নিচু! মাথা নিচু! চিৎকার করে উঠল কিশোর। বসে পড়ো সবাই মেঝেতে!
পাশে বসা শার্লির হাত ধরে একটানে নিচে নামিয়ে ফেলল মুসা। একই সঙ্গে নিজেকেও ছুঁড়ে দিল মেঝেতে।
রাবন নিজেই নামতে পারল।
বেলী আন্টিকে সাহায্য করল কিশোর।
অপেক্ষা করে রইল ওরা। কিন্তু গুলির শব্দ আর হলো না।
নিচেই থাকো, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ওরাও হয়তো অপেক্ষা করছে। আমাদের ওঠার জন্যে।
আরও দুতিন সেকেন্ড অপেক্ষা করে আচমকা লাফিয়ে উঠে দরজার দিকে দৌড় দিল সে।
কিশোর, কোথায় যাচ্ছ! মুসা বলল। কি করছ তুমি? মরবে তো!
জবাব দিল না কিশোর। এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে ফেলে বাইরে লাফিয়ে পড়ল। এঁকেবেঁকে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল একটা ঝোঁপের মধ্যে।
ঘরে যারা অপেক্ষা করছে তারা কান পেতে আছে। কিশোর কোথায় আছে, কি করছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। মাঝে মাঝে সামান্য খসখস ছাড়া আর কোন শব্দ আসছে না ওদের কানে।
অনন্তকাল ধরে যেন পড়ে রইল ওরা ঘরের মেঝেতে।
অবশেষে সামনের দরজায় শব্দ হলো।
পাল্লাটা খুলল।
ভেতরে ঢুকল জুতোর শব্দ।
বন্ধ হলো পাল্লাটা।
ঠিক আছে, এখন উঠতে পারো। কিশোরের কণ্ঠ।
সবার আগে উঠে পড়ল শার্লি। ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, হাতে একটা বড় ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর।
ঘরের কোণে ডালটা নামিয়ে রেখে এসে আগুনের কাছে বসল সে। ডাল ভাঙার শব্দ হয়েছিল। গুলি নয়।
জিমের অত শখের জাপানী ফেদার ম্যাপলের ডাল, বেলী আন্টি বললেন। রেগে আগুন হয়ে যাবে ও। কিন্তু ডাল ভাঙতে এল কেন?
নিশ্চয় ডালের ওপর উঠে বসে নজর রেখেছিল ঘরের ভেতর, জবাব দিল কিশোর। টেলিফোন পেয়ে আমাদের কি প্রতিক্রিয়া হয়, দেখতে চাইছিল হয়তো। ফিরে গিয়ে যে ফোন করেছে তাকে জানাত।
পড়ে গিয়ে কোমরটা যদি ভাঙত আমি খুশি হতাম, রাগত স্বরে বলল মুসা।
মুসার দিকে তাকাল কিশোর। দুঃখের বিষয়, খুশিটা আর হতে পারলে না। চলো এখন, রয়ের ওখান থেকে ঘুরে আসি। রবিন, তুমি থাকো। শার্লিকে ঝলল, শার্লি, দাও তত দ্রুত একটা চিঠি লিখে। তোমার মামাত ভাইয়ের কাছে। কাগজ কলম নাও। যা যা বলি, লেখো।
আমি গেলে অসুবিধে কি? রবিনের প্রশ্ন।
না, মাথা নাড়লেন বেলী আন্টি। তোমার শরীর এখনও বাইরে বেরোনোর উপযুক্ত হয়নি।
রয়ের কাছে কেন যাচ্ছে, সংক্ষেপে বেলী আন্টি আর শার্লিকে জানাল কিশোর।
শার্লি বলল, রয়কে একটা ফোন করে দিলেই তো হয়। আমিও দিতে পারি। রবিনও পারে।
উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর। চমকে দেয়ার মজাটা আর তাহলে থাকে না। টেলিফোনেই যদি কাজটা সেরে ফেলা যেত, যাওয়া আর না লাগত, তাহলে আলাদা কথা ছিল। কিন্তু যাওয়া যখন লাগবেই, গিয়েই পরিচয় করে নেব। জানাব সব।…দাও দাও, চিঠিটা লিখে দাও। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
*
যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কেসটার কিনারা করে ফেলা জরুরী, কিশোর বলল। ফোনে ওই হুমকি দেয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকবেন মরগান আঙ্কেলরা।
বনের ভেতরের সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে মুসা। জ্যাকসনদেরই সন্দেহ করছ এখনও?
সন্দেহটা এখন পর্যন্ত ওদিকেই তো বেশি যাচ্ছে। তাই না? বিশেষ করে আমাদেরকে পাতলা বরফের দিকে নিয়ে যাওয়ার পর।
তা বটে। ম্যারিল্যান্ডে জ্যাকি আর রকি কারও কাছে কোন রকম জিনিস বিক্রি করেছে কিনা, সে-খোঁজ নিতে এখন বলা যেতে পারে ডোবারকে। ওদের বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় হয়ে যাবে।
তারচেয়ে ভাল হয়, যদি চোরাই মালগুলো বের করে ফেলতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এবারের মৌসুমে যা চুরি করেছে, সব পাইনভিউতেই আছে এখনও। সরায়নি। লুকিয়ে রেখেছে। শীতের পর নিজেরা যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।
সারাটা পথ আলোচনা করেও কি ভাবে মালগুলো বের করবে, তার কোন সমাধান বের করতে পারল না ওরা।
*
রয় কভারলিকে পেল ওরা, রয়দের বাড়ির বোমেন্টে। মাটির নিচের এই মস্ত ঘরটায় রয়ের ওঅর্কশপ। বড় একটা ওঅর্কবেঞ্চে বসে গভীর মনোযোগে কাজে ব্যস্ত। চারপাশে ছড়ানো ছিটানো কম্পিউটারের অসংখ্য পার্টস। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ জোড়া দিয়ে একটা কম্পিউটার তৈরি করছে।
রয়, তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, দূরজায় উঁকি দিয়ে মিসেস কভারলি বললেন।
কি করছ? জিজ্ঞেস করল মুসা।
ফিরে তাকাল রয়। চোখ থেকে সেফটি গগলসটা খুলে নিল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দুই গোয়েন্দার দিকে। দুচোখে প্রচণ্ড বিস্ময়। তোমরা?
আমি কিশোর পাশা, ও মুসা..।
আরে জানি জানি! কিন্তু এলে কি ভাবে?
রবিন আর শার্লির কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে।
রবিন কই?
পাইনভিউতে, জবাবটা দিল মুসা। পানিতে ডুবে আধমরা হয়ে এখন আগুনের সামনে দম নিচ্ছে।
দেখেই চিনলে কি করে আমাদের? কিশোরের প্রশ্ন। নিশ্চয় আমাদের ছবি এত বেশি দেখিয়েছে রবিন…।
মাথা ঝাঁকাল রয়। তারপর লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, দেখো, কথাই বলে যাচ্ছি শুধু। বসতে বলতেও ভুলে গেছি। এসো এসো, ভেতরে এসো।
তারা কথা বল, মিসেস কভারলি বললেন। আমি চা পাঠাচ্ছি।
একটা বিষয়ে আটকে গেছি, রয়, বলল কিশোর। তোমার কম্পিউটার জ্ঞান দিয়ে কোন সাহায্য পাওয়া যায় কিনা, দেখতে এলাম। রবিন বলল, তুমি এ ধরনের কাজে বিশেষজ্ঞ।
পকেট থেকে শার্লির চিঠিটা বের করে দিল কিশোর।
পড়ে বলল রয়, এটার কোন প্রয়োজন ছিল না। তোমরা সোজা এসে। বললেই পারতে।,
তখন কি আর জানতাম, দেখামাত্র চিনে ফেলবে।
যাকগে, বলো কি করতে হবে? জানতে চাইল রয়।
পকেট থেকে নম্বর লেখা কাগজটা বের করে রয়ের হাতে দিল কিশোর।
কাগজটার দিকে তাকিয়ে রয় বলল, ভিজল কি করে?
ওই যে বললাম, চুবানি খেয়েছে। পাইনভিউ লেকের পানিতে সাঁতার কাটতে নেমেছিল রবিন, মুসা বলল।
চোখ কপালে উঠল রয়ের। তার মানে! পাগল হয়ে গেছে?
পাইনভিউতে চুরির খবর জানা আছে রয়ের। তিন গোয়েন্দা কেসটা হাতে নেয়ার পর কি কি ঘটেছে জানাল ওকে কিশোর। সব শেষে কাগজটা দেখিয়ে বলল, আমার ধারণা, পাইনভিউ লেকের চুরি-ডাকাতিগুলোর সঙ্গে এ নম্বরগুলোর কোন সম্পর্ক আছে। কোন ধরনের কোডও হতে পারে।
তীক্ষ দৃষ্টিতে লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল রয়। মুখ তুলে বলল, চলো, ওপরে।
ওপরে এসে কিশোর বলল, তোমাদের ফোনটা ব্যবহার করা যাবে?
রান্নাঘরের দিকে হাত নেড়ে রয় বলল, কিরো গিয়ে।
কাকে করবে? জানতে চাইল মুসা।
ডোবার কগনানকে। যাও না। তুমিই করে এসো না। জিজ্ঞেস করবে, নতুন কিছু জানতে পারল কিনা।
ফোন সেরে দোতলায় চলে এসো, রয় বলল। ডান দিকের প্রথম ঘরটা।
নিজের ঘরে কিশোরকে নিয়ে এল রয়। কাণ্ডই করে রেখেছে। ঘরের দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চিতে ইলেকট্রনিক যন্ত্র লাগানো। তারের জটলা দেখে মনে হয় না এগুলো আর কোনদিন ছাড়ানো যাবে।
একটা কম্পিউটারের সামনে বসে পড়ল রয়। প্রথমে কাগজের নম্বরগুলো টাইপ করে নিল। তারপর একটা ম্যাথমেটিক্যাল টেস্ট চালাল সেগুলোর ওপর।
বুঝলে কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়ল রয়। এখনও না।
কোন ধরনের সাঙ্কেতিক লেখা নাকি?
মনে হয় না। প্রথম সারির নম্বরগুলো দেখো ভালমত খেয়াল করে। সাত তিন অর্থাৎ তিয়াত্তর দিয়ে শুরু। সবগুলোই। দ্বিতীয় সারিরগুলো চার শূন্য অর্থাৎ চল্লিশ। তারপর ফুলস্টপ। আবার একজোড়া সংখ্যা। আবার ফুলস্টপ। আবার সংখ্যা…
রয়ের কাঁধের ওপর দিয়ে নম্বরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আচমকা চিৎকার করে উঠল কিশোর, ইস, আমি একটা গাধা! অনেক আগেই বুঝে যাওয়া উচিত ছিল আমার। রয়, ম্যাপ আছে?
এবার অবাক হওয়ার পালা রয়ের। তা তো আছে। কিন্তু কি বুঝলে?
ম্যাপটা কোথায়? উত্তেজিত হয়ে উঠেছে কিশোর।
বুকশেলফ থেকে একটা ম্যাপ এনে দিল রয়।
বুঝলে না এখনও? কিশোর বলল। লনগিটিউড এবং ল্যাটিচিউড।
হাসি ছড়িয়ে পড়ল রয়ের মুখে। ঠিক। ঠিক বলেছ। কিন্তু তার জন্যে তো ম্যাপ বইয়ের দরকার নেই।
কম্পিউটারেই একটা ম্যাপের প্রোগ্রাম খুলে নিল রয়। মাউসের সাহায্যে লনগিটিউড ৭৩ ও ল্যাটিচিউড ৪০-এর চারপাশে রেখা একে একটা বাক্স তৈরি করল। মাউসের সাহায্যেই বাক্সটাকে বড় করতে লাগল।
নিউ ইয়র্ক, কিশোর বলল।
কাগজের নম্বর দেখে টাইপ শুরু করল রয়। রিটার্ন বাটন টিপতেই বড় হয়ে সামনে এগিয়ে এল ম্যাপ।
নিউ পোর্ট, বলে উঠল কিশোর। উত্তেজনায় গলা কাঁপছে। আরও জুম করো। টার্গেট ঠিক করো।
কাগজের নম্বরের সারি দেখে আবার নম্বর টাইপ করল রয়। পাইনভিউ লেকের ওপর লাল রঙের ক্রস চিহ্ন জুলতে নিভতে শুরু করল।
এটাই তোমার জায়গা, কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে রয়ও উত্তেজিত হয়ে। উঠেছে।
লেকের মধ্যে? আনমনে যেন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল কিশোর।
হ্যাঁ।
ঘরে ঢুকল মুসা। ডোবারের সঙ্গে কথা বললাম। নতুন কিছু পায়নি। বলল, আরও কয়েক জায়গায় খোঁজ নেবে।
নিতে থাকুক। এসো, দেখে যাও।
কিছু পেলে নাকি? এগিয়ে এল মুসা।
তোমাদের নম্বরগুলো হলো লনগিটিউড এবং ল্যাটিচিউড, রয় বলল।
মানে? কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে রইল মুসা।
ওকে ওভাবেই থাকতে দিয়ে কিশোর বলল রয়কে, এগিয়ে যাও। দেখা যাক, কি আসে?
আবার খানিকক্ষণ নম্বর টিপল রয়। লেকের ওপর এখন জ্বলতে-নিভতে শুরু করল লাল ক্রস।
দরজায় থাবা পড়ল এ সময়। রয়ের মা ডাকলেন, এই, চা নিয়ে যা।
তুমি কাজ করো, মুসা বলল। আমি আনছি।
দরজা খুলে মিসেস কভারলির হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে ফিরে এল। তাতে চা আর বিস্কুট। একটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল।
ট্রের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ফেরাল কিশোর। নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটল দুবার। মাছ ধরার অতি চমৎকার জায়গা! মুসার দিকে তাকাল সে। এত ভাল জায়গাগুলো বিছানার নিচে লুকিয়েছে কেন, বলো তো?
মুসার হা-টা আরও বড় হলো। অহেতুক কেন আমার মাথাটাকে গুলিয়ে দিচ্ছ?
জবাবটা নিজে নিজেই দিল কিশোর, গোপন রাখার জন্যে। উন্নত আধুনিক যন্ত্রপাতি পছন্দ করে না বুড়ো জ্যাকসন। কাগজটা দেখলে নিশ্চয় কিছু বুঝতে পারবে না সে।
মজা পেয়ে গেছে রয়। দ্রুত টাইপ করে চলেছে তার আঙুলগুলো। লেকের ওরে আরও কয়েক জায়গায় লাল ক্রস আবিষ্কার করল।
আর দরকার নেই, কিশোর বলল। লেকে গিয়ে এখন খোঁজ নিতে হবে। রয়, ক্রসগুলো সহ তোমার ম্যাপের এই অংশটার একটা প্রিন্ট দিতে পারবে?
তা তো পারবই। সঙ্গে আরও ভাল জিনিসও দিতে পারব।
একটা তাকের কাছে গিয়ে দাঁড়াল রয়। নানা ধরনের ছোট ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির মধ্যে থেকে একটা যন্ত্র টেনে বের করল। দেখতে সেলুলার ফোনের মত যন্ত্রটার বড় একটা এলসিঁড়ি স্ক্রীন আছে। কিশোরকে দিয়ে বলল, এটা ব্যবহার করতে পারো। গ্লোবাল পজিশনিং স্যাটেলাইট সিসটেম। সংক্ষেপে জিপিএস। স্যাটেলাইটকে ব্যবহার করে এটা তোমার অবস্থান বলে দিতে পারবে। বোঝা যাবে তুমি কোথায় আছ। যে ক্রস চিহ্নগুলো আবিষ্কার করলাম, নিখুঁত ভাবে ওই সব জায়গা বের করা যাবে এটার সাহায্যে। জায়গাগুলোতে কি আছে, খুঁজলেই বেরিয়ে পড়বে। কখন রওনা হচ্ছি আমরা?
মুসার দিকে তাকাল কিশোর, কখন?
দেরি করে লাভ কি? জবাব দিল মুসা। যদিও মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারিনি এখনও আমি।
চলো। যেতে যেতে বলছি।
চাটা খেয়ে নাও, রয় বলল।
*
গাড়িতে এসে উঠল ওরা। জিপিএসটা আর ম্যাপের প্রিন্টআউট সঙ্গে নিয়েছে রয়।
লেকের কাছে যখন পৌঁছল ওরা, অন্ধকার হয়ে গেছে। শীতের ঠাণ্ডা রাত নামছে। তুষার পড়ছে। মেঘে ঢাকা চাঁদ। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ঝোড়ো বাতাস ঝাঁপটা দিয়ে যাচ্ছে। টান মারছে পরনের কয়েক প্রস্থ পোশাকের একেবারে ভেতরেরটা ধরেও।
কষ্ট আর ভোগান্তি জোগাড়ের সমস্ত উপায়গুলো মনে হচ্ছে তোমাদের জানা, গায়ের কোটটা টেনে দিতে দিতে বলল রয়।
এলে কেন? কিশোর বলল। স্পটগুলো খুঁজে বের করো।
কোন রকম ঝুঁকি নিল না সে। গাড়িতে চুরি আছে। সোজা দেখে কয়েকটা ডাল কেটে নিল ছড়ির মত ব্যবহারের জন্যে। ডালগুলো হেঁটেছেটে সাফ করে নিল।
রবিন তো দিনে পড়েছিল বলে রক্ষা। কিশোরের হাত থেকে একটা ডাল নিয়ে নিল মুসা। অন্ধকারের মধ্যে এখন পানিতে পড়লে বাঁচতে হবে না আর।
লেকে নেমে পড়ল ওরা। লাঠি ঠুকতে ঠকতে আগে বাড়ল। ম্যাপ দেখে। এগোল, সবচেয়ে কাছের স্পটটার দিকে। ম্যাপ আর জিপিএস-এর স্ক্রীনের সবুজ আভার দিকে নজর রয়ের। বরফ ঠুকতে ঠকতে আগে আগে চলেছে কিশোর। রয় মাঝখানে। পেছনে মুসা, টর্চের আলো ফেলে পথ দেখাচ্ছে।
কিছু দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল রয়।
পাচ্ছি। বরফ। জবাব দিল কিশোর।
বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে চিৎকার করে বলল রয়, কি জিনিস খুঁজতে এসেছি আমরা?
বলতে পারলে খুশি হতাম।
ডাকাতির মাল লুকিয়ে রাখেনি তো স্পটগুলোতে? তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে লেকের পাড়ের বাড়িগুলোকে দেখার চেষ্টা করল রয়।
মনে তো হচ্ছে। এখনও কেউ মাছ ধরছে নাকি দেখা যাক।
বলাটা যত সহজ, করা ততটাই কিংবা তারচেয়েও বেশি কঠিন হলো। তাজা, তুষার বরফ ঢেকে দিচ্ছে। এক জায়গায় এসে থামল রয়। পা দিয়ে খোঁচা মেরে। সেখান থেকে তুষার সরিয়ে দিতে লাগল মুসা। দেখাদেখি কিশোর আর রয়ও তা-ই করতে লাগল। কয়েক মিনিট অবিরাম চেষ্টা করে আট ফুট ব্যাসের গোল একটা জায়গা থেকে তুষার সরিয়ে ফেলল ওরা। নিচের কঠিন বরফ বেরিয়ে এল। টর্চের আলো ফেলে দেখতে লাগল মুসা।
কিছু দেখছ? জিজ্ঞেস করল রয়।
পরিষ্কার করা জায়গাটায় নতুন করে তুষার এনে ফেলছে ঝোড়ো বাতাস।
নাহ্, কিছুই নেই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল রয়। এ স্রেফ পাগলামি! অকারণ কষ্ট!
এত তাড়াতাড়িই কাবু হয়ে গেলে? তোমার আসার ইচ্ছে দেখে তো মনে হচ্ছিল গোয়েন্দাগিরির খুব শখ? মুসা বলল। গোয়েন্দাগিরিটা কষ্টেরই। আরাম করে এ কাজ হয় না।
থাক থাক। আর লেকচার দেয়া লাগবে না, জবাব দিল রয়।
হাটু গেড়ে বসে পড়ল কিশোর।
পাতলা বরফ নাকি দেখো আগে, সাবধান করল মুসা। রবিনের পড়ে ওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করে শিউরে উঠল নিজের অজান্তেই।
কিছু একটা আছে এখানে, কিশোর বলল। আলোটা আরও সরাও তো দেখি।
কিশোরের নির্দেশিত জায়গায় আলো ফেলল মুসা। বরফের গায়ে একটা খাজমত চোখে পড়ল ওখানে। ম্যানহোলের ঢাকনার চেয়ে ছোট।
একটা গর্ত, কোন সন্দেহ নেই, দেখতে দেখতে বলল কিশোর। বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে।
আলোটা আরও কাছে নিয়ে এল মুসা। আলোকরশিতে ধরা পড়ল চকচকে ছোট একটা জিনিস। বরফের মধ্যে গেঁথে রয়েছে।
কি ওটা? মুসার প্রশ্ন।
নতুন করে পড়া তুষারে দ্রুত ঢেকে যাচ্ছে জিনিসটা। হাত দিয়ে ডলে পরিষ্কার করে নিল কিশোর। টিনের পাত মনে হচ্ছে।
কোকের ক্যানের হতে পারে। এখানকার মানুষগুলো বড় নোংরা। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে, রয় বলল।
এখানে ময়লা ফেলতে আসবে কে? তা ছাড়া কোকের ক্যানের টিন এ রকম নয়।
তা-ও তো কথা। পরের স্পটটায় দেখব নাকি? রয় বলল। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমিও বরফ হয়ে যাচ্ছি।
চলো, দেখাই যাক, উঠে দাঁড়াল কিশোর।
কি করে খুঁজতে হয় বুঝে ফেলেছে এখন ওরা। পরের স্পটটা বের করতে সময় লাগল না। প্রথমটার মতই একই রকম আরেকটা বুজে যাওয়া গর্ত দেখতে পেল। লেকের বরফের ওপর তুষারের আস্তর জমে আবার বরফ হয়েছে। স্তর দুটো আলাদা ভাবে বোঝা যায়।
এখানেও তো তেমন কিছু দেখছি না, হতাশ ভঙ্গিতে বলল কিশোর। দেখি, আরেকটা।
এত ঠাণ্ডা, উফ! রয় বলল।
ঠাণ্ডার জায়গায় ঠাণ্ডা তো হবেই, উঠে দাঁড়িয়ে রয়ের হাত থেকে ম্যাপটা নিয়ে নিল কিশোর।
তৃতীয় স্পটটায় এসে আবার গোল করে বরফ পরিষ্কার করল। আগের দুটোর মতই গোল একটা গর্তের চিহ্ন। বুজে গেছে বরফে। এটার মাঝখানেও প্রথমটার মত টিন গোঁজা।
নাহ, এখানকার লোকগুলো সত্যি… বলতে গেল রয়।
চুপ! ওকে থামিয়ে দিল মুসা। আলো নিভিয়ে দিল।
কি হয়েছে? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রয়।
শব্দ, কান পেতে আছে মুসা। ইঞ্জিনের।
ওদের পায়ের নিচের বরফে শব্দ বাড়ি দিতে শুরু করল। বাড়তে লাগল। ক্রমে। মুহূর্ত পরেই বোঝা গেল ওটা ইঞ্জিনের শব্দ। বরফে আঘাত হানাতে ওরকম শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। ওদের দিকেই এগিয়ে আসছে। ঘুরে সেদিকে টর্চের আলো ফেলল মুসা। চকচকে ক্রোমের ওপর গিয়ে পড়ল আলো।
পালাও! চিৎকার করে উঠল কিশোর।
একটা ট্রাককে ছুটে আসতে দেখা গেল ওদের দিকে। সে আর রয় ঘুরে ডাইভ দিয়ে পড়ল এক দিকে। মুসা আরেক দিকে। কয়েক ইঞ্চির জন্যে বেঁচে গেল কিশোর। তার পাশ দিয়ে ট্রাকটা যাওয়ার সময় টর্চের আলোয় দেখতে পেল বডিতে লেখা: মেরিন ডগলাস স্যালভিজ।
.
১২.
গর্জন করতে করতে ছুটে অন্ধকারে হারিয়ে গেল ট্রাক।
চিৎকার করে উঠল কিশোর, মুসা, কোথায় তুমি?
আমি এখানেই আছি। ভাল। তোমরা?
আমি ভাল নেই, জবাব দিল রয়। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।
তার কথায় পাত্তা না দিয়ে অন্ধকারে ট্রাকটা যেদিকে চলে গেছে সেদিকে তাকিয়ে মুসা বলল, দেখা দরকার, কে এ রকম করে রাতের বেলা চড়াও হতে এসেছিল আমাদের ওপর।
ট্রাকটা তো ডগলাসের! উঠে দাঁড়াল কিশোর।
তারমানে ডগলাসই চোর? মিথ্যে সন্দেহ করেছি আমরা জ্যাকি আর রকিকে? আলো ফেলে ডালটা খুঁজতে লাগল মুসা।
আমাদের খুন করতে চেয়েছিল নাকি? রয়ের প্রশ্ন।
বুঝলাম না, জবাব দিল কিশোর। খুন করার ইচ্ছে থাকলে তো ঘুরে আবার আসত।
ভয় দেখাতে এসেছিল আমাদের, মুসা বলল। বরফে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে একটা বোনাস মজা দিয়ে দিলাম আমরা।
ডগলাস কিনা সন্দেহ আছে আমার, চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল। ভাবছি, ওর বাড়িতে খোঁজ নিতে যাব নাকি?
চলো, মুসা রাজি।
খোঁজাখুঁজি চালিয়ে যাওয়ার আর সাহস হলো না ওদের। ফিরে এল। নিজেদের গাড়িতে। ডগলাসের স্যালভিজ ইয়ার্ডে রওনা হলো।
ইয়ার্ডে পৌঁছে ড্রাইভওয়ের উল্টো দিকে রাস্তার ধারে গাড়ি রাখতে বলল কিশোর। গেটের দিকে হাত তুলে বলল, ওই দেখে। চাকার তাজা দাগ।
গাড়ি থেকে নামল ওরা। দাগগুলো পরীক্ষা করতে গেল কিশোর।
দাগের ওপর তুষারের স্তর পাতলা, বিড়বিড় করে যেন নিজেকেই বলল। সে। তারমানে বড়জোর ঘণ্টাখানেক আগে গেছে।
উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল কিশোর।
গর্জন করে পাক খেয়ে বইছে হিমেল বাতাস। ইয়ার্ডের ভাঙাচোরা গাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে শিস কেটে যাচ্ছে।
পুটি কোথায়? কিশোরের প্রশ্ন।
কোন সাড়া নেই কুকুরটার। কোথাও দেখা গেল না ওটাকে। একটিবারের জন্যে ঘেউ ঘেউও করল না।
মূল বাড়িটা অন্ধকার। অফিসটাও।
মুসার হাত থেকে টর্চটা নিয়ে প্রথমে অফিসের দিকে গেল কিশোর। জানালা দিয়ে ভেতরে আলো ফেলল। আসবাবপত্র এলোমেলো। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে খবরের কাগজ। মেঝেতে পড়ে থাকা বড় এক টুকরো মাংসের ওপর আলো পড়ল। টুকরোটার পাশেই নেতিয়ে পড়ে আছে পুটি।
সেদিক থেকে চোখ না সরিয়ে বলল সে, গোলমাল তো একটা দেখা যাচ্ছে।
তার পাশে এসে জানালা দিয়ে উঁকি দিল মুসা আর রয়।
পুটিকে দেখতে পেল।
ঘুমাচ্ছে নাকি কুকুরটা? রয়ের প্রশ্ন।
ওটার পাঁজরের ওঠানামা চোখে পড়ল কিশোরের। বলল, বেঁচেই আছে। ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে মনে হয় ওকে।
ডগলাস কোথায়? মুসার প্রশ্ন।
চলো, খুঁজে দেখা যাক। একসঙ্গে না গিয়ে তিনজন তিন দিকে।
ভাঙাচোরা গাড়ির সারির ভেতর দিয়ে এগোতে লাগল ওরা। মাটির দিকে চোখ। তুষারে পায়ের চিহ্ন খুঁজছে। কিন্তু ছাপ এত বেশি ওখানে, কোনটা যে নতুন বোঝা মুশকিল। দুর্ঘটনায় ভেঙেচুরে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া গাড়ি আছে প্রচুর। তিন-চার থাক করে একটার ওপর আরেকটা রাখা। কোন কোনটা পুড়ে এমন অবস্থা হয়েছে, চাকাটাকা তো নেই-ই, দরজা-জানালা, বাম্পার এমনকি ফেন্ডার প্যানেল পর্যন্ত গায়েব।
শব্দ শুনতে পাচ্ছি, অন্য সারির মধ্যে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে জানাল মুসা।
দৌড়ে গেল কিশোর আর রয়।
থাবা দেয়ার শব্দ, মুসা বলল। শুনতে পাচ্ছ?
কোনখান থেকে আসছে? কান পাতল রয়।
ঝোড়ো রাতের বাতাসের মধ্যে অন্য কোন শব্দ বোঝা কঠিন। তারপরেও তিনজনেই শুনতে পেল শব্দটা।
ডগলাস? ডগলাস? আপনি করছেন শব্দ? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
পুরানো সেডান গাড়ির একটা উঁচু স্তূপ থেকে দুবার জোরাল থাবা দেয়ার শব্দ হলো। একটারও জানালার কাঁচ নেই। কোন কোনটার দরজা গায়েব। তবে প্রত্যেকটার ট্রাংক রয়েছে। যদিও রঙ চটা।
এদিকে, শব্দ লক্ষ্য করে দৌড় দিল মুসা।
নিচের গাড়িটার ট্রাংক থেকে শব্দটা আসছে মনে হলো। সেটাতে থাবা দিল মুসা। সামান্য আঘাতেই নড়ে উঠল ওপরের গাড়িগুলো।
ওপর দিকে টর্চের আলো ফেলে কিশোর বলল, সাবধান। একদম ওপরের বড় গাড়িটার ভাবভঙ্গি ভাল না। পড়ে যাবে।
বের করো আমাকে! ডগলাসের কথা ভেসে এল নিচের গাড়িটার ট্রাংক থেকে।
এক মিনিট। এখনই বের করছি, জবাব দিল মুসা।
রয়, একটা শাবল পাও নাকি দেখো তো, কিশোর বলল। বেয়ে ওঠা গেলে ওপরেরটা ঠেলে ফেলা যাবে হয়তো।
কিন্তু উঠতে গেলেই যদি উল্টে পড়ে সব?
স্তূপটা পরীক্ষা করে দেখে মাথা দোলাল কিশোর, হুঁ, পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
রয় শাবল নিয়ে ফিরে এলে মুসা বলল। যে ভাবে আছে এ ভাবেই খোলার চেষ্টা করতে হবে।
যে ট্রাংকটায় আটকে আছে ডগলাস, সেটার দিকে কাত হয়ে মুসা বলল, ডগলাস, একটা ভেজালে পড়ে গেছি আমরা। আপনার ওপরের গাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে নাড়া লাগলেই উল্টে পড়ে যাবে।
ক্রেনটা নিয়ে এসে ওপরের গাড়িটা সরিয়ে ফেলা যেতে পারে, রয় বলল।
না না! ট্রাংকের ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল ডগলাস। ক্রেনটায় গণ্ডগোল আছে। আমি ওটা মেরামত করে সারতে পারিনি।
তাহলে আর কি, জবাব দিল মুসা। দেখি এই অবস্থায় কতটা কি করতে পারি।
ট্রাংকের তালার নিচের ফাঁকটায় শাবলের মাথা ঢুকিয়ে দিল মুসা। বলল, ডগলাস, রেডি! ট্রাংকের ডালা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে চলে আসবেন।
শাবলের চাড় পড়তেই তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দ হতে লাগল। চাপ লাগছে যে। মাথাটায়, গাড়ির সে-দিকটা নিচু হয়ে গেল।
ওপরের গাড়িটাতে টর্চের আলো স্থির রেখেছে কিশোর। গাড়ির পেছন দিকটা নিচু হয়ে গেছে অনেক। মুসা, সাবধান। আস্তে চাপ দাও।
শাবলে হাতের চাপ কমিয়ে ফেলল মুসা। কিন্তু চাপ ছাড়া খুলব কি করে?
আস্তে আস্তে চাপ বাড়িয়ে দেখো কি হয়।
ওপরের গাড়িটার দিক থেকে চোখ সরাচ্ছে না কিশোর। মুসা চাপ কমাতেই স্থির হয়ে গেল ওটা। ঠিক আছে। চাপ দাও আবার।
ট্রাংকের মধ্যে শাবলের মাথাটা আরও কয়েক ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিল মুসা। ধীরে ধীরে চাপ বাড়াতে থাকল। বাঁকতে শুরু করেছে তালার কাছটা।
থামো! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
চাপ কমিয়ে দিল মুসা। ওপরের গাড়িটাকে দুলুনি বন্ধ হওয়ার সময় দিল।
ডগলাস, ডেকে বলল মুসা, আবার! রেডি!
শাবল দিয়ে জোরে এক চাড় মারল মুসা। লাফ দিয়ে ওপরে উঠে গেল ট্রাংকের ডালা। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি লাগল দ্বিতীয় গাড়িটাতে। দুলুনি অনেক বেড়ে গেল ওপরের গাড়িটার।
উঠে বসতেও প্রচুর সময় লাগিয়ে দিল ডগলাস। ঠাণ্ডার মধ্যে এ ভাবে আটকে থেকে আড়ষ্ট হয়ে গেছে শরীর। বড় বেশি ধীরে নড়ছে। শাবলটা ফেলে দিয়ে তার হাত চেপে ধরল মুসা।
পড়ে যাচ্ছে! চিৎকার করে উঠল রয়।
পেছনে ঢলে পিছলে পড়তে শুরু করেছে ওপরের গাড়িটা। দৌড়ে সরে গেল। রয়। লাফ দিয়ে গিয়ে সামনে পড়ল কিশোর। ডগলাসের আরেক হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। সে আর মুসা মিলে প্রায় চ্যাংদোলা করে বের করে নিয়ে এল ডগলাসকে। তাল সামলাতে না পেরে তুষারের ওপর পড়ে গেল তিনজনেই। নিচে পড়ল ওপরের গাড়িটা। অল্পের জন্যে বেঁচে গেল ওরা। ময়লা সহ তুষারের কণা এসে ছিটকে পড়ল ওদের গায়ে।
খাড়া হয়ে রয়েছে গাড়িটা। হুডের প্রায় পুরোটাই ঢুকে গেছে কঠিন বরফে।
চলুন এবার ভেতরে যাওয়া যাক, মুসা বলল।
কি মনে করে এখানে এসেছিলে তোমরা? জিজ্ঞেস করল ডগলাস। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। হাঁটতে গিয়ে দেখল ঠিকমত পা ফেলতে পারছে না। ঠাণ্ডায় অবশ হয়ে যাওয়া পা ফেলে কোনমতে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগল।
আপনার ট্রাক নিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে গিয়েছিল কেউ, মুসা বলল। লেকের মাঝখানে।
আমি যাইনি। যাওয়ার অবস্থায় যে ছিলাম না দেখলেই তো। অফিসের দিকে এগোনোর সময় শঙ্কিত ভঙ্গিতে চারপাশে তাকাল ডগলাস। পুটি কোথায়?
অফিসের ভেতরে, জবাব দিল কিশোর। মনে হয় ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।
খোঁড়াতে খোঁড়াতেই দৌড়ে গিয়ে অফিসে ঢুকল ডগলাস। হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল কুকুরটাকে।
কি করেছে তোকে ওরা, পুটি!
আধখাওয়া মাংসের টুকরোটার কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসল কিশোর। সাদা পাউডার ছড়ানো রয়েছে মাংসের ওপর। বলল, যা অনুমান করেছিলাম। ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে দিয়েছে। আরও কিছুক্ষণ গভীর ঘুম ঘুমাবে।
ঘুমটা ভাঙলেই বাঁচি, উদ্বিগ্ন শোনাল ডগলাসের কণ্ঠ। মাটিতে থাকলে ঠাণ্ডা লাগবে, সে-জন্যে কুকুরটাকে কাউচে শুইয়ে দিল সে।
পুলিশকে ফোন করে আসি, মুসা বলল।
ডগলাসকে বলল কিশোর, সাইডারের রস গরম করে দেব? খাবেন? গা গরম হবে।
কালো কফি। ফুটন্ত। এবং অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
দিচ্ছি।
বাধা দিল রয়, তুমি বসো। আমিই যাচ্ছি। আমারও লাগবে কফি।
মুসা বলল, আমিই বা আর বাদ যাই কেন? যা ঠাণ্ডার ঠাণ্ডা!
ঠিক আছে, আমার জন্যেও এনো, রয়কে বলে ডগলাসের দিকে ফিরল কিশোর। আপনাকে আটকেছিল কে?
দুটো লোক। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার মাথায় একটা ব্যাগ পরিয়ে দিয়ে বয়ে নিয়ে গেল বাইরে।
চিনতে পেরেছেন?
কালো স্কি মাস্ক পরে ছিল মুখে। চেহারা দেখিনি।
কিছু বলেছে?
ভয় দেখিয়েছে।
গলা চিনতে পেরেছেন?
পরিচিতই লেগেছে। তবে চিনতে পারিনি।
জ্যাকসনের নাতিরা না তো?
কুকুরটার গায়ে হাত বোলানো থেমে গেল ডগলাসের। ঠাট্টা করছ?
না।
তাই তো! ঠিকই বলেছ তো! আকার-আকৃতিতে মিলে যায়। গলাটাও ওদেরই মনে হচ্ছে এখন।
ধূমায়িত কফির কাপ নিয়ে হাজির হলো রয়। পেছনে এল মুসা।
পুলিশ আসছে, জানাল সে।
ডগলাস, লেকটার ব্যাপারে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি? লেকের ম্যাপটা বের করে ডগলাসকে দেখাল। এই স্পটগুলো দেখুন। কিছু বুঝতে পারছেন?
কি বলতে চাও তুমি? ম্যাপের দিকে তাকাল ডগলাস।
জায়গাগুলোর তালিকা করে লুকিয়ে রেখেছে জ্যাকসনের নাতিরা।
কেন?
সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি। আইস ফিশিঙের জন্যেও করা হয়ে থাকতে পারে।
কি যেন ভাবল ডগলাস। উঠে গিয়ে ডেস্কের কাগজপত্রের ভেতর থেকে লেকের একটা ছেঁড়াফাটা ম্যাপ বের করল। পেন্সিল দিয়ে গিজিগিজি করে প্রচুর নোট লেখা তাতে।
দুটো ম্যাপ পাশাপাশি রেখে কয়েক মিনিট মিলিয়ে দেখল। তারপর মাথা নাড়ল, তুমি শিওর, এই ম্যাপটা আইস ফিশিঙের জন্যে করা হয়েছে?
না, শিওর না, জবাব দিল কিশোর।
আমার ধারণা মাছ ধরার জন্যে চিহ্নিত করেনি। ফিশিং স্পট হিসেবে মোটেও ভাল না জায়গাগুলো। ভীষণ বিপজ্জনক। দুএক জায়গায় বঁড়শি ফেলে দেখেছি। খায় না তেমন। অকারণ ঝুঁকি নেয়া। রয়ের ম্যাপটার একটা ক্রস চিহ্নে আঙুল রাখল। এ জায়গাটার নিচ দিয়ে তীব্র স্রোত বয়। বরফকে কোনমতেই একভাবে থাকতে দেয় না। দিনের শেষ ভাগে এখানে রোদও পড়ে বেশি।
তাতে কি? মুসার প্রশ্ন।
রোদ মানেই গরম। আর গরমে বরফের ওপর দিকটা গলে যায়। রাতে আবার শক্ত হয়। এ রকম করতে থাকলে দুর্বল হয়ে যায় বরফ। ওসব জায়গায় মাছ ধরতে গেলে প্রাণের ঝুঁকি নিতে হবে। কে যায়?
তবে অন্য কোন লাভজনক কারণে কেউ ঝুঁকি যদি নিতে চায় নিতে পারে, তাই না? কিশোর বলল।
কোন কারণেই নিতে চাইবে না কেউ। মাথায় যদি সামান্যতম ঘিলু থাকে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা পড়লে বরফের পাতলা স্তরও ভীষণ শক্ত থাকে। তখন বোঝাটোঝা কম নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু কি কারণে যাবে?
কারণ, মাছ শিকারীরা কেউ ওদিকে যায় না। রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর।
পুলিশ এল। ডগলাসের বক্তব্য শুনল। ওষুধ মেশানো মাংসের টুকরোটা দেখল। একটা ব্যাগে তুলে নিল গবেষণাগারে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করানোর জন্যে। তারপর ডগলাসকে সাবধান থাকতে বলে চলে গেল।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বয় বলল, আজকের মত তো শেষ হলো। কাজ। বাড়ি গিয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করছে।
চিন্তা নেই। পৌঁছে দেব, কিশোর বলল। কিংবা এত রাতে আর বাড়ি ফিরে না গিয়ে চলো শার্লিদের ওখানেই চলে যাই। বাড়িতে মাকে একটা ফোন করে দিয়ো, রাতে ফিরছ না।
তা কথাটা মন্দ বলোনি, অরাজি হলো না রয়। ঠিক আছে, চলো। এত কাছে এসে রবিনকে না দেখে গেলে রাগ করবে। তা ছাড়া এখানে কম্বলের নিচে ঢোকাটাও তাড়াতাড়ি হবে।
হেসে ফেলল মুসা আর কিশোর।
.
১৩.
পরদিন সকাল সকালই উঠে বাড়ি রওনা হয়ে গেল রয়। জানিয়ে গেল, বিকেলের আগে সময় দিতে পারবে না। স্কুলে যেতে হবে। জরুরী আরও একটা কাজ আছে। শেষ করে তারপর আসবে। বার বার করে বলে গেছে, তাকে বাদ দিয়ে যেন কোনমতেই স্পটগুলোতে খুঁজতে না যায় তিন গোয়েন্দা। হুমকি দিয়েছে, তাহলে চিরকালের শত্রুতা হয়ে যাবে।
দিনের অনেকটা সময়ই তদন্তের কাজে ঘুরে বেড়াল মুসা আর কিশোর। ডগলাসের ট্রাকটা দেখতে পেল বনের ভেতর। পরিত্যক্ত অবস্থায়।
রবিন সারাটা দিনই বিশ্রাম নিল।
বিকেলে আসার আগে ফোন করল রয়। জানাল, সে রওনা হচ্ছে।
কিশোর বলল, রয়, একটা মেটাল ডিটেক্টরও দরকার আমাদের। সেই সঙ্গে কালকের ম্যাপ আর তোমার জিপিএসটা তো আনবেই।
ডোবার কগনানকে ফোন করল সে। চলে আসতে বলল। বলল, পাইনভিউ লেকের চুরিগুলোর ব্যাপারে মূল্যবান তথ্য দিতে পারবে। তারপর ফোন করল পিটারকে। মিস্টার মরগানের বাড়িতে আসতে বলল সবাইকে।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই চলে এল পিটার।
রয় আসতে আসতে সন্ধ্যা করে ফেলল। অন্ধকার হয়ে গেছে ততক্ষণে।
গাড়ির শব্দ শুনেই বেরিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা আর পিটার।
হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামল রয়। কাঁধে জিনিসপত্রের ব্যাগ। এক হাতে মেটাল ডিটেক্টর, অন্য হাতে একটা হালকা কুড়াল আর একটা আইস পিক।
ওর ভঙ্গি দেখে বলে উঠল মুসা, খাইছে! মেরু অভিযানে যাবে নাকি?
হেসে জবাব দিল রয়, বরফ কাটতে কাজে লাগবে। বাড়তি যদি না থাকে এখানে, সেজন্যে নিয়ে এলাম।
আর কারও সাহায্য দরকার হবে? জিজ্ঞেস করলেন মরগান আঙ্কেল। নিজের কথাই বোঝালেন তিনি।
আপাতত লাগবে না, কিশোর বলল। লাগলে জানাব।
হতাশ মনে হলো আঙ্কেলকে। তবে আর কিছু বললেন না। উঠে গিয়ে বসলেন বেশ কিছুটা দূরে। বেলী আন্টি আর শার্লি যেখানে বসে টিভি দেখছে।
বলে বলে হাল ছেড়ে দিয়েছেন বেলী আন্টি। গোয়েন্দাদের কাজে বাধা দিতে এলেন না আর। এমনকি ওদের কথার মধ্যেও এলেন না। ওদের কর্মকাণ্ড গা সওয়া হয়ে গেছে গত কয়েক দিনে।
কার কি কাজ, ভালমত বুঝিয়ে দিতে লাগল কিশোর। পিটারকে বলল, পিটার, তুমি আর রবিন গিয়ে জ্যাকসনদের ওপর নজর রাখবে। যদি বোঝে ওরা আমাদের ওপর হামলা চালাতে আসছে, শিস দিয়ে সঙ্কেত, দেবে। তিনবার। শিস-দুবার ছোট, একবার লম্বা। যাও, দশ মিনিট সময় দিলাম। অবস্থান নাওগে।
আরনির বাড়িতে ছুটল পিটার আর রবিন। বনের ভেতর দিয়ে এগোল যাতে চোখে পড়ে না যায়। জ্যাকসনের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখল ভেতরে আলো ওলছে। বেশি কাছে যাওয়ার সাহস পেল না ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। তবে নিজেদের নিয়ে চিন্তিত নয় রবিন-বাড়িটার বেশি কাছে না গেলেই হলো, ভাবছে। কিশোরদের কথা। ওদের বরফ কাটার শব্দ যদি শুনে ফেলে জ্যাকসনরা?
ভেবে লাভ নেই। যা হবার হবে। যেটা করতে বলা হয়েছে ওদের, সেটাই করল। দুজন দুদিকে সরে গিয়ে দোকানের দুটো প্রবেশ পথের দিকে লক্ষ রাখতে লাগল।
রবিনদেরকে অবস্থান নেয়ার সময় দিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। মুসা, আর রয়কে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। লেকের দিকে রওনা হলো।
ঠাণ্ডা নির্মল রাত। চাঁদের আলোয় আলোকিত লেকের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, যাক, আবহাওয়াটা ভালই আজ। কালকের মত না। কাজ করতে অত কষ্ট হবে না।
ডোবার তো এল না এখনও, রয় বলল।
বলেছে যখন, আসবে, বলল কিশোর। কোন কারণে দেরি হচ্ছে আরকি। আসার আগেই দেখি কাজটা শেষ করে ফেলতে পারি কিনা আমরা।
হাতের লম্বা লাঠির মত জিনিসটা দিয়ে খোঁচা দিতে দিতে এগিয়ে চলল কিশোর। আগের দিন যে স্পটগুলো দেখেছে, সেগুলোতে গেল না আর।
তাকে অনুসরণ করল রয়। হাতের জিপিএসটার দিকে চোখ। যন্ত্রটার এলসিডি স্ক্রীন থেকে সবুজ আভা বেরোচ্ছে।
হঠাৎ বলে উঠল, ডানে!…হ্যাঁ হ্যাঁ, আরেকটু ডানে।
জিপিএস পকেটে রেখে দিয়ে মেটাল ডিটেক্টরের দিকে নজর দিল সে। কানে হেডফোন লাগানোই আছে। কিশোরের পাশ কাটিয়ে আগে চলে গিয়ে ডিটেক্টরের সাহায্যে তুষারে ঢাকা বরফের মধ্যে খুঁজতে শুরু করল। কয়েক বর্গগজ খুঁজেই থেমে গেল আচমকা।
এখানেই আছে, চেঁচিয়ে উঠল সে।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মুসা আর কিশোর। আগের রাতের মত হাত দিয়ে তুষার সরাতে লাগল, ডিটেক্টরটা যেখানে নির্দেশ করছে ঠিক সেই জায়গায়। বেরিয়ে পড়ল সাদা বরফ।
কুড়াল দিয়ে কোপানো শুরু করল মুসা। কঠিন বরফে আঘাত হানার শব্দ লেকের পাড়ে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনি তুলে ফিরে এল। শব্দ না করে কাটা সম্ভব না।
প্রায় এক বর্গগজ জায়গায় ইঞ্চি পাঁচেক বরফ কাটা হতেই বেরিয়ে পড়ল অনেকগুলো টিনের পাত নিয়ে গোল করে পাকানো একটা বল।
কালকের মতই তো টিনের পাত। কাল ছিল একটা। আজ অনেকগুলো।
বলটায় মাছ ধরার সুতো বাঁধা, দেখতে পাচ্ছ? কিশোর বলল। কালকেরগুলো পরিত্যক্ত জায়গা। কাজ সেরে চলে যাওয়ার সময় টিনের পাতগুলো সরানোর প্রয়োজন বোধ করেনি। কল্পনাই করেনি হয়তো, এ সব জায়গায় খুঁজতে আসবে কেউ।
আইস পিক দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে টিনের বলটার চারপাশের তুষার সরিয়ে ফেলল সে।
ভাল করে দেখার জন্যে মাথা বাড়িয়ে দিল রয়।
দস্তানা খুলে ফেলল কিশোর। বলটাকে শক্ত করে ধরে বরফ থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। উঠে আসতে শুরু করল ওটা। টান লাগল। ওটার সঙ্গে বাঁধা সুতোটায় টান পড়ল।
সুতোর চারপাশের বরফ কুপিয়ে কেটে ফেলতে শুরু করল মুসা। থেমে গেল হঠাৎ। শিসের শব্দ। দুবার খাটো। একবার দীর্ঘ।
*
জ্যাকসনের বাড়ির পেছনের ঘরের জানালায় টেলিভিশনের আলো নড়াচড়া করতে দেখছিল রবিন। হঠাৎ দেখে দুটো কালো ছায়ামূর্তি দোকানের সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
জ্যাকি আর রকি, রাতের বাতাসকে উদ্দেশ করে যেন ফিসফিসিয়ে বলল রবিন।
কি করব এখন? একই ভঙ্গিতে ফিসফিস করে জবাব দিল পিটার।
চমকে গিয়ে ফিরে তাকাল রবিন। কথামত কাজ না করায় রেগে গেল। পিটারের ওপর। তোমার এখানে কি?
একা একা ওখানে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন কি করব আমরা?
রাগটা চেপে রাখল রবিন। বলল, ওরা সরলেই সাবধান করে দিতে হবে কিশোরদের।
দৌড়ে দোকানের পেছন দিকে চলে গেল দুই ভাই। একটু পরেই ইঞ্জিনের গর্জন শোনা গেল। রবিনরা দেখল স্নোমোবাইলে চড়ে লেকের দিকে ছুটে যাচ্ছে দুজনে।
*
দ্রুত হাতে তখন ঠাণ্ডা পানি থেকে সুতোটাকে টেনে তুলছে কিশোর। কানে এল ইঞ্জিনের শব্দ।
স্নোমোবাইল, রয় বলল।
আলো নেভাও, বলে উঠল কিশোর।
দ্রুত টর্চ নিভিয়ে ফেলা হলো। তবে চাঁদের আলোতেও সাদা বরফের ওপর তাদের আকৃতি বহুদূর থেকে চোখে পড়বে।
সুতো টানা বন্ধ করল না কিশোর। আজকে জিনিসগুলো বের করেই ছাড়বে। তার আগে কিছুতেই যাবে না লেক ছেড়ে।
সুতো শেষ হলো। শেষ মাথায় বাঁধা রয়েছে একটা মোটা দড়ি। দড়ি ধরে টানতে লাগল।
কাছে চলে আসছে স্নোমোবাইলের ইঞ্জিনের শব্দ।
সরে যাওয়া দরকার, রয় বলল।
দড়িটাও শেষ হলো। মাথায় বাঁধা একটা কালো রঙের প্লাস্টিকের ব্যাগ। মুখটা খুলল কিশোর। চাঁদের আলোয় চকচক করে উঠল ভেতরের রূপালী জিনিস।
কাছে চলে এসেছে স্নোমোবাইল।
কিশোর, চলে এসো, জরুরী কণ্ঠে রয় বলল।
ব্যাগের মুখটা আবার বেঁধে ফেলতে লাগল কিশোর। তোমরা দৌড়াতে থাকো। আমি আসছি। একেকজন একেক দিকে যাও।
দৌড়ানো শুরু করল রয়। মুসা ছুটল তার পেছনে।
ইঞ্জিনের গর্জন বাড়ছে। কাপুনি টের পাওয়া যাচ্ছে বরফে।
ব্যাগের মুখ বাঁধা হয়ে গেছে কিশোরের। ওটাকে টেনে নিয়ে দৌড় দিল সে ও।
.
১৪.
ডগলাস বলেছে স্পটগুলো বিপজ্জনক। প্রমাণ পেল এখন। মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে বরফ ভাঙার শব্দ কানে এল কিশোরের।
জায়গাটা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান সোমোবাইল চালকের। কি করতে হবে জানা আছে। সোজা না এসে, অনেকখানি ঘুরে চক্কর দিয়ে এগোতে শুরু করল। কিশোরের দিকে। যে ভাবেই হোক ওরা বুঝে গেছে চোরাই মাল কিশোরের কাছেই আছে।
বরফ ভাঙার শব্দ বাড়ছে। জমাট বরফের মত স্থির হয়ে গেল কিশোর। নড়লেই মুহূর্তে এখন বরফ ভেঙে নিচে পড়ে যাবে। যদি না নড়ে তাহলেও বিপদ। স্নোমোবাইল চালক এগিয়ে এসে ঝাঁকুনি দিয়ে ভেঙে দেবে। তাতেও নিচে পড়ে যাবে সে।
ওরা ভাঙলে অন্য একটা সম্ভাবনাও আছে। স্নোমোবাইল নিয়ে ওরাও নিচে পড়ে যেতে পারে। মরলে ডাকাতগুলোকে নিয়েই মরা উচিত। তৈরি হয়ে দাঁড়াল। সে।
শেষ মুহূর্তে কয়েক ইঞ্চির জন্যে মিস করল ওকে স্নোমোবাইল। কারণ চালকের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে ঝাঁপ দিয়ে বরফের ওপর পড়ে গেছে কিশোর। গায়ের কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে শাই করে চলে গেল ইস্পাতের ভারী আইস বারের মাথা। আগের জায়গায় থাকলে হয় শিকটা শরীরে গেঁথে যেত, নয়তো মাথায় বাড়ি খেত।
মুসার চিৎকার শুনে মাথা উঁচু করে দেখল সে, ওকে পড়ে যেতে দেখে ছুটে আসছে মুসা।
পালাও, মুসা! এসো না! চিৎকার করে উঠল কিশোর। মুসার দিকে ছুটে যাচ্ছে এখন স্নোমোবাইল।
ঘুরে আবার দৌড় দিল মুসা। স্নোমোবাইলের সঙ্গে পারল না।
পৌঁছে গেল স্নোমোবাইল। রকি চালাচ্ছে। জ্যাকি পেছনে বসা। হাতের আইস বারটা দোলাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে কিশোরের মতই একপাশে ঝাঁপ দিল মুসা। ওর গায়েও লাগাতে পারল না জ্যাকি।
থামল না স্নোমোবাইল। ছুটছে। পৌঁছে গেল রয়ের কাছে। কিশোর কিংবা মুসার মত অতটা ক্ষিপ্রতা দেখাতে পারল না রয়। হাঁটুর পেছন দিকে আইস বারের প্রচণ্ড বাড়ি খেল সে। প্রায় ডিগবাজি খেয়ে পড়ল।
শীতল বরফের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে কিশোর। চড়চড় শব্দ তুলে ভেঙে যাচ্ছে বরফ। টুকরোটা কতখানি বড় হয়ে ভাঙবে তার ওপর নির্ভর করছে তার বাঁচা-মরা। বেশি ছোট হলে উল্টে যাবে। পানিতে তলিয়ে যাবে সে। আর বড় হলে তার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থেকে ভেলায় ভাসার মত ভেসে থাকতে পারবে। চারপাশের বরফ ভাঙার শব্দ হৃৎপিণ্ডটাকে যেন খামচে ধরছে। একভাবে পড়ে থেকে জ্যাকি আর রকির ফেরত আসার অপেক্ষা করতে লাগল।
কতখানি দূরে আছে ওরা দেখার জন্যে আবার মাথা তুলল সে। অবাক হয়ে গেল দুটো মূর্তিকে স্কেইট করে স্নোমোবাইলটার দিকে ছুটে যেতে দেখে। মুসাকে দৌড়ে আসতে দেখল তার দিকে।
বরফ যেখানে ভাঙছে সেখান থেকে খানিকটা দূরে এসে থেমে গেল মুসা।
কাছে এসো না! বরফ ভাঙছে, চিৎকার করে উঠল কিশোর। সরে যাও! সরে যাও! নিজের মাথার পেছন দিকে ইঙ্গিত করল। মেটাল ডিটেক্টরটা তুলে নাও।
দৌড়ে গিয়ে বরফের ওপর পড়ে থাকা মেটাল ডিটেক্টরের লম্বা ডাণ্ডাটা ধরে তুলে নিল মুসা। কি করব এটা দিয়ে?
মধ্যযুগীয় নাইটরা কি করে যুদ্ধ করত মনে আছে?
আগে কি আর জানতাম এখন কাজে লাগবে? তাহলে ইতিহাসের ক্লাসে কখনোই অমনোযোগী হতাম না।
বল্লমের মত ব্যবহার করতে পারো নাকি দেখো। তাহলেই চলবে।
বুঝলাম। আমি যাচ্ছি। ফিরে এসে যেন করফের ওপরই পাই তোমাকে, মুসা বলল।
পাবে, হেসে জবাব দিল কিশোর। সাঁতার কাটার এক বিন্দু ইচ্ছেও আমার নেই।
ঘুরে কিশোরদের দিকে আসছে এখন স্নোমোবাইলটা। পেছন পেছনে তাড়া করে আসছে ছায়ামূর্তি দুটো। কাছে আসতেই বোঝা গেল মূর্তি দুটোর একজন রবিন, আরেকজন পিটার।
ড্রাইভারটাকে বাড়ি মেরে ফেলে দিতে পারো নাকি দেখো, মুসাকে বলল কিশোর।
দৌড় দিল মুসা। ঝাঁকি লেগে বরফের টুকরোটা মূল বরফের গা থেকে আরও খানিক ছুটল, কিশোর যেটাতে পড়ে আছে।
তিন দিক থেকে স্নোমোবাইলটাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে মুসা, রবিন আর পিটার। মুসার হাতের মেটাল ডিটেক্টরের ডাণ্ডাটা মনে হলো বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে ওদের। এগোলেই বাড়ি খাবে বুঝে গেছে। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল। চক্কর দিয়ে স্পীড বাড়িয়ে তীব্র গতিতে ছুটে আসতে শুরু করল মুসাকে লক্ষ্য করে।
জোরে চড়চড় করে উঠল বরফ। লড়াইটার দিকে আর নজর দিতে পারল না কিশোর। চোখ ফেরাতে হলো নিজের চারপাশের বরফের দিকে। কানে এল মুসার ইয়াহু চিৎকার। পরক্ষণে ধাতুর সঙ্গে ধাতুর বাড়ি লাগার শব্দ। নিশ্চয় ডিটেক্টরের ডাণ্ডা আর আইস পিকের সংঘর্ষ হয়েছে। তারপর হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল সব। কৌতূহল দমন করতে পারল না কিশোর। দেখার জন্যে মাথা উঁচু করতেই হলো তাকে।
দেখল স্নোমোবাইলটা ছুটে আসছে তার দিকে। ইঞ্জিন বন্ধ। গায়ের ওপর এসে পড়তে আর সামান্যই বাকি। ক্ষণিকের জন্যে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল বাতাস। পরক্ষণে কানের কাছে বিকট এক গর্জন শুনতে পেল সে। তারপর ঝাঁকি। সবশেষে দুলুনি। তলিয়ে যাবার আগের মুহূর্তে দেখল স্নোমোবাইলটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। পানিতে পড়ে একে অন্যকে মই বানিয়ে বেয়ে ওপরে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করেছে রকি আর জ্যাকি।
*
বাঁচাও! বাঁচাও! বরফ পানিতে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করে উঠল রকি।
চোরাই মাল বাঁধা দড়িটার একপ্রান্ত থাবা দিয়ে তুলে নিল মুসা। সাবধানে এগোল বরফের মাঝখানের বিশাল গর্তটার দিকে। ওখানেই পড়েছে কিশোর, রকি, জ্যাকি আর স্নোমোবাইলটা। গর্তটা বড় বলেই আবার মাথা তুলতে পেরেছে ওরা, স্রোতের টানে রবিনের মত নিচে চলে যায়নি। বরফের স্তর এত পুরু, বেয়ে ওপরে ওঠা অসম্ভব।
দড়ির মাথাটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিল মুসা। ধরো জলদি!
গাধা নাকি! কোথায় ছুঁড়েছে? আমি তো এখানে, ধমকে উঠল জ্যাকি।
অন্ধকারে দাপাদাপি করছে কিশোর। দড়িটা খুঁজে পেল না।
তুলে এনে আবার ছুঁড়ে মারল মুসা। এবার ধরতে পারল কিশোর।
বরফকে বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। ভাঙা গর্তের এতটা কিনারে চলে এসেছে, যে কোন মুহূর্তে ওর ভারে ওই জায়গাটাও ভেঙে পড়তে পারে। দড়ির আরেক মাথা থেকে ব্যাগটা খুলে ফেলে দিয়ে মাথাটা নিজের কোমরে পেঁচিয়ে নিল। চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে কিশোরকে টেনে নিয়ে সামনে এগোল। যখন বুঝল, এখানে বরফ ভাঙার ভয় আর নেই, উঠে দাঁড়াল।
নাক দিয়ে দম টেনে মুখ দিয়ে ছাড়ল। একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে আগে বাডল। পিচ্ছিল বরফে নিজের দেহটাকে নিয়েই হাঁটা কঠিন, তার ওর ভারী বোঝা টেনে এগোতে হচ্ছে। বার বার পিছলে পড়ার হাত থেকে বাঁচাতে হচ্ছে নিজেকে। গতি বড় ধীর। কতক্ষণ সহ্য করতে পারবে কিশোর?
যতক্ষণ পারে পারুক। ওসব ভেবে লাভ নেই। নিজের কাজ করে গেল মুসা।
থামা, দম নেয়া, আগে বাড়া!
থামা, দম নেয়া, আগে বাড়া!
কতক্ষণ যে এ রকম করে এগোল বলতে পারবে না। দড়িতে ঢিল পড়তেই ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে। মনে হলো দড়ি ছেড়ে দিয়েছে কিশোর। কিংবা দড়িটা ছুটে গেছে তার হাত থেকে।
ঘুরে গর্তের দিকে দৌড় দিতে গেল সে। কখন যে চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে। মেঘের নিচে খেয়ালই করেনি। আলো নেই। অন্ধকারে কিছু দেখতে পেল না। কিসে যেন হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। কনুই আর হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে গুঙিয়ে উঠল।
মেঘ সরে গেল চাঁদের মুখ থেকে। আলোকিত হয়ে উঠল আবার মুসার চারপাশের জায়গাটা। কিসের ওপর পড়েছে দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসল। বরফের ওপর লম্বা হয়ে পড়ে আছে কিশোর। নড়ছে না।
কিশোর! চিৎকার করে উঠল মুসা।
সাড়া পেল না।
কিশোরের গায়ে জোরে জোরে ঠেলা দিতে লাগল। কিশোর! এই কিশোর?
পুরোপুরি সরে গেছে মেঘ। উজ্জ্বল তুষারে প্রতিফলিত ফকফকা জ্যোৎস্না। অনেক কষ্টে একটা চোখ মেলল কিশোর। ঠোঁট নীল। ফিসফিস করে বলল, জমে যাচ্ছি!
এত হট্টগোল শুনে লোকজনও ছুটে এল দল বেঁধে।
রকি আর জ্যাকিকে তুলতে গেল কয়েকজন।
চিৎকার করে বলল মুসা, এদিকে আসুন কেউ…কম্বল! স্লেড!
*
দশ মিনিট পর মিস্টার মরগানের বাড়িতে পৌঁছে গেল কিশোর, ডোবার কগনানের গাড়িতে চড়ে। স্নোমোবাইলটা পানিতে পড়ার পর ওখানে গিয়েছিল সে।
রকি আর জ্যাকিকেও তোলা হয়েছে। প্রচুর চাপ পড়ল বেলী আন্টির ওপর। বরফ-পানিতে ডোবা তিন তিনজন মানুষের ভেতরে-বাইরে গরম করতে গিয়ে। হিমশিম খেতে লাগলেন তিনি।
ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো।
.
১৫.
ফায়ারপ্লেসের গনগনে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে রবিন, মুসা আর ডোবার কগনান নিজেদের গরম করছে।
রকি আর জ্যাকিই আপনার আসামী; রবিন বলল। মাল চুরি করে নিয়ে গিয়ে বরফের নিচে লেকের তলায় লুকিয়ে রাখে ওরা। পরে সুযোগ সুবিধে মত বের করে। আমাদের ধারণা, ম্যারিল্যান্ডে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে ওগুলো। খোঁজ নিয়ে দেখুন। বের করে ফেলতে পারবেন।
ওখানে আর খোঁজ নিতে যাওয়ার দরকার নেই, কঠোর পুলিশী কণ্ঠে বলল ডোবার। ওদের মুখ থেকেই বের করে নেব।
দরজার কাছে হই-চই শোনা গেল। দেখা গেল পিটারের কাঁধে ভর দিয়ে টলোমলো পায়ে ঘরে ঢুকছে রয়।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ তোমরা দুজনে? জানতে চাইল ডোবার।
শয়তান জ্যাকিটা ইস্পাতের রড দিয়ে আমার পায়ে বাড়ি মারল, রয় বলল। পায়ে ব্যথা নিয়েই দৌড়াতে থাকলাম…
আমি ওকে দৌড়াতে দেখলাম, পিটার বলল। যে ভাবে ছুটছিল, থেকে থেকেই ভাজ হয়ে যাচ্ছিল পা, বুঝলাম পায়ের অবস্থা কাহিল। বেশি দূর যেতে পারবে না। পিছে পিছে ছুটলাম।
গিয়েছিলে বলেই বেঁচেছি, কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলল রয়। কিভাবে যে লেক থেকে উঠে গিয়ে বনের মধ্যে ঢুকলাম বলতে পারব না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। হুঁশ হলে দেখি হাতে বানানো স্ট্রেচারে করে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে পিটার। ওকে যে আমি কি বলে…
তাকে থামিয়ে দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল পিটার, ছোট্ট এই গল্পটার এখানেই সমাপ্তি।
না, সমাপ্তি নয়, রয় বলল। পিটার, আমাকে বলতে দাও। তুমি আমার পিছু না নিলে বনের মধ্যে আজ মারাই যেতাম। বরফের মধ্যে বেহুশ হয়ে যে ভাবে পড়ে গিয়েছিলাম, হুঁশই হয়তো আর ফিরত না…
থাক থাক, হাত তুলে বাধা দিল পিটার। খবরটা আর ছড়ানোর দরকার নেই। বিরাট হৃদয়ের অধিকারী, মহান উদ্ধারকারী-এ সব বিশেষণে ভুবন বিখ্যাত হয়ে যাব শেষে।
রয়কে বেডরূমে নিয়ে গেল ডোবার। বেলী আন্টি আর ডাক্তার মিলে ওখানে অসুস্থদের সেবা করছেন।
পিটারও ওদের সঙ্গে ঢুকল। ফায়ারপ্লেসের সামনে একটা চেয়ারে বসে পড়ল।
তারমানে ভাল কাজ একটা করেই ফেললে, পিটারের ওপর থেকে রাগ যায়নি রবিনের। কিন্তু তাই বলে, তোমার জায়গা ছেড়ে সরে আসার কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না আমি। তুমি তখন সরে না এলে ঘটনাটা অন্য রকম ঘটত।
কৈফিয়তের ভঙ্গিতে পিটার বলল, দেখো, রবিন, তুমি তিন গোয়েন্দার একজন। সোনার টুকরো ছেলে। সব সময়ের হিরো। তোমার মত গোয়েন্দা আমি হতে পারব না। সবই মেনে নিলাম। কিন্তু দুই ভাইকে বাধা দিয়ে আমি ঠেকাতে পারতাম না। মারামারি করে পারতাম না ওদের সঙ্গে। পিটিয়ে তক্তা বানাত। তারপর-ঠিকই স্নোমোবাইলটা নিয়ে চলে যেত।
তক্তা বানালে বানাত, নরম হলো না রবিন। মরে তো আর যেতে না। কিন্তু তোমার ভীতুপনার জন্যে কি সর্বনাশটাই না ঘটতে যাচ্ছিল।
যা ঘটেছে সেটা আমি সরে না এলেও ঘটত, পিটার বলল। আমার কথা শেষ করতে দাও। আড়াল থেকে দুই ভাইয়ের কথা শুনেই আমি বুঝেছিলাম স্নোমোবাইল নিয়ে বেরোবে ওরা। চুপচাপ গিয়ে ট্যাংকের সব তেল ফেলে দিলাম। তারপর গেছি তোমার কাছে।
নিচের চোয়াল ঝুলে পড়ল রবিনের। কি করেছ। তুমি কি করেছ?
রবিনের কথায় কান দিল না পিটার। কেন সরতে না পেরে সোজা গিয়ে বরফ ভেঙে পানিতে পড়ল স্নোমোবাইল? ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে। কেন বন্ধ হলো ইঞ্জিন? ট্যাংকের ইিপ লাইন আর কারবুরেটরের সামান্য তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে।
পিটারকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করল রবিনের। আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে ওর একটা হাত ধরে ঝাঁকাতে শুরু করল।
বাহ্, হাসিমুখে বলল পিটার, হিরো তাহলে শেষমেষ হয়ে গেলাম আমিও। চোরের অপবাদ থেকে হিরো!
*
একটু সুস্থ হতেই জ্যাকি আর রকিকে নিয়ে রওনা হলো পুলিশ। প্রথমে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। পুরোপুরি সুস্থ হলে হাজতে নেবে।
গাড়িতে উঠতে যাবে দুই ভাই, এমন সময় গাড়ি নিয়ে ঢুকল জিথার জ্যাকসন।
ঘটনাটা কি? চিৎকার করে উঠল সে।
আপনি না এলে প্রশ্নটা আমরা আপনার বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, জবাব দিল ডোবার। দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?
দুই ভাইকে ধরে জ্যাকসনের দিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করল সে।
রকি! জ্যাকি! বিশ্বাস করতে পারছে না জ্যাকসন। তোদের পুলিশে ধরেছে কেন?
চুরি করেছে, তাই ধরেছি, জবাবটা ডোবারই দিয়ে দিল। এ এলাকায় বেড়াতে এসে দোকানে কাজ করার ছুতোয় আপনার বাড়িতে থেকেছে। রাতে মানুষের বাড়িতে ঢুকে টুকে চুরি-ডাকাতি করেছে। লুটের মাল নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে লেকের বরফের তলায়। গত কয়েক বছর ধরে করছে এ সব। এবারও বাদ দেয়নি।
অবিশ্বাসটা বাড়ল জ্যাকসনের। জ্যাকি, কি বলছে ওরা?
জবাব দিল না জ্যাকি। নীরবে মুখ ফিরিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
রকি?
বুকের ওপর ঝুলে পড়ল রকির মাথা।
এ ভাবে আমার…আমার-কান কাটলি তোরা! গাড়ির গায়ে গিয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল জ্যাকসন। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।
.
১৬.
দিন কয়েক পরে আবার একটা পার্টি দিল মরগান আঙ্কেলরা।
গাড়ি ভর্তি করে এল তিন গোয়েন্দা সহ পিটার, রয় ও শার্লির বন্ধুরা। রাস্তার শেষ মোড়টা ঘুরতে চোখে পড়ল ওদের পাইনভিউ লেকের ছবির মত দৃশ্য। কিন্তু এক প্রান্তের আইস-ফিশিং শ্যান্টিগুলোর কাছে একজন মৎস্য শিকারীকেও দেখা গেল না। অন্য প্রান্তে নেই হকি খেলোয়াড়ের দল।
মরগান আঙ্কেলদের মূস্ত লিভিং রূমটাতে ঢুকল ওরা দল বেঁধে। আরও লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তারা এসে পৌঁছায়নি এখনও।
পিটারের বাবাকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তিনিও এসেছেন। বুড়ো জ্যাকসনকে দাওয়াত দেয়া হবে না জেনেই এসেছেন।
ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে. তিন গোয়েন্দা। ঘরে ঢুকলেন পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন, ইউরি রিকম্যান।
কেসটার সমাধান করে দেয়ার জন্যে পুলিশের তরফ থেকে তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, তিন গোয়েন্দাকে বললেন তিনি। হাততালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানাল উপস্থিত মেহমানরা।
আপনাদেরকেও ধন্যবাদ, তিন গোয়েন্দার পক্ষ থেকে জবাব দিল কিশোর। কিন্তু আপনাদের সাহায্য ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না।
তার কথার সঙ্গে যোগ করল রবিন, আন্টি যে ভাবে জলে ডোবা মানুষগুলোকে বাঁচিয়েছেন, সেটার প্রশংসা না করেও পারছি না।
মাছ শিকারীরা সবে কথা বলা শুরু করেছে পিটার ও তার বন্ধুদের সঙ্গে, ঠিক এ সময় দরজায় দেখা দিল বুড়ো জ্যাকসন।
এক্সকিউজ মী, বিব্রত ভঙ্গিতে বলল সে। দাওয়াত ছাড়াই এসে ঢুকে পড়লাম। কারণ, জানি আজ সবাইকে এখানে একসঙ্গে পাব। আমি আমার নাতিদের হয়ে মাপ চাইতে এসেছি সবার কাছে। ভাবলেই আমার এত খারাপ লাগে…বিশ্বাস করুন, ঘুণাক্ষরেও যদি টের পেতাম, পিটিয়ে সোজা করে ফেলতাম।..
টের পাননি কি আর করা, ক্যাপ্টেন রিকম্যান বললেন। আপনার হয়ে জেলখানার চোর-বদমাশরাই এখন ওদের সিধে করুক।
ঘরের ভেতর চোখ বুলিয়ে পিটার আর তার বাবাকে দেখতে পেল জ্যাকসন। পিটারের কাছে আমি বিশেষ ভাবে মাপ চাইতে এসেছি।
জ্যাকসনের কথা শুনে গুঞ্জন উঠল মেহমানদের মধ্যে।
পিটার, বুড়ো বলল, অকারণে তোমার ওপর দোষ চাপিয়েছিলাম আমি। আমাকে মাপ করে দাও। আমি এখন বুঝতে পারছি, তুমি সত্যিই একটা ভাল ছেলে। আমি যা করেছি তোমার বিরুদ্ধে, সেটা ঠিক করিনি।
ঘরের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেল পিটায়। জ্যাকসনকে অবাক করে দিয়ে তার হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল। আমি কিছু মনে করিনি, মিস্টার জ্যাকসন।
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গেলেন এরপর মিস্টার হিগিনস। জ্যাকসনের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, জ্যাকি, পরস্পরকে ঘৃণা করাটা চালিয়ে যেতেই পারি আমরা, ব্যাপারটা যত খারাপই হোক। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক খারাপের জন্যে গাঁয়ের মানুষকে ঝামেলায় ফেলাটা কি ঠিক হচ্ছে?
এরপর যা ঘটল, বিশ্বাস করতে পারল না মেহমানরা। চোখ বড় বড় করে। সবাই দেখল, হাতে হাত মেলাচ্ছেন মিস্টার হিগিনস আর বুড়ো জ্যাকসন। ঘর ভর্তি মানুষ আনন্দে হুল্লোড় করে উঠল। হাততালি দিতে লাগল।
একটা সত্যি কথা বলি এবার? হেসে বলল জ্যাকসন, বরফের ওপর হকি খেলাটা আমাদের মাছ শিকারীদের জন্যে বরং ভাল। লেকের এক প্রান্তে খেলা চললে ভড়কে গিয়ে ওদিকের সমস্ত মাছ চলে আসবে অন্য প্রান্তে আমাদের দিকে। কাজেই হকি খেলতেই পারে ছেলেরা। আপনারা কি বলেন?
হাসতে শুরু করল শৌখিন মৎস্য শিকারীর দল।
পিটার বলল, তাহলে আর মুফতে খেলতে যাচ্ছি না। খেলে দেয়ার জন্যে। আমাদের টাকা দিতে হবে।
পিটারের কাঁধে হাত রাখলেন ক্যাপ্টেন রিকম্যান। খেলার জন্যে টাকা দেবে কি দেবে না সেটা মেছুয়াদের ব্যাপার। কিন্তু আমার একটা প্রস্তাব আছে। আমি জারি গাড়ি সাংঘাতিক ভালবাসো তুমি। মেরামত করাটা তোমার নেশা। আমি তোমাকে একটা কাজ দিতে চাই। আগামী দুমাস প্রতি শনিবারে গিয়ে আমাদের থানার সবগুলো পুলিশের গাড়িকে টিউনিং করে দিয়ে আসবে!
পিটারের মুখ দেখে মনে হলো, লটারির টাকা পেয়ে গেছে। সত্যি বলছেন?
মাথা ঝাঁকালেন ক্যাপ্টেন। মুখে মৃদু হাসি।
ঘরের পরিবেশ হালকা হয়ে এল। পার্টি শুরু হলো সবাই যার যার মত কথা বলছে। গরম সাইডার আর চকলেট খাচ্ছে।
পিটার বলল, মুসা, হয়ে যাবে নাকি একটা হকি ম্যাচ। কালকেই খেলে ফেলতে পারি আমরা।
উঁহু, খেলাটেলা পরে, হাত নেড়ে মানা করে-দিল বুড়ো জ্যাকসন। আগে ওরা আইস-ফিশিং শিখবে। মুসার দিকে ভুরু নাচাল। কি বলো, মুসা আমান? আড়চোখে কিশোরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। ছিপটিপের জন্যে পয়সা দিতে হবে না। কিশোর বলল, তাহলে আমি রাজি। মাথা দুলিয়ে সায় দিল রবিন। তুমি কি বলো, রবিন?
<