১৩.
আকাশে ভাসমান মেঘ যেমন সচল ভাবে ছায়া ফেলে ঢেকে দেয়, তেমনি ভাবে মুসাদের বাড়িটাকে ঢেকে দিয়েছে ড্রাগনের ছায়া। হঠাৎ শীত করতে লাগল ওদের। যেন সূর্যের সমস্ত উত্তাপ শুষে নিয়েছে ড্রাগনের ছায়া।
ঘুরে দাঁড়াল মুসা। জোর করে সরে এল জানালার কাছ থেকে।
কাঁপতে কাঁপতে দৌড় দিল রান্নাঘরের দিকে।
সামনের আঙিনায় ড্রাগনের সরীসৃপ সুলভ হিঁচড়ে আসার শব্দ হচ্ছে। প্রতিবার পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠছে বাড়িটা।
একটা গাছ ভাঙার মড়মড় শব্দ কানে এল। ধড়াস করে আছড়ে পড়ল গাছটা। তার ছিঁড়ে চড়চড় শব্দ করতে লাগল বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ।
বাড়ির পাশ ঘুরে আসছে, চিৎকার করে জানাল রবিন।
শীতল অন্ধকার ছায়া এগিয়ে এসে ঢেকে দিচ্ছে এখন পেছনের আঙিনা। তারপর ছায়াটা পড়ল রান্নাঘরের জানালায়।
চোখ তুলে জানালার দিকে তাকাল মুসা। ড্রাগনের মস্ত, রিঙের মত করে পরানো আঁশওয়ালা, বর্মপরা চেহারার বুকটা দেখতে পেল। বাড়ির পেছনে ধাক্কা খেল ওটার শরীর। থরথর করে কেঁপে উঠল পুরো বাড়িটা। রান্নাঘরের প্লাস্টার ভেঙে খসে গিয়ে ঝুরঝুর করে পড়তে লাগল।
জানালার কাছে মুখ নামাল ওটা। কানফাটা শব্দ তুলে বন্ধ করল হাঁ করা চোয়াল দুটো। বাস্কেটবলের সমান বড় লাল টকটকে চোখ মেলে উঁকি দিল ঘরের ভেতরে।
চিৎকার দিয়ে জানালার কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে শুরু করল রবিন। কিশোরের গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল। থামল না। কিশোরের পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল ঘরের অন্য প্রান্তের দিকে।
জানালার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। অন্য কোন দিকে নজর নেই। ঘনঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। আচমকা ছোট্ট একটা চিৎকার দিয়ে ঘুরে দৌড় মারল টেবিলের দিকে। একটা মরিয়া ভাবনা মাথাচাড়া দিয়েছে মনে।
টেবিলটার ওপর প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ল সে। দুহাতে দুদিক থেকে ঝাড় দিয়ে এনে জড় করতে শুরু করল টেবিলে পড়ে থাকা তাসগুলো। থরথর করে কাঁপছে।
সবগুলো তাস একহাতে নিয়ে অন্য হাতে তুলে নিল বাক্সটা।
তাসগুলোকে বাক্সে ঢোকানোর চিন্তা ছাড়া আর কিছু ভাবছে না আপাতত।
ঢোকাতে পারলে হয়তো চলে যাবে ড্রাগনটা।
গত রাতের মত।
গতরাতে, মনে আছে তার, তাসগুলোকে সব একসঙ্গে করে বাক্সে ঢোকাতেই থেমে গিয়েছিল ঝড়বৃষ্টি। আলো ফিরে এসেছিল।
ঝনঝন করে উঠল জানালা। ড্রাগনটার নাকের ছোঁয়া লেগেছে ওখানে। ফিরে তাকাল কিশোর। লাল চোখ দুটো ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। নাকের ফুটো বিস্ফারিত হয়ে গেল দানবটার।
মাথাটাকে পেছনে টেনে নিল ড্রাগন। লম্বা গলাটা ধনুকের মত বাঁকা হয়ে গেল।
আঘাত হানতে যাচ্ছে। মাথা দিয়ে বাড়ি মারবে। প্রচণ্ড আঘাতে গুঁড়িয়ে দেবে ঘরের দেয়াল। তারপর ওদেরকে কামড়ে ধরে টেনে বের করবে।
সময় নেই। একেবারেই সময় নেই।
বাক্সের মধ্যে তাসগুলো ঢোকানো শুরু করল সে।
তাড়াহুড়োয় হাত থেকে পড়ে গেল বাক্সটা।
আপনাআপনি চাপা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
ঝপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। কাঁপা হাতে থাবা দিয়ে তুলে নিল আবার বাক্সটা।
তাসগুলো অর্ধেক ঢুকিয়েছিল। ঠেলা দিয়ে বাকিটাও ঢুকিয়ে দিতে লাগল।
ঠেলা! ঠেলা! ঢুকে যাচ্ছে তাসগুলো।
ঢোকা শেষ।
বাক্সের মুখ বন্ধ করে দিল সে।
কাজ হবে তো?
.
১৪.
ফট করে জোরাল একটা শব্দ হলো। অনেক বড় একটা বৈলুন ফেটে যাওয়ার
তীব্র সাদা আলোর ঝলকানিতে একই সঙ্গে শোনা গেল তিনজনের বিস্মিত চিৎকার।
চোখ মিটমিট করে জানালার দিকে দৃষ্টি ফেরাল কিশোর। সকালের ঝলমলে রোদ বন্যার মত এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘরে।
বাইরে এখন স্তব্ধ নীরবতা।
জানালার কাছে ছুটে গেল ওরা। বাইরে উঁকি দিল।
ইয়া বড় বড় পায়ের ছাপ পড়ে আছে মাটিতে। গম্ভীর হয়ে দাগ বসে গেছে।
ড্রাগন নেই। কোথাও দেখা গেল না ওটাকে। উধাও হয়ে গেছে।
আনন্দে কথা বেরোল না মুসার মুখ থেকে। নীরবে পিঠ চাপড়ে দিতে লাগল কিশোরের।
হাসতে শুরু করল রবিন। হাসিটা সংক্রামিত হলো মুসার মাঝে। কিশোরও নীরব রইল না আর। পাগলের মত হাসতে লাগল তিনজনে। পিঠ চাপড়ে দিতে তাসের খেলা লাগল পরস্পরের। শেষে কোলাকুলি শুরু করল।
ড্রাগনটা চলে যাওয়ায় হাপ ছেড়ে বেঁচেছে।
কিন্তু টেবিলের ওপর রাখা তাসগুলোর দিকে চোখ পড়তেই হাসি বন্ধ হয়ে গেল মুসার। ওগুলো দিয়ে আসতে হবে কাকু-কাকুকে। এখনই।
হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন। এমন করে তাকাতে লাগল তাসগুলোর দিকে, যেন যে কোন মুহূর্তে বোমার মত ফেটে যাবে ওগুলো। কাকু কাকু আগেই সাবধান করে দিয়েছিল আমাদের, তাসগুলো বিপজ্জনক। আমরাই কানে তুলিনি।
মাথার ঘন কোঁকড়া চুলে আঙুল চালাল কিশোর। কাকু-কাকু যদি জানবেই তাসগুলো এতটা বিপজ্জনক, তাহলে বিক্রির জন্যে সাজাল কেন?
ওগুলোর হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিল হয়তো, জবাব দিল রবিন।
মিসেস রেডরোজই বা চুরি করল কেন?
অতিরিক্ত দাম হাঁকত কাকু-কাকু। বিনে পয়সায় জোগাড় করা গেলে দাম দিতে যাবে কেন?
তাহলে মুসার পকেটে ভরে পাচার করল কেন?
ধরা পড়লে মুসা পড়ত। চোর হিসেবে তার শাস্তি হত। এটা তো সোজা কথা।
মাথা নাড়ল কিশোর, উঁহু, অত সোজা নয়। নিজের ঠোঁটে জোরে এক টান দিয়ে ছেড়ে দিল। কারণটা অন্যখানে। মিসেস রেডরোজ জানত, তাকে দেখতে পারে না প্রতিবেশীরা। তাড়াতে চায় এখান থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেডরোজ। তবে যাওয়ার আগে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল। তাসগুলো মুসার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল প্ল্যান করেই। জানত, তাসগুলো পেলেই খেলতে চাইব আমরা। আর খেলতে বসলে নিজেদের অজান্তেই ভয়ানক ক্ষতি করে দেব পড়শীদের। যদি দোষ পড়ে আমাদের ওপর পড়বে। এক মুহূর্ত ভাবল সে। তারপর বলল, হ্যাঁ, এটাই একমাত্র কারণ। আমি শিওর।
রেগে উঠল মুসা, তাহলে তো মহিলাকে গিয়ে এখনই ধরা দরকার…
পাবে কোথায়? ভুরু নাচাল কিশোর। গিয়ে দেখগে, তার বাড়িতে তালা। মারা।
তুমি দেখেছ নাকি?
না। অনুমান করছি। তাসের খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্যে বসে থাকবে না সে।
তাহলে আর সময় নষ্ট করছি কেন? চলো যাই। আগে মিসেস রেডরোজের বাড়িতেই যাব। ওখান থেকে কাকু-কাকুর বাড়িতে যাব। তাসগুলো ফেরত দিয়ে আসতে।
আমরাও যাব? কাকু-কাকুর বাড়িতে যেতে ভয় পাচ্ছে রবিন। সমর্থনের আশায় কিশোরের দিকে তাকাল।
কিশোর কিছু বলার আগেই মুসা বলে উঠল, আমাকে একা পাঠাতে চাও নাকি? আমি বাপু একা যেতে পারব না। তোমরা সঙ্গে থাকলে তা-ও সাহস পাব।
রবিনের দিকে তাকা কিশোর। তারপর মাথা ঝাঁকাল। বেশ। চলো।
তাসের বাক্সটার জন্যে হাত বাড়াল মুসা। যেই তুলে নিতে যাবে মুখটা খুলে গিয়ে একটা তাস পড়ে গেল মাটিতে। ধড়াস করে উঠল তার বুকের ভেতর। আবার না কোন অঘটন ঘটে যায়।
নিচু হয়ে তাড়াতাড়ি তুলে নিল তাসটা।
ওটায় কি আছে দেখে আঁতকে গেল।
দেখো দেখো! চিৎকার করে উঠল সে। এ তাসটা তো আগে দেখিনি একবারও!
অন্য দুজনের দেখার জন্যে হাতটা বাড়িয়ে দিল সে।
আরে এ তো…এ তো কাকু-কাকুর ছবি! রবিনও হতবাক।
কিশোরও দেখল। ভুল বলেনি মুসা বা রবিন। কাকু-কাকুই। সাদা চুল। সাদা গোফ। অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঠেলে বেরিয়ে আছে ঠোঁটের দুই কোণে গোল গোল কুতকুতে নীল চোখ মেলে যেন সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে ওদের দিকে।
দেখো তো, উল্টো দিকে কিছু আঁকা আছে কিনা? কিশোর বলল।
তাসটা ওল্টাল মুসা। অবাক হয়ে দেখল, লেখা রয়েছে: জাদুকর।
হু, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। জাদুকর। তারমানে এটা মায়াতাস। সমস্ত তাসগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিছু বুঝলে?
জোরে জোরে মাথা নাড়াল মুসা। বোঝাবুঝির আমার দরকার নেই। এগুলোর কোন ব্যাপারেই আর ঢুকতে চাই না। যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। চলো; গিয়ে তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়ে আসি।
কিন্তু তার কথায় কান দিল না কিশোর। তাসটা হাতে নিয়ে উঁচু করে দেখল। আনমনে বিড়বিড় করল, সত্যিই কি জাদুকর? জাদু বলে সত্যি কোন জিনিস আছে?
তাসটা আবার কেড়ে নিয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে পকেটে ভরে ফেলল মুসা, না থাকলে খানিক আগে কার ভয়ে ঘাম ছুটে গেল আমাদের? ড্রাগনের পায়ের ছাপ তো এখনও রয়েছে মাটিতে। এগুলো কি মিথ্যে? দেখো, অত কথার দরকার নেই। চলো, ফেরত দিয়ে আসি…
কিন্তু রহস্যটা ভেদ না করেই?
কিশোরের কোন কথার ধার দিয়েই গেল নাঃআর মুসা। তার হাত চেপে ধরে টেনে নিয়ে চলল দরজার দিকে।
জিনসের প্যান্টের পেছনের পকেটে ভরে নিয়েছে তাসের প্যাকেটটা।
.
১৫.
সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তিনজনে। সামনের লনের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগল।
মোড়ের কাছে বিশাল একটা ম্যাপল গাছ ছিল। কাত হয়ে পড়ে আছে এখন বিদ্যুতের তারের ওপর। একনাগাড়ে ফুলিঙ্গ ছিটাচ্ছে এখন ছেঁড়া তারগুলো। মাঝে মাঝে বেড়ে গিয়ে ফুলিঙ্গের ফুলঝুরি তৈরি করছে। চড়চড়, ছরছর শব্দ। করেই চলেছে।
গাছটার সামনে থামল ওরা।
রাস্তার ওধারে লাল রঙের একটা ভর্তা হয়ে যাওয়া জিনিস দেখাল মুসা। গাড়ি ছিল ওটা।
সারা ব্লক জুড়ে ধ্বংসলীলা চলেছে। ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। ভর্তা হয়ে যাওয়া গাড়ি। ভেঙে পড়া গাছ। ছেঁড়া তার। রাস্তায় বড় বড় গর্ত। দলিত মথিত পাতাবাহারের বেড়া আর ফুলের বেড।
রাস্তা আটকে রেখেছে তিনটে পুলিশের গাড়ি। নীরবে জ্বলছে নিভছে ওগুলোর লাল আলো।
ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে জটলা করছে লোকে। নানা রকম জল্পনা করছে। মাথা চাপড়াচ্ছে কেউ। কেউ বা উত্তেজিত কণ্ঠে বোঝানোর চেষ্টা করছে অন্যকে। হাত তুলে দেখাচ্ছে ধসে পড়া বাড়িঘর, ভর্তা হয়ে যাওয়া গাড়ি। চমকে যাওয়া বিমূঢ় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ছে কেউ কেউ।
এ সবের মূলে আমরা! বিড়বিড় করে বলল মুসা। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না কোনমতেই। লোকের সর্বনাশ করেছি!
আমাদের দোষ বলা যাবে না, গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। আমরা তো জানতাম না তাস খেললে এতবড় কাণ্ড ঘটবে। আমাদেরকে দিয়ে যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে, দোষী আসলে সে। মিস লীলা রেডরোজ। তাকে খুঁজে বের করা দরকার।
আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, হতভম্ব হয়ে যাওয়া ভঙ্গিতে বলল রবিন। গলা কাঁপছে। ভাবতেই পারছি না, সাধারণ কয়েকটা তাস এতবড় ক্ষতি করে দিতে পারে।
কয়েকজন প্রতিবেশীকে ওদের দিকে তাকাতে দেখে কুঁকড়ে গেল মুসা। তার মনে হতে লাগল ওরা যে অপরাধী লোকে সেটা টের পেয়ে গেছে। জেনে গেছে খেলতে বসে নাইট আর ড্রাগন ডেকে এনে ওরা এই মহা সর্বনাশ ঘটিয়েছে।
ভাবনাগুলো কোনমতেই স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না মুসাকে। তাসের প্যাকেটটা বয়ে এনেছে বলে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে তার। ইস, কোন কুক্ষণে যে কাকু-কাকুর বাড়িতে গিয়েছিল!
ভাবনাগুলো অন্য দুজনেরও শান্তি হারাম করছে। যতই ভাবছে, রাগটা গিয়ে পড়ছে লীলা রেডরোজের ওপর। অঘটনগুলোর জন্যে সত্যিই যে দায়ী।
ওর বাড়ির দিকে হাঁটা দিল আবার তিন গোয়েন্দা। পুলিশের গাড়িগুলো পার হয়ে এল। কানে এল রেডিওর কড়কড় শব্দ। ইউনিফর্ম পরা অফিসারেরা রাস্তার এ মাথা ও মাথায় হাটছে। গভীর ছাপগুলো দেখছে। মাথা চুলকাচ্ছে বোকার মত। বিস্মিত ভাবভঙ্গি।
মোড়ের কাছ থেকেই দেখা গেল লীলা রেডরোজের বাড়িটা। দরজা-জানালা সব বন্ধ। বাড়িতে যে কেউ নেই সেটা বোঝার জন্যে কাছে যাওয়া লাগে না।
বাড়িটায় ঢুকল ওরা। কিশোরের অনুমানই ঠিক। তালা লাগানো। বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে লীলা রেডরোজ।
হতাশ হলো মুসা। ক্ষতিপূরণ আদায় করতে না পেরে।
কিশোর বলল, মহিলাকে খুঁজে বের করবই আমরা। জিনিসপত্র যা নষ্ট হয়েছে, সেগুলোর ক্ষতিপূরণ যদি না দিতে পারে, জেলের ভাত খাবে।
রেডরোজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কাকু-কাকুর বাড়ির দিকে এগোল। ওরা। সামনের দরজা বন্ধ। জানালাগুলোর কোনটাতেই প্রাণের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার। বাড়িতে ঢুকে দেখা গেল সকালের খবরের কাগজটা পড়ে রয়েছে ড্রাইভওয়েতে।
ঘটনাটা কি? কাকু-কাকুও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল নাকি?
দেখো, কাকু-কাকুর বাড়িটার কিছুই হয়নি, কিশোর বলল। ওর লন, সামনের আঙিনা, কোথাও কোন ক্ষতি হয়নি।
পকেটের তাসের প্যাকেটটায় হাত রাখল মুসা। বাড়ি থাকলেই হয় এখন। তাসগুলোকে তাড়াতে পারলে বাঁচি।
রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে কাকু-কাকুর সুন্দর করে ছাঁটা লনে প্রবেশ করল ওরা। ওর সামনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
জানালা দিয়ে উঁকি দিল মুসা। কিন্তু রোদের প্রতিফলন জানালার কাছে এক ধরনের সোনালি পর্দা সৃষ্টি করেছে। ভেতরে দৃষ্টি প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।
বড় করে দম নিল সে। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে তিন ধাপ নিচু সিঁড়ি বেয়ে সামনের দরজার কাছে উঠে ঘণ্টার বোতাম টিপে ধরল। বাড়ির ভেতর থেকে ঘণ্টা বাজার আওয়াজ কানে এল।
মিস্টার কাকু-কাকু, বাড়ি আছেন? ডেকে জিজ্ঞেস করল মুসা। ভয় যে পাচ্ছে, সেটা প্রকাশ পেল কণ্ঠস্বরেই। মিস্টার কাকু-কাকু?
জবাব নেই।
বাড়ির ভেতর থেকে পদশব্দ ভেসে এল না। কোন শব্দই নেই।
আবার বেল বাজাল মুসা। অপেক্ষা করতে লাগল। হঠাৎ করেই হাত দুটো বরফের মত শীতল লাগতে লাগল তার। চাদির কাছে দপদপ করছে মাথার শিরাগুলো।
ভয় তো পাবই, নিজেকে কৈফিয়ত দিল সে। লোকটা জাদুকর। অদ্ভুত, অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে তার। হয়তো একজন ভয়ঙ্কর ক্ষমতাশালী প্রেতসাধকই, কে জানে।
এবং সেই ক্ষমতাশালী লোকটা ভাবছে, তার জিনিস চুরি করেছে মুসা।
কি, কিছু শুনছ? নিচ থেকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। তার কাছ ঘেঁষে এল রবিন। দুজনে তাকিয়ে রয়েছে মুসার দিকে।
আবার বেল বাজাল মুসা। দুই হাতে কিল মারতে শুরু করল দরজায়।
ঠেলা লেগে খুলে গেল দরজা।
ভীষণ চমকে গেল সে। মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে এল আপনাআপনি।
অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করে মাথা ঢুকিয়ে দিল ভেতরে। বাড়ির ভেতরে সামনের অংশটা অন্ধকার। ভারী দম নিল সে। নাকে এল তীক্ষ্ণ, মিষ্টি এক ধরনের সুবাস। মশলা মেশানো।
মিস্টার কাকু-কাকু? ডাক দিল আবার।
অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হলো তার ডাক। ভোতা, ফাপা এক ধরনের শব্দ।
আবার ভারী দম নিল সে। প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকা হৃৎপিণ্ডটাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। তারপর দরজাটাকে আরেকটু ফাঁক করে পা রাখল ঘরের ভেতর।
শুনছেন? ডেকে জিজ্ঞেস করল সে। কেউ আছেন?
পরক্ষণেই ধড়াস করে এক লাফ মারল তার হৃৎপিণ্ড। লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল। সে। সামনের ঘর থেকে ভেসে এল একটুকরো তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ।
.
১৬.
দরজার কাছে পিছিয়ে আসতে গিয়ে ধাক্কা খেল কিশোর আর রবিনের গায়ে। মুসা। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ির মাথায় উঠে এসেছে ওরা।
আ-আছে..ঘ-ঘ-ঘরেই আছে সে… তোতলাতে শুরু করল মুসা।
আবার শোনা গেল তীক্ষ্ণ, উচ্চকিত হাসি।
আমার কাছে তো বাচ্চাদের হাসির মত লাগছে, মুসার গা ঘেঁষে এসে ফিসফিস করে বলল রবিন। কিংবা কোন জানোয়ারের।
ফ্যাকাসে এক ফালি রোদ পড়েছে লিভিং রূমে। সেটা ধরে প্রায় গায়ে গায়ে লেগে থেকে এগোতে শুরু করল ওরা। ঘরের অন্ধকার চোখে সয়ে এলে দেখা গেল ঘর ভর্তি পুরানো আসবাবপত্র। কয়েকটা খাড়া হেলানওয়ালা কাঠের চেয়ার আছে। একটা টেবিল আছে, তাতে এলোমেলো ভাবে নানা রকম জিনিস ছড়ানো। একটা ভাঙাচোরা পিয়ানো আছে। ছোট একটা টেবিলে রাখা একটা রূপার বল। জানালায় এত ভারী পর্দা টানা যে, আলোই আসতে পারছে না।
আবার হাসির শব্দ শোনা গেল।
ফিরে তাকাল মুসা। হাসিটা কোথা থেকে আসছে, শব্দ সৃষ্টিকারীটা কে, দেখে ফেলল।
একটা বানর। ছোট একটা বাদামী বানর একটা পিতলের খাঁচার মধ্যে উত্তেজিত ভঙ্গিতে লাফালাফি করছে। বানরের ভাষায় কিচকিচ করে চলেছে। সমানে।
বাহ, সুন্দর তো বানরটা! রবিন বলল। খাঁচাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
তীক্ষ কিচির-মিচির থামিয়ে দিল বানরটা। মাথা কাত করে তাকিয়ে দেখতে লাগল রবিনকে।
পোষাই তো মনে হচ্ছে, রবিনের পাশে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। সাবধানে তাকিয়ে আছে বানরটার দিকে। নাকি আগে মানুষ ছিল, কাকু-কাকু জাদু করে ওকে বানর বানিয়ে ফেলেছে?
না, ও সব সময়ই বানর ছিল। পেছন থেকে বলে উঠল একটা তীক্ষ্ণ খসখসে কণ্ঠ।
কাকু-কাকুর গলা চিনতে পেরে চরকির মত পাক খেয়ে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল মুসা।
শীতল গোল গোল কুতকুতে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে কাকু-কাকু। সাদা চুলগুলো মাথার পেছনে ঘাড়ের কাছে খাড়া হয়ে আছে। মখমলের লাল আলখেল্লার নিচে ডোরাকাটা পাজামা পরেছে।
মিস্টার কাকু-কাকু… শুরু করতে গেল মুসা।
এখানে কি তোমাদের? রাগত স্বরে জিজ্ঞেস করল কাকু-কাকু। এখন কটা বাজে? এত সকালে এসে ঘুম ভাঙালে কেন আমার? নাকি বাড়িটা খালি ভেবে আর লোভ সামলাতে পারোনি। চুরি করতে ঢুকে পড়েছ?
না-না! তোতলাতে শুরু করল মুসা, আ-আ-আমরা আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। আ-আমরা…
বেশ দেখা তো হলো আমার সঙ্গে। চিৎকার করে উঠল কাকু-কাকু। সব সময় এ ভাবে চুরি করেই লোকের সঙ্গে দেখা করতে ঢোকো নাকি?
না। দরজাটা খোলাই ছিল, জবাব দিল মুসা।
চুরি করে ঢুকিনি আমরা, এতক্ষণে কথা বলল কিশোর। ঢোকার আগে বেশ কয়েকবার বেল বাজিয়েছি।
ব্যঙ্গের স্বরে বলল কাকু-কাকু, তাই নাকি…
বাধা দিয়ে রবিন বলল, দেখুন, আমরা সত্যি বলছি! চুরি করার সামান্যতম ইচ্ছে আমাদের নেই!
চোয়াল ডলল কাকু-কাকু। গোঁফের মাথা দুটো টেনে লম্বা করে দিল। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে গোয়েন্দাদের দিকে। তোমরা কেন এসেছ, আমি জানি, অবশেষে বলল সে।
অ, জানেন…জানবেনই তো… পেছনের পকেট থেকে তাসের প্যাকেটটা বের করে আনল মুসা। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই যে, নিন!
জ্বলে উঠল কাকু-কাকুর নীল চোখ। তাহলে তোমরাই বাক্সটা চুরি করেছিলে।
না, আমরা চুরি করিনি, মুসা বলল।
তাহলে তোমাদের কাছে গেল কি করে?
মিস লীলা রেডরোজ চুরি করে আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছিল সেদিন। আমাদেরকে দিয়ে খেলিয়ে প্রতিবেশীদের ক্ষতি করে তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত মুসার দিকে তাকিয়ে রইল কাকু-কাকু। তারপর কিশোর আর রবিনের ওপর ঘুরে এসে আবার মুসার ওপর স্থির হলো তার দৃষ্টি। অ, তারমানে খেলাটাও তোমাদেরই কাজ। ড্রাগন ডেকে এনেছ। আরেকটু হলেই ধ্বংস করে দিচ্ছিলে তোমাদের পুরোটা ব্লক।
হয়তো, শান্তকণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। কিন্তু তারপরেও স্বীকার করব না, দোষটা আমাদের। কারণ, ওরকম এক প্যাকেট তাস হাতে পেলে আপনিও খেলতে বসতেন। তাস খেলাটা দোষের কিছু না। কিন্তু সেটা যে এ রকম বাস্তব হয়ে উঠবে, সব কিছু ধ্বংস করে দেবে, সেটা কে জানত? যখনই বুঝলাম বিপজ্জনক, ফেরত দিতে নিয়ে এলাম।
যখন আনতে গেলাম, তখন দিলে না কেন? রেগে উঠল কাকু-কাকু।
তখন দিলে চোর বলতেন আমাদের।
এখনও যদি বলি?
বললে বলুনগে। এখন চোর বললে, আর ততটা গায়ে লাগবে না। কারণ, আমরা বুঝে গেছি, তাসগুলো বিপজ্জনক। যা-ই বলুন, কোন কিছু আর কেয়ার করি না। কারণ, কারও ক্ষতির কারণ আর হতে চাই না আমরা। কিন্তু একটা কথা বলুন তো, আপনিই বা এ রকম এক প্যাকেট বিপজ্জনক তাস বিক্রির জন্যে রেখেছিলেন কেন? যে কিনত, সে কি ভাবছেন খেলত না? ক্ষতির কারণ হত না? আর না জেনে ক্ষতি করলে দোষটা কার ওপর বর্তাত? ভুরু নাচাল কিশোর। আপনার ওপর। কারণ আপনিই এগুলোর আসল মালিক।
মানুষের ক্ষতি তো করেছই, আবার বেশি চোরের মার বড় গলা… থাবা দিয়ে মুসার হাত থেকে প্যাকেটটা কেড়ে নিল কাকু-কাকু।
দেখুন যা হবার হয়ে গেছে, পরিস্থিতিটাকে হালকা করার জন্যে বলল রবিন, কাকু-কাকুকে ভয় পাচ্ছে সে। এটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই।
বাড়াবাড়ি মানে? রাগ তো কমলই না, বেড়ে গেল আরও কাকু-কাকুর। শয়তানিটা আমি করেছি, না তোমরা? চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি…
সহ্য করতে পারল না আর মুসা। রেগে উঠল, দেখুন, আমরা চুরি করিনি! আমরা চোর নই, বার বার বলছি আপনাকে। কিছুতেই বিশ্বাস করছেন না। তা ছাড়া কি করে জানব আমরা, তাস খেলে বাস্তবে ড্রাগন আর নাইট ডেকে আনা যায়? এ রকম গাঁজাখুরি কথা কেউ বিশ্বাস করবে? আগে খুলে বলেননি কেন সে কথা? আসলে, ভুল আমাদের সবারই হয়েছে। আপনিও বাদ যাবেন না।
হ্যাঁ, যেন একমত হয়ে মাথা ঝাঁকাল কাকু-কাকু। গোফের কোনায় চাড় দিতে শুরু করল। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুসার দিকে। ভুল। বড় রকমের ভুল। অনেক বেশি জেনে ফেলেছ তোমরা।
কাকু-কাকুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। ঘাবড়ে গেল। পিছাতে গিয়ে ধাক্কা লাগল একটা উঁচু হেলানওয়ালা সোফায়। অনেক বেশি জেনে ফেলেছি। মানে? কি বলতে চান? তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল তার কণ্ঠ।
ওর পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর আর রবিন।
প্রশ্নের জবাব দিল না কাকু-কাকু। অদ্ভুত হাসি ফুটল তার ফ্যাকাসে মুখে। তিন গোয়েন্দার ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে তাসগুলো সব বের করল প্যাকেট থেকে।
তাস যখন তোমাদের এতই পছন্দ, বিচিত্র হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে-তার গোফ জোড়াকে মনে হলো ডানা মেলে উড়ছে, নিজেরাই এর চরিত্র। হয়ে যাও না কেন? তাসের জগতেই ঢুকে পড়ো তোমরা।
মানে? দম আটকে এল মুসার। কি বলতে চান…
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাত গরিয়ে তাসগুলোকে শূন্যে উড়িয়ে দিল কাকু-কাকু।
ছুঁড়ে ফেলল মুসা, রবিন আর কিশোরকে লক্ষ্য করে।
ঘুরতে ঘুরতে, ওলট-পালট করতে করতে নিচে পড়তে লাগল তাসগুলো। ওদের মাথায়, ওদের কাঁধে। নীরবে ভাসতে ভাসতে মাটিতে নেমে গেল।
তাসগুলো সব মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার নেমে এল ওদের ওপর।
গাঢ়, ঠাণ্ডা অন্ধকার। এ রকম অনুভূতি আর আগে কখনও হয়নি ওদের।
ধীরে ধীরে ঘরটা মিলিয়ে গেল। কাকু-কাকু মিলিয়ে গেল। নিজেরাও পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে না আর।
নড়ল না তিনজনের কেউ। মনে হচ্ছে পড়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে। বরফের মত শীতলতার মধ্যে।
নিথর নীরবতার মধ্যে।
তারপর একটা বিস্ফোরণ ঘটল যেন নিজেদের দেহে। তীক্ষ্ণ ব্যথা। আর্ত চিৎকার বেরিয়ে এল আপনাআপনি।
ব্যথাটা বুকের কাছ থেকে ছড়িয়ে গেল সমস্ত শরীরে। বাহুতে। পায়ে। মাথার মধ্যে ফেটে পড়ল ব্যথা। ঝিমঝিম করতে থাকল।
মাথা…মাথা…ঝিমঝিম…
মনে হলো টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে মাথাটা।
মনে হলো কোটর থেকে খুলে ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে চোখ। দাঁত খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে মুখ থেকে।
চিৎকার করতে থাকা ওদের হাঁ করা মুখ দিয়ে মগজটা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ করেই মনে হলো ওরে, এই অন্ধকার ওদের চেনা।
নিথর এই শীতল অন্ধকারটাকে চেনে ওরা।
মনে হতে লাগল, এটাই মৃত্যু।
.
১৭.
অন্ধকার কেটে যাওয়ার আগেই যেন ধুয়ে চলে গেল শীতলতা। গরম ঢেউয়ের ধাক্কা এসে লাগল যেন শরীরে।
কয়লা-কালো অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। অন্ধকার চাদরের মধ্যে মিটমিট করছে কতগুলো আলোর ফোঁটা। তাসের খেলা
তারা?
হ্যাঁ। তারকা খচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেঘমুক্ত আকাশ। ঝিরঝিরে বাতাস। চুল কাপে।
হাঁটুতে ভর দিয়ে রয়েছে, বুঝতে পারল। হাঁটু আর হাতের তালুতে। চার হাত-পায়ে। লম্বা ঘাসের মধ্যে।
বাতাস এত তাজা। এত মিষ্টি। দারুণ সুবাস।
বেঁচে আছি! আমি বেঁচে আছি! প্রথমেই এ কথাটা মনে পড়ল ওর।
কানে এল গোঙানির শব্দ। ওর পাশে থেকে। ঘাসের মধ্যে খসখস শব্দ।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এল রবিন। চোখের পাতা সরু সরু করে তাকাল কিশোরের দিকে। যেন চিনতে পারছে না। ঝাঁকি দিয়ে চুল থেকে কুটো ফেলল। ফিসফিস করে বলল, কিশোর, কোথায় রয়েছি আমরা?
তাই তো! কোথায় রয়েছি? লম্বা ঘাসের মধ্যে রবিনকে অনুসরণ করে। বেরিয়ে এল মুসা।
ভালই তো আছি দেখা যাচ্ছে, জবাব দিল কিশোর। যদিও গলা কাঁপছে তার। আমার মনে হচ্ছিল মগজ ফেটে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল, মারা যাচ্ছি।
কিন্তু আমরা এখন কোথায়? আবার প্রশ্ন করল রবিন। ছিল সকাল। এখন তো দেখতে পাচ্ছি রাত।
নিজেকে টেনে তুলল কিশোর। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল। চওড়া একটা মাঠের মধ্যে রয়েছি আমরা। সমতল মাঠ।
রবিন আর মুসাও উঠে দাঁড়াল।
চারপাশে তাকাতে তাকাতে মুসা বলল, কোন খামার-টামারের সামনে রয়েছি।
লম্বা ঘাসের মাঠ ছাড়িয়ে ওপাশে কমলা রঙের ছোট ছোট আগুনের কুণ্ড দেখতে পেল সে। গোল, নিচু কতগুলো কুঁড়েঘরের সামনে জ্বলছে।
গ্রামটাম হবে, কিশোর বলল। ঘরগুলো দেখো। ঘাস কিংবা খড় দিয়ে তৈরি।
অদ্ভুত! বিড়বিড় করল মুসা
ধূসর রাতের আলোতে ভাল করে দেখা যায় না। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে তাকাল কিশোর। উঁচু একটা খড়ের গাদা চোখে পড়ল। ওটার পাশে উবু হয়ে আছে। একটা ঠেলাগাড়ি। ছোট ছোট আরও দুটো ঠেলাগাড়ি চোখে পড়ল ওদের। দূরে কুঁড়ের সারির কাছেই কোনখান থেকে ভেসে এল একটা ঘোড়ার ডাক।
ঘাড় থেকে থাবা মেরে লাল একটা পোকা ফেলল রবিন। অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ি যাওয়া দরকার। জায়গাটাও আমার ভাল লাগছে না।
মনে তো হচ্ছে বাড়ি যাওয়াটা অত সহজ হবে না, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা; বাড়ি থেকে বহু দূরে রয়েছি আমরা। কাকু-কাকু কি করেছে। আমাদের? এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কি যে বলছিল খেয়ালই করিনি। ঠিকমত।
ও বলেছে, কিশোর বলল, তাস যখন এত পছন্দ, তাসের জগতেই ঢুকে পড়ো তোমরা। তাসগুলো ছুঁড়ে মেরেছে আমাদের ওপর। তারপর এখানে পৌঁছে। গেছি আমরা।
তারমানে তাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছি আমরা? চিৎকার করে উঠল মুসা। তাসের খেলায়? মুখোশ পরা নাইট আর আগুন ঝরানো ড্রাগনের দেশে?
অসম্ভব! বিড়বিড় করে বলল আতঙ্কিত রবিন।
হ্যাঁ, সত্যিই অসম্ভব। প্রতিধ্বনি করল কিশোর। কিন্তু সেটাই ঘটিয়ে বসে আছি আমরা।
কিন্তু…কিন্তু… কথা খুঁজে পেল না মুসা।
তীক্ষ একটা চিৎকার কানে আসতেই ফিরে তাকাল কিশোর।
খসখস শব্দ। পায়ের আওয়াজ। লম্বা ঘাসের ডগা বেঁকে যেতে দেখল সে।
লম্বা এক সারি খুদে মানুষকে ঘাসের মধ্যে সারি দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। গায়ে চামড়ার পোশাক। বড় বড় এলোমেলো চুলে ঢাকা মাথায় গম্বুজ আকৃতির ধাতব হেলমেট, তারার ভোতা আলোয় চকচক করছে। হাতে লম্বা, চোখা ফলাওয়ালা বল্লম।
হুপ! হুপ! হুপ! প! হাঁটার তালে তালে একনাগাড়ে বিচিত্র শব্দ করছে ওরা।
জেকিলস! ফিসফিস করে বলল কিশোর। সাবধান হয়ে গেল। ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ।
ঝট করে বসে পড়ল তিনজনে। লুকিয়ে পড়ল লম্বা ঘাসের মধ্যে।
আমি ওদের চিনে ফেলেছি, ফিসফিস করে বলল কিশোর। তাসের মধ্যেও ওদের ছবি ছিল। ওরা শয়তান…।
তাসের পেছনে আমিও লেখা দেখেছি, কম্পিত কণ্ঠে রবিন বলল। ওরা খুব দুষ্ট শিকারী। নিজেদের মাংস নিজেরা খায়। মানুষ তো খায়ই।
.
১৮.
হুপ! হুপ! হুপ! হুপ!
আতঙ্কিত হয়ে বামন-মানবগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। মার্চ করে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। হাঁটার তালে তালে বল্লম উঠছে, বল্লম নামছে। এক ভাবে। এক ভঙ্গিতে।
ভারী দম নিল কিশোর। ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে শুরু করল লোকগুলোর চলার পথ থেকে।
হুপ! হুপ! হুপ! হুপ!
লোকগুলো কি ওদের দেখে ফেলেছে?
জানার জন্যে অপেক্ষা করা যাবে না।
হামাগুড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা সরে গেল ওরা। হঠাৎ লাফিয়ে উঠে মাথা নিচু করে লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে দৌড় দিল কিশোর। রবিন আর মুসা ছুটল ওর পাশে পাশে।
ঘাসে ঢাকা নরম মাটিতে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ছুটতে থাকল ওরা। কিন্তু ঘাসের গায়ে ঘষা লেগে শব্দ হয়েই যাচ্ছে। ফিরে তাকাল না। তবে কান পেতে রইল লোকগুলোর শিকার দেখতে পাওয়ার উল্লসিত চিৎকার শোনা যায় কিনা।
কোথায় যাব? কোথায় লুকাব? ভাবছে কিশোর।
বুকের মধ্যে পাগল হয়ে উঠেছে হৃৎপিণ্ডটা। ছোটার সময় হাঁপানোর শব্দকে কম করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল সে।
তারার ফ্যাকাসে আলোয় উঁচু খড়ের গাদাটাকে কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে এক অতিকায় দৈত্যের মত।
এক মুহূর্ত দ্বিধা করল না সে। ভাবনা-চিন্তাও করল না বিশেষ। করার সময়ও নেই।
মাথা নিচু করে প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ল গাদাটার ওপর। এক পাশ থেকে ঢুকে পড়ল তার ভেতর।
ভেজা ভেজা। খসখসে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো গা চুলকানো।
এক হাতে চোখ ঢেকে যতটা পারল গভীরে ঢুকে গেল ও। মুখেও খড়ের খোঁচা লাগছে। খোঁচা দিচ্ছে কাপড়ে ঢাকা চামড়াতেও। ধারাল খড়ের ডগা তেরছা ভাবে খোঁচা মেরে আচড়ে দিচ্ছে ঘাড়ের চামড়া।
খড়ের গাদার মধ্যে খড়খড় আওয়াজ পিলে চমকে দিল কিশোরের। পরক্ষণে বুঝতে পারল, মুসা আর রবিনও ঢুকেছে ওর পাশেই।
খাইছে! বলে উঠল মুসা। এ তো এক্কেবারে ভেজা!
আমাদের দেখে ফেলল নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কি-কি জানি, তুতুলে বলল মুসা। থাক, আর কথা বলার দরকার নেই। শুনে ফেলবে…
চুপ হয়ে গেল ওরা।
কান পেতে আছে কিশোর। জেকিলাদের পায়ের শব্দ শোনার জন্যে।
কানে এল না।
হুপ হুপও করছে না আর।
চলে গেল নাকি?
নাকি খড়ের গাদা থেকে ওদের বেরোনোর অপেক্ষা করছে?
মুখের চামড়ায় খোঁচা মারছে খড়ের ডগা। নাকের ভেতর ঢুকে যাওয়া একটা ভেজা খড় সরিয়ে দিতে চাইল সে। যথেষ্ট বেগ পেতে হলো সরাতে।
ইস, এত চুলকান চুলকাচ্ছে, ফিসফিস করে বলল রবিন।
কিশোরের নিজেরও কম চুলকাচ্ছে না। কি জবাব দেবে? পিঠ…বুক…গাল…কোথায় চুলকাচ্ছে না!
সেই সঙ্গে ক্রমাগত খোঁচানো।
চামড়ায় জ্বলুনি শুরু হয়ে গেল। শরীর না মুচড়ে আর থাকতে পারল না। গায়ের ওপর চেপে থাকা খড় সরানোর চেষ্টা করল। চুলকানো থামিয়ে দিল। লাভ নেই। চুলকাতে গেলে কষ্ট আরও বাড়ে।
দাতে দাঁত চেপে স্তব্ধ হয়ে রইল। উফ, এত চুলকানি…এত চুলকানি…
হঠাৎ চাপা একটা গোঙানি যেন জোর করেই বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
বেশ বড় বড় লাল রঙের এক ধরনের পোকা। মুখ থেকে টেনে সরাল একটাকে। আরেকটা ঘষা দিয়ে ফেলে দিল হাতের উল্টো পিঠ থেকে।
ঘাড়ের ওপর পোকা হেঁটে বেড়াচ্ছে সড়সড় করে। শার্টের কলার দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। হেঁটে বেড়াতে শুরু করল পিঠের ওপর।
শত শত লাল পোকায় ছেয়ে আছে খড়ের গাদা। মানুষের গন্ধ পেয়েই যেন এসে হাজির হলো। ঘুরে বেড়াতে শুরু করল ওদের গায়ের ওপর।
ইয়াক! করে উঠল কিশোর। একটা লাল পোকা ওর ফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটের কোণ দিয়ে মুখে ঢুকে পড়ল।
থু-থু করে ফেলে দিল ওটা। জিভে ঝজাল-টক স্বাদ আটকে থাকল অনেকক্ষণ। দাঁতে দাঁত চেপে ফাঁক বন্ধ করে রাখল এরপর। কোনমতেই যাতে আর পোকা ঢুকতে না পারে।
পোকা ঢুকে থাকার কথা কল্পনা করে আরও একবার থু-থু করে উঠল। গাল চুলকাল। খড়ের গাদায় ঘষে পিঠের চুলকানি বন্ধ করতে চাইল।
কিন্তু কোন কাজই হলো না।
মনে হচ্ছে যেন ভয়াবহ এই চুলকামিতেই মারা যাবে।
চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। পোকায় ছাওয়া খড়ের গাদা থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলতে, কাপড় ছিঁড়তে, খামচে চামড়া তুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
কোনদিনই এ চুলকানি আর বন্ধ হবে না, নিজেকে বলল সে। বাকি জীবনটা এ ভাবে চুলকে চুলকেই কাটাতে হবে।
নাহ, আর সওয়া যায় না! পাশ থেকে বলতে শুনল রবিনকে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। মরলে মরব। তা-ও না চুলকে আর পারব না।
তবে মুসা তুলনামূলকভাবে স্থির রয়েছে। ফিসফিস করে বলল, চুপ! জেকিলরা এখনও ধারে কাছেই আছে।
যন্ত্রণার চোটে গায়ে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল কিশোরের। কমানোর কোন উপায় নেই। গায়ের ওপর চেপে রয়েছে ভয়াবহ খড়।
কান থেকে একটা পোকা বের করে ফেলল সে।
ফেলতে না ফেলতেই আরেকটা উঠে এল নাকের ওপর। ঢুকে গেল নাকের ফুটো দিয়ে।
না না! এ কাজও কোরো না! নিজেকে আদেশ দিল সে।
কিন্তু কথা শুনল না হাঁচি।
প্রচণ্ড জোরে হ্যাঁচ্চোহ করে উঠল সে।
.
১৯.
ওর হাঁচির শব্দ মিলাতে না মিলাতেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠল কয়েকজন। তারপর বাগত চিৎকার-চেঁচামেচি।
বেরিয়ে পালানোর সময় নেই আর। একাধিক পায়ের শব্দ ছুটে আসতে শোনা গেল।
অনেকগুলো হাত একসঙ্গে ঢুকে গেল খড়ের গাদায়। পা চেপে ধরে টেনে টেনে বের করে ফেলল কিশোরকে।
বিজাতীয় একটা ভাষায় অনর্গল কথা বলছে লোকগুলো, যার একটা বর্ণও বুঝতে পারল না সে। রবিন আর মুসাকেও বের করে ওরা আছড়ে ফেলল খড়ের গাদার নিচের শক্ত মাটিতে।
দ্রুত তিনজনকে ঘিরে ফেলল ওরা। কম করে হলেও ডজনখানেক বামন হবে। তীক্ষ্ণধার বল্লমের ফলা তিনজনের গায়ের কাছে কয়েক ইঞ্চি দূরে এসে থেমে গেল। নড়াচড়া করলেই দেবে ঘ্যাঁচ করে বিঁধিয়ে। ওদের চেহারায় প্রচণ্ড রাগ।
বুক চুলকাল কিশোর। শার্টের নিচ থেকে একটা পোকা বের করে এনে ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে।
পাগলের মত চুলকে চলেছে রবিন আর মুসা। পোকা ফেলছে গা থেকে। দুনিয়ার আর কোনদিকে খেয়াল নেই যেন।
রবিনের চুলে চার-পাঁচটা পোকা ঘুরে বেড়াতে দেখে থাবা দিয়ে ফেলে দিল কিশোর।
অবশেষে, ফিরে তাকাল খুদে মানুষগুলোর দিকে, ওদের যারা বন্দি করেছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কেউ ইংরেজি জানো?
কলরব বন্ধ হয়ে গেল ওদের। ওদের এলোমেলো, জট বেঁধে যাওয়া লম্বা চুলের নিচের চোখ দুটো পাতা সরু করে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দার দিকে। আরও সতর্ক ভঙ্গিতে চেপে ধরল হাতের বল্লমগুলো।
ইংরেজি? লোকগুলোর ওপর দৃষ্টি ঘুরাতে থাকল কিশোর। জানো কেউ?
কৌতূহলী হয়ে গোয়েন্দাদের দিকে তাকিয়ে রইল লোকগুলো। যেন কল্পনাই করতে পারেনি বন্দিরা কথা বলতে পারে।
চলো যাই! মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠল মুসা। এখানে আমরা থাকব কিসের জন্যে?
নীরবতা।
লোকগুলোর বল্লমের ফলা আরও এগিয়ে এল দুএক ইঞ্চি। ওদের ঘিরে থাকা চক্রটা আরও ছোট হয়ে এল।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল মুসা, কিশোর আর রবিন।
খুদে লোকগুলোর মাথার ওপর দিয়ে চক্রটার বাইরে তাকাল কিশোর। পালানোর পথ খুঁজছে তার চোখ। লোকগুলোর ওপাশে সমতল মাঠ ছাড়া আর রয়েছে সারি সারি গোল কুড়ে। প্রতিটি কুঁড়ের সামনে জ্বলছে একটা করে ছোট অগ্নিকুণ্ড।
ঢোক গিলল সে। পালানোর পথ নেই। লুকানোর জায়গা চোখে পড়ল না।
পিঠে চোখা ফলার খোঁচা খেয়ে আউক করে উঠল সে।
লাফ দিয়ে সামনে এগোল।
ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করছে জেকিলেরা। পেছন থেকে বল্লম দিয়ে খোঁচা মারতে থাকল। নড়তে বলছে।
হাই! দাঁড়াও! চিৎকার করে উঠল কিশোর। কণ্ঠের আতঙ্ক চাপা দিতে পারল না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা আমাদের?
আবার ঘোৎ-ঘোৎ। রাগত হট্টগোল। চাপা গর্জন।
লাফ দিয়ে আগে বাড়তে গেল মুসা। বল্লমের জোরাল খোঁচা এসে লাগল পিঠে।
নাহ্, বাঁচার কোন আশা নেই! হাল ছেড়ে দিল রবিন। একমাত্র পথ, গায়েব হয়ে যাওয়া।
যেটা কোনমতেই হওয়া যাবে না, যোগ করল মুসা।
অতএব বাঁচাও যাবে না।
এটা কিন্তু খেলা নয়, কিশোর বলল। কঠোর বাস্তব।
মাঠের ওপর দিয়ে ওদেরকে হেঁটে যেতে বাধ্য করল জেকিলরা। নিচু একটা কুঁড়ের সামনে এনে দাঁড় করাল। অগ্নিকুণ্ডের কাছে। আগুনের নিচে কড়কড় করে। কয়লা পুড়ছে। জ্বলন্ত রুবির মত। জোরাল বাতাসের ঝাঁপটা লাগল। ফুঁসে উঠল আগুন। লেলিহান শিখা লাফ দিয়ে ছুটে এল গোয়েন্দাদের দিকে।
কি করবে ওরা আমাদের, বলো তো? করুণ চোখে কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। জীবন্ত কাবাব বানাবে?
কি জানি! নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর। জানি না। তবে একটা কথা বলতে পারি। শিকারকে না মেরে জ্যান্ত ছিঁড়ে খায় না কখনও জেকিলরা।
এ রকম একটা তথ্যও খুশি করতে পারল না মুসা বা রবিনকে। শিরশির করে কাঁপুনি বয়ে গেল কিশোরের সারা দেহে। পা দুটো আর দেহের ভার রাখতে পারছে না।
ওদের মুখোমুখি বল্লম তুলে সারি দিয়ে দাঁড়াল জেকিলরা। আগুনের দিকে পেছন দিয়ে দাঁড়াতে বাধ্য করল।
আমরা কোন ক্ষতি করতে আসিনি তোমাদের! চিৎকার করে বলল কিশোর। কোন ক্ষতি করব না।
আমাদের ছেড়ে দাও! রবিনের কণ্ঠে কান্নার সুর। আমরা এখানে থাকি না। বাস করি না। আমাদেরকে আটকে রাখার কোন অধিকার তোমাদের নেই।
ঘোৎ-ঘোৎ করে নিজেদের মধ্যে কি সব আলোচনা করতে লাগল কয়েকজন। গোয়েন্দাদের দিকে নজর নেই। বাকিরা সব বল্লম তাক করে কড়া নজর রাখল যেন কোনমতেই পালাতে না পারে বন্দিরা।
ছোট ছোট বামন, কিশোরের দিকে কাত হয়ে ফিসফিস করে বলল মুসা। ওদের এত ভয় পাচ্ছি কেন আমরা? ছুটে পালালেই তো পারি।
মাথা নাড়ল কিশোর। উঁহু। খবরদার। সেই চেষ্টাও কোরো না। দেখতে ছোট হলে কি হবে। ওদের গায়ে অমানুষিক জোর। তা ছাড়া হাতে বল্লম। সাংঘাতিক নিশানা। মিস করে না।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। তাহলে কি করব আমরা?
জবাব দেয়ার সুযোগই পেল না কিশোর। ঘষার শব্দ কানে এল। কাশি শোনা গেল। সাদা চামড়ার পোশাক পরা একটা জেকিল ছুটে বেরিয়ে এল কুঁড়ের নিচু দরজা দিয়ে।
ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। বোঝার চেষ্টা করছে, কি খবর নিয়ে আসছে লোকটা। গায়ের চামড়ার ফতুয়া আর পাজামা আগুনের আলোয় চকচক করছে। বাকি সবার মত কালো চুল নয় এর। ঝকড়া সোনালি চুলের বোঝা। চওড়া কপাল। জ্বলজ্বলে নীল চোখ।
মেহমান, অদ্ভুত রকম ভারী গলায় বলে উঠল আগন্তুক। মেহমান, আবার একই কণ্ঠে একই শব্দ উচ্চারণ করল লোকটা।
আপনি…আপনি ইংরেজি জানেন? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা ঝাঁকাল লোকটা। জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কিশোরের দিকে। তোমাকে দেখে তো নাইট বলে মনে হচ্ছে না, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল সে। ক্রেলের মতও লাগছে না।
তিন গোয়েন্দার দিকে এগিয়ে এল লোকটা। সরে নেতাকে জায়গা করে দিল দুজন জেকিল। তোমরা কি পথ? নাকি জাদুকর?
আগুনের আলো খেলা করছে তার দুচোখে। দুই হাত কোমরে রেখে তাকিয়ে আছে সে। জবাবের অপেক্ষা করছে।
আমরা…আমরা অতি সাধারণ মানুষ, জবাব দিল কিশোর।
চোখের পাতা সরু করে চোখ প্রায় আধবোজা করে তাকাল লোকটা। সাধারণ মানুষ! তোমরা কি শক্তিশালী?
না! চিৎকার করে উঠল রবিন। আমাদের কোন ক্ষমতাই নেই। আমাদের যেতে দিন। প্লীজ!
আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি, শান্তকণ্ঠে লোকটাকে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোর। আমরা সৈনিক নই। আমরা…আমরা ছাত্র। আমরা ছেলেমানুষ।
মসৃণ চোয়াল ডলল লোকটা। তাহলে ছেলেমানুষ-ছাত্র তোমরা এলে কেন এখানে?
এক দুষ্ট জাদুকর আমাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছে এখানে, জবাব দিল কিশোর। আমরা ইচ্ছে করে আসিনি…
জাদুকর শুনেই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল জেকিলরা। বল্লম তুলে নাচাতে শুরু করল।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওদের নেতার। জাদুকরে পাঠিয়েছে? তারমানে তোমরাও জাদুকর।
না! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। আমাদের কোন ক্ষমতা নেই। কোন ক্ষমতাই নেই। যা ঘটেছে, পুরোটাই একটা ভুলের কারণে। ভুল বোঝাবুঝির কারণে।
এক এক করে তিন গোয়েন্দার মুখের দিকে তাকাতে থাকল লোকটা। বিড়বিড় করে বলল, তাই না? বেশ, দেখা যাক।
দলের লোকের দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠে কি আদেশ দিল নেতা। সঙ্গে সঙ্গে দুজন জেকিল দৌড় দিল একটা কুঁড়ে ঘরের দিকে। ভেতরে ঢুকে গেল।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বেরিয়ে এল সে। একজনের হাতে একটা রূপার বড় পানপাত্র। দুই হাতে শক্ত করে ধরে আছে সেটা। যেন মহামূল্যবান বস্তু রয়েছে ভেতরে।
লোকটা কাছে এলে পাত্রটা তার হাত থেকে নিয়ে নিল নেতা। তিন গোয়েন্দার সামনে নিচু করল, যাতে ভেতরে কি আছে দেখতে পায় ওরা। রূপার পাত্রে কালচে রঙের কি যেন রয়েছে। পাক খাচ্ছে। বুদবুদ উঠছে। ফোঁটার সময় হয়েছে তরল পদার্থটার।
এঁহ! একবার তাকিয়েই মুখ চোখ বিকৃত করে ফেলল কিশোর। পচা মাংসের গন্ধ বেরোচ্ছে জিনিসটা থেকে।
নাও, এটা তোমাকে খেতে হবে, পাত্রটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিল নেতা।
উঁহু! খেতে পারব না! পেটের মধ্যে গোলানো শুরু হয়ে গেছে তার। দুই হাতে নাক টিপে ধরে রাখল।
তারপরেও কি করে যেন নাকে ঢুকে যাচ্ছে ভয়ানক দুর্গন্ধ। এত খারাপ গন্ধের কথা কল্পনাই করা যায় না। পচা মাংস, পচা মাছ আর খটাশের গন্ধ একসঙ্গে করলে যা হয়, তা-ই হয়েছে।
ঘন কালো তরল পদার্থ পাত্রের কিনার বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
খাও খাও, জলদি খাও, ধমকে উঠল জেকিল-নেতা। তাড়াহুড়া করে গিলতে পারলে আর অত খারাপ লাগবে না।
কিন্তু…জিনিসটা কি? নাক থেকে হাত না সরিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর। বিকৃত শোনাল কথাটা।
বিষ, অকপটে জবাব দিল লোকটা। মারাত্মক বিষ।
দম আটকে ফেলল কিশোর। কিন্তু কেন?
এটা আমাদের সত্য-পরীক্ষা, বুঝিয়ে দিল লোকটা। এটা খাওয়ার পরেও যদি তুমি বেঁচে থাকো, তাহলে বুঝতে হবে তুমি সত্যি কথা বলছ।
ফুটতে থাকা কালো তরলটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কিন্তু, চিৎকার করে উঠল সে, কেউ কি এ জিনিস খেয়ে বাঁচতে পেরেছে?
মাথা নাড়ল লোকটা। না। এখনও কেউ পারেনি।
কতক্ষণ আর নাক ধরে থাকা যায়। হাত সরালেই দুর্গন্ধে পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠছে। বমি আসতে চাইছে। এত ভয়াবহ দুর্গন্ধ, শুধু গন্ধেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে সে।
খাও, আদেশ দিল আবার নেতা। সত্য-পরীক্ষা তোমাকে খেতেই হবে। নাও, ধরো। খাও।
এক হাতে ওর মাথা চেপে ধরল লোকটা। অন্য হাতে পাত্রটা চেপে ধরল। ঠোঁটের সঙ্গে।
.
২০.
গরম, আলকাতরার মত ঘন তরলের স্পর্শ পেল মুখের বাইরে কিশোর।
দুর্গন্ধে ভরা বাষ্প আটকে যাচ্ছে সারা মুখে।
কানফাটা একটা গর্জন কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিল হঠাৎ।
পাত্রটা জেকিলের হাত থেকে পড়ে গেল। ঘন তরল পদার্থ ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
আবার গর্জন। মাটি কেঁপে উঠল।
পিছিয়ে গেল জেকিল-নেতা। বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।
ভুলে জিভ দিয়ে চেটে ঠোঁট পরিষ্কার করতে গেল কিশোর। জিভে লাগল। বিষের স্বাদ।
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল।
কিন্তু সব কিছু ভুলে গেল বিশাল ড্রাগনটাকে দেখে।
আবার গর্জন।
আরেকটা ড্রাগন দেখা গেল। শরীর দোলাতে দোলাতে দৌড়ে আসছে ঘাসে ঢাকা মাঠের ওপর দিয়ে। তারপর আরও একটা ড্রাগনকে দেখা গেল।
ড্রাগনে সওয়ার আরোহীদেরকেও চোখে পড়ল তার। ড্রাগনের লম্বা, ওপরের দিকে বাঁকানো ঘাড়ে বসে আছে সারা দেহ বর্মে আবৃত যোদ্ধারা। ড্রাগনের পিঠের কাঁটা ওদের বিশেষ অসুবিধে করছে বলে মনে হচ্ছে না।
ওরা নাইট। হাতের তরোয়াল আর ঢাল আগুনের আলোয় চকচক করছে।
ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করছে ড্রাগনগুলো। খুলছে আর বন্ধ করছে ধারাল দাঁতওয়ালা চোয়াল। মাড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল খড়ের গাদা। নেতার কুঁড়ের দিকে দৌড়ে গেল একটা ড্রাগন। ম্যাচ বাক্সের মত ভর্তা করে ফেলল ওটাকে।
হেলমেট আর বর্ম পরা ড্রাগনের লম্বা ঘাড়ে ঝুলে থেকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিচের দিকে। তরোয়াল ঘুরিয়ে কোপ মারছে হতবাক জেকিলদের।
হট্টগোল আর আর্তনাদে ভরে গেল মাঠটা। উল্লসিত নাইটদের যুদ্ধ চিৎকার। ড্রাগনের তীক্ষ্ণ, কর্কশ ডাক। আতঙ্কিত জেকিলদের গোঙানি আর আর্তনাদ।
শয়তান খুদে মানবের দল তাদের বল্লম ফেলে দিল দৌড়। ওদের নেতা পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে দলের লোকদের ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগল। ফিরে এসে যুদ্ধ চালাতে বলল।
হাসতে হাসতে মুসার বুকে অসততা ধাক্কা দিয়ে কিশোর বলল, বাপরে! কি একখান লড়াই। তোমার খেলা গেমটার মত।
এতে হাসির কি আছে বুঝতে পারল না মুসা। বলল, চলো, সময় থাকতে পালাই!
উল্টো দিকে ঘুরে দৌড়ানো শুরু করল গোয়েন্দারা। সরে যেতে লাগল জেকিল, নাইট আর তাদের ড্রাগনদের কাছ থেকে। জেকিলদের অগ্নিকুণ্ড আর কুঁড়ের কাছ থেকে।
নরম মাটিতে ব্যাপ থ্যাপ পায়ের শব্দ হতে লাগল ওদের। প্রাণপণে ছুটছে। ঘাস বন পেরিয়ে চওড়া একটা মেটে ঢেলার খেত সেটার ওপর দিয়ে ছুটল। যুদ্ধ থেকে দূরে। শয়তান জেকিলদের কাছ থেকে দূরে।
জোরে জোরে হাঁপাতে হাঁপাতে বুকের মধ্যে ব্যথা শুরু হয়েছে কিশোরের। ফিরে তাকাল সে।
কুঁড়েগুলো এখন জ্বলছে। কমলা আগুনের লকলকে শিখা উঠে যাচ্ছে। আকাশপানে। রাতের বেগুনী আকৗশ। মনে হচ্ছে ঘাসে ঢাকা সমস্ত সমভূমিটাতেই আগুন ধরে গেছে। দাবানলের মত।
জেকিলেরা সব গায়েব। ড্রাগনের পিঠে চড়ে মাঠময় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। নাইটেরা। উল্লাসে মাথার ওপর তরোয়াল উঁচু করে ধরে নাচাচ্ছে আর চিৎকার করছে।
ছুটতে থাকো, কিশোর বলল তার দুই সঙ্গীকে। ছুটতে ছুটতেই শার্টের হাতা গুটিয়ে নিল। থেমো না। এই নাইটগুলোকেও বিশ্বাস নেই। ওরাও আমাদের শত্রু।
আমাদের দেখে ফেললেই এখন সর্বনাশ, রবিন বলল। তেড়ে আসবে। ড্রাগনের সঙ্গে দৌড়ে পারব না আমরা।
ধরা পড়লে কাম শেষ, মুসা বলল।
আবার ফিরে তাকাল কিশোর। জ্বলন্ত কুঁড়ের আগুনের আলোয় এখনও উল্লাস করতে দেখা যাচ্ছে ড্রাগনারোহী নাইটদের। বিজয়ের আনন্দে মেতে আছে।
লড়াইটা মোটেও ন্যায্য হলো না, মুসা বলল। আমি বলতে চাইছি, একটা অসম লড়াই হলো। বড় বড় টানে তাজা ঠাণ্ডা বাতাস যেন বুক ভরে গিলে নিল মুসা।
মরুক না ব্যাটারা, ক্ষোভ চাপা দিতে পারল না কিশোর। তাতে আমাদের কি? আমাদের তো বিষ খেতে বাধ্য করছিল ওরা।
মনে করতেই পচা দুর্গন্ধটা যেন নাকে এসে লাগল কিশোরের।
ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিল আবার।
কাছিমের পিঠের মত বাঁকা হয়ে নেমে গেছে এখানে সমভূমিটা।
নিচে জঙ্গল। ওখানে আবার কোন ভয়ঙ্কর প্রাণীরা লুকিয়ে আছে কে জানে! কিন্তু ড্রাগন আর নাইটদের হাত থেকে পালাতে হলে এখন ওদিকেই যেতে হবে। আর কোন পথ নেই।
নেমে চলল ওরা।
আচ্ছা, কোথায় রয়েছি আমরা, বলো তো? চলতে চলতে রবিন বলল। কোন জায়গায়? কি ভাবে ঘটল এ সব? আমাদের বাড়িঘরগুলোই বা কোথায়?
কিশোর বা মুসা কথা বলার আগেই ভারী পায়ের শব্দ হলো।
পায়ের চাপে মাটি কাঁপছে।
গুম! গুম! গুম! গুম!
রবিনের হাত ধরে টান মারল কিশোর। ডাগন আসছে! জলদি পালাও!
গুম! গুম! গুম! গুম!
চাঁদের আলোয় দেখা গেল ড্রাগনটাকে। ওপরে কাছিমের পিঠের মত বাকা। জায়গাটার কিনার ধরে চলেছে। হাটার তালে তালে দুলছে বিশাল বপু। ডানা। দুটো কাঁটা বসানো কাঁধের কাছে আধখোলা, উঁচু করে রেখেছে।
ছোট ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে রইল ওরা।
লম্বা, বৰ্ম বসানো গলাটা বাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে ড্রাগনটা। চোয়াল বন্ধ। হাঁটার সময় ওপরে নিচে দুলছে মস্ত মাথাটা। ওটার ঘাড়ে কোন নাইটকে দেখা গেল না।
কিশোরের হাত ধরে চাপ দিল রবিন। মুসা তার গা ঘেঁষে রয়েছে। নীরবে ড্রাগনটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিনজনে। বুক কাঁপছে। সবার মনে একই প্রশ্ন।
ড্রাগনটা কি দেখে ফেলেছে ওদের?
গন্ধ পেয়েছে?
খুঁজছে ওদেরকে?
না। একই ভঙ্গিতে হেঁটে সরে যেতে লাগল ওটা। এক সময় চাঁদের আলো থেকে মুছে গেল। হারিয়ে গেল অন্ধকার দিগন্তে।
পুরো একটা মিনিট আরও চুপচাপ বসে রইল ওরা। বুকের কাপুনি কমার অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর নীরবতা ভাঙল কিশোর। ফিসফিস করে বলল, ওটা বুনো। নাইটদের হাতে পড়েনি এখনও। পোষ মানানো হয়নি।
কিন্তু আমরা আছি কোথায়? একটু আগে রবিনের করা প্রশ্নটাই মুসাও করল। দুঃস্বপ্নে?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। আমরা রয়েছি তাসের জগতে। তাসের খেলায়। আমাদের চরিত্র বানিয়ে খেলছে জাদুকর।
কাকু-কাকু তারমানে সত্যিই জাদুকর, মুসা বলল।
তাতে আর কোন সন্দেহ আছে এখন?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মুসা বলল, কিন্তু আমরা এখন কি করব? আমাদের বাড়ি ফিরে যাবার উপায় কি? আলীবাবার পাহাড়ের গুহা খোলার মত কোন জাদুই শব্দ ব্যবহার করব নাকি? সিসেম ফাঁক! সিসেম ফাঁক!
সিসেম ফাঁক! মুসার দিকে তাকাল কিলোর। চিন্তিত মনে হচ্ছে ওকে। উঁহু। ওরকম মন্ত্রে কাজ হবে না…
তাহলে কিসে হবে? অস্থির হয়ে উঠেছে মুসা। কিশোর, কিছু একটা করো। ইস, কোন কুক্ষণে যে সেদিন কাকু-কাকুর বাড়িতে জিনিস বিক্রি করা দেখতে গিয়েছিলাম…
ফিরে যেতে হলে আবার তাসগুলো প্রয়োজন হবে আমাদের, মুসার কথায় কান নেই কিশোরের। ওগুলো সব একসাথে করে বাক্সে ঢুকিয়ে দিতে পারলেই আবার তাসের জগৎ থেকে বেরিয়ে যাব আমরা।
কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে তাসগুলো? মুসার প্রশ্ন।
চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে ঘাসের মাঠটা। বাতাস বাড়ছে। ঠাণ্ডা। ভেজা ভেজা।
জাদুকরের বাড়ির মেঝেতে নিশ্চয় পড়ে আছে এখন, শুকনো কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর।
দমে গেল মুসা। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাহলে আর পাব কি করে?
চলো, হাটা শুরু করি, রবিন বলল। কোন না কোন শহর পেয়েই যাব। কোথাও না কোথাও একটা ফোনও পাওয়া যাবে।
রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। ব্যাপারটা দেখছি এখনও পুরোপুরি বোধের মধ্যেই যায়নি তোমাদের। ফোন নেই এখানে। শহরও পাবে না। মধ্যযুগীয় কোন একটা সময়ে প্রবেশ করেছি আমরা। কিংবা রূপকথার জগতে। যেখানে ড্রাগন, নাইট আর এলফের মত প্রাণীদের রাজত্ব।
চাঁদের আলোয় মুসা আর রবিন দুজনের চোখেই অস্বস্তি দেখতে পেল সে।
তবে, কিশোর বলল, এ থেকে বেরোতে আমাদের হবেই। কোন না কোন উপায় একটা বের করতে হবে। তাসের এই গেমের মধ্যে থেকে গেলে মৃত্যু অবধারিত।
কিন্তু সেই উপায়টা কি? মুসা বলল, এখানে এ ভাবে বসে বসে ভাবতে থাকলেই কি চলবে? বাড়ি আর কোনদিন পৌঁছানো হবে না তাহলে।
তা বটে, উঠে দাঁড়াল কিলোর। ঠাণ্ডা বাতাসে গায়ে কাঁটা দিল তার। মাটিতে কাঁপুনি তুলে থপ্ থপ্ করে হেঁটে যাওয়া ড্রাগনটার কথা ভাবল সে। কেঁপে উঠল আরেকবার।
একটাকে যখন দেখলাম, নিশ্চয় বুনো ড্রাগন আরও আছে। রাতের বেলা এ পথে চলাফেরা করে ওরা।
কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না, বুনো এই দৈত্যগুলোকে পোষ মানাল কি করে নাইটেরা? রবিনের প্রশ্ন।
হাতিকে ধরে আমরাও তো পোষ মানাই, জবাব দিল কিশোর। নিশ্চয় আছে কোন কায়দা।
নিচের উপত্যকার বনটার দিকে তাকাল সে। বনেই ঢুকে পড়ব না-কি? নিজেকেই প্রশ্ন করল যেন। হয়তো বনের মধ্যেটা এখানকার চেয়ে নিরাপদ। হয়তো রাস্তাটাস্তাও পেয়ে যেতে পারি। তাহলে লোকালয়ে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে। স্বাভাবিক মানুষদের গ্রামে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। কিছু বলল না। মুসা চুপ করে রইল।
হাঁটতে শুরু করল ওরা। আগে আগে চলেছে কিশোর।
ঢুকে পড়ল বনের মধ্যে। পায়ের নিচের মাটি এত নরম, জুতো দেবে যায়। পিছলে যায়। দ্রুত এগোনো তাই কঠিন।
থামল না ওরা। এগিয়ে চলল।
কয়েক মিনিট হাঁটার পর মাটিতে কিসের ওপর যেন পা পড়ল মুসার। নিচে তাকাল। গাছের ডালের মত কি যেন।
মট করে কিছু একটা ভাঙল।
গাছের ওপর থেকে নেমে এল ভারী একটা জাল। মাথার ওপর পড়ল তিনজনের।
ফাঁদ! ফাঁদ! চিৎকার করে উঠল কিশোর। ধরা পড়ে গেলাম আমরা।
.
২১.
এত ভারী জাল যে, ভারের চোটে বসে পড়তে হলো ওদের।
ধস্তাধস্তি করে গায়ের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা করল। দুই হাতে অনেক কষ্টে মাথার ওপর জালটা উঁচু করে ধরল মুসা। আবার উঠে দাঁড়াতে চাইল।
কিন্তু সাংঘাতিক মোটা দড়ি। খসখসে। ধারাল শন জাতীয় কোন কিছু দিয়ে তৈরি। হাতে কেটে বসে যায়। সুবিধে করতে পারল না সে।
তিনজনে মিলে নড়ানোর চেষ্টা করেও নড়াতে পারল না।
বাপরে বাপ! বলে উঠল মুসা। কি জিনিস দিয়ে তৈরি?
যেটা দিয়েই হোক, গুঙিয়ে উঠল রবিন। বেরোতে তো হবে আমাদের।
হ্যাঁ, চেষ্টা চালিয়ে যাও, কিশোর বলল। থেমো না।
কিন্তু বহু চেষ্টা করেও গায়ের ওপর থেকে জালটা ফেলতে পারল না ওরা। ভারী তো বটেই, তৈরিও করা হয়েছে এমন করে, যাতে নিচে পড়লে কোনমতেই ছুটতে না পারে শিকার। জালে আটকা পড়লে পাখির কেমন কষ্ট লাগে, হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল ওরা এখন।
এরপর কি ঘটবে?
ভয়ঙ্কর সব ভাবনা খেলে যাচ্ছে কিশোরের মগজে। এতই ভয়ানক, সেগুলো মুসা আর রবিনকে বলে ওদের ভয় পাওয়াতে ইচ্ছে করল না ওর।
যদি এমন হয়, জালটা পাতা হয়েছে বহুকাল আগে? কেউ আর এখন দেখতে আসে না জালে শিকার পড়ল কিনা, কি ঘটবে তাহলে?
কেউ ওদের উদ্ধার করতে আসবে না। এই জালের নিচে আটকা পড়ে থেকে খেতে পেয়ে তিলে তিলে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় মৃত্যু ঘটবে ওদের।
আর যদি নতুন পাতা হয়ে থাকে, কে পাতল? কি ধরার জন্যে পাতল? মানুষ?
জেকিলদের আচরণের কথা মনে করে গায়ে কাঁটা দিল ওর।
পায়ের শব্দ শোনা গেল। বনতলে বিছিয়ে থাকা পাতার পুরু আস্তরণের ওপর দিয়ে কে যেন হেঁটে আসছে। শুকনো পাতায় পা পড়ে মচমচ শব্দ হচ্ছে। বরফর মত জমে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকল ওরা।
আসছে কে যেন! ফিসফিস করে বলল কিশোর।
শত্রু না হলেই হয়, জবাব দিল মুসা।
অদ্ভুত একটা জন্তু এসে দাঁড়াল জালটার কাছে। পুরো চেহারাটা নজরে এল। আত্মা শুকিয়ে গেল তিন গোয়েন্দার।
পরনে রোমশ চামড়ার পোশাক। মানুষের মতই দুই পায়ে হাঁটে। কালো চুলের দুই পাশে শুয়োরের কানের মত দুটো কান। ডগাটা ছুঁচাল। ওপর দিকে তোলা। মানুষের চোখ। শুয়োরের নাক। প্রায়-ঠোঁটহীন-মুখের দুই কোণ থেকে বেরিয়ে আছে ওয়ালরাসের মত লম্বা দাঁত।
হাল্লো! খাতির করার চেষ্টা করল মুসা। জাল থেকে আমাদের ছুটাতে এসেছেন?
জালের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে জীবটা। লম্বা তিন আঙুলের ডগায়। বসানো জানোয়ারের মত বাকা নখ। লম্বা চুলের মধ্যে সেগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে মাথা চুলকাল।
হাল্লো! ইংরেজি জানেন আপনি? জিজ্ঞেস করল আবার মুসা।
জবাবে ঘোঁৎ-ঘোৎ করে উঠল জীবটা। শুয়োরের মতই। বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এল চাপা সে-শব্দ।
প্লীজ… বলতে গেল আবার মুসা।
কিন্তু তীক্ষ্ণ একটা লম্বিত হেউপ হেউপ হেউপ ডাকে থেমে গেল সে।
বনের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল চার পাওয়ালা ছোট একটা জানোয়ার। বড় জীবটার পাশে এসে দাঁড়াল। বন্দিদের দেখে উত্তেজিত হয়ে ডাকাডাকি করতে লাগল। জালের চারপাশ ঘিরে নেচে বেড়াতে লাগল। কালো কালো ছোট খুর দিয়ে খোঁচা মারছে জালের দড়িতে। পারলে ওপরে উঠে এসে বন্দিদের। গায়েই খোঁচা মারে।
জানোয়ারটা দেখতে অনেকটা ছোট জাতের কুকুরের মত। গায়ের চামড়া লোমহীন। মানুষের চামড়ার মত। তবে অনেক বেশি মসৃণ আর চকচকে। হলুদ রঙের। কুকুরের মতই হেক হেক করে ডাকছে। হাই তোলার ভঙ্গিতে হাঁ করে এক সময় দুই সারি চিকন ধারাল দাঁত দেখিয়ে দিল।
বড় জম্ভটা ঘোৎ-ঘোৎ করে ছোটটার মাথা চাপড়ে দিল। বোধহয় শান্ত হতে বলল। ছোট কুকুরের মত জন্তুটা চিৎকার থামিয়ে দিয়ে আদর পাওয়া বিড়ালের মত গরগর করতে লাগল।
জাল ধরে টানতে শুরু করল শুয়োর-মানব।
আমাদের ছেড়ে দিচ্ছে! খুশিতে চিৎকার করে উঠল মুসা।
কিন্তু ভুল করেছে সে।
বন্দিদের ছাড়ল না শুয়োর-মানব। বরং জালের মধ্যেই আটকে রেখে জাল। সহ ওদের টেনে নিয়ে চলল বনের মধ্যে দিয়ে।
কোনমতেই বেরোতে পারল না গোয়েন্দারা। সাংঘাতিক শক্তি জটার গায়ে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে অবলীলায় টেনে নিয়ে চলল তিন তিনজন মানুষ সহ এ রকম একটা ভারী জাল। অসহায় হয়ে জালের মধ্যে চিত হয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
শিকার ধরা পড়লে কুকুর যা করে, ঠিক সে-রকমই করতে লাগল ছোট আকারের কুকুরে-শুয়োর কিংবা শুয়োরে-কুকুরটা। চিৎকার-চেঁচামেচি, হাঁক-ডাক লাফালাফি সবই করছে। একবার ছুটে সামনে চলে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে। জাল ঘিরে চক্কর দিতে দিতে নাচানাচি করছে।
চলার সময় ক্রমাগত ঘোৎ-ঘোৎ করছে শুয়োর-মানব। তার ওয়ালরাস দাঁতের গা বেয়ে জানোনায়ারের মত লালা গড়াচ্ছে। লম্বা নীল জিভ বের করে জানোয়ারের মতই চেটে নিচ্ছে সেগুলো।
জালের মধ্যে বড়ই কষ্ট হচ্ছে গোয়েন্দাদের। চিত হয়ে থেকেও আরাম পাচ্ছে না। টানার সময় প্রচণ্ড ঝাঁকি লাগছে। গায়ে গায়ে বাড়ি খাচ্ছে। ব্যথা লাগছে রীতিমত।
অবশেষে থামল জন্তুটা। জাল টানা বন্ধ হলো।
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। হাঁটু ডলছে মুসা। নীরবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে রবিন।
জম্ভটা কোথায় নিয়ে এল ওদের?
লম্বা, নিচু, ধূসর রঙের একটা পাথরের বাড়ি দেখা গেল। এক মাথায় একটা দরজা। জানালা-টানালা নেই।
শুয়োর-মানবের বাড়ি?
জোরাল ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে, লম্বা দাঁত চাটতে চাটতে, বড় বাড়িটার পাশের ছোট একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেল জটা। সামনের একটা পাথরের দরজা খুলল।
সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে বেরিয়ে এল আগুনের শিখা।
একটা বেলচা তুলে নিল জটা। আগুনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। খোঁচানো শুরু করল। তারপর আরও কিছু কয়লা ফেলল আগুনে।
কিশোর, ওটা কি? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।
ঢোক গিলল কিশোর। চুলাই তো মনে হচ্ছে।
খাইছে! চমকে গেল মুসা। ওর মধ্যে ফেলে কাবাব বানাবে আমাদের? এ তো রাক্ষস মনে হচ্ছে! রূপকথার রাক্ষস!
জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে জন্তুটার দিকে। ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে দাঁত চাটছে। চুলার কয়লা খুঁচিয়েই চলেছে। পাগল হয়ে যেন লাফালাফি করছে আগুনের শিখা।
কি করব আমরা, কিশোর? প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে রবিন। কোন একটা বুদ্ধি বের করো। জলদি! পারবে বের করতে?
আবার ঢোক গিলল কিশোর।
নাহ, শুকনো স্বরে জবাব দিল সে। কোন বুদ্ধিই আসছে না মাথায়।
.
২২.
চুলায় আরও দুতিন বেলচা কয়লা ফেলল রাক্ষসটা। লাল টকটকে কয়লার তাপ বাইরে বেরিয়ে আসতে লাগল। তারপর সন্তুষ্ট হয়ে বেলচাটা ছুঁড়ে ফেলল একদিকে। গোয়েন্দাদের দিকে ফিরে থপথপ করে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
ওর শুয়োরের মত মুখে ক্ষুধার্ত হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। হলুদ রঙের কুকুরের মত প্রাণীটাও উত্তেজিত ভঙ্গির্কে হাঁপাচ্ছে। রাক্ষসটাকে ঘিরে চক্কর দিতে দিতে এগোতে লাগল জালের দিকে।
চাঁদি দপদপ করছে কিশোরের। বুকের মধ্যে ধুড়স ধুড়স করছে হৃৎপিণ্ডটা। হাজার রকম ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে মগজে। মরিয়া হয়ে বাঁচার উপায় খুঁজছে।
জালটা এখন তুলবে, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ভোলার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় মারবে। একসঙ্গে তিনজনকে ধরতে পারবে না রাক্ষসটা।
কিন্তু ভুল করেছে কিশোর। জন্তুটাকে এতটা বোকা ভাবা ঠিক হয়নি। জাল থেকে ওদের বের করল না সে। জাল সহই ওদের নিয়ে চলল চুলার কাছে। প্রচণ্ড আগুনের হলকা এসে লাগল চোখে মুখে। পুড়ে যাবে মনে হলো চামড়া। আগুনের তপ্ত উজ্জ্বলতা সইতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল কিশোর।
টের পেল ধীরে ধীরে মাথার ওপর থেকে সরে যাচ্ছে জাল। চোখ মেলল সে। প্রায় বেরিয়ে পড়েছে রবিন আর মুসা। আরেকটু সরল জাল। কিশোরও বেরিয়ে পড়ল। খপ করে ওকে আর মুসাকে চেপে ধরল রাক্ষসটা। ভাবল বোধহয়, সবচেয়ে বড় শরীরের দুটোকেই আটকে রাখবে। অন্যটা পালালে পালাক।
ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করতে লাগল মুসা। কিন্তু সাংঘাতিক শক্তিশালী রাক্ষসের হাত থেকে মুক্ত করতে পারল না নিজেকে।
না না, প্লীজ! চেঁচানো শুরু করল মুসা। দোহাই তোমার, শুয়োর-রাক্ষস, আমাদের ছেড়ে দাও। আমাদের মাংস ভাল না। মোটেও পছন্দ হবে না তোমার।
হ্যাঁচকা টান মেরে চুলার আরও কাছে ওদেরকে নিয়ে গেল রাক্ষসটা।
থামো! থামো! চেঁচিয়েই চলেছে মুসা।
জবাবে ঘোঁৎ-ঘোৎ করতে লাগল রাক্ষসটা। শুয়োরের চেহারার মুখটায় কোন রকম আবেগ লক্ষ করা গেল না।
চুলার মুখ দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বেরোচ্ছে আগুনের শিখা। চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে আঁচ। তবে রাক্ষসটার কিছু হচ্ছে বলে মনে হলো না।
অবলীলায় দুই হাতে দুজনকে ধরে উঁচু করে ফেলল রাক্ষসটা। নিয়ে চলল চুলার মুখের কাছে।
প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে নাচানাচি ও চিৎকারের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে কুকুরে প্রাণীটা। একবার আগে যাচ্ছে, একবার পেছনে, আবার আগে।
পেছন থেকে হঠাৎ কুঁই কুঁই করে উঠল ওটা। স্বর বদলে গেছে। ভীত কণ্ঠস্বর।
রাক্ষসের হাতে ঝুলতে ঝুলতেই ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে তাকাল কিশোর। দেখল, ঘাড় ধরে কুকুরটাকে উঁচু করে ফেলেছে রবিন। সোজা নিয়ে গেলে চুলার মুখের কাছে। আগুনে ফেলে দেয়ার ভঙ্গি করল।
থমকে গেল রাক্ষসটা। গোটা দুই খাটোমত ঘোঁৎ-ঘোতানি বেরোল মুখ দিয়ে।
প্রথমে কিশোরকে মাটিতে নামাল রাক্ষসটা। তারপর মুসাকেও নামাল। কিন্তু হাত ছাড়ল না।
উত্তেজনা চলে গেছে কুকুরটার। আতঙ্কে কো-কোঁ করছে। বুঝে গেছে রবিনের উদ্দেশ্য।
ছাড়ো ওদের, রাক্ষস কোথাকার! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। নইলে দিলাম এটাকে আগুনে ফেলে!
দাঁড়িয়েই রইল রাক্ষসটা। ইতস্তত করছে।
ওর দুর্বলতাটা বুঝে গিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল রবিন, ছাড়লে না এখনও! কুকুরটাকে চুলার একেবারে মুখের কাছে নিয়ে গেল সে। তার নিজের দেহেও যে ভয়াবহ আঁচ লাগছে, কেয়ারই করল না সেটাকে।
আতঙ্কে ত্রাহি চিৎকার শুরু করেছে কুকুরটা। খানিক আগে মুসা যে ভাবে শরীর মুচড়ে রাক্ষসের হাত থেকে ছুটতে চাইছিল, কুকুরটা করছে এখন সেরকম।
ভাল চাও তো ছাড়ো! চিৎকার করে উঠল রবিন।
রাক্ষসটা ওর ভাষা বুঝল কিনা বোঝা গেল না। তবে উদ্দেশ্য বুঝতে পারল। অবশেষে ছেড়ে দিল কিশোর আর মুসাকে। ওর কালো চোখে ভয় মেশানো আক্রোশ।
সরো এখন! বলার সঙ্গে হাত দিয়েও ইশারা করল রবিন। কুকুরটাকে ধরে রেখেছে চুলার মুখের কাছে।
বোঝা গেল, খাবারের চেয়ে কুকুরটার প্রাণ রাক্ষসটার কাছে বেশি প্রিয়। পিছিয়ে যেতে শুরু করল সে।
কিশোর, দৌড় মারো! রবিন বলল। কুকুরটাকে আগুনে ফেলে দেয়ার ভয়ে আমাদের কিছু করবে না সে।
দ্বিধা করছে কিশোর।
দেরি করছ কেন? যাও। কুকুরটাকে ছাড়ব না আমি, যতক্ষণ না নিরাপদ হতে পারছি।…দৌড়াও।
আর দেরি করল না কিশোর। মুসাকে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। হতাশ ভঙ্গিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে রাক্ষসটা।
কুকুরটাকে শক্ত হাতে বুকের সঙ্গে চপে ধরল রবিন। রাক্ষসটাকে হুমকি দিল, নড়বে না, খবরদার! নড়লেই আগুনে ফেশ্ব! যা বলল, সেটা ইশারাতে বুঝিয়ে দিল সে।
নড়ল না রাক্ষসটা। জোরে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। পরাজিত ভঙ্গিতে ঝুলে পড়ল তাঁর কাঁধ।
পিছাতে শুরু করল রবিন। সরে যেতে লাগল চুলার কাছ থেকে।
এগিয়ে আসার জন্যে পা বাড়াতে গেল রাক্ষসটা।
সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটার গলায় হাত রেখে গলা টিপে মারার ভয় দেখাল রবিন। থেমে গেল রাক্ষসটা।
কুকুরটাকে নিয়েই দৌড় মারল রবিন। বনের কিনারে এসে ফিরে তাকিয়ে দেখল, অসহায় ভঙ্গিতে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে রাক্ষসটা। পোষা। প্রাণীটাকে সাংঘাতিক ভালবাসে সে। ক্ষতির আশংকায় সামান্যতম নড়াচড়া করছে না।
বনের কিনারে এনে কুকুরটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখল রবিন। তারপর এক ছুটে ঢুকে গেল বনের মধ্যে। কিশোর আর মুসাকে দেখতে পেল। তার জন্যেই অপেক্ষা করছে।
রবিনকে দেখার পর একটা সেকেন্ডও আর দেরি করল না ওরা। ছুটতে শুরু করল বনের মধ্যে দিয়ে।
পেছন ফিরে তাকাল না আর কেউ। রাক্ষসটা আসছে কিনা, সেটাও দেখতে চাইল না। এত জোরে জীবনে দৌড়ায়নি ওরা।
ছুটতে ছুটতে দম আটকে আসতে চাইল ওদের। পা ব্যথা করছে। দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে। কিন্তু তার পরেও থামল না। ছোটা…ছোটা..ছোটা…
বনের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা। সামনে পাহাড়ের ঢাল। ঢালে জন্মে আছে ভুট্টা গাছের মত এক ধরনের গাছ। চাঁদের আলোয় বেড়ার মত লাগছে সামনের সারির গাছগুলোকে।
ওর মধ্যে লুকাতে পারব আমরা! আশা হলো রবিনের।
মাথা নিচু করে প্রায় ডাইভ দিয়ে গাছগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ল ওরা। শুকনো খড়খড়ে গাছ। কখনও দুহাতে ফাঁক করে, কখনও কাধ দিয়ে ঠেলা মেরে সরিয়ে সরিয়ে এগিয়ে চলল। শুকনো পাতা জুতোর চাপে মচমচ করছে।
গাছগুলো অনেক উঁচু। মাথা ঢেকে দিচ্ছে। তবে খচমচ, খসখস নানা রকম শব্দ করেই চলেছে। এগোনোর সময় ঠেলা লেগে বাঁকা হয়ে গিয়ে আগা নুইয়ে ফেলছে।
মিনিটখানেক পর থেমে গেল কিশোর। এত জোরে হাঁপাচ্ছে, দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। দম নেয়ার জন্যে।
চারপাশে লম্বা গাছগুলো বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। পাতা খসখস করছে।
এখানে আমরা নিরাপদ, মৃদু স্বরে বলল রবিন। অন্তত কিছুক্ষণের জন্যে হলেও। কি বলো, কিশোর?
হ্যাঁ, ফোঁস ফোঁস করে হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল কিশোর। কেউ আমাদের দেখতে পাবে না।
কিন্তু এত লম্বা ভুট্টা গাছ আমি আর দেখিনি, মুসা বলল। এত মোটা আর…
কথা শেষ না করেই থেমে গেল সৈ। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ওর সামনের একটা গাছের বাকল খুলে যেতে শুরু করেছে।
দ্রুত নড়াচড়া চোখে পড়ল তার।
একটা হাত!
বাকলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা লিকলিকে হাত। কার্টুন ছবির মত।
আশপাশের অন্য গাছগুলোও খড়মড় কাঁচক্যাঁচ করে বিচিত্র শব্দ করছে। জ্যান্ত প্রাণীর মত দুলতে শুরু করেছে।
তারপর সেগুলোরও বাকল খুলে যেতে লাগল। লম্বা কাঠির মত চকচকে মসৃণ দেহগুলো বেরোতে থাকল গাছের ভেতর থেকে।
ডজন ডজন সরু সরু নীরব প্রাণী। সবুজ মসৃণ মাথা। কোন চেহারা নেই। মুখ নেই। পাতায় মোড়া সবুজ সবুজ মাথা। ভুট্টার মোচার মত।
ডজন ডজন!
ক্যাচক্যাচ শব্দ করে করে খুলতেই আছে গাছের দল। বেদম দুলছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে ভেতরের কাঠি-প্রাণীগুলো বেরিয়ে আসার সময়।
মসৃণ হাতগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে। রবারের মত লম্বা হচ্ছে। ওদেরকে পেঁচিয়ে ধরতে শুরু করল সে-সব হাত। শক্ত হতে লাগল চাপ…
শক্ত…
স্টেলক! আচমকা চিৎকার করে উঠল রবিন। তাসের গায়ে আঁকা দেখেছিল এগুলোর ছবি। তাসের পিঠে নাম লেখা ছিল।
আমি…আমি মনে করতে পারছি না, মুসা বলল। কথা বেরোতে চাইছে না ঠিকমত। গলা চিপে ধরা হয়েছে যেন তার।
কিশোরেরও বুক পেঁচিয়ে ধরছে হাতগুলো। জীবন্ত আঙুর লতার মত। গলা পেঁচাচ্ছে। শক্ত হচ্ছে চাপ।
দম নিতে পারছি না আমি… হাঁসফাঁস শুরু করল কিশোর। দম নিতে পারছি না…।
শরীর মুচড়ে মুচড়ে ছাড়ানোর চেষ্টা শুরু করল মুসা। লাথি মারতে লাগল।
কিন্তু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখল ওদেরকে অদ্ভুত প্রাণীগুলো।
অনেক বেশি। সংখ্যায় অনেক বেশি ওগুলো।
আরও, আরও গাছ খুলতেই আছে। শয়ে শয়ে! হাজারে হাজারে! বেরিয়ে আসছে একের পর এক লতানো কাঠি-প্রাণী, স্টেলক।
কি করব আমরা এখন? কোনমতে বলল রবিন। শ্বাস নিতে পারছে না। গলার মধ্যে ঘড়ঘড় আওয়াজ হচ্ছে। কি করব…!
ঝাড়া মারো! ঝাড়া মারো! চিৎকার করে বলল মুসা। ঝাড়া, খামচি, লাথি, চড়-থাপ্পড় যখন যেটা পারছে মেরে চলেছে সে। স্টেরা মাংসাশী, বুঝে গেছে সেটা। বেরোতে না পারলে শ্বাসরোধ করে মারবে ওদের।
বহু কষ্টে স্টেলকদের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করে ভুট্টা খেতের কিনারে বেরিয়ে এল ওরা। পাথরের মত স্থির হয়ে গেল মুহূর্তে।
সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা সেনাবাহিনী। ক্রেল। শত শত। ঘোড়ার পিঠে আসীন। কারও হাতে বল্লম। কারও তরোয়াল।
.
২৩.
সবার আগে নড়ে উঠল কিশোর। ঘুরে আবার দৌড় দিতে গেল ভুট্টা খেতের দিকে। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
চোখের পলকে ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল ডজনখানেক ক্রেল। সামনে এসে পথরোধ করে দাঁড়াল। তরোয়াল ধরল বুকের ওপর।
নাহ, আর পারা গেল না! হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল মুসা। কোন জাদুকরের বাপও এসে এখন আর বাঁচাতে পারবে না আমাদের!
একটা মাঠের ওপর দিয়ে ওদেরকে হটিয়ে নিয়ে চলল ক্রেলেরা। ডজনখানেক সৈন্য ঘিরে রেখে এগোচ্ছে। কারও হাতে তরোয়াল, কারও হাতে বল্লম। বাকি সৈন্যরা ঘোড়ার পিঠে চেপে পেছন পেছন আসছে।
ধূসর মেঘের চাদরের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ। আরও ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে রাতের বাতাস। আরও ভেজা। কাদামাটিতে পিছলে যাচ্ছে বন্দিদের জুতো।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে হেঁটেই চলল ওরা। পা আর চলছে না। গলার ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে নেমে ঢুকে যাচ্ছে চোখের ভেতর।
হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করল রবিন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওরা আমাদের? এবার কি করবে? কেটেকুটে শিক কাবাব বানাবে?
জানি না, জবাব দিতেও আর ইচ্ছে করছে না কিশোরের।
অনন্তকাল ধরে যেন কেবল হাঁটতেই থাকব আমরা! মুসা বলল।
শেষ হলো মাঠ। বনে ঢুকল ওরা। লতানো উদ্ভিদে ভরা ঘন জঙ্গল। কাঁটা। ঝোঁপেরও অভাব নেই। সরু, আঁকাবাকা একটা রাস্তা চলে গেছে কাঁটা ঝোঁপগুলোর মাঝখান দিয়ে। হাঁটতে গেলে খোঁচা লাগে। ওদেরকে সেই পথ ধরে হটতে বাধ্য করল ক্রেলেরা।
বন থেকে বেরোল এক সময়। সরু সেই পথ ধরে কাদায় ভরা একটা ঢালু জায়গা দিয়ে ওদের নিয়ে চলল ক্রেলেরা।
পেছন পেছন আসতে আসতে সুর করে গেয়ে উঠল, মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…
ঢোক গিলল কিশোর। পানির অভাবে খসখসে হয়ে যাওয়া কণ্ঠনালী ব্যথা করে উঠল। এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পিঠে এসে লাগল বল্লমের খোঁচা।
সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করেও আবার পা ফেলতে বাধ্য হলো সে।
মুক্তি নেই মুক্তি নেই..মুক্তি নেই… কুৎসিত সুরে জঘন্য গানটা গেয়েই চলল ক্রেলেরা। শুধু এই দুটো শব্দই।
উপত্যকা পেরিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে আবার ওপরে উঠতে শুরু করল ঢাল।
খাড়াই বেয়ে ঘুরে ঘুরে ওপরে উঠে অবশেষে চূড়ায় এসে শেষ হলো।
উঁচু চূড়াটায় দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল তিন গোয়েন্দা। অনেক নিচে মাঠটা চোখে পড়ছে।
তরোয়াল তুলল ক্রেলেরা। এগিয়ে যেতে ইশারা করল বন্দিদের।
আমাদেরকে চূড়া থেকে ফেলে দিতে চায়! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ফিরে তাকাল ক্রেলদের দিকে। চেঁচিয়ে বলতে লাগল, কেন আমাদের ফেলতে চাইছেন? কি করেছি আমরা? ছেড়ে দিন আমাদেরকে। লড়াই করতে আসিনি আমরা।
মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…মুক্তি নেই…
তরোয়াল তুলে এগিয়ে এল কয়েকজন ক্রেল।
এগোতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা।
চলে এল একেবারে চূড়ার কিনারে।
কিশোর আর রবিনের হাত চেপে ধরল মুসা। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, গুড বাই, বন্ধুরা। অনেক কাল একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা। কত আনন্দ করেছি। সব। শেষ হয়ে যাচ্ছে এখন। গুড বাই!
দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে লাফ দেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো সে।
স্থির হয়ে গেল হঠাৎ।
ধীরে ধীরে এক পকেট থেকে বের করে আনল হাতটা।
একটা তাস।
মনে পড়ল, তাসটা বাক্স থেকে খসে মাটিতে পড়ে গেলে তুলে নিয়েছিল সে। মনের ভুলে পকেটে রেখে দিয়েছিল।
চিৎকার করে উঠল কিশোর। থামো থামো! একটা বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়!
.
২৪.
ফিরে তাকাল মুসা। অবাক। মানে!
হাত বাড়াল কিলোর। দেখি, তাসটা দাও আমার হাতে।
কি করবে?
তর্ক কোরো না! আহ, জলদি করো! মুসা দেয়ার আগেই সেটা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল কিশোর।
মুক্তি নেই..মুক্তি নেই..মুক্তি নেই…
ঘোড়ার পিঠে বসা ক্রেলেরা গান গাইছে।
মাটিতে দাঁড়ানো ক্রেলেরা চলে এল বন্দিদের কয়েক ইঞ্চির মধ্যে। শীতল, নিষ্ঠুর দৃষ্টি। তরোয়াল তুলে খোঁচা মারার ভঙ্গি করল।
তৗসটা নিয়ে নিল কিশোর। পিঠে আঁকা জাদুকরের ছবিটা দেখল।
কাকু-কাকুর ছবি।
কি করবে ওটা দিয়ে? রবিনের প্রশ্ন। ওটা কি ভাবে বাঁচাবে আমাদের?
দাও ছুঁড়ে ফেলে! জাদুকরের ওপর প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসে উঠল মুসা। কাকু কাকুকে সামনে পেলে এখন ওকেই ছুঁড়ে ফেলত পাহাড় থেকে।
উঁহু, মাথা নাড়ল কিশোর। ছুঁড়ে ফেললে লাভ হবে না। ছিঁড়ে ফেলতে হবে। জাদুর মায়া কাটবে হয়তো তাতে।
তাসটা সোজা করে ধরল কিশোর। ছিঁড়তে যাবে, আচমকা দমকা বাতাসে তাসটা টান দিয়ে কেড়ে নিল ওর হাত থেকে। ছুঁড়ে ফেলল চূড়ার কিনার দিয়ে।
নিজের অজান্তেই প্রচণ্ড চিৎকার বেরিয়ে এল কিশোরের কণ্ঠ চিরে।
ওদের আশা-…একমাত্র আশা…বাতাসে ভাসতে ভাসতে পড়ে যাচ্ছে নিচে। চূড়ার কিনার দিয়ে।
কোন রকম ভাবনা চিন্তা না করে ঝাঁপ দিল কিশোর।
থাবা মারল তাসটাকে ধরার জন্যে।
মিস করল।
মাথা নিচু করে পড়তে শুরু করেছে সে।
ওপরে মুসা আর রবিনের হাহাকার শোনা গেল। ক্রেলেরাও চেঁচাচ্ছে। আনন্দে। উত্তেজনায়।
উড়ে চলেছে যেন কিশোর।
মরিয়া হয়ে থাবা মারল আবার।
ধরে ফেলল তাসটা।
ফড়াৎ করে এক টান মেরে ছিঁড়ে ফেলল।
মাথা নিচু করে তীব্র গতিতে উপত্যকার দিকে উড়ে চলেছে তখন সে।
প্রচণ্ড আক্রোশে তাসটাকে টুকরো টুকরো করতে লাগল।
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, ভয়ঙ্কর গতিতে মাটি ছুটে আসছে তার দিকে।
তারপর হঠাৎ করেই সব অন্ধকার।
এত অন্ধকার…
গম্ভীর নীরবতা…
সেই সাথে ঠাণ্ডা।
কাজ কি হলো! ভাবল সে।
তাস ছিঁড়ে ফেলাতে কি কাটল জাদুর মোহ?
বাড়ি ফিরতে পারল?
নাকি সত্যি সত্যি মৃত্যু ঘটেছে এবার?
.
২৫.
ধীরে ধীরে কেটে গেল অন্ধকার।
গাড়ির শব্দ কানে এল।
স্পষ্ট হয়ে উঠল দিনের আলো।
বার কয়েক চোখ মিটমিট করে ফিরে তাকাল সে।
তার দুই পাশে একই রকম ভাবে বিমূঢ় ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখল মুসা আর রবিনকে।
আস্তে আস্তে কেটে গেল ঘোর।
দেখল, কাকু-কাকুর বাড়ির সামনের লনে পড়ে আছে ওরা।
বোঝার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মুসা। দৌড় দিল গেটের দিকে।
আরে কোথায় যাচ্ছ? শোনো! শোনো! পেছন থেকে ডাক দিল কিশোর।
ফিরেও তাকাল না মুসা। ছুটতে ছুটতেই জবাব দিল, আর একটা সেকেন্ডও আমি এখানে থাকব না। বাপরে বাপ! এবার নিশ্চয় ডাইনোসরের রাজত্বে পাঠাবে!
কথাটা সাবধান করে দিল কিশোর আর রবিনকেও। ওরাও উঠে দৌড় দিল। মুসার পেছন পেছন। জাদুকরের সীমানা থেকে পালিয়ে যেতে চায়।
গেটের কাছে গিয়ে কি ভেবে ফিরে তাকাল কিশোর।
কাকু-কাকুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সামনের দরজায়।
মিটিমিটি হাসছে।
প্রচণ্ড রাগ হলো কিশোরের। দাঁড়িয়ে গেল যেন হোঁচট খেয়ে।
তার গায়ে ধাক্কা খেল রবিন। কি হলো?
ওই লোকটার সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া আছে আমার! শীতল কণ্ঠে বলল কিশোর।
পাগল হয়েছ!
জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। কাকু-কাকুর সঙ্গে কথা বলতে যাবেই।
খপ করে তার হাত চেপে ধরল রবিন। হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলল, পরে। এখন বাড়ি চলো। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে শান্ত হই। তারপর আমিও আসব তোমার সঙ্গে। আসলেই। এত সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না ওকে।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে গেছে মুসাও। রবিন ঠিকই বলেছে। চলো, আগে বাড়ি চলো। আরও একজনেরও হিসেব নিতে হবে আমাদের। লীলা রেডরোজ। ওকেও ছাড়ব না আমি। খুঁজে বের করবই। ওর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করাটা বাকি রয়ে গেছে।
ঢিল হয়ে এল কিশোরের দেহ। মাথা ঝাঁকাল। বেশ। চলো। আগে বাড়িতেই যাই।
<