০৯.
প্রথম যেতে হবে রকি বীচ হাই স্কুলে, মুসাকে তুলে নেয়ার জন্যে।
ওকে খুঁজে বের করতে দেরি হলো না। জিনাকেও পাওয়া গেল ওখানে। মেয়েদেরও বাস্কেটবল প্রতিযোগিতা আছে।
কিশোরকে দেখে দু-জনেই অবাক হলো। বাস্কেটবলের প্র্যাকটিস দেখতে এসেছ? জিজ্ঞেস করল জিনা।
না, মুসাকে নিয়ে যেতে। তোমাকে পেয়ে গিয়ে ভালই হলো। কাল ববের বাড়িতে শেকসপীয়ারের মূর্তিটা তুলে রেখেছিলে তুমি। কেমন লেগেছিল?
দ্বিধা করল জিনা। মার্বেলের মত ঠাণ্ডা, মসৃণ…
আর কিছু?
ভাবল জিনা, আঠা আঠা!
কি ধরনের আঠা? তেলতেলে খাবারের ওপর যেমন থাকে, বার্গারের ওপর?
আবার দ্বিধা করল জিনা। কি জানি, হবে হয়তো।
এতেই চলবে। মুসার দিকে তাকাল কিশোর, যাবে না?
কাজ শেষ হয়নি তো এখনও।
ঘড়ি দেখল কিশোর। ১টা বেজে ৫ মিনিট। থিয়েটারে যাওয়ার কথা দুটোর সময়। এক ঘণ্টা সময় নেই হাতে। ববের ওখানে গেলে এক্ষুণি যেতে হবে। ঠিক আছে, তুমি থাকো। আমি একাই সেরে আসি। দুপুর দুটোয় থিয়েটারে হাজির থেকো।
প্রায় ছুটে পার্কিং লটে ফিরে এল কিশোর। পিকআপে চড়ে স্টার্ট দিল। ফ্রিওয়েতে বেরিয়ে এসে রওনা হলো পশ্চিম হলিউডে।
কাজটা সহজ হবে না–চালাতে চালাতে ভাবছে সে-ববের কাছ থেকে তথ্য আদায় করাটা সহজ না।
ববের বাড়ির সামনে যখন গাড়ি রাখল সে, ঘড়িতে ঠিক দেড়টা বাজে। সিঁড়ি বেয়ে দৌড়ে উঠল ওপরে। দরজার ঘণ্টা বাজাল।
কে? ভেতর থেকে সাড়া এল।
কিশোর পাশা।
নীরব হয়ে রইল ওপাশ।
পিটার হাইয়েমের বন্ধু, আবার বলল কিশোর।
দরজা খুলল। চোখের পাতা সরু হয়ে এল ববের, তোমার নাম যে কিশোর, জানতাম না। তোমার নামের মধ্যে একটা অনুসন্ধানের গন্ধ পাচ্ছি। জানার ইচ্ছে বড় প্রবল।
সত্যি বলতে কি, অস্বস্তিতে পড়ে গেল কিশোর, আসলে কয়েকটা প্রশ্নই করতে এসেছি আপনাকে। ভেতরে আসব?
ঘড়ি দেখল বব। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরোব, থিয়েটারে যেতে হবে। কি প্রশ্ন তোমার?
আমার বন্ধু পিটারের ব্যাপারে। ভয়ই লাগছে। অভিশাপ নিয়ে তার এমন হাসিঠাট্টা ভাল লাগছে না আমার। তার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আপনি কি পরামর্শ দিতে পারেন, কি করা যায়?
মাথা ঝাঁকিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল বব, এসো।
লোকটার চোখে আলোর ঝিলিক চোখ এড়াল না কিশোরের। করিডরের শেষ মাথায় ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বব বলল, আমার অনুষ্ঠান তাহলে ভাল লেগেছে তোমার?
লেগেছে। তবে খিদে না থাকলে আরও লাগত।
হাসল বব। আসলে খালি পেটেই এ সব কাজ করা ভাল। আমি তো কাল সারাদিনই কিছু খাইনি।
যা ভাবার ভেবে ফেলল কিশোর–বর কিছু না খেয়ে থাকলে তার হাতে বনরুটির তেল লাগার কথা নয়। কাল বিকেলে রলি আর পিটার বার্গার খেয়েছে। তার আঙুলে লেগে থাকাটা স্বাভাবিক।
সুইচ টিপে আলো জ্বালল বব। দরজার ডান পাশে সুইচটা। আরেকটু ডানে সরে দেয়ালের গায়ে সকেট, তাতে প্লাগ ঢুকিয়ে টেবিল ল্যাম্পের লম্বা তার বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মেঝেতে পড়ে থাকা তারটার মাঝামাঝি জায়গায় কয়েকটা প্যাঁচ খেয়ে আছে। টেবিলেই রয়েছে ল্যাম্পটা। উল্টোদিকের টেবিলে রাখা শেকসপীয়ারের মূর্তিটা, গম্ভীর, সার্বক্ষণিক কুটি করে আছে।
মনে মনে হিসেব করল কিশোর, সকেট থেকে ল্যাম্পের দূরত্ব পনেরো ফুট। মনে করার চেষ্টা করল অনুষ্ঠানের সময় কে কোথায় বসেছিল। দরজার কাছে বব, তার ডান পাশে চশমা পরা একটা মেয়ে, তার পাশে কোকড়া-চুল এক লোক, তারপর রলি, এবং তারপর তিনজন অভিনেতা। তাদের শেষজনের পাশে পিটার, মূর্তিটার কাছাকাছি, তারপর আরও দু-তিনজন অভিনেত্রী। চক্রের বাকি অংশটা। পুরণ করেছে সে নিজে, মুসা আর জিনা।
লোকটার কাছ থেকে কি ভাবে কথা আদায় করবে ভাবছে সে। আসলে, যত যা-ই বলুন, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ব্যাপারটা আধিভৌতিক কিছু। বরং…
মানুষের শয়তানি বলতে চাইছ? মুচকি হাসল বব। প্রথম প্রথম এলে আর এ রকম কিছু ঘটলে সবাই তাই ভাবে। পরে ঠিক হয়ে যায়। বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। বেশ, তুমি আমাকে বলো, বাতিটা আপনাআপনি নিভল কি করে?
টাইমার লাগানো থাকতে পারে, জবাব দিল কিশোর।
আবার হাসল বব। হ্যাঁ, ওভাবে বাতি নিভিয়ে, অন্ধকারে এতগুলো মানুষকে ডিঙিয়ে, কারও গায়ে সামান্যতম ছোঁয়া না লাগিয়ে গিয়ে মৃতিটা ফেলে, আবার সবাইকে ডিঙিয়ে এসে আগের জায়গায় বসে পড়লাম; তারপর জ্বেলে দিলাম মাথার ওপরের বাতিটা! এতই সহজ!
ল্যাম্পের বাল্বটা কেটে গিয়ে থাকতে পারে।
কাটেনি। দেখেছি। সকেট থেকে প্লাগটা খুলে গিয়েছিল।
তাই নাকি? আমি গাধা তাহলে লক্ষ করলাম না কেন কাল? ভাবল কিলোর। পিটারের জন্যে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম আর তার দিকে খেয়াল ছিল বলেই বোধহয় দেখিনি। বলল, তাহলে কেউ টেনে খুলে ফেলেছে।
কেউ নয়, কিছু, শুধরে দিল বব।
ঠোঁট গোল করে নীরবে শিস দেয়ার ভঙ্গি করল কিশোর। তাজ্জব ব্যাপার…
তার কাঁধে হাত রাখল বব। ইয়াং ম্যান, তোমার বন্ধুর জন্যে নিশ্চয় একটা দায়িত্ব আছে তোমার। আমার চেয়ে তোমার কথা বেশি গুরুত্ব দেবে সে, জানি। তাকে বোঝাওগে। ঘড়ি দেখল বব, আর সময় নেই, থিয়েটারে যেতে হবে। তোমাকে আর সময় দিতে পারছি না, সরি।
অনেক দিয়েছেন, ধন্যবাদ। ঘুরে করিডরে বেরিয়ে এল কিশোর। ববের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলল, ভাল কথা, আমার বন্ধু জিনা আপনার কাছে মাপ চেয়ে নিতে বলেছে। এখানে আসার আগে বার্গার খেয়েছিল। হাতে তেল লেগে ছিল। মূর্তিটায় লেগে নোংরা হতে পারে, এ জন্যে চিন্তা হচ্ছে তার। অত উত্তেজনার মধ্যে পরে আর মুছতে মনে ছিল না।
মাথা ঝাঁকাল বব। দেখেছি। কাল ওটা তোলার সময় লেগে গিয়েছিল আরকি। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মুছতে হয়েছে আমাকে। গন্ধটা দারুচিনির মত। লাইটের সুইচেও এই জিনিস লক্ষ করেছি।
অবাক হয়েছে যে, সেটা চেহারায় প্রকাশ পেতে দিল না কিশোর। যাই হোক, জিনা আপনাকে সরি বলতে বলেছে।
হাসল বব। ও কিছু না। ওকে অত চিন্তা করতে মানা কোরো। আমি মুছে ফেলেছি।
থ্যাংকস।
সামনের দরজা দিয়ে বেরোল দু-জনে। তালা লাগাতে লাগাতে বব বলল, আবার একদিন এসে যোগ দিতে পারো। তবে মনে হচ্ছে এবার অনুষ্ঠান করতে দেরি হবে। উইলের শান্ত হতে সময় লাগবে।
উইল?
উইলিয়াম শেকসপীয়ার।
ও। ঠিক আছে, যাই। থিয়েটারে দেখা হবে।
আবার পিকআপ নিয়ে ফ্রিওয়েতে বেরিয়ে এল কিশোর। অল্পক্ষণেই স্পীডোমিটারের কাটা উঠে গেল পঞ্চাশ-পঞ্চান্নতে, আর তার মগজের কাটা কয়েক শো-তে। জিনা আর মুসাকে বাদ দিলে, পিটার ছাড়া একমাত্র রলিই বার্গার খেয়েছিল। তার টেনে প্লাগ খুলে, দৌড়ে ঘর পার হয়ে গিয়ে মূর্তি ফেলে এসে সুইচ টিপে মাথার ওপরের আলো জ্বেলে দেয়া–এতগুলো কাজ কি সে করতে পেরেছে অন্ধকারের মধ্যে?
ভুরু কাছাকাছি হয়ে গেল কিশোরের। বব নিজের ব্যাপারেও এই প্রশ্নই তুলেছিল তখন। তবে ববের চেয়ে রলির বয়েস কম। ক্ষিপ্র হওয়া স্বাভাবিক। কাজটা তার জন্যে কঠিন হলেও হয়তো অসম্ভব নয়।
আর যা-ই হোক, শেকসপীয়ারের ভূত এসে মূর্তি ফেলে দিয়েছে, এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করে না কিশোর।
.
১০.
গারবার থিয়েটারের পার্কিং লটে ঢোকার আগে গাড়ির গতি কমাল কিশোর। অনেক লম্বা লাইন পড়েছে টিকেট কাউন্টারের সামনে। নিশ্চয় গতরাতের নিউজ দেখেছে। কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ বোধহয় একেই বলে–বার বার মরতে বসছে পিটার, ব্যবসা করছে অন্য লোক।
এগিয়ে গেল সে। মারাত্মক কতগুলো চোখা কাটা ডিঙিয়ে। প্রিং লাগানো। গাড়ি ঢোকার সময় মাটিতে দেবে থাকে। বেরোনোর সময় লাফ দিয়ে উঠে আসে। টায়ারে লাগলে চিরে ফালাফালা হয়ে যাবে। বেরোনোর একমাত্র পথ তখন, গেট। সুতরাং পার্কের ভাড়া মেরে দেয়ার আর উপায় থাকে না। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার। পার্কিং লটগুলোতে প্রচুর এই জিনিস দেখেছে কিশোর, তারপরেও দেখলেই কেন যেন মধ্যযুগীয় অত্যাচার-কক্ষের কথা মনে পড়ে যায় তার।
গাড়ি পার্ক করে রেখে থিয়েটার স্টেজের দরজার দিকে দৌড় দিল সে।
করিডরে ঢোকার মুখে টোপাজের সঙ্গে দেখা। বাধা দিল না। মাথা নুইয়ে যাওয়ার ইশারা করল। কর্কবোর্ড পার হয়ে এল সে। স্টেজে ঢোকার দরজার ঠিক ওপাশেই মুসা আর পিটারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পিটারের কপালের দাগটার কোন চিহ্ন নেই এখন।
হেসে বলল কিশোর, বেঁচেই আছ দেখতে পাচ্ছি।
আছি। আর কিছু ঘটেনি।
মুসাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, জিনা আসেনি?
মৃদু আলোকিত একটা কোণ দেখিয়ে মুসা বলল, ওখানে।
নাচছে জিনা।
কি করছে ও? কিশোরের প্রশ্ন।
হাসল মুসা, ভুলে গেছ? করিডরের সাইনটার কথা মনে নেই?
অডিশন নোটিশ? তারমানে সত্যিই সে…
জিনা তো তোমার অচেনা নয়। একবার কিছু করবে বলে গো ধরলে করেই। ছাড়ে।
হু! এইজন্যেই মেয়েদের এড়িয়ে চলতে চাই আমি।
কিন্তু সব সময় সবকিছু চাইলেই কি আর পারা যায়?
লাউডস্পীকারে গমগম করে উঠল পিটারের গলা, শুরু হতে যাচ্ছে কিয়োটো কন মোটো! আজ রাতের সবচেয়ে বড় ড্যান্স নাম্বার।
ঘোষণা শুনে দৌড়ে এল জিনা। মুসা আর কিশোরের সঙ্গে পাশের একটা দরজা দিয়ে ঢুকল অডিয়েন্সে।
ওরা বসতে না বসতে অন্ধকার হয়ে গেল স্টেজ। গুঞ্জন করে উঠল একটা মোটর, মোলায়েম সুরে বাজতে শুরু করল পিয়ানো। অর্কেস্ট্রা পিটের ভেতর থেকে উঠে আসছে মিউজিক।
অন্য বাদকেরা কোথায়? জানতে চাইল মুসা।
আনলেই পয়সা দিতে হবে, জবাব দিল কিলোর। তাই প্রতিটি রিহার্সালে আনা সম্ভব হয় না।
বেশ কিছু আলো জ্বলে উঠল। স্টেজের পেছনে ফুটে উঠল জাপানের একটা দৃশ্য।
হঠাৎ জোরাল হয়ে গেল মিউজিক। পর্দার আড়াল থেকে নাচতে নাচতে ঢুকল। নাচিয়েরা। আলোটা এমন ভঙ্গিতে ফেলা হয়েছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ওদের, ছায়াগুলো মনে হচ্ছে একটা আরেকটাকে ভেদ করে যাচ্ছে আড়াআড়ি ভাবে। ওদের শরীরের তীক্ষ্ণ মোচডগুলোতে মার্শাল আর্টের প্রকাশ প্রবল।
মুগ্ধ হয়ে দেখছে কিশোর। হালকা, সরু সরু আলোকরশ্মি যেন বাতাস চিরে ছুটে চলেছে এদিক ওদিক।
আচমকা যেন জমে গেল নর্তকেরা। একেবারে স্থির। একটা পর্দার আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল আরেকজন নর্তক। মনে হলো যেন উড়ে এল বাতাসে ভর করে। আস্তে করে এসে মঞ্চে নামল তার ছায়া। একাই নাচতে শুরু করল।
ওহ, পিটার! বিস্ময় চাপতে পারল না জিনা।
সচল ছায়াটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। পিটার যে ভাল নাচতে পারে জানা ছিল তার, কিন্তু এতটা ভাল কল্পনা করেনি। মুহূর্তে যেন দখল করে নিয়েছে পুরো মঞ্চটা।
মনে হচ্ছে মার্শাল আর্টের ওস্তাদ! প্রশংসা করল মুসা।
নাচতে নাচতে শরীর বাকিয়ে, মুচড়ে, নানা রকম কায়দা-কসরৎ দেখাচ্ছে পিটার।
নাচ চলেছে, এই সময় একটা ঘড়ঘড় শব্দ শোনা গেল।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের, টার্নটেবল ঘুরছে!
পর্দা কাঁপতে শুরু করল। মেঝেতে পড়ে গেল নাচিয়েরা। বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল কেউ কেউ।
লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে পড়েছিল পিটার।পড়ল হাঁটু ভাজ করা অবস্থায়। ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। মুখ থুবড়ে পড়ল মেঝেতে।
একলাফে সীট থেকে উঠে মঞ্চের দিকে দৌড় দিল কিশোর, মুসা আর জিনা। বাজনা থেমে গেছে। আলো জ্বলে উঠেছে। উত্তেজিত হয়ে পড়েছে দর্শক।
গোয়েন্দাদের মঞ্চে উঠতে বাধা দিল উল্কি আঁকা একটা হাত, কঠিন গলায় বলল, নামো! এখানে ওঠা বারণ।
নিরু। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিনজনের দিকে। চোখের আগুনটা বর্ষিত হচ্ছে মূলত কিশোরের ওপর।
আপনি তো আমাদের চেনেন! কিশোর বলল।
কি হবে চিনলে? থিয়েটারের লোক ছাড়া আর কাউকে উঠতে দেয়ার নিয়ম নেই। এখন তো আরও দেয়া যাবে না। কোন কিছু ঘটে গেলে দায়ী হবে কে?
অসহায় দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। নিরু অন্যায় কিছু বলেনি।
তবু মুসা বলল, আমরা কোন সাহায্য করতে পারি নাকি দেখতাম।
কি ব্যাপার? সেট খসে পড়েছে নাকি?
পরিচিত কণ্ঠ শুনে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল কিশোর। মুসা আর জিনাও ঘুরল।
তিনজনেই অবাক। পিটার দাঁড়িয়ে আছে। বলল, এমন করে তাকাচ্ছ যেন আমাকে চিনতে পারছ না! হয়েছেটা কি?
আ-আ-আপনি নন! তোতলাতে শুরু করল জিনা।
মঞ্চ থেকে একজন লোককে ধরাধরি করে তুললেন ভিনসি জাপা এবং আরেকজন শ্রমিক। যাকে তোলা হলো সে পিটারের সমান লম্বা, সোনালি চুল।
ছায়া দেখে কিন্তু অবিকল একই রকম লাগছিল! নিজেকে যেন বোঝাল কিশোর।
আমরা ভেবেছিলাম…আমরা..মানে… কথা সাজাতে পারছে না মুসা।
বিস্ময়টা দূর হয়ে গেল পিটারের চেহারা থেকে। এইবার বুঝেছি! টেরি হান্না। অক্সিডেন্ট করেছে। তোমরা মনে করেছ আমি।
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল জিনা।
অনেকটা আমার মতই দেখতে। লম্বা, চওড়া…ভাড়া করে আনা হয়েছে আমার জায়গায় চালানোর জন্যে। নাচটাচ তো জানি না ওরকম
চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল একটা কণ্ঠ, ট্রট, টার্নটেবলটার কি হয়েছিল?
টার্নটেবলের উচ্চারণটা শোনাল টয়টেবল। ভিনসি জাপার নিউ ইয়র্ক টান।
স্টেজ থেকে জবাব এল, আপনি কিউ দিয়েছেন সেভেনটি সেভেন। ওটা টার্নটেবলের কিউ।
কী! ঝট করে কম্পিউটারের দিকে ফিরে তাকালেন ম্যানেজার। কিন্তু একটা লোককে তুলে ধরে রাখায় দৌড়ে যেতে পারলেন না।
কম্পিউটারে কোন গোলমাল হয়নি তো? টার্নটেবল অপারেটর জিজ্ঞেস করল।
হতে পারে! বিড়বিড় করলেন ম্যানেজার, কিন্তু কথাটা কিশোরের কান এড়াল না। টেরি হান্নাকে স্টেজের ধারে একটা কটে নামিয়ে রেখে ফোনের দিকে দৌড় দিলেন।
টেরির কাছে গিয়ে জানতে চাইল পিটার, কি অবস্থা তোমার?
ব্যথায় ককাতে ককাতে জবাব দিল টেরি, মনে হয় গোড়ালিটা গেছে।
কিশোর আর জিনার দিকে ফিরল মুসা, গোড়ালি ভেঙে থাকলে কয়েক মাসের জন্যে বাতিল। নাচানাচি বাদ।
ব্যাপারটা পিটারের বেলায়ও ঘটতে পারত, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর। কিন্তু তদন্ত করারও কোন উপায় দেখছি না। আমাদের উঠতে দেবে না। জোর করে কিছু করতে গেলে পুলিশের কাছে দিয়ে দেবে।
তাহলে কি করব? আমরা শ্রমিক নই, অভিনেতা নই, থিয়েটারের কেউ নই। এখানকার লোকেরাও পিটারের বন্ধু হিসেবে আমাদের চিনে ফেলেছে। ফাঁকি দিতে পারব না। তাহলে? নিরাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল মুসা।
একটা উপায় অবশ্য আছে… চোখ চকচক করছে জিনার।
তার দৃষ্টি অনুসরণ করে আউটার করিডরের দিকে তাকাল মুসা ও কিশোর।
আধখোলা দরজা দিয়ে অডিশন নোটিশটা চোখে পড়ছে। বাইরে থেকে আ বাতাস লাগলেই নড়ে উঠছে কাগজটা।
ওখানে ঢোকার কথা বলছ নাকি? মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল জিনা।
কিশোর আগেই বুঝেছে। মুসার কথার জবাব দিল, না। তবে নোটিশটা বলেছে একজন পুরুষ আর একজন মহিলা প্রয়োজন।
তাকে শুধরে দিল জিনা, এখন একজন পুরুষে আর হবে না, দু-জন লাগবে টেরির সমান লম্বা, মার্শাল আর্ট জানা…
এতক্ষণে বুঝেছে মুসা, আমি আমার কথা বলছ! কিন্তু নাচের ন-ও তে জানি না আমি। জীবনে কখনও স্টেজে উঠিনি…
তাতে কি? কিশোর বলল, মার্শাল আর্ট তো জানো। ঠিকমত অঙ্গভা করতে পারলে, জড়তা এড়াতে পারলে ওটাই নাচ হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমি তে থাকবই আশেপাশে। ভয় কি?
কিন্তু আমাদের নেবে কেন?
এখন ওদের লোক প্রয়োজন। আমাকে নেবেই ওরা, কারণ অভিনেতা হিসে ছোটবেলায়ই সুনাম করে ফেলেছি। জিনাকে নেবে পিটারের সুপারিশে। আ আমাদের তিনজনের সুপারিশ তোমাকে নেয়ার জন্যে যথেষ্ট।
.
১১.
দরদর করে ঘামছে মুসা। কিশোরের কথাই ঠিক হয়েছে। ঢুকতে কোন অসুবি হয়নি ওদের। নিয়ে নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নাচ শিখতে শিখতে এখন প্রাণ বেরোনো জোগাড় মুসার। বাস্কেটবল প্র্যাকটিসের চেয়ে অনেক কঠিন লাগছে তার কাছে।
কিশোরকেও নাচতে হচ্ছে। মুসার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। কারণ অ ফিট নয় তার শরীরটা।
পরদিন সকালে বিছানা থেকে নামার সময় মুসার মনে হলো একটা ট্রাক যে চলে গিয়েছিল তার শরীরের ওপর দিয়ে। পেশীতে ব্যথা। এই শরীর নিয়েই আবা যেতে হবে প্র্যাকটিস করতে।
কিশোরের অবস্থা আরও খারাপ। তার সঙ্গে দেখা হতেই মুসা বলল, এ নাচিয়েগুলো মানুষ না, কিশোর! আন্না ওদের শরীরে কি দিয়েছে আল্লাই জানেন?
হেসে বলল কিশোর, ওদেরকে বাস্কেটবল খেলতে দিলে বলবে, বাস্কেটব খেলোয়াড়েরা মানুষ নয়:…সব কাজেই প্র্যাকটিস দরকার। একেক কাজে একে রকম প্র্যাকটিস। একজনের কাজ আরেকজনকে করতে দিলে এবং সেটা তা জানা না থাকলে সাংঘাতিক কঠিন মনে হবে।
কিন্তু কিশোর, স্টেজে গিয়ে দর্শকদের সামনে যদি না পারি? পচা ডিম মেরে শেষ করে দেবে। কয়েক মন সাবান দিয়ে ধুয়েও গন্ধ দূর করতে পারব না!
আরে অত ঘাবড়িও না, পারবে ঠিকই। আমরা তো আর হিরো হতে যাচ্ছি, কোনমতে কাজ চালিয়ে দিতে পারলেই হলো। আমাদের আসল কাজ হলো গোয়েন্দাগিরি করা, পিটারকে বাঁচানো।
কিন্তু মঞ্চে উঠলেই তো আমার হাত-পা সিঁটিয়ে যাবে। অভিনয়ের আমি কি বুঝি? আমি পারব না, কিশোর, ভাই, আমাকে মাপ করো…
আরে দূর, অত ঘাবড়াও কেন? পারবে, খুব পারবে। না পারলে আমি শিখিয়ে দেব। আসল কাজটা হলো চেষ্টা করা। চেষ্টায় সব হয়।
নাচ শেখান যে ভদ্রলোক, তার নাম হেফটি ভাগনার। মুসার ভয় দেখে হাসলেন। সান্ত্বনা দিলেন, তোমার চেয়ে অনেক আনাড়িকে নাচের ওস্তাদ বানিয়ে দিয়েছি আমি। তোমার তো রীতিমত ট্যালেন্ট আছে। ভাল লাফ দিতে পারো…বাস্কেটবল এই একটা সুবিধা করে দিয়েছে তোমার। ভয় নেই, কোন ভয় নেই, দর্শকরা তোমার প্রশংসাই করবে, আমি হেফটি ভাগনার বলছি।
ওস্তাদের কথায় ভয় অনেক কাটল মুসার, আত্মবিশ্বাস বাড়ল।
.
অবশেষে মুসাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন ভাগনার। কোন পার্ট করতে হবে তা-ও বুঝিয়ে দিলেন, পিটার আর তার হিরোইন নেলি গুহার ভেতর থেকে পালানোর চেষ্টা করবে। সৈকতে বেরিয়ে গিয়ে পড়বে জাপানীদের খপ্পরে। ওই দৃশ্যটাতে ওদের সঙ্গে থাকবে তুমি।
আমি এটা ভাল পারতাম।
তুমি সবই ভাল পারবে, জাত অভিনেতা, বুঝে গেছি আমি। তোমাকে আরও কঠিন একটা পার্ট দেয়া হবে। ঘোরের মধ্যে স্বপ্ন দেখবে পিটার-ক্যালিফোর্নিয়ায় বাড়ি পৌঁছে গেছে, সৈকতে বেড়াতে বেরিয়েছে। গান গাইবে ওখানে, নাচবে, নানা রকম খেলা খেলবে, সেখানে তুমিও থাকবে তার সঙ্গে…
হু, মন্দ না। তারপর?
বীচবল খেলতে হবে তার সঙ্গে তোমাকে…
বীচবল!
মুচকি হাসল জিনা। কিশোরের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম সমবেদনায় জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল।
আঁতকে উঠলে যে? পারবে না নাকি? জিজ্ঞেস করলেন ভাগনার।
পারব না, কারণ যে কোন আউটডোর গেম আমার অপছন্দ-বললে কাজ হারানোর ভয় আছে, চুপ করে রইল কিশোর।
হেসে বলল মুসা। আরে দূর, অত ঘাবড়াও কেন? পারবে, খুব পারবে। না পারলে আমি শিখিয়ে দেব। আসল কাজটা হলো চেষ্টা করা। চেষ্টায় সব হয়। কিশোরের দিকে চেয়ে ভাগনারের অলক্ষে চোখ টিপল। বোঝাতে চাইল–কেমন মজা! আমার সময় তো খুব বলেছিলে, চেষ্টায় সব হয়। অন্যকে পরামর্শ দেয়া খুব সহজ!
তাহলে আর কি? ভাগনার বললেন, ঠিক আছে, যাও এখন। তিনটায় আবার দেখা কোরো।
.
পিটারের ড্রেসিং রুমের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল কিলোর, পিটার, ভাল খবর আছে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে মুসা আর জিনা।
হাসিমুখে ওদের স্বাগত জানাল পিটার আর ভিনসি জাপা।
পিটার বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও, বোলো না! দেখি আন্দাজ করতে পারি কিনা? চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রাখল সে। শেকসপীয়ারের ভূতকে তাড়া করে ধরে ফেলে এখন শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছ। চোখ মেলে হাসল। এমনি, দুষ্টুমি করছিলাম। খবরটা আমি জানি। আরও জানি, ভালই করবে তোমরা।
থিয়েটারে স্বাগতম, মুসা আর কিশোরের সঙ্গে হাত মেলালেন জাপা। এখানে ঢুকতে আর কোন বাধা থাকল না এখন তোমাদের। সেই সুবাদে খানিকটা পপকর্ন হয়ে যাক? মাঝারি আকারের একটা কাগজের ঠোঙা বের করে আনলেন যে চেয়ারে বসেছেন সেটার পেছন থেকে। একেবারে তাজা দিয়েছে।
ডায়েট কন্ট্রোল করার ফলে পেট প্রায় খালিই থাকে কিশোরের। জিভে জল এসে গেল তার। কিন্তু সে কথা বলার আগেই জিনা বলে উঠল, বাহ, পোশাকটা তো সুন্দর! নতুন?।
পিটারের কস্টিউম র্যাকের দিকে এগিয়ে গেল সে। সিল্কের একটা আলখেল্লার মত ঢোলা পোশাক, তাতে নানা রঙের ফিতার বন্ধনী লাগানো। ধরার জন্যে হাত বাড়াল।
ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙল। চিৎকার করে উঠল পিটার, আহহা, গেল তো পড়ে!
ফিরে তাকাল জিনা।
ভাঙা কাঁচ কুড়ানোর জন্যে নিচু হলো মুসা, ভাঙা আয়না মানে ব্যাড লাক!
তুমিও দেখি ববের মত কথা বলো, পিটার বলল।
কাঁচ কুঁড়াতে মুসাকে সাহায্য করল কিশোর আর জিনা।
দরজার দিকে এগোতে এগোতে জাপা বললেন, কম্পিউটারে নাম্বার সাজাতে বলিগে। কান খাড়া রাখবে কিন্তু। কিউ ভুল কোরো না। রিহার্সালের সময় যা বলেছি, অক্ষরে অক্ষরে মনে রাখবে। শেষ কথাগুলো নতুন অভিনেতাদের উদ্দেশে বললেন তিনি।
আসছি, পিটার বলল। কাঁচগুলো তুলেই চলে আসব।
ড্রেসিং রুম থেকে বেরোনোর আগে পপকর্নের ঠোঙাটার দিকে লোভীর মত তাকাল কিশোর। স্টেজের ডানে চলে গেল পিটার, ওদিক দিয়েই তার ঢোকার কথা। জিনা বসল দর্শকদের মাঝে। কিশোর আর মুসা স্টেজে রয়ে গেল ঢোকার অপেক্ষায়।
কিশোর দেখল, সুতো আর কঁচি হাতে পিটারের ড্রেসিং রুমের দিকে যাচ্ছে। একজন লোক। গলায় ঝোলানো দর্জির ফিতে।
পিটারের দর্জি, মুসাকে বলল কিশোর।
দর্জি?
থিয়েটারে নানা রকম পোশাক লাগে, কস্টিউম। সব সময় রেডি রাখতে হয়। কোথাও ছিঁড়ল-ফাটল কিনা দেখে রাখে দর্জি। মেরামত দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা সেরে রাখে।
বাপরে, থিয়েটারে অনেক ঝামেলা!
কাছে একটা টুলে পড়ে থাকা খবরের কাগজের হেডিঙে চোখ পড়ল কিশোরের:
দুর্ভাগ্যের শিকার তরুণ অভিনেতা
শেকসপীয়ারের প্রতিশোধ!
কাগজটা হাতে নিল সে। হেডলাইনের নিচে পিটারের একটা ছবি। কপালের ফোলাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার নিচে ক্যাপশন:
ওয়াইন্ড! ওয়াইল্ড! ওয়াইল্ড-এর স্টার পিটার হাইয়েম
এই হপ্তায় অনেকগুলো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
ছবিটা দেখতে দেখতে মুসা বলল, আসলে যতটা ফুলেছিল তার চেয়ে বেশি ফোলা লাগছে ছবিতে।
হ্যাঁ, চোখের পাতা সরু হয়ে এল কিশোরের। ইচ্ছে করেই হয়তো ছবিটায় এ রকম করেছে। দ্রুত পাতা উল্টে শো-বিজের গসিপ পাতায় চলে এল সে।
এটা দেখো, কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে দেখতে দেখতে বলল মুসা, আর্ট টিলারি একটা বিদেশী ফিল্মে কাজ করার কন্ট্রাক্ট সই করেছে। পিটারকে ছাড়া কলিনের আর কোন পথ নেই, তাকে পছন্দ করুন আর না-ই করুন।
তীক্ষ একটা চিৎকার ভেসে এল পিটারের ড্রেসিং রুম থেকে।
চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সেদিকে দৌড় দিল মুসা। কাগজটা হাত থেকে ফেলে তার পেছনে ছুটল কিশোর। ওদের পেছনে আরও কয়েকজন।
ঘরে ঢুকে দেখা গেল পাগলের মত ডান হাত চুলকাচ্ছে পিটারের দর্জি। চামড়া লাল হয়ে উঠেছে।
কি হয়েছে? জানতে চাইল কিশোর।
কোণের সিঙ্কের কাছে দৌড়ে গেল দর্জি। কল ছেড়ে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হাত ভেজাতে ভেজাতে বলল, উফ, জ্বলে গেল! পুড়ে যাচ্ছে যেন!
এই, ডাক্তার ডাকুন! দরজার কাছে উঁকি মারছে অনেক লোক, তাদের উদ্দেশে বলল কিশোর। দর্জির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, হয়েছে কি?
আঙুলের কাছ থেকে বাহুর মাঝামাঝি পর্যন্ত এখন লাল অনেকগুলো দাগ দেখা যাচ্ছে দর্জির। কি জানি, বলতে পারব না! ওটা কেবল ছুঁয়েছি, অমনি এই অবস্থা!
কাঁপা হাতে পিটারের নতুন পোশাকটা দেখাল সে।
.
১২.
আর আধ ঘন্টা বাকি। প্লীজ, যার যার জায়গায় যান, স্টেজের স্পীকারে বেজে উঠল জাপার কণ্ঠ।
আমি যাই, মুসা আর কিশোরকে বলল পিটার। রেডি হতে হবে।…ও, ডাক্তার বুঝেছেন কি জিনিস লাগানো ছিল পোশাকে। অ্যানটিভোট দিয়ে দিয়েছেন ফক্সিকে, ঠিক হয়ে যাবে।
গুড, কিশোর বলল। দর্জির জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে ছিল সে। তোমার পোশাকের কি হবে? ওটা তো আর পরতে পারবে না।
মুখে ছায়া নামল পিটারের। বলতে কষ্টই হলো যেন, আজ রাতের জন্যে অন্য আরেকটা দেয়া হবে আমাকে। দেখেটেখে দেবে, যাতে ক্ষতিকর কিছু লাগানো না থাকে।
আজ রাতে পারবেন কাজ করতে? মুসার প্রশ্ন।
পারব। তবে মনের জোর আর রাখতে পারছি না। ভয়ই লাগছে। ভাগ্যিস পরিনি পোশাকটা! ফক্সি বেচারার জন্যেই বেঁচে গেলাম। আমার যন্ত্রণাটা গেল তার ওপর দিয়ে।
বাঁচলে তো বটেই, কিশোর বলল। স্টেজে যাওয়ার আগে গায়ে দিলে আর অভিনয় করতে হতো না। যে লাগিয়েছে সে এটাই চাইছিল, যাতে মঞ্চে যেতে না পারো। এখন মনে করার চেষ্টা করো তো পোশাকটা কে কে ধরেছিল আজকে?
মাথা হেলিয়ে ভাবল পিটার। ফক্সি ধরেনি এটা ঠিক…
সে তো জানা কথাই, মুসা বলল। নিজে আজেবাজে জিনিস লাগিয়ে আবার নিজেই ধরতে যেত নাকি?
কে লাগিয়েছে কার কথা বলি? নিজের থুতনিতে টোকা দিল পিটার। নিচের ওয়ারড়ো ডিপার্টমেন্টের কেউ হতে পারে, ডিজাইনারদের কেউ হতে পারে। কজনকে সন্দেহ করব?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। আমার ধারণা, তোমার ঘরে এসে ঝোলানোর পর পোশাকটাতে ওই জিনিস লাগানো হয়েছে। নইলে যে নিয়ে আসত তারও হাতে লাগত; চুলকাত। পুরো কাপড়ে না লাগিয়ে সামান্য একটু জায়গায় লাগালৈ অবশ্য আলাদা কথা।
ওটা আনার পর ড্রেসিং রূমে অনেক লোক ঢুকেছে। ভিনসি জাপা, হেফটি ভাগনার, রলি ওয়ারনার, কয়েকজন অভিনেতা। ওদের যে কেউ লাগিয়ে থাকতে পারে।
রলি ওয়ারনারের নামটা লাফ দিয়ে উঠে এল কিশোরের মনে। রলি-পিটারের সহকারী। বব রডম্যানের বাড়িতে দুর্ঘটনার সবচেয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তি। পিটারকে বসিয়ে দিয়ে নিজেকে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে করছে এ সব?
দরজায় উঁকি দিলেন জাপা। কিশোর আর মুসাকে বললেন, দেরি করছ কেন তোমরা? টিকিট বিক্রি শেষ। একটা সীটও পড়ে নেই। তোমাদেরকে বসার জায়গা দেখিয়ে দেব, এসো।
ড্রেসিং রুম থেকে প্রায় ছুটে বেরোল দুই গোয়েন্দা। দরজা দিয়ে দর্শকরা ঢুকলে সীট নম্বর দেখে তাদের বসানোর ব্যবস্থা করছে একজন লোক। সেই লোকই কিশোর আর মুসাকে বারের কাছাকাছি একটা জায়গা দেখিয়ে দিল। জিনা দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। হাত নেড়ে ওদের ডাকল। বক্স অফিসের কি অবস্থা দেখার জন্যে উঁকি দিল কিশোর। টিকেট কাউন্টারের সামনে এখনও লম্বা লাইন। আশায় আছে লোকগুলো, যদি কোনমতে একটা টিকিট পেয়ে যায়!
সাংঘাতিক ব্যবসা হবে মনে হচ্ছে, যে লোকটা ওদের সীট দেখিয়ে দিয়েছে। তাকে বলল কিশোর। ঘরভর্তি লোকের সামনে মঞ্চে উঠে অভিনয় করতে কেমন লাগবে, ভাবতেই রোমাঞ্চিত হলো সে।
তিন মাসের জন্যে বুকড হয়ে গেছে শো, জবাব দিল লোকটা। অথচ এখনও প্রিভিউ চলছে, আসল শো শুরুই হয়নি। অর্ডারের পর অর্ডার আসছে। কে ভেবেছিল এই কাণ্ড হবে এ হপ্তায়? আগে তো মরেই ছিল।
চলে গেল লোকটা।
জিনা বলল, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকের কথা শুনছিলাম। পিটারের অ্যাক্সিডেন্টের কথাই বলাবলি করছে সবাই। যেন শো দেখতে নয়, দুর্ঘটনা দেখতে এসেছে। ঘটলে খুশি হবে। কখন ঘটবে তার অপেক্ষা করবে। হায়রে মানুষ।
মুসা বলল, যে কোন ধরনের বিজ্ঞাপন শো-র জন্যে ভাল।
একটা লোকের ওপর বার বার আঘাত আসছে, মরেও যেতে পারে, এটাকে বিজ্ঞাপন বলো! তুমিও তো মনে হচ্ছে মনে মনে চাইছ অ্যাক্সিডেন্ট থোক!
কমতে শুরু করল আলো। চুপ হয়ে গেল দর্শকরা। অর্কেস্ট্রা বাজতে শুরু করল।
অভিনয় দেখতে দেখতে যেন অন্য এক জগতে চলে গেল কিশোর। ভুলে গেল সে গোয়েন্দা, অভিনয় নয়, তদন্ত করতে এসেছে এই থিয়েটারে।
.
মধ্যবিরতির পর স্টেজের পেছনে এসে উঠল সে, জিনা আর মুসা।
পিটারকে দেখে জিনা বলল, আপনি সত্যি ভাল অভিনয় করেন, পিটার।
মুখ তুলে হাসল পিটার, থ্যাংকস। বাধাটা যে পুরোপুরি ভেঙে দিলাম সেটা কেমন লাগল?
বাধা…
মুসা কথাটা শেষ করার আগেই মাথার ওপর কি যেন নড়ে উঠল। ঝট করে মুখ তুলে তাকাল কিশোর। পরক্ষণেই এক হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল পিটারকে।
ফ্লাই এরিয়া থেকে ভারি একটা কাঠের দরজা খসে পড়ল। আরেকটু হলেই লাগত পিটারের গায়ে। মেঝেতে পড়ার আগেই আটকে গেল, ওপরের অংশটা দুটো দড়ি দিয়ে বাঁধা।
স্টেজে ছুটে এল জাপা। চিৎকার করে ডাকল নিরুকে।
পর্দার আড়াল থেকে মাথা বের করল নিরু।
এটা কি! দরজাটা দেখিয়ে বললেন জাপা।
আমি কি করে বলব?
কি করে বলবে মানে?
কিউটা তো আপনিই দিলেন। আপনার কথামতই কাজ হয়েছে।
ক্ষণিকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন সবাই। জাপাকে দেখে মনে হচ্ছে ফেটে পড়বেন। এমন ভঙ্গিতে এগোলেন নিরুর দিকে, যেন কথা বললেই মেরে বসবেন। চোখের মাথা খেয়ে বসেছিলে? আমি তো ছিলাম পর্দার আড়ালে, দেখেছি নাকি কি ঘটছে? তুমি তো দেখেছ। আমি বললেই তুমি শুনবে কেন? উফ্, আর কত! বিরক্ত হয়ে গেছি এ সব অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে!
আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? কিউ দেয়ার মালিক আপনি, আমরা আপনার কথামত কাজ করি। ইচ্ছে করে কি আর ফেলেছি? না পারলে আপনি বরং চলে যান, অন্য কেউ আসুক। অ্যাক্সিডেন্টগুলো আপনার জন্যেই হচ্ছে।
চড় মারার জন্যে হাত তুললেন ম্যানেজার।
তাড়াতাড়ি তাঁকে ধরে ফেলল চারজন শ্রমিক। শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল।
নিরুর দিকে তাকিয়ে ফুঁসতে লাগলেন জাপা, তুমি কি করে চাকরি করো এখানে দেখে নেব! সব শয়তানি তোমার! সমস্ত শয়তানির মূলে তুমি!
যান যান, যা করতে পারেন করুনগে! নিরুও জাপার হুমকির তোয়াক্কা করল না। •
ঠেলতে ঠেলতে স্টেজের দরজা দিয়ে ম্যানেজারকে বের করে নিয়ে গেল লোকেরা।
তার পেছনে চলল কিশোর, মুসা আর জিনা। যে পরিমাণ খেপেছেন জাপা, তাঁকে দিয়ে আপাতত আর কাজ হবে না, বাকি নাটকটা চালানোর দায়িত্ব অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হলো।
কিশোর দেখল, দরজায় লাগানো পেগবার্ড পরীক্ষা করছে টোপাজ। খুব ভাল। অফিসের চাবি ফেরত দিয়ে যেতে ভুলে গেছে ম্যানেজার। বিড়বিড় করল সে।
মুসা আর জিনাকে টেনে সরিয়ে আনল কিশোর। ফিসফিস করে বলল, ভুলে যায়নি।
মানে? দুজনেই হাঁ।
পকেট থেকে খাটো একটা চেনসহ চাবি বের করে দেখাল কিশোর, রেখেছিলেন ঠিকই। গোলমালের সুযোগে আমি সরিয়ে ফেলেছি। জাপার অফিস খুঁজে দেখব। জানার চেষ্টা করব অ্যাক্সিডেন্টগুলোর মূলে তিনিই কিনা।
.
মুসার টর্চের আলো ঘুরে বেড়াতে লাগল অফিসঘরে। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। চুরি করে থিয়েটারে ঢোকার আগে কাউকে চোখে পড়েনি তার।
হঠাৎ বলল ফিসফিস করে, শুনছ?
শুনছি, জবাব দিল কিশোর। তোমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ। দেখি, আলোটা আরেকটু ফেরাও তো এদিকে।
কিশোরের হাতের ফোল্ডারটার ওপর আলো ফেলল মুসা। কভারে লেখা: পারসোনাল।
নিরু ওয়ারনারের ফাইল।
কি লেখা? জানতে চাইল মুসা।
বারের মধ্যে গোলমাল করার অপরাধে একবার অ্যারেস্ট হয়েছিল। আরও খানিকক্ষণ দেখে ফাইলটা বন্ধ করে ফেলল কিলোর। আর কিছু নেই। তিনসি জাপার ফাইলে সন্দেহ করার মত কোন তথ্য নেই। তবে টোপাজের ফাইলে আছে। একটা অপরাধে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। জামিনে মুক্তি দিয়েছে। নিয়মিত হাজিরা দিতে হয় থানায়।
আর কিছু?
নাহ্, মাথা নাড়ল কিশোর। চলো, বেরোই। ফাইলটা ফোল্ডার কেবিনেটে রেখে দিল সে।
বেরোনোর সময় বা হাতে দরজার হাতল ধরে টানল।
গ্রাউন্ড ফ্লোরের নিচের তলায় অর্থাৎ মাটির নিচে রয়েছে ওরা। পা টিপে টিপে এগোচ্ছে। সিঁড়ির রেলিঙ ধরতেই উহ্ করে উঠল। বাঁ হাত চুলকাতে শুরু করল।
কি হলো? জানতে চাইল মুসা।
চুলকানি। দুটো ধাপ উঠল কিশোর। আরও বাড়ল চুলকানি। আরি, বাড়ছেই তো! অসহ্য!
আশ্চর্য! বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। এখানে চুলকানির বিষ এল কোত্থেকে? বিছুটির ব-ও তো নেই কোথাও।
এই জিনিসই যে পিটারের কাপড়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছিল, সন্দেহ রইল না কিশোরের। মনে হচ্ছে জাপার পপকর্নের ঠোঙায়…
…ছিল এই বিষ! বাক্যটা শেষ করল মুসা।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে তাকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, তোমার চুলকাচ্ছে?
না।
তাহলে দরজার হাতলে লেগে ছিল, রেলিঙে নয়। কোন ভাবে লাগিয়ে ফেলেছেন জাপা…।
ভোঁতা একটা শব্দ হলো।
এটা কিন্তু আমার হার্টের নয়! কান পাতল মুসা।
বাঁ দিক থেকে আসছে। চলো, দেখি?
জাপার কম্পিউটারের দিক থেকে আসছে শব্দটা। দৌড়ে এল দু-জনে। মনিটরের জ্বলন্ত পর্দা ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। টর্চ জ্বালল মুসা।
জলদি নেভাও! ধমক এল পেছন থেকে।
ফিরে তাকাল দুই গোয়েন্দা।
মনিটরের পর্দার হালকা আভায় পিস্তলের চকচকে নলটা চিনতে ভুল হলো না ওদের।
.
১৩.
হাত তোলো! সাবধান, কোন চালাকি নয়। আদেশ এল কঠোর কণ্ঠে।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল কিশোর আর মুসা। ওদের সামনে পিটারের ড্রেসিং রূম। সামান্য ফাঁক হয়ে আছে।
ওই দরজা দিয়ে ঢোকো! আবার আদেশ।
পা দিয়ে ঠেলে পাল্লা খুলল কিশোর। নিয়ন আলোয় আলোকিত একটা ছোট ঘড়ি রাখা পিটারের ড্রেসিং টেবিলে, গোলাপী আভা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে।
সুইচ টেপার শব্দ হলো। উজ্জ্বল আলো জ্বলে উঠল।
গলা শুনেই লোকটাকে চিনেছে কিশোর। হাতে ৩৮ ক্যালিবারের রিভলভার। নুরিখ টোপাজ।
হাতের চুলকানি বন্ধ হয়নি কিশোরের।
তাহলে তোমরাই! টোপাজ বলল।
চট করে কিশোরের দিকে তাকিয়ে নিল মুসা। আমরা মানে? বুঝতে পারল না।
রিভলভারে শক্ত হলো টোপাজের আঙুল। বলেছি না আমার সঙ্গে চালাকি। করবে না। কম্পিউটারটাতে তোমরাই গোলমাল করে রেখেছ। হাত দিতে দেখেছি।
আমরা নই!
পুলিশকে বোলো, এ কথা। রিভলভারটা তাক করে ধরে রেখে ফোনের দিকে হাত বাড়াল টোপাজ।
পুলিশকে বোঝানো মোটেও কঠিন হবে না, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। সমস্যা আপনারই বেশি হবে। থানায় যে অফিসারের কাছে হাজিরা দিতে যান, তিনি যদি শোনেন আপনার কাছে একটা বেআইনী অস্ত্র আছে, খুশি হবেন না নিশ্চয়।
অন্ধকারে আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিল কিশোর, লেগে গেল। চমকে যেতে দেখল টোপাজকে। রিভলভারের ভয় আর করল না, সিংকের কাছে এগিয়ে গিয়ে কলের মুখ ছেড়ে ঠাণ্ডা পানি দিতে লাগল হাতে।
ফোনের ওপর স্থির হয়ে গেছে টোপাজের হাত। তুমি জানলে কি করে?
রিভলভারটার কথা অনুমান করেছি, হাসল কিশোর। তবে অপরাধ যে একটা করেছেন, এটা জানি।
রিভলভার নামাল টোপাজ। যাও, ভাগো! এবারের মত ছেড়ে দিলাম।
কিন্তু আমরা ছাড়লে তো? সুযোগ পেয়ে গেল মুসা। কম্পিউটারের কাছে আপনি কি করছিলেন?
আমি এখানে গার্ডের চাকরি করি। যেখানে খুশি যাওয়ার অধিকার আমার আছে। স্টেজের ডানে চেয়ারে বসে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ জেগে গেলাম। দেখি কম্পিউটারের সামনে একটা ছায়া নড়াচড়া করছে। তোমাদের টর্চের আলো দেখে দিল দৌড়…
কি ধরনের ছায়া? জানতে চাইল কিশোর।
দুজনের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিল টোপাজ। খাটো, তোমাদের মত নয়। রোগা, সেটাও তোমাদের মত নয়।
তার মানে আমরা নই, মুসা বলল, বুঝলেনই তো। আর কিছু বলার আছে?
দেখো, আমাকে যা-ই ভাব তোমরা, একটা কথা বিশ্বাস করো, এই থিয়েটারটাকে সত্যি ভালবাসি আমি। এর কোন ক্ষতি চাই না। দয়া করে যদি এখন বলো, এত রাতে এখানে কি করছিলে, খুশি হব। পিটারের বন্ধু সেজে আসলে কি করছ বলো তো?
কিশোরের দিকে তাকাল মুসা। জবাব দিতে দ্বিধা করছে।
একটা মুহূর্ত ভাবল কিশোর। মাথা ঝাঁকাল। মিস্টার টোপাজ, আপনাকে বলতে রাজি আছি। তবে কথা দিতে হবে গোপন রাখবেন…
চোখ উজ্জ্বল হলো টোপাজের, তারমানে তোমরাই সেই গোয়েন্দা!
অবাক হবার পালা কিশোরের। হাত চুলকানি বন্ধ করল।
মুসা জানতে চাইল, আপনি জানলেন কি করে?
কেউ বলেনি। পত্রিকায় পড়েছি।
অসম্ভব! বলে উঠল কিশোর।
তাহলে নিজের চোখেই দেখো। ভাঁজ করা একটা পত্রিকার পাতা প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে টেনে বের করল টোপাজ। দেখো, লিখেছে; গোপন সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে দুজন গোয়েন্দা গোপনে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজছে, তদন্ত চালাচ্ছে থিয়েটারে। মুখ তুলল ডোরম্যান, খবরটা পড়ে অবাক হয়েছি। ভাবছিলাম, কে হতে পারে?
এখন তো জেনে গেলেন। কাউকে বলবেন না আশা করি।
না, বলব না। তোমরা যে তদন্ত করছ, তাতে খুশিই হয়েছি। বললাম না, থিয়েটারটাকে ভালবাসি।
থ্যাংক ইউ। কিছু মনে না করলে একটা সাহায্য করুন আমাদের।
কি সাহায্য?
প্যান্টের পেছনে ডলে ভেজা হাত মুছল কিশোর। আসুন আমার সঙ্গে।
ড্রেসিং রূম থেকে বেরিয়ে কম্পিউটারের দিকে এগোল সে। টোপাজকে বলল, ওটা একবার দেখব।
দেখো।
মুসা এগোল কিশোরের পেছনে। অফিসের দিকে চলে গেল টোপাজ।
কিউর একটা তালিকা দেখা গেল মনিটরের পর্দায়। ওপরে লেখা: এডিট মোর।
এ তো গ্রীক ভাষা মনে হচ্ছে আমার কাছে, মুসা বলল।
কিংবা বলো গ্রীক বিয়োগান্তক নাটক।
নাকি শেকসপীয়ারের ট্র্যাজেডি?
এই কুসংস্কারের আলোচনা বাদ দাও তো, মুসা। বাস্তব কথা বলো। প্রমাণ দরকার এখন আমাদের।
নম্বর আর কোডগুলো তো পাগলের পাগলামি মনে হচ্ছে আমার কাছে। কি করে বুঝবে এ সবের মানে?
বোঝার দরকার নেই এগুলো। আমি দেখতে চাইছি অন্য জিনিস।
কয়েক মিনিট পর উঠে দাঁড়িয়ে কিশোর বলল, গণ্ডগোল করে রাখা হয়েছে এখানে।
টোপাজকে বলে থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এল দুই গোয়েন্দা। গার্ডের সন্দেহ জাগতে পারে এই ভয়ে পার্কিং লট থেকে দুরে রাস্তার ধারে পিকআপ রেখেছে কিশোর। সেদিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ টের পেল, হাতের চুলকানি চলে গেছে। পানিতে সেরেছে বোধহয়।
খবরের কাগজওলারা আমাদের কথা জানল কি করে? প্রশ্ন করল মুসা।
মুখ ফসকে বলে দিয়েছে হয়তো পিটার।
বলেছে যে এ কথা আমাদের জানানো উচিত ছিল।
হয়তো জানাতে চায়নি। এ সবে সে-ও জড়িত থাকতে পারে। দুর্ঘটনায় যদি আহত হয়ে বসেও থাকে, তাহলেও ক্ষতি নেই তার। অভিনয় বন্ধ থাকলেও বেতন দিতে হবে তাকে, সেরকমই চুক্তি হয়েছে।
ভেবে বলল মুসা, কিন্তু বসে থাকার মত লোক মনে হয় না পিটারকে। কাজ করতেই ভালবাসে সে।
আমি ভাবছি কম্পিউটারটাকে স্যাবটাজ করল কে?
ভিনসি জাপা নন তো?
কিন্তু তিনি হলে রাতের বেলা চুরি করে ঢুকে করতে যাওয়ার দরকার কি? দিনের বেলা সবার সামনেই পারেন, কম্পিউটারে তিনি হাত দিলে কেউ সন্দেহ করবে না। তা ছাড়া আমাদের কাছে বলেছেন, প্রোগ্রামিং করতে জানেন না।
আরও একটা ব্যাপার, মোটেও খাটো কিংবা রোগা নন তিনি।
ঠিক, মাথা ঝাঁকাল কিশোর, ও রকম লোক কে আছে থিয়েটারে? কাকে কাকে চিনি আমরা?
এক মুহূর্ত চুপ করে ভাবল মুসা। তারপর বলল, শুধু শরীর স্বাস্থ্যে মিললেই হবে না, তাকে প্রোগ্রামিংও জানতে হবে, তাই না? কোন ধরনের পেশাজীবী কম্পিউটার বেশি ব্যবহার করে? গবেষক, লেখক
ছাত্র, বাদক…
থমকে দাঁড়াল কিশোর, বাদক!
রবিনকে প্রায়ই বলতে শুনি, কম্পিউটারে ড্রাম ট্র্যাকস প্রোগ্রাম করে ড্রামাররা, নানা রকম বাদ্যযন্ত্র…
জানি। থিয়েটারে ও রকম একটা লোককেই চিনি। ফ্ল্যাশ-পটের খুব কাছাকাছি ছিল, অথচ বিস্ফোরণে গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি।
খাইছে! তাই তো! জাহির বিলিয়ার্ড!
তাহলে বুঝলে তো, শেকসপীয়ারের ভূত ঘটাচ্ছে না এ সব অঘটন!
.
১৪.
গারবার থিয়েটারের পার্কিং লটে যখন গাড়ি রাখল কিশোর, সকালের রোদ ঢুকছে তখন জানালা দিয়ে।
আমার মনে হয় না কাজটা করতে পারব, মুসা বলল। যতই প্র্যাকটিস করাক।
পারবে, হাই তুলতে তুলতে বলল কিশোর। অনেক রাতে ঘুমিয়েছে। তারপর তোরে উঠেছে আবার। থিয়েটারে এসেছে প্র্যাকটিস করতে। ওরা নতুন লোক। সেজন্যে বেশি প্র্যাকটিস করতে হচ্ছে। জোর রিহার্সাল চলছে।
গাড়ি থেকে নেমে থিয়েটারের দিকে এগোল দুজনে।
কিন্তু এ ভাবে না ঘুমিয়ে আর কতদিন চালাব? মুসার প্রশ্ন।
কে যায় চালাতে? তুমি কি ভাবছ স্টেজে গিয়ে বীচবল খেলতে ভাল লাগবে আমার? একটুও না। কেসটার একটা কিনারা করতে পারলেই পালাব। তোমার আগে ঘুম থেকে উঠেছি আমি আজ। রবিনকে ফোন করেছি। ওকে টেনে তুলেছি বিছানা থেকে।
গালাগাল করেনি?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। করেছে। গাড়িতে করে রাত তিনটেয় ফিরেছে সান ফ্রানসিসকো থেকে। প্রথমে তো ঘুম জড়ানো স্বরে বকাবকি শুরু করল। কিন্তু জাহিরের কথা যেই বললাম, পুরো সজাগ হয়ে গেল। বলল, আজকে রিহার্সালের পর ওর সঙ্গে লেগে থেকে কিছু বের করার চেষ্টা করবে।
স্টেজ ডোর দিয়ে স্টেজে ঢুকল ওরা। কালো পর্দার আড়ালে জাপার কন্ট্রোল চেম্বারের ভেতর থেকে আসছে কম্পিউটারের কী-র একটানা খটাখট।
মিস্টার জাপা, ডেকে বলল মুসা, আমরা এসে গেছি। তাড়াতাড়িই এলাম, কি বলেন?
খটাখট বন্ধ হয়ে গেল। জবাব নেই।
মিস্টার জাপা? পর্দা সরাল কিশোর।
মনিটরের সামনে বসা পিটার ঘুরে তাকাল। ঠোঁটে আঙুল রেখে কথা বলতে নিষেধ করল ওদের। ফিসফিস করে বলল, চুরি করে এখানে বসেছি, দেখলে আমাকে মেরে ফেলবে!
কণ্ঠস্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, কি করছ?
কম্পিউটার স্ট্যান্ডে রাখা একটা মোটা ফাইল দেখিয়ে বলল পিটার, কিউর হার্ড কপি এটা। কম্পিউটারের নিচের তাকে রেখে দেয় জাপা। কয়েক হপ্তা আগে বানিয়েছে। কোন পরিবর্তন করতে হলে নিজের হাতে করে। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখে নিল সে, অন্য কেউ শুনছে কিনা। তারপর স্বর আরও নামিয়ে বলল, কম্পিউটারের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছি, কোন গোলমাল করা হয়েছে নাকি। সত্যি বলতে কি, জাপাকে এখন সন্দেহ হচ্ছে আমার।
রাগ ফুটল মুসার কণ্ঠে, নিজেই যদি করবেন, তাহলে আমাদের ডেকে আনলেন কেন…
ঠিক আছে, ঠিক আছে, হাত তুলল কিশোর, সন্দেহ যখন হয়েছে, দেখুক। আমাদের না জানলেই কি? পিটার, তুমি কিন্তু ভুল করেছ। আমাদের ওপর যখন তদন্তের দায়িত্বই দিলে, কথা গোপন করা ঠিক হয়নি তোমার। এই বইটার কথা বলা উচিত ছিল।
মাথা কাত করে পিটার বলল, বলেছি তো। কাল রাতে মাথায় এল কথাটা। তোমাদের অ্যানসারিং মেশিনকে মেসেজ দিয়ে রেখেছি। পাওনি?
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর, না। ভাবল, মেশিনটা কি খারাপ হয়ে গেল?
যাই হোক, কথাটা মনের মধ্যে খোঁচাতে থাকল, পিটার বলল। সকালে উঠেই চলে এলাম দেখার জন্যে। হাসল সে। কিছু মনে কোরো না, তোমাদের সাহায্যই করতে চেয়েছি।
কিছু পেলে?
দ্বিধা করল পিটার, না…এখনও পাইনি। তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্বাস করতে পারল না কিশোর। পিটারের আচরণ সন্দেহজনক মনে হলো ওর। নার্ভাস হয়ে আছে। কিছু যেন লুকানোর চেষ্টা করছে। কেন? অসুবিধেটা কি?
করিডরে গলার স্বর শুনে তাড়াতাড়ি কম্পিউটার বন্ধ করে দিল পিটার। বইটা রেখে দিল নিচের তাকে।
জাপা ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এই, তোমরা এসেছে নাকি?
ভেতরে ঢুকলেন তিনি। সঙ্গে এসেছেন হেফটি ভাগনার, আর চারজন অভিনেতা।
এসেছি, হেসে জবাব দিল কিশোর। জিনা একটু পরে আসবে।
আচ্ছা। আসুক। আজ সারাদিন রিহার্সাল চলবে তোমাদের। রাতে স্টেজে উঠতে হবে।
নার্ভাস ভঙ্গিতে কিশোরের দিকে তাকাল মুসা।
মাথা ঝাঁকিয়ে, হেসে অভয় দিল তাকে কিশোর।
.
তবে যত ভয়ই পাক, স্টেজে উঠে অন্য মানুষ হয়ে গেল মুসা। তার মধ্যে যে এতটা ট্যালেন্ট আছে, জানত না। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল দর্শকরা।
পিঠ চাপড়ে দিয়ে জাপা বললেন, চমৎকার। চেষ্টা করলে ভাল অভিনেতা হতে পারবে তুমি।
রাতে বাড়ি ফেরার পথে হেসে বলল জিনা, স্টার তাহলে বনেই গেলে?
কে যায় স্টার বনতে! আমি খেলোয়াড় হতে চাই। স্টেজে নাচানাচি করতে ভাল লাগে না।
চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে কিশোর।
রেডিওটা নাড়াচাড়া শুরু করল জিনা। নব ঘুরিয়ে স্টেশন টিউন করতে লাগল। একটা স্টেশনে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক হচ্ছে…আরেকটাতে বেসবল খেলা…তারপরেরটাতে খবর।
দূর, কোনটাই ভাল না, বিরক্ত হয়ে বলল জিনা। রবিনের কাছ থেকে ভাল কয়েকটা টেপ চেয়ে নিয়ে রেখে দেয়া উচিত গাড়িতে।
রেখে লাভ নেই। মনে করিয়ে দিল কিশোর, গাড়িটা আমার নয়, চাচার। খবরটা দাও তো। গলাটা চেনা মনে হলো!
ঠিকই বলেছে কিশোর। এ তো পিটারের গলা! টেপ করা ইন্টারভিউ হচ্ছে।
গারবার থিয়েটারে বার বার তার ওপর আঘাত আসার কথাই বলছে পিটার ফুলিয়ে-ফাপিয়ে।
সাক্ষাৎকার যে নিচ্ছে সে-ও কম যায় না। বলল, কয়েক দিনেই আপনার যা জনপ্রিয়তা লক্ষ করছি, আর্ট টিলারিকেও তো ছাড়িয়ে যাবেন আপনি। ব্রডওয়েতে তো যাবেনই, সেটা ছাড়িয়েও আরও বহুদূর।
বুঝতে পারছি না কি হবে! দীর্ঘশ্বাস ফেলল পিটার। উইলিয়াম শেকসপীয়ারের ভূত এখন আমার পিছু ছাড়লেই হয়!
হঠাৎ ব্রেক কষল কিশোর।
গতি কমে যাওয়ায় ঝটকা দিয়ে সামনে ঝুঁকে গেল জিনা আর মুসা।
কি হলো? চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
বুঝে গেছি। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল কিশোর।
কি বুঝেছ?
জবাব দেয়ার আগেই পেছনে টায়ারের শব্দ হলো। আরেকটা গাড়ি ব্রেক করেছে।
ফিরে তাকাল ওরা। একটা স্পোর্টস কার।
মুসা বলল, কিছুক্ষণ থেকেই আয়নায় দেখছি গাড়িটাকে! শিওর আমাদের পিছু নিয়েছে!
.
১৫.
অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরল আবার কিশোর। পরের মোড়টায় যেন উড়ে চলে এল পিকআপ।
পেছন পেছন ঠিকই আসতে লাগল গাড়িটা।
স্টিয়ারিং বাঁয়ে কাটল কিশোর। মাটি থেকে লাফ দিয়ে উঠে গেল পিকাপের ডান পাশটা। চিৎকার করে উঠল জিনা।
কোথায় যাচ্ছ? চেঁচিয়ে জানতে চাইল মুসা।
জানি না।
একটা ছোট গর্তে পড়ল চাকা। ঝট করে মাথার ওপরে হাত তুলল মুসা, দেরি করে ফেলেছে। ছাতে ঠোকর খেল চাদি। উফ করে উঠল ব্যথায়। বলল, ভাঙা গাড়িতে চড়ার এই হলো শাস্তি।
গুলির শব্দ হলো পেছনে।
মাথা নামাও! বলে জিনার মাথাটা ড্যাশবোর্ডের নিচে চেপে দিয়ে নিজেও মাথা নুইয়ে ফেলল মুসা।
কিশোরের সে-সুযোগ নেই। কারণ গাড়ি চালাতে হচ্ছে ওকে।
আবার পাশে কাটল সে। নাহ, আর পারবে বলে মনে হয় না। কারণ ও চালাচ্ছে ঝরঝরে পিকআপ, পেছনের গাড়িটা স্পোর্টস কার। গতি বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে ক্ৰমে। বাঁয়ের রকটা মনে হচ্ছে মাইলের পর মাইল লম্বা। পথের পাশে গাছের সারি। ডানেও একই অবস্থা, কেবল মাঝে মাঝে বিশাল বিল্ডিঙগুলোতে ঢোকার জন্যে যেটুকু খোলা। একটা বাড়িকে শপিং মল করা হয়েছে। গেটের কাছে নিওন আলোয় লেখা PARK শব্দটার আলো নেভানো।
পালানোর আর কোন পথ না দেখে তীক্ষ্ণ মোড় নিয়ে সেই গেটের দিকে এগোল কিশোর। হলুদ রঙের একটা CLOSED সাইন, যেন ছুটে আসতে লাগল ওদের দিকে।
কিশোর, কি করছ? চিৎকার করে উঠল জিনা। বলেই দু-হাতে মুখ ঢাকল।
তীব্র ঝাঁকুনি, গেটের কাঠ ভাঙার মড়মড় শব্দ। পার্কিং গ্যারেজে ঢুকে পড়ল কিশোর। র্যাম্পে উঠতে শুরু করেছে পিকআপ। মাথাটাকে সীটের পেছনে চেপে ধরেছে সে।
চারতলায় একটা বইয়ের দোকান আছে, এরই মধ্যে কোনমতে বলল কিশোর।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! মুসা বলল।
ড্যাশবোর্ড আঁকড়ে ধরে আস্তে মাথা উঁচু করে জানালা দিয়ে তাকাল জিনা। ওপরে উঠতে চাও তো? ফাঁদে পড়ব।
দেখা যাক, কিশোর বলল। ঘুরে ঘুরে উঠতে শুরু করল পিকআপ।
বাড়িটা ছয়তলা। ছয়টা তলাই পার হয়ে র্যাম্প থেকে প্রায় লাফ দিয়ে অ্যাসফল্টের ছাদে বেরিয়ে এল গাড়ি। সাদা দাগ দিয়ে ঘর একে চিহ্ন দেয়া রয়েছে। একেকটা ঘরে একটা করে গাড়ি থাকবে। কিন্তু এখন কোন গাড়ি নেই। ওদের বয়ে দেয়াল, তাতে এলিভেটর, কাঁচের ছোট দরজা। ওটার পাশে সিঁড়ি।
পিকআপের ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ কানে আসছে না কিশোরের। ওরা কি একা? রিয়ারভিউ মিররে তাকাল। র্যাম্পের মুখ, যেখান দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা, সেটাকে লাগছে কালো একটা গর্তের মত। পঞ্চাশ ফুট পেছনে।
মনে হয় হারিয়ে দিয়েছি, বলল সে।
তাহলে আর কি? ঝাঁপ দাও ওপর থেকে। রাস্তায় নেমে পড়ি, তিক্ত কতে বলল মুসা। যাওয়ার আর তো কোন উপায় দেখছি না।
ছাদের চারটে কোণের দিকে তাকাল কিশোর।
স্পোর্টস কারটার কোন সাড়া না পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে আবার নামার জন্যে র্যাম্পের দিকে রওনা দিল।
এই সময় নিচ থেকে আলোকিত হতে শুরু করল কালো গর্তটা।
ওরাই আসছে! জিনা বলল।
ব্রেক কষল কিশোর। অ্যাসফল্টের গায়ে ঘষা খেয়ে আর্তনাদ করে উঠল রবারের চাকা।
থামলে কেন? চেঁচিয়ে উঠল মুসা, জোরে চালাও না! সরিয়ে দিতে পারবে ধাক্কা দিয়ে!
কিন্তু কাশি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল পিকআপের ইঞ্জিন।
ইগনিশনে মোচড় দিল কিশোর।
স্টার্ট হলো না ইঞ্জিন।
দুটো হেডলাইটের আলো বেরিয়ে আসতে লাগল র্যাম্পের গর্ত থেকে।
আবার চেষ্টা করল কিশোর। লাভ হলো না।
নেমে পড়ো গাড়ি থেকে! এক হাতে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে আরেক হাতে জিনার হাত চেপে ধরে টান মারল মুসা।
তিনজনেই নেমে দৌড় মারল সিঁড়ির দিকে।
উঠে পড়েছে স্পোর্টস কার। ওটার হেডলাইটের আলো ওদের ওপর পড়ে লম্বা লম্বা কিভুত ছায়া তৈরি করল-পা অস্বাভাবিক লম্বা, মাথা ছোট।
প্রাণপণে ছুটছে ওরা। আর বিশ ফুট যেতে পারলেই
আচমকা ডানে সরে গেল হেডলাইটের রশ্মি। চোখের পলকে সামনে চলে এল কালো রঙের চকচকে গাড়িটা, সামনে দেয়াল তৈরি করে দাঁড়িয়ে গেল। আটকে দিল সিঁড়িতে ঢোকার পথ।
দেখো, আমার কাছে পিস্তল আছে। গর্জে উঠল একটা ভোঁতা কণ্ঠ।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল গাড়ির দুদিকের দরজা।
পিস্তলটা দেখতে পেল কিশোর। কোন রকম প্রতিবাদ না করে মাথার ওপর হাত তুলে দাঁড়াল।
দেখাদেখি মুসা আর জিনাও তাই করল।
গাড়ি থেকে নামল দুজন লোক। স্কি মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকা। যে লোকটা ড্রাইভ করছিল, তার হাতে পিস্তল।
মুসা জিজ্ঞেস করল, কে আপনারা?
ইটের গাঁথনি তুলে দেয়াল তৈরি করে ঘিরে দেয়া হয়েছে ছাতের চারপাশ। একদিকের দেয়াল দেখিয়ে পিস্তল নেড়ে ধমক দিল ড্রাইভার। ওদিকে যাও?
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল কিশোরের, ছাদ থেকে আমাদের লাফ দিতে বলবেন নাকি…
যাও বলছিকথা কম! আবার ধমক দিল ড্রাইভার। সঙ্গীকে বলল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছ কি? পিকআপটার ব্যবস্থা করো।
আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে কিশোর। তারপরেও বুদ্ধি ঠিকই কাজ করছে। বুঝতে পারছে, কণ্ঠস্বর আরেক রকম করে কথা বলছে লোকটা। যেন ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় করছে।
দ্বিধা করল অন্য লোকটা। তারপর স্পোর্টস কারের দরজা দিয়ে মাথা ঢোকাল। বের করে আনল দুই বোতল মদ। পিকআপের দিকে এগোল।
কি-ব্ধি করতে চান? তোতলাতে শুরু করল কিশোর, ও-ওটা আমার চাচার গাড়ি!
শব্দ করে হাসল পিস্তলধারী। তাতে কি? মরে গেলে চাচাটাচা কিছু থাকবে না। এগারোটার নিউজে কি বলবে এখনই শুনতে পাচ্ছি আমি: তিনটে ছেলেমেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গাড়ি চালিয়ে মলের ছাদে উঠে পড়েছিল। ছাদের কিনারের দেয়ালে গুতো লাগিয়ে দেয়াল ভেঙে নিচে পড়েছে। তিনজনই মৃত। হাহ হা!
আমরা মাতাল…অসম্ভব…
কথা শেষ করতে পারল না কিশোর। তরল পদার্থ পড়ার শব্দ হলো। ফিরে তাকিয়ে দেখল পিকআপের সীটে মদ ঢালছে লোকটা। ও-কি করছেন? মদ ঢেলে দিচ্ছেন কেন?
এই থামো, সহকারীকে বাধা দিল পিস্তলধারী, সব ঢেলো না। খানিকটা রেখে দাও। ওদের গেলাতে হবে। রক্তে অ্যালকহল লেভেল বেশি দেখতে না পেলে সন্দেহ করে বসবে পুলিশ।
একটা বোতল পুরো ঢেলে শেষ করল অন্য লোকটা। বাকি বোতলটা নিয়ে এগোল ওদের দিকে।
শয়তান কোথাকার… মুঠো পাকাল মুসা। কি করতে চায় লোকগুলো বুঝে ফেলেছে।
থামো, মুসা, বাধা দিল কিশোর, কিছু কোরো না!
পিস্তলটা মুসার মুখের দিকে তাক করে ধরেছে ড্রাইভার। ঠিক। তোমার বন্ধু যা বলছে, করো!
চুপ হয়ে গেল মুসা।
যা বলছি করো, আবার বলল পিস্তলধারী, তাতে ব্যথা কম পাবে। হয়তো টেরই পাবে না কিছু। বোতলের মুখ খুলে দেয়ার জন্যে ইশারা করল সঙ্গীকে। মুসাকে খেতে বলল প্রথমে।
বিড়বিড় করছে জিনা। প্রার্থনাই করছে বোধহয়।
মুসার ঠোঁটের কাছে বোতলের মুখ ঠেকাল লোকটা 1 দাতে দাঁত চেপে রেখেছে মুসা! তাকিয়ে আছে পিস্তলটার দিকে। কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আস্তে করে ঠোঁট ফাঁক করল।
হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ হলো। পাই করে সেদিকে ঘুরল পিস্তলধারী। কে এল। আবার…
সুযোগটা ছাড়ল না জিনা। মাথা নিচু করে ছুটে গেল লোকটার দিকে। কঁধ দিয়ে ধাক্কা মারল পেটে, বেল্টের সামান্য ওপরে। একই সঙ্গে থাবা চালাল পিস্তল ধরা হাতে।
বিস্ময় এবং ব্যথায় ছোট্ট একটা আর্তচিৎকার বেরোল লোকটার গলা থেকে। হাত থেকে উড়ে গেল পিস্তল।
অ্যাসফন্টের ওপর খটাং করে পড়ল ওটা। পড়ার আগেই ধরার জন্যে ডাইভ দিয়েছে মুসা। ধরে রাখতে পারল না। হাতের ঠেলা লেগে দূরে গিয়ে পড়ল পিস্তলটা। আনার জন্যে এগোতে যাবে, এই সময় চিৎকার করে বলল কিশোর, মুসা, লাগবে না।
ফিরে তাকিয়ে মুসা দেখল, তাড়াহুড়ো করে গিয়ে গাড়িতে উঠছে লোকগুলো। দরজা টেনে ধরে রেখেছে কিশোর আর জিনা, যাতে বন্ধ করতে না পারে। মুসাকেও ডাকল কিশোর।
স্টার্ট দিয়ে সরে যেতে লাগল স্পোর্টস কার।
র্যাম্পের মুখ দিয়ে বেরোল আরেকটা গাড়ি। একটা লাল পুরানো ফোক্সওয়াগেন।
রবিন! অবাক হয়ে গেল কিশোর।
প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি রবিন। যেই বুঝল, নাক ঘুরিয়ে তেড়ে গেল স্পোর্টস কারটাকে।
পিকআপে উঠে পড়ল কিশোর, মুসা আর জিনা। এইবার ইগনিশনে মোচড় দিতেই স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। সোজা র্যাম্পের মুখের দিকে গাড়ি ছোটাল কিশোর।
নাকে আসছে অ্যালকহলের কড়া গন্ধ। এই ভয়াবহ উত্তেজনার মধ্যেও দেখতে পাচ্ছে মেরিচাচীর বিস্মিত মুখ। বাড়িতে কেউ মদ খায় না। একটু আধটু অভ্যাস যা। ছিল রাশেদ চাচার, সেটাও ছাড়িয়েছেন চাচী। কিশোর খেয়েছে, এটা যদি মাথায় ঢোকে তার বাকিটা আর ভাবতে চাইল না কিশোর!!
র্যাম্পের মুখে বাধা সৃষ্টি করা গেল না, তার আগেই ঢুকে পড়ল স্পোর্টস কার। তীব্র বেগে নেমে যেতে লাগল। পেছনে লেগে রইল পিকআপ আর ফোক্সওয়াগেন।
নিচে তিরিশ গজ দূরে লাল একটা সাইন দেখা যাচ্ছে: ENTRANCE ONLY তার ওপাশে রাস্তা।
ধ্যাত্তোর! গেল চলে! হতাশায় ড্যাশবোর্ডে দুম করে কিল মারল মুসা।
কিন্তু গতি না কমিয়ে বেরোতে গিয়েই ভুলটা করল ড্রাইভার। যে পথ ধরে নামছিল, তার গোড়াটা ঢালু হয়ে গিয়ে হঠাৎ করেই সোজা হয়ে গেছে। সেটাতে সামনের চাকা পড়তেই সাংঘাতিক ঝাঁকুনি লাগল। বলের মত ড্রপ খেয়ে ওপরে উঠে গেল গাড়ি। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দুপাশের দরজা। বাইরে ছিটকে পড়ল দুই আরোহী। গাড়িটা সরে চলে গেল।
ব্রেক কষল কিশোর। পড়ে থাকা দুটো দেহের দশ ফুট দূরে এসে থামল পিকআপ।
একধাক্কায় দরজা খুলে ফেলে লাফিয়ে নেমে দৌড় দিল কিলোর। অন্যপাশ দিয়ে নামল মুসা আর জিনা।
পিকআপের পেছনে ফোক্সওয়াগেন থামিয়ে রবিনও নেমে পড়ল।
নিথর হয়ে পড়ে আছে দুটো দেহ।
নিচু হয়ে টেনে একজনের মুখোশ খুলে ফেলল কিশোর।
টান লেগে ডান থেকে বায়ে কাত হয়ে গেল রলি ওয়ারনারের মুখটা।
অন্য লোকটার মুখোশ খুলল রবিন।
ভিনসি জাপা!
.
১৬.
আতঙ্কিত দৃষ্টিতে দেহ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে জিনা। মরে যায়নি তো?
ওদের নাড়ি দেখল কিশোর। না। তবে অবস্থা ভাল না। আঘাত ভালইলেগেছে।
তাহলে তো অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দেয়া দরকার; মুসা বলল। বাড়িতে ঢোকার মুখেই একটা টেলিফোন আছে। সেটার দিকে দৌড় দিল সে।
আশ্চর্য! মাটিতে বসে পড়েছে জিনা। রলিকে আমি বরাবরই সন্দেহ করেছি, কিন্তু ম্যানেজারকে খুব ভাল মানুষ মনে হয়েছে!
আরও আশ্চর্য হওয়ার মত খবর আছে আমার কাছে, রবিন আর জিনা দুজনের দিকে তাকাল কিশোর। ওরা দুজনই শুধু নয়, এর মধ্যে আরও লোক জড়িত। মিউজিশিয়ানদের লকার খুঁজতে গিয়ে জাহিরের সম্পর্কে কি পেয়েছি দেখো, জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বের করে দিল সে।
ভেতর থেকে একটা হলদে ভাজ করা কাগজ বের কর কিশোর। তাতে নম্বর আর তথ্য ভরা। এগুলো কিউ এবং কিউ নম্বর। সে-রাতে আমি যেগুলো দেখলাম কম্পিউটারে, গোলমাল করা, সেগুলোও আছে এতে।
তারমানে জাহিরও আছে এর মধ্যে, জিনা বলল। কিন্তু কেন?
আবার ভাঁজ করে কাগজটা খামে ভরে নিজের পকেটে রেখে দিল কিশোর। প্রশ্নের জবাব জানতে চাইলে আরও গভীরে যেতে হবে আমাদের। পালের গোদাটাকে খুঁজে বের করতে হবে।
টেলিফোন সেরে ফিরে এসে মুসা জানাল, অ্যাম্বুলেন্স আসছে।
রবিন জিজ্ঞেস করল কিশোরকে, মনে হয় গোদাটা কে জানা আছে তোমার?
পিটারের ওপর বার বার আক্রমণ. এলে একটা লোক সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে, থামল কিশোর। এক এক করে তাকাল সবার মুখের দিকে। এ ভাবে শ্রোতাদের ঝুলিয়ে রেখে মজা পায় সে। চিরকালের অভ্যাস।
কে? জানতে চাইল মুসা।
খুলেই বলি, দাঁড়াও। গাড়ির রেডিওতে খবরটা শোনার পর ব্যাপারগুলো খাপে খাপে বসে গেল আমার মাথায়। পিটারের কথা শুনে মনে হতো, অ্যাক্সিডেন্ট ঘটায় খুশিই হয়েছে সে নইলে এমন করে টিকিটও বিক্রি হত না, তারও কাজ থাকত কিনা সন্দেহ।
ওসব তো জানি আমরা, অধৈর্য হয়ে জিনা বলল। পিটার ব্রডওয়েতে যাবে, আরও ওপরে উঠবে। খ্যাতির চূড়ান্তে চলে যাবে। তাতে আমাদের কি? আসল লোকটা কে বলো?
খ্যাতির লোভ বড় লোভ, সেই সঙ্গে যদি টাকা আসে তাহলে তো কথাই নেই। পিটার হাইয়েমের কাছে এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার আছে: যা যা করেছে সে, তাতে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। নিজের গুণগান প্রচার করার লোক নিজে ঠিক করেছে সে। ডেভন কলিনের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজেই নিজের বিজ্ঞাপন করেছে, নির্লজ্জের মত নিজের প্রশংসা করেছে। জোর করে টিকে থাকতে চেয়েছে নাটকটাতে…।
লোকটার মাথায় যে ছিট আছে, সে তো জানিই আমরা, মুসা বলল। নিজের সম্পর্কে বড় বেশি উঁচু ধারণা। কিন্তু এ সব বলে কি বোঝাতে চাইছ তুমি?
অ্যাক্সিডেন্টগুলো ঘটার আগে টিকিট বিক্রি হত না, মরেই যেত হয়তো শো টা। দর্শক না থাকলে কাকে দেখাবে? কিন্তু পরে, দুই হপ্তার মধ্যে সাংঘাতিক হিট হয়ে গেল, অথচ এখনও ওপেনিঙের ঘোষণাই দেয়া হয়নি। এই পরিবর্তনটা কেন ঘটল?
খবরের কাগজ আর টিভি-রেডিয়ো ঘটিয়েছে ঘটনাটা, জবাব দিল মুসা, এ তো জানা কথা। এমন প্রচার শুরু করল..
একদম ঠিক, এক আঙুল তুলল কিশোর। কাগজগুলো পেয়ে গেল মজা। যেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে, অমনি ফলাও করে ছেপে দেয়। থিয়েটারে তাদের কোন রিপোর্টার ওই সময় না থাকলেও খবরটা ঠিকই পেয়ে যায়।
তারমানে, রবিন বলল, কেউ খবরটা পাঠিয়ে দেয় ওদের।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। এমন কেউ পাঠায়, যার কাছে বিজ্ঞাপন আর প্রচার একটা বিরাট ব্যাপার। সে জানে, এই একটা মাত্র জিনিসই তার চাকরি বাঁচাবে।
বুঝেছি! পিটার! বলে উঠল মুসা।
ভেবে দেখো, মুসার কথা যেন কানেই ঢোকেনি কিশোরের, তুমি একজন তরুণ অভিনেতা, একটা নাটক করছ যেটার সফল হওয়ার সম্ভবনা আছে। সারা জীবন একটাই স্বপ্ন তোমার, একটা নাটক হিট হোক। কিন্তু কাজটা করতে গিয়ে দেখলে কোন কারণে টিকিট বিক্রি হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে যেতে পারে.নাটক। তাহলে কাজ চলে যাবে তোমার। আবার সেই ভাতেমরা অভিনেতায় পরিণত হবে, না খেয়ে থাকতে হবে। কি করবে তখন?
হাত ওল্টাল মুসা, কি আর করব? মোটর মেকানিকের কাজ নেব।
আরে দূর, তোমার কথা কে বলছে, একটা উদাহরণ দিচ্ছি, কিশোর বলল। তুমি তখন চাইবে নাটকটার উন্নতি, যে ভাবেই হোক। ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড দেখতে এখন কেন যাচ্ছে লোকে? নাটক দেখতে যতখানি, তার চেয়ে বেশি পিটারের দুরবস্থা দেখতে। আশা করছে একটা অক্সিডেন্ট ঘটবেই।
হু, মাথা দোলাল মুসা, বুঝতে পারছি।
আমার কিন্তু সে-রকম মনে হয় না, জিনা একমত হতে পারল না। নিজের ওপর নিজে দুর্ঘটনাগুলো কি করে ঘটাল সে?
সে তো ঘটায়নি, কিশোর বলল। হুমকি দিয়ে ফোনঃআসা, চিঠি আসা, এগুলো কেবল তার মুখের কথা, আমাদের কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি সে। চিঠিগুলো কোথায় যখন জানতে চেয়েছি, বলেছে ফেলে দিয়েছে। আমার তো। ধারণা, সব মিথ্যে কথা, ওরকম কোন চিঠি পাইনি সে। দুর্ঘটনা ঘটানোর জন্যে লোক ঠিক করেছে সে-ই। এমন করে সাজিয়েছে, যাতে মনে হবে অল্পের জন্যে বেঁচে গেছে, কিন্তু সত্যি সত্যি কোন ক্ষতি হবে না। থিয়েটারের বাইরে সেদিন যে সাইনবোর্ডটা পড়ল, দেখেছ কোনখানে পড়েছে? পিটার যেখানে দাঁড়ানো ছিল তার চেয়ে কতটা দূরে?
দেখেছি, ক্যামেরার একেবারে চোখের সামনে, যাতে সহজেই ধরা পড়ে। বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে জিনা।
আর ফ্ল্যাশ-পট অ্যাক্সিডেন্টটাও সাংঘাতিক বিপজ্জনক মনে হয়েছে, মুসা। বলল। কিন্তু এমন সময় ফেটেছে, যখন সরে যাওয়ার জন্যে ঘুরেছে পিটার।
রবিন বাল, জাহিব করে থাকতে পারে এ কাজ, অর্কেস্ট্রা পিট থেকে।
জাপার নির্দেশে, যোগ করল কিশোর। যাই হোক, এই ঘটনার পর পিটারের ড্রেসিং রূমে ঢুকেছি আমরা। নিক নামে একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলছিল তখন সে। ব্যাপারটা নিয়ে প্রথমে মাথা ঘামাইনি আমি, যতক্ষণ না তার বিজ্ঞাপন প্রচারকের নামটা মনে পড়ল।
নিক ফ্লিন্ট। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ফ্লাশ-পট অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা প্রচার করে দেয়ার জন্যে তাকে ফোন করেছিল পিটার। এখন বুঝতে পারছি গোপনে, আমাদের তদন্ত করার কথাটা খবরের কাগজকে কে জানিয়েছে। পিটার নিজে। এটাতে আরেকটা বিজ্ঞাপন হয়েছে তার।
ঠিক, কিশোর বলল। আর মনে হচ্ছে কম্পিউটারের দায়িত্বটা ছিল জাহিরের ওপর। চুরি করে থিয়েটারে ঢুকে কিছু কিছু কিউ গোলমাল করে দিত, অবশ্যই জাপার সহায়তায়।
তারপর সে-রাতে টোপাজের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল জাহির, মুসা বলল। আর যেতে সাহস করেনি। তাই বাধ্য হয়ে গোলমাল করার কাজটা নিজেই করতে গেল পিটার।
কিংবা হয়তো দেখতে গিয়েছিল আজ সকালে, জাহির ঠিকমত সব করতে পেরেছে কিনা। কোন কিউটাতে দুর্ঘটনা ঘটবে, এটা জানা না থাকলে সত্যি সত্যিই দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই আগে থেকে সাবধান থাকতে চাইছিল।
সুতরাং কাল রাত থেকে শুরু করে আজ সকাল পর্যন্ত অনেক ভাবে ওদের বাধা দিয়েছ তোমরা, রবিন বলল। পুরো ব্যাপারটা ফাস হয়ে যাওয়ার ভয়ে শেষে তোমাদের পেছনেই লেগেছিল এরা। মুখ বন্ধ করে দিতে চেয়েছিল।
এক মিনিট, হাত তুলল জিনা। পোশাকে চুলকানির ওষুধ লাগানো আর মূর্তি ফেলার ব্যাপারটা তাহলে কি?
জবাবটা মুসাই দিতে পারল, নতুন পোশাকটা যেদিন পেয়েছে পিটার সেদিনের কথা মনে করো। একটা প্যাকেট হাতে বেরিয়ে গেল জাপা, বলল পপকর্নের প্যাকেট। আসলে তার মধ্যেই চুলকানির ওষুধ বলো আর বিষ বলো, জিনিসটা ছিল। পোশাকে লাগিয়েছিল সে-ই। তুমি যখন পোশাকটা ধরতে গেলে ইচ্ছে করে আয়নাটা ফেলে দিয়ে ভাঙল পিটার, তোমাকে সরানোর জন্যে। নাহলে তুমি ধরে ফেললে তোমারও হাত চুলকানি শুরু হতো। কে লাগিয়েছে হয়তো আন্দাজ করে ফেলতাম আমরা, এই ভয়ে তখন চুলকানির খবরটা জানাতে চায়নি পিটার।
কিশোর বলল, শেকসপীয়ারের মূর্তি ফেলার ঘটনাটা পিটার আর ওলি দুজনে। মিলে ঘটিয়েছে। ববের বাড়িতে যাওয়ার পথেই নিশ্চয় আলোচনা করে ঠিক করেছে, ওখানেও একটা দুর্ঘটনা ঘটাবে। দুজনেই বার্গার খেয়েছে, আঙুলে বনরুটির। তেল লেগেছিল। সেজন্যে মূর্তি আর বাতির সুইচ দুটোতেই লেগে গিয়েছিল ওই তেল। রলি তার ধরে টেনে টেবিল ল্যাম্পের প্লাগ খুলেছে, আর পিটার নিজের গায়ে নিজেই মূর্তি ফেলেছে। আমরা তখন চোখ বন্ধ করে আছি, ফলে কেউই দেখতে পাইনি কিছু।
কিন্তু পিটারের কপালে বাড়ি লেগেছিল, প্রশ্ন তুলল জিনা। আরেকটু হলেই কেটে যেত।
আমার কাছে অবাক লেগেছে, এত জোরে বাড়িটা লাগল, পরদিনই আবার মিলিয়ে গেল, বলল মুসা।
মেকআপ করে করেছিল ওরকম, জবাব দিল কিশোর। পকেটে বোধহয়। লাল মোম রেখে দিয়েছিল, কপালে লাগিয়ে দিয়েছে। নিজের কপাল নিজেই চেপে ধরে রেখেছিল, অন্য কেউ তো আর দেখতে যায়নি আঘাত কতখানি।
টার্নটেবলের ব্যাপারটা কি? আবার প্রশ্ন করল জিনা। একটা নিরপরাধ লোকের পা ভাঙল ওভাবে পিটার?
না, এই কাজটা সম্ভবত জাপা করেছে। টার্নটেবলের দায়িত্বে ছিল সে।
বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা এখনও বুঝতে পারছি না, পিটারের নাহয় স্বার্থ আছে, সে এ সব করেছে, কিন্তু বাকি লোকগুলো? তারা কেন করেছে?
পিটারের মতই রলিরও কাজ হারানোর ভয়। জাহিরেরও টাকার দরকার ছিল। বড় কিছু অভিনেতা আর গায়ক-বাদক ছাড়া সবাই টাকার কষ্টে ভোগে, কাজটাকে পেশা হিসেবে নিলে।
স্টেজ ম্যানেজারেরও নিশ্চয় চাকরি হারানোর ভয়? মুসার প্রশ্ন।
মাথা নাড়ল কিশোর, এই একটা ব্যাপারই বুঝতে পারছি না। স্টেজ ম্যানেজারের চাকরির অভাব হয় না। কাজ জানা লোকের খুব কদর। ওয়াইল্ড ওয়াইল্ডের মত জটিল একটা নাটকের কাজ যাকে-তাকে দিয়ে হবে না। তারমানে জাপা কাজ জানে।
হঠাৎ কপালে ভাঁজ পড়ল মুসার। বুঝলে, টার্নটেবল অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটাও কেমন যেন গোলমেলে। জাপা যদি জানেই পিটার নাচছে, তাহলে ওভাবে অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটাত না। তাকে অচল করে দেয়ার তো ইচ্ছে ছিল না কারোরই।
স্টেজ ম্যানেজার জানত যে লোকটা পিটার নয়, যুক্তি দেখাল জিনা।
মাথা নাড়ল রবিন, তাহলে একজন ভাল ড্যান্সারকেই বা অচল করে দেয়ার কি যুক্তি থাকতে পারে?
জবাবের আশায় কিশোরের দিকে তাকাল তিনজনেই।
শিওর হয়ে আমিও কিছু বলতে পারছি না, কিশোর বলল। তবে জবাবটা কি করে জানা যাবে হয়তো বলতে পারি। উচ্চারণ।
বুঝলাম না, জিনা বলল।
এসো আমার সঙ্গে।
ফোনের কাছে ওদের নিয়ে এল কিশোর। পিটারের নম্বরে ফোন করল। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এল মুসা, রবিন আর জিনা, যাতে ওপাশের কথা রিসিভারে শুনতে পারে।
হালো? পিটারের গলা ভেসে এল।
জাপার নিউ ইয়র্কি উচ্চারণ নকল করে জবাব দিল কিশোর, হ্যাঁ, ভিনস্ বলছি।
ওদেরকে ধরেছ?
ধরেছি।
যাক, বাঁচা গেল। খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ। আমাকে কম্পিউটার ধরতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল কিশোরের। পুরো ব্যাপারটা ফাস করে দিত সে।
হ্যাঁ।
রলির কি খবর? তার ব্যবস্থা করেছ?
থমকে গেল কিশোর। তার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিন সহকারী।
জবাব দাও। চুপ করে আছো কেন? চিন্তায় চিন্তায় আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল!
হ্যাঁ, জবাব দিল কিশোর।
ঠিক আছে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল পিটার। কাল তোমার চেক পেয়ে যাবে।
জাপাও তাহলে টাকার জন্যেই এ কাজ করেছে। বুঝতে পারল কিশোর।
পিটারকেও ধরা, দরকার-ভাবল সে। তবে ফোনে কিছু বলা ঠিক হবে না। সাবধান হয়ে গিয়ে পালাতে পারে।
রাখলাম, ওপাশ থেকে বলল পিটার।
আচ্ছা।
রিসিভার রেখে দিল কিশোর। পিটার কি কি বলেছে, বন্ধুদের জানাল।
রবিন বলল, শেষ প্রশ্নটার জবাবও তাহলে পেয়ে গেলাম।
নীরবে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ-না কিছু বোঝা গেল না।
মুসা বলল, আরেকটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। রলির পেছনে লাগল কেন পিটার?
নিশ্চয় বুলি লেগেছিল পিটারের পেছনে। সে মনেপ্রাণেই চাইছিল পিটার একটা দুর্ঘটনায় পড়ে অকেজো হয়ে যাক, তাহলে তার পালা আসবে। পিটারের জায়গায় অভিনয়ের সুযোগ দেয়া হবে তাকে। সেজন্যে টার্নটেবলের সুইচ টিপেছিল সে। জানত না, পিটারের জায়গায় অন্য লোক নাচছিল তখন। শত্রুর শেষ রাখতে নেই। তাই রলিকে শেষ করে দিতে চেয়েছে পিটার।
দূরে সাইরেনের শব্দ শোনা গেল।
অ্যাম্বুলেন্স আসছে, রবিন বলল।
মাথা ঝাঁকিয়ে আবার রিসিভার তুলে নিল কিশোর, এবার পুলিশকে ফোন করা দরকার। পিটারকে ধরতে হবে। জাহিরকেও।
বিড়বিড় করল জিনা, কি আশ্চর্য! লোভে পড়ে মানুষ কি না করে। অথচ কে ভাবতে পেরেছিল জাপার মত ভদ্রলোক…।
খাঁটি দার্শনিকের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুসা, শুধু চেহারা দেখে কখনোই বিচার করা উচিত নয় কে ভাল লোক, কে মন্দ। তা বটে! মাথা ঝাঁকাল জিনা।
<