…বেরোনোর কোনও পথ পেলাম না, পত্রিকার লোকদেরকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলল কিশোর। তাই আর কি করব? ভাবলাম, লুকিয়েই থাকি। তারপর যা হয় হবে। কাজে লাগল ফন্দিটা। ধোঁকা খেল ব্যাটারা। আমিও বেঁচে গেলাম।
বুদ্ধিমান ছেলে, বলল একজন রিপোর্টার।
কিশোর পাশা বুদ্ধিমানই, হেসে বললেন চীফ ইয়ান ফ্লেচার। নইলে কি আর পুলিশকে সাহায্য করতে পারত?
রিপোর্টারদের সঙ্গে কথা বলছে, একই সাথে পুলিশের ফাইলও ঘাঁটছে কিশোর। রকি বীচ পুলিশের হাতে অ্যারেস্ট হওয়া অপরাধীদের সমস্ত ছবি রয়েছে
ফাইলে। কিডন্যাপারদের চেহারার লোক আছে নাকি ওখানে দেখছে সে।
কি চায় কিচ্ছু বলেনি? প্রশ্ন করল একজন রিপোটার।
অবান্তর প্রশ্ন, বাধা দিয়ে বললেন চীফ। সেটা পুলিশের ব্যাপার। আপনাদেরকে বলার জন্যে নয়। একটু থেমে বললেন, তবে একটা কথা বলতে পারি, মিস্টার রাশেদ পাশা তেমন বড়লোক নন যে তার ভাতিজাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে মস্ত লাভ হবে কিডন্যাপারদের। অন্তত টাকাপয়সার দিক দিয়ে।
মনে মনে চীফের ওপর ভীষণ রেগে গেল রিপোর্টাররা। কিন্তু কিছু করার নেই। কেউ যদি কিছু বলতে না চায় তাকে চাপাচাপি করার অধিকার নেই ওদের। কিশোরের বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ওরা।
ঠিক কিডন্যাপারদের মত কিন্তু লাগেনি ওদেরকে, রবিন মন্তব্য করল।
নতুন কিছু জেনেছেন, স্যার? চীফকে জিজ্ঞেস করল মুসা। ধরা যাবে?
বুঝতে পারছি না। অতটা সহজ হবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু রিপোর্টারদেরকে তো বললেন সাধারণ কিডন্যাপিং।
কিডন্যাপাররা ধরা না পড়া পর্যন্ত মুখ বুজে থাকাই ভাল। এতে কম সাবধান থাকে ওরা। ধরা সহজ হয়।
তা ঠিক, কিশোরও একমত হল। যত কম জানে ততই ধরতে সুবিধে। কিডন্যাপাররা ভাববে আমরা কিছুই জানি না। অসাবধান হবে। সেই সুযোগটা তখন কাজে লাগাতে হবে আমাদের।
ব্যাপারটা কি এখন খুলে বল তো, কিশোর, চীফ অনুরোধ করলেন।
আমাকে অন্য কেউ ভেবে ভুল করেছে ওরা। কোনও দেশের ভি আই পি গোছের কারও ছেলে মনে করেছে। পলিটিক্যাল কারণ হতে পারে। প্রতিশোধ হতে পারে। একজন জিম্মি খুঁজছে ওরা।
হু। নীরবে ভাবলেন কিছুক্ষণ চীফ। তারপর মুখ তুললেন। ভালোয় ভালোয়। যে বেঁচে এসেছ এইই বেশি। ঠিক আছে, এখন যা করার পুলিশই করবে। তোমাকে কয়েক দিন সাবধানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। ইতিমধ্যে লোকগুলোকে ধরে ফেলতে পারব আমরা, আশা করি। তখন আর তোমার ভয় নেই, নিরাপদ। তোমার চাচা-চাচী তো চলে গেছেন। যাবে কিভাবে? পুলিশের গাড়িতে করে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করব?
মাথা কাত করে সায় জানাল কিশোর।
বাইরে বেরিয়েই দেখা গেল রোলস রয়েসটাকে। চারটে গাড়ির পেছনে। ওটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হ্যানসন। দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল। তিন গোয়েন্দা।
আপনি? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
আমাকে যেতে বলা হয়নি, জবাব দিল হ্যানসন। তার মানে ডিউটিতেই রয়েছি আমি। তোমরা যেখানে থাকবে সেখানেই থাকতে হবে আমাকে। তাই আছি। কোথায় যেতে হবে এখন?
বাড়িতে। এক মিনিট দাঁড়ান। বলে দৌড়ে থানার সামনে ফিরে এল। কিশোর। একটা গাড়ি ঘোরানো হয়েছে ওদেরকে নেয়ার জন্যেই। ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিয়ে সে বলল, আর কষ্ট করতে হবে না। ওদের গাড়ি এসে গেছে।
রোলস রয়েসে উঠল তিন গোয়েন্দা। ড্রাইভিং সীট থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরে জিজ্ঞেস করল হ্যানসন, কোথায় যাব?।
র্যাটলস্নেক রোড, শান্তকণ্ঠে নির্দেশ দিল কিশোর।
কোথায়? চমকে গেছে মুসা।
সেই বক্স ক্যানিয়নটায় যাব আবার। হ্যানসন, চালান।
প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। চুপ করে রইল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
র্যাটলস্নেক রোডে যখন পৌঁছল ওরা তখনও কড়া রোদ। গাড়িতে তালা লাগিয়ে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হ্যানসনও চলল ঝোপের ভেতরে লুকান পথ ধরে। পঁচিশ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেল ক্যানিয়নে, যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিশোরকে।
আমি ভেতরে খুঁজব, বলল সে। তোমরা কেবিনটার বাইরে খোঁজ। দেখ। কোনও সূত্র পাও কিনা।
আমি কেবিনের ভেতরে অনেকক্ষণ ছিলাম, বলল সে। কিছু থাকলেও এখন। আর চোখে পড়বে না আমার। মুসা, তুমি আর হ্যানসন ভেতরে খোঁজ। বাইরের চারপাশটায়ও ঘুরে দেখবে। আমি আর রবিন যাচ্ছি হেলিকপ্টারটা যেখানে নেমেছিল সেখানে।
কিন্তু খুঁজবটা কি? রবিনের প্রশ্ন।
আমারও সেই কথা, মুসা বলল।
যে কোনও সূত্র, জবাব দিল কিশোর। লোকগুলো কে, কোত্থেকে এসেছে, কি চায়, এখনই বা কোথায় গেল, এসব। এমন কিছু মিলতেও পারে যা থেকে এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে।
ধীরে ধীরে পর্বতের ওপাশে হারিয়ে গেল সূর্য। লম্বা ছায়া পড়ল গিরিখাতের ভেতরে। কেবিনের ভেতরে বাইরে সমস্ত জায়গায় খুজল মুসা আর হ্যানসন। কিছু পেল না। রবিন আর কিশোরও কিছু পেল না হেলিকপ্টার নামার জায়গায়। মনে পড়ল কিশোরের, কেবিন থেকে দূরে তাকে খুঁজতে গিয়েছিল কিডন্যাপাররা। ছড়িয়ে পড়ে আবার শুরু হল খোঁজা। প্রায় নিরাশ হয়ে পড়েছে এই সময় হঠাৎ ঝুঁকল কিশোর। একটা জিনিস তুলে নিল মাটি থেকে। অন্যেরা দৌড়ে এল তার কাছে।
কী? জানতে চাইল রবিন।
বুঝতে পারছি না, আস্তে জবাব দিল কিশোর। দেখ।
গোধূলির ম্লান আলোতেও চকচক করে উঠল জিনিসটা। হাতির দাঁত কুঁদে। তৈরি হয়েছে আরেকটা খুদে হাতির দাঁত। সোনার জালিতে বসিয়ে ছোট একটা আঙটা লাগানো হয়েছে।
কানের দুল? মুসা বলল।
অন্য গহনাও হতে পারে। কিংবা সৌভাগ্যের প্রতীক, রবিন বলল। ওই যে অনেকে বিশ্বাস করে, ওরকম কিছু আরকি।
যা-ই হোক, কিশোর বলল। নিখুঁত নয় জিনিসটা। হাতে বানানো। বিদেশী হস্তশিল্প হতে পারে। পর্বতের গভীরে গিরিখাতে এই জিনিস এল কি করে ভাবছি।
কিডন্যাপাররা ফেলে গেল? মুসার প্রশ্ন।
যেতেই পারে।
কিশোরের কাছ থেকে জিনিসটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল হ্যানসন। লোকগুলোর কথার টানটা কোন দেশের বোধহয় বুঝতে পারছি। আফ্রিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকাকালে ইংরেজদেরও কথার টান অনেকটা ওদেশের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। খাঁটি ব্রিটিশদের মত আর কথা বলতে পারত, না ঔপনিবেশিকরা। কোনও দেশে বেশিদিন থাকতে থাকতে ওরকম হয়েই যায়। এই জিনিসটা মনে হচ্ছে আফ্রিকার স্থানীয় অধিবাসীদের গহনা।
উত্তেজিত কণ্ঠে কিশোর বলল, কোন দেশের সেটাই এখন আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে।
কিশোর, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। আমি ভেবেছিলাম এ কেসটা আমাদের জন্যে বাদ।
লোক ভাল না ওরা, সাবধান করল রবিন।
জানি, জবাব দিল কিশোর। সেজন্যেই তো বাদ দিতে পারছি না। আমাদের বয়েসী একটা ছেলে মহাবিপদের মধ্যে রয়েছে। রকি বীচেই কোথাও আছে সে। আমাদের কাজ তাকে সাহায্য করা।
কেন, দুনিয়ার সব মানুষকে সাহায্যের দায়িত্ব কি শুধু আমাদেরই? গজগজ করল মুসা।
না। তবে অন্তত এই একটি কেসে পিছিয়ে আসতে পারছি না আমরা। আঘাতটা আমার ওপরও এসেছিল। মারাও পড়তে পারতাম। ওই ছেলেটারও একই অবস্থা হতে পারে। ওকে সাহায্য করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। ভুল করেই হোক আর যেভাবেই হোক, আমাকে কিডন্যাপ করা না হলে হয়ত এতে জড়াতাম না। বক্তৃতার ঢঙে কথাগুলো বলে হ্যানসনের দিকে ফিরল কিশোর। বাড়ি যেতে হবে। আপনারও ডিউটির সময় শেষ হয়ে এল।
চল। মাথা ঝাঁকাল হ্যানসন।
ঝোপের ভেতরের সরু পথ ধরে একসারিতে হাঁটছে ওরা। দ্রুত কমে আসছে গোধূলীর আলো। র্যাটলস্নেক রোডের দিকে চলতে চলতে মুসা বলল, কিশোর, ছেলেটাকে বের করব কিভাবে?
উপায় নিশ্চয় আছে। সেজন্যে তাঁর সম্পর্কে আরও কিছু জেনে নেয়া প্রয়োজন। আমাদের। আজ রাতে গবেষণা চালাব আমি। কাল সকালে হেডকোয়ার্টারে দেখা কর তোমরা। তখন বিস্তারিত আলোচনা করব।
.
০৭.
আরে আস্তে খাও না, মিসেস আমান বললেন। ফুরিয়ে তো আর যাচ্ছে না। গলায় আটকাবে তো।
পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেছে মুসা। তাড়াহুড়া আছে, মা।।
খবরের কাগজ থেকে মুখ তুললেন মিস্টার আমান। কিশোরের কিডন্যাপিঙের ব্যাপারটা নয় তো? সাবধান। খুব বিপজ্জনক কিন্তু।
জানি।
মিসেস আমান বললেন, কেমন অদ্ভুত ব্যাপার বল তো? ভুল করে একজনের জায়গায় আরেকজনকে নিয়ে যাওয়া।
কিশোর তো তবু চুপ করেছিল। আমি হলে…, বাক্যটা শেষ না করে হাত নেড়ে বুঝিয়ে দিল মুসা।
দ্রুত নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে এল সে। সাইকেল নিয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডে রওনা হল। সুন্দর সকাল। ফুরফুরে বাতাস। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার গোপন প্রবেশ পথ লাল কুকুর চার দিয়ে এসে ভেতরে ঢুকল মুসা। বাইরের ওয়ার্কশপে কাজ করতে দেখল কিশোরকে। ওয়ার্কবেঞ্চের ওপর তিনটে খুদে যন্ত্র খুলে ছড়িয়ে বসেছে গোয়েন্দাপ্রধান।
জরুরী সংকেতের প্রয়োজন হতে পারে,মুসাকে দেখে বলল কিশোর। এস, হাত লাগাও। রবিন আসতে আসতে সেরে ফেলি।
পিটারের ব্যাপারে খোঁজখবর করার কথা ছিল, ওয়ার্কবেঞ্চের অন্য প্রান্তে। বসল মুসা। তার কি হল? নিয়েছ?
নিয়েছি, হাসল কিশোর। অনেক কিছু জেনেছি কাল রাতে। পিটার মনটেরোকে খুঁজে বের করা কঠিন হবে না।
বল! উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না মুসা।
রবিন আসুক। এক কথা দুবার বলতে ভাল লাগে না।
জোর করে কিশোরের মুখ খোলান যাবে না। হতাশার একটা ভঙ্গি করে যন্ত্র। মেরামতে লাগল মুসা। পাটসগুলো সব পরিষ্কার করে আবার জুড়ে দেয়ার জন্যে রেডি করেছে, এই সময় হাজির হল রবিন। সবুজ ফটক এক দিয়ে ঢুকল সে। সরি, জোরে জোরে সাইকেল চালিয়ে আসাতে হাঁপাচ্ছে। মা দেরি করিয়ে দিল। কাজ না সেরে বেরোতে পারলাম না। তা কি খবর, কিশোর? আমাদের কেসের ব্যাপারে আলোচনার কথা ছিল। চীফ ফ্লেচারের কাছ থেকে আর কোনও খবর। পেয়েছ?
পেয়েছি। সকালেই ফোন করেছিলাম। হেলিকপ্টারটাকে পেয়েছে পুলিশ। ভেনচুরার কাছে একটা মাঠে ফেলে দিয়ে চলে গেছে।
আমাদেরকে বোকা বানিয়েছিল? উড়ে গেল দক্ষিণে, অথচ পাওয়া গেল উত্তরে।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ঠিকই করেছে। আমি হলেও ওরকমই কিছু করতাম। কে আর সেধে গিয়ে পুলিশের হাতে পড়তে চায়। চীফ বলেছেন লোকগুলোকে ধরার মত কোনও সূত্রই ছিল না কপ্টারে। ভাড়া নেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল জরুরী ডাক সরবরাহ করবে। এয়ারফিল্ড থেকে নিয়ে গিয়েছিল ওটা পাইলট মাথায় হেলমেট আর চোখে গগলস ছিল তার। ফলে চেহারা কেউ দেখতে পায়নি। আর কাগজপত্র যে সব ভুয়া তাতে তো কোনও সন্দেহই থাকার কথা নয়।
বাহ্, চমৎকার, ব্যঙ্গের সুরে বলল মুসা। অনেক উপকার হবে, আমাদের!
কিডন্যাপারদের খবর কি? রবিন জানতে চাইল।
এখনও সনাক্ত করা যায়নি, কিশোর জানাল। হেলিকপ্টার আর মার্সিডিজে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। ওয়াশিংটনের এফ বি আই অফিসে ওই ছাপ রেকর্ড করা নেই। আর মার্সিডিজটাও ভাড়া করা।
বলতে চাও আমাদের হাতে কোনও সূত্রই নেই, ভোতা গলায় বলল মুসা।
না, ঠিক তা নয়, হাসল গোয়েন্দাপ্রধান। বলেছি না কাল রাতে অনেক গবেষণা করেছি। আমার মনে হয়…
এ কথা শেষ হল না তার। পেছনে শোনা গেল জোরাল কণ্ঠস্বর। মেরিচাচী। সবাই তাহলে এখানে। ভালই হল। কিশোর, দুই দিন আগে কথা দিয়েছিলি ছোট স্টোররুমটা পরিষ্কার করে দিবি।
সরি, চাচী।
ঠিক আছে। আজকে করে দে। মাল রাখতে হবে ওখানে। বাইরে থেকে থেকে নষ্ট হচ্ছে জিনিসগুলো। তিনজনে করতে আর কতক্ষণ লাগবে…
আমি একাই পারব, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। দুই সহকারীর দিকে তাকিয়ে বলল, এগুলো লাগিয়ে ফেল। আমি আসছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল সে। অনেক বার কথাটা ভেবেছে আগেও, আজ আরেক বার ভাবল, পৃথিবীতে এই কাজ জিনিসটা না থাকলে অনেক ভাল হত। আর যদি খিদেটা না থাকত। অনেক ঝামেলা থেকে মুক্তি পেত মানুষ।
বিষণ্ণ দৃষ্টিতে কিশোরের চলে যাওয়া দেখতে লাগল রবিন আর মুসা। কিশোর কি জেনেছে জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ছোট যন্ত্রগুলো জোড়া লাগানোয় মন দিল।
শেষ হয়ে গেল লাগানো।
অযথা বসে না থেকে ওয়ার্কশপটা গোছানোয় লেগে গেল দুজনে। সেই কাজও শেষ। অনেকক্ষণ বসে থেকে উসখুস করে হেডকোয়ার্টারে ঢোকার জন্যে যেই দুই সুড়ঙ্গের দিকে এগোল, শোনা গেল একটা কণ্ঠ, দাঁড়াও!
কাজ করতে করতে ঘেমে একাকার হয়ে এসেছে কিশোর। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। ওয়ার্কশপে এসে ঢুকল সে।
কাল রাতের কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেল তো এবার! অস্থিরতা আর চেপে রাখতে পারল না মুসা।
কি জেনেছ? রবিনের প্রশ্ন।
কিশোর! আবার ডাক শোনা গেল মেরিচাচীর। অফিসের কাছ থেকে ডেকেছেন।
খাইছে! আবার! ককিয়ে উঠল মুসা।
চল লুকিয়ে পড়ি! পরামর্শ দিল রবিন। জবাব দিও না।
লাভ হবে না তাতে। ভাল করেই জানে আমরা এখানে আছি। বেরিয়ে যেতে দেখেনি, কিশোর বলল।
তা ঠিক, সাংঘাতিক হতাশ হয়েছে মুসা। মেরিচাচীর কাছ থেকে লুকিয়ে রক্ষা নেই। স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড। না, এফ বি আই। না না, ক্যানাডিয়ান মাউনটিজ। উঁহু, তিনটা একসঙ্গেই। এত কড়া নজর ঈগলেরও নেই। চল, বেরোই।
বেরিয়ে এল তিনজুনে। জঞ্জালের পাশ দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ হাত তুলল রবিন, কিশোর, দুজন লোক!
কিডন্যাপারগুলো না তো! আঁতকে উঠল মুসা।
না। দেখছ না, একজন কালো চামড়া।
কালো? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। ঠিকই আছে। এরকমই হওয়ার কথা। এস।
হওয়ার কথা? কিছুই বুঝতে পারল না মুসা। কি বলতে চাও?
কিন্তু জবাব দেয়ার অবকাশ নেই যেন কিশোরের। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগোচ্ছে। তাকে ধরার জন্যে দ্রুত এগোল দুই সহকারী। কিন্তু অফিসের কাছাকাছি যাওয়ার আগে ধরতে পারল না।
চোখে সন্দেহ নিয়ে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকালেন মেরিচাচী। এই ভদ্রলোকরা তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। ভাড়াটাড়া করার ব্যাপার। মনে তো হচ্ছে আগামী পুরো হপ্তাটাই কাজ আটকে থাকবে আমার। কিছুই হবে না।
না, ম্যা ম, মেরিচাচীর আশঙ্কা দূর করার জন্যে তাড়াতাড়ি বলল শ্বেতাঙ্গ লোকটা। লম্বা, সোনালি চুল, মুখটা ওই দুই কিডন্যাপারের মতই রোদেপোড়া। আমাদের হয়ে ছোট্ট একটা তদন্ত করে দিতে হবে ওদের।
লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। ইংরেজি বলছে ইংরেজদের মত, কিন্তু সেই অদ্ভুত টান।
ছোট হলেই ভাল, মেরিচাচী বললেন। আগামী হপ্তা থেকে ইস্কুল শুরু হবে ওদের। এর মধ্যেই আমার কাজগুলো সব করিয়ে রাখা দরকার।
বলে আর দাঁড়ালেন না তিনি। অফিসে চলে গেলেন। দ্রুত একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল কিশোর। তারপর লোকগুলোকে ইশারা করল সঙ্গে আসার জন্যে। ওয়ার্কশপে নিয়ে এল ওদেরকে।
কিডন্যাপিঙের ব্যাপারে, তাই না? জিজ্ঞেস করল সে, আপনাদের পরিচয়?
আমি হাবার্ট কিং, সোনালি চুল লোকটা বলল। কালো লোকটাকে দেখিয়ে বলল, ওর নাম হ্যারি ম্যাকঅ্যাডাম। কিডন্যাপিঙের ব্যাপারেই আলোচনা করতে এসেছি আমরা।
ভাল গোয়েন্দা দরকার আমাদের, হ্যারি বলল। তোমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি। খুবই ভাল নাকি তোমরা। অনেক জটিল রহস্যের সমাধান করেছ। সেজন্যেই এলাম। সাহায্য করতে রাজি থাকলে বল, সব কথা খুলে বলছি। কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল তোমাকে। কি চায় ওরা।
খুশি হয়েই করব, মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম, কিশোর জবাব দিল। তবে কেন কিডন্যাপ করা হয়েছিল আমাকে, জানি, আপনাদেরকে আর বলতে হবে না। ওরা কি চায় তা-ও জানি।
জান? মুসা অবাক।
জানি, সেকেণ্ড। আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল কারণ আমি দেখতে অনেকটা পিটার মনটেরোর মত। পিটার হল স্যার উইনিফ্রেড মনটেরোর ছেলে। আফ্রিকার একটা ছোট্ট ব্রিটিশ কলোনি নানদার প্রধানমন্ত্রী তিনি। ইংরেজ। বিয়ে করেছেন এক ভারতীয় মহিলাকে। আগামী বছরের মধ্যেই ওটাকে স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। তার সরকারে থাকবে বেশির ভাগই কালো চামড়ার মানুষ। আর শ্বেতাঙ্গ যারা থাকবে, তারা বাইরের কেউ নয়, নানদায় যারা জন্মগ্রহণ করেছে শুধু তারাই। কিন্তু প্রতিপক্ষ আছে। দলটার নাম ব্ল্যাক নানান এলিয়ান্স। গোপনে কাজ করছে এর সদস্যরা, দেশ থেকে সমস্ত শ্বেতাঙ্গদের তাড়াতে চাইছে। আরও একটা দল আছে, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী। ন্যাশনাল পার্টির লোক ওরা। ওরা চায়, কোনও কালো লোক থাকবে না সরকারে। সব শাদা। সেনাবাহিনীও গঠিত হবে সব শ্বেতাঙ্গদের দিয়ে, যাতে কালোদের দাবিয়ে রাখতে পারে।
কিশোর, তুমি এত কথা জানলে কি করে? রবিন অবাক।
আর এর সঙ্গে কিডন্যাপিঙেরই বা কি সম্পর্ক? মুসা জানতে চাইল।
অনেক সম্পর্ক, কিশোর বলল। কিডন্যাপাররা ন্যাশনাল পার্টির উগ্রবাদী। শ্বেতাঙ্গদের লোক। পিটারকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে তার বাবাকে বাধ্য করতে চায়, যাতে স্যার মনটেরো তাঁর প্ল্যান বাতিল করে তাদের কথায় রাজি হন। মিস্টার কিং আর মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম নিশ্চয় স্যার মনটেরোর সমতাবাদী দলের লোক। পিটারকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।
হঠাৎ নীরব হয়ে গেল যেন ওয়ার্কশপটা।
বড় বেশি জান তুমি, হ্যারি বলল। অনেক বেশি জেনে ফেলেছ। এতটা ভাল না।
তার কালো থাবায় ধরা ভয়ংকর দর্শন এক পিস্তল।
.
০৮.
কালো মুখে জ্বলন্ত কয়লার মত জ্বলছে যেন হ্যারির চোখ। সোজা কিশোরের দিকে পিস্তল তাক করে রেখেছে। এসব জানার একটাই উপায়। কিডন্যাপারদের সঙ্গে যোগসাজস আছে তোমার। তুমি স্পাই।
হুট করে কিছু কোরো না, হ্যারি, কিং বলল। তার দৃষ্টিও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। হ্যাঁ, ইয়াং ম্যান, বল তো কি করে এসব জানলে তুমি?
জানা কি এমন কঠিন কাজ নাকি? তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত ওল্টাল কিশোর। আমি ইও নই বোকাও নই। একটা সহজ কথা ভাবছেন না কেন? আমি কিডন্যাপারদের লোক হলে আমাকে ওভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া হত নাকি? আর আমিও কি ঢাকঢোল পেটাতাম?
তাকিয়ে রয়েছে হ্যারি। বলে যাও।
কাজটা সহজ হল কি করে বল, আদেশের সুরে বলল.কিং।
বেশ। বড় করে দম নিল কিশোর। ধরে তো নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। ওদের আলাপ আলোচনা শুনলাম। কথায় অদ্ভুত টান। আমাকে পিটার বলে ভুল করল। ভাবল স্যার উইনিফ্রেড মনটেরোর ছেলে। যাই হোক, পালিয়ে আসতে পারলাম অবশেষে। তারপর আবার গেলাম কেবিনটার কাছে। এটা পেয়েছি, হাতির দাঁতে তৈরি জিনিসটা বের করে দেখাল সে। আমাদের শোফার হ্যানসনের বিশ্বাস, এটা আফ্রিকার কোনও ব্রিটিশ কলোনি থেকে এসেছে।
জিনিসটা হাতে নিয়ে দেখল কিং। তুলে ধরল হ্যারির জন্য। দেখে মাথা নাড়ল হ্যারি।
চমৎকার একটা লাইব্রেরি আছে আমাদের রকি বীচে, বলে গেল কিশোর। রেফারেন্স বই আর ম্যাগাজিন ঘেটে বের করতে খুব একটা কষ্ট হল না স্যার মনটেরোর নাম। জানতে পারলাম নান্দার ব্রিটিশ কলোনির প্রাইম মিনিস্টার তিনি। স্বাধীনতার জন্যে গোলমাল চলছে এখন দেশটায়। পার্টিগুলোর নাম। জানলাম। তারপর আর বুঝতে কষ্ট হল না কেন পিটারকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছিল লোকগুলো। আপনাদের কথায়ও একই রকম টান। এবং দুজন দুরঙের চামড়া হলেও কাজ করছেন একসাথে। অর্থাৎ স্যার মনটেরোর হয়ে। কাজেই বোঝাটা কি এতই কঠিন?
তাই তো, মুসা বলল। একেবারেই সহজ।
হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসল কিং। চলবে?
হ্যাঁ, বলে আবার হোলস্টারে পিস্তল রেখে দিল হ্যারি। সত্যিই বলছে মনে হয়।
এবং খুব ভাল গোয়েন্দা। আশা করি আমাদেরকে নিরাশ করবে না ও। কি বল, কিশোর?
না, করব না, দৃঢ় কণ্ঠে বলল কিশোর।
ভেরি গুড, কিং বলল। মাত্র গতকাল রকি বীচে এসেছি আমরা। বিকেলের কাগজে পড়েছি তোমার কিডন্যাপিঙের খবর। তোমার ছবি দেখেছি। তিন গোয়েন্দা নামে যে একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছ তোমরা, এবং সেটার সাংঘাতিক সুনাম, তা-ও জানলাম। ভাবলাম তোমাদেরকে দিয়েই হবে। চলে এলাম।
তাহলে কি আমাদের ভাড়া করছেন? মুসার প্রশ্ন।
হ্যারির দিকে তাকিয়ে যেন আলোচনার উদ্দেশ্যেই বলল কিং, তোমার কি মনে হয়, হ্যারি? ওরা পারবে? এমন গোয়েন্দাই আমাদের দরকার, তাই না? ।
মনে হয় পারবে, হ্যারির মুখেও হাসি।
রবিন আর মুসার মুখেও হাসি। কিন্তু কিশোর গম্ভীর। জিজ্ঞেস করল, পিটারের সঙ্গে চেহারার কতটা মিল আছে আমার, স্যার?
আমাকে শুধু কিং বললেই চলবে। মিল? একেবারে যমজ বলা চলে। আশ্চর্য! বিশ্বাসই হতে চায় না। দুবছর ধরে আমেরিকায় আছে পিটার। এতদিনে নিশ্চয় চেহারা কিছুটা হলেও বদলেছে। ফলে লোকগুলো আর চিনতে পারেনি। তোমাকেই পিটার বলে ভুল করে বসেছে। ওর কথায়ও নানদার টান। একটা। ব্যাপার বুঝতে পারছি না…।
আমার কথা শুনেও কেন বুঝতে পারল না ওরা, এই তো? হাসল কিশোর। মুখে কাপড় গোঁজা ছিল আমার। প্রথমে বলার চেষ্টা করেছি। তারপর যে-ই ওদের উদ্দেশ্য বুঝে গেলাম, চুপ হয়ে গেলাম একেবারে। একটা কথাও আর বললাম না।
ভাল করেছ, হ্যারি বলল। মারাত্মক বিপদে পড়ে যেতে তাহলে। ওদের নাম আর চেহারার বর্ণনা যা পেয়েছি তাতে পরিচিত লাগছে না। তবে উগ্রবাদী। দলের লোক সন্দেহ নেই। ওই দলের লোকরা ভয়ংকর।
দেশে থাকলে নিরাপদ নয়, কিং বলল। সেজন্যেই ছেলেকে আমেরিকায়। পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্যার-মনটেরো। লস অ্যাঞ্জেলেসে থেকে ইস্কুলে পড়ে। খুঁজে খুঁজে এখানেও এসে হাজির হয়েছে উগ্রবাদীরা। হপ্তাখানেক আগে প্রায় ধরেও ফেলেছিল পিটারকে। অনেক কষ্টে পালিয়েছে সে। তারপর তার আর খোঁজ নেই। স্যার মনটেরোর তো প্রায় পাগল হবার জোগাড়। লস অ্যাঞ্জেলেসের নানদার ট্রেড মিশনের মাধ্যমে পিটার খবর পাঠানোর পর গিয়ে তিনি শান্ত হয়েছেন।
কি খবর পাঠিয়েছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ট্রেড মিশনটা কি? মুসা জানতে চাইল।
ট্রেড মিশন হল একটা অফিসিয়াল গ্রুপ, হ্যারি বলল। যাদের কাজ হল দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়ীক সম্পর্ক বৃদ্ধি করা।
আর মেসেজ যেটা পাঠিয়েছে, কিং বলল। সংক্ষিপ্ত। বেশ অদ্ভুত। আমরা। তো এর মাথামুণ্ড কিছুই বের করতে পারিনি। তাতে রকি বীচের কথা বলা হয়েছে। পিটারের নিশ্চয় ভয় শত্রুদের হাতে পড়ে যেতে পারে তার মেসেজ। সহজ করে লিখলে ওরাও বুঝে ফেলবে।
ওই মেসেজের মানে করে দিতে বলছেন আমাদেরকে? মুসা জিজ্ঞেস করল।
দেখি তো? দেখতে চাইল রবিন।
হোটেলে রয়ে গেছে। ওখানেই নিরাপদ। হ্যারি বলল, যেতে চাইলে এখনি নিয়ে যেতে পারি।
দুজনকে অনুসরণ করে ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। লম্বা, কালো একটা ক্যাডিলাক দাঁড়িয়ে আছে। তাতে চড়ল সবাই। হঠাৎ মুসা বলে। উঠল, কিশোর, দেখ! রাস্তার অন্যপাশে একটা জায়গা দেখাল সে।
কী?
ওই ঝোপের ভেতর কাকে দেখলাম, মুসা বলল।
চল তো দেখি, কিং বলল।
সাবধানে ঝোপটার দিকে এগোল সবাই। রাস্তার কিনার থেকে শুরু করে পরের ব্লক পর্যন্ত এগিয়ে গেছে ঝোপ। পাতলা। ভেতর দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। কাউকে দেখা গেল না সেখানে। তবে ছিল যে তার প্রমাণ মিলল। একটা পোড়া সিগারেটের গোড়া পড়ে রয়েছে।
বললাম না দেখেছি! প্রায় চিৎকার করে বলল মুসা।
জিরাতে কেউ বসে থাকতে পারে, কিশোর বলল। সিগারেট টেনেছে।
হয়ত, কিং বলল।
তা না হলে, নিজেকেই যেন বোঝানোর চেষ্টা করছে কিশোর। স্যালভিজ ইয়ার্ডের ওপর নজর রাখতে আসবে কে? কিডন্যাপাররা এখনও এই এলাকায়। থেকে থাকলে নিশ্চয় খবরের কাগজ দেখেছে। ভুল লোককে ধরেছিল বুঝতে পেরেছে।
আবার ক্যাভিলাকে ফিরে এল ওরা। গাড়ি চালাল হ্যারি।
ছেলেদের দিকে ফিরে কিং বলল, পিটারকে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের। ঝোপের ভেতর যে ছিল, সে হয়ত নজর রাখেনি, কিন্তু আমার ভয় লাগছে কিডন্যাপাররা এখনও এই শহরেই আছে। সহজে হাল ছাড়বে না ওরা।
এগুলো আসলে এক ধরনের জেদ, কিশোর বলল। নিজেরা যা ভাবে সেটাই ঠিক, অন্যদেরটা কিছু না।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আর এই উগ্রপন্থী পলিটিশিয়ানগুলো তো আরও বেশি। আরেকটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না ওরা, স্যার মনটেরো ছেলেকে যতই ভালবাসুন, সবার আগে তাঁর কাছে হল দেশ। পিটারকে ধরে নিয়ে গিয়ে হুমকি দিলেই তিনি শুনতেন না, তার কাজ করেই যেতেন। এমনকি পিটারকে মেরে ফেলারও হুমকি যদি দিত ওরা তিনি শুনতেন না।
চুপচাপ শুনল তিন গোয়েন্দা, কিছু বলল না। মোড় নিয়ে সৈকতের ধারে মিরামার হোটেলের ড্রাইভওয়েতে এসে ঢুকল গাড়ি। ছেলেদেরকে নিয়ে কামরায় চলল কিং, আর হ্যারি গেল হোটেলের সেফ থেকে মেসেজটা বের করে আনতে।
মেসেজ আনা হলে দরজায় তালা লাগিয়ে দিল কিং। টেবিল ঘিরে বসল সবাই। জোরে জোরে পড়ল কিশোর, অ্যাটাকড ইন এল. এ.। কেয়ারড। রকি। বীচ। জাঙ্গাস প্রেস।
নিরাশ হয়ে পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা।
মুসা বলল, কিছুই তো বলেনি!
এর মধ্যে সংকেতও তো কিছু দেখছি না, বলল রবিন।
না। সংক্ষিপ্ত মেসেজটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। শুধু শেষ দুটো শব্দ বাদে। জাঙ্গাস প্লেস। এটার কি মানে?
সেটা বোঝানোর জন্যই তো তোমাদেরকে ডেকে আনলাম, কিং বলল। রকি বীচের প্রতিটি গাইডবুক দেখেছি আমরা। কিন্তু জ্যাঙ্গার কথা কোথাও কিছু লেখা নেই। ভাবলাম, এখানকার কেউ হয়ত বলতে পারবে।
আমি জীবনেও শুনিনি ওই নাম, রবিন বলল।
আমিও না, বলল মুসা।
কিশোর শুধু নীরবে মাথা নাড়ল।
হবে না, কিং, হ্যারি বলল। তার কাঁধ ঝুলে পড়েছে। এই ছেলেগুলোও আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে না।
.
০৯.
পারবই না, কিশোর বলল। তা বলতে পারেন না।
চট করে কিশোরের দিকে তাকাল কিং। তুমি… কিছু বুঝতে পেরেছ?
লস অ্যাঞ্জেলেসে তার ওপর হামলা আসায় ভয় পেয়ে গিয়েছে পিটার, কিশোর বলল। পালিয়েছে। চলে এসেছে এখানে। রকি বীচকে লুকানোর জায়গা বেছে নিল কেন সে?
ইস্কুল ছুটি হলে এখানেই আসে, হ্যারি জানাল। গতবার স্যার মনটেরো এসেছিলেন কয়েকটা দিন ছেলের সঙ্গে কাটাতে। তখনও দুজনে একহপ্তা রকি বীচে থেকে গেছে।
তার মানে রকি বীচ তার চেনা, চেনা শব্দটার ওপর জোর দিল কিশোর।
চেনা হতেই পারে, মুসা বলল। এতে অবাক হওয়ার কি আছে? গুরুত্ব কিসের?
আছে, মুসা, আছে। হতে পারে এখানে বিশেষ একটা জায়গা বেছেছে যেখানে লুকানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেটাই ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছে স্যার মনটেরোকে। জ্যাঙ্গাস প্রেস বলে ওই জায়গাকেই বুঝিয়েছে।
কিন্তু, হ্যারি বলল। স্যার মনটেরো বুঝতে পারেননি।
না পারলেও, কিশোর বলল। এটাই সেই জায়গা যেখানে সে লুকিয়েছে। ওরকম কোনও জায়গার নাম নেই রকি বীচে। তার মানে ইঙ্গিতে কিছু বোঝাতে চেয়েছে। সরাসরি বললে সবাই বুঝে ফেলত, সে জন্যে বলেনি।
হ্যাঁ, মুসা মাথা ঝাঁকাল। উগ্রবাদীরাও দেখে যাতে বুঝতে না পারে।
কিঙের দিকে তাকাল কিশোর। শব্দটা আফ্রিকান নয় তো? ওরকম কোনও শব্দ আছে আফ্রিকান ভাষায়?
তা আছে, নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল কিং। একজনের নাম। নানা উপজাতির মহান নেতা ছিলেন তিনি।
হ্যারি বলল, ১৮৮০ সালের দিকে ইউরোপিয়ানরা যখন বসতি স্থাপন করতে আরম্ভ করে তখন জ্যাঙ্গার সঙ্গে ভীষণ লড়াই বাধে ওদের। তিনিই নানদার শেষ নেতা, যার সঙ্গে বিদেশীদের যুদ্ধ হয়। এরপর ওভাবে আর কারও সঙ্গে হয়নি। তার নামের মানে অবশ্য কয়েক রকম হয়, কোন জায়গায় কি অনুবাদ করা হবে তার ওপর নির্ভর করে। এই যেমন কোথাও বলতে গেলে হয় বজ্ৰময় মেঘ, আবার। কোথাও বৃষ্টির শব্দ।
এই? হতাশ মনে হল গোয়েন্দাপ্রধানকে। জ্যান্সার কোনও বিশেষ জায়গা। ছিল? কোনও বিশেষ ঘটনা, কিংবা কোনও বিশেষ বন্ধু, যার সঙ্গে কিছুটা মিল পাওয়া যায়?
কি বলতে চাও বুঝলাম না, কিং বলল। জ্যাঙ্গা হল নানদার একটা কিংবদন্তী। অসংখ্য গল্পগাথা আছে তার সম্পর্কে। হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে পরিচয়। বিশেষ কিছু খুঁজে বের করতে হলে কয়েক মাস লেগে যাবে।
অত সময় নেই আমাদের হাতে, হ্যারি বলল,। মাস তো দূরের কথা। কয়েকটা দিনও নেই।
নাহ, কোনও পথ দেখছি না, হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল রবিন।
পথ তো একটা নিশ্চয় আছে, এত সহজে হাল ছাড়ে না গোয়েন্দাপ্রধান। পিটার তখন মরিয়া। সুতরাং ভালমত চেনে ওরকম একটা সংগঠনের সাহায্য নিয়েছিল। ভাবতেই যেটা প্রথমে তার মনে এসেছে। কিং, জ্যাঙ্গার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এরকম জরুরী জায়গা, ঘটনা, যুদ্ধের কথা বলতে পারেন? এমন কিছু, নানদার বেশির ভাগ লোকই যেটা জানে।
চুপ করে কিছুক্ষণ ভাবল কিং। কোনটা বলবে সেটাই ভাবছে বোধহয়। অবশেষে বলল, ইমবালায় ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড লড়াইয়ে জিতেছিলেন একবার। শেষবার পরাজিত হয়েছিলেন জিয়ালায়। লর্ড ফাউড নামে একজন জেনারেলকে পরাজিত করেছিলেন তিনি, আবার তাঁকে পরাজিত করেছিল আরেকজন জেনারেল, জেনারেল অডলি।
তাড়াতাড়ি পকেট থেকে নোটবুক বের করে সব লিখে নিতে লাগল রবিন।
জাঙ্গার রাজধানী ছিল উলাগায়, হ্যারি বলল। পরাজিত হওয়ার পর তাকে গিয়ে ফোর্ট জর্জের জেলখানায় বন্দি করল ইংরেজরা।
হ্যারির কথা কেড়ে নিয়ে যেন বলল কিং, সেখান থেকে পালালেন জ্যাঙ্গা। আবার লড়াই শুরু করলেন। হেডকোয়ার্টার করলেন কারগা ভ্যালির দুর্গম এক জায়গায়।
তারপর, উপসংহার টানল হ্যারি। স্মিথস ফোর্ড নামে একগায়ের কাছে লড়াইয়ে অবশেষে মৃত্যুবরণ করলেন।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তাঁর নামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত নাম এখন জোগাড় করতে হবে আমাদের। তার পর…
জোরে থাবা পড়ল দরজায়। ঝট করে একসঙ্গে সব কটা মাথা ঘুরে গেল সেদিকে। চেঁচিয়ে ডাকল একটা নারীকণ্ঠ, মিস্টার কিং! মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম! আছেন ওখানে?
দরজার কাছে এগিয়ে গেল কিং। বলতে বলতে গেল, ও মিস ডলি জেসাপ। ট্রেড মিশন থেকে এসেছে। স্যার মনটেরোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রক্ষা.. করছে সে।
হয়ত পিটারের খোঁজ পেয়েছেন স্যার মনটেরো, আন্দাজ করল হ্যারি। ।
দরজা খুলল কিং। লম্বা, কালো চুলওয়ালা এক তরুণী দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে নেভি সোয়েটার। পরনে ধূসর স্ল্যাকস। তাড়াহুড়ো করে এসে ঘরে ঢুকল।
ওকে পেয়েছেন? জিজ্ঞেস করল ডলি। ফোন করতে মানা করলেন। খবর দিই কি করে। স্যার মনটেরোর কাছ থেকে গোপন মেসেজ এসেছে… হঠাৎ ছেলেদের ওপর চোখ পড়তেই থেমে গেল সে। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল ওদের। দিকে।
আমি বুঝিনি আপনারা একা নন, কিংকে বলল সে।
পিটারের সম্পর্কে কিছু? জিজ্ঞেস করল কিং।
তার খবর পাওয়া গেছে? হ্যারির প্রশ্ন।
না, ওসব নয়। অফিসিয়াল মেসেজ।
হুঁ, মাথা ঝাঁকাল কিং। ছেলেদের দিকে ফিরে বলল, অল রাইট, বয়েজ, তোমরা তোমাদের তদন্ত চালিয়ে যাও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিটারকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। কোনও খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে এখানে জানাবে। আমাদেরকে।
বেরিয়ে যেতে ইঙ্গিত করা হচ্ছে ওদেরকে, বুঝতে পারল ছেলেরা। বেরিয়ে এল হোটেলের কামরা থেকে। নিচে নেমে বাস স্টপের দিকে রওনা হলো।
রবিন জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে শুরু করব, কিশোর?
জ্যাঙ্গা। টেলিফোন বুক, ডিরেকটরি, ম্যাপ, রেফারেন্স বুক, মোটকথা যত জায়গায় ওই নামের সম্পর্ক থাকতে পারে মনে হবে সবখানে খুঁজব। ভাগাভাগি হয়ে খুঁজতে বেরোব আমরা। ম্যাপ খুঁজতে মুসা চলে যাও সিটি হলে। রবিন। লাইব্রেরিতে। সিটি ডিরেকটরি আর টেলিফোন বুক খুঁজবে। আমি যাব হিসটরিক্যাল সোসাইটিতে।
খিদে পেয়েছে, লজ্জিত হাসি হাসল মুসা। বাড়ি থেকে আগে লাঞ্চটা সেরে আসি?
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। নাহ, তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল। একটা স্ন্যাকসে ঢুকে কিছু খেয়ে নাও। তারপর চলে যাও কাজে। বিকেলের পরে হেডকোয়ার্টারে দেখা হবে।
বাস এল। তাতে চড়ল ওরা। নোট বুক বের করে যেসব জায়গায় গিয়ে লড়াই করেছেন জ্যাঙ্গা, সেগুলোর তিনটে লিস্ট করে একেকজনের হাতে একেকটা। দিল রবিন। তারপর বিশেষ বিশেষ জায়গায় নেমে আলাদা হয়ে গেল তিনজনে।
.
সাড়ে তিনটেয় হিসটরিক্যাল সোসাইটি থেকে বেরিয়ে ইয়ার্ডে ফিরে চলল কিশোর। তেমন কিছুই পায়নি সে। হেডকোয়ার্টারে ঢুকে দেখল রবিন কিংবা মুসা। ফেরেনি। চুপচাপ বসে থাকতে ভাল লাগে না। ইমারজেন্সি সিগন্যালগুলো নিয়ে। বসল সে। নতুন ব্যাটারি ভরল। ফাইন টিউনিং করল। তখনও ফিরল না দুই সহকারী। শেষে ট্রেলারে ঢুকে জ্যাঙ্গার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বসল কিশোর।
জবাব একটা নিশ্চয় আছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস, জ্যাঙ্গা যেসব জায়গায় গিয়েছেন। ওগুলোর নামের মধ্যেই রয়েছে সূত্র। আর সেটা বের করতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি পিটারকে।
রবিন আর মুসা যখন এল, তখন পাঁচটা প্রায় বাজে। ওদের গম্ভীর মুখ দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল কিশোর।
কিছু না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলে হাত নেড়ে বসে পড়ল রবিন।
নামগুলো সব আফ্রিকান, কিশোর, মুসা বলল হতাশ কণ্ঠে। রকি বীচে ওরকম নামের কিছু নেই।
আসলে সব জায়গায় চেষ্টা করিনি আমরা, নিরাশ মনে হলো না। গোয়েন্দাপ্রধানকে। খাওয়ার পর লাইব্রেরিতে গিয়ে জ্যাঙ্গা খুঁজব। আরও কোনও ইমপরট্যান্ট জায়গায় গিয়ে থাকতে পারেন যেটার কথা আমাদেরকে বলতে ভুলে গেছে কিং আর হ্যারি।
বাড়িতে কাজ আছে আমার, রবিন বলল। মাকে কথা দিয়ে এসেছি। তার সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে।
আমারও আছে, মুসা জানাল।
আমার নেই, কিশোর বলল। আমি একাই যেতে পারব। বই ঘাঁটাটা এমন কোনও কঠিন কাজ না।.
কিশোর, মুসার কণ্ঠে অস্বস্তি। মনে হয়… মনে হয় ভুল পথে খুঁজছি আমরা।
আমারও তাই মনে হচ্ছে, রবিন বলল।
কি জানি! গাল চুলকাল কিশোর। তার বিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে মনে হয় দুই সহকারী। কিন্তু আমার বিশ্বাস, পিটার যা বলার বলে দিয়েছে। ওই মেসেজে জানিয়ে দিয়েছে কোথায় আছে সে।
.
১০.
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে বসে শুধু খাবার খুঁটতে লাগল কিশোর। অন্যমনস্ক। রুচি নেই যেন।
কি রে? ব্যাপারটা নজর এড়াল না মেরিচাচীর। অসুখ নাকি?
নাহ! প্লেটের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর। আগের রাতে ঘুম ভাল হয়নি। সকালেও তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে। তার আগে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনে হয়েছে, বোধহয় মুসার কথাই ঠিক। লাইব্রেরিতে নানদার ওপর একটা বই পেয়ে নিয়ে এসেছে। হেডকোয়ার্টারে বসে বসে অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছে। পিটারকে খুঁজে বের করতে কাজে লাগে এমন কিছুই চোখে পড়েনি।
আরে কি হলো? খাচ্ছিস না কেন? ডিম নে, মেরিচাচী তাগাদা দিলেন। নাকি পেটে…
ঠিক আছে, দাও একটা, প্লেট বাড়িয়ে দিল কিশোর। কিশোরের এই উদাসীনতা রাশেদ পাশারও নজরে পড়েছে। আড়চোখে তাকালেন তিনি, কিছু বললেন না।
ভাবছে কিশোর। পিটার তার সূত্র ঠিকমতই দিয়েছে। বোঝার জন্যেই। কিন্তু কিশোর বুঝতে পারছে না। কিছু একটা মিস করছে। নাস্তা শেষ হলো। নতুন। কিছুই বের করতে পারল না ততক্ষণেও সে।
এই সময় বাজল টেলিফোন। মুখও তুলল না সে। সমস্যা তার ভাল লাগে। সেগুলোর সমাধান করতে…
কিশোর, ডেকে বললেন মেরিচাচী। রবিন।
নিরাসক্ত ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে রিসিভার কানে ঠেকাল কিশোর। বলো।
কিশোর, পেয়ে তো গেলে! আমাদেরকে ফোন করলে না কেন?
কি বললে? চোখ মিটমিট করছে কিশোর। কি পেয়ে গেলাম?
কেন, জবাব। পিটার কোথায় লুকিয়েছে?
মজা করছ তো। করো। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। সকালে এমনিতেই মেজাজ ভাল নেই আমার। হ্যারি আর কিঙের কাছে গিয়ে আলোচনা। করব ভাবছি। হয়ত…
তার মানে পাওনি? রবিন অবাক।
পাইনি? কি পাইনি?
লাইব্রেরি থেকে যে বইটা নিয়েছ তাতে?
কি বলছ তুমি? নতুন কিছু তো দেখলাম না। আগাগোড়া পড়েছি।
তাহলে মিস করেছ। চলে এস। আমরা হেডকোয়ার্টারে বসে আছি। রবিন, কী…? কিন্তু লাইন কেটে দিয়েছে রবিন। গেলাসের দুধটুকু না খেলে উঠতে দেবেন। মেরিচাচী। মাঝে মাঝে এটা অত্যাচার মনে হয় কিশোরের। এখন আবার একটা নতুন অত্যাচার যোগ হয়েছে, কিডন্যাপিঙের পরে, বাইরে বেরোতে গেলেই খালি সতর্ক করেন। দুই ঢোকে দুধটুকু শেষ করে ছুটে বেরোল রান্নাঘর থেকে। হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল।
গোয়েন্দাকে সব সময় চোখকান সজাগ রাখতে হয়, গম্ভীর হওয়ার ভান করতে গিয়ে হেসে ফেলল মুসা।
টিটকারি রাখ তো এখন…
বাধা দিয়ে রবিন জিজ্ঞেস করল, সত্যি বলছ কিছু পাওনি?
থাকলে তো পাব, বিড়বিড় করল কিশোর।
রবিন, বলেই দাও ওকে, মুসা বলল।
বেশ, শুরু করল রবিন। আমরা ঢুকে দেখি তুমি নেই। টেবিলে বইটা দেখতে পেল মুসা। টেনে নিলাম। চীফ জ্যাঙ্গার ওপর লেখা চ্যাপ্টারটাতেই পেলাম। ওটা।
কি পেলে? অত ভণিতা করছ কেন? জলদি বলো!
বইটা তুলে নিয়ে পাতা ওল্টাল রবিন। পড়তে আরম্ভ করল, নানদা সর্দার জ্যাঙ্গার আশা বেড়ে গেল যখন ইমবালা, অর্থাৎ দা হিল অভ দা রেড লায়নে ইংরেজ বাহিনীকে পরাজিত করলেন। কারণ তিনি বুঝতে পারলেন অন্তত তিনটে বছরের জন্যে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছেন ইউরোপিয়ানদের। এটুকু পড়েই থেমে গেল সে। কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল।
মুসাও হাসল।
হাঁ করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বুঝতে পারছে না। তো? কি পেলে? ইমবালার কথা তো আমরা…
কিশোর, অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রবিন। এখনও বুঝতে পারলে না? তোমার হয়েছে কি? দা হিল অভ দা রেড লায়ন! ইমবালার ইংরেজি মানে, লাল সিংহের পাহাড়। মনে পড়ছে না? এখানেও আছে রেড লায়ন। দা রেড লায়ন র্যাঞ্চ। বিখ্যাত পুরনো হোটেলটা, যেখানে হলিউডের বড় বড় অভিনেতারা ছুটি কাটাতে আসে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। তারপর ওপর দিকে মুখ তুলে হো হো করে হেসে উঠল। রবিনের পিঠ চাপড়ে দিতে দিতে বলল, রবিন, কাজই করেছ একটা! ঠিক বলেছ। দা রেড লায়ন র্যাঞ্চ। ছেলেকে নিয়ে নিশ্চয় ওখানে থেকেছেন স্যার মনটেরো। ইস, আমি একটা গাধা! লিখেই। দিয়েছে ইমবালার মানে, অথচ আমার চোখেই পড়ল না!
ভুল আমরা সবাই করে থাকি, ভারিক্কি চালে বলল মুসা।
হেসে ফেলল কিশোর। প্রতিশোধ নিচ্ছ, না? নাও। কিছু মনে করছি না। আমি। কাজ হয়েছে এতেই খুশি।
রবিনও হাসল।
হ্যারি আর কিংকে ফোন করা দরকার, কিশোর বলল।
কিন্তু কেউ ফোন ধরল না ওপাশ থেকে।
নাস্তা করতে গেছে হয়ত, রিসিভার রাখতে রাখতে বলল কিশোর। চল, গিয়ে ধরি। একসঙ্গেই নাহয় তখন র্যাঞ্চে যাওয়া যাবে।
তাহলে সাইকেল নেয়ার দরকার নেই, রবিন বলল। সাইকেলগুলো আবার কোথায় রাখব? বাসে চলে যাই। তারপর ওদের সঙ্গে গাড়িতে।
গুড আইডিয়া, মুসাও একমত।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দ্রুত বেরিয়ে পড়ল হেডকোয়ার্টার থেকে। বিশ মিনিট পরে একটা বাস ওদেরকে নামিয়ে দিল মিরামার হোটেলের সামনে। কিরে ঘরে ফোন করল ক্লার্ক। আছে। ছেলেদেরকে পাঠিয়ে দিতে বলল কিং।
ঘরে ঢুকে কিশোর জিজ্ঞেস করল, কিছু শুনেছেন আর?
না, জবাব দিল কিং। নানদায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব খারাপ হয়ে আসছে। পিটারকে খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন স্যার মনটেরো, আমাদের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন।
আমরা বোধহয় এবার সাহায্য করতে পারব আপনাদের। বই পড়ে যা আবিষ্কার করেছে সেটা খুলে বলল কিশোর।
দা হিল অভ দা রেড লায়ন! নিশ্চয়! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল হ্যারি। মনে হয়, ঠিকই আন্দাজ করেছ তোমরা।
বলেছিলাম না, তার দিকে তাকিয়ে তিন গোয়েন্দার প্রশংসা করে বলল কিং। ছেলেগুলো চালাক। জলদি চল। গাড়ি বের করতে হবে।
পার্কিং লটে এসে বিশাল ক্যাডিলাক গাড়িটায় চড়ে বসল সবাই। ড্রাইভ করতে বসল কিং। তাকে পথ বাতলে দিতে লাগল রবিন। শহরের উত্তরাঞ্চলের পাহাড়ের পাদদেশে চলে এল ওরা। রেড লায়ন র্যাঞ্চের দোতলা বাড়িটা রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে। ওটার দুপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কয়েক গুচ্ছ হলদে রঙ করা। কাঠের বাড়ি আর কিছু শাদা রঙের কটেজ। পুরো অঞ্চলটাই ঘিরে দেয়া হয়েছে অলিণ্ডার আর হিবিসকাসের উঁচু বেড়া দিয়ে। গাড়ি পার্ক করে রেখে প্রধান। বাড়িটার দিকে এগোল ওরা।
রেজিস্ট্রেশন ডেস্কে বসে আছে, ধোপদুরস্ত কালো স্যুট পরা ক্লার্ক। মুখ তুলে তাকিয়ে মোলায়েম হাসি হাসল। হঠাৎ ফ্যাকাসে হয়ে গেল হাসিটা। চিৎকার করে উঠল, মিস্টার টিনটন!
ডেস্কের পেছনের দরজাটা খুলে গেল। বেরিয়ে এল একজন খাট, হালকাঁপাতলী লোক। গায়ে চেককাটা জ্যাকেট, পরনে ঢোলা পাজামা। কিশোরের দিকে তাকাল জ্বলন্ত দৃষ্টিতে। আবার এসেছ তাহলে! এবার বিল আদায় করেই ছাড়ব!
তারমানে পিটার মনটেরো এসেছিল! প্রায় চেঁচিয়েই উঠেছিল কিশোর, সময় মত সামলে নিল।
আপনি ম্যানেজার? খাটো লোকটাকে জিজ্ঞেস করল কিং।
হ্যাঁ, আমি ম্যানেজার, কর্কশ জবাব দিল লোকটা। কিশোরের দিক থেকে চোখ সরাচ্ছে না। ইয়াং ম্যান, এখুনি বিল মিটিয়ে না দিলে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব আমি।
তার দরকার হবে না, শান্তকণ্ঠে বলল, হ্যারি। টাকাটা আমরা দিয়ে দেব। একে পিটার ভাবছেন তো? ও পিটার নয়। ওই
নয়? সন্দেহ দেখা দিল ম্যানেজারের চোখে। তাহলে…
দেখতে পিটারের মতই, বুঝিয়ে দিল কিং। তবে পিটার নয়। চেহারা অনেকটা এক রকম।
কেন, খবরের কাগজে আমার ছবি দেখেননি? কিশোর জিজ্ঞেস করল। তাহলে তো এই ভুল করার কথা নয়
মাথা নাড়ল ম্যানেজার। সাংঘাতিক ব্যস্ত আমরা। বিশেষ করে এই হপ্তায়। কয়েকজন মেহমান এসেছে। তাদেরকে সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছি। পেপার দেখব। কখন। কিশোরের দিকে তাকিয়েই রয়েছে সে। তার কুঁচকানো কমদামী পোশাক দেখছে। পিটারকে অবশ্য এত বাজে পোশাকে এত অগোছালো অবস্থায় দেখিনি। কিন্তু তুমি যদি পিটারই না হও, তাহলে ওরা তোমার বিল দিতে চাইছে কেন?
আমি আর মিস্টার ম্যাকঅ্যাডাম, হ্যারিকে দেখাল কিং। স্যার মনটেরোর প্রতিনিধি। এই যে আমাদের আইডেনটিটি। লস অ্যাঞ্জেলেসে নানদার ট্রেড মিশন আছে, ইচ্ছে হলে আমাদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে পারেন ওখানে। এখন বলুন, পিটারের কাছে কত পান। দিয়ে দিচ্ছি।
একটা বিল বের করে দিল ক্লার্ক। টাকা মিটিয়ে দিল হ্যারি ইতিমধ্যে দুজনের আইডেনটিটি চেক করল ম্যানেজার। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, কেমন যেন দ্বিধায় ফেলে দেয়।
বুঝতে পারছি কেন এমন লাগছে আপনার, কিং বলল। আরেকটু খোলাসা করে বললেই আর দ্বিধা থাকত না। কিন্তু সেটা করতে পারছি না। অনেক জরুরী। কাজ পড়ে আছে আমাদের। পিটার এখানে না থাকলে কোথায় আছে খুঁজে বের করতে হবে। ও এখানে আসার পর থেকে কি কি ঘটেছে দয়া করে বলবেন কি?
দ্বিধা করতে লাগল ম্যানেজার। তারপর মাথা ঝাঁকাল। ঠিক আছে, বলছি। হপ্তাখানেক আগে এসেছিল সে। এর আগেও এসেছিল তার বাবার সঙ্গে। কাজেই চিনতে পেরেছিলাম। এসে বলল কয়েক দিনের মধ্যেই তার বাবা আসবেন, তার সঙ্গে দেখা করবে। বিশ্বাস করলাম। জায়গা দিলাম তাকে। দুদিন পরে দুজন, লোক এসে বলল স্যার মনটেরোর কাছ থেকে এসেছে। পিটারের রুম নম্বর চাইল ওরা। কেউ এসে বললেই বোর্ডারদের নামধাম বলে দিই না আমরা। ওদের পরিচয়। জানতে চাইলাম। তারপর পিটারকে ফোন করলাম। লোকগুলোকে ঘরে পাঠিয়ে দিতে বলল সে।
লোকগুলো দেখতে কেমন ছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ততটা ভাল মনে নেই, ম্যানেজার বলল। চারদিন আগে এসেছিল ওরা। একজন বেশ গাট্টাগোট্টা, কোকড়া বাদামী চুল। আরেকজন লম্বা, পাতলা, কালো চুল। ওদের নাম মনে করতে পারছি না।
কিশোরের দিকে তাকাল হ্যারি আর.কিং। মাথা ঝাঁকাল সে। চেহারার বর্ণনায় লোকগুলোকে দুই কিডন্যাপারের মতই লাগল ওদের।
ওরা চলে যাওয়ার পর কি হলো? জিজ্ঞেস করল কিং।
অদ্ভুত কাণ্ডই করেছে, তখন অবশ্য সে রকম মনে হয়নি। লোকগুলো ওপরে যাওয়ার একটু পরেই দেখলাম মেইন গেট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। মিনিট পাঁচেক পরেই লোকগুলো তাড়াহুড়ো করে নেমে এসে বেরিয়ে গেল।
পিটারকে আর দেখেননি? হ্যারি জানতে চাইল।
না। আর আসেনি। বিলের টাকাও দিয়ে যায়নি।
আবার হারালাম, তিক্তকণ্ঠে বলল হ্যারি।
আমরা ভেবেছিলাম পাবই, নিরাশ হয়েছে রবিনও।
চিন্তিত লাগছে কিশোরকে। ওর ঘরটা দেখতে পারি?
কী বক্সের দিকে তাকাল ম্যানেজার। খালিই আছে। হাত বাড়িয়ে চাবিটা তুলে আনল। ঊনত্রিশ নম্বর ঘর। দোতলায়। সামনের দিকে। ডানের এলিভেটর দিয়ে উঠতে পার। কিংবা এলিভেটরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে।
এলিভেটরের দিকে এগোতে এগোতে মাথা নাড়ল কিং, যেন বিশেষ ভরসা। করতে পারছে না। কিশোর, ওর ঘর দেখে কি হবে? ওখানে তো নেই। একটা আশাই করতে পারি এখন শুধু, আবার আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
লোকগুলোকে সন্দেহ করেছিল, বোঝাই যায়, জবাব দিল কিশোর। এলিভেটরে ঢুকে পড়েছে। বোতাম টিপে দিয়ে বলল, তা না হলে ওভাবে হোটেল থেকে পালাত না। নিশ্চয় লোকগুলোকে চিনতে পেরেছিল, শত্রু হিসেবে। দেখেই আবার পালিয়েছে। লোকগুলো হয়ত তখনও তার ঘরেই ঢোকেনি।
তাতে আমাদের কি লাভ? হ্যারির প্রশ্ন।
সে আশা করছিল, তার মেসেজ পেয়ে স্যার মনটেরো ছুটে আসবেন হোটেলে। পালানোর আগে নিশ্চয় আবার ভেবেছিল সে কোথায় যাচ্ছে তার একটা নির্দেশ রেখে যাওয়া দরকার। কোনও একটা মেসেজ। কিংবা কোনও সূত্র।
এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এল ও। রওনা হলো পিটারের ঘরের দিকে। সকলের মনেই আশা, ছোট্ট একটা মেসেজ অন্তত রেখে যাবে পিটার।
<