খেসকি লেক। রিসালপুর। কয়েকশো বছরের পুরানো এই লেকটি। নোনা মাটির এলাকা। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ছোটবড় কাঁটাঝোঁপ। লেকটি ঠিক তার মাঝখানে। পচা পানি, শ্যাওলা ও দামে ভর্তি। লেকের চেহারা দেখে ওদের মঙলা লেকের ডাইভিংয়ের সুখানুভূতি নিমেষেই উবে গেল। তবুও ওদেরকে এই পচা লেকেই ডাইভিং করতে হবে। লেকের অদূরে খাটানো একটা বড় তাবু ওদের তিনজনের বাসস্থান। তাঁবুর প্রায় মাইলখানেক দূর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বরফ গলা পানির খরস্রোতা কাবুল নদী। চারপাশে জনশূন্য পরিবেশ। একটা আদিমতার পরশ সর্বত্র। জানজুয়া অভিমত প্রকাশ করল, খেসকি লেক আমার জীবনে একটা অন্ধকার অধ্যায় হয়ে থাকবে। জিয়ার অভিমত, খেসকি লেক আমাকে সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। আনোয়ার বলল, আদিমতার পরশ জড়ানো খেসকি লেক। তুমি আমাকে পৃথিবীর আদি অবস্থার কথা স্মরণ করিয়ে দিলে। জানজুয়া ও জিয়া একসঙ্গে বলে উঠল, খাসা বলেছ!

ওদের সঙ্গে কোন আর্দালি নেই। ট্রেনিংয়ের কদিন রিসালপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ওদেরকে নিয়মিত খাবার সরবরাহ করা হবে। রাতের অন্ধকারে এই এলাকায় নেকড়েরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যার অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে তিনজন তাঁবুর ভিতরে ঢুকল। একটা ছোট হারিকেনের মৃদু আলোয় ভেতরটা আলোকিত। ওদের পরনে সুইমিং কস্টিউম। খালি গা। প্রস্তুত ওরা ইন্ট্রাক্টরের ডাকে যখন তখন যেন সাড়া দিতে পারে। বিকেলে আর্দালি ফ্লাস্ক ভরে চা দিয়ে গেছে। চা-সিগারেট শেষ করে, গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল তিনজন ট্রেইনী ফ্রগম্যান।

তখনও চারদিকে অন্ধকার। কুয়াশা ভেজা প্রকৃতি। তাঁবুর বাইরে জীপের হর্নের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তিন ফ্রগম্যানের। মেজর ডেভিড চিৎকার করছেন, হারিআপ। কনকনে শীতের মাঝে ওরা নগ্ন পায়ে, নগ্ন গায়ে, শুধু সুইমিং কস্টিউম পরা অবস্থায় বেরিয়ে এল। শরীর গরম রাখার জন্য তিনজন লাফাচ্ছে অনবরত। ডেভিডের সারা শরীর মোটা গরম কাপড়ে আবৃত। তিনি জীপের পাশে দাঁড়িয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে সিগারেট টানছেন। হঠাৎ তিনি নির্দেশ দিলেন, তিনজন তিনটে তোয়ালে নাও। চমকে উঠল তিন ট্রেইনী ফ্রগম্যান! নগ্ন শরীরে এই কনকনে শীতের মধ্যে পানিতে চুবানি খেতে হবে নিশ্চয়ই! ডেভিডের সুদর্শন চেহারাটা মুহূর্তের ব্যবধানে ওদের কাছে বীভৎস বলে মনে হলো। লোকটা কি মানুষ? না পিশাচ? না অন্য কিছু? তোয়ালে নিয়ে ওরা আবার বেরিয়ে এল বাইরে।

দৌড়াও। কাবুল নদীর দিকে। মেজর ডেভিডের নির্দেশে ওরা তিনজন শুরু করল দৌড়।

নোনা মাটি। উঁচু নিচু পথ বরফের মত ঠাণ্ডা। তিনজনের নগ্ন পা যেন আর কিছুতেই উঠতে চাইছে না। তবুও ওরা প্রাণপণে দৌড়চ্ছে। কাবুল নদীর পেট চিরে বেরিয়ে গেছে একটা নাতিপ্রশস্ত চ্যানেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজন চ্যানেলের পাড়ে উপনীত হলো। বরফ গলা জল থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ওরা আন্দাজ করল, এই পানির তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির ওপরে নয়। নির্দেশ মত তিনজনই ঝাঁপিয়ে পড়ল বরফ গলা জলে। ওরা পাগলের মত ধস্তাধস্তি করছে, যাতে শরীরে রক্ত জমে না যায়। যে-কোন মুহূর্তে শরীরের রক্ত জমে যেতে পারে। মিনিট তিনেক পর তিনজনের গলা থেকে বেরুতে শুরু করল ভৌতিক চিৎকার। অপরিচিত কেউ ওদের দেখলে নির্ঘাত পাগল ঠাওরাবে। প্রায় পনেরো মিনিট পর এই অবস্থা থেকে ওদের মুক্তি দিলেন মেজর ডেভিড।

এরপর শুরু হলো ফ্রগম্যান বা অ্যামফিবিয়ান পিটি। এই কঠিন পিটি ওদের ঠাণ্ডায় জড়ানো শরীরকে গরম করে তুলল। মিনিট বিশেক পর প্রত্যেকের শরীর চুঁইয়ে পড়া শুরু হলো ঘাম। একঘণ্টা ধরে চলল এই পিটি। পিটি শেষে তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে আনোয়ার ভাবল, জয় পরাজয় মূলত ইচ্ছার ওপরেই নির্ভরশীল।

আকাশে সূর্য উঠেছে। সূর্যের আলোয় স্নাত ঝলমলে প্রকৃতি। ঠাণ্ডার তীব্রতা কমেছে কিছুটা। রিসালপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে জীপ এল, ব্রেকফাস্ট, একুয়ালাং সিলিণ্ডার, ক্যাম্প স্টুল, ফ্লিপার ও ওয়েট জ্যাকেট নিয়ে। ক্যাম্পস্টুলে বসে মেজর ডেভিডসহ নাস্তা সারল ওরা। তারপর ওদেরকে বলা হলো ডাইভিংয়ের জন্য তৈরি হতে। ঠাণ্ডার তীব্রতা থেকে কিছুটা রক্ষা পাবার জন্য ওয়েট জ্যাকেট পরল তিনজন। মোটা পুরু স্পঞ্জের তৈরি ওয়েট জ্যাকেটগুলো ফুল হাতা, সামনে বুক খোলা; কবুজি থেকে বুকের খোলা অংশ চেইনে বন্ধ করা যায়। পানিতে নামার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকেটগুলোর পুরু স্পঞ্জের কোষে কোষে পানি ঢুকে আটকে থাকে। শরীরের উত্তাপে ধীরে ধীরে পানি গরম হয়ে ওঠে। ফলে ফ্রগম্যান ঠাণ্ডার হাত থেকে কিছুটা রেহাই পায়।

ঠিক হলো, ক্যাপ্টেন জানজুয়া ও জিয়া এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার ও সুবেদার আনোয়ার জোড়া বেঁধে ডাইভিং করবে। মেজর ডেভিড রাবারের ডিঙি নৌকায় পানির ওপরে থাকবেন। ওরা খেসকি লেকের পিচ্ছিল পাড় বেয়ে নামা শুরু করল। ওদের নগ্ন পায়ের তলা ঠাণ্ডায় অবশ। কিছুদূর নামার পর ঘটল বিপত্তি। পিচ্ছিল পাড় বেয়ে নামার সময় তিনজন পড়ে গেল। ওপর থেকে মেজর ডেভিড বললেন, টু আওয়ার্স এক্সট্রা সারফেস সুইমিং আফটার লাঞ্চ উইথ ডবল বটল। অর্থাৎ দুপুরে খাবার পর পিঠের ওপর অতিরিক্ত ৭৮ পাউণ্ড ওজনের সিলিণ্ডার বেঁধে দুঘণ্টা সাঁতার কাটতে হবে।

ডাইভ দেবার আগে ওরা একে অন্যের সঙ্গে রশি দিয়ে কব্জি বেঁধে নিল, যাতে কেউ বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে। ওদের সঙ্গে রয়েছে। আণ্ডারওয়াটার ওয়াচ, ডেপথ গেজ এবং আণ্ডার ওয়াটার কম্পাস। পচা পানির দুর্গন্ধ নাকে ঝাঁপটা দিচ্ছে। ফেস-মাস্ক ঠিক করে নিয়ে চারজন ডুব দিল জোড়ায় জোড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ারের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কয়েকটা দীর্ঘাকৃতি সাপের ছোঁয়া পেল ও। কোনটাই ওকে কামড় দিল না। সাপগুলোর পিচ্ছিল শরীর ওর গা ঘেঁষে চলে গেল। প্রতি মুহূর্তে নগ্ন পায়ে লম্বা পিচ্ছিল শ্যাওলা জড়িয়ে যাচ্ছে। কোটা শ্যাওলা, আর কোটা সাপ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। চারদিকে গা ঘিন ঘিন করা অনুভূতি। কিছুক্ষণ পর ওরা টের পেল, ওয়েট জ্যাকেটের ভিতর পানি গরম হয়ে শরীরের স্থানীয় তাপমাত্রা বজায় রাখতে সাহায্য করছে।

তলদেশের পানি অতিরিক্ত ঘোলা–যেন নরম কাদার আস্ত রণ; নানা আগাছায় পরিপূর্ণ। দৃষ্টিসীমা কয়েক ইঞ্চির ভিতরে সীমিত ওদের। আনোয়ার সুবেদারের কোন ইঙ্গিত বুঝতে পারছে না।শেষে সুবেদার ওকে নিয়ে পানির ওপরে ভেসে উঠল। স্থির হলো, আঙুলের ইশারা একেবারে মুখের সামনে এনে দেখানো হবে। তাতেও কাজ না হলে ওর রশিতে বিভিন্ন ধরনের টান দিয়ে সংকেত দেয়া হবে। আবার ওরা ডুব দিল। বিশ ফুট গভীরতায় যাওয়ার পর আর নিচে যাওয়া সম্ভব হলো না। নিচে ঘন শৈবাল ও দাম। শুরু হলো সম্মুখে এগিয়ে চলা। কম্পাস ওদের পথ নির্দেশক। মুখের পাশ ঘেঁষে বিভিন্ন পিচ্ছিল জলজ প্রাণীর আনাগোনা টের পাচ্ছে চার ফ্রগম্যান। প্রায় একঘণ্টা চলল ওরা কম্পাস ধরে। এরপর টান পড়ল ট্যাংকের বাতাসে। রিজার্ভ ট্যাংকের কর্ড টান দিয়ে চারজন ভেসে উঠল জোড়ায় জোড়ায়।

ফিনিশড-কানের কাছে ওরা মেজর ডেভিডের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। তিনি রাবারের র‍্যাফট নিয়ে বুদ্বুদ লক্ষ্য করে এগিয়ে এসেছেন। ওরা দ্রুত সাঁতার কেটে কিনারায় পৌঁছল। তারপর তাঁবুতে ফিরে এল সবাই। তাঁবুর সামনে ঘাসের ওপর বসে ওরা বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ আনোয়ারের নজর পড়ল নগ্ন পায়ের ওপর। প্রায় গোটা বিশেক জেঁক। ওগুলো রক্ত খেয়ে বেশ মোটা তাজা হয়েছে। ওর সমস্ত শরীর কিলবিল করে উঠল ঘৃণায়। সুবেদার আনোয়ার সিগারেটের আগুন দিয়ে একটা একটা করে সবগুলো জোক খুলে ফেলল ওর শরীর থেকে।

কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার ওদেরকে যেতে হলো খেসকি লেকে। আবার দিতে হলো ডুব। বেলা এগারোটা পর্যন্ত চলল ডাইভিং। ডাইভিং শেষে কাবুল নদীর বরফ গলা পানিতে শরীর ভাল মত পরিষ্কার করে রোদে বসে ওরা দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিল। লাঞ্চের পর বেলা চারটে পর্যন্ত চলল পানিশমেন্ট-সুইমিং। সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার নেমে এলে শেষ হলো ওদের ইভনিং ট্রেনিং।

তাবুর বাইরে আর্দালিরা আগুনের কুণ্ডলী জ্বালিয়েছে। ওরা তাঁবুর ভিতরে বসে অফিসার্স মেস থেকে আনা স্ন্যাকস, চা সহযোগে হালকা নাশতা সারল। তাঁবুর বাইরে অন্ধকার। কুণ্ডলীর পাশে বসে আর্দালিরা চাপাস্বরে ফিসফাস করছে। মেজর ডেভিডসহ ওরা তিনজন তাঁবুর ভিতর খোশগল্পে মগ্ন। রাত সাড়ে আটটার দিকে ডেভিড বলে উঠলেন, চলো, ওঠা যাক। ব্যাপার কি? তিনজনের চোখে-মুখে বিস্ময়! ডেভিড ধীরে সুস্থে জানালেন, নাইট ডাইভিং। ওরা নির্বোধের মত একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করল। লোকটা মানুষ না পিশাচ? সেঁক, সাপ, শৈবাল, দামে ভরা লেকে যেখানে দিনের বেলায় ডাইভিং করাটাই রীতিমত বিপজ্জনক, সেখানে কিনা এই রাতে ডাইভিং করতে হবে।

জানজুয়া বলল, স্যার, তার চেয়ে আমরা কাবুল নদীতে পনেরো মিনিট গোসল করে আসি। কি কঠিন অবস্থায় পড়লে এই তীব্র শীতের রাতে কাবুল নদীর বরফগলা পানিতে গোসলের প্রস্তাব করা যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। মেজর ডেভিড দাঁত বের করে হেসে জানালেন, হবে, হবে সেটাও হবে। সর্বনাশ! এ যেন পাগলকে সাঁকো নাড়াতে বারণ করার অবস্থা। জানজুয়া ও জিয়া ফিসফিস করে ডেভিডের উদ্দেশ্যে খিস্তি করছে। আনোয়ার পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠল, শালা, অমানুষ একটা।

ভয় নেই আনোয়ার। তোমার মৃত্যু-সংবাদ আমার মেয়েকে দেব না। তুমি মরে গেলে আমার মেয়ে চিরকুমারীই রইবে। এবারে চলল, রূপালী লেকে একটু জলকেলী করা যাক। কথাগুলো ইংরেজিতে বললেন ডেভিড।

ডাইভিং গীয়ার পরা অবস্থায় সবাই চলল খেসকি লেকের উদ্দেশে। ঘুটঘুঁটে জমাট বাঁধা অন্ধকার। তীব্র ঠাণ্ডা। চাপ চাপ অন্ধকারের নীরব কোলে সারা পৃথিবী বিশ্রামরত। মাঝে মাঝে অন্ধকারের বুক চিরে দূর থেকে ভেসে আসছে নিশাচর পাখির ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ। মুহূর্তের জন্য প্রকৃতি সচকিত হয়ে উঠছে। আবার তলিয়ে যাচ্ছে গভীর নিদ্রায়। ঠিক আধো-ভৌতিক পরিবেশ। দূর আকাশে দেখা যাচ্ছে এলোমলো কিছু ক্ষীণ তারা। খেসকি লেকের পাড়ে সবাই থমকে দাঁড়াল। প্রেতাত্মাদের পরিত্যক্ত রহস্যময় দীঘি বলে মনে হচ্ছে লেকটাকে।

আণ্ডার ওয়াটার টর্চ ওদের ইচ্ছে করে দেয়া হলো না। লেকের কিনারায় একটা রাবারের র‍্যাফট। র‍্যাফটের ওপর মেজর ডেভিড ও সুবেদার আনোয়ার। জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার ভেলাটার কোণা ধরে পানিতে ভাসছে। শ্যাওলা, দাম ও আগাছার পাশ ঘেঁষে র‍্যাফট এগিয়ে চলল। লেকের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে থেমে গেল ভেলা। প্রত্যেকের হাতে রশি বাঁধা। ওদের বলা হলো ডাইভিংয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে। ডেভিড র‍্যাফট-এর ওপর বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, দড়িতে এক টান অর্থ, নিচে যেতে হবে। দুই টান, দাঁড়াও। তিন টানে ডানে এবং চার টানে বামে। পাঁচ টান ওপরে উঠে আসার সিগন্যাল। ঘন ঘন টান ইমারজেন্সী।

ওরা ডুব দিল খেসকি লেকে। নিচে দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ শূন্য। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। আনোয়ার নিজেকে হারিয়ে ফেলল অন্ধকারে। শরীরের কোন অংশই নজরে পড়ে না। অসহ্য ঠাণ্ডা। শ্যাওলা ও জলজ প্রাণীর পিচ্ছিল অনুভূতি নগ্ন শরীরে। রেডিয়াম সংযুক্ত বলে আণ্ডার ওয়াটার ঘড়ির ডায়াল ও ডেপথ গেজ শুধু নজরে পড়ছে। ডেপথ গেজ অনুযায়ী বিশ ফুট গভীরে পৌঁছল সবাই। প্রচুর শ্যাওলা ওর শরীর পেঁচিয়ে ধরছে। এই পিচ্ছিল শ্যাওলার মাঝে। প্রায় তিরিশ মিনিট কেটে গেল । আনোয়ার হঠাৎ আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সমস্ত শরীরের রক্ত ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। হাতের আঙুলগুলো জমে যাওয়ার ভয়ে অনেকক্ষণ ধরে মুঠ পাকাচ্ছিল আর খুলছিল যাতে রক্ত সঞ্চালন অব্যাহত থাকে।

কিন্তু এখন আর মুঠো পাকানো যাচ্ছে না। হাতের আঙুলগুলো অনুভূতিশূন্য। স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করানো যাচ্ছে না ওগুলো। কব্জিতে বাঁধা রশিও হাত দিয়ে ধরা গেল না। বাধ্য হয়ে হাত ঝাঁকি দিয়ে রশিতে ইমারজেন্সী সিগন্যাল দিল আনোয়ার। ইমারজেন্সী সিগন্যাল পেয়ে ওকে দ্রুত টেনে তোলা হলো ওপরে। অন্যদেরকেও একই কায়দায় ওপরে ওঠানো হলো। তারপর সবাই ফিরে এল তাঁবুতে। ডাইভিং গীয়ার খুলে ওরা তাড়াতাড়ি ঢুকল পিপিং ব্যাগে। পরপর কয়েক বাউল গরম সুপ খেলো সবাই। ধীরে ধীরে পিপিং ব্যাগের আরামদায়ক উষ্ণতা ও গরম সুপ ওদের শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা ফিরিয়ে দিল কিছুটা । ডিনার শেষে মেজর ডেভিড আর্দালিসহ বিদায় নিলেন।

আগেই বলা হয়েছে জায়গাটার নোনা মাটির ওপর ছোট ছোট কাঁটাঝোঁপ। সেখানেই একটা বাবলা গাছের নিচে ওদের তাঁবু। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে দলবদ্ধ নেকড়ের চাপা গর্জন। পরম নিশ্চিন্তে তিনজন ফ্রগম্যান ঘুমিয়ে পড়ল পিপিং ব্যাগে, তাঁবুর ভিতর। অথচ ওদের নিরাপত্তার কোন বালাই নেই।

রাত তিনটা। মুহুর্মুহু জীপের হর্নের আওয়াজ শোনা গেল তাঁবুর বাইরে। ঘুম ভেঙে গেল তিনজনের। হারিআপ, কাম আউট মেজর ডেভিডের গলা ফাটানো চিৎকার শুনতে পেল ওরা। মীন বাস্টার্ড, স্যাডিস্ট প্রভৃতি গালি দিতে দিতে তিনজন শুধু সুইমিং কস্টিউম পরা অবস্থায় পিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল। মেজর ডেভিড় বললেন, লেটস গো ফর এ লেট-নাইট, ডীপ। অর্থাৎ গভীর রাতের ডাইভিং। নির্দেশমত সবাই দৌড়ানো শুরু করল কাবুল নদীর সেই বরফগলা জল ভর্তি চ্যানেলের দিকে। ডেভিড চিৎকার করে নির্দেশ দিলেন, ডাউন। তিনজন ফ্রগম্যান ঝাঁপিয়ে পড়ল বরফগলা জলে। শুরু হলো প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি। এটা শরীর গরম রাখার একটা প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ওদের। দীর্ঘ আধ ঘণ্টা পর পরিত্রাণ মিলল তিনজনের।

সকালে দেখা হবে, ডেভিড দাঁত বের করে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। তাঁর গমন পথের দিকে চেয়ে আনোয়ার বলে উঠল, বানচোত । আবার তিনজন ফিরে এল তাঁবুতে-ঘুমিয়ে পড়ল পিপিং ব্যাগের আরামদায়ক উষ্ণতার মাঝে।

এরপর থেকে প্রতিদিন অনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী, একই ধরনের ট্রেনিং চলতে থাকল। দিনরাত মিলে প্রায় চোদ্দ ঘণ্টা ওদের খেসকি লেকের পচা পানির তলদেশে ডাইভিং করতে হচ্ছে। বিশ্রামের সময়গুলোর বেশ কিছু অংশ শরীর থেকে জোক ছাড়াতে কেটে যায়। তিনদিন পর থেকে শুরু হলো ক্যাপ্টেন জিয়ার নাক থেকে হলুদ পানি গড়ানো। মেজর ডেভিড ওদের রাবার সুট ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। রাবার সুট তিনজনকে জোঁক আতঙ্ক থেকে অব্যাহতি দিল।

দিনের বেলা। তিনজনে ডাইভিং করছে খেসকি লেকে। আনোয়ার ডেপথ গেজ দেখে বুঝতে পারল সে বিশ ফুট গভীরে– রয়েছে। আজ আরও গভীরে যাবে ও। ডেপথ গেজে বিশ ফুট অতিক্রান্ত হয়ে গেল। হঠাৎ সে টের পেল ফেস-মাস্কের ভিতর দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ঘন অন্ধকার চারদিকে। ব্যাপারটা হঠাৎই ঘটে গেল। আনোয়ার হারিয়ে গেছে খেসকি লেকের তলদেশে। বিশ ফুট পর থেকে শুরু হয়েছে একটা নরম কাদার স্তর। কাদার মাঝে দাম ও শৈবাল। সে আটকা পড়েছে নরম কাদার এই স্তরে। সঙ্গী সুবেদার দ্রুত ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। সুবেদারের আপ্রাণ চেষ্টায় আনোয়ার বহু কষ্টে কাদার স্তর ভেদ করে উঠে এল ওপরে। একটা মারাত্মক অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেল সে।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর। দিনের বেলায় ওরা পুনরায় ডাইভিং করছে খেসকি লেকে। আনোয়ার বিশ ফুট গভীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ট্যাংকের বাতাস প্রায় শূন্য। এই সময় ও হঠাৎ আটকে গেল শৈবাল ও দামের ভিতর। বহু চেষ্টার পরও নিজেকে মুক্ত করতে পারল না। এবারও সঙ্গী সুবেদারের প্রচেষ্টায় সে বিপদমুক্ত হলো। সুবেদার দ্রুত ওপরে গিয়ে তাঁবু থেকে ছুরি নিয়ে নেমে এল নিচে। ছুরি দিয়ে দাম কেটে ওকে মুক্ত করল। এ যাত্রায়ও আনোয়ার নির্ঘাত প্রাণে বেঁচে গেল। এরপর থেকে পানির তলদেশে ওদের সঙ্গী হত ডাইভিং-নাইফ।

এভাবে অতিক্রান্ত হলো পনেরো দিন। ওদেরকে পুনরায় নিয়ে আসা হলো মঙলা লেকে। মঙলা লেকের জল স্ফটিক স্বচ্ছ–ঈষৎ নীল। তিরিশ গজ পর্যন্ত দৃষ্টি যায়। কোথাও বা তারচেয়েও বেশি। মঙলা লেকে ডাইভিং আনন্দপূর্ণ। বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও বিচিত্র মাছে ভরা লেক। ওরা হারিয়ে যেতে চায় লেকের তলদেশে । এই স্ফটিকস্বচ্ছ ঈষৎ নীল পানি, রঙিন নুড়ি, বিচিত্র জলজ প্রাণী আনোয়ারের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তোলে-বড় আনন্দপূর্ণ ও তৃপ্তিময়। ও ভুলে যায় পৃথিবীকে হারিয়ে যায় বহুদূরে। ওরা তিনজন ওপরে উঠে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে আসে বৃহৎ আকারের একটা করে মাছ। মাছগুলো স্পিয়ারগান দিয়ে শিকার করা। সুস্বাদু চপ, কাটলেট প্রভৃতি চমৎকার খাবার তৈরি হয় শিকার করা মাছ দিয়ে। ক্রমেই ওরা ভুলে গেল খেসকি লেকের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা।

ডাইভিংয়ের গভীরতা বেড়েই চলল। সেই সঙ্গে পানির নিচে চাপ সহ্য করার ক্ষমতাও বাড়ছে। ৭০ ফুট গভীরতায় পৌঁছল তিনজন। বেলা এগারোটার আগে পানি থেকে ওঠা নিষেধ। আনোয়ার ভাবছে, এগারোটা কেন? সে চিরদিনের জন্য মঙলা লেকের তলদেশে থাকতে রাজি। মঙলার ফুটফুটে তলদেশ অপূর্ব। কিন্তু গভীর পানিতে বেশিক্ষণ ডাইভিং বিপজ্জনক। বেলা এগারোটার পর টি-ব্রেক । ওরা তখন উঠে আসতে বাধ্য হয় লেক থেকে।

স্কি-ইং (SKI-ING)। মুসা কোম্পানীতে ৩৫টি স্পীড বোট রয়েছে। এগুলোর শক্তি ৩৩ থেকে ১৫০টি হর্স পাওয়ার। স্কি-ইং তুলনাহীন আনন্দদায়ক। অদ্ভুত রোমাঞ্চকর। তিনজনের মাঝে একজন স্পীড বোট চালায়। একজন স্কি-ইং করে। একজন বোটে বসে থাকে। বোট তীব্রগতিতে এগিয়ে চলে লেকের বুকে। বোটের পেছনে বাঁধা একটা রশির প্রান্ত স্কি-ম্যান ধরে রাখে। পায়ে থাকে তার স্কি। লেকের খোলা বাতাসে ওদের চুল এলোমেলো হয়ে যায়। তিনজন পালাক্রমে সর্পিল গতিতে ছুটে বেড়ায় লেকের বুকে।

পি.এন.এস. ইকবাল, করাচী। আরব সাগরের খাড়ির প্রান্তে প্রায় পানির ওপর নির্মিত। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল পি.এন.এস. ইকবালের দোতলায় বিশাল আকারের তিনটা কামরা ওদের তিনজনের জন্য বরাদ্দ করা হলো। প্রথম কামরায় ক্যাপ্টেন জানজুয়া, তারপর ক্যাপ্টেন জিয়া ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার। প্রতিটি কামরায় অ্যাটাচড় বাথরূম। অত্যাধুনিক বাথরূমগুলোতে ঠাণ্ডা ও গরম পানির সুব্যবস্থা। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই আরব সাগরের কালোজল চোখে পড়ে। প্লেনে করে তিনজন পৌঁছল পি. এন.এস. ইকবাল, করাচীতে।

কমপ্রেশন টেস্ট। গভীর পানিতে যাওয়ার উপযুক্ততার পরীক্ষা। কমপ্রেশন টেস্টের জন্য একটা নির্দিষ্ট চেম্বার রয়েছে। চেম্বারটি মিশ্র ধাতুর তৈরি। ভীষণ মজবুত। সম্পূর্ণরূপে এয়ারটাইট। কঠিন কাঁচে আবৃত কয়েকটা ফোকর রয়েছে চেম্বারের গায়ে। পরীক্ষকরা এই ফোকর দিয়ে পরীক্ষার্থীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। বাইরে যোগাযোগের জন্য চেম্বারের ভিতরে কয়েকটা টেলিফোন রয়েছে। চেম্বারটি প্রায় গোলাকৃতি। ফুট দুয়েক ব্যাসের গোলাকার দরজাটা মজবুত স্টীলের তৈরি। ভিতরে ধূমপান নিষেধ। সাবধান! কোন ধারাল জিনিস ভিতরে নিয়ে যাওয়া চলবে না। ইস্পাতের সঙ্গে ধারাল জিনিসের ঘষায় যে-কোন মুহূর্তে চেম্বারের ভেতর আগুন ধরে যেতে পারে। কারণ ভেতরে প্রেশারাইজড় বাতাসের চাপ রয়েছে। বাতাসের অতিরিক্ত চাপে কোন পরীক্ষার্থীর অবস্থা মারাত্মক হয়ে উঠলে সুইচে চাপ দিলে বাইরে ঘণ্টা বেজে ওঠে।

যথাসময়ে তিনজনের শুরু হলো কমপ্রেশন টেস্ট। ওরা চেম্বারে আবদ্ধ। হিসহিস শব্দে ভেতরে প্রেশারাইজড বাতাস ঢুকছে। ডেথ গেজে টের পাওয়া যাচ্ছে গভীরতা। শরীর এবং কানের ঝিল্লির ওপর ক্রমেই চাপ বাড়ছে। একজন ফ্রগম্যান পানির নিচে যে অবস্থার সম্মুখীন হয়, চেম্বারের মাঝে ওদের কৃত্রিম উপায়ে সেই অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ অনুযায়ী ওরা মাঝে মাঝে নিশ্বাস বন্ধ অবস্থায় ব্লো করছে। ফলে শরীরের ওপর নিউট্রালাইজ হয়ে যাচ্ছে বাইরের চাপ। একশো ফুট গভীরে যাওয়ার পর জিয়ার সাইনাস ও কানের পর্দায় ব্যথা শুরু হলো। ওরা দ্রুত সংকেত পাঠাল বাইরে। জিয়া টেলিফোনে। কথা বলা শুরু করল বাইরে অপেক্ষমাণ ডাক্তারের সঙ্গে। জিয়ার কথা অনুযায়ী ওদের কিছুক্ষণ স্থির করে রাখা হলো, একশো ফুট গভীরতায়। আবার ধীরে ধীরে বাড়ল চাপ। এইভাবে ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো দুশো ফুট গভীরে। আর কারও কোন অসুবিধা হলো না। তিনজনই উত্তীর্ণ হলো কমপ্রেশন টেস্টে।

এরপর শুরু হলো ডিকমপ্রেশন। কমপ্রেশন টেস্টে চাপ বাড়ানো হয়। কিন্তু ডিকমপ্রেশন টেস্টে চাপ কমানো হয়। চাপ বাড়ানোর চাইতে কমানোর প্রক্রিয়া বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ডিকমপ্রেশন টেস্টে একজন ফ্রগম্যান বেণ্ড, লাং বাস্ট বা এয়ার এমবোলিজমের শিকার হতে পারে। ধীরে ধীরে প্রেশার চেম্বারে বাতাসের চাপ কমছে। ডেপথ গেজে দেখা যাচ্ছে ওরা একশো ফুট গভীরে। পুনরায় জিয়া অসুবিধার সম্মুখীন হলো। বাইরে সংকেত পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হলো চাপ কমানো। একশো ফুট গভীরতা জিয়ার জন্য ক্রিটিক্যাল ডেপথ। এই গভীরতায় জিয়াকে একটু বিশ্রাম নিয়ে চাপ সয়ে নিতে হবে। কিছুক্ষণ পর প্রেশার চেম্বারে শুরু হলো ডিকমপ্রেশন। এই টেস্টেও ওরা তিনজন সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলো।

আরব সাগরের বেলাভূমি। কুচকুচে কালো জল। বিশাল সাগর শত রহস্য বুকে নিয়ে স্থির, অবিচল। করাচী শহর তখনও তন্দ্রার কোলে আচ্ছন্ন। ঘন কুয়াশায় আবৃত চারদিক। বাইরে যেন জমাট বাঁধা ঠাণ্ডা। এই ঠাণ্ডা ভেদ করে ছুটে চলেছে–জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার। সঙ্গে রয়েছে নিষ্ঠুর প্রকৃতির হাবিলদার রমজান। আরব সাগরের কোল চিরে বেরিয়ে যাওয়া একটা খাড়ির পাড়ে তিনজনে হাজির হলো। অদূরে চকচকে বেলাভূমি, ঘন কুয়াশার সাদা চাঁদরে আবৃতা। দিনের বেলায় শত শত বিদেশী টুরিস্ট নরনারীর চঞ্চল পদক্ষেপে মুখরিত হয়ে ওঠে এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বেলাভূমি। এটাই ওদের ট্রেনিং এলাকা। কিন্তু ওদের অভিজ্ঞতা টুরিস্টদের ঠিক উল্টো।

খাঁড়ির পাড়ের ওপর দিয়ে সবাই দৌড়চ্ছে। মাইল দুয়েক অতিক্রান্ত হওয়ার পর থামতে বলল হাবিলদার রমজান। সম্মুখে একটা বিশাল আকৃতির মোটা পাইপ। করাচী শহরের মলমূত্র ও যাবতীয় আবর্জনা সাগর বক্ষে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এই পাইপ দিয়ে । সাগরের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে মলমূত্ৰ চাপ চাপ হয়ে আসছে। এগুলো মাছের উপাদেয় খাদ্য। ওরা দেখতে পেল, বিভিন্ন আকারের মাছ হুটোপুটি খেলছে নোংরা জায়গাটায়।

হঠাৎ রমজানের উচ্চম্বরের নির্দেশ শোনা গেল, স্যার, আপনারা এই পানি দিয়ে কুলকুচো করুন। ভাল করে হাত মুখ পরিষ্কার করুন। সেই সঙ্গে গোসলও করতে হবে। ফ্রগম্যান তিনজন বৈদ্যুতিক-শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। ব্যাটা বলে কি? চারদিকে তাজা, পুরানো মলের চাই। তার ওপর অন্যান্য আবর্জনা তো আছেই। একবার দেখলেই সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে ওঠে। হাবিলদারের দিকে তিনজনে তাকাল করুণ দৃষ্টিতে। কিন্তু রমজান নির্বিকার। নির্দেশ পালন না করলে কোর্স থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নির্দেশ পালন করা ছাড়া পরিত্রাণের কোন উপায় নেই। ফ্রগম্যান ট্রেনিংয়ের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে তিনজন এগোল মলভর্তি ঘনকালো নোংরা পানির দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ল দুর্গন্ধময় পানিতে।

দেহ সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গে মলের চাঁইগুলো খুঁড়িয়ে গেল। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তারপর। আনোয়ার আঁজলা ভরে পানি নিল কুলি করার জন্য। আঁজলার পানিতে ক্ষুদ্র একটা মলের দলা দেখতে পেল সে। শরীরটা ঘিন ঘিন করে উঠল। উদগ্র বমি বহুকষ্টে সংবরণ করল আনোয়ার। দুর্গন্ধে মাথাটা গুলিয়ে উঠেছে। পড়ে গেল আঁজলার পানি নিষ্ঠুর রমজান একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। ভীষণ রাগ, ক্ষোভ ও অসহনীয় কষ্টে মনটা বিষিয়ে উঠল। হাত দিয়ে মলের চাঁইগুলো সরানো যাচ্ছে না। সরাতে গেলেই ওগুলো গুঁড়িয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে পানিতে। কিছু কিছু মলের চাই গুঁড়িয়ে যাওয়ায় পানির ঘনত্বও বেড়ে গেছে। ধীরে ধীরে আবার আঁজলা ভরে পানি তুলল আনোয়ার।

আনোয়ার দ্রুত মুখে দিল পানি। জিভ জড়িয়ে গেল ঘন পানির পরশে। পানি তো নয়–যেন নরকের বিষ। অনেকক্ষণ ধরে মুখ হাত পরিষ্কার করতে হলো পানি দিয়ে। দাঁতের ফাঁকে ময়লা আটকে গেল। সারা শরীরে ওদের একটা পাতলা স্তর পড়েছে। পিচ্ছিল শ্যাওলার মত। কটুগন্ধে ওদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নীরব দর্শকের মত অদূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে রমজান। ও যেন পাষাণ মূর্তি। স্নেহ, মমতা ও মানবীয় গুণের ঊর্ধ্বে এক নরপিশাচ। ওরা ঘন ঘন তাকাচ্ছে রমজানের দিকে। ঠাণ্ডায় ওদের দাঁতে দাঁত বাড়ি খেয়ে সৃষ্টি হলো এক অদ্ভুত বেসুরো আওয়াজ। হঠাৎ রমজান চিৎকার করে উঠল, স্যার, আপনারা উঠে আসুন। আনোয়ারের মনে হলো, এটাই রমজানের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর বাণী। তিনজন তীরে উঠেই ছুট লাগাল পি.এন.এস. ইকবালের দিকে।

রূমে এসে সোজা বাথরূমে ঢুকল আনোয়ার। গরম পানির শাওয়ার ছেড়ে দিল। শরীর গরম হয়ে এলে ঠাণ্ডা ও গরম পানি অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভিজল সে। কয়েকবার পেস্ট লাগাল দাঁতে। শরীরের প্রতিটি অণুপরমাণু সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে শেষে ডেটল দিয়ে গোসল সেরে বাথরূম থেকে বেরিয়ে এল ও। গরম চিকেন সুপসহ নাস্তা সেরে আবার তিনজন ছুটল আরব সাগরের দিকে। শুরু হবে রহস্যময় সাগরের হলদেশে ডাইভিং।

উজ্জ্বল রোদ ঝিলমিল করছে। রোদে বীচের বালি থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ ধাঁধানো দ্যুতি। ফুরফুরে বাতাসে আন্দোলিত সাগরবক্ষ। দূর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে দুএকটা জাহাজ। সাগরের কিনারায় একটা বোট অপেক্ষমাণ। মেজর ডেভিড বসে রয়েছেন বোটের ওপর। বোটে করে ওদের নিয়ে যাওয়া হলো প্রায় আধ মাইল দূরে। রাবারসুটবিহীন অবস্থায় ডাইভিং করতে হবে। সবাই ভাবছে প্রচণ্ড শীতে হয়তো শরীরের রক্ত জমে যাবে। বেশিক্ষণ ডাইভিং করা সম্ভব হবে না। ডেভিড নির্দেশ দিলেন, ডাউন। ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল আরব সাগরের কুচকুচে কালো পানিতে হারিয়ে গেল গভীর পানির অন্তরালে।

আরামদায়ক উষ্ণ পানি। ওদের ভয় কেটে গেল। নিচে পানিও পরিষ্কার। বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যাচ্ছে ওদের। এখানে পানির গভীরতা চল্লিশ ফুট। আনোয়ার পৌঁছে গেল তলদেশে। বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিকে। দুই তিন ইঞ্চি থেকে শুরু করে প্রায় চোদ্দ পনেরো ফুট লম্বা মাছগুলো। কোন কোনটা ওর মুখের সামনে এসে বোকার মত হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ছে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওরা আগন্তুকদের। হঠাৎ আনোয়ারের দৃষ্টি আটকে গেল-তলদেশে অসংখ্য রঙিন পাথর।

কমলা, পীত, তামাটে, কালো, ধূসর বিভিন্ন রঙের পাথর। তবে কালো রঙের পাথর বেশি। কোন কোনটার আকৃতি বিরাট। এইসব পাথরের ফাঁকে ফাঁকে রঙিন নুড়ি পাথরও দেখতে পেল সে। নুড়ি পাথরগুলো মুক্তার মত টলটলে। কতকগুলো পাথরের অগ্রভাগ তীক্ষ্ণ। বিশাল আকৃতির কয়েকটা পাথরের গায়ে ফাটল। ফাটলগুলোর মাঝে গভীর অন্ধকার। হাঁ করা ফাটলগুলোর মুখে সবুজ শ্যাওলার আস্তরণ। নানা বর্ণের মাছ, সাপ, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও অচেনা সামুদ্রিক প্রাণী আনাগোনা করছে ওখানে।

রূপালী ফুলের রাজ্য আনোয়ারের দৃষ্টি কেড়ে নিল। লাল, সবুজ, গোলাপী, হলুদ নানা বর্ণের, অজস্র ফুলের সমারোহ। ফুলের উজ্জ্বল আলোয় তলদেশের বেশ কিছুটা অংশ আলোকিত। পানির তলায় প্রস্ফুটিত ফুলগুলোকে আকারে বেশ বড় দেখাচ্ছে। কি অপরূপ! কত সুন্দর! ওর মনটা নির্মল আনন্দে ভরে উঠল। অদ্ভুত ধরনের কিছু ফুল লক্ষ করল সে। এগুলো থেকে উজ্জ্বল নীলাভ আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। ফুলের দেশে কতকগুলো মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে এঁকেবেঁকে। ওরা যেন রূপালী দেশের রাজপুত্র।

ওর মুগ্ধ দৃষ্টি আবারও হরণ করল–তুষারশুভ্র বালির প্রান্ত । স্বচ্ছ পানিতে নিটোলভাবে ফুটে রয়েছে। যেন এইমাত্র কোন নিপুণ শিল্পী এঁকে গেল। এই নীরব, স্পন্দনহীন, তুষারশুভ্রতার মাঝে ও দুষ্ট বালকের মত ছুটোছুটি করছে। সারাদেহে এক অনাবিল আনন্দের পুলক। ওর চারপাশে প্রকৃতির অপূর্ব বিস্ময় অপার সৌন্দর্য। মাঝে মাঝে চঞ্চল বালকের মত কোমল বালি নিয়ে খেলা করছে আনোয়ার। সময় জ্ঞান হারিয়ে নিটোল বালির প্রান্তরে ও যেন হারিয়ে গেল । হঠাৎ টান পড়ল ট্যাংকের বাতাসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওপরে আসতে হলো ওকে।

পরদিন। শীতের সকাল। জানজুয়া, জিয়া ও আনোয়ার আবার উপস্থিত হলো সাগরের পাড়ে। চারদিকে কাঁচামোনা রোদ। দশজন যাত্রী বহন করার উপযোগী একটা কাঠের তৈরি মজবুত নৌকা পড়ে রয়েছে সাগরের পাড়ে। মেজর ডেভিড ওদের নৌকাটি ঘাড়ে করে দৌড়ানোর নির্দেশ দিলেন। সমুদ্র সৈকতের ওপর দিয়ে ওরা দৌড়চ্ছে। প্রত্যেকের জুলফি বেয়ে কুলকুল করে গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। একটা উঁচু মাটির টিলার প্রান্তে পৌঁছুতেই ওপর থেকে কে যেন লাফিয়ে পড়ল নৌকার ওপর। তিনজন, তাকিয়ে দেখতে পেল মেজর ডেভিডকে। তিনি নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসছেন। মাঝে মাঝে দুপা এপাশ ওপাশ করে নৌকা দোলাচ্ছেন। ওদের দৌড়ের গতি শ্লথ। একে মজবুত কাঠের নৌকা, তার ওপর ডেভিডের ভারী শরীর। তিনজনের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম। ওরা ইশারায় ঠিক করল ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা।

হঠাৎ কাত হয়ে গেল নৌকা। ডেভিড লাফিয়ে পড়লেন মাটিতে। ওদের দৌড়ের গতি আবার দ্রুত হলো। প্রায় দুই মাইল অতিক্রম করার পর ডেভিড থামতে নির্দেশ দিলেন। আনোয়ার, জানজুয়া, জিয়া, তোমরা টায়ার্ড। সামনে পরিষ্কার পানি। হাতমুখ ধুয়ে ভাল করে গোসল করে এসো। যাও। মেজর ডেভিডের কথা শুনে ওদের মেজাজ গেল বিগড়ে। সামনে মলের চাই ছড়ানো সেই নারকীয় পানি। আনোয়ারের তীব্র দৃষ্টি ডেভিডের দিকে। ডেভিড শিশুর মত ফিক করে হেসে আবার বললেন, যাও বেটা, নাহাকে আও।

ব্ল্যাক হোল টেস্ট। ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ ভয়ঙ্করতম পরীক্ষা এটা। আনোয়ারকে জানানো হলো, সাগরের তলায় কোন এক জায়গায় ওকে একাকী তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট বসে থাকতে হবে। ওর সঙ্গে রমজান। দুজন ডুব দিল আরব সাগরে। প্রায় সত্তর ফুট তলিয়ে গেল ওরা। সম্মুখে একটা বিশাল কালো ডুবন্ত পাহাড়। গায়ে একটা ফাটল। ভয়ঙ্করভাবে হাঁ করে আছে ফাটলটি। আবার সেই কৃষ্ণমূর্তি অন্ধকার। আনোয়ারের মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল একটা ঠাণ্ডা স্রোত। ওর মনে হলো ফাটলটা মোরে-ঈলের উপযুক্ত বাসস্থান। হাবিলদার ও আনোয়ার এগিয়ে চলল ফাটলের দিকে। অন্ধকার যে এত নিকষ কালো হতে পারে তা ওর জানা ছিল না। পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার যেন এই গহ্বরের মাঝে লুক্কায়িত। এটা যেন সমস্ত রহস্যের আধার-এক ভয়াল অন্ধকূপ। দুজনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করল অন্ধকূপের অভ্যন্তরে।

আগে চলেছে রমজান। পেছনে আনোয়ার। রমজান মাঝে মাঝে আণ্ডার ওয়াটার টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে। ফাটলের অভ্যন্তরে বহুদূর পর্যন্ত গেল ওরা। হাবিলদার রমজান হঠাৎ হারিয়ে গেল । আনোয়ার বুঝতে পারল, ওকে একা রেখে চলে গেল রমজান। ওকে এখন একাকী অবস্থান করতে হবে তিরিশ থেকে চল্লিশ মিনিট। ভৌতিক গহ্বর। বর্ণনাতীত অন্ধকার। ভয়ঙ্কর গভীরতা। রহস্যময় পরিবেশ। নিজের অজান্তেই আনোয়ার চমকে উঠল। একটা পিচ্ছিল জলজ প্রাণী ওর গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। ও মুহূর্তে মনস্থির করে ফেলল, কোন রকম ভয় পাওয়া চলবে না। ভয় পেলে মৃত্যু অনিবার্য। ওর মাঝে শুরু হলো বেঁচে থাকার জন্য অদ্ভুত প্রক্রিয়া, যা শুধু অনুভব করা যায়, কাউকে বোঝানো যায় না। ও এখন এমন এক পরিবেশে অবস্থান করছে, যা পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের কাছে কল্পনাতীত বিস্ময় ও ভীতিকর।

নিজের হার্টবিটের শব্দ সে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে। পাথুরে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে শব্দ। যে-কোন মুহূর্তে শরীরের রক্ত জমে যেতে পারে। অনবরত হাত-পায়ের আঙুল নড়াচ্ছে–যেন ঠাণ্ডায় ওগুলো জমে না যায়। হঠাৎ একটা পিচ্ছিল জলজ প্রাণী ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। প্রাণীটার নড়াচড়ার কোন লক্ষণ নেই। শেষে আনোয়ার ওটাকে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিল। ও ভাবছে এই গহ্বর থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে তো? যদি পথ হারিয়ে ফেলে? যদি ট্যাংকের বাতাস ফুরিয়ে যায়? দুশ্চিন্তাগুলো দ্রুত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল ও। ৩৫ মিনিট পার হওয়ার পর সে এগুতে শুরু করল ফাটলের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পর নিরাপদেই বেরিয়ে এল ব্ল্যাক হোল থেকে।

চাঁদ নেই। মুক্তোর মত অগণিত তারা দূর নীলিমায়। রাত এগারোটা। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বইছে নির্জন সৈকত জুড়ে। মৃদু গর্জন তুলে বোট ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। জানজুয়া, আনোয়ার, জিয়া ও হাবিলদার রমজান ডাইভিং গীয়ার পরা অবস্থায় বোটের ওপর। মেজর ডেভিডের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। পেছনে করাচী শহরের আলোগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। চারদিকে শুধু ঘন অন্ধকার । হিম বাতাস ভেদ করে ছুটে চলেছে বোট। শুরু হবে নাইট ডাইভিং–এই প্রথম।

জানজুয়া। ডাকলেন মেজর ডেভিড।

ইয়েস, স্যার।

আল্লাহর সঙ্গে প্রেম করেছ?

সঠিক উত্তর আমার জানা নেই।

উঁহু, তাহলে তুমি প্রেম করোনি। তবে চেষ্টা করেছ বহুবার। তাই না?

রাইট, স্যার।

মেজর ডেভিড এবার জিয়াকে বললেন, তোমার কোন গার্লফ্রেণ্ড আছে? থাকলে তাকে স্মরণ করো।

এর কারণ তো বুঝতে পারলাম না, স্যার।

যদি ফিরে না আসো।

ও এই ব্যাপার! আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি স্যার, ডাইভিং শেষে নিরাপদেই ফিরে আসব।

সাবাস, বেটা। ডেভিড এবার তাকালেন আনোয়ারের দিকে। প্রশ্ন করলেন, আনোয়ার, তুমি কি সুস্থ?

ইয়েস, স্যার। ওর দৃঢ় কণ্ঠ।

তুমি সত্যি বলছ, তার প্রমাণ কি?

রাইট, স্যার। সাগরতলে আমি মৎস্যকুমারীদের সঙ্গে নাচব, গাইব, আপনি টেলিফোন করবেন। আমি আণ্ডার ওয়াটার টেলিফোনে একটা সুন্দর গান শুনিয়ে দেব আপনাকে।

আনোয়ারের বলার ধরন দেখে ডেভিড হেসে উঠলেন হো হো করে।

বোট প্রায় সাগরের মাঝামাঝি। ওদের ডিগ্রী, আণ্ডার ওয়াটার কম্পাস, দূরত্ব প্রভৃতি দেয়া হলো। চল্লিশ ফুট গভীরতা দিয়ে ওদের ডাইভিং করে পৌঁছতে হবে তীরে। মেজর ডেভিড পুনরায় ফিসফিসিয়ে উঠলেন, তোমার অনাগত বৌকে স্মরণ করো, আনোয়ার। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সে চোখের জল ফেলছে।

বাড়িতে যেয়ে আপনার মেয়েকে সান্ত্বনা দেবেন, স্যার। ওকে… আনোয়ারের কথা অসমাপ্ত রয়ে গেল। ডেভিড বুঝে ফেলেছেন, এরপর ও কি বলবে। তিনি দ্রুত নির্দেশ দিলেন, ডাউন। ওরা চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে।

লাফ দেয়ার পূর্ব মুহূর্তে চকিতে চেয়েছিল আনোয়ার ডেভিডের মুখের দিকে। ডেভিড দেখলেন, আনোয়ারের মুখ স্মিত হাস্যে উজ্জ্বল। সেখানে ভয় চিন্তার কোন চিহ্ন নেই। কি অদ্ভুত জীবন! একটু আগেও ওরা ছিল চঞ্চল, উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত। যার পরশ এখনও বোট ঘিরে। মেজর ডেভিডের বুক চিরে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। তিনি চুপচাপ বসে রইলেন বোটের ওপর।

চারজন ডাইভিং করছে সাগরতলে নিচে উষ্ণ পানি আরামদায়ক। ওরা পৌঁছে গেল তলদেশে। অসংখ্য ফসফরাসের টুকরো ভাসমান । ওগুলো থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে উজ্জ্বল আলো। ফসফরাসের উজ্জ্বল আলোয় তলদেশ জ্যোৎস্নাস্নাত রাতের মত উজ্জ্বল। নিজের চোখে না দেখলে এই সৌন্দর্য অবিশ্বাস্য! সামুদ্রিক মাছ ও জলজ প্রাণী সাবলীল ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বচ্ছ পানিতে বহুদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যাচ্ছে ওদের। কম্পাস নির্দেশিত পথ ধরে ওরা এগিয়ে চলল। রাত কত গভীর নিচে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তলদেশের পরিবেশ প্রায় একই রকম। রূপালী ফুলের রাজ্যের প্রান্ত ঘেঁষে তুষারশুভ্র বালুকাবেলার ওপর দিয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ ওদের দৃষ্টি চমকে উঠল!

একটা বিশাল দানব হাঁ করে রয়েছে। লাল রঙা জিভ। ঝিকমিকে তীক্ষ্ণ দাঁত। নাকে যৈন দুটো বড় বড় গহ্বর। চোখ দুটো ভাঁটার মত জ্বলছে। রমজান ওদের তিনজনকে অপেক্ষা করতে বলে এগিয়ে গেল । দানবটাকে ও ভাল করে দেখতে চায়। এধরনের অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার জন্য যেন ওর জন্ম। রমজানের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে ইঙ্গিতে জানাল, ওটা সত্যিকারের দানব নয়। একটা ডুবন্ত পাথরের ঢিবি। ঢিবিটার গায়ে অসংখ্য রঙিন পাথর ও জ্বলন্ত ফসফরাসের টুকরো আটকে রয়েছে। সেজন্যে ওটাকে দূর থেকে দানবের মত মনে হচ্ছিল। ডুবন্ত পাথরের ঢিবি পেরিয়ে চারজন ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল কিনারার দিকে। পথে পড়ল এধরনের আরও অনেকগুলো দানবসদৃশ ঢিবি। এক সময় ওরা পৌঁছে গেল কিনারায় । নিরাপদেই ফিরে এল চারজন ফ্রগম্যান মুক্ত পৃথিবীতে।

আণ্ডার ওয়াটার ডিমোলিশনও একটা ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট। সাগরের তলদেশে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। ক্যাপ্টেন জানজুয়া, জিয়া, আনোয়ার আবার প্রস্তুত। ওদের দেয়া হলো পাঁচ পাউণ্ড এক্সপ্লোসিভ ও মেকানিক্যাল ডিভাইস। বোট থেকে পানিতে নামার আগে ডেভিড বললেন, আই প্রে টু গড ফর ইওর সাকসেস।

সাগরের তলদেশে একটা বড় সাইজের পাথর ওরা. বেছে নিল। পাথরটা গোলাকার। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ সেট করল ওরা পাথরটার তলদেশে। মেকানিক্যাল সুইচে টান দিয়ে সবাই দ্রুত উঠে এল ওপরে। আর তিরিশ মিনিট-তারপর ঘটবে বিস্ফোরণ।

পানির ওপর সবাইকে মৃদু হেসে স্বাগত জানালেন ডেভিড। সরাই বোটে করে নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। তিরিশ মিনিট হতে আর কয়েক মিনিট বাকি। মেজর ডেভিড বললেন, আজ ডিনারে তোমরা প্রচুর মাছ খেতে পারবে।

স্যার, এরপর কি আমাদের মাছ শিকার করতে হবে? জানজুয়া প্রশ্ন করল ডেভিডকে।

ডোন্ট বি স্টুপিড। তোমরা মাছ অলরেডি শিকার করেছ। এখন শুধু ওগুলো ধরতে হবে।

কিন্তু কেমন করে, স্যার?

জিয়ার কথায় ডেভিড ধীরে ধীরে বললেন, যদি বিস্ফোরণ ঘটে।

আনোয়ার বোটের গলুইয়ের ওপর বসেছিল। দৃঢ় অথচ অনুচ্চ কণ্ঠে সে বলে উঠল, বিস্ফোরণ ঘটবেই।

আনোয়ার, তুমি একটু বেশিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী।

মেজর ডেভিডের কথা শেষ হতে না হতেই ওদের কানে এল চাপা গর্জন। ঘটল বিস্ফোরণ। ছিটকে উঠল সাগরের জল।

পরক্ষণে পানির ওপর ভেসে উঠতে শুরু করল মাছ, সাপ, কচ্ছপ, কাঁকড়া ও নানারকম সামুদ্রিক প্রাণী। সাগরের কালো পানি রক্তে হয়ে উঠল রঙিন। ওরা বোট নিয়ে এগিয়ে গেল সেদিক। কয়েকটা দীর্ঘাকৃতির সামুদ্রিক সাপ দেখতে পেল ওরা । সাপগুলোর শরীর ছিন্নভিন্ন। তেঁতলানো মাংসের মাঝে মেরুদণ্ডের ভাঙা কাঁটা দেখা যাচ্ছে। কচ্ছপ এবং কাঁকড়াগুলোও র্থেতলে গেছে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আঘাতে। কয়েকটা বড় বড় মাছের মাথাও সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে গেছে। ওরা বেছে বেছে কয়েকটা বড় বড় মাছ বোটে তুলে নিল। বোট এগিয়ে চলল তীরের উদ্দেশে।

এরপরও ওরা ডাইভিং করতে থাকল। ওদেরকে ১৮০ ফুট গভীরতা পর্যন্ত যেতে হবে। ওদের আণ্ডার ওয়াটার ক্যামেরায় ধরা পড়ল, সেই তুষারশুভ্র বালির প্রান্তর, রূপালী ফুলের রাজ্য, রঙিন পাথর, জ্বলন্ত ফসফরাস খণ্ড, ডুবন্ত দানবসদৃশ পাথরের ঢিবি, কোরাল রীফ, ব্ল্যাক-হোল, বিশাল শার্ক, ব্যারাকুড়া প্রভৃতি দুপ্রাপ্য চিত্র। একসময় ওরা ১২০ ফুট তলদেশে পৌঁছাল। ঠিক এই সময় জরুরী নির্দেশ এল চেরাট ক্যান্টনমেন্ট থেকে। ওরা ডাইভিং অসমাপ্ত রেখে বেরিয়ে পড়ল ক্যান্টনমেন্টের পথে।

.

১৬.

স্লোয়ারফেয়ার। তুষারের দেশে শুরু হবে যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার জীপ নিয়ে চলেছে কালাম উপত্যকায়। এবারে লোক সংখ্যা দেড়শো । সঙ্গে রয়েছে দুমাসের উপযোগী রেশন। প্রথমে নওশেরা, তারপর রিসালপুর অতিক্রম করল ওদের ছোট্ট কনভয়। মালাকান থেকে শুরু হলো চড়াই উত্রাই।

কোথাও মসৃণ পীচঢালা পথ ঢালু হয়ে গভীরে নেমে গেছে। আবার কোথাও উঁচু তুষারাবৃত পাহাড় অতিক্রম করে গেছে। রাস্তার একপাশে সুউচ্চ পাহাড়ের সারি। ঢালে সবুজ ফার ও পাইন গাছ বরফ আচ্ছাদিত, শুভ্র। অপরপাশে পাহাড়ী স্রোতস্বিনী। তিরিশ-চল্লিশ ফুট চওড়া, অগভীর। রূপালী চকচকে পাঁনি। স্রোতস্বিনীর প্রান্ত ঘেঁষে সবুজ খেত। খেতের কোল জুড়ে বিশাল উঁচু পর্বত-তুষারময়। অধিকাংশ জায়গায় স্রোতস্বিনীর জল ও রাস্তার উচ্চতা প্রায় সমান। এই সমতা অদ্ভুত বৈচিত্র্যময়। মনে হচ্ছে ওদের কনভয় স্রোতস্বিনীর জলের ওপর দিয়ে ভেসে, চলেছে।

সোয়াত। শু্যটিং স্পট। বহু পাকিস্তানী ছায়াছবির বহিদৃশ্যাবলী এখান থেকে গৃহীত হয়। বরফাচ্ছাদিত উঁচু পর্বত, মসৃণ পীচঢালা পথ, অগভীর পাহাড়ী নালা, সবুজ খেত–অপূর্ব! এখানেও পর্বতের ঢালে ফার ও পাইন গাছ কোমল বরফে জড়ানো। সারা প্রকৃতি জুড়ে এক টুকরো স্নিগ্ধ হাসি। আনোয়ার মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। দুচোখ ভরে দেখছে সোয়াতের অপরূপ সৌন্দর্য। এখান থেকে শুরু হলো স্রোতস্বিনীর ওপর চমৎকার সব কংক্রিটের ব্রিজ একের পর এক। রাস্তা বাঁক ঘুরে ব্রিজের ওপর দিয়ে ওপারে গিয়েছে। আবার সম্মুখের ব্রিজ ঘুরে এপারে এসেছে।

ওদের কনভয় এঁকেবেঁকে সোয়াত অতিক্রম করল। সোয়াত পার হয়ে ওদের প্রতিটি গাড়ির চাকার সঙ্গে অ্যান্টি স্কিড চেইন লাগানো হলো, যাতে কোন গাড়ির চাকা স্কিড় করে গভীর খাদে পড়ে না যায়। ওদের কনভয় অত্যন্ত মন্থর গতিতে এগুচ্ছে। ভীষণ পিচ্ছিল রাস্তা, দুর্গম। রাস্তার একপাশে গভীর খাদ। একটু অসতর্ক হলেই বিপদ। ছোট্ট কনভয়টি পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে।

কালাম উপত্যকা। গ্রীষ্মকালীন নিবাস। সী-লেভেল থেকে আট হাজার ফুট উঁচুতে। চারদিকে বরফাচ্ছাদিত পর্বত। পনেরো ষোলো হাজার ফুট উঁচু। পাইন গাছের লম্বা সারি এই পর্বতের ঢাল জুড়ে। গাছগুলোর সবুজ দেহ কোমল তুষারে জড়ানো। ছোট ছোট দুই-একটা মাটির বাংলো বাড়ি দেখা যাচ্ছে পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে। উপত্যকার একপ্রান্ত তিরিশ-চল্লিশ ফুট ঢালু। এই ঢালু প্রান্তের পাদদেশ ছুঁয়ে বয়ে চলেছে একটা খরস্রোতা পাহাড়ী নালা। স্বচ্ছ জলের নালাটি পৃথিবীর অন্যতম সুস্বাদু রূপালী ট্রাউট মাছে ভর্তি । উপত্যকার ওপর তিনটে রেস্ট হাউজ, ইউরোপীয়ান ফিটিংস-এ সাজানো। প্রতিটি ঘরের ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুন। সৈনিকরা রেস্ট হাউজের, অদূরে একটি স্কুল বিল্ডিংয়ে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করল। মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন আরজুমান্দ মালেক, ক্যাপ্টেন আখতার ও ক্যাপ্টেন আনোয়ার রইল রেস্ট হাউজে।

পরদিন সকাল । আরজুমান্দ মালেক ও আনোয়ার বেড়াতে বের হলো। ওদের পরনে গরম পোশাক, ও, পায়ে স্নো বুট। ওরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল ফার ও পাইন গাছে ছাওয়া পর্বতের ঢালের দিকে। সেখানে পৌঁছে একটা সুন্দর মাটির ঘর দেখতে পেল ওরা। দুষ্ট ছেলের মত কৌন হ্যায়, কৌন হ্যায়, করে চিৎকার করতেই দরজা খুলে গেল। সেখানে দাঁড়ানো একটি যুবতী। পরিচ্ছন্ন সালোয়ার কামিজ পরিহিতা। অপূর্ব সুন্দরী। চমকে উঠল-মেয়েটাকে কোথায় যেন দেখেছে ওরা! ভাল করে দেখতেই ওদের ভুল ভেঙে গেল। লিজ টেলর নয়। তবে লিজের হুবহু প্রতিকৃতি। মেয়েটির মুখে স্মিত হাসি।

ওরা দুজন এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে। ইঙ্গিতে ঘর সংলগ্ন মাটির বারান্দায় বসতে চাইলে মেয়েটি মৃদু হেসে বসতে আহ্বান জানাল ওদের। যুবতী ইংরেজি, উর্দু, হিন্দী, পশতু কিছুই বোঝে না। ওদের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। বিরল পাহাড়ী ভাষায় কথা বলে এরা। তবে পশতুর সঙ্গে অতি সামান্য মিল রয়েছে।

ইশারায় ভাব বিনিময় শুরু হলো সালোয়ার কামিজ পরিহিতার সাথে। মেয়েটি ইঙ্গিতে জানাল সে বাড়িতে এখন একা। বাড়ির– অন্যান্য লোকেরা কাজের জন্য শহরে গিয়েছে। ফিরতে দেরি হবে। আনোয়ার ও মালেক সেনাবাহিনীর লোক, তাও মেয়েটি বুঝে নিল। আনোয়ার দুএকটা পাহাড়ী শব্দ জানত। সে বলল, ওর উস্কা (পানি খাব)। যুবতী কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর দুর্বোধ্য, পাহাড়ী ভাষায় কথা বলে উঠল । কিন্তু আনোয়ার তার কিছুই বুঝতে পারল না। ও ইঙ্গিতে জানাল, সে দুএকটার বেশি পাহাড়ী শব্দ জানে না। যুবতী বরফ গলিয়ে পানি এনে দিল ওদের। পানি খেয়ে সেদিনের মত ওরা বিদায় নিল।

রেস্ট হাউজ থেকে স্কুল বিল্ডিং মাত্র কয়েক মিনিটের পথ। অথচ ওদের এই পথটুকু অতিক্রম করতে অনেক সময় লাগে। প্রায় গোলাকৃতি মাঠটি পুরু বরফে ঢাকা। আনোয়ার স্কি চালানো শিখছে, উঁচু পর্বতবেষ্টিত এই ক্ষুদ্র মাঠে। ওর পরনে অলিভ-গ্রীন ঢোলা ট্রাউজার্স, গায়ে গরম ফুল হাতা ভেস্ট, তার ওপর ফুল হাতা মোটা উলেন সার্জের দামী শার্ট, শার্টের ওপর ফুল হাতা সোয়েটার ও জ্যাকেট পারকা। গলায় স্নো হোয়াইট স্কার্ফ, পায়ে নাইলনের স্টকিং, তার ওপর উলেন স্টকিং ও এয়ার কুশনওয়ালা স্নো বুট। মাথায় কানাকা ফারের টুপি। বেশ কয়েকদিন অনুশীলনের পর ও একজন স্কিম্যান হয়ে গেল।

ক্রেভিজ ক্রসিং। দুপাশে উঁচু পর্বত। মাঝে গভীর গিরিখাদ। বিশেষ কায়দায় এই দুর্গম পথ পাড়ি দেয়ার নাম ক্রেভিজ ক্রসিং। শুরু হলো অনুশীলন। একটা ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী রকেট নিল ওরা। বের করে নিল ফিউজ। নিউট্রালাইজড হয়ে গেল রকেট। কোন বিস্ফোরণ ঘটবে না। অ্যাংকর আকৃতির তিনটা হুক ওয়েলডিং করে লাগানো হলো রকেটের বডিতে। রকেটের লেজের সঙ্গেও শক্ত একটা নাইলনের লম্বা কর্ড বাঁধা। শেলটাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো ওপাশের পর্বত লক্ষ্য করে। তারপর টেনে দেখে নিল ওরা ঠিকমত আটকেছে কিনা। একে একে ওরা পার হয়ে গেল নাইলনের রশির সাহায্যে গভীর ফাটল । শেষ হলো অনুশীলন ক্রেভিজ ক্রসিং।

ক্লিফ ক্লাইম্বিং। খাড়া পর্বতের চূড়ায় আরোহণ। নব্বই ডিগ্রী খাড়া পর্বত। অ্যালুমিনিয়ামের পিটন (পেরেক) ওরা বিঁধিয়ে দিচ্ছে পর্বত গাত্রে। পিটন ধরে একে একে সবাই উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। ওদের প্রত্যেকের পিঠে ভারী ওজনের প্যাক। সারা শরীর বরফের দেশের উপযোগী পোশাকে আবৃত। পায়ে স্নো বুট। হাতে আইসঅ্যাক্স বা বরফ কাটা গাঁইতি। অমানুষিক পরিশ্রম শেষে ওরা পৌঁছল নব্বই ডিগ্রী খাড়া পর্বতের চূড়ায়। শেষ হলো, ক্লিফ ক্লাইম্বিং।

স্কি-ইং। বরফের ওপর স্কি-ইং দারুণ রোমাঞ্চকর। আনোয়ার শুরু করল অনুশীলন। ওর পায়ে চামড়ার তৈরি স্কি-ইং বুট, স্টীলের মত মজবুত। মাথায় কান ঢাকা পারকা। পরনে ট্রাউজার্স ও পারকা-জ্যাকেট। প্রতি হাতে দুটো করে গ্লাভস । ওপরেরটাকে বলা হয় মিটন শেল। ভিতরেরটাকে বলা হয় মিটন ইনার । দুহাতে দুটো স্কি-ইং স্টিক। চারদিকে শুধু বরফ আর বরফ। ওর স্কি-ইং ট্র্যাকের দৈর্ঘ্য প্রায় এক মাইল। সাঁ সাঁ করে সে এগিয়ে চলল তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল গতিতে পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে। ঠিক যেন একটা ছুটন্ত তুষার মানব।

ইনিশিয়ার ক্লাইম্বিং। পুরো দশ দিনের প্রোগ্রাম। এবার ওদের বহুদূর যেতে হবে বরফের মাঝে। চল্লিশজনের দল। এদের মাঝে একমাত্র অফিসার আনোয়ার-কমাণ্ডার। এই সৈনিকদের বলা হয়, আদার র‍্যাংকস। প্রত্যেকের পরনে অলিভ গ্রীন ট্রাউজার্স। গায়ে ফুলহাতা উলেন ভেস্ট, সার্জের মোটা শার্ট, ফুল-হাতা সোয়েটার ও জ্যাকেট পারকা; গলায় স্নো হোয়াইট স্কার্ফ। পায়ে নাইলন স্টকিং ও তার ওপর উলেন স্টকিং ও এয়ার কুশনওয়ালা স্নো বুট। মাথায় কান ঢাকা ফারের টুপি।

একশো পঞ্চাশ পাউণ্ড ওজনের ভারী রূকস্যাক প্রত্যেকের পিঠে। রূকস্যাকে দশদিনের পুরো রেশন, গোলা বারুদ, বাড়তি কাপড়-চোপড়, স্কি বুট, চকোলেট, সিগারেট, স্নো বুট প্রভৃতি। কোমরের বেল্টের সঙ্গে ঝোলানো হোলস্টারে পিস্তল, কম্পাস, পানির বোতল, মেডিসিন কীট ও কমাণ্ডো নাইফ। গলায় ঝোলানো বিনকিউলার। ডান কাঁধে ঝোলানো সাব-মেশিনগান। বাম কাঁধে একজোড়া স্কি-ও স্কি-ইং স্টিক ও ডান হাতে আইস অ্যাক্স; বরফ কেটে রাস্তা তৈরির জন্য ।

আদার র‍্যাংকসদের এগুলো ছাড়াও বাড়তি জিনিসপত্র বহন করতে হচ্ছে। গরু ও দুম্বার বড় বড় ঠ্যাং ও গ্যাসোলিনের ক্যান ওদের কাঁধের সঙ্গে ঝোলানো। এছাড়াও রয়েছে স্টোভ, নব্বই পাউণ্ড ওজনের ওয়্যারলেস সেট, জেনারেটর, দুই ইঞ্চি মর্টার ও ছয়টা হেভী মেশিনগান। এগিয়ে চলেছে অভিযাত্রী দল। আগে চলেছে দুজন পাহাড়ী স্কাউট । তারপর কমাণ্ডার আনোয়ার, জেসিও নায়েক সুবেদার কবীর, আদার র‍্যাংকস জানস খান, আদার র‍্যাংকস আসলাম খান, মালেক নূর, শেরদিল ও জুলফেকার। পেছনে অন্যান্য সবাই। এদের মাঝে একমাত্র বাঙালী আনোয়ার। সকাল নয়টায় শুরু হয়েছে যাত্রা। দুর্গম পথ। কোথাও রাস্তা অত্যন্ত সরু, মাত্র ছয় ইঞ্চি চওড়া। পাশে গভীর গিরি খাদ। কোথাও রাস্তা আঁকাবাঁকা। পর্বতের ঢালে অসংখ্য পাইন গাছ। গাছের ডালপাতায় তুষার জমে আছে। বেলা বারোটায় কুয়াশার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সূর্য। আনোয়ার ডাকল, জানস খান।

জ্বী, স্যার। বিশালদেহী জানস খানের গম্ভীর গলা শোনা গেল।

সবাইকে হুঁশিয়ার করে দাও। এখন বরফ গলে রাস্তা আরও পিচ্ছিল হয়ে যাবে।

অভিযাত্রী দল কালাম উপত্যকা থেকে এক হাজার ফুট উঁচুতে। ক্রমশ বাড়ছে সূর্যের তাপ। বরফ গলে রাস্তা ভীষণ পিচ্ছিল হয়ে গেল। সবার চোখে প্রটেকটেড সানগ্লাস। সানগ্লাসবিহীন অবস্থায় যে-কোন মুহূর্তে স্নো ব্লাইনেসে আক্রান্ত হতে পারে ওরা। ধীরে ধীরে বাতাসে অক্সিজেন কমে আসছে। প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর পাঁচ মিনিটের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে ওরা। বিশ্রামের সময় গ্যাসোলিনের স্টোভে বরফ গলিয়ে প্রচুর জলপান করছে সবাই শরীরের ডিহাইড্রেশন পূরণ করার জন্য। দুপুর দেড়টার দিকে সবাই থামল। তাজা হান্টার বীফ, পরোটা, গরম মাংসের কাবাব ও কফি সহযোগে লাঞ্চ সারল ওরা।

আবার শুরু হলো ক্লাইম্বিং। রাস্তা ক্রমশই উঁচু হয়ে গিয়েছে। সম্মুখে সুউচ্চ পর্বতের চূড়া। অভিযাত্রীদল সতর্ক। বরফে পা ফসকে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। রাস্তার পাশে খাদের তলদেশ নজরে পড়ে না। সূর্য আস্তে আস্তে হেলে পড়ল পশ্চিমাকাশে। তাপমাত্রাও কমে এল সেইসঙ্গে। অভিযাত্রীদের চলার গতি বাড়ল কিছুটা । বরফ গলছে না, ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। দুহাজার ফুট অতিক্রান্ত হলো। সবাই পরিশ্রান্ত। বেলা চারটায় আনোয়ার নির্দেশ দিল, হল্ট।

জেসিও কবীর, শেরদিল, আসলাম খান রান্নার আয়োজন শুরু করল। জানস খান ও জুলফেকার স্নো-টেণ্ট খাঁটিয়ে দিল কমাণ্ডারের। স্নো-টেন্টগুলো একপিস কাপড়ের তৈরি। টেন্টের দুই মুখে দুটো চোঙ-টেন্টের প্রবেশ পথ। চোঙের গোড়ার দিকে নাইলনের নেট ঝোলানো। টেন্টগুলো সাত ফুট বাই চার ফুট। ভিতরে ছয় ইঞ্চি মোটা এয়ার ম্যাটরেস, ডবল পিপিং ব্যাগ ও একটা এয়ার পিলো। দ্রুত নেমে এল অন্ধকার। মৃত্যুশীতল নীরবতায় ছেয়ে গেল বরফের রাজ্য। প্রাণের কোন ছোঁয়া নেই। পর্বতচূড়াগুলো অস্পষ্ট। কিছুই আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। আকাশ জুড়ে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। ডিনার শেষে আনোয়ার ঢুকল টেন্টে। জেসিও কবীর ও জানস খান এসে শুভরাত্রি জানিয়ে গেল ওকে।

বরফের দেশে রাত-আনোয়ারের জীবনে এই প্রথম। ডবল পিপিং ব্যাগের ভিতরে এখন সে। চোখে তন্দ্রালু ভাব। রাত এলেই ওর মনটা কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। ওর মনের গভীরে জেগে ওঠে এক টুকরো স্মৃতি। রাত ওর প্রিয়। ও যেন নিশাচর। শরীরের পেশীগুলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়ল আনোয়ার, লোকালয় থেকে বহুদূরে বরফের দেশে।

পরদিনও একই ভাবে ক্লাইম্বিং করল অভিযাত্রী দল। পাঁচ দিন কেটে গেল ওদের বরফের রাজ্যে। কখনও পর্বতের ঢাল ঘেঁষে, পিচ্ছিল পথ বেয়ে, গভীর খাদের প্রান্ত ছুঁয়ে এগিয়েছে ওরা। ষষ্ঠ দিন, বিকেলবেলা। আবহাওয়া চমৎকার। ওরা যাত্রাবিরতি করল। জায়গাটা সমতল। সামনের দিকটা একটু ঢালু। কয়েকটা ঘন পল্লবিত পাইন গাছ দাঁড়িয়ে রয়েছে। উনিশ হাজার ফুট পর্যন্ত ট্রি-লাইন। তারপর কোন গাছপালা নেই। শুধু সীমাহীন বরফ। আনোয়ার সবাইকে স্নো-টেন্ট টাঙানো ও রান্নার আয়োজনের নির্দেশ দিল। ও আজ স্কি-ইংয়ে বেরুবে।

নায়েক সুবেদার কবীর বলল, স্যার, এখনি সন্ধ্যার অন্ধকার নামবে। পথে কোন বিপদ ঘটতে পারে, আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই।

কবীর, বিপদ যদি ঘটেই, তবে সেটা মোকাবেলা করার মত ক্ষমতা আমার আছে। ভয় পেয়ো না। আমি নিরাপদেই ফিরে আসব। শেরদিল, আসলাম খান, সরফরাজ কেউ ওদের প্রিয় কমাণ্ডারকে একা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। কিন্তু কারও কথা শুনছে না সে। একাই যাবে স্কি-ইং করতে।

স্যার, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

কে? জানস খান। আনোয়ার ঘুরে তাকাল।

জ্বি, স্যার।

তোমরা অযথা ভয় পাচ্ছ। কিছুই হবে না–আমাকে একাই যেতে দাও। কমাণ্ডার যেন অনুমতি চাইল আদার র‍্যাংকস জানস খানের কাছে। কোমরের বেল্ট থেকে কমাণ্ডো-নাইফ খুলে এগিয়ে এল জানস খান। বাড়িয়ে ধরল আনোয়ারের দিকে। বলল, স্যার, এটা বুকে বিঁধিয়ে দিন। তাহলে আমি আপনার পথরোধ করে দাঁড়াব না। এই সুযোগে সবাই ওকে সঙ্গে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানাল। অগত্যা অনুরোধের চেঁকি গিলতে হলো কমাণ্ডারকে।

আগে আনোয়ার, পেছনে জানস খান। ঘণ্টায় তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল বেগে এগুচ্ছে দুজন। কয়েক মিনিট চলার পর সম্মুখে পড়ল একটা ঢাল। ঢালটি বেশ গভীর। তারপর আবার সমতল বরফ। আনোয়ার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেল। ওদের চলার গতি এখন ঘণ্টায় পঞ্চাশ থেকে ষাট মাইল। আনোয়ার ইশারা করতেই জানস খান দ্রুত পাশে চলে এল ওর। এগিয়ে চলল দুই তুষার-মানব পরম নিশ্চিন্তে।

ক্যাম্প এলাকায় সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। কেউ গ্যাসোলিনের চুলায় বরফ গলাচ্ছে। কেউ তৈরি করছে মাংসের কাবাব, কেউ পাইন গাছের শুকনো ডালপালা ভাঙছে। সেগুলো একটা বড় পাইনের নিচে স্থূপীকৃত। গ্যাসোলিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতেই শুকনো ডালপালা জ্বলে উঠল । কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওরা আগুনের পরশ নিচ্ছে শরীরে। সূর্য প্রায় অস্তমিত। তবুও আনোয়ার আর জানস খানের ফিরে আসার নাম নেই। হঠাৎ আবহাওয়া বদলে গেল। ঝড় আসছে–তুষার ঝড়। দ্রুত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ক্যাম্প এলাকায়। ওদের প্রিয় কমাণ্ডার ও সঙ্গী জানস খান তুষার ঝড়ের কবলে। যেভাবেই হোক ওদের উদ্ধার করতে হবে । আসলাম খান, শেরদিল, সরফরাজ সহ দশজন শক্তিশালী আদার র‍্যাংকসকে নিয়ে পরামর্শ করতে বসল জেসিও কবীর।

আনোয়ার ও জানস খান ফিরে আসছে ক্যাম্প অভিমুখে। হঠাৎ পেছনে শোঁ শোঁ আওয়াজ। থমকে দাঁড়াল দুজন। পেছনে তাকিয়ে খান বলে উঠল, স্যার, তুষার-ঝড়।

কুল ডাউন, জানস খান । মাথা ঠাণ্ডা রাখো। আনোয়ার দ্রুত পকেট থেকে ম্যাপ বের করল। ক্যাম্পের দূরত্ব আর মাত্র দুমাইল । সম্মুখে তিরিশ গজের মধ্যে রয়েছে সেই ঢালটি ।

জানস খান।

স্যার।

তুষার ঝড় আসার আগেই আমাদের ঢালটি অতিক্রম করতে হবে। গেট অ্যাহেড। ওরা দুজন দ্রুত এগিয়ে চলল। পেছনে ধেয়ে আসছে ঝড় ।

ওরা ঢালের প্রান্তে। ঠিক সেই সময় এসে পড়ল ঝড়। চারদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ। ভারী বাতাস। বুলেটের মত বরফের কুচি ছুটছে।

জানস খান, ঢাল পার হও, কুইক। চিৎকার করে উঠল আনোয়ার। ওরা ঢলের প্রায় মাঝামাঝি। পেছন থেকে বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় ওদের গতি দ্রুততর হলো । ঢালের নিচু জায়গা। এক্ষুণি ভরে যাবে কোমল বরফে । দ্রুত পার হতে না পারলে ওরা চাপা পড়বে শত শত টন বরফের নিচে। প্রায় ষাট ডিগ্রী খাড়া চড়াই বেয়ে স্কি-ইং করে ওরা উঠে যাচ্ছে। আর মাত্র কয়েক গজ। তারপর শুরু হয়েছে সমতল বরফ। আনোয়ার পার হয়ে গেল বরফের চড়াই । শেষপ্রান্তে সমতল বরফে আছড়ে পড়ল ওর ভারী শরীর। সঙ্গে সঙ্গে ছেয়ে গেল সারা শরীর বরফে। দ্রুত উঠে দাঁড়াল সে। প্রচণ্ড বাতাসের ধাক্কায় শরীর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই সময় ওর কানে এল একটা ক্ষীণ আর্তনাদ বাঁচাও। পেছনে তাকিয়ে চমকে উঠল আনোয়ার–জানস খান নেই। খান বলে চিৎকার করে ও লাফিয়ে পড়ল ঢালের প্রান্তে।

ঢালের প্রান্তদেশে শুয়ে পড়েছে সে। দেখছে নিচে-বরফের প্রচণ্ড মাতামাতি। কোমর বরফে ঢেকে যাচ্ছে ঢালের তলদেশ। পরিষ্কার কিছু দেখা যাচ্ছে না। অব্যক্ত ব্যথায় গুমরে উঠল আনোয়ারের মন। ওর জন্যই জানস খান চাপা পড়বে শত শত টন বরফের নিচে। মনে হয় আর বাঁচানো গেল না ওকে। আনোয়ার আবার চিৎকার করে উঠল, জানস খান! ডানদিক থেকে শোনা গেল জানস খানের দুর্বল আওয়াজ, স্যার। আনোয়ার দ্রুত এগিয়ে গেল। নিচে দেখা গেল খানকে। প্রায় চার ফুট গভীরে তখন সে। কোমল বরফরূপী মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধরত। ধীরে ধীরে নিচে নেমে যাচ্ছে জানস খানের ভারী শরীর।

আনোয়ার দ্রুত স্কি-ইং স্টিক পুঁতল ঢালের প্রান্তে। জানস খান, তুমি আমার পা ধরো। বলে আনোয়ার শরীর নামিয়ে দিল নিচে। ও দুহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে স্কি-ইং স্টিক। জানস খান জড়িয়ে ধরল ওর ঝুলিয়ে দেয়া পা। ধীরে ধীরে উঠে আসা শুরু করল খান। আনোয়ার বুঝতে পারছে স্কি-ইং স্টিক বেঁকে যাচ্ছে ক্রমেই। যে-কোন মুহূর্তে উপড়ে যেতে পারে।

আনোয়ার শুধু বলল, একটু তাড়াতাড়ি, খান। ঠিক এই সময় ঢালের প্রান্তে হাজির হলো জেসিও কবীর। সঙ্গে দুজন আদার র‍্যাংকস ও দুজন স্কাউট। আনোয়ার ওদের দেখতে পেয়ে। দ্রুত ডাক দিল, কবীর, আমরা এদিকে। দ্রুত এগিয়ে এল উদ্ধারকারী দল। ঢালের প্রান্তে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করল জেসিও কবীর। তারপর তুষার ঝড়ের মধ্য দিয়ে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।

পরদিন সকাল। আবহাওয়া অপরিচ্ছন্ন, তুষারপাত হচ্ছে। সারাদিন ধরে চলল তুষারপাত । সারাটা দিন স্নো টেন্টের মাঝে কেটে গেল ওদের। অষ্টম দিনে আবহাওয়া মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে গেল। শুরু হলো অনুশীলন। বরফের ওপর ভারী অস্ত্রের ফায়ারিং এবং কাল্পনিক শত্রু এলাকা আক্রমণ। রাতে শুরু হলো নাইট রেইড। তারপর ফিরে আসার পালা। পর্বত বেয়ে ওঠার চেয়ে নামাটা আরও বিপজ্জনক, যে পথ ওদের অতিক্রম করতে সময় লেগেছিল আটদিন, সেই পথ ওরা নেমে এল সাত আট ঘণ্টার মধ্যে। কোন মারাত্মক দুর্ঘটনা ছাড়াই ফিরে এল অভিযাত্রী দল নিচে রেস্ট হাউজে।

রেস্ট হাউজের আরামদায়ক পরিবেশে ওরা বিশ্রাম নিল পুরো একদিন। বিশ্রামের জন্য হাতে এখনও দুদিন সময়। পরদিন সকাল। ঝলমলে রোদ উঠল আকাশে। চকচক করছে তুষার। অলস দিন। আনোয়ার ও আরজুমান্দ মালেক বের হলো নির্জন পর্বতের ঢালের সেই যুবতীর উদ্দেশে। ঘরের সামনে গিয়ে ওরা চিৎকার করল, কৌন হ্যায়। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই যুবতী। নীরবে স্বাগত জানাল ওদের।

কাছে যেতেই যুবতী বলল, কেনা (অর্থাৎ বসো। আনোয়ার ও আরজুমান্দ মালেক বসে পড়ল মাটির বারান্দায়। আনোয়ারও মেয়েটিকে বলল, কেনা। যুবতী না বসে মিটিমিটি হাসতে লাগল। হঠাৎ সে কথা বলে উঠল। কিন্তু ওরা কিছুই বুঝল না। তারপর ইশারা ইঙ্গিত শুরু করল ওদের উদ্দেশে। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা বুঝতে পারল, মেয়েটি জানতে চাইছে, এতদিন ওরা কোথায় ছিল। এবারে ইঙ্গিতে ওরাও বুঝিয়ে দিল–ওই দূরে, উঁচু বরফের চূড়ায় গিয়েছিল ওরা। আনোয়ার বলল, এগগায়া এস্তা? দ্রুত এস্তা বলে ঘরের ভিতরে গেল মেয়েটি ডিম আনার জন্য। আরজুমান্দ মালেক বলল, শালা, খুব তত জমিয়েছিস! এবার নামটা জিজ্ঞেস কর।

কিন্তু কি করে?

যেভাবে ডিম আনতে বললি।

দ্যুৎ শালা। তারচে বরং তুই ইশারাতে নামটা জিজ্ঞেস কর।

মালেকের চোখ কপালে উঠল, আরে বিয়ে করবি তুই, আর নাম জিজ্ঞেস করব আমি?

মালেক, আমি বাঙালী মেয়েকেই বিয়ে করব। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আনোয়ারকে সিরিয়াস মনে হলো ।

নে, নে, তুই শালা বাঙালী প্রেমেই মত্ত থাক। এটাকে আমিই নিই।

বারান্দায় বসে ওরা আশপাশে ভাল করে দেখল। পাইন গাছের ফাঁকে ফাঁকে বেশ কয়েকটা মাটির ঘর দেখতে পেল ওরা। দুজন ভাবছে, পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের কি অদ্ভুত জীবন! এই নির্জন বরফের রাজ্যে সুন্দরী যুবতাঁকে একা রেখে সবাই চলে গেছে শহরে। কাজ শেষে কবে ফিরবে কে জানে?

ঘর থেকে বেরিয়ে এল যুবতী। হাতে দুটো অ্যালুমিনিয়ামের পরিষ্কার পাত্র। তাতে কাঁচা ডিম ভেঙে এনেছে। ওরা গপাগপ খেয়ে নিল। আরজুমান্দ মালেক ইশারায় জানতে চাইল যুবতীর নাম । বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করল মালেক। যুবতী কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মত চেয়ে রইল। আনোয়ার উঠে দাঁড়িয়ে মালেককে বলল, আমি তোর নাম জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিবি। আনোয়ার বুকে হাত দিয়ে কয়েকবার নিজের নাম উচ্চারণ করল। তারপর ফিরল মালেকের দিকে। ডাকল, আরজুমান্দ মালেক। মালেক দ্রুত উত্তর দিল। আনোয়ার ফিরল যুবতীর দিকে। ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল নাম। তবুও যুবতী নিরুত্তর। এবার শুরু হলো প্রচেষ্টা। মালেক ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আনোয়ার উত্তর দিচ্ছে, আনোয়ার নাম জিজ্ঞেস করলে মালেকও দিচ্ছে জবাব। এরই মাঝে আনোয়ার চট করে ফিরল যুবতীর দিকে। ইঙ্গিত করল–ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটি শব্দ নূরী।

আনোয়ার ও মালেক একসঙ্গে জানতে চাইল নূরী? যুবতী ঘাড় হেলিয়ে জানাল-ঠিক! আনোয়ার ইংরেজিতে বলল,

মালেক, তোর বৌয়ের নাম তো বেশ সুন্দর।

বেশ সুন্দর নয় খু-উ-ব সুন্দর। তোরই ভাবী তো? . শালা, আগে দেখ, তোর বৌ হতে ও রাজি আছে কিনা। আনোয়ারের কণ্ঠে রীতিমত কৌতুক।

বলিস কি! ও তো আমার বৌ হয়ে বসে আছে। দাঁড়া ওকেই জিজ্ঞেস করছি। মালেক নূরীকে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, অ্যাই নূরী, তোর স্বামী কে? আমি না?

নূরী একবিন্দুও বুঝতে পারল না ওদের কথা।

চল, আজ অনেক হয়েছে। আর একদিন আসা যাবে। মালেককে নিয়ে উঠে দাঁড়াল আনোয়ার । ওরা বিদায় চাইল নূরীর কাছে। নূরী ওদের ইঙ্গিতে আবার আসতে বলল। ওরা হাঁটা শুরু করল রেস্ট হাউজ অভিমুখে। মাটির বারান্দার ওপর দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল নূরী ওদের গমন পথের দিকে। কে জানে, পর্বতবাসিনী নূরী ওদের নিয়ে কি ভাবছে?

একটি গ্লেসিয়ার। বিশ হাজার ফুট উঁচুতে ম্যাপে নির্দেশিত এই গ্লেসিয়ারের চূড়ায় আরোহণ করতে হবে এবার অভিযাত্রী দলকে। ভিন্ন পথে এগিয়ে চলল ওরা। আবহাওয়া তেমন ভাল নয়। সূর্য ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। সামনের পথ বেশ সরু হয়ে বেঁকে গেছে। পাশে গভীর খাদ। খাদের পাশ ঘেঁষে সরু পথ অতিক্রম করছে ওরা। সবাই সতর্ক। হঠাৎ শেরদিল চিৎকার করে উঠল, স্যার, সরফরাজ নিচে পড়ে গেছে।

আনোয়ার দ্রুত নায়েক সুবেদার কবীরকে নির্দেশ দিল, জলদি নিচে যাও এবং অবস্থা সম্পর্কে আমাকে ইনফর্ম করা, কুইক।

কবীর দ্রুত নিচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ওয়্যারলেসে শোনা গেল কবীরের কণ্ঠ। আনোয়ার সেট অন করে রেখেছে। স্যার, সরফরাজ ভাল আছে। তেমন কোন মারাত্মক আঘাত পায়নি। শুধু জেনারেটরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। ওভার।

ও কত ফুট গভীরে পড়েছে? ওভার। আনোয়ারের প্রশ্ন।

আবার ভেসে এল কবীরের কণ্ঠ, প্রায় বারোশো ফুট নিচে, স্যার।

ঠিক আছে, তুমি ওকে রেস্ট হাউজে রেখে ফিরে এসো । আমরা এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। ওভার অ্যাণ্ড আউট। কেটে গেল যোগাযোগ।

সাতদিনের মাথায় আবহাওয়া ভীষণ খারাপ হয়ে গেল । চারদিকে শোঁ শোঁ আওয়াজ। বাতাসে বরফের কুচি ছুটে বেড়াচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওদের । আনোয়ার ক্যাম্প করতে নির্দেশ দিল । সবাই আশ্রয় নিল স্নো টেন্টের অভ্যন্তরে। একদিন একরাত পর আবহাওয়া কিছুটা শান্ত হয়ে এল। ওরা আবার শুরু করল যাত্রা। দশদিন পর অভিযাত্রী দল পৌঁছল ম্যাপ নির্দেশিত গ্লেসিয়ারের পাদদেশে।

বিশাল গ্লেসিয়ার। এটির আয়তন কত, তা অনুমান করা মুশকিল। চারদিক শুধু সীমাহীন বরফ। তারই মাঝে গ্লেসিয়ারটি গম্বুজের মত দাঁড়িয়ে আছে। সবার দৃষ্টিতে বিস্ময়। চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় মসৃণ বরফের দেয়াল-একেবারে খাড়া প্রায় ১০০ ফুট উঁচু। শুরু হলো পিটনের সাহায্যে ক্লাইম্বিং। আট-নয় ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ওরা পৌঁছল গ্লেসিয়ারের চূড়ায়। সুন্দর সমতল চূড়া। পিচ্ছিল বরফের আস্তরণ, অতি মসৃণ। এইসব গ্লেসিয়ারের চূড়া প্রায় সারা বছরই তুষার ঝড়ের মোকাবেলা করে। কখনও হালকা মাঝারি ধরনের, আবার কখনও বা প্রচণ্ডবেগে প্রবাহিত হয় তুষার ঝড়। ওরা যখন চূড়ায় পৌঁছল, তখন মাঝারি আকারের ঝড় হচ্ছে সেখানে। * পায়ে সবাই ক্র্যাম্প-অন পরে নিল । ক্র্যাম্প-অনের নিচে ধারাল স্পাইক লাগানো। হাঁটার সময় স্পাইকগুলো বরফের ভিতর ঢুকে যায়। ফলে পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে সহজেই চলাফেরা করা যায়।

অভিযাত্রী দল পরিশ্রান্ত। চটপট স্নো টেণ্ট খাটাল ওরা। জানস খান, শেরদিল, জুলফেকার ও জেসিও কবীর তৈরি করল একটি সুন্দর ইগলু। এটাই আনোয়ারের আবাস। ইগলুর দিকে চেয়ে আনোয়ার বলল, এক্সেলেন্ট! এবার তোমরা যে যার টেন্টে ঢুকে পড়ো। এরকম আবহাওয়ায় ফ্রস্ট-বাইটের আশঙ্কা পুরোমাত্রায়।

আবহাওয়া ভাল হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। অবিরাম তুষারপাত হচ্ছে। আকাশ ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে তুষার ঝড় ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। আবার স্তিমিত হয়ে আসছে। সেটা ক্ষণিকের জন্য। আট দশ দিন ওরা কেউ সূর্যের মুখ দেখেনি। ইগলুর অভ্যন্তরে কেটে গেল আনোয়ারের দুই দিন। তৃতীয় দিন ক্র্যাম্প-অন পায়ে ও বেরিয়ে এল ইগলুর বাইরে। চারদিক ভাল করে লক্ষ করল । আবহাওয়া কখন পরিষ্কার হবে বলা মুশকিল । এদিকে রেশনও প্রায় শেষ। আনোয়ার সবাইকে প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিল। ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার অভিযাত্রী দল যাত্রা শুরু করল রেস্ট হাউজের উদ্দেশে। নিরাপদেই পৌঁছল ওরা।

পনেরো দিনের মাথায় প্রকৃতি ওদের একটি সুন্দর মিষ্টি সকাল উপহার দিল। পুব আকাশে রক্তিম সূর্য। প্রত্যুষের নতুন আলোয় হেসে উঠল বরফের রাজ্য। চারদিকে ঝলমল করছে মুক্তোর মত কোমল রূপালী বরফ। আনোয়ারের ঘুম ভেঙে গেল। গতকাল আরজুমান্দ মালেক দলবল নিয়ে ক্লাইম্বিং শেষে ফিরে এসেছে। ফিরেই আনোয়ারকে বলেছে, আজ নূরীকে দেখতে যেতে হবে।

আনোয়ার জানালা খুলে বাইরে তাকাল। সম্মুখে দিগন্ত বিস্তৃত বরফ, উদীয়মান সূর্য-শান্ত, সমাহিত পরিবেশ। ও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে গভীর চিন্তায়। হঠাৎ দরজায় নক হলো। ছেদ পড়ল আনোয়ারের চিন্তায়। ডাক দিল সে। কাম ইন প্লীজ।

হাই আনোয়ার, গুড মর্নিং। রূমে প্রবেশ করল আরজুমান্দ মালেক।

মর্নিং আনোয়ার ওকে একটি সোফা দেখিয়ে বসতে বলল ।

সোফায় বসে একটি সিগারেট ধরাল মালেক। লম্বা টান দিয়ে বলল, আনোয়ার, তুই আজকাল কি ভাবিস বল তো?

এমন কিছু নারে। আনোয়ার একটু অন্যমনস্ক।

দোস্ত, তুই আমার কাছে লুকোতে চাইছিস? প্লীজ, বল না । মাঝে মাঝে তোকে অন্যমনস্ক মনে হয় কেন? মালেকের কণ্ঠে অনুনয়।

ভাবছিলাম, শেষ জীবনটা কিভাবে কাটবে? আনোয়ারের ভাবলেশহীন কণ্ঠ।

আনোয়ার, ওটা তো তোর জন্য নির্ধারিত ব্যাপার। তোর মরণ হবে হয় বুলেটে-বেয়োনেটে, নয়তো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। আর যদি ভালভাবে কাটে তবে আমেরিকার কোন ফাইভস্টার হোটেল। পাশে…

নে, চুপ কর। পৃথিবীতে মৃত্যু অতি নিশ্চিত। আর মৃত্যুর সময়টা অতি অনিশ্চিত, একটু থেমে আনোয়ার আবার বলল, নূরীকে দেখতে যাওয়ার কথা আমার মনে আছে। এবারে কেটে পড়। টয়লেট আমাকে ডাকছে।

আমাকেও রেডি হতে হবে। নাস্তা সেরে তুই তাড়াতাড়ি আয়। রূম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল মালেক।

ও শিওর। বলল আনোয়ার।

পরিচ্ছন্ন সকালে দুজন আবার উপস্থিত হলো পাইন ঘেরা সেই পর্বতের ঢালে। আসার সময় মালেক চা, কফি ও চকোলেট সঙ্গে নিয়েছে নূরীর জন্যে। সারা রাস্তায় এই নিয়ে আনোয়ার ওকে খেপাল। মাটির বারান্দার সামনে গিয়ে ওরা নির্দিষ্ট সংকেত দিল, কৌন হ্যায়? পরিচিত গলা শুনে মেয়েটি খুলে দিল দরজা। একগোছা তাজা ফুলের মতই দাঁড়িয়ে রয়েছে নূরী। মুখে অতি পরিচিত মৃদু হাসি। নূরী ডাকল, দালতারাসা। (অর্থাৎ এখানে এসো) আনোয়ার জানত দালতারাসার অর্থ। মালেককে নিয়ে সে এগিয়ে গেল। নূরীর সামনে গিয়ে বলল চায়ে উস্কা(অর্থাৎ চা খাব)। নূরী ইশারায় বুঝিয়ে দিল ঘরে চা নেই। মালেক পকেট থেকে চা, কফি ও চকোলেট বের করে নূরীর দিকে এগিয়ে দিল। আনোয়ার ইশারা করল নূরীকে চকোলেট খাবার জন্য। চকোলেটগুলো বেশ সুস্বাদু। একটা মুখে পুরে ওদের দুজনের দিকে দুটো চকোলেট এগিয়ে দিল নূরী। ইশারায় ওদেরকেও খেতে বলল। আজ ওরা প্রথম নূরীর সঙ্গে ঘরের ভিতরে গেল। মাটির তাকে বিভিন্ন জিনিস সুন্দর করে সাজানো। টাঙানো দুটি দড়িতে কাপড়-চোপড়। একটিতে পুরুষের কাপড়, অপরটিতে মেয়েদের। পুরুষের কাপড়গুলো ভীষণ নোংরা, কিন্তু নূরীরগুলো পরিষ্কার ।

মাটির দেয়াল কেটে ছোট্ট একটি দরজা। আনোয়ার অনুমান করল, ওটাই নূরীর কিচেনে যাওয়ার পথ। নূরীকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলো। তারপর দুজন নূরীকে নিয়ে কিচেন রূমে ঢুকল। ছোট্ট ঘরটি মাটির দেয়াল ঘেরা। কাঠ ও মাটির তৈরি ছাদ। দেয়ালে কয়েকটি খাঁজ-জিনিসপত্র রাখার জায়গা। ঘরের মাঝখানে ছোট উনুন। এককোণে শুকনো ডালপালা জড়ো করা। ওরা নূরীকে চা ও কফি বানানো শেখাল, নূরী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে দেখল, কিভাবে চা, কফি বানাতে হয়। কফি তৈরি শেষে সামনের ঘরে ফিরে এল ওরা তিনজন। প্রত্যেকের হাতেই পট ভর্তি গরম কফি। আনোয়ার ও মালেক কফি পান শুরু করল। নূরী তাকিয়ে দেখছে ওদের। মালেকের ইশারায় নূরীও কফি নিল। কফি পান শেষে পুনরায় কিচেনে ঢুকল সে। দুটো পট হাতে ফিরে এল ও। পটভর্তি কাঁচা ডিম। ইশারায় ওদের খেতে বলল নূরী। আনোয়ার ও মালেক নূরীকে বোঝাচ্ছে, কফির পর এগুলো খাওয়া ঠিক নয়–কিন্তু ও অবুঝ। ভীষণ পীড়াপীড়ি শুরু করল । শেষে ওরা বাধ্য হয়ে খেয়ে ফেলল কাঁচা, ডিম। তারপর বিদায় চাইল নূরীর কাছে। নূরী ইশারায় আবার ওদের আসতে বলল । কিছুদূর আসার পর পেছন ফিরতেই ওরা দেখতে পেল নূরীকে–দাঁড়িয়ে রয়েছে বারান্দার ওপর। মালেক ও আনোয়ার দুজনেই হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওকে। নূরীও হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল। বরফ ভেঙে ওরা এগিয়ে চলল রেস্ট হাউজের দিকে। একসময় ওরা হারিয়ে গেল নূরীর দৃষ্টি সীমার আড়ালে।

<

Super User