ট্রান্সিটো আরিজা ছিলেন মুক্তিপ্রাপ্ত একজন কোয়াড্রন। তার দেহের এক চতুর্থাংশ রক্ত ছিল নিগ্রো রক্ত আর তিন-চতুর্থাংশ শ্বেতাঙ্গ রক্ত। আনন্দের জন্য তার সহজ প্রবণতা দারিদ্রের কষাঘাতে নিষ্পেষিত হয়ে গিয়েছিল, পুত্রের দুঃখ-যন্ত্রণায় তিনি এখন একটা আনন্দ লাভ করলেন, তাকে তিনি নিজের দুঃখ-যন্ত্রণা বলে মনে করলেন। পুত্র প্রলাপ বকতে শুরু করলে তিনি তাকে চিকিৎসক নির্দেশিত রস পান করালেন, তাকে ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা করার জন্য তার গায়ের উপর উলের কম্বল একটার পর একটা চাপালেন, কিন্তু সেই সঙ্গে তাকে তার চরম অবসন্ন অবস্থা উপভোগ করতেও উৎসাহিত করলেন।
তিনি তাকে উদ্দেশ করে বললেন, এখন তোমার বয়স অল্প, এখনই এর সুযোগ নাও, যতখানি পারো যন্ত্রণা ভোগ করো, এ সব জিনিস সারাজীবন ধরে পাবে না। ডাক বিভাগের লোকজন অবশ্য এই ভাবনার সঙ্গে একমত হলো না। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাজকর্মে অবহেলা পরিলক্ষিত হল। অমনোযোগের ফলে ডাক আসবার পর পতাকা তুলতে গিয়ে সে ভুলভাল করলো। এক বুধবার সে জার্মান পতাকা তুলে দেয়, অথচ সেদিন জাহাজটা ছিল লেল্যান্ড কোম্পানির এবং সেটা ডাক নিয়ে এসেছিল লিভারপুল থেকে। আরেক দিন সে উড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা, অথচ জাহাজটা ছিল জেনারেল ট্রান্স আটলান্টিক কোম্পানির এবং সেটা ডাক নিয়ে এসেছিল সৎ নাজার থেকে। প্রেমের বিভ্রান্তি ডাক বিলির ক্ষেত্রে নানা রকম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলো, লোকজনের কাছ থেকে বহু অভিযোগ এলো এবং ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে তার চাকরি খোয়ায় নি তার মূলে ছিল লোটারিও থুগুটের আনুকূল্য। তিনি তাকে টেলিগ্রাফের কাজে নিযুক্ত রাখলেন এবং গির্জার বাদন দলে বেহালা বাজাবার জন্য সঙ্গে নিয়ে যেতে লাগলেন। ওদের দুজনের বয়সের পার্থক্য ছিল অনেক, একজন পিতামহ ও আরেকজন পৌত্র হতে পারতো, তাই তাদের বন্ধুত্বের ব্যাপারটা বোঝা কঠিন ছিল। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে যেমন তাদের সুন্দর সমঝোতা ও প্রীতির সম্পর্ক ছিল, বন্দরের সরাইখানাগুলিতেও তাই ছিল। সামাজিক শ্ৰেণীগত অবস্থা নির্বিশেষে সবাই সন্ধ্যায় ওই সরাইখানাগুলিতে গিয়ে জড়ো হত, মাতাল ভিখিরি পালিয়ে আসতো ভাজা মালিট মাছ ও নারকেল-ভাত খাবার লোভে। লোটারিও থুগুট টেলিগ্রাম অফিসের শেষ পালার কাজ সমাপ্ত করে এই রকম একটা সরাইখানায় চলে আসতেন, অনেক সময় সকাল পর্যন্ত সেখানে বসে বসে জ্যামাইকান পাঁচমিশালী সুরা পান করতেন আর আন্টিলীয় পালের জাহাজগুলি থেকে ডাঙ্গায় নেমে আসা পাগলা মাঝি-মাল্লাদের সঙ্গে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে স্ফুর্তি করতেন। তিনি ছিলেন স্থূলকায়, ঘাড়টা ছিল ষাঁড়ের মতো, মুখে সোনালি দাড়ি, আর রাতে বেরুবার সময় তিনি মাথায় চাপাতেন একটা লিবার্টি ক্যাপ, শুধু যদি ঘণ্টার একটা মালা থাকতো তাঁর সঙ্গে তা হলে তাঁকে অবিকল সন্ত নিকোলাসের মতো দেখাতো। সপ্তাহের অন্তত একটি রাত তিনি শেষ করতেন কালো একটি মেয়েকে নিয়ে, যাদের তিনি অভিহিত করতেন রাতের পাখি বলে, যারা নাবিকদের জন্য গজিয়ে ওঠে স্বল্পস্থায়ী হোটেলে অর্থের বিনিময়ে জরুরি ভিত্তিতে ভালোবাসা বিক্রি করতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সঙ্গে দেখা হবার পর তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হল এক ধরনের হাকিমী আনন্দ নিয়ে তাকে নিজের স্বর্গের গোপন আনন্দযজ্ঞে দীক্ষিত করার চেষ্টা। যে সব রাতের পাখিকে তিনি সর্বোত্তম মনে করতেন তাদের মধ্য থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জন্য মেয়ে নির্বাচন করার দায়িত্ব নিলেন তিনি, তাদের সঙ্গে দাম ও তাদের কামকলা নিয়ে আলোচনা করলেন, নিজের টাকা থেকে তাদের সেবার জন্য ওদের প্রাপ্য অর্থ অগ্রিম মিটিয়ে দিতে চাইলেন, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা রাজি হল না। তার কৌমার্য এখনো অক্ষত আছে এবং সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে ভালোবাসা ছাড়া সে তার কৌমার্য বিসর্জন দেবে না।
হোটেলটা ছিল ঔপনিবেশিক যুগের একটি প্রাসাদ। এক সময় ভালো দিন ছিল সেটার। এর বিশাল আকারের মার্বেল পাথরের ঘরগুলি এখন পেস্টবোর্ড দিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট ঘরে বিভক্ত, উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার জন্য সেখানে ফুটো করা আছে। এই ছোট ঘরগুলি ভাড়া দেয়া হয়, উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখার জন্য যেমন, তেমনি ভেতরের কাজকর্ম করার জন্যও। পরাধিকার চর্চা করে ভেতরে উঁকি মারার চেষ্টা করার জন্য কাউকে কাউকে চড়া দাম দিতে হয়েছে বলে গল্প আছে। একবার সেলাইর কাঁটা ঢুকিয়ে একজনের চোখ গেলে দেয়া হয়েছিল। আরেকজন উঁকি দিয়ে দেখে যে কুকর্মে লিপ্ত রমণীটি তার স্ত্রী। বেশ সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকরাও বেশ্যাদের ছদ্মবেশ ধরে স্বল্প সময়ের জন্য জাহাজ থেকে নামা নাবিকদের সঙ্গে এখানে আসতেন, নিজেদেরকে কিছুক্ষণ নিছক ভুলে থাকার তাগিদে। আরো অজস্র গল্প শুনে ওই রকম একটি ঘরে যাবার কল্পনাতেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ভয়ে শিউরে উঠলো। আর তাই, এভাবে লুকিয়ে দেখা এবং নিজেকে দেখানোর মধ্যে যে ইউরোপের রাজা মহারাজাদের সূক্ষ্ম রুচির পরিচয় বিধৃত, লোটারিও থুগুট কখনো তা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বিশ্বাস করাতে পারেন নি।
লোটারিও থুগুটের দৈহিক বিশালত্বের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল তার দেবশিশুর মতো গোলাপকুঁড়ি জননেন্দ্রিয়। এটা নিশ্চয়ই কোনো সৌভাগ্যজনক ত্রুটি ছিল, কারণ সব চাইতে বেশি পোড় খাওয়া পাখিরাও তার সঙ্গে বিছানায় যাবার অধিকার নিয়ে তর্কবিতর্ক করতো, আর তারপর তারা এমন চিৎকার করতো যেন কেউ তাদের জবাই করছে আর তাদের চিৎকারে প্রাসাদের ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে উঠতো, সেখানে বাস করা ভূতপ্রেতগুলিও ভয়ে কাঁপতো। লোকে বলতো যে থুগুট সাপের বিষের একটা মালিশ ব্যবহার করতেন যার ফলে মেয়েদের কোমরের পশ্চাদ্ভাগ আগুনের মতো তেতে উঠতো কিন্তু তিনি শপথ করে বলেছেন যে ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদের অতিরিক্ত তার আর কিছু নেই। হো হো করে হাসতে হাসতে তিনি বলতেন, এ সবই হচ্ছে শুধু ভালোবাসা। সম্ভবত তার কথাই যে সত্য এটা বুঝতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার অনেক বছর কেটে যায়। অবশেষে তার ভাববিলাসী শিক্ষার উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছে ফ্লোরেন্টিনোর যখন একটি লোকের সঙ্গে দেখা হয় তখন তার সব সন্দেহ কেটে যায়। তিনটি রমণীকে একই সময়ে শোষণ করে লোকটি রাজার হালে জীবন কাটাতো। রোজ সকালে তার পায়ের সামনে লুটিয়ে ওই তিনজন তার কাছে ওদের হিসেব বুঝিয়ে দিতো, কম মুনাফার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করতো এবং নিজেদের বাসনা পূরণের জন্য একটাই আর্জি জানতো, যে তার জন্য সব চাইতে বেশি টাকা এনেছে তার সঙ্গে সে বিছানায় যাবে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হয় একমাত্র ভয়ে ওরা এই রকম গ্লানিকর আচরণ করতো কিন্তু তিন মেয়ের মধ্যে একজন ভিন্ন কথা বলে তাকে চমকে দেয়।
সে বললো, শুধু ভালোবাসার জন্যই একজন মানুষ এ সব করে।
লোটারিও থুগুট হোটেলটির অন্যতম সম্মানিত খরিদ্দার হয়ে ওঠেন রতিক্রিয়ায় তার পারদর্শিতার জন্য ততটা নয় যতটা তাঁর ব্যক্তিগত আকর্ষণীয় গুণাবলীর জন্য। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও মালিকের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিল তার শান্ত ও পলায়নপর স্বভাবের জন্য। তার শোকের সব চাইতে কঠিন সময়ে সে হোটেলের একটা শ্বাসরুদ্ধকর ছোট ঘরে ঢুকে তালা বন্ধ করে কবিতা আর আবেগপ্রবণ ধারাবাহিক প্রেমের গল্প পড়তো আর তার স্বপ্নকল্পনা বারান্দার কালো সোয়ালো পাখির বাসা আর চুম্বনের শব্দ ও দিবানিদ্রার সময়ের নিস্তব্ধতার মধ্যে পাখার ঝাঁপটানি ছড়িয়ে রাখতো। কিন্তু সন্ধ্যার পর, আবহাওয়া যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, তখন দিনের কর্ম শেষে যে সব মানুষ কিছু সান্ত্বনা পেতে এবং খানিকটা দ্রুত ভালবাসার খোঁজে এখানে আসতো তাদের কথাবার্তা না শুনে কোনো উপায় ছিল না। এর ফলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বহু বিশ্বাসভঙ্গের কথা শুনলো, এমনকি কয়েকটি রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্যও সে জেনে ফেললো। গুরুত্বপূর্ণ কিছু খরিদ্দার এবং স্থানীয় সরকারি কর্মচারীও তাদের স্বল্পস্থায়ী প্রেমিকাদের কাছে ওই সব কথা বলতো, চিন্তাও করতো না যে পাশের ঘরে কারো কানে এ সব কথা পৌঁছে যেতে পারে। এই ভাবে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আরেকটি খবর পায়। সেটাভেন্টো দ্বীপপুঞ্জের বারো নৌমাইল উত্তরে অষ্টাদশ শতাব্দিতে একটা স্প্যানিশ পালতোলা জাহাজ পাঁচশো বিলিয়ন পেসোরও বেশি মূল্যের খাঁটি সোনা ও মহার্ঘ মণি-মুক্তার পশরা নিয়ে ডুবে যায় এবং এখনো তা সমুদ্রের তলদেশেই বিরাজ করছে। কাহিনীটি শুনে সে অবাক হয়ে যায়। কিন্তু কয়েক মাস কেটে যাবার আগ পর্যন্ত সে বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবে নি। কিন্তু এক সময় তার প্রেম ওই ডুবন্ত ঐশ্বর্য উদ্ধার করার এক দুর্দম ইচ্ছা তার মনে জাগিয়ে তুললো, যেন ফারমিনা ডাজা সোনার বৃষ্টি ধারায় স্নান করতে পারে।
বহু বছর পর সে যখন কবিতার রসায়ন দ্বারা পরিশীলিত তার আদর্শায়িত মেয়েটি সত্যি সত্যি কি রকম দেখতে ছিল তা মনে করার চেষ্টা করে তখন সে দেখলো তখনকার মর্মভেদী গোধূলি থেকে তাকে আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। তার প্রথম চিঠির উত্তরের জন্য অধীর আগ্রহে থাকার সময় সে যখন নিজেকে দৃষ্টির আড়ালে রেখে ওকে লক্ষ করতো তখনো সে তাকে দেখেছিল বেলা দুটার ঝিকিমিকির মধ্যে বাদাম গাছ থেকে ঝরে পড়া ফুলের জলধারায় স্নাত। বছরের ঋতু যাই হোক না কেন। ওখানে সর্বদাই বিরাজ করতো এপ্রিল মাস। লোটারিও থুগুটের সঙ্গে গির্জায় বেহালা বাজাতে যাবার পেছনে তার উৎসাহের কারণ ছিল একটাই, বাদক দলের সঙ্গে সে যে সুবিধাজনক স্থানে দাঁড়ায় সেখান থেকে সে স্তুতি গীত গাইবার সময় ফারমিনা ডাজাকে ভালো ভাবে দেখতে পেতো, তার পতপত করে ওড়া পোশাক তার চোখে পড়তো। কিন্তু তার চিত্তবিভ্রমই শেষ পর্যন্ত ওই আনন্দ উপভোগের পথে বাধা সৃষ্টি করে। তার আত্মার অবস্থার তুলনায় মরমীয়া সঙ্গীতগুলি এতোই নির্বিষ মনে হলো যে সে তার মধ্যে উচ্ছল নাচের প্রেমগীতি যোগ করে সেটাকে আরেকটু উত্তেজক করার প্রয়াস পেল, আর লোরেঞ্জো থুগুট তখন বাদন দল থেকে তাকে অব্যাহতি দিতে বাধ্য হলেন। এই সময়েই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার আরেকটি আকাক্ষার কাছে আত্মসমর্পন করে। ট্রান্সিটো আরিজা তাঁর উঠানের টবে গার্ডেনিয়া ফুল ফোঁটাতেন। ফারমিনা ডাজার স্বাদটা জানবার জন্য ফ্লোরেন্টিনো ওই ফুল খেতে শুরু করলো। এই সময়েই সে তার মায়ের তোরঙ্গে এক শিশি সুগন্ধি কোলোন আবিষ্কার করে। হামবুর্গ মার্কিন জাহাজ কোম্পানির নাবিকরা চোরাই মাল হিসেবে এ সব বিক্রি করতো। তার প্রিয়ার অন্য স্বাদগুলি আস্বাদন করার লোভ সামলাতে না পেরে সে ওই কোলোন পান করতে শুরু করলো। সারা রাত ধরে, সকাল না হওয়া পর্যন্ত, সে ওই শিশির কোলোন খেতে থাকে। শেষে সে ফারমিনা ডাজাতে মাতাল হয়ে গেল, প্রথমে কোলোন পান করে ও পরে বন্দরের সরাইখানাগুলিতে মদ গিলে, তারপর জেটিতে বসে সমুদ্রের চুলখোলা আকাশের নিচে নাবিকদের সান্তনা প্রদান করা প্রেমলীলা দেখতে দেখতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে। ট্রান্সিটো আরিজা সকাল ছটা পর্যন্ত ওর অপেক্ষা করলো, তার মনে হল দুশ্চিন্তায় সে মরে যাবে, ছেলেকে সে সব অসম্ভব আস্তানায় খুঁজে বেড়ালো, অবশেষে দুপুর বারোটার সামান্য আগে সে ফ্লোরেন্টিনোকে খুঁজে পেল উপসাগরের একটা খাড়িতে, যেখানে সচরাচর জলে ডোবা মড়া ঢেউয়ের ধাক্কায় ভেসে আসতো।
তার রোগমুক্তির পর সেরে ওঠার সময়ের ছেদটুকুর সুবিধা নিলেন ফ্লোরেন্টিনোর মা। চিঠির উত্তর না পেয়ে তার নিষ্ক্রিয়তাকে তিনি তিরস্কার করলেন। তিনি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন দুর্বলরা কখনো প্রেমের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে নি, ওই রাজ্য কঠোর এবং নির্দয় এবং মেয়েরা সাহসী ও দৃঢ়চেতা মানুষের কাছেই ধরা দেয়, কারণ জীবনের মুখোমুখি হবার জন্য যে নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় তা মেয়েদেরকে ওই রকম পুরুষরাই দেয়। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এই শিক্ষা গ্রহণ করলো, হয়তো একটু বেশি ভালো ভাবেই। ট্রান্সিটো আরিজা যখন তাকে তার কালো স্যুট, ফেল্ট হ্যাট, তার আবেগ জাগানিয়া বোটাই এবং সেলুলয়েড কলারে সুসজ্জিত হয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন তখন তিনি একটা গর্বের অনুভূতি লুকাতে পারলেন না, যার মধ্যে মাতৃসুলভতার চাইতে কামাসক্তির অংশ কম ছিল না। তিনি ওকে ঠাট্টা করে বললেন, সে কোনো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যাচ্ছে নাকি। ফ্লোরেন্টিনোর কান লাল হয়ে গেল। সে উত্তর দিল, প্রায় ওই রকমই। মা দেখলেন যে ছেলে ভয়ে প্রায় নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, কিন্তু তার সঙ্কল্প ছিল অপরাজেয়। তিনি তার উদ্দেশে তার শেষ সাবধান বাণী ও আশীর্বাদ উচ্চারণ করলেন, উচ্ছলভাবে হাসতে হাসতে, এবং দুজনে একসাথে। তার বিজয় উদ্যাপন করবার জন্য তিনি তাকে আরেক শিশি কোলোন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলেন।
ও এক মাস আগে ফারমিনা ডাজাকে তার চিঠি দিয়েছিল। তারপর থেকে পার্কটিতে ফিরে না যাবার যে প্রতিশ্রুতি ও তাকে দিয়েছিল সে প্রায়ই তা ভঙ্গ করে কিন্তু অতি সতর্কতার সঙ্গে, ও যেন তাকে দেখতে না পায়। কোনো কিছুই বদলায় নি। দুটোর দিকে বাদাম গাছের নিচে পড়ালেখার পালা সাঙ্গ হত, শহর তখন সবেমাত্র দিবান্দ্রিা থেকে জেগে উঠেছে। বেলা পড়ে দিন ঠাণ্ডা হয়ে উঠতে শুরু করা পর্যন্ত ফারমিনা ডাজা তার পিসির সঙ্গে ওইখানে বসে সেলাই করতো। আজ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা পিসি বাড়িতে ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্য সে সামরিক পদক্ষেপে রাস্তা অতিক্রম করে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, কিন্তু সে সম্বোধন করলো ফারমিনা ডাজাকে নয়, তার পিসিকে। দয়া করে আপনি ভেতরে যান, আমাকে এক মিনিটের জন্য একা এই তরুণীর সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে দিন। পিসি বললেন, কী ঔদ্ধত্য! আমি শুনতে পারবো না ওকে বলার মতো এমন কিছু তোমার থাকতেই পারে না।
সে বললো, তাহলে আমি ওকে কিছু বলবোই না, কিন্তু আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি এর পরিণতির জন্য আপনি দায়ী হবেন।
এসকোলাস্টিকা ডাজা আদর্শ প্রেমিকের কাছ থেকে এ রকম আচরণ প্রত্যাশা করেন নি, কিন্তু তিনি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। এই প্রথমবারের মতো তার মনে হল যে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা কথা বলছে স্বয়ং হোলি স্পিরিটের অনুপ্রেরণায়। তিনি তরুণ-তরুণী দুটিকে দোরগোড়ায় বাদাম গাছের নিচে একা রেখে সেলাইর কাটা বদলাবার জন্য বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।
প্রকৃতপক্ষে, শীতের সোয়ালোর মতো তার জীবনে অকস্মাৎ উদিত তার এই মিতবাক পাণিপ্রার্থী সম্পর্কে ফারমিনা ডাজা খুব কমই জানতো। চিঠিতে ওর সই দেখেছিল বলে সে তার নামটা জানে, নইলে তাও জানতো না। সে জেনেছিল যে ও এক অবিবাহিতা মহিলার পিতৃহীন সন্তান। মহিলা পরিশ্রমী এবং অচপল স্বভাবের, কিন্তু তার যৌবনের একটি মাত্র ভুলের জন্য তিনি সমাজের সামনে কলঙ্ক হয়ে বেড়াচ্ছেন। সে এটাও জেনেছিল যে ও ডাকবিলি করে না, বরং ও একজন যোগ্যতাসম্পন্ন সহকারী, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, আর তার মনে হল সেদিন যে ও এখানে টেলিগ্রাম বিলি করতে এসেছিল সেটা ছিল তাকে দেখার একটা অজুহাত মাত্র। এই ভাবনাটা তাকে নাড়া দিল। সে এটাও জেনেছিল যে ও গির্জার বাদক দলের একজন সঙ্গীত শিল্পী, যদিও প্রার্থনার সময় চোখ তুলে ওর দিকে তাকাবার সাহস সে কখনো সঞ্চয় করতে পারে নি, তবে এক রবিবার একটা বিস্ময়কর গোপন তথ্যের মতো তার সামনে একটি সত্য প্রকাশ পেল, অন্য যন্ত্রীরা যখন সবার জন্য তাদের যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশন করছে তখন বেহালা বাদক বাজাচ্ছে একমাত্র তার জন্য। সে নিজের জন্য এ রকম একটি মানুষ বেছে নিতো না। কিন্তু বেওয়ারিশ শিশুর চশমার। মতো তার চশমা, তার পাদ্রীজনোচিত পোশাক, তার রসহ্যমণ্ডিত সঙ্গীত ফারমিনা ডাজার মনে একটা অপ্রতিরোধ্য কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছিল। সে কদাচ কল্পনা করে। নি যে ভালবাসার বহু মুখোশের মধ্যে কৌতূহল হলো একটি।
সে কেনো যে ওর চিঠিটা নিল তা সে নিজের কাছেও ব্যাখা করতে পারলো না। কিন্তু সেজন্য সে নিজেকে তিরস্কার করে নি, তবে চিঠির উত্তরদানের ক্রমবর্ধমান চাপ তার জীবনকে জটিল করে তোলে। তার মনে হল তার বাবার প্রতিটি উচ্চারণ, প্রতিটি সাধারণ চাহনি, তুচ্ছতম ভাবভঙ্গি যেন তার গোপন কথাটি জানার জন্য পাতা ফাঁদ। তার ভয় এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে সে খাবার টেবিলে কথা বলাই বন্ধ করে দিল, পাছে কোনো অসতর্ক উক্তির মাধ্যমে সে তার গোপন কথাটি প্রকাশ করে ফেলে, এমনকি সে তার পিসিকেও এড়িয়ে যেতে শুরু করলো যদিও তিনি ওর অবদমিত দুশ্চিন্তাকে নিজের দুশ্চিন্তা বলেই মনে করেছিলেন। ফারমিনা সময়ে-অসময়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বারবার পড়া চিঠিটা আবার পড়লো, চিঠির আটান্নটি শব্দের তিনশো চৌত্রিশটি অক্ষরের মধ্যে কোনো গোপন সঙ্কেত আছে কিনা তা আবিষ্কারের
চেষ্টা করলো, সাদা অক্ষরে যা বলা হয়েছে তার বাইরেও কোনো ইঙ্গিত আছে কিনা। সেটা ধরতে চেষ্টা করলো, কিন্তু প্রথম পাঠের সময় সে যা বুঝেছিল তার বেশি কিছুই সে বুঝতে পারলো না। সেদিন তার বুক তোলপাড় করে উঠেছিল, সে কোনো রকমে ছুটে বাথরুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, খামটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ভেবেছিল একটা দীর্ঘ আবেগময় চিঠি সে পাবে, কিন্তু পেল শুধু ছোট একটা সুরভিত কাগজে লেখা মাত্র কয়েকটি কথা, যার সুদৃঢ় সঙ্কল্প তাকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল।
প্রথমে সে কোনো গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তাই করে নি যে তাকে এ চিঠির উত্তর দিতে হবে, কিন্তু চিঠির বক্তব্য এতো স্পষ্ট ছিলো যে উত্তর না দেয়ার কোনো উপায়ই থাকলো না। ইতিমধ্যে, তার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের যন্ত্রণার ভেতরে, স্বীকার করতে না চাইলেও সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো যে সে প্রায়ই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কথা ভাবছে, তার সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠছে, এমনকি বিশেষ বিচলিত হয়ে সে নিজেকে প্রশ্নও করেছে কেন ও ঠিক সময়ে পার্কে উপস্থিত থাকছে না, সে নিজেই ওকে আসতে বারণ করেছে সে কথা সে সম্পূর্ণ ভুলে যায়। সে ভেবেছিল যে ওই সময়টায় সে তার চিঠির উত্তর লেখায় ব্যস্ত থাকবে। আর এখন সে তার কথা সারাক্ষণ ভাবতে লাগলো, সে যে কারো কথা এভাবে ভাবতে পারে তা সে কখনো কল্পনাও করে নি। এখন তার মাঝে মাঝেই মনে হয় ওর যেখানে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই ও বুঝি সেখানে আছে, ও যেখানে থাকতে পারে না সে চায় ও সেখানে থাকুক, তার মনে হয় সে যখন ঘুমিয়ে থাকে ও তখন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দেখছে, সে এর একটা শারীরিক অনুভূতি পর্যন্ত পায়, তাই সেদিন অপরাহে সে যখন পার্কের হলুদ পাতাগুলির উপর তার দৃঢ় পদক্ষেপের শব্দ শুনতে পায় তখন তার মনে হয়েছিল এটা হয়তো তার কল্পনারই আরেকটা চাতুরী। কিন্তু যখন ও কর্তৃত্বের সুরে, ওর সাধারণ উদাসীন ভঙ্গির চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভঙ্গিতে, তার কাছ থেকে চিঠির উত্তর দাবি করলো তখন সে কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। সে বিষয়টা পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু বাজে অজুহাত শুনে চলে যাবার জন্য ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অতল গহ্বর পেরিয়ে এখানে আসে নি।
ও তাকে লক্ষ করে বললো, চিঠি যখন তুমি গ্রহণ করেছে তখন উত্তর না দিলে অসৌজন্য প্রকাশ পাবে।
গোলক ধাঁধার সমাপ্তি ঘটে ওখানেই। ফারমিনা ডাজা তার আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল, দেরির জন্য ওর ক্ষমা ভিক্ষা করলো, কথা দিল যে ছুটি শেষ হবার আগেই ও তার চিঠির উত্তর পাবে এবং সে তা পায়ও। স্কুল খুলবার তিন দিন আগে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এসকোলাস্টিকা পিসি একটা তথ্য জানার জন্য টেলিগ্রাফ আপিসে যান। পিয়েড্রাস ডি মোলারে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে কত খরচ পড়বে তা জানতে চান তিনি। যে সব জায়গায় টেলিগ্রাফ যায় তার তালিকাতে ওই গ্রামের নামই ছিল না। যাই হোক, তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার সাহায্য নিলেন, কিন্তু ওকে যে তিনি আগে কখনো দেখেছেন সেটা বুঝতেই দিলেন না, তারপর তিনি ভুল করে টিকটিকির চামড়ায় মোড়ানো তার একটা প্রার্থনা পুস্তক কাউন্টারের উপর রেখে চলে যান, ওটা ছিল নিছক ভান, আর তার মধ্যে ছিল সোনালি নকশা আঁকা সুন্দর একটি খাম। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বাকি বিকালটা কাটিয়ে দিল গোলাপ ফুল খেয়ে, চিঠিটা বারবার পড়ে, একটি একটি অক্ষর করে, যত বেশি পড়লো তত বেশি গোলাপ খেল, আর মাঝরাত নাগাদ এতো বার চিঠিটা পড়লো আর এতো বেশি গোলাপ ফুল খেল যে তার মা বাধ্য হলেন একটা গরুর বাচ্চার মতো তার মাথা চেপে ধরে তাকে এক ডোজ ক্যাস্টর অয়েল খাইয়ে দিতে।
ওই বছরেই তারা বিধ্বংসী প্রেমে পড়ে। দুজনের একজনও অপর জনের কথা না ভেবে, তাকে স্বপ্নে না দেখে, তার চিঠি পাওয়া এবং উত্তর দেবার জন্য সমান অধৈর্য হয়ে থাকতে পারলো না। ওই উন্মাতাল বসন্তে, কিংবা তার পরের বছরে, ওদের কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবার কোনো সুযোগ হয় নি। অধিকন্তু, তাদের প্রথম দেখার পর থেকে অর্ধশতাব্দি পরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার সিদ্ধান্তের কথা পুনর্ব্যক্ত করার আগ পর্যন্ত তাদের একটি দিনও বাদ যায় নি যখন তারা একে অন্যকে চিঠি লেখে নি, এক সময়ে তারা দিনে দুটো করেও চিঠি লিখেছে, কিন্তু এসকোলাস্টিকা পিসি যে আগুন জ্বালাতে সাহায্য করেছিলেন তিনি যখন সে আগুনের লেলিহান শিখার তীব্রতা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন তখন তিনি এটা বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেন।
পিসি প্রথম চিঠিটা টেলিগ্রাফ অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের নিয়তির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিশোধ নেবার জন্য। তারপর পথে ওরা যখন আকস্মিক দেখা হবার ভান করে তখন তিনি চিঠিপত্রের বিনিময়ে বাধা দিলেন না, তবে তিনি ওদেরকে কোনো কথাবার্তা বলার অনুমতি দেবার সাহস পেলেন না, সে কথার্বাতা যতই তুচ্ছ বা অল্প সময়ের জন্য হোক না কেন। এ সত্ত্বেও, তিন মাস পরে তিনি উপলব্ধি করলেন যে তাঁর ভাইঝি তাঁর প্রথম ধারণা অনুযায়ী কোনো মেয়েলী খেয়ালের শিকার হয় নি। এবং এখন তাঁর নিজের জীবনই প্রেমের আগুনের ফলে ভীষণ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। আসল ঘটনা হল, তার ভাই-এর দয়াদাক্ষিণ্য ছাড়া এসকোলাস্টিকা ডাজার জীবন ধারণের কোনো উপায় ছিল না এবং তিনি নিশ্চিত জানতেন তার অত্যাচারী প্রকৃতির ভাই তার বোনের বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপারটা কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার সময় হলে তিনি নিজে তার যৌবনকাল থেকে যে প্রচণ্ড দুঃখ যন্ত্রণা ভোগ করে এসেছেন তার ভাইঝিকে তার মধ্যে ঠেলে দিতে পারলেন না, আর তখন তিনি এমন একটা কৌশলের আশ্রয় নিলেন যা তাঁকে তাঁর নির্দোষিতার মোহটুকু বজায় রাখতে সাহায্য করলো। ব্যবস্থাটা ছিল সহজ। প্রতিদিন বাড়ি থেকে অ্যাকাডেমি যাবার পথে ফারমিনা ডাজা কোনো একটা গোপন স্থানে তার চিঠিটা রেখে দিতো আর ওই চিঠিতেই সে ওকে জানিয়ে দিতো কোথায় সে এর উত্তরটা পাবে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজাও একই কাজ করতে লাগলো। এই ভাবে, বছরের বাকি সময়টার জন্য, এসকোলাস্টিকা পিসির বিবেকের দ্বন্দ্ব স্থানান্তরিত হল গির্জার কোনো একটা জায়গায়, গাছের গর্তে, ঔপনিবেশিক আমলের কোনো দুর্গের ফাটলে। মাঝে মাঝে ওদের চিঠি বৃষ্টিতে ভিজে যেতো, কাদায় নোংরা হত, দৈবদুর্বিপাকে ছিঁড়ে যেত, আরো নানা কারণে কয়েকটা হারিয়েও যেত, কিন্তু ওরা সব সময়ই পরস্পরের সঙ্গে আবার সংযোগ স্থাপনের একটা পথ পেয়েই যেত।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রতি রাতেই লিখতো। দোকানের পেছনের ঘরে তেলের প্রদীপের বিষাক্ত ধোয়া গিলতে গিলতে সে চিঠি লিখে চলতো। লাইব্রেরিতে পড়া তার প্রিয় কবিদের অনুকরণে লেখা চিঠিগুলি ক্রমান্বয়ে অসংলগ্ন ও উন্মত্ত প্রলাপের রূপ ধারণ করতে থাকে। লাইব্রেরিতে এরই মধ্যে প্রায় আশিটি গ্রন্থ সংগৃহীত হয়ে গিয়েছিল। এক সময়ে তার মা তাকে নিজের যন্ত্রণা উপভোগ করার কথা বলেছিলেন, এখন তিনি তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। ভোরে মোরগের ডাক শোনার পর তিনি তার শোবার ঘর থেকে পুত্রের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতেন, এ রকম করলে তুমি তো পাগল হয়ে যাবে। কোনো মেয়ের দামই এতো হয় না। এই ধরনের অনিয়ন্ত্রিত আবেগের শিকার হতে তিনি ইতোপূর্বে কাউকে দেখেন নি। কিন্তু ও তার কথার বিন্দুমাত্র দাম দিল না। মাঝে মাঝে সে সারা রাত না ঘুমিয়ে সকালে কাজে যেতো, প্রেমের উচ্চতায় তার মাথার সব চুল তখন এলোমেলা। অফিসে যাবার পথে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে সে তার চিঠিটা লুকিয়ে রাখতো যেন ফারমিনা ডাজা স্কুলে যাবার সময় সেখান থেকে তা তুলে নিতে পারে। কিন্তু ফারমিনা ডাজার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন রকম। বাড়িতে বাবা আর স্কুলে সিস্টারদের সতর্ক দৃষ্টির কারণে সে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কিংবা ক্লাসে নোট নেবার ছল করে তার খাতার পাতার অর্ধেকটা মাত্র কোনো রকমে লিখতে পারতো। কিন্তু শুধু সময়ের স্বল্পতা বা ধরা পড়ার ভয়ে এমনটা ঘটে নি। তার নিজস্ব স্বভাব তাকে তার চিঠিতে আবেগের চোরা গর্ত এড়িয়ে শুধু দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা বর্ণনায় উদ্বুদ্ধ করে, ফলে তার চিঠিগুলির রূপ হয়ে দাঁড়ায় একটা জাহাজের লগ বুকের মতো। প্রকৃতপক্ষে এ সব চিঠির উদ্দেশ্য ছিল মনোযোগকে ভিন্নমুখী করা, আগুনে হাত না দিয়েও কয়লাকে জ্বলন্ত রাখা, আর অন্য দিকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার চিঠির প্রতিটি ছত্রে নিজেকে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করতে থাকতো। ফারমিনাকে নিজের উন্মত্ততা দ্বারা সংক্রামিত করার জন্য মরীয়া হয়ে ক্যামেলিয়া ফুলের পাপড়ির বুকে পিনের সরু মাথা দিয়ে অনুকবিতা লিখে ফ্লোরেন্টিনো ফারমিনাকে পাঠালো। ফারমিনা নয়, সে-ই, দুঃসাহসিকতার সঙ্গে, তার এক চিঠির মধ্যে নিজের মাথার চুল ভরে দিল। সে আশা করেছিল যে ফারমিনা হয়তো তার বেণীর একটা সম্পূর্ণ গুচ্ছ প্রতিদান হিসেবে তাকে পাঠাবে কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হল না, তবে ওকে একটা কাজে উদ্বুদ্ধ করতে ফ্লোরেন্টিনো সক্ষম হয়। এর পর থেকে ফারমিনা তার চিঠির সঙ্গে পাঠাতে শুরু করে অভিধানের মধ্যে চাপা দিয়ে রাখা শিরা ওঠা শুকনো গাছের পাতা, প্রজাপতির ডানা, মায়াবী পাখির পালক, আর তার জন্মদিন উপলক্ষে ও তাকে দেয় সন্ত পিটার ক্লেভিয়ারের পোশাকের এক বর্গ সেন্টিমিটারের এক টুকরা কাপড়। সে সময় ওই রকম কাপড়ের টুকরা গোপনে বিক্রি হত, একজন স্কুলছাত্রীর পক্ষে বেশ চড়া দামেই বলতে হবে। তারপর একদিন রাতে, কোনো রকম সতর্ক সঙ্কেত ছাড়াই, বেহালা বাজাবার শব্দ শুনে সে ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠে, বুঝতে পারে যে তার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে একজন প্রেমগীতি বাজাচ্ছে, একই নাচের সুর বাজাচ্ছে বারবার, বারবার, আর সে শিউরে উঠে শুনলো যে প্রতিটি ছড়ের টানে ধ্বনিত হচ্ছে ধন্যবাদজ্ঞাপনের সুর, তার বাগানের ফুলের পাপড়ির জন্য, ওকে চিঠি লেখার জন্য অঙ্ক কষার সময় থেকে চুরি করা মুহূর্তগুলির জন্য, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের চাইতে পরীক্ষার ক্ষেত্রে ওর কথা বেশি চিন্তা করার জন্য, তার ভয়ের জন্য, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে এতো বড় অবিবেচনার কাজ করতে পারে সেটা বিশ্বাস করার সাহস তার হল না।
পরদিন সকালে প্রাতরাশের টেবিলে লোরেঞ্জো ডাজা তাঁর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না, কারণ প্রথমত সেরেনেড তথা জানালার নিচে দাঁড়িয়ে প্রিয়ার উদ্দেশে গীতবাদনের ক্ষেত্রে একটা সুর বারবার বাজাবার অর্থ কী তা তিনি জানতেন না, দ্বিতীয়ত খুব মন দিয়ে শোনা সত্ত্বেও ঠিক কোন বাড়ির উদ্দেশে ওটা নিবেদিত হয়েছিল। তা তিনি স্থির করতে পারেন নি। এই সময় এসকোলাস্টিকা পিসির কথা শুনে তাঁর। ভাইঝির প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। তিনি অবিচল চিত্তে বললেন যে তার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে তিনি একজন নিঃসঙ্গ বেহালা বাদককে দেখেছেন, ও পার্কের ওপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তিনি এও জানালেন যে একটি সুর বারংবার বাজাবার অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদের কথা জানিয়ে দেওয়া। সেদিনের চিঠিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা স্পষ্ট করে লিখলো যে গত রাতে সে-ই বেহালা বাজিয়েছে, সুরটা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে, ফারমিনা ডাজাকে সে মনে মনে যে নামে ডাকতো তার সৃষ্টির নামকরণ সে ওই নামেই করেছে : মুকুট শোভিত দেবী। সে পার্কে আর ওই সুর বাজায় নি, কিন্তু সে তার পছন্দ মতো এমন সব জায়গায় চাঁদনি রাতে ওই সুর বাজিয়েছে যেখান থেকে ফারমিনা ডাজা তার শোবার ঘরে থেকেই নিরাপদে তা শুনতে সক্ষম হয়। তার একটা বিশেষ প্রিয় স্থান ছিল নিঃশব্দের সমাধিস্থল, একটা ন্যাড়া টিলার উপর, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় থেকে অরক্ষিত, শকুনির দল ঝিমুচ্ছে সেখানে, আর ওই পরিবেশে তার সঙ্গীত একটা অপ্রাকৃতিক ধ্বনিময়তা অর্জন করতো। পরে সে বাতাসের গতি চিনতে শিখলো এবং তার সুর যে প্রয়াজনীয় জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছেছে সে সম্পর্কে সে সুনিশ্চিত হল।
অর্ধশতাব্দির বেশি কাল ধরে এই দেশ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে চলেছিল। সে বছরের আগস্ট মাসে নতুন একটা গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এবং তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, সরকার সামরিক আইনের ঘোষণা দিল এবং ক্যারিবীয় উপকূলবর্তী সব প্রদেশে সন্ধ্যা ছটা থেকে সান্ধ্য আইন প্রবর্তন করলো। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গোলমাল ঘটে গিয়েছিল, সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্রতিশোধমূলক বেশ কিছু নির্যাতন অত্যাচারও চালিয়েছিল কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনের অবস্থা ওই সময়ে এতই বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত ছিল যে পৃথিবীর অবস্থা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অনবহিত থাকলো। ফলে একদিন উষালগ্নে একটি সামরিক পাহারা দল তাকে আবিষ্কার করলো এক বিচিত্র পরিবেশে। সে তার প্রেমগীতি দ্বারা মৃতের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ করছে। তাকে গুপ্তচর বলে অভিহিত করা হলো, সে বিশেষ একটা সুর বাজিয়ে নিকটবর্তী জলপথে উদারপন্থী দস্যুদের জাহাজে গোপন খবর পাঠাচ্ছে এই অভিযোগ আনা হল তার বিরুদ্ধে। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গুলি করে হত্যা করা হত, কিন্তু অলৌকিক ভাবে সে বেঁচে যায়।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বলেছিল, গুপ্তচর? কী যা তা বলছেন? আমি এক হতভাগ্য প্রেমিক ছাড়া আর কিছু নই।
তাকে স্থানীয় সেনানিবাসে বন্দি করে রাখা হয়। তিন রাত সে ঘুমায় গোড়ালিতে শেকল বাঁধা অবস্থায়। যখন মুক্তি পেল তখন তার বন্দিদশার স্বল্পকালীনতার জন্য তার মনে হল যে সে প্রবঞ্চিত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে, এমনকি তার বৃদ্ধ বয়সেও, যখন আরো অনেক যুদ্ধের ঘটনা তার স্মৃতিতে তালগোল পাকিয়ে ধূসর হয়ে গেছে, তখনও সে মনে করতো যে এই শহরে, সম্ভবত এই দেশে, সেই একটি মাত্র লোক যাকে প্রেমের কারণে পাঁচ পাউন্ড লোহা পায়ে টেনে বেড়াতে হয়।
তাদের উন্মত্ত পত্রালাপ দু’বছর চলার পর ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মাত্র এক অনুচ্ছেদের একটি চিঠিতে ফারমিনা ডাজাকে বিয়ের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। ইতিপূর্বে গত ছয় মাস ধরে সে বিভিন্ন সময়ে তাকে একটা করে সাদা ক্যামেলিয়া ফুল পাঠিয়েছিল কিন্তু পরের চিঠিতেই ফারমিনা ফুলটা ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়। ফলে সে নিঃসন্দেহ হল যে ফারমিনা পত্রালাপ চালিয়ে যেতে চায় কিন্তু বাগদানের মতো গুরুতর বিষয়কে বাদ দিয়ে। আসলে, ফুলের ওই আসা যাওয়ার পালাকে ফারমিনা সর্বদা প্রেমিকের একটা খেলা বলে গ্রহণ করেছিল, এর মধ্যে যে তার নিয়তির একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় বদলের ব্যাপার ছিল সেটা বিবেচনা করার কথা তার কখনো মনেই হয় নি। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রস্তাবটা আসার পর তার এই প্রথমবারের মতো মনে হল সে বুঝি মৃত্যুর নখরাঘাত দ্বারা আহত হল। আতঙ্কিত হয়ে সে এসকোলাস্টিকা পিসিকে জানালো এবং পিসি সাহসিকতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে তাকে পরামর্শ দিলেন, যে সাহসিকতা তার নিজের বিশ বছরের সময়ে ছিল না এবং যখন নিজের নিয়তি সম্পর্কে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
তিনি তাকে বলেন, ওকে হ্যাঁ বলে দাও, তুমি যদি ভয়ে মরেও যাও তবুও, তুমি যদি পরে দুঃখ পাও তবুও, কারণ তুমি যাই করো না কেন, যদি না বলো তাহলে বাকি জীবনভর তোমাকে এর জন্য দুঃখ পেতে হবে।
কিন্তু ফারমিনা ডাজা এমনই বিভ্রান্ত বোধ করে যে সে বিষয়টা সম্পর্কে ভাবার জন্য কিছু সময় চাইলো; তারপর তিন মাস, অবশেষে চার মাস পার হয়ে গেলেও যখন সে কোনো উত্তর দিল না তখন সে আবার একটা ক্যামেলিয়া ফুল পেল, তবে এবার খামের মধ্যে আগের মতো শুধু একটা ফুল নয়, তার সঙ্গে এলো একটা চূড়ান্ত ঘোষণাও, এবারই শেষ, হয় এখনই, নইলে আর কখনো নয়। তখন ওই অপরাহেই এবার ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মৃত্যুর মুখ দর্শন করলো। সে একটা খাম পেল, স্কুলের নোট খাতার পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে ফারমিনা পেন্সিলে এক লাইনের উত্তর লিখেছে। ঠিক আছে, আমি তোমাকে বিয়ে করবো যদি তুমি কথা দাও যে তুমি আমাকে কখনো বেগুন খেতে বাধ্য করবে না।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু তার মা ছিলেন। ছ’মাস আগে সে যখন তার বিয়ের ইচ্ছার কথা মাকে বলে তখনই তিনি তাদের পুরো বাসাটা ভাড়া নেবার জন্য কথাবার্তা শুরু করেছিলেন। তখন পর্যন্ত তিনি আরো দুটি পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে বাসাটা ভাড়া নিয়েছিলেন। দোতলা একটা বাড়ি, সপ্তদশ শতাব্দির, স্প্যানিশ শাসনামলে যখন তামাকের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল তখন এ বাড়িতেই ছিল তাদের দপ্তর। পরে মালিকরা ধ্বংস হয়ে যাবার পর ভবনের বিভিন্ন অংশকে তারা একটু একটু করে ভাড়া দিতে বাধ্য হয়, কারণ তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা তাদের ছিল না। বাড়ির একটা অংশ ছিল রাস্তার দিকে মুখ করা, সেখানে অবস্থিত ছিল তামাকের খুচরা দোকান, পেছন দিকে অন্য একটা অংশে ছিল। একটা পাকা উঠান, ওখানে অবস্থিত ছিল কারখানা আর একটা বৃহাদাকার আস্তাবল, যেখানে বর্তমানে ভাড়াটিয়ারা তাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে শুকাতে দিত। বাড়ির প্রথম অংশই ছিল সব চাইতে সুবিধাজনক এবং সুসংরক্ষিত, যদিও সব চাইতে ছোটও, ট্রান্সিটো আরিজা থাকতেন ওই অংশে, পুরনো তামাকের দোকানেই ছিল তাঁর টুকিটাকি জিনিসপত্রের দোকানঘর। রাস্তার দিকে ছিল একটা মস্ত বড় দরজা, তার এক পাশে ছিল পূর্বতন গুদামঘর, বায়ু চলাচলের জন্য সেখানে ঢালু ছাদের একপাশে ছিল ছোট্ট একচিলতা একটা জানালা। ট্রান্সিটো আরিজা ওখানেই ঘুমাতেন। সমস্ত জায়গার অর্ধেকটা জুড়ে ছিল মালপত্র মজুদ রাখার স্থান, একটা কাঠের পার্টিশান দিয়ে আলাদা করা। সেখানে ছিল একটা টেবিল আর চারটা চেয়ার, যেমন খাওয়া দাওয়ার জন্য সেগুলি ব্যবহৃত হত তেমনি লেখার জন্যও। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা সকাল অবধি লেখায় ব্যস্ত না থাকলে ওখানেই একটা দড়ির দোলনা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়তো। ওদের দুজনের জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল সেখানে, কিন্তু তৃতীয় একজন এলে বেশি ছোট হয়ে যাবে। বিশেষ করে সে যদি প্রেজেন্টেশান অব দি ব্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমিতে পড়া কোনো তরুণী হয়, যার বাবা একটা ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িকে প্রায় নতুনের মতো পুননির্মাণ করেছেন এবং সেই সময় যখন পুরনো অভিজাত সাত খেতাবধারী পরিবারের সদস্যরা প্রতি রাতে ভয়ে ভয়ে বিছানায় যেতেন, কখন না জানি ঘুমের মধ্যে তাদের প্রাসাদের ছাদ হুড়মুড় করে তাদের মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ট্রান্সিটো আরিজা মালিকদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় উপনীত হলেন, ওরা তাকে উঠান সংলগ্ন ভবনটিও ব্যবহার করতে দেবে এবং বিনিময়ে তিনি বাড়িটাকে পাঁচ বছরের জন্য ভালো ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করবেন।
তা করার সামর্থ্য তাঁর ছিল। টুকিটাকি জিনিসের দোকান থেকে আর ব্যান্ডেজের জন্য ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় বিক্রি করে তার যে নগদ অর্থ রোজগার হত তা তাঁর পরিমিত জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট ছিল। এর বাইরে অস্বস্তি আক্রান্ত বেশ কয়েকজন নব্য দরিদ্রকে টাকা ধার দেওয়ার মাধ্যমে তিনি তাঁর সঞ্চয়কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তোলেন। তাঁর সর্তক বিবেচনা বোধের জন্য ওরা চড়া সুদ দিয়েও তার কাছে থেকে টাকা ধার করতেন। মহিলারা, রানীর মতো হাবভাব নিয়ে, তার দোকানের সামনে তাদের গাড়ি থেকে নামতেন, সঙ্গে কোনো চাকর বা দাসী নেই, তাঁরা হল্যান্ডের লেস এবং বিভিন্ন সৌখিন জিনিস কেনার ভান করতেন, আর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার মাঝে মাঝে তাদের হারানো স্বর্গের শেষ ঝলমলে অলঙ্কারগুলি বন্ধক রাখতেন। ট্রান্সিন্টো আরিজা তাদের বংশ গৌরবের প্রতি এতোটাই শ্রদ্ধা দেখিয়ে তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতেন যে তাদের অনেকেই তাঁর কাছ থেকে ওঁরা যে সাহায্য পেয়েছেন তার চাইতেও তিনি ওদের প্রতি যে সম্মান দেখাচ্ছেন তার জন্য বেশি কৃতজ্ঞ হয়ে ওখান থেকে ফিরে যেতেন। দশ বছরের কম সময়ের মধ্যে তিনি ওদের বন্ধক দেয়া, তারপর এক সময় বন্ধক ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, তারপর আবার অশ্রুসিক্ত চোখে বন্ধক দেয়া হীরা মণি মুক্তার অলঙ্কারগুলি এতোবার দেখেন যে সেগুলি তার চেনা হয়ে যায়, যেন ওই অলঙ্কারগুলি তার নিজেরই। ছেলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেবার পর তিনি তার যাবতীয় লাভ সোনায় রূপান্তরিত করে একটা মাটির ভাণ্ডে ঢুকিয়ে তাঁর খাটের নিচে রেখে দেন। তারপর তিনি তার হিসেবের খাতা নিয়ে বসেন। তখন ট্রান্সিটো আরিজা দেখলেন যে তিনি যে শুধু ভাড়া করা বাড়িটা পাঁচ বছর রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবেন তাই নয়, একটু বুদ্ধির সঙ্গে চললে, ভাগ্য একটু সাহায্য করলে, তিনি হয়তো মৃত্যুর আগেই তার প্রত্যাশিত এক ডজন নাতি-নাতনির জন্য সেটা কিনেও ফেলতে পারবেন। অন্য দিকে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা টেলিগ্রাম আপিসে প্রথম সহকারীর অস্থায়ী পদ লাভ করেছে। লোটারিও থুগুটের আশা আগামী বছর তিনি স্কুল অব টেলিগ্রাফি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে এখান থেকে চলে গেলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাই হবে এই আপিসের প্রধান।
বিয়ের ব্যবহারিক দিক নিয়ে তাই কোনো সমস্যা থাকলো না। তবু, ট্রান্সিটো আরিজা দুটো জিনিস পরিষ্কার করে নেয়া বিচক্ষণতার কাজ বলে মনে করলেন। প্রথমটি হল লোরেঞ্জো ভাজা সত্যি সত্যি কে সেটা জানতে হবে। তাঁর বাচনভঙ্গি ও উচ্চারণের ঝোঁক থেকে তিনি কোথা থেকে এসেছেন তা নিঃসন্দেহে বোঝা যায়, কিন্তু তার প্রকৃত পরিচয় এবং তার জীবিকা অর্জনের উপায় সম্পর্কে কেউ সঠিকভাবে কিছু জানে না। এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওদের বাগদানপর্ব দীর্ঘ দিনের হতে হবে, পাত্র পাত্রী যেন ব্যক্তি হিসেবে পরস্পরকে ভালো ভাবে চিনতে পারে এবং তাদের ভালবাসা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার আগ পর্যন্ত তারা যেন বিশেষ সংযম বজায় রাখে। তিনি যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওদেরকে অপেক্ষা করতে বললেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বিষয়টি গোপন রাখতে রাজি হল, শুধু মা যেসব যুক্তি দেখান তার জন্য নয়, তার নিজের তপস্বীসুলভ নির্জনতাপিপাসু মনের জন্যও বটে। ও দেরি করার ব্যাপারেও রাজি হল, তবে শর্তগুলি তাঁর কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়, কারণ অর্ধশতাব্দির বেশি স্বাধীনতার কালে এই দেশে একদিনের জন্যও নাগরিক শান্তি বিরাজ করে নি। ফ্লোরেন্টিনো বললো, অপেক্ষা করতে করতে আমরা বুড়ো হয়ে যাবো।
তার ধর্মপিতা, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, ঘটনাক্রমে এই আলোচনার সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহকে কোনো প্রতিবন্ধকতা বিবেচনা করলেন না। তার মতে এ সব হল জমির মালিকদের ষাঁড়ের মতো তাড়িয়ে নেয়া গরিবদের সংগ্রাম, সরকার যেমন নগ্ন পদ সৈনিকদের তাড়িয়ে নিয়ে যায় ঠিক সেই রকম। আসল যুদ্ধ, তিনি বললেন, হচ্ছে পাহাড় অঞ্চলে। শহরে আমরা কখনো যুদ্ধের গুলিতে নিহত হই নি, শহর অঞ্চলে আমাদের হত্যা করা হয়েছে শাসক ও কর্তৃপক্ষের আদেশে।
যাই হোক, ওদের পরবর্তী কয়েকটি চিঠিপত্রের মাধ্যমে বাগদানের বিশেষ ব্যাপারগুলি স্থির হয়ে গেল।
এসকোলাস্টিকা পিসির পরামর্শ অনুযায়ী ফারমিনা ডাজা দুটি শর্তই মেনে নিল, বাগদানপর্ব স্থায়ী হবে দু’বছর এবং বিষয়টা ততদিন সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। ও আরো জানালো যে ওর মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ হবার পর, বড় দিনের ছুটির শেষে, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার পাণি প্রার্থনা করলে ভালো হয়। বাগদান পর্বের আনুষ্ঠানিকতা কিভাবে সম্পাদিত হবে তা সময় হলে ওরা ঠিক করবে, ফারমিনার বাবা এটা কতখানি অনুমোদন করেন তার ওপর তা বহুলাংশে নির্ভর করবে। ইত্যবসরে, তারা পরস্পরকে আগের মতোই ঘনঘন আবেগময় চিঠি লিখতে থাকে, তবে মনের পূর্বতন বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে মুক্ত হবার ফলে তাদের চিঠিপত্রের মধ্যে একটা গার্হস্থ্যের সুর লাগে, যা ছিল অনেকটা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে মতো। কোনো কিছুই তাদের স্বপ্নকে বিঘ্নিত করলো না।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জীবন বদলে যায়। ভালবাসার প্রতিদান তাকে এমন একটা আত্মবিশ্বাস ও শক্তি দিয়েছিল যা সে ইতোপূর্বে কখনো অনুভব করে নি। নিজের কর্মক্ষেত্রে সে এতোই স্বনির্ভরতার পরিচয় দেয় যে লোটারিও থুগুট বিনা দ্বিধায় তার স্থায়ী সহকারী পদের জন্য ওর নাম করেন। ততদিনে তার স্কুল অব টেলিগ্রাফি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজমের পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। এখন তাঁর অবসর সময় যে একমাত্র কাজ তিনি যথার্থ উপভোগ করতেন সেই কাজে ব্যয় করতে লাগলেন : বন্দরে গিয়ে নাবিকদের সঙ্গে অ্যাকর্ডিয়ান বাজানো এবং বিয়ার পান করা এবং সব শেষে সাময়িক হোটেলটিতে গিয়ে কোনো রাত-পাখির সঙ্গে নিশি যাপন করা। ওই প্রমোদস্থলে লোটারিও থুগুটের প্রভাবের কারণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অনেক দিন পরে আবিষ্কার করে। লোটারিও থুগুট এক সময় ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক এবং রাতের পাখিদের অধিকারী উভয়ই হন। তাঁর বহু বছরের সঞ্চয় দিয়ে একটু একটু করে তিনি এটা কিনে নেন, তবে তার হয়ে সব কিছু পরিচালনা করতেন একজন শীর্ণকায়, কানা, ছোটখাটো মানুষ, পালিশ করা মাথা, আর এতো সদয় প্রকৃতির যে কেমন করে তিনি একজন ভালো ম্যানেজার হলেন তা বোঝা কঠিন। কিন্তু তিনি যথার্থই তাই ছিলেন। অন্তত ফ্লোরেন্টিনো আরিজার তাই মনে হয় যখন তার কোনো অনুরোধ ছাড়াই তিনি তাকে জানালেন যে এই হোটেলের একটি কক্ষ তার জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্ধ থাকবে, সেখানে যখন তার ইচ্ছা হবে সে তার উদরের নিম্নাংশের চাহিদা মেটাতে পারবে। তা ছাড়াও তার পড়াশোনা ও প্রেমপত্র লেখার জন্য সে একটা শান্ত জায়গা পাবে। আর বাগদানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পূর্ণ হবার জন্য যখন দীর্ঘ মাসগুলি কেটে যেতে থাকে তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার আপিসের চাইতে তার হোটেল কক্ষেই বেশি সময় কাটাতে শুরু করে এবং মাঝে মাঝে সে যখন পোশাক পাল্টাবার জন্য বাড়িতে আসতো শুধু তখনই তার মা তার দেখা পেতেন।
বই পড়া তার একটা চির অতৃপ্ত ব্যাধিতে পরিণত হল। তাকে পড়তে শেখাবার পর থেকেই মা তাকে স্ক্যান্ডিনেভীয় লেখকদের সচিত্র বইপত্র কিনে দিতেন। ছোটদের কাহিনী হিসেবে বিক্রি হলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলি ছিল যে কোনো বয়সের মানুষের জন্য নির্মম ও ন্যায়ভ্রষ্ট উপাখ্যানমালা। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার পাঁচ বছর বয়সেই ক্লাসে এবং স্কুলের বৈকালিক সাহিত্যানুষ্ঠানে ওই সব কাহিনী স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতো কিন্তু এর ফলেও ওই সব কাহিনী তার মনে যে আতঙ্ক জাগিয়ে তুলতে তা প্রশমিত হত না। পক্ষান্তরে তা আরো বৃদ্ধি পেত। এর ফলে সে যখন কবিতা পড়তে শুরু করলো তখন দুটোর তুলনা করে তার মনে হল সে যেন এখন একটা মরুদ্যানে প্রবেশ করছে। তার কৈশোরেও সে পপুলার লাইব্রেরির সব বই গিলে খেয়েছে। ট্রান্সিটো আরিজা আর্কেড অব স্ক্রাইবসের বইয়ের দোকানদারদের কাছ থেকে সুবিধাজনক দামে বই কিনে আনতেন। তার মধ্যে হোমার থেকে শুরু করে নিম্নতম মানের স্থানীয় কবিদের কাব্যগ্রন্থও থাকতো, আর ফ্লোরেন্টিনো যা সামনে পেত তাই পড়তো, যেন তাই ছিল নিয়তি নির্ধারিত এবং এতো বছর এতো বই পড়ার পরও কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ তা বিচার করার ক্ষমতা সে অর্জন করতে পারে নি। তবে একটা জিনিস সে পরিষ্কার বুঝলো; গদ্যের চাইতে কবিতা তার বেশি পছন্দ এবং কবিতার ক্ষেত্রেও তার বেশি পছন্দ প্রেমের কবিতা, আর ওই সব কবিতা দ্বিতীয় পাঠের পরই, ইচ্ছা না থাকলেও তার মুখস্থ হয়ে যেত, আর যে সব কবিতার ছন্দ ও মিলবিন্যাস যতো ভালো, তার আবেদন যত মর্মভেদী, সেসব কবিতাই সে বেশি সহজে শিখে ফেলতো।
ফারমিনা ডাজাকে লেখা তার প্রথম দিকের চিঠিগুলির আসল উৎস ছিল ওই সব কবিতা। স্প্যানিশ রোমান্টিক কবিদের কাঁচা অপরিণত প্রেম সম্ভাষণগুলি সে ওখান থেকেই তার চিঠির জন্য চয়ন করে। তার চিঠি ওই ধারাতেই চলতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না বাস্তব জীবন হৃদয়বেদনার চাইতে অধিকতর পার্থিব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিদানে তাকে বাধ্য করে। ওই সময়ে সে সমকালের অশ্রুসিক্ত ধারাবাহিক উপন্যাসগুলিও পড়তে আরম্ভ করে, আরো নিকৃষ্ট মানের লৌকিক কাহিনীও পড়তে থাকে। দুই সেন্টাভো মূল্যে স্থানীয় কবিদের কাব্য পুস্তিকা শহরের খোলা চত্বরে ও দোকানপাটের পাশের ঘেরা জায়গায় বিক্রি হত। সেই সব কবিতা মায়ের সাথে একসঙ্গে পড়ে সে চোখের জল ফেলতে শেখে। কিন্তু একই সঙ্গে সে স্বর্ণ যুগের অপরূপ সুন্দর ক্যাস্টিলীয় কাব্যও স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করতে পারতো। সাধারণ ভাবে, তার হাতের কাছে যা পড়তে এবং যে ক্রম অনুসারে পড়তো, তার সবই সে পাঠ করতো। তাই প্রেমে পড়ার কঠিন দিনগুলির বহু পরে, যখন সে আর তরুণ নয়, তখনো সে প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়ে ফেলে ইয়ং পিপলস ট্রেজারির পুরো বিশ খণ্ড, গার্নিয়ার ব্রাদার্সের ক্লাসিকস ইন ট্রান্সলেশনের সম্পূর্ণ ক্যাটালগ এবং প্রোমেটিও সংগ্রহে প্রকাশিত ডন ভিসেন্ট ব্লাস্কো ইবানেজের সব চাইতে সহজ রচনাগুলি।
যাই হোক, অস্থায়ী হোটেলে তার যৌবনকালের রোমাঞ্চকর কর্মকাণ্ড শুধু বই পড়া আর আবেগদীপ্ত চিঠি লেখায় সীমাবদ্ধ থাকে নি, ওই সময়ে প্রেমহীন প্রেমের গোপন বিষয়াবলীতেও সে দীক্ষিত হয়ে ওঠে। ওই ভবনে জীবন শুরু হতো দুপুরের পরে, তখন তার বন্ধু পাখিরা শয্যা ছেড়ে উঠতো, জন্মগ্রহণ করার সময় যে রকম নিরাভরণ ছিল ঠিক সেই ভাবে, ফলে কাজের শেষে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যখন ওখানে এসে উপস্থিত হত তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করতো এক দঙ্গল নগ্ন পরী অধ্যুষিত এক প্রাসাদে। তাদের সঙ্গে যাতায়াত করা মুখ্য চরিত্রগুলির বিশ্বাসভঙ্গের কারণে তারা শহরের যাবতীয় গোপন খবর জেনে ফেলতো, ওই খবরগুলি তারা তখন, তাদের ভাষ্যসহ, একে অন্যকে চিৎকার করে বলতো। তাদের নগ্নতায় তারা তাদের অতীতের কিছু কিছু নিদর্শন তুলে ধরতো : পেটের উপর ছুরির কাটা দাগ, পিস্তল-বন্দুকের গুলির ক্ষত চিহ্ন, প্রেমের ক্ষুরের আঘাত, কসাইর হাতে সেলাই করা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের নমুনা। দিনের বেলায় তাদের কারো কারো সঙ্গে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও থাকতো, যৌবনের স্পর্ধা অথবা অসাবধানতার ফসল তারা, ওদের এখানে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মায়েরা তাদের কাপড় জামা খুলে ফেলতো, এই নগ্নতার স্বর্গে ওরা যেন নিজেদের ভিন্নরকম মনে না করে সে জন্য। সবাই নিজের নিজের রান্না করতো, আর ওরা যখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে নিমন্ত্রণ করতো তখন তার চাইতে ভালো আর কেউ খেত না, কারণ প্রত্যেকের কাছ থেকে সে তার সব চাইতে ভালো জিনিসটা তুলে নিত। প্রতিদিনের এই উৎসব সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতো। সন্ধ্যা হলেই নগ্ন মেয়েগুলি গান গাইতে গাইতে, কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে, বাথরুমের দিকে এগিয়ে যেত, একে অন্যের কাছ থেকে সাবান, টুথব্রাশ, কাচি ধার নিত, পরস্পরের চুল কেটে দিত, ধার করা পোশাক পরতো, বিষণ্ণ ভাড়ের মতো মুখে রঙ মাখতো, তারপর রাতের প্রথম শিকার ধরবার জন্য রাস্তায় বেরুতো। তখন ওই বাড়ি হয়ে উঠতো নৈর্ব্যক্তিক ও মানবতাবর্জিত, তখন পয়সা না দিয়ে কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করা ছিল অসম্ভব।
ফারমিনা ডাজার সঙ্গে পরিচয় হবার পর থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা আর কোনো জায়গায় এতো স্বস্তি বোধ করতো না, কারণ এই একটি জায়গাতেই তার মনে হত সে বুঝি ওর সঙ্গেই আছে। সম্ভবত ওই একই কারণে সুন্দর রুপালি চুলের এক রুচিশীল বয়স্ক মহিলাও এখানে থাকতেন। তিনি নগ্ন মেয়েদের বন্ধনমুক্ত জীবনে অংশ নিতেন না, ওই মেয়েরাও তাঁর প্রতি এক ধরনের ধর্মীয় ভাব নিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতো। জনৈক অপরিণত প্রেমিক তাঁর অল্প বয়সে তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছিল, তাকে কিছুকাল উপভোগ করে, তারপর তাকে এখানে ফেলে রেখে উধাও হয়ে যায়। তার গায়ে কলঙ্কের দাগ সত্ত্বেও তিনি বেশ ভালো একটা বিয়ে করতে সক্ষম হন। যখন তিনি বেশ বৃদ্ধ হয়ে পড়েন এবং নিঃসঙ্গ, তখন তার দুই ছেলে আর তিন মেয়ের মধ্যে একটা তর্কের জন্ম হয়, কে মাকে তাদের সঙ্গে থাকার জন্য নিয়ে যাবে। কিন্তু তিনি তার যৌবনের ভোগ-লালসার স্মৃতি বিজড়িত এই হোটলের চাইতে ভালো কোনো বাসস্থানের কথা চিন্তা করতে পারলেন না। এখানকার স্থায়ী কক্ষটিই ছিল তার বাড়ি এবং এই ব্যাপারটা তাঁর সঙ্গে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার তাৎক্ষণিক মানসিক যোগাযোগ ঘটিয়ে দেয়। তিনি তাকে বলেন যে ফ্লোরেন্টিনো সমগ্র পৃথিবীতে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলে পরিচিত হবে, কারণ এ রকম একটা কামোত্তেজক স্থানে বাস করেও সে গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে তাঁর আত্মাকে সমৃদ্ধ করেছে। আর তার দিক থেকে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা মহিলার প্রতি এতটাই মায়া-মমতাবোধ করে যে সে তাঁকে তাঁর বাজার-সওদা করতে সাহায্য করতে শুরু করে আর প্রতি অপরাহু কাটাতে থাকে তার সঙ্গে আলাপচারিতায়। তার কাছে নিজের কোনো গোপন কথা না বলা সত্ত্বেও তিনি তাকে তার প্রেম ঘটিত ব্যাপারে অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন কিছু কথা বলেন। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ভালবাসার অঙ্গনে তাকে একজন প্রাজ্ঞ মহিলা বলে মনে করতো।
ফারমিনা ডাজার ভালবাসা লাভের আগেই যদি সে এতো সুলভ প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ না করে থাকতে পারে, তাহলে নিশ্চয়ই এখন, ফারমিনা তার আনুষ্ঠানিক বাগদত্তা হবার পর, তার আর ওই সব প্রলোভনের শিকার হবার প্রশ্নই ওঠে না। অতএব, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই মেয়েদের সঙ্গে বাস করতে থাকে, তাদের সুখ-দুঃখে সে অংশ নেয়, কিন্তু ওই পর্যন্তই, এর চাইতে বেশি অগ্রসর হবার কথা তার কখনো মনে হয় নি, ওই মেয়েদেরও না। একটি আগাম না জানা ঘটনায় তার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা পরিষ্কার ভাবে ফুটে ওঠে। এক বিকালে ছটার দিকে মেয়েরা যখন তাদের রাত্তিরের খদ্দেরদের অভ্যর্থনা করার জন্য সাজগোজ করছে তখন হোটেলে তার তলার ঘরগুলি যে মেয়েটি পরিষ্কার করতো সে তার ঘরে এসে ঢোকে। সে ছিল অল্প বয়সী কিন্তু চোখ মুখ বসে যাওয়া, সময়ের আগেই বুড়িয়ে গেছে, তাকে দেখে মনে হল একটা অপূর্ব নগ্নতা দ্বারা আবৃত সম্পূর্ণ ধরা চূড়া পরা কোনো অনুতাপকারী। সে ওকে প্রতিদিন দেখে, ও যে তাকে লক্ষ করছে তা সে কখনো বোঝে নি। সে তার ঝাটা, একটা ময়লার বালতি, মেঝে থেকে ব্যবহৃত কনডম তুলে রাখার জন্য একটা বিশেষ থলে নিয়ে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। মেয়েটি তার ঘরে ঢুকে, সযত্নে, তার পড়ায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে সেদিকে নজর রেখে তার ঘর পরিষ্কার করতে লাগলো। তারপর ও তার বিছানার খুব কাছ দিয়ে যাবার সময় সে তার পেটের উপর, নিচের দিকে, একটা উষ্ণ কোমল হাতের স্পর্শ পেল, সে অনুভব করলো যে হাতটা তার প্যান্টের বোতাম খুলছে আর ওর নিবিড় নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে তখন সারা ঘর পূর্ণ। সে তার বই পড়তে থাকার ভান করলো কিন্তু যখন আর সহ্য করা সম্ভব হলো না তখন সে তার শরীর ওর হাতের আওতার বাইরে সরিয়ে নিল।
মেয়েটি নিরাশ হল। ওকে যখন এখানে চাকরি দেয়া হয় তখনই ওকে সাবধান করে দেয়া হয়েছিল যে সে কখনো খদ্দেরদের শয্যাসঙ্গিনী হবার চেষ্টা করবে না। ওকে এটা তাদের বলে দিতে হয় নি, কারণ ও ছিল সেই সব মেয়েদের একজন যে বেশ্যাবৃত্তি বলতে পয়সার বিনিময়ে অপরের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াকে বোঝাতো না, একজন অচেনা মানুষের সঙ্গে শোয়াকেই তার বেশ্যাবৃত্তি বলে মনে হত। ওর দুটি সন্তান ছিল, দুই ভিন্ন ব্যক্তির ঔরসে তাদের জন্ম, সাময়িক ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য এটা হয় নি, এর কারণ ছিল এই যে তিনবারের পর কেউ তার কাছে ফিরে এলে তাকে ভালবাসতে সে ছিল অপারগ। এর আগ পর্যন্ত ও তার জীবনে কোনো জরুরি তাগিদ অনুভব করে নি, কোনো রকম হতাশা অনুভব ছাড়া শুধু অপেক্ষা করে যাবার মতো একটা স্বভাব তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল কিন্তু ওই বাড়ির জীবনের আকর্ষণ তার সদগুণের চাইতে বেশি প্রবল হয়ে ওঠে। ও কাজে আসতো বিকাল ছটায়, সারা রাত কাজ করতো একটার পর আরেকটা ঘরে, ঘর ঝাড় দিত, মেঝে থেকে কনডম তুলতো, বিছানার চাদর বদলাতো। প্রেমমিলনের পর পুরুষরা যে কতো রকম জিনিস ফেলে যেত তা ধারণা করাও কষ্টকর। তারা রেখে যেত বমি আর চোখের জল, এটা ওর বোধগম্য ছিল, কিন্তু তারা ঘনিষ্ঠতার আরো নানা রকম রহস্যময় বস্তু ফেলে রেখে যেত, রক্তের ডোবা, পায়খানার দাগ, কাঁচের চোখ, সোনার ঘড়ি, নকল দাঁত, কোকড়া সোনালি চুল ভর্তি লকেট, প্রেমপত্র, ব্যবসা সংক্রান্ত চিঠি, সমবেদনা জ্ঞাপন করা চিঠি, নানা ধরনের চিঠি। কেউ কেউ তাদের হারানো জিনিসের জন্য ফিরে আসতো, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জিনিসগুলির কোনো দাবিদার খুঁজে পাওয়া যেত না। আর লোটারিও থুগুট ওই সব জিনিস তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করে রেখে দিতেন। তাঁর আশা, এই ভবন যা এক সময় সুদিন দেখেছে তা ওই সব হাজারো বিস্মৃত জিনিস নিয়ে একদা প্রেমের জাদুঘরে পরিণত হবে।
মেয়েটির কাজ ছিল শক্ত, বেতন ছিল অল্প, কিন্তু সে তার কাজ করতে সুচারু রূপে। যা সে সহ্য করতে পারতো না তা হল ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা ও বিলাপের ধ্বনি, ম্প্রিঙ্গের ঐকানি প্রভৃতি। এই সব তার মনে এমনই উত্তেজনা ও দুঃখ জাগিয়ে তুলতো যে সকাল নাগাদ তার মনে একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছা জেগে উঠতো, রাস্তায় প্রথম যে ভিক্ষুক বা হতভাগা মাতালকে সে দেখবে তারই শয্যাসঙ্গিনী হবে সে, কোনো রকম ভান-ভনিতা না করে এবং কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সে যা চায় তাই তাকে দেবে। এই পরিস্থিতিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মতো একটি লোকের উপস্থিতি, তরুণ, পরিচ্ছন্ন, রমণীবিহীন, তার জন্য যেন ঈশ্বরের এক উপহার হিসেবে দেখা দিল। প্রথম মুহূর্তেই সে বুঝেছিল যে এই মানুষটা অবিকল তার মতো, ভালবাসা যার ভীষণ দরকার। কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ওই মেয়ের তীব্র কামনা সম্পর্কে ছিল অসচেতন।
সে ফারমিনা ডাজার জন্য তার কৌমার্য অক্ষুণ্ণ রেখেছে, এ পৃথিবীর কোনো শক্তি বা যুক্তিতর্ক নেই যা তাকে ওই সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে।
বাগদান অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার স্থিরিকৃত তারিখের চার মাস আগে এই ছিল ফ্লোরেন্টিনো আরিজার জীবন। এই সময়ে একদিন সকাল সাতটায় লোরেঞ্জো ভাজা টেলিগ্রাফ আপিসে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি ফ্লোরেন্টিনো আরিজার খোঁজ করে জানতে পারলেন যে সে তখনো কাজে আসে নি। লোরেঞ্জো ডাজা বেঞ্চিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন, বড় উপল পাথর বসানো তার ভারি সোনার আংটিটা এক আঙুল থেকে খুলে অন্য আঙুলে পরতে থাকলেন। আটাটা দশ মিনিটে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ঘরে ঢুকতেই তিনি তাকে চিনতে পারলেন, এই সেই টেলিগ্রাম আপিসের লোক যে সেদিন তাকে টেলিগ্রাম বিলি করে এসেছিল। লোরেঞ্জো ভাজা তার বাহু জড়িয়ে ধরে বললেন, চলো বাপু, তোমার সঙ্গে আমি পাঁচ মিনিট কথা বলবো, একজন পুরুষ মানুষ আরেকজন পুরুষ মানুষের সঙ্গে, সমানে সমানে।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মুখ মড়ার মতো সাদা হয়ে গিয়েছিল। সে অভিভূতের মতো তার সঙ্গে চললো। এই সাক্ষাতের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। ফারমিনা ডাজা তাকে সতর্ক করে দেবার কোনো সুযোগ বা উপায় খুঁজে পায় নি। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই : এর আগের শনিবার প্রেজেন্টেশান অব ব্লেসেড ভার্জিন অ্যাকাডেমির প্রধান, সিস্টার ফ্রাঙ্কা ডি লা লুজ, একটা সাপের চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে পৃথিবীর উৎপত্তি বিষয়ক ধারণাবলীর ক্লাসে এসে ঢোকেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছাত্রীদের পর্যবেক্ষণ করার সময় অনেকগুলো মেয়ের কাঁধের উপর দিয়ে তিনি লক্ষ করে যে ফারমিনা ডাজা তার খাতায় নোট নেবার ভান করলেও সে আসলে একটা প্রেমপত্র লিখছিল। অ্যাকাডেমির বিধি বিধান অনুযায়ী এ রকম একটি অপরাধের শাস্তি ছিল বহিষ্কার। লোরেঞ্জো ডাজা জরুরি। এক আহ্বান পেয়ে রেক্টরের বাসভবনে গিয়ে হাজির হন, আর সেখানেই তিনি তাঁর লৌহ শাসন ব্যবস্থা যে ফাঁক দিয়ে গলে গলে পড়ছিল সেটা আবিষ্কার করেন। ফারমিনা ডাজা তার স্বভাবজ স্থৈর্যের সঙ্গে চিঠি লেখার অপরাধ স্বীকার করে কিন্তু তার গোপন প্রেমিকের পরিচয় জানাতে অস্বীকার করে। প্রতিষ্ঠানের বিচার সভাতেও সে যখন একই অবস্থান নেয় তখন তার বহিষ্কারাদেশ বহাল রাখা হল। তার বাবা বাড়িতে এসে ফারমিনা ডাজার ঘরে তল্লাশি চালান, এ পর্যন্ত যে ঘর একটি পুণ্যস্থান বলে বিবেচিত হয়ে এসেছিল। তল্লাশির ফলে তিনি ওর ট্রাঙ্কের নিচে কৃত্রিম গুপ্ত তাকের উপর তিন বছর ধরে লেখা চিঠির প্যাকেটগুলি আবিষ্কার করেন, যতখানি ভালবাসা দ্বারা চিঠিগুলি অনুপ্রাণিত হয়েছিল ততখানি ভালবাসার সঙ্গেই সেগুলি ওই জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়। চিঠির সইয়ের মধ্যে সন্দেহ করার মতো কিছু ছিল না, কিন্তু লোরেঞ্জো ভাজা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তখন পারেন নি, কখনোই পারেন নি যে তার মেয়ে নিজের গোপন প্রেমিক সম্পর্কে সে যে একজন টেলিগ্রাফ যন্ত্রপরিচালক এবং বেহালা বাজাতে ভালবাসে এর বেশি কিছুই জানতো না।
তার বোনের অজান্তে যে এই ধরনের একটা জটিল সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না এ বিষয়ে লোরেঞ্জো ডাজার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। তিনি তাকে কোনো অজুহাত দেবার কিংবা পুনর্বিচারের কোনো সুযোগ দিলেন না। তিনি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে জাহাজে তুলে সান হুয়ান ডি লা সিনেগা পাঠিয়ে দিলেন। যেদিন ফারমিনা বাড়ির দোরগোড়ায় তার পিসিকে বিদায় জানায় তার সেই যন্ত্রণাদগ্ধ স্মৃতির হাত থেকে সে কখনো মুক্তি পায় নি। বাদামি পোশাকের নিচে পিসির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল, অস্থিসর্বস্ব দেহ, রঙ ছাইয়ের মতো, ঝিরঝির বৃষ্টির মধ্যে তিনি পার্কের ভেতর দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, নিজের বলতে তার জীবনে যা ছিল সব তার হাতে নিয়ে, শোবার জন্য একটা মাদুর আর রুমালে বাঁধা এক মাস চলার মতো কিছু টাকা, রুমালটা হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরা। বাবার কর্তৃত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে ফারমিনা ক্যারিবীয় অঞ্চলের সবগুলি প্রদেশে তার পিসির খোঁজ নিতে আরম্ভ করে, সম্ভাব্য সকল মানুষের কাছ থেকে সে তার খবর জানার চেষ্টা করে কিন্তু ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হবার আগে পর্যন্ত সে তার কোনো হদিসই পায় নি। ত্রিশ বছর পর বহু হাত ঘুরে বহু সময় নিয়ে তার কাছে একটা চিঠি এসে পৌঁছায়, সে চিঠি থেকে ফারমিনা জানতে পারে যে অনেক দিন আগেই তিনি একটা কুষ্ঠ আশ্রমে মৃত্যুবরণ করেন। তার পিসি এসকোলাস্টিাকাকে অন্যায় শাস্তি দেয়ার জন্য ফারমিনার যে ওই রকম অসম্ভব তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে তা লোরেঞ্জো অনুমান করতে পারেন নি। ফারমিনা পিসিকে সর্বদা মায়ের মতো দেখেছে, মাকে সে প্রায় মনেই করতে পারতো না। সেই পিসিকে অন্যায় ভাবে শাস্তি দিতে দেখে সে নিজের ঘরে গিয়ে দরজায় তালা বন্ধ করে দেয়, কোনো খাদ্য বা পানীয় গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়, অবশেষে প্রথমে ভীতি প্রদর্শন ও পরে ছদ্ম অনুনয়-অনুরোধ উপরোধের পর সে যখন তার ঘরের দরজা খুললো তখন তার বাবা আবিষ্কার করলেন এক আহত বাঘিনীকে, যে আর কখনো তার পনেরো বছরে ফিরে যাবে না।
সব চাটুকারিতার সাহায্যে তিনি কন্যার হৃদয় গলাবার চেষ্টা করলেন। তিনি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে তার ওই বয়সের ভালবাসা একটা মরীচিকা মাত্র, তিনি যুক্তি দিয়ে তাকে বোঝাতে চাইলেন যে ওই চিঠিগুলি তার ফেরত দেয়া উচিত, অ্যাকাডেমিতে প্রত্যাবর্তন করে হাঁটু গেড়ে তার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত, তিনি কথা দিচ্ছেন যে সে সুখী হবে ওই রকম একটি উপযুক্ত পাত্র পাবার জন্য তিনিই সকলের আগে সাহায্য করবেন। কিন্তু এই সব কথা তিনি যেন এক মৃত ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বললেন। অবশেষে, হেরে গিয়ে, সোমবার দুপুরে খাবার টেবিলে তিনি মেজাজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন, অপমানকর ও ধর্মমত সম্পর্কে অবজ্ঞাপূর্ণ মন্তব্য করা থেকে নিজেকে কোনো রকমে বিরত করে তিনি যখন বারুদের মতো ফেটে পড়তে যাচ্ছিলেন তখন তিনি মেয়েকে মাংস কাটার ছুরিটা নিজের গলার কাছে তুলে ধরতে দেখলেন, কোনো রকম নাটকীয়তা ছাড়া, হাত অকম্পিত, আর চোখের দৃষ্টি এতো গীতিময় যে তিনি আর কিছু বলতে সাহস পেলেন না। ওই সময়েই তিনি একটা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন, যে অভিশপ্ত মানুষটাকে তিনি কখনো দেখেছেন বলে মনে। করতে পারছেন না, যে তার জীবনে একটা প্রচণ্ড দুঃখের মতো অকস্মাৎ উদিত হয়েছে, তার সঙ্গে তিনি পাঁচ মিনিটের জন্য মুখোমুখি কথা বলবেন, সমানে সমানে। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় অভ্যাসের বসে তিনি তার পিস্তলটা সঙ্গে নেন, তবে সতর্কতার সঙ্গে শার্টের নিচে সেটা লুকিয়ে রাখতে ভুললেন না।
লোরেঞ্জো ডাজা যখন তার হাত ধরে ক্যাথিড্রালের খোলা চত্বর পেরিয়ে প্যারিস ক্যাফের খিলান দেয়া গ্যালারিতে নিয়ে গিয়ে তাকে বারান্দায় আসন গ্রহণ করতে আমন্ত্রণ জানালেন তখনো সে তার হতবিহ্বল ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। ওই সময়ে ক্যাফেতে আর কোনো খদ্দের ছিল না। ক্যাফের বিশাল সালোর রঙিন কাঁচের জানালাগুলি ধূলিধূসরিত, কিছু কিছু কাঁচের অংশ ভেঙ্গে গেছে, এক কৃষ্ণাঙ্গ রমণী মোমের টালিগুলি ঘষে পরিষ্কার করছে, চেয়ারগুলি মার্বেলের টেবিলের উপর উল্টো করে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অনেক দিন লোরেঞ্জো ডাজাকে ওখানে সর্বজনীন বাজারের কিছু লোকজনের সঙ্গে জুয়া খেলতে ও সুরা পান করতে দেখেছে। তারা অন্যত্র সংঘটিত দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে চিৎকার ও তর্কবিতর্ক করতো, আমাদের নিজেদের যুদ্ধবিগ্রহের সঙ্গে তার কোনোই সম্পর্ক ছিল না। প্রেমের মারাত্মক বিপর্যয় সম্পর্কে সচেতন, ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, প্রায়ই ভেবেছে লোরেঞ্জো ডাজার সঙ্গে, শিগগিরই কিংবা দেরিতে, তার অনিবার্য সাক্ষাৎ কেমন হবে, যে সাক্ষাৎ আগাম প্রতিহত করার শক্তি কোনো মানুষেরই নেই, কারণ তাদের উভয়ের নিয়তির খাতায় তা লেখা হয়ে গেছে। সে ভেবেছিল যে ওটা হবে এক অসম বিরোধ, ফারমিনা ডাজা তার চিঠিগুলিতে বাবার ক্রুদ্ধ প্রকৃতি সম্পর্কে তাকে সাবধান করে দিয়েছিল বলেই নয়, সে নিজেও লক্ষ করেছে যে তিনি জুয়ার টেবিলে যখন হাসেন তখনও তার চোখ দুটি দেখায় অত্যন্ত রাগীরাগী। তাঁর সব কিছুই একটা অমার্জিত স্থূলতার সাক্ষ্য দিত: তার কদর্য পেট, তার কর্কশ জোরালো কথাবার্তা, তার বন-বেড়ালের মতো গোফ, তাঁর অমসৃণ হাত, উপল পাথর বসানো আংটির চাপে তাঁর আঙুল। তাঁর একমাত্র প্রীতিপ্রদ জিনিস ছিল তাঁর হাঁটার ভঙ্গি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাকে প্রথমবারের মতো হাঁটতে দেখার সময়ই সেটা লক্ষ করেছিল। তাঁর পদচারণা ছিল তাঁর কন্যার মতোই, হরিণীর পদচারণা। কিন্তু এখন তিনি যখন চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বললেন তখন লোরেঞ্জো ডাজাকে যেমন কর্কশ দেখাচ্ছিল তেমন কর্কশ বলে তার মনে হলো না, তারপর যখন তাকে এক গ্লাস আনিস্যে সুরা পানের আমন্ত্রণ জানালেন তখন সে তার সাহস অনেকখানি ফিরে পেল। এই মুহূর্তে তার ওই সাহসের প্রয়োজন ছিল বেশ জরুরি।
লোরেঞ্জো ডাজা তার কথা শেষ করতে যথার্থই পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেন নি, তা ছাড়া তিনি এমন একটা মনজয়করা আন্তরিকতার সঙ্গে তার কথাগুলি বলেন যা ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে বিমূঢ় করে ফেলে। তিনি জানালেন যে স্ত্রীর মৃত্যুর সময় তিনি নিজের জীবনের জন্য একটি মাত্র লক্ষ্য স্থির করেছিলেন : তাঁর কন্যাকে তিনি এক অভিজাত সম্ভ্রান্ত নারীতে রূপান্তরিত করবেন। পথটা ছিল দীর্ঘ ও অনিশ্চিত। তিনি ছিলেন খচ্চরের এক নগণ্য ব্যবসায়ী, লিখতে জানেন না, পড়তে জানেন না, ঘোড়া-চোর বলে যার খ্যাতি সান হুয়ান ডি লা সিনেমা প্রদেশে যতটা ব্যাপক ছিল ততটা প্রমাণিত ছিল না। লোরেঞ্জে ডাজা একটা খচ্চর চালকের সিগার ধরিয়ে দুঃখ করে বললেন, খারাপ স্বাস্থ্যের চাইতে একটা জিনিসই নিকৃষ্টতর, সেটা হল বদনাম। তবে তার সৌভাগ্যের আসল গোপন কারণ ছিল একটাই। তিনি নিজে যত কঠোর পরিশ্রম করতেন এবং যতটা দৃঢ় সঙ্কল্পের সঙ্গে তার কাজ করতেন সে রকম আর কেউ একটি কাজও করতো না, যুদ্ধবিগ্রহের সব চাইতে তিক্ত দিনগুলিতে যখন গাঁয়ের ঘরবাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হচ্ছিল, শষ্য ক্ষেতগুলি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল সেই সব সময়েও। তাঁর কন্যা অবশ্য কখনোই নিজের নিয়তি সম্পর্কে পিতার পূর্ব পরিকল্পনার কথা জানতো না, তবু সে তার একজন উৎসাহী সহযোগীর মতোই আচরণ করতো। সে ছিল বুদ্ধিমতী ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। এ ক্ষেত্রে সে এতোটাই পারঙ্গম ছিল যে নিজে পড়ালেখা শেখার সঙ্গে সঙ্গে সে তার বাবাকেও পড়তে শেখায়। আর মাত্র বারো বছর বয়সেই সে বাস্তবতার ওপর এতোটাই প্রভুত্ব অর্জন করে যে পিসি এসলোকাস্টিকার সাহায্য ছাড়াই সে সংসারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। তিনি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সোনার ওজনের একটা খচ্চরের চাইতেও ওর মূল্য বেশি। যখন তার কন্যা প্রাথমিক স্কুলের শেষ পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেল এবং গ্রাজুয়েশনের সময় যখন তার নাম বিশেষ সম্মানিতদের মধ্যে উল্লেখিত হল তখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে তার স্বপ্নের তুলনায় সান হুয়ান ডিলা সিনেগা বড় বেশি সঙ্কীর্ণ একটি স্থান। তখন তিনি তাঁর সব জমিজমা ও পশু বিক্রি করে দিয়ে নতুন উদ্যম আর সত্তর হাজার স্বর্ণ পেসো সঙ্গে নিয়ে এই বিধ্বস্ত কীটদষ্ট প্রাক্তন গৌরবের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন, যেখানে পুরনো মূল্যবোধের মধ্যে বেড়ে ওঠা একটি সুন্দরী নারীর অনুকূল একটা বিয়ের মাধ্যমে এখনো পুনর্জন্ম লাভের সম্ভবনা আছে। তাঁর বহু কষ্টের পরিকল্পনার মধ্যে একটা অভাবিত বাধার মতো উদিত হয়েছে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। তাই আমি তোমার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি, এই উক্তি করে লোরেঞ্জো ডাজা তার সুরার মধ্যে সিগারের প্রান্তদেশ ডুবিয়ে নিলেন কিন্তু ধূমপান করলেন না, তারপর তিনি বেদনার্ত কণ্ঠে তার কথা শেষ করলেন : আমাদের পথের সামনে থেকে তুমি সরে যাও।
আনিস্যের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার কথা শুনছিলো। ফারমিনা ডাজার অতীত তার সামনে উন্মোচিত হবার সময় সে ওই কাহিনী শুনছিলো এতটাই তন্ময় হয়ে যে যখন তার কথা বলার পালা আসবে তখন সে কী বলবে সে সম্পর্কে সে একটুও চিন্তাভাবনা করে নি। কিন্তু সময় যখন উপস্থিত হল তখন সে বুঝলো যে সে যাই বলুক না কেন আজ তার নিয়তির একটা মীমাংসা হয়ে যাবে।
সে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি ওর সঙ্গে কথা বলেছেন?
লোরেঞ্জো ডাজা বললেন, সেটা তোমার কোনো ব্যাপার নয়।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজা বললো, আমি প্রশ্নটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছি, কারণ আমার মনে হয় এ বিষয়ে তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ সব একদম চলবে না, লোরেঞ্জো ডাজা বললেন। এটা পুরুষদের ব্যাপার, পুরুষরাই সিদ্ধান্ত নেবে।
তাঁর কণ্ঠস্বরে ভয় দেখানোর সুর লাগলো। একজন খদ্দের সবেমাত্র ক্যাফেতে ঢুকে নিকটবর্তী একটা টেবিলে বসেছিল। সে চোখ তুলে ওদের দিকে তাকালো। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা অত্যন্ত ক্ষীণ কিন্তু অত্যন্ত কর্তৃত্বব্যঞ্জক কণ্ঠে বললো, সে যাই হোক না কেন, ও কি ভাবছে তা না জেনে আপনাকে আমি কোনো উত্তর দিতে পারবো না। দিলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতা হবে।
লোরেঞ্জো ডাজা এবার তার চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়ে বসলেন, তার চোখের পাতা লাল ও ভেজা ভেজা হয়ে উঠলো, বা চোখটা অক্ষিগোলকের মধ্যে ঘুরে গেল, তারপর বা পাশে একটু বেঁকে গিয়ে স্থির হয়ে থাকলো। তিনি গলা নামিয়ে বললেন, তোমাকে গুলি করতে তুমি আমাকে বাধ্য করো না।
ফ্লোরেন্টিনো আরিজার মনে হল তার পেটের ভেতরের নাড়িভুড়ি যেন শীতল ফেনায় ভরে যাচ্ছে, কিন্তু তার গলার স্বর একটুও কাঁপলো না, কারণ সে অনুভব করলো হোলি স্পিরিট যেন তাকে আলোকিত-উজ্জ্বল করে দিয়েছে। বুকের ওপর একটা হাত রেখে সে বললো, গুলি করুন। প্রেমের জন্য মৃত্যুবরণ করার চাইতে বেশি গৌরবের আর কিছু নেই।
লোরেঞ্জো ডাজা তার দিকে আড় চোখে তাকালেন, একটা তোতা পাখির মতো। তার বাঁকানো চোখ দিয়ে তিনি ওকে লক্ষ করলেন, তারপর দুটি শব্দ পরপর এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন যেন তিনি ওর দিকে থুথু নিক্ষেপ করছেন, কুত্তার বাচ্চা।
.
ওই সপ্তাহেই তিনি মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, ভাবলেন যে এভাবেই ফারমিনা ফ্লোরেন্টিনোকে ভুলে যাবে। তিনি ওকে কোনো ব্যাখ্যা দিলেন না, ঝড়ের বেগে ওর শোবার ঘরে ঢুকালেন। তার গোঁফ আর চিবুনো সিগার ক্রোধরঞ্জিত, তিনি ওকে তক্ষুনি তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে বললেন। ও জিজ্ঞেস করলো ওরা কোথায় যাচ্ছে, আর তিনি জবাব দিলেন, আমাদের মৃত্যুর কাছে। উত্তরটা সত্যের খুব কাছাকাছি বলে ওর মনে হল। ভয় পেয়ে, কয়েক দিন আগের সাহস নিয়ে ও তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি ততক্ষণে পেটানো তামার বকলস লাগানো তার বেল্ট কোমর থেকে খুলে তার হাতের মুঠির চারপাশে পাচাতে শুরু করেছিলেন, তারপর বেল্টটা টেবিলের ওপর এতো জোরে চালালেন যে সারা বাড়ি জুড়ে তার শব্দ একটা রাইফেলের গুলির শব্দের মতো ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল। তার শক্তির সীমা ফারমিনা ডাজার ভালো জানা ছিল, তাই সে দুটো খড়ের মাদুর ও একটা দড়ির দোলনা-বিছানা গোল করে বেঁধে নিল, দুটো ট্রাঙ্কে তার সব কাপড় জামা ভরলো, সে যে এই সফর থেকে আর কোনো দিন ফিরবে না সে সম্পর্কে সে ছিল নিশ্চিত। তারপর, কাপড় জামা পরার আগে, সে বাথরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে টয়লেট পেপারের মোড়ক থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার উপরে ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে ছোট একটা বিদায়ী চিঠি লিখলো। এর পর সে একটা কাঁচি দিয়ে একেবারে ঘাড়ের কাছ থেকে তার সম্পূর্ণ চুলের বেণীটা কেটে সোনালি সুতায় কাজ করা একটা মখমলের বাক্সে বেণীটা গোল করে মুড়ে চিঠির সঙ্গে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলো।
.
ওই ছিল এক উত্তম সফর। প্রথম পর্বে অ্যান্ডীয় খরচালকদের একটি দলের সঙ্গে খচ্চরের পিঠে চড়ে তারা সিয়েরা নেভাডা পর্বতমালার দীর্ঘ সরু উচ্চ রেখা ধরে এগিয়ে যায়। এটা চলে এগারো দিন ধরে। এই সময় নাঙ্গা সূর্যের উত্তপ্ত রোদে পুড়ে আর অক্টোবরের আনুভূমিক বৃষ্টিতে ভিজে তাদের স্বচ্ছ চিন্তার শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর ওপর, পর্বতচূড়াগুলি থেকে উত্থিত সারা দেহমন অবশ করে দেয়া বাষ্প তাদেরকে ভয়ে পাথর করে দিচ্ছিল। তৃতীয় দিনে উঁশ মাছির আক্রমণে পাগল হয়ে একটা খচ্চর তার চালককে নিয়ে খাদে গড়িয়ে পড়ে, সেই সঙ্গে ওটা টেনে নিয়ে যায় একই দড়িতে বাধা আরো সাতটা খচ্চরকে। লোকটির আর ওই পশুদের আর্ত চিৎকার দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেও পাহাড়ের চূড়ায় আর খাড়ির গর্তে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, আর ফারমিনা ডাজার স্মৃতিতে ওই চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বছরের পর বছর। তার মালপত্র খচ্চরগুলির সঙ্গে খাদের মধ্যে তলিয়ে যায় কিন্তু তলিয়ে যাবার শতাব্দিব্যাপী মুহূর্ত থেকে শুরু করে ভয়ার্ত চিল্কারের শব্দ থেমে না যাওয়া পর্যন্ত সে ওই মৃত্যুবরণকারী হতভাগ্য খচ্চরচালক কিংবা তার ক্ষত-বিক্ষত খচ্চরগুলির কথা একবারও ভাবে নি, সে তখন তার নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবেছে, কেন তার খচ্চরটা ওই খচ্চরগুলির সঙ্গে এক দড়িতে বাঁধা ছিল না!
এই প্রথমবার সে পশুর পিঠে চেপেছে। বর্তমান সফরের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট তার জন্য দুঃসহ তিক্ততায় ভরে যায় একটি কারণে, সে আর কখনো ফ্লোরেন্টিনো আরিজাকে দেখবে না, সে আর কখনো তার চিঠির সান্ত্বনা লাভ করবে না। সফরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সে ওর বাবার সঙ্গে একটি কথাও বলে নি আর তার বাবাও এতই হতবুদ্ধি হয়ে যান যে তিনিও খুব প্রয়োজনের মুহূর্তেও ওর সঙ্গে কথা বলেন নি, অপরিহার্য হলে কোনো একজন খচ্চর চালকের মাধ্যমে ওকে খবর দিয়েছেন। ওদের কপাল ভালো থাকলে ওরা পথিপার্শ্বের কোনো সরাইখানা পেয়ে যেত, সেখানে গ্রাম্য খাবার পরিবেশন করা হত যা ফারমিনা খেতে অস্বীকার করলো। সরাইমালিক ওদের বাসি ঘাম আর পেচ্ছাবের গন্ধমাখা ক্যানভাসের খাঁটিয়া ভাড়া দিত। তবে বেশির ভাগ সময়ে তারা রাত কাটাতো পথের পাশে নির্মিত সর্বজনীন ডরমিটরিতে, আদিবাসী। ইন্ডিয়ানদের বসতিতে। সেখানে সারিসারি বাঁশের দণ্ডের ওপর কটু খেজুর পাতার ছাদ টানানো, সব পথচারির-ই সকাল পর্যন্ত ওখানে রাত্রি যাপনের অধিকার ছিল। ফারমিনা ডাজা একটি রাতও ঘুমোতে পারে নি, ভয়ে তার শরীর ঘামে ভিজে যেত, রাতের অন্ধকারে সে নীরব পর্যটকদের আসা যাওয়ার শব্দ শুনতো, ওরা বাশের সঙ্গে তাদের পশু বেঁধে রেখেছে, যেখানে জায়গা পাচ্ছে সেখানেই তাদের দড়ির দোলনা-শয্যা ঝুলিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যার সময় প্রথম পর্যটক দল যখন এসে উপস্থিত হত তখন জায়গাটা থাকতো শান্ত, কোনো ভিড় নেই, কিন্তু সকাল নাগাদ এটা রূপান্তরিত হয়ে যেত একটা মেলা প্রাঙ্গণে, এক গাদা দোলনা-বিছানা বিভিন্ন উচ্চতায় ঝুলছে, পাহাড়ি অঞ্চলের আরুয়াক ইন্ডিয়ানরা উবু হয়ে বসে ঝিমুচ্ছে, পাশেই খুঁটিতে বাঁধা তাদের ছাগলগুলি চ্যাঁচাচ্ছে, খাঁচায় আটকানো লড়াইয়ের রাতা মোরগগুলি ঝুটোপুটি করছে, আর পাহাড়ি কুকুরগুলি নিঃশব্দে হাঁফাচ্ছে, যুদ্ধের বিপদের কারণে ওদের না ডাকতে শেখানো হয়েছে। এই সব হীনাবস্থার সঙ্গে লোরেঞ্জো ডাজার বিশেষ পরিচয় ছিল। তিনি তাঁর জীবনের অর্ধেকটা এ সব জায়গা দিয়ে যাওয়া আসা করে কাটিয়েছেন, আর এখন প্রায় প্রত্যেক সকালেই এখানে তার কোনো না কোনো বন্ধুর সাক্ষাৎ লাভ করছেন। কিন্তু তাঁর মেয়ের জন্য এটা ছিল এক তীব্র অন্তহীন যন্ত্রণা। লবণ দেয়া বস্তা বস্তা মাগুর মাছের তীব্র গন্ধ, শোকে কাতর, খাদ্য গ্রহণে অনীহা, এই সব মিলিত হয়ে শেষ পর্যন্ত তার খাবার ইচ্ছাটাই ধ্বংস করে দেয়। শুধু একটি কারণে সে হতাশায় ডুবে গিয়ে পাগল হয়ে যায় নি। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার স্মৃতি তাকে সর্বদা স্বস্তি দিয়েছে। তার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে এটাই হচ্ছে ভুলে যাবার দেশ।
আরেকটা সার্বক্ষণিক ভয় ছিল, সেটা হল যুদ্ধের। সফরের প্রথম থেকেই তারা একটা বিপদের কথা শুনে এসেছে। নিজেদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সেনাবাহিনীর যে ছড়ানো ছিটানো পর্যবেক্ষক দল আছে তাদের সামনে পড়লেই মহাবিপদ। কিভাবে দু’পক্ষের লোকদের চেনা যাবে এবং চেনার পর তাদের সঙ্গে কি রকম আচরণ করতে হবে তা খচরচালকরা ওদের শিখিয়ে দিয়েছিল। অফিসারের নেতৃত্বাধীন অশ্বারোহী সৈন্যদের সামনে ওরা প্রায়ই পড়ে। নতুন সৈন্য সংগ্রহের জন্য ওরা দড়ির ঘেরাটোপ দিয়ে লোকজন পাকড়াও করতো, কাজটা এমন ভাবে করতো যেন ওরা মানুষ নয়, গরুর পাল। অজস্র ভয়াবহ ঘটনার চাপে ফারমিনা ডাজা একটা বিপদের কথা ভুলে গিয়েছিল, যেটা তার কাছে আসন্ন মনে হয় নি বরং কাল্পনিক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু একটা ঘটনায় তার ভুল ভেঙে গেল। একদিন রাতে পর্যবেক্ষণকারী সৈন্যদের একটি দল সফরকারীদের দুজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে বসতি থেকে মাইল দেড়েক দূরে গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়। ওরা কোন পক্ষের বোঝা যায় নি। লোরেঞ্জে ডাজা নিহত সফরকারীদের চিনতেন না, কিন্তু তিনি তাদের মৃতদেহ গাছ থেকে নামিয়ে খ্রিস্ট্রীয় মতে তাদের সমাহিত করেন এবং ওদের মতো একই ভাগ্য যে তাঁর হয় নি সে জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেন। ধন্যবাদ দেবার যথার্থ কারণ ছিল, কারণ এক রাতে হামলাকারীরা তাঁর পেটে রাইফেল ঠেকিয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জিজ্ঞাসা করে তিনি উদারপন্থী না রক্ষণশীল। ওদের নেতার পরনে ছিল শতছিন্ন জামা, সারা মুখে কাঠ কয়লার কালি মাখানো, সে লোরেঞ্জোর মুখে আলো ফেলে ওই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করেছিল। জবাবে লোরেঞ্জো ভাজা বলেছিলেন, আমি দুটোর একটাও না, আমি একজন স্প্যানিশ প্রজা।
ওই সেনাপ্রধান তখন চিৎকার করে বলে ওঠে, কী সৌভাগ্য! তারপর হাত তুলে তাকে অভিবাদন করে বলে, রাজা দীর্ঘজীবি হোন! বলে সে বিদায় নেয়।
দু’দিন পর ওরা এক ঝলমলে সমভূমিতে নেমে এলো। সেখানে অবস্থিত ছিল। আনন্দ-উচ্ছল শহর ভালেদুপার। উঠানে উঠানে মোরগের লড়াই চলছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে গান বাজনা হচ্ছে, তেজী ঘোড়ায় চড়ে অশ্বারোহীরা ঘোড়া দাবড়াচ্ছে, আতশবাজি ফোঁটানো হচ্ছে, ঘণ্টা বাজছে। এক জায়গায় কয়েকজন মিলে একটা আতশবাজির প্রাসাদ নির্মাণ করছে। এ উৎসবের কিছুই ফারমিনা ডাজার চোখে পড়লো না। ভালেদুপারে ওরা ওর মায়ের ভাই লিসিমাকো সাঞ্চেজের বাড়িতে উঠলো। তিনি ওদের অভ্যর্থনা করার জন্য মহাসড়কের উপরে উঠে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে একগাদা কলরবমুখর তরুণ আত্মীয়স্বজন, প্রদেশের সব চাইতে ভালো ঘোড়ার পিঠে আসীন ওরা। লোরেঞ্জো ডাজা ও ফারমিনাকে আতশবাজি বিস্ফোরিত করতে করতে ওরা শহরের রাস্তার উপর দিয়ে বাড়িতে নিয়ে চললো। বাড়িটা ছিল গ্র্যান্ড প্লাজার উপর, ঔপনিবেশিক গির্জাটার পাশে। ওই গির্জা কয়েকবার মেরামত করা হয়েছে। ওটাকেই মূল বসতবাড়ি বলে মনে হচ্ছিল, বড় বড় ঘর, একটা গ্যালারি, মুখের সামনে ফলের গাছ, ফলের বাগান, চারপাশে গরম আখের রসের ঘ্রাণ।
ওরা আস্তাবলে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যর্থনা-কক্ষগুলি বিপুলসংখ্যক অচেনা আত্মীয়-স্বজনে পূর্ণ হয়ে গেল। তাদের অসহনীয় উচ্ছ্বাস ফারমিনার কাছে একটা মারাত্মক মহামারীর আক্রমণের মতো মনে হল। এই মুহূর্তে পৃথিবীতে আর কাউকে ভালবাসার মতো মনের অবস্থা তার ছিল না। ঘোড়ার পিঠের জিনের ঘর্ষণে তার পশ্চাদ্দেশে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল, ক্লান্তিতে সে মৃতপ্রায়, অনবরত পাতলা পায়খানা হচ্ছে, এখন সে লালায়িত শুধু একটা নির্জন নীরব স্থানের জন্য যেখানে সে প্রাণ খুলে কাঁদতে পারবে। দেখা মাত্র তার অবস্থা বুঝতে পারে মাত্র একটি প্রাণী, তার খালাতো বোন হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ, তার চাইতে দু’বছরের বড়, তারই মতো উদ্ধত অহঙ্কারী ভাবভঙ্গি। সে তার অবস্থা বুঝতে পারে কারণ সেও তার মতোই এক বেপরোয়া ভালবাসার আগুনে জ্বলছিল। রাত্রি নামতেই সে ফারমিনাকে নিয়ে তার শোবার ঘরে এলো। আগে থাকতেই সে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল, ওরা দুজন এ ঘরে একসঙ্গে থাকবে। সে যখন তার পাছায় আগুনের মতো লাল বড় বড় ফোস্কাগুলি দেখলো তখন তার বিশ্বাস হল না, কেমন করে সে এখনো বেঁচে আছে। তার মায়ের সহায়তায় সে ফারমিনা ডাজার ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিষ্কার করে জ্বালা করা জায়গায় আনিকার ঠাণ্ডা সেঁক দিয়ে তার যন্ত্রণা অনেকখানি প্রশমিত করলো। হিল্ডাব্রান্ডার মা ছিলেন ভারি মিষ্টি মহিলা, একেবারে তাঁর স্বামীর মতো দেখতে, প্রায় যমজ বলা যেতে পারতো ওদের দুজনকে। এ ঘরে যখন এসব চলছিল তখন উৎসব উপলক্ষে বারুদপ্রাসাদ থেকে ছোঁড়া কামানের গোলার শব্দে এ বাড়ির ভিত্তি পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
মাঝরাতে দর্শনার্থীরা বিদায় নিল। সর্বজনীন উৎসব থিতিয়ে এসেছে। হিব্রান্ডা ফারমিনাকে একটা রাতের পোশাক ধার দিল, তারপর তাকে মসৃণ চাদর আর নরম পালকের বালিশের শয্যায় শুয়ে পড়তে সাহায্য করলো। আর তখুনি অতর্কিত এক তাৎক্ষণিক সুখের আতঙ্ক তাকে গ্রাস করলো। তারপর শোবার ঘরে যখন ওরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই তখন হিল্ডাব্রান্ডা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল, আড়াআড়ি করা খিলটা লাগিয়ে দিল এবং নিজের বিছানার নিচ থেকে মোম-গালা দিয়ে সিলমোহর করা একটা ম্যানিলা খাম টেনে বের করলো, খামের গায়ে জাতীয় টেলিগ্রাফের প্রতীক চিহ্ন লাগানো, তার বোনের মুখে উদ্ভাসিত ঈর্ষার অভিব্যক্তি দেখার সঙ্গে সঙ্গে ফারমিনা ডাজার হৃদয়ের স্মৃতিতে সাদা গার্ডেনিয়া ফুলের বিষণ্ণ গন্ধ আবার জেগে উঠল। সে দাঁত দিয়ে লাল মোম-গালা সিল ছিঁড়ে ফেললো, তারপর সকাল না হওয়া পর্যন্ত এগারোটি নিষিদ্ধ টেলিগ্রাম চোখের জলে ভিজিয়ে দিলো।– তাহলে ও ঠিকই জানতে পায়। ঘটনাটা ছিল এই রকম। সফরে বেরিয়ে পড়ার আগে লোরেঞ্জে ডাজা একটা ভুল করে ফেলেন। তিনি শ্যালক লিসিমাকো সাঞ্চেজকে তার আসার খবরটা দেন এবং লিসিমাকো তখন প্রদেশ জুড়ে বিভিন্ন শহর ও গাঁয়ে তাদের নিকট ও দূরের যতো আত্মীয়পরিজন আছে সবাইকে ওদের সফরের খবর জানিয়ে দেন। ফলে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা যে ওদের সমগ্র সফরসূচিই জানতে পারে তাই নয়, টেলিগ্ৰামকর্মীদের একটা ভ্রাতৃসংঘও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তারা কাবোডিলা ভেলার শেষ বসতি পর্যন্ত ফারমিনা ডাজার অগ্রযাত্রার নিখুঁত হদিস রাখে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজার পক্ষে তাই ফারমিনা ডাজার সঙ্গে একটা তীব্র আবেগসমৃদ্ধ যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়, ভালেদুপারে পৌঁছার পর রিহাচায় যখন তাদের সফর পর্ব শেষ হয় তখন লোরেঞ্জো ডাজার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে তার কন্যা ফ্লোরেন্টিনোকে ভুলে গেছে। তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। কন্যার ওপর নজর রাখার ক্ষেত্রে তিনি যে কতোটা শৈথিল্য প্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা তিনি অনুমান করতে পারেন নি। তাঁর মন তখন ছিল ভিন্নমুখী। এতো বছর পর তাঁর শ্বশুরকুলের লোকজন তাদের গোষ্ঠীগত সংস্কার দূরে ঠেলে দিয়ে তাঁকে সাদরে নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করেছে, তাঁকে আপ্যায়িত করেছে, তার সঙ্গে মধুর আচরণ করছে, তিনি এ সবের মধ্যে ডুবে ছিলেন। বস্তুতপক্ষে ফারমিনা সাঞ্চেজের পরিবার ভীষণ ভাবে এই বিয়ের বিপক্ষে ছিল। লোরেঞ্জে ডাজা ছিলেন একজন বহিরাগত অভিবাসী, হামবড়া হাবভাব, অমার্জিত, সারাক্ষণ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে, অনায়ত্ত খচ্চর বেচাকেনা করে, ওই ব্যবসা এতো সহজ সরল যে সেটা সাধু ও সৎ ব্যবসা বলে মনে করা কঠিন। লোরেঞ্জো ডাজা চড়া দামে জুয়া খেলেছিল। তাঁর প্রিয়তমা ছিলেন ওই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী প্রতিনিধিত্বশীল পরিবারের আদরের কন্যা, যাদের মেয়েরা হত উদ্দাম বন্য প্রকৃতির, আর পুরুষরা কোমলপ্রাণ কিন্তু পরিবারের সম্মান রক্ষার ক্ষেত্রে উন্মাদ প্রায়। ফারমিনা সাজে একটা অন্ধ দৃঢ়তার সঙ্গে তার কামনার মানুষের পানে ধাবিত হচ্ছিল, ভালবাসার ক্ষেত্রে বাধা দিলে অনেক সময় অনিবার্য ভাবে যা ঘটে। তিনি এতো দ্রুতো ও গোপনীয়তার সঙ্গে লোরেঞ্জে ডাজাকে বিয়ে করলেন যে মনে হয় শুধু ভালবাসার জন্য তিনি এ রকম করেন নি, বরং ঠিক সময়ের আগেই ঘটে যাওয়া একটা ভুলের ওপর ধর্মীয় আভরণ টেনে দেবার জন্য তিনি ওরকম করেছিলেন।
লোরেঞ্জো ডাজা উপলব্ধি করেন নি যে তাঁর কন্যার ভালবাসার ক্ষেত্রে তিনি যে অনমনীয় অবস্থা গ্রহণ করেছেন তা পঁচিশ বছর আগে তাঁর নিজের অতীতেরই বিদ্বেষপূর্ণ পুনরাবৃত্তি। তাঁর শ্বশুরকুলের যে মানুষরা একদিন তার বিরোধিতা করেছিল এখন তিনি তাদের কাছেই অভিযোগ জানালেন, যে মানুষগুলি সেদিন যে ভাবে নিজেদের আত্মীয়-পরিজনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল ঠিক সেই ভাবে। এ দিকে দুঃখ আর ক্ষোভ প্রকাশে তিনি যে সময় ব্যয় করলেন তাঁর মেয়ে সে সময়টায় নিজের প্রেমকে সংহত করার সুযোগ পেল। তার শ্বশুরকুলের আত্মীয়দের সম্পন্ন জায়গা জমিতে তিনি বাছুরকে খোঁজা বানানো আর খচরকে পোষ মানানোর কাজে ব্যস্ত থাকলেন, আর তাঁর কন্যা সানন্দ সময় কাটাতে লাগলো এক দঙ্গল জ্ঞাতি বোনদের সঙ্গে, যাদের নেতৃত্ব দিত হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ, ওদের মধ্যে সবচাইতে সুন্দরী ও সবচাইতে বেশি সহানুভূতিশীল, যে কিনা একজন বিবাহিত মানুষের প্রেমে পড়েছে, তার চাইতে বয়সে বিশ বছরের বড়, ছেলেমেয়ের বাবা, আর এখন তার পানে গোপন চকিত দৃষ্টিপাত করেই হিল্ডাব্রান্ডাকে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
ভালেদুপারে অনেক দিন থাকার পর এবার ওরা পর্বতমালার ঢালু পথ দিয়ে এগিয়ে গেল, অতিক্রম করলো ফুলে ছাওয়া মাঠ আর স্বপ্নের মতো চারণক্ষেত্র, আর প্রতিটি গ্রামেই তাদের অভ্যর্থনা হল প্রথম গ্রামটির মতোই : গানবাজনা, আতশবাজি, গোপন যোগসাজশে পটু জ্ঞাতি বোনের দল আর টেলিগ্রাফ অফিস থেকে যথা সময়ে আসা তারবার্তা সহযোগে। ফারমিনা ডাজা বুঝলো যে ভালেদুপারে ওরা প্রথমদিন যা দেখেছিল তা অসাধারণ বা ব্যতিক্রমী কিছু ছিল না, এই উর্বর প্রদেশে মানুষ সপ্তাহের প্রতিটি দিনই উদযাপন করত ছুটির দিনের মতো করে। দর্শনার্থীরা রাত হলে যেখানে পারতেন সেখানেই শয্যা গ্রহণ করতেন, যেখানে ক্ষুধার্ত বোধ করতেন সেখানেই খেতে বসে যেতেন, এ সব বাড়িঘরের দরজা থাকতো সর্বদাই উন্মুক্ত, সবখানেই পাওয়া যেত ঝুলন্ত দোলনা-শয্যা, আর পাছে টেলিগ্রামে খবর এসে পৌঁছবার আগেই কোনো অতিথি দল চলে আসে তাই উনুনে সারাক্ষণই রান্না হতে থাকতো গরম গরম মাংসের ঝোল, আর সত্যিই প্রায় সর্বদাই খবর পাবার আগেই অতিথিরা এসে উপস্থিত হতেন। হিব্রান্ডা সাঞ্চেজ সফরের বাকি গোটা সময়টাই ফারমিনা ডাজার সঙ্গী হয়, নিজের উফুল্ল প্রকৃতি দিয়ে সে বোনের জটপাকানো জটিল রক্তের মধ্যে দিয়ে তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে, তাকে পৌঁছে দেয় একেবারে তার উৎপত্তির উৎস মূলে। ফারমিনা ডাজা নিজের সম্পর্কে অবহিত হল, এই প্রথমবার তার নিজেকে মুক্ত স্বাধীন মনে হল, তার বুক ভরে গেল স্বাধীনতার বাতাসে, তার নিজেকে মনে হল বন্ধু পরিবৃত, সে আশ্রয়হীন নয় এবং এই অনুভূতি তাকে ফিরিয়ে দিল তার মানসিক স্থৈর্য এবং বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা। তার জীবনের শেষ দিকে স্মৃতিকাতরতার যুক্তিহীন স্বচ্ছতা নিয়ে এই ভ্রমণের স্মৃতি প্রায়ই তার মনে পড়তো, মনে হত মাত্র সেদিন এটা ঘটেছে।
সে রোজ হাঁটতে বেরুতো। একদিন রাতে হাঁটার পর ঘরে ফিরে একটা জিনিস আবিষ্কার করে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল, মানুষ যে শুধু ভালবাসা ছাড়া সুখী হতে পারে তাই নয়, ভালবাসা স্বত্ত্বেও সে সুখী হতে পারে। আবিষ্কারটা তাকে শঙ্কিত করলো, কারণ তার এক জ্ঞাতি বোন নিজের বাবা-মাকে লোরেঞ্জো ডাজার সঙ্গে একটা বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতে শুনে ফেলেছিল। লোরেঞ্জো ডাজা বিশাল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী ক্লিওফাস মাসকোটের সঙ্গে তার মেয়ে ফারমিনার বিয়ের সম্ভাবনার কথা নিয়ে ওদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। ফারমিনা ডাজা ওকে চিনতো। ঝলমলে সাজে সজ্জিত তার সুদৃশ্য ঘোড়ায় চড়ে প্লাজায় ঘুরে বেরাতে সে তাকে দেখছে, রুচিশীল, চালাক-চতুর, স্বপ্নিল চোখের পাতা, মনে হয় পাথরের বুক থেকেও তা দীর্ঘশ্বাস টেনে আনতে সক্ষম, আর তখন ফারমিনা শীর্ণ দেহ, ছোট একটা পার্কে বাদাম গাছের নিচে কোলের উপর কবিতার বই নিয়ে বসে থাকা বেচারা ফ্লোরেন্টিনো আরিজার স্মৃতির সঙ্গে ক্লিওফাস মাসকোটের তুলনা করলো এবং তার মনে তখন সন্দেহের বিন্দু মাত্র ছায়াও রইলো না।
ওই সময় হিল্ডাব্রান্ডা সাঞ্চেজ এক গণকের দেখা পায়। তার ভবিষ্যদ্বাণীর দক্ষতা তাকে বিস্মিত করে। তার কথা শুনে হিল্ডাব্রান্ডার হৃদয় আশা ও আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। ফারমিনা ডাজাও তার কাছে যায়। সেখানে তাসের সাক্ষ্য ও ভবিষ্যদ্বাণী তার বুকে গভীর সাহস এনে দেয় : তার বিয়ে নিঃসন্দেহে সুখের হবে, দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং ফারমিনার মনে কোনো সন্দেহ থাকলো না যে একমাত্র তার প্রেমিকের সঙ্গেই ওই রকম সৌভাগ্যজনক নিয়তি সুনিশ্চিত হতে পারবে। ওই নিঃসন্দিগ্ধতায় উজ্জীবিত হয়ে ফারমিনা ডাজা নিজের হাতে তার নিয়তির ভার নিল। এর ফলেই ফ্লোরেন্টিনো আরিজার কাছে পাঠানো তার টেলিগ্রামগুলি আর তার ইচ্ছার প্রকাশ ও কাল্পনিক প্রতিশ্রুতিদানের মধ্যে বাঁধা থাকলো না, সেগুলি হয়ে উঠলো নিয়মনিষ্ঠ, বাস্তবসম্মত এবং আগের চাইতেও তীব্র। সেখানে সুস্পষ্ট তারিখের কথা বলা হল, কিভাবে সব কিছুর ব্যবস্থা হবে তার নির্দেশনা থাকলে, তাদের যখনই এর পর দেখা হবে তখনই, কারো সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করে, যেখানে এবং যেভাবে সম্ভব, তারা যে বিয়ে করবেই সে সঙ্কল্পের কথা ব্যক্ত হলো। ফারমিনা ডাজা তার ওই প্রতিশ্রুতিকে এতোটাই অলঙ্ঘনীয় বিবেচনা করে যে তার বাবা যখন তাকে ফোনেস্কা শহরে তার প্রথম প্রাপ্তবয়স্ক নাচের আসরে যোগদানের অনুমতি দেন, তখন তার মনে হল যে তার ভাবী স্বামীর অনুমতি না নিয়ে ওখানে যাওয়া তার পক্ষে শোভন হবে না। ওই সময়ে ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তাদের অস্থায়ী হোটেলে তাস খেলছিল। ওখানেই ও খবর পেল যে ওর জন্য একটা জরুরি তারবার্তা অপেক্ষা করছে।
ফোনেস্কার এক টেলিগ্রাম অপারেটর খবরটা দিয়েছে। সে তাকে ধরবার জন্য সাতটা মধ্যবর্তী স্টেশনের চাবি টিপেছে, ফারমিনা ডাজা একটা নাচে যোগ দিতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে ফ্লোরেন্টিনো আরিজার অনুমতি চেয়েছে সে। যখন অনুমতিটা ফারমিনা পেল তখন কিন্তু সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারে না, সত্যিই কি ফ্লোরেন্টিনো তারের ওপাশ থেকে অনুমতি দিয়েছে, নাকি অন্য কেউ। যতটা খুশি হল। তার চাইতে বেশি বিস্মিত হল ফ্লোরেন্টিনো আরিজা। ফারমিনা ডাজা যেন সন্দেহমুক্ত হয়ে বুঝতে পারে সেজন্য সে একটা সঙ্কেতের সাহায্য নিল। সে টেলিগ্রাফ অপারেটরকে জানালো, ওকে বলল যে আমি মুকুটশোভিত দেবীর নামে শপথ করে এটা বলছি। ফারমিনা ডাজা সহজেই সঙ্কেতটি বুঝল এবং তার প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের নাচে সকাল সাতটা পর্যন্ত কাটিয়ে দিল, তারপর তাড়াতাড়ি কাপড় বদলে গির্জায় সকালের প্রার্থনায় যোগ দেবার জন্য ছুটে বাড়ি ফিরলো। ইতিমধ্যে তার ট্রাঙ্কের নিচে সুরক্ষিত ফ্লোরেন্টিনো আরিজার চিঠি ও টেলিগ্রামের সংখ্যা তার বাবা তার কাছ থেকে যা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তার চাইতে অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল, আর সে একজন বিবাহিতা রমণীর মতো আচার-আচরণ আয়ত্ত করে ফেলেছিল। লোরেঞ্জো ডাজা আচার-আচরণে তার এই পরিবর্তনের মধ্যে প্রমাণ পেলেন অন্য কিছুর। তাঁর স্থির বিশ্বাস হল, দূরত্ব এবং সময় তার কন্যাকে ওর কৈশোরিক অলীক কল্পনা থেকে মুক্ত করেছে। তিনি ওর বিয়ের পরিকল্পনার কথা আর তুললেন না। এসকোলাস্টিকা। পিসিকে তাড়িয়ে দেবার পর থেকে পিতা ও কন্যার মধ্যে একটা আনুষ্ঠানিক চাপা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, এখন তার মধ্যেই একটা তরলতার সৃষ্টি হল। তাদের আপাত স্বস্তিপূর্ণ কথাবার্তা চালচলন দেখে এ সম্পর্ক যে মায়া-মমতা ও স্নেহের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা কারোর সন্দেহ করার উপায় ছিল না। এই সময়েই ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার একটি সঙ্কল্পের কথা ফারমিনা ডাজাকে জানাবার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার জন্য নিমজ্জিত জাহাজটি থেকে ঐশ্বর্য উদ্ধার করবে। এ কথা সত্য যে এক বিকালে দৈব অনুপ্রেরণার মতো সঙ্কল্পটি তার মনে ঝলসে ওঠে। সেদিন সমুদ্র মনে হচ্ছিল অ্যালুমিনিয়মের পাতে মোড়া। মুলিন গুল্মের প্রভাবে অসংখ্য মাছ জলের ওপর ভেসে উঠেছিল। আকাশের তাবৎ পাখি এতো খাবার দেখে অসম্ভব হল্লা করতে শুরু করে। জেলেরা তাদের বৈঠা তুলে ওদের তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিষিদ্ধ করা যে অলৌকিক ঘটনা তাদের সামনে বিরাট সম্পদ এনে দিয়েছে তার ভাগ তারা পাখিদের দিতে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। মুলিন গুলোর ব্যবহার দ্বারা মাছকে ঘুম পাড়ানো ঔপনিবেশিক যুগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, আইন করে, কিন্তু গোটা ক্যারিবীয় অঞ্চলের জেলেরা সাধারণত এটা ব্যাপক হারে ব্যবহার করতো, ডিনামাইট ব্যবহারের পূর্ব পর্যন্ত। ফারমিনা ডাজার সফরের সময় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তার অনেকটা সময় কাটাতো জেটিতে বসে, সমুদ্রের বুকে জেলেরা তাদের বিশাল জাল নিয়ে নৌকায় করে কিভাবে ঘুমন্ত মাছগুলিকে ধরছে সেটা দেখতে দেখতে। ছোট ছোট বালকের একটা দল ওই সময় তীরে দাঁড়ানো কৌতূহলী লোকদের সমুদ্রে টাকাপয়সা ছুঁড়ে মারতে বলতো, তারা ডুব দিয়ে সমুদ্রের গভীরতা থেকে তা আবার ওদের তুলে এন দেবে। বড় বড় সামুদ্রিক জাহাজগুলি এখানে নোঙ্গর ফেললে এই বালকরাই ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে। সাঁতরে জাহাজে গিয়ে উঠতো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক পর্যটক এদের নিয়ে নানা কাহিনী রচনা করেছে। ফ্লোরেন্টিনো আরিজা এদের চেনে বহু দিন ধরে, সে প্রেমে পড়বার আগ থেকে, কিন্তু ওরাই যে একদির ডুবে যাওয়া পালের জাহাজটা থেকে ঐশ্বর্যরাশি তুলে আনতে সক্ষম হতে পারে এই সম্ভাবনা সেদিনের আগে তার মনে কখনো উদয় হয় নি। পরের রবিবার থেকে প্রায় এক বছর পরে ফারমিনা ডাজার প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত তার উন্মত্ততায় এবার আরেকটি চালিকা শক্তি যুক্ত হল।
<