প্রেম ও কলেরা – গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
বাংলা অনুবাদ : কবীর চৌধুরী

উৎসর্গ
স্মৃতি বিস্মৃতির অগণিত মুহূর্তের উদ্দেশে

ভূমিকা

গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। প্রধানত একটি বিশেষ অঞ্চলের জীবন, ইতিহাস, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক বিষয় ও বৈচিত্রময় নানা চরিত্রের মানুষের আলেখ্য নিয়ে তাঁর কথাসাহিত্য গড়ে উঠলেও তার কল্পনার বিস্তার, পর্যবেক্ষণ শক্তি, অসামান্য কৌতুকরসবোধ, ডিটেল উপস্থাপনার ক্ষমতা ও ভাষার একই সঙ্গে সারল্য ও জটিলতা তার সাহিত্যকর্মকে স্থান ও কালের উর্ধ্বে এক অত্যুচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মার্কেজের জন্ম কলম্বিয়ার আরাকাতাকায়, ১৯২৮ সালে। বোগোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণের পর তিনি প্রথমে একটি কলম্বীয় সংবাদপত্রের রিপোর্টার ও পরে রোম, পারী, বার্সিলোনা, কারাকাস ও নিউইয়র্কে বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করেন। সাংবাদিকতা থেকেই তিনি সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। তাঁর লেখা অনেকগুলি উপন্যাস ও ছোটগল্প সংকলন তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে।

মার্কেজের গল্প-উপন্যাস পড়ার সময় পাঠক নিজের অজান্তেই এক মায়াবী ভুবনে ঢুকে পড়েন। আমাদের স্বপ্নের মধ্যে যেমন আমরা প্রায়ই এক আশ্চর্য সুন্দর জগতের সন্ধান পাই, যা একই সঙ্গে আমাদের অতি চেনা এবং সম্পূর্ণ অচেনা, মার্কেজের কথাসাহিত্য পাঠের সময় আমাদের অনুরূপ অভিজ্ঞতা ঘটে। মার্কেজ তার সাহিত্যকর্মে যে বাস্তবতা সৃষ্টি করেন তাকে সমালোচককুল আখ্যায়িত করেছেন জাদুবাস্তবতা বলে। বিষয়টি নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার গোটা ধারণাকেই এক বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। মার্কেজের জগতের সীমানা জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে দুলতে থাকে, একটা শান্ত রহস্যময় গোধূলিআলোয়, আর আমরা যদি সেই আলো আমাদের চিত্তে প্রবেশ করতে দিই তাহলে এক তীব্র লেলিহান রশ্মির মতো তা আমাদের সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।

শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা, কর্নেলের কাছে কেউ চিঠি লেখে না ও অন্যান্য গল্প, কুলপতির শেষ জীবন, পূর্বকথিত একটি মৃত্যুর ইতিবৃত্ত, সরল এরেন্দিরা ও অন্যান্য গল্প, নিজের গোলক ধাঁধায় জেনারেল, প্রেম ও কলেরা প্রভৃতি সাহিত্যকর্মে গার্সিয়া মার্কেজ যে জীবন দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, একজন অসামান্য সাহিত্যিক হিসাবে নিজেকে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা বিশ্বের সর্বত্র শ্রদ্ধামিশ্রিত বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।

কলম্বিয়ার যে ছোট্ট উষ্ণ ধূলিধূসরিত আরাকাতাকায় মার্কেজ তার শৈশবকাল কাটিয়েছেন, দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচি-খালা-ফুপুদের মাঝখানে যে খোলামেলা প্রশস্ত বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন তাই তাকে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি শতবর্ষের নিঃসঙ্গতার পটভূমি যুগিয়েছে। আরাকাতাকা-ই ওই উপন্যাসের মাকোন্ডো গ্রাম। শতবর্ষের নিঃসঙ্গতায় পরিবেশিত হয়েছে একটি পরিবারের জটিল কাহিনী, অজস্র শাখা-প্রশাখায় তা বিস্তৃত, নানা ঘটনা, উপঘটনা, স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা ও ঘৃণার ছবিতে তা আকীর্ণ।

মাকোন্ডা গ্রামের একশো বছরের ইতিবৃত্ত এ উপন্যাসে বিধৃত। গ্রামটির পত্তন করেছিলেন হোসে আর্কেড়িও বুয়েন্দিয়া। তার পুত্র-কন্যা, পৌত্র-প্রপৌত্রী এবং বিপুল সংখ্যক বংশধররাই গোটা গ্রামের বাসিন্দা। তাদের অনেকেরই নাম হোসে আর্কেডিও বুয়েন্দিয়ার নামেরই নানা রূপ : ছেলেদের নাম হোসে আর্কেডিও এবং অরিলিয়ানো, নাতিদের নাম অরিলিয়ানো হোসে, অরিলিয়ানো সেগুন্দো এবং হোসে আর্কেডিও সেগুন্দো। তাছাড়া পরিবারের রমণীকুল- দুই উরসুলা, কয়েকজন রমেডিঅস, ফার্নান্দা আর পিলার- পুরুষরা যখন স্বপ্নবিলাস আর আকাশ কুসুম রচনায় ব্যাপৃত পিলার তখন তার পদযুগল মাটির পৃথিবীতে শক্ত করে গেঁথে সংসারতরণী ভাসিয়ে রাখার চেষ্টায় নিয়ত ব্যস্ত। একদিকে পরিবারের বৈচিত্র্যময় জীবনযাত্রার ছবি, অন্যদিকে অবিশ্রাম গৃহযুদ্ধের ঝনঝনানি, হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, কত স্বপ্ন ধসে পড়ে, কত প্রাণহানি ঘটে, তবু গার্সিয়া মার্কেজের জাদু-বাস্তবতার মধ্য দিয়ে নানা বর্ণের ছটা চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে। এ উপন্যাসের পরতে পরতে জড়িয়ে আছে হাসি আর অশ্রু, লঘু কৌতুক আর গভীর বেদনা, কঠিন বাস্তবতা আর বায়বীয় অবাস্তবতা। এ উপন্যাসের মাধ্যমে মার্কেজ লাতিন আমেরিকান সাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্য পাঠকের সামনে উচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করলেন। পঁচিশটির মতো ভাষায় শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা অনূদিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সাহিত্যের ইতিহাসে মার্কেজ রচিত মাকোন্ডার এই মহাকাব্যিক উপন্যাসের নাম একেবারে প্রথম সারির প্রথম দিকে তার স্থান নিশ্চিত করে নিয়েছে।

গার্সিয়া মার্কেজ এক সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন যে তার শৈশব-কৈশোরে তিনি পিতামহের কাছ থেকে নিরন্তর গল্প শুনেছেন। পিতামহ ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, যৌবনে স্বদেশের গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সারাক্ষণ তিনি তাকে ওই গৃহযুদ্ধের কাহিনী শোনাতেন। তিনি গার্সিয়ার অন্তরের অন্তঃস্থলে ইতিহাস ও বাস্তবতার বোধ প্রবিষ্ট করান। আর তার মাতামহী তাকে শোনাতেন রূপকথার গল্প, তাদের পরিবারের অজস্র কিংবদন্তির কিসসা, স্বপ্নে পাওয়া বাণীর আলোকে তিনি পরিবারের সবার জীবন সংগঠিত করার চেষ্টা করতেন। গার্সিয়া মার্কেজ বলেন যে, তাঁর কাছ থেকেই তিনি লাভ করেছেন। বাস্তবতাকে দেখার জাদুময়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অতিপ্রাকৃত দৃষ্টিভঙ্গি।

সাংবাদিক হিসাবে গার্সিয়া মার্কেজ কিছু কাল কাটান উপকূলাঞ্চলীয় শহর বারানকুইলায়। তাঁর সাহিত্যিক শিক্ষানবিশির শুরুও ওই সময়। বছর কুড়ি বয়স। তিন সমবয়সী সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে দিনরাত সাহিত্য নিয়ে আলোচনা, একের পর এক বই পড়া, একে অন্যকে নিজেদের লেখা শোনানো, আর বিশেষভাবে ডিফো, ডস প্যাসোস, কামু, ভার্জিনিয়া উলফ ও উইলিয়াম ফকনারের সাহিত্যকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়াস। গার্সিয়া এবং অন্য তিনজনকে বন্ধুরূপে দেখা যায় শতবর্ষের নিঃসঙ্গতায় জার্মান, আলভারো, আলফনসো এবং গেব্রিয়েল।

১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার লাভের ঘোষণায় পর জনৈক সাংবাদিককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কেজ বলেন, তিনি যে একজন সহজাত স্বতাড়িত লেখক এই মিথটি তিনিই। সৃষ্টি করেছেন। আসলে তিনি লেখক হবার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন, পড়েছেন ও লিখেছেন, পড়েছেন ও লিখেছেন, এছাড়া নান্যঃপন্থা। তিনি রুশ, ভালো ভালো ব্রিটিশ ও আমেরিকান লেখকদের বই পড়েছেন। তিনি বলেন যে জেমস জয়েস আর এরস্কিন কল্ডওয়েল, এবং অবশ্যই হেমিংওয়ের কাছ থেকে তিনি অনেক শিখেছেন, কিন্তু যা অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য মনে হয় তাকে বিশ্বাসযোগ্য ও সম্ভবপর রূপে দেখাবার কলাকৌশল তিনি শিখেছেন। সাংবাদিকতা থেকে।

সাহিত্যিক মার্কেজ খুবই রাজনীতিসচেতন। তাঁর রাজনীতি বামঘেঁষা, কিন্তু তিনি কট্টরপন্থী নন, এবং কোন বিশেষ গোষ্ঠীর লোকও নন। তাঁর রাজনৈতিক মত ও বিশ্বাস কোন সুসংহত নীতিমালা ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ লাভ করে না, তা প্রকাশ পায় বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনার ওপর তার মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। তিনি যখন নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, কোন রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা মন্ত্রী কিংবা গেরিলা সেনাধ্যক্ষ, তখন তার কথার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবর্তনের পক্ষে, বিপ্লবের পক্ষে, হয়তো তার স্বদেশ কলম্বিয়ায়। ১৯৮০-এর দশকে যখন একজন মার্কেজকে একই সঙ্গে ফ্রান্সের মিতের এবং কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ও তাঁদের প্রতি তাঁর সমর্থন দানের প্রসঙ্গ তুলে এর মধ্যে একটা স্ববিরোধিতা আছে বলে ইঙ্গিত করেন তখন মার্কেজ বলেন, “না, এটা যুক্তিসঙ্গত। ফ্রান্সের অগ্রগতি মিতের সঙ্গে, আর লাতিন আমেরিকার ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে।”।

মার্কেজের “লাভ ইন দি টাইম অব কলেরা”, আমরা বাংলা অনুবাদে যার নাম দিয়েছি ‘প্রেম ও কলেরা’, শুধু নোবেল বিজয়ী মার্কেজের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাসই নয়, বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলেও ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছে। উপন্যাসটির তিন মুখ্য চরিত্র ডাক্তার জুভেনাল উরবিনো, ফ্লোরন্টিনো আরিজা ও ফারমিনা ডাজার জীবন পঞ্চাশ বছর ধরে পরস্পরের জীবনের সঙ্গে নানা গ্রন্থিতে জড়িয়ে যায়, রাগ-অনুরাগ ও দ্বন্দময় আবেগ অনুভূতির টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্ক যে পরিণতির দিকে অগ্রসর হয় তা পাঠককে একই সঙ্গে আনন্দিত, বিস্মিত ও শিহরিত করে। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও ফারমিনা ডাজার ক্ষেত্রে। ফ্লোরেন্টিনো যখন ফারমিনার প্রবল অপ্রতিরোধ্য প্রেমে পড়ে তখন প্রেমিক ও প্রেমাস্পদ উভয়েই ছিল অল্পবয়েসী তরুণ-তরুণী। উদ্ভিন্নযৌবনা ফারমিনা ডাজার বিয়ে হয়ে যায় শহরের সব চাইতে কাম্য প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী অভিজাত বংশের উচ্চশিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন বিত্তশালী সুদর্শন ডাক্তার জুভেনাল উরবিনের সঙ্গে। এই বিয়ে হয় সুখের, কিন্তু পঞ্চাশ বছরের সুখী দাম্পত্য জীবনের শেষে ডাক্তার যখন মৃত্যবরণ করেন তখন ফারমিনার পূর্ব-প্রেমিক ফ্লোরেন্টিনো, যে কখনোই ফারমিনাকে ভুলতে পারেনি, তার কাছে আবার তার আবেদন নিয়ে উপস্থিত হয় এবং এক পর্যায়ে, উভয়েই বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়া সত্ত্বেও, তাদের চমকপ্রদ মিলন ঘটে নদীবক্ষে চলাচল এক নৌযানে। মার্কেজ যেভাবে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তার মধ্যে ডিটেলের যে অবিশ্বাস্য সম্ভার যুক্ত করেছেন তা পাঠককে মুগ্ধ করে। চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে লেখকের দক্ষতা ঈর্ষণীয়। প্রধান তিন চরিত্র ছাড়াও তিনি এই উপন্যাসে এমন অনেকগুলি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন যাদের ভোলা যায় না, যেমন ফারমিনার বাবা লোরেঞ্জে ডাজা, তারা পিসি এস্কোলাস্টিকা ও খালাতো বোন হিল্ডাব্রান্ডা, ফ্লোরেন্টিনোর মা ট্রান্সিটো আরিজা, তার শয্যাসঙ্গিনী বিধবা নাজারাত, সারা নরিয়েগা, আসেনসিনো সান্তাদারা, তার বন্ধু ও সহকর্মী লিওনা কাসিয়ানি, টেলিগ্রাফ অফিসে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শিক্ষক লোটারিও থুগুট এবং এমনি আরো কয়েকজন। এ উপন্যাসে আমরা অনায়াসে এক কাহিনী থেকে আরেক কাহিনীতে প্রবেশ করি এবং সব কিছু মিলে যে মোজেইক শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় তা আমাদের বাইজানটাইন যুগের শিল্পকর্মের কথা মনে করিয়ে দেয়।

এই প্রেমের উপন্যাসে কলেরার প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, বিভিন্ন কাল ও ঘটনাপর্বে। তরুণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা প্রেমে পড়ে অসুস্থ হয়, তার পেটের পীড়া দেখা দেয়, চোখের নিচে কালি পড়ে, গলা শুকিয়ে যায়, বমি হতে থাকে, মায়ের ভয় হয় যে ছেলের বুঝি কলেরা হয়েছে। ফ্লোরেন্টিনোর ধর্মপিতা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক সব কিছু দেখে নানা প্রশ্ন করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হন, ওর কলেরা হয়নি, সে প্রেমরোগে আক্রান্ত হয়েছে, দুটোর উপসর্গই এক রকম।

শহরে একবার কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটলে ফারমিনা ডাজা একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার বাবার ভয় হল মেয়ে বোধ হয় কলেরা-আক্রান্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ডাক্তার। জুভেনাল উরবিনো ফারমিনাদের বাড়ি যায়, ফারমিনাকে পরীক্ষা করে, তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে ফারমিনার কলেরা হয়নি, সাধারণ অসুখ হয়েছিল।

ওই সময়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলে মাঝে মাঝেই মহামারী আকারে কলেরা ছড়িয়ে পড়তো। উপন্যাসের নানা পর্বে আমরা এ প্রসঙ্গ পাই। ডাক্তার জুভেনাল উরবিনের বাবা তার সময়ে একটা সাংঘাতিক কলেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কালে আক্রান্ত রোগীদের যেভাবে চিকিৎসা ও সেবাদান করেন তা ছিল তুলনাহীন। তিনিও ডাক্তার ছিলেন। তিনি কাজ করেন শহরের সঙ্গতিহীন কৃষ্ণাঙ্গ রোগীদের মধ্যে, এক পর্যায়ে রোগ তাকেও আক্রমণ করে এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন ভয়শূন্য অন্তরে, কলেরার শিকার হয়ে। আমাদের মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের চতুরঙ্গ উপন্যাসে শচীনের জ্যাঠামশাই জগমোহনের কথা।

প্রেম ও কলেরার একেবারে শেষ পর্বে উপন্যাসটির সমাপ্তি লগ্নেও আমরা কলেরার প্রসঙ্গ পাই, তবে মার্কেজ এখানে নিয়ে এসেছেন জাদুবাস্তবতার আবহ। যৌবনোত্তীর্ণ ফ্লোরেন্টিনো আরিজা ও ফারমিনা ডাজা যখন জীবনের গোধূলিলগ্নে নদীর বুকে নৌযানে ভ্রমণ করছে তখন খবর পাওয়া গেল যে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে কলেরা দেখা দিয়েছে, কয়েকটি মৃতদেহকেও জলে ভাসতে দেখা গেল। প্রেমিক-প্রেমিকা এই সুযোগ কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা তাদের জাহাজে বিপদপতাকা উড়িয়ে দিলো, এই জাহাজে কলেরা-আক্রান্ত রোগী রয়েছে, কাজেই তারা কোনো বন্দরে থামতে পারবে না। তাদের জাহাজ ভ্রমণসূচির যাত্রাশুরু ও শেষ গন্তব্য স্থানের মধ্যে যাওয়া-আসা করতে থাকলো। জাহাজের কাপ্তান। ব্যাপারটার মধ্যে একটা স্নিগ্ধ কৌতুকের উপাদান পেলেও একটু বিব্রত বোধ করেন, কিন্তু ফ্লোরেন্টিনো আরিজা তো কোম্পানির মালিক, তার নির্দেশ তো কাপ্তানকে মানতেই হবে। কাপ্তান যখন জিজ্ঞাসা করলেন, তো, কতকাল নদীবক্ষে আমরা এই রকম যাওয়া-আসা। করবো, তখন ফ্লোরেন্টিনো আরিজা, তুলনারহিত প্রেমিক, উত্তরে জানাল অনন্তকাল।

আরো কয়েকটি কথা বলতে হয়। তা হচ্ছে মার্কেজের অসামান্য কৌতুকরসবোধ, সচেতনভাবে অত্যুক্তি ও আতিশয্যকে প্রশ্রয় দান, কাহিনীর মধ্যে যৌনতার অনুষঙ্গ যা কখনো কখনো প্রায় পর্নোগ্রাফির কান ঘেঁষে চলে যায়। একটা উপকাহিনীতে বারবনিতাদের প্রসঙ্গ আছে, মার্কেজ ওই পর্বটি এমনভাবে উপস্থিত করেছেন যে তার মধ্যে অশ্লীলতার বিন্দুমাত্র ছোঁয়া লাগে না।

‘প্রেম ও কলেরা’ একটি অসামান্য প্রেমের উপাখ্যান, প্রাথমিক পর্বে একটি প্রত্যাখ্যাত প্রেমের অর্ধশতাব্দী পরে তার সাফল্যজনক চরিতার্থতার কাহিনী, কিন্তু এই বর্ণনা উপন্যাসটির বর্ণাঢ্যতার, প্রাণবন্ততার, বহুমাত্রিকতার সামান্যই প্রকাশ করে। বিষয়বস্তু, ভাষার কারুকাজ, চরিত্র চিত্রণ ও বাস্তবতার সঙ্গে রোমান্টিকতার মিশেল ‘প্রেম ও কলেরা’-কে একটা আকর্ষণীয় অনন্যতা দিয়েছে আর সেটাই এ উপন্যাসের দৈর্ঘ্য ও জটিলতা সত্ত্বেও আমাকে তার অনুবাদে প্রবৃত্ত করেছে।

এই অনুবাদে আমি কঠোরভাবে মূলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছি, সেই সঙ্গে অনূদিত কাজটিকে সুখপাঠ্য ও সাবলীল রাখার বিষয়েও মনোযোগ দিয়েছি। অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল ধরে আমার সকল অনুবাদ-কাজে আমি সে চেষ্টাই করেছি। বর্তমান অনুবাদটি পাঠকের ভালো লাগলে আমার শ্রম সার্থক বিবেচনা করব, তবে এই চমৎকার উপন্যাসটি অনুবাদ করার সময় আমি নিজে যে বিশেষ আনন্দ পেয়েছি তা নির্দ্বিধায় বলব।

অলমতি বিস্তারেন।

কবীর চৌধুরী
১ জানুয়ারি ২০০২
ঢাকা।

.

লেখক পরিচিতি

গেব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালে কলম্বিয়ার আরাকাতাকায়। বোগোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর তিনি প্রথমে একটি কলম্বীয় সংবাদপত্রে রিপোর্টার ও পরে রোম, পারী, বার্সিলোনা, কারাকাস ও নিউইয়র্কে বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। সাংবাদিকতার জগত থেকেই তিনি সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। তাঁর লেখা অনেকগুলি উপন্যাস ও ছোটগল্প তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। ১৯৮২ সালে তিনি সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। মার্কেজ রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে নীল কুকুরের চোখ (১৯৪৭), পাতার ঝড় (১৯৫৫), কর্নেলের কাছে কেউ চিঠি লেখে না (১৯৫৮), কু সময়ে (১৯৬২), বড়-মার শেষকৃত্য (১৯৬২), শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা (১৯৬৭), সরল এরেন্দিরা ও অন্যান্য গল্প (১৯৭২), কুলপতির শেষ জীবন (১৯৭৫), একটি পূর্বকথিত মৃত্যুর ইতিবৃত্ত (১৯৮১), কলেরার কালে প্রেম (১৯৮৫), নিজের গোলক ধাঁধায় জেনারেল (১৯৮৯), বিচিত্র তীর্থযাত্রী (১৯৯২) এবং প্রেম ও অন্যান্য পিশাচ (১৯৯৪)। মার্কেজের একাধিক গ্রন্থ বিশ্বের নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার বিশেষ আলোচিত দুটি উপন্যাস হল শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা এবং কলেরার কালে প্রেম।

কবীর চৌধুরী- জন্ম ১৯২৩, বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক কর্মী। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা একশো পঁচিশ ছাড়িয়ে গেছে। তিনি ইংরেজি, আমেরিকান, ফরাসি, জার্মান, রুশসহ বিভিন্ন ভাষার অনেক শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সাহিত্য শিক্ষা সংস্কৃতিক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি, একুশে ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার এবং ভারতের উইলিয়াম কেরি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ইংরেজি থেকে বাংলা ও বাংলা থেকে ইংরেজি দু’ভাষাতেই তিনি অনুবাদ করেন। ১৯৯৮ সালে কবীর চৌধুরী বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক পদে বৃত হন। সময় প্রকাশন গত বছর বইমেলায়। কবীর চৌধুরী অনূদিত রূপান্তরিত কিশোর সাহিত্য “সেরা সাত” প্রকাশ করে, যা ইতিমধ্যে বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে।

<

Super User