নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ – গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
(ওসিআর ভার্সন – ভুল সংশোধন করা সম্ভব হয়নি)
অনুবাদ : তরুণ কুমার ঘটক
প্রথম প্রকাশ বইমেলা, জানুয়ারি ২০১৪
অনুবাদকের কথা
নোবেলজয়ী কিংবদন্তী উপন্যাসের শিরোনাম ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ (Cien años de soledad)। এই গ্রন্থটি অনুবাদের প্রধান সমস্যা যে কিছু কিছু স্প্যানিশ ও ইংরাজি সংস্করণে টীকা (notes) নেই। ফলে অপেক্ষা করতে হল স্প্যানিশ রয়্যাল অ্যাকাডেমি প্রকাশিত সংস্করণের জন্য। দিল্লীতে অবস্থিত Instituto cervantes-এর স্প্যানিশ ভাষার শিক্ষক শ্রী শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে তিনি এই সংস্করণটি আমাকে এনে দিলেন। টীকা টিপ্পনী ব্যতীত এই রকম উপন্যাস অনুবাদ করা অসম্ভব।
স্প্যানিশ রয়্যাল অ্যাকাডেমির সংস্করণে প্রখ্যাত লেখক ও সমালোচকদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা রয়েছে, যার মধ্যে মারিও ভার্গাস ইয়োসার লেখাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। যাই হোক, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস মানুষের জীবনের আপাত কমিক দিশা অন্বেষণ করতে গিয়ে লিখে ফেলেছেন ট্র্যাজেডি। তার ভাষা অনবদ্য, বড়ো বড়ো বাক্যের পাশে আচম্বিতে এসে পড়ে ছোটো বাক্য। মাঝে মাঝে ব্যাকরণের নিয়ম অতিক্রম করে যান লেখক। কিন্তু তাঁর বাক্যের মধ্যে চটুল ব্যঙ্গ খুবই কম।
আমি দীর্ঘদিন স্প্যানিশ ভাষা চর্চা করেও মাঝে মাঝে ধন্দে পড়ে যাই কীভাবে তার বহুমূল্য ভাষা প্রাসাদের অভ্যন্তরস্থিত সূক্ষ্ম অলংকরণ যথাযথ অনুবাদ করব? তবুও চেষ্টা করেছি বোঝার জন্যে বিদগ্ধ লেখকদের লেখা পড়েছি। স্প্যানিশ ভাষায় খ/হ এবং ব/ভ প্রায় সমোচ্চারিত অক্ষর। আমি ‘হ’ ও ‘ভ’ রেখেছি। বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে কিছু সমস্যা থেকে যায়।
যদি আপনাদের এই অনুবাদ ভালো লাগে, আমার অধ্যবসায় সার্থক হবে।
তরুণ কুমার ঘটক
০১.১০.২০১৩
.
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস–এর জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা
বর্তমান বিশ্বের সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। তাঁর জন্ম ১৯২৮ সালে, কলম্বিয়ার আরাকাতাকা নামক স্থানে।তার শৈশব কাটে মা, দাদু ও দিদিমার সঙ্গে। স্কুলের মাধ্যমিক পাঠ শুরু ১৯৪০ সালে এবং ১৯৪৬ সালে সিপাকিরার (Zipaquira) কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ সমাপ্ত হলে তিনি কার্তাহেনার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন ১৯৪৭ সালে, যদিও পাঠ্য বিষয়ে তার আগ্রহ তেমন ছিল না। পেশায় চিকিৎসক এবং লেখক মানোয়েল সাপাতা ওলিভেইয়ার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুর মাধ্যমেই তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হন। সময়টা ছিল ১৯৪৮-এর মাঝামাঝি; কিছু দিন আগেই উদারপন্থী নেতা হোর্হে এলিয়েসের গাইতান বোগোতায় খুন হয়ে যান, ঘটনাটি ‘বোগোতাসো’ (বোগোতার কুখ্যাত ঘটনা) নামে পরিচিত, এরপর প্রতিবাদ মিছিলের ওপর নির্মম অত্যাচার নেমে আসে। সেই বছরই ‘এল্ উনিভের্সাল’ (বিশ্বজনীন) সংবাদপত্রটির প্রকাশনা শুরু হয় এবং তার সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেস যুক্ত হন। পরে স্বাস্থ্যের কারণে সুক্রে নামক স্থানে বিশ্রাম নিতে যান এবং বাররানকিইয়ার এক বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটে। সেখানেই একটি পুস্তক বিপণীর প্রাক্তন কর্ণধার রামোন ভিনিয়েস্-এর সঙ্গে তার আলাপ হয়; ১৯১০-১৯২০ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী মহলে এঁর খ্যাতি ছিল, তাকে বলা হত ‘এল কাতালান’ (কাতালুনিয়া অঞ্চলের মানুষ) এবং নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসের শেষ দিকে যে প্রাজ্ঞ কাতালান-কে পাই তা ওই ব্যক্তির আদলে গড়া এক চরিত্র। তার ‘নোটবই’ সত্যিই ছিল, বলেছেন ডি, গিলার্ড নামে এক লেখক। বন্ধুরা সেই সময় গার্সিয়া মার্কেসকে সমকালীন লেখকদের কিছু বই পড়তে দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন দোস পালসোস, ফকনার, ভার্জিনিয়া উলফ, স্টেইনবেক, হেমিংওয়ে, ক্যালওয়েল এবং হাক্সলি। ১৯৪৯ সালে গার্সিয়া মার্কেস বাররানকিইয়াতে বাস করতে শুরু করেন এবং ১৯৫০ সালের শুরু থেকে ‘এল এরান্দো’ (অগ্রদূত) সংবাদপত্রে যোগদান করেন। দৈনন্দিন যে কলাম তিনি লিখতে শুরু করেন তার। শিরোনাম (লা হিরাফা) ‘জিরাফ’। সঙ্গে সঙ্গে ‘ক্রোনিকা’ (ঘটনাক্রম) শীর্ষক একটি স্বল্পায়ু পত্রিকায় লেখাও শুরু করেন, সম্পাদনার দায়িত্বও তাকে পালন করতে হয়। ১৯৫১ সালে গার্সিয়া মার্কেস ফিরে এলেন কার্তাহেনা শহরে, শুরু করলেন নিজস্ব এক পত্রিকা, নাম ‘কমপ্রিমিদো’ (ওষুধের বড়ি)। আবার বাস শুরু হল বাররানকিইয়াতে। সেখানেই আবার ‘জিরাফ’ নামের কলাম পুনর্জীবিত হল। তার প্রথম উপন্যাস ‘লা ও হারাসকা’ (ঝরাপাতা)-র পাণ্ডুলিপি ফেরত দিল বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ‘লোসাদা।’ লেখক জীবনের শুরুতেই এক আঘাত। ‘এবালেদা’ (অগ্রদূত) যে গল্পটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করল তার শিরোনাম মান্দায় বৃষ্টি দেখে ইসাবেল-এর ‘স্বগতোক্তি’ কিন্তু প্রকাশিত হল ‘শীত’ নামে। সম্ভবত এই প্রথম ‘মাকন্দো’ নামটি শোনা গেল। পুস্তক বিক্রেতা হিসেবে পার্সিয়া মার্কেস কিছুদিন আটলান্টিক-এর উপকুলস্থিত নানা স্থানে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ১৯৫২ তে জেনারেল গুস্তাভো হোস পিনিইয়া কলম্বিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন যদিও দেশের অন্যান্য অঞ্চল অপেক্ষা কার্তাহেনা শহরে রাজনৈতিক দমনপীড়নের আঁচ লাগে কম। ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বাররানকিয়ার সংবাদ পত্র ‘এল নাসিওনাল’ (জাতীয়তাবাদী)-এর সঙ্গে যুক্ত হলেন গার্সিয়া মার্কেস। তার লেখায় প্রকাশিত হতে থাকে মানুষের উদ্বেগ ও শঙ্কা, অভিনব শৈলীতে লেখা কলামে পাঠকের আগ্রহ বাড়ে; তিনি বলেন যে স্পেনের লেখক রামোন গোমেস দে লা সেরনার ‘গ্রেগেরিয়াস’ (পরমতাবলম্বী) দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।
গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সাংবাদিক জীবনে যে প্রচুর লেখালেখি করতেন তা একদিকে যেন তার সাবলীল লেখার ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক হয়, তেমনি বিবিধ বিষয়ের সম্যক জ্ঞান পরবর্তীকালে তার গল্প-উপন্যাসের পটভূমি রচনার কাজে লাগে। যদিও তার কল্পনা সেইসব বিষয়কে অন্য মাত্রা এনে দেয়। সাংবাদিক হিসেবে লেখালেখির মধ্যেই মুদ্রার অন্য দিকটা ভেসে উঠতে থাকে, গল্প-লেখার অদম্য ইচ্ছে; ১৯৪৬ সাল থেকে ‘এল্ এসপেক্তাদোর’ (দর্শক) সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে তার গল্প। তার ক্ষুদ্রায়তন প্রথম উপন্যাস ‘লা ওহারাস্কা’ (ঝরাপাতা) প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে, যদিও সেটির সংশোধিত খসড়া প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল ১৯৫১ সালেই। ১৯০৩ থেকে ১৯২৮ (গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর জন্মসাল) পর্যন্ত কিছু ঘটনা নিয়ে এই উপন্যাস। এখানেও ঘটনাস্থল মাকন্দো। এক চিকিৎসকের আত্মহত্যা নিয়ে আত্মকথনের মাধ্যমে তিন প্রজন্মের তিন চরিত্র বক্তব্য পেশ করে। এই গল্পে এক বৃদ্ধ কর্নেল-এর চরিত্র আছে, যা আমরা তার পরবর্তীকালের উপন্যাসে দেখতে পাব আর ‘ঝরাপাতা’ কলা ব্যবসায়ীদের এক কোম্পানির প্রতীক। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে ওই ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। সম্ভবত এই সময় থেকেই নিজের পরিবার এবং গল্পের বিষয়বস্তু সমূহ নিয়ে এক উপন্যাস রচনার ভাবনা আসে তার মাথায়। আসলে ‘বাড়ি’র পটভূমি নিয়ে একটি উপন্যাস লেখা হবে এমন ভাবনাই ছিল; উপন্যাসটির শিরোনাম ‘বাড়ি’ হতে পারত। আরাকাতাকা নামক স্থানে জন্মের পর থেকে গার্সিয়া মার্কেস তার দাদু ও দিদিমার সঙ্গে বাস করেছেন। তার আট বছর বয়সে দাদুর মৃত্যু হয়। ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত আরাকাতাকায় কলা ব্যবসার প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, সঙ্গে সঙ্গে স্থানটিরও উন্নতি হয়। পরবর্তী কালে লেখকের স্মৃতিতে বারবার ভেসে উঠবে জন্মস্থানের কথা, কিন্তু তার আর সেখানে ফেরার কোনো আশা থাকবে না। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে পারিবারিক স্মৃতির ভূমিকা কম নয়, বলেছেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা। ঝরাপাতার সামনে বসে থাকা নিশ্চল শিশুর ছবি ফিরে আসবে গার্সিয়া মার্কেস-এর ভবিষ্যতের লেখায়; ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষে’ আমারানতা উরসুলা নিজের শবাচ্ছাদন বস্ত্র বোনে–এই দৃশ্যের সঙ্গে হুবহু নিল ছিল তাঁর এক কাকিমার। আরাকাতাকায় ঠিক এমন ভাবে তিনি তাঁর শবাচ্ছাদন-বস্ত্রটি বুনতেন। চোখে দেখা দৃশ্য বা চরিত্র কি আশ্চর্যভাবে চলে আসে তার উপন্যাসে। সুন্দরী রেমেদিওস’–এর স্বর্গে উঠে যাওয়ার দৃশ্যটি সম্পর্কে তিনি বলেন– এটি খুব সাধারণ ব্যাপার, মানুষ যা ভাবে তার চেয়ে অনেক সহজ। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে ‘সুন্দরী রেমেদিওস’-এর যে চরিত্র আমি লিখেছি ঠিক এই রকম এক মেয়ে ছিল। আসলে সে বাড়ির এক পুরুষের সঙ্গে পালায়, লজ্জা আর সইতে পারে না তার পরিবার; একজন বলে যে বাগানে চাদর ভাঁজ করতে দেখা গেছে তাকে আর তারপর সে আকাশে উড়ে গেল…লেখার সময় পরিবারের গল্পটি আমি নিয়েছি… আসলে ঘটনাটা হল যে মেয়েটি এক পুরুষের সঙ্গে পালিয়েছিল, এ ঘটনা তো আকছার ঘটে, এর মধ্যে কোনো সাহিত্যের রস নেই’।
মারিও ভার্গাস ইয়োসা বলেন—’ঝরাপাতা’ উপন্যাসে ইসাবেল-এর চরিত্র মিলে যায় লুইসা সান্তিয়াগো নামে বাস্তব এক নারীর সঙ্গে, মাত্র চার কী পাঁচ বছর বয়সে গার্সিয়া মার্কেস এঁকে প্রথমবার দেখেন; ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসের চরিত্র মের্সেদেস্ এক কেমিস্ট; ‘বাররানকিয়াতে’ লেখক তাকে দেখেছিলেন, এই উপন্যাসের চরিত্র আমারানতা উরসুলা স্বপ্ন দেখে তার গর্ভে দুই ছেলের জন্ম হবে, তাদের নাম হবে রোদরিগো এবং গনসালো, এ তো গার্সিয়া মার্কেস-এর ছেলেদের নাম; ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাসে যুবক চক্রান্তকারীদের নাম এবং ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে মাকন্দোর শেষ অবস্থায় আউরেলিয়োনো বোয়েনদিয়ার বন্ধুরা হল বাররানকিয়ার তিন সঙ্গীর দুজন; আলভারো (সেপেদা), আলফনসো (ফোয়েনমাইয়োর) এবং এরমান (ভার্গাস); ‘হস্তিনী’ (লা এলেফান্তা) এই উপন্যাসে ভক্ষক, তার পদবি সাগাসতুমের পদবির সঙ্গে এক, বাস্ক প্রদেশের ওই যাজক গার্সিয়া মার্কেস-এর শিক্ষক ছিলেন; উরসুলা ইগুয়ারানের দীর্ঘস্থায়ী বার্ধক্য, অন্ধত্ব এবং পাগলাটে ভাব মিলে যায় দন্যা ভ্রানকিলনার চরিত্রের সঙ্গে, যদিও উপন্যাসের চরিত্র চিত্রণে অতিশয়োক্তি আছে। কর্নেল বোয়েনদিয়ার ক্যাম্পে বাঘের ছদ্মবেশে এক অদ্ভুত যোদ্ধার উপস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট গল্প গার্সিয়া মার্কেস নিজেই বলতেন, এসব মার্লরোর ভিউক, ‘মামরু’র গল্প, দিদিমার মুখে তিনি শুনেছিলেন যে এই ব্যক্তি যুদ্ধে গিয়েছিলেন। ‘ঝরাপাতা’ উপন্যাসের কর্নেল শারীরিক প্রতিবন্ধী। গার্সিয়া মার্কেস্-এর দাদু দন নিকোলাস-এর এক চোখ ‘অন্ধ ছিল এবং তিনি বলতেন যে ‘হাজার দিনের যুদ্ধে’ উরিবে-র সেনাবাহিনীতে তার নাম নথিভুক্ত ছিল। ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রের মতো তিনিও নিরলান্দিয়ার শান্তি চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটিতে এবং বোয়েনদিয়া পরিবারটির বংশলতিকায় গার্সিয়া মার্কেস-এর পারিবারিক ইতিহাসের তথ্য বিপুলভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। মারিও ভার্গস ইয়োসা তাই বলেন যে গার্সিয়া মার্কেস ভাবতেন যে ‘উপন্যাসটির প্রাথমিক প্রেরণা এসেছিল একটি নির্দিষ্ট ধারণা থেকে–দন নিকোলাসের স্মৃতি– তিনি হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতেন সার্কাস দেখাতে, তার ছায়ায় নির্মিত চরিত্র আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া, বালক বয়সে বাবার হাত ধরে বরফ দেখতে যাওয়ার কথা তার মনে পড়ে যায়। বোয়েনদিয়া পরিবারটির আদি নিবাস রিওয়াচায়, সেখানেই জন্মগ্রহণ করেন দন নিকোলাস এবং দন্যা ত্ৰাণকিলিনা। ওরা ছিল তুতো ভাইবোন, যেমন ভরসুলা ইগুয়ারান এবং হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া (ইগুয়ারান পদবিটা সাহিত্য ও বাস্তবে একই) এবং প্রথম বোয়েলদিয়ার পিতৃপুরুষদের মতো তাদেরও শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে জন্ম হয়েছিল। যে কারণে হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া পৰ্বাঞ্চলের বাসভূমি পরিত্যাগ করে মান্দা নামক স্থানে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তুললেন তা হল প্রতিবেশী প্রুদেনসিও আগিলারকে তিনি হত্যা করার পর সেখানে তার মনে শান্তি ছিল না, বারবার মৃত মানুষটা তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। দন নিকোলাসও এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলেন এবং সেই জন্যে তিনি আরাকাতাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন; নিহত মানুষটির পদবিও ছিল এক। দন নিকোলাসের অভিধান-পাগলামো ছিল, শব্দার্থ নিয়ে তিনি মেতে থাকতে ভালোবাসতেন–বোয়েনদিয়া পরিবারের একটি বংশধারা গোপন অভিধানের শব্দগুলোর অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টায় জীবন অতিবাহিত করে (মেলকিয়াদেস্-এর পাণ্ডুলিপি) কিন্তু মনে রাখা ভালো যে পরিবারের ছাপ পড়েছে অন্যান্য চরিত্রের মধ্যেও এসব তথ্য পেলেও গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এক চিরনতুন উপন্যাস নির্মাণ করেন, যা লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে একেবারে মৌলিক; বাস্তব তথ্যকে সাহিত্যের অনবদ্য সৃজনে কেমন করে রূপান্তরিত করতে হয় সেই জাদু লখক জানতেন।
‘বাড়ি’ নিয়ে গার্সিয়া মার্কেস একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু গ্রন্থাকারে সেটি প্রকাশিত হয়নি। শিরোনাম ছিল ‘বোয়েনদিয়ার বাড়ি’ (উপন্যাসের উপাদান ছিল); লেখা হয়েছিল ১৯৫০-এর মে-জুন মাসে আর কিছু অংশ ওই বছর নভেম্বরে। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার বাড়ি ফিরে আসার ঘটনা দিয়ে উপন্যাসটির শুরু। পুরনো বাড়ির বিধ্বস্ত রূপ তিনি দেখেন এবং বৃষ্টি থামার পর নতুন নির্মাণ শুরু করেন। একটানা বর্ষণ ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসের এক প্রধান ঘটনা। গার্সিয়া মার্কেস কোন স্থানে তার গল্পগুলো প্রতিস্থাপন করবেন তা ঠিক করে ফেলেন কিন্তু সময় এবং কোন সুরে বাঁধবেন তা নিয়ে ধন্দে ছিলেন। ‘জিরাফ’ নামে সংবাদপত্রে যে কলাম লিখতেন তাতে সময় সম্পর্কে নতুন ভাবনা দেখা যায়। ‘ফ্যান্টাসির হাত কাটা কোট’ (১৯৫০) রচনায় সময় আর মিথ নিয়ে আলোচনা আছে, কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস তার নতুন লেখা নিয়ে যে উচ্চাশা পোষণ করতেন তা কার্যকরী করার মত মনস্কতা তখন তার গড়ে ওঠেনি।
‘দর্শক’-এর সাংবাদিক হিসেবে ১৯৫৪ সালে তিনি যান রোমে। ১৯৫৭-তে তিনি কলম্বিয়ায় ফিরে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেন, ইউরোপের দুই জার্মানি চেকোশ্লোভাকিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ করার পর তিনি যান ভেনেজোয়েলা, সেখানে একটি গ্রন্থে তিনি সহযোগিতা করেন, গ্রন্থটির শিরোনাম ‘মুহূর্ত’, এলিট আর চিত্রময় ভেনেজোয়েলা। ১৯৫৫ সালে ‘ঝরাপাতা’ প্রকাশিত হল, কাকতালীয় ভাবে ওই সময় প্রকাশিত হল হুয়ান রুলফোর সুবিখ্যাত উপন্যাস ‘পেদ্রো পারামো’, পরের বছর প্রকাশিত হল গার্সিয়া মার্কেস-এর আর-একটা উপন্যাস ‘লা মালা ওরা ( মন্দ সময়’), এই গ্রন্থটির জন্যে তিনি পেলেন ‘এসো পুরস্কার’ (premio Esso)। গার্সিয়া মার্কেস ছোটো উপন্যাসটি প্রকাশ করে মাকান্দার নাটকীয় কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন। অবিশ্রান্ত বর্ষণ নিয়ে মানুষ বিরক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত হল ‘এল করোনেল নো তিয়েনে কিয়েন লে এসক্রিবা’/ ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না।’ এই উপন্যাসেও অনেক ঘটনার সঙ্গে থাকে বৃষ্টির ভূমিকা, কর্নেল নিঃসঙ্গ, তাঁর সঙ্গী বলতে স্ত্রী আর এক মোরগ, মনে পড়ে মৃত পুত্রের কথা, যুদ্ধের স্মৃতিকাতরতা; সবই মাকন্দো নামক স্থানে ঘটে। ১৯৬২ সালে বেশ কিছু গল্প নিয়ে সংকলন প্রকাশিত হয়, শিরোনাম ‘বড়মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া’ আরও যে আটটি গল্প ওখানে অন্তর্ভুক্ত হয় সেগুলি হল ‘উন দিয়া দে এসতোস’ / ‘হালের একটা দিন’, ‘এন এসতে পোয়েবলো নো আই লাদ্রোনেস’ / ‘এ গায়ে চোর নেই’ ‘লা প্রদিহিওসা তার্দে দে বালতাসার’ / ‘বালতাসারের আশ্চর্য বিকেল’ / ‘লা ভিউদা দে মনতিয়েল’ / ‘মনতিয়েল এর বিধবা স্ত্রী’ ‘উন দিয়া দেসপোয়েস দেল সাবাদো’ / ‘শনিবারের পর একদিন’ ‘রোসাস আর্তিফিসিয়ালেস’ / ‘কৃত্রিম গোলাপ’। সমালোচকরা বলেছেন এবং লেখকও তা স্বীকার করেছেন যে এইসব গল্প লেখার সময় তাঁর মাথায় এসেছিল একটি বিশ্বজনীন উপন্যাস রচনার ভাবনা এবং সেটি সম্ভবত তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী এক সৃষ্টি এবং রচিত হল ‘সিয়েন আন্যোস দে সোলেদাদ’। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’। প্রকৃতপক্ষে যা ঘটল তা হল এইসব গল্প নতুন মাত্রা নিয়ে প্রবেশ করল উপন্যাসটিতে, কিন্তু আগের সব লেখা এই উপন্যাস রচনার ছকে আসেনি। পরিণত মনস্কতায় সমৃদ্ধ নতুন ধরনের স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ যে গল্পগুলি ছিল সেগুলি এসে মিলল এই উপন্যাসে–নদী, উপনদী, শাখানদী সব মিলল সাগরে। পাঠক হিসেবে আমরা ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটিকে এক স্বতন্ত্র সৃষ্টি হিসেবে পড়ি, যদিও ওই গল্পগুলোর ভূমিকাও জানি। উপন্যাসটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি এবং পরবর্তী কালের রচনা মাথায় রেখেই আমরা এই বিশ্ববিশ্রুত উপন্যাস পাঠে মগ্ন হই। পাঠক যাতে এই উপন্যাস পাঠে কিছুটা উপকৃত হন তাই এই প্রস্তাবনা।
.
গাব্রিয়েল সম্পর্কে যা জানি
আলভারো মুতিস্
কার্তাহেনার বোকাগ্রান্দে অঞ্চল, সে এক প্রচণ্ড ঝড়ের রাত, ৪২ বছর আগে সেদিন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়, আলাপ করিয়ে দিলেন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন-এর সহপাঠী এবং গুণমুগ্ধ বন্ধু গনসালো মাইয়ারিননা। হাওয়ার দাপটে গাছের ডাল শুয়ে পড়ছে মাটিতে, কান ফাটানো শব্দে ডাব পড়ছে ফুটপাথে, পুরো ফকনারীয় পরিবেশ।
ওর চরিত্রে দুটো বিষয় দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম, তখন সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে তার গল্প “La noche dc tos alcaravanes” অর্থাৎ বাঁকা চোখের রঙিন পাখির রাত। আমার মতে ওটা অসামান্য এক সৃষ্টি, অপরিসীম সম্ভাবনাময়–জানি না কেন সম্ভাবনাকে অপরিসীম বলেছিলাম। তার চরিত্রের দুটি বৈশিষ্ট্য–পাণ্ডিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা অতল, অনিঃশেষ, অভাবনীয় আর লেখা শব্দের গোপন সৌন্দর্যের প্রতি দুর্নিবার প্রেম (কেবলমাত্র এই বিপুল প্রাণবন্ত আগ্রহ দেখা যায় ‘দন কিহোতের মধ্যে যখন তিনি পাণ্ডিত্য এবং অস্ত্র বিষয়ে বক্তৃতা করেন) আর আমার মনে হয়েছিল এক পরিণতমনস্ক পৌরুষের অধিকারী সে, দীপ্তিমান, অসামান্য অব্যর্থ সাধারণ-জ্ঞান–যা কুড়ির যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত অবিচল থেকেছে। গাব্রিয়েল-এর জীবনে দেখা যায় যে কোনো কোনো জিনিসের প্রতি বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্রয় আর বন্ধুত্বের ওপর ভরসা। এমন বন্ধু আর কাউকে আমি পাইনি, আবার এমন লোকও দেখিনি যার মধ্যে ভালোবাসা আর স্থৈর্যের এমন যুগলবন্দি আছে। আমার প্রায়শই মনে হয়েছে গাব্রিয়েল জন্মেছে পরিণত মন নিয়ে, বয়স বাড়েনি, আর কোনোকালে সে বুড়ো হবে না যাবতীয় বস্তুর এক অপরিবর্তনীয় আলোর রূপে বিভোর থাকে সে আর এটা তার সষ্ট চরিত্রের মধ্যে অনায়াসে মিশে যায়।
তার সাহিত্য সম্পর্কে মন্তব্য করা আমার পক্ষে বেশ কঠিন। প্রকাশিত হবার আগে আমি তার সব পাণ্ডুলিপি পড়েছি। আমার মনে হয় ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ এক সম্পূর্ণ সফল উপন্যাস, যদিও এটাকে অনেকে ফাউ বলে মনে করে। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ পড়ার সময় আতঙ্কে আমি বধির হয়ে যাই। আমাদের আমেরিকার অসচেতন সার্বিক জীবনযাপনের প্রতিটি স্তর তিনি ছুঁয়েছেন, এর মধ্যে আছে পুরাণ, গভীর মননশীলতা আর অনুমানের অপরিমেয় শক্তি, এর সবটা বোঝার জন্যে যে শান্ত মনঃসংযোগ প্রয়োজন তা আমি হারিয়ে ফেলি। আমি বিশ্বাস করি ওই গ্রন্থের মধ্যে এমন রত্ন লুকিয়ে আছে, যা নিয়ে এখনও কিছু বলা হয়নি। প্রতিটি প্রজন্ম গ্রন্থটিকে গ্রহণ করবে ভবিতব্য এবং সময়ের আহ্বান হিসেবে আর পরিবর্তন তেমন কিছুই হবে না।
গাব্রিয়েল আর আমি একসঙ্গে অনেক সুখের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ভাগ করে নিয়েছি, আমরা তিনটি মহাদেশ ঘুরেছি একসঙ্গে, ভাগাভাগি করে বই পড়েছি, গান শুনেছি এবং কত বন্ধুর সঙ্গে একসঙ্গে আড্ডা মেরেছি। তার সান্নিধ্য জীবনের অন্ধকার সময়ে এক অবলম্বন। তার নোবেল পাওয়ার আনন্দ একসঙ্গে উপভোগ করেছি, অত্যুৎসাহের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সবসময় অবিচলিত থাকার চেষ্টা করেছি। মদ্যপান করতে করতে মধ্যরাত পার করেছি। মের্সেদেস এবং কারমেন-এর কত স্মৃতি আমাদের একই ভাগ্যের দোসর। সত্যি কথা বলতে কী, কিছুই যেন ঘটেনি। অথবা আরও ভালোভাবে বলা যায় যে সেই ভাগ করা সময়টার এদিক ওদিক হয়নি, এটা ছিল এবং এখনও আছে এক চলমান ভোজসভা হয়ে।
পাদটীকা
১. লেখক আলভারো মুতি গার্সিয়া মার্কেস-এর অন্তুরঙ্গ বন্ধু।
২. মের্সেদেস-গার্সিয়া মার্কেস-এর স্ত্রী।
৩. কারমন সম্ভবত আলভারোর স্ত্রী, যিনি গার্সিয়া মার্কেসকে সাহায্য করেন লেখায়।
.
ভূমিকা
নোবেল পুরস্কার একটি সাহিত্যকর্মের শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হতে পারে না, কিন্তু গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর নোবেলজয়ী উপন্যাস Cien años de soledad / ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়ে প্রায় চার দশকব্যাপী পাঠকের আগ্রহ ধরে রেখেছে এবং সমালোচকদের নিত্যনতুন লেখায় সমৃদ্ধ হচ্ছে। গত অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে স্প্যানিশ ভাষার কোনো উপন্যাস এর ধারে কাছে পৌঁছোত পারেনি এবং পাঠকের এমন বিপুল আগ্রহ দেখা যায়নি। পাঠকের চাহিদার জন্যে সপ্তাহে একটি সংস্করণ পর্যন্ত মুদ্রিত করতে হয়েছে। এটি এক বিরল ঘটনা। ‘ya es un libro clasico’ অর্থাৎ ইতিমধ্যেই এই গ্রন্থ ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদা অর্জন করেছে, বলেছেন লেখক পেদ্রো লুইস বার্সিয়া। অবশ্য চেষ্টারটন্ ঠাট্টা করে বলেছিলেন—‘ক্লাসিক হচ্ছে সেই গ্রন্থ যা লোকে না পড়েও অনেক কিছু বলতে পারে।‘ কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস-এর এই উপন্যাসটির চাহিদা ক্রমবর্ধমান।
পেরু তথা লাতিন আমেরিকার প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক মারিও ভার্গাস ইয়োসা বলেন যে, উপন্যাসটি এমনই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে এর গভীরতার পূর্ণ আধার আয়ত্তে না থাকলেও পাঠক এটি পড়ে রসাস্বাদন করতে পারে। এটির জন্যে ইতিহাস, পূরাণ কিংবা পূর্বসূরিদের রচনার পূর্বপাঠ আবশ্যিক বলে মন হয় না। লাতিন আমেরিকার সাহিত্যধারায় এর তাৎপর্য কী বুঝতে হলে এই উপন্যাসটির জন্মের প্রসঙ্গ অবধারিতভাবে চলে আসে।
ষাটের দশক লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। স্প্যানিশ ভাষার শ্রেষ্ঠতম উপন্যাসগুলি এই সময় আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬২-তে আলেহো কাপেনতিয়ের-এর ‘আলোর শতাব্দী’ এবং কার্লোস ফোয়েন্তেস রচিত ‘আর্তেমিও ক্রুশ-এর মৃত্যু’ প্রকাশিত হল, ১৯৬৩ তে হুলিও কোর্তাসার-এর ‘এক্কাদোক্কা’ এবং মারিও ভার্গাস ইয়োসার ‘শহর আর কুকুর’-এর প্রকাশনার কাজ চলছে, ১৯৬৬ সালে বেরোয় হুয়ান কার্লোস ওনেত্তির ‘শব-পারিষদ’ কাব্রেরা ইনফান্তের ‘তিন বিষণ্ণ বাঘ’, লেসামা লিয়ার ‘স্বর্গ’ আর ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হল ‘নিঃসঙ্গ তার শতবর্ষ’।
অসামান্য সাহিত্যের দীপ্তিময়তার কাল একটি সম্মাননীয় নামে অভিষিক্ত হল—‘বুম’, অথবা বলা হল ‘লাতিন আমেরিকার নতুন উপন্যাস’। কেউ কেউ বললেন যে পুরোনো যুগের লেখা বাতিল হয়ে সৃষ্ট হল কাহিনি নির্মাণের নতুন ধারা, আর অনেকে বললেন যে আন্তর্জাতিক গ্রন্থ প্রকাশনার প্রতিযোগিতায় এই লেখকরা দিবারাত্র পরিশ্রম করে বাজার দখল করলেন। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে লাতিন আমেরিকার পূর্বসূরিদের পথেই এই নতুন ধারার জন্ম। বোর্হেস, মাসেদোনীয় ফের্নানদেস, হোসে মারিয়া আর্গেদাস প্রমুখ লেখকদের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। ওক্তাভিও পাস খুব সুন্দর বলেছেন—’ভবিষ্যতের অন্বেষণ সবসময় শুরু হয় অতীতকে পুনর্জীবিত করে।’
‘বুম’-এর প্রত্যক্ষ প্রভাব ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে আছে কি না তা নিয়ে মতানৈক আছে। কিন্তু একথা মানতেই হবে যে ওই যুগের উপন্যাস নির্মাণের চূড়ান্ত রূপ এটি এবং একই সঙ্গে ভিন্নতর সৃষ্টির অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। এই নতুন ধারার বিরোধীরা যে ‘মাফিয়া’র জগৎ সৃষ্টি করেন তার প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায় না ওই উপন্যাসে। তথাপি আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে ওই দুই ধরনের পরস্পর বিরোধী সাহিত্যের এক চোরা স্রোত গার্সিয়া মার্কেস-এর উপন্যাসে আলতো দোলা দিয়ে যায়। তিনি সচেতনভাবে উপন্যাস ও ছোটোগল্প নির্মাণের নতুন ভাষা ও বিষয়বস্তুর পুরোধা হয়ে ওঠেন।
১৯৫৯ সালে কিউবার বিপ্লব সফল হওয়ার পর লাতিন আমেরিকার সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠল বিপ্লবের সাহিত্য, না, সাহিত্যের বিপ্লব? আরজেনটিনার প্রখ্যাত লেখক হুলিও কোর্তাসার বললেন যে নতুন বিষয় পরিবেশন করার জন্যে ভাবতে হবে নতুন আঙ্গিক নিয়ে, ভাষা নিয়ে। ফলে অনেক সাহিত্য কেবল আঙ্গিকসর্বস্ব হয়ে পড়ল। কিন্তু গার্সিয়া মার্কেস সে পথে হাঁটলেন না। সাহিত্যের বাস্তবতা, অবাস্তবতা নিয়ে অনেক কথা হল। সব তর্কবিতর্ক শোনার পর গার্সিয়া মার্কেস বললেন—’পুলিশ মানুষকে হত্যা করছে বলাটাই শুধু বাস্তবতা নয়, বাস্তবতার মধ্যে আছে পুরাণ, রূপকথা, ইতিহাস–যা জড়িয়ে আছে মানুষের জীবনে এবং সবকিছুকেই গ্রহণ করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা তার লেখায় হয়ে ওঠে পুরাণকথার মত রহস্যময় আর সুপাঠ্য। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে অনায়াসে চলে আসে–সৃষ্টির আনন্দ, আদি পাপ, জীবনের অনন্ত চক্র, অপ্রতিরোধ্য ভবিতব্য, পৃথিবীর অক্ষরেখার মতো বংশলতিকা, হারানো স্বর্গ, সাবেকি এক মা ইত্যাদি।
উপন্যাসের মতোই বাস্তব বেঁচে থাকে, কিন্তু তার প্রকাশ কেবল বদলে যায়, শুধুমাত্র ফটোগ্রাফের নিশ্চল বাস্তবতা হয়ে থাকে না। তার নতুন নতুন বর্ণচ্ছটা আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হতে থাকে–অলীক বাস্তব, বিস্ময়কর বাস্তব, পুরাণে রূপান্তরিত বাস্তব, আশ্চর্য বাস্তব, আরও কত কী চলতে থাকে। এর মধ্যে সাহিত্যে যা বহুল প্রচলিত তা হল জাদু বাস্তবতা। হিসপানিক সাহিত্যধারার দীর্ঘকালব্যাপী পথ পরিক্রমার শেষে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর উপন্যাস নির্মাণে এই নতুন ধারাটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন ওঠে অনিবার্যভাবে যে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেন্স কি কোনো তত্ত্ব উত্থাপন করেন, যেমন কোর্তাসার করেছেন ‘রাইওয়েলা’ (এক্কা দোক্কা) উপন্যাসে? না, তিনি তেমন কিছু উল্লেখ করেননি, তবে তত্ত্ব লুকিয়ে থাকে উপন্যাসের ভেতর। উপন্যাস নির্মাণে প্রথাভঙ্গের পথ শুরু করেন কোতাসার, শেষ করেন গার্সিয়া মার্কেন্স।
‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটি সম্বন্ধে মারিও ভার্গাস ইয়োসা বলেন যে এটি সম্পূর্ণ বাস্তবতা, সম্পূর্ণ উপন্যাস। মাকন্দোয় বৃষ্টি দেখে ইসাবেলার ‘স্বগোতোক্তি’ শীর্ষক গল্পটি থেকে ‘ঝরাপাতা’ উপন্যাস রচনা পর্যন্ত গার্সিয়া মার্কেস বাস্তবতার সাহিত্যরূপ (কল্পনাশ্রয়ী বাস্তবতা) নিয়ে যে প্রক্রিয়া শুরু করেন তার চূড়ান্ত রূপ নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ পূর্বসূরিদের সব উপন্যাসের এক পরিণত বুদ্ধিদীপ্ত সংশ্লেষ পাওয়া যায় এটিতে। তিনি এক অসামান্য ঐশ্বর্যময় জগৎ সৃষ্টি করেন, এই জগৎ এবং উপন্যাস এক সঙ্গেই শেষ হয়ে যায়। মানুষকে নিয়ে ঠাট্টার খেলা হয়ে উঠতে পারে সাহিত্য। সেটা দেখায় আলভারো এক রাতের পার্টিতে। ‘প্রাজ্ঞ কাতালুনিও’র কথায় বাস্তব এবং অবাস্তব জগতের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়।
‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ কি এই পৃথিবীর এক প্রহসন? ‘দন কিহোতে’ যেমন শিভালরি গ্রন্থের অতিশয়োক্তিকে ব্যঙ্গ করে, তেমনই কি সাহিত্য নিয়ে ব্যঙ্গ এই গ্রন্থ? মাকন্দোর চরিত্ররা একে একে সে দেশ ছেড়ে চলে যায়, শুধু থাকে গাব্রিয়েল, ‘একটি ফরাসি পত্রিকার প্রশ্নোত্তর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে উত্তর পাঠায়; এই প্রতিযোগিতায় জেতার পুরস্কার প্যারিস ভ্রমণ।‘ প্রাজ্ঞ কাতালুনিও ‘এক বুদ্ধিজীবী, ধ্রুপদি সাহিত্য পাঠ করেছেন তিনি।‘ লিখিত শব্দের প্রতি তার আবেগ শ্রদ্ধার এবং পাড়ার গল্পকথার প্রতি অশ্রদ্ধা একটা পরিকল্পনা। তার নিজের পাণ্ডুলিপির মধ্যেও এই দ্বিত্ব দেখা যায়। সাহিত্যের ভবিতব্য মানুষের মতো বেশ্যালয়ে হারিয়ে যাওয়া, বলেন প্রাজ্ঞ কাতালুনিও। লিখিত প্রমাণাদির সঙ্গে মানুষ একসূত্রে বাঁধা। প্রাজ্ঞ কাতালুনিও বলেন—’যেদিন মানুষ ভ্রমণ করে ট্রেনের প্রথম শ্রেণিতে আর সাহিত্য যায় মালগাড়িতে সেদিনই পৃথিবীর শেষ।’ এই গ্রন্থপ্রেমিক মাকন্দো ছেড়ে যাবার সময় তার বইগুলি লাগেজে দিতে চাননি এবং সঙ্গে করেই নিয়ে যান। গার্সিয়া মার্কেস এই বিদগ্ধ মানুষটির প্রতি অন্য লোকেদের শ্রদ্ধার ভাবই দেখিয়েছেন। তাঁর পাণ্ডুলিপি অনুবাদ করার জন্যে আলফনসো কাতালান ভাষা শেখে, তাকে দেখে আউরেলিয়ানোর মনে পড়ে জিপসি মেলকিয়াদেস-এর দলিল-দস্তাবেজের কথা। এভাবে জাদুর সঙ্গে সংস্কৃতির এবং সেই সূত্রে সাহিত্যের মিলন ঘটে যায়।
গার্সিয়া মার্কেস সাহিত্যের ভবিতব্যকে তুলনা করেন মানুষের সঙ্গে, মহত্ত্ব অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ রচনার দর্শন অসাধারণ কয়েকটি পক্তির মধ্যে নিহিত আছে। সময়ের প্রচলিত ধারণা ভেঙে যায়, এক কাল্পনিক দেশের মধ্যে প্রবেশ করে পাঠক আর অদ্ভুত যা কিছু ঘটে, জাদুকরী সবকিছুই দৈনন্দিন জীবনের সত্যতা থেকে কম বিশ্বাসযোগ্য নয়।
‘মাকন্দো’ অবশ্যই এক কাল্পনিক নাম, লেখক শৈশবে এই নামের একটি কলা চাষের খামার সম্ভবত দেখেছিলেন, এটি তার জন্মস্থান আরাকাতাকার কাছেই ছিল। রিকার্দো গুইয়োন (Ricards Gullon) নামে সমসাময়িক এক লেখকের মতে মাকান্দা লাতিন আমেরিকার সঙ্গে একাত্মীভূত কোনো স্থান নয়; একটিমাত্র প্রতীকী স্থান নয় মাকন্দো, কারণ উপন্যাসে মিশ্র প্রতাঁকের উল্লেখ আছে। মাকন্দোর মানুষ এই স্থানের ভূচিত্র এবং মাটি সম্পর্কে সচেতন। আসলে মাকন্দোর প্রতিষ্ঠাতা উরসুলা। কারণ এখানে আমাদের এক সন্তানের জন্ম হয়েছে, বলে সে। স্থানটির প্রতিষ্ঠার জন্যে যারা হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার সঙ্গে অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল তারা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক অবস্থা পার হয়, সাধারণভাবে বলা যায় যে ওইখানে ট্রপিক্যাল গাছগাছালির সংখ্যাধিক্য ছিল। আর্দ্রতা এবং নৈঃশব্দের স্বর্গ সে অঞ্চল। এক আবিষ্কারকের মতে হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া সমুদ্রের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে সমুদ্রের সংকেত মেলে একটি বিধ্বস্ত স্পেনীয় জাহাজে। কীভাবে জাহাজটি সেখানে পৌঁছেছে তার উল্লেখ নেই, কিন্তু আমরা ধরে নিতে পারি যে তার কাছাকাছি সমুদ্র আছে আর বাকি কাহিনিটা রহস্যাবৃত থাকে। কয়েকবছর পর হেসে আরকাদিও বোয়েলদিয়া ‘স্পেনীয় জাহাজটি থেকে ১২ কিমি দূরে’ সমুদ্র আবিষ্কার করবে এবং এই কাহিনি বিস্তারের পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠবে। অবশ্য এই আবিষ্কারের এমনকিছু গুরুত্ব দেবে না কেউ। এক নদীর ধারে খোলা মাঠের মধ্যে মাকন্দোর প্রতিষ্ঠা হয়, চারপাশে কাদা আর জল, সমান সমান, অভিযাত্রী প্রতিষ্ঠাতারা তার মধ্যে একবার হারিয়ে যায়, সেখানে আদিবাসীদের বসতি আছে। আমারান এবং আরকাদিও স্প্যানিশ ভাষা শিখতে গিয়ে ‘ইন্দিয়োস’-দের (দক্ষিণ আমেরির ইনডিয়ান) ভাষা ভুলে যাবে। হোসে আরকাদিও স্বপ্ন দেখে যে সেই উষ্ণ অঞ্চলে সে বরফ আবিষ্কার করবে এবং তারপর মাকান্দায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আদিবাসীরা আগন্তুক-প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে বাস করতে থাকে, কিন্তু উপন্যাসে ওদের উপস্থিতি খুব একটা নেই। মাকন্দোয় ভারী বর্ষণ উল্লেখযোগ্য এক চরিত্র। কিন্তু ইচ্ছেশক্তিতে মানুষ সেখানকার ভূচিত্র বদলে দেয়। জাহাজ আসার সুবিধে হবে বলে নদীটাকে ওরা বাড়িয়ে নেয়। রেলপথ, সিনেমা, গ্রামোফোন এমনকি টেলিফোন পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়। এই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংসের বীজ বোনা হয়। মাকন্দোর পতন শুরু হয় প্রথম দিকের সামাজিক সংঘাতের ভেতর দিয়ে। মেমে বোয়েনদিয়ার পুত্রকে বাড়িতে আনার ঘটনাটি মাকন্দোর ওপর চরম আঘাত হানার ঘটনাবলির একটি হিসেবে গণ্য করা হয়। তখন জনগণের অবস্থা এত অনিশ্চিত যে-কোনোলোক কারো ঘরের কোনো কেচ্ছা নিয়ে মাথা ঘামাত না। কলা চাষের সময় একটি ধর্মঘটের কিছু ঘটনার কথা জানতে পারি, যার সূত্রপাত পূর্বেই ঘটেছিল। মাকন্দোর সমৃদ্ধি ও পতন এক বাস্তব স্থানের সাহিত্য-দর্শন। অনেকবারই লেখক বলেছেন–জীবনের শুরু থেকে ছোটোবড়ো যা কিছু দেখেছি সবই আমার জন্মস্থানের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা, আমার দাদু-দিদিমার বাড়িতে মানুষ হওয়ার সুবাদে সবই আমার দেখা। ক্যারিবীয় অঞ্চলের যে-কোনো গ্রামের মতোই ছিল সে গ্রাম, বাড়িটাও আর পাঁচটা বাড়ির মতোই, আমার প্রতিবেশীদের মতই কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং অন্ধ বিশ্বাসপ্রবণ মানুষ ছিলেন, সকাল থেকে রাত আমার কাছে সবই ছিল জাদুর মতো, কী কারণ কেউ জানত না, দিদিমা-দাদু মারা যাবার পর, উইপোকার দাপটে বাড়িটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল আর গ্রামটা হয়ে পড়েছিল বড়ো দুঃখী, নিঃসঙ্গ। এমন বিষণ্ণ গ্রামটি দেখে মনে হত বোধহয় ধ্বংসপ্রবাহ তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে। মাকলো ধ্বংস হয় নিজস্ব অন্তর্দ্বন্দ্বে, কিন্তু উপন্যাসে দায়ী বলা হয়েছে ইয়াঙ্কিদের বাণিজ্যিক উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা, সামাজিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি, কিন্তু বোয়েনদিয়া পরিবারের নিজস্ব দুর্বলতাও কম দায়ী ছিল না। দ্বিতীয় আউরেলিয়ানো ধনী হয়েও প্রগতির পথ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। মেমে-র চোখে দেখানো হয়েছে বিদেশিরা মাকাম্পোর ঐশ্বর্যের কেমন সদ্ব্যাবহার করেছিল। নেতিবাচক ভাষ্য এবং তথ্যে ব্যাপারটা বলা হয়–”লাইনের ধারে ধারে কলার খেত দেখেনি। গ্রিঙ্গোদের সাদা বাড়িগুলো লক্ষ করেনি, গরম আর ধুলোয় ধূসর বাগান দেখেনি, ছোটো প্যান্ট আর নীল ডোরা কাটা জামা পরা মেয়েরা যে গাড়ি বারান্দায় বসে তাস খেলত তাও তার চোখে পড়েনি। ধুলোভরা পথে মালবোঝাই গোরুগাড়ি, সে দেখেনি। সবলা মাছের মত স্বচ্ছ জলে যে তরুণীরা লাফায়ঝাপায় তাদের সে দেখেনি, তাদের সুপুষ্ট স্তনের দিকে চেয়ে ট্রেনযাত্রীরা এক তিক্ত স্বাদ অনুভব করত, মজুরদের নোংরা ঘিঞ্জি দুর্দশাগ্রস্ত বস্তিগুলো তার চোখে পড়েনি, এরই ওপরে পতপত করে উড়ে বেড়াত মাউরিসিও বাবিলোনিয়ার হলুদ প্রজাপতিরা আর যেসব বাড়িতে থাকত সবুজ রঙের শিশু আর ট্রেন চলার সময় গর্ভবতী নারীরা কি বিশ্রী চিৎকার করত। স্থান তো কেবল ল্যান্ডস্কেপ নয়। কিন্তু কেনেথ ক্লার্ক বলেন–মধ্যযুগের মাঠ বলতে কঠোর শ্রমের জায়গা ছাড়া কিছু নয়… এসব জায়গা থেকে অনেক দূরে দেখা যায় উর্বর জমিতে অরণ্য আর কাদাভরা অগভীর জলাভূমি। তিনি আরও বলেন যে প্রকৃতির প্রতি অবিশ্বাস আর তাদের ক্ষমতা যেন এক প্রতীক। “তিন শতাব্দীর বিজ্ঞান চর্চার ধারক আমরা, আমাদের মনেও কিন্তু পার্থিব সব কিছুই আধ্যাত্মিক জগতের কিংবা পবিত্র ইতিহাসের প্রতীকরূপে উপস্থিত হয়। মাকন্দোর ল্যান্ডস্কেপ সম্পর্কে এমন ধারণা খুব স্পষ্ট। লেখক তার প্রায় সমস্ত নিসর্গচিত্রকে প্রতীক রূপেই বর্ণনা করেন। কিন্তু মানুষেরই বাস সেখানে। গার্সিয়া মার্কেস-এর সামাজিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থাকে বৈপরীত্য। মাকন্দোর প্রকৃতি ও মানুষ কল্পনার অবাস্তব ধারণার চেয়ে কিছু বেশি তাৎপর্য বহন করে। ফুলে ফুলে ভরা সমতলে কলা বাগান তৈরি হওয়ার পর স্পেনীয় জাহাজের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়, আরও দূরে বিস্তীর্ণ জলাভূমি।
প্রকৃতি এবং মানুষ ব্যতিরেকে বস্তুর মধ্যেও স্থানের আভাস পাওয়া যায়। ফেরানদার মনে হয় ওসব জিনিসেরও যেন নিজস্ব জীবন আছে। এসব দেখে লেখকের ধন্দ হয়। তিনি এসবের মধ্যে দোয়েলের প্রেতাত্মা) অস্তিত্ব অনুমান করেন। কারণ পুরোনো বাড়িলিতে এদের আবাস। আমরা জানি যে গার্সিয়া মার্কেস তার শৈশবের বাসস্থান সেই প্রাচীন বাড়িটা খুঁজতে চেয়েছিলেন। আত্মজৈবনিক এক সুত্র উপলক্ষে লেখকের নিজের কথায় স্পষ্ট হয় ‘দোয়েশের কীরকম জাদু সেই বাড়িটায় ছিল। আমার দিদিমা বিশালদেহী। আমি তাকে সবসময় দেখতাম শোকের পোশাকে। অদ্ভুত সব গল্পের ঝাপি ছিল তার। তিনি আমার কল্পনাকে উদ্দীপিত করতেন। লেখক গুইয়ান (Gollon) উপন্যাসটি বিশ্লেষণ করার সময় বলেন যে বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায় রূপান্তরটা এই উপন্যাসের স্থানিক পরিচয় বহন করে। কিন্তু এখানে শঙ্খলা বলতে জাদুকরী শঙ্খলা বোঝায়। যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া তার চারপাশে এমন জগৎ তৈরি করে নেয়, যা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন… বিচ্ছিন্নতা এবং নির্জনতার মধ্যে তার একাকিত্ব বেড়ে যায় এবং জাদুকরী পরিমণ্ডল বেষ্টিত এক ঐতিহ্যবাহী স্থানের পরিচয় পাওয়া যায় আর এই আবহে মানুষ সুরক্ষিত বোধ করে এবং অতিপ্রাকৃত জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। জাদু কিন্তু মাকন্দোর সর্বত্র বিরাজমান, সমস্ত অঞ্চলটাই জাদুগ্রস্তু। সময়ের অতি সরল বিন্যাসের এবং ফলে উপন্যাসটি আমাদের বিশ্বাস করিয়ে দেয় যে প্রগতি বাধা পায় জাদুতে এবং মাকন্দোর ধ্বংস ত্বরান্বিত করে ওই জাদু। কিন্তু এ এক যান্ত্রিক ব্যাখ্যা, এমন ব্যাখ্যা উপন্যাসের ঐশ্বর্যময় উদ্দেশ্যটিকে আঘাত করে, এখানে কার্যকারণ এবং প্রতিক্রিয়ার সরলীকৃত মিশ্রণ নেই। উপন্যাসটি পাঠ করে যা প্রথমেই মনে হয় তা হল বিষয়বস্তুটি বড়ো জটিল, কারণ সংঘাত এবং পরিণতি বিভিন্ন স্তরে গড়ে ওঠে, যেখানে সময় ঘটনা বিন্যাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সময়নির্ভর ঘটনার গতি এক সমস্যাও সৃষ্টি করে। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে এটা বিশেষভাবে তাৎপর্যময়, কারণ এখানে সময়ের ব্যাপ্তি একশো বছর। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি যে এতে অনেক বেশি সময়ের কথা বলা হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সময়টা দেখতে হবে। আউলিয়ানো বায়েনদিয়া সময়ের গতি দেখে বিস্মিত হয়, এক বছরে শহরের বয়স বেড়ে যায় এবং তাতে বিস্মিত হয় সে এবং পরক্ষণেই সংলাপ, উরসুলা ফিসফিস করে জিগেস করতই কী আশা করেছিলি?’ আউরেলিয়ানো বলে—’সময় বয়ে যায় ঠিক, ভাবলে এত দ্রুত ভাবতে পারিনি।‘ ‘একশো বছরের’ এক উপলক্ষ উল্লেখ করে দ্বিতীয় আউরেলিয়ানো। লোকজীবনের অঙ্গ লটারি, টিকিট বিক্রির জন্যে সে ঘোষণা করে এখানে ঈশ্বরের হাত আছে, এ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না, কারণ প্রত্যেক শতবর্ষের পর একবারই এটা আসে। আর-একবার রাজনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে ‘কর্তামশায়ের শরৎকাল’ উপন্যাসেও এমন এক ঘোষণা হয়। রক্ষণশীল সরকার ক্যালেন্ডার সংস্কার করছে যাতে প্রত্যেক প্রেসিডেন্টের শাসনকাল একশোবছর স্থায়ী হয়। ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে একশো বছরের জীবন বেশ দীর্ঘ। এই উপন্যাসে একশো বছরের অর্থ সময়ের কোনো নির্দিষ্ট মাপ নয়, ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ এক সিসটেমের ব্যাপ্তির মাপ। বোয়েনদিয়া পরিবারের রাজত্বকাল একটি অংশমাত্র। গুইয়োন (Gollon) এক সময়চক্রের উল্লেখ করে বলেন যে লেখকের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে সময়ের পরিসর।
সময়ের গতির যথেষ্ট ব্যবহার আছে ঘটনাক্রমে। লেখকের ইচ্ছে অনুসারে সময় এগোয়, পেছোয় এবং এই ধারাটি আমরা দেখি যে লোকগাথা এবং লোককাহিনির ঐতিহ্য অনুসারী।
কোনো কোনো লেখক উপন্যাসটিতে সময় প্রসঙ্গে ফনারের প্রভাব লক্ষ করেছেন। গার্সিয়া মার্কেস অবশ্য বলেছেন যে, এই উপন্যাসটি লেখার আগে কখনও ফকনারের লেখা পড়েননি। গার্সিয়া মার্কেস-এর ব্যারোক এবং মিথ-এর অনবদ্য ভঙ্গিতে সময়ের ব্যবহার এমন উচ্চাঙ্গের যে সমকালীন কোনো লেখকের মধ্যে তা দেখা যায় না। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ এর শুরুর পঙক্তিগুলো একবার লক্ষ করা যাক–অনেক বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াড-এর মুখোমুখি কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার মল বিদ্ধ করে এক স্মৃতি, সেই সুদূর এক বিকেলের কথা যেদিন ওর বাবা বরফ চেনাতে নিয়ে গিয়েছিল। এতে সময় বহুমাত্রিক, বর্তমান (ফায়ারিং স্কোয়াড-এর সামনে), ভবিষ্যৎ (অনেক বছর পর) এবং এক অতীত (সেই সুদূর বিকেল) যাতে পারিবারিক এক স্মৃতির চিত্র পাওয়া যায়। সময়ের গতি বদলাতে থাকে। সময়ের এমন উল্লেখ দেখে কেউ কেউ বলেছেন যে, যেন পুরাণের কোনো কল্পলোকে পাঠক গিয়ে ভাসতে থাকেন হাওয়ার পিঠে চেপে। সময়ের গোলকধাঁধা প্রথমেই শুরু হয়ে যায়। গ্রামের পত্তন থেকে মেলকিয়ালেস-এর আবির্ভাব এবং বস্তুর পরিবর্তন পর্যন্ত একটা সময়। সময়, অভ্যন্তরীণ ইতিহাস এবং স্মৃতি হয়ে ওঠে। মাকলন্দাবাসীর স্মৃতি লোপ সমস্ত। বস্তুজগৎ সম্পর্কে বিভ্রম সৃষ্টি করে। অনিন্দ্রার মহামারীর ফলে বিলুপ্ত স্মৃতি অতীতবিহীন এক নির্বুদ্ধিতার ফসল। গার্সিয়া মার্কেস ভাঙা পৃথিবীর হারিয়ে যাওয়া সময়ের এক মহাকাব্য রচনা করনে। তার প্রকাশভঙ্গি প্রাণবন্ত, অনবদ্য।
অতীতের কলঙ্কজনক অধ্যায় সময় কমিয়ে দিতে পারে। কলা কোম্পানির শ্রমিকদের ধর্মঘটে মাকলন্দর কর্তৃপক্ষ অত্যাচার করে না। ইতিহাস বিকৃত করে ঐতিহাসিক কিন্তু হোসে আরকাদিও দ্বিতীয়র ব্যক্তিগত স্মৃতি জাগরুক, যাকে পাগল বলা হয় সে আদতে বুদ্ধিমান। আর যমজ হওয়ার ঘটনা কাকতালীয়–সবকিছু আবিষ্কৃত হয় মার্চ মাসে এবং সোমবার। বসন্তকাল, কাজের সময়। জাদুবিদ্যা অনেক পরিবর্তন ঘটায় এবং আমরা বুঝতে পারি যে “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ সেইসব অতিনাটকীয় ঘটনার বিবরণমাত্র। মাকান্দার সময় চক্রাকারে ঘোরে, মিথ্যা চক্রের আবর্তন। আমারানতার পুত্র আউরেলিয়ানো, সে এক আউরেলিয়ানোর পুত্রও বটে, তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি করার জন্যই পূর্বনির্ধারিত। তার নাম হবে আউরলিয়ানো বোয়েনদিয়া এবং সে বত্রিশটি গৃহযুদ্ধে জয়ী হবে। এক্ষেত্রে ইতিহাসের নবালত্তি উলটোভাবে ঘটতে পারত (আয়নায় যেমন হয়)।কিন্তু সমস্ত রাজবংশের মতোই বোয়েনদিয়া পরিবারের ভবিষ্যৎ পূর্বনির্ধারিত, যেন এটাই ভবিতব্য। প্রথম বংশধারা গাছের তলায় আটকে থাকে আর শেষটা খেয়ে ফেলে পিঁপড়ে’। এটা বর্তমান, ইতিহাস হয়ে ওঠেনি। সমস্ত রাজবংশের উত্থান ও পতন আছে, বাস্তববাদী লেখকরা তার বন্দনায় জন্ম আর পতনের কথা লেখেন।
‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে কালচক্র ধরা পড়ে নামের পুনরাবৃত্তিতে, আকস্মিক ঘটনায় নয়। চরিত্রের প্রণাবলী বংশধারায় লালিত। “বাবাদের পাগলামো এসেছে সন্তানদের মধ্যে কথাটা বলে উরসুলা। উৰ্ত্তরাধিকার প্রথা যথার্থ প্রকাশ পায় অজাচার-আতঙ্কে, যার ফলে সন্তানরা শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শেষ উত্তরাধিকারী ব্যতীত এই অঘটন ঘটে না। এও ঘটে তাদের ইচ্ছেয়। লেখক বৈপরীত্য নিয়ে খেলা করেন। অজাচার-ভীতি বেশ বাড়িয়ে বলা হয়। তুতো ভাইবোনের বিয়ে ইয়ানার জন্ম দেয়। মিথ’-এর পরিসরে সময়ও থেমে যেতে পারে। গার্সিয়া মার্কেস মনস্তত্ত্বের সদ্ব্যবহার করেন যখন কল্পনা করা হয় যে সময় এগিয়ে গেছে। এই ভাবে এতদিনের প্রত্যাশিত সাক্ষাৎকার ঘটে, যার জন্যে দুজনই প্রশ্ন তৈরি করে রেখেছিল; এমনকি উত্তরগুলো পূর্বপরিচিত, আবার হয়ে গেল চিরকালের দৈনন্দিন কথাবার্তা। উরসুলা এবং আউরেলিয়ানো এক আশ্চর্য পরিবেশে বাস করে যদিও ওটা অভ্যস্ত জীবন, আগে থেকে নির্ধারিত এক ছবি (prevista) এদিক থেকে দেখলে আমরা এই চরিত্র দুটিকে determinista-naturalista অর্থাৎ প্রকৃতির ইচ্ছেয় নিয়ন্ত্রিত ভাবতেই পারি। উপন্যাসটির চরিত্রাবলী ॥atun-tragico ‘ট্রাজিক ভাগ্যের শিকার। দূরত্বের জন্যে উপন্যাসটিকে বলা হয়েছে (oliardesco groliardic (ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিদ্রুপাত্মক রচনা) এবং কাব্যময়। লুকোনো এক অর্থ আছে এর মধ্যে, সেটি হল যে মানুষ তার নিজের বা অপরের তৈরি করা ভবিতব্য অতিক্রম করতে পারে না।
.
জাদু এবং অদ্ভুতের জগৎ
উপন্যাসটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জাদু এবং অদ্ভুতের খেলা। ইউরোপের রেনেসাস মধ্যযুগের অন্ধকার ভেদ করে যুক্তির আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে চেয়েছিল। সেরভানতে তাঁর ‘দন কিহোতে’, উপন্যাসে দেখান যে মিথ্যে ফেলগুলোর সঙ্গে বিবাহ হচ্ছে পীঠকের যুক্তির, অসম্ভব কথা লেখা হয়েছে… অবাক হোন, বন্ধ করুন, নিন্দে করুন, উপভোগ করুন। জাদুর আশ্চর্য জগৎ লোকাঁচারের হাজারো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং আজও তা টিকে আছে প্রধানত গ্রামীণ জীবনধারায়। ঝাড়ফুক, ওঝাগিরি, ভবিষ্যদ্বাণী মানুষের সংস্কৃতির অঙ্গ, যা মধ্যযুগে গজিয়ে উঠেছিল এবং এর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ইনকুইজিশন। জাদুর অন্ধকার জগৎ জুড়ে রয়েছে নানাভাবে হিসপানিক সাহিত্যে, আদিবাসীদের ‘মিথ’-এর সঙ্গে লাতিন আমেরিকার মেস্তিসো’ (আদিবাসী ও বহিরাগত ইউরোপীয় রক্তেরসংকর) সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে দিব্যি টিকে রয়েছে। নতুন সাহিত্যধারায় তার অনুষঙ্গ এসেছে। আলেহো কার্পেনতিয়ের, মিগেল আনহেল আতুরিয়াস, হোর্হে লুইস বোর্হেস-প্রমুখ দিকপাল সাহিত্য স্রষ্টারা ঐতিহ্যানুসারী এই জাদুজগতের প্রভাবের সদ্ব্যবহার করেছেন। নাগরিক জীবনেও এর প্রভাব দেখেছেন হুলিও কোর্তাসার। কিন্তু গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সচেতনভাবে জাদুর নতুন অর্থ আবিষ্কার করেছেন। প্রথম দিকের পাতায় ‘ম্যাসিডোনিয়ার প্রাজ্ঞ অপরসায়নবিদ’ এর উল্লেখ ছাড়াও অপরসায়ন এবং তার মিথ’ প্রসঙ্গত এসেছে এই উপন্যাসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অপরসায়নের প্রভাবে মেলকিয়াদে এর যৌবন ফিরে আসে, জরা লুপ্ত হয়। এই চোখধাঁধানো প্রতিক্রিয়াকে ব্যঙ্গ করেন লেখক। মেলকিয়াদে বাঁধানো দাঁত বের করে বিস্ময়বিমুগ্ধ দর্শকদের দেখিয়ে বাজিমাত করে। কোনো কোনো জায়গায় জাদু শুধুমাত্র লোক ঠকানো খেলা। এই প্রসঙ্গে নস্ত্রাদামুসের উল্লেখ আমাদের অবাক করে। এই কাহিনির অন্যতম মুখ্য চরিত্র উরসুলা বাস্তব জগতের সঙ্গে যুক্ত, জাদু কিংবা ব্যর্থ আবিষ্কারে তার তেমন আগ্রহ নেই, অপরসায়নবিদদের সঙ্গে সত্যিকারের বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব সে বেশ বুঝতে পারে যখন তার স্বামী বলে–”বিজ্ঞানের কোন আশীর্বাদ না পেয়ে আমাদের এখানেই পচে মরতে হবে। জীবিত মানুষদের পাশাপাশি মৃতরাও হাজির হয়, যেমন হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার তলোয়ারের আঘাতে মৃত দেনসিও আগিলারের উপস্থিতি। এরা ভূত নয়,(দৃশ্যটির রোমান্টিক চরিত্র স্মরণীয়) এসব মৃতরা রাতেও যেমন তেমনি দিনের আলোতেও আবির্ভূত হয়, কথা বলে। প্রদেনসিও’র আবির্ভাব ওদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। আউরেলিয়ানো অপরসায়ন বিদ্যার এক সূক্ষ্ম অনুভব লাভ করে। সেইজন্যে মৃতদের আসা যাওয়া, জীবিত মানুষদের মধ্যে ওদের মিশে যাওয়া তাকে বিস্মিত করে না। মেলকিয়াদেস-এর পুনরাবির্ভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। চরিত্রগুলো যখন যুক্তিহীনতা নিয়ে অভিযোগ করে তখন আমরা জাদুকরী পরিমণ্ডল দেখতে পাই। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া লাতিন ভাষায় কথা বলে এক ভাষাবিদের সঙ্গে। ধর্মীয় প্রসঙ্গে Lo Maravillo/ আশ্চর্য ঘটনা মনে হতেই পারে যখন পাদ্রি নিকানোর আকাশের দিকে উঠে যাওয়ার ক্ষমতা প্রদর্শন করে।কিন্তু বাস্তবও কম জাদুকরি নয়। আউরেলিয়ানো ত্রিতে যে ভূত দেখতে পায় সেটা রেবেকা ছাড়া অন্য কেউ নয়। ভবঘুরে ইহুদি শয়তানের রূপ ধরে আসে এবং তার উপদেশাবলীও জাদুকরি।
এই উপন্যাসটিতে গার্সিয়া মার্কেস দেখান যে, যা কিছু অদ্ভুত, যা আমাদের অবাক করে সবই দৈনন্দিন জীবনেরই অন্তর্ভুক্ত এবং প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি অতিবাস্তবকে কাব্যময় সত্যরূপে পরিবেশন করেন। দৈনন্দিনতার সঙ্গে কবিতার মিলন ঘটানোই কাব্যের উদ্দেশ্য, ভাষার জাদু আছে বলে গদ্যতেও সেই স্বাদ পাওয়া যায়।
.
লোককথা, লোকাচার
পাঠক উপন্যাসটি পাঠ করার পর ভাবেন যে এটা ভিন্ন প্রকৃতির। এই ভিন্নতা শুধুমাত্র সম্পূর্ণতার জন্যে নয়, লিখিত ভাষায় এযাবৎ যত সাহিত্য রচিত হয়েছে তার চাইতে বাড়তি কিছু আছে এতে, যার জন্যে এই পার্থক্য ধরা যায়। Cien Anos de soledad/ “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটির বেশ কিছু সূত্র এসেছে লোককথা থেকে, যদিও তা বুদ্ধিসঞ্জাত এবং সঠিকভাবে ব্যবহৃত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কিছু চরিত্র এবং ঘটনা প্রথমে এসে উধাও হয়ে যায়, কিন্তু পরে তাদের ভূমিকা স্পষ্ট বোঝা যায়। কথক হিসেবে গার্সিয়া মার্কেস দেবার মতে; তার জগৎ কোথায় শুরু এবং কোখায় শেষ জানেন তিনি, কিন্তু পাঠকদের অংশবিশেষ বলে চলে যান অন্যত্র, পরে একটা সুতো দিয়ে গল্পের মালাটি সম্পূর্ণ করেন। ডিটেকটিভ কাহিনিতে এই প্রকরণটি ব্যবহৃত হয়। Cronica de una nuerte aunciada/পূর্বঘোষিত মৃত্যুর সমাচার’ উপন্যাসে এই আঙ্গিক সফলভাবে প্রয়োগ করেন লেখক। লোককথাকার প্রাচীন কাহিনির সঙ্গে নতুন গল্প বলে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন, সামগ্রিক স্মৃতি’-কে তারা ধরে রাখেন। গল্প, কবিতা, গান যা তারা ব্যবহার করেন সবই হারিয়ে যাওয়ার পর গবেষণাপত্র বা লেখার সাহায্যে উঠে আসে। এই কথকরা প্রাচীন কাহিনি, বীরত্বের গল্প ইত্যাদি বিস্মৃতির অন্ধকারে ডুবে যেতে দেন না। আফ্রিকার লোককথা হারিয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেই মহাদেশটির সাহিত্য। উন্নত দেশগুলোতে এইসব কাহিনি পরে উঠে আসে নানাভাবে নভেলে, সংবাদপত্রে অথবা নাটকে। মাকন্দোর এক বড়ো ট্রাজেডি স্মৃতিভ্রংশত। ওই মাকন্দোর কথা ভুলে গিয়েছিল পাখিরা, গরম আর ধুলোয় শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল কিংবা বিস্মৃতির অতলে ডুবে যাওয়া গ্রামে। মেলকিয়াসে এর সঙ্গে স্মৃতি ফিরে আসে। সে মৃত্যুরহস্য জানে এবং মান্দায় বাস করার সিদ্ধান্ত নেয়, কারণ সেখানে তখনও কেউ মৃত্যু দেখেনি।
কল্পনার ভেতর দিয়ে ওরা মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করে লোককথার জানা পথ ধরে যেমন হাজার এক রাতের গল্প। এর পরিচয় পাওয়া যায় যখন সাহারাজাদ প্রতি রাতে একটা করে নতুন গল্প বানায়। প্রাচ্যের যেসব গল্প ধারাবাহিক জীবনের কথা বলে তার প্রভাব আছে ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসে, হাজার এক রাতের গল্প আছে জাদুর জগৎ, এখানেও এসেছে নতুন জিপসি এবং আরও সঠিকভাবে cl cofre magico অর্থাৎ জাদুবাক্স। মাকলো একটি জাদুগ্রস্ত স্থান। এখানে ঘটে চলে অন্দুতের খেলা, প্রকৃতিতে তার ব্যাখ্যা মেলে না, অতিলৌকিকতা আসে ধর্মীয় প্রসঙ্গে। লেখক সব উপাদানই সংগ্রহ করেছেন লোককথা থেকে। শেষের দিকে ঐতিহ্য অনুসারী প্রভাব দেখা যায় যখন লড়াকু মোরগের প্রসঙ্গে রসাশ্রিত গল্প বলা হয় আর ওদের কথাবার্তা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা। লোকগল্পের প্রভাব পাই Francisco el hombre / মদ্দা ফ্রানসিসকো চরিত্রে। এ দৃশ্য স্মরণ করায় অন্ধ গায়কের কথা, লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে এমন গল্প চালু ছিল। মেক্সিকোর corrido (কোররিদো) গান থেকে আরজেনটিনার Gaucho (গাউচো)-দের গান–সবই লোক জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
অতিশয়োক্তি এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য, এoliardesco সাহিত্যে প্রায়শই এটা দেখা যায়, অর্থহীন গান আর কার্নিভালের কবিতা–সবই অতিকথন। অতিরঞ্জন তো পরিশীলিত সাহিত্যের অঙ্গ, xpressionist সাহিত্যে এর ছড়াছড়ি, কিন্তু আদিম শিল্পরীতিতেও এর অনেক দুষ্টান্ত আছে। কতকগুলো চরিত্রের নাম যেমন হেরিনেলদো মার্কেস সম্ভবত হিস্পানিক লোকগাথার অবদান, এমন গাথা লাতিন আমেরিকায় বহুল প্রচলিত। একটি চরিত্র নিজের সমাধি দেখতে পায়–Expronceda-রচিত ‘সালামাঙ্কার ছাত্র’ শীর্ষক উপন্যাসে। এটি লোকসাহিত্যের অন্তর্গত। Fernanda del Carpio নামটির সঙ্গে মিল আছে এক গাথার নায়ক Bernardo del Carpioর সঙ্গে। এই প্রাচীন কাহিনির নায়কের নাম ‘দন কিহোতে’ উপন্যাসেও পাওয়া যায়। উপকাহিনিগুলি মূল কাহিনির বিস্তারে সাহায্য করে। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার ভারী দেহ টানতে ‘সাতজন পুরুষ’ লাগে, বদল ঘটে চরিত্র এবং আবহাওয়ায়–এইসবের মধ্যে অতিকথন আছে। মেলকিয়াদে-এর ত্বক ঢাকা পড়ে যায় কচি শ্যাওলায়, বাড়াবাড়ি হিংসায়, যুদ্ধবাজ আউরেলিয়ানো বায়েনদিয়াকে ‘বত্রিশটি যুদ্ধে যোগ দিতে হয়। নারীর রূপবর্ণনায় অতিশয়োক্তি–রেমেদিওস মর্তলোকের মানুষ ন্য, ট্রপিক্যাল বৃষ্টি নিয়ে বাড়াবাড়ি–চারবছর এগারো মাস দুদিন ধরে চলে বৃষ্টিপাত; এমন সংখ্যার ধারণাটা আগেই এসেছে পরাবাস্তববাদী লেখায়। আমারানতা উরসুলা এবং আউরেলিয়ানোর দেহজ প্রেম কোনো বাঁধন মানে না, তার বর্ণনায় লেখক বলেন–un estado enfebrecido durante la cual destruyen cuanto los rodea/’HA ARTIGO এক অবস্থা যে ওরা চারপাশের সব পার্থিব বস্তু ধ্বংস করে ফেলে।
অনেক কাহিনির সমাহার এই উপন্যাস। এক জটিল পরিবারের গোলকধাঁধায় কথক হারিয়ে যায়, জাদুর এক বিচিত্র জগৎ, এখানে সবকিছুই সম্ভব। সবকিছুর সমন্বয় ঘটানোর জন্যে প্রয়োজন এমন এক কথক, যার স্মৃতিশক্তি অসীম। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সময় সচেতন বলে মাকন্দোর সম্পূর্ণ গল্পটি বলতে পারেন। গোড়া থেকে শেষ যে বিচিত্র অবস্থায় চরিত্রগুলোর আনাগোনা তা লেখকের কল্পনায় ছবির মতো আঁকা। সময়, অদ্ভুত পরিস্থিতি, সামগ্রিক স্মৃতি–সবই লেখকের নখদর্পণে। গল্প বলার সব উপাদান একত্র হয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। লেখকেরও মনে হয় কোনো চরিত্র বোধ হয় হারিয়ে গেল, তার মনোমতোই এটা ঘটে। কিন্তু পরে তার আবির্ভাব ঘটে এবং নতুন করে তাকে আমরা আবিষ্কার করি। চেনা মাকন্দোর পরিমণ্ডল ছেড়ে কেউ বেরোতে পারে না। বেরোলে কী অবস্থা হয় দেখা যায় যখন হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়ার কিছু পরিকল্পনা নিয়ে পত্রবাহক যাত্রা করেছিল। পথ হারিয়ে সে যথাসময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না আর অনেক বছর কর্তৃপক্ষের উত্তরের আশায় ছিল। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া।
কলম্বিয়ার লোককথা জানা থাকায় লেখকসবকিছুই তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসহ উপন্যাসে রাখতে পেরেছেন। এক সমালোচকের মতে সাংবাদিকতার পেশায় ছিলেন বলে লেখকের লোককাহিনি জানা সম্ভব হয়েছিল, তার উপন্যাসে খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে লোককথার প্রভাব। ঐতিহ্যের প্রতি প্রগাঢ় টান থাকায় তার লেখায় স্পেনীয় মিথ আর আমেরিকি বিবেকের বন্ধন গড়ে ওঠে, একদিকে স্বর্ণ অন্বেষণ, ‘এল দোরাদো, স্পেনীয় জাহাজ। আর অন্যদিকে গ্রামীণ বিশ্বাস আর পুরাতন সংস্কার সব মিলেমিশে একাকার এই উপন্যাসে।
.
ধর্মীয় ও সাহিত্য সম্পর্কিত মৌল উপাদান
বিবিধ সাহিত্যধারায় লালিত এই উপন্যাস। প্রথম সূত্র বাইবেল, ‘পার্থিব স্বর্গের’ মিথ থেকে মাকন্দোর সৃষ্টি যেখানে মৃত্যু বলে কিছু জানত না কেউ। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া সর্বদা বিস্মরণের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে বস্তুর নামকরণ করে। সে বাইবেল বর্ণিত কর্তাব্যক্তি, patriarch. মাকন্দোর এক নির্বাচিত গ্রাম, অন্য গ্রাম বা জনপদ থেকে ভিন্ন, অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাসও আলদা। মধ্যযুগ কিংবা তার আগের লোককথায় কিংবা ইতিহাসে সৃষ্টিসংক্রান্ত ও অতি সম্পর্কিত যে বিবরণ পাওয়া যায় তা থেকে ভিন্ন চরিত্রের এক গ্রাম এটি। ঈশ্বরের শক্তির প্রতীক পাদ্রিবাবা নিকানোর ওপরে উঠে যাওয়ার ঘটনা, বিকারগ্রস্ত পাদ্রিবাবা আনতানিও ইসাবেল-এর মুরগির ডিম ফেটে বাচ্চা বেরোনোর কথা ও শয়তান সম্বন্ধে মন্তব্য ইত্যাদি ধর্মীয় বিশ্বাসের উপকরণ অনেক আছে নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে। ক্যাথলিক আচার ও উপলক্ষ যেমন ‘ছাইয়ের বুধবার’, কর্নেল বোয়েনদিয়ার সন্তানদের চেনার উপায়, “ছাইয়ের ক্রস’ ইত্যাদি ধর্মীয় উপকরণ। মেমের ছেলেকে পাওয়া যায় এক ভাসমান জুড়িতে যেমন মোজেসকে পাওয়া গিয়েছিল। প্রচুর ভবিষ্যদ্বাণী, মৃত্যু বা অন্য ঘটনার সংকেত ইত্যাদি বাইবেল থেকে সংগৃহীত। জনপ্রিয় ধর্মানুষ্ঠান যার মাধ্যমে অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করা যায় এবং মানবিক কাজকর্মের উন্নতি ঘটে এমন সংস্কারও এই উপন্যাসে এক ভূমিকা পালন করে। ‘সুন্দরী’ রেমেদিওস-এর স্বর্গারোহণের সঙ্গে তুলনীয় Asencion de la virgen/ ‘কুমারীর স্বর্গারোহণ’ (কুমারী মারি)। প্রধান নারীচরিত্রের নাম উরসুলা, তার মৃত্যু ঘটে ‘শুভ বৃহস্পতিবার’ পাদ্রি নিকানোর পরিচালিত সমবেত প্রার্থনার অভুক্ত ধর্মীয় আচার-আচরণের মধ্যে জাদু আছে, ফেরনানদার মেমেকে উদ্ধার করা এবং তাকে কনভেন্টে দিয়ে আসার ঘটনায় লেখক জাদুবাস্তবের আশ্রয় নেন। ধর্ম আর অলৌকিতা মিশে যায়।
‘নিসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটি সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘আমাদিস’ এবং ‘শ্বেতাঙ্গ তিরানতের’ প্রভাব আছে। মারিও ভার্গাস ইয়োসা এই বিষয়টায় বেশ জোর দিয়েছেন। ‘আমাদিস’-এ বাস্তবের সঙ্গে মিশেছে আশ্চর্যের খেলা। তিনি বলেন ‘বোয়েনদিয়া পরিবারের ইতিহাসে (আমাদিস এবং শ্বেতাঙ্গ তিরানতের মতো) বাস্তবের নানা স্তর রয়েছে ব্যক্তিগত এবং সামগ্রিক, পুরাণ এবং ইতিহাস, সামাজিক এবং মনস্তাত্ত্বিক, দৈনন্দিন এবং ‘মিথ’ বশত এবং ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসের অন্যতম উদ্দেশ্য গল্প বলার এক শতাব্দীর পুরোনো পচাগলা পথ ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেউপন্যাসকে অপ্রত্যাশিত পুনর্জীবন দান করা, মধ্যযুগের দেবতাদের পরিত্যাগ করা উচ্চাকাঙ্ক্ষাভরা এক কাঠামো তৈরি করে; সব বাস্তবতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ‘ফিকশনের অন্তর্ভুক্ত করা মানুষের জীবনে বা কল্পনায়, যা প্রবাহিত হয়ে চলে। “আমাদিস’-এর শৈলী ভিন্ন, ওটার সঙ্গে তুলনা চলে না এই উপন্যাসটির নির্মাণের আঙ্গিক। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস যে Goliardic ক্ষমতা দেখান তা ভ্রাম্যমাণ নাইট-এর কাহিনিকারদের ছিল না। মাকন্দোর শেষ জীবিত মানুষ গাব্রিয়েল খুব বই চরিত্র, সে “রিসে যায় বদল করে পরার মত দগ্রস্থ পোশাক, এক জোড়া জুতো আর Rahelais-এর রচনা সমগ্র নিয়ে। গার্সিয়া মার্কেস-এর প্যারোডি সেরভানতে অপেক্ষা Rabelais-এর কাছাকাছি।তিনি বলেন Rabelais প্যারিসে নিয়ে গিয়েছিল Daaniel Defoe রচিত ‘বছরভর প্লেগের ডায়েরি’,এর তেমন গুরত্ব নেই এবং বিকল্পটি সমালোচকদের ফাঁদে ফেলে। বরঞ্চ Rabelais–প্রসঙ্গ যথাযথ এবং Defoe-র নামটা গার্সিয়া মার্কেস-এর ভুল সম্ভবত। Rabelais-এর নাম প্রাসঙ্গিক কারণ নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’-এর পেছনে আছে তার অনুপ্রেরণা। এই প্রসঙ্গটি আলোচনা করব। পরাবাস্তববাদীরা যাকে পুরোধা বলে মানেন সেই Rabelais-এর রচনা সহজবোধ্য নয়। Rabelais-এর মতো গার্সিয়া মার্কেন্স খুব সহজে জনপ্রিয়তা লাভ করেন, যা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের সমস্ত বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। জনপ্রিয়তার কারণ তাদের সাহিত্য নির্মাণের শৈলী। গার্সিয়া মার্কেস-এর রচনায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাস্তবের কার্নিভাল-রূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। আউরেলিয়ানোর ইতিহাস আবিষ্কারের চেষ্টা সত্য সন্ধানের মত দুরুহ এক কাজ। এই উপন্যাসে আমরা সত্যের রূপ প্রত্যক্ষ করার অবিরাম চেষ্টা লক্ষ করি। দিন কিহোতের মধ্যে ঐতিহ্য অনুসারী সত্য উদ্ঘাটনের খেলা দেখা যায়। লেখক তার আশ্চর্য কল্পনার দ্বারা স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের ভেদরেখা মুছে ফেলেন। নান্দনিক তরে নতুন ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে এটা সম্ভব হয় এবং পরাববাদ সম্বন্ধে আধুনিক মনে পছন্দের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। সৃজনশীলতার মুক্তির অভিযান আমরা পেরিয়ে এসেছি। আসরিয়াল থেকে কোর্তাসার সবাই লাতিন আমেরিকার উপন্যাসে পরাবাস্তবতার বিবর্তন-ধারা অনুসরণ করেছেন। আধ্যাত্মিক ভাবধারা অনুসরণ করেও বুর্জোয়া বাস্তবতার দেউলিয়াপনা ধরা পড়ে এবং তার ফলেই জন্ম নেয় অন্য এক ধারার উপন্যাস যার মধ্যে মধ্যযুগীয় ‘চারণকবির স্বাধীনতা দেখা যায় (Libertad Juglaresca)। গার্সিয়া মার্কেস-এর সময় বাস্তবতা বলতে নিত্যদিনের জীবনের খুঁটিনাটির বিবরণ বোঝাত যেন নিত্যকার চিত্রলিপি অঙ্কন করাই সাহিত্য এবং সেখান থেকে Rabelais-এর শরীরশিল্প অভিমুখে যাত্রা। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ শরীর শিল্পকে অতিরঞ্জিত করে, প্রেম সার্থক হয় এক জটিল প্রতিক্রিয়ায় যখন পিতাদের হাড়গুলো ক্লক ব্লক শব্দ করে।
কার্নিভালের জনপ্রিয় উৎসব এই উপন্যাসে দেখা যায়, এই কার্নিভালের পাগলামো উচ্চগ্রামে পৌঁছোয় যখন আউরেলিয়ানো সেগুনদো (দ্বিতীয় আউরেলিয়ানো) স্বপ্নে দেখে সে বাঘের ছদ্মবেশ নিয়ে মানুষের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছে, নাক ডাকছে, তখন জলাভূমি থেকে ছদ্মবেশধারী একদল লোক এমন অপরূপ এক সুন্দরীকে নিয়ে আসছে, যা স্বপ্নেও দেখা যায় না‘। উৎসবের পরিণতি বিয়োগান্ত, কিন্তু গোলমালের মধ্যেও কার্নিভালের সব উপকরণই ছিল, “প্লাজায় জড়ো হয় সবাই, মৃত ও আহতদের মধ্যে নজন ক্লাউন, চারজন কলম্বিয়ার মেয়ে, তাসের রাজা সতেরো জন, একটা শয়তান, তিনজন যন্ত্রশিল্পী, দুজন করে ফরাসি এবং তিনজন জাপানি সম্রাজ্ঞী রতিক্রীড়ার মধ্যেও মুখোশের খেলা, মেয়েটি আউরেলিয়ানোর পালিতা, পুতুল খেলছিল, ‘ওদের চোখে ক্লাউনের রং, লাল ঠোঁট, তুর্কিদের মতো গোঁফ, চোখের পাতায় কালো পেন্সিলের (আইব্রাউ) রং, টাইপরা, মাথায় রঙিন টুপি। বাখতিন এক অচেনা কার্নিভালের কথা বলেছেন, যেখানে এক ‘ধর্ষিতা গোরুকে নানারঙের ফিতে দিয়ে সাজানো হয়। D.H, Lawrence-এর ‘লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক-এর একটি দৃশ্যের প্যারোডি “ বলে গণ্য হতে পারে। ওই গ্রন্থটিতে এমন একটি দৃশ্য আছে। আউরেলিয়ানো সেগুনদোর হজমশক্তির প্রতিযোগিতা কার্নিভালের অন্তর্গত। আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার সঙ্গে মসকোতের বিবাহোৎসকের মাধ্যমে উপলক্ষটি শুধু নয়, আগের রীতিনীতিকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে।
সাহিত্যের সূত্র ধরে কিছু মিথ’ আসে, যেমন, সাইবেন কিংবা আমারাতা মৃত্যুর অপেক্ষায় চারবছর ধরে শবাচ্ছাদনবস্ত্র বোনে দুটোই এসেছে ‘ওডিসি থেকে। হোসে আরকাদিও বোয়েন দিয়া নতুন আবিষ্কারের নেশায় পাগলামো করে আর কত অচেনা মানুষ অবাস্তব কাজকর্ম করে, যেমন অপরসায়ন, পার্চমেন্ট ইত্যাদি। দন কিহোতের মিথ এখানে যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শৈশব যেন মানসিকতায় অসম্পূর্ণ’–এই ধারণা আসে রুশোর। প্রথম গ্রন্থ ‘এমিল থেকে এবং “উদাসীন রাত্রি কাদালসো থেকে যার মধ্যে মনুষ্যজীবনের। শুরুর কথা বলা হয় এইভাবে প্রথম বছরগুলো…অসুখ, রুগ্নতা, নির্বুদ্ধিতা, বিরক্তি, গা ঘিনঘিনে…। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে বেহেসীয় ভাবনার ছড়াছড়ি দেখতে পাই। হোসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া এবং উরসুলার পরিবারের উৎপত্তির সঙ্গে মিল আছে বোর্হেস এর গল্পে। আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার জীবনচক্রের সংক্ষিপ্তসার বোর্হেস-এর কিছু গল্পের ছক গ্রহণ করেছে, বিশেষত সময় এবং ব্যর্থতার কথায়, তার নামে রাস্তা তৈরি করার মধ্যে মরণোত্তর খ্যাতি এবং পরিহাসে। গল্প বলার কাঠামোর সঙ্গে বোর্সে-এর নাম এসে যায়, যেমন, প্রতিবিম্ব নিয়ে খেলা (বাস্তব প্রতিবিম্বে ধরা পড়ে। যার বহু ব্যবহার আছে, আবার একই রকম ঘরের গোলকধাঁধা তারই আবিষ্কার।
আলেহা কারপেনতিয়ের-এরনামটি উল্লেখ করা উচিত। তার ‘আলোর শতাব্দী’ উপন্যাসের নায়ক ভিকতাউগেস-এর বীরত্বের সঙ্গে কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার সাদৃশ্য আছে। পুলিশের অত্যাচার; সন্ত্রাস এবং স্বেচ্ছাচারের একটি দৃষ্টান্তস্বরূপ এক দৃশ্য আছে নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে, যখন সাত বছরের এক বালক তার পানীয় নিয়ে যাবার সময় এক পুলিশের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ইউনিফর্মে পানীয়ের সামান্য লেগে যায়, এই অপরাধে তাকে টুকরো করে কেটে ফেলে পুলিশ আর ছেলেটির দাদু বাধা দিতে গেলেও তার গলা কেটে ফেলা হয়। এমন একটি দৃশ্য পাওয়া যায় মিগেল আনহেল আতুরিয়াস-এর ‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট উপন্যাসে। সেখানে দৃশ্যটা এইরকম–এক বৃদ্ধ সচিবের হাত থেকে দোয়াত পড়ে যায় প্রেসিডেন্ট-এর গায়ে, যার শাস্তি চলে জীবনভর। এক মার্কিন চরিত্রের আবির্ভাব এবং তার সঙ্গে মাকান্দার উন্নতি এবং ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে সাদৃশ্য পাওয়া যায় রোমুলো গাইয়েগোর ‘দন্যা বারগারা’ উপন্যাসের মিস্টার ডেনজার নামক চরিত্রের। কর্নেল লোরেনসো গাভিলান কার্লোস ফোয়েনতে-এর ‘আর্তেমিও ক্রুশের মৃত্যু’ উপন্যাসের এক চরিত্র এবং ‘রোকামাদুর’ হুলিও কোরতাসারের ‘রাইওয়েলা’ (এক্কা দোক্কা) উপন্যাসের চরিত্র।
বৃষ্টির জলে ডুবন্ত বাড়ির জল নিষ্কাশনের ঘটনাটি আগেই উল্লিখিত হয়েছে উরুগুয়ের ফেলিসবের্তো এরনানদেস-রচিত ‘ডুবে যাওয়া বাড়ি’ উপন্যাসে। হোসে আরকাদিও এবং রেবেকার অজাচার সম্পর্কের পটভূমি স্মরণ করিয়ে দেয় ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার আমমার এবং তামমোন’ কবিতায়, এর উৎস বাইবেল বর্ণিত একটি ঘটনায়, যদিও প্রাচীন স্পেনীয় গাথায় এমন কাহিনির উল্লেখ আছে। আমরা জানি যে, গার্সিয়া মার্কেস লেখক জীবনের গোড়ায় ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। লা হিরাফা’ (জিরাফ) পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে গার্সিয়া মার্কেস বলেন ‘আটলানটিকের উপকুলে যে-কোনো গ্রামে এমন অসহায় দুঃখী মহিলা অনেক দেখা যায় এবং গার্সিয়া লোরকা নাটকে তাদের জীবন ও মৃত্যুর করুণ কাহিনি বিবৃত করেন…। গার্সিয়া মার্কেস যে নাটকটির কথা বলেন তার শিরোনাম ‘বেরনার্দা আলবার বাড়ি। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার সঙ্গে যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে উইলিয়াম ফকনারের সাররিসূচরিত্রটির সঙ্গে। ভবঘুরে ইহুদি চরিত্রটির মধ্যে মিথ’-এর বৈশিষ্ট্য আছে। এই বিষয়টি উনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে বারবার এসেছে। কিন্তু এই উপন্যাসে মাকন্দোয় সে আসার পর এত গরম পড়ে যে পাখিরা বাড়ির তারের জানলা ভেদ করে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে মরার জন্যে। একবার সে এক দানবের রূপ ধরে আসে, কিন্তু গ্রামবাসীরা তাকে হত্যা করে। দুই ক্ষেত্রে বাইবেল কথিত “Apocalypsis”-এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে উপাদান নিয়ে এমনভাবে আত্মস্থ করে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস উপন্যাসটি নির্মাণ করেছেন যা নতুন হলেও পুরাতনের ছায়া সর্বত্র বিদ্যামান। কিন্তু তার শৈলী কোলাজ থেকে একেবারেই ভিন্ন। মারিও ভার্গাস ইয়োসার মতে তার ঈশ্বরদ্রোহী ক্ষমতা বলে এমন এক সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে যার অজানা কোনো সূত্র নেই। শতবর্ষের নিঃসঙ্গতা বাস্তবের সঙ্গে সাহিত্যলোকের মিলন (আদিম ও জনপ্রিয়), এমন এক রীতিতে আখ্যান রচিত হয় যা অতল এক জলাশয়। এখানে কয়েকটিমাত্র বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল, যা বিশ্লেষণ করার জন্যে বিস্তারিত আলোচনা করার অবকাশ আছে।
.
প্রেম এবং মৃত্যু
সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী যে মূল সুর এই উপন্যাসে ঘুরে ফিরে আসে তা হল–প্রেম এবং মৃত্যু। “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসটিতে প্রেম সম্পর্কিত এমন কিছু পঙক্তি পাই যা স্প্যানিশ ভাষার মণিমুক্তো। মেমে এবং মাউরিসিয়া বাবিলোনিয়ার সম্পর্ক…মেয়েটি তার জন্যে উন্মত্ত হয়ে যায়। ঘুম চলে যায়, খিদেও পায় না আর এমন একাকিত্বে মৰ্গচৈতন্য তার অবস্থা যে বাবা পর্যন্ত যেন এক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেলেসতিনার মত জাদুকরি মধ্যস্থতা করে পিলার তেরনেরা। যুবকের প্রেমের সঙ্গে হলুদ প্রজাপতির অনুষঙ্গ জাদুর ইঙ্গিতবাহী। প্রেমিকা না থাকলেও একাকিত্বের যন্ত্রণার মধ্যে প্রেমের কথা আসে। মাওরিসিয়া বাবিলোনিয়া একাকিত্বের যন্ত্রণায় বৃদ্ধ হয়ে মারা যাবে, প্রেমিকার সঙ্গে পুনরায় মিলন ঘটবে না তার। কিন্তু সবচেয়ে রোমান্টিক ঘটনা প্রেমের জন্যে পিয়েত্রো ক্রেসপির আত্মহনন। আমারানতা বড়ো কঠোরমনা, প্রেমিককে আমল দেয় না। নভেম্বরের-তারিখ, মৃতদের দিন (All souls day) ওর ছোটো ভাই বড়ো দোকানটা খুলে দিল, দেখে সবকটা বাতি জ্বলছে, সমস্ত বাদ্যযন্ত্র চলছে সব ঘড়ির কাটায় একই সময় এবং ওই অর্থহীন কনসার্ট-এর মধ্যে পিয়েত্রো ক্রেসপিকে দেখল পেছনের একটি ডেস্কে, ছুরি দিয়ে কবজি কাটা, দুটো হাতই ওয়াশ-বেসিনে বেঞ্জয়েন এ ডোবানো। উরসুলার চোখে ‘সে এক সন্ত,’ পাদ্রি নিকানোর পবিত্র মাটিতে শবদেহ সমাধিস্থ করতে আপত্তি জানায়। হতাশ প্রেমিকের সংবেদী হৃদয়ে এমন যুক্তিতর্ক বিবর্জিত রোমান্টিকতা পরিণত হয় গোধুলির আলো-আঁধারের অভিসারে নিয়তিনিবন্ধ সর্বনাশের এক ইঙ্গিত হয়ে থাকে ‘অক্টোবরের অপয়া বৃষ্টিপাত; রোমান্টিকতার স্পষ্ট আভাসের মধ্যে প্রকৃতি হয়ে ওঠে হৃদয়বিদারি দুঃখের প্রতীক।
উপন্যাসের শুরুতে যে প্রেমচক্রের সূচনা হয় তাতে দেখা যায় বিবাহিত জীবনে নারীর কুমারীত্ব অটুট রাখতে হয় (উরসুলা)। অজাচারের পাপভীতি সত্যি হয়ে ওঠে যখন শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে সন্তানের জন্ম হয়, আবার ভয় জয় করার জোরও দেখা যায় যদি তুমি ইগুয়ানার জন্ম দাও আমরা ইগুয়ানাই পালন করব”, বলে হেসে আরকাদিও বোয়েনদিয়া এবং প্রেম নিয়ে তার সারকথা–”জুন মাসের মায়াবিনী রাতে ঠাণ্ডা আরামশয্যায় ওরা, চাঁদ উঠেছে আকাশে আর ওরা বিছানায় লুটোপুটি করে সারাটা রাত জেগে থেকেছে। হোসে আরকাদিও এবং পিলার তেরনেরা প্রেমের আগুনে ঝাঁপ দেয় একইসঙ্গে। আউরেলিয়ানো সহজভাবে জিজ্ঞেস করে প্রেম কেমন, হোসে আরকাদিও বলে,–ভূমিকম্প যেমন। স্পেনীয় কবি ভিসেন্তে আলেইক্সানবের খুব পরিচিত কবিতার শীর্ষনাম ‘ধ্বংস কিংবা প্রেম। এ উপন্যাসে এটি প্রাসঙ্গিক। হোসে আরকাদিও এবং এক জিপসি কন্যার শরীরী মিলন– ‘ওরা গভীর উদ্বেগে দুজন দুজনকে চুম্বন করে আর পোশাক খুলতে থাকে। শেষে ছেলেটি প্রেমের আবেগে তাড়িত হয়ে মাকন্দো ছেড়ে চলে যায়। প্রেমের বিফলতা দেখা যায় যখন আউরেলিয়ানো এক মুলা (আদিবাসী ও ইউরোপীয় রক্তের সংকরজাত) তরুণীর সঙ্গে শোয়, সে রাতে মোট তেষট্টিজন পুরুষ ওর বিছানায় শুয়েছিল। খুব চেষ্টা করেও ‘ছেলেটা উদাসীন হতে থাকে এবং ভয়ংকর নিঃসঙ্গতার বোধে আক্রান্ত হয়। প্রেমহীনতা জন্ম দেয় একাকিত্বের। তখন থেকে চরিত্রদের দেখা যায় অন্য এক বাস্তবে, নারীর সাহচর্য ভিন্ন রূপ নেয়। পরে আউরেলিয়ানোর সঙ্গে রেমেদিওস-এর প্রথম দেখা হবে, সে তখন প্রেমের আর্তি বোধ করবে আবার, তার মধ্যে সাহিত্যের প্রকাশ দেখবে, বাড়িটা ভালোবাসায় ভরে যায়। আউরেলিয়ানো কবিতা লেখে যার মাথামুণ্ড নেই, ল্যাজও নেই। মেলকিয়াদে যে মোটা শক্ত কাগজ (পার্চমেন্ট) দিয়েছিল তাতে সে কবিতা লেখে, বাথরুমের দেওয়ালে লেখে এবং সব কবিতায় থাকে রেমেদিওস পুবের হাওয়ায়, গোলাপের নিঃশ্বাসে, ভোরের রুটির ঘ্রাণে, সর্বত্রসহ সময়–রেমেদিওস। এখানে উপন্যাসের গীতিধর্মিতা উপচে ওঠে, কবিতা আর উপন্যাসের ভেদরেখাঁটি মুছে যায়। প্রেমহীনতায় চরিত্রগুলির অসন্তোষ প্রকট হয়ে ওঠে, অন্য কারুর প্রতি আকৃষ্ট হয় প্রেমিক, কিন্তু যাকে প্রেম নিবেদন করতে চায় সে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়–el armante imposible–অধরা প্রেমিক। আউরেলিয়ানো যায় পিলার তেরনেরার কাছে আবেগের ক্ষেত্রে যেন ‘রেমেদিওস দিকদিগন্তবিহীন এক জলাভূমি, বুনো পশুর কটুগন্ধ এবং সদ্য ইস্তিরি করা জামা।
হোসে আরকাদিও এবং রেবেকার মধ্যে অজাচারের চুড়ান্ত রূপ দেখা যায়, ওরা সম্পর্কে ভাইবোন। কিন্তু নিষেধের উধে চলে যায় কামোলন্মাদনা। ঝড়ের নিয়ন্ত্রিত শক্তি আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় কোমর ধরে তাকে শুন্যে তুলে নেয়, মরবে না বলে সে অস্বাভাবিক শক্তি সঞ্চয় করে, তাকে তিন থাবায় আঁকড়ে ধরে, পাখির ছোট্ট ছানার মতো ওকে যেন টুকরো টুকরো করে ফেলে। জন্মগ্রহণ করার জন্যে ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, কষ্টের মধ্যে আনন্দ পায় সে, দোলশয্যার সৌরভ ছড়িয়ে যায় জলাভূমিতে, তার রক্ত শুষে নেয় একটা শুকনো কাগজ। প্রেমের দৃশ্যে এমন হিংসাত্মক বর্ণনা লক্ষ করার মতো, অপরাধবোধটা হয় কমারীত্ব নিয়ে আনন্দ, বেদনা, মৃত্যু একাকার। আউরেলিয়ানো হোসে এবং তার পিসি আমারানতার প্রেম জন্ম নেয় যৌনক্ষুধা থেকে কিন্তু যখন আউরেলিয়ানো নিকারাগুয়া থেকে ফিরে আসে তাকে ‘ক্যাম্পের জন্তু মনে হয়। এইসব মানুষের অত্যাচার এক সমস্যা সৃষ্টি করে। এক সৈনিক বলে,–উদারপন্থীরা পুরোহিত পাদ্রিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে যাতে এক পুরুষ তার মাকে পর্যন্ত বিয়ে করতে পারে।
প্রেমহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া। যুদ্ধক্ষেত্রে যে অজস্র নারীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয় তারা সবাই তার শুক্ৰবীর্য বহন করেছে, এ ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। রণাঙ্গন প্রেমবিরোধী, নায়করা কাউকে ভালোবাসতে পারে না।
যৌনমিলনের জড়তা নিয়ে প্রহসন দেখা যায় ফেরনাদার বিবাহসংক্রান্ত ঘটনায়, রানির মতো শিক্ষাদীক্ষা তার, আউরেলিয়ানো সেগুনদোর প্রেমিকা পেত্রা কোতেস-এর সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ফেরোনার জীবনে ধর্মীয় প্রভাবের আধিক্য হেতু অনেক নিষেধের বাঁধন ছিল। ধর্মাধ্যক্ষ স্বয়ং দিয়েছিল বাঁধন, সারা বছরে মাত্র ৪২টা দিন সে যৌনাচার করার সুযোগ পায়। এই নারী ভাবে আলবার ডিউক তাকে কামনা করে। বৃদ্ধবয়সে রানির বেশে নিঃসঙ্গ জীবনে মানবিকতার সাধনায় ব্যাপৃত হয় সে, অর্থাৎ অনেকটাই স্বাভাবিক মানুষের মতো আচরণ করতে থাকে।
আউরেলিয়ানো এবং নেগ্রোমানতার ভালোবাসা আখ্যানে সম্পর্কের জাদু আছে, এমন অদ্ভুত ঘটনা, যা কেবল কল্পনার রাজ্যে ঘটে– বেশ্যাবৃত্তির সঙ্গে মিশে যায় নারীর কমনীয়তা। আউরেলিয়ানো পেশাদার রূপোপজীবিনীর সাহচর্য পেলেও আমানতা উরসুলার প্রতি তার আবেগ প্রশমিত হয় না। প্রেম সার্থক হলে তার জীবনে আশ্চর্য উন্মাদনা দেখা দেয়। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসটির চরিত্রগুলো প্রেমের স্বাদ পেয়ে মৃত্যুর ছায়াকে দূরে ঠেলে দিতে চেষ্টা করে। মেলকিয়াদে দ্রুত বৃদ্ধ হয়ে পড়ে, সারা পৃথিবীর অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছে সে যেমন করেছে ভবঘুরে ইহুদি। সে স্থান বদলে নেবার ক্ষমতা ধরে এবং মৃত্যুর ছায়া সঙ্গে নিয়ে আসে, কিন্তু তার মরণ হয় না। লেখক জীবন ও মৃত্যুর ‘ভাবনা সম্বন্ধে সচেতন। দেনসিও আগিলার মৃত্যুর পরেও একাকিত্বের যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় জীবিতদের প্রতি স্মৃতিমেদুরতা, উদ্বেগ ইত্যাদি তাকেও পীড়িত করে। জীবনের সব বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তার মধ্যে। মোরগলির ঘটনা, আদিম ধর্মবিশ্বাসের মতো খ্রিস্টান ধর্মেও চলে আসে। মৃতরাও জীবিত মানুষের মতো। এক বাস্তব পৃথিবীর বাসিন্দা। মৃতদের একাকিত্ব কী দুর্বিষহ তা বেকের এক ছড়ায় প্রকাশ। করেছেন(স্পেনের কবি বেকের)। প্রথমে মাকান্দায় মৃত্যু বলে কিছু ছিল না এবং এমন অদ্ভুত এক শান্তির পরিবেশ ছিল যে মৃত্যুর মতো স্বাভাবিক ঘটনার কথা কেউ জানত না। মেলকিয়াদে-এর মৃত্যু ঘিরে অতিপ্রাকৃত সংকেত দেখা যায়। চরিত্রটি নিজে স্বীকার করে যে সে অমরত্ব লাভ করেছে। কিন্তু শবদেহটি যেমন হয় তেমনি স্বাভাবিক এবং শেষে তা সমাধিস্থ করা হয়। কিছুক্ষণ পরে তার নিঃশব্দ পদচারনার কথা বলা হয়। মৃতের চেতনা শৈশব ফিরে আসার মতো। হোসে আরকাদিও ফায়ারিং স্কোয়াড-এর সামনে স্মরণ করে তার বাবা তাকে একটা সবুর মধ্যে বরফ চিনিয়ে দিয়েছিল; একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হয়। শুরুতে যখন কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া ঠিক এই কথাই বলে। একনাটকীয় পুনরাবৃত্তি দর্পণের চমৎকার খেলা। মৃত্যুদৃশ্যের অবতারণা কাহিনির এক মূল বিষয়ে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া। মার্কেস-এর কথায় এটি বীজ রোপণের প্রেরণা।
সৌন্দর্য মৃত্যুর সংকেত হতে পারে। সুন্দরী রেমেদিএস পুরুষদের দিকে চেয়ে তাদের মেরে ফেলতে পারে। সে যৌনজড়তা এবং সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, মৃত্যুর অশনি সংকেত। এমন সংকেত আরও আছে যেমন কপালে আঁকা ছাই দেখে বোঝা যায় যে কর্নেল আউরে লিয়ানো বোয়েনদিয়ার সতেরোটি সন্তান ছিল। মৃত্যুর অসংখ্য অশুভ ইঙ্গিত আছে, কিন্তু আউরেলিয়োনো বোয়েনদিয়া জানে যে “যখন মরা উচিত তখন মরে না কেউ, যখন পারে তখন মরে। মৃত্যুর পর রীতি মেনে চলে আমারানতা, যখন তার বাবার শবদেহ পায়। ফেরদা আদি ক্যাথলিক প্রথা মেনে চলে। রেবেকার শবাধারের আচ্ছাদনটি বানে আমারান। তার ব্যক্তিসত্তটি দেখার অনুমতি পায় সে লম্বা চুল, নারীর নীল পোশাক, একটু পুরোনো ধরনের এবং কিছুটা পিলার তেরনেরা রান্নাঘরে সাহায্য করার সময় যে পোশাক পরত সেইরকম। রোমান্টিক এবং প্রতীকী পোশাকে এমনভাবে সে আসে যেন জীবিতদের সঙ্গে কথা বলতে পারে। আমারানতার কাছে সেলাইয়ের দুচ চায় আর তার নিজের শবাধারের আচ্ছাদনটি বুনতে বলে। বোনার পর মৃত্যু মুহূর্ত আসছে জানতে পেরে সে দূত হয়, শহরের সব মৃতদের মধ্যস্থতা করে। আমারানতা নিয়তিনির্ধারিত মৃত্যু গ্রহণ। করতে দ্বিধা করে না। মরণশীল মানুষ অতীতের মৃতদের সঙ্গে কথা বলে। তাই কর্নেল হেরিনেলদো মার্কেস-এর শবদেহ যাচ্ছে সমাধির পথে, বৃষ্টি হচ্ছে, শোনা যায় উরসুলার কণ্ঠ–”আমাকে এবং আমার মানুষদের অভিনন্দন জানাও, বলো বৃষ্টি থামলে আমাদের আবার দেখা হবে।’ চরিত্রগুলো আগেই নিজেদের মৃত্যুর খবর পেয়ে যায় এবং প্রাক্তন মৃতদের সঙ্গে কথা বলতে পারে।
মৃত্যুর দিনটা আগেই জানা হয়ে যায়। এক পবিত্র দিনে উরসুলার মৃত্যু হয়। আরও একবার উরসুলার উধাও হয়ে যাবার সময়ে মৃত্যুর স্বাভাবিক সংকেত পাওয়া যায়। মাকন্দোকেন্দ্রিক জীবনের রহস্যময়তার একটি সূত্র দেখা যায়। জনহীন হয়ে যাবার পর আকাশের পাখিরা প্রচণ্ড গরমের মধ্যে বাড়ির জানলার পর্দা ভেদ করে ঘরের মধ্যে গিয়ে মরে তখন আনতেনিও ইসাবেল ব্যাখ্যা করে বলে যে ভবঘুরে ইহুদি ধ্বংসের বার্তা বয়ে এনেছে। দ্ব্যর্থব্যঞ্জক ইঙ্গিত–মৃত্যু এবং মাকন্দোপত্তকারীদের সর্বজনীন অবক্ষয়। প্রসঙ্গত, রেবেকার মৃত্যু এক স্মরণযোগ্য ঘটনা।
কন্যাকে ব্রাসেলস্-এ পাঠানোর পর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আউরেলিয়ানো সেগুদো মাকন্দোর অতীত সম্পর্কে সবকিছু বলে হোসে আরকাদিও সেগুনদোকে। যমজ ভাইয়ের সঙ্গেই তার মৃত্যুর মহড়া চলে। সাবধানতা সত্ত্বেও সমাধিক্ষেত্রে মানুষরা নিজেদের শবদেহ ঠিক ঠিক চিনতে পারে না। জন্মের মায়াবী দর্পণ ভাঙতে পারে না মৃত্যু। শিশুরা সৈনিকদের মতো আক্রমণ করে হাসে আরকাদিওকে এবং তার ধনসম্পদ লুঠ করার জন্যে ওকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে। বার্সিলোনায় ফিরে যাওয়ার পর প্রান্ত কাতালুনিও’র মৃত্যু হয় মাকন্দোর বাইরে, তার জন্মস্থান বার্সিলোনায়। পিলার তেরনেরার মৃত্যু হয় স্বর্গের প্রবেশ পথে চোখ রেখে। মনে হয় একটা ইতিহাস শেষ হয় আর চূড়ান্ত পর্যায় আসে যখন উরসুলা আমানতার মৃত্যু হয় এক জন্ম দিতে গিয়ে, তার অবয়বটি শানিত হয় এবং বলিরেখাগুলো আলাবাসটার-এর ভোরে মিলিয়ে যায় এবং আবার সে হাসতে পারে। আউরেলিয়ানোর নিঃসঙ্গতা সর্বাত্মক, সে পড়তে শুরু করবে এক পাণ্ডুলিপির ইতিহাস যা এই উপন্যাস। সে কল্পনা করে নেয় যে এই ঘরটা থেকে সে বেরোবে না, কারণ তার মৃত্যুর পূর্বঘোষণা ছিল, গোড়া থেকেই এই উপন্যাসে মৃত্যু উপস্থিত।
[*সেগুন্দো—দ্বিতীয়]
.
হিংসা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ
১৯৪৮-এর ‘বোগোতাসো’র (বোগোতার এক কুখ্যাত ঘটনা) পর কলম্বিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে মাকন্দোর পরিস্থিতির মিল পাওয়া যায়। হিংসার এক বাতাবরণে দেশ নিমজ্জিত হয়। আনহেল রামা বলেন যে রাজনৈতিক মিছিলগুলির মধ্যে বক্তব্য বিষয়ের রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়। এক ব্যক্তিগত হিংসার ঘটনার মধ্যে দিয়ে মাকলোর গোড়াপত্তন হয়। সম্মান’-এর বোধ এবং তার সঙ্গে যৌনতার যে অনুষঙ্গ তার সাহিত্যে শিকড় মেলে তা স্পেনীয় ঐতিহ্যের। পরিত্যক্ত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ শুধুমাত্র এক মহাদেশ আবিষ্কারকদের নয়, তার সংস্কৃতির রূপ পর্যন্ত স্মারকচিহ্ন হিসেবে উপস্থিত হয় নতুন বিশ্বে। সম্মান স্পেনের স্বর্ণযুগের নাটকের সূত্র, যা লোরকার ভাবনার জগৎ পর্যন্ত প্রসারিত এবং তারই ধারা এসে মেশে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস-এর ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ শীর্ষক উপন্যাসে এবং তারপরেও তার আর-একটি উপন্যাস পূর্বঘোষিত মৃত্যুর সমাচার’ পর্যন্ত পুরুষকার ও সম্মান’-এর ধারণা প্রতিষ্ঠিত। হিংসা রাজনৈতিক সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া ৩২টি ব্যর্থ সশস্ত্র অভুত্থানের নায়ক। এই লড়াই (সকলের জানা ঐতিহাসিক সূত্র অনুসারে) চলে উদারপন্থী এবং রক্ষণশীল দুই পরস্পর-বিরোধী শক্তির মধ্যে। এদের রাজনৈতিক তত্ত্ব এবং আদর্শ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে আউরেলিয়ানোর, তার শ্বশুরের মতে উদারপন্থীদের উদ্দেশ্য আইনশৃঙ্খলা, ঈশ্বরবিশ্বাস, রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য ধ্বংস করা, পরোক্ষে রক্ষণশীলরা তা চায় না। এই বিরোধ থেকে হিংসা ও বিশৃঙ্খলা। মাকন্দোর শাসক হয়ে উদারপন্থী আরকাদিও এমন নির্দয় ও স্বার্থপর কাজকর্ম করতে থাকে, যা মাকন্দোর ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। উরসুলা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রক্ষণশীলদের বিজয়ী আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়াকে গুলি করার আদেশ দেয় কিন্তু ফায়ারিং স্কোয়াড-এর ক্যাপ্টেন উদারপন্থী নায়ককে নিয়ে পালিয়ে যায় এবং এক যুদ্ধ আবার শুরু হয়। কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার অধীনে পাঁচহাজার লোক ছিল, কিন্তু রাজনীতিতে তার বিশ্বাস ছিল না–’আমাদের সময় চলে যাচ্ছে আর পার্টির ছাগলগুলো পার্লামেন্টে সিট ভিক্ষে করছে।শান্তিচুক্তি হলেও আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া যুদ্ধ চালিয়ে যায়, হিংসা চলতেই থাকে। তার বিপ্লবী চেতনা সমৃদ্ধতর হতে থাকে এবং সেই মহাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সঙ্গে মাকন্দোর অবস্থাও জড়িয়ে যায়। এমন উপলব্ধি হয় তার। কিউবার বিপ্লব প্রসঙ্গত আসে উরসুলা যখন তার পুত্রের চিঠি পায় সান্তিয়াগো দে কুবা থেকে, তার অক্ষরগুলি বিবর্ণ ও অস্পষ্ট। ফিদেল কাস্ত্রোর বিপ্লবের প্রতি গার্সিয়া মার্কে-এর সহানুভূতি গোপন থাকে না।
কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া রক্ষণশীলদের মূলোৎপাটন করার জন্যে নির্মম, নৃশংস হত্যালীলা চালিয়ে যায়, সে নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ তার কাছে হিংসা ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। সামরিক আইন বলে দেশের সর্বত্র হিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, ডক্টর নোগেরাকে গুলি করা হয়, পাদ্রি নিকানোরকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটানো– সবই তার সংগ্রামের অংশ।
জেনারেল মোনকাদা রক্ষণশীল হওয়া সত্ত্বেও মাকন্দোর এক সুশাসক, সে উরসুলার প্রিয়পাত্র, কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়ার বন্ধু, তবুও তাকে গুলি করে মারা হয়, কর্নেল বলে বন্ধু, মনে রেখো আমি তোমাকে গুলি করছি না, করছে বিপ্লব’ হিংসার মত্ততা এবং ক্ষমতার দম্ভ নরমপন্থী উদারবাদীদেরও খেয়ে ফেলে। বিপ্লবী কার্যক্রমের মধ্যে একটাই সদর্থক কাজ উল্লেখযোগ্য ভূমির মালিকানা সংক্রান্ত আইনের সংস্কার। গার্সিয়া মার্কেস কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে মেক্সিকো বিপ্লবের কাহিনি থেকে কিছু উপাদান গ্রহণ করেন। আসোয়েলা (Azuela) দেখান যে কৃষিবিপ্লবের নৈতিকতা নিয়ে তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন না। বোয়েনদিয়া বংশের প্রতিষ্ঠাত্রী উরসুলা উপন্যাসের মুখ্য এক চরিত্র, বৃদ্ধ বয়সে বিপন্ন বিষাদের শিকার হলেও তার সহজিয়া বৈশিষ্ট্য বজায় রাখে। রক্ষণশীল ও উদারবাদীদের শান্তিচুক্তির কথা শুনে কর্নেল আউরেলিয়ানো বোয়েনদিয়া কোনো মন্তব্য করে না। রক্ষণশীলরা ক্যালেন্ডার সংস্কার করে যাতে প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট একশো বছর ক্ষমতায় থাকতে পারে।
‘মোদেনিসমো’ (আধুনিক) যুগ, থেকে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপনিবেশবাদ নিয়ে যে যন্ত্রণা, যে উদ্বেগ দেখা যায় তার থেকে সরে যায় না “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ। কলাচাষের বাণিজ্য নিয়ে আসে ইয়ার্কি প্রভুরা, আসে তাদের টেকনোলজি, আসে কালচার। যে ধন ছিল ঈশ্বরের তা হল মার্কিন কর্তাদের, বৃষ্টির রাজ্যে এল পরিবর্তন ফসল বোনা ও তোলার দ্রুত পদ্ধতি, নদীর বহতা সরিয়ে দিল ওরা। আদিবাসী জনগণের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে ওরা, ওদের সম্বন্ধে ঘৃণাসূচক মন্তব্য করে, আর আদিবাসীদের বাস হয় ওদের থেকে দূরে, ট্রেনলাইনের ওপারে। কিছুটা শিল্পায়ন হওয়ার পর মাকন্দের সমাজে আসে অস্থিরতা এবং তার পতন ত্বরান্বিত হয়। হোসে আরকাদিও সেগুনদে কলাশমিকদের প্রথম ধমর্ঘট ডাকতে উদ্যোগী হয়।
সামাজিক ক্ষোভ নিয়ে আসে পুলিশ, মিলিটারি। একদিকে জনগণের উদ্বেগ, উত্তেজনা আর অন্যদিকে ফেরমানদার রক্ষণশীল ধ্যানধারণার প্রকাশ ঘটতে থাকে ক্রমান্বয়ে, তার মতে হোসেআরকাদিও সেগুলো পরিবারে একমাত্র নৈরাজ্যবাদী। এক জটিল সিস্টেমেরজাতাকলে ‘শ্রমিকরা পড়ে যন্ত্রণার গহ্বরে’, অত্যাচারী প্রশাসন পুষ্ট হয় ডাক্তার, উকিল প্রভৃতি অবস্থাপন্ন তাবেদার মানুষদের সমর্থনে। মুখ্য শাসকদলকে রক্ষা করার জন্যে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বড়ো তৎপর, অত্যাচারের পক্ষে ওরা। শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে এবং তারা “অন্তর্ঘাতের বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের আশ্রয় নেয়’–Sabotear cl subotaje স্টেশনের সামনে সমাবেশ উপন্যাসটির অর্থপূর্ণ সারাৎসারের মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের ওপর অত্যাচারের বর্ণনা উপন্যাসের সামাজিক দিকটির উন্মোচন ঘটায়–মতায়ন এবং স্বৈরাচারের প্রকৃত এক প্রতিচ্ছবি। মেশিনগানের শিকার শ্রমিকদের নানাবিধ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়–”একটা নীরব ট্রেনযাত্রা যা কখনও শেষ হয় না’–কবি মিগেল এরনানদে-এর আহত মানুষ যায় ট্রেনে চড়ে–সমুদ্রের দিকে নিয়ে যাবে শ্রমিকের শব। হোসে আরকাদিও সেগুনদো সাক্ষী থাকে তিনহাজার মৃতের আর বিকৃত ইতিহাসের এক দলিলস্বরূপ হয়ে থাকে, কারণ মাকন্দোবাসীদের কেউ পরে আর স্বীকার করতে চায় না যে এমন নির্মম অত্যাচার কখনও ঘটেছিল। এইভাবেই অনেক ইতিহাস লেখা হয়। একটা ভয় প্রবেশ করেছিল মাকন্দোর সমাজজীবনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির কর্তা মিস্টার ব্রাউন চেয়েছিল এক অবিরাম বৃষ্টি যাতে সব রক্ত ধুয়ে যায়। বৃষ্টি হয়েছিল টানা চারবছর এগারো মাস দুদিন। শেষের শুরু হল এইভাবে। বৃষ্টির দাপট দেখে কলা কোম্পানিগুলো ওদের সব ফ্যাক্টরি, অফিস ইত্যাদি ভেঙে দেয় এবং কিছুদিন পর বিদেশিদের বাড়িঘর রইল শুধু জঞ্জালের স্তূপ হয়ে।‘
.
মিথ–এর উপকরণ
নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসটির পটভূমি বাস্তব এক জগৎ, কিন্তু পুরাণের ভাষায় ব্যক্ত হয় তার কথা। জানা অজানা ‘মিথ’ একটা অর্থময় কাঠামো তৈরি করে। বাইবেল ও ধর্মীয় প্রভাবের কথা তো ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি। সমবেত ট্র্যাজেডির যে ভাষা গার্সিয়া মার্কেস ব্যবহার করেছেন তা কখনই দুর্বোধ্য নয়, সাবলীল, স্বচ্ছ, কখনও শ্লেষাত্মক, কখনও রসালো, কাব্যিক এবং মনোরম। কিন্তু পূরাণকথা মিশে থাকে প্রতি স্তরে। তা বলে আধুনিক যুগ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভাষা ব্যবহার করেন না লেখক। দীর্ঘ সময়ের কাহিনিতে আসে মানুষের উত্থান পতনের কথা, তার ব্যথা-যন্ত্রণা, ব্যভিচার, পার্থিব প্রগতি আর ভবিতব্যের কথা। বোয়েনদিয়া পরিবারের গল্প হলেও সময় বা বংশলতিকা ধরে ঘটনাপ্রবাহ নেই। কিছু সূত্র আছে যা মিথসম্পৃক্ত–গোড়ার কথা, মুক্তি, অত্যাচার, উর্বরতা, কুমারীত্ব ইত্যাদি। বহুলাংশে প্রতীকী এবং সনাতন মূল্যবোধ কেবল নারী চরিত্রগুলির মধ্যে উদ্ভাসিত হয়। একটি গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী সমাজে প্রেম থেকে যুদ্ধ সবকিছুই ‘মিথ কথন রীতিতে ঘটে যায়। গার্সিয়া মার্কেস কাব্যিক ভাষায় ব্যক্তিবিশেষ ও সামগ্রিক জীবনের কথা বলেন। শৈশবও যৌবনের কলম্বিয়ার বাস্তবতাকে তিনি সর্বজনীন মাত্রায় উত্তরণ ঘটান, যা সমস্ত সীমানা ভেঙে একটা ক্লাসিক হয়ে ওঠে। সমাজতাত্ত্বিকগণের মতে ভাষা ও মাটির ভেদাভেদ মুছে এটি হয়ে যায় পৃথিবীর মানুষের মহাকাব্য। বোয়েনদিয়া পরিবারের মানুষরা যে একাকিত্বে ছটফট করে তা আমাদের একাকিত্ব, ওদের যুগই আমাদের যুগ। সার্বিক স্মৃতিমেদুরতার, সর্বজনীন নিঃসঙ্গতার এক অনবদ্য সৃষ্টি “নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ।
তথ্যসূত্র : ১. হোয়াকিন মার্কোর সংস্করণের ভূমিকা।
১. স্প্যানিশ রয়্যাল অ্যাকাডেমি সংস্করণে গনসালো সেলোরিওর ভূমিকা।
.
‘মাকন্দো’ সৃষ্টির পটভূমি
আত্মজীবনীতে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বলেন–শুধু বেঁচে থাকাই জীবন নয়, স্মৃতির কথা। ধরে রাখা আর তার বিবরণ বলার নাম জীবন। তার স্মৃতিকথার শিরোনাম তাই ‘বলার জন্যেই বেঁচে থাকা।’ যে স্বর্গীয় শান্ত পরিবেশে দাদু, দিদিমা আর মায়ের সঙ্গে আরাকাতাকা নামক গ্রামে একদা তিনি সুখের শৈশব অতিবাহিত করেন, সেই পুরোনো বাড়ি বিক্রি করার জন্যে মায়ের সঙ্গে আবার এলেন ১৯৫০ সালে, তখন তিনি তেইশ। এবার সেই গ্রাম দেখে তার শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। এই কি সেই স্বর্গসুষমাসমৃদ্ধ গ্রাম? ধুলো আর গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ, মনে হয় গ্রামের এক প্রেতাত্মার মুখোমুখি হয়েছেন। অনেকটা সময় পার হলে বুঝি এমন দশাই হয়, কোথাও যেন প্রাণ নেই। একটা ছোটো ওষুধের দোকানে প্রবেশ করে দেখলেন এক মহিলা কী একটা সেলাই করছেন, মা তাকে জিগ্যেস করলেন–কেমন আছ দিদি? তিনি মাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন আর দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়ালেন। আধঘণ্টা ধরে চলল কান্না। দুজনের নীরব কান্না আমার বুকের গভীরে শাশ্বত যন্ত্রণা হয়ে রইল। বলেছেন গার্সিয়া মার্কেস।
তিনি অনেকবারই বলেছেন যে সেই গ্রামের অতীত দিনের জীবন নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে আছে। এক বছর ধরে একটি উপন্যাস অনার ভাবনায় বুঁদ হয়ে রইলেন, লেখা হল, তার শিরোনাম ‘বাড়ি’, শৈশবের স্মৃতির যত ঘটনা তারই প্রকাশ ঘটল। আর সেখানেই আসলে সৃষ্টি হল মাকন্দো। কিন্তু বাস্তবে যা ঘটেছে বা যা তিনি দেখেছেন তার এমন হুবহু বর্ণনা লেখকের পছন্দ হয়নি। সেটা অসম্পূর্ণ রেখে তিনি লিখলেন চারটি নতুন উপন্যাস “ঝরাপাতা, কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না, মামা গ্রান্দের (বড়ো মা) অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং “দুঃসময়’–এগুলোর বিষয়বস্তু সবই ভিন্ন ভিন্ন স্তরে যুক্ত হয়ে গেল নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসে। গার্সিয়া মার্কেস-এর কথায় এগুলো একটা প্যাকেজ’, যার মধ্যে আছে–পারিবারিক ইতিহাসের স্মৃতি, কলা কোম্পানির আঞ্চলিক এবং কলম্বিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস, আছেকিংবদন্তির গল্প, ওই অঞ্চলের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি, আচার, প্রথা ইত্যাদি…প্রায় পনেরো বছর পর হঠাৎই তার মনে হয় যে এক নতুন ভাবনায় আন্দোলিত হচ্ছে সৃজনশীল অন্তদৃষ্টি। ১৯৬৫ সালে একদিন মেক্সিকো সিটি থেকে আকাপুলকো যাওয়ার সময় আরাকাতকার কথা মনে হয়, মনে পড়ে যায় সেদিনকার মা আর এক প্রতিবেশিনীর কান্নার দৃশ্য। ভাবনা দানা বাঁধতে থাকে, কাঠামোর একটা চিত্র ভেসে ওঠে মনে, কেমনভাবে বলা হবে এবং ভাষা সবই তাকে আলোড়িত করে। ঠিক তখন থেকে শুরু হল দুরুহ কিন্তু সহজ কাজটা ‘নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ’ উপন্যাসটির নির্মাণ।
একটি স্থানের স্মৃতি থেকে জন্ম হলেও সাহিত্য রূপান্তরিত হয় সর্বজনীন অভিজ্ঞতায়। গার্সিয়া মার্কেস-এর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি হত তারকাব্যিক উত্তরণ ঘটল, সেটা আর কলম্বিয়ার নয়, অন্য যেকোনো জায়গার কথা হয়ে যায় আর অনেকটাই সর্বজনীন মাত্রা পায়। একটি বাড়ি রূপান্তরিত হয় মাকন্দোয়, তার শ্রবৃদ্ধি ঘট, একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় কাহিনি, অজাচার’-এর পাপ নিয়ে পরিবারে এক ভীতি বরাবর থেকে যায় এবং শেষে এক সন্তান জন্ম নেয় শুয়োরের ল্যাজ নিয়ে, যদিও তার মৃত্যু হয় জন্মের পরই এবং কাহিনিটিও শেষ হয়। নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ উপন্যাসের কেন্দ্র এক পুরাণের গ্রাম, যা মানুষের ভবিতব্য, অস্বাভাবিকতা এবং মানবজাতির অসহায়ত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে।
<