কার্পেথিয়ানের কালো গোলাপ – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

১. সুজনের পৃথিবী

পুরোনো ঢাকার নন্দলাল দত্ত লেনের তিন বাই দুই নম্বর বাড়ির সবচেয়ে নিরীহ আর সুন্দর ছেলে সুজনের দিন শুরু হয় গালমন্দ শুনে। পাড়ার মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে ঢুকেই বড় চাচা শুরু করেন–হতভাগা এখনো ঘুমোচ্ছে দেখ! আল্লা খোদার নাম তো মুখে নেবে না কখনো, গাছে পানি দেয়ার জন্যেও রোজ বলতে হবে!

এইটুকু বলার ভেতরও যদি সুজনের ঘুম না ভাঙে বড় চাচা হুঙ্কার ছাড়বেন–এখনো উঠলি না হারামজাদা!

চোখে রাজ্যের ঘুম জড়িয়ে থাকলেও সুজনকে উঠতে হয়। কলতলায় গিয়ে কয়লার গুঁড়ো দিয়ে দাঁত মেজে মুখ ধুয়েই কোদাল আর বালতি ভরা পানি নিয়ে ছুটতে হয় বড় চাচার সবজি বাগানে।

বাড়ির পেছনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি, বড় চাচা সারা বছর সেখানে সবজির চাষ করেন। সারা বছর সেখানে কাজ থাকে সুজনের। সকাল বিকেল মিলিয়ে দিনে তিন চার ঘন্টা এর পেছনে চলে যায়। পানি দেয়াই তো একমাত্র কাজ নয়। মাটি কোপাতে হয়, গাছের গোড়া নিড়িয়ে দিতে হয়, সার দিতে হয়, আগাছা বাছতে হয়, গাছের ফলনের সময় বীজতলা তৈরি করে নতুন চারা জন্মাতে হয়, সবজি বাগানের কাজ শেষ করার পর চাচাঁদের ছোট ছোট চারটা ছেলেমেয়েকে সকালে স্কুলে দিয়ে আসতে হয়, রাতে এক ঘন্টা পড়াতে হয়। তারপর বাজার করা, রেশন ভোলা, লণ্ডিতে যাওয়া থেকে শুরু করে সারা দিনে আরো অনেক কাজ থাকে সৃজনের। এর ফাঁকে স্কুলের পাট চুকিয়ে সে গত বছর কলেজে ঢুকেছে। এক বছর ধরে রোজ বিকেলে একটা টিউশনিও করে।

পাড়ার মহিলারা কখনো চাচিদের আড়ালে ওর মাকে বলেন, যে ছেলের বাপ মরেছে জন্মের আগে, ওর যদি এত ভোগান্তি না হবে তাহলে আর ভুগবে কে?

মা কি বলবেন! লুকিয়ে শুধু চোখ মোছেন আর ভাবেন কবে সুজন বড় হবে; ওঁকে এই রাক্ষসপুরি থেকে মুক্তি দেবে। ছোটবেলায় চিলেকোঠার ঘরে রাতে ঘুমোনোর সময় মার মুখে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শুনে সুজন বলতো, বড় হলে এই রাক্ষসপুরিটা ভেঙে তোমাকে আমি নিয়ে যাবো। সারাদিন বাড়ির সব কাজ করার পরও সবার গালমন্দ শুনে চোখের পানি মুছতে মুছতে মুক্তির স্বপ্ন দেখেন সুজনের মা।

সুজনের বাবা মারা গেছেন একাত্তর সালের আঠার নবেম্বরে। সবাই বলে দারুণ সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি, একা পাকিস্তানী সৈন্যদের একটা বাঙ্কার গ্রেনেড ছুঁড়ে উড়িয়ে দিতে গিয়ে বুকে শত্রুর গুলি লেগে শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধে যাবার আগে ছিলেন নামকরা সাংবাদিক। নাম বললে সবাই চেনে। সুজনের জন্ম হয়েছে বাহাত্তরের জানুয়ারিতে। তখন সবাই ছোট্ট সুজন আর ওর মাকে নিয়ে কত মাতামাতি করতো! চাচারা পর্যন্ত ওর মাকে সমীহ করে কথা বলতেন। বড় চাচা ছিলেন শান্তি কমিটির মেম্বার, করতেন মুসলিম লীগ। যুদ্ধের সময় পাড়ার দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে নাকি গোপনে ধরিয়েও দিয়েছিলেন। যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা ওঁকে ঠিকই গুলি করে মারতো-বেঁচে গেছেন শহীদ সাংবাদিক জাফর চৌধুরীর বড় ভাই বলে।

শহীদদের জন্য দুঃখ করার দিন দ্রুতই ফুরিয়ে গেলো। সরকারি ভাতা অনিয়মিত হতে হতে একদিন বন্ধ হয়ে গেলো, সুজনরা নিজেদের বাড়িতে থাকে বলে। ওর বাবার সঙ্গে যারা যুদ্ধ করেছিলেন, ওঁদের কেউ কেউ ব্যবসা করে কোটিপতি হয়ে সুজনদের ভুলে গেলেন। অন্যরাও এড়িয়ে চলা শুরু করলেন, পাছে কোনো দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। আটাত্তর সালে দাদি মারা যাওয়ার পর বড় চাচাও স্বমূর্তি ধরলেন। ততদিনে একাত্তরের রাজাকারগুলো সবখানে বেশ জাকিয়ে বসেছে। বড় চাচা বললেন এ বাড়িতে শুধু ওদের দুই ভায়েরই হক আছে। দাদি মারা যাওয়ার সময় নাকি সুজনদের কিছু দিয়ে যান নি। এখানে থাকতে হলে তাঁর কথামতো চলতে হবে। সুজনের নানা নানি ছিলেন না। এক মামা আছেন, তাঁর অবস্থাও ভালো নয়। যাওয়ার কোনো জায়গা না থাকায় চাচা চাচিদের গালমন্দ খেয়েও এ বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলো ওরা।

মার কাছে শুনে শুনে বাবার একটা পরিষ্কার ছবি সুজনের মনে আঁকা হয়ে গিয়েছিলো। আমেরিকায় থাকেন ওর একমাত্র ফুপু। একসময় তিনি নিয়মিত চিঠি লিখে ওদের খোঁজ খবর নিতেন, টাকা পয়সাও পাঠাতেন। ফুপু সুজনকে লিখতেন–আমার বড় আশা, তুই তোর বাবার মতো নামকরা একজন হবি। বাবার বইগুলো যত্ন করে রাখিস। মেজদার খুব প্রিয় ছিলো বইগুলো। ফুপু আরো লিখতেন মার দিকে খেয়াল রাখিস। কয়েক বছর আগে টাকা পয়সা নিয়ে বড় চাচার সঙ্গে ফুপুর কিসব গণ্ডগোল হয়েছে। সেই থেকে তিনি বাড়িতে চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। গত বছর এসএসসি পরীক্ষার পর সুজন লিখেছিলো ও আমেরিকা যেতে চায়। চিঠির কোনো উত্তর পায় নি।

চিলেকোঠার ঘরে দুটো বড় সিন্দুকে সুজনের মা ওর বাবার বইগুলো তালাবন্ধ করে রেখেছেন। মাঝে মাঝে খুলে দেখেন, বেছে একটা দুটো সুজনকে পড়তে দেন, আবার সিন্দুকে তালা দিয়ে রাখেন। ক্লাস এইটে থাকতেই সুজন গোর্কির মা, অস্ত্রয়ভস্কির ইস্পাত, জ্যাক লন্ডনের হোয়াইট ফ্যাং আর শেক্সপীয়ারের কয়েকটা নাটকের অনুবাদ পড়েছিলো। নাইনে ওঠার পর মা ওকে রবীন্দ্র রচনাবলীর কয়েক খণ্ড পড়তে দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের কয়েকটা গল্প আর কিছু নাটক পড়ে সুজন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। নিজেকে কখনো মনে হয়েছে অমল, কখনো মনে হয়েছে ফটিক, কখনো মনে হয়েছে বলাই। গোর্কির ছেলেবেলা পড়ে মনে হয়েছে ও আলিশা। সারাদিন বাড়ির হাড়ভাঙা খাটুনির পর রাতে চাচাতো ভাইবোনদের পড়িয়ে নিজের পড়া শেষ করে সুজন বাবার বই নিয়ে বসে। মা বলেন স্কুল কলেজের পড়ার বইয়ের চেয়ে এসব বই কম দরকারি নয়।

অনেক রাত জেগে বই পড়ে বলে ভোরে সহজে ঘুম ভাঙতে চায় না সুজনের। বড়চাচা প্রায় সকালে ওঠার জন্য বকুনি দেন। রোজ অন্তত এক ঘন্টা বাগানে কাজ করা চাই। ক্লাস ফোরে থাকতে বড় চাচা ওকে এ কাজে লাগিয়েছেন। দুই চাচার ছেলেমেয়েরা কুটোটিও নাড়ে না। তবে এতে সুজনের অন্যরকম একটা উপকার হয়েছে। ভোরবেলা কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ঘাম ঝরিয়ে যে ব্যায়াম হয় তাতে করে ওর শরীরের গড়নটি হয়েছে ভারি সুন্দর। মার মতো ফর্শা হয়েছে। সবাই বলে ওর চোহারা নাকি খুব মিষ্টি। আজকাল পাড়ার মহিলারা মার কাছে ওর চমৎকার স্বাস্থ্যেরও প্রশংসা করেন। তবু সুজনের সবচেয়ে খারাপ লাগে সূর্য ওঠার আগে ঘুম থেকে উঠতে হয় বলে।

বাবার কারণে সুজনের যেমন বই পড়ার নেশা জন্মেছিলো, মার কাছ থেকে ও পেয়েছিলো চমৎকার গানের গলা। বিয়ের পরও মা রেডিওতে নিয়মিত রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাইরে গান গাওয়া ছেড়ে দিলেও নিজের ছেলেকে তিনি ঠিকই গান শিখিয়েছিলেন। ছোট থাকতেই সুজনের প্রচন্ড আগ্রহ ছিলো গান শেখার। মা যতটুকু জানতেন সবই শিখিয়েছেন, যার ফল পাওয়া গেছে গত বছরই। আন্তঃস্কুল সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় রবীন্দ্র সঙ্গীত আর গণসঙ্গীতে প্রথম হয়ে সোনার মেডেল পেয়েছিলো সুজন। গণসঙ্গীত অবশ্য মার কাছে শেখে নি। গত বছর ওদের স্কুলের পাশের কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে সুধীনদা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, এতো চমৎকার গলা তোমরা, ভাল গণসঙ্গীত গাইতে পারবে। সময় করে এসো আমার কাছে, কয়েকটা গান তুলে দেবো তোমাকে। সেই সুধীনদার শেখানো হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গণসঙ্গীত গেয়ে সুজন প্রতিযোগিতায় সোনা জিতেছিলো।

ওদের স্কুলের কোনো ছেলে ছাত্র সংগঠন করতো না। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো সুজন। বাবার পরিচয়ের কারণে বছর দুয়েক আগে একদিন ওদের কলেজের আসিফ ভাই ওকে নিয়ে গিয়েছিলো ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে। সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো শহীদ জাফর চৌধুরীর ছেলে হিসেবে। সেই থেকে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে ওর যোগাযোগ। ও স্কুলে থাকতেই কলেজের কোনো অনুষ্ঠান হলে আসিফ ওকে নিয়ে যেতো গান গাইবার জন্য। ফুটফুটে এক কিশোরের গলায়-ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা, যদি তোর ডাক শুনে, কিংবা বাঁধ ভেঙ্গে দাও শুনে সবাই মুগ্ধ হয়ে যেতো। বাবার পরিচয় পেলে বড়দের কেউ কেউ এখনো এসে বলেন, জাফর ভাইর মতো চমৎকার মানুষ হয় না। যে কোনো মানুষের বিপদে আপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। আদর্শের জন্য শহীদ হয়েছেন। এসব কথা শুনলে বাবার জন্য গর্বে বুকটা ভরে ওঠে ওর। তখন মনে হয় পৃথিবীটা অনেক বড়, অনেক সুন্দর। কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায় বাড়ির লোকজনদের দুর্ব্যবহারের কথা। ভুলে যায় সকল লাঞ্ছনা আর গঞ্জনা। ভাবে এই পৃথিবীকে যারা আরো সুন্দর করার জন্য লড়ছে সে তাদেরই একজন। ছাত্র ইউনিয়নের কাজে নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলো–বছর না ঘুরতেই নগর কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হলো ওকে। সুজন জানে এবার ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ওকেই সাধারণ সম্পাদকের পদের জন্য দাঁড় করানো হবে। কলেজের ছেলেরা সবাই ওকে এক ডাকে চেনে।

সেদিন কলেজের কি একটা গণ্ডগোল হওয়ায় বিকেলে সুজনদের কেমিস্ট্রি ক্লাশটা হল না। বাসায় না গিয়ে ও সোজা চলে গেলো ছাত্র ইউনিয়নের অফিসে। ওকে দেখে আসিফ হইচই করে উঠলো–তোর জন্য একটা দারুণ খবর আছে সুজন। আগে বল কি খাওয়াবি?

সুজনের পকেট তখন একেবারে ফাঁকা। টিউশনির বেতন পেতে আরো তিন দিন। শুকনো হেসে বললো, কি খাওয়াবো সেটা নির্ভর করছে খবরটা কি তার ওপর।

গলা খুলে হাসলো আসিফ–খবর হচ্ছে আটদিন পর তুই বুখারেস্ট যাচ্ছিস।

তার মানে? আসিফের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো সুজন।

মানে খুব সোজা। সাদামাটা গলায় আসিফ বললো, ওখানকার ইয়ং পাইওনিয়ারদের একটা কংগ্রেস হচ্ছে। আমাদের দুজন প্রতিনিধি চেয়েছে ওরা। আমরা ঠিক করেছি তোকে আর খুলনার বরুণকে পাঠাবো।

আমি যাবো মানে আমি কি ইয়ং পাইওনিয়ার?

আমাদের ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আগেও ইয়ং পাইওনিয়ারদের কনফারেন্সে ডেলিগেট পাঠানো হয়েছে।

এত সব বড় বড় নেতা থাকতে আমাকে কেন?

আসিফ গম্ভীর হয়ে বললো, আগামী দিনের নেতাদের আমরা এভাবেই তৈরি করি, যাতে তারা যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারে।

কোনো কথা না বলে সুজন হা করে তাকিয়ে রইলো আসিফের দিকে। আসিফ নিরীহ গলায় বললো, মুখ বন্ধ কর, পেটে মাছি ঢুকবে। কাল তুই ছয় কপি পাসপোর্ট ছবি তুলে রাখবি। পরশু তোকে নিয়ে পাসপোর্ট অফিসে যাবো। টাকা বেশি দিয়ে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পাসপোর্ট করিয়ে নিতে হবে। তারপর যেতে হবে ভিসার জন্য। গরম কাপড়ের জন্য ভাবিস না। গত বছর মস্কো থেকে আমি দারুণ একটা ওভারকোট আর টুপি এনেছিলাম। ওগুলো নিতে পারবি।

এতক্ষণ পর সুজনের বিশ্বাস হল ও সত্যি সত্যি রুমানিয়া যাচ্ছে। বললো, কতদিন থাকতে হবে?

রুমানিয়াতে দু সপ্তাহ। আমরা চেষ্টা করছি ফেরার পথে সোভিয়েত ইউনিয়নের দু একটা পাইওনিয়ার ক্যাম্প দেখে আসতে পারি কিনা। ওটার ব্যবস্থা করা গেলে ধর আরো দিন দশেক।

সুজনের মুখে ততক্ষণে হাসি ফুটলো–সত্যিই দারুণ খবর দিয়েছেন আসিফ ভাই। মিষ্টি পাওনা থাকলো। আমি জানি আপনিই আমার কথা বলেছেন।

বলেছি। গম্ভীর হওয়ার ভান করে আসিফ বললো, তবে সেটা মিষ্টি খাওয়ার লোভে নয়। তোকে আমি ভালবাসি বলেই।

লাজুক হেসে সুজন শুধু বললো, জানি।

তাহলে বল বুখারেস্ট থেকে আমার জন্য কী আনবি?

আপনি যা বলবেন।

কিছুক্ষণ সুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মিষ্টি হেসে আসিফ বললো, কার্পেথিয়ানের তুশনাদ হ্রদের তীরে চমৎকার ক্যাম্পিং শেষ করে তুই ভালোয় ভালোয় ফিরে আসবি–এর চেয়ে বেশি কিছু আমি চাই না।

পাঁচ বছরের বড় আসিফের জন্য গভীর ভালবাসায় সুজনের বুকটা ভরে গেলো। বললো, রুমানিয়ায় আমার যা সবচেয়ে ভালো লাগবে সেটাই আনবো আপনার জন্য।

গম্ভীর হওয়ার ভান করে আসিফ মাথা নাড়লো–না, সেটা তোর পক্ষে সম্ভব হবে না।

কেন? অবাক হয়ে জানতে চাইলে সুজন।

গতবার আমি যখন রুমানিয়া গিয়েছিলাম তখন সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো সেখানকার মেয়েদের। বাইরে থেকে যারা যায় সবাই বলে ইউরোপের অন্য কোনো দেশের মেয়েরা এতো সুন্দর হয় না। তোরও নিশ্চয় ভাল লাগবে।

ধেৎ, কি যে বলেন! লজ্জায় লাল হল সুজন-সুভেনিরের দোকানে কি মেয়ে কেনা যায়?

সুভেনিরের লোভ দেখবি না সুজন। আমার কাছে যা আছে সেগুলো রাখার জায়গা না পেয়ে এমনিতেই বড় বিপদে আছি আমি। তুই আর বিপদ বাড়াস নি।

আসিফের কথার ধরনে গলা খুলে হাসলো সুজন। সঙ্গে গলা মেলালো আসিফ।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সবার আগে রুমানিয়া যাওয়ার কথাটা মাকে জানালো সুজন। মা তখন রান্নাঘরে তরকারি কুটছিলেন। সুজনের কথা শুনে বটিখানা একপাশে সরিয়ে, ওর কপালে চুমু খেয়ে বললেন, আমি জানি তুই অনেক বড় হবি। তোর বাবার চেয়েও অনেক বড়। অনেক দেশের মানুষ তোকে চিনবে।

বাবার কথা উঠতেই সুজনের বুকটা ভারি হয়ে এলো। ধরা গলায় বললো, যত বড় হই না কেন তোমার কাছে ছোট্ট সুজনই থাকতে চাই মা।

গভীর মমতায় ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মা। সুজন বললো, চাচাঁদের তুমিই খবরটা দিও মা। আমার ভয় হচ্ছে যদি যেতে না দেন।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বললেন, যেতে দেবেন না কেন? তুই বেড়াতে ভালবাসিস। এরকম সুযোগ কি বার বার আসে?

তুমি তো বলো বাবা অনেক দেশ ঘুরেছেন। তিনি কি রুমানিয়া গিয়েছিলেন?

ছেলের প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলেন মা-তোর বাবা চীন আর আলবেনিয়া ছাড়া সবগুলো কমিউনিস্ট দেশই ঘুরেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন তিনবার।

তুমি কখনো যাও নি বাবার সঙ্গে?

একবার মস্কো গিয়েছিলাম। তবে ঘুরেছি ইণ্ডিয়াতে। দিল্লী, আগ্রা থেকে শুরু করে পণ্ডিচেরী পর্যন্ত কিছু বাদ রাখি নি।

কবে গিয়েছিলেন ইন্ডিয়া?

যে বছর আমাদের বিয়ে হল–সেই তেষট্টি সালে। দুবছর পরে গিয়েছিলাম মস্কো।

তোমাকে এখন দেখলে কেউ বলবে না চব্বিশ বছর আগে তুমি মস্কো গিয়েছিলে।

ম্লান হেসে মা বললেন, এখন কি আমাকে ঠিকে ঝি মনে হয়?

মাকে জড়িয়ে ধরে সুজন বললো, তুমি আমার মা। চিরকাল তোমাকে আমার মা ই মনে হবে।

সুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মা বললেন, এখন তো ইউরোপে অনেক শীত। তোর যে গরম কাপড় কিছুই নেই!

ওসব নিয়ে তুমি কিছু ভেবো না মা। আসিফ ভাই সব ব্যবস্থা করে দেবেন।

দরকারের চেয়ে বেশি করেছিলো আসিফ। অনেক আগে ওর ছোট ভাই পুকুরে ডুবে মারা গিয়েছিলো। পুতুলের মতো ফুটফুটে ভাইটাকে পাগলের মতো ভালবাসতো আসিফ। সুজনের সঙ্গে কথা বলার পর মনে হয়েছে ওর ছোট ভাইটা বেঁচে থাকলে ওর মতোই সুন্দর হতো দেখতে। সুজন নিজেও জানে না আসিফের বুকের ভেতর ওর ছোট ভাইর জায়গাটুকু কখন সে দখল করে নিয়েছে।

বড় চাচা শুনে প্রথমে একটু গাঁইগুই করেছিলেন। আসিফ তাঁকে বুঝিয়েছে। পাসপোর্ট ভিসা, টিকেটের জন্য যাবতীয় ছুটোছুটি সেই করেছে। সেদিনের পর থেকে প্লেনে ওঠা পর্যন্ত আটটা দিন একরকম ঘোরের ভেতর কেটেছে সুজনের। তবে মাঝখানে একটু দমে গিয়েছিলো বরুণ যাবে না শুনে। যাওয়ার তিন দিন আগে বরুণ জানিয়েছে ওর বাবার খুব অসুখ। এ অবস্থায় রুমানিয়া যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়।

বরুণকে সান্ত্বনা দিয়ে আসিফ বলেছে, তুই কিস্যু ভাবিস না বরুণ। তার বাবা ভালো হয়ে যাবেন। তোকে আগামী বছর পাঠাবো। আর সুজনকে বলেছে, একা যেতে হবে বলে মন খারাপ করছিস কেন? আমি যখন প্রথমবার সোফিয়া গেলাম তখন একাই গিয়েছিলাম, তোর চেয়ে বেশি বড় ছিলাম না। তুই তো মিশনারি স্কুলে পড়ে ভালো ইংরেজি বলতে পারিস। আমি তাও পারতাম না।

গরম জামা কাপড় সুজনের বলতে গেলে কিছুই ছিলো না। এমন কি একটা সুটকেস পর্যন্ত নয়। আসিফ নিজের সুটকেসে দরকার মতো সব কিছু গুছিয়ে দিয়েছে। সব শেষে নিজের অটোমেটিক ক্যামেরাটাও ওর কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে। এয়ারপোর্টে আসিফের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে কিছুতেই কান্না সামলাতে পারলো না সুজন।

.

২. একটি রোমাঞ্চকর দায়িত্ব

ভোরে অনেকক্ষণ বেজে থেমে গিয়েছিলো টেলিফোনটা। আকাশ তখন গভীর ঘুমে অচেতন। ম্যালকমদের পার্টি থেকে রাতে ও এ্যাপার্টমেন্টে ফিরেছে সাড়ে তিনটার দিকে। চল্লিশ মিনিট গাড়ি ড্রাইভ করে ফিরতে হবে বলে পার্টিতে ও কড়া ড্রিংক নেয় নি। ম্যালকমের নতুন বান্ধবী সুজানা ওকে মার্টিনির সঙ্গে সোডা আর লাইম দিয়ে চমৎকার একটা ককটেল বানিয়ে দিয়েছিলো। সঙ্গে বারবেকিউর কচি ভেড়ার রোস্ট ছিলো। সালাদটাও ছিলো চমৎকার। ম্যালকমদের থ্যাংকস গিভিং পার্টিটা দারুণ জমেছিলো।

ফেরার সময় ফাঁকা রাস্তায় ঘন্টায় আশি মাইল স্পীডে নিজের সদ্য কেনা আলফা রোমিও গাড়িটা চালাতে গিয়ে আকাশের মনে হচ্ছিলো হেমন্তের ভারহীন মেঘের মতো ভেসে চলেছে। রাতে ও ঠিক করেছিলো লম্বা একটা ঘুম দিয়ে বারটায় উঠবে। গত কয়েক দিন সোহেল ভাই না থাকাতে রাতে ওকে ভয়েস অব আমেরিকায় বাংলা বিভাগের কাজও করতে হয়েছে। ও কাজ করে ইউরোপিয়ান ডেস্কে।

প্রথমবার টেলিফোনের শব্দ কানে না গেলেও দ্বিতীয়বার বাজার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের ঘুম ভেঙে গেলো। বিছানার শুয়ে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে, হ্যালো বলতেই মার গলা শুনলোসকালে কি বেরিয়েছিলি আকাশ? আমি দু ঘন্টা আগেও একবার ফোন করেছিলাম।

ঘুম জড়ানো গলায় আকাশ বললো, না মাম, ঘুমোচ্ছিলাম। রাতে পার্টি ছিলো, দেরি করে ফিরেছি। তুমি কোত্থেকে বলছো?

সেইন্ট লুইস থেকে। স্বাতাঁকে দেখতে এসেছিলাম। জামাই যেতে দিলো না।

আকাশের দুবছরের বড় বোন স্বাতী, বিয়ে করেছে আমেরিকান ছেলেকে, ল্যাণ্ডস্কেপ ইঞ্জিনিয়ার, ভারি চমৎকার স্বভাবের। দুদিন আগে ওদের ছেলে হওয়ার খবর পেয়েছে আকাশ। বলেছে পরের উইকএণ্ডে দেখতে যাবে। মাকে ও জিজ্ঞেস করলো, পিচ্চিটা কেমন আছে মাম, কার মতো দেখতে হয়েছে?

গায়ের রং পেয়েছে বাপের। হেসে মা বললেন, তবে চুল আর চোখের রং কালো। কি যে সুন্দর হয়েছে না দেখতে?

মার গলায় খুশির ছোঁয়া দেখে ভালো লাগলো আকাশের। স্বাতী যখন গত বছর নিজের পছন্দের এই ছেলেটিকে বিয়ে করতে চাইলো, মার মুখ কালো হয়ে গিয়েছিলো। চব্বিশ বছর ধরে এদেশে থাকলেও মার স্বভাব মোল আনা বাঙালি রয়ে গেছে। ভাগ্যিস জামাইটা হয়েছিলো বাঙালি স্বভাবের, হয়তো পূর্ব পুরুষ ইটালি থেকে আসার কারণে। নইলে মা খুব কষ্ট পেতেন।

মা বললেন, কথা বলছিস না কেন আকাশ? আজকের তারিখটা মনে আছে তো?

আকাশের ঘুমের ঘোর তখনও পুরোপুরি কাটে নি। একটু অবাক হয়ে জানতে চাইলো, আজকের তারিখ মনে রাখতে হবে কেন মাম?

তুই সব সময় তোর জন্মদিনের কথা ভুলে যাস। শুভ জন্মদিন আকাশ। মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্ন অব দ্য ডে।

থ্যাংক ইউ মাম। আকাশ লাজুক হাসলো।

মা ঠিকই বলেছেন। নিজের জন্মদিনের কথা ওর কখনো মনে থাকে না। দেয়ালে ঝোলানো স্মিথসোনিয়ার মিউজিয়ামের চমৎকার ডিজিটাল ক্যালেণ্ডারে জ্বলজ্বল করছে নবেম্বর ২৯, ১৯৮৯। তার মানে ওর বয়স আজ তেইশ বছর হচ্ছে। নিজেকে বেশ পরিণত বয়স্ক একজন মনে হলো আকাশের। অবশ্য অফিসে ওর সিনিয়ররা সব সময় বলেন, বয়সের তুলনায় ও যথেষ্ট পরিণত এবং বুদ্ধিমান। গত বছর জানুয়ারিতে ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মাস কম্যুনিকেশনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ভয়েস অব আমেরিকায় জয়েন করেছে। এত অল্প বয়সে ওর আগে কেউ এ ধরণের পোস্টে জয়েন করে নি। রেকর্ড মার্কস নিয়ে পাস করেছে বলেই চাকরিটা জুটেছিলো ওর কপালে।

চাকরির দু বছর না হতেই তিনবার ও ইউরোপ ঘুরে এসেছে বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে। যখন ফ্রেঞ্চ বলে খাঁটি ফরাশিরাও চেহারা না দেখলে বুঝতে পারবে না ও যে ফরাশি নয়। কাজ চালাবার মতো জার্মান আর স্প্যানিশও বলতে পারে। ইউনিভার্সিটির সে দল টিমে ক্যাপ্টেন ছিলো পর পর দুবছর। এ সবই ওকে ভয়েস অব আমেরিকার বিশেষ প্রতিনিধির এই লোভনীয় চাকরি পেতে সাহায্য করেছে।

মা বললেন, আমরা ঘুমোবি নাকি? দশটা বাজে। অফিসে, যাচ্ছিস কখন?

হাই তুলে আকাশ বললো, এ বেলা অফিস নেই। ভেবেছিলাম বারটা অব্দি ঘুমোবো। তুমি আর ঘুমোতে দিলে কই!

স্বাতী আর স্যাম তোকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মা একটু থেমে শব্দ করে হেসে উঠলেন–জুনিয়র স্যামও ওর আঙ্কেলকে উইশ করছে। বিকেলে আমরা তোর জন্মদিনের কেক খাবো। তোর বাবাও আসবে। খুব মিস করবো তোকে।

সামনের উইক এন্ডে সেন্ট লুইস এসো মাম। ড্যাডকেও বোলো আসতে।

তুই যে আসবি স্বাতী বলেছে। ভাল থাকিস আকাশ। আমরা সবাই তোকে ভালোবাসি।

আমিও তোমাদের ভালবাসি মাম। তোমরা ভালো থেকো। টেলিফোন রেখে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো আকাশ। ভয়েস অব আমেরিকায় চাকরি হওয়ার পর দুই রুমের এই এ্যাপার্টমেন্টটা কিনেছে ও। বার হাজার ডাউন পেমেন্ট করেছে এর জন্য, বাকিটা মাসে মাসে কিস্তিতে দিচ্ছে। এখানে সব কিছু কিস্তিতে কেনা যায়। গাড়িটাও একই ভাবে কেনা। পুরোটা নগদ দিতে হলে এত দামি গাড়ি কিনতে ওর কয়েক বছর লাগতো। আলফা রোমিও গাড়িটা কেনার পর থেকে ওর বান্ধবীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। তবে ওরা শুধুই বান্ধবী, বেশি কিছু নয়।

বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লো আকাশ। ঘড়ি ধরে পুরো তিরিশ মিনিট ফ্রি হ্যাঁণ্ড ব্যায়াম করলো। ঘাম ঝরিয়ে যখন আয়নার সামনে দাঁড়ালো তখন এগারটা বাজে। নিজেকে আয়নায় দেখে হাসি পেলো আকাশের। ওর বয়স তেইশ হলেও কেউ বলবে না ও কুড়ি পেরিয়েছে। যদিও শেভ করে রোজই, ব্যায়াম করা পেটা শরীর ওর, তবু চেহারায় রয়ে গেছে কিশোরসুলভ কমনীয়তা। এ দেশে জন্ম হলেও ওর গায়ের রঙ তামাটে, চেহারায় কিছুটা মিল রয়েছে হলিউডের এককালের তুখোড় অভিনেতা ওমর শরীফের সঙ্গে। অনেকে জানতে চেয়েছে ও আরব না ইজিপ্সিয়ান। বাঙালী শুনে অবাক হয়েছে, সচরাচর বাঙালিদের চেহারা এত শার্প হয় না।

শেভ করে গোসল সেরে এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস হাতে পুবের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো আকাশ। হেমন্তের নরম রোদমাখা এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। তামাটে রঙের চেস্টনাট আর লালচে ওক গাছগুলো ঝলমলে রঙের পাতা ঝরিয়ে ডাল নেড়ে অভিনন্দন জানালো ওকে। আকাশের ভাবতে ভালো লাগলো। আজ ওর জন্মদিন। পটোম্যাক নদীর পশ্চিম তীরে বার তলার ওপর ছোট্ট এ্যাপার্টমেন্টটা ওর বেশি ভালো লাগে এক চিলতে এই বারান্দাটার জন্য। সামনে শুয়ে আছে শান্ত নদী, ওপারে ওয়াশিংটন ডিসির মূল শহর। ওর বারান্দা থেকে আমেরিকার সবুজ নিরিবিলি রাজধানী শহরের পুরোটাই দেখা যায়। দূরে ক্যাপিটল হল-এর সাদা গম্বুজ, তার সামনে স্মিথসোনিয়াম মিউজিয়ামের পুরোনো আমলের লাল ইমারত, আরো কাছে ওয়ার মনুমেন্ট। সমান্তরালভাবে চলে গেছে কন্সটিটিউশন এভিনিউ আর ইণ্ডিপেণ্ডেন্স এভিনিউর চওড়া রাস্তা দুটো। দু পাশে সাজানো গাছ, মাঝখানে ঘাসজমি দূর থেকে মনে হয় এক টুকরো সবুজ মখমলের রিবন পড়ে আছে। নিউইয়র্ক, শিকাগো কিংবা অন্য সব শহরের মতো এখানে আকাশ ছোঁয়া দালানের স্তূপ নেই, রাস্তায় আবর্জনা নেই, ভবঘুরে ভিখিরি কদাচিৎ চোখে পড়ে। অতি পরিপাটি সাজানো গোছানো এই শহর–দুবছর না কাটতেই আকাশের মন কেড়ে নিয়েছে।

ঘরে ফিরে ও ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসঙ্গেই সারলো। রুটি, মাখন, জেলি, সসেজ সব ফ্রিজেই থাকে। সামান্য সময় দিতে হল টোস্টারে রুটি টোস্ট আর দুটো ডিম পোচ করার জন্য। সিরিয়ালও ছিলো কয়েক রকমের। ওসব খেতে ইচ্ছে করলো না আকাশের। সকালে বা দুপুরে বাটার টোস্টের সঙ্গে সসেজ আর ডিম খেতেই ভালো লাগে ওর। কখনও একমুঠো বীন ভেজে নেয় মার্জারিনে।

খাবার সেরে কালো কফির পেয়ালা নিয়ে বারান্দায় বসতেই আবার টেলিফোন বাজলো। সম্ভবত সামান্থা নয়তো অফিসের ব্লেন্ডা। ওদের নোট বইতে ওর জন্মদিনের তারিখ লেখা আছে।

উঠে গিয়ে রিসিভার তুলতেই ওপাশ থেকে ওর বস হেনরী পেপার্স-এর বাজখাই গলা ভেসে এলো ঘুম থেকে উঠেছো তাহলে। ম্যালকম বললো এ সময় তোমাকে ঘরেই পাওয়া যাবে । ব্রেকফাস্ট সেরেছো?

হেনরী পোপার্সকে অফিসের কেউ নরম গলায় কথা বলতে শোনে নি। টেলিফোনে নিজের বউকে যখন বলেন আমি তোমাকে ভালোবাসি ক্যাথি, শুনে মনে হয় কোনো অপকর্মের জন্য বুঝি তাকে ধমক দিচ্ছেন। আকাশ কিছুই বুঝলো না, বস তার ওপর প্রসন্ন, নাকি রেগে আছেন। ছোট্ট জবাব দিলো, ব্রেকফাস্ট শেষ করেছি।

এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো। তিরিশ মিনিট পর আমার কামরায় দেখতে চাই তোমাকে। আকাশকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন হেনরী পেপার্স। গত বারো বছর ধরে তিনি ভয়েস অব আমেরিকার ইউরোপিয়ান ডেস্কের প্রধান। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির জার্নালিজমের প্রফেসর ইমানুয়েল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁর কাছে আকাশের কথা শুনেই ওকে ওয়াশিংটনে তলব করে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ওর জন্য হেনরী পেপার্স-এর হৃদয়ে যে নরম একটি কোণ রয়েছে এ কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দেন নি কাউকে। অফিসের কেউ জানে না ওঁর ছেলে বব, একাত্তরে ভিয়েতনামের যুদ্ধে গিয়ে যে লাশ হয়ে ফিরে এসেছিলো, তখন ও ছিলো আকাশের বয়সী।

ঠিক তিরিশ মিনিট পর আকাশ ওঁর ঘরে ঢুকতেই স্বভাব সুলভ বাজখাই গলা শুনলো বোসো। ভূমিকা না করেই তিনি বললেন, রুমানিয়ার খবর কিছু জানো?

ডিক পেন বুখারেস্টে ওদের প্রতিনিধি। গত সাতদিন রুটিন মতো গতানুগতিক কিছু খবর পাঠিয়েছে। মাস তিনেক আগে আকাশ নিজেও ঘুরে এসেছে রুমানিয়া থেকে। ওখানকার কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস হয়েছে। নিকোলাই চসেস্কু আবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। পূর্ব ইউরোপের অন্য সব দেশে কমিউনিস্ট সরকারগুলোর পতন হলেও রুমানিয়ায় সে ধরনের কোনো কিছু ঘটার কোনো সংবাদ তখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। আকাশ বললো, গতকাল পর্যন্ত ডিক যা পাঠিয়েছে তাতে বলার মতো কিছু নেই।

ডিক একটা আস্ত গর্দভ। হুঙ্কার দিলেন হেনরী পেপার্স প্রফেসর গর্ডনকে চেনো? ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনে আছেন। এক সময় সিআইএ-র উপদেষ্টা ছিলেন।

চিনি। সংক্ষেপে জবাব দিলো আকাশ। বছর দুয়েক আগে ওদের ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর গর্ডন পূর্ব ইউরোপের ওপর একটা সেমিনার করেছিলেন। সেখানকার যাবতীয় তথ্য তার নখদর্পণে। গত কয়েক মাস ধরে সেখানে পরিবর্তনের হাওয়া লাগার পর তার মতামত সবাই গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করছে।

চিনলে ভালো কথা। গর্জে উঠলেন হেনরী পেপার্স। এক্ষুণি তুমি তার সঙ্গে দেখা করো। সাড়ে বারোটায় তোমাকে সময় দিয়েছেন। পরশু রুমানিয়া যাচ্ছো তুমি। ভিসা

তো নেয়া আছে? কাল মার্থার কাছ থেকে টিকেট সংগ্রহ করবে। কোনো প্রশ্ন?

পরশু ফ্লাইট কখন?

সন্ধ্যায়।

তাহলে আজ আর কাল দুদিনের ছুটি চাই। মার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিলো উইক এন্ডে।

প্রফেসর গর্ডনের সঙ্গে আলোচনার পর থেকে ছুটি মঞ্জুর। রুমানিয়ায় তোমাকে সাতদিনও থাকতে হতে পারে একমাসও হতে পারে। সেভাবে তৈরি হয়ে যেও। একটু থেমে ওর মুখের দিকে তাকালেন হেনরী পেপার্স। ছেলেটাকে ওঁর ভালো লাগে এ জন্যে–কখনো কোনো কাজে না বলবে না। যত কঠিন এ্যাসাইনমেন্ট হোক দারুণ সব রিপোর্ট বের করে আনে। লোক পটাতে এ ছেলের জুড়ি নেই। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র–এ কথা তিনি বিশ্বাসও করেন। ধমকের গলায় বললেন, উইশ ইউ গুড লাক।

ধন্যবাদ জানিয়ে বসের কামরা থেকে বেরিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো আকাশ। রুমানিয়া–শব্দটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ওর চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বরফ ঢাকা কার্পেথিয়ান পর্বতমালা, পাইন আর বার্চের ঘন সবুজ বন। গতবার আলাপ হয়েছিলো এলেনার সঙ্গে, সদ্য ফোঁটা গোলাপের মতো মিষ্টি মেয়ে, বুখারেস্ট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, ওর দোভাষীর কাজ করেছিলো। এখানে চাকরি নেয়ার পর রুমানিয়া, পোল্যাণ্ড, হাঙ্গেরী–এসব দেশে বার দুয়েক ঘোরা হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে পোল্যাণ্ড গিয়ে ওয়ালেসার একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়ে গোটা অফিসে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিলো। এবার চেষ্টা করবে চসেস্কুর সঙ্গে যদি কথা বলা যায়। নতুন দায়িত্ব পেয়ে রোমাঞ্চ বোধ করলো আকাশ। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলো। সোয়া বারোটা বাজে। পনেরো মিনিটের ভেতরে ব্রুকিংস-এ যেতে হবে।

প্রফেসর লিংকন গর্ডন অফিসে ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। তিন মিনিট দেরি করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেই হাসি খুশি চেহারার বুড়ো প্রফেসর ওকে বললেন, হেনরীকে আমি ভালো করেই জানি। তোমাকে যে ও দম ফেলার সময় দেয় নি এটা বুঝতে আমার বাকি নেই। বসো, কফি দিতে বলি।

ছোট্ট অফিস কামরার অর্ধেক জুড়ে প্রফেসরের বিশাল টেবিল। সারা ঘরে এলোমেলো বইপত্র ছড়ানো। টেলিফোনে সেক্রেটারিকে কফি দিতে বলে প্রফেসর আকাশের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলেন-আমার ঘরটা খুবই আগোছালো। আশা করি তুমি কিছু মনে করবে না। কাজের কথায় আসা যাক।

কটু থেমে সামান্য কেশে গলা পরিষ্কার করে প্রফেসর বললেন, পূর্ব ইউরোপের পাঁচটা দেশে কমিউনিস্ট সরকারের যে পতন হয়েছে এ ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই জানতাম। পোল্যাণ্ডের সলিডারিটি সম্পর্কে আমি পাঁচ বছর আগেই ভবিষ্যত্বাণী করেছিলাম। আমার কথার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সিআইএ-র তিন বছর লেগেছে।

আকাশ বললো, আপনি দু বছর আগে কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এক সেমিনারেও এ কথা বলেছিলেন।

তোমার মনে আছে তাহলে! প্রফেসর গর্ডন বললেন, এদের সম্পর্কে আমার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকলেও রুমানিয়া আর আলবেনিয়া সম্পর্কে খুব কমই জানি।

প্রফেসরের তরুণী সেক্রেটারি আকাশের সামনে কফির পেয়ালার সঙ্গে এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি বললেন, গত মাসে বাংলাদেশের একজন সাংবাদিকের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছিলো। সে কিছুদিন আগে রুমানিয়া আর আলবেনিয়া ঘুরে এসেছে। ওর কিছু পর্যবেক্ষণ আমি নোট করে রেখেছিলাম। আলবেনিয়ার সঙ্গে আমাদের কোনোরকম সম্পর্ক না থাকাতে সেখানকার ব্যাপারে এগুতে পারি নি। তবে রুমানিয়া সম্পর্কে বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য আমার হাতে এসেছে। আমার ধারণা রুমানিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থান হতে পারে। তোমার জন্য আমি একটা ফাইল তৈরি করেছি। এখনকার পরিস্থিতি বুঝতে এটা তোমাকে সাহায্য করবে।

ফাইল হাতে নিয়ে আকাশ বললো, রুমানিয়ায় সামরিক অভ্যুত্থান হলে আমেরিকার ভূমিকা কী হবে?

রহস্যময় হেসে প্রফেসর গর্ডন বললেন, নিরব দর্শকের। অভূত্থান ঘটাতে চাইছে সোভিয়েতপন্থীরা। আমরা প্রকাশ্যে সমর্থন করবো না, বিরোধিতাও করবো না। অফিসিয়ালি আমরা কিছুই জানি না। চসেস্কুকে যদি হটাতে পারে তখন আমাদের কাছে আসা ছাড়া ওদের গতি নেই। রাশিয়া আগের মতো কারও দায় নিতে পারবে না।

দায় নিতে না পারলে চসেস্কুকে হটাতে চাইছে কেন?

ইদানীং চসেস্কু রাশিয়ার বিরুদ্ধে যা-তা বলছে। এটা গর্বাচভের জন্য খুবই অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত কয়েক বছর ধরে চসেস্কুর সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কও তো ভালো যাচ্ছে না।

সে জন্যেই তো আমরা রাশানদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে চসেস্কুকে কিছু জানাতে চাই না। আসলে আমরা কিছুই জানি না। এই বলে প্রফেসর মুখ টিপে হাসলেন।

রুমানিয়ার পরিস্থিতি বোঝার জন্য প্রফেসর গর্ডনের অফিসে পুরো একটি ঘন্টা কাটালো আকাশ। ওর কথা বলার ভঙ্গি আর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা প্রফেসরকে রীতিমতো মুগ্ধ করলো।

আকাশ ওর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই প্রফেসর ফোন করলেন হেনরী পেপার্সকে–দারুণ ছেলে পাঠিয়েছে হেনরী! একেবারে হীরের টুকরো।

আমার বিচারবুদ্ধির ওপর তোমার আস্থা দেখে খুশি হলাম লিংকন। অপর প্রান্ত থেকে হুঙ্কার শুনলেন প্রসেফর।

সত্যি বলছি হেনরী! একে আমরা আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগাতে পারি।

তোমার মতলব বুঝেছি। বাজখাই গলায় হেনরী পেপার্স বললেন, না বাপু, সেটি হচ্ছে না। আকাশকে আমি কোনো অবস্থায় হারাতে চাই না।

<

Super User