অনীকের জন্য ভালোবাসা – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

১. মার সঙ্গে দিব্যেন্দুর বিয়ে

আমার নাম অনীক। স্কুলে আমার ক্লাসের ছেলেমেয়েরা ডাকে শুধু নিক। লন্ডনের সাউথগেট কমিউনিটি স্কুলের সেভেন্থ গ্রেডে পড়ি। আমার বয়স ষোল, উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি, ওজন একশ বেয়াল্লিশ পাউন্ড। গায়ের রং বাদামি, চুল কালো, চোখের রঙও কালো। আমার জন্ম বাংলাদেশের সিলেটে, এখন বৃটিশ নাগরিক। আমার মা পনেরো বছর ধরে লন্ডনে আছে, বিবিসি-তে চাকরি করে।

বাবার কথা আমার মনে পড়ে না। আমার যখন বয়স এক বছর তখন মার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ভেঙে যায়। মা আমাকে নিয়ে লন্ডনে চলে আসে। এত বছর ধরে লন্ডনে থাকলেও মা নিজের দেশকে ভুলতে পারেনি। তার ঘরে তিন আলমারি বাংলা বই, কয়েকশ বাংলা গানের এল পি, অডিও ক্যাসেটের কোনো হিসেব নেই। টেলিভিশনে বাংলা ছবি দেখালে মা ওটা রেকর্ড করে রাখে, আর ছুটির দিনগুলোতে ঘুরে ফিরে দেখে। মা আমাকে ছোটবেলা থেকে বাংলা শিখিয়েছে যত্ন করে। আমার বয়সী যে কোনো বাঙালি ছেলের চেয়ে আমি ভালো বাংলা লিখতে পারি। স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আমি জার্মান নিয়েছি। বাংলা এত ভালো জানলেও বলার সময় মার মতো কিংবা দিব্যেন্দুর মতো তাড়াতাড়ি বলতে পারি না।

দিব্যেন্দু মার সঙ্গে বিবিসিতে কাজ করে। দুবছর আগে মা ওকে বিয়ে করেছে। বাইরের লোকজনের সামনে দিব্যেন্দুকে বাবা বলি, ঘরে নাম ধরে ডাকি। বয়স চল্লিশ, মার চেয়ে দুবছরের বড়। তবে স্বাস্থ্য ভালো বলে তিরিশের বেশি মনে হয় না। আমার চেয়ে দিব্যেন্দু অনেক হ্যান্ডসাম। ফর্শা তো বটেই, চেহারাও খুব শার্প, অনেকটা টম ক্রুজের মতো। দিব্যেন্দু যখন মাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো তখন ওদের কমন বন্ধুরা খুব অবাক হয়েছিল। যে অর্থে মেয়েদের সুন্দরী বলা হয় মা সে অর্থে সুন্দরী নয়। গায়ের রং আমার চেয়ে সামান্য ফর্শা, চশমা পরা গম্ভীর চেহারায় মাকে তার বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক মনে হয়।

বিয়ের অনেক আগে থেকেই দিব্যেন্দু আমাদের বাড়িতে আসতো। ছোটবেলায় সে আমাকে তার নাম ধরে ডাকতে শিখিয়েছে। বলেছে আমার একজন ভালো বন্ধু সে। তার মতো চমৎকার মনের মানুষ আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। ছোটবেলা থেকেই দেখছি আমার যখন যা দরকার বলার আগেই কীভাবে সে টের পেতো আমি জানি না। ঠিক নিয়ে আসতো। মজার কোনো ইউনিভার্সাল ছবি রিলিজ হলে প্রথম দিনই তিনখানা টিকেট কেটে হাজির হবে । মা প্রথম প্রথম আপত্তি করতো। শেষে এটা রুটিন ব্যাপার হয়ে গিয়েছে।

বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে সবার আগে দিব্যেন্দু কথা বলেছিলো আমার সঙ্গে। রোজকার মতো স্কুল থেকে ফিরে আমি ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঘর খুলে ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে টেলিভিশনের সামনে খেতে বসবো, এমন সময় ডোরবেল বাজলো। মা অফিসে যায় সকালে, ফেরে রাত সাতটার দিকে। আমি দরজা খুলে দিব্যেন্দুকে দেখে অবাক হলাম। কারণ মা না থাকলে সে আসে না। বললাম, মা তো অফিসে!

জানি। আমি অফিস থেকেই আসছি। দিব্যেন্দু সামান্য হেসে বললো, আজ আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। কী করছো তুমি?

কিছু না। আমি বললাম, খাওয়া নিয়ে বসতে যাচ্ছিলাম।

তোমাকে নিয়ে যদি বাইরে কোথাও খাই তুমি কি আপত্তি করবে?

বাইরে খেতে আমি খুব ভালোবাসি। বললাম, আমি খুশি হবো।

দিব্যেন্দু আমাকে নিয়ে নিরিবিলি এক ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে এলো। আমি যা পছন্দ করি সেসব খাবারের অর্ডার দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছিলো। আমি বললাম, আমার সঙ্গে কী কথা বলবে দিব্যেন্দু?।

কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দিব্যেন্দু বললো, আমাকে তোমার কেমন মনে হয় অনীক?

কেমন আবার মনে হবে! খুবই ভালো মনে হয়।

তুমি এখন বড় হয়েছে। কখনও কি লক্ষ্য করেছে তোমার মা কি রকম লোননি?

মাঝে মাঝে মনে হয় লোননি। তবে মা তো কাজের ভেতর ডুবে থাকতে বেশি ভালোবাসে।

অন্য কারও ভালোবাসা পায়নি বলে কাজ ভালোবাসে।

কেন পাবে না? দিব্যেন্দুর কথায় মনঃক্ষুণ্ণ হলাম–মাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।

তুমি তো ছেলে। নিশ্চয় তুমি ভালোবাসবে। আরও ভালোবাসা দরকার তোমার মার।

আমি ছাড়া মাকে আর কে ভালোবাসতে যাবে?

আমি তোমার মাকে ভালোবাসি।

তা হলে আরও ভালোবাসার দরকার বলছো কেন?

আমি তোমার মাকে বিয়ে করতে চাই। শান্ত গলায় কথাগুলো বললো দিব্যেন্দু।

আমি ওর কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম। বিয়ে মানে মা আর আমার মাঝখানে আরেকজন আসবে। মা কি আমাকে বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেবে? ভাবতে গিয়ে ভয় হলো। বললাম, মাকে কি বলেছো একথা?

বলেছি।

মা কী বললো?

বলেছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে। তুমি হ্যাঁ বললে ঠিক আছে। তুমি না বললে তোমার মাও না বলবে।

বিয়ের পর তোমরা কি আমাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেবে?

কক্ষনো না। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকবো। তুমি এখন যেরকম বন্ধু আছো, আরও কাছের বন্ধু হবে।

আমাদের কি তোমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে?

তুমি কী চাও?

আমি চাই মাকে বিয়ে করে তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে।

আমার কথা শুনে দিব্যেন্দু গলা খুলে হাসলো–তুমি যা চাও তাই হবে।

দিব্যেন্দুকে আমি কী বলবো ভেবে পেলাম না। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম–তুমি কি মনে করো মা এতে সুখী হবে?

দিব্যেন্দু গম্ভীর হয়ে বললো, আমি জানি হবে।

ঠিক আছে দিব্যেন্দু। একটু ইতস্তত করে আমি বললাম, মাকে তুমি বিয়ে করতে পারো। আই উইশ ইউ গুড লাক।

থ্যাঙ্ক ইউ অনীক। হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে দিব্যেন্দু মৃদু হেসে বললো, আমার ভয় হচ্ছিলো–তুমি যদি রাজি না হও!

দিব্যেন্দুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললাম, মাকে আমি সুখী দেখতে চাই।

দিব্যেন্দু শান্ত গলায় বললো, আমরা সবাই সুখী হবো অনীক।

মার বিয়েতে কোনো হৈচৈ হলো না। বিবিসি থেকে মা আর দিব্যেন্দুর কজন কমন ফ্রেন্ড এসেছিলো। আমার লেবানিয় বান্ধবী শীলা এসেছিলো। মার বিয়ের কথা শুনার পর থেকে ও আসার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলো।

মা বলে দিয়েছিলো আঠারো বছরের আগে আমাকে হার্ড ডিংক্স দেয়া হবে না। মার বিয়ের রাতে দিব্যেন্দু ডিনারের পর শব্দ করে শ্যাম্পেনের বোতল খুললো। বোতলের মুখ দিয়ে সাদা ফেনার ফোয়ারা ছুটলো। সবাই শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে দিব্যেন্দুর দিকে এগিয়ে গেলো। শীলা আমার কাছে দাঁড়িয়েছিলো। সবার গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢেলে দিব্যেন্দু ছোট গ্লাস এনে আমার আর শীলার হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপর নাটকীয় ভঙ্গিতে মাকে বললো, আশা করি আজকের রাতের জন্য ওরা এক পাত্র পান করতে পারবে।

মা কোনো কথা না বলে মৃদু হাসলো। বিয়ের রাতে খুব হালকা বেগুনি রঙের একটা জামদানি পরেছিলো মা। শাড়ির ভেতর ধবধবে সাদা সুতোর নকশা। মাকে অনেক সুন্দরী মনে হচ্ছিলো। শীলাও বললো, তোমার মাকে দারুণ গ্রেসফুল লাগছে। মনেই হচ্ছে না তোমার মতো বড় একটা ছেলে আছে ওর। দিব্যেন্দুর এক বন্ধু মাকে আর আমাকে নিয়ে ওর সঙ্গে রসিকতা করলো এ্যাদ্দিন পরে বিয়ে করে তুই সবাইকে হারিয়ে দিয়েছিস। রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব শুধু নয়, রাজপুত্রের মতো একটা ছেলেও রেডিমেড পেয়ে গেলি। দিব্যেন্দুও হেসে জবাব দিলো মনে হচ্ছে হিংসায় তোদের বুক ফেটে যাচ্ছে। আই অ্যাম প্রাউড অব মাই সন। বলে দিব্যেন্দু আমার কপালে চুমো খেলো নিক শুধু আমার ছেলে নয়, আমরা দুজন চমৎকার বন্ধু।

শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দিব্যেন্দুর কথা শুনে মনে হলো আমার বয়স অনেক বেড়ে গেছে।

আমার অ্যালবামে বাবার একটা ছবি আছে। আমার বয়স তখন এক। মা বাবা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, আমি বাবার কোলে। ছবিটা সাদা কালো হলেও এত বছরেও নষ্ট হয়নি। ছবিতে মাকে যে রকম সুন্দর দেখাচ্ছিলো দিব্যেন্দুর সঙ্গে বিয়ের রাতে আরও সুন্দর মনে হচ্ছিলো। মনে হলো দিব্যেন্দু মিথ্যে বলেনি, মা সত্যি সুখী হয়েছে।

মার সঙ্গে দিব্যেন্দুর বিয়ের প্রথম বছরটা চমৎকার কাটলো। ওদের বিয়ে হয়েছিলো ডিসেম্বরে। এক বছর পর উইন্টার ভ্যাকেশনে আমরা ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম। দিব্যেন্দুদের বাড়ি কলকাতায়।

সেবার খুব মজা হয়েছিলো কলকাতায়। আমরা দিব্যেন্দুদের বাড়িতে না উঠে গ্রেট ইস্টার্ন নামের একটা হোটেলে উঠেছিলাম। দিব্যেন্দুরা জয়েন্ট ফ্যামিলি। ওর বাবা, মা, বড় দুই ভাই, দুই কাকা আর তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেশ বড় পরিবার। সবাই ভবানীপুরের পুরোনো এক বাড়িতে একসঙ্গে থাকে। দিব্যেন্দু বলেছে ওদের পরিবার গোঁড়া। অন্য ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলো ওর বাবা। বাড়িতে ওর বাবা সবার বড়। তার কথা কেউ অমান্য করে না।

দিব্যেন্দুর মা অবশ্য বিয়ের পর ছেলেকে চিঠিতে লিখেছিলো–তোর যা ভালো। মনে হয় করবি। তুই সুখী হলে আমিও সুখী হবো। বৌমা আর দাদুভাইকে আমার আশীর্বাদ আর আদর দিস। দিব্যেন্দু ওর মার চিঠি আমাকে পড়তে দিয়েছিলো। একজন অচেনা মহিলা আমাকে দাদুভাই বলে চিঠিতে আদর পাঠিয়েছে পড়ে ভালোই লেগেছিলো। দিব্যেন্দুকে বলেছিলাম, তোমার মাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। দিব্যেন্দু বলেছিলো, মা–ও বউ দেখতে চেয়েছে। আমরা সামনের উইন্টারে কলকাতা যাবো।

কলকাতা আসার আগে দিব্যেন্দুর মা লিখেছিলো–হুট করে বউ নিয়ে বাড়িতে এসে উঠিস না। তোর বাবাকে এখনও মানাতে পারিনি। তোরা বরং তোর বন্দনা মাসির বাড়িতে উঠিস। বন্দনাকে আমি বলেছি। তোরা ওর বাড়িতে উঠলে ও খুশি হবে।

প্লেনে উঠে দিব্যেন্দু বললো, মাসি-টাসি নয়, আমরা হোটেলে উঠবো।

দিব্যেন্দুর সিদ্ধান্ত জানতে পেরে মা আর আমি দুজনই খুশি হয়েছিলাম। অচেনা কারও বাড়িতে থাকতে আমি যে পছন্দ করি না একথা মা ভালোভাবেই জানে। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলটাও বেশ ভালো। লন্ডনে এরকম চেহারার অনেক হোটেল দেখেছি। কলকাতা শহরটাও অনেকটা লন্ডনের মতোই। একটু বেশি পুরোনো আর নোংরা এই যা তফাত।

কলকাতায় দিব্যেন্দুর অনেক বন্ধু ছিলো। বিয়ের খবরও বন্ধুদের কাউকে জানায়নি সারপ্রাইজ দেবে বলে। হোটেলে ও একটা রিসেপশনে বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছিলো। সবাই মাকে দেখে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিবিসি যারা শোনে তারা মার নাম জানে। দিব্যেন্দুকে বিয়ে করার পর আমি হঠাৎ করেই যেন আবিষ্কার করলাম আমার মা দেখতে রীতিমতো সুন্দরী। বিয়ের আগে একটুও সাজতে দেখিনি মাকে। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতো বলে মনে হতো তেমন সুন্দরী নয়, বয়স্কও মনে হতো। বিয়ের পর মা চশমার ফ্রেম পাল্টিয়ে সরু গোল্ডেন ফ্রেম নিয়েছে, একটু মেকাপ নেয়াও শুরু করেছে–এতেই মার চেহারা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেলো। দিব্যেন্দুর বন্ধুর স্ত্রীরা সবাই ওকে বললো, চমৎকার বউ হয়েছে দিব্যেন্দু।

আমার সবচেয়ে মজা লেগেছিলো যখন ওরা আমাকে মার ভাই ভেবেছে। এক মহিলা বললো, এ বুঝি তোমার শালা, বোনের সঙ্গে চেহারায় অনেক মিল আছে। শুনে আমি আর দিব্যেন্দু হাসতে হাসতে বিষম খেলাম। মা তো লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেলো। সবাই যখন আমার পরিচয় জানলো তখন ওদের একেক জনের চেহারা দেখার মতো হলো। এক মহিলার হাত থেকে প্লেট খসে পড়লো, আরেক জনের ড্রিংক্স আটকে গেলো গলায়, সবার চোখ গোল হলো, মুখ হা হয়ে গেলো আর আমরা হাসি চাপতেই ব্যস্ত। পরে এক মহিলা অসভ্যের মতো মার বয়স জানতে চেয়েছিলো।

কলকাতায় যাওয়ার পরদিনই দিব্যেন্দুর মা এসেছিলো হোটেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। মা ওর পা ধরে সালাম করতেই ভদ্রমহিলা মাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর নিজের গলার হার খুলে মার গলায় পরিয়ে দিলো। মা আমাকে ইশারা করলো ওকে পা ধরে সালাম করার জন্য। এ কাজটা আমি খুবই অপছন্দ করি, তবু মার ইচ্ছায় করতে হলো। দিব্যেন্দুর মা আমার কপালে চুমো খেয়ে বললো, বেঁচে থাকো দাদুভাই।

আমাকে ওভাবে আদর করতে দেখে দিব্যেন্দু মুখ টিপে হাসছিলো। ওর মা সেই হাসি দেখতে পেয়ে বললো, আসছে বার আমি একটা ছোট্ট দাদুভাই দেখতে চাই।

মার কথা শুনে দিব্যেন্দু লজ্জা পেলো। আমি ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম।

কথাটা মার বিয়ের পর আমিও ভেবেছি। মা আর দিব্যেন্দুর যখন ছেলেমেয়ে হবে তখন কি দিব্যেন্দু আমাকে এতখানি ভালোবাসতে পারবে? আমি জানি আমাকে দিব্যেন্দু এতটা ভালোবাসে বলেই মা ওকে বিয়ে করেছে। যখন দিব্যেন্দু নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে তখন মা কী করবে? মাকেও তো দিব্যেন্দুর ছেলেমেয়েদেরই বেশি সময় দিতে হবে। আমি কি তখন বোর্ডিং-এ চলে যাবো? আমার মতো অনেক ছেলেমেয়ে বোর্ডিং-এ থাকে বটে, আমি এটা একদম পছন্দ করি না। এত বছর লন্ডনে থেকেও আমার ভেতরটা একেবারেই বাঙালিদের মতো সেকেলে রয়ে গেছে। শীলা এ নিয়ে মাঝে মাঝে ঠাট্টাও করে। আমার কিছু করার নেই। আমি মার মতো এতটা বাঙালি না হলেও আমি যেমন আছি তেমনই থাকতে চাই।

কলকাতা থেকে আমরা দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর আর কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলাম। খুবই মজা হয়েছিলো সেবার। বিশেষ করে হোটেলে প্রায়ই আমাকে ম্যানেজার বা রিসেপশনিস্ট জিজ্ঞেস করতে দিব্যেন্দু আমার ব্রাদার ই-ল কিনা। ইন্ডিয়ার মানুষদেরও খুব ভালো লেগেছিলো আমার। অনেকটা বাঙালিদের মতোই স্বভাব। বৃটিশদের মতো গোমড়ামুখো নয়, সব কাজ ঘড়ির কাঁটা মেপে করে না। খুবই প্রাণখোলা মানুষ, ঢিলেঢালা স্বভাবের, ঘাড়ে পড়ে আলাপ জমাতে চায়। দিল্লি থেকে ট্রেনে আগ্রা যাওয়ার পথে রাকেশ বলে একটা ছেলে আমারই বয়সের নিজে থেকে আলাপ করলো এসে। ইংরেজি বলার সময় যদিও মনে হয় হিন্দিই বুঝি বলছে, বেশ হ্যান্ডসাম আর স্মার্ট, দেরাদুনে এক মিশনারি স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ে। রাকেশও মাকে দেখে প্রথম ভেবেছিলো আমার বোন। আগ্রা আসার আগে ও আমার ঠিকানা রেখেছিলো, এখনও নিয়মিত চিঠি লেখে, ভিউকার্ড পাঠায়।

সেবার আমরা আঠারো দিন ছিলাম ইন্ডিয়াতে। ফিরেছি কলকাতা হয়ে। দিব্যেন্দুর মা আরও দুবার এসেছিলো আমাদের সঙ্গে দেখা করতে। মা কাশ্মীর থেকে ওর জন্য খুব দামী একটা শাল কিনেছিলো। ওটা পেয়ে দিব্যেন্দুর মা খুব খুশি হয়েছিলো।

যেদিন সন্ধ্যায় আমরা লন্ডনের ফ্লাইট ধরবো সেদিন সকালে দিব্যেন্দুর মা শেষবার এসেছিলো আমাদের হোটেলে। যাওয়ার সময় দিব্যেন্দু আর মাকে জড়িয়ে কান্নাকাটিও করলো। দিব্যেন্দুকে বললো, তোর ভাইদের কারও তো ছেলে হলো না। বাড়ি ভরা গুচ্ছের মেয়ে। বৌমার একটা খোকা হলে তোর বাবা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারবে না। বৌমার বয়স তো আর কম হয়নি…..

দিব্যেন্দুর মার কথা বলার ধরন আমার ভালো লাগেনি। তাই চুপচাপ সরে এসেছিলাম ওদের কাছ থেকে।

.

২. দিব্যেন্দুর পরিবর্তন

লন্ডনে ফেরার পর আবার শুরু হল আমাদের রুটিনবাঁধা জীবন। সকালে গাড়ি নিয়ে দিব্যেন্দু, মা আর আমি একসঙ্গে ঘর থেকে বেরোই। আমি বিকেলে ফিরি। ওরা ফেরে রাতে। উইকএন্ডে আমি কখনও ওদের সঙ্গে, কখনও শীলা কিংবা স্কুলের অন্য বন্ধুদের সঙ্গে শহরের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাই। ছুটির দিন সারা সপ্তাহে জমিয়ে রাখা বাকি কাজ করি। আমি অবশ্য বাগানের কাজ ছাড়া কিছুই করি না। বাকি সব মা আর দিব্যেন্দু করে। দিব্যেন্দু এ বাড়িতে আসার পর আমাদের একটা লাভ হয়েছে। ওর একটা মস্ত বড় জাগুয়ার গাড়ি ছিলো। সেটা আমার স্কুলে যাওয়া আর মার অফিসে যাওয়ার সময় অনেক বাঁচিয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া সন্ধ্যার পর টিউব স্টেশনগুলোয় মাতাল, গুন্ডা আর স্কীনহেড শয়তানদের উৎপাত লেগেই থাকে। গুন্ডারা কয়েকবারই মার ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। আমাকে একবার মারার জন্য তাড়া করেছিলো স্কীনহেড গুন্ডারা। দিব্যেন্দু বলে দিয়েছে সন্ধ্যায় স্কুলে দেরি হলে ওকে যেন ফোন করি। যখনই ফোন করেছি দিব্যেন্দু নিজে ড্রাইভ করে এসে নিয়ে গেছে।

রুটিনবাঁধা হলেও লন্ডনের জীবন কখনও নিরানন্দের মনে হয়নি। বিশেষ করে মার সঙ্গে দিব্যেন্দুর বিয়ের প্রথম বছর চমৎকার কেটেছিলো আমাদের। ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসে ওদের প্রথম বিয়ে বার্ষিকীতে দিব্যেন্দু বড় একটা পার্টি দিয়েছিলো। আমাকে দিব্যেন্দু বলেছিলো, তোমার যত খুশি বন্ধু ইনভাইট করতে পারো তবে কতজন হবে সংখ্যাটা আগে বলে দিও। পার্টিতে আমার বন্ধু এসেছিলো চার জন। দুর্ভাগ্যের বিষয় লন্ডনে আমার কোনো বাঙালি বন্ধু নেই। আবার যারা এসেছিলো তারা কেউই ইংলিশ নয়। শীলার কথা আগেই বলেছি–সে ছিল লেবানি, ভিকি হচ্ছে ইন্ডিয়ান, জেন হাঙ্গেরিয়ান আর মাহমুদ জর্ডানের। মার এক দূর সম্পর্কের খালা থাকে ম্যানচেস্টারে, মার চেয়ে বয়সে সামান্য বড় হবে, সেও এসেছিলো। লন্ডনে দিব্যেন্দুর কোনো আত্মীয় ছিলো না, সবই বন্ধু। সবাই খুব দামী দামী উপহার দিয়েছিলো। ফুলে ফুলে সারা বাড়ি সেদিন বোঝাই হয়ে গিয়েছিলো।

মা আর দিব্যেন্দুর বিয়ের তারিখ ছিলো ডিসেম্বরের সাতাশ-এ। চারদিন পর নিউ ইয়াস ডে। মাকে বলে সেবার নতুন বছরের উৎসব করলাম স্কটল্যান্ডে। আমাদের সবচেয়ে বড়লোক বন্ধু ছিলো জেন। স্কটল্যান্ড গ্র্যাম্পিয়ন পর্বতের কাছে স্টার্লিং-এ ওদের মস্ত খামার বাড়ি। ওর দাদা এসেছিলো হাঙ্গেরি থেকে, এখন ওরা পুরো বৃটিশ হয়ে গেছে। আমাদের বারো জনকে ও বিশেষভাবে নেমন্তন্ন করেছিলো নতুন বছরটা ওদের ওখানে কাটাতে।

আমরা সবাই একদিন আগেই চলে গেলাম ট্রেনে চেপে। সেবার দারুণ মজার উৎসব হয়েছিলো তিন দিকে পাহাড়-ঘেরা জেনদের খামারবাড়িতে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে সবাই সারা রাত জেগেছিলাম। একটু পুরোনো ধাতের মানুষ হলেও জেনের বাবা দারুণ মজার সব গল্প বলতে পারে। খাওয়ার মেনুতে আমাদের জন্য বারবেকিউ ছিলো, নন অ্যালকহলিক ককটেল ছিলো আর ছিলো কয়েক রকমের প্রচুর সালাদ। আঠারো বছর না হলে হার্ড ডিং দেয়া যাবে না–এরকম সেকেলে নীতিতে বিশ্বাসী ছিলো জেনের বাবা।

জেনদের খামারে তিনদিন কাটিয়ে হালকা মনে লন্ডনে ফিরে এসে দেখি বাড়ির বাতাস কেমন যেন ভারি হয়ে আছে। দিব্যেন্দু আর মাকে যেরকম রেখে গিয়েছিলাম ওরা সেরকম আর নেই। রাতে খেতে বসে জেন-এর বাবার কাছ থেকে শোনা দুটো মজার জোক্স বলেছিলাম। শুনে মা সামান্য হাসলো কিন্তু দিব্যেন্দু যেন শুনতেই পায়নি এমনভাবে খেতে লাগলো।

আমাদের রাতের খাওয়া সাড়ে আটটার ভেতর হয়ে যায়। ঘুমোতে যাই দশটায়। এ দু ঘন্টা আমরা টিভি দেখি, নয়তো ভিডিও ক্লাব থেকে মার আনা কোনো বাংলা ছবি দেখি। মাঝে মাঝে, দিব্যেন্দু আর আমি আমাদের পছন্দের কোনো হরর নয়তো সাইফি ছবি আনি। আমরা দুজনেই সায়েন্স ফিকশন আর হরর পছন্দ করি। সেদিন টিভি র‍্যাকের নিচের তাকে দেখি দুটো নতুন হরর ছবি রয়েছে। দিব্যেন্দুকে বললাম, বাবা, তুমি কি এ ছবি দুটো দেখেছো?

বিয়ের পর আমি লক্ষ্য করেছি দিব্যেন্দুকে বাবা ডাকলে মা খুশি হয়। মাঝে মাঝে মাকে খুশি করার জন্য বাইরের কেউ না থাকলেও দিব্যেন্দুকে বাবা ডাকতাম। ও তখন রান্নাঘরে প্লেট ডিশ ধধায়ার কাজে মাকে সাহায্য করছিলো। আমার কথার জবাবে বললো, তোমার ইচ্ছে হলে দেখতে পারো।

দিব্যেন্দুর কথার ধরণ দেখে মনে হলো ওর ছবি দেখার তেমন ইচ্ছে নেই। মুড ভালো থাকলে ও বলতো, খবরদার, আমি আসার আগে টিভি অন করবে না। আমি একটা ফ্রেমও মিস করতে চাই না। তারপর ও আর মা দু কাপ কফি এনে সোফায় বসে। আমি ছবি চালাই। মা আমাদের সঙ্গ দিতে গিয়ে মাঝে মাঝে বলে, সবগুলো হরর ছবি আমার একরকম মনে হয়। তোমরা কী যে মজা পাও আমি বুঝি না। আমার তো মাঝে মাঝে গা গুলোয়।

দিব্যেন্দুকে বললাম, তোমরা তাড়াতাড়ি এসো। আমি ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করছি।

আমাদের আগে যে এ ক্যাসেটটা নিয়েছিলো সে রিওয়াইন্ড না করে ক্লাবে ফেরত দিয়েছে। নির্ঘাত নতুন কোনো ইন্ডিয়ান মেম্বার হবে। এরা প্রায়ই ক্যাসেট রিওয়াইন্ড না করে ফেরত দিতে এসে জরিমানা দেয়। সেটা আবার পরে যে নেয় তার টাকা থেকে বাদ যায়। টাকা অবশ্য বেশি নয়, মাত্র পঁচিশ পি–তাই বা মন্দ কী। চারটা ক্যাসেটে এক পাউন্ড। এরকম প্রায়ই হয়। আমাদের পাড়ায় ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা বাড়ছে।

রান্নাঘরের কাজ সেরে দিব্যেন্দু একা এলো কফির কাপ হাতে। একটু পরে মা এসে শুকনো গলায় বললো, তোমরা ছবি দেখ। আমার মাথা ধরেছে, শোব। মা আর কিছু না বলে ওদের বেডরুমে ঢুকলো।

আমি ছবি ছাড়লাম। দিব্যেন্দু সোফায় ওর নিজের জায়গায় বসে এক মনে ছবি দেখতে লাগলো। তেমন আহামরি ছবি ছিলো না। দশ পনেরো মিনিট পরপরই বিজ্ঞাপন। আমাদের রিমোট খারাপ হয়ে গেছে কদিন হলো, নতুন কেনা হয়নি আলসেমি করে। বিজ্ঞাপন দেখানোর অবসরে, দিব্যেন্দুকে বললাম, তোমাকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? শরীর ভালো আছে?

দিব্যেন্দু গম্ভীর হয়ে কোনো কথা না বলে শুধু মাথা নাড়লো। আমি আবার বললাম, মাকেও মনে হলো বেশ ডিপ্রেসড় । তুমি কি কিছু আঁচ করতে পেরেছো?

তোমার মায়ের শরীর ভালো নয়। এর বেশি দিব্যেন্দু কিছু বললো না। ওর গলাটা একটু রুক্ষ মনে হলো। মা সম্পর্কে কিছু বললে ও মার নাম ধরে বলে, কখনও–তোমার মা বলে না।

প্রথম দিকে ছবিটা সুবিধার মনে না হলেও একটু পরে বেশ জমে গেলো। একটা হন্টেড প্যালেসে একটার পর একটা ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটছে। অন্য সময় হলে দিব্যেন্দু আর আমি দম বন্ধ করে ছবি দেখতাম। অথচ তখন আমার একটুও ইচ্ছে করলো না ছবিটা দেখতে। দিব্যেন্দু যদিও তাকিয়ে ছিলো টেলিভিশনের দিকে, ওর চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিলো ছবি সে মোটেও উপভোগ করছে না। কিছুক্ষণ পর আমি আস্তে করে দিব্যেন্দুকে জিজ্ঞেস করলাম, মার সঙ্গে কি কোনো ব্যাপারে তোমার মনোমালিন্য হয়েছে? মনোমালিন্য শব্দটা ভেবে বের করতে বেশ সময় লাগলো। যদিও মনে হচ্ছিলো বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে কথাটা, বাংলা ভালো জানলে হয়তো অন্যভাবে বলতে পারতাম। মার কড়া বারণ ছিলো বাড়িতে বিদেশী ছাড়া কারও সঙ্গে ইংরেজি বলা চলবে না।

দিব্যেন্দু আমার কথা শুনে একটু বিরক্ত হলো। ওর কপালে ভাঁজ পড়লো। আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে বললাম, তোমাকে আমি আঘাত দিতে চাইনি।

একটু পরে দিব্যেন্দু ঠান্ডা গলায় বললো, সব মানুষের কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে অনীক। তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে বলেই তোমার জানা দরকার, সব কথা জানতে নেই। বিশেষ করে যা কারও একান্ত ব্যক্তিগত।

আমার বয়স ষোল। আমার বন্ধুদের চেয়ে পড়াশোনায় বেশি সিরিয়াস বলে অনেকে বলে বয়সের তুলনায় আমি নাকি অনেক ম্যাচিউরড। আমি জানি সব কিছু জানার ব্যাপারে আমার যে কৌতূহল আছে সেটা ঠিক ম্যাচিউরিটির পর্যায়ে পড়ে না। অনেকটা ছেলেমানুষি হয়ে যায়, তবু আমি এটা এড়াতে পারি না। আমার যে সব বন্ধু আছে তাদের কারওই এমন কোনো গোপন বা ব্যক্তিগত ব্যাপার নেই যা আমি জানি । শীলা, জেন, ভিকি নিজে থেকেই সব কথা বলে, ওদের কিছু জিজ্ঞেসও করতে হয় । আমার ব্যাপারে অবশ্য কাছের বন্ধুরা জানতে না চাইলে বলি না। কিন্তু এটা আমি বুঝি, বন্ধুর কাছে কোনো কিছু গোপন রাখা চলে না।

দিব্যেন্দু কথাটা যেভাবে বললো, মনে হচ্ছে ও আমাকে আর বন্ধু ভাবতে পারছে না। ওর কথা শুনে ওকে বন্ধু নয় বাবার মতোই মনে হলো, যারা কিনা শুধু উপদেশ দেয় আর চায় সব কিছু ওদের মতো করতে। নিজের বাবাকে কাছে না পেলেও অন্যদের বাবাকে তো দেখি–সব সময় ছেলেমেয়েদের ওপর নিজের মত চাপিয়ে দিচ্ছে ছেলেমেয়েদের কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় সব বাবারা এ ব্যাপারে একমত । এমনকি জেনদের বাড়িতে যে গেলাম, শুনেছিলাম স্কটল্যান্ডের লোকেরা খুব খোলামনের হয়, কিন্তু সেখানেও একই অবস্থা। থার্টি ফাস্ট নাইটে জেন ওর বাবাকে অনেক ধরেছিলো বড়দের সঙ্গে আমাদেরও একটুখানি শ্যাম্পেন দিতে, বুড়োকে এতটুকু টলানো যায়নি।

বাবাকে নিয়ে মার সঙ্গে কখনও কোনো সিরিয়াস কথা হয়নি। বন্ধুদের বাবাদের দেখে কখনও মনে হয়েছে বাবা নেই, অনেক আরামে আছি। বাঙালী বাবারা ইউরোপিয়ানদের চেয়েও বেশি রক্ষণশীল হয়। এইটিথ সেঞ্চুরির উপন্যাসে যেমন দেখা যায় এখনও নাকি বাঙালি আর ভারতীয় বাবারা ছেলেমেয়েদের অনেক বয়স পর্যন্ত ফিজিক্যালি মারধর করে। কী ভয়ঙ্কর কথা! আমি ভাবতেই পারি না কেউ আমার গায়ে হাত তুলতে পারে! মা কখনও আমাকে মারেনি। কোনো কারণে বিরক্ত হলে ডেকে বুঝিয়েছে–আমার কাজটা অন্যায় হয়েছে। দিব্যেন্দুর সঙ্গে মার বিয়েতে আমি আপত্তি করিনি ও কখনও আমার ওপর বাবাদের মতো কর্তৃত্ব করবে না বলে । সত্যি কথা বলতে কী এখন পর্যন্ত করেনি। সেই রাতে হরর ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়েছিলো দিব্যিন্দু বুঝি আগের জায়গা থেকে সরে যেতে চাইছে।

ছবির দিকে মন না থাকলেও দিব্যেন্দু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো টেলিভিশনের দিকে। মনে হলো ও আমাকে উপেক্ষা করছে। কথাটা ভাবতে গিয়ে কষ্ট হলো আমার। বুকের ভেতরটা ভারি মনে হলো। ওকে বললাম, তুমি আমাকে বন্ধু বলেছো বলেই জানতে চেয়েছিলাম তোমাদের ভেতর কী হয়েছে। এটা যদি তুমি অনধিকার চর্চা মনে করো–ঠিক আছে এ ধরনের কথা আর কখনও বলবো না।

আমি আশা করছিলাম দিব্যেন্দু বলবে, ও কিছু নয়। এমনিতেই মন খারাপ। কিংবা বলবে–তোমাকে তিনদিন দেখতে না পেয়ে আমাদের সময় খুব খারাপ কেটেছে। তুমি এসেছো, সব ঠিক হয়ে যাবে। দিব্যেন্দু কোনো কথা বললো না। আমার বুকের ভেতর কান্না জমছিলো। মনে হলো এভাবে বসে থাকলে ঠিক কেঁদে ফেলবো। আমার দুর্বলতা প্রকাশ করে আমি দিব্যেন্দুর সহানুভূমি পেতে চাই না। ওকে গুড নাইট বলে উঠে চলে এলাম।

ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুতেই রাগ আর অপমানে আমার কান্না এলো। দিব্যেন্দু আমাকে এভাবে উপেক্ষা করবে আমি ভাবতেই পারছিলাম না। অথচ আমি কিছুই করিনি। কথাটা যতবার ভাবলাম ততবারই কেঁদে বালিশ ভেজালাম।

বাইরে থেকে সবাই বলে আমি নাকি খুব হাসিখুশি স্বভাবের। সারাক্ষণ সবাইকে মাতিয়ে রাখি। বন্ধুরা শুধু নয়, বড়রাও আমাকে পছন্দ করে আমার এই স্বভাবের জন্য। বন্ধুদের সঙ্গে আমি আমার আনন্দ শেয়ার করি, কিন্তু আমার কষ্ট শেয়ার করি না। কেউ আমাকে দেখে কখনও বুঝতে পারবে না প্রিয় কারও উপেক্ষায় আমি কী প্রচণ্ড কষ্ট পাই। একবার শীলা আমার সঙ্গে ডেট করে এক টার্কিশ ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলো প্রোগ্রাম বাতিল না করে। দেখা হওয়ার পর অবশ্য সরি বলেছে। তখন আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। অথচ শীলাকে এতটুকু বুঝতে দিইনি। হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। শীলা অবশ্য পরে বলেছে, আমার খুব খারাপ লেগেছিলো নিক। মেহমেট তোমার মতো নয়। ওর সঙ্গে আমি আর কোথাও যাবো না। শীলা যদি একথা না বলতে আমার সব সময় মনে হতো ও আমাকে উপেক্ষা করেছে।

সে রাতে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। পরে ঠিক করলাম মার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবো। মা নিশ্চয় দিব্যেন্দুকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে না। এক সময় মনে হলো দিব্যেন্দুর জায়গায় আমার নিজের বাবা থাকলে আমাকে এভাবে অবহেলা করতো না।

পরদিন আমার স্কুল ছিলো না। তখনও স্কুল খুলতে সাতদিন বাকি। সকালে নাশতার টেবিলে দিব্যেন্দুর সঙ্গে মার কিছু খুচরো কথা হলো রেডিওর এক প্রোগ্রাম নিয়ে। অনুবাদ বিভাগে নতুন এক মেয়ে এসেছে, ওর নাকি অনুবাদ ঠিক হয়নি। দিব্যেন্দু মাকে বললো সেই মেয়েকে সাহায্য করার জন্য। আমি ভেবেছিলাম দিব্যেন্দু গতরাতের ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। ও কিছুই করলো না। মাকে নিয়ে বেরোবার সময় শুধু বাই অনীক বলে চলে গেলো। ওর ওপর আমার খুব রাগ হচ্ছিলো। আগামীকাল শনিবার। ও যদি দয়া করে মাকে রেখে কোথাও যায় তবেই মার সঙ্গে একা কথা বলতে পারবো। আমার মন বলছিলো এ উইকএণ্ডে ও একাই বেরোবে।

দিব্যেন্দু আর মা চলে যাওয়ার পর গোটা বাড়িতে আমি একা। আমাদের বাড়িটার মালিক হচ্ছে এক বুড়ি মহিলা। মা অনেকবার কিনতে চেয়েছিলো, বুড়ি রাজি হয়নি। নিজেও অন্য জায়গায় ভাড়া থাকে, বলে এ বাড়ি হাতছাড়া করবে না। এ বাড়িটা একটু পুরোনো ধরনের হলেও বেশ আরামের। নিচে ড্রইং, ডাইনিং কিচেন আর লিভিংরুম। ওপরে তিনটা বেডরুম। একটা মা আর দিব্যেন্দুর, একটা আমার, আরেকটা অতিথিদের জন্য। বাড়িটার বাইরের দেয়াল পাথরের, ভেতরে ঘরের মেঝে আর সিঁড়ি কাঠের। সামনে কোনো জায়গা নেই, পেছনে বেশ বড় একখানা বাগান আছে। বাগানে দুটো আপেল গাছ আর একটা চেস্টনাট ছাড়া বড় গাছ নেই। কয়েকটা চিরসবুজ জাতীয় ছোট গাছের ঝোঁপ আছে। এপ্রিলে শীত চলে গেলে চারা বোনা হয়। পুরোনো টিউলিপ বেডগুলো মে মাস নাগাদ লাল, সাদা, বেগুনি টিউলিপে ঝলমল করে ওঠে। তখন থেকে মাসে একবার ঘাস ছাঁটতে হয়, সপ্তায় একবার শুকনো পাতা পরিষ্কার করতে হয়, গরমের সময় রোজ গাছে পানি দিতে হয়। বাগানের সব কাজ আমি নিজে করি। ফুল আর গাছ আমার ভালো লাগে।

একা বাড়িতে কিছুই করার নেই। শীলাকে ফোন করে পেলাম না। ভিকি আর জেনও বাড়িতে নেই। গতরাতে যে হরর ছবিটা দেখা বাকি ছিলো, কিছুক্ষণ ওটা দেখলাম। একটু পরেই একঘেয়ে মনে হলো। বুঝতে পারছিলাম এরপর কী হবে।

টেলিভিশন বন্ধ করে বাইরে বাগানে গেলাম। জানুয়ারি মাসের চার তারিখ, এখন পর্যন্ত বরফ পড়া আরম্ভ হয়নি। অন্যান্যবার ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বরফ পড়া শুরু হয়ে যায়। এবার নাকি ফেব্রুয়ারির আগে লন্ডনে বরফ পড়বে না। স্কটল্যান্ডে অবশ্য ডিসেম্বরের শুরুতেই বরফ পড়া আরম্ভ করে, এর কোনো ব্যতিক্রম হয় না। লন্ডনের আবহাওয়া খুব খামখেয়ালি। বড়রা ঠাট্টা করে বলে মেয়েদের মন যেমন বোঝা যায় না, লন্ডনের আবহাওয়াও বোঝা যায় না। বিশেষ করে শরতে আর শীতে এরকম হয়। সকালে দেখা গেলো খটখটে রোদ, মিষ্টি আবহাওয়া, কেউ ছাতা নিয়ে বেরোয়নি, দু ঘণ্টা পরই কালো মেঘে আকাশ অন্ধকার হয়ে ঠাণ্ডা বাতাসের সঙ্গে প্যাঁচপ্যাঁচে বৃষ্টি শুরু হলো। যারা আবহাওয়ার বুলেটিন শোনে তারা অবশ্য খটখটে রোদের ভেতর ছাতা, রেইনকোট, সব সঙ্গে নিয়ে তৈরি হয়ে বেরোয়। বিপদে পড়ে তারা, যারা বাড়ি থেকে বেরোবার আগে বুলেটিন শোনে না।

সেদিন আবহাওয়া ছিলো চমৎকার। ঠাণ্ডা হলেও আকাশে রোদ ছিলা, এ সময়ে যা কদাচিৎ দেখা যায়। মাঝে মাঝে শুকনো ঠাণ্ডা বাতাসে শীতের ধার থাকলেও বিরক্তিকর ছিলো না। কিছুক্ষণ একা বাগানে হাঁটলাম। আপেল গাছের গোড়ায় ছোট্ট একটা গর্ত চোখে পড়লো। গত রোববারে বাগান পরিষ্কার করার সময় ওটা দেখিনি। বুকের ভেতরটা খচ করে উঠলো। ইঁদুরের গর্ত হলে ভয় নেই, বীভার বা ওই জাতীয় কিছু হলে আপেল গাছের শেকড় কেটে ফেলবে। এই আপেল গাছটা মা আর আমার দুজনেরই খুব প্রিয়। চমৎকার রঙ আর মিষ্টিও অনেক। অক্টোবর, নভেম্বর আর ডিসেম্বরে গাছতলায় আপেল পড়ে লাল হয়ে থাকে। মা বলে এই আপেল গাছ দেখলে নাকি গ্রামের বাড়ির কথা মনে হয়। মার গ্রামের বাড়িতে দুটো সিঁদুরে আমগাছ আছে। কালবৈশাখির ঝড়ের পর গাছতলায় টুকটুকে লাল আম এভাবে পড়ে থাকে। আমার আর মার প্রিয় আপেল গাছের গোড়ায় কোন পাজি জন্তু এভাবে গর্ত করেছে খুঁড়ে দেখতে হবে। মনটা ভালো ছিলো না, আপেল গাছের গোড়ায় গর্ত দেখে আরও খারাপ হয়ে গেলো।

<

Super User