টিকলী আর টোপরের বাড়ি সিদ্ধেশরী রোডে। একজনের বাড়ি থেকে অন্য জনের বাড়ির দূরত্ব এক মিনিটের পথ। দুই বাড়ির মধ্যে ছুরি-কাটারী সম্পর্ক থাকলেও ওরা দুজনে ছোটবেলা থেকে এক সাথে খেলাধুলা করে মানুষ হয়েছে। টোপরের বাবা কাহহার সাহেব ব্যবসায়ী। ভীষণ হিংসুটি, কৃপণ ও শক্ত দিলের মানুষ। দেশের বাড়ি মনোহরদি। প্রথম স্ত্রী চার বছরের একটা ছেলে রেখে মারা যাওয়ার পর শাফিয়া বেগমকে বিয়ে করেন। তার গর্ভে এক ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছে। কাহহার সাহেবের আগের স্ত্রীর গর্ভে যে ছেলে, সেই টোপর। তার ভালো নাম হাসান। স্বামীর স্বভাব চরিত্র শাফিয়া বেগমকে কষ্ট দিলেও টোপরকে পেয়ে সেসব ভুলে থাকেন। নিজের পেটের ছেলে-মেয়ের চেয়ে তাকে বেশি আদর যত্ন করেন। ছেলে মেয়ে দুটির নাম শাহিন ও নিশাত। শাহিন নাইনে ও নিশাত সিক্সে পড়ে।
টিকলীর আসল নাম আজরা মাহবুবা। ওরা চার ভাই দুই বোন। বড় তিন ভাই ও এক বোন শিশুকালে মারা গেছে। টিকলী আর তার দুবছরের বড় ভাই আলী বেঁচে আছে। টিকলী সিদ্বেশরী মহিলা কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। আর আলী ঢাকা ভার্সিটিতে ম্যানেজমেন্টে অনার্স করছে। এ বছর পার্ট-টু পরীক্ষা দিয়েছে। তাদের বাবা হালিম সাহেব মিষ্ট্ৰিী অফ হেলথে আছেন। খুব এক রোখা লোক। তবে অত্যন্ত সৎ ও আদর্শবান। প্রথম দিকের তিন ছেলে ও এক মেয়ে মারা যাওয়ায় শেষের দুছেলে মেয়েকে একটু বেশি আদর করলেও নিজের মত সৎ ও আদর্শবান করে গড়েছেন।
হালিম সাহেবের সিদ্বেশরী রোডে দুটো বাড়ি। যে বাড়িতে থাকেন, সেটা অনেক আগে করেছেন। আর যে বাড়িটা ভাড়া দিয়েছেন, সেটার পাশে কাহহার সাহেবের আগে জায়গা কিনলেও বাড়ি করেছেন পরে। কাহহার সাহেব ফ্যামিলী নিয়ে মধুবাগে থাকতেন। একই দাগ ও খতিয়ানের জমি কেনার সময় বেশ কয়েকবার হালিম সাহেবের বাসায় এসে পরামর্শ করেছেন। কাগজ পত্র দেখেছেন। যে সময় হালিম সাহেব আদর আপ্যায়ণ করিয়েছেন। গন্ডগোল বাধল কাহহার সাহেব যখন মাত্র দুফুট ছাড় দিয়ে চার তলার ফাউন্ডেশন দিলেন। তাও আবার দুফুটের মধ্যে হালিম সাহেবের দশ ইঞ্চি জায়গা। হালিম সাহেব আমিন এনে জায়গা মাপাতে গিয়ে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ ঝগড়া হয়। শেষে মহল্লার লোকজন মিমাংসা করে দেন। কাহহার সাহেব হালিম সাহেবের বাড়ীর দিকে ঘরের জানালা দিলেও পাল্লা ভিতরে দেবেন এবং কোনো সানসেড দিতে পারবেন না। কিন্তু কাহহার সাহেব তখন সবার কথা মেনে নিলেও বাড়ি করার সময় মানেন নি। জানালার পাল্লা বাইরেই দিয়েছেন এবং সানসেডও দিয়েছেন। তখন আর একবার ওঁদের ঝগড়া হয়। মহল্লার অনেকে হালিম সাহেবকে বলেছেন, আপনি ডি.আই.টি.তে অবজেকসান দেন। হালিম সাহেব দেওয়ার মনস্থ করলেও শেষ পর্যন্ত দেননি। ভেবেছিলেন, চিরকাল যখন প্রতিবেশী হয়ে বাস করব তখন আর অবজেকসান দিয়ে কি হবে? বাড়ি থেকে বেরোলেই একে অপরের সঙ্গে দেখা হবে। অবজেকসান দিলে হয়তো ওঁর বাড়ি করাই। বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সাত পাঁচ ভেবে দেননি। কিন্তু কাহহার সাহেবের আচার ব্যবহারে কৃতজ্ঞতার লেশ মাত্র নেই। যখন তখন সামান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি করেন। কয়েকবার একই রকম ঘটনা ঘটার ফলে তার উপর হালিম সাহেবের মন বিষিয়ে গেছে। তাই আজ এত বছর পর্যন্ত প্রতিবেশী হিসাবে বাস করলেও দুই ফ্যামিলীর ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্যে দিন কাটছিল। হঠাৎ সেই মনোমালিন্য আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল টিকলি আর টোপরকে নিয়ে। ছোট বেলায় যখন তারা একসঙ্গে স্কুলে যেত ও খেলাধুলা করত তখন দুজনের মা-বাবা ছেলে মেয়েকে প্রথমে বোঝাতেন। কাজ না হতে পরে মারধর করতেন। কিন্তু টিকলী বা টোপর কোনো শাসনই মানত না। একটু বড় হয়ে তারা মা-বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে মেলামেশা করত। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হল তখন আর তারা গার্জেনদের পরওয়া না করে প্রকাশ্যে মেলামেশা করতে লাগল। ব্যাপারটা তাদের গার্জেনরা সহ্য করতে পারলেন না। ছেলে মেয়েকে যথেষ্ট রাগারাগি ও তিরস্কার করলেন। টিকলী বা টোপর সে সব গ্রাহ্য না করে যে যার মা-বাবাকে জানাল, আমরা ছোটবেলা থেকে দুজন দুজনকে ভালবাসি এবং সময় মতো বিয়েও করব। এই নিয়ে দুই ফ্যামিলীর মধ্যে মনোমালিন্য আগের থেকে অনেক বেশি বেড়ে গেল। তবে প্রকাশ্যে তেমন কিছু হল না। কিন্তু তাদেরকে রাগারাগি ও তিরস্কার করতে ছাড়লেন না। তারাও স্পষ্ট জানিয়ে দিল, তোমরা যদি বেশি বাড়াবাড়ি কর, তা হলে কাজি অফিসে গিয়ে আমরা বিয়ে করে ফেলব। গার্জেনরা বললেন, তা হলে তোদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেব। তাই টোপর আজ যখন বলল, চল কাল কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। তখন টিকলীর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রাজি না হয়ে এত কিছু বলে বোঝাল।
টিকলীর ভাই আলির ফুলের খুব সখ। সেই জন্যে বাসার পশ্চিম পাশে একটা ফুলের বাগান করেছে। মা-বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে নার্সারী থেকে নানান ধরনের ফুলের গাছ কিনে এনে লাগিয়েছে। জুঁই, চামেলী, বকুল, জবা, নিশিপদ্ম, রজনিগন্ধা, গোলাপ ও জিনিয়া এবং আরো অনেক নাম না জানা ফুলের গাছ লাগিয়েছে। বাবাকে বলে একজন মালীও রেখেছে। নিজেও এই সব গাছের পিছনে অনেক পরিশ্রম করে। স্কুল জীবন পর্যন্ত টিকলীর সঙ্গে আলির মোটেই পড়ত না। আলি টিকলীর দুবছরের বড়। তাই তার উপর গার্জেনী ফলাত। টিকলী তা মোটেই সহ্য করতে পারত না। সামান্য একটা কিছু নিয়ে সব সময় টক-ঝক লেগেই থাকত। তুই তোকারী করত। কলেজে ঢোকার পরে টিকলী তুমি করে বললেও টক-ঝক লাগে। কেউ কারো কথা একদম সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ফুল বাগান করা নিয়ে দুজনের খুব ভাব। টিকলীও ফুল খুব ভালবাসে। পড়তে পড়তে যখন ভালো লাগে না অথবা টোপরের সাথে কোনো ব্যাপারে মনোমালিন্য হয় তখন ঘন্টার পর ঘন্টা ফুল বাগানে বেড়ায়, বসে থাকে। ফুলের উপর আদরের হাত বুলোতে বুলোতে তাদের সঙ্গে কথা বলে।
আজ নিউ মার্কেট থেকে ফেরার সময় টোপরের সঙ্গে কথা বলে টিকলীর মন খুব খারাপ লাগতে লাগল। জানালার পর্দা সরিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে রইল। ফুটন্ত ফুলগুলো রোদে ঝলসে যাচ্ছে। দুপরের রোদ সহ্য করতে পারছে না। তার ইচ্ছা হল বাগানে গিয়ে ফুলগুলোকে আদর করে বলে আর কিছুক্ষণ কষ্ট কর, একটু পরে সাবুদের বিল্ডিং এর আড়ালে সূর্য চলে যাবে। তখন তোমরা আরাম পাবে। যখনই টিকলীর মন খারাপ হয় তখনই হয় বাগানে যাবে, নচেৎ এই জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকবে। এখন প্রচন্ড রোদ, তাই বাগানে না গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।
টিকলী প্রতিদিন দুবার গোসল করে। একবার সকালে কলেজে যাওয়ার আগে। আর একবার কলেজ থেকে ফিরে। যেদিন বেশি গরম পড়ে অথবা বিকেলে কোথাও বেড়াতে যায়, সেদিন সন্ধ্যের পরেও একবার গোসল করে। আজ মন খারাপ থাকায় গোসলের কথা ভুলে গেছে।
মেয়েকে ফিরতে সাজেদা বেগম দেখেছেন, ডাইনিং টেবিলে তাকে দেখতে না পেয়ে কাজের বুয়াকে বললেন, দেখত আসমার মা, টিকলী আসছে না কেন?
আসমার মা টিকলীর রুমে এসে বলল, আপা, আপনাকে বেগম সাহেব খেতে ডাকছেন।
টিকলী তখন ফুল বাগানের দিকে তাকিয়ে চার বছর আগের কথা চিন্তা করছিল। তখন সে নাইনে, আর টোপর ইন্টারে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখল, টোপর দাঁড়িয়ে আছে। কাছে আসতে বলল, তোর টিকলী নামটা কে রেখেছিল বলত? নামটা কিন্তু দারুণ।
টিকলী বলল, কেন, আজরা মাহবুবা নামটা কি খারাপ? জানিস, নানা একদিন আমাকে আমার নামের অর্থ জিজ্ঞেস করলেন, আমি বললাম, জানিনা, আপনি বলে দিন। নানা বললেন, তোর নামের অর্থ হলো, কুমারী প্রিয়া। তারপর হেসে উঠে বললেন, আমার ধারনা তুই বিয়ের আগেই কারো প্রিয়া হবি। শুনে আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম। কারণ তার অনেক আগে থেকেই আমি তোর প্রিয়া। আমার মুখে বোধ হয় হাসি ফুটে উঠেছিল। নানা বুঝতে পেরে বললেন, কিরে হাসছিস যে? আমি তখন লজ্জা পেলাম। তবু বললাম, নামের অর্থ শুনে হাসি পাচ্ছে। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা। নানা, হাসান শব্দের অর্থ জানেন? নানা বললেন, তা আর জানব না। হাসান অর্থ সুদর্শন। তারপর মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললেন, হাসান নামে কোনো ছেলের সঙ্গে
তোর পরিচয় আছে নাকি? বললাম, আমাদের কয়েকটা বাড়ির পরের বাড়ীর একটা ছেলের নাম হাসান। তারপর আবার কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেন ভেবে তার কাছ থেকে চলে এলাম।
টোপর বলল, তোর আসল নামের অর্থ জানতাম না, জানার পর মনে হচ্ছে, দুটো নামই খুব সুন্দর।
টিকলী বলল, আর তোর নাম দুটো বুঝি খারাপ? আমার কাছে আমার নামের চেয়ে তোর নাম দুটো বেশি সুন্দর।
টোপর বলল, হাসান নামটা ভালো হলেও টোপর নামটা বিশ্রি লাগে।
টিকলী হেসে উঠে বলল, কেন, বিশ্রি লাগবে কেন? তুই টোপর পরে বিয়ে করতে আসবি, আর আমি টিকলী পরে কনে সাজবো।
টোপরও হেসে উঠে বলল, কথাটা অবশ্য মন্দ বলিস নি।
টিকলী ফুলবাগানের দিকে তাকিয়ে এইসব ভাবছিল, আসমার মায়ের কথা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে তার দিকে ঘুরে বলল, তুমি যাও, আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।
কাহহার সাহেবের ফ্যামিলী খুব আলৰ্টা মর্ডান। ধর্ম সম্পর্কে কেউ কোনো মাথা ঘামায় না। মহল্লার কোনো বাড়ির লোকজনদের সঙ্গেও তেমন মেলামেশা নেই। যাকে বলে আত্মকেন্দ্রিক ও আন-শোসাল মানুষ। নিজেও যেমন কারো সঙ্গে মেলামেশা করেন না, তেমনি ছেলে মেয়েদেরকেও করতে দেন না। কিন্তু তার স্ত্রী শাফিয়া বেগম ঠিক তার উল্টো। স্বামীর নিষেধ সত্ত্বেও তার অগোচরে পাড়া-পড়শী মেয়েদের সঙ্গে মাঝে। মাঝে মেলামেশা করেন। এমন কি হালিম সাহেবের স্ত্রী সাজেদা বেগমের সঙ্গেও আলাপ করেন। শাফিয়া বেগম উচ্চ ফ্যামিলীর শিক্ষিত মেয়ে। মা-বাবার পছন্দ করা ছেলেকে সানন্দে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন। বিয়ের পর স্বামীর আচার-আচরণে খুশি হতে না পারলেও ভাগ্যকে মেনে নেন। তারপর যখন প্রতিবেশী হালিম সাহেবদের সঙ্গে মনোমালিন্যের কথা জানতে পারেন তখন স্বামীকে মিমাংসা করার কথা অনেকবার বলেছেন। কিন্তু কাহহার সাহেব স্ত্রীর কথা গ্রাহ্য করেন নি।
টিকলী রক্ষণশীল ফ্যামিলীর মেয়ে হয়েও টোপরের সঙ্গে মেলামেশা করার জন্য মা-বাবার সঙ্গে অনেক সময় মিথ্যা বলে। আলি বোনের সব কিছু জানলেও সবার সামনে কিছু বলে না। কারণ সে যে টিকলীর বান্ধবী জিনিয়াকে ভালবাসে, সে কথা টিকলী জানে। তাই একা পেলে বলে, তুই যে জন্যে মা-বাবাকে মিথ্যা কথা বলিস, তা আমি জানি। তখন টিকলী গাল ফুলিয়ে বলে, জান তো কি হয়েছে? আমিও তোমার প্রেম কাহিনী জানি। তুমি মা-বাবাকে আমার কথা বলে দিলে, আমিও তোমার কথা বলে দেব। আলি জানে, মা-বাবা টিকলীর ব্যাপারটা নিয়ে এমনিই রেগে আছে। তারপর যদি তার ব্যাপারটা জেনে যায়। তা হলে কি ঘটবে ভেবে টিকলীর কথা শুনে চুপ করে যায়।
টিকলী কয়েক দিন চেষ্টা করেও টোপরের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে আজও কলেজ যাওয়ার সময় রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে আসতে দেখে সালাম দিয়ে পথ আগলে তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
টোপর ও সালামের উত্তর দিয়ে তার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনের চোখে পানি এসে গেল।
প্রথমে টিকলী চোখ মুছে ভিজে গলায় বলল, এই কয়েক দিন তুই আমাকে না দেখে থাকতে পারলি? জানিস, আমি শুধু কেঁদেছি। একটুও পড়াতে মন বসাতে পারিনি।
টিকলী যেদিন প্রথম সালাম দেয়, সেদিন টোপর জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে আজ সালাম দিলি যে?
টিকলী বলেছিল, কাল আব্বা একটা হাদিস পড়ে শোনালেন, মুসলমানদের পরস্পরে সাক্ষাত হইলে একজন অন্যজনকে বলিবে, আসোলামু আলাইকুম (তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা সুন্নত। কেহ সালাম দিলে তদুত্তরে বলিবে ওয়াআলাইকুম আসোলাম (তোমাদের উপর ও শান্তি বর্ষিত হউক)। ইহা বলা ওয়াজিব। সালাম সাম্য শিক্ষার অন্যতম নিদর্শন। সালাম আদান প্রদানের নিয়ম। হল, ছোটরা সালাম দিবে বড়দের, আরোহী সালাম দিবে উপবিষ্টকে, যানবাহনের আরোহী সালাম দিবে পথি-পার্শ্বস্থ লোককে। কোনো অসুমলিম কোনো মুসলিমকে প্রথমে সালাম দ্বারা সম্ভাষণ করিলে তাহার উত্তরে বলিবে হাদা কাল্লাহ (আল্লাহ তোমাকে হেদায়েৎ দান করুন)। রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, প্রথমে যে ব্যক্তি সালাম দেয়। মানুষের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে-ই উত্তম। [বর্ণনায় : হযরত আবু ওসামাহ (রাঃ)-তিরমিজী, আবু দাউদ।]
টিকলী থেমে যেতে টোপর বলল, তোর বাবা তোদেরকে বেশ ধর্মীয় শিক্ষা দেন, আর আমার বাবা শুধু টাকা রোজগারের চিন্তায় সব সময় ব্যস্ত থাকেন।
আমি মাঝে মাঝে ধর্মীয় বই কিছু কিছু দেব, পড়িস। তা হলে ধর্মীয় জ্ঞান পাওয়ার সাথে সাথে সে সর্ব মেনে চলারও প্রেরণা পাবি।
এখন ওসব পড়ার সময় কোথায়? ক্লাশের পড়া করতেই সময় কুলোয় না।
কেন, যখন অবসর সময়ে ঘোরাঘুরি করিস, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিস তখন পড়বি? আমিও তাই করি।
ঠিক আছে দিস তা হলে, পড়ব।
সেদিন টিকলীর উপর রাগ করে চলে এসে এই কয়েকদিন সেও মানসিক অশান্তিতে ভুগছে। তার কথা শুনে চোখ মুছে বলল, রাগের মাথায় সেদিন তোর মনে ব্যথা দিয়ে আমিও কম ব্যথা পাইনি। বল, মাফ করে দিয়েছিস?
টিকলী মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তুই একা অন্যায় করিসনি, তোর কথা না শুনে আমিও করেছি। তা হলে আমাকেও তুই মাফ করে দে।
টোপর বলল, ঠিক আছে চল, যেতে যেতে কথা বলি। তারপর হাঁটতে শুরু করে বলল, আজ আর কলেজে গিয়ে দরকার নেই, কোথাও গিয়ে বসি চল। তোর সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে।
টিকলী বলল, আমার আপত্তি নেই। কোথায় যাবি বল দেখি?
টোপর একটু চিন্তা করে বলল, ওসমানী উদ্যানে। এ সময়ে ওখানে তেমন ভীড় থাকে না।
টিকলী বলল, বেশ তাই চল।
ওরা একটা চলন্ত স্কুটার থামিয়ে উঠে বসে যেতে বলল।
ওসমানী উদ্যানে এসে একটা গাছের তলায় বসে দুজন দুজনের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
এক সময় টিকলী বলল, কি জরুরী কথা বলবি বলে নিয়ে এলি বলবি না?
টোপর বলল, ভেবে দেখলাম, তোর কথাই ঠিক। বাবা বলছিলেন অনার্সটা নেওয়ার পর ফরেনে পাঠাবেন। যাওয়ার আগে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলব কি বলিস?
কথাটা শুনে টিকলী অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
টোপর অধৈর্য গলায় বলল, কিরে চুপ করে আছিস যে?
টিকলী ম্লান মুখে বলল, ফরেনে গেলে তুই আমাকে ভুলে যাবি। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
টোপর তার হাত সরিয়ে দিয়ে চিবুক ধরে বলল, তোকে ভুলে যাব একথা ভাবতে পারলি? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতো, অবিশ্বাসের কিছু দেখতে পাস কি না?
তুই যে আমাকে কত ভালবাসিস তা জানি; ফরেনের ফ্রি মিক্সিং-এর কথা ভেবে হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু অতদিন তোকে না দেখে থাকতে পারব না। তুইও কি পারবি?
না পারলেও তোর জন্যে আমাকে পারতেই হবে। এখানে থাকলে আমাদেরকে দুই ফ্যামিলীর কেউ মেনে নেবে না। বরং শত্রুতা আরো বাড়বে। তাই ভেবেছি, ফরেনে গিয়ে পড়া শোনার সাথে সাথে চাকরিও করব। আর যেমন করে হোক গ্রীন কার্ড নেওয়ার চেষ্টা করব। গ্রীন কার্ড পেয়ে গেলে স্ত্রীকে মানে তোকে নিয়ে চলে যাব। তারপর বলল, কিরে প্ল্যানটা মনে ধরেছে?
ধরেছে, তবে আল্লাহ কতটা সাকসেসফুল করাবেন, তা তিনিই জানেন?
তা হলে এবার একটু হাসতো দেখি, এই কয়েক দিন তোর হাসি মুখ না দেখে আমিও পড়াতে একদম মন দিতে পারিনি।
টিকলী কান্না মুখে হাসি দিয়ে বলল, তুইও এবার হাস, তোর হাসি মুখ দেখলে মন দিয়ে পড়তে পারব।
টোপর হেসে উঠে বলল, আমরা আগের মতো গোপনে দেখা করব, আর বাসায় এমন ভাব দেখাব, যেন সবাই মনে করে আমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
টিকলী বলল, বেশ তাই হবে।
<