পল্লীবালা – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
জয়নগর গ্রামের এমন কোনো ছোট বড় মেয়ে পুরুষ নেই, যে নাকি আসমাকে চেনে। আসমা খুব ডাকসেটে মেয়ে। ভয়-ডর বলতে কিছু নেই। সুন্দরী হলে কী হবে, দুষ্টমীতে ওস্তাদ। কোনো মেয়েকে তাদের পুকুর থেকে মাটির কলসিতে করে পানি নিয়ে যেতে দেখলে, সে বৌড়ী, ঝিউড়ী বা শাশুড়ী যেই হোক না কেন, ইটের টুকরো ছুঁড়ে তার কলসি ফুটো করে দেবেই। সেই জন্যে তাকে মায়ের কাছে অনেক বকুনী খেতে হয়। তবু তা। করবেই। মা মাহমুদা বিবি গরিব মেয়েদের অনেককে কলসি কেনার টাকা দেন। বাবা মোসারেফ হোসেন মেয়েকে রাগারাগি না করলেও দুষ্টুমী করতে নিষেধ করেন। তার কথাও শোনে না। বড় ভাই ইলিয়াস তার চেয়ে তিন বছরের বড়। সে মাঝে মধ্যে চড়-চাপটা দিলে তার সাথে হাতাহাতি করে। ছোটরা তাকে ভয় পায়, দেখলেই ছুটে পালায়। সমবয়সি ছেলে-মেয়েরাও ভয় করে। বড়রা তাকে এড়িয়ে চলে। কেউ যদি তার দিকে তাকায়, তা হলে তার সামনে গিয়ে গর্জে উঠবে, কী দেখছেন? ঘরে মা বোন নেই? আবার কোনোদিন তাকালে চোখ উপড়ে নেব।
তার চেয়ে দু’তিন বছরের বড় দূর সম্পর্কের চাচাতো ভাই মতি তাকে ভালবাসে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি। একদিন সুযোগ পেয়ে বলল, আসমা তুই দেখতে খুব সুন্দরী, কিন্তু তোর স্বভাবটা এত খারাপ কেন?
ব্যাস, আর যায় কোথায়? কর্কশ কন্ঠে বলল, কেন? তোদের পাকা ধানে মই দিয়েছি নাকি? আমার স্বভাব কী খারাপ দেখেছিস তোকে বলতেই হবে। নচেৎ তোর একদিন কী আমার একদিন।
মতি বলল, এখন যা করছিস, সেটাই তার প্রমাণ।
আসমা তার মুখে খুব জোরে একটা ঘুঁসি মেরে বলল, তাতে তোর কী? তোর খাই না পরি?
ঘুঁসি খেয়ে মতির একটা দাঁত ভেঙ্গে গিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।
আসমা দেখেও গ্রাহ্য করল না। বলল, আবার যদি কোনোদিন আমার সাথে লাগিস, তা হলে বাকি দাঁতগুলোও ভেঙ্গে দেব।
মতি বলিষ্ঠ তরুণ। ইচ্ছা করলে প্রতিশোধ নিতে পারত। তা না করে খুব রাগের সাথে বলল, মেয়ে বলে পার পেয়ে গেলি, নচেৎ………….. কথাটা শেষ না করে চলে গেল।
ঘরের সবাই যখন জিজ্ঞেস করল, তোর দাঁত ভাঙ্গল কি করে, তখন লজ্জায় সত্য ঘটনা বলতে না পেরে বলল, হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ওর সঙ্গে ভালবাসা করে বিয়ে করে প্রতিশোধ নেবে। তখন আসমা ক্লাস নাইনে পড়ে। তারপর থেকে মতি আসমার ধারে কাছে যায় না। তবে দূর থেকে লক্ষ্য করে।
মতির বাবার অবস্থা তেমন ভালো না হলেও চাষের ধানে সারা বছর একরকম টেনে টুনে চলে যায়। ওরা দু’ভাই তিন বোন। মতি সবার বড়। গত বছর এস.এস.সি. পাশ করে আর্থিক কারণে কলেজে পড়েনি। বাবার সঙ্গে চাষ-বাসের কাজ করে।
বছর দুই পরে যে বছর আসমা এস.এস.সি. পরীক্ষা দিল সেই বছর তার ভাই ইলিয়াস কুয়েতে চাকরি করতে গিয়ে তিন মাসের মধ্যে মারা গেল। লাশ ফেরৎ এলে তার বাবা মোসারেফ হোসেন দেখে স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেলেন।
মতি সেদিন ইলিয়াসের দাফন-কাফনে সহযোগীতা করল। কয়েকদিন পর আমাদের বাড়িতে আসার সময় পুকুর পাড়ে তার সঙ্গে দেখা।
মতি কিছু বলার আগে আসমা বলে উঠল, কিরে মতি, দাঁত ভাঙ্গার প্রতিশোধ নিতে এসেছিস না কি?
মতি মৃদু হেসে বলল, তখন অবশ্য ভেবেছিলাম, সুযোগ পেলে নেব। পরে চিন্তা করে
দেখলাম, তুই আমার চেয়ে দু’তিন বছরের ছোট, তা ছাড়া দূর সম্পর্কের হলেও চাচাতো বোন। ছোট বোন অন্যায় করলে বড় ভাই হিসাবে মাফ করে দেওয়া উচিত। তাই সে কথা মনে না রেখে মাফ করে দিয়েছি।
আসমা বলল, সেদিন ঘরে এসে আমিও ভেবেছিলাম তোকে মারাটা অন্যায় হয়েছে, মাফ চেয়ে নেব। যাক, তুই মাফ করে দিয়েছিস শুনে খুশি হলাম।
একটা কথা বলব রাবি না বল?
না, কি বলবি বল।
আমি তোর চেয়ে বড়, তুমি করে বলতে পারিস না?
আসমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আর কিছু বলবি?
তুই বড় হয়েছিস, এস.এস.সি. পরীক্ষাও দিয়েছিস। আমি খারাপ কিছু বললাম কিনা ভেবে দেখ। ইলিয়াস মারা যেতে চাচা পঙ্গু হয়ে গেছেন। এবার তুই সংযত হ’! বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতে শেখ। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় ডগাং ডগাং করে ঘুরে বেড়ানোও তোর উচিত নয়।
আসমা ভিজে গলায় বলল, মতি ভাই তুমি ঠিক কথা বলেছ। পাড়ায় ঘোরা আমি বন্ধ করে দিয়েছি। তুমিও কিন্তু আমাকে তুমি করে বলবে।
মতি খুশি হয়ে বলল, ঠিক আছে, চলো চাচাকে দেখে আসি।
এরপর থেকে মতি প্রায় চাচাকে দেখতে এসে আসমার সঙ্গে গল্প করে। তাদের সংসারের বাইরের যাবতীয় কাজ করে দেয়। তাদের পুকুরে মাছ চাষের ও বিক্রি করার ব্যবস্থা করে। তাদের দুরাবস্থা দেখে দুঃখ পায়। যতটুকু পারে মাঝে মধ্যে মা-বাবার অগোচরে চাচার হাতে বিশ-পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সাহায্য করে।
আসমা জানতে পেরে একদিন বলল, মতি ভাই, আব্বাকে যে টাকা তুমি দাও, সেটা কোথায় পাও?
আমি মায়ের কাছ থেকে মাঝে মাঝে হাত খরচের জন্য কিছু কিছু চেয়ে নিই। খরচ না করে জমিয়ে চাচাকে দিয়ে যাই।
কেন দাও বলতো?
বারে, চাচার দুর্দিনে সাহায্য করাই তো উচিত।
তা উচিত, তবে আমার মনে হয় তোমার আরো কোনো মতলব আছে।
এরকম মনে হওয়ার কী কোনো কারণ ঘটেছে?
না, তা ঘটেনি। নিকট আত্মীয় তো কত রয়েছে। তারা কখনো দু’চার টাকা দিয়ে। সাহায্য করেনি। তুমি দূর সম্পর্কের হয়ে করছ, তাই বললাম আরকি।
মতি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তুমি কি অনুমান করেছ জানি না, তবে যদি রেগে যাবে না বলে কথা দাও, তা হলে বলতে পারি।
তার হাবভাব দেখে আসমা অনেক আগেই বুঝেছে, সে তাকে ভালবাসে। ভাবল, সেই কথাই হয়তো বলবে। অনুমানটা যাচাই করার জন্য বলল, রাগব না, কি বলবে বল।
তুমি যখন ঘুঁসি মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছিলে, তার অনেক আগে থেকেই তোমাকে ভালবাসি। তাই তো সেদিন ভালো হতে বলেছিলাম।
আসমার অনুমানই ঠিক হল। তবু ভালবাসার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। কারণ সেও মতিকে ভালবেসে ফেলেছে।
মতি বলল, খুব রেগে গেছ মনে হচ্ছে। এক্ষুণি কিন্তু রাগবে না বলেছ।
আসমা মাথা নিচু করেই বলল, না, রাগিনি মতি ভাই। তবে…. বলে থেমে গেল।
তবে কী বলবে তো?
আসমা কিছু বলল না।
তবে কী আমাকে তুমি পছন্দ কর না?
না তাও না। পরে একদিন বলব।
ঠিক আছে, আজ আসি বলে মতি চলে গেল।
.
মতির এক মামা ঢাকা জজ কোর্টে মুহুরীর কাজ করেন। তার তদবীর এক উকিলের চেম্বারে মতি পিয়নের চাকরি পেল। উকিলের বাসায় থাকা-খাওয়া, বেতন এক হাজার টাকা;
মতি ঢাকায় চাকরি করতে যাওয়ার আগের দিন মোসারেফ চাচাদের বাড়িতে সে কথা জানিয়ে ফেরার সময় আসমাকে ইশারা করে বাইরে আসতে বলল।
আসমা তার সাথে পুকুর পাড়ে এসে বলল, ঢাকায় গেলে মানুষ গ্রামের সবকিছু ভুলে যায়।
মতি বলল, সবাই একরকম হয় না। ওসব কথা থাক, তোমাকে আজ আমার দু’আড়াই বছর আগের সেই একটি প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে। নচেৎ ভাববো, সত্যি সত্যি তুমি আমাকে পছন্দ কর না।
আসমা বলল, এতদিনেও কী তুমি বুঝতে পারনি? শুধু মুখে বললেই কী হয়? ছেলেরা মুখ ফুটে যা বলতে পারে মেয়েরা তা পারে না। তুমি চাকরি করতে ঢাকায় চলে যাবে শোনার পর থেকে খুব খারাপ লাগছে। আমার মুখ দেখেও তুমি বুঝতে পারছ না?
মতির মন আনন্দে নেচে উঠল। এদিক ওদিক তাকিয়ে খপ করে তার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, আজ এতদিন পরে আল্লাহ তোমার মনের কথা জানালেন, সেই জন্যে তাঁর পাক দরবারে শত কোটি শুকরিয়া জানাই। তারপর বলল, নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে।
আসলেও তুমি তাই। তা না হলে এক নিঃস্ব বাবার মেয়েকে ভালবাসতে না।
এ আবার কি কথা বলছ, আমি তো বুঝতে পারছি না?
বোকা না হলে ঠিকই বুঝতে পারতে। তোমার বাবা কী তার ছেলের বিয়ে যৌতুক ছাড়া দেবেন? তার উপর তুমি আবার চাকরি পেয়েছ।
তা হয়তো দেবেন না, তবে আমার অমতেও কিছু করতে পারবেন না। যা জানার আমার জানা হয়ে গেছে। যৌতুকের ব্যাপারটা আমি বুঝব। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
মতি ভাই, একটা কথা বলব কিছু মনে করবে না বল?
তোমার কোনো কথাতেই আমি কিছু মনে করব না। তুমি নিশ্চিন্তে বল।
তুমি আমাকে ভুলে যাও। কারণ যৌতুকের কথা বাদ দিলেও আব্বাকে এই অবস্থায় ফেলে বিয়ে করা কিছুতেই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি চলে গেলে সংসারের অবস্থা কি হবে ভেবে দেখ।
মতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কি হবে আল্লাহকে মালুম। তবে এটা শুনে রাখ, তোমার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব। অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি। ছুটিতে যখন আসব তখন এ ব্যাপারে আলাপ করব।
.
০২.
মোসারেফ হোসেন আজ তিন বছরের বেশি পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। আড়াই বিঘা জমি বেচে বড় ছেলে ইলিয়াসকে কুয়েত পাঠিয়েছিলেন। আরো আড়াই বিঘা বেচে নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু বাক শক্তি ফিরে পাওয়া ছাড়া আর কোনো উন্নতি হয়নি।
ভাইয়া ও আব্বার দুর্ঘটনার পর আসমার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার আসমা যেন আগের আসমা নয়। প্রথম কয়েকদিন তো চুপচাপ পুকুর পাড়ে নির্জন কোনো গাছতলায় বসে বসে কাঁদত। ছোট বোন সালেহা তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়াত। মোসারেফ হোসেন মেয়েকে অনেক বুঝান। একদিন চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, মা, আল্লাহ তোর ভাইকে দুনিয়া থেকে তুলে নিলেন। আমাকেও পঙ্গু করে দিলেন। তুইও যদি ভেঙ্গে পড়িস, তা হলে সালেহাকে, জাহিদকে কে দেখবে? তুই বড় হয়েছিস, লেখাপড়াও করেছিস, এত ভেঙ্গে পড়লে চলবে? তোর মাকে তো জানিস, সে মাটির মানুষ। তোকেই তো এখন সংসারের সব দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।
তারপর থেকে আসমার পরিবর্তন এল। নিয়মিত নামায ও কোরআন পড়তে লাগল। এখন আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় না। কোনো কারণে কোথাও গেলে গায়ে মাথায় চাদর জড়িয়ে যায়। মুরুব্বিদের সঙ্গে দেখা হলে রাস্তা ছেড়ে একপাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। যেসব ছেলে-মেয়েরা তাকে দেখলে ছুটে পালাত, এখন তাদেরকে আদর করে বুকে টেনে নেয়। এসব দেখে গ্রামের লোকজন বলাবলি করে, ভাই মারা যাওয়ার পর ও বাপ পঙ্গু হয়ে যেতে মোসারেফ হোসেনের মেয়েটা খুব ভালো হয়ে গেছে। গ্রামের বৌড়ী-ঝিউড়ীরা স্বস্তি পেয়ে নির্ভয়ে তাদের পুকুর থেকে কলসি করে পানি নিয়ে যায়।
ছোট মেয়ে সালেহার ক্লাস নাইনে উঠার পর পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। টাকার জন্য মোসারেফ হোসেনের চিকিৎসাও বন্ধ হয়ে গেছে। স্ত্রী হামিদা বিবি খুব পর্দানশীন ও ধার্মীক মহিলা। তিনি সব ছেলে মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সেই মতো মানুষ করলেও বড় মেয়ে আসমা ছোট বেলা থেকে বড় দুষ্টু। তাকে বাগে আনতে পারেননি। এখন তার পরিবর্তন দেখে খুব খুশি হয়ে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করেন। আসমা আব্বার যে সমস্ত ধর্মীয় বই পুস্তক ছিল, সেই সব পড়ে নিজে যেমন মেনে চলে, তেমনি ছোট দুটো ভাই-বোনকেও শিক্ষা দেয়। এখন সে বিশ বছরের যুবতী। সংসারের দায়-দ্বায়িত্ব তার উপর। সকালে ও বিকালে স্কুলের কয়েকটা ছেলে মেয়েকে পড়ায়। ছোট ভাই জাহিদ পড়া শোনায় খুব ভালো। তাই শত অভাবের মধ্যেও তার পড়া বন্ধ করেনি। সে এখন ক্লাশ সিক্সে পড়ে।
আজ সকালে জাহিদের ছেঁড়া জামাটা সেলাই করার সময় মতির কথা ভাবছিল। প্রায় ছ’মাস হতে চলল ঢাকায় চাকরি করতে গেছে। নতুন চাকরি বলে ছুটি পায়নি। তাই আসতে পারেনি। সে কথা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে। এপর্যন্ত আসমা তার পাঁচটা চিঠি পেয়েছে। এমাসে এখনো পায়নি। রান্না ঘর থেকে মায়ের ডাক শুনে তার চিন্তায় ছেদ পড়ল।
আসমা…. ও আসমা, কোথায় গেলিরে মা?
আসমা জামাটা সেলাই করতে করতেই মায়ের কাছে এসে বলল, কেন ডাকছ বল।
মাহমুদা বিবি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, তোর আব্বার হাত-পায়ের যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ওষুধ না কিনলেই নয়। ঘরে এক মুঠো চালও নেই।
তারপর দু’গাছা সোনার বালা তার দিকে বাড়িয়ে বললেন, তুই এক্ষুণি বালিয়াকান্দি যা। তোর বড় মামাকে এ দুটো বিক্রি করে টাকা দিতে বলবি।
ততক্ষণে জামাটা সেলাই হয়ে গেছে। দাঁত দিয়ে সুতো কেটে বালা দুটো নিয়ে বলল, বিয়ের চিহ্ন সবকিছুই তো বিক্রি করে দিলে, এ দু’টেও করবে? আব্বা এ দুটো বিক্রি করতে নিষেধ করেছিলেন না?
আস্তে বল, তোর আব্বা শুনতে পাবে। তারপর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তুই তো জানিস, এছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।
তা তো জানি; কিন্তু এই টাকায় কত দিন আর চলবে? তারপর কি করবে ভেবে দেখেছ?
মাহমুদা বিবি আবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবে আর কী করব মা, আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে। তুই আর দেরি করিস না। এতটা পথ যেতে আসতে অনেক সময় লাগবে।
জাহিদের আজ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু। স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে এসে মাকে সালাম করে আসমাকে করার সময় বলল, বড় বুবু জামা সেলাই হয়েছে? পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে তো।
হাঁ হয়েছে, বলে আসমা জিজ্ঞেস করল, আব্বাকে সালাম করেছিস?
হ্যাঁ করেছি।
আসমা জামাটা পরিয়ে দিয়ে বলল, পরীক্ষা শুরু হতে দেরি আছে, একটু দাঁড়া আমিও তোর সঙ্গে যাব। কথা শেষ করে রুমে এসে শাড়িটা ঠিক করে পরার সময় বালা দুটো পেট কাপড়ে জড়িয়ে নিল। তারপর মুখে হাতে একটু নারকেল তেল মেখে মাথায় দু’একবার চিরুনী বুলিয়ে বেরিয়ে এসে জাহিদকে বলল, চল।
আসার সময় বারান্দার তার থেকে চাদরটা নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল।
যেতে যেতে জাহিদ বলল, তুমি স্কুলে যাবে কেন বড় বুবু?
আসমা বলল, স্কুলে যাব না, মামাদের ওখানে যাব।
অত দূরের রাস্তা তুমি একা যাবে? কাল আমার পরীক্ষা নেই, কাল গেলে হত না? আমিও তোমার সঙ্গে যেতাম।
না, পরীক্ষার সময় তোর কোথাও যাওয়া চলবে না। বিশেষ দরকারে আব্বা পাঠালেন। বড় মামার সঙ্গে দেখা করেই চলে আসব।
এ বছর ক্লাসে ওঠার পর আমাকে নতুন প্যান্ট-জামা কিনে দিতে হবে কিন্তু।
দেব রে দেব, তোকে কিন্তু ফার্স্ট হতে হবে।
ফার্স্ট হব কি করে? আমার তো প্রাইভেট মাস্টার নেই। জান বড় বুবু, মিয়া বাড়ির রসিদ দু’টো মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়ে, ওর সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারব?
কেন পারবি না, আমি তো তোকে সব সাবজেক্ট পড়াই। আমার মন বলছে, ইনশাআল্লাহ তুই ফার্স্ট হবি।
স্কুলের কাছে এসে আসমা বলল, ধীর স্থিরভাবে পরীক্ষা দিবি। তাড়াহুড়ো করবি না। প্রথমে প্রশ্নপত্র পুরোটা পড়বি। তারপর যে গুলো সহজ মনে হবে সেগুলোর উওর আগে লিখবি। ঘন্টা পড়ার আগে যদি সব উত্তর লেখা হয়ে যায়, তা হলে বসে বসে রিভাইজ দিবি। তারপর তাকে স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে আসমা হাঁটতে শুরু করল।
তার মামাদের বাড়ি বালিয়াকান্দী, জয়নগর থেকে প্রায় চার মাইল। তার মামারা তিন ভাই। সবাই ভিন্ন। নিম্ন মধ্যবিত্ত কৃষক। ছোট দু’জনের পাঁচ-ছটা ছেলে মেয়ে। চাষবাস করে কোনোরকমে সংসার চালায়। বড় জনের নাম আনোয়ার হোসেন। তার এক ছেলে এক মেয়ে। তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের ঘরে চার বছরের এক নাতি। তার নাম রহিম। তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় জনের অবস্থা একটু স্বচ্ছল। তিনি মাঝে মধ্যে একমাত্র বোনের বাড়ি গিয়ে খোঁজ খবর নেন। যতটুকু পারেন টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন।
আসমা যখন মামা বাড়ি এসে পৌঁছাল তখন বেলা এগারটা।
আনোয়ার হোসেন বাড়িতে ছিলেন। ভাগনিকে দেখে বললেন, কিরে খবর সব ভালো তো?
আসমা সালাম বিনিময় করে মামা মামিকে কদমবুসি করল। তারপর বলল, জ্বি ভালো বলে পেট কাপড় থেকে বালা দুটো বের করে মামার হাতে দিয়ে বলল, এগুলো মা বিক্রি করে টাকা দিতে বলেছে। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হবে।
আনোয়ার হোসেন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভিজে গলায় বললেন, মারে, আমি এমনই হতভাগা, তোদের জন্য কিছুই করতে পারলাম না। তোর মা এক এক করে সব গহনা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। আল্লাহ যে তোদের তকদিরে কি রেখেছেন তা তিনিই জানেন। তারপর স্ত্রীকে বললেন, ওকে কিছু খেতে দাও, আমি এগুলো বিক্রি করে আসি। কথা শেষ করে চোখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন।
বড় মামি হুসনে আরা আসমাকে বললেন, এখন মুড়ি টুড়ি কিছু খাবি, না একেবারে ভাত খাবি?
আসমা বলল, না বড় মামি এখন কিছু খাব না। একেবারে ভাত খাব। ভাবি কোথায়?
সে রান্না ঘরে।
আসমা রান্না ঘরে গিয়ে সালাম দিয়ে বলল, ভাবী কেমন আছ?
জুলেখা তরকারী কুটছিল। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আরে আসমা যে, কেমন আছ? ফুফা ফুপি ভালো আছেন? তারপর একটা পিঁড়ে এগিয়ে দিয়ে বলল, বস।
আসমা বসে বলল, হ্যাঁ, সবাই ভালো আছি। তুমি কেমন আছ?
ভালো, অনেক দিন আসনি কেন? আগে তো প্রায় আসতে।
কি করে আসব? কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দু’বেলা প্রাইভেট পড়াই। তারপর জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া বুঝি মাঠে গেছে?
হ্যাঁ, হাল চাষ করতে গেছে।
রহিমকে দেখছিনা কেন?
তাকে এবারে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। স্কুলে গেছে।
যাই, মেজ মামা ও ছোট মামাদের সঙ্গে দেখা করে আসি।
ঠিক আছে এস।
খাওয়া দাওয়া করে টাকা নিয়ে আসমা বেলা দেড়টায় রওয়ানা দিল। মামা-মামি এত রোদে যেতে নিষেধ করে বিকেলে যেতে বলেছিলেন; আসমা শোনেনি। মাইল দুয়েক আসার পর দূর থেকে ইহসানকে দুটো ছেলের সঙ্গে তাদের বাগানের কাছে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। সে যখন ক্লাস টেনে পড়ত তখন থেকে এস.এস.সি. পাশ করা পর্যন্ত ইহসান তার পেছনে লেগেছিল। প্রতিদিন স্কুলের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। ছুটির সময় পথে অনেকবার দেখা করে প্রেম নিবেদন করে চিঠিও দিয়েছে। আসমা উত্তর দেয়নি। শেষে চিঠি দিয়ে বিয়ে করার কথা বলেছিল। আসমা তারও উত্তর দেয়নি। একদিন একা পেয়ে কুৎসিৎ প্রস্তাব দিয়ে ভয়ও দেখিয়েছিল। আসমা রেগে গিয়ে বলেছিল, আমি স্যারকে বলে আপনার বাবার কাছে নালিশ করব। তারপর থেকে আর কাছে আসেনি, কথাও বলেনি। কিন্তু যাওয়া আসার পথে তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। সে সব চার বছর আগের কথা। এর মধ্যে ইহসানের সঙ্গে আসমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। আজ তাকে দেখে ভয় পেলেও ভাবল, এতদিনে হয়তো ইহসান তাকে ভুলে গেছে। বিয়ে শাদি করেছে। এখন ভয় পাওয়ার কি আছে ভেবে দ্রুত হাঁটতে লাগল। কাছাকাছি এসে না দেখার ভান করে যখন মাথা নিচু করে চলে যাচ্ছিল ঠিক তখনই ইহসানের গলা শুনতে পেল, আসমা দাঁড়াও।
আসমা দাঁড়াল না, আরো দ্রুত হাঁটতে লাগল।
ইহসান প্রায় ছুটে এসে তার পথ রোধ করে বলল, তোমাকে ডাকলাম আর তুমি না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছ যে।
আসমা বাধ্য হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সঙ্গি দু’জন নেই। তবে অনেকটা দূরে একটা লোক এদিকে আসছে। চিন্তা করল, লোকটা কাছে আসা পর্যন্ত ইহসানকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে।
মিথ্যে করে বলল, আমি খুব অন্যমনষ্ক ছিলাম। আপনার কথা শুনতে পাইনি। কি বলবেন বলুন। আমার খুব তাড়া আছে।
ইহসান বলল, চার বছর আগে তোমাকে আমার মনের কথা জানিয়েছিলাম। তখন রেগে গেলেও ভেবেছিলাম, তুমি ম্যাচিওর হওনি। আজও তোমার ভালবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। এখন তুমি পূর্ণ ম্যাচিওর। আশা করি, আজ আর আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দেবে না।
এটা সম্ভব নয় ইহসান ভাই। আপনি বড় লোকের ছেলে। আপনার জন্য কত বড় বড় ঘরের মেয়েরা হাঁ করে বসে আছে। আমার বাবা শুধু গরিব নয়, একেবারে সহায় সম্বলহীন। তা ছাড়া….।
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ইহসান বলে উঠল, প্রেম ভালবাসার কাছে ধনী গরিবের প্রশ্ন অবান্তর। তোমার কোনো কথাই শুনব না। আজ তোমাকে বলতেই হবে, তুমি আমাকে ভালবাসবে কিনা?
আপনি কি জানেন মুখে বললেই যেমন ভালবাসা হয় না, তেমনি জোর করেও তা পাওয়া যায় না।
ইহসান এতক্ষণ নরম ভাবে কথা বললেও এবার গরম মেজাজে বলল, তার মানে তুমি আমার ভালবাসাকে ফিরিয়ে দিচ্ছ?
আসমা এতক্ষণ রেখে ঢেকে কথা বলছিল। আগন্তুক পথিক কাছে এসে গেছে দেখে সেও দৃঢ় কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ ফিরিয়ে দিচ্ছি। কারণ আপনার দুশ্চরিত্রের কথা জানতে আমার বাকি নেই। চেয়ারম্যানের ছেলে বলে কেউ কিছু বলতে সাহস করেনি, নচেৎ টের পেতেন।
ইহসান আসমাকে আসতে দেখে বন্ধু দু’জনকে বাগানের ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে বলেছিল, আসমা যদি আমার কথায় রাজি না হয়, তা হলে বাগানের ভিতরে নিয়ে গিয়ে যা করার করে ওর অহঙ্কার ভাঙবো। এখন আসমার কথা শুনে খুব রেগে গিয়ে তার একটা হাত ধরে বাগানের ভিতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল।
আসমার স্বাস্থ্য ভালো। গায়ে শক্তিও আছে। ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল।
ইহসান আসমাকে জাপটে ধরে বন্ধুদের বেরিয়ে আসতে বলল।
ইহসানের বন্ধু দু’জনের একজনের নাম বসির, অন্যজনের নাম সাগির। তারাও স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। তিনজনেই কয়েক বছর আগে এস.এস.সি. ফেল করার পর আর পড়েনি।
ইহসানের কথা শুনে বসির ও সাগির এসে তিনজনে মিলে আসমাকে বাগানের ভিতরে নিয়ে যেতে লাগল।
আসমা প্রাণপনে বাধা দিতে দিতে চিৎকার করতে লাগল, কে কোথায় আছ বাঁচাও।
আসমা যে লোকটাকে দূর থেকে আসতে দেখেছে তার নাম রিয়াজুল। ততক্ষণে সে তাদের কাছে এসে পৌঁছে গেছে। আসমার চিৎকার শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি তাদের পথ রোধ করে গম্ভীর স্বরে বলল, মেয়েটাকে ছেড়ে দাও।
এতক্ষণ তারা কেউ রিয়াজুলকে লক্ষ্য করেনি। তার কথা শুনে ইহসান বন্ধুদের বলল, শালাকে ভাগাবার চেষ্টা কর।
বসির ও সাগির রিয়াজুলের ষণ্ডা মার্কা চেহারা দেখে কিছু করার সাহস পেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
রিয়াজুল ইহসানের জামার পিছনের কলার ধরে কঠিন কণ্ঠে বলল, ভালো চাও তো ছেড়ে দাও।
ইহসান রিয়াজুলের গলার স্বর শুনে ও বন্ধুদের চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে গেল। আসমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথা নিচু করে করে নিল।
রিয়াজুল তার জামার কলার ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে ভদ্র ঘরের ছেলে। ছিঃ ছিঃ এরকম কাজ করা তোমাদের ঠিক হয়নি। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমরা কোন গ্রামের ছেলে?
ইহসান রাগে কিছু বলতে পারল না। কিন্তু বসির ও সাগির খুব লজ্জা পেয়েছে। তারা আপন চাচাতো ভাই। তাদের কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। বন্ধুকে শুধু সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বসির বলল, আমরা এই গ্রামেরই ছেলে।
তোমার নাম কি?
বসির।
তামার বাবার নাম?
জাফর আলি।
রিয়াজুল সাগিরকে জিজ্ঞেস করল তোমার নাম?
সাগিব।
বাবার নাম?
সানোয়ার আলি।
রিয়াজুল এবার ইহসানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম?
ইহসান উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
বসির বলল, ও চেয়ারম্যান আলি আসগরের ছেলে ইহসান।
তোমরা কি পড়াশোনা কর?
এস.এস.সি. পরীক্ষায় ফেল করে আর পড়িনি।
এটা তোমরা খুব ভুল করেছ। আমি তোমাদের বড় ভাইয়ের মতো। তাই কয়েকটা কথা বলছি শোন, তোমাদের কারো বোনকে যদি কেউ এরকম করত, তা হলে তোমরা কি করতে? নিশ্চয় তাকে উত্তম-মধ্যম দিয়ে শালীসি ডাকতে। এখন ভেবে দেখ, তোমরা যে কাজ করতে যাচ্ছিলে, তা ক্ষমার অযোগ্য। তোমাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত। বড় ভাই হিসাবে আজ তোমাদের ক্ষমা করে দেব, যদি তোমরা ভবিষ্যতে এরকম আর করবে না বলে প্রতিজ্ঞা কর। নচেৎ তোমাদের গার্জেনদের জানিয়ে এর বিহীত করব।
এই কথায় বসির ও সাগির খুব ভয় পেল। কারণ তাদের বাবা খুব কড়া লোক। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, এরকম কাজ আর জীবনে করব না।
ইহসানকে চুপ করে থাকতে দেখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়াজুল বলল, কী ভাই তুমি কিছু বলছ না কেন? মনে হচ্ছে আমার উপর খুব রেগে আছ?
এমন সময় চেয়ারম্যান আলি আসগরকে দু’জন লোকের সঙ্গে আসতে দেখে বসির বলে উঠল, ইহসান তোর আব্বা আসছে।
সেদিকে তাকিয়ে ইহসানের মুখে রাগের পরবর্তে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠল। ভাবল, আব্বাকে যদি লোকটা বলে দেয় তা হলে আস্ত রাখবে না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বলল, আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে আর কোনোদিন এমন কাজ করব না।
রিয়াজুল বলল, পাশের গ্রামে আমার বাড়ি। মনে রেখ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে, আমি জানতে পারব। তখন কিন্তু ছেড়ে কথা বলব না। তারপর আসমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি?
আসমা।
বাড়ি?
আসমা সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ গ্রামের পাশের গ্রাম জয়নগরে।
আরে আমারও তো ঐ গ্রামেই বাড়ি। তোমার বাবার নাম কি?
মোসারেফ হোসেন।
ততক্ষণে আলি আসগর দু’জন সঙ্গিসহ সেখানে এসে ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কী ব্যাপার এখানে কি করছ?
ইহসান কিছু বলার আগে রিয়াজুল সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন চেয়ারম্যান চাচা?
আলি আসগর সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না।
আমি জয়নগর গ্রামের মরহুম সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। ছোট বেলা থেকে ঢাকায় থেকে লেখাপড়া করি। গ্রামে তো থাকি না, চিনবেন কি করে?
আলি আসগর বেশ অবাক হয়ে বললেন, তুমি সালাউদ্দিন মিয়ার ছেলে?
জ্বি।
আল্লাহ তোমার আব্বাকে জান্নাতবাসী করুন। খুব ভালো লোক ছিলেন। শুনেছি, তুমি যখন তোমার মায়ের পেটে তখন তিনি মারা যান। তা হঠাৎ কি মনে করে এলে? এবার দেশে থাকবে নাকি? তোমার ছোট চাচার সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল। তার কাছে। শুনলাম, তোমার বাবার সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল চলছে।
জ্বি সেই জন্যেই তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন।
আলি আসগর আসমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে যেন চেনা চেনা লাগছে, কার মেয়ে তুমি?
আসমা বলল, জয়নগর গ্রামের মোসারেফ হোসেনের মেয়ে।
আহা রে! তোমার বাবাও খুব ভালো লোক। ছেলের কারণে পঙ্গু হয়ে গেল। তা তোমার বাবা কেমন আছে?
জ্বি ঐ একই রকম।
ইহসান, বসির ও সাগির এক ফাঁকে সেখান থেকে কেটে পড়ছে। রিয়াজুল বলল, চাচা, আমরা এবার যাই?
হ্যাঁ যাও, বলে আলি আসগর সঙ্গিদেরকে বললেন, চল।
কিছুটা আসার পর রিয়াজুল আসমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কেন এসেছিলে?
আসিনি, বালিয়াকান্দি মামাদের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম।
লেখাপড়া কতদূর করেছ?
তিন বছর আগে এস.এস.সি. পাশ করেছি।
তাই নাকি? তা হলে তো তুমি করে বলে ভুল করেছি। যাক কিছু মনে করবেন না। না জেনে…………।
কথাটা তাকে শেষ করতে না দিয়ে আসমা পথ রোধ করে কদমবুসি করে ছলছল চোখে ভিজে গলায় বলল, আমি আপনার পায়ের ধূলোর যোগ্যও নই। আমাকে তুমি করেই বলবেন। আপনি আমার ইজ্জত বাঁচিয়ে নবজন্ম দিয়েছেন। ঠিক সময় মতো এসে না পড়লে কি যে হতো আল্লাহকেই মালুম। তারপর দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
রিয়াজুল তাকে কিছুক্ষণ কাদার সময় দিয়ে বলল, হ্যাঁ এটাই আল্লাহ পাকের ইশারা ছিল। এবার চল যেতে যেতে কথা বলি। তারপর যেতে জিজ্ঞেস করল, তোমার কে কে আছে?
আম্মা- আব্বা ও এক ভাই এক বোন। ওরা সবাই আমার ছোট।
তোমার আব্বার নাম যেন তখন কি বললে?
মোসারেফ হোসেন।
চেয়ারম্যান চাচা তোমার আব্বার পঙ্গু হওয়ার কথা যেন কি বলছিলেন?
আমার একটা বড় ভাই ছিল, এইচ.এস.সি পাশ করে কুয়েতে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে সেখানে মারা যায়। লাশ ফিরে এলে আব্বা দেখে স্ট্রোক করে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
ইন্নালিল্লাহে………….রাজেউন পড়ে রিয়াজুল বলল, খুব দুঃখের ব্যাপার। আল্লাহ তোমার আব্বাকে সুস্থ করে দিন। তুমি সেয়ানা মেয়ে। বোরখা পরনি কেন? বোরখা পরলে এরকম বিপদে পড়তে না।
আমার বোরখা নেই। আম্মারটা পরার অযোগ্য। তাই চাদর গায়ে দিয়ে এসেছিলাম। ওরা বাগানের ভিতর ফেলে দিয়েছে।
ওদেরকে তুমি চেন?
চেয়ারম্যানের ছেলে ইহসানকে চিনি। বাকি দু’জনকে চিনি না।
রিয়াজুলের মনে সন্দেহ হল, জিজ্ঞেস করল, ওতো এই গ্রামের ছেলে, চিনলে কেমন করে?
আসমা এই কথার উত্তর না দিয়ে হাঁটতে লাগল।
আমার কথার উত্তর দিলে না যে?
আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমার পিছনে লেগেছিল। সে আজ চার বছর আগের ঘটনা। এতদিন পরে আজ হঠাৎ যে এরকম করবে ভাবতে পারিনি।
তুমি একা একা গিয়েছিলে কেন? ছোট ভাইকে সঙ্গে নিতে পারতে।
ওর আজ থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। খুব জরুরী কাজে আম্মা পাঠিয়েছিলেন। তারপর অনেক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কতদিন এখানে থাকবেন?
সে কথা আল্লাহ জানেন। তবে আপাতত বেশ কিছুদিন থাকব।
তারপর আর কেউ কোনো কথা বলল না। গ্রামে ঢুকে রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে গেছে। সেখানে এসে আসমা বলল, আপনি তো মিয়াবাড়ি যাবেন?
হাঁ মিয়া বাড়ি কোন দিকে বল তো?
আসমা একটা রাস্তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, চলুন আমি দেখিয়ে দিয়ে আসি।
না না তোমাকে যেতে হবে না, আমি লোকজনকে জিজ্ঞেস করে যেতে পারব। তার চেয়ে আমাদের বাড়িতে চলুন। খাওয়া দাওয়া করে রেস্ট নেবেন। আব্বার সঙ্গে পরিচয়ও হবে। বিকেলে আমার ভাই আপনাকে পৌঁছে দেবে।
কথাটা মন্দ বলোনি, তবে তা সম্ভব নয়। আচ্ছা চলি একদিন এসে তোমার আব্বার সঙ্গে পরিচয় করব। কথা শেষ করে রিয়াজুল হাঁটতে শুরু করল।
আসমা যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাড়ির দিকে। হাঁটতে লাগল।
<