জোনাকির আলো – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
আযীয মাস্টার প্রতিদিন ফজরের নামায পড়ে প্রায় আধঘণ্টা কুরআন তেলাওয়াত করেন, তারপর এশাকের নামায পড়ে ঘরে এসে বিস্কুট বা মুড়ি খেয়ে চা খান। আজ মসজিদ থেকে ঘরে এসে নাতনিকে দেখতে না পেয়ে একটু উঁচু গলায় বললেন, কোথায় গেলিরে দাদু, চা দিবি না?
রিজিয়া রান্নাঘর থেকে বলল, একটু বসুন, এক্ষুনি দিচ্ছি। দু’তিন মিনিট পর রিজিয়া চা-মুড়ি নিয়ে এসে বলল, বিস্কুট নেই, টিনে এই ক’টা মুড়ি ছিল।
আযীয মাস্টার বললেন, তোর চা কই?
রিজিয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল।
আযীয মাস্টার জানেন, যেদিন চা বা চিনি কম থাকে সেদিন তার জন্য শুধু রিজিয়া এক কাপ চা করে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, যা কাপ নিয়ে আয়, একেই দুজনে ভাগ করে খাব।
রিজিয়া বলল, আপনি খেয়ে নিন নানা, আমি আজ চা খাব না।
ওসব নেই কাল বললি না কেন? কিনে নিয়ে আসতাম।
আপনার কাছে তো টাকা নেই, কিনে আনতেন কি করে? কথাটা রিজিয়া বলতে গিয়েও বলল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বস। মুড়ি খা।
না নানা আপনি খান। আমি মুড়ি খাব না। পান্তা আছে খাব। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে রিজিয়া বলল, যা চাল আছে এ বেলা হবে, ওবেলার চাল নেই।
তোর সামসু মামার দোকান থেকে দু’কেজি নিয়ে আসিস। বলবি নানা টাকাটা পরে দেবে।
চিনি কম আছে দেখে আপনার কথা বলে একশো গ্রাম আনতে গিয়েছিলাম, দিল না। বলল, তোর নানার কাছে অনেক টাকা পাব, এখন আর বাকি দিতে পারব না।
ততক্ষণে আযীয মাস্টারের চা-খাওয়া হয়ে গেছে। বললেন, মাতব্বরের কাছে যাই, কিছু টাকা হাওলাত নিয়ে আসি।
তার কাছ থেকে তো অনেক টাকা হাওলাত নিয়েছেন, এখন আর দেবেন বলে মনে হয় না।
দেবে দেবে, না দিলে আমরা যে উপোস করে দিন কাটাব তা মাতব্বর জানে।
কিন্তু আর কত দেবেন? তিনি তো অনেক দিয়েছেন।
অনেক দিলেও আরো দেবে।
কিন্তু কেন তিনি আপনাকে টাকা দিচ্ছেন? আপনি কি তা হলে বাস্তুভিটেও তাকে লিখে দিয়েছেন?
এখনো দিই নি, তবে এবার হয়তো দিতে হবে।
আপনাকে কতবার মাতব্বরের কাছ থেকে টাকা হাওলাত নিতে নিষেধ করেছি,তবু নেন কেন?
কি করব রে দাদু, সে ছাড়া অন্য কেউ তো একটা পয়সাও দিতে চায়। মাতব্বর দেয় বলে তবু খেতে পাচ্ছি, না দিলে কি হত আল্লাহ জানে।
মাতব্বর তো এমনিই দেন না, বাস্তুভিটের লোভে দেন।
তোর কথা হয় তো ঠিক; কিন্তু অন্য কেউ সেই লোভেও দিতে রাজি হয় নি।
এই ভিটে নিতে অন্য কেউ কেন রাজি হয় নি রিজিয়া জানে। নানার কাছে শুনেছে, তাদের বাস্তুভিটেটা অনেক আগে হিন্দুদের মড়াচির ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় ইংরেজরা যখন চলে যায় তখন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে ভারতকে দুটো অংশে ভাগ করে দেয়। সেই সময় পাশের গ্রামে যে কয়েক ঘর হিন্দু ছিল, তারা সব কিছু বিক্রি করে হিন্দুস্তানে চলে যায়। সেই থেকে এই মড়াচির এমনি পড়ে ছিল। এখানে নাকি গভীর রাতে নানা রঙের আলো দেখা যেত, মেয়েদের কান্নাও শুনতে পেত। তাই ভয়ে এদিকে কেউ বড় একটা আসত না। একদিন সকালে গ্রামের লোকজন দেখল, মড়াচিরে একটা নতুন বেড়ার ঘর। তারা অবাক হলেও কে এই ঘর বানাল জানার জন্য কেউ সাহস করে সেখানে যেতে পারল না। কয়েকদিন পর জোহরের নামায পড়ার সময় মসজিদে একজন অচেনা দাড়িওয়ালা লম্বা চওড়া লোককে দেখে মুরুব্বিদের একজন তার পরিচয় জানতে চাইলেন। লোকটি বললেন, আমার নাম কুতুবউদ্দিন। আমাদের ঘর-বাড়ি, জমি জায়গা…নদীতে বিলীন হয়ে গেছে, তাই আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে আপনাদের পাশের গ্রামে আসি। সেখানে অনেকের কাছে থাকার জন্য একটু জমি চাইতে তাদের একজন এই জায়গাটার কথা বলে বললেন, ওটা হিন্দুদের জায়গা। তারা দেশ ভাগ হওয়ার সময় ভারতে চলে গেছে। বর্তমানে ওটার কেউ ওয়ারিস নেই। আপনি ওখানে ঘর করে থাকতে পারেন। তাই ওখানে একটা ঘর তৈরি করে এক ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকছি।
মুরুব্বি লোকটি বললেন, কিন্তু জায়গাটায় যে হিন্দুরা মড়া পুড়াত। সে কথা বলে নি?
কুতুবউদ্দিন বললেন, না বলে নি।
এই কয়েকদিনে কিছু অসুবিধে হয় নি?
কই না তো? তবে পানির জন্য একটু অসুবিধে হচ্ছে। পাশের গ্রামের যে বড় পুকুর রয়েছে, ওখান থেকে পানি নিয়ে আসতে হয়। ভাবছি, এখানে একটা পুকুর কাটাব।
মুরুব্বিরা তার কথা শুনে ভাবলেন, লোকটার বেশ টাকা-পয়সা আছে। ওখানে থাকলে তাদের তো কোনো অসুবিধে নেই। তা ছাড়া যে লোক স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে মাড়াচিরে থাকতে পারে, সে লোক নিশ্চয় সাধারণ লোক নয়। তাই তারা আর কিছু বললেন না।
জায়গাটা পাশাপাশি দু’টো গ্রামের মাঝখানে ও শেষ প্রান্তে জনবসতি থেকে একটু দূরে। তাই কুতুবউদ্দিন সেখানে বাস করলেও দুটো গ্রামেরই লোকজন তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ রাখে নি। তবে কুতুবউদ্দিন প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি পুকুর কাটিয়েছিলেন। পুকুরের চারদিকের পাড়ে আম, জাম, নারিকেল, পেয়ারা ও অন্যান্য ফলের গাছ লাগিয়েছিলেন। সে সব গাছে এখন ফল হচ্ছে। কিছু জমি-জায়গাও কিনেছিলেন। তারই ছেলে আযীয মাস্টার। আযীয মাস্টার এস.এস.সি. পাস করে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারি করতেন, আর বাবার সঙ্গে চাষবাসের কাজ করতেন। সবাই তাকে আযীয মাস্টার বলে ডাকে। কুতুবউদ্দিন ছেলের বিয়ে দেয়ার তিন বছর পর মারা যান। আযীয মাস্টারের একমাত্র মেয়ে সাবেরা অত্যন্ত সুন্দরী ছিল। সে ক্লাস ফাঁইভ থেকে বোরখা পরে এস.এস.সি. পর্যন্ত লেখাপড়া করে। কলেজ অনেক দূর বলে মেয়েকে আর পড়ান নি। তবে প্রচুর ধর্মীয় বই কিনে দিয়েছেন। সাবেরা সে সব পড়ে ধর্মের সব কিছু নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। পাশের গ্রামের ধনী আকরাম চৌধুরীর ছেলে শিহাব ঢাকায় ভার্সিটিতে পড়ত। ক্লাসমেট রাকিবের সঙ্গে শিহাবের গাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। রাকিব একবার শিহাবের সঙ্গে তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। একদিন বেড়াতে বেরিয়ে আযীয মাস্টারের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সাবেরাকে দেখে এত মুগ্ধ হল যে, তাকে বিয়ে করার সংকল্প করে। এক সময় বন্ধু শিহাবকে কথাটা জানাতে সে হেসে উঠে বলল, কি যা তা বলছিস? তুই এখন ছাত্র। তা ছাড়া তোর বাবা ধনী ব্যবসায়ী। তিনি ও তোর মা কিছুতেই রাজি হবেন না।
রাকিব বলল, তাদের ব্যাপারটা আমি বুঝব। তুই মেয়ের বাবার সঙ্গে কথা বল।
শিহাব বলল, শুধু মেয়ের রূপ দেখে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়া তোর উচিত নয়। মেয়ের মা-বাবা ও তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশ জানা উচিত। ওরা এখানকার আদিবাসী নয়। ঐ জায়গাটা ছিল হিন্দুদের মড়াচির। তারপর কুতুবউদ্দিন কিভাবে এখানে এসে বাস শুরু করেছিলেন সেসব বলে বলল, সাবেরা মানে যাকে তুই বিয়ে করতে চাচ্ছিস, তার দাদা হলেন কুতুবউদ্দিন। আর তারই ছেলে আযীয মাস্টার হল সাবেরার বাবা। সাবেরা জন্মাবার আগেই কুতুবউদ্দিন মারা যান। তার চার-পাঁচ বছর পর সাবেরার দাদিও মারা যান। ওরা হিন্দুদের মড়াচিরে থাকে বলে কেউ ওদের সঙ্গে মেলামেশা করে না। আযীয মাস্টার মেয়েকে এস.এস.সি. পর্যন্ত পড়িয়ে আর পড়ান নি। এ রকম একটা পরিবারের মেয়েকে তুই বিয়ে করতে চাইলেও আমি কিছুতেই মেনে নেব না। ভার্সিটিতে পড়ছিস, এসব কথা তোর বিবেচনা করা উচিত।
রাকিব বলল, তুই অবশ্য ঠিক কথা বলেছিস, কিন্তু কি জানিস, সাবেরাকে দেখে আমি শুধু মুগ্ধ হয় নি, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে রকম মেয়েকে জীবনসঙ্গী করার স্বপ্ন দেখে এসেছি, সাবেরা ঠিক তার মতো। এস.এস.সি. পাস হলেও আমি তাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে নেব। আর পরিবেশের কথা যে বললি, তার উত্তরে বলব, মানুষ যখন যে পরিবেশে থাকে তখন সেই পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়।
শিহাব বলল, তোর কথা কতটা সত্য জানি না। আমি তো জানি মানুষের অনেক স্বপ্ন থাকে। বাস্তবে তার ক’টা সফল হয়? তা ছাড়া মা-বাবা ও সোসাইটির কথা চিন্তা করবি না?
নিশ্চয় করব। তারা যে রাজি হবে না তা জানি। তাই তো তাদের না জানিয়ে বিয়ে করব। পড়াশোনা শেষ করে যখন বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করব এবং মা-বাবা যখন বিয়ে করার কথা বলবে তখন সব কিছু তাদেরকে জানিয়ে সাবেরাকে ঘরে নিয়ে আসতে বলব।
সাবেরার রূপ দেখে সত্যিই তুই পাগল হয়ে গেছিস। নচেৎ এরকম কথা বলতে পারতিস না। আরে বাবা, ঢাকায় কি সুন্দরী মেয়ের অভাব আছে? উঁচু সোসাইটির ধনী ঘরের এমন অনেক মেয়ে আছে, যারা সাবেরার থেকে হাজার গুণ ভালো। আর তুই যে পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় নেমে সাবেরাকে তোলার কথা বললি, ভেবে দেখেছিস, পড়াশোনা শেষ করতে কত বছর লাগবে? এত বছর ওকে এখানে ফেলে রাখবি নাকি?
ফেলে রাখব কেন? বললাম না, ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হোস্টেলে রেখে পড়াশোনা করাব।
একটা মেয়েকে হোস্টেলে রেখে পাঁচ-ছ’বছর পড়াতে কত খরচ জানিস?
না জানি না। তবে খরচের চিন্তা আমি করি না। যেমন করে তোক ম্যানেজ করব।
কিন্তু কথাটা তো বেশি দিন গোপন থাকবে না। সবাই জেনে গেলে কি করবি?
যতদিন সম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করব। তারপরও যদি জানাজানি হয়ে যায়, মা-বাবাকে সব কিছু জানাব।
শিহাব হেসে ফেলে বলল, তোর কথাগুলো একদম ছেলেমানুষের মতো। ক্লাস এইট পর্যন্ত আযীয মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। তখন থেকে ওকে ভালবাসতাম। অবশ্য সাবেরা সে কথা জানত না। কলেজে পড়ার সময় ওকে দেখার জন্য বিভিন্ন অসিলায় আযীয স্যারের কাছে যেতাম। আমাকে দেখলেই সাবেরা গায়ের ওড়না নাক পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে ঘরে ঢুকে যেত। ছোটবেলা থেকে ও খুব সুন্দরী। বড় হয়ে আরো বেশি সুন্দরী হয়েছে। স্কুলে অনেকবার ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি; কিন্তু শুধু আমাকেই নয়, কোনো ছেলেকেই কাছে ঘেঁষতে দিত না। শেষে তোর মতো চিন্তাভাবনা আমিও করেছিলাম এবং কথাটা আমার ছোট মামাকে জানিয়েছিলাম। ছোট মামা আমার চেয়ে তিন বছরের বড় হলেও আমাদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো। তোকে যেসব কথা বলে আমি বোঝালাম, ছোট মামা শুনে আমাকে সেইসব কথা বলে বুঝিয়েছিল। আমি বুঝতে পেরে সাবেরার চিন্তা বাদ দিয়েছি। তোকেও বলছি তুইও সাবেরার চিন্তা বাদ দিয়ে বেড়াতে এসেছিস বেড়িয়ে যা। ঢাকায় ফিরে গেলে ওর কথা আর মনে থাকবে না।
রাকিব বলল, সব মানুষ যেমন সমান হয় না, তেমনি সব মানুষের মনও সমান হয় না। তোর ছোট মামার কথায় তোর মন বুঝ মানলেও আমার মন মানে নি। তুই ও তোর মামা কেন, পৃথিবীশুদ্ধ লোক আমাকে বোঝালেও আমার মন বুঝবে না। আমি ওকে বিয়ে করবই। তুই শুধু আমাকে সাহায্য করবি কি না বল?
শিহাব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, তোকে সাহায্য করব কি করব না সে কথা পরে বলছি। তার আগে আমার অসুবিধের কথা বলি। প্রথমত, তুই সাবেরাকে বিয়ে করলে তোর ও আমার গার্জেনরা আমাকে দায়ী করবেন। দ্বিতীয়ত, কোনো কারণে তুই যদি ওকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে পড়াশোনা করাতে না পারিস অথবা তোর মা-বাবা জেনে যাবার পর ডিভোর্স করায় তখন আযীয মাস্টারও আমাকে দায়ী করবেন এবং বাবার কাছে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করবেন। তখন আমার পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে দেখ।
রাকিব বলল, অত ভূমিকার কি দরকার ছিল? সোজাসুজি বললেই পারিস সাহায্য করবি না।
তুই আমাকে ভুল বুঝছিস কেন? তোকে সাহায্য না করার জন্য কথাগুলো বলি নি। বন্ধুকে অসুবিধের কথা বলাটা কী অন্যায় হল? এবার আমার মতামত শোন। কালকেই আমি আযীয মাস্টারের সঙ্গে আলাপ করে তোকে জানাব।
না, তুই আগে কিছু ওনাকে বলবি না। যা বলার আমিই প্রথমে বলব। তারপর উনি যদি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করেন, তখন আমার সম্পর্কে যা জানিস সেটাই বলবি। তুই শুধু আমাকে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিবি।
ঠিক আছে, তাই হবে।
কুতুবউদ্দিন প্রথমে একটা বেড়ার ঘরে স্ত্রী ও চার বছরের ছেলে আব্দুল আযীযকে নিয়ে থাকতেন। ছেলে দশ বছরের হতে আরো একটা বেড়ার ঘর করেন। ছেলের বিয়ে দেয়ার আগে বেড়ার ঘর ভেঙ্গে পাকা ওয়াল ও উপরে টিনের চাল দিয়ে তিন কামরা ঘর করেন। একটা কামরায় তিনি স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন। অন্য কামরায় আব্দুল আযীয ও তার স্ত্রী থাকতেন। বাকি কামরাটা বৈঠকখানা।
একদিন স্কুল ছুটির পর আযীয মাস্টার ঘরে আসার পথে মসজিদ থেকে আসরের নামায পড়ে এসে বৈঠকখানায় বসে চা খাচ্ছিলেন। এমন সময় শিহাব রাকিবকে নিয়ে এসে বাইরে থেকে বলল, স্যার বাড়িতে আছেন?
সাবেরা আব্বাকে চা দিতে এসে কাপ নিয়ে যাবে বলে সেখানে দাঁড়িয়েছিল। কেউ আব্বার কাছে এসেছে বুঝতে পেরে বলল, আমি যাই, পরে এসে কাপ নিয়ে যাব। কথা শেষ করে ওড়না দিয়ে নাক পর্যন্ত মুখ ঢেকে বেরিয়ে এসে শিহাবকে দেখে সালাম দিয়ে বলল, শিহাব ভাই কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে শিহাব বলল, ভালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, স্যার আছেন?
হ্যাঁ আছেন। ভেতরে যান বলে এক পলক রাকিবের দিকে তাকিয়ে সাবেরা চলে গেল।
আযীয মাস্টার তাদের কথা শুনতে পেয়ে বললেন, কে? শিহাব না কি? এস ভেতরে এস।
শিহাব রাকিবকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে সালাম দিল।
সালামের উত্তর দিয়ে আযীয মাস্টার তাদেরকে বসতে বলে বললেন, কি খবর শিহাব?
শিহাব বলল, খবর ভালো, আপনি ভালো আছেন?
হ্যাঁ বাবা, আল্লাহ ভালই রেখেছেন। তা হঠাৎ কি মনে করে এসেছ? তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে তো চিনতে পারছি না।
রাকিব কিছু বলার আগে শিহাব বলল, ও রাকিব, আমার বন্ধু। ভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়ি। বেড়াতে এসেছে। আমার মুখে আপনার কথা শুনে দেখা করতে এসেছে। তারপর রাকিবের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই স্যারের সঙ্গে আলাপ কর, আব্বা এই গ্রামের একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি বলে শিহাব বেরিয়ে গেল।
আযীয মাস্টার রাকিবকে বললেন, শিহাব আমার ছাত্র, তুমি ওর বন্ধু। তোমাকে আমি তুমিই করে বলব, কিছু মনে করবে না তো?
রাকিব বিগলিত কণ্ঠে বলল, এতে মনে করার কি আছে? নিশ্চয়ই তুমি করে বলবেন।
তোমাদের বাড়ি মনে হয় ঢাকাতেই?
জি।
তোমার বাবা কি করেন?
উনি ব্যবসায়ী।
তোমরা কয় ভাইবোন?
শুধু দুই ভাই, বোন নেই। আমি ছোট।
বস, চায়ের কথা বলে আসি বলে আযীয মাস্টার উঠে দাঁড়ালেন।
রাকিব বলল, শিহাবের সঙ্গে চা খেয়ে এসেছি। এখন আর খাব না, আপনি বসুন। একটা কথা বলব বেআদবি নেবেন না স্যার। আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
ঠিক এই সময় সাবেরা একটা বড় থালায় দু’কাপ চা ও কয়েকটা বিস্কুট নিয়ে আসার সময় রাকিবের কথা শুনে খুব অবাক হয় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর জানালার পাশে এসে ভেতরে তাকিয়ে দেখল, শিহাব ভাই নেই। তার সঙ্গের ছেলেটা রয়েছে। ভাবল, ছেলেটা কে? শিহাব ভাইয়ের সঙ্গে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিল, অথচ শিহাব ভাই নেই। আব্বা কি বলে শোনার জন্য রাকিবের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
হোয়াট বলে আযীয মাস্টার কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার মেয়েকে চেনো?
কথাটা বলে রাকিব লজ্জায় মুখ নিচু করে নিয়েছিল। এবার মুখ তুলে বলল, জি না। তবে শিহাবের সঙ্গে কাল বেড়াতে বেরিয়ে এখান থেকে যাওয়ার সময় এক নজর দেখেছি।
আযীয মাস্টার অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার বয়স কম। তাই যে কথা বললে তার গুরুত্ব বোঝ না। শিহাবের বন্ধু, তাই কিছু বললাম না। অন্য কোনো ছেলে এ রকম কথা বললে চাবকে পিঠের ছাল তুলে বের করে দিতাম।
রাকিব রাগল না। মোলায়েম স্বরে বলল, আমার বয়স কম হলেও খুব একটা কম নয়। ভার্সিটিতে পড়ছি, জ্ঞানও যে একদম হয় নি তা নয়। জীবনসঙ্গী পছন্দ করার মতো বয়স ও জ্ঞান হয়েছে। আর কথাটার গুরুত্ব বোঝার মতো জ্ঞানও আমার হয়েছে। আপনি বাবার বয়সী ও একজন শিক্ষক। চাবকে আমার পিঠের ছাল তুলে বের করে দিলেও কিছু মনে করতাম না। ফিরে এসে ঐ কথা আবার বলতাম।
আযীয মাস্টার চিন্তা করলেন, অন্য কোনো ছেলে হলে তার কথা শুনে রেগে যেত ও অপমান বোধ করে চলে যেত। কিন্তু তা না করে যা বলল, তাতে মনে হল ছেলেটার চরিত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম?
জি, রাকিব হাসান।
বাবার নাম?
জাহিদ হাসান।
আযীয মাস্টার বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তুমি এখন যাও। শিহাবের ফিরতে বোধ হয় দেরি হবে। ওকে একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।
রাকিব চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে সালাম দিতে যাবে, এমন সময় সাবেরা ঘরে ঢুকে আব্বাকে উদ্দেশ্য করে বলল, শিহাব ভাই কোথায়?
আযীয মাস্টার মেয়েকে চা-বিস্কুট নিয়ে আসতে দেখে তার কথার উত্তর দিয়ে রাকিবকে বললেন, বস, চা খেয়ে যাবে।
সাবেরা থালাটা টেবিলের উপর রেখে চলে গেল।
চা খেয়ে রাকিব সালাম বিনিময় করে সেখান থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসার পর শিহাবকে একটা গাছতলায় বসে থাকতে দেখে বলল, কি রে, এখানে বসে রয়েছিস যে? কার সঙ্গে দেখা করতে যাবি বললি, গিয়েছিলি?
শিহাব হেসে উঠে বলল, তোকে স্যারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ দেয়ার জন্য ঐ কথা বলে চলে এসেছি। চল এবার ঘরে যাই। তারপর যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, স্যারকে কথাটা বলেছিস?
হ্যাঁ বলেছি।
সত্যি বলেছিস!
এতে আবার সত্যি-মিথ্যের কি হল? কথাটা বলার জন্যই তো গিয়েছিলাম।
শুনে স্যার কি বললেন?
আযীয মাস্টার যা কিছু বলেছেন রাকিব সে সব বলল।
তোর সাহসের বলিহারী। স্যার যা কড়া, মরে গেলেও তাকে ঐ কথা বলতে পারতাম না। প্রাইমারিতে পড়ার সময় অনেকবার স্যারের হাতে মার খেয়েছি। তা স্যারের কথা শুনে তুই কি বললি?
রাকিব যা বলেছিল বলল।
তুই শুধু সাহসী নয়, বুদ্ধিমানও। আমি হলে তো ছুট দিতাম। তা শেষমেশ স্যার কি বললেন?
কি আর বলবেন? বললেন, তুমি এখন যাও, শিহাবকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলল।
আমার কিন্তু খুব ভয় করছে। আমাকে না একচোট নেন।
আরে তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এখনও কি প্রাইমারি স্কুলের ছাত্র নাকি যে, তোকে সত্যি সত্যি চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেবেন?
আমি ঐ ভয়ের কথা বলি নি; বাবাকে না কথাটা জানিয়ে দেন, সেই ভয়ের কথা বলছি।
জানালে জানাবেন। তুই তো আর ছোট না যে, তোর বাবা তোকে পেটাবে?
তা পেটাবে না, তবু অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। তা হ্যাঁ রে, স্যার যদি রাজি হন, তা হলে এখনই বিয়ে করবি, না পরে এসে করবি?
এখনই করব।
ঝোঁকের মাথায় তাড়াতাড়ি কোনো কাজ করা কারোরই উচিত নয়। সব কিছু চিন্তা-ভাবনা করে ধীরে-সুস্থে করতে হয়।
দেখ, বড়দের মতো উপদেশ দিবি না। আমি যা করার ইচ্ছা করি তা তাড়াতাড়ি করেই থাকি। আজ পর্যন্ত কোনো ব্যাপারেই ফেল যেমন করি নি, তেমনি ফলাফলও খারাপ কিছু হয়নি।
তবু বলব, আজ সারাদিন ও রাত চিন্তা করে কাল সকালে জানাবি।
আমার চিন্তা করার কিছু নেই। তুই কাল সকালে স্যারের কাছে যাবি।
পরের দিন সকালে শিহাব আযীয মাস্টারের বাড়িতে গিয়ে সালাম বিনিময় করার পর বলল, আমাকে আসতে বলছিলেন স্যার?
আযীয মাস্টার বললেন, হ্যাঁ, বস। বসার পর বললেন, তোমার বন্ধুর প্রস্তাবের কথা তোমাকে নিশ্চয়ই আগেই জানিয়েছিল?
জি, জানিয়েছিল?
তার হয়ে তোমারই প্রস্তাব দেয়া উচিত ছিল।
আমি সে কথা ওকে বলেছিলাম; কিন্তু ও বলল, নিজেই দেবে।
ওদের ফ্যামিলির সব কিছু তুমি জান?
জি জানি। ওদের সব কিছু ভালো।
হ্যাঁ, ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে তাই মনে হল। তবে কি জান বাবা, সাবেরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবার মানে আর চারদিন পর ওর বিয়ে। কাল বললে ছেলেটা বেশি মনে কষ্ট পেত, তাই বলি নি। তুমি ওকে কথাটা জানিয়ে দিও।
রাকিবের কথা শুনে শিহাব কাল থেকে খুব টেনশানে ছিল। স্যারের কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে স্যার, জানাব।
তুমি তো জান, আমরা অন্য জায়গা থেকে এসে হিন্দুদের মড়াচিরে বাস করছি বলে এই গ্রামের ও তোমাদের গ্রামের সমাজ আমাদেরকে মেনে নিলেও তারা আমাদের বিয়ে-শাদিতে দাওয়াত দেয় না। আমার বিয়ের সময় আব্বা দুই গ্রামের লোকজনকে দাওয়াত দিয়েছিলেন, কিন্তু গরিবরা দু’দশজন ছাড়া কেউ আসে নি। তবু এবারে সাবেরার বিয়েতে আমিও দাওয়াত দিয়েছি, জানি না সবাই আসবে কি না। কেউ আসুক আর না আসুক তোমার বন্ধুকে নিয়ে তুমি আসবে। অবশ্য তোমার বন্ধু যদি আরো কয়েকদিন থাকে। তুমি না এলে আজ তোমার কাছে যেতাম সাবেরার বিয়ের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। তুমি বাবা যদি কাল থেকে আমাকে একটু সাহায্য করতে, তা হলে বড় উপকার হত।
কি যে বলেন স্যার, নিশ্চয় আসব। বলেন তো আজ থেকেই আপনাকে সাহায্য করব। আর রাকিব যদি আরো কয়েকদিন থাকে, তা হলে তাকেও নিয়ে আসব।
শুনে বড় খুশি হলাম বাবা। আমার আর এমন কেউ নেই যে আমাকে সাহায্য করবে।
আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। প্রয়োজনে আজ থেকে আপনাকে সাহায্য করব।
আজ আর আসতে হবে না, কাল থেকে এসো।
তাই আসব বলে শিহাব দাঁড়িয়ে উঠে বলল, এবার আসি স্যার।
এমন সময় সাবেরা চা নিয়ে এসে শিহাবের সঙ্গে সালাম বিনিময় করে বলল, বসুন, চা খেয়ে তারপর যাবেন। কাল এসেই চলে গিয়েছিলেন।
শিহাব চা খেয়ে ঘরে ফিরে আসতে রাকিব জিজ্ঞেস করল, স্যার তোকে কি বললেন?
তোর না শোনাই ভালো। শুনলে মন খারাপ হয়ে যাবে।
ইয়ার্কি না করে বলে ফেল তো।
বললাম না, শুনলে তোর মন খারাপ হয়ে যাবে।
হোক মন খারাপ, তুই বল।
সাবেরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের শুক্রবারে বিয়ে।
রাকিব একদৃষ্টে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, ইয়ার্কি করছিস না তো? সত্যি করে বল না? স্যার কি বললেন?
বিশ্বাস কর, সত্যি কথাই বললাম।
বিশ্বাস হচ্ছে না।
কেন?
সত্যি হলে কালকেই স্যার আমাকে বলতেন।
উনি বলতে চেয়েছিলেন, তখনই বললে তুই মনে কষ্ট পাবি, তাই বলেন নি। আরো বললেন, তুই যদি কয়েকদিন থাকিস তা হলে কাল থেকে যেন আমার সঙ্গে সাবেরার বিয়ের ব্যাপারে সাহায্য করিস। স্যারের তো কেউ নেই। তাই আমাদেরকে কাল থেকে সব কিছু করার জন্য বললেন।
রাকিব অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।
কি রে, চুপ করে আছিস কেন? কাল থেকে আমার সঙ্গে স্যারকে সাহায্য করবি না? না সাবেরাকে বিয়ে করতে পারলি না বলে বিয়ের আগেই ঢাকা চলে যাবি? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন রাকিব কিছু বলল না তখন আবার বলল, তোর মনের ব্যথা আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কি করব বল, ভাগ্যের ওপর তো কারুর হাত নেই। এ কথা নিশ্চয় জানিস মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি?
রাকিব একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ, তোর কথাই ঠিক, মানুষ ভাগ্যের হাতে বন্দি। শুধু সাবেরার বিয়ের দিন পর্যন্ত নয়, যতদিন থাকার কথা বলে এসেছি, ততদিনই থাকব।
.
০২.
আজ শুক্রবার সাবেরার বিয়ের দিন। এই ক’দিন আযীয মাস্টারের কথামতো শিহাব রাকিবকে সঙ্গে নিয়ে সব কিছু ব্যবস্থা করেছে। বর ও বরযাত্রীদের বেলা দশটার সময় আসার কথা। আসার পর নাস্তা খাইয়ে বিয়ে পড়ানো হবে। তারপর জুমার নামায পড়ে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে মেয়ে বিদায় করা হবে। কিন্তু দশটার সময় তো এলই না, এমনকি জুমার নামাযের পরেও যখন বর ও বরযাত্রীরা এসে পৌঁছল না তখন আযীয মাস্টার খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এবারে দু’পাশের গ্রামের অনেক লোকজন ও মাতব্বররাও এসেছেন। আযীয মাস্টার মাতব্বরদের জিজ্ঞেস করলেন, এখন কি করা যায় বলুন তো?
তারা বললেন, হয়তো পথে কোনো বিপদ হয়েছে, তাই দেরি হচ্ছে। আপনি একজনকে পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতে বলুন।
এমন সময় একজন লোককে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল। সবাই তার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা এসে জানাল, নদী পার হওয়ার সময় বোটের ধাক্কা লেগে আমাদের নৌকা মাঝনদীতে ডুবে গেছে। অনেকে সাঁতরে পাড়ে উঠলেও বর ও বরযাত্রীদের বেশ কয়েকজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই খোঁজাখুঁজি করছে। বরের বাবা আমাকে পাঠালেন খবরটা দেয়ার জন্য। আরো বললেন, এই মেয়ে অপয়া, আমার ছেলে বেঁচে গেলেও এখানে আর বিয়ে করাবেন না।
কথাটা শুনে সবাই যতটা না অবাক হল, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখ পেল। আযীয মাস্টার খুব মুষড়ে পড়লেন। খবরটা শুনে বাড়ির মেয়েরাও খুব দুঃখ পেল। আর সাবেরা শোনার পর অজ্ঞান হয়ে গেল। মেয়েরা তার মাথায় পানি ঢেলে ও চোখে-মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরালেও কিছুক্ষণ পরপর অজ্ঞান হয়ে যেতে লাগল। কথাটা বাইরের লোকজন জানতে পেরে দুঃখ প্রকাশ ছাড়া তাদের আর কিছু করার রইল না।
দুই গ্রামের মাতব্বররা পরামর্শ করে আযীয মাস্টারকে বললেন, এখন আর কি করবেন? গ্রামের লোকজনদের খাওয়াবার ব্যবস্থা করুন। নচেৎ তারা চলে গেলে এত লোকের খাবার নষ্ট হবে।
আযীয মাস্টার চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার একমাত্র মেয়ে সাবেরার কি হবে আপনারা বলে দিন।
আমরা কি বলতে পারি বলুন। আপনার মেয়ের ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। পরে আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করব। এখন যা বললাম সেটা করলে ভালো হত না?
সেখানে শিহাব ও রাকিব ছিল। মাতব্বরদের কথা শুনে রাকিব বলল, আমি মাস্টার সাহেবের মেয়েকে এই মজলিসেই বিয়ে করব।
শিহাব ও তার বাবা আকরাম চৌধুরী এবং আযীয মাস্টার ছাড়া আর কেউ রাকিবকে চেনে না। তাই তারা অবাক হয়ে তার দিকে তাকালেন।
আকরাম চৌধুরী ছেলের বন্ধু হিসাবে রাকিবের সব কিছু জানেন। বললেন, এ রকম হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া কি তোমার ঠিক হল?
রাকিব বলল, হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিই নি। আমি চিন্তা-ভাবনা করেই নিয়েছি।
আকরাম চৌধুরী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মত?
শিহাব বলল, রাকিব এখানে আসার দু’দিন পর সাবেরাকে দেখে স্যারকে নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিল। তার আগেই সাবেরার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে আমার সঙ্গে বিয়ের এ্যারেঞ্জমেন্ট করেছে। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে জেনে আবার প্রস্তাব দিচ্ছে। স্যার রাকিবের কাছ থেকে তার সম্পর্কে সব কিছু জেনেছেন। এখন তিনি যদি ওকে পছন্দ করেন, তা হলে বিয়েটা হয়ে যাওয়াই আমি ভালো মনে করি।
আকরাম চৌধুরী আযীয মাস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মতামত বলুন।
আযীয মাস্টার বললেন, আমার মাথার এখন ঠিক নেই, আপনারা যদি ভালো মনে করেন, আমার কিছু বলার নেই।
আমরা ভালো মনে করলে তো হবে না, আপনার মতামত কি তাই বলুন।
আযীয মাস্টার বললেন, সাবালিকা মেয়ের বিয়ের মতামত মেয়ে নিজেই দেবে, এটাই শরীয়তের হুকুম। যে বিয়েটা ভেঙ্গে গেল, সেটাতেও আমি ছেলের সব কিছু বলে সাবেরার মতামত নিয়েছিলাম। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি তার মতামত জেনে আসি। এই কথা বলে তিনি ভেতরে গিয়ে দেখলেন, সাবেরা তার মাকে জড়িয়ে ধরে ফেঁপাচ্ছে। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কান্না থামিয়ে মন দিয়ে আমার কথা শোন, বিয়ে-শাদি আল্লাহ যার সঙ্গে জোড়া করেছেন তার সঙ্গে হবেই। তাই হয়তো এই বিয়ে ভেঙ্গে গেল। তুমি তো শিহাবকে চেনো। তারপর রাকিবের পরিচয় দিয়ে বললেন, সে কয়েকদিন আগে তোমাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে জেনে শিহাবের সঙ্গে আজ দু’তিন দিন আমার কথামতো সব কিছু করেছে। বিয়ে ভেঙ্গে গেছে শুনে এখন আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। দুই গ্রামের মাতব্বর ও লোকজন প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন। তুমি যদি রাজি হও, তা হলে এক্ষুনি বিয়ে পড়ানো হবে।
সাবেরা কান্না থামিয়ে আব্বার কথা শুনছিল। থেমে যেতে ভিজে গলায় বলল, আপনি ভালো মনে করে যেখানে যার সঙ্গে বিয়ে দেবেন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই।
আলহামদুল্লিাহ বলে আযীয মাস্টার মজলিসে এসে বললেন, সাবেরা রাজি আছে। আপনারা বিয়ে পড়াবার ব্যবস্থা করুন।
বিয়ে হয়ে যাওয়ার দিন থেকে আরো পনের দিন রাকিব শ্বশুরবাড়িতে, মানে আযীয মাস্টারের বাড়িতে থাকল। তারপর শিহাবের সঙ্গে ঢাকায় ফিরে এল। বিয়ের পর সাবেরার সম্পর্কে যে প্ল্যান-প্রোগ্রামের কথা শিহাবকে বলেছিল, ঢাকায় ফেরার সময় সেসব সাবেরাকে বলে বলেছিল, তুমি শিহাবের ঢাকার ঠিকানায় চিঠি দিও। আমি শিহাবকে বলে রাখব, সে তোমার চিঠি আমাকে দেবে। আমিও তোমাকে চিঠি দেব। সামনে আমার ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষার পর তোমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে হোস্টেলে রেখে কলেজে ভর্তি করে দেব। পরীক্ষার আগে আসতে পারব কি না সঠিক বলতে পারব না। তবে তোমাকে না দেখে বেশি দিন থাকতেও পারব না। আসার জন্য খুব চেষ্টা করব।
সাবেরা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তোমার কথার ওপর আমি কখনো কিছু বলব না। শুধু আমার এতটুকু অনুরোধ, আমাকে যদি তোমার মা-বাবা কোনো দিন মেনে না নেন অথবা ওঁনারা আমাকে ত্যাগ করার কথা বলে ওঁনাদের পছন্দমতো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চান, তা হলে বিয়ে করে ওঁনাদের সুখী করো; কিন্তু আমাকে ত্যাগ করো না। ছ’মাসে হোক, বছরে হোক বা দু’বছর পরে হোক অন্তত একদিনের জন্যে হলেও আমাকে দেখা দিতে এসো।
রাকিব তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলেছিল, আমি তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছি, জীবন গেলেও তোমাকে ত্যাগ করতে পারব না। প্রয়োজনে মা-বাবাকে ত্যাগ করে তোমার কাছে চলে আসব। তারপর আদর করে বিদায় নিয়ে চলে আসে।
ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত মা-বাবাকে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তিন চারবার সাবেরার কাছে এসে দু’একদিন করে থেকে গেছে। পরীক্ষার পর বেশ কয়েকদিন থাকার জন্য বন্ধুর দেশের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা মা-বাবাকে জানাবে যখন ভাবছিল তখন একদিন কানাডা থেকে ফোন এল তার খালা মৃত্যুশয্যায়। বাবার অফিসের জরুরি কাজ থাকায় মাকে নিয়ে কানাডা যেতে হল রাকিবকে। যাওয়ার আগে সাবেরার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল যে, সময় করে উঠতে পারে নি। তাই একটা চিঠিতে সব কিছু লিখে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা জানিয়ে পোস্ট করে গেল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তার খালা মৃত্যুশয্যা থেকে বেঁচে গেলেও ঢাকা ফেরার আগের দিন রোড এ্যাকসিডেন্টে রাকিব মারা গেল।
পরীক্ষার তিন মাস আগে রাকিব যখন সাবেরার কাছে এসেছিল তখন থেকে সাবেরার প্র্যাগনেন্সি শুরু। তিন মাস পর সিওর হয়ে সাবেরা সে কথা চিঠি দিয়ে রাকিবকে জানিয়েছিল। রাকিব চিঠি পড়ে খুব আনন্দিত হলেও তখন পরীক্ষার পড়ার চাপে চিঠির উত্তর দিতে পারে নি। ভেবেছিল পরীক্ষার পর যাবে, তাই উত্তর না দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মাকে নিয়ে কানাডা যেতে হল। তাই যাওয়ার আগে যে চিঠি দিয়েছিল, তাতে বাবা হতে যাচ্ছে জেনে আনন্দিত হওয়ার কথা জানিয়েছিল।
সেই চিঠি পড়ে স্বামী আনন্দিত হয়েছে জেনে সাবেরা যতটা না খুশি হল, তার সঙ্গে দেখা না করে কানাডা চলে গেছে জেনে অনেক বেশি দুঃখ পেল। তারপর এক মাস দু’মাস করে যখন ছ’মাস পার হয়ে গেল অথচ রাকিব এল না, এমনকি একটা চিঠিও দিল না তখন সাবেরা অস্থির হয়ে উঠল। শহরের বড়লোকের ছেলেদের স্বভাব চরিত্রের কথা যতটুকু শুনেছিল, সেসব চিন্তা করে খুব আতঙ্কিত হল। ভাবল, রাকিবকে যতটুকু জেনেছে, সে তো অন্য পাঁচটা ছেলের মতো নয়। তবু কেন এতদিন তার খোঁজ-খবর নেই? তা হলে কি কানাডাতে তার কোনো বিপদ হল? না অন্য ছেলেদের মতো সেখানকার কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সুখের সংসার করছে? এইসব চিন্তা করতে করতে সাবেরার শরীর বেশ ভেঙ্গে পড়ল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পর স্বামীর মঙ্গল কামনা করে ও তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগল।
জামাই এতদিন হয়ে গেল আসছে না দেখে আযীয মাস্টারও খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। দিন দিন মেয়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি দেখে একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এতদিন হয়ে গেল জামাই আসছে না কেন বলতে পারিস?
সাবেরা ম্লান মুখে বলল, তা আমি কি করে বলব?
তোকে চিঠিপত্র দেয় নি?
না।
জামাইয়ের পরীক্ষা প্রায় ছ’মাস আগে শেষ হয়েছে, তবু আসছে না কেন? তোর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় নি তো?
না আব্বা, ওসব কিছু হয় নি। পরীক্ষার পর আসবার কথা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছিল। তারপর কানাডা যাওয়ার কথা বলল।
আযীয মাস্টার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এতদিন তো আর সেখানে নেই? নিশ্চয় ফিরে এসেছে। তবু কেন আসছে না বুঝতে পারছি না।
সাবেরা বলল, তুমি একবার শিহাব ভাইয়ের কাছে যাও। মনে হয় সে এখন ঘরেই থাকে। তাকে জিজ্ঞেস করলে তোমার জামাইয়ের খবর পাওয়া যাবে।
আযীয মাস্টার মেয়ের কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলেন। বললেন, তুই খুব ভালো কথা বলেছিস। আগেই কথাটা আমার মাথায় আসা উচিত ছিল। এক্ষুনি শিহাবের কাছে যাচ্ছি।
শিহাব ঘরেই ছিল। আযীয মাস্টারকে আসতে দেখেই বুঝতে পারল কেন এসেছেন। রাকিবের মৃত্যুর খবর অনেক আগে জেনেছে। জানার পর তার জন্য যতটা না দুঃখ পেয়েছে, সাবেরা ও তার বাবা জানলে আরো অনেক বেশি দুঃখ পাবে এমনকি সাবেরা হয়তো পাগল হয়ে যেতে পারে ভেবে খবরটা তাদেরকে জানায় নি। কাছে এলে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন স্যার?
আযীয মাস্টার সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আল্লাহ একরকম রেখেছেন বাবা। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, রাকিবের খবর জান?
রাকিবের মৃত্যুর কথা কিভাবে বলবে শিহাব চিন্তা করতে লাগল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আযীয মাস্টার আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কিছুদিনের মধ্যে ঢাকা গিয়েছিলে? ছ’মাসের বেশি হয়ে গেল রাকিব আসে নি। কোনো চিঠিপত্রও দেয় নি। সে নাকি কানাডা গিয়েছিল, সেখানেই আছে না দেশে ফিরেছে সে কথা কি জান?
শিহাব চিন্তা করল, একদিন না একদিন তো স্যার কথাটা জানবেনই। মানুষের মৃত্যুর খবর কতদিন আর চাপা থাকে। তা ছাড়া স্যারকে তো মিথ্যে কিছু বলা যাবে না। শিহাব কিছু বলছে না দেখে আযীয মাস্টার অধৈর্য গলায় বললেন, হ্যাঁ না কিছু একটা তো বলবে?
স্যার, কথাটা বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। রাকিব কানাডায় দিন পনের ছিল। যেদিন ফিরবে তার আগের দিন রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। খবরটা আমি অনেক আগেই জেনেছি। আপনারা খুব দুঃখ পাবেন ভেবে এতদিন বলি নি।
রাকিব ছ’মাস আগে মারা গেছে শুনে আযীয মাস্টারের মনে হল কেউ যেন তাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে চোখের পানি ফেললেন। তারপর একসময় চোখ-মুখে কান্না জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান, সাবেরার পেটে রাকিবের সন্তান এসেছে?
জি, জানি। রাকিব কানাডা থেকে একটি চিঠিতে ফিরে আসার ও সাবেরার পেটে বাচ্চা আসার কথা লিখে জানিয়েছিল।
খবরটা শুনে সাবেরার কি অবস্থা হবে আল্লাহ মালুম। তারপর ফিরে আসার সময় আযীয মাস্টার ভাবতে লাগলেন, সাবেরার শরীরের যে অবস্থা, রাকিবের মৃত্যুর খবর শুনে না হার্টফেল করে। তবু তাকে জানানো উচিত ভেবে ঘরে এসে স্ত্রী ও মেয়েকে রাকিব মারা যাওয়ার খবরটা জানালেন।
শুনে মাসুদা বিবি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আল্লাহগো, আমার মেয়ের তকদিরে এই লিখেছিলে? ও কি করে বাকি জীবন কাটাবে?
আর সাবেরা খবরটা শুনে পাথরের মতো জমে গেল। কোনো কান্নাকাটি বা হা-হুঁতাশ করল না। তারপর যথাসময়ে সে মেয়ের জন্ম দিল, সেই মেয়ে রিজিয়া। রিজিয়ার বয়স যখন এক বছর তখন সাবেরা রোগে ভুগে মারা গেল। দাদি মাসুদা বিবি নাতনিকে মায়ের স্নেহ দিয়ে মানুষ করতে লাগলেন। বছর দুয়েক পর একদিন স্বামীকে বললেন, রিজিয়াকে ওর দাদা-দাদির কাছে দিয়ে এস। তারা ওকে লেখাপড়া করিয়ে বড় ঘরে বিয়ে দেবে।
আযীয মাস্টার বললেন, তুমি তো জান, রাকিব মা-বাবাকে না জানিয়ে সাবেরাকে বিয়ে করেছিল, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয়ও নেই। তারা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বরং ঠকবাজ লোক ভেবে অপমান করে তাড়িয়ে দেবে।
কিন্তু রিজিয়া বড় হয়ে যখন তার বাবার কথা জানতে চাইবে তখন কী বলবে?
তখন তাকে সত্য ঘটনা বলব।
আর সে যখন বলবে ছোটবেলায় আমাকে দাদা-দাদির কাছে দিয়ে এলে কেন, তখন কী বলবে?
আযীয মাস্টার স্ত্রীর কথার উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইলেন।
মাসুদা বিবি বললেন, আমার কথা শোন, শিহাব তো সব কিছু জানে। তার কথা রিজিয়ার দাদা-দাদি অবিশ্বাস করতে পারবে না। যাওয়ার সময় তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। যা বলার শিহাবকেই বলতে বলবে।
আযীয মাস্টার বললেন, ঠিক আছে, শিহাবকে বলে দেখি সে কি বলে?
একদিন শিহাবের সঙ্গে দেখা করে আযীয মাস্টার স্ত্রীর কথাগুলো বলে জিজ্ঞেস করলেন, এ ব্যাপারে তুমি কি বল?
শিহাব বলল, চাচি আম্মা অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। আমার মনে হয় তাই করা উচিত। কিন্তু রাকিবের মা-বাবা আমার কথা বিশ্বাস করলেও তা প্রকাশ করবেন না আর রিজিয়াকেও গ্রহণ করবেন না। বরং আমাকে ও আপনাকে যা তা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দেবেন।
আযীয মাস্টার বললেন, আমারও তাই ধারণা। কিন্তু তোমার চাচি আম্মা তোমাকে সঙ্গে নিয়ে রিজিয়াকে দিয়ে আসতে বারবার তাগিদ দিচ্ছে। এখন তুমি যা বলবে তাই হবে।
শিহাব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, যদিও মনে হচ্ছে গিয়ে কোন কাজ হবে, তবু চাচি আম্মার ইচ্ছা পূরণ করার জন্য যাব। কবে যেতে চান?
শুক্রবার স্কুল বন্ধ। ঐ দিন গেলে ভালো হয়।
বেশ, তাই যাওয়া যাবে। আপনি সকালে রিজিয়াকে নিয়ে তৈরি থাকবেন, আমি এসে নিয়ে যাব।
শুক্রবার দিন শিহাব ওদেরকে নিয়ে ঢাকায় এসে প্রথমে একটা হোটেলে উঠল। তারপর বিকেলে রাকিবদের বাসায় গেল।
রাকিবের বাবা জাহিদ হাসান স্ত্রী, বড় ছেলে ও ছেলের বৌ এবং আট বছরের বড় নাতি হিমুকে নিয়ে বারান্দায় বসে চা-নাস্তা করছিলেন। এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, ছোট ভাইয়ের বন্ধু শিহাব ভাই এসেছেন। তার সঙ্গে একজন বুড়ো লোক ও দু’বছরের একটা মেয়েও আছে।
শিহাব ভার্সিটিতে পড়ার সময় রাকিবদের বাসায় অনেক বার এসেছে। তাই দারোয়ান থেকে বাসার সবাই তাকে চেনে। রাকিব কানাডা যাওয়ার মাস খানেক পরে শিহাব একদিন বাসায় এসেছিল। সে সময় রাকিবের মৃত্যু সংবাদ শুনেছিল। তারপর আর আসে নি।
প্রায় আড়াই বছর পর শিহাব এসেছে জেনে তারা একটু অবাক হলেও খুশি হলেন। কেউ কিছু বলার আগে জাহিদ হাসান বললেন, ওদেরকে ড্রইংরুমে বসাও, আমরা আসছি।
একটু পরে সবাই ড্রইংরুমে এলেন।
শিহাব দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল।
জাহিদ হাসান তাদেরকে বসতে বললেন। বসার পর আযীয মাস্টারকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, উনি কে?
শিহাব বলল, আমাদের গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। মেয়েটা ওনার নাতনি, আর রাকিবের মেয়ে।
তার কথা শুনে ঘরের সবাই খুব অবাক হয়ে একবার রিজিয়ার দিকে আর একবার আযীয মাস্টারের দিকে তাকাতে লাগলেন। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
জাহিদ হাসান অবাক হলেও শিহাবের ওপর খুব রেগে গেলেন। রাগটা সামলে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, তুমি রাকিবের বন্ধু না হলে এতক্ষণে তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতাম। যা বলার বলেছ, আর একটা কথা নয়। এক্ষুনি ওদেরকে নিয়ে চলে যাও।
শিহাব বলল, আপনারা বিশ্বাস না করলেও কথাটা সত্য। আর সত্য প্রকাশ করতে কোনো মানুষেরই ভয় পাওয়া উচিত নয়। মেয়েটা যে রাকিবের এবং তিন বছর আগে আমার সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে রাকিব যে এই আযীয স্যারের মেয়েকে বিয়ে করেছিল, সে কথা আমাদের গ্রামের ও পাশের গ্রামের শত শত লোক জানে। তারপর রাকিব কিভাবে বিয়ে করল, সে সব বলে বলল, আপনারা আমাদের গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিলেই সত্য-মিথ্যা প্রমাণ পেয়ে যাবেন।
রাকিবের বড় ভাই রাগিব হাসান রাগের সঙ্গে বলল, আমাদের প্রমাণ নেয়ার দরকার নেই। তুমি ওদেরকে নিয়ে চলে যাও।
শিহাব বলল, জানতাম আপনারা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। তবু এসেছি, রাকিবের বন্ধু হিসেবে তার মেয়ের ভালোমন্দ চিন্তা করে। আপনারা যখন নিজের বংশধরকে মেনে নিতে পারলেন না তখন আমার আর কিছু করার নেই। তারপর সালাম দিয়ে আযীয মাস্টারকে আসতে বলে বেরিয়ে এল।
আযীয় মাস্টার চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতে জাহিদ হাসান বললেন, দাঁড়ান। তারপর ভেতরে গিয়ে ফিরে এসে একটা খাম আযীয মাস্টারের হাতে দেয়ার সময় বললেন, এতে হাজার দশেক টাকা আছে। এখন এটা রাখুন, পরে মাঝে মাঝে আসবেন তখন আবার দেব।
আযীয মাস্টার টাকার খামটা না নিয়ে বললেন, একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে একজন শিক্ষককে অপমান করতে পারলেন? আমি টাকার জন্য আসি নি? এসেছিলাম আপনার বংশের সন্তানকে দিতে। তারপর নাতনিকে বুকে তুলে নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে গেলেন।
শিহাব বেরিয়ে এসে একটা স্কুটার ভাড়া করে অপেক্ষা করছিল। আযীয মাস্টার আসার পর স্কুটারে উঠতে বলে নিজেও উঠে বসল। স্কুটার চলতে শুরু করলে জিজ্ঞেস করল, বেরোতে দেরি হল কেন?
আযীয মাস্টার টাকা দেয়ার ঘটনাটা বলে বললেন, তোমার কথাই ঠিক হল, আমার জন্য ওনাদের কাছে তোমাকেও অপমানিত হতে হল।
শিহাব বলল, ও কিছু না স্যার। আমার কর্তব্য আমি করেছি, এটাই যথেষ্ট। তাতে কে কি বলল তা নিয়ে আমার কোনো যায় আসে না। তারপর বলল, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব করেও মনে থাকে না, আচ্ছা, এবারে যখন সেটেলমেন্টের মাপ হল তখন আপনাকে একদিন বলেছিলাম, ঐ জায়গাটা আপনার নামে করে নিতে, নিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, করে নিয়েছি।
খুব ভালো করেছেন। ভবিষ্যতে কেউ আর ঐ জায়গাটা দখল করার চেষ্টা করতে পারবে না।
পরের দিন ঘরে ফিরে আযীয মাস্টার স্ত্রীকে রিজিয়ার বড় চাচা ও দাদাজী যা কিছু বলেছেন ও করেছেন জানালেন।
মাসুদা বিবি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের কর্তব্য আমরা করেছি। এখন আল্লাহ রিজিয়ার তকদিরে যা লিখেছেন তাই হবে।
রিজিয়া যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন হঠাৎ একদিন মাসুদা বিবি মারা গেলেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আযীয মাস্টার কেমন যেন হয়ে গেলেন। মাস্টারিতে ইস্তফা দিয়ে দিনরাত ঘরে থাকেন। সব সময় বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলেন। জমি-জায়গা বিক্রি করে সংসার চালালেন আর রিজিয়াকে এস.এস.সি. পর্যন্ত পড়ালেন। তারপর তার বিয়ে দেয়ার অনেক চেষ্টা করলেন।
রিজিয়া রাজি না হয়ে বলল, আমার বিয়ে হয়ে গেলে আপনার কি হবে? কে আপনাকে দেখাশোনা করবে?
তার কথা শুনে আযীয মাস্টার বললেন, আমি মরে গেলে তোর কি হবে? তোকে কে দেখাশোনা করবে? তোর ভরণ-পোষণ চলবে কি করে?
রিজিয়া বলল, যে ছেলে ঘরজামাই হয়ে থাকবে তাকে বিয়ে করব।
রিজিয়া দেখতে খুব সুন্দরী। স্বাস্থ্যও খুব ভালো। পাত্রপক্ষরা দেখতে এসেই পছন্দ করে ফেলে, কিন্তু যখনই শুনে ছেলেকে ঘরজামাই হয়ে থাকতে হবে তখনই তারা রাজি না হয়ে চলে যায়।
অনেকগুলো সম্বন্ধ ফিরে যাওয়ার পর আযীয মাস্টার ভেবে রাখলেন, শিহাব গ্রামে এসে দেখা করতে এলে নাতনির বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করবেন।
<