০৩.

মাহবুব মাহবুবাদের বাসা থেকে মেসে ফিরে এলে মাসুম জিজ্ঞেস করল, কিরে এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোর জন্য অপেক্ষা করে করে এই একটু আগে খেলাম।

মাহবুব বলল, পরে শুনিস, এখন খিদেয় পেট চো চো করছে।

নামায পড়েছিস? না তাও পড়িস নি।

কাপড় পাল্টাতে পাল্টাতে মাহবুব বলল, নামায জামাতেই পড়েছি। আর কোনো কথা বলবি না, ভীষণ রেগে আছি। তারপর কলতলা থেকে হাত মুখ ধূয়ে এসে খেতে বসল।

মাসুম চৌকিতে পা ঝুলিয়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখল, গোগ্রাসে গিলছে। বলল, একটু আস্তে খা, গলায় আটকে যাবে তো।

মাহবুব কোনো রা না করে খাওয়া শেষ করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। তারপর বিছানায় বসে বলল, জানিস, ক্লাস শেষে বেরিয়েই আজ সেই মেয়েটির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা।

কার সঙ্গে দেখা?

আরে ঐ যে সাঁতার প্রতিযোগিতার দিন যে মেয়েটা আমাদেরকে লিফট দিতে চেয়েছিল।

মাসুম তড়াক করে উঠে বসে বলল, তাই নাকি? তা তারপর কি হল বলবি তো?

কি আর হবে? আজও লিফট দিতে চাইল। আমি রাজি হলাম না। শেষে অনেক জেদা- জেদির পর গাড়িতে উঠলাম।

তা হলে তো অনেক আগেই ফেরার কথা।

আমাকে শেষ করতে দে, তারপর প্রশ্ন করিস। গাড়িতে উঠার পর মেয়েটা ড্রাইভারকে তাদের বাসায় যেতে বলল। শুনে আমি খুব রেগে গেলাম। ড্রাইভারকে বললাম, গাড়ি থামান, আমি নেমে যাব। মেয়েটা ড্রাইভারকে নিষেধ করে আমাকে বলল, ভয় পাচ্ছেন কেন? কীডন্যাপ করলেও মুক্তিপণ চাইব না। তারপর যা কিছু ঘটেছে সব খুলে বলে বলল, আমার কি মনে হয় জানিস মেয়েটার মাথায় একটু গোলমাল আছে।

মাসুম হেসে উঠে বলল, আমার কিন্তু ঠিক উল্টো মনে হচ্ছে।

মাহবুব অবাক কণ্ঠে বলল, মানে?

মানে পরে বলছি, তার আগে আমার কথার উত্তর দে। মেয়েটির বাবা নিশ্চয় ভীষণ বড় লোক?

সবকিছু দেখে তো তাই মনে হল।

 নিশ্চয় মেয়েটি মা-বাবার এক মাত্র সন্তান?

ঠিক বলতে পারছি না তবে মনে হয় তোর কথা ঠিক।

এবার মানেটা বলছি শোন, এমনি বড় লোকের ছেলেমেয়েরা খুব এক রোখা হয়। তার উপর ঐ মেয়েটি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাই একটু বেশি একরোখা ও জেদি। এই রকম ছেলেমেয়েরা যা পেতে চাই, তা যেমন করে হোক পাওয়ার চেষ্টা করে।

কি জানি, তোর কথা হয়তো ঠিক। তুইওতো বড়লোকের ছেলে, কই তোর তো একরোখা স্বভাব না?

আর তুই বুঝি গরিবের ছেলে? আসলে কি জানিস, আমরা হলাম গ্রামের বড় লোকের ছেলে। তা ছাড়া আমাদের ভাই-বোন আছে। আমি কিন্তু শহরের বড় লোকের ছেলে মেয়েদের কথা বলছি।

তুই যাই বলিস, আমি কিন্তু জানি জোর করে অথবা টাকার জোরে সব কিছু পাওয়া গেলেও মন পাওয়া যায় না।

আর এটা জানিস না, মনকে প্রেম-ভালবাসা দিয়ে জয় করা যায়?

জানি, তবে মনের মতো মন হতে হবে।

 তাতো নিশ্চয়, তুই কি মেয়েটার মনের খবর জানতে পারিস নি?

একদম যে পারিনি তা নয়। কিন্তু যা শুধু অসম্ভব নয় অবাস্তবও। তাকে নিয়ে চিন্তা করাও পাপ।

তবে তুই কি করে বললি, মেয়েটার মাথায় গোলমাল আছে?

কারণ মেয়েটি অসম্ভব ও অবাস্তব জিনিসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

আমার মনে হয় মেয়েটা তোকে ভীষণ পছন্দ করে এবং ভীষণ ভালবেসে ফেলেছে। আর ভালবাসা অসম্ভব ও অবাস্তবকে সম্ভব ও বাস্তবে পরিণত করে।

তোর যত উদ্ভট কথা। বাদ দে এসব প্রসঙ্গ।

 আমি বাদ দিলে কি হবে, মেয়েটি তোকে কিন্তু ছাড়বে না, কথাটা মনে রাখিস।

মনে রাখতে আমার বয়েই গেছে। তোর যদি এতই গরজ, তুই তার পেছনে লাইন লাগাতে পারিস। তুই আমার চেয়ে বড় লোকের ছেলে। তোদের মধ্যে আত্মীয়তা মিলবে ভালো।

দেখ, বারবার বড় লোক বড় লোক বলবি না বলছি। তুইও কম কিসে?

মাহবুব হেসে উঠে বলল, বনে শিয়াল রাজার গল্প পড়েছিস।

ক্লাস টুয়ের বই এ পড়েছি। তুই যাই বলিস না কেন? তোদের সব কিছু আমার জানতে বাকি নেই।

জেনেছিস ভালো করেছিস। এখন বকবকানি থামাবি, না রুম থেকে বেরিয়ে যাব।

ঠিক আছে, আর একটা কথা বলে চুপ করব। আমার দৃঢ় ধারণা কয়েক দিনের মধ্যে তোর সঙ্গে দেখা না হলে, মেয়েটি এখানে এসে পড়বে। মাহবুবকে রেগে যেতে দেখে দুহাত জোড়ো করে বলল, রাগ করিস আর যাই করিস, কয়েক দিনের মধ্যে আমার কথার প্রমাণ পেয়ে যাবি।

এমন সময় আসরের আযান শুনে মাহবুব বলল, এখন প্রমাণ রেখে নামায পড়ে আসি চল।

মাসুম বলল, তাতো যাবই। তার আগে বল, মেয়েটাকে তোর পছন্দ হয় কিনা?

তোর কি মনে হয়?

আমার তো মনে হচ্ছে হয়েছে। তা না হলে সেদিন হ্যাংলার মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতিস না।

.

মাহবুবা নাম মাত্র দুএক লোকমা খেয়ে নিজের রুমে এসে চিন্তা করল, ছিঃ ছিঃ কাজটা ভালো করিনি। এরপর মাহবুবের কাছে মুখ দেখাব কি করে? ভেবে রাখল, কাল দেখা করে মাফ চেয়ে নেবে।

পরের দিন খোঁজ করেও মাহবুবের দেখা পেল না। তারপর আরো চার পাঁচ দিন দেখা না পেয়ে একদিন তার মেসে রওয়ানা দিল।

বঙ্গোপসাগরে লঘু চাপের ফলে আবহাওয়া দুদিন পর্যন্ত গুমোট ছিল। আজ ভোরে এক পশলা বৃষ্টি হলেও গুমোট কাটেনি। আকাশে মেঘ রয়েছে। যে কোন সময়ে আবার বৃষ্টি হতে পারে। সারা আকাশ মেঘে ঢাকা। চার পাঁচ দিন থেকে মাহবুবের খুব জ্বর। মাসুম ডাক্তার এনে দেখিয়ে চিকিৎসা করছে। গত রাত থেকে মাহবুবের জ্ঞান নেই। মাসুম আজ সকালেও ডাক্তার এনেছিল। উনি পরীক্ষা করে বলেছেন, মনে হয়। টাইফয়েডের দিকে টার্ন নিয়েছে। মাথায় বরফ দিতে হবে। ভালো শুশ্রূষা দরকার। আপনি তা পারবেন না। মেডিকেলে অথবা কোনো ক্লিনিকে ভর্তি করে দিন।

মাসুম ডাক্তারকে বিদায় করে মেডিকেলে এম্বুলেন্সের জন্য যেন করেছিল। তারা জানিয়েছে ঘন্টা দুই দেরি হবে। তাই মাহবুবের মাথায় পানি ঢালতে ঢালতে অপেক্ষা করতে লাগল।

ওদের মেসটা গলির মধ্যে। সেখানে গাড়ি যেতে পারে না। তবে বড় রাস্তা থেকে অল্প ভিতরে। ড্রাইভার গলির পাশে গাড়ি পার্ক করে মাহবুবাকে বলল, ঠিকানাটা আমাকে দিন খুঁজে দেখি।

মাহবুবা বলল, আপনি গাড়িতেই থাকুন আমি দেখছি। তারপর গাড়ি থেকে নেমে গলির মুখের পাশে একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে একজন সেলসম্যানকে ঠিকানা লেখা কাগজটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কোথায় বলতে পারেন?

সেলসম্যান মাসুম ও মাহবুবকে চেনে। বললেন, গলির ভিতরে আমাদের বিল্ডিং এর তিনটে বিল্ডিং পরে একতলা বিল্ডিংটা। মাহবুব সাহেবের কয়েকদিন যাবৎ খুব জ্বর। গতরাত থেকে জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণ আগে ওঁর রুমমেট মাসুম সাহেব মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের এখান থেকে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করে গেলেন।

শুনে মাহবুবা চমকে উঠলেও সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিল। তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে গলির ভিতর ঢুকে পড়ল। গেটের কাছে এসে নাম্বার মিলিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল শেষ মাথার রুম ছাড়া সব রুমে তালা ঝুলছে। খোলা রুমটার দরজার কাছে এসে দেখল একজন খাটে শুয়ে আছে অন্যজন তার মাথায় পানি ঢালছে। ভিতরে ঢুকে কয়েক সেকেণ্ড মাহবুবের পাণ্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মাসুমের দিকে চেয়ে চিনতে পারল। সাঁতার প্রতিযোগীতার দিন এই ছেলেটাই মাহবুবের সঙ্গে ছিল। সালাম দিয়ে বলল, চিনতে পারছেন?

মাসুমের দরজার দিকে পিঠ ছিল। তাই মাহবুবার আগমন টের পায়নি। মেয়েলী কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়ে চিনতে পেরে সালামের উত্তর দিয়ে অবাক কণ্ঠে বলল, আপনি?

চিনতে পেরেছেন তা হলে?

 আপনার মতো মেয়েদের একবার দেখলেই চেনা যায়।

তাই নাকি? তা হলে পানি ঢালা বন্ধ করে ওঁকে তাড়াতাড়ি ক্লিনিকে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন, আমার গাড়ি আছে।

কিন্তু আমি যে মেডিকেলে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে————–।

তাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে মাহবুবা বলল, আবার ফোন করে নিষেধ করে দিলেই হবে। নিন তাড়াতাড়ি করুন, হ্যারি আপ। তারপর আলনায় ঝাড়ন দেখতে পেয়ে সেটা নিয়ে নিজেই মাহবুবের মাথা মুছিয়ে দেওয়ার সময় বলল, গলির মুখে ওষুধের দোকানে বাসার লোকেশ্যান জানতে গিয়ে সব কিছু শুনেছি। তারপর ঝাড়নটা তার হাতে দিয়ে বলল, গলিতে গাড়ি ঢুকবে না। আপনি তৈরী হয়ে নিন, আমি ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে আসছি। কথা শেষ করে মাসুমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ধানমণ্ডীর একটা ক্লিনিকে মাহবুব আজ দশ দিন আছে। এখন ভালোর দিকে। ক্লিনিকে না আনলে হয়তো মাহবুব মারাই যেত। দুদিন আশঙ্কাজনক অবস্থায় কেটেছে। সব সময় মাথায় বরফ দেওয়ার পর জ্বর কমে এবং সেই সাথে জ্ঞানও ফিরে। তার টাইফয়েড হয়েছে। এখনো জ্বর ১০২ এর মধ্যে ওঠা নামা করছে। জ্ঞান ফেরার পর মাহবুবাকে দেখে মাহবুব যেমন খুব অবাক হয়েছিল তেমনি আনন্দিতও হয়েছিল। কিন্তু কিছু বলেনি। শুধু তার দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়েছে। পরে মাসুমের কাছে সব কিছু শুনে আরো বেশি আনন্দিত হয়েছে; কিন্তু তা বাইরে প্রকাশ করে নি। তারপর সকাল-বিকাল এসে সেবা যত্ন করতে দেখে একদিন বলল, আপনি আমার জন্য যা কিছু করেছেন এবং এখনো করছেন, তা আজকাল কোন আপনজনও করে না। আপনার ঋণ কোনো দিন শোধ করতে পারব না।

মাহবুবা বলল, আপনি বুঝি এই সব চিন্তা করছেন? আর আমি চিন্তা করছি, সেদিন আপনি আমাদের বাসায় গিয়ে আমাকে চিরঋণী করে রেখেছেন। সেই ঋণ এই সামান্য সেবাযত্নে কি আর শোধ হয়েছে? তা ছাড়া আমি আর আপনার কতটুকু করেছি, মাসুম সাহেব যা করেছেন এবং করছেন, সে তুলনায় আমারটা নগন্য। ঋণী হলে তার কাছে হয়েছেন?

হ্যাঁ, মাসুমের ঋণও আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না। আপনারা দুজনে না থাকলে অনেক আগেই হয়তো কবরে চলে যেতাম।

মাহবুবা আপেল ও কমলা ছাড়িয়ে সামনে দিয়ে বলল, এখন ঋনের কথা রেখে এগুলো খান। তারপর খাইয়ে দিতে লাগল।

মাহবুব খেতে খেতে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

মাহবুবা লজ্জা পেয়ে বলল, ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?

মাহবুব সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, আপনি আমার জন্য এতকিছু করছেন কেন বলবেন?

একটু আগে বললাম না, ঋণ শোধ করছি। বিশ্বাস হয় না।

কেন?

সেদিন না খেয়ে আপনাদের বাসা থেকে চলে আসায় এমন কিছু ঋণী হন নি, যে জন্য এতকিছু করার প্রয়োজন আছে। নিশ্চয় অন্য কোনো কারণ আছে।

তাও থাকতে পারে।

সেটাই জানতে চাই।

ততক্ষণে খাওয়ান শেষ হয়েছে। প্লেটটা রেখে মাহবুবা নিজের রুমালে মুখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, আমার তো মনে হয় আপনি জানেন। তবু জানতে চাচ্ছেন কেন?

সিওর হওয়ার জন্য।

যদি বলি যা জেনেছেন, তা সত্য?

মাহবুব অনেক্ষণ চুপ করে রইল।

 কিছু বলছেন না যে?

কি বলব বলুন, আমার খুব ভয় হচ্ছে।

 আপনি পুরুষ, ভয় পাবেন কেন? বরং আমারই ভয় পাওয়ার কথা।

 আপনার ভয় লাগছে না?

একটুও না।

আপনি একটা ডেঞ্জারাস মেয়ে।

আর আপনি বুঝি গোবেচারা?

তা ছাড়া আর কি?

 আপনি যে আমার থেকে ডেঞ্জারেস, তা অনেক আগেই জানি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। জানেন, প্রায় বছর খানেক আগে যেদিন সুটিং-এ আপনি ফাক্ট হলেন, সেদিন আমিও সেখানে ছিলাম। আপনাকে দেখেই ভালবেসে ফেলি। ঐদিন আপনার সঙ্গে পরিচয় করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারিনি। সেবা মেয়েদের সাঁতার প্রতিযোগীতায় আমিও অংশ নিই। কিন্তু কোনো পদক পাইনি। তারপর ছেলেদের প্রতিযোগীতা দেখতে গিয়ে আপনাকে পাই। তবে তার আগে দুএকবার ভার্সিটিতে দেখেছি। আলাপ করার জন্য আপনার পিছুও নিয়েছি। কিন্তু কিভাবে একজন অচেনা ছেলের সঙ্গে আলাপ শুরু করব ভেবে ঠিক করতে না পেরে ফিরে এসেছি।

এমন সময় মাসুমকে আসতে দেখে মাহবুবা চুপ করে গেল।

মাসুম কাছে এসে সালাম দিয়ে মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে আজ কেমন আছিস?

মাহাবুব সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ভালো। তারপর তার হাতে টিফিন বাক্স দেখে বলল, ওটা এখন রেখে দে, পরে খাব।

মাসুম ঘড়ি দেখে বলল, সে কিরে, বেলা দুটো বাজে খিদে পায়নি?

পেয়েছিল। তারপর মাহবুবাকে দেখিয়ে বলল, উনি একটু আগে কি সব খাওয়ালেন।

মাসুম মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কী আরো কিছুক্ষণ থাকবেন?

 কেন বলুন তো?

আমার একটু কাজ আছে। এক্ষুণী যেতে হবে। ওকে খাইয়ে যাব মনে করেছিলাম; কিন্তু ওতো এখন খাবেনা বলছে।

ঠিক আছে আপনি যান, আমি খাইয়ে তারপর যাব।

মাসুম সালাম বিনিময় করে যাওয়ার সময় মাহবুবকে বলল, যাই দোস্ত, রাতে তো আসছি। তারপর চলে গেল।

মাসুম চলে যাওয়ার পর মাহবুব বলল, আপনার খিদে পায়নি?

পেলেও মেয়েদের সহ্য করার ক্ষমতা আছে। এবার আপনার মা বাবার কথা বলুন।

 জানতে খুব ইচ্ছা করছে বুঝি?

না হলে বললাম কেন?

ওঁরা গ্রামের সহজ সরল মানুষ, বলার মতো কিছু নেই।

তবু বলুন শুনব।

মায়ের কথা আর কি বলব, মাতো মাই-ই। আর বাবাও তাই। তবে বাবার কিছু এক্সট্রা কোয়ালিফিকেশন আছে। যেমন তিনি একজন দক্ষ সাঁতারু ও লাঠিয়াল। অবশ্য কোনো দিন প্রতিযোগীতায় যোগ দেননি। আমার দাদা এবং তার বাবাও তাই ছিলেন।

মাহবুবা বলে উঠল,তাই বোধ হয় আপনিও দক্ষ সাতারু?

হ্যাঁ, বাবার কাছ থেকেই শিক্ষা পেয়েছি। বাবাতো এখনো প্রতিদিন গোসল করার সময় অনেকক্ষণ সাঁতার কাটেন।

আপনাদের বাড়ির কাছে নিশ্চয় নদী আছে?

আমাদের গ্রাম থেকে নদী অনেক দূরে। তবে আমাদের একটা খুব বড় পুকুর আছে। গ্রামের লোকের পানির কষ্ট দূর করার জন্য আমার পরদাদা, মানে দাদার বাবা পুকুরটা কাটিয়েছিলেন। তার চার পাশে চারটে পাকা ঘাটও করে দিয়েছিলেন। আর চারদিকের পাড়ে নানারকম ফলের বাগান। বাগানের ফল ও পুকুরের মাছ বিক্রি করে আমাদের প্রচুর আয় হয়। পুকুরটা এতবড় যে, গ্রামের ছেলে, বুড়ো কেউ পারাপার হওয়ার সাহস পায় না। তাই আমি, বুবু ও আব্বা যখন সাঁতার কেটে পুকুরের এপার ওপার হতাম তখন গ্রামের ছোট বড় সব মেয়ে পুরুষ চারপাশের পাড়ে এসে ভীড় করতো।

আপনার বুবুও তাহলে আপনার মতো ডেঞ্জারেস?

সাঁতার কাটলে কেউ ডেঞ্জারেস হয় না। বরং সাঁতার কাটা শরীরের জন্য খুব। উপকারী। তাই তো ইংরেজীতে একটা কথা আছে, সুইমীং ইজ দা বেষ্ট এক্সাসাইজ গুড ফর হেলথ। যাকগে, এবার ওসব কথা থাক। খেতে দেন, প্রায় তিনটে বাজে। আপনিতো আবার না খেয়ে আছেন। আমাকে খাইয়ে বাসায় গিয়ে খাবেন।

মাহবুবকে খাইয়ে মাহবুবা সাড়ে তিনটের সময় বাসায় ফিরল।

এই কয়েক দিনের মধ্যে মাসুমের সঙ্গে মাহবুবার বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। ক্লিনিকে মাহবুবকে আনার পর দুতিন দিন মাসুম সব সময় ছিল। আশঙ্কাজনক অবস্থা কেটে যাওয়ার পর মাঝে মাঝে বাসায় গিয়ে গোসল ও খাওয়া দাওয়া করে এসেছে। এক সপ্তাহ পর থেকে ক্লাসও করছে।

মাহবুবাও এক সপ্তাহ ক্লাস করেনি। সারাদিন মাহবুবের কাছে থেকেছে।

মেয়ের মুখে মাহবুবের অসুখের কথা শোনার পর আনিস সাহেব প্রতিদিন একবার এসে দেখে গেছেন। মাঝে মাঝে শামীমা বেগমও এসে দেখে গেছেন।

মাহবুব প্রায় পনের দিন ক্লিনিকে থেকে সুস্থ হয়ে আজ তিন দিন হল মেসে ফিরে এসেছে। সুস্থ হলেও সম্পূর্ণ হয়নি। বেশি হাঁটা চলা করতে পারে না। মেসের কাজের বেটিদের হাতের রান্না খেতে পারে না। তাই নিজেরা রান্না করে খায়। সকালে মাসুম নাস্তা বানিয়ে দুজনে এক সঙ্গে খেয়ে ভার্সিটি যাওয়ার সময় বলল, ক্লাস করে এসে রান্না করব, তুই যেন আবার কিছু করতে যাস না।

মাসুম চলে যাওয়ার পর মাহবুব বই নিয়ে বসল। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হল, বাড়িতে চিঠি দেওয়া দরকার। এই মাসে যাবে বলে চিঠি দিয়েছিল। অসুখ হওয়ায় যেতে পারেনি। মা-বাবা নিশ্চয় দুশ্চিন্তায় আছে। বই বন্ধ করে এক পাশে রেখে চিঠি লিখছিল।

এমন সময় মাহবুবা এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, আসতে পারি?

ক্লিনিক থেকে ফেরার পর প্রতিদিন মাহবুব তাকে আশা করেছে। আসেনি দেখে ভেবেছে, নিশ্চয় কিছু কারণ আছে। নচেৎ যে নাকি অক্লান্ত সেবা যত্ন করে তাকে বাঁচাল, সে না এসে থাকতে পারে না। মাহবুবার গলার শব্দ শুনে মাহবুবের সারা শরীরে আনন্দের শিহরণ বইতে শুরু করল। কলম থামিয়ে সালামের উত্তর দিল। তারপর তার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারল না। এতদিন যে মাহবুবাকে দেখেছে আজকের মাহবুবা যেন সে নয়। সাদা ধপধপে শ্যালওয়ার কামিজ পরনে, চিকন ওড়না কাঁধের দুপাশ দিয়ে বক্ষযুগল ঢাকা। পিনোন্নত বক্ষ যুগল ওড়নাকে ঠেলে রেখেছে। ঠোঁটে মেরুন রং এর হালকা লিপিস্টিক। একটা গোলাপ চুলের খোঁপাতে গোঁজা। বাম হাতে এক গুচ্ছ রজনী গন্ধা আর ডান হাতে একটা লাল গোলাপ। মাহবুব সব কিছু ভুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

মাহবুবা এতদিন লক্ষ্য করেছে, মাহবুব কথা বলার সময় তার মুখের দিকে তাকালেও সব সময় তার দৃষ্টিতে যেন অচেনা ভাব। সে জন্যে খুব কষ্ট পেত। তবু তার প্রতি অসন্তুষ্ট হতে পারেনি। মনে হত মাহবুব তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। ক্লিনিকে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেও তার কাছ থেকে সাড়া পাইনি। আজ তাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে লজ্জিত স্বরে বলল, বি ব্যাপার ওভাবে কি দেখছেন? আসার অনুমতিও দিচ্ছেন না?

মাহবুব এতক্ষণ বাস্তবে ছিল না, তার কথা শুনে বাস্তবে ফিরে এসে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, অনুমতি চাচ্ছেন কেন? প্রথম দিনতো নেননি? ঠিক আছে আসুন।

মাহবুবা ভিতরে ঢুকে বলল, সেদিন আপনার জ্ঞান ছিল না। নচেৎ নিশ্চয় নিতাম, তারপর বলল, কেমন আছেন?

আল্লাহর রহমতে ভালো। আপনি?

আমিও ভালো। কিছু লিখছিলেন মনে হচ্ছে?

 হ্যাঁ, মা-বাবাকে চিঠি লিখছিলাম।

পলিথিন ব্যাগে মাহবুবা দুতিন পদের ফল ও বিস্কুট নিয়ে এসেছে, সেগুলো খাটের উপর রেখে বলল, ছুরি আছে?

ছুরি কি হবে?

 ভয় নেই খুন করব না।

মাহবুর ড্রয়ার থেকে একটা বড় চাকু বের করে দিল।

 ওমা, এযে দেখছি মানুষ খুন করার ছুরি।

মাহবুব মৃদু হেসে বলল,হ্যাঁ, প্রয়োজন হতে পারে ভেবেই এটা সব সময় কাছে রাখি।

মাহবুবা অনেক চেষ্টা করেও খুলতে না পেরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল, এর ভিতরে অনেক রকমের ফলা রয়েছে। খুলেন কি করে?

মাহবুব তার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে বলল, এতে দুপাশে বারটা ফলা আছে, তারপর এক একটা খুলে তার কার্যকারীতা বলে জিজ্ঞেস করল, আপনার কোনটা দরকার?

মাহবুবা বলল, কিছু কাটার জন্য।

মাহবুব সেই ফলাটা রেখে অন্য গুলো ঢুকিয়ে দিয়ে তার হাতে দিল।

মাহবুবা আপেল কেটে তাকে খেতে দিয়ে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে বলল, এগুলো কোথায় রাখব বলুন।

মাহবুব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আর কত অপমান করবেন?

মাহবুবা অবাক কণ্ঠে বলল, অপমান করছি মানে?

দেখুন কিছু মনে করবেন না, এতদিন যা কিছু করেছেন একজন বিপন্ন রুগীর জন্য করেছেন; কিন্তু এখন অপমান করা হচ্ছে না?

কখনই নয়, যে কেউ কোনো রুগীকে দেখতে গেলে কিছু না কিছু নিয়ে যায়।

কিন্তু আমি তো এখন সুস্থ।

সুস্থ হলেও সম্পূর্ণ নন। তর্ক বাদ দিয়ে বলুন না কোথায় রাখব?

এটাই কিন্তু লাস্ট বলে মাহবুব খাটের নিচে ইঙ্গিত করে বলল, ওখানে একটা পাঁচ পাউন্ডের ডানো দুধের ডিবে আছে।

মাহবুবা বিস্কুট গুলো ডিবেয় রেখে বলল, এবার ফলগুলো খেয়ে নিন।

বারে আমি একা খাব নাকি?

 মাহবুবা দুপিস খেয়ে বলল, চা খাওয়ার ইচ্ছা করছে।

আমারও, দাঁড়ান বানাচ্ছি।

না না, আপনাকে বানাতে হবে না, আমি বানাব।

তা হলে সেটা খাওয়াতো দুরের কথা মুখেও দেওয়া যাবে না।

কেন?

আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিওর আপনি কখনো রান্না ঘরের ধারে কাছেও যাননি।

মাহবুবা কোটিপতির একমাত্র মেয়ে। চা বানিয়ে খাওয়া কল্পনাও করা যায় না। মাহবুব অসুস্থ, তাই কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলেছে। মাহবুবের কথা শুনে বলল, আপনার কথা ঠিক, তবে চেস্টা করতে বাধা কোথায়?

মাহবুব বলল, বাধা নিশ্চয় আছে, কারণ ষ্টোভ ধরাতে গিয়ে বিপদ ঘটাতে পারেন। তার চেয়ে আপনি বসুন আমি বানাচ্ছি। তারপর দুকাপ চা বানিয়ে মাহবুবাকে এক কাপ দিয়ে নিজেও এক কাপ নিল।

চায়ে চুমুক দিয়ে মাহবুবা বলল, বাহ, বেশ সুন্দর বানিয়েছেন তো? তারপর জিজ্ঞেস করল রান্না-বান্না কে করে দেয়?

কে আবার? দুবন্ধুতে মিলে মিশে করি। কাজের বুয়ার হাতের রান্না আমরা খেতে পারি না।

তা হলে আপনারা বেশ কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করছেন?

কষ্ট আবার কি? ফরেনে নারী পুরুষ অফিসে কাজ করার পর বাসায় ফিরে মিলে মিশে সব কাজ করে। এখন ওসব কথা থাক, কয়েক দিন থেকে আপনাকে একটা কথা বলব ভাবছিলাম।

মাহবুবা মনে করল, মাহবুব নিশ্চয় বলবে, আমি আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। তাই আনন্দিত স্বরে বলল, বেশতো বলুন।

আমার পিছনে লেগেছেন কেন?

 মাহবুবা মনে হোঁচট খেয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

কিছু বলছেন না যে?

 কেন লেগেছি বুঝতে পারেননি?

 সম্পূর্ণ না হলেও কিছুটা পেরেছি।

 যতটুকু পেরেছেন, যদি বলি সেটাই সম্পূর্ণ।

 মাহবুব আর কিছু না বলে চুপ করে রইল।

বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মাহবুবা বলল, কি হল চুপ করে আছেন কেন?

 আপনার মা-বাবা জানেন?

হ্যাঁ, জানেন। তাই তারা তোমার, সরি আপনার অসুখের কথা শুনে ক্লিনিকে কয়েক বার দেখতে গেছেন।

কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না।

কেন?

অনেক কারন আছে, কয়টা বলব।

কারন যতই থাকুক আমি শুধু একটাই শুনতে চাই, আপনি কোনো মেয়েকে ভালবাসেন কিনা বা আপনার কোন বাধা আছে কিনা?

আমি এসব ব্যাপার নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি, তবে বলে থেমে গেল।

 কি হল, তবেটা শেষ না করে থেমে গেলেন কেন?

মাহবুব তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছুদিন হল একটা মেয়েকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে কিন্তু মেয়েটার সব কিছু জানার পর নিরাশ হয়েছি।

মেয়েটা কি জানে, আপনি তাকে ভালবাসেন?

আমিতো ভালবাসার কথা বলিনি, বলেছি পছন্দ হয়েছে।

 ঠিক আছে ঐ কথাটাই সে জানে কিনা?

 তা আমি কি করে বলব? তবে তার আচার আচরন দেখে কিছুটা বুঝতে পেরেছি।

 কথাটা তাকে জানান নি কেন?

 উচিত নয় বলে?

এখানে আবার উচিত অনুচিতের কথা থাকবে কেন? আসলে আপনি খুব চাপা। কোনো কথা খোলাখুলি বলতে পারেন না?

পারি। বলছি শুনুন, মেয়েটা কোটিপতির একমাত্র সন্তান। আমি হলাম পল্লী গ্রামের এক মধ্যবিত্ত লোকের ছেলে। আপনিই বলুন, মেয়েটার দিকে কি এগোনো আমার উচিত?

মাহবুবের পছন্দ করা মেয়েটা যে সে, তা মাহবুবা বুঝতে পেরে বলল, কিন্তু মেয়েটা ও তার মা-বাবা যদি আপনাকে পছন্দ করে সানন্দে গ্রহন করতে চায়, তা হলে কী করবেন?

তবু আমার অনেক বাধা আছে।

যেমন?

প্রথম বাধা হল, সমাজ, শহরের সমাজ আর গ্রামের সমাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। দ্বিতীয় বাধা হল, মেয়েটা ভোগ বিলাসে মানুষ হয়েছে। অপর পক্ষে আমি পল্লী গ্রামে সংযমী ও রক্ষণশীল পরিবারে মানুষ হয়েছি। তৃতীয় বাধা হল, মেয়েটা নিশ্চয় শহরের পরিবেশ ছেড়ে গ্রামের পরিবেশে যেতে চাইবে না। আবেগের বসে গেলেও বেশি দিন টিকতে পারবে না। চতুর্থ বাধা হল, গ্রামের খাওয়া-দাওয়া পোশাক-পরিচ্ছদ তার নিশ্চয় পছন্দ। হবে না। অবশ্য না হওয়াটাই স্বাভাবিক। সব থেকে বড় বাধা, আমি ও আমাদের ফ্যামিলীর সবাই ধর্মীয় বিধি নিষেধ যথা সম্ভব মেনে চলি। মেয়েটা শহরের উচ্চ ফ্যামিলীর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তার পক্ষে সেসব মেনে চলা কী সম্ভব? এরকম আরো অনেক বাধা আছে কয়টা আর তোমাকে, সরি আপনাকে বলব। এখন আপনিই বলুন, আপনাকে যদি কোনো পল্লী গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে পছন্দ করে,তা হলে আপনি কী করবেন?

করব কী, করেইতো ফেলেছি।

 মানে?

 মানেটা বলতে হবে?

 মাহবুব বুঝতে পেরেও ভনিতা করে বলল, না বললে বুঝব কী করে?

 আপনি স্কলার ছাত্র হলে কি হবে, বড় বোকা।

 তাই বুঝি?

শুধু তাই নও, ভীতুও। নচেৎ নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে এতো ভনিতা করতে না।

বাস, শুধু বোকা ও ভীতু? আর কিছু নই?

মাহবুবা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে চিন্তার ভান করে বলল, আপাততঃ কিছু দেখছি।, তবে বিয়ের পর সবকিছু বলতে পারব।

মাহবুব চমকে উঠে বলল, বিয়ের পর?

কথাটা হঠাৎ মাহবুবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।

মাহবুব অনেক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার সব কিছু না জেনে এতটা এগোনো তোমার, সরি আপনার উচিত হয়নি।

মাহবুবা চোখ ভরা অশ্রু নিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে বলল, আমি এগোইনি, মন এগিয়েছে। এবার একটা অনুরোধ করি?

করুন।

এখন থেকে আমাকে তুমি করে বলবেন, সরি বলে সংসোধন করতে হবে না।

 তার আগে আমার সবকিছু শোনা আপনার দরকার। বলছি শুনুন।

তাকে বাধা দিয়ে মাহবুবা বলল, সেদিন মা-বাবার কাছে ও ক্লিনিকে আমার কাছে যতটুকু বলেছেন, তার বেশি শোনার আমার দরকার নেই। আমি আপনার কোন কিছু না জেনেই ভালবেসেছি। আপনি যদি গরিব ঘরের ছেলেও হতেন, তবু ভালবাসা কমতো না। আর মা-বাবাও আপনাকে ভীষণ পছন্দ করে। সে কথা তো আগেই বলেছি।

কিন্তু আমি যে মা-বাবার কথার অবাধ্য কোনো দিন হইনি। তাদের মতামত না নিয়ে কখনো কিছু করিনি?

বেশতো, মা-বাবাকে জানাবেন। প্রয়োজনে তাদেরকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবেন।

আমি মা-বাবাকে চিনি, তারা কোটিপতির মেয়েকে পূত্রবধু করতে কিছুতেই রাজি হবে না। যে সমস্ত বাধার কথা বললাম, তারাও তাই বলবেন।

আপনি বোধ হয় জানেন, আগের যুগে অনেক রাজকন্যা রাজ প্রসাদ ছেড়ে প্রেমিককে বিয়ে করে তার পর্ণকুটীরে বাস করেছে।

তখনকার প্রেমের সঙ্গে আজকালের প্রেমের কোনো তুলনাই হয় না। এখনকার প্রেম, ভোগ-বিলাস আর আনন্দ ফুর্তি করার জন্য। যেখানে ঐশ্বৰ্য্য সেখানেই প্রেম। ঐশ্বৰ্য নেই প্রেমও নেই। ঐ যে প্রবাদ বাক্য আছে  সংসারে অভাব প্রবেশ করলে, প্রেম জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। তা ছাড়া এযুগের মেয়েরা বলে থাকে, সহধর্মিনীর যুগ চলে গেছে। এখন সখিত্বের যুগ। আমি সখীত্ব চাইনা, সহধর্মিনী চাই।

আপনার কথা অস্বীকার করব না, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঐ রকম হলেও এখনো কিছু কিছু আগের যুগের মতো প্রেমের ঘটনা যে আছে, তা অস্বীকার করতে পারবেন? আর সহধর্মিনীর কথা যে বললেন, এখনও অনেক মেয়ে সহধর্মিনী হতে চায়।

তবে তাদের সংখ্যা খুব নগন্য।

আমি যদি সেই নগন্যদের একজন হই?

এটা আবেগের কথা, বাস্তবে প্রবেশ করলে আবেগ কর্পূরের মতো উড়ে যাবে। অবাস্তব কোনো দিন বাস্তব হয় না।

আপনার কথাটা বাস্তব। আমি ঐ নগন্যদের দলে, তাই অবাস্তবকে বাস্তব করে দেখাব। অবশ্য সব কিছু নির্ভর করছে আপনার উপর।

আমার উপর মানে?

মানে আপনার প্রেম ভালবাসা ও সহযোগীতা পেলে আমি অবাস্তবকে বাস্তবে পরিনত করতে পারব।

ঠিক আছে, এবারে বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে আলাপ করব। তারপর জিজ্ঞেস করল, আপনি কিসে পড়ছেন?

বাংলায় অনার্স করছি।

সেদিন আপনাদের বাসায় কথা বলার সময় আপনার মা-বাবা যে আমার আদর্শকে মেনে নিতে পারেন নি, তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন?

তা পারব না কেন?

তাদের মতামতের বাইরে কিছু করতে পারবেন?

আপনার মতো আমিও মা-বাবার কথার অবাধ্য কখনো হইনি। তাদের মতামত না নিয়ে কোনো কিছু করিনিও।

তা হলে?

 তা হলে আবার কি? আপনি কি ভেবেছেন, তাদের মতামত না নিয়েই এতটা অগ্রসর হয়েছি? যদি তাই ভেবে থাকেন, তা হলে ভুল করেছেন। আপনি চলে আসার পর তাদের মতামত আদায় করে ছেড়েছি। তাই তারা কয়েকবার আপনাকে ক্লিনীকে দেখতে গেছেন।

সবকিছু শুনে মাহবুবের বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

মাহবুবাও তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। বলল, কী বিশ্বাস হচ্ছেনা?

আনন্দে চোখে পানি এসে যেতে মাহবুব মাথা নিচু করে নিল।

মাহবুবা বুঝতে পেরে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বলল, আমি কখনো মিথ্যা বলি না। এবার নিশ্চয় আমার অনুরোধটা রাখবেন?

মাসুমের দুটো ক্লাস ছিল, ক্লাস করে ফেরার সময় বড় রাস্তায় গাড়ি দেখে বুঝতে পারল, মাহবুবা এসেছে। রুমে ঢুকে মাহবুবার অনুরোধের কথা শুনে সালাম দিয়ে বলল, রাখবে না মানে, নিশ্চয় রাখবে। ও না রাখলেও আমি জোর করে রাখাব। বলুন কি অনুরোধ করছেন।

মাসুমের গলা পেয়ে মাহবুব চোখ মুছে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, তুই আবার আমাদের ব্যাপারে নাক গলাচ্ছিস কেন? তাড়াতাড়ি রান্নার ব্যবস্থা কর।

মাসুম মাহবুবার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলেন ভাবী, তারপর জিবকেটে বলল, সরি, কথাটা হঠাৎ বেরিয়ে গেছে। মাফ করে দিন।

মাহবুবা লজ্জা পেলেও হাসতে হাসতে বলল, ঠিক আছে, কি বলছিলেন বলুন।

মাসুম বলল, ওর সঙ্গে কোনো ব্যাপারেই পেরে উঠি না। সব সময় আমাকে বিয়ে করা বৌ এর মতো হুকুম করে।

মাহবুবা হাসতে হাসতেই বলল, তাই নাকি? তা হলে তো খুব বিপদে আছেন?

বিপদ মানে মহাবিপদে দিন কাটাচ্ছি। পড়তে পড়তে যখন তখন বলবে, দোস্ত এক কাপ চা খাওয়া। শুধু কি তাই, বলছি শুনুন, এক ঝড় বৃষ্টির রাত্রে দুজনে পড়ছিলাম। রাত দুটোর সময় বলল, দোস্ত খিচুড়ী রান্না কর, খেতে বড় ইচ্ছা করছে। কি আর করি খিচুড়ী রান্না করলাম।

মাহবুব একটু রাগের সঙ্গে বলল, আর আমি যে তোকে সহযোগীতা করি তা বললি না যে?

তাতো করিস; কিন্তু প্রথমে যে ভাবে হুকুম করিস, সেটা সহ্য করতে পারি না।

 মাহবুব কিছু বলার আগে মাহবুবা বলল, আপনি ওঁর হুকুম মানেন কেন?

ওরে বাবা, তা হলেই হয়েছে। এক সপ্তাহ কথা বলা বন্ধ করে দেবে। আমাকে কিছুই করতে দেবে না, একা একা রান্না করবে। অবশ্য দুজনের জন্যই করবে। একমাত্র আপনিই আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।

কি করে?

ভাবী হয়ে।

মাহবুবা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। কিছু বলতে পারল না।

মাহবুব রাগের সঙ্গে মাসুমকে বলল, তুই কিন্তু ভীষণ বাড়াবাড়ি করছিস, শাস্তির কথা মনে রাখিস।

মাহবুবের দিকে তাকিয়ে মাহবুবা বলল, ওমা ওনাকে মারেনও নাকি?

সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন।

মাহবুবা জিজ্ঞেস করার আগেই মাসুম বলল, মারার থেকে বেশি।

 ঐ যে বললাম না, এক সপ্তাহ কথা বন্ধ করে দিয়ে একা একা সবকিছু করবে।

এখন উনি অসুস্থ, ওসব করতে পারবেন না।

আপনি ওকে চেনেন না, ও সব পারে। একবার দুজনেরই ভীষণ সর্দিজ্বর হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আমার থেকে ওর বেশি হয়েছিল। সে সময় বললাম, কয়েক দিনের জন্য না হয় কাজের বুয়া ঠিকেয় রাখি। বলল, না। তুই শুয়ে থাকবি, আমি সব কিছু করব। করলও তাই। আমি কিছু করতে গেলে তাড়িয়ে দিয়েছে।

মাহবুব গম্ভীর কণ্ঠে মাসুমকে বলল, খুব হয়েছে। এবার বাজে প্যাচাল বন্ধ করে রান্না কর। কত বেলা হয়েছে খেয়াল করেছিস?

মাসুম বলল, আজ রান্না করব না, হোটেল থেকে বিরানী এনে তিনজনে খাব। তারপর মাহবুবাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি বোধ হয় অনেক্ষণ এসেছেন?

মাহবুবা ঘড়ি দেখে বলল, হ্যাঁ তা প্রায় ঘন্টা দুই হবে।

এতক্ষণে নিশ্চয় গলা শুকিয়ে গেছে। দাঁড়ান, চা তৈরী করি। দোকানের চা উনি খেতে পারেন না বলে মাহবুবকে ঈঙ্গিতে দেখাল।

মাহবুবা বলল, আপনার বন্ধু চা করে খাইয়েছে। এখন আর খেতে ইচ্ছা করছে না। তবে আপনারা খেলে করতে পারেন।

মাসুম বলল, তা হলে থাক। আপনার জন্যই বলেছিলাম। ঠিক আছে, আমি হোটেল থেকে বিরানী নিয়ে আসি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেল।

মাহবুবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার অনুরোধের কথাটা মনে রাখলে খুশি হব।

মাহবুব বলল, আপনি যদি আমারও ঐ একই অনুরোধ রাখেন, তা হলে আমিও খুশি হব।

ঠিক আছে, আমি রাজি

 তা হলে আমিও রাজি।

একটা কথা বলব?

 বল।

 প্রতিদিন এলে কোনো অসুবিধা হবে?

নিশ্চয় হবে। কারন এটা মেস, আর আমাদেরকে আশপাশের সবাই চেনে। তোমাকে প্রতিদিন আসতে দেখলে সবার কাছে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

মাহবুব তুমি করে বলতে শুরু করেছে দেখে, মাহবুবাও শুরু করল। বলল, তোমাকে না দেখে যে থাকতে পারব না।

আর একটু সুস্থ হয়ে কয়েক দিনের মধ্যে ভার্সিটি যাব। তখন দেখা হবে।

তাতো হবেই; কিন্তু যতদিন না যাচ্ছ, ততদিন কি হবে?

 কি আবার হবে, ধৈৰ্য্য ধরবে।

 পারব না, একদিনও থাকতে পারব না।

গত দুদিন ছিলে কি করে?

বাবার সঙ্গে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলাম, যা কষ্ট হয়েছে না?

 দেখ, ছেলে মানুষি করো না, ধৈৰ্য্য তোমাকে ধরতেই হবে।

মাসুম ফিরে এসে মাহবুবের কথা শুনতে পেয়ে বলল, সবকিছুতে ধৈর্য ধরা গেলেও প্রেমের ব্যাপারে ধরা যায় না। আর একটা ব্যাপারেও ধরা যায় না, সেটা হল পেটের কান্না। এখন সেই কান্না থামাবার উপকরণ হাজির। অতএব দেরি না করে শুরু করা যাক। খালি পেটে প্রেমালাপ জমে না।

মাহবুব বেশ রাগের সঙ্গে বলল মাসুম তুই কিন্তু সীমার বাইরে চলে যাচ্ছিস। পরিনতির কথা চিন্তা করে আর একটা কথাও বলবি না।

দেখেছেন ভাবী, থুড়ি, কি বলে ডাকব বলে দেবেন তো?

 কেন, আমার নাম ধরে ডাকবেন।

আপনার নামের অর্থ প্রেমিকা। তাই ঐ নামে মাহবুব ডাকতে পারলেও আমি পারব না। আচ্ছা, আপনার আর কোনো নাম নেই? মানে ডাক নাম।

না নেই। তবে সুলতানা বলে ডাকতে পারেন। আমার পুরো নাম মাহবুবা সুলতানা।

দারুন নাম তো। সুলতানা মানে ম্রাজ্ঞী। ঠিক আছে সুলতানা বলেই ডাকব। কিন্তু শুধু নাম ধরে ডাকা কি ঠিক হবে?

কেন ঠিক হবে না? আপনি সুলতানা বলেই ডাকবেন।

কিরে তুই আবার মাইন্ড করবি না তো বলে মাসুম মাহবুবের দিকে তাকাল। তাকে বড় বড় চোখে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে কাচুমাচু হয়ে বলল, মাফ করেদে দোস্ত, এই চুপ করলাম। তারপর তাদের দুজনকে দুটো বিরানীর প্যাকেট দিয়ে নিজেও একটা নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিল।

মাহবুব বলল, আমরা খাব আর ড্রাইভার—–।

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মাসুম বলল, তার হয়তো এতক্ষণে খাওয়া শেষ।

যাক এতক্ষণ বুদ্ধর মতো কাজ করে শেষ কালে বুদ্ধিমানের পরিচয় দিলি। সে জন্যে আজকের সব অপরাধ মাফ করে দিলাম।

মাসুম খেতে খেতে বলল, ধন্যবাদ।

খাওয়া দাওয়া করে মাহবুবা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর মাসুম খাটের উপর আরাম করে শুয়ে বলল, একেই বলে ভাগ্য, রাজ কন্যার সাথে রাজ্যও পেয়ে যাবি।

মাহবুব বলল, ভাগ্যের কথা একমাত্র আল্লাহ মালুম। আমি রাজ্য পাওয়ার আশা করিনি। শুধু রাজকন্যাকে পেলেই ভাগ্যবান মনে করব। ব্যাস আর কোনো কথা বলবি না। হয় পড়, নচেৎ চুপ করে শুয়ে থাক। আমি এখন পড়ব। অসুখ করে অনেক ক্ষতি হয়েছে।

Super User