টাইম ট্রাভেল – তিন গোয়েন্দা – ভলিউম ৬০
প্রথম প্রকাশ: ২০০২
০১.
অকারণে সময় নষ্ট করছি আমরা, ফিসফিস করে বলল দুজনের মধ্যে লম্বা লোকটা। তার নাম মাজুল। নতুন কিছুই আবিষ্কার করেননি ডক্টর স্টিভেনস। করলে এতদিনে জেনে যেতাম।
সব সময়ই বড় বেশি অধৈর্য তুমি, গাজুল, তিরস্কার করল দুজনের মধ্যে বেঁটে লোকটা।
ব্রেন স্পেশালিস্ট বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডক্টর জ্যাক স্টিভেনসের বাড়িতে লকিয়ে আছে ওরা। রান্নাঘরের আলমারির আড়ালে রয়েছে এখন। তিনি নতুন কোন ফরমুলা আবিষ্কার করেছেন কিনা জানতে এসেছে। যদি করে থাকেন, হয় ফরমুলাটা চুরি করবে, নয়তো কপি করে নিয়ে যাবে।
ফরমুলা যদি না-ই পাই, তাহলে আরেক কাজ করব, গাজুল বলল। এসেছি যখন, একেবারে খালি হাতে ফিরব না। আর কিছু না হোক, মনিবের জন্যে কয়েকটা গোলাম ধরে নিয়ে যাব। কি বলো?
ঠিক, ভাল বুদ্ধি, উল্লসিত হয়ে মাথা ঝাঁকাল মাজুল। কিন্তু বুদ্ধিমান গোলাম পাব কোথায়? শহরটার লোকজনকে দেখে বোঝা যাচ্ছে একেবারে আদিম অবস্থাতেই রয়ে গেছে এরা। বুদ্ধিশুদ্ধিও বড় কম। বেশি বোকা।
বোকারা কিন্তু ভাল গোলাম হয়, গাজুল বলল। কথা শোনানো যায়।
তা বটে। কিন্তু বোকা লোক যে পছন্দ করেন না মনিব, মাজুল বলল। যাকগে। আমার খিদে পেয়েছে।
আলমারির আড়াল থেকে সে বেরোনোর উপক্রম করতেই খপ করে তার হাত চেপে ধরল গাজুল। পাগল হলে নাকি? ডক্টর স্টিভেনস ঘোরাফেরা করছেন এদিকেই। দেখে ফেললে আমাদের লুকিয়ে থাকার কষ্টটাই মাটি হবে।
কিন্তু আমার খিদে পেয়েছে যে!
উনি এদিক থেকে চলে গেলেই বেরোব আমরা। খিদে তো আমারও পেয়েছে। ফিসফিস করে বলল গাজুল। খিদের কথা বাদ দাও। যা বলছিলাম। আচ্ছা, এক কাজ তো করা যায়। বোকাগুলোকে চালাক করার জন্যে মগজশক্তি রসায়ন ব্যবহার করতে পারি। কয়েকটা অল্পবয়েসী কিশোর ছেলেকে ধরে নিয়ে যাই চলল। অল্প বয়েসী ছেলেগুলোর প্রচুর শক্তি থাকে শরীরে। খাটতে পারে। মগজটাকে উন্নত করে নেয়া গেলে ভাল গোলাম হবে। দেখলে খুশি হবেন বস।
হ্যাঁ, তা হবেন। কিন্তু পছন্দসই ওরকম কয়েকটা বোকা ছেলে পাব কোথায় আমরা?
জবাব দেয়ার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল গাজুল। কলিং বেল বাজানোর শব্দে থেমে গেল। এক মুহূর্ত কান পেতে রইল চুপচাপ। তারপর বলল, মনে হচ্ছে ডক্টর স্টিভেনসের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে কেউ।
.
০২.
কলিং বেলের বোতাম টিপে দিয়ে দরজার গোড়ায় বিছানো খড়ের বানানো ম্যাটের ওপর থেকে পিছিয়ে গেল কিশোর পাশা। ঘরের ভেতরে ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনতে পেল।
ফিরে তাকাল তার দুই সহকারী মুসা আর রবিনের দিকে, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
হচ্ছে। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকে জবাব দিল রবিন, আঙ্কেল জ্যাক আমাদের সাহায্য করতে না পারলে দুনিয়ার আর কেউ পারবে না।
দরজার গায়ে লাগানো পিতলের নামফলকটার দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। তাতে লেখা:
ডক্টর জ্যাক স্টিভেনস, ব্রেন এক্সপার্ট
রকি বীচ সাইন্স ল্যাবরেটর।
কিন্তু সত্যিই যদি আমাদের বোকা ভেবে বসেন তিনি?মুসার কণ্ঠেও অস্বস্তি।
এটা আর নতুন কি? করুণ শোনাল কিশোরের কণ্ঠ। সবাই তো আজকাল তা-ই ভাবছে আমাদের। কোনদিন, কখনই আর মনে হচ্ছে স্কুলের সবচেয়ে বুদ্ধিমান ছেলে হতে পারব না আমরা।
ওই যে যা বললাম, কিশোরের কথার সঙ্গে যোগ করল রবিন, আঙ্কেল জ্যাক যদি আমাদের বোকা ভেবে বসেনও, তিনি সাহায্য করতে না পারলে দুনিয়ার আর কেউ করতে পারবে না। তবে, আমি শিওর, তিনি আমাদের ফিরিয়ে দেবেন না। এটুকু ভরসা না থাকলে কি আর আসতাম।
বাড়ির ভেতরে পদশব্দ কানে এল ওদের। এগিয়ে আসছে।
মাথা চুলকানো বন্ধ করে হাতটা সরিয়ে আনল রবিন।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে টেনেটুনে কাপড়-চোপড় ঠিক করল কিশোর। অস্বস্তি বোধ করছে। প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিল।
মুসার মুখ দেখে মনে হলো ডক্টরকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দৌড় মারবে। পালানোর জন্যে যেন অস্থির হয়ে উঠেছে সে। সবই এগুলো বোকামির লক্ষণ।
খুলে গেল দরজা। একটা মুহূর্ত ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন আঙ্কেল জ্যাক। তারপর বড় বড় হয়ে গেল চোখ। খুশি খুশি গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, আরে রবিন! তোরা! কি মনে করে?
সাদা এলোমেলো চুল, ছড়ানো সাদা দাড়ি, গোলগাল লাল টকটকে হাসিখুশি মুখ, সব মিলিয়ে আঙ্কেল জ্যাককে দেখতে একেবারে সান্তা ক্লজের মত লাগছে। তার চওড়া কাঁধ, বড় বড় হাতের থাবা। মস্ত ভুড়ি নেচে ওঠে হাসার সময়।
সব সময় সাদা পোশাক পরেন তিনি। সাদা সোয়েটার, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় গায়ে দেন সাদা কোট।
অ্যাই চেরি, ভেতরের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে গলা চড়িয়ে হাঁক দিলেন তিনি, দেখে যাও কে এসেছে! গমগমে কণ্ঠস্বর। সরে জায়গা করে দিলেন তিন গোয়েন্দাকে ঢোকার জন্যে।
রান্নাঘর থেকে খাবারের গন্ধ নাকে এসে লাগল। রোস্ট। সম্ভবত মুরগী। চট করে রবিনের দিকে তাকাল মুসা।
খেতে বসেছিলে? আঙ্কেলকে জিজ্ঞেস করল রবিন। না বসবে?
না, শেষ করে ফেলেছি, আঙ্কেল জ্যাক বললেন। তোর আন্টি রান্নাঘরে, এঁটো থালা-বাসন মাজছে। কেন, খিদে পেয়েছে?
মাথা নাড়ল রবিন, না, আমরা খেয়ে এসেছি।
রান্নাঘরের দরজার দিকে ফিরে আবার হাঁক দিলেন আঙ্কেল জ্যাক, চেরি? এই চেরি? রবিনের দিকে তাকালেন, তারপর? হঠাৎ কি মনে করে?
দ্বিধা করতে লাগল রবিন। ইদানীং খুব বোকা হয়ে গেছি আমরা, আঙ্কেল।
ভুরু কুঁচকালেন আঙ্কেল জ্যাক, বোকা হয়ে গেছিস মানে?
কি ভাবে বোঝাব ঠিক বুঝতে পারছি না, কিশোর আর মুসার দিকে তাকাতে লাগল রবিন। শেষে কিশোরকে বলল, তুমিই বলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল কিশোর। আমরা যে কতখানি বোকা হয়ে গেছি, একটা দিনের ঘটনা বললেই বুঝতে পারবেন…
.
০৩.
স্কুল ছুটির পর দেখা কোরো তোমরা আমার সঙ্গে, ক্লাসে গম্ভীর ভঙ্গিতে আমাদের বললেন ক্লাসটিচার মিস্টার ক্রেগ।
কিন্তু আমরা তো কিছু করিনি! অবাক হয়ে প্রতিবাদ জানালাম। জানামতে শাস্তি দেয়ার জন্যেই কেবল স্কুল ছুটির পর কাউকে থাকতে বলেন ক্লাসটিচার।
মিস্টার ক্রেগ শিক্ষক হিসেবে খুব ভাল। ভদ্রলোক। সব ছাত্রছাত্রীরাই তাকে পছন্দ করে। আমরাও করি।
দেখা করতে বলেছেন যখন, করতেই হবে।
স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজল। সব ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে গেল। বসে রইলাম কেবল আমি, মুসা আর রবিন।
তিনটে পরীক্ষার খাতা বের করলেন মিস্টার ক্রেগ। মুখ তুলে তাকালেন তোমাদের খাতা।
মাথার চুলে হাত বোলালেন তিনি। চোখের পাতা সরু করে তাকালেন খাতাগুলোর দিকে। তারপর ঘোষণা করলেন, এই সেমিস্টারের অংক পরীক্ষায়ও সাংঘাতিক খারাপ করেছ তোমরা। পুরোপুরি ফেল।
ঢোক গিললাম। রবিন গুঙিয়ে উঠল। আর মুসা চোখ নামিয়ে তাকিয়ে রইল নিজের জুতোর দিকে
তিনজনেই এতটা খারাপ করবে কল্পনাই করতে পারিনি, নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন তিনি। এতটা খারাপ তো তোমরা ছিলে না কখনও। কি হয়েছে তোমাদের, বলল তো?
নির্বাক হয়ে রইল মুসা আর রবিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, জানি না, স্যার। কিছুই ঢোকে না মাথায়। কিছু বুঝতেও পারি না। অনেক কিছুই মনে থাকে না। অতীতের অনেক কথা মনে করতে পারি না। মনে হয় বিসুরণ ঘটেছে। আমাদের।
কিন্তু বিস্মরণের সঙ্গে বোকামির সম্পর্ক কি?
জানি না, স্যার, বিড়বিড় করে বললাম।
বোকার মত মাথা চুলকে যাচ্ছে রবিন।
মুসা কোন কথা বলছে না।
খাতাগুলো আমাদের সামনে নাড়তে নাড়তে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ, অন্য সব কথা থাক। অংকে তোমরা কেন খারাপ করেছ, সেটা বরং পর্যালোচনা করে দেখি। খাতাগুলো ডেস্কে নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, তোমাদেরকে যে রিভিউ শীটগুলো দিয়েছিলাম, পড়েছ ওগুলো?
পড়েছি, স্যার, একসঙ্গে জবাব দিলাম তিনজনে।
বহুত মাথা ঘামিয়েছি এ নিয়ে, রবিন বলল।
কিন্তু এত কঠিন, যোগ করল মুসা, কিছুই বুঝতে পারিনি।
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন মিস্টার ক্রেগ। তোমাদের যে কিছু হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই আমার। সাহায্য দরকার? প্রয়োজন মনে করলে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি। কি করতে পারি, বলো?
কি জানি, তা-ও তো বুঝতে পারছি না, স্যার, মাথা চুলকানো বেড়ে গেল রবিনের।
আসলে, অংক আমাদের মাথায় ঢোকে না, স্যার, আমি জবাব দিলাম। অংক একেবারেই বুঝি না।
তুমি অংক বোঝা না এ কথা বিশ্বাস করতে বলো আমাকে? ভুরু কুঁচকে বললেন মিস্টার ক্রেগ। আসলে পড়ালেখা বাদ দিয়ে নিশ্চয় গোয়েন্দাগিরি নিয়ে বেশি বেশি মেতে উঠেছ। পড়াশোনায় পুরো ফাঁকি দিচ্ছ।…যাকগে, যা হবার হয়েছে। এবারকার মত ছেড়ে দিলাম। এখন থেকে লেখাপড়ায় ভালমত মনোযোগ দেবে। কি, বুঝেছ?
বুঝেছি, স্যার, মিস্টার ক্রেগকে এ ভাবে রেগে যেতে দেখে অবাক হলাম
কয়েক মিনিট পর স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম তিনজনে।
গরমকাল। অথচ প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইছে। রাস্তার মোড় পেরিয়ে এসে হাসাহাসি হই-চই কানে এল। টেরি আর তার দুই দোস্ত টাকি ও কড়ি খেলছে। আমাদের দেখে ফিরে তাকিয়ে টিটকারি দিতে শুরু করল ওরা। ইদানীং ওরাও আমাদের চেয়ে ভাল রেজাল্ট করে।
এতটা বোকা কি করে হয়ে গেলাম আমরা? বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে আপনমনেই বিড়বিড় করল রবিন।
ফিরে তাকাল মুসা, মাথার মধ্যে কিছু নেই আমাদের। মাঝে মাঝে এতই মন খারাপ হয়ে যায়, ইচ্ছে করে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই।
কিশোর থামলে রবিন বলল, এবার আমার কথা শোনো…
.
কিশোর যেদিনকার কথা বলল, সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে হলঘরে ঢুকতেই দেখা হয়ে গেল রিনিতার সঙ্গে।
রিনিতা আমার ছোট। আমার খালাত বোন। আমাদের বাড়িতে থাকতে এসেছে। ওর মা মারা গেছেন ক্যান্সারে। বাবা একসঙ্গে নিজের কাজকর্ম আর মেয়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গেছেন। শেষে মাকে অনুরোধ করেছেন মেয়েটাকে কিছুদিন দেখাশোনা করার জন্যে। একটু গুছিয়ে নিয়েই আবার তিনি মেয়েকে নিয়ে যাবেন।
রিনিতাকে নিয়ে এসেছে মা। স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে।
কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসে খেলছে রিনিতা। হাতের কাছে, আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা রঙের অসংখ্য প্লাস্টিকের টুকরো। আমার দিকে তাকিয়ে মাতব্বরি চালে ভুরু নাচাল। এত দেরি কেন?
রিনিতা আমাকে সব সময় খোঁচায়। নানা ভাবে যন্ত্রণা দেয়। একটা কথা বলতে পারি না। বললেই গিয়ে দশখান করে বানিয়ে বানিয়ে মার কাছে বিচার দেয়। মাও রিনিতার পক্ষ নিয়ে আমাকেই বকে। রাগে গা জ্বলে। মনে মনে ভাবি, এই বিচ্ছ মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে আসাটাই হয়ে গেছে এক মস্ত ভুল।
যাই হোক, রিনিতার প্রশ্ন শুনে আগে হলে হয়তো রেগে উঠতাম। জবাব দিতাম, সেটা জেনে তোমার কি লাভ? নিজের চরকায় তেল দাও। কিন্তু ইদানীং বোকা হয়ে যাওয়ার পর কেমন মানসিক ভাবেই দুর্বল হয়ে পড়েছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিনমিন করে জবাব দিলাম, স্কুলের পরেও থাকতে হয়েছে।
কেন? ফেলটেল করেছ নাকি? ঠাসানি দিয়েছে টিচার?
প্রশ্নটা এড়ানোর জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি করছ?
হাঁদা নাকি? মুখ ঝামটা দিল রিনিতা। দেখছ না খেলছি প্লাস্টিকের টুকরোগুলো দিয়ে প্রথমে একটা ঘর বানাব। বাস স্টেশন। তারপর একটা বাস। স্টেশনের সামনে রাখব। কিন্তু দেখো না, ঠিকমত জোড়াই লাগাতে পারছি না। মায়ার জন্যে অপেক্ষা করছি। ও এলে একটা ব্যবস্থা হবেই।
দেখি, আমাকে দাও তো।
দূর, আমার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল রিনিতা, তুমি কি লাগাবে? তুমি তো একটা হাঁদা। কালকে মনে নেই, সাধারণ একটা বাক্স বানাতে দিলাম, তাই পারলে না। স্কুলে এত দেরি করলে কেন? পড়া পারেনি বলে টিচার আটকে নাকি?
ঘাবড়ে গেলাম। কোন প্রসঙ্গই সহজে ভোলে না রিনিতা। ওর এ সব কথা, মার কানে গেলে জিজ্ঞেস করতে আসবে। তখন পড়ব আরও বিপদে।
থাক থাক, সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, ভাল লাগল না, রিনিতাকে বলে তাড়াতাড়ি পালিয়ে এলাম সেখান থেকে।
.
০৪.
রবিন থামলে মুসার দিকে তাকালেন আঙ্কেল জ্যাক। এবার তোমার কোনও ঘটনার কথা বলো।
হাত ওল্টাল মুসা। কি আর বলব? আমারগুলোও.ওদের চেয়ে ভাল কিছু না।
তারমানে তুমি কিছু বলতে চাও না?
মাথা নাড়ল মুসা। শুধু একটা কথাই বলি, এ ভাবে মাঝে মাঝেই বিপদে পড়তে হয়, অপদস্থ হতে হয় আমাদের তিনজনকে।
হু, গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন আঙ্কেল জ্যাক। চেয়ারে বসে সামনের দিকে ঝুঁকলেন। এক এক করে তাকালেন রবিন, কিশোর ও মুসার দিকে। তাহলে তোমাদের ধারণা তোমরা বোকা হয়ে গেছ?
কোন সন্দেহ নেই আর তাতে, এক আঙুল দিয়ে গাল চুলকাল কিশোর।
বিস্কুট আর দুধ এনে সামনে রেখে গেছেন চেরি আন্টি। কিন্তু ছুঁয়েও দেখল না কিশোর কিংবা রবিন। এমনকি মুসাও খাবারের দিকে একবার তাকিয়ে সেই যে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, আর তাকাচ্ছে না। বোকা হয়ে যাওয়াতে খাবারের লোভও যেন চলে গেছে তার। চেয়ারে পিঠ খাড়া করে শক্ত হয়ে বসে আছে তিনজনে। কোলের ওপর হাত রেখে।
আসলে হয়তো বোকা নই আমরা, কিশোর বলল। কিন্তু চালাকও নই। মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নেই আমাদের।
বোকা নই মানেটা কি? রবিন বলল। বোকাই আমরা।
একেকটা রামছাগল, মুসা বলল। গাধা। চেহারাটা গাধার মত হলে সারাক্ষণ ব্যা-ব্যাই করতাম।
কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করলেন আঙ্কেল জ্যাক। চোখের পাতা সরু করে টাইম ট্রাভেল চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালেন ওদের দিকে। আমাকে কি করতে বলো?
ইয়ে… বলতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল কিশোর। দ্বিধা করতে লাগল।
শেষে রবিন বলল, তুমি একজন বুদ্ধিমান লোক, তাই না আঙ্কেল? তুমি একজন বিজ্ঞানী।
মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক।
আর বিজ্ঞানীদের সারাক্ষণই মাথা খাটানোর কাজ করতে হয়, ঠিক?
আবার মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক।
এবং তুমি একজন ব্রেন স্পেশালিস্ট, তাই তো? আবার প্রশ্ন করল রবিন।
তৃতীয়বার মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক।
সেজন্যেই এসেছি আপনার কাছে, এতক্ষণে যেন কথা খুঁজে পেল কিশোর। কারণ আপনিই আমাদের বুদ্ধিমান বানানোর একটা উপায় বের করতে পারবেন।
আঙ্কেল, অনুরোধের সুরে বলল রবিন, সত্যিই কি আমাদের জন্যে তুমি কিছু করতে পারো না? বুদ্ধি খানিকটা বাড়িয়ে দিতে পারো না আমাদের?
চিবুক ডললেন আঙ্কেল জ্যাক। সোজা হলেন চেয়ারে।
হ্যাঁ, অবশেষে জবাব দিলেন তিনি, পারি। এমন একটা ওষুধ আমি দিতে পারি, যেটাতে মনে হচ্ছে কাজ হবে।
কি ওষুধ? একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল তিন গোয়েন্দা।
.
০৫.
আবার সামনে ঝুঁকলেন আঙ্কেল জ্যাক। জবাব দিতে গিয়ে হঠাৎ ঘুরে তাকালেন রান্নাঘরের দরজার দিকে।
কি হলো, আঙ্কেল? জানতে চাইল রবিন।
আবার ওদের দিকে ঘুরলেন তিনি। শুনলে না? মনে হয় চেরি। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন তিনি। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন আমাদের ওপর নজর রেখেছে কেউ।
দরজার দিকে তাকাল কিশোর। রবিন আর মুসার চোখও ঘুরে গেল সেদিকে। অস্বাভাবিক কোন কিছু চোখে পড়ল না।
কই? কিশোর বলল। দেখছি না তো কিছু।
কাঁধ ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক। টপ সিক্রেট কোন কাজ করার সময় সব বিজ্ঞানীরই বোধহয় এ রকম অনুভূতি হয়। সাদা সোয়েটশার্টের আস্তিন টেনে নামালেন তিনি। গভীর ভাবে ভাবছেন মনে হচ্ছে কোন বিষয় নিয়ে।
আঙ্কেল, অস্থির হয়ে উঠল রবিন, তোমার কি মনে হয় আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইলেন আঙ্কেল জ্যাক। তারপর জবাব দিলেন, আঁঃ..হ্যাঁ, পারব।
উত্তেজিত ভঙ্গিতে চেয়ারের হাতলে চাপড় মারল মুসা। সত্যি বলছেন? সত্যি পারবেন?
মাথা ঝাঁকালেন আঙ্কেল জ্যাক। হ্যাঁ। এ মুহূর্তে আমি অবশ্য এ ধরনেরই একটা জরুরী গবেষণায় ব্যস্ত। জিনিসটা তোমাদের ওপর প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু…
কিন্তু কি? আগ্রহে সামনে ঝুঁকে এল মুসা।
আবার রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকালেন আঙ্কেল জ্যাক। জিনিসটা ভীষণ বিপজ্জনক।
ঘন ঘন চোখের পাতা পিটপিট করল কিশোর।
অস্ফুট শব্দ করে উঠল রবিন।
ঢোক গিলল মুসা। তাহলে?
বিপজ্জনক হবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না, আবার বললেন আঙ্কেল জ্যাক। তবে হতেও পারে।
হোক বিপজ্জনক কিশোর বলল। কাজ হবে তো?
মাথা দোলালেন আঙ্কেল জ্যাক, হ্যাঁ, তা হবে। কাজ হতে বাধ্য। আমি টেস্ট করেছি। টেস্ট করা না থাকলে তোমাদের ওপর প্রয়োগ করতে যেতাম না মরে গেলেও।
তাহলে…তাহলে প্রয়োগ করে দেখোনা আমাদের ওপর, অধৈর্য হয়ে উঠল রবিন।
হ্যাঁ, করুন না, অসুবিধে নেই, কিশোর বলল। মুসাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বলো?
আমিও রাজি, মুসা বলল।
ভ্রূকুটি করলেন আঙ্কেল জ্যাক। আবার একবার হারিয়ে গেলেন গভীর চিন্তায়।
তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আচমকা ওদেরকে চমকে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বেশ। তাই করব। তোমাদের ওপর প্রয়োগ করব ওই ওষুধ। দেখা যাক, আমার গবেষণা কতখানি সফল হয়।