২১.

দেয়ালে হেলান দিয়ে ধাতব মেঝেতে বসে থাকল ওরা। চোখে শূন্য দৃষ্টি।

খাঁচার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল গাজুল আর মাজুল।

 পৌঁছে গেছি আমরা, গাজুল জানাল।

এমন ভঙ্গিতে কিশোর, মুসা আর রবিন তিনজনেই মাথা আঁকাতে লাগল যেন সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে।

কখন নামলাম? মুসার প্রশ্ন। কোন শব্দ তো শুনলাম না। ঝাঁকুনি তো লাগল না।

কতক্ষণ লাগল আসতে? রবিন অবাক। কখন রওনা হয়েছি, মনে করতে পারছি না।

হাতঘড়ির দিকে তাকাল কিশোর। এ জিনিসটা দিয়ে সম্ভবত সময় মাপা যায়। কিন্তু কি ভাবে মাপতে হয়, ভুলে গেছি।

খপ করে কিশোরের হাত চেপে ধরল রবিন। চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, একটা বড় কাটা দেখা যাচ্ছে। আরেকটা ছোট কাটা। কোনটা দিয়ে কি হয়, বলো তো?

হেই, বাজে বোকো না! ধমকে উঠল গাজুল। তোমাদের বকবকানি শোনার সময় আমাদের নেই। মনে করেছে তোমাদের চালাকি আমরা ধরতে পারিনি। খুব ভালমতই পেরেছি। আমরা জানি কতখানি বুদ্ধিমান তোমরা।

খাঁচার একটা শিক চেপে ধরল গাজুল। তালা খোলার শব্দ হলো। এক ধরনের গুঞ্জন। তারপর পিছলে সরে গেল কয়েকটা শিক লাগানো একটা ফ্রেম। খুলে গেল দরজা।

জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে গাজুল আর মাজুল।

আমি খুব উত্তেজিত বোধ করছি, মাজুল বলল।

আমিও করছি, গাজুল বলল। আর উত্তেজিত হবই না বা কেন। এত চমৎকার তিনটে গোলাম নিয়ে এসেছি মনিবের জন্যে। তিনি ভীষণ খুশি হবেন।

উত্তেজিত আমরাও হচ্ছি, কিশোর বলল। মনিব দেখব। কখনও তো দেখিনি। তা ভাই মনিব জিনিসটা কোন ধরনের জীব? শিং আছে? লেজ কয়টা?

রবিন বলল, তাই তো! মনিব দেখব। বাচ্চা মেয়ের মত হাততালি দিতে লাগল, কি মজা! কি মজা! মুসার দিকে তাকাল। মুসা, তোমার আনন্দ লাগছে না?

না, ভয়ে ভয়ে বলল মুসা। যদি কামড়ে দেয়?

চুপ! চুপ করো! গর্জে উঠল গাজুল। বেরোও। এসো আমাদের সঙ্গে। আমাদের প্লেন ল্যান্ড করেছে মনিবের গম্বুজের ভেতরে। বেরোতে বেশি দেরি করলে মনি ভীষণ রেগে যাবেন।

ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, গম্বুজের ভেতরে। বলেন কি! ঢুকল কি করে?

সে গেলেই দেখতে পাবে, গর্বের সঙ্গে জবাব দিল গাজুল। পরক্ষণে বদলে গেল মুখের ভাব। ধমক দিয়ে বলল, খবরদার, বেশি কথা বলবে না। তোমাদের মনে রাখা উচিত, তোমরা গোলাম। কোন প্রশ্ন করবে না। কৌতূহল দেখাবে না। কথা বলতে যখন বলা হবে শুধু তখনই বলবে। মনে থাকবে?

নাহ্, থাকবে না, জোরে নিঃশ্বাস ফেলে জবাব দিল কিশোর। কি জানি কি হয়ে গেছে আমাদের, কিছুই মনে থাকে না। যাকগে, মন নিয়ে অত চিন্তার কিছু নেই। তা আমাদের কাজটা কি? কি কি গোলামি করতে হবে?

মনিবের ব্যক্তিগত গোলাম হিসেবে তোমাদের কাজ হবে তার ল্যাবরেটরিতে থাকা, সারাক্ষণ সহযোগিতা করা। যেহেতু তোমরা অতিবুদ্ধিমান গোলাম, তোমরা তাঁর সমস্ত অংক করে দেবে, গাজুল বলল। কঠিন কঠিন সব ক্যালকুলেশন। অবশ্য সবই কম্পিউটারে। তোমরা…

আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিশোরের। কম্পিউটার! অংক! এগুলো আবার কি জিনিস?

তাকে ধমক লাগাল রবিন, গাধা নাকি! অংক কি জিনিস বোঝো না? নম্বর, নম্বর। একগাদা নম্বর।

নম্বর না, সংখ্যার হিসেব, অধৈর্য ভঙ্গিতে চিৎকার করে উঠল গাজুল।

কিন্তু নম্বরের হিসেব তো আমরা কিছুই জানি না, বোকার মত রবিন আর মুসার দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। কি ভাবে কি করব, বলো তো? শেষে আমাদেরকে তাড়িয়ে দেবেন মনিব…।

উঁহু, শিং দিয়ে গুতো মারবে, শুধরে দিল তাকে মুসা। গাজুল-মাজুল যে ভাবে মনিবের নামে ভয় পাচ্ছে, আমার মনে হয় তার শিংগুলো খুব চোখা আর বড় বড়…

এই থামবে তোমরা!  চিৎকার করে বলল মাজুল। গাজুলের দিকে ফিরল। ঘটনাটা কি বলো তো ওদের? এমন করছে কেন?

ও কিছু না, গাজুল জবাব দিল, ভয় পেয়েছে। ওদের কথায় কান দিও না। আমরা জানি ওরা কতখানি বুদ্ধিমান। চলো চলো, মনিবের সঙ্গে দেখাটা সেরে ফেলি।

হ্যাঁ, চলো।

তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাল গাজুল। কি হলো, হাঁ করে দেখছ কি? বেরোতে বললাম না? নাকি লেজারের শক দেয়া লাগবে।

নির্বোধের মত প্রশ্ন করল কিশোর, সেটা আবার কি জিনিস? শিঙের চেয়ে খারাপ?

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মাজুল। নাহ, মনে হচ্ছে ধরে প্রথমে ক্লিনিং রূমে নিয়ে যেতে হবে এগুলোকে। লাল রক্তের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছি না আমি।

তবে কি নীল রক্তও আছে? বেফাস প্রশ্ন করে ফেলল যেন কিশোর।

নীল নেই, তবে রূপালী রক্ত আছে। তোমাদের লাল রক্তের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী, নষ্ট প্রায় হয়ই না, আর রাসায়নিক পদার্থ পরিবহনের ক্ষমতাও লাল রক্তের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সত্যিই যদি তোমরা জান না করে থাকো, তোমাদের বুদ্ধি কমে গিয়ে থাকে, লাল রক্ত সব ফেলে দিয়ে দেহে রূপালী রক্ত ভরলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। নাও, চলো এখন।

গোলকযান থেকে ওদেরকে বের করে লম্বা একটা রূপালী হলওয়েতে নিয়ে এল গাজুল-মাজুল। ঘরের সব কিছুই যেন ক্রোম আর আয়নায় তৈরি। গোলকনটার মতই এখানেও সব কিছু চকচকে, যেন রূপালী আগুনের আভায় জ্বলছে।

হাঁটার সময় পায়ের শব্দ জোরাল হয়ে কানে বাজে। দ্রুত হাঁটছে গাজুল আর মাজুল। ওদের সঙ্গে সমতা রাখার জন্যে রীতিমত দৌড়াতে হলো তিন গোয়েন্দাকে।

চকচকে একটা ডাবল ডোরের সামনে এসে দাঁড়াল ওরা। দাঁড়াতেই আপনাআপনি যেন পিছলে নিঃশব্দে খুলে গেল দরজার পাল্লা। গাজুল-মাজুলের পিছু পিছু রূপালী একটা বড় বাক্সের মধ্যে এসে ঢুকল গোয়েন্দারা।

এই এলিভেটর আমাদেরকে ক্লিনিং রূমে নিয়ে যাবে, গাজুল বলল। মনে রাখবে, তোমরা গোলাম। কারও সঙ্গে কথা বলবে না তোমরা।

পেছনে নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ওপর দিকে ওটার টান অনুভব করল কিশোর। বুঝতে পারল ওপরে উঠছে এলিভেটর।

এত বুদ্ধিমান তিনটে ছেলেকে গোলাম হিসেবে ধরে এনেছি দেখলে কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না, খুশি খুশি গলায় গাজুলকে বলল মাজুল। মনিব আমাদের ওপর খুব খুশি হবেন। সবাই হিংসে করবে আমাদের। তাই না?

তা করবে, জবাব দিল গাজুল। ঝামেলা পাকানোর ওস্তাদ ওরা, বোঝ যাচ্ছে, তবে গোলাম হিসেবে খারাপ হবে না।

থামল এলিভেটর। দরজা খুলে গেল। পিঠে ধাক্কা তো মেরে নামতে আদেশ করা হলো তিন গোয়েন্দাকে। আরও বেশি উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত একটা হলওয়েতে নামল ওরা। কাঁচের মত চকচকে মসৃণ দেয়াল আর মেঝে থেকে আলোর আভা বেরোচ্ছে। আয়নার তৈরি ছাত। এত উজ্জ্বল, তাকানো যায় না সেদিকে। আপনা থেকেই চোখের পাতা বুজে আসে।

রবিনের শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ভয়ের শীল শিহরণ। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। হঠাৎ করেই ভাবনাটা চলে এল মাথায়, অন্য কোন গ্রহে নিয়ে আসা হয়নি তো ওদের? চারপাশের পরিবেশ তো বটেই, গাজুল-মাজুলের আচরণও সন্দেহজনক। ওদের কথাবার্তা ঠিক স্বাভাবিক মানুষের মত নয়। স্বাভাবিক মানুষের মত চিন্তা-ভাবনাও করে না ওরা। তারমানে অন্য কোন গ্রহেই ওদেরকে নিয়ে আসা হয়েছে! কিডন্যাপ করা হয়েছে ওদেরকে। ভিনগ্রহবাসীদের রাজার গোলাম বানানোর জন্যে।

মুসা কিছু ভাবতে পারছে না। আতঙ্কে চিন্তাশক্তিই যেন ভোতা হয়ে গেছে ওর।

আর লম্বা, চকচকে হলওয়ে ধরে হাঁটার সময় কিশোরের মনে হচ্ছে, বাস্তবে নেই ওরা, স্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সে জানে, এটা বাস্তব। মুসা আর রবিনের চেয়ে কম ভয় পাচ্ছে না সে।

হল পার হয়ে এসে মস্ত একটা ছড়ানো জায়গা। চারকোনা বাক্সের মত অসংখ্য ছোট ছোট ঘর। কাঁচের বাক্সের মত। তার ভেতরে গাজুল-মাজুলের মত ছোট ঘোট মানুষেরা শুয়ে আছে। যেন মানুষ বানানোর কারখানা এটা।

চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে তিন গোয়েন্দা। হাঁ হয়ে ঝুলে পড়েছে মুসার নিচের চোয়াল। বাক্সগুলোর উল্টো দিকের মস্ত দেয়ালের একটা দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। বেরিয়ে এল একজন মানুষ। যান্ত্রিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এই রোবটগুলোকে আনলে কোত্থেকে? এদের জন্ম তো এখানে হয়েছে বলে মনে হয় না।

না, এরা রোবট নয়, মানুষ, জবাব দিল গাজুল।

 অ! বিড়বিড় করল লোকটা।

কিন্তু মানুষ আনতে গেলে কেন? জিজ্ঞেস করল আরেকটা লোক। জ্বালাবে তো। জালিয়ে মারবে।

জ্বালানোর কারণটা বন্ধ করে নিলেই হবে, গাজুল বলল। তখন গোলাম হিসেবে এদের তুলনা হবে না। তাড়াতাড়ি করা দরকার। অপেক্ষা করতে করতে মনিব শেষে খেপে যাবেন।

আরেকটা ওরকম বাক্সওয়ালা ঘর পেরিয়ে এল ওরা। এটার মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত বোঝাই কাঁচের বাক্স। সবগুলো মানবশিতে ভর্তি। যেন ইনকিউবেটরে রাখা ডিম ফুটে মুরগীর বাচ্চা বেরোনোর মত করে জন্ম দেয়া হয়েছে এই শিশুদের।

দূর থেকে অদ্ভুত বাজনার শব্দ ভেসে এল। বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে কাঠ চেরাই করার সঙ্গে মৌমাছির গুঞ্জন মিশিয়ে দিলে যে রকম শুনতে লাগবে, শব্দটা অনেকটা সেই রকম। একঘেয়ে। শুনতে শুনতে কেমন যেন ঝিম ধরে আসে।

এই যে এটাই, একটা বিশাল ঘর দেখিয়ে বলল গাজুল। এসে গেছি ক্লিনিং রূমের কাছে। এখানেই তোমাদেরকে ধোলাই করা হবে। ডানে ঘোররা।

থেমে গেল কিশোর। ডানে-বাঁয়ে তাকাতে লাগল। ডানদিকটা কোন দিকে? বুঝতে পারছি না তো। ডান কোনদিকে হয়?

তাই তো! হাবার মত চারপাশে তাকাতে লাগল মুসা। ডান কোনটা?

হাত তুলে দুদিকে দেখিয়ে মুসাকে বোঝাতে চাইল রবিন, একবার এদিকে ডান। একবার এদিকে ডান। চতুর্দিকই ডান দিক। কিন্তু কোনদিকে যাব কিভাবে মনে রাখব? কোনদিকে যাচ্ছি, সেটা মনে রাখা তো আরও কঠিন।

থামো! চিৎকার করে উঠল গাজুল। এ সব বদমাশি বন্ধ করো! বোকামির ভান করে এখনও ফাঁকি দেবার চেষ্টা। ভেবেছ আমি কিছু বুঝতে পারছি না, না? এসো, এদিক দিয়ে এসো।

বড়, উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত একটা ঘরে ওদেরকে ঠেলে দিল সে। বড় বড় রূপালী রঙের ধাতব টেবিল সাজানো রয়েছে ঘরটাতে। দেয়াল ঘেঁষে বসানো অদ্ভুত সব ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছে টেকনিশিয়ানরা।

দেয়ালের সাইজ দেখে মনে হয় মাইলখানেক লম্বা। আয়না বসানো ছাতের কাছাকাছি বেরিয়ে থাকা ঝোলা বারান্দার মত দেখতে ক্যাটওয়াকে চলাফেরা করছে টেকনিশয়ানরা। ওখানেও যন্ত্রপাতি বসানো। নানা ধরনের শব্দ বেরোচ্ছে ওগুলো থেকে। তবে কোনটাই তেমন উচ্চকিত কিংবা জোরাল নয়। কানে পীড়া দেয় না।

তার নিজের চেয়ে লম্বা আরেকজন লোককে হাতের ইশারায় ডাক দিল। গাজুল। লোকটা কাছে এলে বিজাতীয় ভাষায় তাকে কি যেন বলতে লাগল সে। এক বর্ণও বুঝতে পারল না তিন গোয়েন্দা।

কথা শেষ হলে ওদের দিকে ফিরে তাকাল সে। নতুন গোলামদের দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছেন মনিব। প্রথমে তোমাদের ভেতরের যন্ত্রপাতি সব ধোলাই করে সাফ করা হবে। তবে প্রথমেই সেটা করতে গেলে মারা যেতে পারো তোমরা, তাই দেহের সমস্ত লাল রক্ত বের করে ফেলে রূপালী রক্ত ভরতে হবে আগে, আমাদের মত। রূপালী রক্ত ভীষণ টেকসই। যত ধোলাইই করা হোক না কেন, মরবে না তখন আর। বুদ্ধিতেও কোন রকম গোলমাল যদি থেকে থাকে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আবার লম্বা লোকটার দিকে ফিরে তাকিয়ে কি যেন বলল গাজুল।

দেয়ালের দিকে ফিরে তিনজন লোককে ডেকে কথা বলল লম্বা লোকটা। অদ্ভুত সেই ভাষার এক বর্ণও বুঝতে পারল না তিন গোয়েন্দা। গাট্টাগোট্টা তিনজন লোক এগিয়ে এল। হাতে তিনটে কিম্ভুত যন্ত্র। প্রতিটি যন্ত্র থেকে একটা করে মোটা নল বেরিয়ে আছে। নলের মাথায় চোখা সুচের মত জিনিস। সেগুলো গোয়েন্দাদের দিকে বাড়িয়ে দিল ওরা।

কি-কি-কি করছেন আপনারা! চিৎকার করে উঠল কিশোর।

ভয় নেই, ডান হাতটা বাড়াও তো, গাজুল বলল। একটুও ব্যথা পাবে না। সুচের মাথায় ব্যথানিরোধক লাগানো আছে। এক দিক দিয়ে তোমাদের লাল রক্ত বেরোতে থাকবে, আরেক দিক দিয়ে রূপালী রক্ত ঢুকবে। দেখবে, দুনিয়াটাই পাল্টে গেছে তখন। খুব আরাম পাবে। নাও, হাতটা বাড়াও। তাড়াতাড়ি করো। মনিব অপেক্ষা করছেন।

মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। ওদের চোখেও আতঙ্ক।

কিশোর বলল, তারমানে…তারমানে আপনাদের দেহেও রূপালী রক্ত?

হেসে মাথা ঝাঁকাল গাজুল। হ্যাঁ। আমাদের দেহে আর যন্ত্রপাতিতে আরও কিছু পরিবর্তন আছে, যেগুলো তোমাদের নেই। আমাদের মগজটাও অন্য রকম, তোমাদের মত না।

কোনও ধরনের রোবট না তো? কথাটা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল রবিনের।

মাথা ঝাঁকাল গাজুল, তা বলতে পারো। রোবটমানব। তবে রোবট হয়ে অসুবিধে নেই। মানুষ হওয়ার চেয়ে রোবট হওয়া অনেক শান্তির। কথা অনেক হলো। নাও, দেখি, ডান হাতটা বাড়াও তো এখন। আধঘণ্টার মধ্যেই দুঃখ-কষ্ট, বাড়ির জন্যে মন কেমন করা-কোন কিছুই থাকবে না আর তোমাদের।

.

২২.

কিশোরের হাতটা ধরার জন্যে হাত বাড়াল একজন রোবটমানব।

চিৎকার করে উঠল কিশোর, না না!

ততক্ষণে রবিনের হাত চেপে ধরেছে একটা রোবট।

কিন্তু মুসাকে ধরতে যেতেই আচমকা ঘুরে দৌড় মারল সে। চিৎকার করে বলতে লাগল, কিশোর, রবিন, পালাও?

রূপালী টেবিলগুলোর ফাঁক-ফোকর দিয়ে ছুটতে থাকল ওরা। প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না কর্মরত রোবটরা। তারপর গাজুলের চিৎকারে তাড়া করে এল কয়েকজন।

ফিরে তাকাল কিশোর। গাজুল-মাজুল সহ আরও সাত-আটটা রোবট ওদের পিছু নিয়েছে।

প্রাণপণে ছুটতে লাগল তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে এল আরেকটা আয়না বসানো চকচকে হলরূমে। এত উজ্জ্বল, এত তীব্র আলো, চোখ মেলে রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

কোথায় যাচ্ছি? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল রবিন।

জানি না! জবাব দিল কিশোর। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, কোথায় যাচ্ছি কি করে বলব?

অন্ধের মত হোঁচট খেয়ে পড়ল সামনের দিকে। দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিৎকার বেরিয়ে এল আপনাআপনি।

সাড়াশির মত কঠিন আঙুল চেপে ধরল ওকে পেছন থেকে।

ছাড়া পাওয়ার জন্যে চিৎকার-চেঁচামেচি, ধস্তাধস্তি শুরু করল সে।

কিন্তু ধরা পড়ে গেছে। রবিন আর মুসাও ছাড়া পাওয়ার জন্যে চিৎকার করছে। হাত-পা ছুঁড়ছে। লাভ নেই। রোবটমানবেরা ওদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।

কাছে এসে দাঁড়াল গাজুল-মাজুল।

গম্ভীর কণ্ঠে গাজুল বলল, অকারণ চেষ্টা, গোলামেরা। এখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে আর পারবে না তোমরা কোনমতেই।

বাড়ি যাওয়া আর হবে না তোমাদের কোনদিন, হাসতে হাসতে বলল মাজুল। আর যদি হয়ও, লাল রক্ত নিয়ে যেতে পারবে না। রূপালী রক্ত নিয়ে যেতে হবে। তা-ও কোনও অপারেশনে, যদি মনিব মনে করেন তোমাদেরকে পাঠানো দরকার।

দরজার দিকে ফিরে তাকাল গাজুল। যন্ত্রহাতে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সেই তিনজন রক্তবদণকারী টেকনিশিয়ান। হাত নেড়ে তাদেরকে ডেকে বলল গাজুল, এসো। বদলে দাও।

তিন গোয়েন্দাকে যারা ধরেছে তাদের উদ্দেশে বলল সে, শক্ত করে ধরে রাখো। ছাড়বে না।

দরজায় দাঁড়ানো একজন টেকনিশিয়ান বলল, এখানে না বদলে ক্লিনিং রূমেই নিয়ে এসো না। রক্ত বদলানোর পর তো ধোলাই করার জন্যে সেখানে নিতেই হবে।

কি যেন ভাবল গাজুল। তারপর বলল, ঠিক আছে, নিয়ে চলো।

আবার ক্লিনিং রূমে নিয়ে আসা হলো তিন গোয়েন্দাকে। রূপালী টেবিলে তোলা হলো। চিত করে শুইয়ে দিয়ে হাত-পা চেপে ধরা হলো।

যন্ত্রের সুইচ টিপে দিতে লাগল টেকনিশিয়ানরা। মৃদু গুঞ্জন তুলে চালু হয়ে গেল মেশিন। সবার চোখ এখন এদিকে। ক্যাটওয়াকে যারা কাজ করছিল, কাজ। থামিয়ে দিয়ে তারাও তাকিয়ে আছে।

আর…আর বোধহয় বাঁচতে পারলাম না, গুঙিয়ে উঠল মুসা। গাজুল ঠিকই বলেছে। আমরা শেষ।

ফুঁপিয়ে উঠল রবিন। কান্নার মত স্বর বেরোল গলা থেকে।

কিশোর তাকিয়ে আছে তার পাশে দাঁড়ানো রোবটমানবের হাতের যন্ত্রটার দিকে। সুচের মত জিনিসটা তার ডান হাতের ওপর নিয়ে এসেছে রোবট। হাতের শিরা খুজছে ফুটিয়ে দেয়ার জন্যে।

চামড়া স্পর্শ করল সুচ।

তীক্ষ একটা ব্যথা।

 শিরার মধ্যে বিধে গেল সুচ।

শীতল আতঙ্ক যেন গ্রাস করল কিশোরকে। অবশ হয়ে এল হাত-পা। মাথার মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি। মুক্তির আর কোন উপায় নেই। কিছুই করার নেই। আর। হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল।

ঠিক এই সময় ক্যাটওয়াকের কাছ থেকে গমগম করে উঠল একটা ভারী কণ্ঠ, কোথায়? কই? কাদের নিয়ে আসা হয়েছে?

কণ্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগল কিশোরের।

চোখ মেলল আবার।

ক্যাটওয়াকের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠের মালিককে দেখেই স্থির হয়ে গেল। বুঝতে পারল কেন চেনা চেনা লাগছিল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

ক্যাটওয়াকে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং ডক্টর মুন! মহাক্ষমতাধর অসাধারণ ক্ষমতাশালী সেই বিজ্ঞানী, যার সঙ্গে বহুবার মোলাকাত হয়েছে ওদের।

ডক্টর মুনকে দেখে নিশ্চিত হলো রবিন, ভিনগ্রহে নয়, পৃথিবীতেই রয়েছে ওরা, ডক্টর মুনের কোনও গোপন আস্তানায়।

তিন গোয়েন্দাকেও দেখতে পেলেন ডক্টর মুন। বিমল হাসি ফুটল তাঁর মুখে। আদেশ দিলেন, অ্যাই ছাড়ো। ছেড়ে দাও ওদের।

বিনীত ভঙ্গিতে গাজুল বলল, রক্ত বদলানো এখনও শেষ হয়নি, মালিক।

না হোক, আদেশ দিলেন: ডক্টর মুন। নিয়ে এসো ওদেরকে আমার চেম্বারে।

রবিনের দিকে ফিরে তাকিয়ে ফিসফিস করে মুসা বলল, মনে হচ্ছে বেঁচে গেলাম এ যাত্রা।

কি জানি! জবাব দিল রবিন। কিংবা হয়তো আরও বড় কোন বিপদে পড়তে যাচ্ছি। ডক্টর মুনকৈ আমরা যে পরিমাণ ভুগিয়েছি এতকাল, এবার নিশ্চয় প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বেন না।

সাদা আলো জ্বলছে ডক্টর মুনের চেম্বারে। তবে ক্লিনিং রূমের মত এত উজ্জ্বল চোখ ধাঁধানো নয়, চোখে পীড়াদায়কও নয়।

ঘুরে গিয়ে মস্ত ডেস্কের ওপাশে বসলেন ডক্টর মুন। তার দুই পাশে গিয়ে দাঁড়াল দুজন বডিগার্ড। ওরা স্বাভাবিক লাল রক্তের মানুষ নাকি রোবটমানব, দেখে বোঝার উপায় নেই। গম্ভীর, ভাবলেশহীন চেহারা।

তিন গোয়েন্দাকে ধরে নিয়ে ঘরে ঢুকেছে তিনজন প্রহরী। তাদের সঙ্গে গাজুল-মাজুল।

ডেস্কের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো গোয়েন্দাদেরকে। হাসিমুখে তাদের দুই পাশে এসে দাঁড়াল গাজুল-মাজুল।

আপনার জন্যে নতুন গোলাম নিয়ে এলাম, মালিক, মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করে বলল গাজুল।

ভীষণ বুদ্ধিমান ওরা, যোগ করল মাজুল।

ভুরু কুঁচকে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে রইলেন ডক্টর মুন। কিন্তু ওরা বুদ্ধিমান হয় কি করে? ওদেরকে তো বোকা বানিয়ে দিয়েছিলাম আমি।

বুঝতে পারল না গাজুল। বোকা বানিয়ে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, ডক্টর মুন বললেন। আমাদের একটা টাইম ট্র্যাভেল মেশিন নিয়ে পালিয়েছিল ওরা। নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছিল লেকের পানিতে। ওটাতে চড়েই কিছুদিন আগে ফিরে এসেছিল আবার।

তারপর? কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল গাজুল।

মগজের মান নামানোর ওষুধ দিয়ে দিলাম বোকা বানিয়ে। ফেরত পাঠিয়ে দিলাম বাড়িতে। ওরা আমার পুরানো শত্রু। আমার কাজে বার বার বাগড়া দিয়েছে। বহু ক্ষতি করেছে। মেরে ফেলা যেত, কিন্তু তার কোন প্রয়োজন মনে করলাম না। এমন একটা কিছু করে দিতে চাইলাম, যাতে আমার কোন ক্ষতি করতে না পারে আর কোনদিন। ভাবলাম, কি করলে সেটা সম্ভব? বোকা বানিয়ে দিলে। বুদ্ধি না থাকলে আমার বিরুদ্ধে লাগতে পারবে না আর কখনও।

হাসিমুখে গাজুল জানাল, শাস্তি ওদের ভালমতই হয়েছে, মালিক। স্কুলে টিচার, বন্ধু-বান্ধবরা সারাক্ষণ ওদের নিয়ে দূর-দূর ছ্যা-ছ্যা করেছে, ইয়ার্কি মেরেছে, হাসাহাসি করেছে। তবে ইদানীং সেই অবস্থাটা আর ছিল না। তবে ওদের ভয় পাওয়া শুরু করেছিল পরিচিতজনেরা। ফ্রীক ভাবতে আরম্ভ করেছিল।

তার মানে?

মগজশক্তি রসায়ন দিয়ে বুদ্ধিমান বানিয়ে ফেলেছি। এত বেশি বুদ্ধিমান হয়ে গেছে ওরা এখন, ওদের বুদ্ধিমত্তার যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে স্কুল থেকেই বের করে দিয়েছে ওদেরকে টিচাররা। বন্ধু-বান্ধবরা ভয়ে মিশতে চায় না। খুব ভাল গোলাম হবে আপনার, মালিক।

হুঁ, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলালেন ডক্টর মুন। ভুল করেছ। মস্ত ভুল। স্বাভাবিক বুদ্ধি যখন ছিল এদের, তখনই এরা আমার ক্ষতি করেছে একের পর এক। আগের চেয়েও বুদ্ধি যদি বেড়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো দানবে পরিণত হয়েছে এখন। এদের এত বুদ্ধিমান রাখা যাবে না কোনমতেই। আমার ল্যাবরেটরিই ধ্বংস করে দিয়ে বেরিয়ে যাবে কোনদিন। তবে ওষুধ খাইয়ে যখন ফেলেছই, দেখা যাক কি রকম বুদ্ধিমান ওরা হয়েছে, তারপর আবার বোকা বানিয়ে দিলেই হবে। আর স্মৃতিশক্তিটাও ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে।…কিশোর পাশা, বলো তো আমি কে?

আপনি আমাদের মালিক, নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিল কিশোর।

মুসা, রবিন, তোমরা বলো তো আমি কে?

 আপনি গাজুল-মাজুল-হাজুল-বাজুল সবার মালিক, জবাব দিল মুসা।

রবিন বলল, আপনি রোবটমানব টাকরাভুম ওরফে গাকরা মিয়া।

রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠল ডক্টর মুনের চোখে। কোনমতে দমন করলেন। ঝট করে তাকালেন একবার গাজুল-মাজুলের দিকে। কুঁকড়ে গেল ওরা।

গাজুল বলল, ওরা বোকা সাজার ভান করছে। কিন্তু গলায় জোর নেই তার।

মাজুল বলল, মালিক, ওদের অংক দিয়ে দেখুন। মুহূর্তে করে ফেলবে। যত কঠিনই দেন না কেন।

আবার কিশোরের দিকে তাকালেন ডক্টর মুন। দুই আঙুল তুলল। বল তো এখানে কটা আঙুল?

নির্দ্বিধায় জবাব দিল কিশোর, সাড়ে দশটা।

মুসাকে জিজ্ঞেস করলেন ডক্টর মুন, তুমি বলো, দুই আর তিন যোগ করলে কত হয়।

বিশ।

হাঁদারাম! ধমকে উঠল রবিন। দুই আর তিন যোগ করলে বিশ হয় নাকি? একুশ হয়, একুশ একুশ।

 আরে কি শুরু করলে কি তোমরা? কিশোর বলল। আমরা যে বুদ্ধিমান হয়ে গেছি, এটা বুঝিয়ে দিতে চাও নাকি? তাহলে তো ধরে গোলাম বানাবে।

তাড়াতাড়ি জিভ কাটল রবিন, না না, তা কেন বোঝাব। এই মুসা, দুইয়ে আর তিনে এগারো হয়, বুঝলে? বারো বললেও অবশ্য ভুল হবে না।

হা-হা করে হাসল কিশোর। গাধাটা কি বলেরে!

গাধা! গাধা! করে সমানে চেঁচাতে লাগল মুসা আর রবিন। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাবার মত হি-হি করে হাসতে লাগল।

যথেষ্ট হয়েছে। চিৎকার করে উঠলেন ডক্টর মুন। থামো!

রাগত চোখে গাজুলের দিকে অকালেন আবার তিনি। ঘামতে আরম্ভ করেছে গাজুল।

কর্কশ কণ্ঠে ডক্টর মুন বললেন, কি, কোথায় বুদ্ধিমান? আগের চেয়ে তো হাদা হয়েছে আরও। এত বোকা তো আমিও বানাইনি। বললাম না মগজশক্তি রসায়ন লাল রক্তে কাজ করে না।

হাত কচলে গাজুল বলল, কিন্তু মালিক, আমি সত্যি বলছি, বুদ্ধিমত্তার জন্যে ওদেরকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে।

তাহলে বোকা হলো কি করে? ভুরু নাচালেন ডক্টর মুন।

 ধীরে ধীরে পেছনে সরে যেতে লাগল মাজুল।

ধমকে উঠলেন ডক্টর মুন, যাচ্ছ কোথায়?

পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মাজুল।

কঠিন কণ্ঠে গাজুল-মাজুলের উদ্দেশে বললেন ডক্টর মুন, নিশ্চয় রিঅ্যাকশন হয়েছে ওষুধে। আমি নিশ্চিত, লাল, রক্তে কাজ করে না এই ওষুধ। আর করলেও বেশিদিন কার্যকর থাকে না। গর্জে উঠলেন হঠাৎ তোমাদের পাঠানো হয়েছে স্বাভাবিক মগজের বুদ্ধিমান মানুষকে ধরে আনতে। এ কাকে নিয়ে এলে তোমরা? কে বলেছিল আমি নিজে হাঁদা বানিয়ে রাখা কতগুলো ছেলেকে ওষুধ খাইয়ে বুদ্ধিমান বানিয়ে ধরে আনতে? তোমরা আমাকে ঠকিয়েছ!

ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল গাজুল আর মাজুল।

করজোড়ে বলল গাজুল, ভুল হয়ে গেছে, মালিক। এবারের মত মাফ করে দিন।

ডক্টর মুন বললেন, ভাল করেই জানো তোমরা এখানকার নিয়ম। এখানে ভুলের কোন ক্ষমা নেই। বিজ্ঞান গবেষণায় সামান্যতম ভূলও বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। তোমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে আরও বড় কোন ভুল করে বসবে। আমার ল্যাবরেটরিতে এ ধরনের রিস্ক আমি নিতে পারি না। কষ্ট করার ভয়ে হাতের কাছে পাওয়া বোকাদেরকে ওষুধ খাইয়ে যারা বুদ্ধিমান বানানোর চেষ্টা করে, তাদের মত অলসদের দিয়ে আমার কোন উপকার হবে না।

ডেস্কের ড্রয়ারের দিকে ডান হাতটা নেমে গেল ডক্টর মুনের।

কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝে গিয়ে চিৎকার করে উঠল গাজুল, না না, মালিক, আর কোনদিন ভুল হবে না…

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই হাতটা বেরিয়ে এল আবার ডক্টর মুনের। হাতে একটা বড় পিস্তলের মত অস্ত্র। গাজুলের দিকে তাক করে টিপে দিলেন ট্রিগার। নলের মুখ থেকে বেরিয়ে এল একটা সাদা আলোকরশ্মি।

মুহূর্তে নেই হয়ে গেল গাজুল। সে যেখানে ছিল সেখানে টেনিস বলের সমান একটা রূপালী ধোঁয়ার কুণ্ডলী তৈরি হলো। ধীরে ধীরে উঠে যেতে লাগল ছাতের দিকে।

ঘুরে দরজার দিকে দৌড় মারল মাজুল।

কিন্তু দুই পা-ও যেতে পারল না। সাদা আলোকরশ্মি এসে লাগল তার পিঠে। চোখের পলকে গাজুলের অবস্থা হলো তারও।

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। ডক্টর মুন বাদে সবার চোখে আতঙ্ক দেখতে পেল।

অস্ত্রটা আবার ড্রয়ারে রেখে দিলেন ডক্টর মুন। প্রহরীদের বললেন, নিয়ে যাও এদের। টেকনিশিয়ানদের বলো, রক্ত বদলাক, কিংবা যত খুশি পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাক এদের ওপর। যদি কাজের উপযুক্ত করতে পারে, ভালো, নয়তো গায়েব করে দিক। হাবা দিয়ে আমাদের কোন কাজ হবে না। ওদের বাড়িতে ফেরত পাঠানোরও আর কোন যুক্তি নেই। যাও, নিয়ে যাও।

.

২৩.

আবার ক্লিনিং রুমে নিয়ে আসা হলো তিন গোয়েন্দাকে।

ঘরে ঢুকেই ঝাড়া দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল মুসা। কিশোরকে যে রোবটটা ধরেছে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিশোরকে ছাড়ানোর পর দুজনে মিলে রবিনকে ছাড়াল। তারপর দিল দৌড়।

আচমকা মুসাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রবিনকে লক্ষ্য করে ডাইভ দিল কিশোর। তাকে সঙ্গে নিয়ে পড়ল মেঝেতে। ঠিক ওই মুহূর্তে দুটো সাদা আলোকরশ্মি ছুটে গেল ওদের মাথার ওপর দিয়ে। অল্পের জন্যে বাঁচল।

ঘাড় ফিরিয়ে মুসার কি অবস্থা দেখল কিশোর।

মুসাও উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মাটিতে।

হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ছুটতে শুরু করল ওরা। পালানোর পথ খুঁজছে।

কোন পথ দেখতে পেল না।

পালানোর কোন উপায় নেই।

একধারে জটলা করছে কয়েকজন রোবটমানব। সেদিকে গেলে ধরা পড়তে হবে নিশ্চিত।

এখানে থাকলে

কিন্তু ভাবার সময় পেল না কিশোর। চিৎকার করে উঠল, সরে যাও!

আবার তিনটে আলোকরশ্মি ছুটে এল ওদের দিকে। অল্পের জন্যে বাঁচল এবারও। কাঁধে আগুনের আঁচের প্রচণ্ড তাপ লাগল কিশোরের। রশ্মিটা সামান্য নিচে নামলেই গায়ে লাগত তার, হাওয়া হয়ে যেত সে।

এদিকে দিয়ে এসো! চিৎকার করে উঠল মুসা।

হতভম্ব একজন রোবট-টেকনিশিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাঁক নিয়ে কতগুলো বাক্সের পেছনে ঢুকে গেল সে। রবিন ছুটল তার পেছনে।

ক্ষণিকের জন্যে ফিরে তাকাল কিশোর! এগিয়ে আসছে তিন প্রহরী। ওদের হাতে লেজার-পিস্তল উদ্যত। কিন্তু ট্রিগার টিপতে সাহস পাচ্ছে না। কেন সেটা বোঝা যাচ্ছে। টিপলেই রশ্মি গিয়ে লাগবে কাঁচের বাক্সের গায়ে। হাওয়া হয়ে যাবে বাক্সে ভরে রাখা রোবটশিশুরা।

মুসা আর রবিনের মত কিশোরও কাজে লাগাল সুযোগটা। ছুটে বাক্সের পেছনে চলে এল।

দরজাটা চোখে পড়ল। সেদিকেই ছুটছে মুসা আর রবিন। বেরোনো• যাবে ওটা দিয়ে? পেছন থেকে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চেষ্টা করে দেখা যাক। আর তো কোন উপায়ও নেই। ছোটা বন্ধ করল না মুসা।

পেছনে কানে আসছে চিৎকার আর পদশব্দ। দরজার কাছে সময়মত পৌঁছতে পারবে কিনা বুঝতে পারল না কিশোর। ভারী দম নিল সে। তারপর প্রাণপণে ছুটতে শুরু করল দরজাটার দিকে। ছোটাও কঠিন। আয়না বসানো মেঝেতে পিছলে যেতে চায় পা।

ওদের ধরতে না পারায় হই-হট্টগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। দুপদাপ পা ফেলে ছুটে আসছে বহু লোক।

খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মুসা আর রবিন। ওদের সামান্য পরেই কিশোরও বেরোল।

কানে এল মুসার চিৎকার। পরক্ষণেই রবিনের। দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে। মুসা। সামলাতে না পেরে তার গায়ের ওপর গিয়ে পড়েছে রবিন।

সামনে খোলা জায়গা নেই। দরজাও নেই।

মরিয়া হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর, আলমারি! একটা আলমারিতে ঢুকেছি আমরা।

তারমানে দরজাটা ছিল মস্ত আলমারির।

 আর কোন পথ নেই, ককিয়ে উঠল রবিন। আটকা পড়লাম!

আলমারির দেয়ালে রূপালী রঙের একটা হাতলের ওপর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। কিশোরের। আচমকা হাত বাড়িয়ে হাতলটা ধরে হ্যাঁচকা টানে নিচে নামিয়ে দিল।

মুহূর্তে দুদিক থেকে পিছলে সরে এসে লেগে গেল আলমারির দরজা। চালু হয়ে গেল আলমারি।

চেঁচিয়ে উঠল মুসা, আলমারি নয়, আলমারি নয়, কোন ধরনের লিফট।

অনন্তকাল ধরে যেন নেমেই চলল লিফটটা। আসলেই চলছে কিনা যখন সন্দেহ হতে লাগল ওদের, ঠিক সেই সময় ঝাঁকি লাগল। স্থির হয়ে গেল লিফট। পিছলে দুদিকে সরে গিয়ে আবার খুলে গেল দরজা।

লিফট থেকে বেরিয়ে এল ওরা।

ফুটবল মাঠের সমান বিশাল একটা জায়গায় ঢুকল। কাঁচে ঢাকা মস্ত গম্বুজের মত ছাত। অসংখ্য গোলকশান দেখতে পেল সেখানে। সারি দিয়ে রাখা। হেলিকপ্টার কিংবা বিমান রাখার ছাউনির মতই এটা গোলকন রাখার ছাউনি। গোলকগুলোর গায়ে নাম লেখা টাইম ট্রাভেল। আলাদা করে বোঝার জন্যে নম্বর দেয়া রয়েছে, যেমন টাইম ট্রাভেল-১, টাইম ট্রাভেল-২, ইত্যাদি।

সেগুলোর দিকে ছুটল ওরা।

একটা গোলকের ওপর চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল রবিন। এই কিশোর, দেখো, আমাদেরটা না? নম্বর মিলে যাচ্ছে।

নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর। গোলকশানটার দিকে তাকিয়ে বলল, সে রকমই তো মনে হচ্ছে। আমাদের নয় ওটা, ডক্টর মুনের। তবে ওটাই নিয়ে গিয়ে লেকের পানিতে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমরা।

গোলকনটার দিকে দৌড় দিল সে।

এ জিনিস চালানোর ওস্তাদ হয়ে গেছে এখন মুসা। দরজা খুলে উঠে পড়ল। কিশোর আর রবিন উঠে বসতেই লাগিয়ে দিল দরজাটা। প্রথমেই টিভি মনিটরটা অন করে দিল। ল্যাবরেটরির ভেতর থেকে ছুটে বেরোতে দেখল প্রহরীদের।

কিশোরের দিকে তাকাল মুসা, কোন সুইচটা টিপব? আজ আর ভুল করতে রাজি না।

সেদিনকার কথাটা মনে পড়ে গেছে এখন তিনজনেরই। কিশোর বুঝতে পারল, বুদ্ধি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারানো স্মৃতিও ফেরত এসেছে। প্রচণ্ড গরম পড়েছিল সেদিন। মুসা প্রস্তাব দিয়েছিল, লেকের পাড় থেকে হাওয়া খেয়ে আসতে। কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে নিষিদ্ধ এলাকায় ঢুকতেই গোলক্যানটার কথা পাড়ল কিশোর। অনেকদিন চড়া হয় না। লেকের পানিতে লুকানো আছে। পানি থেকে তুলে চেপে বসেছিল ওটাতে ওরা। কিশোর প্রস্তাব দিয়েছিল, চড়াই যখন হলো, বেড়িয়ে আসা যাক। কিন্তু কোথায় বেড়াবে? অনেক সুইচের মধ্যে বড় একটা লাল সুইচ আছে। সেটাই টেপার সিদ্ধান্ত নিল। যা থাকে কপালে ভেবে ওই সুইচটাই টিপে দিয়েছিল। এবং তারপর তো কয়েক মাস ধরে চরম ভোগান্তি••এখানে আসার পর ডক্টর মুন ওদেরকে বোকা করে কাউকে সঙ্গে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের গোলকনিটা রেখে দিয়েছিলেন এখানেই…

আরে বলো না, কোনটা টিপব? মুসার উত্তেজিত কণ্ঠ ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল কিশোরকে। জলদি বলো! চলে এসেছে তো ওরা।

নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন চিমটি কাটতে লাগল কিশোর। মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখল গোলকযানের কাছাকাছি চলে এসেছে প্রহরীরা। বলল, লালটাই টেপো আবার। টেলিভিশনের সুইচ অন-অফ করার মত মনে হচ্ছে জিনিসটা। একবার টিপলে অন, পরের বার টিপলে অফ। একবার টিপে ডক্টর মুনের। হেডকোয়ার্টারে পৌঁছেছি, নিশ্চয় দ্বিতীয়বার টিপলে আগের জায়গায়-অর্থাৎ যেখান থেকে এসেছে সেই লেকের পানিতে ফিরে যাবে যানটা।

যদি না যায়? অন্য কিছু করে? রবিন বলল।

কিছুই করার নেই, জবাব দিল কিশোর। এখানে থাকলেও মরতে হবে। তারচেয়ে চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি। ঝুঁকিটা নিতেই হবে।

হাত বাড়াল মুসা।

একবার দ্বিধা করে টিপে দিল লাল সুইচটা।

কয়েকটা সেকেন্ড যেন কিছুই ঘটল না। তারপর একটা ঝাঁকুনি। মনিটরে দেখা গেল চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল প্রহরীরা। তারমানে গম্বুজ থেকে বেরিয়ে এসেছে গোলকন।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিশোরের দিকে তাকিয়ে রবিন বলল, ভাগ্যিস বোকার অভিনয় করার বুদ্ধিটা বের করেছিলে। আর কোনভাবেই ফাঁকি দেয়া যেত না ওদের।

হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল মুসা, আমার অভিনয়টা কেমন হয়েছে?

এত বাস্তব অভিনয় হলিউডের সবচেয়ে বড় অভিনেতারাও করতে পারবে কিনা সন্দেহ, হেসে বলল কিশোর। ডক্টর মুন তো বটেই, গাজুল-মাজুলের মত রোবটমানবেরাও শেষ পর্যন্ত সেই ফাঁকিতে পড়ে গেল। এরচেয়ে ভাল অভিনয় আর কি হতে পারে?

ঝপ করে পানিতে পড়ার শব্দ হলো একসময়। মনিটরে দেখতে পেল ওরা একটা পরিচিত লেক।

পানিতে ফাপা বলের মত ভেসে রইল গোলকযানটা।

নিরাপদেই রকি বীচে ফিরে এসেছে। কিন্তু বিশ্বাস হতে চাইছে না ওদের। শেষে দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে এল রবিন।

জরুরী কণ্ঠে কিশোর বলল, তাড়াতাড়ি এটা ডুবিয়ে দিয়ে চলো পালাই এখান থেকে। বলা যায় না, যে কোন মুহূর্তে টাইম ট্রাভেলার নিয়ে আমাদেরকে ধরতে হাজির হয়ে যেতে পারে ডক্টর মুনের রোবটবাহিনী। চলো চলো, জলদি করো!

যানটাকে তীরের কাছাকাছি নিয়ে আসা হলো। সুইচ টিপে লম্বা মইয়ের মত সিঁড়ি বের করে তীরে ঠেকাল মুসা। নেমে পড়ল তিনজনে। বাকি কাজ। এখন রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে সারতে হবে। পকেট থেকে ছোট্ট যন্ত্রটা বের করল কিশোর। গোলক্যানের কন্ট্রোলবোর্ডের ওপরেই রাখা ছিল। নামার আগে পকেটে ভরেছে। সুইচ টিপে প্রথমে মই সূরাল। তারপর দরজা বন্ধ করল। সবশেষে আরেকটা সুইচ টিপতেই নিঃশব্দে পানিতে তলিয়ে গেল যানটা।

.

দুই দিন পর।

স্কুলে হাজির হয়েছে তিন গোয়েন্দা।

মামলায় স্কুল কর্তৃপক্ষ হেরেছে। আবার ভর্তি করে নিতে বাধ্য হয়েছে। তিনজনকে।

অংকের ক্লাসে একটা কঠিন সমীকরণ দিয়ে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার ক্রেগ, কে করতে পারবে? মুসা, তুমি পারবে?

মাথা নাড়ল মুসা, এত কঠিন অংক আমাকে দিয়ে হবে না, স্যার।

অবাক হলেন মিস্টার ক্রেগ। রবিনের দিকে তাকালেন। তুমি পারবে?

চেষ্টা করে দেখতে পারি, স্যার।

ব্ল্যাকবোর্ডে এসে চক দিয়ে অংকটা করল রবিন। ফিরে তাকাল মিস্টার ক্রেগের দিকে।

মাথা ঝাঁকালেন তিনি, ঠিক পথেই এগিয়েছিলে, কিন্তু দুটো জায়গায় ভুল রয়ে গেছে। ক্লাসের দিকে তাকালেন তিনি। ভুল দুটো আর কেউ ধরতে পেরেছ? শুধরে দিতে পারবে?

রয় বা শারিয়া কেউ জবাব দিল না। একমাত্র হাত তুলল কিশোর। সে এসে ঠিক করে দিয়ে গেল অংকটা।

হাসি ফুটল মিস্টার ক্রেগের মুখে। কি ব্যাপার? আজ মুসা পারলই না, রবিন ভুল করল, করতে পারলে কেবল তুমি। সেই আগের মত। ঘটনাটা কি?

হেসে জবাব দিল কিশোর, আবার আমাদের মগজ স্বাভাবিক হয়ে গেছে, স্যার। প্রথমে মগজ ভোতা করার ওষুধ দিয়ে বোকা বানিয়ে দেয়া হয়েছিল আমাদের, তারপর মগজ উন্নত করার ওষুধ খেয়ে হয়ে গেলাম ক্ষতিকর রকম বুদ্ধিমান। দুটো ওষুধের পরস্পরবিরোধী রিঅ্যাকশনেই সম্ভবত আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে এসেছে আমাদের মগজ। একেবারে আগের মত। অরিজিন্যাল আমরা।

পরস্পরবিরোধী রিঅ্যাকশনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।

ভাল ব্যাখ্যা আমিও দিতে পারব না, স্যার। তবে বিষে বিষক্ষয়ের মত হয়েছে ব্যাপারটা। এর সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্ভবত আঙ্কেল জ্যাক দিতে পারবেন।

হু, মাথা ঝাঁকালেন মিস্টার ক্রেগ। দেখি, একদিন মিস্টার জ্যাককেই গিয়ে ধরব। কি ওষুধ দিয়ে তিনি এই কাণ্ড করিয়েছেন, জানতে হবে। যাই হোক, আবার যে তোমাদেরকে আগের অবস্থায় ফিরে পেয়েছি, এতে আমি খুব খুশি। ক্লাসের দিকে তাকালেন তিনি। তোমরা কি বলো?

হাততালি দিয়ে মিস্টার ক্রেগের কথা সমর্থন করল সবাই।

Super User