১১.
মুসা আর আক্কেল আলী চলে গেল।
চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। একে তো জঙ্গল, তার ওপর শ্মশান, ভূতে বিশ্বাস না থাকলেও গা ছমছম করতে লাগল আমার। পরিবেশটা খারাপ। সেটাকে আরও ঘোরাল করে ভোলার জন্যেই যেন পেঁচা ডেকে উঠছে কর্কশ স্বরে, শোনা যাচ্ছে শেয়ালের হুক্কাহুয়া। কি করছে প্রাণীগুলো? নদীর ধারে কাঁকড়া খুঁজছে, না মড়ার তালাশে আছে?
কিশোর বলল, শ্মশান ছাড়া থাকে না। এমন করে পুরো শরীরটাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়, ছাই ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কাঁকড়া খুঁজতেই গেছে শেয়ালগুলো।
এ সব আলোচনাও এখন ভয় ধরাচ্ছে মনে। সারা আসে না কেন? মনে হতে লাগল, অনন্তকাল ধরে অনুপস্থিত ওরা।
অথচ বেশি সময় কিন্তু লাগল না ওদের। রবিগুণ্ডার ব্যাপারে সতর্ক হয়েই আছে পুলিশ। খবর শুনে একটা মুহূর্তও আর দেরি করলেন না সাব ইন্সপেক্টর ফারুক হোসেন। দলবল নিয়ে হাজির হয়ে গেলেন। গাড়ির শব্দ শুনলে সাবধান হয়ে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করতে পারে চোরটা, সেজন্যে খেতের কিনারে গাড়ি রেখে এতদূর হেঁটে এসেছেন।
সামান্যতম বাধা দিতে পারল না রবিগুণ্ডা, কল্পনাই করেনি তার পিছু নিয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছি আমরা। ও বোধহয় ভেবেছিল, আমরা তাকে চিনতে পারিনি।
তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় কিশোর অনুরোধ করল ফারুক সাহেবকে, স্যার, নিয়ে গিয়ে তো নিশ্চয় কথা আদায়ের চেষ্টা করবেন। কি বলল না বলল আমাদের জানাবেন?
নিশ্চয় জানাব। পুলিশকে অনেক সাহায্য করেছ তোমরা। ধন্যবাদ। এক কাজ কোরো, কাল সকালে চলে এসো। আমার ডিউটি থাকবে তখন।
সুতরাং পরদিন সকালে উঠেই থানায় গিয়ে হাজির হলাম আমরা।
আমাদের বসতে দিলেন ফারুক সাহেব। চা-বিস্কুট আনালেন। কোন খবর আছে কিনা জানতে চাইল কিশোর।
মাথা নাড়লেন তিনি। মহাপাজী। স্বীকার কি আর করে। অনেক চেষ্টা করেছি। একটা কথাই স্বীকার করেছে, পিস্তলটা তার, ওটা দেখিয়ে তোমাদের হুমকি দিয়েছে–না করে পারেনি, তার কারণ পিস্তলে তার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। কিন্তু গুপ্তধনের কথা কিছুই বলেনি সে। সেফের তালা ভেঙে সে নাকি নেয়নি।
মন্দিরের ভেতরটা ভালমত খুঁজে দেখা দরকার ছিল, কিশোর বলল।
হাসলেন সাব ইন্সপেক্টর। দেখিনি মনে করেছ? আজ ভোরে উঠেই দু-জন লোক পাঠিয়েছি। তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে সব। কিচ্ছু পায়নি।
হতাশ হলাম।
আমাদের মুখ দেখে সান্তনা দেয়ার জন্যে বললেন তিনি, ধরা যখন পড়েছে, স্বীকার ওকে করতেই হবে। সরকার সাহেবকে বোলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওগুলো বের করে তাকে ফেরত দেয়ার চেষ্টা করব।
হাসপাতালে দাদার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম আমরা। সব জানালাম তাকে, আর কিছু গোপন করলাম না। দাদা-দাদী দু-জনেই খুব বকলেন আমাদের, ওসব ভয়ঙ্কর চোর-ডাকাতের সঙ্গে লাগতে গিয়েছি বলে। শেষে দাদা বললেন, খবরদার, ওসবের মধ্যে আর যাবিনে। পুলিশ কিছু করতে পারে ভাল, না পারে নেই, টাকা লাগবে না আমার। তোদের যে কোন ক্ষতি হয়নি এতেই আমি খুশি।
কিন্তু আমরা খুশি হতে পারলাম না। এত কষ্ট করে জিনিসগুলো উদ্ধার করলাম আমরা, আর সেটা কেড়ে নিয়ে যাবে একটা চিকে চোর, কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না।
কিশোর তো আরও পারল না। বাড়ি ফিরেই তার প্রথম কথা হলো, দাদুরা আসবেন পরশুদিন। তার আগেই বের করতে হবে গুপ্তধনগুলো।
কি করে? জানতে চাইল মুসা।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ওই কালী মন্দিরের কাছেই কোথাও আছে ওগুলো। ওখানে থেকেছে রবিগুণ্ডা, জিনিসগুলো দূরে কোথাও রাখবে না। চোখে চোখে রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।
সুতরাং সেদিন দুপুরের খাওয়ার পর আবার গেলাম আমরা শ্মশানে। দিনের বেলা অতটা ভয় লাগে না জায়গাটাকে। তবে মানুষজনের আনাগোনা মোটেও নেই। পাখির ছড়াছড়ি। এত ঘুঘু দেখা গেল, এয়ারগানটা কেন নিয়ে এল না, সে জন্যে আফসোসের সীমা রইল না মুসার।
মন্দিরের কাছে এসে আশপাশের বনের ওপর চোখ বোলাল মুসা। কোথায় থাকতে পারে, বলো তো?
আছে এখানেই কোথাও, জবাব দিল কিশোর। মন্দিরের ভেতরে নেই, তাহলে পেয়ে যেত পুলিশ। তারমানে বাইরে রেখেছে। মাটিতে পুঁতেও রাখতে পারে।
তাহলে বের করতে বুলডোজার লাগবে… আচমকা থেমে গেল মুসা। কান পাতল। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলল, এই, মন্দিরের ভেতর লোক আছে! কথা শুনলাম!
মুসার কানের ওপর ভরসা আছে আমাদের। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম ঝোঁপের ভেতর।
চুপ করে বসে রইলাম পুরো একটা মিনিট। তারপর উঠে দাঁড়াল মুসা, তোমরা থাকো এখানে। আমি দেখে আসি।
পা টিপে টিপে মন্দিরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে। কান পেতে শুনল কয়েক মিনিট। ফিরে এসে বলল, দু-জন লোক। গুপ্তধন খুঁজতে এসেছে। রবিগুণ্ডার দলের। সে নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ওদের সঙ্গে। শফিক সাহেব বলে একজন লোকের কথা বলছে, ওই লোক ওদের বস্। ভয়ানক খেপে গেছে নাকি সে। রবিউলকে ধরতে পারলে চামড়া ছাড়াত, পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে বলে রক্ষা।
আরও কয়েক মিনিট পর খালিহাতে বেরিয়ে এল লোকগুলো। খুব রেগেছে, চেহারা দেখেই আন্দাজ করা যায়। একজনের রোমশ শরীর, মুখটা শিম্পাঞ্জীর মত। আরেকজন রোগা-পটকা, খাটো। মুখে বসন্তের দাগ। পান-ধাওয়া কালো দাঁত। মুখটা ছুঁচোর মত।
অহেতুক এখানে সময় নষ্ট করছি, মাইনকা, গরিলা বলল। রইব্বা হারামজাদাটা যে এত্তবড় শয়তান জানতাম না!
জানাজানি রাদ দিয়ে আরও ঘেঁজ, ছুঁচো, অর্থাৎ মানিক বলল। খালিহাতে গেলে যত ঝাল আমাদের ওপর ঝাড়বে শফিক সাহেব।
আমরা কি করব, না পেলে?
রইব্বাটা আমাদেরও ফাঁসিয়ে দিয়ে গেল। খালিহাতে গেলে শফিক সাহেব ভাববে, আমরাও মিছে কথা বলছি। বেঈমানী করছি, ক্ষোভের সঙ্গে বলল মানিক।
মন্দিরের বাইরেও খুঁজতে শুরু করল ওরা। দেখছে, কোনখানে মাটি খোঁড়া হয়েছে কিনা। মন্দিরের দেয়ালের ফাঁকফোকরও বাদ দিল না। যেখানেই কোন জিনিস লুকানোর মত জায়গা দেখছে, তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কিংবা উঁকি দিয়ে দেখছে। কথা বলছে। বেশির ভাগই রবিগুণ্ডাকে গালাগাল, আর নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ। শিম্পাঞ্জীর মত লোকটার নামও জানতে পারলাম, বদু।
খুঁজতে খুঁজতে আমাদের কাছাকাছি চলে এল দু-জনে। ঠিক এই সময় মুসার পেল হাঁচি। কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না, হ্যাঁচচো করে উঠল প্রচণ্ড জোরে।
.
১২.
দৌড়ে এল দুই চোর।
ঝোঁপ থেকে প্রায় টেনে-হিঁচড়ে বের করল আমাদের। চিনে ফেলল। নিশ্চয় রবিগুণ্ডার কাছে আমাদের কথা শুনেছে। বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল, কেন এখানে এসেছি।
রোমাঞ্চকর এক গল্প ফেঁদে বসল কিশোর, বদুটাকে প্রায় বিশ্বাসও করিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু মানিককে ফাঁকি দেয়া গেল না। সে বলল, ওসব ধানাই-পানাই করে লাভ নেই। তোমরাই গুপ্তধনগুলো খুঁজে বের করেছ, শুনেছি। একবার যখন পেরেছ, আবারও পারবে। আর সেগুলো খুঁজতেই এসেছ তোমরা। ভালই হলো। খোজো, বের করে দাও। ছেড়ে দেব।
কি আর করা? কিশোর বলল, মন্দিরের ভেতর থেকে শুরু করব।
ওখানে কি দেখবে? বদু বলল। পুলিশ দেখেছে। আমরাও দেখেছি। কিছুই নেই।
তবু দেখব। বলা যায় না, আপনাদের চোখ এড়িয়েও গিয়ে থাকতে পারে।
আমার মনে হলো, ফাঁকি দিতে চাইছে কিশোর। খামোকাই এখানে ওখানে খুঁজবে, কিছু না পেলে শেষে বিরক্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে লোকগুলো; তারপর গিয়ে আসল জায়গায় খুঁজব আমরা-এমন কিছু হয়তো ভাবছে সে।
কি যেন ভাবল মানিক। দ্বিধা করল একবার। তারপর বলল, বেশ, খোঁজা। এসো।
আমাদের সঙ্গে আবার মন্দিরে ঢুকল ওরাও।
ভেতরটা আবছা অন্ধকার। কেমন একটা ধোয়াটে গন্ধ। মাকড়সার জাল ঝুলছে যেখানে সেখানে। একধারে বেদীতে কালীমূর্তি। লাল জিভ বের করা, গলায় মাটির তৈরি নরমুণ্ডের মালা। একহাতে খাড়া। ভয়ানক চেহারা।
মুসা তো দেখে আঁতকেই উঠল।
গুপ্তধন লুকানোর মত জায়গা তেমন নেই। এককোণে পড়ে আছে চানাচুরওয়ালার পুরানো টিনের বাক্স আর চোঙটা। বাক্সটায় তেল চিটচিটে ময়লা একটা কাপড় বাধা, গলায় ঝোলানোর জন্যে। বাক্সের ওপরে ছড়ানো গোল বারান্দামত জায়গাটায় অনেকগুলো খুপরি, তাতে তেল-মশলার শিশি। খোপে খোপে ডাল ভাজা, বাদাম ভাজা, পেঁয়াজ-মরিচ, আর চানাচুর বানানোর অন্যান্য উপকরণ সাজিয়ে রাখা।
অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম আমরা সবাই মিলে। মূর্তির পেছন দিকটা ভাঙা, ভেতরের খড়গুলো টেনে টেনে বের করা হয়েছে।
কিশোর জানতে চাইল, কে বের করেছে এগুলো? আপনারা?
না, মাথা নাড়ল মানিক। আমার মনে হয়, প্রথমে এর মধ্যেই জিনিসগুলো লুকিয়েছিল রইব্বা, তারপর বের করে আবার অন্য কোথাও রেখেছে।
ভাঙা ফোকরটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। চিন্তিত মনে হলো তাকে। কোমরে ঝোলানো টর্চ খুলে নিয়ে মূর্তির ভেতরে আলো ফেলে ফাপা জায়গাটা দেখল। আরও কিছু খড় বাদে আর কিছুই নেই ভেতরে।
মন্দিরের ভেতরে পাওয়া গেল না জিনিসগুলো।
গজগজ করতে লাগল বদু বলেছি না নেই, শুধু শুধু সময় নষ্ট!
বিরক্ত হয়ে ধমক দিল মানিক, আহ, থাম তো তুই! ওদের কাজ ওদেরকে করতে দে!
বাইরে এসে আবার খোঁজা হলো। মন্দিরের চারপাশে বেশ অনেকখানি জায়গার মাটি পরীক্ষা করা হলো। কোথাও নতুন খোঁড়া কোন গর্ত পাওয়া গেল না। গাছের কোটরও বাদ দেয়া হলো না। কিন্তু কোথায় যে গুপ্তধনগুলো লুকিয়েছে রবিগুণ্ডা, তার কোন হসিদই পাওয়া গেল না।
নিতান্ত নিরাশ হয়েই আমাদের ছেড়ে দিল দুই চোর। শাসিয়ে দিল, ওদের পিছু নেয়ার চেষ্টা করলে ভাল হবে না।
হাঁটতে লাগল ওরা। একটাই রাস্তা। সুতরাং ওদের পিছু নেয়া ছাড়া উপায় থাকল না আমাদের। ওরাও জানে, কিছুদূর এগিয়ে দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। তাই আমরা পিছে পিছে হাঁটায় কিছু বলল না।
কথা বলতে বলতে চলেছে বদ আর মানিক, আমাদের আগে আগে। দ্রুত হাঁটছে ওরা। ফিরেও তাকাল না আমাদের দিকে। নারকেল বাগানের বাইরে বেরিয়ে ওরা চলে গেল একপথে, আমরা আরেক পথে।
খেত পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে উঠতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। গাঁয়ের মসজিদ থেকে আজান শোনা যাচ্ছে। হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরল কিশোর। দাঁড়াও। বাড়ি যাব না আমরা!
তাহলে কোথায় যাবে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
গুপ্তধনগুলো আনতে।
খাইছে! বলো কি? মুসাও আমার মতই অবাক হয়েছে। জানো নাকি কোথায় আছে ওগুলো? তাহলে বের করলে না যে?
বের করলেই তো নিয়ে যেত ওই দুই চোর।
কোথায় আছে? জানতে চাইলাম আমি।
চলো, গেলেই দেখবে।
আকাশে চাঁদ আছে। পথ দেখে চলতে অসুবিধে হলো না। আবার এসে ঢুকলাম নারকেল বাগানে। সোজা মন্দিরের দিকে এগোল কিশোর। টর্চ আছে তার কাছে। কোমর থেকে খুলে নিয়ে জালল।
আমাদের নিয়ে আবার মন্দিরে ঢুকল সে। হেসে জিজ্ঞেস করল, বলো তো, কোথায় থাকতে পারে?
সাফ মানা করে দিল মুসা, জানি না। হাজার বছর একনাগাড়ে ভাবলেও আন্দাজ করতে পারব না!
বেশ, সূত্র দিচ্ছি, দেখো বুঝতে পারো কিনা। ধরো, অনেক দামী কিছু জিনিস আছে তোমার কাছে। ওগুলো সবচেয়ে বেশি নিরাপদ কোন জায়গায় থাকলে? এমন কোথাও, যেখানে রাখলে তোমার অজান্তে কেউ খুঁজে পাবে না, তোমাকে না জানিয়ে নিতে পারবে না কিছুতেই…
সঙ্গে সঙ্গে রাখলে, বললাম।
ঠিক। তুড়ি বাজাল কিশোর। রবিগুণ্ডার পকেটে ছিল না জিনিসগুলো। তাহলে কোথায়…
প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, চানাচুরের বাক্স!
হেসে মাথা ঝাঁকাল কিশোর, হ্যাঁ। চলো, বের করে নিই।
বাক্সের ওপরের ডালাটা আলগা। সেটা সরাতেই দেখা গেল বাটা কানায়। কানায় ভরা ডালভাজা আর বাদামভাজায়। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল কিশোর। বের। করে আনল পানপাত্রটা। বলল, আর দেখার দরকার আছে? সব আছে এর মধ্যে।
কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস! না বলে পারল না মুসা।
নাও, চানাচুরওয়ালা সাজো এখন, হেসে মুসাকে বলল কিশোর। বাক্সটা গলায় ঝোলাও। রাত হয়েছে অনেক, বাড়ি যেতে হবে।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য তখনও কাটেনি। মন্দিরের দরজায় বেরোতেই দেখলাম দুই পাশে দুই প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে দুই চোর।
আমাদের দেখেই খিকখিক করে হেসে বলে উঠল মানিক, কি বদু বলেছিলাম না, ছেলেগুলো বোকা নয়। ওরা ঠিক বুঝেছে কোথায় আছে মাল। আমাদের চেয়ে অনেক চালাক। তুই তো বিশ্বাসই করতে চাস না। ফিরে না এলে কি হত, ভাব।
রইব্বাটাও কম চালাক না, ঘোঁৎ-ঘোৎ করে বলল বদু। অমন একটা চানাচুরের বাক্সের মধ্যে রেখে দেবে, কে ভাবতে পেরেছিল! আমরা তো আমরা, পুলিশই ধোকা খেয়েছে…কিন্তু এ তিনটেকে এখন কি করি?
কি আর করব। আটকে রেখে যাব মন্দিরের মধ্যে। মালগুলো দরকার ছিল আমাদের, পেয়েছি, ব্যস। যাওয়ার আগে একটা ধন্যবাদও দিয়ে যাব ওদের। আমাদের অনেক ঝামেলা বাঁচিয়ে দিল বলে। আবার খিকখিক করে হাসল মানিক। পকেট থেকে বের করল বড় একটা ছুরি। ফলা ধরে টানতেই কিটকিট শব্দ করে খুলে গেল ওটা। ঝিক করে উঠল চাঁদের আলোয়।
হাত বাড়াল সে, দাও, এবার বাক্সটা দিয়ে দাও দেখি। গোলমাল করলে ভূড়ি ফাঁসিয়ে দেব।
এই গুপ্তধন নিয়ে অনেক ঝামেলা সহ্য করেছি আমরা। বার বার উদ্ধার করছি, শেষ মুহূর্তে কেউ না কেউ এসে ছিনিয়ে নিচ্ছে। আর হাতছাড়া করতে রাজি নই আমরা কেউই।
কিশোর চুপ।
মুসাও চুপ। বারটা দেয়ার কোন লক্ষণ দেখাল না।
দাও বলছি! ধমক দিয়ে বলল মানিক।
চুপ করে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু। আমরা কেউ গোলমাল করলেই হাত তুলবে, ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে।
কিশোরের দিকে একবার তাকিয়ে আস্তে করে গলা থেকে বাক্স ঝোলানোর কাপড়টা খুলে নিল মুসা। এক পা বাড়াল মানিকের দিকে, ওটা দেয়ার ভঙ্গিতে।
ছুরিটা বাঁ হাতে নিয়ে মানিকও হাত বাড়াল।
কাপড়টা দুই হাতে চেপে ধরে মানিকের মাথা সই করে আচমকা ঘুরিয়ে বাড়ি মারল মুসা। প্রচুর জিনিসপত্র বোঝাই থাকায় ভারি হয়ে আছে বাক্স। ডাল, বাদাম, তেল-মরিচ-পেঁয়াজ সব ঝরে পড়ল বৃষ্টির মত। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে ডালাটা খুলে উড়ে গিয়ে পড়ল কয়েক হাত দূরে।
মাথার একপাশে বাড়ি লেগেছে মানিকের। উহ করে মাথা চেপে ধরে বসে পড়ল সে। ছুরিটা ছেড়ে দিয়েছে হাত থেকে। কিশোরের টর্চের আলোয় পলকের জন্যে দেখলাম, মানিকের আঙুলের ফাঁকে রক্ত।
বাক্সের কাপড়টা হাত থেকে ছেড়ে দিল মুসা। মাটিতে পড়ে ঝনঝন করে উঠল বাক্স। তাকানও না সে। প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ে মাটি থেকে তুলে নিল মানিকের ছুরিটা।
নড়ে উঠল বদু। ঠেকানোর জন্যে এগিয়ে এল। ধরতে চাইল মুসাকে।
কিন্তু ততক্ষণে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ছুরি চালাল বদুর হাত সই করে। এফেঁড় ওফোড় করে দিল তালু।
মাগোহ! বলে চিৎকার করে উঠল বদু।
বিমূঢ় হয়ে গেছে দু-জনেই। মুসা যে এই কাণ্ড করে বসবে কল্পনাই করতে পারেনি। ওরা ভেবেছিল, তিনজনেই আমরা ছেলেমানুষ, ছুরি দেখিয়ে ধমক দিলেই পেসাব করে দেব।
এত দ্রুত ঘটে গেল ঘটনাটা, আমি বা কিশোরও স্তব্ধ হয়ে রইলাম একটা মুহূর্ত।
হাত বাড়াচ্ছে মানিক, মুসাকে ধরার জন্যে নয়, বাক্সটার দিকে।
আর একটা সেকেন্ডও দেরি করলাম না আমি। নিচু হয়ে এক থাবায় কাপড়টা ধরে হ্যাঁচকা টানে বাক্সটা তুলে নিয়েই দৌড় দিলাম বনের দিকে।
ধরো! ধরো! বলে চিৎকার করে উঠল মানিক।
পেছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলাম আলো নিভিয়ে দিয়েছে কিশোর। মুসাকে সাহায্য করতে হাত লাগিয়েছে।
কোন দিকে তাকালাম না। সোজা দৌড় দিলাম অন্ধকার বনের মধ্যে দিয়ে। আশা করলাম, পেছনে পায়ের শব্দ শুনতে পাব–বদু কিংবা মানিক, কোন একজন আমাকে তাড়া করে আসবেই।
কিন্তু এল না ওরা। মুসা আর কিশোর আটকে রেখেছে নিশ্চয় ওদের।
একটা ঘন ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। বাক্সটা দু-হাতে ধরে বসে বসে হাঁপাতে লাগলাম। কান খাড়া রেখেছি কেউ আসে কিনা শোনার জন্যে। প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছি, যা হয় হবে, গুপ্তধনগুলো আর চোরের হাতে পড়তে দেব না।
লড়াইয়ের শব্দ কানে আসছে। এখনও মুসা আর কিশোরকে পরাজিত করতে পারেনি দুই চোর। সহজে পারবে বলেও মনে হয় না।
আমি ঠিক করলাম, পারুক আর না পারুক, আমি এই ঝোঁপ থেকে বেরোচ্ছি না।
এই সময় হঠাৎ করেই কানে এল কুকুরের ডাক। এগিয়ে আসছে।
রাতের বেলা এই জঙ্গলের মধ্যে গায়ের নেড়িকুত্তাগুলোরও একলা আসার কথা নয়। তারমানে সঙ্গে লোক আছে। কে?
ধক করে উঠল বুক! আক্কেল আলী না তো! আসার সময় তাকে বলে এসেছিলাম, মন্দিরে যাচ্ছি আমরা। আমাদের দেরি দেখে হয়তো কালুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে।
আমার অনুমান যে ঠিক, খানিক পরেই বুঝতে পারলাম।
বাবাগো, খেয়ে ফেলল গো! বলে চিৎকার করতে করতে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছুটে এল একজন লোক। পেছনে ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করেছে একটা কুকুর।
আমার ঝোঁপের সামনে দিয়েই ছুটে গেল লোকটা। পায়ের কাছে লেগে রয়েছে কুকুরটা। দু-জনকেই চিনতে পারলাম–বদু আর কালু। অতবড় লোকটা যে কুকুরকে এ রকম ভয় পায়, না দেখলে বিশ্বাস হবে না। পড়িমরি করে নদীর দিকে চলে গেল সে। পেছনে কালু। হঠাৎ করেই যেন দুঃসাহসী হয়ে পড়েছে কাপুরুষ কুকুরটা।
হাসি পেল আমার। কিন্তু শব্দ শুনে ফেলার ভয়ে চেপে গেলাম।
আরেকটু পর আমার আর কালুর নাম ধরে ডাক শোনা গেল। মুসা ডাকছে আমাকে, আর আক্কেল আলী কালুকে।
ফিরে এল কুকুরটা। আমার ঝোঁপের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। নাক উঁচু করে কুঁই কুঁই করতে লাগল। তারপর ছোট্ট একটা হাঁক ছাড়ল, খেক!
বুঝলাম আমার অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে গেছে। হেসে বললাম, দাঁড়া, বেরোচ্ছি।
কালুর পেছন পেছন চললাম। অন্ধকারে বনের মধ্যে পথ হারিয়েছি, বুঝতে পারলাম। কুকুরটার সাহায্য না পেলে এখন পথ চিনে মন্দিরের কাছে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ত।
গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে টর্চের আলো দেখা গেল। আমাকেই খুঁজতে আসছে কিশোররা।
আমাকে দেখেই বলে উঠল কিশোর, এই যে, আছ ঠিকঠাক? জিনিসগুলো আছে?
আছে, জবাব দিলাম।
শুনলাম, আমি দৌড় দেয়ার পর মানিক আমার পিছু নিতে যাচ্ছিল, টর্চ দিয়ে তার মাথায় বাড়ি মারে কিশোর। দুই দুইবার বাড়ি খেয়ে কাহিল হয়ে পড়ে মানিক। বদুর সঙ্গে লড়তে থাকে মুসা। এই সময় আমাদের খুঁজতে খুঁজতে এসে হাজির হয় আক্কেল আলী। কুকুরকে সাংঘাতিক ভয় পায় বদু দেখেই মারে দৌড়। তাকে তাড়া করে কালু। তিনজনের সঙ্গে পারবে না বুঝে মানিকও আর দাঁড়ায়নি, পিঠটান দিয়েছে।
বাড়ি রওনা হলাম আমরা। সাবধান থাকলাম, যাতে রাস্তায় আর কোন আচমকা আক্রমণের শিকার না হতে হয়।
বড় রাস্তায় উঠে কিশোর বলল, জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় রাখবে?
থানায় চলো।
ওই অবস্থায় আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেলেন ফাড়ির ডিউটি অফিসার। আমাদের পরিচয় দিয়ে সব কথা তাকে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ফারুক সাহেব কোথায়। তিনি জানালেন, বাইরে একটা জরুরী তদন্তের কাজে গেছেন, চলে আসবেন শীঘ্রি।
আমরা বসলাম।
আধঘণ্টা পরেই চলে এলেন ফারুক হোসেন। আমাদের অত রাতে ওই অবস্থায় দেখে তিনিও অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার?
সব শুনে তিনি বললেন, সাংঘাতিক কাণ্ড করে এসেছ। পুলিশ যা পারেনি সেটাই করে বসে আছ! তোমরা যে এতবড় গোয়েন্দা, কল্পনাই করতে পারিনি!
ডিউটি অফিসারও আমাদের অনেক প্রশংসা করলেন। দু-জন পুলিশ অফিসারের এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় লজ্জাই লাগতে লাগল আমার।
কিশোর বলল ফারুক সাহেবকে, স্যার, জিনিসগুলো বাড়ি নিয়ে যেতে ভরসা পাচ্ছি না। এত রাতে তো ব্যাংক খোলা পাব না, নিরাপদ আর কোন জায়গার কথাও জানা নেই। থানায় রেখে যেতে চাই।
একমুহূর্ত চিন্তা করে নিলেন সাব ইন্সপেক্টর। তারপর মাথা ঝাঁকালেন, বেশ, রেখে যাও। রিসিট দিয়ে দিচ্ছি। যখন ইচ্ছে নিয়ে যেয়ো।
.
১৩.
রাতটা নিরাপদে কাটল। পরদিন সকালে আক্কেল আলীর সঙ্গে হাসপাতালে রওনা হলাম।
গিয়েই শুনলাম, দাদাকে রিলিজ করে দেয়া হবে সেদিনই।
আমাদের অ্যাডভেঞ্চারের কথা জানালাম দাদা-দাদীকে। আমরা ছুরি মারামারি করেছি, এ কথা শুনে দাদী তো বাকহারাই হয়ে গেলেন। দাদা দিলেন বকা। আমাদের ওভাবে মন্দিরে যেতে দিয়েছে বলে আক্কেল আলীকেও বকতে লাগলেন।
চুপ করে রইলাম। বকে বকুক, আমাদের কাজ তো সারা।
দাদা-দাদীকে হাসপাতাল থেকে নিয়েই সেদিন বাড়ি ফিরলাম আমরা।
গুপ্তধনগুলো ফাঁড়িতেই রইল। কিশোরের ধারণা, এখনও বাড়িতে আনা নিরাপদ নয়। তবে চানাচুরের বাক্সটা নিয়ে এসেছে। অকারণে কিছু করে না সে। জিজ্ঞেস করলাম কেন এনেছে।
সে বলল, এটা এমন জায়গায় রেখে দেব যাতে বাড়িতে ঢুকলে সহজেই চোখে পড়ে। কেউ খুঁজতে এলে দেখে ফেলে। আমার বিশ্বাস, ওই দুই চোর আবার আসবে জিনিসগুলোর খোঁজে। ওদের বস্ ওদেরকে ছাড়বে না, পাঠাবেই।
মুসা জানতে চাইল, তাহলে এরপর আমাদের কাজ কি?
বাক্সের টোপটা রেখে দিলাম, কিশোর বলল, দেখা যাক ফাঁদে ধরা দেয় কিনা। দিলে বদু আর মানিককেও পাকড়াও করব। তারপর পুলিশে ধরে ভালমত ধোলাই দিলেই সুড়সুড় করে বলে দেবে বসের নাম। পালের গোদাটাকেও ধরতে পারবে তখন পুলিশ। এখন থেকে আমাদের কাজ হবে, নজর রাখা। বাড়ির কাছাকাছি অচেনা কাউকে দেখলেই চোখ রাখব।
একটা কথা কয়েক দিন ধরেই মনে হচ্ছে আমার, জিজ্ঞেস করার কথা ভুলে যাই, এখন করলাম, কিশোর, দাদার অ্যাক্সিডেন্টের পর ওই ভদ্রলোককে কিন্তু আর একবারও দেখিনি।
আমিও ভেবেছি কথাটা। চলো দাদাকে জিজ্ঞেস করে দেখি, হাসপাতালে দেখা করেছে কিনা।
দাদা জানালেন, একদিন দেখা করতে গেছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। বাড়ি কেনার ব্যাপারে আর তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বরং বার বার গুপ্তধনের কথা জানতে চেয়েছে।
তার নাম কি জানতে চাইল কিশোর।
দাদা জানালেন, শফিকুর রহমান।
সন্দেহটা পাকাপোক্ত হলো আমাদের, ওই লোকই চোরেদের বস। কারণ, সেদিন মানিক আর বদু আলোচনা করার সময়ও শফিক সাহেব নামটা বলেছিল।
আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল খাই আমরা, রাতে আর দুপুরে খাই দাদীর চমৎকার রান্না, সকালে নানা রকম পিঠা। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই, রাতে কখনও বসি দীঘির ঘাটে, অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করি, কখনও গিয়ে বসি মজা পুকুরের পাড়ের সেই ঘরটার বারান্দায়।
উড়ে যাচ্ছে যেন আমাদের দিনগুলো। কিন্তু যাদের জন্যে উৎসুক হয়ে থাকি রোজই বিকেলের পর থেকে, তাদের আর সাড়াশব্দ নেই। তিন দিন গিয়ে যখন চারদিন পড়ল, সন্দেহ হতে লাগল আমার, আর আসবে না।
তবে সেদিনই এল ওরা। কিংবা বলা যায় সেই রাতে। জানানটা দিল কাল। দীঘির ঘাটলায় বসে আছি আমরা তিনজন। দাদা-দাদী বেডরুমে চলে গেছেন। আক্কেল আলী গেছে তার ঘরে। গল্প করছি, এই সময় একটা আমগাছের নিচ থেকে চাপা গরগর করে উঠল কুকুরটা।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিলোর। চাপা কণ্ঠে বলল, এসে গেছে।
আগেই প্ল্যান করে রেখেছি আমরা, ওরা এলে কি করব। গাছপালার আড়ালে গা ঢেকে মুসা আর কিশোর এগিয়ে গেল কালুর দিকে। আমি গেলাম মালীর ঘরের দিকে, আক্কেল আলীকে ডাকতে।
ঘুমায়নি সে। আগে থেকেই জানা ছিল তারও, এ রকম জরুরী অবস্থা হতে পারে। একবার ডাকতেই দরজা খুলে উঁকি দিল, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কি?
মনে হয় এসে গেছে। বেরোও।
নিঃশব্দে বেরিয়ে এল সে। পা টিপে টিপে আমরাও এগোলাম কিশোররা যেদিকে গেছে সেদিকে।
একটা আম গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে কিশোর আর মুসা। কালুর গলার কেন্ট ধরে রেখেছে মুসা, শান্ত থাকতে বলছে কুকুরটাকে। ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরেছে কালু, চুপ করেই আছে। গাছের গায়ে গা মিশিয়ে দাঁড়ালাম আমরা।
চাঁদের আলোয় দুটো ছায়ামূর্তিকে বেরোতে দেখলাম গাছের ছায়া থেকে। চেহারা বোঝা না গেলেও আকৃতিতেই চিনলাম বদু আর মানিককে।
বাড়ির সদর দরজার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ প্রায় দশ মিনিট দাঁড়িয়ে রইল ওরা।
আমরাও চুপ। কালুকে নিয়েই ভয়, কখন চিৎকার করে ওঠে।
কেউ জেগে নেই বাড়ির ভেতর, বোধহয় এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই অবশেষে বদুকে রেখে পা বাড়াল মানিক। সদর দরজার দিকে এগোল।
নড়ে উঠল মুসাও। আগেই আন্দাজ করে রেখেছে কিশোর, ওরা এলে কোনপথে কোথায় ঢুকবে। চানাচুরের বাক্সটা কয়লার ঘরে রেখে দিয়েছে সে। তার ধারণা, চোরগুলো ওই জায়গাটাতেই খুঁজবে আগে।
কালুর বেল্টটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে দ্রুত এগোল মুসা, অদৃশ্য হয়ে গেল। বাড়ির পেছন দিকের একটা জানালা খোলা রেখে দিয়েছি আমরা এ রকম জরুরী মুহূর্তের কথা ভেবেই। সেদিক দিয়ে ঘরে ঢুকে যাবে সে।
সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মানিক। পাকা চোর সে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখা দরজাটা খুলে ফেলল। ফিরে তাকাল একবার। লুকিয়ে থাকা বদর উদ্দেশে হাত নাড়ল, তারপর ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে।
অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। মুসার কাজটা সহজ। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকবে, রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকবে মানিকের অপেক্ষায়। সে কয়লার ঘরে নেমে গেলেই ওপরের ঢাকনাটা নামিয়ে তালা লাগিয়ে দেবে।
অস্থির হয়ে উঠেছে কাল। আর চুপ থাকতে চাইছে না। রাফি কিংবা চিতার মত ট্রেনিং পাওয়া শিক্ষিত কুকুর নয় সে, অতি সাধারণ নেড়ি কুত্তা। এতক্ষণ যে কথা। শুনেছে এইই বেশি। হয়তো আরও শুনত, কিন্তু ভজকট করে দিল একটা শেয়াল। ঝোঁপের ভেতর থেকে মাথা বের করল হঠাৎ। আমরা না দেখলেও কালু দেখে ফেলল। আর যায় কোথায়। চুপ থাকার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
মশায় কামড়াচ্ছে। চুলকাতে গিয়ে সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম, ঢিল পড়ল কুকুরটার গলার কলারে, এক ঝটকায় আমার হাত থেকে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে শেয়ালকে তাড়া করার জন্যে লাফ মারল সে।
কিন্তু শেয়াল কি আর দাঁড়ায়। কুকুরের ডাক শুনেই পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল আবার ঝোঁপের মধ্যে।
বদু ভাবল, তাকে দেখেই খেপে গেছে কুকুরটা। বাবাগো, খেয়ে ফেলল গো! বলেই ঘুরে মারল দৌড়। কালুর নজর সরে গেল শেয়ালের দিক থেকে। বন্দুকেও দু চোখে দেখতে পারে না সে। শেয়ালের চেয়ে তাকে তাড়া করাটাই ভাল মনে করল বোধহয়, বদুর পায়ের গোছায় কামড়ে দেয়ার লোভেই যেন ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে গেল তার পেছনে।
ক্ষণিকের জন্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম আমরা। আমাদের প্ল্যান মত ঘটল না সব কিছু। সবার আগে সামলে নিল কিশোর। চিৎকার করে বলল, তুমি আর আক্কেল আলী বহুকে ধরো, আমি মুসার কাছে যাচ্ছি!
কালুর পেছনে দৌড় দিলাম আমি।
একটা শুকনো ডাল কুড়িয়ে নিয়ে আমার পেছন পেছন এল আক্কেল আলী।
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছুটছে বদু। কিন্তু যত জোরেই ছুটুক, কুকুরের সঙ্গে পাল্লায় পারার কথা নয়। বুঝতে পারল, ধরা পড়ে যাবে সে। থামল না তবু। কিন্তু কপাল খারাপ তার। একটা শেকড়ে পা বেধে উড়ে গিয়ে পড়ল ধুড়স করে।
তার গায়ের ওপর উঠে পড়ল কালু। কামড়ানোর জন্যে জায়গা বাছাই করছে যেন।
বাবাগো, আমি শেষ! বলে চিৎকার করে এলোপাতাড়ি ঘুসি মারতে লাগল বদু। একটা লাগল কালুর নাকেমুখে। ওটাও আরেক ভীতু। ব্যথা লাগতেই কেউ করে লাফিয়ে নেমে গেল বদুর ওপর থেকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে লাগল। আবার কামড়াতে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় করছে।
সুযোগটা কাজে লাগাল বদু। আমরা তার কাছে পৌঁছার আগেই লাফিয়ে উঠে। আবার দিল দৌড়।
ঘেউ ঘেউ করে আবার তার পিছু নিল কালু।
কোন দিকে যাচ্ছে হুশ নেই দুর। সামনে যে জলাভূমি সে খেয়াল করল না। বরং আরেকটু এগিয়ে সামনে পানি চিকচিক করতে দেখে কুকুরের হাত থেকে বাঁচার জন্যে সোজা নেমে গেল সেটাতে। ছোপ ছোপ করে কাদা-পানি ভেঙে এগোতে লাগল।
কিন্তু কয়েক কদমের বেশি যেতে পারল না। হঠাৎ দেখলাম হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে গেছে। পা যতই তোলার চেষ্টা করছে, আরও দেবে যাচ্ছে। আতঙ্কিত হয়ে পড়ল সে। মরে যাওয়ার ভয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল।
জলাভূমির কিনারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগল কালু। আমরাও এসে দাঁড়ালাম। তাকে বাঁচানোর জন্যে আমাদেরকে অনুরোধ করতে লাগল বদু।
কয়েক মিনিট পর সেখানে এসে হাজির হলো মুসা আর কিশোর। বদুর দুরবস্থা দেখে হেসেই অস্থির মুসা। ওরা কি করেছে জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিশোর জানাল, মানিককে নিয়ে গণ্ডগোল হয়নি। কয়লার ঘরে তালা দিয়ে রেখে এসেছে।
ডালটা নিয়ে কাদায় নেমে গেল মুসা। তার একটা হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম আমি আর কিশোর। ডালটা বদুর দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা। চেপে ধরতে বলল।
ধরল বদু।
মুসা বলল, এইবার আস্তে আস্তে উঠে এসো। তাড়াহুড়ো করলে কিন্তু ডাল ছেড়ে দেব।
সামান্যতম গোলমাল করল না বদু। যা নির্দেশ দেয়া হলো, নীরবে পালন করল।
তাকে তুলে আনলাম কাদা থেকে।
মুসার হাত থেকে ডালটা নিয়ে লাঠির মত বাগিয়ে ধরল আক্কেল আলী। বন্দুকে হুমকি দিল, তেড়িবেড়ি করলেই দেবে মাথায় বসিয়ে।
তবে আর কিছু করল না বদ। এক কালুর ভয়েই সে কাবু হয়ে আছে। বাকি চারজনের সঙ্গে মারপিটের ঝুঁকি নিতে চাইল না।
বদুকেও এনে কয়লার ঘরে ভরলাম আমরা।
চেঁচামেচিতে দাদা-দাদীও জেগে গেছেন। দাদী দেখতে এলেন কি হয়েছে।
সেই রাতেই আক্কেল আলীকে পুলিশের কাছে পাঠানো হলো, দুই চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
.
পরদিন সকালে নাস্তা খেতে বসেছি। দাদাও বসেছেন আমাদের সঙ্গে। দাদী গরম গরম ভাপা পিঠে এনে দিচ্ছেন রান্নাঘর থেকে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই উঠে পড়ল গুপ্তধন উদ্ধারের আলোচনা।
মুসা বলল, একটা কথা বুঝতে পারছি না, এতদিন বসে রইল কেন রবিউল। চানাচুরওলার ছদ্মবেশে সহজেই তো পালিয়ে যেতে পারত।
জবাব দিল কিশোর, আমার ধারণা, প্রথমে এই বুদ্ধি মাথায় আসেনি তার। কিংবা পালানোর সাহসই হয়নি। জিনিসগুলো নিয়ে গিয়ে মূর্তির মধ্যে ভরে রাখল। দুই শত্রু তখন তার। একদিকে পুলিশ, আরেক দিকে তার দলের লোক–তাদের সঙ্গেও বেঈমানী করেছে। ফলে লুকিয়ে থাকতে হলো তাকে মন্দিরের মধ্যে। কিন্তু নিরাপদ বোধ করল না ওখানে। যে কোন সময় ধরা পড়ে যেতে পারে। শেষে চানাচুরওলা সেজে বুঝতে চাইল, ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে কিনা। বাজারে গেল সেটা বোঝার জন্যে। আরও একটা কারণে গিয়েছিল সে, পুলিশ আর তার দলের লোকের ব্যাপারে খোঁজখবর করার জন্যে…
কিন্তু বাদ সাধলে তোমরা, হেসে কথাটা শেষ করে দিলেন দাদা। একেবারে সময়মত গিয়ে হাজির হলে বাজারে। চিনে ফেললে তাকে। পালাতে যে পারবে না সে, প্রমাণ পেয়ে গেল হাতেনাতে।
হ্যাঁ, ব্যাটার কপালটাই খারাপ, হেসে মন্তব্য করল মুসা।
চুপচাপ খাওয়া চলল কিছুক্ষণ। একটা প্রশ্ন নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, জবাব খুঁজে পাচ্ছিলাম না-শফিকুর রহমান গুপ্তধনগুলোর লোভেই বাড়িটা কিনতে চায়নি তো? আর তাই যদি হয়ে থাকে, সে শিওর হলো কি ভাবে যে এই বাড়িতেই রয়েছে জিনিসগুলো, বের করে নিয়ে যেতে পারেনি আমিন উদ্দিন সরকারের মুন্সী?
প্রশ্নটা তুললাম।
দাদা বললেন, এর একটাই জবাব হতে পারে, কথাটা কোনভাবে মুন্সীদের কারও মুখেই জেনেছে শফিকুর রহমান। আমার কি সন্দেহ হচ্ছে জানো? এই শফিকুর রহমান মধু মুন্সীর ছেলে।
ছেলে! প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলাম আমরা তিনজন।
হ্যাঁ। তার একটা ছেলে ছিল বলে শুনেছি। বাবার কাছে নিশ্চয় গুপ্তধনের কথা শুনেছে সে। বিদেশে চলে গিয়েছিল বলে এতদিন আসতে পারেনি। দেশে ফিরেই বাড়িটা কিনতে এসেছে।
বিদেশে গিয়েছিল কি করে জানলেন? জিজ্ঞেস করলাম।
শফিকুর রহমান নাকি অনেক দিন দেশের বাইরে ছিল, আমাকে বলেছে। তোমাদের বয়েসে জাহাজে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল, ফিরেছে এই কিছুদিন আগে। সে যে মধু মুন্সীর ছেলে, এটা আমার অনুমান। আগে কিছু সন্দেহ করিনি, এখন করছি।
খাওয়ার পর থানায় রওনা হলাম আমরা। ফারুক হোসেনকে পাওয়া গেল। তাকে বললাম শফিকুর রহমানের ব্যাপারটা। তিনি জানালেন, বদু মুখ খুলেছে। বলেছে, শফিক সাহেব নামে এক লোকই ওদের বস্, গুপ্তধনগুলো চুরি করার জন্যে টাকা দিয়েছিল ওদের।
আমাদের মুখ থেকে সব কথা শুনে আরও শিওর হলেন তিনি। শফিকুর রহমানের কাছে যাবেন বললেন।
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গুপ্তধনগুলো নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম আমরা।
মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন দাদা-দাদী।
গর্বের সঙ্গে দাদা বললেন দাদীকে, দেখেছ, কি জিনিস! পানপাত্রটা দেখো, কি সুন্দর কারুকাজ করা। আর পাথর কি! আজকাল এসব জিনিস কল্পনাই করা যায় না।
সুন্দর, স্বীকার করলেন দাদী, তবে কল্পনা করা যায় না কথাটা ঠিক না। টাকা খরচ করলে এখনও এমন বানানো যাবে।
দূর, কি যে বলো তুমি, সেই কারিগরই নেই। চমৎকার একটা হার তুলে নিয়ে দাদীকে দিয়ে বললেন দাদা, নাও, এটা তোমাকে দিয়ে দিলাম। পরো।
সলজ্জ হাসি হেসে দাদী বললেন, তোমার মাথায় দোষ পড়েছে! এই বুড়ো বয়েসে এ হার পরে আমি কি করব! বললেন বটে, কিন্তু হারটা নিয়ে পরে ফেললেন।
হাসলেন দাদা। বললেন, দারুণ মানিয়েছে। আমাদেরকে সাক্ষি মানলেন, কি বলিস, মানিয়েছে না?
সাংঘাতিক! আমার আগেই বলে উঠল মুসা।
কিশোর বলল, এক কাজ করব, দাঁড়াও, তোমার পা-টা ভাল হয়ে গেলে তোমাদের বিবাহ বার্ষিকী পালন করব আমরা…
কিন্তু তার তো অনেক দেরি আছে, দাদা বললেন।
তাতে কি? আমাদের খাতিরে আগামই নাহয় করে ফেললে। বাসর ঘর সাজিয়ে দেব তোমাদের।
কৃত্রিম মুখ ঝামটা দিয়ে একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন দাদী, এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল আক্কেল আলী। ভীষণ উত্তেজিত। বলল, হুজুর, একটা সাংঘাতিক খবর আছে! নন্দী পাড়ার সাহেব মিয়া এসেছে। আমাদের যে জমিগুলো নদীতে ডুবে গিয়েছিল বহুকাল আগে, আবার নাকি ভাসছে। চর জেগেছে, হুজুর, চর জেগেছে!
খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন দাদা। তারপর বিড়বিড় করলেন, সরকারদের সৌভাগ্য! শুরু হয়ে গেল আবার! আক্কেল আলীর দিকে মুখ তুলে বললেন, জাগবেই, জাগতেই হবে। আবার আমাদের সব হবে! আসল জিনিসই ফিরে এশেছে যে! জিনিসগুলোর দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি।
আনন্দে দাদীর চোখে পানি এসে গেছে। প্রচণ্ড আগে সইতে না পেরে উঠে এসে আমার কপালে চুমু খেয়ে মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে ধরলেন নীরবে।
একে একে মুসা আর কিশোরকেও চুমু খেলেন। তারপর বললেন, সরকার বাড়ির সৌভাগ্য ওই সোনার জিনিস নয়, আমার এই তিনটি রত্ন। ওরা ঘরে এসেছে। বলেই না ভাগ্য ফিরতে শুরু করেছে আমার, বুঝতে পারছি সোনাদানায় আবার ভরে উঠবে এই বাড়ি!
জমিদার-দাদার বাড়িতে এরপর মহাআনন্দে কাটতে লাগল আমাদের দিন।
নতুন কিছু আর বলার নেই।
ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা জানার জন্যে নিশ্চয় কৌতূহল হচ্ছে তোমাদের; শফিকুর রহমান মধু মুন্সীর ছেলে–দাদার এই অনুমানটা সত্যি কিনা প্রমাণ করা গেল না, কারণ ধরা গেল না তাকে। পুলিশ তার ঠিকানায় খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, ঘরের তালা বন্ধ। বাড়িওয়ালা জানাল, আগের রাতে নাকি তড়িঘড়ি করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে চলে গেছে লোকটা। বলে গেছে, আর আসবে না। দামী গাড়িটাও নাকি তার নিজের ছিল না, ভাড়া, রেন্ট-অ্যা-কার কোম্পানি থেকে নিয়েছিল।
তবে যাই হোক, শফিকুর রহমান ধরা পড়ুক আর না পড়ুক, বিপদ কেটে গেছে। দাদা-দাদীর মুখে হাসি ফুটাতে পেরে আমরা খুব খুশি। নিশ্চয়ই তোমরাও খুশি?