গরমের ছুটি – ভলিউম ৫৪ – তিন গোয়েন্দা
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৪
০১.
বিশাল এক জঙ্গলের মধ্যে বাড়িটা। জমিদার বাড়ি। কুমিল্লা থেকে এসে ময়নামতি ছাড়িয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার মহাসড়ক ধরে কয়েক মাইল এগোলে পথের বাঁ পাশে পড়বে বিশাল এক বটগাছ। সেটার কাছে নেমে একটা ইট বসানো সরু রাস্তা ধরে আরও কিছুদূর গেলে সেই জঙ্গল, হীরামতির বাগ, অর্থাৎ বাগিচা। গরমের এই ছুটিতে সেটাই আমাদের গন্তব্য। হ্যাঁ, আমি রবিন বলছি। আবার এসেছি বাংলাদেশে বেড়াতে, আমরা তিন বন্ধু-আমি, কিশোর পাশা, এবং মুসা আমান।
অন্যান্যবারের মত এবারেও কিশোরের মামা রিটায়ার্ড ডিআইজি আরিফ চৌধুরী সাহেবের ঢাকার বাসাতেই উঠেছিলাম আমরা। একটা দিন ওখানে কাটিয়ে পরদিনই রওনা হলাম কুমিল্লার উদ্দেশে। গন্তব্য হীরামতির বাগ। নামটা শুনলে কেমন লাগে, তাই না? মনে হয়, প্রচুর হীরা-মতি পাওয়া যায় বুঝি ওই জঙ্গলে। আসলে তা নয়, হীরা আর মতি নামে দুই ভাইবোন ছিল, জমিদারের সন্তান। বিশাল এক দীঘি কাটিয়েছিলেন জমিদার আইন উদ্দিন সরকার, সেই দীঘিতে ডুবে মারা গিয়েছিল ছেলেমেয়ে দুটি। তখন থেকেই সেই দীঘির নাম হয়ে গেল হীরামতির দীঘি। কালক্রমে দীঘির চারপাশের বাগান সংস্কারের অভাবে জঙ্গল হয়ে গেল, দীঘির নামেই নাম হয়ে গেল সেই জঙ্গলেরও।
এই কাহিনী শুনেছি আমরা কিশোরের চাচা রাশেদ পাশার মুখে। তিনিই আমাদের এখানে আসতে অনুরোধ করেছেন। জঙ্গলের মধ্যে যে পূরানো জমিদার বাড়ি আছে, তার মালিক এখন রেহান উদ্দিন সরকার, রাশেদ পাশার দূর সম্পর্কের ফুফা। আইন উদ্দিন সরকারের শেষ বংশধর। আমেরিকায় বসেই শুনেছেন রাশেদ পাশা, তার ফুফুর খুবই দুরবস্থা চলছে এখন। তাই আমাদেরকে এখানে এসে নিজের চোখে সব দেখে খোঁজখবর করে যেতে বলেছেন রাশেদ আংকেল। সম্ভব হলে তখন সাহায্য করবেন।
ঢাকা থেকে কুমিল্লার বাসে চড়েছি আমরা। ময়নামতিতে নেমে স্কুটার নিয়েছি।
বটগাছের গোড়ায় কয়েকটা ছোট ছোট দোকান-মুদি, চা-পান-বিড়ি, এ সবের। ওগুলোর কাছে এসে ড্রাইভারকে থামতে বলল কিশোর। এগিয়ে এল কয়েকজন নোক, কৌতূহলী হয়ে দেখতে লাগল আমাদের। জমিদার বাড়িটা কোনদিকে জিজ্ঞেস করতে সবাই হাত তুলে দেখিয়ে দিল ইট বিছানো রাস্তাটা।
সেই পথ ধরে এগোল আমাদের স্কুটার। অনেক পুরানো রাস্তা, জমিদারী আমলে সরকারদের কোনও একজন তৈরি করেছিলেন নিজের খরচে। এখন অনেক জায়গারই ইট নেই, ক্ষতের মত হয়ে আছে, জায়গায় জায়গায় গর্ত। মেরামত হয় না কত বছর কে জানে।
বেশ গরম পড়েছে। ঘেমে যাচ্ছি। পথের দুপাশে মাইলের পর মাইল কেবল খেত আর খেত। তরমুজ-বাঙ্গী ফলে আছে। এলোমেলো মাতাল হাওয়ায় ধুলোর। ঘূর্ণি উড়ছে। চাষীদের বাড়িঘর চোখে পড়ে কচি-কদাচিৎ। ওরা এই ভোলা মাঠে বাস করে না, থাকে দূরে, খেতের সীমানায় ওই যে ওই গ্রাম চোখে পড়ছে, সেখানে।
অবশেষে দেখতে পেলাম জঙ্গলটা। তিন পাশ ঘিরে খেত, একধারে নদী। কিছুদূর খোলা জায়গা ধরে এগিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল পথটা। ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে কয়েকশো গজ এগোতে দেখতে পেলাম জমিদার বাড়ির চৌহদ্দি। জঙ্গলটা আগে জঙ্গল ছিল না, বাড়ির আশপাশে বিশাল সব বাগান ছিল, আস্তে আস্তে সেই বাগান জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। বিরাট সিংহদরজার প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই আর এখন, কেবল দু-পাশের দুটো স্তম্ভ বাদে। একটা স্তম্ভের গোড়ায় একপাশে এখনও থাবা উঁচিয়ে বসে আছে শ্বেতপাথরের এক মস্ত সিংহ।
খোয়াবিছানো লম্বা গাড়িপথ পার হয়ে বিশাল এক প্রাসাদের সামনের গাড়িবারান্দায় এসে দাঁড়াল স্কুটার। রোদে ঝকঝক করছে ছড়ানো উঠান। সেখানে দানা খুঁটছিল একঝাঁক পায়রা আর ঘুঘু। স্কুটারের শব্দে ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল একসঙ্গে। কয়েকটা পায়রা গিয়ে বসল বাড়ির কার্নিসে, বাকবাকুম জুড়ে দিল।
খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা, কি সুন্দর জায়গা!
স্কুটার থেকে নেমে আমিও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই অসাধারণ! জঙ্গলের মাঝে এমন একটা বাড়ি থাকতে পারে, না দেখলে ভাবাই যায় না। অনেক পুরানো বাড়ি। সংস্কারের অভাবে এখানে ওখানে বেরিয়ে পড়েছে লাল ইট, জানালার শাসিগুলো অপরিষ্কার, আনাচে কানাচে লতাগুল্ম আর শ্যাওলার রাজত্ব। পলকে একটা দিবাস্বপ্ন দেখে ফেললাম-এককালে আমাদেরই মত কত কিশোরের আনাগোনা ছিল এখানে, খেলে বেড়াত তারা, হই-চই করত, আজ একেবারে নীরব।
ওই যে, দাদী। বলে উঠল কিশোর।
উঁচু বারান্দার ওপরের বড় দরজাটা খুলে গেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধা। বয়েস ষাটের বেশি, কিন্তু এখনও মনে হয় চল্লিশের কোঠায়। অপরূপ সুন্দরী ছিলেন এককালে, বোঝা যায়। হবেনই, অত সুন্দরী না হলে কি আর জমিদার বাড়িতে বিয়ে হয়।
আমাদের আসার খবর চিঠিতে আগেই জানিয়েছেন রাশেদ আংকেল। সুতরাং আমাদের পরিচয় দিতে হলো না তাকে। হাসিমুখে সাবলীল ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে লাগলেন আমাদের দিকে। শুধু বললেন, এসেছিস। তোদের অপেক্ষাই করছি।
কোন রকম দ্বিধা নেই, জড়তা নেই, প্রথমেই আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে আদর করলেন। আমি যে বিদেশী, অন্য ধর্মের মানুষ, বাঙালী মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়েও তার পরোয়াই করলেন না তিনি। মুহর্তে পছন্দ করে। ফেললাম তাকে, মনে হলো তিনি আমার নিজের দাদী। তারপর মুসাকে চুমু খেলেন তিনি, আমার পেছনেই ছিল সে। সবশেষে কিশোরকে, স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে উঠে আসতে দেরি করে ফেলেছিল সে।
আয়, ঘরে আয়, ডাকলেন দাদী। আমি জানি, তাঁর ডাকনাম হীরা, অবশ্যই রাশেদ আংকেলের কাছে জেনেছি। এই নামটার জন্যেই আইন উদ্দিন সরকারের বাবা কনেকে বেশি পছন্দ করেছেন, কারণ তাঁর ছেলের ডাকনামও তিনি রেখেছিলেন মতি। সুযোগ পাওয়ামাত্র মিলিয়ে দিলেন হীরামতিকে। হীরামতির বাগ নামটাকে সার্থক করার জন্যেই যেন।
উঠানের কোণ থেকে উঠে বার দুই ঘাউ! ঘাউ! করে হাঁক ছেড়ে এগিয়ে এল একটা নেড়ি কুকুর। নেড়ি হলেও স্বাস্থ্য বেশ ভাল, খাবারের অভাব হয় না।
ও আমাদের কালু, হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন দাদী। আদর করে একবার ডাকলেই হয়, ভাব হয়ে যাবে।
সবার আগে মুসার সঙ্গে ভাব করে নিল কুকুরটা। আমাদেরও অবজ্ঞা করল না।
দোতলায় আমাদের থাকার ঘর গুছিয়ে রেখেছেন দাদী। দেখিয়ে দিলেন। বললেন, হাতমুখ ধুয়ে আয়, আমি নাস্তা দিচ্ছি।
ঘরটা দেখার মত। দেয়াল, ছাত, কড়ি-বরগাগুলো মোটেও মসৃণ নয়, দমকা বাতাসে পুকুরের শান্ত পানিতে যেমন কুচি কুচি ঢেউ ওঠে অনেকটা তেমনি, তার ওপর বিচিত্র অলঙ্করণ। অনেক বড় বড় জানালা। বাইরে বাগান। প্রজাপতি, ফড়িঙ আর পাখির ভিড় সেখানে। আমার মনে হতে লাগল আমি বাস্তবে নেই, পরীর রাজ্যে এসে পড়েছি।
মুখহাত ধুয়ে, কাপড় পাল্টে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নিচতলায় নেমে এলাম মস্ত হলঘরে। বাবুর্চিখানা, চাকরদের ঘর, খাবার ঘর আর রান্নাঘরে ঢোকা যায় সে ঘর থেকে। রান্নাঘর থেকে আরেকটা ছোট ঘরে চলে যাওয়া যায় উল্টোদিকের একটা দরজা দিয়ে, পরে জেনেছি। ওই ঘরটা কোন কাজে লাগে না, তবে অনেকটা সিঁড়িঘর হিসেবেই ব্যবহার হয়। মেঝেতে একটা লোহার শিকের জালিকাটা ঢাকনা, তার নিচে কয়লার ঘর। এককালে রান্নাঘরের চুলায় কয়লা ব্যবহার হত, এখন গ্যাস আসায় বাতিল হয়ে গেছে ওসব চুলা। কয়লা জমিয়ে রাখারও আর প্রয়োজন হয় না। রান্নাঘর দিয়ে ছাড়াও ওই সিঁড়িঘরে ঢোকার আরও একটা পথ আছে, আমাদের শোবার ঘর থেকে। একটা আলমারি আছে দেয়াল ঘেঁষে, প্রথম দেখে তাই মনে হয়েছিল। পরে দেখে অবাক হয়েছি, ওটা আলমারি নয়, একটা গোপন দরজা, অন্য পাশে সরু একটা অন্ধকার সিঁড়ি নেমে গেছে। দেখে খুব রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। যাই হোক, সে-সব কথায় পরে আসছি।
হলঘরের দেয়ালে ঝোলানো বিরাট বিরাট ছবি, বেশির ভাগই হাতে আঁকা, ফ্রেমে বাঁধানো। সরকার পরিবারের পূর্বপুরুষদের ছবি। আধুনিক ছবি অর্থাৎ ফটোগ্রাফ আছে একটাই, হীরাদাদু আর মতিদাদার যুগল ছবি, দু-জনেই বিয়ের সাজে সজ্জিত, বর আর কনে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ছবিটা। খুব সুন্দর।
খাবার ঘরে খেতে বসে কিশোর জানতে চাইল মতিদাদা কোথায়।
দাদী জানালেন, আক্কেল আলীকে নিয়ে শহরে গেছেন কাজে। জানা গেল, আক্কেল আলী এ বাড়ির একমাত্র কাজের লোক। টাকার অভাবে একজনের বেশি নোক রাখার ক্ষমতা নেই আর এখন রেহান উদ্দিনের। অথচ দাদুর যখন বিয়ে হয়, প্রথম আসেন এ বাড়িতে, তখনও অনেক চাকর-বাকর ছিল। আর তার আগে তো কথাই নেই, গিজগিজ করত নাকি মানুষে।
সন্ধ্যার মুখে শহর থেকে ফিরলেন দাদা। পুরানো, ঝরঝরে একটা মোটরগাড়িতে করে। আমরা তখন বাগানে। ছবির মানুষটারই মত আছেন এখনও, কেবল চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে, এবং চোখের কোণে আর গলার নিচে ভাজ।
গাড়ি থেকে নেমেই আমাদের দেখলেন। ঋজু ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। এসে গেছ তাহলে। ভেরি গুড।
বিশাল থাবা দিয়ে চেপে ধরলেন আমার হাতটা। ঝাঁকিয়ে দিলেন আন্তরিক ভঙ্গিতে।
.
০২.
পরের দু-তিনটে দিন কালুকে নিয়ে দারুণ কাটল আমাদের। ফলগাছের অভাব নেই বাড়িটাতে। আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল তো আছেই, আরও নানা রকম ফলের ছড়াছড়ি। বনের মধ্যে ঘুরে বেড়াই আমরা, ফল খেয়ে পেট ভরে থাকে, ভাত খাওয়ার আর জায়গা থাকে না। আমেরিকা থেকে এসে আমরা ভাত খাই শুনে নিশ্চয় অবাক লাগছে তোমাদের। কিন্তু সত্যি বলছি, এখানে এসে রুটির চেয়ে ভাতই বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে আমার। বোধহয় আবহাওয়াটা এমন যে এই খাবারই ভাল লাগে।
কালু ছাড়াও আরও একটা প্রাণী আছে এ বাড়িতে, অনেক বড় একটা কালো হুলো বেড়াল, টিক্কা খান। নামটা আক্কেল আলীর দেয়া। বেড়ালটার বড় বড় গোফ দেখলেই নাকি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নেতা জেনারেল টিক্কা খানের কথা মনে পড়ে যায় তার। বেড়ালটাকে পাখিরাও পছন্দ করে না, সে উঠানে নামলেই চমকে যায় পায়রা আর ঘুঘুর দল, নিমেষে ডানা ঝাঁপটে উড়ে পালায়।
আক্কেল আলী নিজেও একটা চরিত্র বটে। সেই ছেলেবেলায় সাত-আট বছর বয়েসে সে ঢুকেছে এ বাড়িতে, তারপর আর যায়নি। সবাই চলে গেছে একে একে, সে রয়ে গেছে। এখন চাকর-মালী থেকে শুরু করে মতিদাদার শোফারের কাজ, সব সে একা করে। হালকা-পাতলা খাটো শরীর, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, বসে যাওয়া চোয়াল দেখে বোঝার উপায় নেই তার আসল বয়েস কত।
মাত্র কয়েকটা দিনেই বাড়িটার প্রতি ভীষণ মায়া পড়ে গেছে আমার। মনে হতে থাকে, সহজেই সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি এখানে।
তিন দিনের দিন সকালে সামনের বাগানে আমগাছের ছায়ায় বসে আছি, এই সময় গাড়ির শব্দ কানে এল। গাড়িপথে ঢুকল একটা চকচকে গাড়ি। গাড়ি বারান্দায় থামিয়ে নেমে গিয়ে পেছনের দরজা খুলে দিল শোফার। নামলেন বেশ সভ্রান্ত পোশাক পরা একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। বয়েস মতিদাদার সমানই প্রায় হবে। ছুটে গিয়ে হলঘরের দরজা খুলে দিল আক্কেল আলী। দুজনকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
আয়েসী ভঙ্গিতে গাছের গোড়ায় বসে ছুরি দিয়ে কেটে আম খেতে খেতে গল্প করতে লাগলাম আমরা। দারুণ টেস্ট, আমের মত এত স্বাদ পৃথিবীর আর কম ফলেরই আছে। গাড়ির শব্দে উড়ে গিয়েছিল, একটা দুটো করে আবার উঠানে নেমেছে আট-দশটা ঘুঘু আর পায়রা।
ঘণ্টাখানেক পর চলে গেল মেহমানরা। তাঁদের সঙ্গে গেলেন মতিদাদা। আরেকটু পরে দাদীকে দেখলাম পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে দীঘির শান বাধানো ঘাটে বসলেন। ওটাই হীরামতির দীঘি। পাথরে তৈরি সোফার মত আসনে বসে তাকিয়ে রইলেন পানির দিকে, সাদা শাপলাগুলো যেদিকে ফুটেছে সেদিকে মুখ। চুপচাপ বসে রইলেন তিনি।
আমের রসে হাত ভরে গেছে। ধোয়ার জন্যে চললাম দীঘির দিকে। ঘাটের কাছে এসেই থমকে দাঁড়ালাম। এ-কি! দাদী কাঁদছেন! গাল বেয়ে নেমেছে পানির ধারা। কি হয়েছে তার?
আমার সাড়া পেয়েই তাড়াতাড়ি শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ফিরে তাকালেন। জোর করে হেসে বললেন, ও, রবিন! কি রে, খুব গরম?
না, হাত ধুতে এসেছি। দাদী, তুমি কাঁদছ কেন?
কই? চোখে কি যেন পড়ল…
মিথ্যে কথা বোলো না। আমি তোমাকে স্পষ্ট কাঁদতে দেখলাম।
দ্বিধা করলেন একবার দাদী। তারপর হাত দিয়ে তার পাশের জায়গাটা চাপড়ে দিয়ে বললেন, আয়, বোস।
বসলাম তার পাশে।
একটু আগে লোকটা এল না, গাড়িতে করে, দেখেছিস নিশ্চয়?
তিনি তোমাকে কিছু বলেছেন?
না, বলেনি, তবে কাদিয়েছে। ও এই বাড়ি কিনতে চায়। আমাকে আর তোর দাদাকে চিরকালের জন্যে চলে যেতে হবে এখান থেকে। ভাবলেই বুক ফেটে যায় আমার!
কেন দাদী, চলে যেতে হবে কেন? এতটাই অভাবে পড়ে গেছ তোমরা?
বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও ফুরায়, রবিন। জমিদারের ছেলে কাজকর্ম তো কিছু শেখেনি, টাকার দরকার হলেই জমি বেচেছে। এ বাড়ির আশেপাশে যত জমি আছে সব এককালে সরকারদের ছিল। শত শত একর। আজ আর এক বিযেও অবশিষ্ট নেই, শুধু এই বাড়িটা বাদে। দুর্ভাগ্যের সূচনা সেদিন থেকেই, যেদিন সরকারদের সৌভাগ্য হারিয়ে গেল!
সরকারদের সৌভাগ্য মানে! পেছন থেকে বলে উঠল কিলোর। আমাদেরকে একান্তে কথা বলতে দেখে কৌতূহলী হয়ে সে আর মুসাও চলে এসেছে।
আয়, বোস, দু-জনকে বসতে বললেন দাদী।
দীঘির পানিতে ডোবাডুবি করছে দুটো পানকৌড়ি। সেদিক তাকিয়ে আছে মুসা। শিকারীর দৃষ্টি। একটা বন্দুক হাতে পেলেই এখন গুলি করে বসত।
তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে দাদীকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনও জিনিসের কথা বলছ?।
হ্যাঁ, অনেক দামী কিছু জিনিস, আমাদের আগ্রহ দেখে মুচকি হাসলেন দাদী। প্রায় দুশো বছর আগে, ইংরেজ আমলে এ বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা আইন উদ্দিন। সরকারকে ওগুলো উপহার দিয়েছিলেন আগরতলার এক মহারাজা।
কি কি জিনিস ছিল? আগ্রহে বকের মত গলা বাড়িয়ে দিয়েছে কিশোর।
মুক্তার হার, হীরার জড়োয়া সেট, চুণি-পান্না বসানো সোনার একটা পানপাত্র, আর আরও নানা রকম জিনিস।
কিন্তু হারাল কি করে ওগুলো?
দেশ বিভাগের সময় হিন্দু-মুসলমানে যখন দাঙ্গা লাগল, এই এলাকায় তখন হিন্দুদের আধিপত্য। সেই সময় হঠাৎ করে মারা গেলেন তোর মতিদাদার দাদা আমিন উদ্দিন সরকার। সেই থেকে গায়েব হয়েছে জিনিসগুলো।
কি করে মারা গেলেন?
সেটাও এক রহস্য। একদিন দীঘির ওই পাড়ের ঘাটলার কাছে তাকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল। অভিশপ্ত এই দীঘি। কত মানুষকে যে নিল!
খুন করেনি তো?
কেউ কেউ সে রকম সন্দেহ করেছে। তাদের ধারণা ছিল, জিনিসগুলোর লোভে খুন করা হয়েছিল মানুষটাকে! যাই হোক, ওগুলো আর পাওয়া গেল না। তাকে খুন করে হয়তো জিনিসগুলো নিয়ে গিয়েছিল কেউ। কিংবা সেই লোকের হাতে পড়ার আগেই তিনি কোথাও লুকিয়ে ফেলেছিলেন ওগুলো। আর তা করে থাকলে এখন এ বাড়িরই কোনখানে আছে। কারণ দাঙ্গা শুরুর পর আর একটি দিনের জন্যেও বাড়ির সীমানার বাইরে যাননি আমিন উদ্দিন সরকার।
এ বাড়িতেই আছে বলছ? আনমনে বলল কিশোর, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু হয়ে গেছে তার। কি ভাবছে সে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি আমি।
থাকতেও পারে। তবে আমার বিশ্বাস, নেই।
নেই মনে হওয়ার কারণ? জানতে চাইল কিশোর।
কারণ ওগুলোকে সরকারদের সৌভাগ্য নাম দিয়েছিলেন আইন উদ্দিন সরকার। যতদিন ছিল, রমরমা অবস্থা ছিল সরকারদের, যেই গেল, অমনি শুরু হলো পতন।
এ সব কুসংস্কার। জমিদারী বিলুপ্তির পর টাকা রোজগারের অন্য কোন উপায় করেনি বলেই আসলে ফকির হয়েছে ওরা।
একেবারে ভুল বলিসনি কথাটা। অকর্মা বলেই তো এখন শেষ সম্বল বাড়িটাও বিক্রি করতে হচ্ছে। দাদীর কণ্ঠে ক্ষোভ।
বাড়ি বিক্রি মানে? কিশোর শোনেনি খবরটা।
তাকে আর মুসাকে আবার সব খুলে বললেন দাদী। এখান থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে আবার গলা ধরে এল তার।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে ঘনঘন কয়েকবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। তারপর মুখ তুলল, বাড়িটা বাঁচানোর এখন একটাই উপায়, একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা পেয়ে যাওয়া।
মলিন হাসি হাসলেন দাদী। একটা কানাকড়িও নেই আর তোর দাদার কাছে। অনেক টাকা কোথায় পাবেন?
আছে, উপায় আছে। গুপ্তধনগুলো খুঁজে বের করতে পারলেই আর টাকার অভাব হবে না তোমাদের।
সে আশার গুড়ে বালি। অনেকেই খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে, পায়নি। তার মানে নেই এখানে। আমিন উদ্দিন সরকারকে খুন করে কেউ নিয়ে গেছে ওগুলো। কে নিয়েছে, তা-ও জানি। তার এক মুন্সী ছিল। তিনি যেদিন মারা গেলেন, সেদিন থেকেই ওই লোকটাও নিখোঁজ হলো। আর তাকে দেখা যায়নি।
হুঁ! সহজে নিরাশ হতে জানে না কিশোর পাশা। তবু, একবার যখন গুপ্তধনের গন্ধ পেয়েছি, সহজে হাল ছাড়ছি না আমি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, দাদী, এ বাড়িতে থাকলে আমরা ওগুলো খুঁজে বের করবই!
.
০৩.
সেইদিন থেকেই গুপ্তধন খোঁজায় লেগে গেলাম আমরা। কিন্তু কিশোর পাশাও বেকায়দায় পড়ে গেল। কোন সূত্রই নেই হাতে, কিসের সাহায্যে খুজবে? তেমন কোন সূত্রই দিতে পারলেন না দাদী। আক্কেল আলীকে জেরা করেও কিছু জানা গেল না। প্রায় পয়তিরিশ বছর ধরে আছে এ বাড়িতে, অনেক ইতিহাস জানে এখানকার, কিন্তু গুপ্তধন উদ্ধারের ব্যাপারে সে-ও কোন সাহায্য করতে পারল না।
পরদিন সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে আবার বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াতে শুরু করল কিশোর। গোপন দরজা কিংবা গোপন কুঠুরি আছে কিনা খুঁজছে। দাদী বললেন, একটা গোপন সিঁড়িই আছে জানি, যেটার দরজা আলমারির মত, যেটা দিয়ে তোদের ঘরে চলে যাওয়া যায়। আর কিছু নেই।
আসলেও মনে হলো নেই। কারণ অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কিছু পেলাম না আমরা। নিরাশই হয়ে গেলাম। আমাদের অবস্থা দেখে শেষে দাদী বললেন, দেখ, বেড়াতে এসেছিস, বেড়িয়ে যা। ওসব গুপ্তধন খোঁজা বাদ দে। ওগুলো নেই এখানে। থাকলে অনেক আগেই পেয়ে যেত লোকে।
কিন্তু… তর্ক করতে গেল কিশোর।
তাকে থামিয়ে দিয়ে দাদী বললেন, ওসব কিন্তু-ফিন্তু বাদ দিয়ে বনের ভেতর থেকে ঘুরে আয়গে, যা। ভাল লাগবে। অনেক কিছু দেখার আছে। যা।
প্রায় জোর করেই আমাদেরকে ঘর থেকে ঠেলে বের করে দিলেন তিনি।
ভোর বেলা উঠেই শহরে চলে গেছেন দাদা, বোধহয় বাড়ি বিক্রির কাজেই। আমরা ঘুম থেকে উঠে দেখিনি তাঁকে। বাগানে দেখা হয়ে গেল আক্কেল আলীর সঙ্গে। গাছের গোড়ায় নিড়ানি দিচ্ছে। হেসে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?
জানালাম।
কোথায় গেলে কি দেখতে পাব, বলে দিল সে। একটা জায়গায় যেতে নিষেধ করল, বনের ভেতরে একটা মজা পুকুর। জায়গাটা নাকি ভাল না।
সঙ্গে সঙ্গে মুসা ধরল, কি ভাল না? ভূত আছে নাকি?
আবার হাসল আক্কেল আলী, তা জানি না। তবে বড় বড় সাপ আছে। এই তো, আর বছরই তো একটা বিরাট কেউটে মারলাম। জাম পাড়তে গিয়েছিলাম, দেখি গাছের গোড়া বেড় দিয়ে পড়ে আছে।
বেড় দিয়ে পড়ে থাকে! এত্তোবড়!
মুসার কথার জবাবে মাথা নাড়ল আক্কেল আলী। আরও একটা ব্যাপারে সাবধান করল আমাদের, জলার কাছে না যেতে। বেশ বড় একটা জলা আছে। তাতে নাকি পানির চেয়ে কাদা বেশি। পা পড়ে গেলে হড়াৎ করে একেবারে হাঁটু পর্যন্ত দেবে যায়।
পুকুরটা কোন দিকে আছে জেনে নিল কিশোর। সিংহ-দরজা দিয়ে বেরিয়ে সেদিকের পথই ধরল। আক্কেল আলী মানা করায় তার কৌতূহল বেড়ে গেছে।
আমাদের আগে আগে চলেছে কালু। অচেনা বনে-বাদাড়ে সঙ্গে কুকুর থাকলে অনেক সুবিধে।
বনে ঢুকে পড়লাম আমরা। ঘন হয়ে জন্মে আছে আম আর কাঁঠাল গাছ। বিরাট বিরাট কালোজামের গাছও আছে। মাঝে মাঝে বাঁশের ঝাড়। বনের মধ্যে এক ধরনের সবুজাভ আলো। গাছের মাথা দিয়ে যেন চুরি করে নেমে এসে মাটিতে পড়েছে রোদ, গোল গোল হয়ে পড়ে বনতলে সোনালি অলঙ্করণ করে দিয়েছে যেন।
প্রচুর শেয়ালের গর্ত দেখা গেল। আর আছে বেজি ও গোসাপ। প্রথম জানোয়ারটার দিকেই কালুর আগ্রহ বেশি দেখা গেল। গর্ত দেখলেই ছুটে যাচ্ছে সেদিকে, নাক নামিয়ে শুঁকছে। মাঝে মাঝে হাঁক ছাড়ছে ঘাউ ঘাউ করে, যেন বলতে চাইছে: বেরিয়ে আয় ব্যাটা শিয়ালের ছাও, হয়ে যাক একহাত! চুরি করে হাঁস-মুরগী খাওয়া তোমার আমি বের করব!
চলতে চলতে থমকে দাঁড়াল মুসা। তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।
কিশোর জিজ্ঞেস করল, কী?
হাত তুলে দেখাল মুসা, ওই যে।
গাছের ফাঁক দিয়ে আমরাও দেখতে পেলাম পুকুরটা। কালচে-সবুজ পানি।
সুন্দর! বিড়বিড় করল কিশোর।
আমি বললাম, হ্যাঁ, খুব। শাপলা ফুটে আছে কেমন দেখছ? দারুণ!
লাল আর সাদা শাপলায় ছেয়ে আছে পুকুরটা।
তুলতে পারলে কাজ হত, বললাম। দাদীর জন্যে নিয়ে যেতে পারতাম।
হ্যাঁ, নামো, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল মুসা, আর অমনি টুক করে সিন্দুকে টেনে নিয়ে যাক!
সিন্দুক? বুঝতে পারলাম না, সেটা আবার কি?
ও, জানো না এখনও। বাংলাদেশের অনেক পুকুরেই সিন্দুক থাকে। পুরানো দীঘি, পুরানো বড় আন্ধা পুকুর-যেগুলোর চারপাশে জংলা হয়ে থাকে, পানি কালো, সেগুলোতে বাস করে এই ভূতুড়ে সিন্দুক। বড় বড় শেকল থাকে। যেই পানিতে নামবে, আস্তে করে এসে পায়ে পেঁচিয়ে ধরবে। তারপর একটানে একেবারে মাঝপুকুরে, পানির তলায়।
হেসে জিজ্ঞেস করলাম, নিয়ে গিয়ে কি করে?
হাত উল্টে মুসা বলল, আমি কি জানি? হয় গোলাম বানিয়ে রাখে, নয়তো ভূতুড়ে সিন্দুক বানিয়ে নিজেদের দলভারি করে। কিছু তো একটা করেই, নইলে নেয় কেন?
কিশোরের মতই আমারও ভূতপ্রেতে তেমন বিশ্বাস নেই, কিন্তু পুকুরটার দিকে তাকিয়ে মনে হলো সত্যিই থাকতে পারে ও রকম ভূতুড়ে কিছু, শাপলা পাতায় ঢাকা কালো পানি দেখলে কেমন গা ছমছম করে।
পুকুরের একটা পাড়ে ঝোঁপঝাড় একটু হালকা, বাকি তিন পাড়ে ঘন জঙ্গল হয়ে আছে। বেতবন নেমে এসেছে একেবারে পানির ওপর। বেত গাছের গোড়া বিছুটি আর লজ্জাবতী গাছে ছাওয়া। গাঢ় গোলাপী রঙের ফুল ফুটে আছে।
যে পাড় হালকা, সেই পাড়ে এসে উঁড়ালাম আমরা। লাফ দিয়ে সরে গেল একটা ব্যাঙ। ছড়ছড় করে পানির ওপর দিয়ে পিছলে চলে গেল অনেক দূর।
ব্যাঙটা যেখানে বসে ছিল সেখানে তাকাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম। একটা চৌকোণা পাথর। ফুটখানেক পানির নিচে আরও একটা। কাত হয়ে আছে। শ্যাওলায় ছাওয়া। পিচ্ছিল যে হয়ে আছে বোঝার জন্যে পা রাখার দরকার নেই, দেখেই বোঝা যায়। পা দিলেই আছাড় খেয়ে পড়তে হবে পানিতে।
আশ্চর্য! ভুরু কুঁচকে পানির নিচে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল কিশোর, এখানে সিঁড়ি বানাল কে?
সিঁড়ি নাকি? সিন্দুকের ভয় ভুলে এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে তাকাল মুসা।
তা ছাড়া আর কি?
তাই তো। পুকুরে তো সিঁড়ি বানায় মানুষ ঘাটলা তৈরি করলে। নেমে গোসল করার জন্যে।
কিংবা ঘাটলার সিঁড়িতে বসে আয়েশ করার জন্যে।
তাহলে কে সেই আয়েশী লোক?
নিশ্চয় সরকারদের কেউ। দেখো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কাছাকাছি ঘরবাড়ি আছে। বাগানবাড়ি থাকলেও অবাক হব না।
এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করল কিশোর। ঘাটের কাছ থেকে গজ পঞ্চাশেক দূরে বিশাল এক বেতের ঝাড়। সেটার দিকে চোখ আটকে গেল তার। আনমনে হাত নেড়ে আমাদের বলল, চলো তো, দেখি!
বেত গাছের সাংঘাতিক কাটা। লম্বা লম্বা লতা হয়, তাতে আঁকশির মত কাটা, ছোঁয়া লাগলেই চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে যায়।
পড়ে থাকা একটা মরা ডাল খুঁজে আনল মুসা। সেটা দিয়ে কোনমতে বেত ফাঁক করে করে ভেতরে তাকাল। চোখে পড়ল একটা দেয়াল। আর কোন সন্দেহ নেই। সত্যিই একটা বাড়ি আছে এখানে।
ভেতরে কি আছে দেখতে হয়, কিশোর বলল।
এখানে গুপ্তধন আছে ভাবছ নাকি? জিজ্ঞেস করল। গরমের ছুটি
সম্ভাবনা কম। তাহলে পেয়ে যেত লোকে। তবু দেখতে চাই কি আছে।
ঢুকবে কি করে? জিজ্ঞেস করলাম। যা বেতের বেত, চোখের পলকে ছিলেছুলে দেবে।
বাড়ি গিয়ে দা এনে কাটতে হবে। চলো, আক্কেল আলীর কাছ থেকে নিয়ে আসি।
সব শুনে আক্কেল আলী বলল, তোমাদের না ওদিকে যেতে মানা করেছি, তা ও গেলে…
আরে দূর, হাত নেড়ে উড়িয়ে দিল কিশোর, গেলে কি হয়? এর চেয়ে অনেক গভীর আর বিপজ্জনক জঙ্গলে ঢুকেছি আমরা। দুটো দা দাও। ভেতরে ঢুকব।
সাপের কামড় খেয়ে মরার ইচ্ছে হয়েছে আরকি। চলো, আমিও যাব। একলা ছেড়ে দিলে মা বকবেন।
তোমার আর যাওয়ার দরকার নেই, মুসা বলল, আমরাই কাটতে পারব।
তাহলে মা-কে বলে যেতে হবে। নইলে আমিই বলে দেব। তোমাদের কিছু হলে শেষে মা আমাকে আস্ত রাখবেন না।
দাদীকে বলতে গেলে বাধা দিয়ে বসতে পারেন, এই ভয়ে আক্কেল আলীর কথার আর প্রতিবাদ করলাম না। তাকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হতে যাব, এই সময় বারান্দায় বেরোলেন দাদী। এসেছিস তোরা? এ-কি, এখনও গোসলই করিসনি। যা যা, জলদি যা। আমার রান্না হয়ে গেছে।
মুগডাল দিয়ে রুইমাছের মাথার মুড়িঘন্ট, রুইমাছ ভাজা, চালকুমড়া ভাজি আর ডাল দিয়ে গলা পর্যন্ত গিললাম। তারপর যখন ক্ষীরের মত ঘন দুধ আর শহর থেকে কিনে আনা ফজলি আম নিয়ে এলেন দাদী, করুণ চোখে ওগুলোর দিকে তাকাতে লাগলাম। কারণ আমার আর একটা দানা গেলারও সামর্থ্য নেই। তবে মুসা ছাড়ল না। ইয়া বড় বড় দুটো ফজলি আম আর বড় এক বাটি দুধ মেরে দিল অনায়াসে। কম করে হলেও এক হাজার বার আউড়াল-এর চেয়ে সুস্বাদু খাবার পৃথিবীর আর কোন দেশে নেই।
ভরপেট খেয়ে তক্ষুণি আর বেরোতে পারলাম না। আধঘণ্টা মত গড়াগড়ি দিয়ে নিলাম বিছানায়। তারপর উঠে আক্কেল আলীকে সঙ্গে করে দা নিয়ে রওনা হলাম মজা পুকুরের পাড়ে।
.
০৪.
আক্কেল আলীকে সঙ্গে এনে খুব ভাল করেছি। খানিক পরেই বুঝলাম, সে না এলে ওই বেত কেটে ভেতরে ঢোকার সাধ্য আমাদের হত না। সাংঘাতিক শক্ত গোড়। সারা গায়ে বড় বড় কাঁটা। বেতগাছ কাটতে হলে একটা বিশেষ কায়দায় কাঁটা বাঁচিয়ে কোপ দিতে হয়। সামান্য এদিক ওদিক হলেই কনুই থেকে হাতের নিচের অংশের চামড়া আর থাকবে না, ফালাফালা হয়ে যাবে কাঁটার আঘাতে। আক্কেল আলীর বক্তব্য, পাগল না হলে এই বেত কেটে ওই পোড়াবাড়িতে ঢোকার কথা ভাবে না কেউ। অর্থাৎ তার ধারণায়, আমরা তিনজনই পাগল।
বাড়িটা যে আছে ওখানে, জানা ছিল তার। বানিয়েছিলেন এখানকার প্রথম জমিদার, আইন উদ্দিন সরকার। এতটাই পোড়ো, ঢুকে দেখার কথা মনে হয়নি কখনও আক্কেল আলীর। পঁয়তিরিশ বছর আগে সে যখন এসেছিল, তখনও এমনই কাটা ছিল এখানটায়। তার মনে হয়েছিল-কি আর আছে এর মধ্যে দেখার মত, সাপ আর ইঁদুর-শজারু ছাড়া? শুধু ওসব দেখার জন্যে কাটার খোঁচা খেয়ে ঢোকার কষ্ট কে করে।
শেষ পর্যন্ত আক্কেল আলীর চেষ্টাতেই ঘরে ঢোকা সম্ভব হলো। দুই কামরার বাড়ি, বাগানবাড়ি নয়, তবে প্রচণ্ড গরমের সময়, কিংবা মন ভাল না লাগলে এসে একাকী কাটানোর জন্যে একটা চমৎকার জায়গা ছিল এটা একসময়। সামনে পুকুর, বন-জঙ্গল, গরমের দিনে চাঁদনী রাতে নিশ্চয় অপরূপ দৃশ্য হয়।
ভেতরে মাকড়সার জালের ছড়াছড়ি, পা বাড়ালেই হাতে, মুখে লাগে। সঙ্গে করে আনা ছোট একটা ডাল দিয়ে সামনের জালগুলো ছিঁড়ে সরিয়ে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। জানালা আছে দুটো, কিন্তু বাইরে থেকে লতাপাতায় এমন করে জড়িয়ে আটকে রেখেছে, ঠেলে খোলা মুশকিল।
ভেতরের দিকের ঘরে দেয়ালের কাছে বহু পুরানো একটা বেঞ্চ রাখা, তাতে পুরু হয়ে ধুলো জমে আছে। টেবিলও আছে একটা, তাতেও ধুলো। আরেকটু কাছে এগোল কিশোর। আমরা রইলাম তার পেছনে।
দুটো গ্লাস দেখতে পেলাম টেবিলে।
কিশোর বলল, শেষবার যারা ঢুকেছিল এখানে, কথা বলেছিল বসে, তারা নিশ্চয় এই গ্লাসে করে কিছু খেয়েছিল। দু-জন লোক।
আক্কেল আলী বলল কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গেই, কি আর খাবে! মদ খেয়েছিল আরকি! এ বাড়িতে তো এক সময় রীতিই ছিল, পুরুষমানুষের মদ খেতে হবে।
একটা গ্লাস তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে কিশোর বলল, এ রকম গ্লাস রান্নাঘরের আলমারিতেও দেখেছি।
খাটো খাটো গ্লাস, খুব ভারি কাঁচে তৈরি, ইংল্যান্ডের একটা কোম্পানির নাম ছাপ দিয়ে লেখা রয়েছে তলায়।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ঘরগুলোতে আর কোন জিনিস পেলাম না। গুপ্তধনের কোন চিহ্ন না পেয়ে কিছুটা নিরাশই হলাম।
রাতে খাবার টেবিলে বসে পোড়ো বাড়িতে ঢোকার খবরটা জানালাম আমরা।
গ্লাস দুটো পেয়ে খুশি হলো দাদী।
মতিদাদা বললেন, ঘরটা সুন্দর। তোমাদের বয়েসে চাঁদনী রাতে, বৃষ্টির দিনে, কতদিন গিয়ে একা একা বসে থেকেছি ওখানে। বন দেখতে খুব ভাল লাগত। বিশেষ করে পুকুরটা। শাপলায় ভরা, চাঁদের আলোয় রহস্যময় হয়ে উঠত। মুষলধারে বৃষ্টি যখন হত, তখন লাগত আবার আরেক রকম। শাপলাপাতায় বৃষ্টির নাচন দেখেছ? দুর্দান্ত!
চাঁদনী রাতে সিন্দুকেরা নিশ্চয় ছানাপোনা নিয়ে বেরোত! মুসা বলে উঠল। উঠে আসত পানি থেকে। ধাড়িটা থাকত আগে আগে, তার পেছনে মাদীটা, আর তাদের পেছনে ছানার দল। হেলেদুলে এগোচ্ছে বড় দুটো, আর পিচ্চিগুলো নাচানাচি করছে। ছবি তুলে রাখতে পারলে কোটিপতি হয়ে যাওয়া যেত!
ভুরু কুঁচকালেন দাদা। কারা বেরোত?
মুসার ভূতুড়ে সিন্দুকের কথা বুঝিয়ে বলল কিশোর।
হা-হা করে হাসলেন দাদা। বললেন, তাহলে একদিন গিয়ে রাতে থেকেই দেখো, বেরোয় কিনা?
থাক থাক, তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন দাদী, ছেলেগুলোকে আর কুবুদ্ধি দিয়ো না। সাপখোপের আড্ডা, শেষে কামড় খেয়ে মরবে।
কিন্তু কুবুদ্ধিটা কিশোরের মাথায় ঠিকই ঢুকে গেল। ঘরে ফিরে এসে শলা পরামর্শ করতে লাগল আমাদের সঙ্গে, ঘরটা পরিষ্কার করে ওখানে রাত কাটালে মন্দ হয় না। আমরা না করলাম না। একবার যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে, সেটা করবেই, আর তাকে ফেরানো যাবে না। তা ছাড়া ভয় ভয় করলেও ওখানে থাকতে আমাদের যে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না, তা নয়।
সুতরাং পরদিন থেকেই দাদীকে না জানিয়ে কাজ শুরু করে দিলাম আমরা। ধুয়ে মুছে ঝকঝকে তকতকে করে ফেললাম বাড়িটাকে। আশপাশের জঙ্গল সাফ করলাম। জানালা খুলে দেয়া গেল। আরেকটা চমৎকার জিনিস বেরোল, একট। অ্যাকোয়ারিয়াম। মাটিতে বেশ বড় একটা ট্যাংক বানিয়ে, চারপাশ পাকা করে দেয়া হয়েছে। নালা কেটে পুকুর থেকে পানি ঢোকার ব্যবস্থা আছে। তাতে কিছু জলজ উদ্ভিদ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে এমন করে, যাতে মাছের আগ্রহ জন্মায়। ওই অ্যাকোয়ারিয়ামে এসে ঢোকে ওরা। বহু দিন পরিষ্কার করা হয় না বলে ময়লা হয়ে আছে এখন ট্যাংকটার পানি, গাদা গাদা পাতা পড়ে পচে আছে তলায়। ওই পানিতেই কয়েকটা পুঁটি আর একটা টাকি মাছকে ঘুরতে দেখলাম।
দু-দিন লাগল সব ঠিকঠাক করতে।
তৃতীয় দিনের দিন বিকেলে ওই বাড়িতে বসেই চা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। খাবার আর চায়ের কেটলি গুছিয়ে নিয়ে রওনা হলাম।
ঘরের দাওয়ায় বসে বসে প্রকৃতি দেখতে লাগলাম আমরা।..
করুণ গলায় টেনে টেনে বিলাপ করছে ঘুঘু। মাঝে মাঝে অলস ভঙ্গিতে শিস দিচ্ছে দোয়েল। পুকুরের পানিতে শাপলার ফাঁকে ফাঁকে পোকা আর ছোট মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে দুটো জলমুরগী।
পশ্চিমে যতই ঢলতে লাগল সূর্য, বনতলে লম্বা হতে লাগল গাছের ছায়া।
চা খাওয়া শেষ করলাম আমরা।
হঠাৎ মাথার ওপর কর্কশ গলায় ডেকে উঠল একটা পেঁচা। চমকে চোখ তুলে তাকালাম। চালার খাপে বাসা ওটার। দিন শেষ হয়ে রাত আসছে, জেগে উঠছে বনের নিশাচরেরা। খানিক আগেই উঁকি দিয়ে গেছে একজোড়া শেয়াল।
বাসাটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে উঠল কিশোর, ওটা কি?
উঠে দাঁড়াল সে।
আমি আর মুসাও তাকালাম।
কোথায়? জিজ্ঞেস করলাম।
বাসাটার পাশে দেখো। বাক্সের কোণা মনে হচ্ছে না?
খাইছে! তাই তো!
মোটেও দেরি করল না মুসা। খাপের ফাঁকে খুঁজে রাখা ছোট কাঠের বাক্সটা বের করে আনল। প্রায় দুশো বছরের পুরানো বাক্স, সারা গায়ে পিতলের পাত বসিয়ে নকশা করা। নিশ্চয় কারও শখের জিনিস ছিল এটা। বেশ ভারি।
এর মধ্যে গুপ্তধন নেই তো? কানের কাছে নিয়ে বাক্সটা ঝাঁকি দিয়ে ভেতরে কি আছে বোঝার চেষ্টা করল মুসা।
না, বেশি ছোট, কিশোর জবাব দিল। ভাবছি, খাপের মধ্যে গেল কি করে? পাখিতে নিতে পারেনি। এটা তোলার সাধ্য হবে না কোন পাখিরই। তাহলে কেউ রেখেছে। মানুষ।
আছে কি এর মধ্যে? জিজ্ঞেস করলাম।
খুলেই দেখা যাক না, মুসার হাত থেকে বাক্সটা নিয়ে ডালা খোলার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু ডালাটা যে কোন দিকে, কোটা ওপর আর কোটা নিচ, সেটাই বোঝা গেল না। বেশ কায়দা করে তৈরি বাক্সটা।
অন্ধকার হয়ে গেছে। আলোয় না দেখে বাক্সটা খোলা যাবে না বুঝতে পেরে সেই চেষ্টা আর করলাম না আমরা। ওটা নিয়ে বাড়ি ফিরে চললাম।
.
০৫.
গাড়ি-বারান্দায় সেই গাড়িটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আবার বাড়ি কিনতে চায় যে লোকটা, তার। ঘনঘন আসা-যাওয়া করছে, কিনেই ছাড়বে। খুব তাড়াতাড়ি গুপ্তধনগুলো আমরা উদ্ধার করতে না পারলে বাঁচানো যাবে হীরাদাদীর এত সাধের এই জমিদার বাড়ি।
দাদা-দাদী নিশ্চয় লোকটার সঙ্গে হলঘরে আছে, ওখানে বসে বাক্স খোলা নিরাপদ নয়, তাই ডাইনিং রুমে চলে এলাম আমরা। টেবিলে বসেই বাক্সটা খোলায় মন দিল কিশোর। বাক্সের গায়ে হালকা একটা রেখা চোখে পড়ল। বোঝা গেল, ওটাই জোড়া, কিংবা ঢাকনার কিনারা। ঘর থেকে গিয়ে তার ব্যাগ থেকে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা এনে দেয়ার অনুরোধ করল আমাকে।
এনে দিলাম।
গ্লাস দিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো সে, ঢাকনা কোনটা। সূক্ষ্ম ফাঁকটায় ছুরির মাথা ঢুকিয়ে চাড় দিতে লাগল। সামান্যতম নড়ল না ঢাকনাটা। আরও জোরে ছাড় দিতেই সামান্য ফাঁক হলো মনে হলো। জোরে জোরে চাড় দিতে লাগল তখন।
অবশেষে খুলে গেল ঢাকনা। মনে হলো, কোন ধরনের আঠা মাখিয়ে তারপর চেপে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল ওটা, সে জন্যেই খুলতে অত কষ্ট হয়েছে।
ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়লাম আমরা তিনজন।
হতাশ হতে হলো। কিছুই নেই! কিচ্ছু না! একটা সোনার মোহর কিংবা একটা সাধারণ আঙটিও নেই। গুপ্তধন তো দূরের কথা।
বাক্সটা টেবিলে রেখে দিয়ে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে শুরু করল কিশোর।
খালি বাক্স হাতে নিয়ে আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কিছুক্ষণ মুসা। তারপর নিরাশ ভঙ্গিতে রেখে দিয়ে বলল, দূর, খামোকা সময় নষ্ট!
আমি হাতে তুলে নিলাম বাক্সটা। ব্যাপারটা আমার চোখেই পড়ল প্রথম। বাইরের দিকটা যত বড়, ভেতরের দিকটা তার চেয়ে অনেকটাই ছোট, বিশেষ করে নিচের দিক। অতটা তো হওয়ার কথা নয়! অত পুরু নয় কাঠ। তাহলে? কিশোরকে বললাম আমার সন্দেহের কথাটা।
থাবা দিয়ে আমার হাত থেকে বাক্সটা কেড়ে নিয়ে একবার তাকিয়েই বলে উঠল কিশোর, তাই তো! ফলস বটম আছে।
বাক্সের নিচে বসানো চোরা কুঠরিটা খোলার চেষ্টা করতে করতে ঘেমে গেল সে, কিন্তু লাভ হলো না। খুলতে পারল না। শেষে রেগে গিয়ে মারল এক আছাড়। ভেঙে ফেলতে চায়। আর তাতেই হয়ে গেল কাজ। প্রচণ্ড আঘাতে ছুটে গেল ভেতরের স্প্রিঙ, খুলে গেল কুঠুরির ঢাকনা।
হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আমরা তিনজন। ভেতরে রয়েছে একটা পুরানো খাম।
ছোঁ মেরে তুলে নিল কিশোর। খামের ভেতর থেকে বেরোল একটা অনেক পুরানো চাবি, আর এক তা ভাজ করা কাগজ। চাবিটা নিশ্চয় সিন্দুক কিংবা আলমারির, ভাবলাম, আর কাগজটা শুপ্তধন কোথায় আছে তার নকশা। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
চাবিটা পকেটে রেখে ভাঁজ করা কাগজটা মেলল কিশোর।
আরেকবার হতাশ হতে হলো আমাদেরকে। কোন নকশা-টকশা নেই, কলম দিয়ে আঁকা একজন মানুষের ছবি। বিশেষত্ব একটাই, কয়েক রঙে আঁকা হয়েছে ছবিটা, একই কলম ব্যবহার করে, ভিন্ন ভিন্ন রঙের কালি দিয়ে। নিখুঁত করে আঁকা। কার ছবি চিনতে পারলাম। হলঘরে দেখেছি। জমিদার আমিন উদ্দিন সরকারের।
মানে কি এর? বিড়বিড় করল কিশোর।
ঘোড়ার ডিম! রেগে গেছে মুসা।
হতে পারে ওই ছবিটাই খুব দামী… বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। চোখের কোণ দিয়ে চোখে পড়ল একজন মানুষ। নিঃশব্দে কখন এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরে, উত্তেজনায় খেয়াল করিনি।
মুখ তুলে তাকালাম। গভীর আগ্রহে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছেন সেই ভদ্রলোক, যিনি বাড়ি কিনতে চান। আমরা তাকাতেই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় পেয়েছ এটা?
বাক্সের মধ্যে, জবাব দিয়ে দিল মুসা।
বাক্সটা কোথায় পেলে?
কিশোরের বার বার চোখ টেপা সত্ত্বেও খেয়াল করল না মুসা, বলে দিল, পোড়োবাড়িতে। মজা পুকুরের ধারে বেতবন আছে না, সেখানে।
একটু দেখতে পারি ছবিটা? হাত বাড়ালেন ভদ্রলোক।
এই সময় ঘরে ঢুকলেন মতিদাদা। জিজ্ঞেস করলেন, কিসের ছবি?…এ-কি, এ তো আমার দাদার! কোথায় পেলে?
জানানো হলো তাকে।
লক্ষ করলাম, ছবিটার দিকে তাকিয়ে চকচক করতে লাগল ভদ্রলোকের চোখ, যিনি বাড়ি কিনতে এসেছেন। ছবিটা রেখে ভোলা বাক্সটাও হাতে নিয়ে দেখলেন। তারপর টেবিলে রেখে ঘুরে তাকালেন দাদুর দিকে, বললেন, হ্যাঁ, বাকি ঘরগুলো দেখার আর দরকার নেই আজ। রাতের বেলা না দেখে অন্যদিন এসে দিনের বেলা দেখব।
কিন্তু আপনিই তো দেখার জন্যে চাপাচাপি করলেন! ভদ্রলোকের এই হঠাৎ মত পরিবর্তনে যেন কিছুটা অবাকই হয়েছেন দাদা।
তা বলেছি। এখন বুঝতে পারছি, ঠিকই বলেছেন, রাতের বেলা ভালমত দেখা যায় না সব।
বেরিয়ে গেলেন আবার দু-জনে।
রাতের বেলা খাবার টেবিলে ছবিটা নিয়ে আলোচনা হলো। দাদু বললেন, আমার দাদু কিছুটা পাগলাটে স্বভাবের ছিলেন। ধাঁধা আর রহস্যের প্রতি বেজায় ঝোঁক ছিল তাঁর। নিজে নিজে অনেক ধাঁধা তৈরি করেছেন। ছবিও ভাল আঁকতে পারতেন।
তোমার কি মনে হয়, জিজ্ঞেস করল কিশোর, এই ছবিটাও কোন ধরনের ধাঁধা? গুপ্তধন কোথায় আছে তার ইঙ্গিত?
তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন দাদা। তোর মাথায়ও দেখি উদ্ভট সব ভাবনা খেলে বেড়ায়। দাদার সঙ্গে মিলত ভাল। হাহ্ হাহ্!
তুমি গুরুত্ব দিচ্ছ না? তাহলে বাক্সটার মধ্যে অত যত্ন করে উঠিয়ে চালার খাপে ভরে রাখলেন কেন?
ওটাও আরেক পাগলামি।
কিন্তু মেনে নিতে পারল না কিশোর, তার মুখ দেখেই বোঝা গেল।
খাওয়ার পর ঘরে এসে চাবিটা দরজার চৌকাঠের নিচের একটা ফোকরে লুকিয়ে রাখল কিশোর। বলল, সাবধানের মার নেই।
ডাইনিং রুমে তখন যে কথাটা শেষ করতে পারিনি, সেই কথাটাই তুললাম আবার, ছবিটা দামী কোন ছবি নয় তো? হয়তো আমিন উদ্দিন সরকারের ছবির নিচে আঁকা আছে অনেক দামী কোন শিল্পীর ছবি। হতে পারে না?
পারে, মাথা ঝাঁকাল কিলোর।
আমার মনে হয়, মুসা বলল, ছবিটার নিচে কোন গোপন দরজা আছে। ফ্রেমটা কত বড় দেখেছ?
সেটাও সম্ভব। চলো, বরং দেখেই আসি।
শূন্য হলঘর। দাদা-দাদী শোবার ঘরে চলে গেছেন। আক্কেল আলী থাকে বাইরের একটা ঘরে, আগে মালী থাকত ওঘরে। সেটার দরজাও বন্ধ, তার মানে আক্কেল আলীও শুয়ে পড়েছে। বাড়ির বাইরে বাগানে পাহারা দিচ্ছে কালু। আমরা টর্চের আলো ফেলতেই এগিয়ে এল লেজ নাড়তে নাড়তে।
গুপ্তধন খোঁজার এটা চমৎকার সময়। আবার হলঘরে ফিরে এলাম আমরা। আমিন উদ্দিন সরকারের ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। আসল না নকল, নিচে আরও ছবি আঁকা আছে কিনা বোঝার উপায় নেই।
এ ভাবে দেখে কিছু বুঝব না, কিশোর বলল। বুঝতে হলে ল্যাবরেটরিতে পাঠাতে হবে।
নিচে পথ আছে কিনা দেখে ফেলি না কেন? মুসা বলল।
বেশ শক্ত করে দেয়ালে লাগানো আছে ভীষণ ভারি ফ্রেমটা। খুলে সরাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো।
সরিয়ে আবারও হতাশ হলাম। কোন ফঁক-ফোকর নেই। একেবারে নিরেট দেয়াল। দেয়ালে ঠুকে ঠুকে দেখলাম, একটা ইঞ্চি জায়গাও পেলাম না যেখান থেকে ফাপা আওয়াজ বেরোয়।
কি আর করব। ছবিটা আবার আগের জায়গায় বসিয়ে রাখলাম।
আগতত আর কিছু করার নেই এখানে। তদন্তের কাজ রাতের মত স্থগিত রেখে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ার প্রস্তাব দিল মুসা। সানন্দে রাজি হলাম আমি। তবে কিশোরের যাওয়ার ইচ্ছে নেই। সে জানাল, কিছু থাকলে এই ঘরটাতেই আছে। আমার মন বলছে!
থাকলে সেটা সকালেও বের করা যাবে, বললাম আমি। চলো, গিয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করি আগে।