১১.
ঢুকে যেতে শুরু করলাম সুড়ঙ্গের গভীর থেকে গভীরে। মাটি ভেজা ভেজা। নরম। বাইরের পানি পড়ে ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। সেজন্যেই এই অবস্থা। আগেরটার। চেয়ে অনেক বেশি মোড় আর গলিঘুপচি এটাতে। দুদিকের দেয়ালে আরও অনেক ফোকর দেখা গেল। কোনটা শুধুই গর্ত, কোনটা সুড়ঙ্গের মুখ। এখানে পথ হারালে কিংবা ভুল করে যদি ওগুলোর কোনটাতে ঢুকে পড়ে কেউ, বেরোনো মুশকিল। কোনটা দিয়ে কোনটাতে চলে যাবে, চিহ্ন দিয়ে না রাখতে পারলে শেষে বোঝাই যাবে না।
টর্চের আলো ফেলে খুব সাবধানে এগোতে লাগলাম। ভূতের ভয় তো আছেই, পথ হারানোর ভয়ও আছে। কোথাও কোথাও নিচু হয়ে যাচ্ছে ছাত। সেসব জায়গায় মাথা নুইয়ে ফেলতে হচ্ছে। অসাবধান হলে ঠোকর লাগছে মাথায়। দুপাশ থেকে চেপে এসে কোথাও সরু হয়ে যাচ্ছে পথ। হাঁটার সময় বেরিয়ে থাকা পাথরে ঘষা লাগে।
কিছুদূর এগোনোর পর থমকে দাঁড়ালাম। ফিসফিসে একটা কণ্ঠ কানে আসছে। সেই প্রথম থেকেই। আগের দিনও শুনেছি বলে সেদিন আর গুরুত্ব দিইনি। আমার নাম ধরে ডাকাডাকি।
শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে বোঝার চেষ্টা করলাম। কান পাতলে মনে হয়, চতুর্দিকেই হচ্ছে। যেদিকে তাকাই, সেদিক থেকেই আসে। বদ্ধ জায়গায় কিংবা সুড়ঙ্গের মধ্যে বোধহয় কোন রকম কারসাজি করে শব্দ, সেজন্যেই ওরকম লাগে।
কিন্তু এ ভাবে ডাকে কে? দেখা দরকার। কিছুটা সামনে এগিয়ে, কিছুটা পিছিয়ে, এদিক ওদিক আরও দুচারটা উপসুড়ঙ্গে ঢুকে বোঝার চেষ্টা করলাম। হদিস পেলাম না। বেশি ঘোরাঘুরি করতেও সাহস পেলাম না। অগত্যা ডাকে ডাকুক এ রকম একটা মনোভাব নিয়ে আবার ফিরে এলাম মূল সুড়ঙ্গে। এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।
সুড়ঙ্গের আরেকটা বড় মোড় ঘুরে অন্যপাশে বেরোতেই দেখি সামনে দেয়াল। রুদ্ধ। আর যাওয়ার পথ নেই। ছোট একটা গুহায় ঢুকে শেষ হয়েছে পথ। প্রথমে দেয়ালগুলোতে আলো ফেললাম, তারপর মেঝেতে।
কি যেন একটা পড়ে আছে।
এগিয়ে গেলাম। একটা পুরানো ব্রিফকেস। ভেতরে কি আছে দেখার কৌতূহল হলো। কিন্তু তালা লাগানো। খুলতে পারলাম না। এখানে ব্রিফকেস ফেলে গেল কে? প্রথমেই মনে এল চোর-ডাকাতের কথা। হয়তো এর মধ্যে দামী অলঙ্কার কিংবা টাকাপয়সা আছে।
নিচু হয়ে হাতল ধরে তুলে নিলাম ওটা। হালকা। টাকা কিংবা অলঙ্কার বোঝাই হলে অনেক ভারী হতো। ঝাঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি আছে। মৃদু খড়মড় শব্দ হলো। বোঝা গেল না কি আছে। একেবারে খালি নয়, এটুকু বোঝা গেল শুধু।
খোলার চেষ্টা করলাম। তালা লাগানো। চাবি নেই সঙ্গে। ভেঙে খুলতে হবে। বাইরে নিয়ে গিয়ে খুলে দেখব ভেবে রেখে দিলাম হাতে। বাঁ হাতে ব্রিফকেস ঝোলানো, ডান হাতে টর্চ। আর কি আছে গুহায় দেখতে লাগলাম। আমার একপাশে কয়েক হাত দূরে এক দেয়ালের গোড়ায় আলো ফেলতেই স্থির হয়ে গেল হাত। বরফের মত জমে গেলাম যেন। নড়তে পারলাম না। দম নিতে পারলাম না। এমনকি চিৎকারও করতে পারলাম না।
আগের রাতে ঝড়ের সময় যে লোকটাকে দেখেছি, সে পড়ে আছে দেয়ালের নিচে। তেমনি হরিণের চামড়ার পোশাক পরনে। মাথায় পালকের মুকুট।
ভাল করে দেখতে গিয়ে বুঝলাম, লোকটা নয়, তার কঙ্কাল। মাথার চুল সব খসে পড়েনি তখনও। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় হাড়ের সঙ্গে চামড়া জড়িয়ে আছে।
টপ করে মাথায় পড়ল কি যেন। এতটাই চমকালাম, পানির ফোঁটা কিনা সেটা ভাবারও সময় হলো না। ঘুরে দৌড় দিতে গেলাম। দেয়ালে বাড়ি লেগে হাত থেকে ছুটে গেল টর্চ। মাটিতে পড়ে নিভে গেল। গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনলাম। গাঢ় অন্ধকার যেন গিলে নিল আমাকে।
উবু হয়ে বসে হাতড়াতে শুরু করলাম।
টুপ করে ঘাড়ে পড়ল কি যেন। চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু না, পানির ফোঁটা। বেয়ে নামতে লাগল নিচের দিকে।
আবার হাতড়াতে শুরু করলাম মেঝেতে।
টর্চটা ঠেকল হাতে। তুলে নিয়ে সুইচ টিপলাম। জুলল না। ঝাঁকি দিলাম। তাও জ্বলল না। নানা ভাবে চেষ্টা শুরু করলাম জ্বালানোর জন্যে। জুলল না ওটা। হাত কাঁপছে। কিছুতেই স্থির রাখতে পারছি না। বুকের মধ্যে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন।
যখন বুঝলাম, কিছুতেই জ্বালতে পারব না, আতঙ্কে অবশ হয়ে আসতে চাইল হাত-পা। এই অন্ধকারে বেরোব কি করে?
আন্দাজে পা বাড়ালাম সামনের দিকে।
কয়েক পা এগোতেই হোঁচট লাগল কিসে যেন। বিচিত্র খটমট শব্দ হলো। অকেজো টর্চটা মাটিতে রেখে নিচু হয়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কিসে হোঁচট খেয়েছি। হাতে লাগল খসখসে, শক্ত কিছু। কঙ্কালের গায়ে হাত দিয়েছি বোঝার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাব। ঘুরে উল্টো দিকে দিলাম দৌড়।
সুড়ঙ্গমুখের কাছের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। পাগলের মত হাত বাড়িয়ে ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগলাম। ফাঁকা মানেই সুড়ঙ্গমুখ।
পেয়ে গেলাম ওটা। ছুটতে শুরু করলাম অনুমানের ওপর নির্ভর করে।
অকেজো টর্চটা আর তুলে আনিনি। কঙ্কালের কাছেই রয়ে গেছে। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও ব্রিফকেসটা ফেলিনি হাত থেকে।
ছুটছি, ছুটছি, ছুটছি। গায়ে পাথরের ঘষা লাগতে বুঝলাম সুড়ঙ্গের সরু অংশটায় পৌঁছে গেছি। আরও কিছুদুর এগিয়ে মাথায় বাড়ি খেলাম। বুঝলাম, নিচু ছাত। আশা বাড়ল। ঠিকপথেই চলেছি।
ছোটা বন্ধ করে তখন হাঁটতে শুরু করলাম।
হাঁটছি তো হাঁটছিই, পথ আর শেষ হয় না। ঘটনাটা কি? এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়?
আরও প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট হাঁটার পর সন্দেহ হলো, পথ হারাইনি তো?
কথাটা মনে হতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগল। প্রচণ্ড আতঙ্কে মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করলাম আবার। দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছি। ঘষা লেগে ছড়ে যাচ্ছে কনুই। নিচু ছাতে ঠোকর খেয়ে মাথায় গোলআলুর মত ফুলে যাচ্ছে। কোন। কিছুরই পরোয়া করছি না। কেবল ছুটছি আর ছুটছি।
হঠাৎ ধাক্কা খেলাম দেয়ালে। কপাল ঠুকে গেল। হাত বাড়িয়ে দেখে বুঝলাম, সামনে এগোনোর পথ নেই। সরে গেলাম একপাশে। ফোকর পাওয়া গেল একটা। এগোতে গেলাম। কিন্তু সুড়ঙ্গমুখ নয় ওটা। দেয়ালের গায়ে বড় একটা গর্ত। পিছিয়ে এলাম। হাতড়ে হাতড়ে বের করার চেষ্ট করলাম সুড়ঙ্গমুখ। অনেক চেষ্টা করেও পেলাম না। যেটা দিয়ে ঢুকেছি, সেটার মুখও বের করতে পারছি না আর।
অবশ হয়ে গেছে শরীর। পরিশ্রমে হাপাচ্ছি। নাক দিয়ে শিস কেটে বেরোচ্ছে নিঃশ্বাস। একটা দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লাম।
হাল ছেড়ে দিয়েছি। মনে হলো, আর কোনদিন বেরোতে পারব না এই অন্ধকার গোলকধাঁধা থেকে। কেউ জানে না আমি এখানে আছি। কেউ আমাকে উদ্ধার করতে আসবে না।
মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি, বাইরে এখন বিকেলের রোদ। নীল আকাশ। সাদা সাদা মেঘ। পাখি গান গাইছে। ওসব আর কোনদিন দেখতে পাব না আমি! ভীষণ কান্না পেতে লাগল।
আরেকটা কথা মনে পড়তে আতঙ্কে সিটিয়ে গেলাম। বাইরে এখনও দিন, কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না আর আলো। বিকেল শেষ হয়ে যাবে। সূর্য ডুববে। সন্ধ্যা নামবে। সূর্যাস্তের পর পরই বেরোয় কবরের প্রহরী! তারপর কি ঘটবে ভাবতে পারলাম না আর।
ঘাম ঝরছে দরদর করে। ঘাড়ের ঘাম মুছতে গিয়ে হাতে ঠেকল মালাটা। আশার আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল মনে। এমন করে চেপে ধরলাম ওটা যেন ধরার ওপরই নির্ভর করছে আমার বাঁচা-মরা।
.
১২.
বাতাস ভেজা। মাটি ভেজা। বসে থাকতে থাকতে প্যান্টের হিপ ভিজে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে থেকে শার্টের পিঠও ভিজল। শীত শীত করতে লাগল আমার।
কতক্ষণ ওভাবে বসেছিলাম জানি না। হঠাৎ কানে এল, নাম ধরে ডাকছে। কেউ। গুরুত্ব দিলাম না। খিঁচড়ে গেল বরং মেজাজ। আরও যন্ত্রণা দিতে চাইছে। আমাকে।
বাড়তে লাগল ডাকটা। মনে হলো কাছে এগোচ্ছে।
তারপর আস্তে আস্তে আবার দূরে সরে গেল।
কয়েক মিনিট পর আবার শোনা গেল ডাকটা। আবার এগিয়ে আসছে। জোরাল হচ্ছে শব্দ।
আরও এগোতে চেনা চেনা লাগল স্বরটা। তেতো হয়ে গেল মন। আমার সঙ্গে রসিকতা করছে ভূতটা। চেনা মানুষের কণ্ঠ নকল করে আমাকে ধোকা দিতে চাইছে।
আরও এগিয়ে এল ডাক।
আর সহ্য করতে পারলাম না। চেঁচিয়ে উঠলাম, যা ব্যাটা ভূতের বাচ্চা, ভূত! সর এখান থেকে! যা পারিস করগে আমার!
আরও এগোল কণ্ঠটা। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, রবিন, কোথায় তুমি? কোত্থেকে কথা বলছ?
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভুল শুনছি না তো? নিনার কণ্ঠ। নাকি ভূতটাই এসেছে নিনার রূপ ধরে আমাকে জ্বালাতে?
জবাব দিলাম না।
আবার শোনা গেল নিনার চিৎকার, রবিন, জবাব দিচ্ছ না কেন?
চিৎকার করে জবাব দিলাম, নিনা, আমি এখানে! এই যে, এখানে! তুমি কোথায়?
কয়েক সেকেন্ড পর আলো দেখতে পেলাম। এগিয়ে আসছে আলোটা।
উঠে দাঁড়ালাম। আমিও এগোলাম সেদিকে।
মুখের ওপর টর্চের আলো পড়ল আমার। নিনা জিজ্ঞেস করল, এই অবস্থা কেন তোমার?
পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তুমি এলে কি করে?
জবাবে বলল ও, কেন আমি কি রাস্তা চিনি না নাকি?
না, সেকথা বলছি না। তুমি জানলে কি করে আমি এখানে আছি?
তুমি তো আর খেলা দেখলে না, চলে গেলে। আমি খেলা সেরে তোমাদের বাড়ি গেলাম। আন্টি বলল, তুমি দুপুরে খেয়ে সেই যে বেরিয়েছ, আর ফেরোনি। সন্দেহ হলো। কোথায় গেলে? মনে হলো, মৃত্যুপুরীতে চলে যাওনি তো? দৌড়ে বাড়ি গিয়ে একটা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তোমাকে এখানে খুঁজে বের করতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার।
টর্চটা হাত থেকে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। পথ হারিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে খুঁজে বের করলে কি করে?
মাটি নরম। পায়ের ছাপ বসে গেছে। দেখে দেখে এসেছি। হাতে ওটা কি?
চলো, যেতে যেতে বলছি।
সুড়ঙ্গে চলতে চলতে সব কথা খুলে বললাম নিনাকে। আগের রাতে দেখা জীবন্ত লোকটা গুহার ভেতর কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে শুনে ওর গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাইল না। তাগাদা দিল, জলদি চলো, সূর্য ডোবার আগেই বেরিয়ে যেতে ইবে! ওই লোকটাই কুকুরের মালিক, বোঝা যাচ্ছে। মরে দুটোতেই ভূত হয়েছে।
হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল ও।
পেছন থেকে সাবধান করলাম, সাবধান, যত যাই করো, হাত থেকে টর্চ ফেলো না। তাহলে মরেছি!
আর কোন অঘটন ঘটল না। নিরাপদেই বেরিয়ে এলাম গুহাটায়, যেটা থেকে দুটো সুড়ঙ্গ দুদিকে চলে গেছে। ফিরে তাকালাম। পাথরের বেদিতে বসে নীরবে তেমনি বিকট হাসি হাসছে খুলিটা। ফিসফিস করে বললাম ওটাকে, সালাম, ভূতের রাজা, আর আসছি না এখানে! যত ইচ্ছে ভয় দেখাওগে এখন মানুষকে, আমাদের। আর পাচ্ছ না।
মৃত্যুপুরী থেকে বেরিয়ে এসে হাঁপ ছাড়লাম।
পশ্চিম দিগন্তে নেমে গেছে সূর্য। আড়ালে যেতে বেশি বাকি নেই।
জলদি হাঁটো! তাগাদা দিল নিনা। সূর্য ডোবার আগেই কবর এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।
খাড়া পাহাড়টার নিচে যখন নামলাম, সূর্য তখন ডুবে গেছে। তবে আর ভয়। নেই ততটা। প্রহরীর এলাকা পার হয়ে এসেছি আমরা।
এতক্ষণে সহজ হয়ে এল নিনা। আমার হাতের ব্রিফকেসটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি আছে ওটাতে, বলো তো?
না খুললে বোঝা যাবে না। তবে অনুমান করতে পারছি।
কি?
দলিল। ইনডিয়ানদের জায়গার। আর গুহার ভেতরে মরে পড়ে থাকা লোকটা সেই ইনডিয়ান সর্দার, আমি নিশ্চিত।
অবাক হলো নিনা। এ ভাবে হেঁয়ালি করে কথা বলছ কেন? কোন ইনডিয়ান সর্দার?
ও, নিনা তাহলে জানে না ব্ল্যাকফায়ার চার্লি টাসকানির কথা। আগের রাতে বাবার কাছে যা যা শুনেছি সব বললাম ওকে।
মাথা দুলিয়ে নিনা বলল, তাহলে তো এখনই খুলে দেখতে হয় ব্রিফকেসটা।
এখানে না। বাড়ি গিয়ে।
আচ্ছা, ধরো, এটাতে দলিলই পাওয়া গেল। কি করবে?
নিয়ে যাব হার্ব গ্যাটলিঙের কাছে। ও-ই ভাল বলতে পারবে কি করতে হবে।
আমার সঙ্গে একমত হলো নিনা, তা ঠিক। সোজা ওর বাড়িতে চলে গেলেই পারি?
না। রাত হয়ে গেছে। রোজ রোজ এ ভাবে বাড়ি না ফিরলে মা বকা দেবে। তা ছাড়া ব্রিফকেসে দলিলগুলো নাও থাকতে পারে। বাড়ি গিয়ে আগে দেখব। যদি দলিলই থাকে, তাহলে কাল সকালে প্রথম কাজটাই হবে আমাদের গ্যাটলিঙের বাড়িতে চলে যাওয়া।
কিন্তু সকালে তো আমার স্কুল।
তাহলে দুপুরে কিংবা বিকেলে যাব। তুমি স্কুল থেকে ফিরে এলে। তোমাকে না নিয়ে যাব না।
কথা দিচ্ছ?
দিচ্ছি। হাজার হোক, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। উফ, তুমি না গেলে আজ কি যে হতো…
আর কোন কথা হলো না আমাদের। দুজন দুদিকে চলে গেলাম। পাহাড়ী পথ বেয়ে নীরবে আমি নেমে চললাম আমাদের বাড়ির দিকে। বেশি দূরে নেই আর।
.
১৩.
গল্প শেষ করে একে একে সবার মুখের দিকে তাকাল রবিন। দম নিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, কি বুঝলে?
মুসা বলল, এতে আর বোঝাবুঝির কি আছে? ভূত।
ফারিহা কিছু বলল না। নীরবে হাত বোলাচ্ছে টিটুর মাথায়।
কি বলতে গিয়ে আবার বোকা বনে যেতে হয় এই ভয়ে কোন মন্তব্য করল না। ফগ। বিড়বিড় করে শুধু বলল, ঝামেলা!
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন। কিছু বলছ না?
নিচের ঠোঁটে ঘন ঘন দুবার চিমটি কাটল কিশোর। কি আর বলব? ভূতুড়ে কোন কিছুই আমি দেখছি না এর মধ্যে।
ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। দেখছ না মানে? সমস্ত ব্যাপারটাই তো ভূতুড়ে!
মোটেও না, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর। বলতে পারো, অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হয়েছে, যেগুলোর জবাব জানা দরকার। ঠিকমত জবাব পেলেই আর ভূতুড়ে থাকবে না একটা ঘটনাও। তাই না?
চুপ করে রইল রবিন।
ফগের দিকে তাকাল কিশোর। আপনি কিছু বুঝতে পারছেন না?
কোন্ ব্যাপারটা? অস্বস্তিতে পড়ে গেল ফগ।
এই যে এতগুলো ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটল। কোনটা কেন, বলতে পারবেন না?
ঝামেলা! আমাকে আবার এর মধ্যে টানছ কেন? আমি কি ওখানে ছিলাম। নাকি?
এ সব বোঝার জন্যে ঘটনাস্থলে থাকা লাগে না।
তাহলে তুমিই বলো না, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল ফগ।
গ্রহণ করল কিশোর। হাত নাড়ল, বেশ, তাই বলছি। তবে ঘটনা ব্যাখ্যা করার আগে একটা কথা জানা জরুরী, রবিনের দিকে তাকাল সে, রবিন, ব্রিফকেসটার মধ্যে দলিলই ছিল তো?
হ্যাঁ। ইনডিয়ানদের, জবাব দিল রবিন।
নিশ্চয় হার্ব গ্যাটলিঙের কাছে নিয়ে গিয়েছিলে। দেখে কি বলল ও?
অনেক ধন্যবাদ দিল আমাদের। কাগজগুলো বার বার মাথায় ছোঁয়াল। বলল, ব্রিফকেসটা ওর কাছেই থাক। জায়গামত পৌঁছে দেবে দলিলগুলো।
তারপর?
অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল আমাদের কাছে। চলে এলাম আমরা। তার পরদিন আবার গিয়ে দেখলাম বাড়িতে নেই ও। দরজায় তালা। কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। আর কখনও ওকে দেখা যায়নি ওই অঞ্চলে।
আবার মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বুড়ো হয়েছিল তো, নিশ্চয় মারাটারা গেছে। হারলে ক্রীকে যাওয়ার আর সুযোগ পায়নি। ঠিক আছে, এখন রহস্যগুলোর জট ছাড়ানো যাক একে একে। প্রথমেই ধরা যাক, পায়ের ছাপের কথা। খোলা জায়গায় পায়ের ছাপ। শুধু কুকুরের। পাশে মাটিতে অদ্ভুত ঘষার দাগ। ঝোঁপের ডালপাতা ভাঙা। ওই ঘষা দাগ আর ঝোঁপঝাড় ভাঙা থেকেই নিশ্চিত বলে দেয়া যায়, ওগুলো ভূতের কাজ নয়। ভুত কখনও পায়ের ছাপ ফেলে না। ছায়ার মত যেখানে ইচ্ছে চলে যায়। এর একটাই ব্যাখ্যা, ঝোঁপঝাড় ভেঙে কুকুরটার সঙ্গে একজন মানুষও বেরিয়েছিল। আর সে ইনডিয়ান। কুকুরের পায়ের ছাপের পাশে তার নিজের পায়ের ছাপও পড়েছিল। ডাল ভেঙে পাতা দিয়ে ডলে সেগুলো মুছে দিয়েছিল। কেউ যাতে অনুসরণ করতে না পারে, সেজন্যে ওরকম করে নিজের চিহ্ন মুছে রেখে যায় ইনডিয়ান শিকারী।
ও, তাই তো! ওয়েস্টার্ন গল্পে পড়েছি এ সব কথা। কিন্তু আমাদের বাড়িটার দিকে নজর দিয়েছিল কেন সে?
এই প্রশ্নটার জবাবের ওপরই নির্ভর করছে পুরো রহস্যটার সমাধান। শোনো, হারলে ক্রীকে তোমরা যাওয়ার পরই নজর পড়েছিল লোকটার। কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছিল, তোমার রক্তে সেনিকাদের রক্ত মেশানো আছে। নিজের জাতভাই ধরে নিয়েছিল তোমাকে সে। কোনভাবে গলার কালো মালাটা দেখেছিল। বুঝেছিল, দলিলগুলো যদি উদ্ধার করা কারও পক্ষে সম্ভব হয়, সে তুমি। তাই তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল। প্রথম দিনই কুকুরটা ঘটাল এক অঘটন। বনে থেকে শিকার করতে করতে নিশ্চয় ওর স্বভাব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কুনটাকে দেখে খুন করে বসল। চিৎকার শুনে তুমি বেরিয়ে পড়লে ঘর থেকে। ভয় পাচ্ছিলে। ওই সময় তোমার সঙ্গে কথা বলে সুবিধে হবে না। বুঝে ফিরে গেল লোকটা।
কোথায়?
তার গোপন আস্তানায়।
সেটা কোনখানে?
হবে মৃত্যুপুরীর আশপাশে কোনখানে। বনের মধ্যে।
গুহার ভেতর নয় কেন?
কারণ, সে ইনডিয়ান। ওদের সমাজের নিয়ম-কানুন কড়াকড়িভাবে মেনে চলেছে। প্রথমত, কোন বীর যোদ্ধা ছাড়া মৃত্যুপুরীতে ঢোকার নিয়ম নেই। দ্বিতীয়ত, একমাত্র মৃত্যুর সময় হলেই কেবল ওখানে ঢুকতে হয়, তার আগে কোনমতেই নয়। তাই দলিলগুলো গুহার ভেতরে আছে জানা থাকা সত্ত্বেও ওখানে ঢুকে বের করে আনতে পারেনি সে, আনার সাহস হয়নি। গুহার কাছাকাছি থেকেছে, কুকুরটাকে দিয়ে পাহারা দিয়েছে যাতে ওদের গোত্রের বাইরের কেউ ব্রিফকেসটা বের করে আনতে না পারে। সেই লোক জানত, গুহার ভেতর মরে পড়ে আছে সেনিকা সর্দার চার্লি টাসক্যানি। কোন কারণে ব্রিফকেসটা লোকটার হাতে দিয়ে যেতে পারেনি সর্দার। এমন হতে পারে, দলিলগুলো আনার পর লোকটা তার কাছাকাছি ছিল না। হঠাৎ করে সর্দার বুঝতে পারল, তার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর কোন। উপায় না দেখে, ব্রিফকেসটা তুলে দেয়ার মত বিশ্বস্ত কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে ওটা নিয়েই মৃত্যুগুহায় মরতে চলে গেল সে। যেহেতু সর্দার, সেও নিশ্চয় সেনিকা বীর ছিল।
যাই হোক, তোমাকে আর নিনাকে সুড়ঙ্গে ঢুকতে দেখল কুকুরের মালিক। কাকতালীয়ভাবে কুকুরটাও ওই সময় ঢুকে বসেছিল সুড়ঙ্গে। তাড়া করল ওটা তোমাদের। ঘেউ ঘেউ করে সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রচণ্ড শব্দ পাথর ধস নামিয়েছিল। এটা স্বাভাবিক। অনেক সুড়ঙ্গেই শব্দ ওভাবে ধস নামায়। তোমরা বেরিয়ে চলে এলে। কুকুরটা তোমাদের গাছ ঘিরে চক্কর দিতে থাকল। রাতের কোন এক সময়ে ওটাকে ডেকে নিয়ে গেল ওটার মালিক।
পরদিন শামানের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তোমরা। আমার ধারণা, শামানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও তোমার কথা ওকে বলার সুযোগ পায়নি তখনও কুকুরের মালিক। শামান তাই তোমার গলায় কালো মালা দেখে চমকে উঠেছিল। সেও বুঝেছিল, তোমাকে দিয়ে দলিলগুলো বের করানো সম্ভব। সরাসরি ওগুলো এনে দেয়ার কথা বলার সাহস পায়নি। কারণ তখনও বিশ্বাস করতে পারেনি তোমাকে। তুমিও শ্বেতাঙ্গ। যদি বেঈমানী করো? তাই ভুতুড়ে কুকুরের ভয়টা ভাঙেনি। বলেছিল সেনিকাদের জিনিস ওদের ফিরিয়ে না দিলে কুকুরটা পিছু ছাড়বে না তোমার। সত্যি ছাড়ত না, যতদিন তুমি বের করে না আনতে। ব্রিফকেসটা শামানকে দিয়ে আসার পর কি আর ওটা তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল?
মাথা নাড়ল রবিন, না।
বললাম না। যাই হোক, তোমার সাহস দেখে আরও নিশ্চিত হলো কুকুরের মালিক, তুমি সত্যি বের করে আনতে পারবে ব্রিফকেসটা। তাই ঝড়ের রাতে। আবার গেল তোমাদের বাড়িতে। ডাকাডাকি করল। কিন্তু ভয় পেয়ে তুমি আর বেরোলে না। ঘরে ঢুকে কথা বলার সাহস হলো না ওরও। ফিরে গেল।
পরদিন সকালে বাড়ির আশেপাশে কোন পায়ের ছাপ দেখলে না তুমি। অত বৃষ্টি আর কাদাপানিতে ছাপ কি আর থাকে নাকি। নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
তারপর গিয়ে বের করে আনলে ব্রিফকেসটা। শামানকে দিয়ে দিলে। চলে গেল সে। ওটার জন্যে সেও কুকুরের,মালিকের মত অপেক্ষা করছিল ওই বনে। পাওয়ার পর দুজনেই চলে গেল নিজের লোকেদের হাতে তুলে দিতে। এই হলো মোটামুটি গল্প। এখনও কি মনে হচ্ছে এর মধ্যে ভূতুড়ে কিছু আছে?
চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন। আচ্ছা, কুকুরের মালিকটা কে বলো তো? সর্দারের ছেলে?
হাসল কিশোর, তাতে কি কোন সন্দেহ আছে? বাবা যেদিন মৃত্যুগুহায় চলে যায়, নিশ্চয় সেদিন বাড়ি ছিল না সে। সেবারের পর আর কখনও যাওনি হারলে ক্রীকে?
গেছি। বেশ কিছু ইনডিয়ান ফিরে এসেছে। বাড়ি করে বাস করছে। সর্দারের ছেলে কোনজন, জানতে পারিনি। কালো কুকুরটাকেও দেখিনি।
এমন হতে পারে, শামানের মতই আর হারলে ক্রীকে থাকতে আসেনি সর্দারের ছেলেও। ওদের একটা গোপন মিশন ছিল, দলিলগুলো উদ্ধার করা। তোমার সাহায্যে ওগুলো বের করে নিজের লোকের হাতে তুলে দিয়ে ওরা চলে গেছে অন্য কোনখানে। হতে পারে না এটা?
মাথা ঝাঁকাল রবিন। পারে। আর মাত্র দুটো প্রশ্নের জবাব দরকার। এক নম্বর প্রশ্ন–কেন মনে হয়েছিল আড়ালে থেকে কেউ নজর রাখছে আমার ওপর?
মনে হয়েছিল, তার কারণ সত্যি রাখা হচ্ছিল। সতর্ক থাকলে মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এ সব টের পায়। সর্দারের ছেলে লুকিয়ে থেকে নজর রাখছিল তোমার ওপর। শত শত বছর ধরে বনে-জঙ্গলে, পাহাড়ে বাস করে লুকিয়ে থাকার এক অসাধারণ ক্ষমতা অর্জন করেছে ওরা। ওরা লুকালে বনের জন্তু-জানোয়ারেই দেখতে পায় না, তুমি দেখবে কি?
আস্তে আস্তে মাথা দোলাল রবিন, হু। আমিও শুনেছি এ সব কথা। ঠিক আছে, মেনে নিলাম। এখন আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দাও। পাহাড়ের মধ্যে আমার নাম ধরে কে ডাকছিল?
ওটা, আমার বিশ্বাস, বাতাসের কারসাজি। পাহাড়টাতে অনেক ফাটল আছে, তোমার কথাতেই বোঝা গেছে। নানা জায়গায় ওপর থেকে পানি পড়তে দেখেছ। ওরকমই কোন একটা ফাটল দিয়ে বাতাস বয়ে যাওয়ার সময় বিচিত্র শব্দ হয়, তোমার মনে হচ্ছিল তোমার নাম ধরেই ডাকছে।
তাই?
হ্যাঁ। কেন, প্রমাণ করতে যেতে চাও?
না বাবা, দুহাত নেড়ে বলল রবিন, ভূত থাকুক বা না থাকুক, আমি ওই মৃত্যুপুরীর ধারেকাছে নেই আর! একবারই যথেষ্ট। যত খুশি শব্দ করুকগে গুহাটা, আমার তাতে কি?
ফগের দিকে তাকাল কিশোর। চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে শুনছে পুলিশ। কনস্টেবল। ও তাকাতেই চঞ্চল হয়ে গেল চোখের তারা। ফগকে খোঁচানোর জন্যে কিশোর বলল, মিস্টার ফগর্যাম্পারকট, যাবেন নাকি ওই পাহাড়ে? চলুন না গিয়ে দেখে আসি কিসে শব্দ করে? খানিক আগে না বললেন রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছেন?
গলা খাকারি দিল ফগ। অহেতুক কাশল। বিড়বিড় করে বলল, ঝামেলা! আমাকে নিয়ে আবার টানাটানি কেন?
মুচকি হাসল কিশোর, ভয় পেলেন নাকি?
ভূতকে ভয় পাব আমি? আর লোক পেলে না, আবার কোন বেকায়দা প্রশ্নে ফেঁসে যায় এই ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল ফগ। ইস, অন্ধকার হয়ে গেল যে। ওদিকে কত কাজ পড়ে আছে। দরজার দিকে রওনা হলো সে।
পেছন থেকে ডেকে বলল মুসা, চলে যাচ্ছেন যে? আপনার অভিজ্ঞতার কথা শোনাবেন না?
ফিরল না ফগ। দরজার কাছে গিয়ে জবাব দিল, আহ, ঝামেলা! আজ না, আরেকদিন।
বেরিয়ে গেল সে।
মুখ বাঁকিয়ে ফারিহা বলল, ওর অভিজ্ঞতা না কচু। ও কোত্থেকে ভূত দেখবে? নিজেই তো ভূত হয়ে বসে ছিল একবার। আসলে জানতে এসেছিল, কোনও কেসের তদন্ত করছি কিনা আমরা। মাঝখান থেকে বিনে পয়সায় গল্পটা শুনে গেল।
খেক! খেক! করে উঠে যেন বলতে চাইল টিটু, আমি তো তখনই চেয়েছিলাম পায়ে কামড়ে দিয়ে আগাম পয়সা শোধ করে নিতে, তোমরাই তো দিলে না।