০৬.

কবরস্থানে ঢোকার জন্যে পা বাড়াল নিনা। বাধা দিলাম আমি।

বাকা হেসে বলল সে, এবার বোঝো, ভীতুটা কে?

ভয় আমি পাইনি, বললাম বটে, কিন্তু আমি জানি কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, মা বলেছে, এই কবরস্থানে ঢোকার সময় কোনমতেই যেন অশ্রদ্ধা করা না হয়।

বেশ, তুমিই তাহলে আগে যাও। কি করে শ্রদ্ধা করতে হয় আমি জানি না, সরে জায়গা করে দিল আমাকে নিনা।

সরাসরি না ঢুকে গাছপালার কিনার ধরে ঘুরে রওনা হলাম আমরা। গুহামুখের কাছাকাছি গিয়ে ফিরে তাকালাম বিশাল ওকগাছটার দিকে। গোড়া থেকে কিছুটা ওপরে একটা ফোকর। হাত তুলে দেখালাম নিনাকে।

এই এলাকার সবচেয়ে বড় গাছগুলোর একটা ওটা, নিনা বলল। ভেতরটা ফোপরা। ইচ্ছে করলে ঢুকে বসে থাকতে পারো। আমি শুনেছি, পুরো একটা ফুটবল টীম ঢুকে থাকতে পারে ওর মধ্যে।

তাহলেই বোঝো, মানুষ কি রকম বানিয়ে কথা বলে, বললাম। ঢুকতে পারবে বড়জোর দুতিনজন, লোকে বলে এগারোজন। দেখবে, মৃত্যুপুরীর ব্যাপারটাও ওরকম। অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছে।

পাথরের দেয়ালে অনেক বড় একটা কালো গহবরের মত হয়ে আছে। গুহামুখটা। ভেতরে উঁকি দিলাম।

বেশি অন্ধকার, নিনা বলল। কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চলো, বাড়ি চলে যাই।

টর্চ নিয়ে এসেছি, অসুবিধে নেই, বললাম ওকে। কিন্তু তাতেও খুশি হতে পারল না ও।

গুহার ভেতরে কয়েক কদম এগিয়েই থেমে গেলাম। পেছনে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে। অথচ গোধূলিও শেষ হয়নি তখনও। মেঘের কারণে অবেলায় সন্ধ্যা। যাই হোক, এই অন্ধকারের মানে আমাদের জানা। কুকুরটার বেরোনোর সময় হয়েছে। দেখার সময় বেশি পাব না।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে আলো ফেললাম। ভেতরের বাতাস ঠাণ্ডা, ভেজা ভেজা। পাথরের গায়ে শ্যাওলা জন্মে আছে।

কিছু দেখতে পাচ্ছ? এমন করে কানের কাছে কথাটা বলল নিনা চমকে গেলাম।

না, ফিসফিস করেই জবাব দিলাম। চলো, এগোই

মাটি তেমন শক্ত না হলেও পাথরের ছড়াছড়ি। যতই ভেতরে এগোলাম, মাথার ওপর উঁচু হতে থাকল ছাত। গুহা না বলে ওটাকে মস্ত এক সুড়ঙ্গ বলাই উচিত। কারণ লম্বা হয়ে আছে। কিছুটা এগোনোর পরই বাক নিল দেয়াল। পেছনে আড়ালে চলে গেল গুহামুখ। অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরের পৃথিবী। আকাশ চোখে পড়ে না আর। আলো বলতে এখন শুধু টর্চের ওপর ভরসা। আপনাআপনি আঙুলগুলো শক্ত হয়ে চেপে বসল তাতে। আলো না থাকলে এখানে কি যে ঘটবে কল্পনা করারও সাহস হলো না।

কিন্তু টর্চের আলো সাহস জোগাতে পারল না বেশিক্ষণ। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে উঠল আমার। মনে হলো কেউ যেন আড়ালে থেকে আমাদের ওপর নজর রাখছে।

চারপাশে তাকালাম। সবখানে আলো ফেলে দেখলাম। একপাশে বড় বড় পাথরের চাঙড়। ভাবলাম, ওগুলোর ওপাশে লুকিয়ে নেই তো? কিন্তু বেরোল না কোন জানোয়ার বা আর কিছু। নজর রাখা হচ্ছে-এই অনুভূতিটাও গেল না আমার। বরং মনে হলো যা-ই হোক, সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছে ওটা।

আচমকা আমার হাত খামচে ধরল নিনা।

কি? জিজ্ঞেস করলাম।

শুনছ না? ফিসফিস করে বলল ও।

কান পাতলাম। প্রথমে কিছু শুনলাম না তারপর মনে হলো, হ্যাঁ, শুনছি। বললাম, মৃদু গুঞ্জনের মত না?

মাথা ঝাঁকাল নিনা।

 আরেকটু এগোলাম।

গুঞ্জনটা হয়েই চলেছে। বাড়ছে আস্তে আস্তে। যতই এগোলাম, আরও স্পষ্ট হয়ে এল।

দাঁড়িয়ে গেলাম। নিনাও দাঁড়াল আমার সঙ্গে।

এখন আর গুঞ্জন নয়। মনে হলো একটা কণ্ঠ, সুর করে রঅবিন! রঅবিন বলে নাম ধরে ডাকছে আমাকে।

পরস্পরের দিকে তাকালাম আমরা।

তোমাকে চেনে ওটা, নিনা বলল। ওর বাদামী চোখ দুটোতে ভয়, বড় বড় হয়ে গেছে। ও জানে তুমি এখানে এসেছ!

রঅবিন, এসো! রবিন, এসো! বলছে একটা জড়ানো কন্ঠ, কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। তবে মানুষের গলা যে নয়, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

চলো; পালাই! নিনা বলল। আরও জোরে আঁকড়ে ধরেছে আমার হাত। ওটা তোমাকে চেনে। তোমার কাছে কিছু চায়। ভয় লাগছে আমার রবিন, চলো চলে যাই!

গুহামুখের কাছে টেনে নিয়ে চলল আমাকে ও। অনেক পেছনে ফেলে এসেছি ওটা।

ভয় আমিও পেয়েছি। বার বার আমার নাম ধরে ডেকেই চলল কণ্ঠটা, রঅবিন, এসো!

চোখ বুজে ফেললাম। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত বুঝতে পারলাম না কি করব? কল্পনায় ভেসে উঠল মিসেস মারলোর সকাল বেলাকার ভীত মুখ। কানে বাজতে লাগল নিনার কথা–মৃত্যুপুরী থেকে কেউ কোনদিন জীবিত বেরোতে পারেনি। নিজের অজান্তেই হাত চলে গেল গলার কাছে, কালো গুটির মালাটা চেপে ধরলাম। আমার জায়গায় যদি কোন মোহক বীর হতো, কি করত এই পরিস্থিতে পড়লে? মন থেকে পেয়ে গেলাম জবাবটা।

আমি ফিরে যাব না, নিনাকে বললাম। দেখতেই হবে সামনে কি আছে। কেন আমার নাম ধরে ডাকে, কি চায়, জানতে হবে।

কি আর চাইবে? তোমাকে খুন করতে চায়, নিনা বলল। দুজনকেই খুন করবে। সময় থাকতে চলো পালাই।

যেতে ইচ্ছে করলে তুমি চলে যাও আমি এগোব। কবরের প্রহরী

তাহলে আমিও যাব তোমার সঙ্গে।

আবার এগিয়ে চললাম আমরা। সুড়ঙ্গের গভীর থেকে গভীরে। মাথার ওপরে ভেজা চুনাপাথরের ছাত! মৃত্যুর সময় হলে যারা এখানে চলে আসত সেই সব ইনডিয়ান যোদ্ধাদের কথা ভাবলাম,। জোর আনলাম মনে-ওরা আসত সময়মত; আর আমাদের সময়ই হয়নি এখনও, আমার এবং নিনার। সুতরাং বেরোতে পারব না কেন?

হঠাৎ তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার প্রতিধ্বনি তুলল গুহার দেয়ালে। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকালাম। নিনা চিৎকার করেছে। আবার চেঁচিয়ে উঠল সে। আবার। হাত তুলল। থরথর করে কাঁপছে। আমার পেছনে দেখাল।

তাকালাম সেদিকে। মাটিতে রেখেছিলাম টর্চের আলো, ওপর দিকে তুলতে লাগলাম। দুটো প্রবেশ পথ দেখতে পেলাম, সুড়ঙ্গমুখ–একটা আমাদের ডানে, আরেকটা বায়ে। দুটো পথের মাঝখানে দেয়ালের গা থেকে বেরোনো চ্যাপ্টা পাথরে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ কুৎসিত হাসি হাসছে যেন একটা মানুষের খুলি।

.

০৭.

চিৎকার করেই চলেছে নিনা। তাতে আরও ঘাবড়ে গেলাম আমি। হাত গেল কেঁপে। টর্চটা মাটিতে পড়ে নিভে গেল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে চিৎকার বাড়ল ওর। হাতড়ে হাতড়ে ওটা তুলে নিয়ে ঝাঁকি দিতে জ্বলে উঠল আবার।

চেঁচানো বন্ধ হলো ওর। প্রলাপ বকার মত বলতে লাগল, তখনই বলেছিলাম আসা উচিত না, উচিত না, তাও এলে!

ও তো একটা খুলি, যেন কিছুই না এ রকম একটা ভঙ্গি করে আমিও যে ভয় পেয়েছি সেটা চাপা দিয়ে রাখতে চাইলাম।

কি বলছ!

তো আর কি? বহুদিন আগে মারা গিয়েছিল লোকটা।

কি করে বুঝলে?

তুমিই তো বলেছ মৃত্যুর সময় হলে এখানে এসে ঢুকত ইনডিয়ান যোদ্ধারা। সে তো অনেক কাল আগের কথাই।

খুলিটার ওপর আবার আলো ফেললাম আমি। স্কুলের বায়োলজি ক্লাসে কঙ্কাল দেখেছি, খুলিও। জানি ওগুলো দেখতে কেমন হয়। কিন্তু গুহার মধ্যের খুলিটাকে অন্য রকম লাগল। চোখের জায়গার গর্ত দুটো যেন আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। দাঁত বের করে হাসছে বিকট হাসি।

খুলিটার নিচে দুই পাশের দুটো সুড়ঙ্গমুখে আলো ফেলে, দেখতে লাগলাম।

রবিন, নিনা বলল, আমার ধারণা খুলিটা ওখানে রাখা হয়েছে কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে। আমাদের সাবধান করার জন্যে। যাতে ভেতরে না ঢুকি।

এতদূর এসে ফিরে যাব, সাধারণ একটা খুলির ভয়ে? আমি বললাম।

মৃত্যুপুরীতে একটা খুলিও ভয় পাওয়ার জন্যে যথেষ্ট, নিনা বলল। তা ছাড়া। কোন পথটা দিয়ে ঢুকতে হবে আমরা, কি করে বুঝব?

সুড়ঙ্গমুখ দুটোর দিকে তাকিয়ে আছি। দেয়ালের গায়ে কালো দুটো ফোকর। আবার তাকালাম খুলিটার দিকে। চ্যাপ্টা যে পাথরটাতে বসানো তার নিচে আরেকটা গোল পাথর আছে দেখতে অনেকটা চাকার মত। এ রকম আকৃতির। পাথর আর কখনও দেখিনি।

ডানের ফোকরটা দিয়ে বললাম, চলো, ওটাতে ঢুকি।

কেন?

দুজনে দুটোতে ঢুকতে চাও নাকি? আমি ডানেরটায়, তুমি বায়েরটায়?

মাথা খারাপ! একা আমি কিছুতেই যাব না। আর আমার কাছে টর্চও নেই।

আমিও জানি সেটা। অন্ধকারে সুড়ঙ্গে ঢোকা অসম্ভব।

ডানেরটাতেই ঢুকলাম দুজনে। মুখটা এত ছোট, হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হলো। তবে কয়েক হাত এগোনোর পর আস্তে আস্তে চওড়া হয়ে গেল। ছাতও উঠে গেল উঁচুতে। সোজা হয়ে হাঁটা যায়। সুড়ঙ্গে অনেক মোড় আর বাক। ঘোরপ্যাঁচও প্রচুর। কয়েক মিনিট হাঁটার পর নিনা জিজ্ঞেস করল, রবিন, একটা জিনিস লক্ষ করেছ?

এদিক ওদিক তাকালাম, কি?

শব্দটা কমে গেছে।

কোন শব্দ?

 তোমাকে যে ডাকছিল?

কান পাতলাম। তাই তো। ঠিকই বলেছে নিনা। খুলিটা দেখার পর শব্দের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। অনেক কমে গেছে শব্দটা। যদিও একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে তখনও, রঅবিন! রঅবিন! রবিন!

সুড়ঙ্গের ভেতরে যতই এগোলাম আরও কমে এল শব্দ।

মনে হলো ভয় অনেকটা কমেছে নিনার। আমারও সাহস ফিরে এসেছে কিছুটা। শব্দ কমছে, তার মানে শব্দের উৎস থেকে দূরে সরে যাচ্ছি আমরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে একেবারেই শোনা গেল না আর ডাকটা। পুরোপুরি নীরব।

কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকালাম। পেছনে হাঁটছে নিনা। আমার দিকে তাকাল ও। আবার ভয় দেখা দিয়েছে চোখের তারায়। ডাকটা শোনার পর চমকে গিয়েছিলাম। আস্তে আস্তে সয়ে এসেছিল ওটা। একেবারে যখন থেমে গেল, অখণ্ড নীরবতা আবার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিল আমাদের। মনে হতে লাগল, শব্দটা থাকলেই যেন ভাল হতো। আমার গা ঘেষে এল নিনা।

সামনে একটা বড় গুহায় বেরিয়ে এলাম আমরা। মেঝেতে টর্চের আলো ফেলেই স্থির হয়ে গেলাম। রাশি রাশি কঙ্কাল। তাকিয়ে রইলাম হাঁ করে। বুঝতে পারলাম, মৃত্যুর সময় হলে ওখানেই গিয়ে বসে থাকত ইনডিয়ানরা।

এত আওয়াজ কোরো না, ফিসফিস করে বললাম ওকে।

আওয়াজ কে করছে?

জুতো ঘষছ না…?

কথা শেষ করতে পারলাম না। আমার গায়ের ওপর এসে পড়ল নিনা। কিসে করছে… বলতে গেল। কিন্তু ওকেও কথা শেষ করতে দিলাম না আমি। চুপ করে থাকতে বললাম।

হালকা পায়ে হাঁটার শব্দ কানে আসছে।

আমার কানে কানে বলল নিনা, আমাদের সামনে থেকে আসছে!

যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার উল্টো দিকে গুহার দেয়ালে আরেকটা ফোকর। সুড়ঙ্গমুখ। তার ভেতরে হচ্ছে শব্দটা।

কান পাতলাম। এগিয়ে আসছে। পায়ের শব্দ, সন্দেহ নেই, কিন্তু শব্দটা যেন কেমন?

বুঝে ফেললাম। ওই শব্দ আমার পরিচিত। মানুষের পায়ের নয়। রাতের বেলা সেদিন আমাদের ঘরের কাছে শুনেছি।

নিনা! ফিসফিসিয়ে বলার কথা ভুলে গিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমি জানি ওটা কিসের শব্দ। গত রাতে শুনেছি! ওটা…

ভূত! নিনাও চিৎকার করে উঠল।

কে যে আগে দৌড় দিল, মনে নেই। শুধু মনে আছে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ঝেড়ে দৌড় দিয়েছি আমরা পেছন ফিরে।

দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি। ভূতটাও আসছে আমাদের পিছু পিছু।

আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। আগে আগে ছুটছে নিনা। দৌড়ের রেকর্ড ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেন ও। কিন্তু তাতেও কুকুরটার সঙ্গে কুলাতে পারছে । আমাদের তাড়া করে না। নিশ্চয় আমাদের গন্ধ পেয়ে বুঝেছে আমরা সুড়ঙ্গে ঢুকেছি। ধরতে আসছে তাই।

জলদি, রবিন, আরও জোরে! চিৎকার করে তাগাদা দিল নিনা। ওই যে সুড়ঙ্গমুখ!

এত জোরে হাঁপাতে লাগলাম মনে হলো বুকটা ফেটে যাবে। আর কত জোরে ছুটব? সামনে বেশি দূরে নেই আর সুড়ঙ্গমুখ। মাথায় ঠোকর খেলাম। নিচু হয়ে গেছে ছাত। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কুকুরের মত ছুটলাম।

খোলা মুখটা দিয়ে বেরিয়ে গেল নিনা। লাফিয়ে সোজা হয়ে উঠে দৌড় দিল গুহামুখের দিকে। ওখানে পৌঁছতে পারলেও লাভ হবে না। বাইরে নিশ্চয় এখন রাত। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটাও বেরোবে। যদি না থেমে বাইরেও আমাদের তাড়া করে? পারব না ওটার সঙ্গে। সহজেই ধরে ফেলবে। ওটাকে ঠেকাতে চাইলে আটকাতে হবে। আর সেটা গুহার বাইরে গিয়ে হবে না। যা করার ভেতরে থাকতেই করতে হবে। কিন্তু কি করব?

গোল পাথরটার দিকে তাকিয়ে একটা বুদ্ধি এল আমার মাথায়। ডাক দিলাম, নিনা।

থামার একবিন্দু ইচ্ছে নেই ওর, তবু ফিরে তাকাল। ওকে কাছে আসতে বলে একধার থেকে ঠেলতে আরম্ভ করলাম পাথরটা।

কি করছ? চিৎকার করে বলল নিনা। জলদি এসো! ওটা আমাদের ধরে ফেলবে!

পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গমুখ বন্ধ করে দেব। বেরোতে না পারলে আর ধরবে কি করে?

কুকুরটার নিঃশ্বাসের শব্দও কানে আসছে তখন। নিনাকে বললাম, চলে এসেছে ওটা। এসো, হাত লাগাও, আমাকে সাহায্য করো।

সেও এসে ঠেলতে শুরু করল। নড়ে উঠল পাথরটা। আরেকটু…আর একটু…তাহলেই বন্ধ হয়ে যাবে সুড়ঙ্গমুখ। ঠেলতে থাকলাম প্রাণপণে।

চলে এসেছে তো! ককিয়ে উঠে পাথর ছেড়ে দিয়ে আবার দৌড় মারল নিনা।

জোরে এক ঠেলা মেরে গড়িয়ে দিলাম পাথরটা। সুড়ঙ্গমুখে বসে গিয়ে আটকে দিল ফোকরটা।

আরে এসো না! কাঁধের ওপর দিয়ে তাকিয়ে আবার চিৎকার করে ডাকল নিনা।

কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। সামান্য একটু ফাঁক রয়ে গেছে সুড়ঙ্গমুখে। সেটা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলাম। দুর্গন্ধ মেশানো গরম নিঃশ্বাস এসে যেন ধাক্কা মারল নাকেমুখে। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ সোজা তাকিয়ে আছে আমার চোখের দিকে। হাঁ করা মুখে বড় বড় ধারাল দাঁত। পাথরের জন্যে আটকা পড়েছে দেখে এত জোরে হাঁক ছাড়ল, মনে হলো কানের পর্দা ফেটে যাবে আমার। অন্যপাশের সুড়ঙ্গে প্রতিধ্বনি তুলল সেই চিৎকার।

আর দেখার সাহস পেলাম না। দৌড় দিলাম নিনার পেছনে।

দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবছি, পাথর গলে কি চলে আসতে পারবে ওটা? স্বাভাবিক জানোয়ার হলে হয়তো পারবে না। কিংবা পারতেও পারে। যে বিরাট শরীর, প্রচণ্ড শক্তিতে পাথরটা. ঠেলে ফেলেও দিতে পারে। কিন্তু যদি ভূত হয়, তাহলে পাথর কেন, পাহাড়ও ঠেকাতে পারবে না ওটাকে। ঠিক পার হয়ে চলে। আসবে।

পাথরের অন্যপাশে থেকে গর্জন করছে ওটা। ফিরে তাকালাম পাথরটা তখনও দাঁড়িয়েই আছে। তারপর কানে এল আরেকটা চাপা ভারী শব্দ। আমাদের দুইপাশের দেয়াল, ছাত কাঁপতে শুরু করল। মনে হলো যেন ভূমিকম্প। পায়ের নিচে মাটি কাঁপছে। ছাত থেকে ছোট ছোট পাথর খসে পড়তে লাগল।

গুহামুখের কাছে পৌঁছে গেছে নিনা। আমি তখন অনেক পেছনে। ও যখন ছুটে বেরিয়ে গেল মুখটা দিয়ে, তখনও আমি ভেতরে।

প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ করেই চলেছে কুকুরটা। থরথর করে কাঁপছে মৃত্যুপুরী। ছাত থেকে, চতুর্দিকের দেয়াল থেকে বৃষ্টির মত খসে পড়ছে পাথর। যেন ভূমিধস শুরু হয়েছে। ঘাবড়ে গেলাম ভীষণ। পাহাড়ের দেয়াল ধসে পড়ে আমাকে চাপা দেবে নাকি?

বাইরে থেকে নিনার ডাক শোনা গেল, রবিন, বেরোচ্ছ না কেন এখনও?

হঠাৎ যেন বোমা ফাটল। ফিরে তাকিয়ে দেখি, সুড়ঙ্গমুখের দেয়াল থেকে বিরাট এক পাথর খসে পড়েছে। ওটার ধাক্কায় সরে গেছে গোল পাথরটা। কামানের গোলার মত ছিটকে বেরিয়ে এল বিশাল একটা কালো শরীর। ভয়ানক রাগে গর্জন করতে করতে তেড়ে এল আবার।

ততক্ষণে গুহামুখের কাছে পৌঁছে গেছি আমি। দুই লাফে বেরিয়ে গেলাম। আকাশে তখন তারা ফুটেছে। চিৎকার করে ডাকলাম, নিনা, আই নিনা, কোথায় তুমি?

এই যে এখানে! জবাব এল। গাছের ভেতরে!

একটা মুহূর্তও দেরি করলাম না! দৌড় দিলাম কবরস্থানের মাঝখানে ওকগাছটার দিকে। পেছনে ঘেউ ঘেউ করছে কুকুরটা।

রবিন, ধরে ফেলল তো! জলদি করো না। গুঙিয়ে উঠল নিনা।

গাছের ফোকরটা দেখতে পাচ্ছি। মাটি থেকে বেশ কয়েক হাত ওপরে। প্রাণের তাগিদে মানুষ যে কত অসাধ্য সাধন করে, তার প্রমাণ পেলাম সেদিন। তড়াক করে এক লাফ দিয়ে ধরে ফেললাম ফোকরটার ঠিক নিচের একটা ডাল দোল দিয়ে শরীরটাকে তুলে নিলাম ওপরে। পা ঢুকিয়ে দিলাম ভেতরে। আমাকে টেনে নিল নিনা।

গাছের গায়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুকুরটা। আমাদের মত হাত নেই, তাই ডাল ধরতে পারল না। বার কয়েক লাফ দিয়ে চেষ্টা করল, কিন্তু ফোকরটার কাছে পৌঁছতে পারল না।

কি করছে ওটা দেখার কৌতূহল চাপা দিতে পারলাম না। নিনার বাধা অগ্রাহ্য করে আস্তে গলা বাড়িয়ে উঁকি দিলাম।

অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। সোজা তাকিয়ে আছে ফোকরটার। দিকে। আমি তাকাতেই চোখে চোখ পড়ল। ভয়ঙ্কর গর্জন করে লাফ দিল আবার।

ঝট করে মাথা নিচু করে ফেললাম।

.

০৮.

মৃত্যুপুরীর কাছে এক প্রাচীন কবরখানায় গাছের ফোকরে বসে রইলাম দুজনে। শুনতে লাগলাম কুকুরটার তর্জন-গর্জন। যখনই ওটার আস্ফালন বেড়ে যায়, গলার কালো গুটির মালাটা চেপে ধরি। এত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতেও কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, জানি না। ঘুম ভাঙলে দেখি ভোর হয়ে গেছে। চলে গেছে কবরের প্রহরী। যাবেই। নিনা বলেছে, সূর্য ডোবার পরে বেরোয় ওটা, আবার সূর্য উঠলে চলে যায়।

বাড়ি ফিরে সত্যি কথাটা বলতে পারলাম না মাকে, ভয়ে। শুনলে রেগে যাবে। জানালাম, রাত কাটিয়েছি নিনাদের বাড়িতে। মাকে না বলে গিয়ে অন্যখানে থাকার জন্যে বকা খেতে হলো। চুপ করে রইলাম।

দুপুরের পর স্কুল শেষ করে নিনা এল। মা দেখার আগেই তাকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললাম, রাতে কবরস্থানে থাকার কথা যেন বলে না দেয়।

ও বলল, বলবে না। তার মাকেও সে মিথ্যে বলেছে–রাতে আমাদের বাড়িতে থেকেছে।

আমাকে হার্ব গ্যাটলিঙ নামে একজনের বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছে সে। ওদের পড়শী। নাম শুনেই বুঝলাম, লোকটা ইনডিয়ান।

নিনা জানাল, ও একজন শামান। সেনিকা ইনডিয়ান। শামান মানে জানো তো? ওঝা, কবিরাজ। খুব জ্ঞানী লোক। আমার মনে হয় ও আমাদের সাহায্য করতে পারবে।

গেলাম নিনার সঙ্গে। ওদের বাড়ির পাশে বনের মধ্যে একটা কাঠের বাড়িতে থাকে শামান। সেটার কাছে গিয়ে বন্ধ দরজায় টোকা দিল নিনা। বেরিয়ে এল হালকা-পাতলা একজন মানুষ। লম্বা কালো চুল। গালের চামড়া কুঁচকানো, অংখ্য ভাজ। অনেক বয়েস লোকটার। নিনাকে দেখেই হাসল। ভেতরে যেতে বলল আমাদের।

ওর বাড়িটা ভারি পছন্দ হলো আমার। আমাদেরটার মত অত বড় নয়, মোটে একটা ঘর, বেশ বড়, খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ফায়ারপ্লেসের কাছে গাদা করে রাখা হয়েছে অনেকগুলো কম্বল। তার ওপর বসতে দিল আমাদের। ফায়ারপ্লেসের ওপরে কাঠের দেয়ালে ঝোলানো একটা লাল ওয়ামপাম গুটির মালা আর উজ্জল রঙের পালকে তৈরি ঝলমলে একটা হেডড্রেস, অনেকটা মুকুটের মত জিনিস, ইনডিয়ানরা যা মাথায় দেয়।

শামানের পরনে নীল জিনসের প্যান্ট, গায়ে ফ্লানেলের শার্ট। কিছুটা নিরাশই হলাম পোশাক-আশাক দেখে। আমি ভেবেছিলাম জবরজং কিম্ভুত পোশাক থাকবে। কিন্তু এ তো সাধারণ পোশাক। এই লোক কি সত্যি ভূত তাড়াতে পারবে? তবে শার্টের গলার কাছের বোতাম খুলে ভেতরের জিনিসটা দেখিয়ে দেয়ার পর কেটে গেল নিরাশা। তার গলায়ও একটা ওয়ামপাম গুটির মালা। আমারটার মত শুধু কালো গুটি নয়, নানা রঙের গুটি। মালাটাও অনেক বড়।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত আমার মালাটার দিকে তাকিয়ে রইল সে। চোখ দুটো তার কুচকুচে কালো, একেবারে মালার গুটির মত! জিজ্ঞেস করল কোথায় পেলে ওটা?

জানালাম, কে দিয়েছে।

 ও বলল, কালো গুটি খুব ক্ষমতাশালী।

তাকে জিজ্ঞেস করলাম, শামানরা কি ওঝা, না কবিরাজ? অনেক যাদু জানে?

ধীরে ধীরে হাসি ফুটল তার মুখে। কুঁচকানো মুখের ভাঁজগুলো গম্ভীর হলো আরও। মেঝেতে বিছানো একটা কম্বলে আসনপিড়ি হয়ে বসল। বলল, যাদু আমি জানি, তবে অনেক নয়, অল্প। ইচ্ছে করলে ওরকম যাদু তুমিও দেখাতে পারো, রবিন মিলফোর্ড। হয়তো আমার চেয়ে বেশিই পারো। কারণ তোমার গলার মালাটার ক্ষমতা অনেক।

সত্যি বলছেন?

 সত্যি।

 তাহলে আপনি কালো গুটির মালা পরেন না কেন?

নিয়ম অনুযায়ী আমি তো পরতে পারব না কালো গুটি পরে একমাত্র বীর যোদ্ধারা।

আমি তো বীর নই। আমার পরাটা ঠিক হলো কিনা বুঝলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, এই মালা দিয়ে কি ভূত ঠেকানো সম্ভব? কবরের প্রহরীকে বাধা দেয়া যাবে?

কবরের প্রহরীকে বাধা দেয়ার দরকারটা কি তোমার? কোথায় দেখলে ওকে?

 মৃত্যুপুরীতে। কাল ওই সুড়ঙ্গে ঢুকেছিলাম আমরা।

মুহূর্তে বদলে গেল শামানের মুখের ভঙ্গি। মৃত্যুপুরীতে ঢুকেছিলে! একবার আমার দিকে একবার নিনার দিকে তাকাতে লাগল সে। তারপর আমার ওপর দৃষ্টি স্থির হলো তার। মৃত্যুপুরী থেকে কেউ বেচে ফিরতে পারে না!

কিন্তু আমরা ফিরেছি, শান্তকণ্ঠে বললাম।

আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল তার। নজর নামাল আমার গলার মালাটার দিকে। বলল, বেঁচে ফিরেছ, তার কারণ ওই মালা। ওটাই তোমাকে বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে। ওটা ছিল এক মহান বীর যোদ্ধার যাকে কবরের প্রহরীও নিশ্চয় সম্মান করে। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে তোমার পূর্বপুরুষ ওই মহান বীরকে স্মরণ করো মনে মনে, তাকে ধন্যবাদ দাও। মালাটা গলায় না থাকলে এখন আর এখানে বসে কথা বলতে পারতে না।

আমি তাকালাম নিনার দিকে। ও আমার দিকে।

শামান জিজ্ঞেস করল, মালাটা কি কখনও ছুঁয়ে দেখেছ?

 অবাক হলাম। ছুঁয়ে দেখেছি মানে? এই যে গলায় পরে আছি এটা কি ছোঁয়া নয়?

যখন বিপদে পড়েছ, ভয় পেয়েছ, তখন হাত দিয়ে ছুঁয়েছ?

মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, কাল রাতে কুকুরটা যখন তাড়া করল, তখন ছুঁয়েছি। গাছের ফোকরে যখন বসেছিলাম, আর চারপাশে চক্কর দিচ্ছিল ওটা, তখনও ছুঁয়েছি। বার বার। ভয় পেয়েছিলাম তো খুব, তাই আপনাআপনি হাত উঠে যাচ্ছিল গলার কাছে। এমনকি আগের রাতে আমাদের বাড়ির কাছে যখন গিয়েছিল কুকুরটা, তখনও ছুঁয়েছিলাম। কেন যেন ভয় পেলেই হাত উঠে যায় মালাটার কাছে।

আবার বদলে গেল শামানের চেহারা। বিস্ময় ফুটল কালো চোখে। তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিল প্রহরী?

গিয়েছিল। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে গেলাম। সেলারে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইছিলাম কিসে চিৎকার করেছে। ওই সময় মনে হলো আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওটা। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছি গলা কামড়ে ধরবে। কিন্তু ধরেনি। খানিক পর পেছন ফিরে দেখি কিছু নেই।

আবার কালো মালাটার দিকে নজর গেল শামানের। চুপ করে রইল। তার কালো চোখে উদ্বেগের ছায়া।

প্রহরী এ রকম কেন করল, মিস্টার গ্যাটলিঙ? জানতে চাইল নিনা। হান্টার রিজ থেকে নিচেই নামেনি আর কখনও। রবিনদের বাড়িতে কেন গেল?

কারণ রবিনের ওপর চোখ পড়েছে ওর।

তাকিয়ে রইলাম শামানের দিকে, আমার ওপর? কেন?

আঙুল তুলে মালাটা দেখাল শামান, ওটার জন্যে।

নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল আমার। মালাটা ছুঁয়ে দেখলাম। গায়ের সঙ্গে লেগে থাকায় গরম হয়ে আছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে শামান বলল, ওই মালা তোমাকে রক্ষা করছে, রবিন মিলফোর্ড। আবার কবরের প্রহরীকেও আকৃষ্ট করছে। ও জেনে গেছে ওটা আছে তোমার কাছে। কখনও তোমার পিছু ছাড়বে না আর।

ঘাবড়ে গেলাম। তাহলে তো মহামুসিবত! শীত করতে লাগল। মনে হলো। একটা সোয়েটার পরে গেলে ভাল হতো। মগজে যেন কেটে বসে গেল শামানের কথা–কখনও তোমার পিছু ছাড়বে না আর! মালাটা চেপে ধরলাম গলার সঙ্গে। মনে হলো শান্তি পেলাম। ওরকম অনুভূতি আর কখনও হয়নি আমার। মুখ শুকিয়ে গেছে। কথা বলতে কষ্ট হলো। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? আমার কাছে কি চায় ওটা?

মাথা নাড়ল শামান। কি চায় জানি না। শুধু জানি, একটা হাত তুলল সে, যেহেতু কালো মালাটা গলায় পরেই ফেলেছ, ইনডিয়ানদের নিয়ম অনুযায়ী তোমাকে এখন বীর যোদ্ধা বলে প্রমাণ করতে হবে নিজেকে। তা নাহলে ওই প্রহরী ধ্বংস করে ছাড়বে তোমাকে।

আরও শুকিয়ে গেল গলার ভেতরটা। জিজ্ঞেস করলাম, কি করলে বীর যোদ্ধা হব? এখন তো আর লড়াই হয় না যে গিয়ে যুদ্ধ করে আসব।

যুদ্ধ না করেও বীর হওয়া যায়। এমন একটা কাজ করতে হবে তোমাকে, যাতে মৃত যোদ্ধাদের আত্মা শান্তি পায়।

কাজটা কি?

 তা তো বলতে পারব না।

কাজটা কি, তাই যদি না জানি, কি করে করব?

দীর্ঘক্ষণ কোন কথা বলল না শামান আমার গলার মালাটার দিকে তাকিয়ে থেকে চুপ করে ভাবতে লাগল তারপর বলল, এমন কিছু করো, যাতে বর্তমান ইনডিয়ানদের উপকার হয়। ওদের জিনিস ফেরত পায়। তাহলেই ওদের পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তি পাবে। প্রহরীকে সরিয়ে নেবে তোমার পেছন থেকে।

.

০৯.

 আকাশের অবস্থা ভাল না, রাতে খাবার টেবিলে বসে মা বলল। ঝড় আসবে আজ রাতে।

আকাশে মেঘ। দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ল সেটা। ঢেকে দিল পুরো আকাশ। বিদ্যুৎ চমকাতে আরম্ভ করল। কিন্তু সেসব দিকে আমার তেমন নজর নেই। আমি ভাবছি, কি এমন জিনিস খোয়া গেছে ইনডিয়ানদের, যেটা ফেরত এনে দিতে না পারলে কুকুরটা আমার পিছু ছাড়বে না?

খাচ্ছিস না কেন, রবিন? মা জিজ্ঞেস করল, চিন্তা করছিস নাকি কিছু?

কই, না তো, মাকে দেখানোর জন্যে তাড়াতাড়ি বেশি বেশি করে খাওয়া শুরু করলাম।

কিন্তু কয়েক চামচ গিলেই আবার বন্ধ। গলায় আটকে যেতে লাগল। কুকুরটার কথা ভেবে খাবার নামতে চাইছে না গলা দিয়ে। গুহার ভেতরে ওটার ভয়ঙ্কর চেহারা, গরম দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস, বড় বড় দাঁত, লাল দুটো জ্বলন্ত চোখ, ওক গাছটাকে ঘিরে ভয়াবহ গর্জন, কিছুতেই দূর করতে পারছি না মন থেকে।

কি করব? কি করে ওটাকে আমার পেছন থেকে খসাব? ভেবে কোন কূলকিনারা করতে পারলাম না। কানে বাজছে শামানের কথা–এমন কিছু করো, যাতে বর্তমান ইনডিয়ানদের উপকার হয়। ওদের জিনিস ফেরত পায়। তাহলেই ওদের পূর্বপুরুষের আত্মা শান্তি পাবে। প্রহরীকে সরিয়ে নেবে তোমার পেছন থেকে।

কি উপকার করব? যদি দেখে কিছু করছি না তো কি করবে কুকুরটা?

 কারও উপকার করতে হলে তার কিসের অভাব কিংবা কোন কোন অসুবিধে সেটা আগে জানা দরকার। হাতের চামচটা নামিয়ে রেখে মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা, এখান থেকে সেনিকা ইনডিয়ানরা চলে গিয়েছিল কেন, জানো কিছু?

খেতে খেতে মুখ তুলল মা। অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। হঠাৎ সেনিকাদের ব্যাপারে এই আগ্রহ কেন?

দরকার আছে, মা, বলো না? অনুরোধ করলাম।

বাবার দিকে তাকাল মা। আবার আমার দিকে। গেছে কি আর সাধে? ওদের তাড়ানো হয়েছে।

কারা তাড়িয়েছে?

জবাবটা দিল বাবা, আর কারা? শ্বেতাঙ্গরা। স্পেন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এ সব দেশের লোক। বিদেশী হয়েও এলাকার আসল অধিবাসীদের বের করে দিয়েছে। ইনডিয়ানদের বাপ-দাদার সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছে। জোর করে ওদের জমি দখল করে ওদের কুকুরের মত তাড়িয়েছে। যারা যেতে চায়নি, তাদের নিষ্ঠুরের মত খুন করেছে। এ সব ইতিহাস তো তোমার জানার কথা, রবিন।

কিছু কিছু জানি। সব নয়। আচ্ছা, পাহাড়ের মাথার ওই কবরখানাটার মালিক কে? জিজ্ঞেস করলাম, ইনডিয়ানরা নয়?

ছিল।

এখন?

ওরাই, তবে কবর আর দিতে আসতে পারে না, এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরল বাবা। চিবাতে চিবাতে বলল, এলেই লাঠি নিয়ে তাড়া করে শ্বেতাঙ্গরা।

ওরা আদালতে যায় না কেন? যদ্র জানি ইনডিয়ানদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে আমেরিকান সরকারের। জমির দলিল করে নিলেই তো ভোগদখল করতে পারে।

তাও করেছিল। কিন্তু দলিল করে আনার পর পরই কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে এখানকার সেনিকা সর্দার ব্ল্যাকফায়ার চার্লি টাসক্যানি। দলিলগুলো সব। ছিল তার কাছে। কোথায় যে সে গেছে কেউ জানে না। দলিলগুলোও নিখোঁজ হয়েছে তার সঙ্গে। গুজব আছে, চাঁদনি রাতে হান্টার রিজের মাথায় নাকি ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় লম্বা-চওড়া এক জোয়ান পুরুষকে, সঙ্গে বিশাল এক কালো কুকুর। লোকের ধারণা, ভূত।

তারমানে মরে গেছে?

হয়তো গেছে। নইলে আসে না কেন?

 তার ছেলেমেয়ে কেউ নেই?

এক ছেলে ছিল। বাবা নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন পর সেও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। লোকে বলে, তাকে যেতে বাধ্য করেছিল এখানকার কয়েকজন প্রভাবশালী লোক। তারপর একে একে সবাইকে জায়গা ছাড়তে হলো একজন ইনডিয়ানকেও আর টিকতে দেয়া হলো না।

শামান হার্ট গ্যাটলিং বাদে?

ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে নাকি তোমার?

হয়েছে। এতক্ষণে বুঝলাম এত জায়গা থাকতে বনে বাস করে কেন সে। তারমানে খোলা জায়গায় আসতেই দেয়া হয় না।

না, মাথা নাড়ল বাবা। বড় নিষ্ঠুরতা। অমানবিক। যাদের জায়গা, তাদেরই ঠাই নেই, ভোগ করছে অন্য লোক। উড়ে এসে জুড়ে বসা একেই বলে।

চুপচাপ ভাবলাম এক মিনিট। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, বাবা, দলিলগুলো যদি পাওয়া যায়, আবার কি তাদের জায়গায় ফিরে আসতে পারবে ইনডিয়ানরা?

তা পারবে। তখন অন্য কেউ বাধা দিলে পুলিশের সাহায্যও নিতে পারবে। তবে দলিল ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।

কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। এক সর্দার নাহয় গেছে, বাকি ইনডিয়ানরা আদালতে গিয়ে দলিলের নকল বের করে আনে না কেন?

ইনডিয়ানরা সাদাসিধা মানুষ। শ্বেতাঙ্গদের আইন-কানুনের জটিলতা, ঘোরপ্যাঁচ কমই বোঝে। ওরা এখনও অপেক্ষা করে আছে বোধহয়, ওদের সর্দার ফিরে আসবে, তৈরি করে দেবে ওদের বহু আশার স্বপ্নভূমি।

কতদিন হলো সর্দার নিখোঁজ হয়েছে?

এই বছর পাঁচেক। আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচাল বাবা, এত প্রশ্ন কেন? সর্দার আর দলিলগুলোর খোঁজ করছ নাকি?

এখনও করিনি। তবে করব ভাবছি।

আর কিছু না বলে দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে গেলাম ওখান থেকে। নিজের ঘরে গিয়ে একটা বই বের করলাম। কিন্তু মন বসাতে পারলাম না। তা ছাড়া আগের রাতে ঘুমাতে পারিনি। বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে দুচোখ ভেঙে আসতে লাগল। শুয়ে পড়লাম বিছানায়। কিন্তু এত ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুমাতে ভয় পেলাম। মন বলছে কুকুরটা আসবে সেরাতেও।

ঠিক করলাম, যত যাই ঘটুক, ঘর থেকে বেরোব না। না বেরোলে কোন ক্ষতি করতে পারবে না কুকুরটা।

বেশিক্ষণ খোলা রাখতে পারলাম না চোখ। ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ভেঙে গেল বজ্রপাতের শব্দে।

এত জোরে বাজ পড়তে আর শুনিনি। চোখ মেলোম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তীব্র নীল আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরও এসে পড়ল বিদ্যুতের আলো। দিনের মত আলোকিত হয়ে গেল।

আবার বজ্রপাত। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। জানালায় এত জোরে এসে আঘাত হানতে লাগল, ভয় হলো কাঁচ না ভেঙে যায়। কিন্তু ওটা তো খোলা ছিল? নিশ্চয় আমি ঘুমিয়ে পড়লে মা দেখতে এসেছিল। জানালা খোলা দেখে ঝড়ের কথা ভেবে বন্ধ করে রেখে গেছে। ভাল করেছে। নইলে ঘরের মধ্যে বন্যা বয়ে যেত। আমার পায়ের কাছের জানালাটার ছিটকানি বোধহয় ঠিকমত লাগেনি, বাতাসের ঝাঁপটায় সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে পাল্লা। সেখান দিয়ে ফিসফিস করে কে যেন ডাকল, রবিন!

বুকের মধ্যে ধক করে উঠল আমার। পুরুষের কণ্ঠ। কিন্তু বাবার নয়। কার তাহলে?

আবার ডাকল, রবিন?

গায়ের চাদরের ধার খামচে ধরলাম। একটানে নিয়ে এসে ফেললাম বুক থেকে গলার কাছে।

কে ডাকে? ভুল শুনছি না তো?

 আবার শোনা গেল ডাক, রবিন! শোনো!

গুহার মধ্যেও আমার নাম ধরে ডাকতে শুনেছি। তবে এ ডাক সেই ডাক নয়। স্বাভাবিক মানুষের কণ্ঠের মত। জানালার ফাঁকটা দিয়ে আসছে।

কোনমতেই বাইরে বেরোব না। ওই মায়াডাককে অগ্রাহ্য করতে না পারলে মারা পড়ব-নিজেকে বোঝালাম। যতই ডাকুক, ঘর থেকে আর বেরোচ্ছি না আমি।

রবিন! কথা শোনো?

ঘর থেকে নাহয় না-ই বেরোলাম, কে ডাকে দেখতে তো অসুবিধে নেই? আস্তে করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। অন্ধকারে কিছু চোখে পড়ল না।

আবার বিদ্যুৎ চমকাল। বাজ পড়ল বিকট শব্দে।

উঠে বসলাম। বিছানা থেকে না নেমে বাঁকা হয়ে এগিয়ে গেলাম জানালাটার দিকে। হাত দিয়ে দেখলাম, পায়ের কাছটায় বিছানা ভিজে গেছে। জানালা বন্ধ না করলে আরও ভিজবে।

আবার বাজ পড়ল। ভয়াবহ শব্দ। থরথর করে কেঁপে উঠল সবকিছু। বিকট শব্দে কি যেন ভেঙে পড়ল বাইরে। বিদ্যুতের আলোয় এমন একটা দৃশ্য দেখলাম, ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে গেল আমার।

দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম লম্বা এক লোককে। জানালার কাছ থেকে মাত্র চার ফুট দূরে। লম্বা চুল ঘাড়ের ওপর নেমে এসেছে। মাথায় পাখির পালকের মুকুট। গায়ে হরিণের চামড়ার হাতে বানানো জ্যাকেট, পরনে একই চামড়ার প্যান্ট। বহুকাল আগের ইনডিয়ান যোদ্ধারা যে রকম পরত। পাশে দাঁড়ানো একটা কালো কুকুর। মৃত্যুপুরীতে যেটাকে দেখেছি।

সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা।

জানালা বন্ধ করব কি, হাঁটু কাঁপতে শুরু করল আমার। জানালার শার্সিটা ধরে না রাখলে উপুড় হয়ে পড়েই যেতাম।

আবার বিদ্যুৎ চমকানোর অপেক্ষায় রইলাম।

চমকাল। আলোকিত করে দিল আমাদের পেছনের আঙিনা। আবার দেখলাম লোকটাকে। দাঁড়িয়ে আছে একই ভঙ্গিতে। কুকুরটারও নড়াচড়া নেই। আমার দিকে তাকিয়ে আছে দুজনেই।

হাত তুলল লোকটা। মনে হলো আমাকে বাইরে যাওয়ার জন্যে ইশারা করল। তারপর আবার অন্ধকার।

আর দেখার অপেক্ষা করলাম না। আমি যেতে না চাইলে কি করবে লোকটা কে জানে! তাড়াতাড়ি জানালার ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে বালিশে মাথা রাখলাম। চাদর টেনে দিলাম মুখের ওপর।

ঘুম নেই আর চোখে। কান পেতে শুনছি বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব।

.

১০.

সকালবেলা বাড়ির চারপাশে ঘুরে দেখলাম। মানুষের পায়ের ছাপ দেখলাম না। কুকুরটারও না। এমনকি আমার জানালার নিচে যেখানে লোকটাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি সেখানেও কোন ছাপ নেই। সবখানে কাদা। পানি জমে আছে। একটা ম্যাপল গাছের মাথা জ্বলে গেছে। কাণ্ডটা মাঝখান থেকে চিরে দুই টুকরো। একটা অংশ ভেঙে পড়েছে মাটিতে। বাজ পড়েছিল গাছটার মাথায়।

নিনার আসার অপেক্ষায় রইলাম।

কিন্তু দুপুরের পর এল না ও। গেলাম ওর বাড়িতে। ওর মা বললেন, স্কুল থেকে ফেরেনি। গেলাম স্কুলে। দেখি বেজবল খেলছে। মাথায় সেই লাল বেজবল ক্যাপ। আমাকে দেখে হাত নাড়ল। আমিও নাড়লাম। দুই ক্লাসের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। বুঝলাম খেলা শেষ না করে আসতে পারবে না ও। শেষ হতে সময় লাগবে।

ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। খেলা দেখতে ভাল লাগল না। মন জুড়ে। আছে ভূত। চলে এলাম ওখান থেকে।

কিন্তু বাড়ি যেতেও ইচ্ছে করল না। কি করব? পা দুটো যেন ঠেলে নিয়ে চলল পাহাড়ের দিকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সমস্ত রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে ওই গুহার ভেতর।

ঝলমলে রোদ। আকাশে মেঘের চিহ্নও নেই কোনখানে। হান্টার রিজের পথ বেয়ে ওপরে উঠে চললাম আমি। এই রাস্তা, এই পাহাড়, সব নিনার মুখস্থ। আমার। অতটা চেনা হয়নি, তাই দ্রুত এগোতে পারলাম না।

সঙ্গে নিনা নেই। একা যেতে কেমন যেন লাগছে। মনকে বোঝালামও না আসাতে ভাল হয়েছে। ওর ভাল। কালো গুটির মালা আমি পরেছি, ও নয়। কুকুরটার নজর আমার দিকে। অতএব যা করার আমাকেই করতে হবে। ওকে এ সবে টেনে আনব কেন? মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে?

হারলে ক্রীকের ওপরে চলে গেছে সুর্য। ডুবতে তখনও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। সূর্যাস্তের আগে কখনও বেরোয় না কুকুরটা। ওটার মালিক ইনডিয়ান লোকটার ভূতও নিশ্চয় রাতের আগে বেরোবে না। অতএব ওই মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে যাওয়া আমার জন্যে নিরাপদ। আশা করলাম সুড়ঙ্গে ঢুকে তল্লাশি চালিয়ে ভূত বেরোনোর আগেই বাড়ি ফিরে যেতে পারব।

কিন্তু জোর পেলাম না মনে। কেবলই চিন্তা হতে থাকল, আচ্ছা, সত্যি কি সূর্যাস্তের আগে বেরোয় না ভূতগুলো? ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা অবশ্য বেরোত না। কিন্তু ওটা তো কল্পিত ভূত। বিশাল কুকুরটার লকলকে লাল জিব, ধারাল দাঁত, হিংস্র চেহারা আর রক্ত পানি করা বিকট চিৎকারের কথা ভেবে দমে গেলাম। আবার ওটার মুখোমুখি হতে হবে ভাবতেই কলজের পানি শুকিয়ে গেল। মনকে সাহস জোগালাম এই ভেবে, দুই দুইবার দেখা হয়েছে ওটার সঙ্গে আমার। ইচ্ছে করলেই ক্ষতি করতে পারত। করেনি। কিংবা করতে পারেনি। এর একটাই কারণ হতে পারে, আমার গলার কালো মালাটা। দুবার যদি রক্ষা করে থাকতে পারে আমাকে ওটা, আরও একবার পারবে।

কবরস্থানে উঠে গেছে যে রাস্তাটা, সেটার গোড়ায় এসে দাঁড়ালাম। দ্বিধা করলাম একবার তারপর যা থাকে কপালে ভেবে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করলাম।

পৌঁছে গেলাম ঘাসে ঢাকা সেই আয়তাকার জায়গাটায়। কবরস্থানে। মাঝখানে বিশাল ওকের অন্যপাশে মৃত্যুপুরীর কালো মুখটা যেন হাঁ করে আছে। অপরিচিত নয় আর এখন ওটা। তবু দিনের আলোতেও সেদিকে তাকিয়ে গা ছমছম করে উঠল।

আগেরবারের মতই সম্মান দেখানোর জন্যে কবরস্থান মাড়িয়ে না গিয়ে ওটার ধার ধরে এগোলাম। সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা হতে লাগল আবার–কে যেন আড়াল থেকে আমার ওপর নজর রাখছে। আমার প্রতিটি নড়াচড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করছে। অদৃশ্য চোখের অধিকারী। চারপাশে তাকালাম। কেউ নেই। কবরস্থানটা একটা ঘাসে ঢাকা মাঠ। তাতে এমন কোন ঝোঁপ বা গাছ নেই যার আড়ালে লুকিয়ে আমার ওপর চোখ রাখবে কেউ। তাহলে কোনখান থেকে রাখছে? সব কি আমার মনের ভুল? কল্পনা? বনের দিকে তাকালাম। আমার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল যেন নীরব বনটা। মনে হলো আমার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসছে। ঘাড়ের পেছনটা শিরশির করতে লাগল।

মৃত্যুপুরীর দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠল আহত ইনডিয়ান যোদ্ধাদের চেহারা। মৃত্যুর সময় হলে এখানে চলে আসত ওরা। ওই গুহার ভেতরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে কতজন! মনে মনে ঈশ্বরের কাছে মঙ্গল প্রার্থনা করলাম ওদের জন্যে। ওদের উদ্দেশ্যে জোরে জোরে বললাম, হে অশরীরী বীরেরা, আমি তোমাদের বিরক্ত করতে আসিনি। এসেছি তোমাদের বংশধরদের সাহায্য করতে। তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করে নিতে। আমার গায়েও তোমাদের রক্ত আছে। তাই এই গুহাতে অধিকার আছে আমারও। আমাকে সাহায্য করো তোমরা।

শার্টের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে স্পর্শ করলাম একবার কালো মালাটা + ঢুকে পড়লাম গুহায়।

বাইরের চেয়ে ভেতরে অনেক ঠাণ্ডা। কয়েক পা এগোলাম। কি যেন পড়ল কাঁধে। চমকে গিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আবার পড়ল। ওপর দিকে টর্চের আলো ফেলে দেখি পানির ফোঁটা। কোনও ফাটলে জমা হয়ে আছে বৃষ্টির পানি। ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে সেখান থেকে। নিজেকে বোঝালাম, সব কিছু সহজ ভাবে নাও, রবিন। অল্পতেই যদি এ ভাবে চমকে যাও, কাজ করবে কিভাবে?

মেঝেতে আলো ফেললাম। সুপ হয়ে আছে ধসে পড়া পাথর।

গুহার বাকটার অন্যপাশে চলে গেলাম। পেছনে আড়ালে পড়ে গেল গুহামুখ। বিকেলের রোদেলা আকাশও অদৃশ্য। চারপাশে শুধুই অন্ধকার। পাথর আর দেয়াল, দেয়াল আর পাথর ছাড়া অন্য কিছুই চোখে পড়ল না। ভয় তাড়ানোর জন্যে অন্যমনস্ক হতে চাইলাম। নিনার কথা ভাবলাম। কি করছে এখন ও? নিশ্চয় প্রতিপক্ষের ওপর প্রবল আক্রমণ চালিয়েছে। মাথায় লাল ক্যাপ। চোখের সানগ্লাসটা খুলে রেখেছে। খেলার সময় পরা যায় না।

আলো ফেললাম গুহার দেয়ালে। সুড়ঙ্গমুখ দুটোর ওপর। চ্যাপ্টা পাথরে বসে তেমনি বিকৃত হাসি হাসছে খুলিটা। যেন ব্যঙ্গ করছে আমাকে। ধস নেমে এত পাথর পড়ল, ওটার কিছু হয়নি। অবাক হলাম না। জানতাম, থাকবে ওটা। ফোকর দুটোর দিকে তাকালাম। একটার কাছে চিত হয়ে পড়ে আছে গোল পাথরটা, যেটা দিয়ে মুখ বন্ধ করেছিলাম। হয় আপনাআপনি পড়ে গেছে ওটা, কিংবা ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে কুকুরটা। পাহাড় কেঁপে ওঠায়, ধস নামায় হয়তো ফেলতে সুবিধে হয়েছে ওটার। ভাবলাম, ভূতই যদি হবে, তাহলে পাথর ফেলতে প্রকৃতির সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে কেন? নিজের অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা নেই? মাথা চুলকালাম। কি জানি! কত রকম ভূত থাকে। একেক ভূতের একেক ধরনের ক্ষমতা।

আবার তাকালাম খুলিটার দিকে। কালো কোটর দুটোর দিকে তাকিয়ে অস্বস্তিতে ভরে গেল মন। নিনার ধারণাই ঠিক মনে হতে লাগল। ওটাকে ওখানে ইচ্ছে করেই রেখেছিল সেনিকারা, যাতে অনুপ্রবেশকারীরা দেখলে ভয় পায়, সুড়ঙ্গে ঢুকতে সাহস না করে।

আড়াল থেকে কেউ যে লক্ষ করছে আমাকে সেই অদ্ভুত অনুভূতিটা কিন্তু। আছেই। মনে হচ্ছে আমাকে অনুসরণও করছে ওটা। অশরীরী কিছু? নাকি আমার মতই শরীর আছে ওটার। দেখার জন্যে আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে আলো ফেললাম। নাহ, কেউ নেই। অন্ধকার গুহা। কোন নড়াচড়া চোখে পড়ল না। কোন শব্দ নেই।

আবার ফিরলাম সুড়ঙ্গমুখ দুটোর দিকে। প্রথমে ডানে, তারপর বায়ে। দুটোই খোলা। ভেতরে অন্ধকার। আগের বার নিনার সঙ্গে ঢুকেছিলাম ডানেরটাতে। ওটা দেখা হয়ে গেছে। বায়েরটাতে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিলাম।

Super User