কবরের প্রহরী – তিন গোয়েন্দা — ভলিউম ৫০
প্রথম প্রকাশ: ১৯৯৭
০১.
খাওয়ার পর আবার এসে মুসার শোবার ঘরে ঢুকল সবাই। মুসা, ফারিহা, কিশোর, রবিন আর টিটু।
ঢুকেই বলল কিশোর, রবিন, শুরু করো এবার তোমার ভূতের গল্প।
গ্রীনহিলস। বড়দিনের ছুটি কিন্তু বাইরে বেরোনোর উপায় নেই ওদের। প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে। তবে এ জন্যে বেরোতে পারছে না ওরা তা নয়। আসল কারণ, খুব ঠাণ্ডা লেগেছে মুসা ও ফারিহার। অসুস্থ বিছানায় পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে ওরা।
কি আর করে? রবিন আর কিশোরেরও বাইরে ঘোরাঘুরি বন্ধ। মুসা এবং ফারিহাকে সঙ্গ দেয়ার জন্যে মুসাদের বাড়িতে এসে বসে থাকে ওরাও। গল্প করে কাটায়।
এদিনও গল্পই চলছে। ভূতের গল্প। প্রথম গল্পটা বলেছে মূসা এবার রবিনের পালা।
মুসা বালিশে আধশোয়া হলো তার বিছানায়। বাড়তি আরেকটা বিছানায় টিটুকে জড়িয়ে ধরে শুলো ফারিহা। মুসার বিছানায় দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে বসল কিশোর আর রবিন যেহেতু গল্প বলবে, সবাই যাতে তার মুখ দেখতে পায় সেজন্যে একটা চেয়ারে সবার মুখোমুখি বসল সে।
পায়ের ছাপগুলো ছিল সত্যি বিশাল, বুঝলে, শুরু করল রবিন, অনেক বড়!
এই সময় ঝাড়া দিয়ে ফারিহার হাত ছাড়িয়ে একলাতে উঠে দাঁড়াল টিটু। আরেক লাফে বিছানা থেকে নেমে জানালার দিকে ছুটে গেল।
ব্যাপার কি? অবাক হয়ে তাকাল সবাই।
কারণটা জানা গেল একটু পরেই। জানালায় উঁকি দিল লাল টকটকে নোল একটা মুখ কুকুরটাকে দেখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে মুখ কুঁচকাল, আহ, ঝামেলা। অ্যাই, ওটাকে থামতে বলো!
অ্যাই টিটু, থাম, আয় এদিকে, ডাক দিল কিশোর। মিস্টার ফগ? আপনি এখানে?
ফগর্যাম্পারকট। শুধরে দিল পুলিশম্যান।
সরি, মিস্টার ফগর্যাম্পারকট, আগের প্রশ্নটাই করল কিশোর, আপনি এখানে?
এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম। বাগানে সবগুলো সাইকেল একসঙ্গে দেখে বুঝলাম, আছো সবাই এখানেই। অনেকদিন দেখি না, তাই ভাবলাম…
দেখাটা করেই যাই, তাই না? হাসল কিশোর। আসলে কিজন্যে এসেছেন বলি? আমরা কোন রহস্য পেয়েছি কিনা খোঁজ নিতে।
লাল মুখ আরও লাল হয়ে গেল ফগের। ঝামেলা! না না, তা নয়…ইয়ে, ঝামেলা, সত্যি কোন রহস্য পেয়েছ নাকি?
মুচকি হাসল কিশোর। পেয়েছি।
গোলআলুর মত চোখগুলো আরও গোল আর বড় হয়ে গেল ফগের। জানালার। দিকে আরেকটু এগিয়ে এল মুখটা। পেয়েছ?
পেয়েছি।
গলা খাকারি দিল ফগ। এদিক ওদিক তাকাল। যেন দেখতে চাইল আড়াল থেকে কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে কিনা। তারপর স্বর নিচু করে জিজ্ঞেস করল, রহস্যটা কি?
ভূত!
ঝামেলা! রসিকতা কোরো না তো! ফগ ভাবল, সে যে ভূত হয়ে গিয়েছিল সেই কথাটাই খোঁচা মেরে মনে করিয়ে দিতে চাইছে কিশোর।
না, সত্যি বলছি, রহস্যটা ভূতেরই।
সত্যি? ঠাট্টা করছ না তো?
না, ঠাট্টা করব কেন?
তা রহস্যটা কি?
আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসতে চাইছি, পৃথিবীতে ভূত বলে সত্যি কিছু আছে কিনা?
ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামতে আরম্ভ করল ফগ। রুমাল বের করে মুখ মুছল। কৌতূহল ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখে। কিভাবে সিদ্ধান্তে আসবে?
মুসা একটা ভূতুড়ে গল্প বলেছে, ওর আর ফারিহার বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প। এখন বলতে যাচ্ছে রবিন। শুরু করেছিল। আপনি আসাতে থেমে গেছে। তা আপনার কি কোন কাজ আছে আমাদের কাছে? কিশোরের ভঙ্গিটা এমন, থাকলে বলুন, নাহলে বিদেয় হোন।
উসখুস করতে লাগল ফগ। আবার এদিক ওদিক তাকাল। তারপর হে-হে করে একটা বোকার হাসি দিয়ে বলেই ফেলল, ঝামেলা! যদি কিছু মনে না করো তোমাদের আলোচনায় কি আমি অংশ নিতে পারি?
এ রকম একটা প্রস্তাব দিয়ে বসবে স্বয়ং ফগ, কল্পনাও করতে পারেনি গোয়েন্দারা। এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল ওরা। টিটু কি বুঝল কে জানে, ফপের দিকে তাকিয়ে খোক খোক শুরু করল সে।
ধমক দিয়ে ওকে থামাল কিশোর। আবার তাকাল ফগের দিকে। আপনি আমাদের আলোচনায় অংশ নেবেন?
কেন, অসুবিধে কি? হাতে কোন কাজ নেই আমার। আর কি যে তুষারপাত শুরু হলো, বিচ্ছিরি! সময় একদম কাটে না। বাইরে বেরোনোও মুশকিল। একটা রহস্য পেলেও হতো, সমাধানের চেষ্টা করতে পারতাম। শোনো, যদি চাও, ভূতের গল্প আমিও শোনাতে পারি তোমাদের। কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা আমারও আছে।
উৎসাহী হয়ে উঠল কিশোর। ফগের বাস্তব অভিজ্ঞতা! নিশ্চয় মজাদার কোন হাসির ব্যাপার হবে। সহকারীদের অবাক করে দিয়ে রাজি হয়ে গেল সে। বেশ, আসুন। রবিন, দরজাটা খুলে দাও, প্লীজ!
জানালা থেকে ফগের মুখ অদৃশ্য হয়ে গেল।
ওকে ঢুকতে দিচ্ছ? ভাল লাগছে না রবিনের। ভূতের গল্প শোনা না ছাই। ও আসলে আমরা কোন রহস্য পেয়েছি কিনা জানার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে।
উঠুক। এখন কোন রহস্য নেই আমাদের হাতে, তদন্ত চলছে না, ও কোন বাগড়া দিতে পারবে না। তা ছাড়া ওকে সরাসরি মানা করে দেয়াটা অভদ্রতা হতো।
দরজা খুলে দিল রবিন।
ফগ ঘরে পা রাখতে না রাখতেই ঝাঁপ দিয়ে গিয়ে পড়ল টিটু। পায়ের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে গোড়ালিতে কামড়ে দিতে চাইল। চিৎকার করে উঠল ফগ, ঝামেলা! আহ, ঝামেলা! অ্যাই কুত্তা, সর, সর! কুকুরটার পেটে কষে এক লাথি হাঁকানোর ইচ্ছেটা দমন করল, লাথি মারলে যদি আর থাকতে না দেয় ছেলেমেয়েগুলো, এই ভয়ে।
টিটুকে প্রচণ্ড ধমক লাগাল কিশোর। কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনল। এক চড় লাগাব ধরে! কখন কোন শয়তানিটা করতে হবে তাও বোঝে না। সব সময় এক। জলদি গিয়ে ফারিহার কাছে চুপ করে বোস!
আর কোন গণ্ডগোল করল না দিই। লেজ টিয়ে চুপচাপ গিয়ে ফারিহার বিছানায় উঠল।
একটা চেয়ার টেনে বসল ফগ। মুখের ঘাম মুছল।
দরজা লাগিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এল রবিন।
ঝামেলা! রবিনের দিকে তাকাল ফগ। নাও, এবার শুরু করতে পারো। আগে একটা প্রশ্নের জবাব দাও। যে গল্পটা বলবে, সেটা কি বানানো, না সত্যি?
বলাই তো হলো বাস্তব অভিজ্ঞতার গল্প। বানানো হবে কেন?
ঠিক আছে। আর কোন প্রশ্ন নেই আমার।
গল্প শুরু করল রবিন।
.
০২.
অনেক বড় পায়ের ছাপ। কোন বিশাল জানোয়ারের। চেপে বসেছে। কারণ মাটি নরম। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল।
হান্টার রিজে যাচ্ছিলাম। ছাপগুলো চোখে পড়তে থমকে দাঁড়ালাম। চোখ বোলালাম চারপাশে।
পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছি আমি। কোথাও কোন শব্দ নেই। নিচে হারলে ক্রীকের নীল জল। মাথার ওপরে হান্টার রিজের ঘন গাছপালায় ছাওয়া বন!!
আবার তাকালাম মাটির দিকে। কিসের পায়ের ছাপ ওগুলো? কোন জন্তুর? একপাশের ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে বেরিয়েছে বোঝা যায়। পায়ের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে ঘাস। ঝোঁপের ডাল ভাঙা। ওপরের বন থেকে নেমেছিল ওটা। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আবার ফিরে গেছে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।
আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে নিচে আমাদের বাড়িটা স্পষ্ট চোখে পড়ে। ধূসর পাথরে তৈরি পুরানো একটা বড় বাড়ি। বহুকাল আগে ইনডিয়ানদের বানানো।
আবার তাকালাম ছাপগুলোর দিকে। আমি জানি বনের মধ্যে হরিণ আছে। কিন্তু হরিণের পায়ের ছাপ নয় ওগুলো অন্য কিছু কুকুর জাতীয় কোন প্রাণীর। এখানে নেকড়ে আছে নাকি? না কায়োট?
ভালমত দেখতে গিয়ে আরেকটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল, কুকুরটার পায়ের ছাপের পাশে কোথাও কোথাও একধরনের ঘষার দাগ। খুবই অস্পষ্ট।
পেছনে শব্দ হলো। চমকে উঠলাম ফিরে তাকিয়ে দেখি বনমোরগের একটা পরিবার হেলেদুলে নেমে আসছে খোলা জায়গাটার দিকে আমাকে দেখে থমকে গেল। প্রায় মিনিটখানেক অপেক্ষা করল আমি কিছু করছি না দেখে পাশ কেটে চলে যেতে শুরু করল নিচে ক্রীকের দিকে, বোধহয় পানি খেতে
এত কাছে থেকে বনমোরগ আর কখনও দেখিনি বেশ বড় আকারের লাল আর ধূসরে মেশানো পালক। লাল লাল চোখ দেখে মনে হয় রেগে আছে। পায়ের। দিকে তাকালাম। একেবারেই খুদে। যে ছাপ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, ওগুলো বনমোরগের হতেই পারে না।
ঠক করে মাটিতে এসে পড়ল কি যেন আমার সামনে মাত্র দুই হাত দূরে। তাকিয়ে দেখি ছোট একটা পাথর। ঢালে ঠোকর খেতে খেতে লাফিয়ে নেমে গেল কিছুদূর।
চমকে গেল পাখিগুলো। কক কক করে ওড়াল দিল।
পেছনের বন থেকে হুড়মুড় করে দৌড়ে বেরিয়ে এল একটা মেয়ে। উত্তেজিত জিজ্ঞেস করল, লেগেছে?
ভাবলাম, আমার গায়ে লেগেছে কিনা জিজ্ঞেস করছে বুঝি। মাথা নেড়ে বললাম, না লাগেনি অল্পের জন্যে বেঁচেছি।
তোমার কথা কে বলছে, গাধা কোথাকার। পাখিগুলোর দিকে নজর মেয়েটার। কোনটা গিয়ে ঝাঁপ দিল ঝোঁপের মধ্যে, কোনটা বসল গাছের ডালে। বেশি ভীতুগুলো আরও দূরে উড়ে গেল গাছপালার মাথার ওপর দিয়ে। আমার দিকে ফিরল আবার মেয়েটা। হতাশ কণ্ঠে যেন নিজেকেই প্রশ্ন করল, একটার গায়েও লাগেনি?
লাগলে তো তড়পাত দেখতেই পেতে।
এগিয়ে এসে আমার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল মেয়েটা। পরনে শর্টস, গায়ে টি শার্ট, মাথায় লাল-সাদা একটা লস অ্যাঞ্জেলেস ডজারস বেজবল ক্যাপ, চোখে লাল কাঁচের সানগ্লাস আবার জিজ্ঞেস করল, সত্যি লাগেনি কোনটার গায়ে?
লাগলে মরে পড়ে থাকত।
অনেক সময় জখম হলেও উড়ে যায় বনমোরগ অন্যখানে গিয়ে মরে।
তাহলে খোজোগে ঝোঁপের মধ্যে, হাত তুলে দেখিয়ে দিলাম। পাথর ছুঁড়তে হলে একটু সাবধানে ছুঁড়ো। আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিয়ে। আমার মাথাটাই ফাটিয়ে দিয়েছিলে আরেকটু হলে।
লাল কাঁচের ভেতর দিয়ে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল মেয়েটা। বড়দের মত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বোকার মত ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কারও গায়ে লাগতে পারে।
রাগ লাগল মেয়েটার পাকামো দেখে। বললাম, আমি বোকাও নই, যে কারোও নই, আমার একটা নাম আছে-রবিন মিলফোর্ড।
হেসে ফেলল মেয়েটা, তুমি রেগে যাচ্ছ।
রাগিয়ে দেয়ার মত করেই তো কথা বলছ।
হাত তুলল ও, আচ্ছা ঠিক আছে, আর বলব না, সরি। তোমরা নতুন এসেছ এখানে, না?
হ্যাঁ। বেড়াতে।
ঢালের নিচের ওই বড় বাড়িটাতে উঠেছ?
হ্যাঁ, হাত বাড়িয়ে দিলাম। ওটা আমাদেরই। আমার মায়ের।
সেও তার হাত বাড়াল। আমি নিনা হাওয়ার্ডস কিন্তু সবাই ডাকে গগলস। সারাক্ষণ সানগ্লাস পরে থাকি তো, তাই।
হাত মেলালাম আমরা। ওর কনুইয়ের দিকে চোখ পড়ল। গোটা দুই গভীর আঁচড়ের দাগ। ঘষা লেগে কেটেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ফুটবল খেল নাকি? গোলকীপার?
হাসল ও। বলল, আমাকে নিনা ডাকলেই খুশি হব। গগলস শুনতে ভাল্লাগে না। ফুটবল খেলি না, শুধু বেজবল। এই দাগগুলো দেখে বলছ তো? এগুলো খেলার সময় পড়ে গিয়ে নয়, পাথরে ঘষা লেগে কেটেছে। ওপরের শৈলশিরাটা দেখিয়ে বলল, বেশির ভাগ সময় ওখানে কাটাই আমি। রাতে যখন অন্ধকারে আর কিছু দেখা যায় না তখন নামি একটা ঘাসের ডগা ছিঁড়ে নিয়ে দাতে কাটতে লাগল সে।
রাতেও ঘোরাঘুরি করো এই বনের মধ্যে?
করি, তাতে কি? অন্ধকারকে ভয় পাও নাকি তুমি?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে ছাপগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নিনা, এগুলো কিসের ছাপ, বলো তো?
মাটির দিকে তাকায়নি এতক্ষণ ও। ছাপগুলো দেখে মুহূর্তে বদলে গেল চেহারা। দাঁত থেকে খসে পড়ল ঘাসের ডগা। সাদা হয়ে গেল মুখ। সানগ্লাস খুলে নিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াল আরও ভাল করে দেখার জন্যে। যখন সোজা হলো আবার, চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। বাদামী মণি দুটোতে আতঙ্ক।
এখানে কেন এসেছিল ওটা? ফিসফিস করে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল নিনা।
ঢোক গিলোম। জিজ্ঞেস করলাম, কিসে কি করছিল?
প্রহরী, বলল সে, কবরের প্রহরী! ছাপগুলোর কাছ থেকে এমন ভঙ্গিতে সরে গেল মনে হলো ভয় পাচ্ছে।
কবরের প্রহরী?
আবার ছাপগুলোর দিকে তাকাল ও। এত নিচে আর নামেনি কখনও, গলা কাঁপছে ওর। মুঠো করে ফেলেছে হাত।
নিনা?
জবাব না পেয়ে ওর কাধ ধরে কঁকালাম, নিনা, কে ওই কবরের প্রহরী?
আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল ও। একটা কুকুর, রহস্যময় কণ্ঠে বলল। বিশাল। কালো। এত বড় কুকুর কোথাও দেখতে পাবে না আর। তবে ওটা কুকুর নয়।
দ্বিধায় পড়ে গেলাম। বলছে কুকুর, আবার বলে কুকুর নয়, সেটা আবার কি? বললাম, কি যা তা বলছ! হয় কুকুর, নয়তো অন্য কিছু; একসঙ্গে দুটো প্রাণী হতে পারে না।
পারে, নিচুস্বরে জবাব দিল নিনা। ভূত-প্রেতেরা পারে। বিশাল কালো কুকুরের রূপ ধরে থাকে ওটা। দানব!
ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কাঁপছে। বিশ্বাস করতে পারলাম না, যত্তসব ফালতু কথা!
তোমার কাছে ফালতু মনে হতে পারে, কিন্তু এ এলাকার সবাই জানে ওটার কথা। পাহাড়ের ওপরে ওই চুড়ার কাছে ইনডিয়ানদের একটা গোরস্থান আছে। বহুকাল আগে নিচের উপত্যকায় বাস করত সেনিকা ইনডিয়ানরা। কবর দিত ওপরে। ওখানে যাদের কবর দেয়া হয়েছে, তাদের পাহারা দেয় ওই ভূতুড়ে কুকুরটা।
তাকিয়ে রইলাম নিনার দিকে। ভূত! প্রেত। দানব! কবরখানা পাহারা দেয় ভূতুড়ে কুকুর। এ সব কি বলছে?
আবার তাকালাম ছাপগুলোর দিকে। কুকুরের পায়ের এতবড় ছাপ আর দেখিনি আমি। দানবই ওটা।
সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নামল পাহাড়ে। গাছের মাথায় কাপন তুলে বয়ে গেল একঝলক বাতাস। মর্মর শব্দে মাটিতে গড়াল শুকনো ঝরা পাতা।
আমারও ভয় লাগতে আরম্ভ করেছে। ওকে বললাম, ভূতেরা মাটিতে পায়ের ছাপ ফেলে না।
সে কথা আমিও শুনেছি। কিন্তু এই ভূতটা ফেলে। কুকুরের মত গলা ছেড়ে ডাকে। পাহাড়ের ওপর ঘুরে বেড়ায়। এমনকি খুনও করে। আমার দিকে তাকাল ও। রবিন, কখনও পাহাড়ের ওপরে যেয়ো না।
কোনখানে?
শৈলশিরাটা দেখাল নিনা। ওদিকে। বিরাট এক ওক গাছ আছে, তার কাছে মৃত্যুপুরী। গেলে মেরে ফেলবে তোমাকে। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করো আমার কথা।
বিরাট ওক। মৃত্যুপুরী। রূপকথার মায়াপুরীর রাক্ষস-খোক্কসের কেচ্ছা শোনাচ্ছে যেন আমাকে নিনা। তাকালাম ওর দিকে। ওর চোখের আতঙ্ক আমাকেও যেন গ্রাস করতে আরম্ভ করল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগল শরীরে। হাতের তালু ঠাণ্ডা হয়ে এল, মুখের ভেতরটা গেল শুকিয়ে। জোরাল হলো বাতাস। নড়িয়ে দিল ডালপালা। ঝরে পড়তে লাগল আরও অনেক শুকনো পাতা।
তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শোনা গেল আচমকা। কুকুরের ডাকের মত।
ভীষণ চমকে গিয়ে লাফ দিয়ে আমার কাছে চলে এল নিনা। আমিও লাফিয়ে উঠতাম, কিন্তু পা দুটো মনে হলো বরফের মত জমে গেছে।
কিসের ডাক? জিজ্ঞেস করলাম।
ওটাই তো! ফিসফিস করে বলল নিনা। প্রহরী! সূর্য অস্ত গেলেই ডাকে।
কোনখান থেকে? আমিও ওর মত ফিসফিস শুরু করেছি।
ওই যে বললাম, পাহাড়ের ওপরে, চুড়ার কাছে। ওই যে আবার ডাকছে, ভয়ে ভয়ে বলল নিনা। ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল ও। আমি বাড়ি যাচ্ছি।
দাঁড়াও, দাঁড়াও! এক মিনিট, অস্বস্তি লাগছে আমার, ওই ডাক শুনেছ নাকি আরও?
মাথা ঝাঁকাল নিনা।
দেখেছ ওটাকে?
এক মুহূর্ত দ্বিধা করে আবার মাথা ঝাঁকাল সে।
কোথায়?
পাহাড়ের ওপর।
অস্বস্তিটা বাড়ল আমার। তুমি বলছ সব সময় পাহাড়ের ওপর থাকে ওটা। কাল রাতে তাহলে এখানে নেমেছিল কেন? পায়ের ছাপই বলছে, নেমেছিল!
চোখ আরও বড় বড় হয়ে গেল ওর, মুখ সাদা। শুকনো গলায় জবাব দিল, জানি না! এতদিন তো পাহাড়ের ওপরেই থেকেছে ওটা।
কিন্তু কাল রাতে এখানে নেমেছিল। এ জন্যেই ভয় পাচ্ছ তুমি, তাই না?
আমার চোখের দিকে তাকাল নিনা, এর আগে আর কোনদিন নিচে নামেনি ওটা। ছাপগুলোর দিকে তাকাল ও, নিচের উপত্যকার দিকে, তারপর আবার আমার দিকে। কাল রাতে এখানে নেমে তোমাদের বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল ওটা। কার দিকে, কেন তাকিয়েছে, জানি না। আমি শুধু জানি, এর আগে আর কোনদিন নিচে নামেনি প্রহরী।
আরও জোরে চিৎকার করে উঠল ওটা। চমকে উঠলাম দুজনে।
ওই জানালাটার দিকে তাকিয়েছিল ওটা, হাত তুলে দেখাল নিনা, একমাত্র জানালা যেটা পাহাড়ের এই ঢাল থেকে দেখা যায়। জানালাটা কার ঘরের?
গরম নেই। তাও ঘামতে শুরু করলাম। জবাব দিলাম, আমার!
.
০৩.
দৌড় দিতে গেল নিনা। হাত চেপে ধরলাম ওর।
যেতে দাও, ও বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
এক মিনিট, আমি বললাম। কিন্তু শুনল না ও। ঝাড়া মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার দৌড় দিতে যাবে এই সময় মাটিতে পড়ে থাকা চকচকে একটা জিনিস চোখে পড়ল আমার। নিচু হয়ে তুলে নিয়ে বললাম, তোমার সানগ্লাস।
দাও।
হাতটা পেছনে সরিয়ে নিলাম, আগে বলো, ভূতটাকে তুমি দেখার পর কি ঘটল?
দ্বিধা করতে লাগল ও। আগে আমার চশমা দাও।
দিয়ে দিলাম ওটা। চোখে পরে নিল সে। ছাপগুলোর দিকে আরেকবার তাকিয়ে আমার দিকে মুখ তুলল। রাতের বেলাও পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে আমার, বলেছি না?
মাথা ঝাঁকালাম।
হপ্তা দুই আগে ওরকমই এক রাতে বেরিয়েছিলাম। এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম। একটা রাস্তা চলে গেছে পাহাড়ের ওপরের ঢাল বেয়ে ওপরের মাথা গেছে কবরখানার দিকে, নিচটা উপত্যকায় ওই পথের দিকেই যাচ্ছি, বেড়ানো শেষ হয়েছে আমার, বাড়ি ফিরছি আসলে তখন হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ওটাকে ওপরে, পথের একেবারে শেষ মাথায়, কয়েকটা গাছের কাছে।
দেখতে কেমন?
কতবার বলব? কুকুরের মতন। অনেক বড় কুকুর। রীতিমত একটা দৈত্য
কি করলে তখন?
আমার দিকে তাকিয়ে রইল নিনা। কি আবার করব? পাগল নাকি তুমি? ভূতের বিরুদ্ধে কিছু করা যায়? কিছুই করিনি। পাথর হয়ে গিয়েছিলাম। পা নড়াতে পারছিলাম না তারপর ওটা গায়েব হয়ে গেল।
গায়েব হয়ে গেল মানে?
গায়েব হয়ে গেল মানে-গায়েব একেবারে হাওয়া।
সন্দেহ হলে আমার, জিজ্ঞেস করলাম, সত্যি দেখেছিলে তো?
বুকের ওপর হাত দুটা আড়াআড়ি রেখে দাঁড়াল নিনা। তোমার অবগতির জন্যে একটা কথা জানাই মিস্টার রবিন মিলফোর্ড, যেখানে যে জিনিস থাকে না সেটা আমি দেখি না চিৎকারটার ব্যাপারে কি বলবে? এই ইকটু আগে যে দুজনে। শুনলাম? নাকি সেটাও শুনিনি?
তা শুনেছি অস্বীকার করতে পারলাম না কান পাতলাম। থেমে গেছে চিৎকার।
নিনা, তোমাকে মিথ্যুক বলছি না আসলে ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না আমি।
এখানে এতদিন আসোনি বলে করোনি।
হয়তো তবে এখানকার ইনডিয়ানদের কথা আমি অনেক কিছুই জানি। আমার মায়ের এক পূর্বপুরুষ ছিলেন মোহক ইনডিয়ান। শার্টের গলার কাছের বোতাম খুলে কলারটা ট্র্যাক করে ধরলাম, এই দেখো!
কি ওটা?
দেখতে পাচ্ছ না একটা মালা? ওয়ামপাম গুটির। তাও আবার কালো গুটি। অনেক বড় মোহক যোদ্ধারাই কেবল এই মালা পরত। মালাটা কয়েক পুরুষ ধরে হাত বদল হতে হতে মার হাতে পড়েছিল। আমার গত জন্মদিনে আমাকে উপহার দিয়েছে মা।
ছুঁয়ে দেখতে পারি?
মালাটা ধরতে দিলাম নিনাকে।
বহুকাল আগে এই উপত্যকায় বাস করত মোহকরা, নিনা বলল। হয়তো তোমার মায়ের পূর্বপুরুষ সেই ইনডিয়ান যোদ্ধাও এই এলাকায়ই ছিলেন।
ছিলেনই তো, আমি বললাম। ওই বাড়িটা তো তার কাছ থেকেই পাওয়া। মালাটার মতই হাত বদল হতে হতে ওটাও মার দখলে এসেছে।
তারমানে তোমার পূর্বপুরুষ সেই ইনডিয়ান যোদ্ধাকেও মৃত্যুপুরীতেই কবর দেয়া হয়েছে?
হতে পারে। ওই মৃত্যুপুরীটা কি, বলো তো?
অনেক বড় একটা গুহা। পাহাড়ের ভেতরে সুড়ঙ্গের মত ঢুকে গেছে। মৃত্যুর সময় হলে ইনডিয়ান যোদ্ধারা গিয়ে ঢুকত ওর মধ্যে। কেবল বীরেরাই ঢুকত, সাধারণ ইনডিয়ানদের জন্যে বারণ! কড়াকড়ি ভাবে এই নিয়ম মেনে চলত ওরা। একবার ঢুকলে কেউ আর জীবিত বেরোতে পারে না ওখান থেকে। সেজন্যেই নাম হয়েছে মৃত্যুপুরী।
তুমি ঢুকেছ কখনও?
রাগ করে মালাটা ছেড়ে দিল নিনা। বললাম না কেউ জীবিত বেরোতে পারে না ওখান থেকে। কেউ না!
তাই?
তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না নাকি? দেখো, রবিন, বোকামি করে কিছু করে বোলো না। ওই চুড়ার কাছে যেয়ো না। গোরস্থানটা থেকে দুরে থাকবে। কোনমতেই মৃত্যুপুরীর ধারেকাছে যাবে না। যদি যাও, কোনদিন আর ফিরবে না, বলে দিলাম। কবরের প্রহরী ছাড়বে না তোমাকে।
গুডবাই জানিয়ে বাড়ি রওনা হলাম দুজনে।
বাড়ি ফিরতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগল না আমার। ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। ভয়ও পাচ্ছি। চারদিকে নানা রকম শব্দ, আলো থাকতে যেগুলো ছিল না। বার বার মুখ ফিরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে তাকালাম, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ল না।
রাতে ডিনার খেতে বসে মা আর বাবাকে বললাম গোরস্থানটার কথা। ভূতের কথাটা চেপে গেলাম। বললে যদি হাসাহাসি করে? ওই এলাকার অনেক ইতিহাসই জানে মা বলল ইনডিয়ানদের ছয় ছয়টা উপজাতি বাস করেছে ওখানে। গোরস্থানটার কথাও জানে। কথিত আছে-ওটাকে কেউ অবহেলা করলে, ওটার ওপর দিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেঁটে গেলে তার ওপর নাকি অভিশাপ নেমে আসে।
খাওয়ার পর পরই শুতে চলে গেল মা আর বাবা। সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত। কিন্তু আমার ঘুম এল না। বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি করতে লাগলাম। ভাবতে লাগলাম কালো কুকুরটার কথা। ভূত-প্রেত বলে কিছু নেই, অনেকের কাছেই শুনি। তাহলে নিনা কি দেখল? হতে পারে বড় নেকড়ে অথবা কায়োট। বুনো কুকুরও হতে পরে। মালিককে হারিয়ে বুনো হয়ে গেছে কোন পোষা কুকুর।
কিন্তু হঠাৎ করে ওটা নিচে নামল কেন? আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়েই বা থাকবে কেন?
মনে হচ্ছিল ঘুম আর আসবে না। তবে ঘুমিয়েছি। কতক্ষণ পরে জানি না, জেগে গেলাম। আপনাআপনি খুলে গেল চোখের পাতা। কেন জাগলাম? কিসের। শব্দে? মনে হলো বাইরে কিছু একটা নড়াচড়া করছে।
চুপচাপ বিছানায় পড়ে থেকে কান পেতে রইলাম। প্রথমে রাতের স্বাভাবিক সব শব্দ কানে আসতে থাকল, এই যেমন আমার মাথার কাছে রাখা ঘড়িটা। টিকটিক টিকটিক করেই চলেছে। বাইরে গাছের ডালে বাতাসের কানাকানি। হারলে ক্রীক থেকে ভেসে আসছে রাতচরা হাঁসের ডাক। শুকনো পাতা গড়াচ্ছে। মাটিতে। তারপর আরেক ধরনের শব্দ করে উঠল পাতা। পা পড়লে যেমন হয়। শুকনো পাতা মাড়িয়ে হাঁটছে কেউ।
পুরো সজাগ হয়ে গেছি তখন। বাইরে কেউ আছে তাতে আর কোন সন্দেহ রইল না। মোলায়েম পা ফেলে আস্তে আস্তে হাঁটছে সে, কিন্তু শুকনো পাতা তার অস্তিত্ব জাহির করে দিচ্ছে। আমার জানালার কাছে এগিয়ে আসছে পদশব্দ। নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এত ভারী আর জোরাল, কুকুর কখনও ওরকম নিঃশ্বাস ফেলে না। অনেকটা পরিশ্রমে হাঁপিয়ে পড়া মানুষের মত। কি ওটা?
ধীরে ধীরে কমে এল নিঃশ্বাসের শব্দ। আবার পাতায় পা পড়ার মর্মর ধ্বনি। আমার জানালার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগল ওটা।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দৌড়ে নামলাম নিচতলায়। লিভিং রূম পার হয়ে ছুটলাম। মা আর বাবা যাতে শুনতে না পায় সেজন্যে যতটা সম্ভব নিঃশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম সামনের ছড়ানো রেলিঙ দেয়া বারান্দায়।
এ সময় কানে এল চিৎকারটা।
ভয়াবহ আর্তচিৎকার। তাতে যন্ত্রণা তো আছেই, সেই সঙ্গে মিশে আছে আরও কিছু-আতঙ্ক।
তারপর আবার সব চুপচাপ। এতটাই নীরব হয়ে গেল, সন্দেহ হলো, সত্যি চিৎকারটা শুনেছি তো? নাকি সব আমার ভীত, ক্লান্ত মনের কল্পনা? ওপরে বাবা মার ঘরের দিকে তাকালাম, জানালায় আলো জ্বলে কিনা।
আগের মতই অন্ধকার। ওরা কিছু শোনেনি।
আমি কি একাই কি শুনলাম? সন্দেহটা বাড়ল-কল্পনাই করেছি।
চারদিক বড় বেশি নীরব। এতটা কেন? খেয়াল করলাম, হাঁসগুলো ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছে। সেটাও অস্বাভাবিক। এ ভাবে চুপ করে যাওয়ার একটাই কারণ, চিৎকারটা কানে গেছে ওদের। তারমানে ভুল শুনিনি আমি। কল্পনা নয়।
কিন্তু এল কোনখান থেকে?
সিঁড়ির দিকে এগোলাম। বারান্দার একধারে রয়েছে বাড়িটার সেলার। আগের। দিন মা আমাকে মাটির নিচের ওই ঘরটা দেখিয়ে বলেছে যে কদিন থাকব ওটাকে আমাদের সবজি রাখার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হবে। অদ্ভুত জায়গায় তৈরি করা হয়েছে সেলারটা। পাহাড়ের গোড়ায়। কতগুলো সাদা পাথরের পর ঢালটা উঠে গেছে চুড়ার সেই শৈলশিরার কাছে, যেটাতে রয়েছে ইনডিয়ানদের কবর।
অনুমান করলাম, চিৎকারটা এসেছে ওই মাটির নিচের ঘর থেকে।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেলারের দিকে এগোলাম। ঢালের দিকে চোখ! কেউ আছে। কিনা দেখছি। বড় বড় ঘাস জন্মে আছে। ঘাসের ওপর দিয়ে ধীরে ধীরে নজর চলে গেল চুড়ার দিকে। তারপর আরও ওপরে, আকাশের দিকে। আধখানা চাঁদ আর অসংখ্য বড় বড় তারা প্রচুর আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে উপত্যকায়। দেখার জন্যে যথেষ্ট। ঢালের ওপর কিছু দেখলাম না। দুই পাশে তাকালাম। নেই। যেটা এসেছিল, চলে গেছে। মনে হলো, তখনকার মত আমি নিরাপদ।
সেলারের কাছে পৌঁছলাম। অনেক বড় একটা গর্তকে যাতে পানি না পড়ে সেভাবে ঢেকেঢুকে নিয়ে জিনিসপত্র রাখার ঘর বানানো হয়েছে। মুখের কাছে ঝুঁকে বসে ভেতরে উঁকি দিলাম। ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। টর্চ আনার দরকার ছিল। আরও ঝুঁকে, দুই হাতের তালুতে ভর দিয়ে মাথাটা ঝুলিয়ে দিলাম ভেতরে। তাও কিছু চোখে পড়ল না। সকালে আলোতে ছাড়া দেখতে পারব না চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে পিছিয়ে এলাম।
খুট করে পেছনে একটা শব্দ হলো। পাথরের মূর্তি হয়ে গেলাম যেন।
খেয়াল করলাম, ঝলমলে চাঁদের আলো নেই আর এখন! ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে জ্যোৎস্না। ঢালের ঘাস, আশপাশের জমি, পাথর, গাছপালা সব অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার পেছনে কালো একটা ছায়া বড় হয়ে উঠছে আমার ছায়াও পড়েছে মাটিতে। চাঁদ পেছনে থাকায় ছায়াটা লম্বা হয়ে গেছে অনেক। পেছন থেকে আরও বড় একটা ছায়া ঢেকে দিচ্ছে আমারটাকে। আমি যে ভঙ্গিতে আছি, সেরকমই চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো।
ঠিক আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওটা।
.
০৪.
ফিরে তাকানোর সাহস তো হলোই না, চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঘাড়ে এসে পড়তে লাগল যেন ভারী নিঃশ্বাস। এত বেশি হাঁটু কাঁপতে লাগল মনে হলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব মাটিতে। ঠাণ্ডা রাতু। তার মধ্যেও ঘামতে শুরু করলাম। নিজের অজান্তে হাত উঠে গেল কালো গুটির মালাটার দিকে। চেপে ধরলাম। অপেক্ষা করছি ভয়ঙ্কর কিছু ঘটার। গালে গরম নিঃশ্বাস, তারপর ঘাড়ে দাঁত ফোঁটানোর তীক্ষ্ণ ব্যথা বা ওরকম কিছুর।
ওটাও যেন অপেক্ষা করে আছে, আমার পেছনে। আমার আঙুল, আমার হাত, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ যেন কাঁপতে শুরু করল থরথর করে! চিৎকার করতে চাইলাম। স্বর বেরোল না ভয়েই অকেজো হয়ে গেছে যেন স্বরযন্ত্র সামান্যতম। শব্দও করতে পারলাম না। এমনকি দম নিতেও যেন কষ্ট।
প্রচণ্ড গর্জনের পর একটা ভারী শরীর আমার ওপর লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষা করছি। কিছুই ঘটল না। চোখ মেলছি না। ভাবছি, যে কোন মুহূর্তে এখন অনুভব করব ব্যথাটা, যে কোন সময়।
জানি না কতক্ষণ ওভাবে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে কুকুরের মত হয়েছিলাম। কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি তাও বলতে পারব না। অবশেষে মনে হলো একটা কিছু করা দরকার আমার চোখ বন্ধ রেখেই খুব ধীরে ধীরে এক দুই তিন করে শুনতে আরম্ভ করলাম। দশ গোণা শেষ হলেই ফিরে তাকাব। ঘুরতে আমি চাই না। ভয়ঙ্কর ওই চেহারাটা দেখার সাহস বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। চুপ করে আছি বলে হয়তো কিছু করছে না। নড়াচড়া দেখলেই এসে ঘাড় কামড়ে ধরবে সেই ভয়ও আছে। কিন্তু তবু দেখতে হবে। আর অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।
দশ গুনে, চোখ মেলেই ঝটকা দিয়ে ঘাড় ঘোরালাম!
ডানে বায়ে দুদিকেই তাকালাম। চাঁদের আলো খেলে যাচ্ছে ঘাসের ওপর। সেলারের ওপরের পাথরগুলো আগের মতই সাদা, কোথাও কোন ছায়া নেই, আমার পেছনেও নেই।
কিন্তু ছায়া তো ছিল একটা! নাকি চোখের ভুল আমার? বুঝতে পারলাম না।
শৈলশিরার কাছে বনটার দিকে তাকালাম। কোন নড়াচড়া নেই। সব স্বাভাবিক। আকাশে চাঁদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে এক টুকরো মেঘ। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়েছিল বলেই কি ছায়া নেমেছিল উপত্যকায়? তাই হবে। কিন্তু অন্য ছায়াটা? যেটা আমার ছায়াকে ঢেকে দিয়েছিল? নিঃশ্বাসের শব্দ? এ সবের কি ব্যাখ্যা? হতে পারে কুকুরটা এসে দাঁড়িয়েছিল আমার পেছনে। তাই যদি হবে, তাহলে ভূতুড়ে কুকুর নয় ওটা। যতদূর জানি, ভূতের ছায়া পড়ে না। নিনার কথামত অবশ্য ওই কুকুরটা ভূত হলেও অদ্ভুত। পায়ের ছাপ বসে যায় মাটিতে। ছায়া পড়তেই বা দোষ কি? খুট করে শব্দ যে হয়েছিল একটা আমার পেছনে, সেটাও স্পষ্ট শুনেছি। মন কিংবা কানের ভুল নয়। সময়মত ফিরে তাকাইনি বলে নিজেকে গাধা বলে গাল দিতে লাগলাম। তাকালে একটা বড় রহস্যের সমাধান হয়তো তখনই হয়ে যেত। তাকালে হয়তো ঘাড় মটকে মেরে ফেলত, এই বলে সান্তনাও দিলাম মনকে।
অন্ধকার সেলারটার দিকে তাকালাম আবার। ঠিক করলাম, কাল সকালেই জেনে নেব কি ঢুকেছিল ওখানে। দিনের আলো ফুটলে সেলারে নামব। কিসে চিৎকার করল জানতেই হবে।
ঘরে ফিরে এলাম। বিছানায় শুয়েও ঘুম এল না কখন ভোর হবে, কখন সূর্য উঠবে, কখন নামব সেলারে, দেখতে পাব কিসে করেছে চিৎকার, এই চিন্তায় সময় আর কাটছে না।
তবে ঘুমিয়ে পড়লাম এক সময়। আবার যখন চোখ মেলোম দেখি রোদ উঠেছে। সব কিছুই আলোয় উজ্জ্বল। হাসিখুশি দিন। রাতে যে অমন একটা কাণ্ড ঘটে গেছে বিশ্বাসই হতে চায় না।
বিছানা থেকে নেমেই রওনা হলাম সেলারের দিকে। আগে দেখতে হবে কিসে চিৎকার করেছিল। জানতে হবে স্বপ্ন দেখেছি, না সত্যি।
না, স্বপ্ন নয়। সেলারের কাছাকাছি গিয়ে মাটির দিকে তাকিয়েই থমকে গেলাম। আবার সেই পদচিহ্ন। বড় বড় পায়ের ছাপ। সন্দেহ হলো। বাড়ির চারপাশে খুঁজে দেখলাম, সবখানেই আছে। বাগান, আঙিনা সব ঘুরে তারপর এগিয়েছে সেলারের দিকে। পাহাড়ের ঢালে যেমন দেখেছিলাম, অদ্ভুত সেই ঘষার দাগ এখানেও আছে কোথাও কোথাও, কুকুরটার পায়ের ছাপের পাশে। আরও নানা রকম ছাপ দেখতে পেলাম। ছোট ছোট জানোয়ারের বেশির ভাগই চিনি না।
সেলারের প্রবেশ মুখের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে ভেতরে উঁকি দিলাম। বাইরে এত আলো থাকলেও ভেতরটা তখনও অন্ধকার।
হঠাৎ মনে হলো আরও বেশি অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। চমকে উঠলাম। আবার! হাঁটু কাঁপতে আরম্ভ করল। ফিরে তাকালাম। চেয়ে দেখি সূর্যের মুখ ঢেকে দিচ্ছে এক টুকরো মেঘ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে ধমক দিলাম-রবিন, অকারণ ভয়ে মনকে আচ্ছন্ন কোরো না। তাতে সত্য আবিষ্কারে ব্যাঘাত ঘটবে।
মেঘ সরে যাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। সরে গিয়ে আবার রোদ উঠল। ফিরে তাকালাম সেলারের দিকে। ভেতরে গলা বাড়িয়ে দিলাম। চোখে অন্ধকার সয়ে আসার অপেক্ষা করছি।
দেখতে পেলাম ওটাকে। একটা ব্যাকুন। গলায় মস্ত একটা ক্ষত। একগাদা রক্তের মধ্যে পড়ে আছে। চিৎকার করার জন্যে হাঁ করেছিল যে, সেই ভঙ্গিতেই রয়েছে মুখটা। চোখ দুটো ভোলা। নিষ্প্রাণ। কিন্তু আতঙ্কের ছাপ মুছে যায়নি তা থেকে।
সেলারের মুখের কাছে হুমড়ি খেয়ে আছি। ড্রামের মত বাজতে আরম্ভ করেছে। হৃৎপিণ্ডটা। তাকিয়ে আছি র্যাকুনের কালো, ছোট ছোট চোখ দুটোর দিকে।
সবাই জানে ব্যাকুন খুব লড়াকু প্রাণী। বেকায়দায় পড়লে ভালুকেও ছাড়ে না, যুঝতে থাকে। কিন্তু এই হতভাগ্য ব্যাকুনটা বাধা দেয়ার কোন সুযোগই পায়নি। শেয়ালে মারেনি ওটাকে, তাহলে ধস্তাধস্তি হতো, পড়ে থাকার ভঙ্গিটা হতো অন্য রকম। কায়োটেও নয়। তার চেয়েও বড় প্রচণ্ড শক্তিশালী কোন জানোয়ারের কাজ। নেকড়ে বা ভালুকের পক্ষে এ ভাবে খুন করা সম্ভব। কিন্তু। সেটা মেনে নিতে পারলাম না। ওসব জানোয়ার হলে সেলারের কাছে পায়ের ছাপ থাকত
তাহলে কিসে? কুকুরটা? সেলারে নেমে দেখলে জানা যাবে, যদি পায়ের ছাপ থাকে। তবে সেলারের মাটি এত শক্ত, পায়ের ছাপ পড়বে বলে মনে হয় না।
মিউ!
এতটাই চমকে উঠলাম, লাফিয়ে সোজা হতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল ওপরের বেরিয়ে থাকা একটা পাথরে মাথাটা ডলতে ডলতে ফিরে তাকিয়ে দেখি রোমার। আমাদের পড়শী মিসেস মারলোর ছোট কালো বেড়ালটা।
র্যাকুনের গন্ধ পেয়ে সেলারে ঢোকার চেষ্টা করা। ধরে ফেললাম।
এই যে, এখানে এসে বসে আছে, পেছন থেকে বলে উঠল একটা মহিলা কণ্ঠ। মিসেস মারলো। একটা বেড়াল আর একটা কুকুর পোষেন। কুকুরটার নাম ববি। রোমারকে আমার হাতে ছটফট করতে দেখে বললেন, যেই একটু ছাড়া। পেয়েছে অমনি চলে এসেছে। সারাটা রাত অস্থির হয়ে ছিল। খালি ডাকাডাকি করেছে।
কেন ডেকেছে বলতে পারি, মিসেস মারলো, বললাম আমি। কারণটা ওই যে ওখানে, হাত তুলে সেলারের দিকে দেখালাম। মিউ মিউ করে ছুটে গিয়ে সেলারে ঢুকতে চাইল আবার রোমার। ছাড়লাম না।
সেলারের ভেতরে উঁকি দিয়েই যেন বিদ্যুতের শক খেয়ে পিছিয়ে গেলেন মিসেস মারলো। মুখ সাদা।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন জানোয়ারে এ কাজ করেছে জানেন আপনি?
না, রবিন, জানি না, ঢোক গিলে কোনমতে জবাব দিলেন তিনি, শেয়াল টেয়ালে হবে। ভঙ্গি দেখে মনে হলো হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে শেয়ালের চেয়ে বড় কোন জানোয়ারের কাজ, বললাম তাকে। ভালুক কিংবা নেকড়ে।
আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি। মুখ তুলে তাকালেন হান্টার রিজের দিকে। ওসব জানোয়ার লোকালয়ে আসতে চায় না, গলা কাঁপছে তাঁর।
আপনি ঠিক জানেন?।
জানব না কেন? হারলে ক্রীকেই তো জন্মেছি।
কিছুতেই আমার চোখের দিকে তাকালেন না মিসেস মারলো। রোমারকে আমার হাত থেকে নিতে নিতে বললেন, আয়, রোমার, বাড়ি যাই। আর এ ভাবে যখন তখন ঘর থেকে বেরোবি না, বুঝলি? যাওয়ার জন্যে এত তাড়াহুড়া শুরু করলেন তিনি, ঘুরতে গিয়ে জ্যাকেট আটকে গেল একটা ঝোঁপের বেরিয়ে থাকা ভাঙা ডালের মাথায়। টান দিয়ে সেটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রায় ছুটে চললেন।
মিসেস মারলো, পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললাম, কবরের প্রহরীর কাজ নয়তো?
যেন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। ফিরে তাকালেন, রবিন, তোমার ভালর জন্যেই বলছি, হান্টার রিজের ওপরে পাহাড়ের মাথায় যেয়ো না কখনও। তোমার মা আর বাবাকে বোলো, তারাও যেন না যান। বলবে, আমি বলেছি।
কেন যাব না, মিসেস মারলো? জিজ্ঞেস করলাম।
এত কথা জানার দরকার নেই। যা বলছি, করবে।
.
০৫.
কি করব বুঝতে পারলাম না। সবাই খালি পাহাড়ের মাথায় যেতে মানা করে। নাস্তার পর খানিকক্ষণ হারলে ক্রীক থেকে ঘুরে এলাম। বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করলাম।
দুপুরবেলা বাড়িতে খেতে এলাম। মাকে তখনও বলিনি মরা র্যাকুনটার কথা। বললেই সরিয়ে ফেলবে। ওটাকে ওই অবস্থায় নিনাকে দেখানোর ইচ্ছে আমার। আমি জানতাম, ও আমাদের বাড়িতে আসবেই।
ঠিকই এল। দুপুরের পর। এত দেরি করল কেন, জানতে চাইলাম? বলল, স্কুলে গিয়েছিল।
রাতের ঘটনার কথা জানালাম ওকে। র্যাকুনটার কথা বললাম। দেখতে চাইল সে। নিয়ে গেলাম সেলারে।
নিচে নামলাম দুজনে। শক্ত মার্টিতে পায়ের ছাপ পড়েনি। অতএব কুকুরটাই খুন করেছে কিনা, নিশ্চিত হওয়া গেল না।
গম্ভীর হয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে মরা র্যাকুনটাকে দেখল নিনা।
পরামর্শ চাইলাম, কি করা যায় এটাকে, বলো তো?
ও বলল, এক কাজ করি, কবর দিয়ে দিই।
প্রস্তাবটা পছন্দ হলো আমার। আমাদের বাড়ির পেছনে একটা কবর খুঁড়লাম দুজনে মিলে। তারপর মরা র্যাকুনটাকে তুলে এনে কবর দিলাম। রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে গায়ে। অনেকক্ষণ আগে মরেছে, শক্ত হয়ে গেছে লাশ। কেমন। ঘিনঘিন করতে লাগল। ভালমত মাটি চাপা দিয়ে হাত ধুয়ে এলাম। ফিরে এসে দেখি, ডাল দিয়ে একটা ক্রুশ বানিয়ে কবরে পুঁতে দিয়েছে নিনা।
জিজ্ঞেস করলাম, এটা কেন? ব্যাকুনটা কি খ্রীষ্টান ছিল নাকি?
না সেজন্যে নয়, দিলাম অন্য কারণে। অনেক সময় ভূতে মারা প্রাণীও ভূত হয়ে যায়। কবর থেকে উঠে এটাও যাতে ভূত হতে না পারে সেজন্যে ক্রুশ গেঁথে দিলাম। এই বাধা ডিঙিয়ে যত চেষ্টাই করুক, আর ওঠার সাধ্য হবে না।
কোন মন্তব্য করলাম না। বিকেল প্রায় শেষ। আলো কমে আসছে। শৈলশিরার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, প্রহরী কি ওপরেই থাকে সব সময়? কখনও নিচে নামে না?।
এতদিন তো, তাই জানতাম।
তাহলে কিসে মারল র্যাকুনটাকে?
বুঝতে পারছি না, মাথা নাড়তে নাড়তে জবাব দিল নিনা, সত্যিই আমি কিছু বুঝতে পারছি না, রবিন! সব সময় মৃত্যুপুরীর কাছাকাছি থাকে ওটা। দূরে যায় না। লোকালয়ে মানুষের ঘরের কাছে যেতে কেউ কখনও দেখেনি ওটাকে। আমাদের বাড়িটার দিকে ফিরে তাকাল সে। সেলারের দিকে তাকাল। আমার প্রশ্ন, এখন কেন নামল? আর তোমাদের বাড়িতেই বা কেন? সানগ্লাস খুলে নিয়ে ওটার একটা উঁটি কামড়াতে লাগল। গভীরভাবে চিন্তা করছে বোঝা যায়।
জানার একটাই উপায়, নিনা।
কি?
পাহাড়ের মাথায় উঠে দেখতে হবে।
আরেকটু হলে হাত থেকে চশমাটা ফেলে দিয়েছিল নিনা। মাথা খারাপ! কবরের প্রহরী মৃত্যুপুরীতে যাবে!
না গেলে জানব কি করে?
জানার দরকারটা কি?
এত কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারছি না। তা ছাড়া এর একটা বিহিত করা দরকার। এতদিন লোকালয়ে আসত না। এখন আসতে আরম্ভ করেছে। কাল। ব্যাকুন মেরেছে, আজ কিংবা দুদিন পর যে মানুষ মারবে না তার নিশ্চয়তা কি?
মারলে কি করার আছে?
ঠেকাতে হবে ওটাকে।
পারলে তুমি ঠেকাওগে। আমি এর মধ্যে নেই।
ঘটনাটা কি, নিনা? এত ভীতু তো মনে হয় না তোমাকে?
আমি জানি খোঁচাটা লাগবে ওর। মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। আমি ভীতু, না?
নইলে কি?
আমি ভীতু?
যেতে যখন চাও না, ভীতুই তো। তবে তুমি যাই বলো আর না বলো, আমি ওপরে যাবই। ওই মৃত্যুপুরী না দেখে আমার শান্তি নেই।
নিনার চোখ দুটো দ্বিগুণ হয়ে গেল। কারও ঢোকার সাধ্য নেই ওখানে। সব সময় পাহারা দেয় কুকুরটা। যদি ঢোকো, কোনদিন আর বেরোতে পারবে না।
আমি যাব, গোঁয়ারের মত বললাম। মরার সময় হলেই কেবল ওখানে ঢুকত ইনডিয়ানরা, সেজন্যে আর বেরোত না। সুস্থ অবস্থায় কেউ নিশ্চয় ঢুকে দেখেনি বেরোতে পারে কিনা?
কিছু বলার জন্যে মুখ খুলেও বলল না নিনা।
আমি আজই যাব, জেদ চেপে গেছে আমার তখন, অন্ধকার হওয়ার আগেই। তুমি যাবে।
না বলার জন্যে মাথা নাড়তে গিয়েও থেমে গেল সে। সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি পরে ফেলে বলল, যাব।
তোমার সাহস আছে। হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে।
সাহস না, যা করছি আমরা, এটা স্রেফ পাগলামি! কপালে খারাপি আছে আজ আমাদের!
সে দেখা যাবে।
শৈলশিরায় উঠে এলাম আমরা। আগে আগে পথ দেখিয়ে চলল নিনা। এখানকার প্রতিটি রাস্তা, গলিঘুপচি ওর চেনা। পায়ে চলা সরু পথগুলো ঢেকে আছে ঝরা পাতায়। দুপাশে কোথাও গাছপালা, ঝোঁপঝাড়, কোথাও একেবারে খালি। শুধু বড় বড় ঘাস। নিনা সঙ্গে এসেছে বলে মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। ও না এলে পথ খুঁজে বের করাই মুশকিল হয়ে যেত।
তবে ভয় যে পাচ্ছে ও, স্পষ্ট বুঝতে পারছি। সে একা নয়, আমিও পাচ্ছি। বিকেল শেষ হয়ে এলেও পাহাড়ের ওপরে তখনও রোদ আছে, বেশ আলো। কিন্তু দিগন্তে যে মেঘ জমেছে সেটা লক্ষ করিনি। যখন করলাম, দেরি হয়ে গেছে তখন। ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিল সূর্যকে। ধূসর করে দিল আকাশের রঙ। বার বার আকাশের দিকে তাকাতে লাগলাম। বোধহয় সেজন্যেই রাস্তার দিকে ভাল করে নজর দিতে পারিনি। একটা মোড় নিয়ে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল নিনা। এখান থেকে সোজা পাহাড়ের মাথায় উঠে গেছে রাস্তাটা। মুহূর্তে অনুমান করে নিলাম এই পথের। মাথায়ই কুকুরটাকে দেখেছিল ও।
যেতে চাও, এখনও বলো? জিজ্ঞেস করল নিনা!
দ্বিধায় পড়ে গেলাম। এত তাড়াতাড়ি যে মেঘে ঢেকে অন্ধকার হয়ে যাবে ভাবিনি।
কি বলো, ফিরে যাব? আবার প্রশ্ন করল নিনা।
না, মনে সাহস এনে বললাম, এতদূর এসে ফিরে যাব না। এতক্ষণেও তো কিছু ঘটল না।
বোকার মত কথা বলে ফেলেছি সেটা আমিও বুঝলাম, নিনাও বুঝল, কিন্তু কিছু বলল না। মৃতের গুহার কাছেই যাইনি তখনও, ঘটবে কি? তবু কথাটা বললাম নিজের মনে সাহস রাখার জন্যে।
পথ বেয়ে উঠতে থাকলাম আমরা। শেষ মাথায় পৌঁছে থামলাম। আরেকটা পথ পাওয়া গেল। সেটা ধরে আরও ওপরে উঠতে লাগলাম। কিছুদূর ওঠার পর বড় বড় কতগুলো পাথরের পাশ কেটে কখনও মোচড় দিয়ে কখনও বা মোড় নিয়ে এগিয়েছে পথটা। পাহাড়ের মাথার কাছে পৌঁছে গেছি আমরা ফিরে তাকিয়ে দেখি অনেক নিচে হারলে ক্রীকের নীল জল। বাকি সব কিছু গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়েছে।
আরও ওপরে উঠতে থাকলাম। পথ ক্রমে সরু হয়ে আসছে। বড় বড় কতগুলো গাছের ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষ হলো এই পথটাও। সামনে বেশ বড় একটা আয়তাকার জায়গায় ঘাস জন্মে আছে। তিনপাশ ঘিরে আছে ঘন ঝোঁপঝাড়, গাছপালা; আর বাকি একপাশে পাহাড়ের দেয়াল, খাড়া হয়ে উঠে গেছে ওই পথটা ছাড়া আর কোনদিক দিয়ে জায়গাটাতে ঢোকার উপায় নেই। ঠিক মাঝখানে জন্মে আছে বিশাল এক ওক। গাছটা এতই বড়, পুরো জায়গাটাতে তার ছায়া পড়ে।
নিনা বলল, আয়তাকার জায়গাটাই ইনডিয়ানদের কবরস্থান গাছের পেছনে একটা গুহামুখ দেখা গেল। সেটা মৃত্যুপুরীতে ঢোকার পথ। পাহাড়টা দেখেই অনুমান করা যায়, সুড়ঙ্গটা অনেক গম্ভীর হবে।