০৯.
কফি খাওয়া শেষ হলে লম্বা একটা টেবিলের কাছে মুসাকে নিয়ে এল ক্রিসি। বলল, কাপড় খুলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো।
খাইছে! কাপড় খুলব?
হাসল ক্রিসি, কেন, লজ্জা লাগছে? আরে সব খুলতে হবে না। শুধু শাট আর গেঞ্জিটা খোলো। ঘাড়ের কাছটা ডলতে হবে না?
হাঁপ ছাড়ল মুসা, তাই বলুন। আমি তো ভাবলাম…
পাশের ঘরে চলে গেল ক্রিসি। একটা তোয়ালে আর দুটো শিশি নিয়ে ফিরে এল। একটা শিশিতে বড়ি, আরেকটাতে মালিশ। তোয়ালেটা একটা চেয়ারের হেলানে রেখে জিজ্ঞেস করল, রেডি?
হ্যাঁ
উপুড় হয়ে টেবিলে শুয়ে পড়তে গেল মুসা।
দাঁড়াও, শিশি খুলে দুটো বড়ি বের করল ক্রিসি। এদুটো আগে খেয়ে নাও।
পেইন কিলার?
রোগীর অত কথা জানার দরকার নেই, রহস্যময় কণ্ঠে বলে চোখ মটকে হাসল ক্রিসি। যা করতে বলছি করো।
পানি দিয়ে বড়ি দুটো গিলে টেবিলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল মুসা।
ডান হাতের তালুতে তেল নিয়ে ডলে ডলে দুই হাতেই মিশিয়ে নিল। ক্রিসি। আস্তে করে হাত দুটো রাখল মুসার পিঠে। শিউরে উঠল মুসা। তেলের কারণে নাকি হাতের স্পর্শে, বুঝতে পারল না। তবে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
ডলতে শুরু করল ক্রিসি। আস্তে আস্তে চাপ বাড়াচ্ছে।
কেমন লাগছে?
ভাল, অস্বস্তি বোধটা চলে যাচ্ছে মুসার।
তোমার মনে কোন দুশ্চিন্তা আছে, যেন কথার ছলে কথাটা বলল ক্রিসি। প্রশ্ন নয়।
উহু
স্বীকার না করলে কি হবে? আমি জানি, আছে।…পিঠ অত শক্ত কোরো না। আরও ঢিল করো।-হ্যাঁ, এখন বলো তো দেখি তোমার সমস্যাটা কি?
চুপ করে রইল মুসা। এক ধরনের ঘোর লাগছে মাথার মধ্যে। ঝিমুনি ঝিমুনি ভাব। স্বপ্নের জগতে চলে যাচ্ছে যেন সে। সত্যি, ম্যাসাজ করতে জানে বটে ক্রিসি। এত আরাম লাগছে! যেন জাদু করে ব্যথাটা কমিয়ে দিচ্ছে।
ঘুমে জড়িয়ে এল তার চোখ।
ঘুমিয়ে পড়ল..
*
বারান্দা দিয়ে হেঁটে চলল মুসা। পাশে একটা দরজা দেখে থামল। দরজা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে একটা বেডরূম। বিছানায় শুয়ে নিশ্চিন্তে নাক ডাকাচ্ছে ওর বন্ধু ড্যানি।
ড্যানি? আস্তে করে ডাকল মুসা। শুনছ? ওঠো। উঠে পড়ো।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ল ড্যানি। হাই তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল, কে?
আমি, ড্যানি। মুসা।
ওর কথা যেন শুনতেই পায়নি ড্যানি। দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলা, কেরিআন্টি, দাঁড়াও, আসছি।
আন্ডারওয়্যার পরা অবস্থায়ই তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে গেল সে। মুসার পাশ দিয়েই গেল অথচ ফিরেও তাকাল না ওর দিকে।
কি হলো? দেখল না কেন ওকে? ড্যানি কি অন্ধ হয়ে গেছে? না সে নিজেই ভূত হয়ে গেছে–মানুষের চোখে অদৃশ্য?
দরজায় দাঁড়িয়ে বারান্দায় উঁকি দিল ড্যানি।
একটা শব্দ কানে আসছে মুসার। নিচতলা থেকে।
আবার খালার নাম ধরে ডাকতে লাগল ড্যানি। তারপর ছুটে বেরিয়ে গেল।
নিচে কিসের শব্দ দেখার জন্যে তার পেছন পেছন দৌড় দিল মুসা। চিৎকার করে সাবধান করল ড্যানিকে, ড্যানি, বাইরে যেয়ো না। তত্ত্বাবধায়কটা কোনখান থেকে তাকিয়ে আছে কে জানে!
কিন্তু শুনল না ড্যানি। ওভাবে আন্ডারওয়্যার পরেই নিচতলার সদর দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলে বাইরে তাকাল। গ্যারেজ থেকে মনে হয় শব্দটা আসছে। গাড়ির গায়ে সিরিশ দিয়ে ঘষছে যেন কেউ।
কে ওখানে? চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল ড্যানি।
যেয়ো না, যেয়ো না! বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল মুসা। ওই লোকটা হবে।
শুনল না ড্যানি। কে কে করতে করতে বেরিয়ে চলে গেল। হাত ধরে। টেনে ওকে ভেতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করল মুসা। কিন্তু জোর পেল না। মনে হলো একটা ছায়াকে ধরেছে। খুব সহজেই ওর হাতের মুঠো থেকে পিছলে বেরিয়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা লন ধরে দৌড় দিল ড্যানি।
ড্যানি, আল্লার দোহাই লাগে তোমার, থামো! চিৎকার করে বলল মুসা।
গ্যারেজের ভেতরে ঘষার শব্দ থেমে গেছে। সুইচের জন্যে হাতড়াতে শুরু করল ড্যানি। পাওয়ার পর যখন টিপে দিল তখনও অন্ধকার হয়ে রইল গ্যারেজ। আলো জ্বলল না। দ্রুকুটি করল সে। বড় বড় হয়ে গেল চোখ যখন দেখল তার আন্টির গাড়ির বেশ খানিকটা জায়গার রঙ ঘষে ঘষে তুলে ফেলা। হয়েছে।
তুলুক, তাগাদা দিল মুসা, দেখার দরকার নেই। জলদি চলো এখান থেকে।
গ্যারেজের ভেতরে শব্দ হলো আবার। বোকার মত দুঃসাহস দেখিয়ে বসল ড্যানি। গ্যারেজের ভেতরে যেতে যেতে ডাকল, অ্যাই, কে ওখানে?
ঝপঝপ করে একগাদা তরল পদার্থ এসে পড়ল ওর গায়ে। ভিজে গেল গা। ঝনঝন করে মেঝেতে একটা বালতি পড়ার শব্দ হলো। কি ঘটছে ও কিছু বুঝে ওঠার আগেই খস করে ম্যাচের কাঠি জ্বলে উঠল। গাড়ির হুডের কাছে। দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়ামূর্তি। বিদঘুঁটে গন্ধ ঢুকল মুসার নাকে।
ড্যানি! চিৎকার করে উঠল সে। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করছে, যতই চিৎকার করুক না কেন, গলা দিয়ে স্বর বেরোয় না।
জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি ড্যানির দিকে ছুঁড়ে মারল ছায়ামূর্তি। বুকে লেগে কাঠিটা পড়ল পায়ের কাছে জমে থাকা ট্রেলে। দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। একটা সেকেন্ড বোকা হয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল ড্যানি। পরক্ষণে জীবন্ত এক মানব-মশালে পরিণত হলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল কমলা রঙ আগুন। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল পা থেকে মাথায়। অদ্ভুত এক কাকতাড়ুয়া পুতুলের মত নাচানাচি শুরু করল, ড্যানি। ভয়াবহ যন্ত্রণায় অমানুষিক চিৎকার করছে।
ওকে ধরার চেষ্টা করল মুসা। আগুন থেকে বাঁচাতে চাইল। একটা কিছু করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু কিছুই করতে পারল না। কিছু করার নেই। অনেক দেরি হয়ে গেছে। মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল ড্যানি। চামড়া পুড়ে, কুঁচকে, বিকৃত হয়ে যাচ্ছে মুখ। মাঢ়ীসহ দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। ভয়াবহ দৃশ্য। কিন্তু শুধু চিৎকার করা ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না। মুসা। চোখের সামনে প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু ঘটতে দেখেও সহ্য করতে হচ্ছে। চিৎকার-চিৎকার-চিৎকার…
*
চোখ মেলতে ছাতের দিকে নজর গেল মুসার। প্রথমে বুঝতে পারল না কোথায় রয়েছে। কেয়ারও করল না। যেখানে খুশি থাক। দুঃস্বপ্নটা যে কেটেছে এতেই সে খুশি। এত ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন কমই দেখেছে।
পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখল, সোফায় কুকড়ি-মুকড়ি হয়ে ঘুমাচ্ছে ক্রিসি। মুহূর্তে মনে পড়ে গেল ওর কোথায় রয়েছে, বিকেলে কি কি ঘটেছিল, সব।
কিন্তু বিছানায় এল কি করে? ছিল তো টেবিলে। ম্যাসাজে আরাম পেয়ে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তারমানে ক্রিসি ওকে বয়ে এনেছে। জোর তো সাংঘাতিক!
উঠে বসল মুসা। ভীষণ ক্লান্তি লাগছে। ঘুমানোর পর এরকম তো লাগার। কথা নয়! মাথার মধ্যে ঘোরটা এখনও কাটেনি। গাটাও গোলাচ্ছে ও। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একে শরীর অসুস্থ, তার ওপর গত কিছুদিন ধরে যে পরিমাণ উত্তেজনা আর মানসিক চাপ যাচ্ছে, এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ঘাড়ের ব্যথাটা কমেছে। বাড়ি যাওয়ার তাগিদ অনুভব করল সে। নিজের বিছানায় ছাড়া ঘুমিয়ে শান্তি নেই।
দুঃস্বপ্নটা চেপে আছে এখনও মনে। ড্যানির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা এতই বাস্তব লেগেছিল, ভুলতে পারছে না। এত জায়গা থাকতে কেন কেরিআন্টির বাড়িতে ওকে দেখল, তারও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। ড্যানির ওখানে যাওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। যদিও কাউকে বলে যায়নি। কিন্তু অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
কেরিআন্টি থাকেন সান্তা বারবারায়।
বিছানা থেকে নেমে একটা ভোয়ালে টেনে নিয়ে বাথরূমে রওনা হলো মুসা। ম্যাসাজ টেবিলটার পাশ কাটানোর সময় ফোনের ওপর নজর পড়তেই থমকে দাঁড়াল। একটা ফোন করলে কেমন হয়? দূর! কি ভাবছে! স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় নাকি?
কিন্তু ইচ্ছেটা তাড়াতে পারল না মন থেকে। শেষে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে তুলে নিলে রিসিভার। ক্রিসির দিকে তাকাল। তেমনি ঘুমাচ্ছে। নম্বর টিপল। ওপাশে রিঙ হচ্ছে। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে মুসা।
ফোনটা ড্যানিই ধরল। কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তাতে অস্বস্তি বোধ করল না মুসা। দুঃখ নেই মোটেও। বরং স্বস্তি। একটা বিরাট বোঝা নেমে গেল মন থেকে। স্বপ্নটা মিথ্যে। ড্যানি বেঁচে আছে।
কি ব্যাপার? জানতে চাইল ড্যানি।
তুমি ভাল আছ নাকি শিওর হয়ে নিলাম।
হাই তুলল ড্যানি। ভালই আছি। এখানে এসেছি তুমি জানলে কি করে?
অনুমান, স্বপ্নের কথাটা চেপে গেল মূসা। সরি, তোমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম। যাও, শুয়ে পড়োগে। কেরিআন্টি কোথায়?
বেড়াতে গেছে।
আচ্ছা, রাখি। দুদিন পর যোগাযোগ করব।
ওখানে সব ঠিক আছে?
আছে। গুড নাইট, ড্যানি।
গুড নাইট।
রিসিভার নামিয়ে রাখল মুসা। ফিরে তাকাতে দেখে সোফায় সোজা হয়ে বসে আছে ক্রিসি। চোখে চোখ পড়তে হাসল। কোথায় ফোন করলে?
সান্তা বারবারায়। আমার এক বন্ধুকে।
অ। কেমন লাগছে এখন?
ব্যথাটা কমেছে।
আবার হাসল ক্রিসি। কমতেই হবে। বলেছিলাম না, আমার ম্যাসাজে জাদু আছে? … যাচ্ছ কোথায়?
বাথরূমে। বাড়ি যাব। ঘুমাতে হবে।
কেন, এখানে অসুবিধে কি?
আমার কোন অসুবিধে নেই। অসুবিধেটা আপনার। বিছানা আমি দখল করে রাখলে সোফায়ই থাকতে হবে আপনাকে…
তাতে কি? আমার অসুবিধে হচ্ছে না।
কিন্তু আমার হবে। অস্বস্তিতে ঘুমাতে পারব না আমি। শরীরটাও যে রকম খারাপ লাগছে, না ঘুমালে মারা পড়ব।
বাথরূমের দিকে এগোল মুসা।
.
১০.
পরদিন রবিবার। সকালবেলা রবিনকে ফোন করল কিশোর। খবর আছে। ডেভন ব্রেকের দোকানের নতুন মালিক ওরই চাচা উইনার ব্রেক। মিসেস ব্রেকের কাছ থেকে কিনে নিয়েছে দোকানটা। লোকটা কোন সহযোগিতা। করতে রাজি হয়নি। এমনকি ব্রেকের বাড়ির ফোন নম্বরটাও দিতে চায়নি।
রবিনকে মাথা ঠাণ্ডা রাখার পরামর্শ দিল কিশোর। গোস্ট লেনে এখন ঘনঘন যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। বহুদিন পর বাড়ি ফিরেছে। ইয়ার্ডে কাজ জমে গেছে অনেক। তা ছাড়া আরও কাজ আছে।
সারাটা দিন মুসার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল রবিন। কিন্তু পেল না। ওকে। কোথায় যে গেছে, কেউ বলতে পারল না।
সোমবারেও মুসার খবর নেই।
এমনকি সোফির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানেও যোগ দিতে এল না।
ব্ল্যাক ফরেস্ট গোরস্থানের গির্জার সামনে রাখা হলো কফিন। আত্মীয় স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা এল শোকের কালো পোশাক পরে। মারলার পাশে দাঁড়ানো রবিন। চুপচাপ তাকিয়ে আছে কয়েক গজ দূরের কফিনটার দিকে। সোফি যে মারা গেছে, মাথাটা আলাদা, ধড়ের সঙ্গে জোড়া লাগিয়ে সেলাই। করে দিয়েছে হাসপাতালের ডাক্তার, এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না। একঘেয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে মৃত্যুর ওপারের সেই সবুজ তৃণভূমি আর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া টলটলে পানির নহরের বর্ণনা করে চললেন পাদ্রী। রূপকথার মত লাগছে রবিনের কাছে।
অনুষ্ঠান শেষ হতে বহু সময় লাগল। সোফিকে কবর দেয়ার পর তার মা বাবার কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে নানা কথা বলতে লাগল রবিন। কোন সাহায্য লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করল। নিজের কানেই বড় ফাপা শোনাল কথাগুলো। কি সাহায্য করবে সে? তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? সোফি ছিল তাদের একমাত্র মেয়ে।
সবাই যার যার বাড়ি ফিরে গেল। রবিনের ফিরতে ইচ্ছে করল না। একা বাড়িতে মন টিকবে না। মুসাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ইয়ার্ডে গিয়ে কিশোরের সঙ্গেও আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো সম্ভব নয়। ও বলে দিয়েছে ব্যস্ত থাকবে।
গাড়ি নিয়ে পাহাড়ের কাছে চলে এল সে। পাহাড়ে চড়তে ভাল লাগে। ওর। কিন্তু আজ লাগল না। চুড়ায় খানিকক্ষণ বসে থেকে আবার নেমে এল নিচের উপত্যকায়। লেকের পাড়ে বসে রইল, ঘোরাঘুরি করল, লেকের শান্ত পানিতে ঢিল ছুঁড়ল। অন্যমনস্ক। সারাক্ষণ মন জুড়ে রইল সোফির মৃত্যু, রহস্যময় তত্ত্বাবধায়কের চিঠি, মুসার জন্যে দুর্ভাবনা।
সারাটা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরল সে। বাবা-মা ফেরেননি। কি করবে? মুসাকে ফোন করল আবার। পাওয়া গেল না। একটা বই নিয়ে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে আধশোয়া হলো বিছানায়। কিছুতেই মন বসাতে পারল না। ড্যানির চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে এখন মুসাকে নিয়ে। ড্যানি কাউকে কিছু না। বলে পালিয়েছে, বাঁচার জন্যে। মুসাও কি তাই করল?
সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, বলতে পারবে না। টেলিফোনের শব্দটা যেন ঘুমের মধ্যেও কানে বোমা ফাটাল তার।
চোখ মেলতেই নজর পড়ল ঘড়ির দিকে। বারোটার বেশি। কেঁপে উঠল বুক। কে করল? কোন দুঃসংবাদ ছাড়া এত রাতে কেন ফোন করবে?
কাঁপা হাতে রিসিভার তুলে নিয়ে কানে ঠেকাল। হালো?
রবিন? কাঁদো কাদো স্বরে মারলা বলল। ড্যানি…
কি হয়েছে ড্যানির?
ও নেই…
ইমপসিবল!
ফোঁপাতে লাগল মারলা। সান্তা বারবারায় ওর খালার বাড়িতে চলে গিয়েছিল। এইমাত্র ফোন করে জানাল আমাকে মুসা। ও বাড়ি ফিরে এসেছে।তত্ত্বাবধায়ক ঠিকই খুঁজে বের করেছে ড্যানিকে। গায়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। …উফ, কি ভয়ঙ্কর!… রবিন, এবার আমার। পালা…
মুসা ছিল কোথায় এতদিন, কিছু বলেছে?
জিজ্ঞেস করিনি। করতে মনে ছিল না। ড্যানির কথা শুনেই…
আমি আসব তোমার ওখানে?
না না! হঠাৎ, যেন বহু দূরাগত মনে হলো মারলার কণ্ঠ। কেউ আর, এখন আমার কাছে এসো না। আমার কাছ থেকে দূরে থাকো। আমি জানি। যে-কোন সময় একটা চিঠি এসে হাজির হবে আমার নামে!
কিন্তু মীটিং হওয়া দরকার আমাদের। আলোচনা করতে হবে। পুলিশকে খবর দিতে হবে। আর বসে থাকা যায় না।…অ্যাই, মারলা, আমার। কথা শুনছ?
লাইন কেটে দিয়েছে মারলা। ওকে আর ফোন করে লাভ নেই। ধরবে না।
কিশোরকে ফোন করল রবিন। ঘুম থেকে টেনে তুলল। সব কথা জানাল।
দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর কিশোর বলল, এখন লাইনে। আছে মারলা। তারপর ক্লডিয়া। সবশেষে মুসা। কাল সকালের, ডাকেই একটা চিঠি পাবে মারলা, কোন সন্দেহ নেই তাতে। এই তত্ত্বাবধায়ক লোকটা মিথ্যে হুমকি দেয়নি। কাল অবশ্যই একটা মীটিং ডাকা উচিত তোমাদের। যাদের যাদের নাম আছে।
আমিও সেকথাই ভাবছি। সকালে?।
সকালে না, বিকেলে করো। আমিও আসতে পারব। সকালে কাজ আছে।
মারলা আর ক্লডিয়া মীটিঙে বসলে হয়। মারলা তো এখনই আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল না। খবরটা দিয়েই লাইন কেটে দিয়েছে। ওর কাছ থেকে দূরে থাকতে বলেছে। কি করব বুঝতে পারছি না।
আলোচনায় বসতেই হবে। জায়গা ঠিক করো। বিকেলে হলে আমিও থাকব।
কি বোঝাবে ওদের? পুলিশের কাছে যেতে বলবে তো?
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কিশোর বলল, দেখি, কি করা যায়।
সকালে কি কাজ তোমার?
ডেভনের দোকানে যাব। তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু উল্টো রাস্তা হয়ে যায়। বাসে করে চলে যেতে পারব। তোমার আসার দরকার, নেই। বরং বাড়িতে থেকে রেস্ট নাও। টাইমসের অফিসেও যাব একবার। বিজ্ঞাপনটা কে দেয় খুঁজে বের করার চেষ্টা করব।
পারবে?
দেখা যাক। রাখি এখন। অত চিন্তা কোরো না। ঘুম না এলে বরং একটা ঘুমের বড়ি খেয়ে নাও। সকালে উঠে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আলোচনায় বসার ব্যবস্থা করে রাখবে। সময় আর জায়গা ঠিক করে আমার অ্যানসারিং মেশিনে জানিয়ে রেখো। বাড়ি এসেই যাতে পেয়ে যাই।
আচ্ছা।
আর, রবিন…
বলো?
শয়তানটাকে ঠেকাতেই হবে আমাদের। আবার কারও ক্ষতি করার আগেই।
কিন্তু খুঁজে বের করব কিভাবে ওকে?
করব। যেভাবেই হোক। ছাড়ব না।
অত শিওর হচ্ছ কি করে?
অপরাধ করতে করতে এক না এক সময় ভুল করেই ফেলে অপরাধী। অপরাধ বিজ্ঞান তা-ই বলে। তত্ত্বাবধায়কের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হবে না। ঠিক আছে, রাখলাম। কাল দেখা হবে।
আচ্ছা।
লাইন কেটে দিল রবিন। এরপর ফোন করল মুসাদের বাড়ির নম্বরে।
.
১১.
পরদিন ব্ল্যাক ফরেস্ট পার্কে আবার মিলিত হলো ওরা। মারলা, ক্লডিয়া, রবিন আর মুসা। আজ দলের দুজন কম। সোফিও নেই, ড্যানিও নেই।
কেউ যেন কারও দিকে তাকাতে পারছে না। মুখ নিচু করে গম্ভীর হয়ে আছে।
সকালের ডাকে ঠিকই একটা চিঠি পেয়েছে মারলা। নামের স্তম্ভে ড্যানির নামটা নেই। সবার ওপরে এখন মারলার নাম। টাইমস পত্রিকায় পার্সোন্যাল সেকশনে একটা সাঙ্কেতিক বিজ্ঞাপন। মানে করলে হয়:
তোমার ডান হাতের তর্জনী কেটে কাটা আঙুল সহ চিঠিটা ক্লডিয়ার কাছে পাঠিয়ে দাও
কথা বলতে যাচ্ছিল ক্লডিয়া, কিন্তু ওকে থামিয়ে দিল রবিন। কিশোরের জন্যে অপেক্ষা করছে। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগেই ফোন করে কিশোরের অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ দিয়ে রেখেছে।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ঘাসে ঢাকা পাহাড়ের উপত্যকা ধরে লম্বা লম্বা পায়ে হেঁটে এল সে।
ফিরে তাকাল সবাই।
গাছের গোড়ায় হেলান দিয়ে বসেছে মুসা। তার কাছে এসে সবার মুখোমুখি বসল কিশোর।
কথা শুরু করল রবিন, একটা কথা এখনও জানানো হয়নি তোমাদের। ওই লোকটা কে, জেনে ফেলেছে কিশোর।
কোন লোকটা? নেহাত সাদামাঠা স্বরে জানতে চাইল ক্লডিয়া।
সেই লোকটা। মরুভূমিতে যাকে খুন করেছি আমরা।
মুহূর্তে সতর্ক হয়ে উঠল সবাই। একটা ঘাসের ডগা চিবুচ্ছিল মুসা। তাড়াতাড়ি ফেলে দিয়ে বলল, খাইছে! বলো কি? কে?
ডেভন ব্রেক।
কে সে?
সান্তা বারবারার এক দোকানদার।
অ, কোন উৎসাহ পেল না ক্লডিয়া। এ কথা এখন জেনেই কি আর না জেনেই বা কি। লোকটা তো এখন মৃত। আমরা ওকে খুন করেছি। কিশোর, তোমার জন্যে আলোচনা আটকে দিয়ে বসে আছে রবিন। কি নাকি বলবে তুমি আমাদের?
হ্যাঁ, বলব, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তোমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে এমন কিছু পয়েন্ট আমি উল্লেখ করতে চাই। তবে তার আগে একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো। ড্যানি কোথায় গিয়েছিল এ কথাটা তোমাদের মধ্যে কে জানতে?
কেউ না, মারলা জবাব দিল। কাউকে না জানিয়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্যটাই ছিল জেনে গিয়ে মুখ ফসকে কাউকে যাতে বলে না দিতে পারি আমরা, কোনমতেই তত্ত্বাবধায়কের কানে না যায়।
তা তাহলে তত্ত্বাবধায়ক কি করে জানল ও কোথায় গেছে? কিশোরের। প্রশ্ন।
কেউ জবাব দিতে পারল না।
এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল কিশোর। কেউ একজন নিশ্চয় জানো তোমরা। কে? মুসার দিকে তাকাল সে। মুসা, তুমি? তোমার সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল ড্যানির। বলে গেছে?
কিশোর ছাড়া অন্য সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠল মুসা, ও যে। ওর আন্টির বাড়ি গিয়েছিল, এ কথা জানতাম আমি।
কি করে? প্রায় চিৎকার করে উঠল রবিন।
চুপ করে রইল মুসা।
জবাব দিচ্ছ না কেন? ভুরু নাচাল মারলা। কি করে জানলে?
আমি ওকে ওখানে ফোন করেছিলাম। দেখলাম আছে নাকি। মানে, ভাল আছে নাকি।
কিন্তু জানলে কি করে ওখানে আছে?
মুখ নিচু করল মুসা। হাতের তালু দেখতে দেখতে জবাব দিল, জানি না।
দেখো, তুমি কিছু লুকাচ্ছ আমাদের কাছে। কঠোর হয়ে উঠল ক্লডিয়ার কণ্ঠ। দুদিন ধরে নাকি তোমার কোন পাত্তা নেই। রবিন বহুবার ফোন করেছে বাড়িতে, তোমাকে পায়নি। কোন বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতেও যাওনি। কোথায় ছিলে?
দ্বিধা করতে লাগল মুসা।
কোথায় ছিলে? আবার জিজ্ঞেস করল মারলা।
একটা মেয়ের বাড়িতে, অবশেষে জানাল মুসা।
তাজ্জব হয়ে গেল সবাই। মুসা আমান মেয়ের বাড়িতে থেকেছে।
কোন মেয়ে?
কে সে?
কি নাম?
কোথায় থাকে?
তোমরা চিনবে না, যেন মস্ত কোন অপরাধ করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে জবাব দিল মুসা। নতুন পরিচয় হয়েছে।
কি নাম ওর? জানতে চাইল রবিন।
ক্রিসি। ক্রিসি ট্রেভার। আমাদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হবে।
ওখানে কেন গিয়েছিলে?
ম্যাসাজ করাতে। সেদিন গুডলাক ফাউনটেইনে বসে বারগার খাচ্ছিলাম। মেয়েটাও খাচ্ছিল। আমাকে পানিতে পয়সা ছুঁড়ে মারতে দেখে প্রশংসা শুরু করল। এভাবেই আলাপ। কথায় কথায় জানাল সে হাসপাতালে কাজ করে। আমিও একসময় বললাম আমার ঘাড়ের ব্যথার কথা। সে তখন বলল, খুব ভাল ম্যাসাজ করতে পারে সে। আমার ব্যথাটা কমিয়ে দিতে পারবে। ঠিকানা দিল, সময় করে যাওয়ার জন্যে। পরশুদিন স্কুলের মাঠে। দৌড়াদৌড়ি করে ব্যথাটা বাড়ালাম। ক্রিসির কথা মনে পড়ল। চলে গেলাম। ওর কাছে। খুকখুক করে কাশল মুসা। সত্যি, ভাল ম্যাসাজ করে ও। ব্যথাটা কমিয়ে দিয়েছে। সেদিন রাতেই চলে আসতে চেয়েছিলাম। আসতে দিল না। জোর করে ধরে রাখল। বলল, ওর ম্যাসাজ শেষ হয়নি। রোগীকে পূর্ণ সুস্থ না করে বাড়ি পাঠানো উচিত না। কি আর করব! কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, জোরাজুরি করেও লাভ হলো না। আসতে দিল না তো দিলই না। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুম আসে না বলাতে ঘুমের বড়ি খাইয়ে দিল।
কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল মারলা, ড্যানি যে আন্টির বাড়ি গেছে একথা জানলে কি করে তুমি, এখনও বলোনি কিন্তু।
কি বলব? হতাশ ভঙ্গিতে দুই হাত ওল্টাল মুসা।
কি করে জানলে?
অত দ্বিধা করছ কেন? মারলার সঙ্গে সুর মেললি রবিন।
বলতে তো পারি। কিন্তু বললে তোমরা বিশ্বাস করবে না।
কেন? না করার কি হলো? ব্যাপারটা কি বলো তো?
ভূত বিশ্বাস করি বলে তো সবাই হাসাহাসি করো আমাকে নিয়ে…
তারমানে বলতে চাও ভূতে খবরটা দিয়েছে? তীক্ষ্ণ হয়ে গেল মারলার কণ্ঠ।
মাথা নাড়ল মুসা, কে দিয়েছে জানি না। রাতে দুঃস্বপ্ন দেখলাম। দেখি, ড্যানি আন্টির বাড়িতে গেছে। আমিও আছি সেখানে। রাতে গ্যারেজে একটা শব্দ শুনে দেখতে চলল সে। চিৎকার করে অনেক মানা করলাম। শুনল না। গ্যারেজে ঢুকল। ওখানে অপেক্ষা করছিল লোকটা। একটা ছায়ামূর্তি। বালতিতে করে ড্যানির গায়ে পেট্রল ছুঁড়ে দিয়ে ম্যাচের কাঠি জ্বেলে ছুঁড়ে মারল…উফ, এতই বাস্তব! এখনও দেখতে পাচ্ছি।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর ক্লডিয়া বলল, আশ্চর্য! স্বপ্ন যে মাঝে মাঝে সত্যি হয় এটাই তার প্রমাণ।…যদিও আমি বিশ্বাস করি নাঃ লোকটার চেহারা দেখেছ?
মাথা নাড়ল মুসা, না। অন্ধকারে লুকিয়ে ছিল। ড্যানির গাড়ির রঙ তুলে ফেলেছিল সিরিশ দিয়ে ঘষে। ঘষার শব্দ করে কৌতূহল জাগিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ড্যানিকে:
আবার নীরবতা। কাশি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল কিশোর। যা ঘটার তো ঘটে গেছে, এখন আসল কথায় আসা যাক। যে কারণে আজকের এই মীটিং। আমার একটা পরামর্শ আছে। তোমাদের বাঁচার এখন সবচেয়ে সহজ উপায় হলো পুলিশের কাছে গিয়ে সব জানিয়ে দেয়া।
হু, ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে ভরুক, ঝাঝাল কণ্ঠে বলল মারলা। তাহলে এতদিন গোপন রেখে লাভটা হলো কি?
কোন লাভই হয়নি। ক্ষতি হয়েছে বরং অনেক। জেলে ঢোকাটাই এখন তোমাদের জন্যে সবচেয়ে নিরাপদ। মরার চেয়ে জেলে যাওয়া ভাল।
কাঁপা গলায় মারলা বলল, কিন্তু এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যাটা ওখানেও আমাদের ছাড়বে না। ড্যানি কোথায় আছে তার জানার কথা নয়। মুসা। তাকে বলেনি। আর আমরা তো কেউ জানতামই না। কাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সবজান্তা। অলৌকিক ক্ষমতা আছে ওর। দূর থেকে যেন অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে সোফির অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাল, ড্যানি কোথায় আছে। জেনে নিয়ে পুড়িয়ে মারল…জেলের বদ্ধ জায়গায় আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে যাব। বেরোতেও পারব না…
বাধা দিয়ে বলল কিশোর, মুক্ত থেকেই বা কি লাভ হলো ড্যানির? জেলেই বরং তোমরা নিরাপদ। ওখানে অন্তত পুলিশ থাকবে তোমাদের পাহারা দেয়ার জন্যে। তত্ত্বাবধায়কের সাধ্য হবে না ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে জেলের মধ্যে ঢোকে:
যদি ভূত-প্রেত কিছু না হয়, বিড়বিড় করল মুসা।
ভূতফুত কিছু না। ও জলজ্যান্ত মানুষ। মারলার সর্বনাশ করার আগেই ওকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।
কোথায় আছে কি করে জানব? জিজ্ঞেস করল রবিন।
তাকে খুঁজতেই বেরিয়েছিলাম আজ সকালে।
কোন খোঁজ পেলে?
পত্রিকার অফিস থেকে কিছু বের করতে পারিনি। যারা বিজ্ঞাপন দিতে। আসে তাদের নামধাম পরিচয় গোপন রাখে ওরা। পুলিশ গিয়ে চাপাচাপি করলে অবশ্য না বলে পারবে না। তবে তার আগে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।
মানে, পুলিশকে সবকথা জানানোর আগে?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ। দেখি আরেকটু সময় নিয়ে, আর কিছু বের করতে পারি কিনা।
তত্ত্বাবধায়ক ধরা পড়লে খুন হওয়ার আর ভয় থাকবে না আমাদের, এটা ঠিক। মুখ বাকাল ক্লডিয়া। কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট করে মানুষ খুনের দায় থেকে রেহাই পাব না কোনমতে।
সেটা পরের কথা, পরে দেখা যাবে। এখনকার বিপদ থেকে আগে বাঁচা দরকার।
ব্রেকের দোকানে গিয়ে কি জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
ডেভনের চাচার সঙ্গে কথা বলেছি। বিশেষ সাহায্য-সহায়তা করল না। ও নিশ্চয় কিছু জানে। কিন্তু চেপে গেল আমার কাছে। অনেক চাপাচাপি করে ডেভনদের বাড়ির ঠিকানা আদায় করে এনেছি।
ওর মা যেখানে থাকে?
হ্যাঁ
দেখা করেছ?
না। যাব এখন।
আমিও যাব।
চলো।
মীটিং এখানেই শেষ। মারলার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, বাড়ি গিয়ে চুপ করে বসে থাকোগে। আমার ওপর ভরসা রাখো। তোমার একটা চুলও ছিঁড়তে পারবে না তত্ত্বাবধায়ক
গাড়ির হর্ন শোনা গেল।
ঘনঘন হর্নের শব্দে ফিরে তাকাল সবাই। সোনালি চুল একটা মেয়ে হাত নেড়ে মুসাকে ডাকছে।
ও-ই ক্রিসি, উঠে দাঁড়াল মুসা। কি জন্যে এল আবার… পা বাড়াল ও গাড়ির দিকে।
.
১২.
সান্তা মনিকায় ছোট একটা লাল ইটের বাড়িতে থাকেন মিসেস ব্রেক। কিন্তু পাওয়া গেল না তাকে। বার বার দরজার ঘণ্টা বাজিয়েও সাড়া মিলল না। বাড়ি নেই। তারমানে দেখা করতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।
বাড়িটার আশেপাশে খানিকক্ষণ ঘুরঘুর করল কিশোর আর রবিন। লোকে কিছু বলে না, তবে সন্দেহের চোখে তাকায়।
এ ভাবে ঘোরাঘুরি না করে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসার পরামর্শ দিল রবিন। খাওয়াও যাবে, বসারও ব্যবস্থা হবে।
খাওয়া সারতে ইচ্ছে করে অনেক দেরি করল ওরা। বেরিয়ে এসে আবার মিসেস ব্রেকের দরজার ঘণ্টা বাজাল। এবারেও সাড়া নেই। তারমানে এখনও ফেরেননি।
খাওয়া তো হলো। আর কি করে সময় কাটানো যায়? ভাবতে লাগল। ওরা। কিশোর বলল, চলো, সিনেমা হলে গিয়ে বসে থাকি।
অতএব গেল সেখানেই। একটা সায়ান্স ফিকশন ছবি। ভবিষ্যতের মানুষদের কাহিনী। যারা মানব-জীবনের ওপর বিরক্ত হয়ে গিয়ে রোবট হয়ে যেতে চায়। সীটে বসে ঘুমিয়ে পড়ল রবিন। আগের রাতে ড্যানির মৃত্যুসংবাদ শোনার পর আর ঘুমাতে পারেনি। কিশোর পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল আনমনা হয়ে।
ছবি শেষ হলে রবিনকে ডেকে তুলল সে। রাত দশটা বাজে।
ঘুম খারাপ হয়নি। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে রবিনের।
হল থেকে বেরিয়ে আবার মিসেস ব্রেকের বাড়ি চলল ওরা।
এবার পাওয়া গেল তাঁকে। একবার বেল বাজাতেই খুলে দিলেন। দুজনের ওপর নজর বোলাতে লাগলেন। বলো?
মোটাসোটা, খাটো মহিলা। নার্ভাস ভঙ্গিতে বার বার ডান চোখটা কাঁপে। বয়েসের তুলনায় মাথার চুলে ততটা পাক ধরেনি। ক্লান্ত লাগছে তাকে।
মিসেস ব্রেক? কিশোর জিজ্ঞেস করল।
মহিলা মাথা ঝাঁকাতে পরিচয় দিল সে, আমার নাম কিশোর পাশা। ও আমার বন্ধু, রবিন।
আপনার নিখোঁজ ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি আমরা, বলে ফেলল রবিন।
ঘাবড়ে গেল কিশোর। এখনই এটা বলা উচিত হয়নি রবিনের। যদি মানা করে দেন মহিলা, কথা বলবেন না, বিফল হয়ে ফেরত যেতে হবে। কষ্ট করে এতক্ষণ সময় কাটানোর কোন অর্থ থাকবে না।
তবে মহিলা ওদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না…? মহিলা বললেন কি বলতে এসেছ?
আপনার ছেলের কি হয়েছে জানি আমরা, কিশোর বলল। সব ঘটনা আপনাকে খুলে বলতে চাই। ঘরে আসব?
ডেভিকে তোমরা চিনতে? অনিশ্চিত শোনাল মহিলার কণ্ঠ।
না, জবাব দিয়েই চট করে কিশোরের মুখের দিকে তাকাল রবিন, আবার বেফাঁস কিছু বলে ফেলল কিনা বোঝার জন্যে। তার কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে বলল, ওকে কবর দিতে সাহায্য করেছে যারা, তাদের মধ্যে আমি একজন।
কেঁপে উঠলেন মিসেস রেক। কে তোমরা?
নাম তো বললামই, জবাব দিল কিশোর। আমরা শখের গোয়েন্দা।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দুজনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন মহিলা। তারপর সরে জায়গা করে দিলেন, এসো।
বসার ঘরে ওদের বসতে দিয়ে বললেন, আমি কফি খাব। তোমরা খাবে?
কফি? কিশোর বলল, এসব জিনিস আমরা খুব একটা খাই না। ঠিক আছে, দিন এককাপ। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। সেই কখন থেকে এসে আপনার বাড়ির কাছে ঘুরঘুর করছি দেখা করার জন্যে…
আমার বোনের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বোলো এক মিনিট। নিয়ে আসছি।
রান্নাঘরে চলে গেলেন মিসেস ব্রেক
ঘরের চারপাশে চোখ বোলাতে গিয়ে দেয়ালে ঝোলানো একটা বাধানো ফটোগ্রাফ চোখে পড়ল রবিনের। কিশোরের গায়ে কনুইয়ের গুতো দিয়ে বলল, ওই যে, ডেভন।
ছবিটার দিকে তাকিয়ে কাঁটা দিল রবিনের গায়ে। ওর মনে হলো, ওরই দিকে তাকিয়ে আছে ডেভন। ছবির চোখে যেন নীরব জিজ্ঞাসা–কেন আমাকে এত তাড়াতাড়ি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিলে? কি ক্ষতি আমি করেছিলাম তোমাদের? তাকিয়ে থাকতে পারল না সে। চোখ সরিয়ে নিল।
ট্রেতে করে কফি নিয়ে এলেন মিসেস ব্রেক। কেটলি থেকে কাপে কফি ঢালতে তাকে সাহায্য করল কিশোর।
ওদের মুখোমুখি চেয়ারে বসলেন মিসেস ব্রেক। কাপে চুমুক দিলেন। হ্যাঁ, বলো, কি বলতে এসেছ।
কনসার্ট দেখে ফেরার পথে মরুভূমিতে যা যা ঘটেছিল, খুলে বলল রবিন। কবর দেয়ার কথায় আসতেই নীরবে কাঁদতে শুরু করলেন মহিলা। রবিনের চোখেও পানি এসে গেল। পুলিশের কাছে কেন যায়নি ওরা এই কৈফিয়ত দিতে গিয়ে কথা আটকে যেতে লাগল তার মুখে।
আপনাকে খবর দেয়ার কথা ভেবেছি আমরা, রবিন বলল। লোকটা কে, কোথায় বাস করে, কিছুই জানতাম না। জানলে খবরটা ঠিকই দিতাম, যেভাবেই হোক। এই যে, জানার পর পরই চলে এলাম, একটুও দেরি করিনিঃ…ওর বাড়িতে কি করে খবর দেয়া যায় সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমরা। একবার মনে করলাম পুলিশকে একটা উড়োচিঠি দিয়ে জানিয়ে দিই অমুক জায়গায় অমুক দিন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। লাশটাকে অমুক জায়গায় কবর দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও ভয় ছিল খোঁজ করতে করতে ঠিকই আমাদের হদিস করে ফেলবে পুলিশ। দম নেয়ার জন্যে থামল সে।
সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, আবার বলল রবিন, ওকে খুন করতে চাইনি আমরা। কিভাবে গাড়ির নিচে চলে এল সেটা এখনও মাথায় ঢুকছে না আমার। লাশটা দেখার পর মনে হয়েছিল, রাস্তার ওপর শুয়ে ছিল আপনার ছেলে। বেহুশ হয়ে। অন্ধকারে স্রেফ তার ওপর দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে দেয়া হয়েছে। চাকার নিচে কিছু পড়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলে আমার বন্ধু ড্যানি। নিচে নেমে দেখি কি আর বলব! মিসেস ব্রেক, আপনার ছেলেকে খুন করেছি আমরা। যে কোন শাস্তি দিতে পারেন। আমাদের। ইচ্ছে করলে এখনই পুলিশে ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দিতে পারেন।
রবিনকে অবাক করে দিয়ে তার বাহুতে হাত রাখলেন মহিলা। বিশ্বাস করতে পারল না সে। রেগে ওঠার বদলে সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। আশ্চর্য!
ওর লাশের কি হলো এটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি, মিসেস ব্রেক বললেন। রোজ রাতেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতাম, কোথায় পড়ে আছে লাশটা? জানতাম মারা গেছে ও। কে খুন করেছে তা-ও জানি। তোমরা ওকে খুন করোনি, রবিন। অহেতুক কষ্ট পাওয়ার দরকার নেই। ওর লাশের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়েছিল তোমার বন্ধু। তোমাদের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা। যায়নি। আগেই খুন হয়ে গিয়েছিল।
চোখে অবিশ্বাস নিয়ে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। কিশোর নির্বিকার। রবিন তাকাতেই চোখ টিপল। অর্থাৎ, কি, বলেছিলাম না?
কফির কাপটা নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলেন মিসেস ব্রেক। পুরো ব্যাপারটা তোমাদের খুলেই বলি। খুব মানসিক কষ্টে আছ তোমরা, বোঝা যাচ্ছে। কপালে হাত ডললেন তিনি। তোমাদের সব বলতে পারলে আমারও মনটা খানিক হালকা হবে।
চুপ করে রইল ওরা। শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে।
কপাল থেকে হাত নামালেন মিসেস ব্রেক। কোন্খান থেকে শুরু করব? প্রথম থেকেই বলি সব। ভালই চলছিল আমাদের মা-ছেলের সংসার। ঠিকমত দোকানে যেত ডেভি, ব্যবসা করত, ঠিকমত বাড়ি ফিরত। কোন রকম বদনেশা ছিল না। রাতে খাবার টেবিলে সারাদিন যা যা করত সব আমাকে বলত। একরাতে হঠাৎ করেই মেয়েটার নাম বলল। প্রায়ই আসত সিডি ডিস্ক কিনতে। উদ্ভট গান তার বেশি পছন্দ। মেয়েটার নাম মায়া। তেমন গুরুত্ব দিলাম না। দোকানে কত ধরনের কাস্টোমারই আসে। সবার গানের রুচিও একরকম না। এটা নিয়ে মাথা ঘামালাম, না। তবে ঘামানো উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আজ আমার ডেভি বেঁচেই থাকত।
বদলাতে শুরু করল ডেভি। অসহিষ্ণু, বদমেজাজী হয়ে উঠল। কারণে অকারণে আমার সঙ্গে খেচাখেচি শুরু করে দিত, আগে যেটা সে কখনোই করত না। ওর এই পরিবর্তনে শঙ্কিত হলাম আমি। অনিদ্রা রোগেও ধরল ওকে। দোকান থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরতে লাগল। তারপর একদিন আর ফিরলই না। দুদিন কোথায় কাটিয়ে ফিরে এল। বুঝলাম কোন মেয়ের পাল্লায়। পড়েছে। সেই মেয়েটাও হতে পারে, মায়া। ভাবলাম, পড়ে পড়ুকগে। জোয়ান বয়েসী ছেলে। পড়বেই। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করাতে যখন এড়িয়ে গেল, সন্দেহ হলো আমার।
তারপর একদিন বাথরূমে তাকে কোকেনের প্যাকেট বাছাই করতে দেখে ফেললাম। কলজে কেপে গেল আমার। গানের জগতে হেরোইন আর অন্যান্য নেশায় জড়িয়ে যাওয়াটা একটা অতি সাধারণ ব্যাপার, জানা আছে আমার। এই বিষ যে কোথায় নিয়ে যায় মানুষকে, তা-ও জানা। সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেলাম। একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে সর্বনাশ ঠেকানোর কোন পথই আর খোলা থাকবে না। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর দোকানের ভার ওর ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কোন গণ্ডগোল করেনি কখনও, তাই হিসেব নেয়ার কথাও ভাবিনি। সেদিন ভাবলাম। হিসেব নিতে গিয়ে দেখি কিছুই নেই। সব খুইয়ে বসে আছে। ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট শূন্য। আমি একটা স্কুলের টীচার। দোকানদারি না করলেও চলে যাবে মা-ছেলের। তাই দোকানের জন্যে চিন্তা না করে আগে ছেলের দিকে নজর দিলাম। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলাম ওকে। প্রথমে রাজি হতে চাইল না। আমিও লেগেই রইলাম। শেষমেষ আমার চাপাচাপিতে ক্লিনিকে যেতে যেদিন রাজি হলো, সেদিন এমন। একটা জিনিস দেখে ফেললাম, বুঝলাম ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েও আর লাভ নেই।
বাগানে ফুলগাছের পাতা ছাটতে গিয়ে পচা গন্ধ লাগল নাকে। খুঁজতে খুঁজতে দেখি একটা ঝোপের ধারে নতুন গর্ত। মাটি চাপা দেয়া। অল্প একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল সবুজ একটা পলিথিন ব্যাগ। তার ভেতরে তিনটে জানোয়ারের ধড়, মাথা কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে–কুকুর, বেড়াল এমনকি একটা খটাশও আছে। গায়ের চামড়া জায়গায় জায়গায় কামানো। ডেভিকে জিজ্ঞেস করলাম। অস্বীকার করল না ও।
আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখালাম ওকে। কাকুতি-মিনতি শুরু করল। বলল সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে আবার ভাল হয়ে যাবে। আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না জানতাম, সেজন্যেই ভয় দেখিয়েছিলাম। কোন বদমাশদের দলে যোগ দিয়েছে জিজ্ঞেস করলাম। বলে দিল সব। ওই মেয়েটাই ওর সর্বনাশ করেছে।
কয়েক দিন আর বাড়ি থেকেই বেরোল না ডেভি। একদিন মায়া এসে হাজির হলো। ডেভির চেয়ে দুতিন বছরের ছোট হবে। খুব সুন্দরী। ডেভির সঙ্গে ফিসফাস করে কি সব বলল। সন্দেহ হলো আমার। ওরা গাড়িতে করে বেরিয়ে যেতেই আমিও গাড়ি নিয়ে পিছু নিলাম।
বড় একটা গুদামের মত বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল ওরা। খানিক দূরে গাড়িতে বসে রইলাম। ঘন্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেল। রাত হলো। তখনও ওদের বেরোনোর নাম নেই। আমার আশেপাশে যে সেব লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখলাম, একটাকেও ভাল লোক বলে মনে হলো না। সব গুণ্ডাপাণ্ডা। ভয় পাচ্ছিলাম রীতিমত। রাত বারোটা পর্যন্ত বসে থেকে আর থাকার সাহস হলো না। বাড়ি না ফিরে চলে গেলাম আমার বোনের বাড়িতে। কি করা যায় ওর সঙ্গে পরামর্শ করতে।
পরদিন পুলিশ নিয়ে গেলাম ওই গুদামে। দুজন অফিসার ভেতরে ঢুকল। আমি বসে রইলাম বাইরে, পুলিশের একটা পেট্রল কারে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এল অফিসার দুজন। মুখ সাদা। একজন রাস্তার ধারে দেয়ালের কাছে গিয়ে বমি শুরু করল। অন্যজন আমাকে জানাল, ভেতরে কেউ নেই। তবে যা আছে দেখলে সহ্য করতে পারব না। ভাবলাম ডেভির কিছু হয়েছে। লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ঢুকে পড়লাম গুদামে।
অনেকক্ষণ একটানা কথা বলার পর দম নেয়ার জন্যে থামলেন মিসেস ব্রেক।
শয়তান উপাসকদের আস্তানা ছিল ওটা, তাই না? শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ভুরু কোচকালেন মিসেস ব্রেক, তুমি জানলে কি করে?
আপনার কথা শুনে। ওভাবে জন্তু-জানোয়ার বলি দিয়ে উপাসনা করে শয়তান উপাসকরাই। বলি দেয়ার জন্যে মানুষ তো আর সহজে মেলে না আজকাল যাই হোক। কি দেখলেন?
দৃশ্যটা কল্পনায় ভেসে উঠতে চোখমুখ বিকৃত করে ফেললেন মিসেস ব্রেক। কি যে ভয়াবহ দুর্গন্ধ ছিল ওখানে, বলে বোঝাতে পারব না। সব জায়গায় রক্ত, কোথাও শুকনো, কোথাও আধাশুকনো, কোথাও প্রায় তাজা। পশুর চামড়া আর নাড়ীভুড়ি ছড়িয়ে আছে সবখানে। বিচিত্র সব নকশা এঁকে রেখেছে মেঝেতে। কোনটা বৃত্ত, কোনটা পাঁচ কোণওয়ালা তারকা, কোনটা ছয় কোণ। ওগুলোর মধ্যে দুর্বোধ্য নানা রকম চিহ্ন আঁকা। কোন কোনটার মধ্যে নামও লিখেছে। সবই রক্ত দিয়ে। কালো রঙের আধপোড়া প্রচুর মোমবাতি পড়ে আছে মেঝেতে। কয়েক সেকেন্ডের বেশি ছিলাম না, কিন্তু তাতেই মাথা ঘুরতে শুরু করল আমার। মনে হলো পাগল হয়ে যাব। ছুটে বেরিয়ে এলাম বাইরে। অফিসাররা আমাকে নানা ভাবে শান্ত করার চেষ্টা করল। ডেভির জন্যে কষ্টে মনটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। এত ভাল স্বভাবের একটা ছেলে আমার এ কাদের সঙ্গে মিশল! ওরা শুধু খারাপ নয়, ভয়ানক খারাপ, নরকের ইবলিস! ছেলের আশা ছেড়ে দিলাম।
তারমানে শয়তান উপাসকদের কাণ্ডকারখানা অজানা নয় আপনার? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল কিশোর।
মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ব্রেক। না। বইতে পড়েছি।
আপনার ছেলেকে ওরা পটিয়ে-পাটিয়ে বলি দেয়ার জন্যে নিয়ে গিয়েছিল।
আবারও মাথা ঝাঁকালেন মিসেস বেক। চোখে পানি টলমল করে উঠল আবার।
বলো কি! আঁতকে উঠল রবিন। এই যুগে খোদ আমেরিকা শহরে নরবলি!
ফিরে তাকাল কিশোর। আমেরিকা হলে কি হবে? মানুষের চরিত্র হতো। আর বদলায়নি। আদিম যুগেই রয়ে গেছে। বিবেক-বুদ্ধি বেশি যাদের, তারা জোর করে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে নিজেকে। যারা পারে না…যাকগে, মিসেস ব্রেকের দিকে তাকাল কিশোর, তারপর কি হলো?
মায়া হলো একজন শিক্ষানবীস, মিসেস ব্রেক বললেন। পুরোপুরি ডাইনী হতে হলে শুধু পশু বলি দিলে চলবে না, নরবলি দিতে হবে। শয়তান। উপাসকদের বিশ্বাস, যে যত বেশি মানুষ খুন করতে পারবে, কিংবা অন্যকে প্ররোচনা দিয়ে তার সাহায্যে ছলে-বলে-কৌশলে খুন করাতে পারবে, সে তত বেশি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে। বলি দেয়া আত্মাগুলো দখলে চলে আসবে তার। যে যত বেশি নিষ্ঠুর হবে, আত্মাগুলো তার আদেশ তত বেশি পালন করবে। আমার ছেলেকে বোকা পেয়ে প্রথম শিকার হিসেবে তাকে নির্বাচিত করেছিল মায়া।
কি করে জানলেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। মায়ার সঙ্গে কথা বলেছিলেন? নাকি ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছেন?
মিসেস ব্রেকের এক চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। মোছার চেষ্টা করলেন না তিনি। ধরা গলায় বললেন, ওর সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি আমার। গুদাম থেকে পালানোর দুদিন পর একদিন রাতদুপুরে ফোন। করল আমাকে। কেমন আছি জিজ্ঞেস করল। ওটাই তার সঙ্গে শেষ কথা। আর কথাও হয়নি, দেখাও না। নিখোঁজ হয়ে গেল।
মায়াকে জিজ্ঞেস করেননি ও কোথায় গেল?
না। তবে ওর বাবা-মার সঙ্গে দেখা করেছি।
কোথায়? গলা লম্বা করে সামনে মুখ বাড়িয়ে দিল কিশোর। কখন?
মর্গে। ওদের মেয়েকে শনাক্ত করতে এসেছিল।
মায়াও মারা গেছে!
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন মিসেস ব্রেক। হ্যাঁ। শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে তোমাদের, কিন্তু তবু বলি, ও মরাতে আমি খুশি হয়েছি। বেঁচে থাকলে আমার ছেলের মত আরও কত ছেলের যে সর্বনাশ করত কে জানে। যা হোক, আমি সেদিন গুদামে পুলিশ নিয়ে গিয়ে দেখে আসার পর কি ঘটল বলি। গুদামটার ওপর সাদা পোশাকে নজর রাখল গোয়েন্দা পুলিশ। কিন্তু শয়তান উপাসকদের কেউ আর ফিরে এল না সেখানে। মায়ার নাম বললাম পুলিশকে। শুধু নামটাই জানাতে পেরেছিলাম, তখনও ওর পরিচয় জানতাম না। নাম আর চেহারার বর্ণনা।
একটা কথা, বাধা দিয়ে বলল কিশোর, ওর চুলের রঙটা বলতে পারেন?
সোনালি।
হু! চিন্তিত ভঙ্গিতে নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর।
একথা কেন জানতে চাইলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
আছে, কারণ আছে। মিসেস ব্রেক, আপনি বলুন।
মায়া নামের কোন মেয়েকে খুঁজে বের করতে পারল না পুলিশ। ডেভিকেও না। ওর সন্ধান জানার চেষ্টা করতে লাগলাম আমি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলাম। জানতাম, আর কোনদিন ফিরে আসবে না আমার ছেলে। খুন করে কোথাও ফেলে দেয়া হয়েছে ওকে। তবু, মায়ের মন বুঝ মানল না, দিলাম। এক রাতে পুলিশ ফোন করল। স্যান বার্নাডিনো ভ্যালি হাসপাতালে যেতে অনুরোধ করল আমাকে। একটা মেয়ের লাশ নাকি নেয়া হয়েছে। হাসপাতালে যার সঙ্গে মায়ার চেহারা মিলে যায়।
যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, পুলিশের অনুরোধ এড়াতে না পেরেই গেলাম। দেখা হলো মায়ার মা-বাবার সঙ্গে। মায়াকে শনাক্ত করলাম। ওর আসল নাম সারাহ। হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে। মরার আগে নাকি অদ্ভুত কাণ্ড করছিল সে। একটা বেড়াল বলি দিয়ে সারা গায়ে রক্ত মেখে, কালো মোম জ্বেলে, ঘরের মেঝেতে তারকা একে তার ওপর বসে শয়তানের উপাসনা করছিল। কিছুদিন থেকেই মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন তার বাবা। চিৎকার শুনে তার ঘরে গিয়ে দেখেন মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে আছে মেয়ে। অবস্থা খারাপ দেখে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। হাসপাতালে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মারা গেল সে। মরার আগে পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে ডেভিকে সে খুন। করেছিল।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে দম নিলেন তিনি। তারপর রবিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডেভিকে তোমরা খুন করোনি। খুন করে মরুভূমিতে ফেলে রেখে এসেছিল তাকে মায়া।
কত তারিখ ছিল সেটা? জানতে চাইল কিশোর।
জুলাইর একতিরিশ।
রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, ওই দিনই তোমরা অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলে না?
হ্যাঁ
মাথা ঝাঁকাল কিলোর। মিসেস ব্রেকের দিকে ফিরল, তারপর?
মিসেস ব্রেক বললেন, সারাহ নিজের মুখে স্বীকার করেছে ডেভিকে ওইদিন খুন করেছে সে। ওইদিনই রাতে বেড়াল বলি দিয়ে উপাসনা করেছে। ওইদিনই মারা গেছে। হাসপাতালের মর্গে নিজের চোখে ওর লাশ দেখেছি। আমি। শুধু আমি একা নই, ওর মা-বাবাও দেখেছেন। ডাইনী তো আর হতে পারল না। শুধু শুধু ছেলেটাকে আমার খুন করল।
আবার একটা মুহূর্ত নীরব থাকার পর মিসেস ব্রেক বললেন, সবই বললাম তোমাদের। ডেভির লাশটা যে খুঁজে পেয়েছ তোমরা, শেয়াল-কুকুরে খাওয়ার জন্যে ফেলে না রেখে কবর দিয়ে এসেছ, সেজন্যে তোমাদের কাছে। আমি কৃতজ্ঞ। আবার গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। কোনখানে দিয়েছ, মনে আছে? খুঁজে বের করতে পারবে?
পারব, মাথা কাত করল রবিন।
ঠিক আছে, একদিন নিয়ে যেয়ো আমাকে।
আচ্ছা।
আজ তাহলে উঠি আমরা, মিসেস ব্রেক? কিশোর বলল। অনেক রাত হলো। অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার..
সময় আর নষ্ট করলে কোথায়? বরং ডেভির খোঁজ জানিয়ে আমাকে কৃতজ্ঞ করে দিলে। অনেক ধন্যবাদ তোমাদেরকে। … কিশোর, সেরাতে তুমিও কি গাড়িতে ছিলে?
না, আমি ছিলাম না। বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি তখন লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে বহুদূরে। রবিন আর মুসা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ফিরে এসে যখন শুনলাম, মনটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মানুষ খুনের দায়ে ওরা জেলে যাবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল…
না জেনে শুধু শুধুই কষ্ট পেয়েছ তোমরা। খুন করেছে আরেকজন, ভোগান্তিটা গেল তোমাদের…
ওহহো, মিসেস ব্রেক, একটা কথা, কিশোর বলল, জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছিলাম। মনে করতে হয়তো খারাপ লাগবে আপনার। তবু এত কথা যখন বললেন, এটাও জেনেই নিই। কিভাবে খুন করেছিল সারাহ, বলেছে?
কেঁপে উঠলেন মিসেস ব্রেক। ঠোঁটের কোণ কুঁচকে গেল। ঘুমের মধ্যে মাথার চাঁদিতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চোখা একটা পেরেক ঢুকিয়ে দিয়েছিল ডাইনীটা…
আর বলতে পারলেন না মিসেস ব্রেক। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
তাকে শান্ত হওয়ার সময় দিল কিশোর। রবিনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, পেরেক-টেরেক কিছু দেখেছিলে তোমরা?
নাহ, মাথা নাড়ল রবিন। অত কিছু দেখার মত অবস্থা ছিল না কারও। সবাই খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল। আতঙ্কিত।
হু। তারমানে খুজলে এখনও চাদিতে পেরেকটা পাওয়া যাবে।
চাদিতে পেরেক ঢোকালে তো মাথা থেকে রক্ত বেরোত। ঠোঁটের কোণ থেকে কেন?
সরু পেরেক ঢোকালে রক্ত আর কতটা বেরোবে? সামান্যই। ব্যথার চোটে মরার আগে নিশ্চয় জিভে কামড় লেগে গিয়েছিল ডেভনের। জিভ কেটে রক্ত বেরিয়ে ঠোঁটের কোণে লেগে গিয়েছিল। উঠে দাঁড়াল কিশোর। মিসেস ব্রেককে সান্তনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পেল না। কোনমতে বলল, আজ তাহলে যাই, মিসেস ব্রেক…
বোসো। যাওয়ার আগে আরও একটা অদ্ভুত খবর শুনে যাও। পরদিন সারাহর বাবা মিস্টার জবার মর্গ থেকে মেয়ের লাশ আনতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কবর দেয়ার জন্যে। পাওয়া যায়নি লাশটা। রহস্যময় ভাবে গায়েব হয়ে গিয়েছিল। পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও হদিস করতে পারেনি লাশটার কি হয়েছিল।
এটা একটা খবর বটে। চোখমুখ কুঁচকে ফেলল কিশোর। মিস্টার জবারের ঠিকানাটা দিতে পারেন?।
নাম জানি। কোন শহরে বাস করেন সেটা জানি। কিন্তু ঠিকানা জিজ্ঞেস করিনি। পুরো নাম গ্রেগরি জবার। রিভারসাইডে থাকেন। ইনফরমেশন থেকে ওদের ফোন নম্বর জেনে নিতে পারলে ঠিকানা বের করা। কঠিন হবে না।
রবিনের দিকে তাকাল কিশোর, চলো। মিসেস ব্রেককে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমরা। ওনার এখন একা থাকা দরকার।…অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে, মিসেস ব্রেক। আমাদের দিয়ে যদি কোন রকম সাহায্য হবে মনে করেন কখনও, দ্বিধা-সঙ্কোচ না করে খবর দেবেন।