(এ বইটি রোমহর্ষক সিরিজে শ্বেতহস্তী নামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। উল্লেখ্য: রোমহর্ষক সিরিজের লেখক জাফর চৌধুরী রকিব হাসানের ছদ্মনাম।)

চাঁদের পাহাড় — ভলিউম ৫৪ -– তিন গোয়েন্দা

০১.

রাস্তা জুড়ে দাঁড়াল বিশাল হাতিটা।

খাড়াই বেয়ে উঠতে উঠতে ছেলেদের মনে হলো মেঘে ঢেকে দিয়েছে সূর্য।

মুখ তুলে দেখল ওরা, আকাশ মেঘে ঢাকেনি। ঢেকেছে শুড়ওয়ালা এক চারপেয়ে কালো দানব। এতবড় হাতি আর দেখেনি ওরা।

হাতিটাও ওদের মতই অবাক হয়েছে। থমকে দাঁড়িয়ে কুতকুতে চোখে তাকাল ওদের দিকে। গুমগুম শব্দ বেরোল গলার গভীর থেকে। রেগে গেছে। শুড়টা বাড়িয়ে দিল সামনে, ওদের গন্ধ নেয়ার জন্যে।

কাঁধের সঙ্গে ভাজ করে লেপ্টে ফেলেছিল কান দুটো। ঝটকা দিয়ে ছড়িয়ে দিল ছাতার মত। এতটাই বড়, কিশোর অনুমান করল, ওই সাইজের ডাইনিং টেবিল বানালে একেকটাতে আটজন করে লোক খেতে বসতে পারবে। রোদে ঝকঝক করছে ওটার ছয় ফুট লম্বা সাদা দাঁত।

কিশোরের মত স্থির থাকতে পারল না ওর বন্ধু মুসা। বলল, চলো, পালাই।

কোথায়? দুই ধারে ঘন ঝোঁপঝাড়ের দেয়াল হয়ে আছে।

 যেদিক থেকে এলাম, মুসা বলল।

দৌড় দিয়ে লাভ হবে না। তাড়া করবে। হাতির সঙ্গে পারা যাবে না। ধরে। ফেলবে। ছয়-সাত টন ওজনের হাতির এক পায়ের পাড়াই যথেষ্ট, ভর্তা হয়ে যাব।

তাহলে কিছু একটা করো! এ সব যুক্তি তো আর প্রাণ বাঁচাবে না।

সামনের দিকে তঁড়টাকে ছুঁড়ে দিয়ে বিকট চিৎকার করে উঠল দানব। রক্ত হিম করা চিৎকার। কলরব করে ছুটে পালাতে শুরু করল বানর আর পাখির দল।

পেছনে তাকাল কিশোর। ওদের ভাড়া করে আনা নিগ্রো কুলির দল আতঙ্কিত হয়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে, একজন বাদে। তার নাম আকামি। ওদের গাইড এবং ট্র্যাকার। সে দাঁড়িয়ে আছে ওর একেবারে পাশেই। হাতে একটা হাতি মারার রাইফেল। সেটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিল সে।

মাথা নাড়ল কিশোর। জ্যান্ত ধরার চেষ্টা করব।

মুচকি হাসল আকামি। নিজে সে দুঃসাহসী লোক, সাহসী মানুষদের পছন্দ করে। কিন্তু হাতি ধরার কথা সে-ও কল্পনা করতে পারে না।

সামনে এগোনোর সাহস নেই, পিছিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছে, দু-ধারে মাউন্টেইনস অভ দা মুন, অর্থাৎ চন্দ্ৰপাহাড়ের কুখ্যাত ঘন ঝোঁপঝাড়ের দেয়াল। সময় থাকলে হয়তো কুপিয়ে কেটে পথ করে নেয়ার চেষ্টা করতে পারত, কিন্তু হাতিটা ওদেরকে সে-সময় দেবে বলে মনে হলো না।

মাটিতে গর্ত থাকলে নির্ধিধায় তাতে ঢুকে যেত এখন, তাও নেই।

একটা মাত্র পথ খোলা আছে, ওপর দিকে। কিন্তু সেদিক দিয়ে পালাতে হলে ডানা দরকার, উড়ে যেতে হবে। তার মানে, পালানোর পথ নেই।

দ্রুত ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। তাকিয়ে আছে ওপর দিকে।

লিয়ানা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। মাথার ওপরে বড় বড় গাছের ডাল থেকে ঝুলছে ওই লতা। জাহাজ বাঁধার দড়ির মত শক্ত।

ধরব কি করে? কি করতে হবে বুঝে গেছে মুসা।

 আমার কাঁধে ওঠ, কিশোর বলল।

কিশোরের কাঁধে উঠল মুসা। হাত বাড়িয়ে একটা লতা ধরে দোল দিয়ে উঠে। যেতে শুরু করল ওপরে।

এ আবার কি হচ্ছে!-অবাক হয়ে ভাবছে যেন হাতিটা। তাকিয়ে রয়েছে আজব ওই দড়াবাজিকরের দিকে।

আকামিকে নির্দেশ দিল কিশোর, যাও, ওঠো, জলদি!

কিশোরকে ছেড়ে আগে ওঠার ইচ্ছে ছিল না আকামির। কিন্তু তর্ক করে নষ্ট করার সময় এখন নেই। রাইফেলটা স্ট্র্যাপে ঝুলিয়ে, কিশোরকে মই বানিয়ে মুসার মতই উঠে যেতে শুরু করল সে-ও।

বিকট হস্তীনিনাদ করে দুলকি চালে এগোতে লাগল হাতি। লিয়ানার ডগায় ফঁসের মত গিঁট বেঁধে থাকে। সে-রকম একটা গিঁটে পা ঢুকিয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ল আকামি। হাত বাড়াল কিশোরকে ধরার জন্যে।

বাড়ানো হাতটা ধরে ফেলল কিশোর। টেনে তাকে তুলে নিতে লাগল আকামি।

কিন্তু সার্কাসের এই খেলা মোটেও পছন্দ হলো না হাতির। ধরার জন্যে ছুটে এল সে। কিশোরের নিচে দাঁড়িয়ে আরেকবার হাঁক ছাড়ল। ওঁড়ের ফুটো থেকে বেরোনো গরম নিঃশ্বাসের ঝাপটা লাগল পায়ে। কিশোরের গোড়ালি পেঁচিয়ে ধরল শুডুটা।

আকামি টানছে ওপর দিকে, হাতি টানছে নিচে। ঘাবড়ে গেছে কিশোর। ভয়ঙ্কর এক মুহূর্ত। এই টানাটানি বন্ধ না হলে ছিঁড়ে দুই টুকরো হয়ে যাবে সে। আকামি তাকে ছেড়ে দিলেও বিপদ। নিচে পড়বে। পায়ের তলায় পিষে মারবে তখন দানবটা।

চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এল কুলিরা। টিন বাজিয়ে, নানা রকম শব্দ করে হাতির দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করল।

ওদের দিকে ফিরে ভয় দেখানোর জন্যে চিৎকার করে উঠল হাতি।

আওয়াজটা অদ্ভুত। ভয়াবহ সন্দেহ নেই, তবে বাঘ-সিংহের গর্জনের মত নয় শব্দটা, বরং অনেকটা মেয়েমানুষের চিৎকারের মত; অনেক গুণ জোরাল, গায়ের রক্ত জমিয়ে দেয়।

কুলিদের হট্টগোলের জবাবটা দিয়েই আবার কিশোরের দিকে নজর ফেরাল সে। যেন বলতে চাইল-দাঁড়াও, তোমাদেরও ধরব, আগে হাতের কাজটা শেষ করে নিই!

আবার টান দিল কিশোরের পা ধরে।

ওপরে হড়াৎ করে পিছলে গেল কিছু। এই সম্ভাবনাটার কথা ভাবেনি কিশোর। লতাটা বোধহয় খুলে আসছে ডাল থেকে। নতুন বিপদ। লতা ছিঁড়ে গেলে শুধু সে-ই না, আকামিও পড়বে-দুজনেই মরবে তখন।

ছাড়ো! আমাকে ছেড়ে দাও! মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে।

 কিন্তু ছাড়ল না আকামি। কিশোরের কব্জিতে আরও চেপে বসল আঙুলগুলো।

আরও একটা জিনিস পিছলে যেতে শুরু করল টানাটানিতে। কিশোরের গোড়ালি ঢাকা ভারি বুট, সাপের কামড় থেকে বাঁচার জন্যে পরেছিল। পট করে ছিঁড়ে গেল ফিতে। দ্রুত পিছলে পা থেকে খসে বেরিয়ে গেল জুতোটা।

মুক্ত হয়ে গেল পা। টেনে তাকে তুলে নিল আকামি। তারপর দুজনে মিলে বেয়ে উঠে গেল উঁচু ডালে।

জুতোটাকে নিয়ে পড়ল হাতি। আছাড় দিয়ে, পা দিয়ে মাড়িয়ে, দাঁত দিয়ে খুঁচিয়ে ওটাকে ছিঁড়ে, চ্যাপ্টা করে মাটিতে পুঁতে ফেলল। তারপর ঢেকে দিল লতাপাতা দিয়ে।

শিকারকে শেষ করে এ ভাবে কেন ঢেকে দেয় আফ্রিকান হাতি, এটা একটা বিস্ময়। এর জবাব কেউ জানে না।

কিশোর ভাবল, শান্ত হয়ে এবার চলে যাবে হাতিটা। কিন্তু গেল না ওটা। আবার নজর দিল ওদের দিকে। কুতকুতে চোখে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দেখল গাছের মানুষগুলোকে। হঠাৎ এসে বিশাল মাথা দিয়ে ঢুস মারল গাছের গায়ে।

থরথর করে কেঁপে উঠল গাছ। ঝাঁকুনির চোটে ওপরের ডাল থেকে চিৎকার করে খসে পড়ল একটা বানর। মাটিতে পড়ল না। ধরে ফেলল আরেকটা ডাল।

প্রমাদ গুণল কিশোর-মুসা। হাতির এই আচরণের কথা ওরা শুনেছে। একেক সময় এমন খেপা খেপে যায় ওরা, গাছ থেকে ফেলে হলেও শিকারকে ধরার চেষ্টা করে। এই হাতিটাও একই কাজ করছে।

সামনের ডান পা-টা গাছের গায়ে তুলে দিয়ে ঠেলতে লাগল সে। মোপানি গাছ। শিকড় খুব শক্ত। তাই সামান্য একটু বাকা হলো মাত্র, কাত হলো না।

ছাড়ল না হাতি। ফেলেই ছাড়বে। দাঁত দিয়ে গাছের গোড়ার চারপাশের মাটি খুঁড়তে শুরু করল। সেই সঙ্গে ছিঁড়তে লাগল শিকড়। গোড়াটা নরম করতে পারলেই, ব্যস।

চুপ করে বসে থাকলে মরতে হবে, চিৎকার করে ডেকে বলল কিশোর, মুংগা, শিকল!

খানিক দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতিটার কাণ্ড দেখছে কুলিরা। ডাক শুনে নড়ে উঠল তাদের একজন। আরও কয়েকজনের সাহায্যে মোটা একটা শিকলের এক মাথা তাড়াতাড়ি বেঁধে দিয়ে এল বিশাল টিলার চোখা মাথায়। আরেক মাথায় একটা ফাস বানিয়ে দৌড়ে এল হাতির এক পায়ের নিচে পেতে দেয়ার জন্যে। হাতি তাতে পা দিলেই ফাস টেনে আটকে দেবে।

মাথা সোজা করে আবার গাছ ঠেলতে আরম্ভ করেছে হাতি। ভয়াবহ ঝাঁকুনি লাগছে। বানরের দল পালিয়ে গেছে অন্য গাছে। কিশোর-মুসারাও এ কাজ করতে পারলে বেঁচে যেত। কিন্তু ওরা তো বানরের মত লাফাতে পারে না। কেবল প্রাণপণে গাছ আঁকড়ে ধরে রইল।

মুংগার ওপর নজর পড়ল হাতির। বিকট চিৎকার দিয়ে ঘুরল।

শিকল ফেলে দৌড় মারল মুংগা। কিছুদূর তাকে আর কুলিদেরকে তাড়া করে গেল হাতি। চোখের পলকে যে যেদিকে পারল ছুটে ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা।

আবার গাছের কাছে ফিরে এল হাতি।

গুলি করা ছাড়া উপায় নেই। ভারি .৫০০ ডাবল-ব্যারেল রাইফেলটা হাতির দিকে তাক করতে গেল আকামি।

ধরে ফেলল মুসা, আমাকে দাও।

তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল আকামি, এত ভারি রাইফেল দিয়ে মুসা গুলি চালাতে পারবে না ভেবে।

আরে দূর, দাও না! কি ভেবেছ আমাকে? ভারি রাইফেল চালিয়েছি আরও। দু-শো ফুট দূর থেকে ছোট্ট খাবারের টিন ফুটো করে দিতে পারি। আর এটা তো হাতি, বাড়ির সমান।

অনুমতির আশায় কিশোরের দিকে তাকাল আকামি।

 হাসল কিশোর। মাথা কাত করে ইঙ্গিত করল দেয়ার জন্যে।

রাইফেলটা নিয়ে গুলি করতে যেতেই আবার ঘুরে দাঁড়াল হাতি। আবার বিরক্ত করতে এসেছে তাকে মুংগা আর তার লোকেরা। খেপে গিয়ে আরেকবার কালো দু-পেয়ে জীবগুলোকে তাড়া করল সে।

আবার সরে গেল লোকগুলো।

কি করে এত দ্রুত অদৃশ্য হয়ে যায় ওরা, ভেবে অবাক লাগল মুসার। ভাবল, এ যাত্রা বাঁচতে পারলে কুলিদের কাছ থেকে কায়দাটা রপ্ত করবে ভালমত। কাজে লাগবে ভবিষ্যতে।

আবার গাছের দিকে ফিরে আসতে শুরু করল জানোয়ারটা। তাজ্জব ব্যাপার! ভয়ানক জেদ হাতির। যার পেছনে লাগবে তাকে শেষ না করে আর রাগ যায় না।

আর ওটাকে কাছে আসার সুযোগ দিল না মুসা। গুলি করল।

ভারি রাইফেলের প্রচণ্ড গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল হাতিটা। মাটিতে কাত হয়ে পড়ল না, ভাজ হয়ে গেল সামনের দুই হাঁটু, যেন আস্তে বসে পড়ল মাটিতে, একটুও শব্দ না করে।

গুলি করার পর আরেক কাণ্ড ঘটেছে। গাছের ডালে বেকায়দা অবস্থায় দাঁড়িয়ে গুলি করেছে মুসা, রাইফেলের সাংঘাতিক ধাক্কা সইতে না পেরে পড়ে গেল মাটিতে। পাথরে পড়লে হাড়গোড় ভেঙে মরত, কিন্তু ওর ভাগ্য ভাল, গাছের গোড়ায় এখানে একধরনের শ্যাওলা হয়ে আছে। ওগুলোতে পড়ল। এত বড় আর মোটা শ্যাওলা পৃথিবীর আর কোথাও জন্মায় না। অনেক পুরু গালিচা তৈরি করে রেখেছে যেন, ফলে তাতে পড়ে বেঁচে তো গেলই সে, কোন আঘাতও পেল না।

রাইফেলটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছে। উঠে দাঁড়াল। চোখ পড়ল বিশাল। হাতিটার ওপর। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না এতবড় একটা দানবকে এত সহজে মেরে ফেলেছে। দুঃখও হচ্ছে। হাতি শিকার করতে আফ্রিকায় আসেনি ওরা, এসেছে বিশাল ওই প্রাণী জ্যান্ত ধরে নিয়ে যেতে।

কিশোরও নেমে এল গাছ থেকে। এগিয়ে গিয়ে হাতির কাঁধে বিধে থাকা একটা বল্লমের মাথার দিকে তাকিয়ে রইল। মরচে পড়ে গেছে। কেউ ছুঁড়ে মেরেছিল, মাংসে গেঁথে রয়েছে ফলাটা, কিন্তু ডাণ্ডাটা ভেঙে গেছে। পচে ঘা হয়ে গেছে। এ কারণেই বোধহয় মানুষের ওপর এত ক্ষিপ্ত হয়ে ছিল প্রাণীটা।

মাথার কাছে একটা বড় ফুটো। সেটা দেখিয়ে আকামি জিজ্ঞেস করল মুসাকে, এখানে গুলি করেছিলে?

মাথা ঝাঁকাল মুসা।

চট করে কিশোরের দিকে তাকাল আকামি। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল দু জনের। তাড়াতাড়ি একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল সে-শিকলটা তুলে এনে ফাস পরিয়ে দিল হাতির পায়ে।

অবাক লাগল মুসার। জিজ্ঞেস করল, মরা হাতিকে বাঁধছ কেন?

মরেনি, জবাব দিল কিশোর।

 মানে? মগজে বুলেট খেয়ে পড়ে গেল, মরেনি মানে?

হাতি শিকারে তোমার অভিজ্ঞতা নেই তো, তাই বলছো। হাতির মাথার সামনের দিকটায় শুধুই হাড়, পুরু শক্ত হাড্ডি। এই হাড়ে ঢুকে আটকে যায় বুলেট, মগজ পর্যন্ত যেতে পারে না। মগজ অনেক পেছনে, দুই চোখের মাঝামাঝি জায়গায়। গুলির আঘাতে কেবল বেহুশ হয়েছে ওটা, শীঘ্রি জেগে যাবে।

হা হয়ে গেল মুসা। কথাটা জানে না বলে নিজের ওপর রাগ হলো, তবে খুশিও হলো, প্রাণীটাকে খুন করতে হয়নি বলে।

কিশোরের কথাই ঠিক।

গলার গভীর থেকে ভারি একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ উঠে এল হাতিটার। তারপর চাপা গোঙানি। কাছাকাছি ছিল যারা, তাড়াতাড়ি সরে গেল।

চোখ মিটমিট করল হাতিটা। শুড় নাড়ল। তারপর বিকট চিৎকার করে আবার খাড়া হয়ে উঠল। তাড়া করতে গেল কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজন কুলিকে।

কিন্তু পায়ে আটকানো শিকল ঠেকিয়ে দিল তাকে।

পিছিয়ে গিয়ে, আরেকবার চিৎকার করে আবারও তেড়ে গেল হাতি। সাংঘাতিক টান লাগল শিকলে। আর তাকে আটকাতে পারল না শিকল, মট করে ছিঁড়ে গেল।

উধাও হয়ে গেছে কুলিরা।

কাউকে না পেয়ে মোপানি গাছটার দিকে তাকাল সে। কেউ নেই দেখে নিরাশ হয়েই যেন আরেকবার চিৎকার করে, রওনা হয়ে গেল বনের দিকে। পাথরে ঘষা লেগে লেগে শিকলের শব্দ উঠছে ঝনঝন, ঝনঝন। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল সেই শব্দ।

খানিক দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মুসা আর কিশোর।

স্তব্ধ হয়ে গেছে দু-জনে। এত শক্ত শিকল এমন করে ছিঁড়ে ফেলতে পারবে হাতিটা, কল্পনা করেনি।

জোর গুঞ্জন করে উঠল কুলিরা।

.

০২.

কান পেতে শুনছে সবাই। হাতির চিৎকার থেমে যেতে হঠাৎ বড় বেশি নীরব মনে হলো বনটাকে। কেমন যেন গা শিউরানো পরিবেশ। মনে হচ্ছে, এর চেয়ে হাতির চিৎকারও ভাল ছিল।

চলো, এগোই, কিশোর বলল।

 আকামি জানাল, কুলিরা আর এগোতে চায় না।

কেন?

ওরা বলছে এটা খারাপ জায়গা। এখানে কিছু ধরতে পারব না আমরা। এখানে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই। এ রকম জায়গা নাকি আর কখনও দেখেনি। ওরা।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। সে-ও দেখেনি কখনও। মনে হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে। আশপাশের দানবদের তুলনায় নিজেকে অতি ক্ষুদ্র লাগছে।

বড় বড় গাছগুলো এমন করে ছেয়ে আছে শ্যাওলায়-দেখে মনে হয় বুড়ো মানুষের দাড়ি। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে দুলছে। ডালে ডালে জড়াজড়ি করে আছে শত শত ফুট লম্বা লতা। যখন তখন নেমে আসছে আকাশের মেঘ, গাছপালা। ভেদ করে মাটি ছুঁয়ে ভেসে যাচ্ছে, যেন শিকার দেখে ছো মারার জন্যে নামছে আকাশচারী দানব।

ঘন হয়ে ঝুলে আছে কুয়াশার মত বাষ্প।

ভাবা যায় ঘরের সমান বড় একেকটা ফুল! ইউরোপ আমেরিকায় হাঁটু সমান উঁচ ফুল দেখেছে সে, কিন্তু এখানে সেই একই জাতের ফুলই চারজন মানুষের সমান উঁচ। আমেরিকায় যে বীজ পাখিতে খায়, সেটা এখানে পাখির চেয়ে বড়। যে সব ফার্ন সাধারণত হাঁটুর চেয়ে উঁচু হয় না, এই চন্দ্ৰপাহাড়ের সেগুলো বড় বড় গাছের সমান। সব কিছুই অস্বাভাবিক বড়।

অদ্ভুত এক জগৎ! শুরুতে তো কিশোর বিশ্বাসই করতে পারছিল না বাস্তবে রয়েছে। চিমটি কেটেও দেখেছে নিজের গায়ে ব্যথা পায় কিনা।

গাছপালার মতই এখানকার প্রাণীরাও বড়। হামিংবার্ড দেখেছে কবুতরের সমান। চিতাবাঘগুলো হয় বাঘের চেয়ে বড়। দেখতে দেখতে একসময় মুসা বলেছে, যা অবস্থা, কেঁচো দেখব সাপের সমান!

মাথা ঝাঁকিয়েছে কিশোর, তাই তো হয় এখানে। কেঁচো হয় তিন ফুট লম্বা। মাউন্টেইনস অভ দা মুনের ওপর একটা সাইন্টিফিক রিপোর্ট করেছিল ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিন, উনিশশো বাষট্টির মার্চে বেরিয়েছিল সংখ্যাটা। এখানকার দানবীয় প্রাণীদের উল্লেখ আছে তাতে। অভিযাত্রীরা দেখে গেছে তিন ফুট লম্বা কেঁচো।

তাহলে এই আজব জায়গা সম্পর্কে কিছু শোনা যায় না কেন?

যায় না কে বলল? ম্যাপ দেখলেই পেয়ে যাবে। ভিকটোরিয়া হ্রদের কাছে, অনেক টুরিস্ট যায়। ম্যাপে নাম রুয়েনজোরি। এর মানে রেইনমেকার, বা বৃষ্টি প্রস্তুতকারী। সারাক্ষণই বৃষ্টি হতে থাকে এখানে। আর এর জন্যেই কোন টুরিস্ট রিসোর্ট গড়ে ওঠেনি। মানুষের চোখে না পড়ার আরেকটা বড় কারণ হলো, বেশির ভাগ সময়ই মেঘে ঢাকা পড়ে থাকে এই অঞ্চল।

বাব্বাহ্! এই অবস্থা! নামটা রুয়েনজোরি, না? আমি তো জানতাম মাউন্টেইনস অভ দা মুন।

এটা রুয়েনজোরির আরেক নাম।

 পুরানো, না নতুন?

 পুরানো। প্রাচীন মিশরীয়রা রেখেছিল।

 কেন?

আজব জায়গা বলে। পৃথিবীতে এমন অবস্থা আর কোথাও নেই। এ যেন অন্য এক পৃথিবী। তাই পুরানো ম্যাপে নাম ছিল লুনায়ে মনটিস, অর্থাৎ মাউন্টেইনস অভ দা মুন, অর্থাৎ চাঁদের পাহাড়। একহাজার বছরেরও বেশি কাল ধরে ম্যাপে ওই নাম থাকার পর হঠাৎ করেই মুছে ফেলা হলো। হয়তো লোকে তখন মনে করেছিল এ রকম জায়গা বলে কিছু নেই। কারণ পরের দিকে অভিযাত্রীরা আর এ জায়গাটা খুঁজে পায়নি। বিখ্যাত পর্যটক স্টেনলি-লিভিংস্টোনকে খুঁজে পেয়েছিলেন যিনি, তিনি একবার বলেছেন-ম্যাপে যে জায়গায় চাঁদের পাহাড় দেখানো রয়েছে, ওই জায়গাটাতে শুধু পানি, জাহাজে করে পার হয়েছি আমি; তার মানে ওখানে পাহাড় বলে কিছু নেই। সুতরাং ম্যাপ থেকে মুছে ফেলা হলো তখন। পরে আবার ফিরে এলেন তিনি। আফ্রিকার এই এলাকা ধরে যাওয়ার সময় কয়েক মুহূর্তের জন্যে মেঘ সরে গেলে বেরিয়ে পড়ল পর্বতের চূড়া-চিরতুষারের রাজত্ব, দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। ফিরে গিয়ে চাঁদের পাহাড়ের জায়গায় নতুন নাম বসালেন, রুয়েনজোরি।

আগের নামটাই ভাল ছিল। শুনতে একটু কেমন কেমন লাগে বটে, কিন্তু এক ধরনের রোমান্টিকতা আছে। আমরা আরও সহজ করে চাঁদের পাহাড়ই বলব, কি বলো?

অসুবিধে নেই।

এহেন রহস্যময় চাঁদের পাহাড়ের আরও গভীরে যে যেতে রাজি হবে না নিগ্রো কুলিরা, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বিশেষ করে গুলি খেয়ে মরে যাওয়া হাতি জ্যান্ত হয়ে চলে যাওয়ার পর। হাতির মাথায় কোথায় গুলি লাগাতে হয়, ওরাও জানে না। কারণ বন্দুক দিয়ে শিকার করেনি ওরা, করেছে বর্শা আর তীর ধনুক দিয়ে।

 অধৈর্য হয়ে বলল মুসা, সারাদিন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব নাকি? যেতে বলছ না কেন? ধমক লাগালেই হয়।

মাথা নাড়ল কিশোর, লাভ হবে না। ধমক দিয়ে কোন আফ্রিকানকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবে না, নিজের ইচ্ছেয় যদি না যায়। যেতে বাধ্য করলে বিপদে ফেলে দেবে। সাংঘাতিক কুসংস্কার এদের, বনের বাঘ-সিংহকে পরোয়া করে না, কিন্তু ভূতের ভয়ে কুঁকড়ে যায়। এদের বেশির ভাগেরই ধারণা প্রতিটি বড় ঝোঁপ, প্রতিটি পাথর একটা করে ভূতের বাসা। যত বড় ঝোঁপ হবে, ভূতটাও হবে তত বড়। সময় দিতে হবে ওদের, বুঝতে দিতে হবে, দানবীয় এই গাছপালা আসলে কোন ক্ষতি করতে পারে না।

সময় কাটছে। কুলিদের বোঝানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করল আকামি। অনেকক্ষণ পর যখন দেখল ওরা, এই দানব বনের ভূত তাদের কোন ক্ষতি করছে না, তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও আরও কিছুদূর এগোতে রাজি হলো।

একটা বুট নষ্ট করে ফেলেছে হাতি। আরেকটা পায়ে রেখে কোন লাভ নেই। সেটাও খুলে ফেলে দিয়ে আরেক জোড়া বুট পরে নিল কিশোর।

যেটা ফেলে দিল, মহানন্দে সেটা তুলে নিল হামবি নামের এক কুলি সর্দার। পায়ে টায়ার কেটে তৈরি একজোড়া স্যান্ডেল। সেগুলো খুলে রেখে বুটটা পরে ফেলল সে। আরেক পায়ে জুতোর মত করে পাতা জড়িয়ে লতা দিয়ে বেঁধে নিয়ে গর্বিত দৃষ্টিতে তাকাল সঙ্গী কুলিদের দিকে। এত সুন্দর জুতো জীবনে আর পরেনি সে।

.

০৩.

লোকে কথায় বলে-গর্বে মাটিতে পা পরে না। কিন্তু নতুন জুতোর গর্বে আরও বেশি করে পা ফেলতে লাগল হামবি, নতুন শক্তি দিল যেন বিচিত্র জুতোজোড়া। হাসতে হাসতে পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল সে। কিন্তু আচমকা থমকে দাঁড়াল, হাসি মুছে গেছে মুখ থেকে। পাহাড়ী পথ বেয়ে একটা ভূতকে নেমে আসতে দেখেছে।

কয়াশায় জড়িয়ে থাকায় ভূতটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। ভূত মনে হওয়ার কারণ, মানুষের মত দেখতে হলেও ওটা বেজায় লম্বা। তার ধারণা মানুষ এত লম্বা হতে পারে না।

পেছনের কুলিরাও দেখে ফেলল ভূতটাকে। আতঙ্কে, উত্তেজনায় একে অন্যের গায়ে গুতো দিয়ে কলরব শুরু করে দিল ওরা। দু-একজন ঘুরে দৌড় দেয়ারও চেষ্টা করল, ধরে ফেলল আকামি।

দমকা বাতাসে সরে গেল কুয়াশা। স্পষ্ট দেখা গেল এখন মানুষটাকে, ভূত নয়। কিন্তু তবু কুলিদের কারও বিশ্বাস হতে চাইল না।

ওরা যে অঞ্চল থেকে এসেছে, সেখানকার মানুষ পাঁচ ফুটের ওপরে কয়েক ইঞ্চির বেশি লম্বা হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মানুষ উয়াটুসিদের কখনও দেখেনি ওরা, যারা সাত ফুটের বেশি লম্বা হয়।

উয়াটুসিরা নিগ্রো নয়, সাদা মানুষও নয়, ওদের চামড়া উজ্জ্বল তামাটে রঙের। মাথা সোজা করে চলার স্বভাব, চলেও দ্রুতগতিতে, যেন দমকা বাতাস। ভাল নাচতে পারে, লাফ দিয়ে উঠতে পারে অনেক উঁচুতে।

কিং সলোমনস মাইনস ছবি থেকে উঠে এসেছে দেখি! বিড়বিড় করল কিশোর।

মাথা ঝাঁকাল মুসা। ফিল্মটা সে-ও দেখেছে। ওই ছবিতে উয়াটুসিদের একটা চমৎকার দৃশ্য চিত্রায়িত করা হয়েছে।

আঁকাবাঁকা পথ ধরে নেমে আসা লোকটার একটা সাদা চাদরে মোড়া, হাতে লম্বা লাঠি। বিদেশীদের দেখে নিশ্চয় অবাক হয়েছে, কিন্তু ভয় পেল না। নিজের চেয়ে আকারে ছোট মানুষকে ভয় করে না উয়াটুসিরা।

এগিয়ে আসছে লোকটা। পাশ কাটানোর সময় সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম জানাল।

আকামি, কিশোর বলল, ওকে থামতে বলো। ওর সঙ্গে কথা বলব।

সব আফ্রিকান গোত্রেরই মোটামুটি নিজস্ব একটা ভাষা থাকে, উয়াটুসিদেরও আছে। সেটা জানে না আকামি। সুতরাং সোয়াহিলি ভাষায় কথা বলল সে-আফ্রিকার অনেক জায়গার লোকেই এই ভাষাটা বোঝে।

বুঝল লম্বা লোকটা। মাথা ঝাঁকাল। তবে সোয়াহিলিতে না বলে কিশোরের দিকে ফিরে ইংরেজিতে বলল, কি করতে পারি, বলো?

অবাক হয়ে গেল কিশোর, আপনি ইংরেজি জানেন!

হাসি ফুটল তামাটে মুখটায়। এত বছর ধরে ইংরেজরা মাতব্বরি করল আমাদের ওপর, ভাষাটা জানব না? তবে আমি শিখেছি সিনেমায় কাজ করার সময়।

সিনেমা?

হ্যাঁ, একটা ছবিতে কাজ করতে হয়েছে আমাকে। অভিনয়।

 নেচেছেন?

 নেচেছি, লাফিয়েছি, কথাও বলেছি।

লাফিয়েছেন? কথাটা ধরল মুসা। তারমানে ওটা সাংঘাতিক লাফ, নইলে সিনেমায় নিতে যাবে কেন?

তা বলতে পারো।

আপনার নামটাই কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়নি এখনও, কিশোর বলল।

আমার নাম ওগারো। আমি একটা গায়ের মোড়ল।

ও, তারমানে সাধারণ লোক নয়। ইংরেজি জানে, গায়ের সর্দার…নিজের, মুসার আর আকামির পরিচয় দিল কিশোর।

মুসা বলে বসল, পরিচয় তো হলো, এবার আপনার লাফ দেখাবেন? শুনেছি উয়াটুসিরা অনেক উঁচুতে উঠতে পারে লাফ দিয়ে, কথাটা সত্যি?

ওগারো হাসল, সত্যি না হলে কি আর সিনেমার জন্যে ছবি তোলে?

 তা-ও তো বটে। একমুহূর্ত ভাবল মুসা, লাফ দিয়ে কত ওপরে উঠতে পারবেন আপনি?

কতটা উঠতে বলো?

আবার ভেবে নিল মুসা। কিশোরকে দেখিয়ে বলল, আমার বন্ধুর মাথার ওপর দিয়ে পেরিয়ে যেতে পারবেন?

পরামর্শটা ভাল লাগল না কিশোরের। মুসার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, ভাল করে ভেবে দেখো কি বলছ। যদি পার হতে না পারে, লাথি লাগবে আমার মুখে।

লাগবে বলা যায় না, লাগতে পারে, মুচকি হাসল মুসা।

সব শুনতে পেল ওগারো। আরেক কাজ করো বরং। কিশোর, তুমি তোমার বন্ধুকে কাঁধে নিয়ে উঠে যাও। লাফিয়ে দুজনের মাথার ওপর দিয়ে চলে যাব আমি।

হেসে ফেলল কিশোর। এগিয়ে গেল মুসার দিকে। তাকে জব্দ করতে চেয়েছিল মুসা এখন পড়েছে বেকায়দায়।

কি আর করবে মুসা, নিজের ফাঁদে নিজেই পড়েছে। কাঁধ নিচু করে দিল। তার কাঁধে উঠে বসে দুই পা ঝুলিয়ে দিল কিশোর মুসার বুকের ওপর।

কেমন লাগছে? হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

 রাগে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে উঠল মুসা।

শব্দ করে হেসে ফেলল কিশোর। তরল স্বরে বলল, মন খারাপ কোরো না। লাথি খেয়ে মরার ভয় পাচ্ছ তো? ভয় নেই, সবাইকে একদিন মরতে হবে-আগে আর পরে। তুমি না থাকলে তোমার জন্যে সত্যি খারাপ লাগবে আমার, মুসা। আহা, এতগুলো বছর একসঙ্গে ছিলাম, কত জ্বালিয়েছ আমাকে।

কিশোরের পা খামচে ধরল মুসা।

আঁউ! করে চিৎকার করে উঠল কিশোর, খামচি দিলে কেন?

যদি পড়ে যাও, সেজন্যে শক্ত করে ধরলাম।

আমি তো তোমার মাথা শক্ত করে ধরে আছি। পড়ব কেন?

হাসল মুসা। বুঝলে না? বুঝিয়ে দিলাম, এখনও মরিনি! জ্বালানো শেষ হয়নি।

গায়ের চাদর খুলে ফেলল ওগারো। তার তামাটে রঙের সুগঠিত শরীরটা দেখতে লাগছে একটা তামার স্তম্ভের মত।

দুই গোয়েন্দা ভাবল, কিছুদূর পিছিয়ে গিয়ে দৌড়ে এসে লাফ দেবে সে, হাই জাম্প যেভাবে দেয়া হয়। কিন্তু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল ওগারো। হঠাৎ করে হাঁটু ভাঁজ করে আবার সোজা করে ফেলল, শূন্যে লাফিয়ে উঠল ঘড়ির মত। মুসার মাথা ছাড়াল পা, তারপর কিশোরের। ওর মনে হলো বিশাল পা দুটো এসে বাডি মারবে মুখে। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে।

কিন্তু মাথার ওপর এক ঝলক দমকা বাতাস ছাড়া আর কিছু টের পেল না। চোখ মেলে দেখতে পেল তার পেছনে দাঁড়িয়ে হাসছে সর্দার। এতবড় একটা পরিশ্রমের পরও সামান্যতম হাঁপাচ্ছে না। চাদরটা তুলে নিয়ে আবার গায়ে পেঁচাল।

আর কিছু করতে হবে? জিজ্ঞেস করল সে।

করলে খুবই উপকার হয়, কিশোর বলল। তবে তার আগে বলে নিই, আমরা কেন এখানে এসেছি। আমরা এসেছি জন্তু-জানোয়ার ধরতে। চিড়িয়াখানা, সার্কাস, ফিল্ম কোম্পানির দরকার হয় এ সব জানোয়র। তাদের কাছে বিক্রি করব। এ ব্যাপারে আপনার সাহায্য দরকার।

জানোয়ার ধরা খুব বিপজ্জনক কাজ। একা করা কঠিন।

একা নই আমরা। তিরিশ জন লোক আছে। সবাই আফ্রিকান। আফ্রিকা চেনে ওরা, কোন্ জানোয়ার কোথায় থাকে, ওদের স্বভাব কেমন, জানে।

মাধা নাড়ল সর্দার। ওরা জানে কেবল খুন করতে। জ্যান্ত ধরতে জানে না।

কিন্তু আমার লোকেরা শিখে ফেলেছে। কয়েক মাস ধরে আমাদের সঙ্গে আছে ওরা। অনেক জানোয়ার ধরেছি-জিরাফ, মোষ, হায়েনা, চিতাবাঘ, বেবুন, জলহস্তী, অজগর সাপ, দাঁতালো শুয়োর, বুশ-বেবি, হানি ব্যাজার, আরও অনেক কিছু।

ও, তাহলে তো অনেকই এগিয়েছ। নিয়েই ফেলেছ সব।

না, এখনও বাকি আছে। সবচেয়ে বড়টাকেই ধরা হয়নি এখনও।

হাতির কথা বলছ?  

হ্যাঁ। সাধারণ হাতি আগেই ধরতে পারতাম। তবে আমরা চাই চন্দ্ৰপাহাড়ের হাতি। বাচ্চা একটা হাতি অবশ্য চলে এসেছে আমাদের সঙ্গে। ওটার মা-কে মেরে ফেলেছে পোচাররা। হাতিটাকে বাঁচাতে গিয়ে পোচারদের মার খেয়ে আহত হয়েছে আমার আরেক বন্ধু রবিন মিলফোর্ড। অবস্থা এতটাই খারাপ, ফিরতি প্লেনেই দেশে, অর্থাৎ আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি তাকে। আমার বন্ধু মুসা মরা হাতির বাচ্চাটাকে সান্তনা দিতে গিয়েছিল। বাচ্চাটা চলে এসেছে তার সঙ্গে। নেওটা হয়ে গেছে। খাঁচার বাইরে থাকলে মুসাকে ছেড়ে এক পা নড়বে না।

হাসল সর্দার। কিন্তু এখানকার হাতি তো ধরতে পারবে না।

 কেন পারব না?

এগুলো অনেক বড়, অনেক শক্তি গায়ে। চন্দ্ৰপাহাড়ের হাতির মত শক্তিশালী আর কোন জানোয়ার পৃথিবীতে নেই। কারণ ওরা পাহাড়।

এই প্রথম লোকটার চোখে ভয় দেখতে পেল কিশোর। জিজ্ঞেস করল, পাহাড়ের মত বড় বলতে চাচ্ছেন তো?

না, আসল পাহাড়ই বলতে চাইছি।

সচল কুয়াশায় ডুবছে-ভাসছে যেন পেছনের আর আশপাশের পাহাড়গুলো।

সাধারণ জায়গা মনে কোরো না এটাকে, সর্দার বলল, জাদুর ছড়াছড়ি এখানে। চেহারা দেখে এখানে জিনিস চেনা মুশকিল। খালি চোখে যা দেখা যায়, আসলে সেটা সে-জিনিস নয়, অন্য কিছু। মস্ত ধোকা। আমাকে পাগল ভাবছ তো? বোকা ভাবছ? কোনটাই আমি নই। আমাদের ওঝারাও বোকা নয়। তাদের কথা বিশ্বাস করি আমরা। এই ভূমি হাতিদের পবিত্র স্থান। কুয়াশায় ঢেকে দেয় পাহাড়-পর্বত, হঠাৎ দেখবে একটা হাতি দাঁড়িয়ে আছে তোমার সামনে। পরক্ষণেই নেই, সেখানে আবার পাহাড়। দেখলে কে অবিশ্বাস করবে হাতি আর পাহাড় এক নয়? সুতরাং বুঝতেই পারছ, হাতির সঙ্গে লাগতে যাওয়া আর পর্বতের বিরুদ্ধে লড়াই করা এখানে একই কথা।

আজব বিশ্বাস, ভাবল কিশোর। অনবরত পাক খেয়ে ঘুরে মরছে যেন কুয়াশার স্তর, তার মধ্যে দানবীয় ফুল, অজগর সাপের মত মোটা মোটা লতাগুলোকে কেমন অপার্থিব লাগছে। আপনি বলতে চাইছেন হাতি যদি ধরেও ফেলি, ওটা পরে পাহাড় হয়ে যাবে?

তা বলছি না। বিদেশী মানুষের জাদু আমাদের জাদুর চেয়ে অন্য রকমও হতে পারে। আমি বলছি, হাতি ধরায় আমাকে সাহায্য করার অনুরোধ কোরো না। উয়াটুসিরা অসহায়।

বেশ, হাতি ধরতে না হয় না-ই গেলেন। কিন্তু আরও সাহায্য করতে পারেন আমাদের। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে গুজগুজ, ফিসফাস করছে কুলিরা। এগোতে সাহস পাচ্ছে না ওরা। একটু বোঝাবেন ওদের? বলবেন, সামনে কোন বিপদ নেই?

কিন্তু বিপদ নেই এ কথা তো বলতে পারি না। হাতির পেছনে লাগলে অবশ্যই আছে। সোজা গিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢুকবে। এগিয়ে এসে পিষে মারবে তোমাকে পর্বত। ওগুলোর মধ্যে যে দুষ্ট প্রেতেরা বাস করে, হাত তুলে আশপাশের দানবীয় উদ্ভিদগুলোকে দেখাল সর্দার, ওরা চোখের পলকে বুনো জানোয়ার হয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলবে তোমাদের।

ওগারোর কুসংস্কার দেখে মনে মনে হাসল কিশোর, তবে মুখে সেটা প্রকাশ করল না। বলল, সেই ভাবনা আমাদের। বেশ, সামনে বিপদ নেই, একথাও নাহয় না বললেন। সামনে যে তাঁবু ফেলার নিরাপদ জায়গা আছে এটা বলতে নিশ্চয় আপত্তি নেই?।

না, তা নেই, এ কথা খুশি হয়েই বলতে পারি। আমার গায়েই থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি তোমাদের। বেশি দূরে নয়। তোমার আর সব লোক কোথায়? এখানে তো মাত্র বারোজন?

এটা স্কাউটিং পার্টি, কিশোর জানাল। আগে আগে হেঁটে চলে এসেছি আমরা, পথঘাট চিনে নেয়ার জন্যে। মোটর চলার রাস্তা আছে কিনা দেখে গিয়ে ওদেরকে খবর দিলে ওরা আসবে। জীপ আর ট্রাক নিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় অপেক্ষা করছে ওরা। খবর পেলেই রওনা হবে। এখন আপনি আমাদের সাহায্য না করলে সব ভজকট হয়ে যাবে।

দেখি, কি করতে পারি, বলে ভয়ে কুঁকড়ে থাকা কুলিদের দিকে এগোল ওগারো।

মন দিয়ে সর্দারের কথা শুনল লোকগুলো। তার গায়ে ওদেরকে থাকতে দেয়া হবে জেনে মুহূর্তে খুশি হয়ে উঠল ওরা, ভয় কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হলো চোখমুখ। আনন্দে হুল্লোড় করে উঠল।

আবার এগিয়ে চলল দলটা। নানা রকম দানবীয় উদ্ভিদের অভাব নেই পথের পাশে, কিন্তু এখন ভয় কেটে গেছে কুলিদের। তবে গাছগুলোর কাছ থেকে দূরে থাকছে যতটা সম্ভব। মানুষ সমান উঁচু বিছুটির রোয়াগুলো বড় বড় কাঁটার মত, সুচের মত তীক্ষ্ণ। তাড়াহুড়ো করে এগোতে গিয়ে এই কাঁটার খোঁচা খেলো মুসা। বুশ জ্যাকেট আর সাফারি ট্রাউজারের মত ভারি কাপড়ও অতি সহজেই ভেদ করে চামড়ায় ফুটে গেল কাঁটা। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল সে।

পথের ওপর পড়ে থাকা বিছুটির একটা ভাঙা ডাল তুলে নিয়ে কাঁটাগুলো পরীক্ষা করে কিশোর বলল, এতে লাগলে গাড়ির চাকাও ফুটো হয়ে যাবে! সাংঘাতিক শক্ত!

এগিয়ে গিয়েছিল সর্দার। গোলমাল কিসের দেখার জন্যে ফিরে এল। মুসার হাতের আঁচড় থেকে রক্ত বেরোতে দেখে আন্দাজ করে ফেলল কি হয়েছে। গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, হবেই। চিতাবাঘের নখ ধারালই হয়।

চিতাবাঘ পেলেন কোথায়? অবাক হয়ে বলল মুসা, এ তো কাটা!

চিতাবাঘ যখন মরে যায়, এই গাছ হয়ে যায়। আবার গাছ মরে গিয়ে চিতাবাঘ হয়।

সর্দারের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। ইংরেজি জানা বুদ্ধিমান একজন মানুষের এরকম অদ্ভুত বিশ্বাস জন্মায় ভাবতে অবাক লাগে। সব গাছপালাই কি নানা রকম জানোয়ার?

না, সব জানোয়ার নয়। কিছু কিছু গাছ আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মা।

তাহলে নিশ্চয় ওসব গাছকে ভয় করার কিছু নেই। আপনার পূর্বপুরুষরা নিশ্চয় সব ভালমানুষ ছিলেন?

তা ছিলেন। ভাল এবং দয়ালু। কিন্তু মরার পর খারাপ হয়ে গেছে। খারাপ এবং নিষ্ঠুর।

কেন এ রকম হলো?

কারণ ওদেরকে খাবার দিই না আমরা। দিতে পারি না। অনেক বেশি লোক। কত দেব? যাকে দিতে পারি না, সে-ই আমাদের শত্রু হয়ে যায়, রেগে গিয়ে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। ধারাল নখওয়ালা জানোয়ার হয়ে ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে, বিষাক্ত রস খাইয়ে আমাদের অসুস্থ করে ফেলে, গায়ের ওপর পড়ে পিষে মারে।

সর্দারের কথাকে সত্য প্রমাণ করার জন্যেই যেন গাছ থেকে ঝরে পড়ল একটা বিশাল লবেলিয়া ফুল। লাফ দিয়ে সরে গেল নিচে যে লোকটা ছিল সে। গায়ে পড়লে মরত।

ফুলটা ভাল করে দেখল কিশোর। নীল রঙের পাপড়িগুলো যেন একেকটা ইস্পাতের পাত। দশ-বারো বছরের একটা ছেলের সমান বড় ফুলটা এত ভারি, টেনে তুলতেই কষ্ট হয়।

চমৎকার নমুনা, বলে আকামির দিকে ফিরল কিশোর। দু-জন লোককে আসতে বলো তো, তুলে নিক।

হাত তুলল সর্দার। না না, নিয়ো না, আমার কথা শোনো। থাক এখানেই। এটা সঙ্গে নেয়ার মানে মৃত্যুকে বহন করা। দু-জন মানুষ হারাতে না চাইলে এ কাজ কোরো না।

ফিসফিস করে বন্ধুকে বলল মুসা, লোকটা পাগল। এসো, আমরা দুজনেই বয়ে নিই।

না, মাইন্ড করে বসতে পারে। তাহলে বেকায়দায় পড়ব আমরা। ও এখানকার সর্দার, ভুলে যেয়ো না।

পিপার মত ফুলটাকে ঠেলে রাস্তার ওপর থেকে সরিয়ে দিল কিশোর। থাক এখানে। পরে এসে নেব।

গায়ের দিকে এগোতে এগোতে আরও নানারকম অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল ওদের। মাটিতে চার ফুট উঁচু হয়ে জন্মে থাকা শ্যাওলার পাশাপাশি গাছের গায়ে আঠারো ফুট পুরু হয়ে জন্মেছে আরেক ধরনের শ্যাওলা। ওগুলোর মধ্যে গর্ত করে বাসা বেঁধেছে পেঁচা। কোন কোন জায়গায় এমন করে ঢেকে ফেলেছে, মূল গাছটাকেই আর দেখা যায় না, মনে হয় শ্যাওলার বড় বড় স্তম্ভ। সেইসব স্তম্ভকে আবার ছেয়ে রেখেছে অপূর্ব সব অর্কিড, কি তাদের রঙ-লাল, গোলাপী, নীল, সবুজ! রামধনুর সাতরঙের ছড়াছড়ি এখানে।

সামনে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল জঙ্গল। ওখানে ঘাসের রাজত্ব। আর ঘাসও বটে! মানুষের মাথা ছাড়িয়ে যায়।

তারপর আবার বদলে গেল দৃশ্য। কলাবাগানে ঢুকল ওরা। কলাগাছ না বলে তালগাছ বলাই ভাল, আর কলাগুলোকে কলা না বলে শসা। এত বড়।

মাটিতে পড়ে থাকা একটা কলা তুলে নিয়ে ছুরি দিয়ে কেটে অবাক হয়ে গেল মুসা। কিছু নেই ভেতরে, কেবল বড় বড় বীচি। শসটা কি হয়েছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, বেশিদিন পড়ে থাকলে খোসার ভেতরেই শাঁসটা নষ্ট হয়ে যায়।

আরও এগোতে মানুষের কলরব শোনা গেল। বোঝা গেল, গায়ের কাছে চলে এসেছে।

গাঁয়ে ঢোকার মুখে পথের পাশে একটা বিরাট ঘর। ফুলে ফুলে ঢাকা। ভেতরে তাকে তাকে সাজানো রয়েছে ফল, শস্য, আর মাংস।

এটা কি? সর্দারকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

দুষ্ট প্রেতের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্যে এই ব্যবস্থা। খাইয়ে-দাইয়ে ওদের। পেট ভরিয়ে রাখতে পারলে মানুষের দিকে আর নজর দেবে না।

কাজ হয় এতে?

সব সময় হয় না, স্বীকার করল সর্দার। এত কিছু দেয়ার পরেও গাঁয়ে ঢোকে। নিয়ে আসে রোগ-শোক, আমাদের গরু ছাগল চুরি করে নিয়ে যায়। এ সব করতে করতে সাহস এতটাই বেড়ে গেছে, কিছুদিন ধরে আমাদের ছেলেমেয়েদেরও ধরে নিতে আরম্ভ করেছে। রাতের বেলা রহস্যজনক ভাবে হারিয়ে যায় ছেলেমেয়েগুলো। পরদিন সকালে পাহাড়, জঙ্গল আঁতিপাতি করে খুঁজেও ওদের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। একবার গেলে ফেরে না আর কখনও।

বিষণ্ণ দেখাল সর্দারকে। আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী জাদুও এখানে বিফল হয়েছে। কি করব বুঝতে পারি না। যাই হোক, আমাদের যন্ত্রণার কথা বলে। তোমাদের মন খারাপ করতে চাই না। এসো, আমাদের গায়ে স্বাগতম।

আফ্রিকার অন্যান্য গাঁয়ের চেয়ে ওগারোর গ্রাম অনেক বেশি সুন্দর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে করে রাখা হয়েছে। শক্ত, মোটা শ্যাওলা দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে কুঁড়েগুলোর; কাঠামোে আর খুঁটি বাঁশের তৈরি। বাঁধা হয়েছে লিয়ানা লতা দিয়ে। পেপিরাসের উঁটি দিয়ে চাল ছাওয়া হয়েছে-প্রাচীন মিশরীয়রা যে জিনিস দিয়ে কাগজ বানাত, সেই একই জিনিস। তালপাতা দিয়ে তৈরি চালার চেয়ে এ চালা অনেক বেশি টেকসই। চালার নিচের দিকটা অনেকখানি করে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে, যাতে বেড়াগুলোতে বৃষ্টির পানি না লাগতে পারে।

কিন্তু ঘরবাড়ির চেয়ে গাঁয়ের মানুষের প্রতিই বেশি কৌতূহল আর আগ্রহ কিশোর-মুসার। সাত ফুটের বেশি লম্বা নারী-পুরুষ এগিয়ে এল তাদের সঙ্গে মমালাকাত করার জন্যে। গায়ের সাদা চাদরের কারণে মার্বেলের স্তম্ভ বলে মনে হচ্ছে ওদেরকে। মেহমানদের ঘিরে ফেলল ওরা।

নিজের ভাষায় আগন্তকদের পরিচয় গ্রামবাসীদের জানাল সর্দার।

ওগারোর মতই সহজ-সরল গ্রামের মানুষগুলো। হাসিমুখে মেহমানদের অভ্যর্থনা করল।

.

০৪.

 একটা ব্যাপার লক্ষ করল কিশোর, গায়ের সব মানুষ সাত ফুট উঁচু নয়।

ওদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করছে অনেক খুদে খুদে মানুষ, যাদের গায়ে সাদা চাদর নেই, শুধু কোমরের কাছে একটুকরো গাছের বাকল বাধা। ওটাই ওদের নেংটি। উয়াটুসিদের মত তামাটে নয় এদের গায়ের রঙ, কুচকুচে কালো।

সবচেয়ে জিব ব্যাপারটা হলো, ওদের উচ্চতা। তিন থেকে চার ফুট, তার বেশি নয়। অথচ সবাই প্রাপ্তবয়স্ক।

এ তো মনে হচ্ছে গালিভারের গল্পের দেশে চলে এলাম! অবাক হয়ে বলল মুসা। ব্ৰবডিংনাগ আর লিলিপুট, দু-জাতের একসঙ্গে বসবাস। একদল দৈত্য, আরেক দল বামন। কি করে সম্ভব হলো এটা?

বামনরা হলো পিগমি, কিশোর বলল। কঙ্গোর এই এলাকার অনেক বিস্ময়ের একটা এই বিস্ময়। একই জায়গায় যেমন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষের বাস, পাশাপাশি বাস পৃথিবীর সবচেয়ে খুদে মানুষদেরও-উয়াটুসি এবং পিগমি। উয়াটুসিদের কুঁড়ের পেছনে ওই যে ওইখানে মৌচাকের মত খুপরিশুলো দেখছ, ওগুলো পিগমিদের বাড়িঘর।

ওদের কথা শুনছিল সর্দার। বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। গাঁয়ের একটা অংশে পিগমিরা থাকে। ওরা আমাদের চাকর। তবে ওদেরকে অসম্মান কিংবা অপমান করার কোন কারণ নেই। ওদের সর্দারের সঙ্গে দেখা হয়েছে? ওর নাম হিব।

নাম ধরে ডাকতেই বড় পুতুলের আকারের একজন মানুষ বেরিয়ে এল ভিড়ের মধ্যে থেকে। আন্তরিক ভঙ্গিতে হাত মেলাল কিশোর-মুসার সঙ্গে, অবশ্যই আফ্রিকান কায়দায়। শরীরের তুলনায় মাথাটা অস্বাভাবিক বড়। চোখের কোণে আর গলার ভাঁজ দেখেই বোঝা যায়, অনেক বয়েস তার, বুড়ো মানুষ।

উচ্চতার এই তারতম্য অদ্ভুত লাগছে কিশোরের কাছে।

কালো বনের কালো লোকটার চেহারার সঙ্গে মানুষের চেয়ে শিম্পাঞ্জীর মিলই বেশি। কিশোরকে আরও অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে কথা বলে উঠল সে, তোমাদের সাহায্য করতে পারলে খুশি হব আমরা। তোমাদের দেশের লোকেরা কথা-বলা-ছবি তুলতে এসেছিল আমাদের দেশে। তখন তোমাদের ভাষা শিখেছি।

তোমাদের দেশ বলতে আমেরিকানদের বোঝাচ্ছে হিবা। তার জানা থাকার কথা নয়, আমেরিকা থেকে এলেও কিশোর আমেরিকান নয়, বাংলাদেশী। আর মুসা তো তাদেরই দেশী, আফ্রিকান। সেসব ব্যাখ্যা করতে গেলে বাংলাদেশ আর আমেরিকা সম্পর্কে অনেক জ্ঞান দিতে হবে লোকটাকে। অত কথার মধ্যে গেল না কিশোর। হেসে বলল, আপনাদের ভাষাও যদি আমি এমন করে বলতে পারতাম, খুব ভাল হত।

সর্দার হিবা বলল, হাতি মারতে এসেছ তোমরা। আমরা তোমাদের সাহায্য করব।

পাহাড়ের সমান হাতি মারতে সাহায্য করবে এই বানরের সমান মানুষ!-হাসি পেল কিশোরের। তবে হাসল না। বলল, তাহলে তো উপকারই হয়। অবশ্য একটা ভুল করছেন, হাতি মারতে নয়, হাতি ধরতে এসেছি আমরা।

ওই একই কথা হলো, বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল হিবা। ধরার পরই তো মারা। মাংস না খেয়ে জ্যান্ত হাতি কেন ধরে নিয়ে যাবে বিদেশীরা, এটা বুঝবে না সে। তাকে বোঝানোর চেষ্টাও করল না কিশোর। ধরতে সাহায্য করলেই হয়। পরের কথা পরে।

কিশোর কি ভাবছে, আন্দাজ করে ওগারো বলল, পিগমিরা অনেক বড় হাতি শিকারি। আমরা, উয়াটুসিরা কাউকে ভয় পাই না, অথচ হাতি মারার সাহস নেই। কিন্তু পিগমিদের আছে। ওরা আমাদের চেয়েও সাহসী। তাদের জাদুর আলাদা। ক্ষমতা আছে। আমি এখনও জানি না, হাতি ধরতে পারবে কিনা তোমরা, কিন্তু যদি পারো, এই পিগমিদের সাহায্যেই পারবে।

মাথা নুইয়ে সর্দারের কথায় শ্রদ্ধা জানাল কালো বামন, বলল, হাতি ধরতে বিদেশীদেরকে সব রকম সাহায্য করব আমরা।

আশ্বাস পাওয়া গেছে। একজন কুলিকে সঙ্গে দিয়ে গাঁয়ের একজন লোক পাঠিয়ে দিল ওগারো, পাহাড়ের গোড়ায় রেখে আসা কিশোরদের বাকি দলটাকে খবর দেয়ার জন্যে।

চোদ্দটা ট্রাক, লরি, জীপ আর ল্যান্ডরোভারের সারি এসে ঢুকল গায়ের পাশের খোলা জায়গায়। ক্যাম্প করার ব্যবস্থা হলো ওখানে।

উয়াটুসিদের বড় বড় শিংওয়ালা গরুগুলো ঘাস খেতে খেতে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে লাগল একদল আজব মানুষকে।

তাঁবু খাটানো দেখতে এসেছে গাঁয়ের ছেলেমেয়েরাও। তাদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল বছর তেরো বয়েসের একটা ছেলে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল তামাটে। সুন্দর চোখ, মুখে হাসি। ভাবভঙ্গিতে বোঝা গেল, কথা বলতে চায়।

ছেলেটাকে পছন্দ হয়ে গেল মুসার। জিজ্ঞেস করল, তুমি ইংরেজি জানো?

জানি। তবে বাবার মত বলতে পারি না।

 দ্রুত তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল মুসার। জানল, ছেলেটার নাম আউরো। সর্দার ওগারোর ছেলে সে।

চমৎকার একটা হ্রদ আছে এখানে। দুপুরের পর সেটা দেখিয়ে আউরোকে জিজ্ঞেস করল মুসা, মাছ আছে এখানে?

অভাব নেই, আউরো বলল। মাছ ধরতে যেতে চাও?

 রাজি হয়ে গেল মুসা।

দৌড়ে গিয়ে বাবার কুঁড়ে থেকে পেপিরাস-আঁশের সুতোয় তৈরি দুটো ছিপ নিয়ে এল আউরো। সুতোর মাথায় কোনও প্রাণীর হাড় দিয়ে বানানো দুটো বঁড়শি বাধা। বুনো শুয়োরের চোয়ালের হাড়ে তৈরি একটা বেলচা জাতীয় জিনিসও আনল।

এটা কি জন্যে? জানতে চাইল মুসা।

 কেচো তোলার জন্যে।

 এক জায়গায় ভেজা নরম মাটি খুঁড়তে শুরু করল আউরো।

দুটো কেঁচো হলেই চলবে আমাদের, দুটো বঁড়শির দিকে তাকিয়ে বলল মুসা। চন্দ্ৰপাহাড়ের কেঁচোর আকারের কথা ভুলে গিয়েছিল।

অবাক হলো আউরো। দুটো কেন?

 দুই ছিপের জন্যে দুটো।

একটাই তো একশো বার গাঁথতে পারবে।

কথাটা বুঝল না মুসা।

ইঞ্চি ছয়েক খোঁড়ার পরই আচমকা গর্তের তলার মাটি খুঁড়ে ছিটকে বেরোল একটা বাদামী মাথা।

সাবধান, সাপ! ঝট করে পেছনে সরে গেল মুসা।

সাপ না।

মাথার পেছনে একটু নিচে যেখানে ঘাড় থাকার কথা সেখানটা চেপে ধরল আউরো। খুঁড়েই চলল মাটি, যতক্ষণ না টেনে বের করে আনতে পারল জীবটাকে। তারপর হাত লম্বা করে তুলে ধরল।

পিগমির সমান লম্বা জীবটা, মুসার কব্জির মত মোটা। মাথাটা বাদামী, শরীরটা আগুনে-লাল। হাঁ করে রেখেছে কুৎসিত মুখ। এ ছাড়া চেহারায় আর কোন বৈশিষ্ট্য নেই।

দূরে দাঁড়িয়ে ছিল কিশোর। দেখতে এগোল।

চোখও নেই, মুসা বলল, কানও নেই।

আমাদের দেশের সাধারণ কেঁচোর মতই, কিশোর বলল। কানে শোনে না, গন্ধ পায় না, স্বাদ বোঝে না। তবে অল্প অল্প দেখতে পায়।

চোখ ছাড়া কি দিয়ে দেখে?

দেখে বলা যাবে না। খুদে খুদে ইন্দ্রিয় আছে এটার, এর সাহায্যে আলো আর অন্ধকারের পার্থক্য বোঝে। দিনের বেলা মাটির নিচে থাকে, রাতে বেরোয়। তখন টর্চের আলো গায়ে ফেললেই তাড়াতাড়ি আবার গিয়ে মাটির নিচে সেঁধোবে।

দানবীয় কেঁচোর শরীরের নিচের দিকে দু-পাশে এক ধরনের খোঁচা খোঁচা জিনিস আছে।

এগুলো দিয়ে কি হয়? জিজ্ঞেস করল মুসা।

এগুলো মাটির নিচে সুড়ঙ্গ করে এগোতে সাহায্য করে কেঁচোকে।

কিন্তু সুড়ঙ্গই বা করে কি করে? খুঁড়ে ফেলা মাটি যায় কোথায়?

সেটাই তো এক বিস্ময়। শরীরের ভেতর দিয়ে পার হয়ে যায় ওই মাটি। খোঁড়া মাটি গিলে ফেলে কেঁচো, সেগুলো আবার বের করে দেয় পেছনের একটা ফুটো দিয়ে। ফলে শরীরটা এগিয়ে গেলেও মাটিতে কোন সুড়ঙ্গ রয়ে যায় না, বের হওয়া মাটিতেই ভরে যায় খোঁড়া অংশটা।

আচ্ছা, এই কেঁচোটা পুরুষ না মেয়ে?

মেয়েও, পুরুষও।

তারমানে উভয়লিঙ্গ! বাপরে বাপ! একটা সাধারণ কেঁচোর মধ্যে এত কারিগরি!

এখন বুঝলে তো, কেঁচোও সাধারণ কোন প্রাণী নয়।

হ্রদের পাড়ে একটা কলাগাছের ভেলা বাঁধা আছে। মুসাকে নিয়ে সেটাতে চড়ল আউরো। বেয়ে নিয়ে এল বেশি পানিতে। মাথা কেটে ফেলে আগেই কেঁচোটাকে মেরে ফেলেছে সে। এখন সেটাকে কেটে দুই টুকরো করে বঁড়শিতে গাঁথল।

পানিতে বঁড়শি ফেলার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টান পড়ল সুতোয়। টেনে তুলল মুসা। ক্যাটফিশের মত একটা মাছ, তবে আরও অনেক বড়।

মুসার পর পরই আউরোও ধরে ফেলল আরেকটা।

অবাক কাণ্ড! মুসা বলল, এখানকার সব কিছুই বিশাল, কেবল পিগমিরা বাদে। তোমরা, উয়াটুসিরা দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা মানুষ। এখানকার হাতিগুলো একেকটা দানব। ফুল বড়, গাছ বড়, এমনকি অতি সাধারণ একটা কেঁচো, তা-ও সাপের সমান। ব্যাপারটা কি?

আউরো কিছু বলার আগেই পেছনের পর্বত থেকে ভেসে এল বিকট আওয়াজ। গায়ে আসার পর এই শব্দ আরও শুনেছে ওরা, কিশোর বলেছে-পর্বতের গা থেকে কয়েক লক্ষ টন বরফ ভেঙে পড়ার আওয়াজ। কিন্তু উয়াটুসিদের বক্তব্য আলাদা।

আতঙ্কে গোল গোল হয়ে গেল আউরোর চোখ। তুমি বলছ আমরা বড়, কিন্তু আমাদের চেয়েও অনেক বড় সে!

সে? সে কে?  

বজ্রমানব। সবচেয়ে লম্বা গাছটার চেয়েও লম্বা সে। হেঁটে যাওয়ার সময় মাটি কাঁপে থরথর করে। কথা বলার সময় মনে হবে হাজারখানেক সিংহ গর্জন করছে। তোমরা যাকে বিদ্যুৎ চমকানো বলো, আসলে সেটা হলো তার চোখের দষ্টি-রেগে গেলে অমন করেই জ্বলতে থাকে। সেই আগুন গাছে আঘাত হানলে গাছ ভেঙে পড়ে। গাঁয়ের ওপর পড়লে ঘরবাড়ি সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সে আসে রাতের বেলা, চুপি চুপি। প্রথমে আমাদের গরু-ছাগল নিয়ে যেত। এখন মানুষও ধরে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা নামলে আসে, ভোরের আগেই চলে যায়।

অতই যদি শক্তিশালী, চোরের মত আসে কেন?

তা বলতে পারব না।

 আসলে সে ভীতু। নয়তো অন্যায় কিছু করে। সেজন্যেই চুপি চুপি আসে।

ওরকম করে বোলো না! ভয়ে ভয়ে চারপাশে তাকাতে লাগল আউরো। বজ্রমানবকে চেনো না! তার বিরুদ্ধে কথা বললে তোমাদেরও ছাড়বে না। তোমাদের মারবে, তোমাদের জন্ত-জানোয়ার সব কেড়ে নেবে।

হ্রদের একপাশে গ্রাম। অন্য পাশে পানিতে নেমে এসেছে বন। গাছের নিচে কালো ছায়া।

অন্ধকার হয়ে আসছে, আউরো বলল। বাড়ি চলে যাওয়া উচিত।

লগি বেয়ে ভেলাটাকে তীরে নিয়ে এল ওরা। মাছ দুটো এবং বাকি কেঁচোর পুরোটাই মুসাকে দিয়ে দিতে চাইল আউরো।

মুসা জিজ্ঞেস করল, কেঁচো দিয়ে কি করব?

 রান্না করে খাবে। খুব স্বাদ।

ওয়াক, থুহ! বলে কি! কেঁচো আবার খায় নাকি! সাপ হলেও কথা ছিল। তোমরা সাপ খাও?

খাব না কেন? সাপের মাংস খুব ভাল, মুরগীর মাংসের চেয়ে নরম আর রসাল। কেঁচোর মাংস আরও ভাল, কারণ এগুলোর হাড় নেই।

হাড় থাকুক আর না থাকুক, খিদেয় মরে গেলেও কেঁচো খেতে পারবে না মুসা।

মাছগুলো আমি নিয়ে যাই, বলল সে, কেঁচোটা তুমিই নাও। মাছ ধরতে নিয়ে গিয়ে অনেক মজা দিলে, ধন্যবাদ তোমাকে। সকালে দেখা হবে।

তাবুতে এসে মাছ দুটো রান্না করার জন্যে বাবুর্চির হাতে দিল মুসা। খেতে বসে বজ্রমানবের কাহিনী বন্ধুকে শোনাল সে।

কেমন গাঁজা মনে হয় না? মুসা বলল।

হয়ও, আবার না-ও, বলল কিশোর। যারা বিশ্বাস করে তাদের হদ্দ বোকা বলতে পারো। তবে এটাই স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক! গাছের চেয়ে লম্বা, বস্ত্র নিক্ষেপ করে, গরু-মানুষ এ সব চুরি করে, এমন মানুষের গল্প তুমি বিশ্বাস করো!

আমি না করলেও দুনিয়ার অনেকেই এ ধরনের আজগুবী গল্প বিশ্বাস করে, বিশেষ করে বনের লোকেরা। আমাদের মত তো সভ্য জগতে বাস করে না ওরা, স্কুলে লেখাপড়া শেখার সুযোগ পায় না। বজ্রপাত, ভূমিকম্প, বন্যা, এ সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ কেন ঘটে, তার বৈজ্ঞানিক কারণ জানে না। কুসংস্কার থাকবেই ওদের। তাই ওদের বিশ্বাস এসব ঘটানোর মূলে থাকে দুটো শক্তি-হয় দেবতা, নয়তো শয়তান। এই গাঁয়ে গরু-ছাগল হারাচ্ছে, ছেলেমেয়ে নিরুদ্দেশ হচ্ছে, ভয় ওরা পাবেই। আমারই তো চিন্তা হচ্ছে।

তার মানে বজ্রমানবের গল্পটা তুমি বিশ্বাস করছ?

ওরা যে ভাবে করছে সেভাবে করি না। আমার ধারণা গরু-ছাগল চুরি এবং বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পেছনে মানুষের হাত আছে। আজ রাতে পাহারার ব্যবস্থা করব। আমাদের জানোয়ারগুলোও নিতে আসতে পারে। গরু-ছাগলের চেয়ে দাম অনেক বেশি ওগুলোর।

দলের সবচেয়ে বিশ্বাসী দু-জন লোক আকামি আর মুংগাকে পাহারায় নিয়োজিত করল কিশোর।

আমি জানি তোমরা খুব ক্লান্ত, ওদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলল সে। সারাটা দিন কঠোর পরিশ্রম করেছ। কিন্তু জানোয়ারগুলো চুরি হয়ে গেলে এই পরিশ্রমের কোন অর্থ থাকবে না। পালা করে পাহারা দেবে তোমরা। একজন জেগে থাকলে আরেকজন ঘুমাবে।

কিশোরের কথায় প্রতিবাদ করল না ওরা।

মুংগা বলল, ভাববেন না বাওয়ানা। আমাদের অসুবিধে হবে না। আমরা বেঁচে থাকতে জানোয়ার চুরি করতে পারবে না কেউ।

চিন্তিত ভঙ্গিতে জানোয়ারের খাঁচাগুলোর দিকে তাকাল কিশোর। অগ্নিকুণ্ডের আলোয় খাঁচার জানোয়ারগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ে না। সাবধানে থাকতে হবে, নিজেকে বোঝাল সে।

মুসা দাঁড়িয়ে আছে হাতির বাচ্চার সামনে। আদর করে ওটার নাম রেখেছে খুদে দানব। কিছুতেই ভেতরে থাকতে চাইছে না ওটা, শিকের ফাঁক দিয়ে শুড় বের করে দিয়ে ওর হাত জড়িয়ে ধরে টানছে, আর হাতির ভাষায় মানব শিশুর মত আবদার করছে বের করে দেয়ার জন্যে।

হেসে তার শুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল মুসা। বলল, রাতে আর কোথায় রাখব তোকে, বল? এখানেই আরাম। আমি তো কাছেই থাকব, তুই ডাকলেই শুনতে পাব। থাক, হ্যাঁ? লক্ষ্মী ছেলে।

কিন্তু লক্ষ্মী হওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই খুদে দানবের। বেরোতে পারলে খুশি।

সারাদিন প্রচুর খাটাখাটনি গেছে। তাই তাঁবুতে ঢুকে শোয়র সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল মুসা। কিশোরেরও সময় লাগল না ঘুমাতে।

.

০৫.

ভীষণ গোলমালে চমকে ঘুম থেকে জেগে গেল ওরা। প্রচণ্ড হই-হট্টগোল!

অনেক মানুষের কণ্ঠ, মহিলাদের কান্না, বাচ্চাদের তারস্বরে চিৎকার, রেগে যাওয়া পুরুষের ধমক-সব মিলিয়ে এক এলাহি কাণ্ড।

বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে একদৌড়ে তাবুর বাইরে চলে এল মুসা। প্রথমেই খেয়াল করল, হাতির বাচ্চাটা নেই।

খাঁচার কাছে দৌড়ে এল সে। পেছনে এল কিশোর।

শূন্য খাঁচা।

সারা গায়ে তুমুল হই-চই। লম্বা, বেঁটে, দুই প্রজাতির মানুষেরাই ভীত পিঁপড়ের মত আতঙ্কে ইতস্তত ছোটাছুটি করছে।

শূন্য খাঁচাটার কাছে, দুই গোয়েন্দার পাশে এসে দাঁড়াল সর্দার ওগাররা।

হাতিটাকে নিয়ে গেছে, কিশোর বলল।

কথাটাকে গুরুত্বই দিল না সর্দার। আরও জরুরী দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে সে।

আমার ছেলেকে দেখেছ? জিজ্ঞেস করল সে। কান্নার পর্যায়ে চলে গেছে তার কণ্ঠস্বর, তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। মনে হয় নিয়ে গেছে!

আরও কয়েকজন গ্রামবাসী দৌড়ে এল দুটো গরু হারানোর খবর নিয়ে। উয়াটুসিদের কাছে মানুষের চেয়ে কম দামী নয় গরু। ভাল হলে তো কথাই নেই। কিন্তু গ্রাম থেকে আসা মহিলা কণ্ঠের বিলাপ আর কান্না গরুর জন্যে নয়। কাঁদছে। সর্দারের ছেলে আউরোর জন্যে, তার মা।

গাঁয়ের সর্দার, অবশ্যই সাধারণ লোকেদের মত হবে না। তার ঘরবাড়িও অন্যদের চেয়ে আলাদা। দরজায় তালা লাগানোর ব্যবস্থা আছে তার ঘরে। গায়ের। একমাত্র তালা। সেই ঘর থেকে আউরোকে নিয়ে যাওয়া একটা বড় রহস্য।

দরজায় তালা ছিল না? জানতে চাইল কিশোর।

নিশ্চয় ছিল, সর্দার জানাল।

তাহলে ঢুকল কি করে লোকটা?

তুমি বুঝতে পারছ না, ও মানুষ নয়, দুষ্ট প্রেত, স্বয়ং বজ্রমানব। আর প্রেতের জন্যে তালা কোন ব্যাপার নয়।

রাতে তো দু-জনকে পাহারা রেখেছিলাম, বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল মুসা। ওদের তো দেখছি না! কিডন্যাপ করে নিয়ে গেল নাকি?

আকামি আর মুংগাকে দেখেছে নাকি কুলিদের জিজ্ঞেস করল কিশোর। না, দেখেনি ওরা।

খাঁচার আশপাশের সমস্ত ঝোঁপঝাড় খুঁজে দেখা হলো। এক জায়গায় ঝোঁপের ডাল ভাঙা, দোমড়ানো। ঘাস দলিত মথিত। লড়াই হয়েছে যেন ওখানটাতে।

বনের অনেক ভেতরে ঢুকেও খোঁজা হলো।

ঘাবড়ে গেল কিশোর, দু-জন অভিজ্ঞ লোককে হারাল না তো? আকামি আর মুংগা না থাকলে এই অভিযানই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

এই সময় শোনা গেল মুসার চিৎকার, এই যে, ওরা এখানে!

দৌড়ে এল কিশোর। একটা বড় পাথরের ফাটলে পড়ে আছে দু-জন লোক। হাত-পা বাঁধা, মুখে কাপড় গোঁজা। মারধরও করা হয়েছে।

মুখের কাপড় খুলে, বাঁধন কেটে দেয়া হলো ওদের।

কি হয়েছিল? জানতে চাইল কিশোর।

লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না আকামি। কি আর বলব! মুংগা ঘুমাচ্ছিল, আমি পাহারা দিচ্ছিলাম। চোখ বন্ধ করিনি, তবে খুব ক্লান্তি লাগছিল। কাউকে আসতে দেখলাম না, শুনলামও না কিছু, হঠাৎ কে যেন মুখ চেপে ধরল। চিৎকার করার চেষ্টা করলাম। আমার মুখে কাপড় খুঁজে দেয়া হলো। ঘুমের মধ্যেই মুংগার মুখেরও কাপড় খুঁজে বেঁধে ফেলল। আমি অনেক ধস্তাধস্তি করলাম, কিন্তু ছুটতে পারলাম না। আমাকেও বেঁধে ফেলল। তারপর এখানে এনে ফেলে দিয়ে চলে গেল।

বেশি লোক?

 অনেক।

কি ধরনের মানুষ ওরা?

 দেখিনি। তবে ওরা যে কালো মানুষ নয়, এটুকু বুঝেছি। সাদাও নয় ওরা।  

কি যা-তা বলছ। ওদের দেখইনি, গায়ের রঙ বুঝলে কি করে?

গন্ধ থেকে। ওদের গায়ে রোদ আর মাটির গন্ধ নেই কালো মানুষদের মত। সাদা মানুষের মত তামাকের গন্ধও নেই। ওদের গায়ে চা আর পুদিনার গন্ধ। ওরা নাবিক, জাহাজে করে উত্তর থেকে মোমবাসায় এসেছে।

আরব! অনুমান করল কিশোর। কিন্তু আরবরা এই পার্বত্য অঞ্চলে কি করতে এসেছে?

আরবদের সম্পর্কে এ সব কথা বুঝতে পারছে না আউরো।

ওরা হলো দুষ্ট প্রেত, বলল সে। আর ওদের সর্দার হলো বজ্রমানব। ও এসেছিল?

বজ্রমানবের কথা আমি কিছু জানি না, আকামি বলল।

তার মাথা থাকে তারার দেশে। কথা বলার সময় গলা দিয়ে বজ্রের গর্জন বেরোয়, চোখের দৃষ্টিতে জ্বলে বিদ্যুতের চমক।

বজ্র বা বিদ্যুৎ কোনটাই ছিল না আমাকে যখন ধরল।

 বিজ্ঞের ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল আউরো। গলা বন্ধ করে রেখেছিল, চোখ করে ফেলেছিল অন্ধকার, যাতে আওয়াজও না হয়, আলোও দেখা না যায়। হলে যে আমরা জেগে যাব। কিন্তু ষাঁড়ের মত শক্তিশালী আর গাছের সমান লম্বা একজনকে তো নিশ্চয় দেখেছ?

অন্ধকারে ওসব কিছুই দেখিনি। তবে গায়ে মোষের জোর আছে এ কথা বলতে পারি। প্রথমে কয়েকজন চেপে ধরল আমাকে। ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলাম। তারপর দুটো হাত এসে পড়ল আমার গায়ে। পিষে ফেলতে শুরু করল। দুর্বল করতে করতে একেবারে পানি বানিয়ে দিল আমাকে। কারও হাতে এত শক্তি আর দেখিনি।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ! ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ওগারো। ওই তো বজ্ৰমানব! আমার ছেলেকে নিয়ে গেছে। আর কোনদিন তাকে পাব না। কোন মানুষ লড়াই করে পারে না বজ্রমানবের সঙ্গে।

আমরা লড়াই করব তার সঙ্গে, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করল কিশোর, এবং আমরা পারবও! আপনার ছেলেকেও ফিরিয়ে আনব, যদি সে বেঁচে থাকে। সর্দার, কিছু মনে করবেন না, আপনার ভূতের গল্প আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। গরু যে চরি করে, সে আধিভৌতিক কিছু নয়, আমার-আপনার মতই মানুষ। বাজি ধরতে পারেন আমার সঙ্গে।

মাটি পরীক্ষা করছে মুসা।

কি ধরতে চাও বলে ফেলো! হঠাৎ বলে উঠল সে। এই পায়ের ছাপগুলো দেখো আগে। তারপর বুঝবে মানুষ কিনা!

কাদামাটিতে বসে গেছে খালি পায়ের ছাপ, স্বাভাবিক আকারের নয় সেগুলো। আশেপাশে বড় আকারের বুটের ছাপও বসে গেছে গম্ভীর হয়ে।

দেখে মিইয়ে গেল কিশোর। একটু আগে যা বলেছে সেগুলোকে এখন বড় বড় কথা বলে মনে হতে লাগল। মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে যেন টেনে নিয়ে যাওয়া হলো ভয়ের সরু একটা সুতো। আরও নিশ্চিত হয়ে গেছে, কিডন্যাপাররা অবাস্তব কিছু নয়। তবে সাধারণ মানুষও নয়। এতবড় জুতো যে পরে, সেই মানুষটা কত বড়! ওজনও নিশ্চয় অনেক। আর সেই ওজন চর্বির নয়, মাংসপেশীর। ভয়াবহ সেই শক্তির নমুনা কিছুটা পেয়েছে আকামি।

শুধু গায়ের জোরই নয়, আরও নানা রকম ক্ষমতা আছে দৈত্যটার। এতবড় শরীর নিয়ে নিঃশব্দে হাজির হয়ে যেতে পারে, আকামির মত শক্তিশালী মানুষকে সহজে কাবু করে ফেলে, তালা খুলতে পারে, সামান্যতম শব্দ না করে চুরি করতে পারে একটা তেরো বছরের ছেলেকে, গরু চুরি করে; সবচেয়ে বড় কথা, একটা হাতির বাচ্চাকে খেদিয়ে নিয়ে চলে গেল, কেউ টেরও পেল না। অচেনা কেউ ধরতে এলে ভীষণ চেঁচামেচি করে হাতির বাচ্চা। তার মানে এই লোকটা হাতির ব্যাপারে অভিজ্ঞ।

অস্বস্তিটা মুখের ভাবে কিংবা আচরণে প্রকাশ পেতে দিল না কিশোর।

বড় বড় বুটের ছাপ থাকায় সুবিধেই হয়েছে, বলল সে। অনুসরণ করা যাবে। নাস্তা খেয়েই বেরিয়ে পড়ব আমরা।

বিশ মিনিট পর দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল কিশোর-মুসা। এগিয়ে চলল বুট ও হাতির পায়ের ছাপ অনুসরণ করে। সঙ্গে কয়েকজন কুলি, আর অবশ্যই আকামি ও মুংগা। কয়েকজন অতি উৎসাহী গ্রামবাসীও আসতে চেয়েছিল। বাধা। দিয়েছে সর্দার ওগারো।

মরতে চাও? হুঁশিয়ার করেছে সে। বজ্ৰমানবকে রাগিয়ে দিয়ে আমাদের সবাইকে মারতে চাও? এক হাতে টিপে এই গ্রামটা ভর্তা করে দিতে পারে সে। আউরো তো আমারই ছেলে, আমারও যেতে ইচ্ছে করছে; কিন্তু আমি শুধু বাবাই। নই, আমি এ গাঁয়ের সর্দারও, সবার ভালমন্দ দেখার ভার আমার ওপর।

শুরুতে অনুসরণ বেশ সহজ হলো। মানুষের ছাপ যেখানে চোখে পড়ল না সেখানেও হাতির পায়ের বড় গোল গোল গভীর ছাপ পরিষ্কার দেখা গেল। দুনিয়ার আর কোন জানোয়ারই এত স্পষ্ট পায়ের ছাপ রেখে যায় না।

একেবারেই তো সহজ, হেসে উঠল মুসা। এই আরবগুলো ততটা চালাক নয়। শীঘ্রি দেখা পেয়ে যাব। তারপর বোঝাব মজা।

কিশোর কিছু বলল না। গভীর ভাবে পরীক্ষা করছে মানুষের পায়ের ছাপগুলো। আকামিকে জিজ্ঞেস করল, কয়জন মানুষ মনে হয় তোমার?

বারো…বড়জোর পনেরো।

আর আমাদের তিরিশ, সন্তুষ্ট হয়ে বলল মুসা। ব্যাটাদের খতম করে দেয়া কোন ব্যাপারই না।

কিন্তু ক্যাম্পে আরও লোক থাকতে পারে, কিশোর বলল। কথা হলো, এত স্পষ্ট ছাপ রেখে যাচ্ছে, এটা কি জানে না ওরা? নিজের প্রশ্নের জবাব নিজেই দিল, নিশ্চয় জানে। বেশিক্ষণ আর অতটা সহজ থাকবে না। কোথাও না কোথাও কোন চালাকি খাটাবে। তোমরা সব সাবধানে থাকো, চোখকান খোলা রাখো।

সামনে বুনো ফুলের একটা বন, গাছগুলো ওদের মাথার চেয়ে উঁচু। ডালগুলো এত মোটা, ফুলগাছের বলে মনে হয় না। বিশাল মোমবাতির মত লাগছে খাড়া হয়ে থাকা বিশ ফুট উঁচু লবেলিয়াকে। চূড়ার কাছে ছড়িয়ে থাকা কুঁড়ির দিকে তাকালে মনে হয় আগুন লেগেছে ওখানে।

ফুলবন পেরোতেই বদলে গেল বনের চেহারা, শুরু হলো বাঁশঝাড়। অনেক উঁচুতে চোখা চোখা বাঁশপাতায় তৈরি চাঁদোয়াকে নীল আকাশের পটভূমিতে অনেক বেশি সবুজ লাগছে। কুয়াশার কারণে সব সময় ভিজে থাকে পাতা, ভেজা মাটিতে ঝরে পড়ে মুক্তোর মত পানির ফোঁটা টুপটাপ, টুপটাপ। বাঁশগুলোও স্বাভাবিকের চেয়ে মোটা, থামের মত।

এতটা বড় হতে নিশ্চয় অনেক সময় লাগে, মুসা বলল।

মোটেও না, মাথা নেড়ে বলল কিশোর, বাড়া দেখলে অবাক হবে। এক মিনিটের জন্যে এখানে মাটি শুকাতে পারে না। ফলে খেয়ে না খেয়ে বাড়তে থাকে। বাঁশ। দুই মাসেই একশো ফুট লম্বা হয়ে যায়। আমি বানিয়ে বলছি না।

মুসার চোখে অবিশ্বাস দেখে হাসল সে। অন্য গাছ বড় হতে যত সময় লাগে, তারচেয়ে অনেক কম সময় লাগে বাঁশ বড় হতে, খুব দ্রুত বাড়ে। কিন্তু এখানে যে হারে বাড়ে, তাকে বলতে হয় তীব্র গতি, কিংবা ঝড়ের গতি।

এত লম্বা বাঁশের বয়েস মাত্র দুই মাস! আমি বিশ্বাস করি না।

না করলেও ব্যাপারটা সত্যি। আর বড় হবে?

না, একশো ফুটই শেষ। এরপর কি ঘটবে?

ফুল ফুটবে। মাত্র একবার। তারপর মারা যাবে। ফুল থেকে যে বীজ ঝরবে সেগুলো থেকে নতুন চারা গজাবে। ওই যে দেখো একটা নতুন চারা, সবে গজানো শুরু হয়েছে।

মানুষের উরুর সমান মোটা ফুটখানেক উঁচু একটা বাঁশের চারার দিকে তাকাল মুসা।

কাল দিনের বেলায়ও এটা ছিল না এখানে, কিশোর বলল। রাতারাতি গজিয়ে গেছে।

কি করে জানলে?

পত্রিকা আর বই পড়ে। বৈজ্ঞানিক অভিযান চালানো হয়েছে এদিকটায়। অনেক মাপামাপি করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রথম কয়েক সপ্তাহ বাঁশের চারা চব্বিশ ঘণ্টায় দুই ফুট করে বাড়ে। আস্তে আস্তে কমে আসে বাড়ার এই হার। তবে অনেক চারাই কমার সুযোগ পায় না।

কেন?

জন্তু-জানোয়ারে খেয়ে ফেলে। খেতে খুব ভাল, নরম, রসাল।

আমি তো জানতাম বাঁশ শুধু মানুষে খায়। চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায় বাঁশের তরকারি।

উয়াটুসি আর পিগমিরাও পছন্দ করে। গরিলার তো খুব প্রিয় খাবার। দেখো, গরিলারা ঘুরে গেছে এখান থেকে।

ভেজা নরম মাটিতে স্পষ্ট দেখা গেল গরিলার পায়ের ছাপ। মানুষের খানি পায়ের ছাপের মতই দেখতে। তবে আকারে অনেক বড়, এর পাশে পূর্ণবয়স্ক মানুষের পায়ের ছাপকে মনে হবে শিশুর পায়ের মত।

এত গভীর কেন? জানতে চাইল মুসা।

হবে না, যা ভারির ভারি। একটা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ গরিলার ওজন হয় সাতশো পাউন্ড, বড় একজন মানুষের চারগুণ।

গেল তো এখান দিয়েই, বাঁশের এই চারাটাকে খেলো না কেন?

এটা গজানোর আগেই হয়তো গেছে। যত দূরে চলে যায় ততই ভাল। রোমশ ওই ভদ্রলোকদের সঙ্গে মোলাকাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার।

কেন, ভয় পাচ্ছ?

না পাওয়ার কোন কারণ আছে? আদর করে যদি তোমার গায়ে হাত ছোঁয়ায়। তাহলেই চিত হয়ে যাবে। চারপাশে তাকাল কিশোর। আল্লাই জানে, কাছাকাছি আছে কিনা! দেখছে কিনা এখন আমাদের!

অত ভয় পাচ্ছ কেন? হামলা চালাবে নাকি?

গরিলার মেজাজ-মর্জির কোন ঠিক ঠিকানা নেই। চালাতেও পারে।

বিরক্ত না করলেও মারতে আসবে? কোন জানোয়ারই নাকি বিরক্ত না হলে মানুষকে আক্রমণ করে না?

তা করে না। কিন্তু কিসে যে গরিলাকে বিরক্ত করবে, সেটা বলাই মুশকিল।

এগিয়ে গেছে আকামি আর মুংগা। বাশের আড়ালে হারিয়ে গেছে। ওদেরকে ধরার জন্যে তাড়াতাড়ি এগোল দু-জনে।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশে কালো মেঘ। অন্ধকার কেমন নিঃসঙ্গ আর বিষণ্ণ করে তুলেছে বনতল। ভারি, এক ধরনের চাপা ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে এল হঠাৎ। ঝট করে শব্দের দিকে ফিরে তাকাল দু-জনে।

গরিলার বাসা আছে এখানে! নিচু স্বরে বলল কিশোর।

কিন্তু বাসাটা পাওয়া গেলেও তার মধ্যে গরিলা দেখা গেল না। দুই ফুট উঁচু করে গাছের ডালপাতা আর ঘাস বিছিয়ে একটা গদিমত তৈরি করা হয়েছে। গরিলার বিছানা।

আমি তো জানতাম গাছে থাকে ওরা, মুসা বলল।

গাছে চড়তে পারে, তবে রাতে ডালে থাকতে চায় না। এত ভারি শরীরের ভারে ডাল ভেঙে পড়ার ভয়ে বেশি ওপরেও উঠতে চায় না। বড়গুলো তো মাটি ছেড়ে নড়েই না।

বিড়বিড়, ফিসফাস, ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে কথা বলছে যেন অনেক মানুষ। এগিয়ে আসছে কমে। কিসের শব্দ, আন্দাজ করতে পারছে না মুসা। তবে শব্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর আগে পেট নিয়ে ঘামানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল সে। সামনে আবছা অন্ধকারে একটা বাঁশের কোঁড় গজিয়ে ঢাকতে দেখল। হাতের কাছে আর কোন খাবার নেই দেখে ছুরি বের করে নিয়ে এগোল কেটে নেয়ার জন্যে। ভাবল, গরিলারা যদি খেতে পারে, সে পারবে না কেন?

Super User