১৩.

জবারের বাড়ি যাওয়ার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল কিশোর। ইনফরমেশন থেকে ঠিকানা জোগাড় করেছে। কিন্তু রবিন বলল আগে মারলাকে দেখতে যাওয়া দরকার। পার্কের মীটিং থেকে যাওয়ার সময় ওর মনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল।

মারলাদের বাড়ির সামনে পৌঁছে কিশোরকে গাড়িতে বসতে বলে, দেখতে চলল রবিন। মারলার ঘরের একটামাত্র জানালায় আলো জ্বলছে। বাকি পুরো বাড়িটাই অন্ধকার। বারোটা বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। ভেজানো দরজা ঠেলে উঁকি দিল রবিন।

চিত হয়ে শুয়ে আছে মারলা। মৃদু শব্দে মিউজিক বাজছে। রবিনের সাড়া পেয়ে ফিরে তাকাল। চোখ কেমন ঘোর লাগা, লাল টকটকে। মাথার কাছের টেবিলে রাখা একটা আধখাওয়া মদের বোতল। অবাক হলো রবিন। মারলা তো মদ খায় না!

রবিন, বিড়বিড় করল মারলা, তুমি নাকি?

কেন দেখতে পাচ্ছ না? এগিয়ে গিয়ে বিছানার কাছে দাঁড়াল রবিন। কি। হয়েছে তোমার?

ছাতের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মারলা। কি হয়েছে? কিছুই না। খুব ভাল আছি আমি। ড্যানির যা অবশিষ্ট আছে, কাল নিয়ে আসবে। ওর মা আমাকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন, একটা বাক্স কিনে নিয়ে যেতে পারব কিনা। ভাবতে পারো? দুই হপ্তা আগে রাস্তায় দেখে জোর করে বাজারে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে, পছন্দ করে ড্যানিকে একটা প্যান্ট কিনে দেয়ার জন্যে। কাঁদতে শুরু করল সে। কথা জড়িয়ে গেল। আর এখন এল কফিন কিনে দেয়ার অনুরোধ।

ওর বাহুতে হাত রাখল রবিন। ড্যানির জন্যে তোমার চেয়ে কষ্ট আমার কম হচ্ছে না, মারলা। ও আমার বন্ধু ছিল। তত্ত্বাবধায়কের শয়তানি আমরা বন্ধ করবই। প্রতিশোধ নেব। কিশোর আর আমি অনেকখানি এগিয়ে গেছি। মরুভূমিতে পড়ে থাকা লোকটার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এলাম

কোন আগ্রহ বোধ করল না মারলা। তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে লেগে সুবিধে করতে পারব না আমরা। বরং যা করতে বলে করে ওর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া উচিত।

না, ওর কথা শুনব না আমরা।

শোনাই উচিত! নইলে সোফি আর ড্যানির অবস্থা হবে। বাঁচতে হলে ওর কথা শুনতেই হবে, ব্যথায় ককিয়ে উঠল মারলা। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। বোতলটার দিকে বাঁ হাত বাড়াল, যদিও ডান হাত দিয়েই নেয়ার সুবিধে বেশি।

টান দিয়ে বোতলটা সরিয়ে ফেলল রবিন। অনেক খেয়েছ। ঘুমাও। এখন। কাল সকালে এসে দেখে যাব আবার।

বোতলটা দেয়ার জন্যে অনুরোধ করতে লাগল মারলা। নিজে উঠে রবিনের হাত থেকে কেড়ে নেয়ারও যেন শক্তি নেই। বাঁ হাতটা আরও বাড়িয়ে দিয়ে বলল, দাও, প্লীজ!

বারবার বা হাত বাড়াতে দেখে অবাক হলো রবিন। সন্দেহ হলো ওর। একটানে মারলার গায়ের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে ফেলল।

মারলার ডান হাতে ব্যান্ডেজ বাধা। আনাড়ি হাতে বেঁধেছে। রক্তে ভিজে গেছে। রক্ত লেগে গেছে হাতটা বিছানার যেখানে ফেলে রেখেছিল সেখানকার চাদরে।

ডান হাতের তর্জনীটা নেই দেখাই যাচ্ছে।

মারলা! চিৎকার করে উঠল রবিন। তুমি কি মানুষ! করলে কি করে একাজ! নিজের আঙুল নিজে কেটে ফেললে!

উঠে বসল মারলা। চোখেমুখে রাগ আর ভয় একসঙ্গে ফুটেছে। আর কি। করতে পারতাম? একটা আঙুলই তো শুধু গেছে। যাক। প্রাণটা তো বাচল। জানো, খুব একটা কষ্ট হয়নি। ভালমত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নিলাম। তারপর ধারাল ছুরি দিয়ে কষে এক পোচ। ব্যস, গেল আলগা হয়ে। চিঠিটার সঙ্গে একটা খামে ভরে রেখেছি…,

থামো! আর শুনতে চাই না!

থামল না মারলা। ওটা এখন নিয়ে যেতে হবে ক্লডিয়ার কাছে। বিজ্ঞপ্তিতে তাই বলেছে। ডাকে তো আর পাঠানো যাবে না। রক্ত দেখলেই সন্দেহ করবে। কি আর করব? নিজেকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। খামটা একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিয়ে যাব।

কাজটা করা তোমার মোটেও উচিত হয়নি…

এটাই উচিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক মানুষ না। পিশাচ! সোফি আর ড্যানির কি দুর্গতি করেছে দেখলেই তো। যেখানে খুশি যেতে পারে সে। যা ইচ্ছে করতে পারে। এর পরেও ওকে ঘটানোর সাহস হবে? কথা না শুনলে। কি ঘটত বুঝেই একাজ করেছি। টুকরো টুকরো হয়ে কিংবা ছাই হয়ে মরার চেয়ে একটা আঙুল খোয়ানো অনেক ভাল।

হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে রবিন বলল, কি জানি কোনটা ভাল! কিন্তু এখন তুমি ওই শয়তানের তারকায় ঢুকে পড়েছ।

তাতে কি হয়েছে? একটা আঙুলের বিনিময়ে বেঁচে তো গেলাম।

কি জানি বাচলে না আরও মরলে! একদিন হয়তো আরও বেশি পস্তাতে হতে পারে এর জন্যে।…ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব? যাবে?

অদ্ভুত দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকাল মারলা। সাহায্য লাগবে না। আমি নিজেই গাড়ি চালাতে পারব। মাত্র তো একটা আঙুল গেছে। বাকি নয়টাই এখনও ঠিক। তুমি কি ভেবেছ একটা আঙুল বাদ যাওয়াতেই পঙ্গু হয়ে গেছি আমি?

তোমার আব্বা-আম্মাকে ডাকব?

আহ, বললাম তো আমার কোন সাহায্য লাগবে না, বিরক্ত হলো। মারলা। এখন ওদের দেখালে হুলস্থুল কাণ্ড বাধিয়ে দেবে। যে জন্যে নিজের আঙুল খোয়ালাম, সেটাও আর করতে দেবে না। কথার অবাধ্য না হয়েও তত্ত্বাবধায়কের আক্রোশ থেকে বাঁচতে পারব না তখন। বরং সকলেই জানুক। ততক্ষণে ব্যথাও শুরু হবে, তত্ত্বাবধায়কের ফাঁদ থেকেও বেরিয়ে আসব। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলে নিজেই যেতে পারব… তুমি যাও। এখানে কিছু আর করার নেই। বোতলটা দিয়ে যাও দয়া। করে।

*

গাড়িতে বসে অস্থির হয়ে উঠেছে কিশোর। এত দেরি করছে কেন রবিন? নেমে গিয়ে দেখে আসার কথা যখন ভাবছে এই সময় এল সে। সব কথা জানাল। জবারের সঙ্গে দেখা করে এসেই ক্লডিয়াদের বাড়িতে যাবে, ঠিক করল ওরা। মারলার পরের নামটা ক্লডিয়ার। তত্ত্বাবধায়ক এরপর ওর নামেই মেসেজ পাঠাবে। মারলা কি করেছে সেটা জানিয়ে ক্লডিয়াকে সাবধান করে দেয়া দরকার।

গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পাশে চুপচাপ বসে আছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে।

কি ভাবছ? রবিনের চোখ সোজা সামনের দিকে। ঝলমলে জ্যোৎস্নার বান ডেকেছে যেন। আকাশে পূর্ণ চাঁদ। পূর্ণিমা নাকি আজ? আচ্ছা, শয়তান উপাসকরা কি পূর্ণিমাকে বেছে নেয়? নাকি অমাবস্যা?

সেটা নির্ভর করে কোন ধরনের পূজা ওরা করছে।

কিশোর, একটা কথা ভাবছি। আমাদের এই তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে ওই শয়তান উপাসকদের কোন সম্পর্ক নেই তো?

সোজা হলো কিশোর। আমিও এতক্ষণ ধরে এই কথাটাই ভাবছি…

*

রিভারসাইডে পৌঁছে মিস্টার জবারের বাড়িটা খুঁজে বের করতে পুরো একটা ঘণ্টা লেগে গেল ওদের। দুজনে একসঙ্গে এসে দাঁড়াল তার দরজার সামনে।

শহরের দরিদ্রতম এলাকায় বাস করেন। এখানে পুরো ব্লকের সব বাড়িই পুরানো। চাঁদের আলোয় বিচিত্র দেখাচ্ছে, যেন কার্ডবোর্ডের তৈরি ছাউনি সব।

মিস্টার জবারের বাড়িটা আরও বেশি পুরানো। মলিন, বিবর্ণ, হতদরিদ্র চেহারা।

 দরজায় থাবা দিল কিশোর। বেশ কয়েকবার থাবা দেয়ার পর দরজা খুলে। দিলেন একজন বয়স্ক ভদ্রলোক। ছেঁড়া পর্দার ওপাশ থেকে উঁকি দিলেন। বাড়িটার চেহারার সঙ্গে মিল রাখতেই যেন পরনের পোশাকটাও তার অতি পুরানো।

কি? জিজ্ঞেস করলেন জবার।

আমরা আপনার মেয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি, কিশোর বলল। যাদের সঙ্গে মিশেছিল, তারা আবার জ্বালানো শুরু করেছে। আমরা ওদের শয়তানি বন্ধ করতে চেষ্টা করছি। সেজন্যে আপনার সাহায্য দরকার।

কে তোমরা?

আমার নাম কিশোর। ও রবিন। আমরাও ওদের শয়তানির শিকার। সাংঘাতিক বিপদে ফেলে দিয়েছে। উদ্ধার পেতে চাই।

সারাহকে চিনতে নাকি তোমরা?

না। তবে তার সব কথা জানি। কিভাবে মারা গেছে শুনেছি। মারা যাওয়ার আগে যে লোকটাকে খুন করেছে তার কথাও জানি।

ওই ইবলিসগুলোর সঙ্গে মেশার আগে একটা পিঁপড়ে মারারও ক্ষমতা। ছিল না ওর। কি মেয়েটাকে কি বানিয়ে ফেলল! কেঁপে উঠল বৃদ্ধের কণ্ঠ। এসো। ভাল ছেলে বলেই মনে হচ্ছে তোমাদের। দেখি, কি সাহায্য করা যায়।

মিসেস জবারকে ডিস্টার্ব করব না তো আবার? বিনীত ভঙ্গিতে বলল কিশোর।

না না, ও ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমাচ্ছে। একটু আস্তে কথা বললেই হবে। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকেই ঘুম-নিদ্রা একেবারে গেছে বেচারির। কড়া কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয় এখন।

 বসার ঘরে ওদেরকে নিয়ে এলেন মিস্টার জবার। বয়েস ষাটের কাছাকাছি হবে। সারাহ্ নিশ্চয় ওদের বেশি বয়েসের সন্তান। কিংবা পালিতা কন্যাও হতে পারে।

রবিন আর কিশোরকে বসতে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, বলো এখন, কি জানতে চাও?

কি করে মারা গেল আপনার মেয়ে? জানতে চাইল কিশোর। সে একাই কথা বলছে। রবিন চুপ করে আছে।

যেদিন মারা গেল সেদিন রাতে ওর ঘর থেকে একটা চিৎকার শুনলাম। মনে হলো প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি বুক চেপে ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি করছে সারাহ। বুঝলাম হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাঁচাতে পারল না। বুক চেপে ধরে কাশতে লাগলেন জবার। অবস্থা দেখে মনে হলো যেন তাঁরই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। অনেক কষ্টে কাশি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মেয়ে মানুষ খুন করেছে একথা তোমাদের কে বলল?

মিসেস জোসেফিনা ব্রেক।

বেচারি, একটা সেকেন্ড মুখ নিচু করে রাখলেন মিস্টার জবার। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কাছে কি জানতে চাও?

আপনার মেয়ের যে কোন বন্ধুর নাম, যে ওই শয়তান উপাসকদের সঙ্গে জড়িত ছিল, কিংবা এখনও আছে।

ওর কোন বন্ধু ছিল না। ও ছিল একেবারে একা। নিঃসঙ্গ। এত সুন্দরী ছিল, কিন্তু কোন দিন কোন ছেলেবন্ধু জোটেনি। কোন ছেলে এসে ওর সঙ্গে যেচে বন্ধুত্ব করতে চায়নি। খুব অবাক লাগত আমার। কোন মেয়ে ওকে কখনও ফোন করত না। কেন, কখনও বুঝতে পারিনি। এখনও পারি না। জন্মের পর থেকেই খুব শান্ত ছিল মেয়েটা। হৈ-হট্টগোল পছন্দ করত না। কারও সঙ্গে কথা বলত না। একা একা নিজের মত থাকত। সেই মেয়েটাই শেষে কি হয়ে গেল!

কার সঙ্গে প্রথম মেলামেশা করেছিল, জানেন নাকি? এতক্ষণে একটা প্রশ্ন করল রবিন। কথা তো সে নিশ্চয় কারও সঙ্গে বলেছে। নইলে শয়তান উপাসকদের খপ্পরে পড়ল কি করে?

নাহ, জানি না! ক্ষোভের সঙ্গে জবাব দিলেন মিস্টার জবার। যদি জানতাম এই অবস্থা হবে, তাহলে তো কড়া নজরই রাখতাম। কি করে যে ওই ইবলিসগুলোর সঙ্গে পরিচয় হলো, কিছুই বলতে পারব না।

এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে কয়েকটা বাধানো ছবির ওপর দৃষ্টি আটকে গেল রবিনের। একটা বুকশেলফের ওপর দাঁড় করানো। জবারদের পারিবারিক ছবি।

চেয়ার থেকে উঠে পায়ে পায়ে সেগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। একটা ছবিতে একা একটা মেয়ে বসে আছে। লাল চুল। সবুজ চোখ। বেড়ালের চোখের মত জ্বলছে। মেয়েটার চোখ দেখলেই মনে হয় মানসিক রোগী। কোন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এরকম করে তাকায় না। হাত নেড়ে কিশোরকে ডাকল রবিন।

কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর, কি?

দেখো তো চিনতে পারো নাকি?

একবার তাকিয়েই বলে উঠল কিশোর, বিকেলে মুসাকে ডেকেছিল যে সেই মেয়েটার মত না?

মাথা ঝাঁকাল রবিন। হ্যাঁ। কেবল চুলের রঙ বাদে।

ফিরে তাকাল কিশোর, মিস্টার জবার, সারাহর কোন যমজ বোন ছিল?

না তো! উঠে এলেন তিনি। কেন?

ছবির দিকে আঙুল তুলল কিশোর, আজ বিকেলে অবিকল এই চেহারার একটা মেয়েকে দেখেছি আমরা।

কাকে দেখেছ কে জানে। আমার মেয়ে মারা গেছে পনেরো দিন আগে। ওকে দেখতেই পারো না।

কিন্তু দেখেছি, জোর দিয়ে বলল রবিন, কোন সন্দেহ নেই আমার।

অসম্ভব! জোর দিয়ে বললেন মিস্টার জবার।

দ্বিধায় পড়ে গেল রবিন, চেহারার তো কোন অমিল নেই। চুলের রঙে মিলছে না যদিও। কিন্তু সেটাও কোন ব্যাপার নয়। হেয়ার ড্রেসারের দোকানে গিয়ে যে কেউ লাল চুলকে সোনালি করিয়ে নিতে পারে।

ঠিক বলেছ, ওর সঙ্গে একমত হয়ে বলল কিশোর। মিস্টার জবার, আপনি যা-ই বলুন না কেন, আপনার মেয়ে বেঁচে আছে…

কি বলছ তোমরা মাথায় ঢুকছে না আমার! নিজের চোখে ওকে মর্গে মৃত দেখে এলাম…

কিন্তু পরদিন গিয়ে আর লাশটা খুঁজে পাননি…

পাইনি। তাতে অত অবাক হওয়ার কিছু নেই। হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ গায়েব হওয়াটা নতুন ঘটনা নয়। কঙ্কাল বিক্রির লোভে ডোমেরাই অনেক সময়…

উত্তেজিত হয়ে সবাই কিছুটা জোরে জোরে কথা বলা শুরু করেছিল, তাতে ঘুম ভেঙে গেল মিসেস জবারের। ভেতরের ঘর থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, গ্যারি, কার সঙ্গে কথা বলছ?

কারও সঙ্গে না, মাই ডিয়ার, জবাব দিলেন মিস্টার জবার। ঘুম আসছে না তো, একা একাই। তুমি ঘুমাও। আমি আসছি একটু পরেই, রবিন আর কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ফিসফিস করে বললেন, জলদি পালাও। তোমাদের দেখলে সারারাতেও আর ঘুমাবে না। বকবক করতেই থাকবে।

বকবকে কিশোরেরও বড় ভয়। রবিনের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। দরজার কাছে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে বলল, মিস্টার জবার, পরে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

 রবিনকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। বাইরে বেরিয়েই বলে উঠল, সারাহকেই দেখেছি আমরা। সেরাতে মারা যায়নি সে। হার্ট অ্যাটাকে অনেক সময় কমাতে চলে যায় মানুষ। মৃত্যুর সমস্ত লক্ষণ ফুটে ওঠে শরীরে। ডাক্তাররাও ভুল করে ফেলেন। সারাহর ক্ষেত্রেও নিশ্চয় ওরকম কিছু ঘটেছিল। হুঁশ ফেরার পর পালিয়েছে।

হ্যাঁ, এটা হওয়া বিচিত্র নয়। এমনও হতে পারে হার্ট অ্যাটাকটা ছিল তার বাহানা। মেডিটেশন করে করে এত ক্ষমতাই অর্জন করেছে, ইচ্ছে করলে সুপ্তির এমন এক জগতে চলে যেতে পারে, যাতে মনে হয় মরেই গেছে…অনেক পীর-ফকির তো এসব করেই মানুষকে ধোকা দেয়

জানি! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা দোলাল কিশোর। জলদি গাড়িতে ওঠো। মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।

ক্লডিয়াদের ওখানে যাব না?

যাও। ওকে সাবধান করা দরকার। তাড়াতাড়ি করো।

*

এত রাতেও ক্লডিয়াদের গেট খোলা। হাঁ হয়ে খুলে আছে। হয় কেউ গাড়ি নিয়ে ঢুকেছে, ঢোকার পর আর বন্ধ করেনি। নয়তো কেউ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছে। লাগানোর সময় ছিল না।

সোজা গাড়িবারান্দায় ঢুকল রবিন। গাড়ি থামাল। নেমে গিয়ে বেল বাজাল। খুলে দিলেন কুড়িয়ার বাবা মিস্টার নিউরোন। পরনে পাজামা। ঘুম থেকে উঠে এসেছেন। রবিনকে চেনেন।

এত রাতে তোমারও দরকার পড়ল নাকি ক্লডিয়াকে? কণ্ঠস্বরেই বোঝা গেল মেজাজ ভারী হয়ে আছে তার। কোন কারণে খাপ্পা। পুলিশের লোক। চোর-ডাকাত নিয়ে কারবার। মেজাজ খিঁচড়ে থাকাটা অস্বাভাবিক না।

মানে! অবাক হলো রবিন। কি বলছেন, আঙ্কেল? আরও কেউ এসেছিল নাকি?

কি যে সব হয়েছে আজকাল তোমাদের, বুঝি না! আমাদের কি অমন বয়েস ছিল না নাকি? রাত দুপুরে যত্ত সব জরুরী কাজ পড়ে গেল সবার। তোমার দেখা করাটাও নিশ্চয় জরুরী?

সত্যি বলছি, আঙ্কেল, আসলেই জরুরী। ক্লডিয়াকে একটু ডেকে দেবেন, প্লীজ?

ও কি বাড়ি আছে নাকি যে ডেকে দেব। খানিক আগে মারলা এসেছিল। হাতে করে একটা পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে এসেছিল। ডান হাতে তোয়ালে জড়ানো। কি যে বলল ক্লডিয়াকে কে জানে। একটু পরেই দেখি হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছিস? বলে, মুসাদের বাড়ি। …কেন?: জরুরী কাজ আছে। এজন্যেই তো বলছি রাত দুপুরে এমন কি কাজ পড়ে গেল যে… সরাসরি রবিনের দিকে তাকালেন মিস্টার নিউরোন। কোথাও যাওয়ার কথা আছে নাকি তোমাদের?

আছে বলাটাই নিরাপদ ভেবে তা-ই বলে দিল, রবিন। পুলিশী সন্দেহ এবং জেরা এড়ানোর জন্যে। জেরার মধ্যে পড়লেই ফাস করে দিতে হবে সব। কোন উপায় থাকবে না। তার পেট থেকে সমস্ত কথা আদায় করে নেবেন মিস্টার নিউরোন। এখনও সব কথা পুলিশকে জানানোর জন্যে তৈরি নয় ওরা।

বেরোনোর সময় সঙ্গে করে কিছু নিয়ে গেছে? জানতে চাইল রবিন।

হ্যাঁ। একটা পলিথিনের ব্যাগে করে কি যেন নিয়ে গেল।

অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আঙ্কেল। শুধু শুধু এত রাতে কষ্ট দিলাম। সরি।

কিন্তু ঘটনাটা কি…কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

পর্বতে, বলার সময় মিস্টার নিউরোনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রাখল রবিন। মিথ্যে কথা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। তাড়াতাড়ি এসে গাড়িতে উঠল।

দরজায় দাঁড়িয়ে তখনও ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন মিস্টার নিউরোন। চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে। হাজার হোক পুলিশের লোক। সন্দেহটা বোধহয় ঠিকই করে বসেছেন।

গাড়িতে উঠে কিশোরকে সব জানাল রবিন। তারপর বলল, ব্যাপারটা মোটেও ভাল ঠেকছে না আমার, কিশোর। ক্লডিয়া মুসাদের বাড়ি গেল কেন?

তাই বললেন নাকি মিস্টার নিউরোন? নিশ্চয় তত্ত্বাবধায়কের কাজে গেছে, তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল কিশোরের গলা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস মারলার কাটা আঙুল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসাকে জানানোর জন্যে ক্লডিয়াকে জরুরী কোন মেসেজ দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক। জলদি যাও এখন মুসাদের বাড়িতে।

ক্ষতির আশঙ্কা করছ নাকি তুমি?

সে তো বটেই।

 কি ক্ষতি?

স্টার্ট দাও, বলছি। তোমার নামটা নেই কেন চিঠিতে, বুঝে ফেলেছি আমি। রবিন, ভয়ানক বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি আর মুসা!

.

১৪.

চোখ মেলল মুসা। আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কদিন ধরে যে কি হয়েছে তার বুঝতে পারছে না। ঘুমালেই দুঃস্বপ্ন দেখে।

ছাতের দিকে চোখ পড়ল। পরিচিত ছাত। নিজেদের বাড়ি।

পাশ ফিরে তাকাল। বিড়ালের মত কুণ্ডলী পাকিয়ে সোফায় ঘুমাচ্ছে। ক্রিসি। নিজের ঘরে যেমন ঘুমাত, তেমনি ভাবেই। কিছুতেই ওকে বিছানায় শুতে রাজি করাতে পারেনি মুসা।

হাত-পা টানটান করে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙল মুসা। পা লম্বা করে দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে এল বিছানা থেকে। মুখের ভেতরটা শুকনো। মাথা ধরেছে। কদিন ধরে এই ব্যথাটা লেগেই আছে, কখনও টিপ টিপ করে, কখনও তীব্র। ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়েও পুরোপুরি সারানো যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে অদ্ভুত একটা ঘোর লাগা ভাব। সেই সঙ্গে ক্লান্তি। বহুবার বলেছে ক্রিসিকে। গুরুত্বই দেয়নি সে। হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।

 জানালার কাছে এসে বাইরে রাতের শহরের দিকে তাকাল সে। নির্জন রাস্তা। পৃথিবী মনে হচ্ছে না। যেন অন্য কোন গ্রহ। নিজের শরীরটাকেও নিজের লাগছে না তার। পেশিতে পেশিতে ব্যথা। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো। কোনমতেই তাকে কাছছাড়া করতে চাইছে না ক্রিসি। কোন না কোন ছুতোয় সঙ্গে রয়ে যাচ্ছে। বিকেলে মীটিং থেকে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল নিজের বাসায়। মুসা রাজি হয়নি। শেষে যেচে-পড়েই ওর সঙ্গে চলে এসেছে ওদের বাড়িতে। খানিকটা গাইগুই করলেও চক্ষুলজ্জায় সরাসরি মানা করতে পারেনি মুসা।

কিন্তু কেন?

কি চায় ওর কাছে ক্রিসি?

 কেন ওর সঙ্গে ছায়ার মত লেগে আছে?

এতদিনে বুঝে গেছে শুধু ম্যাসাজ করার জন্যে ওকে ডেকে নেয়নি সে। তাকে দিয়ে কিছু একটা করাতে চায়। যে কারণে আটকে রেখেছে। নিজের চোখে চোখে রেখেছে। কি করতে হবে সেটা এখনও বলেনি। তবে বলবে। শীঘ্রি। অনুমান করতে পারছে মুসা।

গেট দিয়ে একটা গাড়ি ঢুকল। এঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল। গাড়ি বারান্দায় এসে থামল গাড়িটা।

ফিরে তাকাল মুসা।

জেগে গেছে ক্রিসি। ওর সবুজ চোখ পুরোপুরি সজাগ। ঘুমের সামান্যতম ছোঁয়া নেই। বিড়ালের মত। বিড়াল যেমন জাগার সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে যায়, ঠিক তেমনি।

এত রাতে কে? দরজার দিকে এগোতে গেল মুসা।

বাধা দিল ক্রিসি। দাঁড়াও ডাকুক আগে। তোমার কাছেই এসেছে।

সদর দরজায় ঘণ্টা বাজল। চোখের ইশারা করল ক্রিসি, এবার যাও। সাবধান থাকবে।

কেন?

 যা বললাম কোরো। আমার কথার অবাধ্য হলে বিপদে পড়বে।

থমকে গেল মুসা। হুমকি দিল নাকি ওকে ক্রিসি? ওর কণ্ঠস্বর এরকম বদলে গেছে কেন?

আবার ঘণ্টা বাজল। ক্রিসির ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে এগোল মুসা। নিচে নেমে দরজা খুলে দিল। ও ভেবেছিল রবিন কিংবা কিশোর হবে। কিন্তু ক্লডিয়াকে আশা করেনি। ওর হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ।

তুমি!

হ্যাঁ, ভোতা, শুকনো গলায় বলল ক্লডিয়া, তোমার জন্যে এনেছি এটা। ব্যাগটা বাড়িয়ে দিল, নাও। যা খুশি করো এটা নিয়ে।

ব্যাগটা নিল মুসা, ঘটনাটা কি, বলো তো?

মারলা তার কাজ সেরে চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে আমাকে, কেমন যান্ত্রিক গলায় বলল ক্লডিয়া। ওকে যা করতে বলা হয়েছে সে করেছে। আমাকে যা বলা হয়েছে এখন আমি সেটা করলাম।

কে বলেছে?

তত্ত্বাবধায়ক। আমাদের ডাকবাক্সে একটা নোট পেয়েছি। দুটো মেসেজ লেখা আছে তাতে। একটা আমার জন্যে। একটা তোমার জন্যে। ব্যাগের মধ্যে আছে সেটা। আর একটা পিস্তল আছে।

পিস্তল?

 হ্যাঁ, আমার আব্বারটা। তত্ত্বাবধায়ক তোমার কাছে পৌঁছে দেয়ার হুকুম দিয়েছে আমাকে। মেসেজ পড়লেই সব জানতে পারবে। যা যা দিলাম এই ব্যাগে, সব তোমার প্রয়োজন হবে।

এই সময় মুসার পাশে এসে দাঁড়াল ক্রিসি।

দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল ক্লডিয়ার। এক পা পিছিয়ে গেল।

দাত বের করে দরাজ হাসি হাসল ক্রিসি। পিস্তলটাতে গুলি আছে তো, ক্লডিয়া?

ঢোক গিলল ক্লডিয়া। আপনাকে চেনা চেনা লাগছে?

চেনা মানুষকে তো চেনাই লাগবে, রহস্যময় কণ্ঠে জবাব দিল ক্রিসি। সময় যাক, আরও ভাল করে চিনতে পারবে। তোমাকে যা করতে বলা হয়েছে, করেছ নিশ্চয় ঠিকঠাক মত?

আ-আপনাকেও কিছু করতে বলেছে নাকি তত্ত্বাবধায়ক?

হেসে উঠল ক্রিসি। কথা কম বলো। ভাগো এখন, যাও। ক্লডিয়ার মুখের ওপর দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিল সে। মুসার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। ব্যাগ খোলো।

ব্যাগের ভেতরে হাতড়াতে লাগল মুসা। ক্লডিয়া তার বাবার পিস্তলটা নিয়ে এসেছে। বের করে হাতে নিল। বলে গেছে গুলি ভরা আছে। দেখার প্রয়োজন বোধ করল না সে। মাথার মধ্যে কেমন করছে। ঘোরটা যেন। বাড়ছে। গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু। এমন লাগছে কেন?

পিস্তলটা একহাতে নিয়ে আবার ব্যাগ হাতড়াল মুসা। মারলার কাটা আঙুলটা বের করে আনল। সঙ্গে সঙ্গে হাত থেকে ফেলে দিল ওটা। ব্যাগ। আর পিস্তলটাও পড়ে গেল মেঝেতে। ভাগ্য ভাল, ঝাঁকুনি লেগেও গুলি ফুটল না।

 কাটা আঙুল এবং পিস্তল, দুটোই মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল ক্রিসি। আঙুলটা নিজের পকেটে ভরে পিস্তলের চেম্বার খুলল। খোলার ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল এ কাজে অভ্যস্ত সে। ব্যবহার করতে জানে।

ম্যাগাজিন গুলিতে ভর্তি।

খলখল করে হেসে উঠল ক্রিসি। আজকের রাতটা হবে আমাদের মহাআনন্দের রাত। জলদি তোমার মেসেজটা পড়ে ফেলো।

 কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে কাগজের টুকরোটা বের করল মুসা। দোমড়ানো লাল কাগজে লেখা নোট। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের উজ্জল আলোয় লেখাটা পড়ার চেষ্টা করল সে কষ্ট হলো বুঝতে, তবে পড়তে পারল। উল্টো করে লেখা বাক্যটার মানে করলে হয়:

রবিনের খুলি উড়িয়ে দাও

 নোটটাও হাত থেকে খসে পড়ে গেল মুসার। আমি পারব না!

পারবে, পারবে। না পারার কোনই কারণ নেই। নইলে কি ঘটবে জানো? জেলে যেতে হবে তোমাকে।

গেলে যাব। তবু রবিনকে খুন করতে পারব না আমি। মাথা খারাপ নাকি!

তাহলে তোমাকে খুন হতে হবে, কঠিন হয়ে গেল ক্রিসির কণ্ঠ। তারপরও বাঁচবে না রবিন। তাকে খতম করার ব্যবস্থা করা হবে। একবার যখন টার্গেট হয়ে গেছে, তত্ত্বাবধায়কের হাত থেকে তার নিস্তার নেই…

তত্ত্বাবধায়কের কথা আপনি জানলেন কি করে?

মুচকি হাসল ক্রিসি। কারণ আমিই তত্ত্বাবধায়ক। এতক্ষণে তোমার বুঝে যাওয়ার কথা। আমি তো ভাবলাম বুঝে গেছ।

মাথার ঘোলাটে ভাবটা কাটছে না মুসার। ঘোরটা যাচ্ছে না। ভাবল, আবার দুঃস্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু এভাবে খুন-খারাপি করে, একজনকে দিয়ে আরেকজনকে খুন করিয়ে লাভটা কি আপনার?

লাভ আছে। আমার গুরু বলেছেন নিজের হাতে খুন করার চেয়ে অন্যকে দিয়ে খুন করিয়ে মৃত আত্মাগুলোর মালিক হতে পারলে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হওয়া যায়। কারণ এতে চালাকির দরকার হয়। শয়তান নিজে চালাক। তাই চালাক মানুষকে পছন্দ করে। আমি নিজে কতটা চালাক সেটা বোঝার জন্যে, এবং একই সঙ্গে আত্মার মালিক হওয়ার জন্যে এই ফাঁদ পেতেছি আমি। তোমাদের টার্গেট করেছি। কনসার্টের টিকেটগুলো তোমাদের কাছে আমিই পাঠিয়েছিলাম। বোকার মত আমার ফাঁদে ধরা দিয়েছ তোমরা।

তোমরা কনসার্ট থেকে ফেরার আগে ডেভন গাধাটাকে খুন করে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখেছিলাম। কাকতালীয় ভাবে হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি চালিয়ে আমার সুবিধে করে দিলে তোমরা। আমার বিশ্বাস, এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করেছেন খোদ শয়তান। লোকটাকে যে তোমরাই খুন। করেছ এটা তোমাদের বোঝাতে কোন কষ্টই হলো না আমার। চিঠি দিয়ে তখন তোমাদের ব্ল্যাকমেইল করা সহজ হয়ে গেল আমার জন্যে। ঘাবড়ে গিয়ে সোফি অ্যাক্সিডেন্ট করে মারা যাওয়াতে আরও ভড়কে গেলে তোমরা। ওকে আর আমার নিজের হাতে মারতে হয়নি। তবে আমার চিঠি পাওয়াতেই ঘাবড়ে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে সে। ওর আত্মার মালিক তাই আমি। শয়তানি হাসি ফুটল ক্রিসির ঠোঁটে। ড্যানিকে আমিই পুড়িয়ে মেরেছি। আমার অবাধ্য হয়ে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল বলে ভীষণ রাগ হয়েছিল আমার। তবে ওর খোঁজ দেয়ার জন্যে তোমাকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হয়…

আমি খোঁজ দিয়েছি! মূসা অবাক। কখন?

সেরাতে ওকে ফোন করাটা মোটেও উচিত হয়নি তোমার। ফোন করে নিজের অজান্তেই আমাকে জানিয়ে দিলে ও কোথায় আছে…

রাগ মাথাচাড়া দিচ্ছে মুসার মগজে। পা বাড়াতে গেল সে।

পিস্তল নেড়ে নিষেধ করল ক্রিসি, উঁহু! মারা পড়বে! একটু এদিক ওদিক দেখলেই গুলি মেরে দেব। আমি যে সেটা পারব, তোমার বিশ্বাস করা উচিত।

বিশ্বাস করল মুসা। এখন আমাকে কি করতে হবে?

বললামই তো, রবিনকে খুন করো।

তাতে আমার লাভটা কি হবে? বন্ধুকে খুন করব। তাকে খুনের দায়ে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ

নিতে যাতে না পারে, সে ব্যবস্থা আমি করতে পারি। তবে এক শর্তে।

বলে ফেলুন।

আমাদের দলে যোগ দিতে হবে।

শয়তানের দলে!

শয়তানকে ঘৃণা করা উচিত না। শয়তান ভীষণ ক্ষমতাশালী। তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি জানি, গুরুরও হবে। তোমার মত ছেলে আমাদের দরকার।

 ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। তারপর চমকের পর চমক। আস্তে আস্তে ঘোরটা কেটে যাচ্ছে মুসার। মাথার ভেতরটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। কেন এই ঘোর, শরীর খারাপ লাগা, মাথা ধরা, দুঃস্বপ্ন দেখা, তা-ও অনুমান করতে, পারছে এখন। ম্যাসাজ করার আগে দুটো করে বড়ি খাইয়েছে ওকে ক্রিসি। নিশ্চয় তার মধ্যে ভয়ঙ্কর নেশা জাতীয় কোন জিনিস দিত। আফিম-টাফিম জাতীয় কিছু। বলল, কিন্তু আপনার কথায় বিশ্বাস কি?

বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোন পথ নেই এখন তোমার। তবে সত্যি বলছি, তোমাকে দিয়ে আমাদের দলের অনেক কাজ হবে। সেজন্যেই তোমাকে মারব না। তা ছাড়া শুরুতেই একটা খুন করে ফেলে সাধনার একটা বড় ধাপ ডিঙিয়ে যাবে তুমি। এরপরের ধাপগুলো ডিঙানো খুব একটা কঠিন হবে না তোমার জন্যে। মহাক্ষমতাধর হয়ে যাবে তুমি অল্প বয়েসেই। আবার পিস্তল নাচাল ক্রিসি, ভেবে দেখো, কোনটা করবে? বেঁচে থেকে ক্ষমতাশালী হবে, না অকালে ধ্বংস হবে?

ভাবল মুসা। ক্ষমতাশালীও হতে চায় না, ধ্বংসও হতে চায় না। ঘাড় কাত করল, ঠিক আছে, আমি রাজি। হাত বাড়াল, দিন পিস্তলটা।

উঁহু, অত সহজে না, মাথা নাড়ল ক্রিসি। তোমাকে সেই জায়গাটায় নিয়ে যাব, যেখানে কবর দিয়েছ ডেভনকে। নাটকীয়তার জন্যে করছি ভেবো না। ওর আত্মা ঘোরাফেরা করছে ওর কবরের কাছে। সাধনা করে সোফি আর ড্যানির আত্মাকেও ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। রবিনকে ওখানে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হলো চারজন। ছয়টা তারকার বাকি দুটো কোণও ভরব আমি আর দুজনকে দিয়ে–মারলা আর ক্লডিয়া। ইতিমধ্যেই তারকার কোণে ঢুকে পড়েছে ওরা। একবার যখন ঢুকেছে, বেরোতে আর পারবে না। তারকার ছয়টা কোণ ভর্তি করার পর মাঝখানে ঢোকাব আমার নাম…

কি করে ঢুকবেন? আপনাকেও তো মরতে হবে তাহলে।

মরব। তবে আবার বেঁচে ওঠার জন্যে। হৃৎপিণ্ডে ছুরি ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করব। তারকার ছয়টা আত্মাকে বশ করার পর ওদের সাহায্যেই বেঁচে উঠব আবার। বেঁচে থাকব অনন্তকাল। অসীম ক্ষমতার অধিকারী হব আমি…

আপনার পাগলা গুরুটা বুঝিয়েছে বুঝি এসব? নেশার ঘোর পুরোপুরি কেটে গেছে মুসার। উন্মাদ না হলে কোন ছাগলে বিশ্বাস করে…

ধক করে জ্বলে উঠল ক্রিসির বিড়াল-চোখ। খবরদার, আমার গুরুকে নিয়ে ঠাট্টা করবে না! যা বলছি করো, প্রমাণ পেয়ে যাবে কার কথাটা সত্যি।

হ্যাঁ, প্রমাণই দরকার আমার। বলুন, কি করতে হবে।

.

১৫.

 মুসাদের বাড়ির সদর দরজায় টেপ দিয়ে সঁটা কাগজটা প্রথম চোখে পড়ল রবিনের। তাতে গোটা গোটা করে লেখা:

রবিন, মরুভূমিতে সেই লোকটার কবরের কাছে যাচ্ছি আমি। তুমি এখনই চলে এসো। আসবে অবশ্যই। জরুরী কথা আছে।–মুসা।

অবাক হলো রবিন। ডেকে দেখাল কিশোরকে।

গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। বিপদের গন্ধ পাচ্ছি আমি, রবিন। সাবধান থাকতে হবে।

যাবে না ওখানে?

যাব তো বটেই। না গেলে মুসাকে বাঁচানো যাবে না। চলো। রাতের বেলা এখন জায়গাটা খুঁজে পাবে তো?

পাব।

খুব একটা অসুবিধে হলো না রবিনের। মোড়ের কাছে পাহাড়ের একটা খাড়া দেয়ালের কাছে এসে গাড়ি থামাল। সেরাতে গাড়ির গুতো লেগে বালির দেয়ালে গর্ত হয়ে গিয়েছিল। সেটা দেখাল কিশোরকে।

রাস্তা থেকে কতটা দূরে কবর দিয়েছিলে? জানতে চাইল কিশোর। টর্চ জ্বালার প্রয়োজন নেই। দেখার জন্যে চাঁদের আলোই যথেষ্ট।

এই পঞ্চাশ কদম হবে। কিন্তু আর গাড়ি কই? মুসার তো আমাদের আগেই চলে আসার কথা।

যেখানে যেতে বলেছে সেখানে আগে যাই চলো। নিশ্চয় আসবে।

রাস্তা থেকে নেমে বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই রাতটার কথা ভাবল রবিন। একটা ভয়াবহ অশুভ রাত। অন্ধকার। ঝোড়ো বাতাসে বালি উড়িয়ে এনে ওদের চোখে-মুখে ফেলছিল। লোকটাকে কবর দিতেও কত যে অসুবিধে ভোগ করেছে ওরা। ইস, যদি খালি জানত, ও আগেই মরে। গিয়েছিল। ওরা খুন করেনি। তাহলে কি এই ঝামেলায় পড়তে হয়।

আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। বিশাল গোল চাঁদ। উজ্জ্বল জ্যোৎস্না। আর সেদিন ছিল অমাবস্যার অন্ধকার। কোন কুক্ষণে যে হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি চালানোর বাজিটা ধরেছিল ওরা। ডাকে আসা রহস্যময় টিকিট পেয়ে কনসার্টে যাওয়াটাও পাপ হয়েছে। সেজন্যেই এই শাস্তি…

কিন্তু ওরা কি আর জানত ওদের কোন বন্ধু মজা করে নয়, তত্ত্বাবধায়কই শয়তানি করে টিকেটগুলো পাঠিয়েছিল, ওদের ফাঁদে ফেলার জন্যে। কিভাবে। জানবে? কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্যাকটাস আর মরুর শুকনো ঝোপে ঘেরা একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল দুজনে। গোল খোলা জায়গাটাকে ঘিরে যেন প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় ক্যাকটাসগুলো। চাঁদের আলোয় লম্বা ছায়া পড়েছে। মাটিতে। ওগুলোর মাঝখানে তিন-চার ফুট গভীর একটা খাদ। খাদের তলায়। পাথরের স্তূপ। বালি খুড়ে কবর দেয়ার পর পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। কবরটা যাতে শেয়াল বা মরুভূমির অন্য কোন লাশখেকো জানোয়ারে তুলে নিয়ে যেতে না পারে।

হাত তুলে দেখাল রবিন, ওই যে…

ওর কথা শেষ হতে না হতেই উহ্ করে উঠল কিশোর। গড়িয়ে পড়ে গেল খাদের মধ্যে।

কি হলো! বলে চিৎকার দিয়ে ফিরে তাকিয়েই রবিন দেখল মুসা দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতে একটা বেজবল ব্যাট, কোমরের বেল্টে গোঁজা পিস্তল। ক্যাকটাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাড়ি মেরে ফেলে দিয়েছে কিশোরকে।

 পাগল হয়ে গেলে নাকি? বলতে গেল রবিন। কিন্তু তাকেও এক ধাক্কায়। খাদে ফেলে দিল মুসা।

খিলখিল হাসি শোনা গেল আরেকটা গাছের আড়াল থেকে। বেরিয়ে এল সোনালি চুল সেই মেয়েটা। ওর হাতেও একটা রূপালী রঙের পিস্তল। আদেশ দিল, ব্যাটটা ফেলো। পিস্তল খুলে নাও। শেষ করে দাও ওকে।

ব্যাট ফেলে কোমর থেকে পিস্তল খুলে নিল মুসা।

বালিতে পড়ায় তেমন ব্যথা পায়নি রবিন। কোনমতে উঠে বসে চিৎকার করে বলল, কি করছ, মুসা? তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?

না, রবিনের দিকে পিস্তল তাক করে জবাব দিল মুসা, আমার মনিব। তত্ত্বাবধায়কের হুকুম পালন করছি। ক্লডিয়া এসে এই পিস্তল সহ মেসেজ রেখে। গেছে। তাতে বলা হয়েছে গুলি করে তোমার খুলি উড়িয়ে দিতে। সেটাই করতে যাচ্ছি। নইলে ভয়ঙ্কর মৃত্যু ঘটবে আমার।

মুসা, শোনো বোকামি কোরো না…

 পিস্তল কক করল মুসা। বিদায়, রবিন।

শোনো, মুসা, প্লীজ!

 কি শুনব?

 আমাকে খুন করলেও ও তোমাকে ছাড়বে না। আমি জানি…

সেজন্যেই তো ওদের দলে যোগ দিতে যাচ্ছি আমি। তোমার আত্মা চুরি করে একদিন মহাক্ষমতাধর হয়ে যাব।

এসব কথা তোমাকে বুঝিয়েছে বুঝি ডাইনীটা? তোমার মগজ ধোলাই করে দিয়েছে…

দেরি করছ কেন, মুসা? ক্রিসি বলল। গুলি করো।

হ্যাঁ, করছি। একটা কথা মনে পড়ল। যুদ্ধের সময় জার্মানরা অনেক বন্দিকে দিয়ে কবর খোঁড়াত, তারপর কবরের কিনারে ওদের দাঁড় করিয়ে  করত। ডিগবাজি খেয়ে গর্তে উল্টে পড়ত গুলি খাওয়া মানুষগুলো। দেখতে নাকি খুবই ভাল লাগত ওদের। আমার এখন সেটা দেখতে ইচ্ছে করছে।

হা-হা করে অট্টহাসি হাসল ক্রিসি। নির্জন মরুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল সে-শব্দ। বাহ, আমার নির্বাচনে ভুল হয়নি। শয়তানের উপাসনা করতে হলে এই মানসিকতাই তো দরকার। যে যত নিষ্ঠুরতাই বলুক এসব কাজকে, আমি বলব না। এগুলোই তো মজা। প্রথম পরীক্ষায় উতরে গেলে তুমি, মুসা। ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছেই পূরণ হোক। খাদ থেকে উঠে আসতে বলো ওকে। আমার নির্দেশেরও কিছুটা পরিবর্তন করে দিচ্ছি। মাথায় নয়, পেটে গুলি করো ওর। যাতে অনেকক্ষণ ধরে কষ্ট পেয়ে গুঙিয়ে গুঙিয়ে মরে। দেখতে ভাল লাগবে।

অ্যাই, উঠে এসো, পিস্তল নেড়ে কঠোর কণ্ঠে আদেশ দিল মুসা। চাঁদের আলোয় চকচক করছে কালো নল।

ফিরে তাকাল রবিন। বেহুশ হয়ে পড়ে আছে কিশোর। নড়ছে না।

গর্ত থেকে বেরোতে অতিরিক্ত দেরি করল রবিন। ভাবছে, থাবা দিয়ে মুসার হাত থেকে পিস্তলটা ফেলে দেয়া যায় কিনা। কিন্তু তাতেও লাভ হবে না। ক্রিসির হাতেও পিস্তল আছে।

খাদ থেকে উঠে এল রবিন। তার বায়ে রয়েছে এখন ক্রিসি, মুসা ডানে। দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারে।

তোমার প্ল্যানটা কি, সারাহ? জানতে চাইল রবিন। সময় বাড়াচ্ছে। বাঁচার যদি কোন সুযোগ পাওয়া যায়।

হেসে উঠল ক্রিসি। আমি আর এখন সারাহ নই। সারাহ ঢুকে পড়েছে তারকার মধ্যে। মায়াও নই। সে-ও গেছে। আমি এখন ক্রিসি।

আমাদের সবাইকেই তারকায় ঢোকানোর শখ হয়েছে নাকি তোমার? ক্রিসির পিস্তলটার দিকে তাকাল রবিন।

শখ নয়, এটা আমার প্রয়োজন। ছয়টা আত্মা দরকার আমার। ছয় কোণে ছয়টা ভরে দিয়ে মাঝখানে থাকব আমি। ওরা হবে আমার গোলাম। তিনটে পেয়ে গেছি–ডেভন, সোফি আর ড্যানি। তোমাকে নিয়ে হবে চারজন। আমার ভাগ্য ভাল, না চাইতেই এসে হাজির হয়েছে আরও একজন, খাদে পড়ে থাকা কিশোরকে দেখাল ক্রিসি। ওকেও নেব। শেষটা পূরণ করে নেব মারলা কিংবা ক্লডিয়াকে দিয়ে। যাকে সুযোগমত পাই।

আর মুসা? ওকে দিয়ে কি করবে?

ও হবে আমার ডান হাত। আমার বাহন। আমার প্রধান গোলাম। ওকে দিয়ে যা ইচ্ছে করাব আমি… মুসার দিকে ফিরল ক্রিসি। মুসা, দেরি করছ কেন? দাও পেটে একটা বুলেট ঢুকিয়ে। খাদে পড়ে কেঁচোর মত মোচড়াতে থাকুক। আহ, কি মজাই না হবে দেখতে! করো করো, গুলি করো!

হ্যাঁ, করছি, রোবটের মত যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর মুসার। রোবটের মতই নড়ল। পিস্তল তুলল রবিনকে তাক করে। নাহ, হচ্ছে না। এই, আরেকটু পিছাও। খাদের আরও কিনারে যাও। নইলে ডিগবাজিটা হবে না ভালমত।

পেছনে সরতে গিয়ে কিশোরের দিকে চোখ পড়ল রবিনের। একটু যেন। নড়ল মনে হলো? নাকি চোখের ভুল?

পিছিয়ে গেল রবিন।

একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটল। লাফ দিয়ে সরে গেল মুসা। চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরেই বাড়ি মারল ক্রিসির পিস্তলধরা হাতে। ঠিক একই সময়ে ঝটকা দিয়ে উঠে বসে ক্রিসির পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল কিশোর।

মুসার বাড়িতে পিস্তলটা উড়ে চলে গেল ক্রিসির হাত থেকে। কিশোরের টানে পড়ে গেল ক্রিসি খাদের মধ্যে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু। ততক্ষণে বেজবল ব্যাটটা তুলে নিয়েছে কিশোর। নির্দ্বিধায় বসিয়ে দিল ক্রিসির। মাথায়। এক বাড়িতেই বেহুশ।

ওকে বেঁধে ফেলা দরকার! চিৎকার করে বলল মুসা। ওই ডাইনীকে বিশ্বাস নেই!

তারমানে ওর কোন অলৌকিক ক্ষমতাই নেই, এমন ভঙ্গিতে বলল। রবিন, যেন নিরাশই হয়েছে। তাহলে এত সহজে কাবু করা যেত না।

কথা পরে, আগে দড়ি! মুসা বলল।

 দড়ি কোথায় পাব? গাড়িতেও তো নেই।

তাড়াতাড়ি কোমরের বেল্টটা খুলে নিল মুসা। ওটা দিয়ে ক্রিসির হাত পিছমোড়া করে নিজেই বাধল।

আর কিশোরও ওদের বেল্ট দুটো খুলে দিল। ভালমত বাঁধতে আর অসুবিধে হলো না।

খাদের কিনারে পা ঝুলিয়ে জিরাতে বসল রবিন। মুসাকে বলল, ভাল অভিনয় শিখেছ তো। আমি তো বিশ্বাসই করে ফেলেছিলাম তুমি সত্যি সত্যি ক্রিসির গোলাম হয়ে গেছ।

গত কয়েক দিন গোলাম হয়েই ছিলাম। আফিম না কি জানি খাইয়ে আমাকে সারাক্ষণ নেশার ঘোরে রেখে দিত। আজ সেটা সময়মত কেটে না, গেলে কি যে ঘটাতাম কে জানে!

এমনিতেই কম ঘটিয়েছ নাকি? উফ, ঘাড় ডলতে ডলতে বলল। কিশোর। বাড়িটা আরেকটু আস্তে মারতে পারলে না?

পারতাম। তাহলে আমাকে বিশ্বাস করত না ক্রিসি। ফাঁকিটা আর দিতে পারতাম না। সত্যি কি বেহুশ হয়ে গিয়েছিলে নাকি?

নাহ, মাথা নাড়ল কিশোর। তুমি যদি অভিনয় করতে পারো, আমি পারব না কেন?…গাড়িটা রেখেছ কোথায় তোমরা? রাস্তায় তো দেখলাম না।

মোড়ের কাছ থেকে একশো গজ দূরে, ঝোপের ধারে। পড়ে থাকা ক্রিসিকে দেখাল মুসা, একে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিভাবে নেয়া যায় বলো তো?

বয়ে নেব, আর কিভাবে? বলেই কান পাতল কিশোর। কিসের শব্দ? পুলিশের সাইরেন না?

তাই তো মনে হচ্ছে! খবর পেল কিভাবে?

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাঁকের কাছে পুলিশের গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দ শোনা গেল। দৌড়ে আসতে দেখা গেল কয়েকটা ছায়ামূর্তিকে। সবার আগে আগে ছুটে আসছে একটা মেয়ে।

ক্লডিয়া! চাঁদের আলোতে চিনতে কষ্ট হলো না ওকে।

পিস্তল হাতে খাদের কাছে এসে দাঁড়াল তিনজন পুলিশ অফিসার। তাদের মধ্যে একজন ক্লডিয়ার বাবা মিস্টার নিউরোন।

*

ফেরার পথে রবিনের গাড়িতে করে চলেছে কিশোর, মুসা আর ক্লডিয়া। ওদের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি, পেছনে আরেকটা। সামনেরটাতে ভোলা হয়েছে হাতকড়া লাগানো ক্রিসিকে। মুসার জেলপিটা স্টার্ট নিচ্ছিল না, যেটাতে করে সে আর ক্রিসি এসেছে। রাস্তার ধারে ঝোপের ধারেই ওটা ফেলে রবিনের গাড়িতে করে ফিরে চলেছে চারজনে।

গাড়ি চালাচ্ছে রবিন। পাশে মুসা।

পেছনের সীটে কিশোর আর ক্লডিয়া।

একটা কথার জবাব দাও তো, কিশোর বলল, তুমি জানলে কি করে। আমরা এখানে আছি?

মুসাকে ব্যাগটা দিয়ে বাড়ি ফিরতেই পাকড়াও করল আমাকে আব্বা, ক্লডিয়া জানাল। দুই ধমক দিয়েই জেনে নিল কোথায় গিয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে থানায় ফোন করে পেট্রল কার আনাল। আমাকে নিয়ে ছুটল মুসাদের বাড়িতে। দরজায় মুসার নোটটা দেখে কারোরই বুঝতে অসুবিধে হলো না। কোথায় তোমাদেরকে পাওয়া যাবে।

হু, তিক্তকণ্ঠে বলল কিশোর, আজকাল আর গোয়েন্দাগিরি নিয়ে গর্ব করার উপায় নেই। সবাই খুব সহজেই সব কিছু বুঝে ফেলে।

তাতে কি কোন ক্ষতি হয়েছে? হাসল ক্লডিয়া। ক্রিসি ডাইনীটার বোঝা বওয়া থেকে তো রেহাই পেলে।

তা পেয়েছি, সামনের সীট থেকে বলে উঠল মুসা। তবে সবচেয়ে আনন্দ লাগছে ওর ভয়ঙ্কর মায়াজাল কেটে যে বেরোতে পেরেছি সেজন্যে। মাথা থেকে একটা পাহাড় নেমে গেছে মনে হচ্ছে। উফ, কি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মাঝেই না কেটেছে পনেরো-ষোলোটা দিন!

ডাকে আসা উড়োটিকেট পেলে কনসার্ট দেখতে যাবে আর? পেছন থেকে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

আরও! তওবা! তওবা! দুই গালে চটাস চটাস চাটি মারতে শুরু করল মুসা।

Super User