১২.
ইউনিকর্ন? জিজ্ঞেস করল কিশোর, কি হয়েছে ওর?
রান্নাঘরের দরজার নিচে একটা নোট পেয়েছে লিলি। তাতে লেখা হয়েছে…
লিলি কোথায়?
ওপরে। ঘরে।
একটা মুহর্ত আর দেরি করল না কিশোর। দৌড় দিল। একেক লাফে দুতিনটে করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে উঠতে লাগল। পেছনে রয়েছে রবিন আর মুসা। জানালার চৌকাঠে লিলিকে বসে থাকতে দেখল ওরা। তাকিয়ে রয়েছে মাঠের দিকে। কাঁধ ঝুলে পড়েছে। হাতে একটুকরো সাদা কাগজ।
তিন গোয়েন্দার সাড়া পেয়ে মুখ ফেরাল সে। কিশোরের চোখে পড়তে বলল, তুমি ঠিকই অনুমান করেছ। চুরিই করেছে। হাতের কাগজটা দলামোচড়া করে ফেলল। কিন্তু আমার এত বড় সর্বনাশ করলটা কে?
কিছুটা আন্দাজ করতে পারি আমি, জবাব দিল কিশোর।
কাগজটা কিশোরের হাতে দিল লিলি।
খুলল কিশোর। টাইপ করে লেখা রয়েছে, লিলি, ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিওতে তুমি যোগ দিতে গেলে মারা যাবে ইউনিকর্ন। তোমার ঘোড়া আমিই চুরি করেছি, গাড়িতে বাজি রেখে পুড়িয়ে দিয়েছি। তারমানে ঘোড়াটাকে মারতে যে আমার হাত কাঁপবে না বুঝতেই পারছ।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। লিলি, ব্রড জেসনের ব্যাপারে কতখানি জানেন আপনি?
বড় বড় হয়ে গেল লিলির সবুজ চোখ। ব্রড এতে জড়িত নয়।
সেটা জোর দিয়ে বলতে পারেন না। এমন কেউ ইউনিকর্নকে চুরি করেছে যে এই র্যাঞ্চের সব কিছুই চেনে। যে আপনার গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ পায়।
সে রকম তো অনেকেই আছে এই র্যাঞ্চে।
সেই অনেকে কি জ্যান্ত ব্যাটলম্নেক নাড়াচাড়া করতে পারে? বাজি বিশেষজ্ঞ? আমার ব্যাগে যে সাপটা পাওয়া গেছে ওটা বনের সাপ নয়, মরুভূমির। নিয়ে আসা হয়েছে কুপারের চিড়িয়াখানা থেকে। কুপারের ধারণা, ব্রডই চুরি করেছে।
দাঁতে দাঁতে ঘষল লিলি। এইমাত্র গেল কুপার। সাপের দাম চাইতে এসেছিল। সোজা ভাগিয়ে দিয়েছে তাকে লুক। কুপারকে দুচোখে দেখতে পারে না। অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে লিলি। ওর ধারণা, ডাবল সিতে গোলমাল লাগানর মূলে ওই কুপার র্যাঞ্চ।
আপনার কি ধারণা?
কাকে দায়ী করব বুঝতে পারছি না। তবে ইউনিক আব্বাকে ফেলে দেয়ার পর অনেকগুলো অঘটন ঘটেছে এই র্যাঞ্চে।
আরেকবার নোটটা পড়ল কিশোর। ব্রডকে চাকরি দেয়ার পর থেকে অঘটনগুলো ঘটতে শুরু করেনি তো? ভাল করে ভেবে দেখুন।
না। ব্রডকে আমার সন্দেহ হয় না।
কিন্তু ওর ক্রিমিন্যাল রেকর্ড রয়েছে, রবিন বলল। চুরি করত।
এখন করে না। ইউনিকের ক্ষতিও করবে না। এই র্যাঞ্চের জন্যে ও একটা বিরাট সাহায্য। ভাল হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে।
কিন্তু ঘোড়াটাকে নিয়ে প্রচুর আজেবাজে কথা বলেছে সে, রবিন বলল।
ও কিছু না। বাবাকে পিঠ থেকে ফেলে দিয়েছে বলে রাগ। তাই বলে পছন্দ করে না এটা ঠিক নয়। উঠে দাঁড়িয়ে কিশোরের হাত থেকে নোটটা নিল লিলি। আরেকবার পড়ল। আমাকে খুন করার চেষ্টা সে কেন করবে?
গাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার কথা বলছেন তো? কিশোর বলল, করেছেহয়তো বেনিকে সাহায্য করার জন্যে। আপনাকে ঠেকাতে চাইছে যাতে রোডিওতে যোগ দিতে না পারেন, যাতে বেনির প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারেন। আপনি গেলে তার হেরে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
মাথা নাড়ল লিলি, বুঝতে পারছি না কি করব?
আর, যাই করেন, রোডিওতে যোগ না দেয়ার চিন্তা করবেন না। এখন বলুন, র্যাঞ্চে টাইপরাইটার আছে?
একটা। তবে নোটের লেখা আর ওটার লেখা এক নয়। হরফ মেলে না।
নোটটা নিয়ে গিয়ে ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ডকে দেখান। ইউনিকর্নের চুরির ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিতে পারে এবার।
আবার বাজল ডিনারের ঘণ্টা। মুসা বলল, চলো, আমার খিদে পেয়েছে।
আমার খিদে নষ্ট হয়ে গেছে, লিলি বলল। তোমরা যাও। একটু পরেই আসছি। কেরোলিন আন্টিকে চিন্তা করতে মানা করো।
করিডরে বেরিয়ে রবিন বলল, করতে মানা করলেই কি আর চিন্তা করা বন্ধ করে দেবেন। উদ্বেগ নিয়েই যেন জন্মেছেন মহিলা, সবার জন্যেই খালি চিন্তা।
বোনপোর কথা শুনুক আগে, মুসা বলল, তারপর দেখবে চিন্তা কাকে বলে। সত্যি, ব্রডটা যে কেন একাজ করতে গেল। ভীষণ কষ্ট পাবেন মহিলা। আরও বেশি কষ্ট লাগবে চাকরিটা তিনিই দিয়েছেন বলে।
কিশোর কিছু বলল না। চুপচাপ এসে ঢুকল ঘরে। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এল। কাপড় পাল্টাল। চুল আঁচড়াল। কি যেন মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না ওর। ঠিক করল, খাওয়ার পর ভাবতে বসবে। প্রথম থেকে যা যা ঘটেছে সব খতিয়ে দেখবে। বোঝার চেষ্টা করবে কোন ব্যাপারটা মিস করেছে। যদি তা-ও বুঝতে না পারে, সরাসরিই গিয়ে ব্রডকে বলবে তার সন্দেহের কথা।
.
খাওয়ার পরে সবাইকে শান্ত দেখা গেল। কেউ আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিল, কেউ ঢেকুর তুলল, কেউ বা খিলাল দিয়ে দাঁত খোঁচাতে লাগল। কেবল কিশোরই অস্থির। উসখুস করছে আর বারবার জানালা দিয়ে তাকাচ্ছে মিস্টি ক্যানিয়নের দিকে। ওখানে, ওখানেই কোথাও নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে ইউনিককে। ব্রড হয়ত জানে, কোথায়।
এমন কিছু কি আছে বাঙ্কহাউসে কিংবা ট্যাক রুমে যা ওর চোখ এড়িয়ে গেছে? থাকলে, গিয়ে খুঁজে বের করার এটাই সুযোগ। রবিনকে একধারে নিয়ে। গিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলল। তারপর উঠে এল ওপরে। একটা স্টেটসন হ্যাট মাথায় বসিয়ে, টর্চ হাতে বেরিয়ে এল। নিঃশব্দে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে চলে এল চত্বরে।
আকাশে মেঘ জমেছে। গায়ে লাগল ঠাণ্ডা বাতাস। দ্রুতপায়ে বাঙ্কহাউসের দিকে এগোল সে। কাছে এসে টোকা দিল দরজায়, ভেতরে কেউ আছে কিনা জানার জন্যে। সাড়া পেল না।
দম বন্ধ করে আস্তে ঠেলা দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা।
বড় একটা স্লিপিং রুম, একটা বাথরুম আর লকার রয়েছে বাঙ্কহাউসে। লকারগুলোতে আলো ফেলল। কাগজে নাম লিখে লিখে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। ওগুলোর পাল্লায়, কার কোনটা বোঝানোর জন্যে। একটাতে দেখা গেল ব্রড জেসনের নাম। হ্যাঁণ্ডেল ধরে টান দিল কিশোর। জোরে ক্যাচকোচ করে খুলে গেল পাল্লা।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লোকটার জিনিসপত্র দেখতে লাগল সে। সন্দেহজনক আর কিছুই পেল না, একটা রূপার বাকলসওয়ালা বেল্ট বাদে। এক বাণ্ডিল চিঠিপত্র আর কাগজ দেখে সেগুলোতে চোখ বোলাল। এমনকি বুটের ভেতরেও খুঁজল। কিছু পেল না।
লকারের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। বাড়ির দিকে তাকাল, চত্বরে চোখ বোলাল। কাউকে দেখতে পেল না। তাকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি চলছে এরকম কোন লক্ষণও নেই। লিভিং রুমের জানালা দিয়ে মেহমানদের দেখা যাচ্ছে। পাতাবাহারের একটা বেড়ার আড়ালে চলে এল সে। বেড়াটা চলে গেছে ট্যাক রুমের কাছে। আড়ালে থেকে এগিয়ে চলল।
জানালা নেই ট্যাক রুমের। বাতাসে চামড়া আর তেলের গন্ধ। ঝুলিয়ে রাখা। জিনিসগুলোর ওপর আলো ফেলল সে। কোন কিছু অস্বাভাবিক লাগছে না, কিছু খোয়া গেছে বলেও মনে হচ্ছে না। ব্রডের ঘোড়ায় চড়ার সরঞ্জামগুলো খুঁজে কিছু পেল না।
হতাশ হল কিশোর। ঘড়ি দেখল। আধ ঘন্টা হয়েছে বেরিয়েছে। আর বেশি দেরি করা যাবে না, তাহলে কেউ লক্ষ্য করে বসবে যে অনেকক্ষণ ধরে সে নেই ওদের মাঝে। খোঁজ পড়তে পারে।
ভাবতে ভাবতেই গিয়ে মেডিক্যাল কেবিনেট খুলল সে। প্রতিটি টিউব আর শিশি-বোতলের লেবেল পড়তে লাগল। যদি কিছু পেয়ে যায়, এই আশায়। কিন্তু এখানেও নিরাশ হতে হলো তাকে।
কিন্তু আছেই, নিজেকে বোঝাল সে, থাকতেই হবে। না থেকে পারে না। নইলে হারিকেন অস্বাভাবিক আচরণ করল কেন? আরেকবার ভাল করে দেখতে গিয়ে একটা শিশির গায়ে চোখ আটকে গেল। আগের বার খেয়াল করেনি। একটা পারঅক্সাইডের বোতলের ওপাশে রাখা হয়েছে। লেবেল দেখার জন্যে বের করতে গেল ওটা, এই সময় পেছনে শোনা গেল বুটের শব্দ।
আরেকটু হলেই হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল শিশিটা। লেবেল দেখার সময় নেই। পকেটে রেখে দিল। সাথে করে নিয়ে যাবে। টর্চ নিভিয়ে দিল সে। দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল, চোখে না পড়ার জন্যে। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। আওয়াজটা কোথায় হলো? ট্যাক রুমের ভেতরে, না বাইরে?
ধক ধক করে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। কি মনে হতে আস্তে করে ঘুরে তাকাল দরজার দিকে। বিশালদেহী একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, ছায়ামূর্তির মত। হাত তুলল লোকটা।
দম আটকে গেল যেন কিশোরের। লোকটার হাতে একটা চাবুক। এগিয়ে আসতে শুরু করল, যেন জানে কোথায় লুকিয়ে আছে কিশোর।
ঝট করে বসে পড়ল সে। শপাং করে উঠল লোকটার হাতের চাবুক। বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল কিশোরের মুখের কাছ দিয়ে।
.
১৩.
লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। ব্রড জেসন।
কে তুমি? বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল ব্রড। কিশোর? সত্যি সত্যি অবাক মনে হলো তাকে। এখানে কি করছ?
হারিকেনের মেজাজ যে খারাপ করানো হয়েছে তার প্রমাণ খুঁজছি।
আবার? তা তো খুঁজবেই। গোয়েন্দা যে তুমি একথাটা ভুলেই যাই।
টিটকারিটা গায়ে মাখল না কিশোর। চাবুকটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস কর, এটা নিয়ে এখানে কি কাজে এলেন?
রাগ কিছুটা গলে গেল ব্রডের। তুমি ঢুকেছ, বুঝতে পারিনি। ভাবলাম, ব্যানারদের চোরটা ঢুকেছে। চুপি চুপি ঢুকতে দেখলাম তো। তবে, বাড়ি লাগাতে চাইলে ঠিকই লাগাতে পারতাম। মিস করেছি ইচ্ছে করেই। সেটা প্রমাণ করার জন্যেই আলোটা নিভিয়ে দিল সে। আরেকবার হিসিয়ে উঠল চাবুক। বন্ধ হয়ে গেল মেডিসিন কেবিনেটের দরজা।
আবার আলো জ্বেলে বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়াল মাইক। তুমি জানলে আসতাম না। কিন্তু অযথা খুঁতখুঁত করছ। ঘোড়াটা চুরি হয়নি।
হয়নি? লোকটার চোখে চোখে তাকিয়ে এক কদম আগে বাড়ল কিশোর, তাহলে ইউনিকর্নের কি হয়েছে বলে আপনার ধারণা?
পালিয়েছে।
আপনি কিছু করেননি?
শক্ত হয়ে গেল ব্রডের চোয়াল। তার মানে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না তুমি। ভাবছ, যেহেতু একসময় চুরি করতাম, স্বভাবটা এখনও ভাল হয়নি। অকাজ। কুকাজ এখনও করে বেড়াই। ভুল করছ। আর দশজন সৎ কর্মীর মতই কাজ করি। আমি এখানে। ইউনিককেও চুরি করিনি, হারিকেনকেও ওষুধ খাওয়াইনি। কেনই বা করব এসব কাজ?
লিলি যাতে রোডিও জিততে না পারে, সেজন্যে।
কিসের জন্যে? ভুরু কুঁচকে গেল ব্রডের। তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। আমি তো চাই লিলি জিতুক।
তাতে যদি বেনি হেরে যায় তাহলেও?
জ্বলে উঠল ব্রডের চোখ। আঙুল শক্ত হলো চাবুকের হাতলে। তুমি ভাবছ লিলিকে স্যাবটাজ করছি আমি?
করছেন না? বেনির জন্যে?
দেখো, অনেক ভুল করেছি জীবনে, আর করতে চাই না। বেনির জন্যে দুর্বলতা আছে আমার, অস্বীকার করছি না। কিন্তু জিততে হলে বেনিকে নিজের ক্ষমতায় জিততে হবে। নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল ব্রড, আমিও রোডিও রাইডার। আমি বিশ্বাস করি, ষড়যন্ত্র করে এসব খেলায় কিছু হয় না। যদি ক্ষমতা থাকে, লিলিকে হারাতে পারবেই বেনি।
বেনিও কি তাই মনে করে?
ওকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই না আমি। আরেক দিকে তাকিয়ে বলল ব্রড।
দরজার কাছে চলে এল কিশোর। বেনির জন্যে ইনডিপেনডেন্স ডের রোডিও কতটা জরুরী?
ঢোক গিলল ব্রড। অনেক।
কেন?
সেটা তোমার জানার দরকার নেই।
আছে। একটা নোট এসেছে লিলির কাছে। তাতে লেখা হয়েছে সে ওই দিন। রোডিওতে যোগ দিলে ইউনিকর্ন মারা যাবে।
নিরেকের কাজ হতে পারে। কিংবা পাইকের। দুটো শয়তানই তো মেয়েটাকে জ্বালিয়ে মারছে, বলতে সামান্যতম দ্বিধা করল না ব্রড।
মাথা নাড়ল কিশোর। ওরা আমার ব্যাগে সাপ রাখতে যায়নি। সাপ। নাড়াচাড়া করতে পারে কিনা ওরা সে ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। গাড়ির নিচে বাজি রাখার সুযোগও ওরা পায়নি।
কিন্তু বেনিই বা কি ভাবে…? থেমে গেল ব্রড। কাঁধ ঝুলে পড়ল। তুমি হভাবছ আমি করেছি? তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছি?
বেনিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।
অবাক কথা শোনালে।
তাহলে বোঝান, বেনির জন্যে এই রোডিও কেন এত জরুরী?
বড় বড় হয়ে গেল ব্রডের নাকের ফুটো। বেশ। তাহলে বাপের থাবা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে, মুক্তি পাবে। বিজ্ঞাপনে, সিনেমায় অভিনয় করতে পারবে। রোডিও পুরস্কার হিসেবেই পাবে অনেক টাকা। কেন জরুরী, সেটা বোঝা কি এতই শক্ত?
বাবার সঙ্গে বেনির সম্পর্ক খারাপ নয়, কিশোর অন্তত সে রকম কিছু দেখেনি, সে কথা ভেবেই বলল, টাকার কি দরকার? বাপের তো অনেক টাকা আছে। একমাত্র সন্তান হিসেবে বেনিই সব পাবে।
পাবে তো ঠিক, পুতুল হয়েও থাকতে হবে। যা করতে বলবে কুপার, তাই করতে হবে ওকে। নিজের কোন ইচ্ছে থাকবে না, ভালমন্দের বিচার থাকবে না। এভাবে কি গোলামি করা যায় নাকি?
আপনাকে নিয়েও নিশ্চয় বেনির নিজস্ব ইচ্ছে আছে?
অবশ্যই আছে।
বাপের থাবা থেকে বেরোতে নিশ্চয় সব করতে রাজি বেনি? রেসের ঘোড়া
সব নয়, কিশোর, ভুল করছ। নিজের এবং বাপের সুনাম নষ্ট হয় এরকম কিছুই করবে না সে। তুমি কি ইঙ্গিত করছ বুঝতে পারছি। বিশ্বাস না হলে বেনিকেই গিয়ে জিজ্ঞেস কর। এই তো, মিনিট দশেক আগেও আমার সাথে ছিল।
অবাক হলো কিশোর। উদ্বিগ্নও। যত বার বেনি ডাবল সিতে ঢুকেছে, একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। কোথায়?
লেকের ধারে। চুরি করে আমার সাথে দেখা করতে আসে। আমার সাথে ওর মেলামেশা কুপারের পছন্দ নয়। অনেক বলা হয়েছে, আর বলার ইচ্ছে নেই, একথা ভেবেই যেন গটমট করে কিশোরের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল ব্রড। বাইরের খোয়ায় তার বুটের চাপে খচমচ শব্দ হলো।
আলো নিভিয়ে দিয়ে এল কিশোর। দরজা দিয়ে বাইরে তাকাতে চোখে পড়ল। আকাশ ঢেকে গেছে মেঘে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। জ্যাকেটের কলার তুলে দিয়ে দৌড় দিল সে, লেকের দিকে। ওখানে পৌঁছে বেনিকে পেল না।
ফিরে এল আবার। বাড়ির পেছনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরে, লিলির ঘরে। বালিশে পিঠ দিয়ে বসে আছে লিলি। পকেট থেকে ছোট শিশিটা বের করল কিশোর। অর্ধেক ভরা। এটা হারিকেনকে খাওয়ালে কি ঘটবে বলুন তো?
লেবেল পড়ে লিলি বলল, ঘুমিয়ে পড়বে। এটা ডিপ্রেসেন্ট। খুব কমই। ব্যবহার করতে হয়। কোন কারণে ঘোড়া খেপে গেলে কিংবা ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠলে খাইয়ে দেয়া হয়। শান্ত হয়ে যায় তখন।
বোধহয় কিশোরের সাড়া পেয়েই ঘরে ঢুকল মুসা। এত দেরি করলে। আমি আর রবিন তো ভাবনায়ই পড়ে গিয়েছিলাম। আর পাঁচ মিনিট দেখতাম, তারপর খুঁজতে বেরোতাম। ওর হাতে একটা আপেল। গেঞ্জিতে সেটা মুছে নিয়ে কামড় বসাল।
উজ্জ্বল হয়ে গেল কিশোরের চোখ। চিৎকার করে বলল, মুসা, এক্কেবারে ঠিক সময়ে আপেলটা নিয়ে হাজির হলে!
বোকা হয়ে গেল মুসা। মানে?
আপেলে করেই ওষুধ খাওয়ান হয়েছে ইউনিকর্নকে। আধ খাওয়া একটা আপেল দেখেছি ওর স্টলে। পরদিন গিয়ে দেখি ওটা নেই।
আরে বুঝিয়ে বল না! হাত তুলল মুসা। চোখের কোণ দিয়ে দেখল রবিনও ঢুকছে। বলছ তো উল্টো কথা। ইউনিকনের মেজাজ খারাপ হয়নি, হয়েছে। হারিকেনের। ইউনিকর্ন চুরি হয়েছে।
প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপছে তখন কিশোর। একটা ভুল করেছি আমি। ইউনিকর্ন চুরি হয়নি, হয়েছে হারিকেন। কেউ একজন বেরোতে সাহায্য করেছে। ঘোড়াটাকে। তারপর তার পিঠে চেপে চালিয়ে নিয়ে গেছে। ইউনিকর্নের পিঠে কেউ চাপতে পারে না, কিন্তু হারিকেনের পারে। সে রাতে এই ওষুধ খাওয়ানো। হয়েছিল ইউনিকর্নকে, শিশিটা দুই সহকারীকে দেখাল কিশোর।
কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে যেন লিলির চোখ। তারমানে আমি সে রাতে। ইউনিকর্নের পিঠে চড়েছিলাম! এই জন্যেই ফেলে দিয়েছিল ঝাড়া মেরে!
হ্যাঁ, হঠাৎ করে হারিকেনের মেজাজ খারাপ দেখা যাওয়ার জবাবও এটাই, মাথা দুলিয়ে বলল রবিন।
কিশোর বলল, আমার বিশ্বাস বেনিই একাজ করেছে, লিলির দিকে তাকাল সে, আপনাকে থামানোর জন্যে অদলবদল করে রেখেছিল ঘোড়াদুটোকে, একটার স্টলে আরেকটাকে ঢুকিয়ে রেখেছিল।
বেনি? বিড়বিড় করল লিলি, বিশ্বাস করতে পারছি না!
ওর মোটিভ আছে, সুযোগও ছিল। ক্যাম্পিং করেছি যে রাতে সে রাতে বনের মধ্যে ব্রডের সঙ্গে দেখেছি ওকে। সাপটা নিশ্চয় সে-ই এনে ছেড়ে দিয়েছিল আমার। ব্যাগে। ব্যানারদের জিনিস যেদিন চুরি হয় সেদিনও বেনি এখানে এসেছিল।
বারবিকিউতেও ছিল, মুসা বলল।
আজও ব্রডের সাথে দেখা করতে এসেছিল। দরজার নিচে নোটটা ফেলে রেখে যেতে পারে সে, রবিন বলল।
কিন্তু বাজি রেখে গাড়ি পোড়াতে পারে না, প্রশ্ন তুলল লিলি।
ব্রড তাকে সাহায্য করে থাকতে পারে, মুসা বলল। আর বেনিরও না পারার কোন কারণ তো দেখি না।
তোমরা তাহলে এখনও সন্দেহ করো তাকে?
না করার কোন কারণ নেই, কিশোর বলল। বরং করার পক্ষেই যথেষ্ট কারণ আছে।
ঠিক, রবিন বলল। কিশোর, একটা ব্যাপার বুঝলাম না। তুমি বলছ, হারিকেন আর ইউনিকর্নকে বদল করে ফেলা হয়েছে। তাহলে তফাতটা বুঝলাম না কেন আমরা? হারিকেনের খুরের কাছে না সাদা লোম আছে?
ওরকম সাদা সহজেই করে দেয়া যায়, হাসল কিশোর। পারঅক্সাইড ওষুধ। খাইয়ে ইউনিকর্নকে শান্ত করেছে বেনি, তারপর তার পায়ের লোম সাদা করেছে। সেজন্যেই ঘোড়াটার স্টলের কিছু কিছু খড় সাদাটে লেগেছে। ঘোড়ার পায়ে ঢালতে গিয়ে খড়ে পড়ে গিয়েছিল পারঅক্সাইড।
তার পর, কিশোরের মনের কথাগুলোই যেন পড়ছে রবিন, হারিকেনকে বের করে নিয়ে গিয়ে ওর স্টলে ঢোকানো হয়েছে ইউনিকর্নকে।
এবং সবাই মনে করেছে, যোগ করল কিশোর, হারিকেনেরই মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
বেশ, চলো, বালিশ সরিয়ে বিছানা থেকে নামল লিলি। আমি দেখলেই বুঝব, সত্যিই আসল সাদা, না পারঅক্সাইড দিয়ে করা হয়েছে।
চলুন, কিশোর বলল। শিওর হয়ে নিয়ে বেনির সঙ্গে গিয়ে কথা বলব। আমার ধারণা, ডাবল সির আশেপাশেই কোথাও আছে সে।
চলো। এসব সত্যি হলে বেনিকে আমি ছাড়ব না। জ্বলে উঠল লিলির সবুজ চোখ।
পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে চত্বরে বেরোল চারজনে। বাতাস বেড়েছে। ফোঁটা, ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে।
আকাশের এক প্রান্ত চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুতের শিখা। বিকট শব্দে বাজ পড়ল। পাহাড়ের মাথায়। আস্তাবলের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লিলি। সুইচ টিপে আলো জ্বালল। হারিকেনের স্টলের দিকে তাকিয়েই থমকে গেল। অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল মুখ থেকে।
স্টলটা খালি!
পাক দিয়ে উঠল কিশোরের পেট।
এবার? রবিনের জিজ্ঞাসা।
স্টলের কাছে দৌড়ে গেল কিশোর। তার ওপাশের আস্তাবল থেকে বেরোনোর দরজাটা খোলা। জোর বাতাসে দড়াম করে বাড়ি খেল পাল্লা। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আবার। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিতে লাগল কংক্রীটের মেঝে।
এই দরজা দিয়েই ইউনিকর্নকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও।
.
১৪.
এটাও গেল? বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালে হেলান দিল লিলি। দাঁড়িয়ে থাকার জোর পাচ্ছে না যেন।
বেশিক্ষণ হয়নি, কিশোর বলল। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল আরেকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ব্রড় জেসন। ওকে বলল সে, ইউনিকর্ন আর হারিকেন দুটোকেই চুরি করেছে বেনি।
হারিকেনের খালি স্টলটার দিকে তাকাল ব্রড়। কি বলছ?
লিলি বলল, কিশোরের ধারণা, ঘোড়াদুটোকে অদলবদল করা হয়েছিল। হারিকেনকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, বেনি, ইউনিকর্নকে হারিকেনের স্টলে ঢুকিয়ে রেখে। যেটাকে হারিকেন ভাবা হয়েছে আসলে সেটা ছিল ইউনিকর্ন।
অসম্ভব! দুটো ঘোড়ার স্বভাবই আলাদা!
কিশোর যা বলেছে সব ব্রডকে খুলে বলল লিলি। শেষে বলল, কিশোর বলছে, এসবে তুমিও জড়িত আছ।
ওকে আগেই বলেছি আমি এসবে নেই, জোর গলায় বলল ব্রড়। বেনিও নেই।
বেশ, তাহলে প্রমাণ করুন, এগিয়ে এল কিশোর। কোথায় ঘোড়া লুকিয়ে রেখেছে বেনি, আন্দাজ করার চেষ্টা করছে সে। চলুন, ঘোড়াগুলোকে বের করে আনি।
বলতে দ্বিধা করল না ব্ৰড়, চলো।
গুড। এবার বলুন তো, বেনির প্রাইভেট কোরালটা কোথায়? যেখানে সে প্র্যাকটিস করে?
কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে এই বার দ্বিধা করল ব্ৰভ। বেনি রাগ করবে। আমি ওকে ঘোড়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও বলেছে দেখেনি।
প্র্যাকটিস কোথায় করে? ব্রডের কথার গুরুত্বই দিল না কিশোর।
আবার দ্বিধা করল ব্রড। মিস্টি ক্যানিয়নের পশ্চিম ধারে। পাহাড়ের ভেতরে। একটা প্রাকৃতিক ঘের রয়েছে, একেবারে বেড়া দেয়া কোরালের মতই।
ওদিকটায় তো গিয়ে খুঁজে এসেছে লুক, কিশোরকে জানাল লিলি, পায়নি। বেনির সাথেও কথা বলেছে…
শুনল না কিশোর। ব্রডকে জিজ্ঞেস করল, ঘোড়া রাখার কোন জায়গা আছে ওখানে? ঘরটর?
খড়ের একটা ছাউনি শুধু, ব্রড জবাব দিল। তবে দুটো ঘোড়া সহজেই জায়গা হয়ে যাবে।
রবিন বলল, হয়তো ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল হারিকেনকে বেনি। লুকের লোকেরা খেয়াল করেনি। কিংবা কল্পনাই করতে পারেনি বেনি নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখবে। অনুমতি ছাড়া প্রাইভেট এলাকায় ঢুকে বিপদে পড়তে চায়নি।
শোনো… বলতে গিয়ে বাধা পেল ব্রড।
কিশোর তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেখানে কি করে যেতে হয়?
তুমি পারবে না। রাস্তা নেই। ঝড়বাদলার রাত। খুঁজেই পাবে না।
ও ঠিকই বলেছে, লিলি বলল কিশোরকে। পাহাড়গুলো তো আমি চিনি। এমন রাতে যাওয়াই মুশকিল। বনের ভেতর দিয়ে, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে, নদীর ধার দিয়ে যেতে হয়।
কোন নদী? জানতে চাইল কিশোর, যেটার কাছে গিয়ে হারিকেনকে হারিয়ে যেতে দেখেছি?
হ্যাঁ। ওটার কাছ থেকে মাইল দুয়েক দূরে একটা খড়িমত আছে, ওখানেই।
আর কিছু জানার নেই আমার। বলেই রবিনের দিকে ঘুরল কিশোর, শেরিফের অফিসে ফোন করো। বলবে এখানে আর কুপার র্যাঞ্চে যেন অফিসার পাঠান।
তুমি কি করবে? জিজ্ঞেস করল ব্রড।
আমি যাচ্ছি বমাল চোর ধরতে। মুসার দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, মুসা, চলো জলদি।
ওদের পিছে পিছে এল লিলি। কিশোর, দাঁড়াও। এখন যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। ওই পাহাড়গুলোকে তোমরা চেনো না। সাংঘাতিক বিপদে পড়বে।
বিপদকে ভয় করলে চোর ধরতে পারব না। তাছাড়া এরকম কাজ করে অভ্যাস আছে আমাদের। আকাশ চিরে দিল বিদ্যুৎ শিখা। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কিশোর বলল, এমনিতেই হয়ত দেরি হয়ে গেছে। ঘোড়াসহ চোর ধরতে না পারলে আর তাকে ধরা যাবে না। প্রমাণও করতে পারব না কিছু। এই একটাই সুযোগ আমাদের।
আস্তাবলে ঢুকল কিশোর আর মুসা। যার যার ঘোড়ায় জিন পরাতে লাগল। আগেরগুলোই নিল, কিশোরের জেনারেল উইলি, মুসার ক্যাকটাস। বেল্টের বাকলস আঁটতে আঁটতে কিশোর বলল, তাড়াতাড়ি করতে হবে আমাদের। একটাই ভরসা, ইউনিকনের পিঠে চড়তে পারবে না চোর। যতই ওষুধ খাওয়ানো হোক।
ইউনিকর্নকে মেরেটেরে ফেলবে না তো?
কিছুই বলা যায় না। রাশ ধরে টেনে জেনারেলকে বাইরে নিয়ে এল। কিশোর। পিঠে চেপে বসল।
প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে ছুটল দুই ঘোড়সওয়ার। আগে আগে চলেছে কিশোর, হাতে টর্চ। মুসার কাছেও টর্চ আছে, কিন্তু জ্বালছে না। তেমন প্রয়োজন না পড়লে জ্বালবে না। অহেতুক ব্যাটারি খরচ করতে চায় না।
বৃষ্টি ভেজা মাঠ পেরিয়ে বনে ঢুকল দুটো ঘোড়া। বনের ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। চেনা পথ, তবুও ভুল হয়ে যেতে চায়। এসব কাজে মুসা কিশোরের চেয়ে পারদর্শী। কাজেই এখন আগে আগে চলল সে।
গাছের ডালে শিস কেটে যাচ্ছে বাতাস। পাহাড়ের ঢালে উঠে কয়েকবার করে। পা পিছলাল দুটো ঘোড়াই। বন পেরিয়ে খোলা জায়গা। চলে এল ওরা সেই শৈলশিরাটায়, যেখানে অদৃশ্য হয়েছিল হারিকেন। ঢাল বেয়ে নদীর পাড়ে নামাটাই হল সবচেয়ে কঠিন। জেনারেল উইলির মত ভাল ঘোড়াও নামতে রাজি হতে চাইল না। জোরজার করেই নামাতে হলো।
তবে নামল নিরাপদেই।
নদীর পাড়ে ঘোড়ার পায়ের তাজা ছাপ দেখে আশা বাড়ল কিশোরের। তবে পাশে মানুষের পায়ের ছাপ নেই। অবাক কাণ্ড! তাহলে কি ইউনিকনের পিঠে চড়েই গেছে? সেটা করে থাকলে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে। যেভাবেই যাক, তার অনুমান। ঠিক, বেনির কোরালের দিকেই গেছে চোর।
নদীর পাড় ধরে পশ্চিমে এগোল দুজনে। ঘন ঘন বাজ পড়ছে পাহাড়ের মাথায়। মুষল ধারে ঝরছে বৃষ্টি। কিশোরের মনে হলো হাড়ের মধ্যে গিয়ে ঢুকছে। ঠাণ্ডা।
নদীর কাছ থেকে সরে এল পথ। তবে চিহ্ন দেখে এগোতে তেমন অসুবিধে হচ্ছে না। বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়ে গেছে মাটি। তাতে স্পষ্ট বসে আছে খুরের তাজা দাগ।
ঘন বনের ভেতরে ঢুকল আবার ওরা।
হঠাৎ কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাকটাস। জেনারেল উইলি থামল তার পেছনে। নিশ্চয় কিছু আঁচ করেছে। টর্চের আলোয় কিছু দেখা গেল না। ঘোড়া। দুটোকে আবার আগে বাড়ার নির্দেশ দিল দুজনে।
তবে বেশি দূর আর যেতে হলো না। গিরিখাতের ভেতরে বেড়া আর গেট দেখা গেল। তিনপাশে পাহাড়ের দেয়াল, আরেক পাশে বেড়া দিয়ে ঘিরে কোরাল তৈরি করা হয়েছে। গাছপালা নেই ভেতরে। জানা না থাকলে জায়গাটা সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কল্পনাই করবে না কেউ এখানে এরকম একটা কোরাল রয়েছে।
আরও কাছে গিয়ে র্যাসিংট্রাক দেখা গেল। কিছু তেলের খালি ড্রাম রয়েছে, ব্যারেল রেসিঙে ব্যবহারের জন্যে। আর একধারে পাহাড়ের গা ঘেষে ঘন গাছের জটলার ফাঁক দিয়ে বিদ্যুতের আলোয় চোখে পড়ল খড়ের ছাউনির চালার সামান্য একটুখানি।
ফোঁস ফোঁস করছে জেনারেল। ঘোড়াটাকে আর এগোতে বলল না কিশোর। নেমে পড়ে লাগাম বাধল বেড়ার একটা খুঁটিতে। মুসাও নামল।
পা টিপে টিপে এগোল দুজনে কাদা মাড়িয়ে।
গাছগুলোর কাছাকাছি আসতেই ভেতরে শোনা গেল ঘোড়ার ডাক। আর। কোন সন্দেহ রইল না কিশোরের, ঠিক জায়গাতেই এসেছে। জোরে এক ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল সে। তেলচিটে গন্ধ এসে লাগল নাকে।
প্রথমেই টর্চের আলো পড়ল একটা কালো ঘোড়ার ওপর। ভেজা শরীর। টপটপ করে পানি ঝরে পড়ছে গা থেকে। ইউনিকর্ন। মুসার টর্চের আলো পড়ল আরেকটা ঘোড়ার ওপর। ওটার গা শুকনো। হারিকেন। আরও একটা ঘোড়া দেখা গেল, ওটাও পরিচিত, ওটারও গা ভেজা।
একটা ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল একজন মানুষ।
ডেকে বলল কিশোর, আর লুকিয়ে লাভ নেই, বেনি, বেরিয়ে আসুন।
বেরিয়ে এল বেনি। পরনে সাধারণ জিন্স আর শার্ট। ঘোড়সওয়ারের পোশাক নয়, যাতে লোকের সন্দেহ হতে পারে। তবে কোমরের বেল্টটা নজর এড়াল না। কিশোরের। রুপার বাকলসওয়ালাটাই পরেছে।
মুখের পানি মুছে হেসে জিজ্ঞেস করল কিশোর, এটা দিয়েই আমাকে বাড়ি মেরেছিলেন, তাই না?
জবাব দিল না বেনি। বিমূঢ় হয়ে গেছে। চোখে ভয়। কল্পনাই করতে পারেনি এই বাদলার রাতে তার পিছু নেবে দুই গোয়েন্দা।
.
পালানর চেষ্টা করেনি বেনি। বুঝতে পেরেছে, পালিয়ে লাভ নেই। দুর্ভাগ্যটা মেনে নিল। তাকে আর চোরাই ঘোড়াদুটোকে নিয়ে ফিরে চলেছে কিশোর আর রবিন। নদীর পাড় থেকে ওপরে উঠতেই চোখেমুখে এসে পড়ল উজ্জ্বল আলো। দাঁড়িয়ে রয়েছে একদল ঘোড়সওয়ার।
রবিন এসেছে স্যাণ্ডির পিঠে চড়ে, অস্থির ভঙ্গিতে মাটিতে পা ঠুকছে ঘোড়াটা। বড় একটা ঘোড়ায় চড়ে এসেছে লিলি। ব্রড আর লুকও এসেছে ওদের সাথে। আরও একজন আছেন, ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড।
ব্রড বলল, বেনি, আমি কল্পনাই করতে পারিনি… কথা আটকে গেল তার।
জবাব দিল না বেনি। পাথর হয়ে গেছে যেন। চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
লিলি বলল ব্রডকে, থাক, এখন আর কথা বলে লাভ নেই। বাড়ি চলো।
.
পরদিন ডাবল সিতে আবার এলেন ডেপুটি হ্যারিসন ফোর্ড। আকাশে মেঘ আছে এখনও, তবে আর বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। মাটি ভেজা। বাতাস খুবই তাজা আর পরিষ্কার। সামনের বারান্দায় বসে আছে লিলি আর তিন গোয়েন্দা। লেমোনেড খাচ্ছে।
সিঁড়ি দিয়ে বারান্দায় উঠে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে নিলেন ফোর্ড। ভাবলাম, তোমাদেরকে খবরটা দিয়েই যাই। শোনার জন্যে অস্থির হয়ে আছ হয়তো। বেনিকে ধরা হয়েছে। সব কথা স্বীকার করেছে সে। ব্রড জেসন এতে জড়িত নেই।
আমি জানতাম, খুশি হলো লিলি। ও আমাকে সত্যি কথাই বলেছে।
ঘোড়াগুলোকে অদলবদল লিলি একাই করেছে, হারিকেনের পিঠে চড়ে নিয়ে গেছে, ঠিক কিশোর যা সন্দেহ করেছিল। গাড়ির নিচে বাজিও সে-ই রেখেছে, কিশোরের ব্যাগে সাপ ঢুকিয়েছে। রোজই এখানে আসত ব্রডের সাথে দেখা করতে, ওই সময়ই করেছে অকাজগুলো। ঘোড়াকে ওষুধ খাওয়ার সময় আরেকটু হলেই ওকে ধরে ফেলেছিল কিশোর, বেল্ট দিয়ে বাড়ি মেরে যদি তোমাকে বেহুশ করে না ফেলত সে।
ব্যানারদের জিনিসগুলো কে চুরি করেছিল? জিজ্ঞেস করল রবিন।
ও-ই। তোমরা সবাই তখন বাইরে ছিলে। নোটটাও সে-ই টাইপ করেছে। তার বাবার টাইপরাইটার দিয়ে। স্বীকার করেছে।
ফিলিপ নিরেক আর ডবসি কুপার তার মানে কিছুই করেনি?
গ্লাসে লেমোনেড ঢেলে বাড়িয়ে দিল লিলি। হাত বাড়িয়ে সেটা নিলেন। ফোর্ড। করেনি কথাটা ঠিক না। শয়তানী তো কিছু করেছেই লিলির সঙ্গে। তবে ঘোড়া চুরির ব্যাপারে ওদের কোন হাত ছিল না। নিরেকের ওপর ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন ব্যাংকের ম্যানেজার। সে যেভাবে যা করছিল পছন্দ হচ্ছিল না তার। আরও অনেকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, কানে এসেছে ম্যানেজারের। দুএকজন গিয়ে রিপোর্টও করেছে। এমনিতেই নিরেকের ওপর একটা অ্যাকশন নিতেন ম্যানেজার, এখন তো কথাই নেই। পাইকও অনেক শত্রু তৈরি করে। ফেলেছে এই এলাকায়। শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কিনা সন্দেহ। এক চুমুকে প্রায় অর্ধেক, গ্লাস খালি করে ফেললেন ডেপুটি। লিলির দিকে ফিরলেন। বেনি কুপারের বিরুদ্ধে নালিশ করতে চাও?
কাল রাতে ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে, লিলি বলল। নালিশ করলেই তাকে জেলে ভরবেন। প্রতিযোগিতায় আর নামতে পারবে না। আমি চাই, ও আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হোক। জিততে পারলে জিতবে।
হাসলেন ডেপুটি। বড় বেশি আত্মবিশ্বাস মনে হয় তোমার?
কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিল লিলি। ওর সাথে একটা বোঝাঁপড়া করার ইচ্ছে আছে আমার। সেটা রোডিওতেই ভাল হবে। হারিকেনকে ফিরে পেয়েছি যখন, আমার বিশ্বাস ভালমতই একটা মার দিয়ে দিতে পারব। সুযোগটা করে দেয়ার জন্যে কিশোরের কাছে আমি ঋণী হয়ে থাকলাম।