১৩.

সাবধানে বেয়ে বেয়ে উঠে আসছে জোনস আর হিলারি। আগের দিন যে সিঁড়িটা দিয়ে উঠেছিল রবিন, সেটা দেখে ফেলল জোনস। ওঠা অনেক সহজ হয়ে গেল তার জন্যে।

হিলারির কাছে বোধহয় অতটা সহজ লাগছে না। ওর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

উঠে আসছে দুজনে। জানে না, ওদের মাথার ওপরেই লুকিয়ে রয়েছে যাদেরকে খুজছে।

কিশোর, এবার? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল রবিন।

এখনও হাত-পা কাঁপছে কিশোরের। তবে মগজটা ঠিকমতই কাজ করছে। বেরিয়ে থাকা একটা গাছের শেকড় ধরে টান দিল। কিছু হল না। আরও জোরে টানল। উঠে এল শেকড়, সাথে করে নিয়ে এল ধুলো, মাটি, পাথর।

ওপর দিকে তাকাল জোনস আর হিলারি। কয়েকটা পাথর গড়িয়ে গেল ওদের দিকে। সাথে করে নিয়ে নামতে লাগল আলগা পাথর আর মাটি। বাড়ি লেগে বড় পাথরও নড়ে উঠল। আরেকবার বাড়ি লাগতেই খসে গিয়ে ধসের সৃষ্টি করল।

তাড়াতাড়ি দুপাশে সরে গেল দুজন লোক।

ধসটা নেমে গেল ওদের মাঝখান দিয়ে।

বস… শুরু করতে যাচ্ছিল হিলারি, ওর গলা কাঁপছে। নিশ্চয় হাতও কাঁপছে।

হয়েছে, আর উঠতে হবে না, জোনস বলল। এখানে ওঠেনি ওরা। ওঠার উপায় নেই। যে হারে ধস নামে! নিশ্চয় বনের মধ্যে লুকিয়েছে। আজ রাতটা নদীর কিনারে কাটাব আমরা। কাল সকালে আবার খুঁজতে বেরোব।

 চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা আস্তে আস্তে ছেড়ে বুক খালি করল রবিন। তারপর বলল, বাঁচালে, কিশোর!

নেমে যাচ্ছে জোনস আর হিলারি।

ওরা দৃষ্টির বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল কিশোর আর রবিন। তারপর উঠে এগিয়ে চলল শৈলশিরা ধরে। যতই এগোচ্ছে, চওড়া হচ্ছে শিরাটা। ওপর থেকে এখন উপত্যকাটা দেখতে পাচ্ছে ওরা। গাছগাছালিতে ছেয়ে আছে, ঘন সবুজ।

সূর্য ডুবছে। লম্বা লম্বা ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে উপত্যকার ওপর। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে নদীটা, বেশ চওড়া হয়ে। দুধারে গজিয়ে উঠেছে লম্বা ঘাস, ঘন ঝোপঝাড়। এখানে ওখানে বাষ্প উড়ছে, নিশ্চয় গরম পানির অনেক ঝর্না রয়েছে ওখানে। উপত্যকার আরেকটা প্রান্ত এত দূরে, চোখেই পড়ে না।

রবিনের দিকে তাকিয়ে কিশোর বলল, তোমার চোখ তো লাল। আমার কি অবস্থা?

কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল রবিন। একেবারে গায়ের লোকের মত। কি যেন মনে পড়তে বলল, এই শোনা শোনো, জনের চোখ কিন্তু লাল ছিল না। যেদিন আমরা তাকে দেখেছি সেদিন গাঁয়ের বাইরে থেকে এসেছিল। মনে হচ্ছে গন্ধই ওদের ক্ষতিটা করে। ওরা রয়েছে ভাটিতে, নদীর কিনারে। বাতাস গন্ধকের গন্ধ উড়িয়ে নিয়ে যায় সোজা ওদের দিকে।

তা নেয়, কিশোর বলল। তবে যে হারে অসুস্থ, মনে হয় শুধু গন্ধকের গন্ধে নয়। আরও কোন কারণ আছে। তার হাত-পায়ের কাপুনি এখনও রয়েছে। পাহাড় বেয়ে নামার কথা ভাবতেই মুখ কালো হয়ে গেল। ইস, রাতটা এখানেই থেকে যেতে পারলে ভাল হত! কিন্তু উপায় নেই। আবার নামতে আরম্ভ করল। রবিনের পিছু পিছু। ওঠাটা যত কঠিন, নামা ততটা নয়, তাই কোন রকম বিপদ না ঘটিয়ে নিরাপদেই পা রাখতে পারল নিজের ঘাসে। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। স্বস্তির।

নেমেই চারপাশে চোখ বোলাল সে। কাছাকাছি যে কটা ফার্ন জাতীয় গাছ দেখল, সবগুলোর পাতা, ডাল, ফুল বাদামি হয়ে গেছে। নদীর পানির রঙ ধূসর, তীরের কাছে পানিতে পাতলা সরের মত জমে রয়েছে।

দেখো, রবিনকে বলল সে।

দেখল রবিন। কি মনে হচ্ছে?

অস্বাভাবিক লাগে, তাই না?

পানির দুষণ?

হতে পারে। আমার চোখ জ্বালা করছে। চলো এখান থেকে চলে যাই।

উঁচু পাহাড়ের ওপাশে ডুব দিয়েছে সূর্য। সোনালি রশ্মি আর ঢুকতে পারছে না, এখানে। ঠাণ্ডা, কালো কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। জ্যাকেট গায়ে দিয়ে নদীর ধার ধরে এগোল দুজনে। পানির ধারে ঘন হয়ে জন্মে থাকা ঘাস, লতাপাতা, ঝোপ সব বাদামী হয়ে গেছে, পানির একেবারে লাগোয়াগুলো মরেই গেছে প্রায়।

ঢালের ওপরেই রয়েছে ওরা, তবে এত কম ঢালু, অন্য প্রান্তের দিকে না, তাকালে বোঝাই যায় না। ওপাশটা এখান থেকে উঁচুতে। পাহাড়ের পাথুরে দেয়াল জায়গায় জায়গায় ক্ষয়ে গেছে অগণিত ধসের ঘষায়।

এখন তো মনে হচ্ছে, আমাদের প্লেন অ্যাক্সিডেন্টটাও অ্যাক্সিডেন্ট নয়, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর, ঘটানো হয়েছে। পকেট থেকে একটা ক্যাণ্ডি বের করে খেতে লাগল সে।

তা কি করে হয়? পানি খাওয়ার জন্যে বোতলের মুখ খুলল রবিন।

 তা-ই হয়েছে। প্রথমে ইলেকট্রিক সিসটেম নষ্ট হয়ে গেল, ক্যাণ্ডি চিবাতে চিবাতে বলল কিশোর। নামতে বাধ্য হলাম আমরা। তোমার বাবাকে কিডন্যাপ করার জন্যে তৈরি হয়ে ছিল ফ্র্যাঙ্কলিন জোনস।

তাই তো! চোখ বড় বড় করে ফেলল রবিন। তার মানে স্যাবোটাজ করা হয়েছে প্লেনটাকে?

হ্যাঁ। জোনস কিংবা তার কোন সহকারী করেছে কাজটা।

নীরবে খেল কিছুক্ষণ দুজনে। তারপর রবিন জিজ্ঞেস করল, এখন কি করা? বাবাকে বের করতেই হবে।

আপাতত হাঁটতে হবে আমাদের। আমার বিশ্বাস, উপত্যকাটা উত্তর-দক্ষিণে ছড়ানো। তার মানে কাঠ পারাপারের রাস্তাটা রয়েছে সামনে। গেলে হয়তো মুসার সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে আমাদের। কিংবা ফরেস্ট সার্ভিসের সঙ্গে।

তা ঠিক। এদিক দিয়ে গেলে অবশ্য আরেকটা সুবিধে, জোনস আমাদের পিছু নিতে পারবে না। দেয়াল ডিঙানোর সাহস নেই ওর।

আরেকটা কাজ হতে পারে, যোগ করল কিশোর, হয়তো জানতে পারব কি কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে ইনডিয়ানরা।

খাওয়া শেষ করে ক্যাণ্ডির মোড়কগুলো পকেটে রেখে দিল ওরা। বুনো এলাকার প্রতিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করতে চায় না, যেমন আছে তেমনি থাক।

অন্ধকার হয়ে আছে উপত্যকা। ওপরে তারা ঝিলমিল করছে। ধীরে ধীরে পাহাড়ের কিনারে উঁকি দিল বিশাল চাঁদ।

পরিশ্রমে ভেঙে পড়ছে শরীর, কিন্তু বিশ্রামের উপায় নেই। চাঁদের আলোয়। পথ দেখে দেখে এগিয়ে চলল ওরা। নদীর ধার ধরে। সামনে বড় পাথর কিংবা ঝোপঝাড় পড়লে সেগুলো ঘুরে এসে আবার আগের রাস্তা ধরছে। আধ মাইল মত চলার পর একটা জলাভূমি পড়ল, সরে আসতে বাধ্য হলো ওরা, একদিকের দেয়ালের কাছে। জলাভূমি শেষ হয়ে গেছে কিছুটা এগিয়ে, আবার নদীর দিকে ঘুরতে গিয়েই বরফের মত জমে গেল যেন রবিন। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল স্থির হয়ে। ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে।

কি হয়েছে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নীরবে হাত তুলে দেখাল রবিন। ফুট বিশেক দূরে মাটিতে পড়ে জ্বলছে সাদা সাদা কি যেন।

কিশোরের হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল।

আমি যা ভাবছি তা-ই ভাবছ? তোতলাতে শুরু করল রবিন।

কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে এগোল ওরা। যতই কাছে এগোল আরও ভাল করে দেখতে পেল, সাদা জিনিস অনেক বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ঘাস আর ঝোপের ভেতর থেকে ফুটে বোরোচ্ছে ফেকাসে আলো। বাতাস বয়ে গেলে ঘাসে ঢেউ জাগে, তাতে মনে হয় ভেতরের সাদা রঙটাই বোধহয় কাঁপছে।

আরেকটু এগিয়ে থামল দুজনে। থরথর করে কাঁপছে রবিন। কিশোরেরও কাঁপুনি শুরু হয়েছে, তবে সেটা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করছে সে।

ওদের প্রায় পায়ের কাছেই পরে রয়েছে একচিলতে সাদা রঙ, দূর থেকে এটাকেই দেখেছিল।

দে-দেখ, কত লম্বা! কোনমতে বলল রবিন।

একটা টিবিয়া, হাড়টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। বয়স্ক লোকের। ইনডিয়ানদের সমাধিতে চলে এসেছি আমরা।

 দেখার কোন ইচ্ছেই ছিল না আমার! বিকৃত হয়ে গেছে রবিনের কণ্ঠ। ধসটস নেমে বোধহয় মাটির নিচ থেকে বের করে দিয়েছে হাড়গুলোকে। কতগুলো আছে, আন্দাজ করতে পারো? পাথর আর মাটির একটা বড় স্কুপের কাছে জড় হয়ে আছে হাড়গুলো, ধসটা নেমেছিল পাশের পাহাড় থেকে।

ওই আরেকটা ঢিবিয়া, কিশোর বলল। ওই যে ওটা ফিমার, ওগুলো পাজরের হাড়, ওটা মেরুদণ্ড ভাঙা। চাঁদের আলোয় চকচক করছে হাড়গুলো। পুরো একটা কঙ্কালই বোধহয় রয়েছে এখানে।

ওই যে খুলিটা! গায়ে কাটা দিল রবিনের।

খুলির চোখের জায়গায় কালো কালো বড় দুটো গর্ত। ছোট কালো একটা তিনকোনা গর্ত, নাক ছিল যেখানটায়। হাঁ হয়ে আছে চোয়াল, দুই সারি দাঁত নীরব বিকট হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন।

দাঁড়াও তো দেখি! এগিয়ে গিয়ে ঝকঝকে একটা জিনিস তুলে নিল কিশোর। কোমরের বেল্টের রূপার একটা বাকস, মাঝখানে ইয়া বড় এক নীলকান্তমণি বসানো।

দেখেটেখে রবিন বলল, একেবারে জনেরটার মত দেখতে।

কঙ্কালটা তার হারিয়ে যাওয়া চাচারও হতে পারে, বাকলসটা পকেটে রেখে দিল কিশোর।

কিন্তু চাচা তো নিখোঁজ হয়েছে একমাস আগে। এত তাড়াতাড়ি হাড়ের এই দশা…

জানোয়ারে খেয়ে সাফ করে দিয়ে যেতে পারে।

খুলিটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ভয়টা চলে গেছে। তার জায়গায়। ঠাই নিয়েছে বিষণ্ণতা। অসুস্থ বোধ করছে সে। এটা দেখো। গোল একটা ছিদ্র দেখাল সে।

বুলেটের ছিদ্র?,

হ্যাঁ। খুন করা হয়েছে লোকটাকে।

.

এগিয়ে চলেছে মুসা। ক্লান্ত হয়ে আসছে ক্রমেই। শেষে আর পারল না। খোলা রাস্তা থেকে সরে চলে এল বনের ভেতরে। স্পেস ব্লাংকেটটা বের করে গায়ে। জড়িয়ে শুয়ে পড়ল একটা পাইনের গোড়ায়। একটু পরেই কানে এল ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দ। এগিয়ে চলেছে ভুল দিকে, যেদিক থেকে সে এসেছে, পর্বতের দিকে। ওদিকে কেন? ডায়মণ্ড লেক তো ওদিকে নয়?

উঠে বসল সে। পাশের রাস্তা দিয়ে চলে গেল ট্রাক। হেডলাইট নিভানো। আবার শুয়ে পড়ল সে, ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ। সেই অবস্থায়ই ভাবল, হেডলাইট জ্বালেনি কেন? শুধু পার্কিং লাইট জ্বেলে চলেছে?

মনে হলো সবে চোখ মুদেছে, এই সময় আবার শুনতে পেয়েছে ট্রাকের শব্দ। হাতের ডিজিটাল ঘড়ি দেখল। মধ্যরাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়েছে ভালমতই।

উঠে দাঁড়াল সে। এইবার ট্রাকগুলো ঠিক দিকেই চলেছে, হাইওয়ের দিকে। চলে যায় মিস্টার মিলফোর্ড, রবিন আর কিশোরের সাহায্য…ভাবতে ভাবতে দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল সে। স্পেস ব্লাংকেটটা নেড়ে চিৎকার করতে লাগল, থামো! থামো!

সামনের ট্রাকটার গতি কমে গেল। ফলে পেছনেরগুলোও কমাতে বাধ্য হলো।

উত্তেজিত হয়ে ট্রাকের কাছে ছুটে এল মুসা।

 আগের ট্রাকটা থেমে গেছে। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজা।

রানিং বোর্ডে লাফিয়ে উঠল সে।

ভেতরে চোখ পড়তেই স্থির হয়ে গেল। সোজা তার কপালের দিকে তাক করে রয়েছে এম-১৬ রাইফেলের নল। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ নেমে গেল। তার। মনে পড়ল কিশোরের কথা জানোয়ার নয়, মানুষ শিকারের কাজে ব্যবহর হয় এম-১৬।

ঢোকো! নেকড়ের মত গরগর স্বর বেরোল ডকের গলা থেকে, শয়তানী হাসি ফুটেছে ঠোঁটে। তোমার বন্ধুরা কোথায়?

.

আর পারা যায় না, এবার বিশ্রাম নিতেই হবে, ঠিক করল রবিন আর কিশোর। কুঙ্কালটা যেখানে পেয়েছে তার কাছ থেকে দূরে উজানে এসে স্পেস ব্লাংকেট মুড়ি দিয়ে ঘাসের ওপরই শুয়ে পড়ল। আগুন জ্বালতে সাহস করল না জোনসের লোকদের ভয়ে।

ভোরের আগেই উঠে পড়ল আবার। খিদেয় মোচড় দিচ্ছে পেট, কিন্তু সাথে রয়েছে কেবল পপকর্ন, সেদ্ধ করারও ব্যবস্থা নেই। অনেক ধরনের গাছ জন্মে রয়েছে, ফুলফল সবই আছে, তবু খেতে সাহস করল না। বুনো অঞ্চলের মানুষের জন্যে সেই পুরানো প্রবাদ; যেটা তুমি চেনো না, সেটা খেয়ো না। খেয়ে মরার। চেয়ে না খেয়ে বেঁচে থাকা অনেক ভাল। কাজেই খিদেটা সহ্য করতে লাগল ওরা।

আবার এগিয়ে চলা। নদীটা বাঁয়ে রেখে হাঁটছে দুজনে। পথ নেই, ঘাস আর রুক্ষ পাথরের ছড়াছড়ি, ফলে গতি হয়ে যাচ্ছে ধীর। গন্ধকে বোঝাই গরম পানির ঝর্না পেরিয়ে আসতে লাগল একের পর এক, পার হওয়ার সময় দম বন্ধ করে রাখে, দৌড়ে পার হয়ে যায় যত দ্রুত সম্ভব। নদীর পানিতে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ছে ধূসর রঙের সর, কোথাও কোথাও ভাসমান তেল।

একটা উঁচু জায়গায় উঠে এল ওরা।

থামল। অনেক কষ্টে অবশেষে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে, মনে হলো। সামনে ছড়িয়ে রয়েছে উপত্যকার অন্য প্রান্ত, সবুজ ঝলমল করছে দুপুরের রোদে। উপত্যকাটা অনেক চওড়া। ধীরে ধীরে উঠে গেছে ওপর দিকে। গাছপালায় ছাওয়া। ওখান থেকেই নেমে আসছে সরু নদী।

ওই যে, রাস্তা! টুপিটা পেছনে ঠেলে দিয়ে বলল রবিন।

পাহাড়ের যেখান থেকে জলধারাটা বেরিয়েছে, সেই একই ফাঁক দিয়ে পাশাপাশি বেরিয়েছে সরু পথটা। কয়েক শো গজ এগিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। সমতল একটা জায়গায়।

কাঠ বয়ে নেয়ার রাস্তা বলে তো মনে হচ্ছে না, রবিন বলল, মালটি যেটার কথা বলেছিল।

না।

সরু নদীটার কাছে চলে এল ওরা। ভয়াবহ দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। পানিতে দেখা গেল কালো আলকাতরার মত জিনিস। আটকে রয়েছে নদীর কিনারে এসে ছোট ছোট খাড়িতে। খাড়ির কিনারের উদ্ভিদ হয় মরে গেছে, কিংবা মরছে।

নোংরা পানির দিকে তাকিয়ে রইল দুজনে। ঝর্নার পানি যে রকম টলটলে থাকার কথা সে রকম নয়, বরং পুকুরের বদ্ধ পানির মত ময়লা। তেল ভাসছে। রোদ লেগে চিকচিক করছে রামধনুর সাত রঙ সৃষ্টি করে।

বেশিক্ষণ থাকতে পারল না ওরা। বাতাসের জন্যে হাঁসফাস করছে ফুসফুস। ওই বাতাসে শ্বাস নেয়া যায় না। তাড়াতাড়ি সরে চলে এল সেখান থেকে।

তেল অথবা অ্যাসফল্ট, রবিন বলল। কিংবা হয়তো দুটোই আছে।

অন্য কিছু। দুর্গন্ধটা বেশি খারাপ, কিশোর বলল। জঘন্য।

 তোমার একটা পরীক্ষার কথা মনে পড়ছে, কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরিতে করেছিলে। সেটা থেকেও এরকমই গন্ধ বেরোচ্ছিল।

জটিল একটা থার্মো-রিঅ্যাকটিভ এক্সপেরিমেন্ট ছিল সেটা, কিশোর বলল। হাসি ফুটল পরক্ষণেই। মনে পড়ে, স্যার কি রকম কুঁকড়ে গিয়েছিলেন, ফেটে গিয়ে জিনিসটা যখন ছড়িয়ে গিয়েছিল?

হাসতে লাগল দুজনেই। চলে এল সরু পথের শেষ মাথায় চ্যাপ্টা গোলাকার জায়গাটাতে। চাকার অসংখ্য দাগ দেখা গেল।

ট্রাক! নিচু হয়ে মাটি থেকে একটা সিগারেটের গোড়া কুড়িয়ে নিল রবিন, কিশোর যে দুটো পেয়েছিল সেরকম।

গম্ভীর হয়ে মাথা ঝকাল কিশোর। হ্যাঁ, চালানের কথা বলেছিল না জোনস?

নদী, ঝোপ, গাছপালা আর শৈলশিরার দিকে তাকাতে লাগল ওরা। গোলাকার সমতল জায়গাটা থেকে আরেক দিকে আরেকটা পথ বেরিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে উত্তর-পশ্চিমের বার্চ আর পাইন গাছে ভরা একটা বনের ভেতর।

দেখো, হাত তুলে দেখাল কিশোর।

গোলাকার জায়গাটার দক্ষিণ-পশ্চিমে শৈলশিরার নিচে পাহাড়ের গায়ে কতগুলো গুহা। ওগুলোর কাছে এগিয়ে গেছে চাকার দাগ। সেদিকে রওনা হলো দুজনে।

বাবা! চিৎকার করে ডাকল রবিন। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেছে।

গুহার সারির কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। ভেতর থেকে আসছে দুর্গন্ধ। চোখে জ্বালা ধরাল। ঝাজ লাগল গলায়। কাশতে শুরু করল ওরা, সেই সঙ্গে ঘন ঘন হাঁচি। শেষে আর টিকতে না পেরে ফিরে আসতে লাগল আগের জায়গায়।

পথের ধারে আরেকটা গুহামুখ দেখে ওটার সামনে দাঁড়াল।

 কিশোর বলল, এটার গন্ধ এত খারাপ না।

ভেতরে উঁকি দিল রবিন। জানাল, চারকোনা গুহা।

ঢুকে পড়ল দুজনে। ভেতরে আলো খুবই কম, চোখে সয়ে আসার সময় দিল। ওরা। দেখতে পেল অবশেষে। দেখে হা হয়ে গেল। মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত একটার ওপর আকেরটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে শত শত ৫৫-গ্যালনের ড্রাম।

লেবেলে পড়ল কিশোর, পিসিবি এস।

রবিন পড়ল আরেকটার, অ্যাসিড।

 পড়তে থাকল কিশোর, অ্যালকালাইন, অক্সিডাইজারস, সালফার স্লাজ।

আতঙ্ক ফুটেছে দুজনের চোখে। রাসায়নিক বর্জ্য পদার্থ! মারাত্মক বিষাক্ত!

সহসা ছায়া ঘন হল গুহার ভেতরে, সূর্যের মুখ কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে। যেন। ঝট করে ফিরে তাকাল ওরা। গুহামুখে এসে দাঁড়িয়েছে একজন মানুষ, আলো আসা ঢেকে দিয়েছে। আটকা পড়ল ওরা!

.

১৪.

তোমরা! রাগত গলায় বলল কণ্ঠটা, তোমরা এখানে কি করছ?

জন, তুমি? কিশোর বলল।

আমরা এখানে কি করে জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আরও রেগে যাচ্ছে জন। বেরোও! বাইরের লোকের এখানে ঢোকা নিষেধ! এটা আমাদের পবিত্র জায়গা। কেউ ঢোকে না এখানে।

ভুল করছ, কিশোর বলল, এস, দেখাচ্ছি, কিসে তোমাদের অসুস্থ করে –তুলছে।

দ্বিধা করল জন। তারপর ভেতরে এসে ঢুকল।

ড্রামগুলো দেখাল কিশোর। একটা ড্রামের তলা ফুটো হয়ে গিয়ে ভেতরের আঠাল পদার্থ চুঁইয়ে পড়ছে মেঝেতে। তীব্র রাসায়নিক গন্ধ।

চুপচাপ দেখল জন। তারপর কিশোর আর রবিনের সঙ্গে চুপচাপ বেরিয়ে এল। বাইরে, খোলা হাওয়ায়, যেখানে ঠিকমত শ্বাস নেয়া যায়।

ড্রামগুলোতে কি আছে বলল কিশোর।

 রাসায়নিক বর্জ্য! জন বলল, আমাদের বাতাস আর পানি দুষিত করছে!

করছে। তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে, রবিন বলল। আমাদেরও হয়েছে। এটাও এই বর্জ্যের কারণেই।

দুজনের চোখের দিকে তাকাল জন। তাহলে তো ট্রয়কের পানি খাওয়া নিরাপদ নয় আমাদের জন্যে। ওটার মাছও নিশ্চয় বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।

বনের জানোয়ারও। নদীতে পানি খেতে আসে ওরা।

এই গুহাটাতে তো গন্ধ কমই, কিশোর বলল। অন্যগুলোর কাছে যাওয়া যায় না, এতই বেশি। ওগুলোতে নিশ্চয় বোঝাই হয়ে আছে ফুটো হয়ে যাওয়া ড্রামে। বর্জ্যের ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে তোমাদের পবিত্র উপত্যকাকে।

কঠিন হয়ে গেছে জনের মুখ। ভাবছে রাসায়নিক বর্জ্যের ভয়াবহতার কথা। রাগে আগুন হয়ে ফুঁসে উঠল, আমাদের পবিত্র জায়গার এই সর্বনাশ কে করছে?

ফ্র্যাঙ্কলিন জোনস। জোনস ট্র্যাকিং কোম্পানির মালিক। চেনো?

নিশ্চয়। আমাদের মোড়ল মাঝে মাঝে গিয়ে তার কাজ করে। আমাদের অনেক সাহায্য করেন মিস্টার জোনস…

সেটা কাছাকাটি থাকার জন্যে, রবিন বলল। এই এলাকায় ঢুকতে যাতে সুবিধে হয়। জোনসই আমার বাবাকে কিডন্যাপ করেছে। কোথায় রাখবে, আন্দাজ করতে পারো?

না। এদিকটায় এর আগে আসিইনি আমি। তবে চেষ্টা করলে খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।

গোলাকার জায়গাটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, আমাদেরকে বের করলে কি করে? পায়ের ছাপ দেখে?

কাঁধ সামান্য কুঁজো করে হাঁটছে জন। নজর নিচের দিকে। চাকার দাগগুলো দেখছে। দাদা, আমাকে আজ সকালে গান গাওয়া অনুষ্ঠান থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তোমাদের জন্যে চিন্তা করছেন তিনি। আমার চাচীর গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে। পড়লাম। রাস্তায় দেখলাম তোমাদের যে পিকআপটা দেয়া হয়েছিল সেটা নষ্ট হয়ে। পড়ে আছে। তোমাদের জুতোর ছাপ অনুসরণ করে আসাটা কিছুই না। প্রথমে চোখে পড়ল দুই জোড়া জুতোর ছাপ তোমাদের পিছু নিয়েছে, তারপর তিন জোড়া। তাড়া করেছিল তোমাদের। তোমরা দৌড়ে পালিয়েছ, দুবার লড়াই করেছ, এক জায়গায় মুসার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছ। বুটের দাগ শুধু তোমাদের পিছু নিয়েছে তারপর থেকে, মুসার পিছু নেয়নি।

এত কিছু বলতে পারলে শুধু চিহ্ন দেখেই? অবাক হয়ে বলল কিশোর।

এ-তো সহজ কাজ। আমি বনের ছেলে, এমনিতেই বন আমার পরিচিত। তার ওপর ট্র্যাকিং শিখেছি চাচার কাছে। সাংঘাতিক ভাল ট্র্যাকার ছিল আমার চাচা।

ট্র্যাকিং করে অনুমান করতে পেরেছ আমাদের পিকআপটাকে কে স্যাবোটাজ করেছে?

কি বললে? চমকে গেল জন।

বোল্টটা করাত দিয়ে কেটে কিভাবে ওদেরকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল বলল কিশোর।

মাথা নোয়াল জন। এরকম একটা কাজ কে করল? মুখ তুলল। তোমরা বেঁচে আছ দেখে খুব ভাল লাগছে আমার। মুসা নিশ্চয় ওস্তাদ ড্রাইভার।

একসাথে মাথা ঝাঁকাল রবিন আর কিশোর।

কিশোর, দেখাও না…, কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল রবিন।

অ্যাঁ, হ্যাঁ! ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল কিশোর। প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ দেয়াটা কঠিন। তবু সত্যি কথাটা জানাতেই হবে। পকেট থেকে রূপার বাকলসটা বের করে জনকে দেখাল সে, দেখ তো, চিনতে পার কিনা?

হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিল জুন। সে যেটা পরেছে অবিকল সেটারই মত দেখতে। আমার চাচার। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেলে?

উপত্যকায়, হাত তুলে একটা দিক দেখাল কিশোর। একটা কঙ্কালের পাশে। আসার পথে নিশ্চয় হাড়গুলো দেখে এসেছ?

চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকাল জন। শক্ত হয়ে গিয়ে আবার ঢিলে হয়ে গেল চোয়াল।

এইবার আমি বুঝতে পেরেছি, আমার ভিশন কোয়েস্টের মানে কি ছিল? কি বোঝাতে চেয়েছেন ঈশ্বর! ঠিক জায়গায়, কিন্তু আশীর্বাদ ছাড়া। ঠিক জায়গায়, অর্থাৎ ইনডিয়ানদের পবিত্র এলাকাতেই রয়েছে, কিন্তু তার আত্মা অশান্তই থেকে গেছে, পরপারের ঠিক জায়গায় যেতে পারেনি।

একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইল তিনজনে।

 হাড়গুলো দেখার জন্যে থেমেছিলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না। তোমাদের জন্যে ভাবনা হচ্ছিল।

আরও খারাপ খবর আছে তোমার জন্যে। খুলিটাতে বুলেটের ফুটো দেখেছি।

গুলি করা হয়েছে? কে করল? কেন করল?

হ্যারিস হেরিং-এর দুর্ঘটনার কথা বলল কিশোর। তিন গোয়েন্দা আর রবিনের বাবাকে খুন করে যে দুর্ঘটনার মত করে সাজাতে চায়, সেকথাও বলল।

তুমি বোঝাতে চাইছ, জন বলল, তোমাদের মতই চাচাও কিছু সন্দেহ করেছিল, এই জায়গাটা দেখে ফেলেছিল বলেই তাকে মরতে হয়েছে?

হতে পারে।

চুপ করে ভাবল জন। বলল, অনুষ্ঠানে দাদা জেনেছেন, বিদেশী ডাইনী এসে আমাদের অসুস্থ করে তুলেছে। ডাইনীর লোভ খুব বেশি, সে যা চায় সেটা দিয়ে দিলেই কেবল তাকে ধ্বংস করা সম্ভব।

তাহলে জোনসই সেই ডাইনী।

কিন্তু যা চায় সেটা দিয়েই ধ্বংস করতে হবে, এর মানে কি? বুঝতে পারছে না রবিন।

জানি না, হাত ওল্টাল জন। চাচার বাকলসটা পকেটে রেখে দিল। চলো, খুঁজে বের করি। চওড়া একটা চাকার দাগ দেখিয়ে বলল, এটা মিস্টার জোনসের উইনিব্যাগোর দাগ। এসো। দাগটাকে অনুসরণ করে দুলকি চালে ছুটতে আরম্ভ করল সে।

ওর পেছনে ছুটল কিশোর আর রবিন। জনের ট্র্যাকিঙের ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছে। সরু রাস্তা ধরে এসে বার্চ আর পাইনের জঙ্গলে ঢুকল ওরা। গতি কমাল জন। সতর্ক হয়ে চলতে লাগল এখন থেকে।

বাতাসে পাইনের সুগন্ধ বেশিক্ষণ খাঁটি থাকতে পারল না, ভেজাল ঢুকে নষ্ট হয়ে গেল, গুহার কাছে যে দুর্গন্ধ পেয়েছে, সেই একই দুর্গন্ধ এখানেও।

এ থেমে গেল জন। পাওয়া গেছে। মিস্টার জোনসের উইনিব্যাগো। ওটা নিয়েই আমাদের গাঁয়ে যায়, খাবার, গুলি, দিয়ে আসে। বাচ্চাদের জন্যে খেলনা নিয়ে যায়।

পথের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দামি অনেক বড় গাড়িটা। গুহার কাছ থেকে সরিয়ে এনে বর্জ্য পদার্থের বিষক্রিয়া-সীমানার বাইরে এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। গাছপালার ভেতরে।

ওটার দিকে পা বাড়াতে গেল জন।

দাঁড়াও! ওর হাত ধরে ফেলল কিশোর। ভেতরে লোক থাকতে পারে। ওদের কাছে রাইফেল আছে।

মাটিতে জুতোর ছাপ দেখাল জন। সোলের নিচে চারকোনা খোপ খোপ করা। সেই ছাপ পড়েছে ধুলোতে। গাড়ির দিকে এগিয়ে গেছে।

চিনতে পেরেছ? জিজ্ঞেস করল সে।

মাথা নাড়ল কিশোর আর রবিন। পারিনি।

মুসা। ওকে রেখে সবাই চলে গেছে। এই যে দেখো, বুটের দাগ।

মুসাকে ধরে ফেলেছে! গুঙিয়ে উঠল কিলোর।

জনের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল দুই গোয়েন্দা। এসো, পা বাড়াল আবার জন।

সাবধানে যাও, হুঁশিয়ার করল কিশোর। জোনস কাছাকাছিই থাকতে পারে।

পা টিপে টিপে গাড়ির কাছে চলে এল তিনজনে। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। দুজন মানুষকে দেখা গেল ভেতরে। ধাতব কিচেন চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখে কাপড় গোঁজা। একজন মুসা। আরেকজন…

বাবা! চিৎকার করে উঠল রবিন।

.

১৫.

প্রথমেই মুসা আর মিলফোর্ডের মুখের কাপড় টেনে বের করা হলো।

বাবা, ঠিক আছ তুমি?

এখন হলাম, মলিন হাসি ফুটল মিলফোর্ডের ঠোঁটে। কপালের জখমটার ফোলা কমেনি, আরও লাল হয়েছে। ডাক্তার ছাড়া হবে না। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই আগে ডাক্তার ডাকবে, কোমল গলায় বাবাকে কথা দিল রবিন।

তোমাকে ধরল কি করে, মুসা? বাঁধন খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নেতিয়ে রয়েছে সহকারী গোয়েন্দা। গাধা যে আমি, মাথায় গোবর পোরা, সে জন্যেই ধরেছে! বনের ভেতর দিয়ে কোন শর্টকাট রয়েছে, ডক চেনে, আমার অনেক আগেই এসে ওর ট্রাকগুলো বের করে নিয়েছে।

বাঁধনমুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিলফোর্ড আর মুসা। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে, ডলে ডলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে লাগলেন।

থ্যাঙ্কস, বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে রবিনের মাথা থেকে নীল ক্যাপটা নিয়ে মাথায় চাপালেন মিলফোর্ড। কিছু মনে করলে না তো?

আরে না না, কি যে বলো। তোমার জন্যেই তো রেখেছিলাম, হাসতে হাসতে বলল রবিন। এতদিন পর খুশির হাসি ফুটেছে তার মুখে। তারপর মনে পড়ল জনের সঙ্গে বাবার পরিচয় নেই। পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার।

দ্রুত সেরে উঠল মুসা। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে, কয়েকটা লাফ দিয়ে, শরীরের আড়ষ্টতা বিদেয় করে দিয়ে এগিয়ে গেল গাড়িতে রাখা রেফ্রিজারেটরের দিকে। খিদেয় মরে যাচ্ছি আমি। ডালা খুলে বের করল মাখন, রুটি আর ফলের রস।

সবাই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর।

ভেতরে জায়গা বেশি নেই, জিনিসপত্রে ঠাসাঠাসি, তারই ভেতরে কোনমতে হেঁটে বেড়াতে লাগলেন মিলফোর্ড। মাথা ঘুরে উঠল। টলে পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনমতে তাক ধরে সামলালেন। ধপ করে বসে পড়লেন আবার চেয়ারে। তোমাদেরকে দেখে খুশি লাগছে। আমি যখন ছিলাম না তখন কি কি ঘটেছে বলো তো?

সব কথা খুলে বলল রবিন। শেষে বলল, হ্যারিস হেরিং মারা গেছে, বাবা। জোনস তাকে খুন করেছে।

আদেশ দিয়েছে জোনস, মিলফোর্ড বললেন, আর কাজটা সেরেছে ডক। হেরিঙের পিছে লেগে ছিল, জেনে গিয়েছি সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। হিলারি সেসনার ইলেকট্রিক্যাল সিসটেমে গোলমাল করে দিয়েছিল আমাকে খুন করার জন্যে। কেবিনের ফায়ার ওয়ালের পেছনে জট পাকিয়ে থাকা একগাদা তারের মধ্যে ছোট একটা বোমা রেখে দিয়েছিল। স্বীকার করেছে সব।

ইলেকট্রনিক ফিউজ ব্যবহার করেছিল নিশ্চয়, মুখভর্তি খাবারের ফাঁক দিয়ে কোনমতে বলল কিশোর। ফলে মাটিতে থেকেই ওটা ফাটাতে পেরেছে জোনস।

তা-ই করেছে। এমন জায়গায় নামাতে চেয়েছে আমাকে, যেখানে নির্ঘাত মারা পড়ব। আর যদি ক্র্যাশ ল্যাণ্ড করে মারা না-ও যাই, আমাকে হাতে পেয়ে যাবে সে। খুন করতে পারবে। তাতে বরং সুবিধে বেশিই তার, মারার আগে জেনে নিতে পারবে খবরটা আর কে কে জানে। তারপর দেখল, প্লেনে অনেক লোক ঢুকে বসে আছে। ভয় পেয়ে গেল সে। ভাবল, বুঝি আমরা চারজনেই খবরটা জানি। এটা তার জন্যে খুবই খারাপ। পুরো পাঁচ লাখ ডলারের মামলা, কিছুতেই এটা হাতছাড়া করতে চাইল না। দরকার হলে সবাইকে খুন করবে, তবু যেন কোন রকম তদন্ত না হয় এখানটায়।

ওই সাংঘাতিক কেমিক্যাল জমিয়ে রেখে এত টাকা আয় করবে সে? মুসা অবাক।

হ্যাঁ। ছোট ব্যবসায়ী সে, এত টাকার লোভ সামলাতে পারল না। এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি বহু কোম্পানিকে জরিমানা করেছে। কেন করেছে জান? বর্জ্য পদার্থ বৈধ উপায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসাটা অনেক খরচের ব্যাপার। কাজেই অনেক কোম্পানিই টাকাটা বাঁচাতে অসৎ পথ ধরে। তারপর ধরা পড়ে জরিমানা দেয়। হপ্তা দুই আগে ইপিএ একটা কোম্পানিকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। ওরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, শহরের নর্দমায় বর্জ্য ঢেলে দিতেও দ্বিধা করেনি।

 সর্বনাশ! আঁতকে উঠল কিশোর। ভয়ানক ব্যাপার ঘটে যেত তো তাহলে! নর্দমার মুখ বন্ধ, সিউয়ারেজু শ্রমিকের মৃত্যু, চাষের খেতের ক্ষতি, সবই হতে পারত। টাকার জন্যে এতটা নিচে নামতে পারে মানুষ!

এর চেয়েও নিচে নামে। যা-ই হোক, ওই ঘটনার পর সম্পাদক সাহেব আমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দিলেন। বর্জ্য পদার্থ কোথায় কোথায় ঢালা হয় তার ওপর সচিত্র প্রতিবেদন করতে হবে, ধারাবাহিকভাবে ছাপা হবে ওটা। হ্যারিস হেরিং কাগজকে টেলিফোন করে বলেছে একজন সাংবাদিক পাঠাতে, কথা বলতে চায়। প্রথমে তো নামই বলতে চায়নি আমাকে, এতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর আশঙ্কা ছিল, নাম ফাঁস হয়ে গেলে ওকে খুন করে ফেলা হবে। শুধু বলল, একটা। অটো কোম্পানিতে চাকরি করে। খরচ কমানর জন্যে বেআইনী ভাবে বর্জ্য সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে কোম্পানিটা। জোনসের ট্রাকের পিছু নিয়ে কোথায় বর্জ্য ফেলা হয়, দেখেও এসেছে হেরিং। সেটা গোপনে সংবাদপত্রকে জানিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে হুশিয়ার করে দিতে চায়।

দরজার গায়ে হেলান দিয়ে কথা শুনছিল জন। মিলফোর্ড থামলে বলল, আমাদের উপত্যকাটার সর্বনাশ করে দিয়েছে ব্যাটারা! মাটি নষ্ট করেছে, পানি নষ্ট করেছে, মাছ জন্তুজানোয়ার খাওয়ার অযোগ্য করে দিয়েছে, বিষাক্ত করে দিয়েছে বাতাস, শ্বাস নিতে পারি না আমরা। অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমার চাচাকে খুন করেছে ওরা।

বিষাক্ত বর্জ্যের ব্যাপারে অনেক কথাই যেতে আরম্ভ করেছে সরকারের কানে, মিলফোর্ড বললেন। ব্যবস্থা একটা করবেই। তবে তোমার চাচার ব্যাপারে কোন কথা কানে আসেনি আমার। বুঝতে পারছি না ওরাই করেছে কিনা কাজটা।

গাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের আসনে বসল কিশোর। বলল, আঙ্কেল, আপনার প্রতিবেদনের জন্যে যথেষ্ট তথ্য জোগাড় হয়ে গেছে?

অনেক কিছুই পেয়েছি, বললেন তিনি। শুরুটা ভালই হয়েছে। এখানে। জোনসের অনেক রেকর্ডপত্র রয়েছে, ড্রয়ারে, বের করে কেবল পড়ার অপেক্ষা। এই গাড়িটাই ওর অফিস। সব সময়ই ঘুরে বেড়ায়। সচল অফিস বলে ওকে সন্দেহ করে ধরাটা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

এখন তো সহজ হয়ে গেছে, মুসা বলল। কিশোর, সরো ওখান থেকে। ব্যাটার অফিসটাই চালিয়ে নিয়ে চলে যাব।

আমি চালাব, চেয়ার থেকে উঠতে গেলেন মিলফোর্ড।

না, আপনার শরীর ভাল না। আমিই পারব।

রবিনও বাবাকে উঠতে দিল না। মুসা ঠিকই বলেছে, বাবা।

আমি ঠিকই আছি, আবার উঠতে গেলেন মিলফোর্ড। চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। চেয়ারের পেছনটা খামচে ধরলেন। বসে পড়তে হল আবার। নাহ্, মনে। হচ্ছে সত্যিই খারাপ আমার শরীর।

চাবিগুলো কোথায়? পাচ্ছি না তো। মিলফোর্ডের দিকে তাকাল কিশোর, জানেন, কোথায় রেখেছে?

জোনসের কাছেই আছে বোধহয়।

নিরাশ হলো কিশোর। ড্রয়ারের চাবির কথা জিজ্ঞেস করেছে সে।

মুসা জিজ্ঞেস করল গাড়ির চাবিটার কথা। সেটা কোথায় তা-ও বলতে পারলেন না মিলফোর্ড। তবে তাতে একটুও দমল না সহকারী গোয়েন্দা। চাবি ছাড়াই কি করে স্টার্ট দিতে হয় জানা আছে তার। দরজার দিকে পা বাড়াল সে, হুড তুলে কিছু কাজ করতে হবে ইঞ্জিনের তারে।

দাঁড়াও! বদলে গেছে জনের কণ্ঠস্বর। মুসাকে দেখে সেদিন গাছের ছায়ায় যেমন অনড় হয়ে গিয়েছিল, সেরকম ভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে শব্দ শোনার চেষ্টা করছে। লোকের সাড়া পাচ্ছি।

হুড়াহুড়ি করে জানালার কাছে চলে এল গোয়েন্দারা। বাইরে তাকাল। ঠিকই বলেছে জন। গাছপালার ভেতরে নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। ঝিক করে উঠল ধাতব কিছুতে রোদ লেগে। রাইফেলের নলে লেগেছে, একথা বলে দিতে হল না ওদেরকে।

অ্যামবুশ করেছে ওরা! নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেছে কিশোরের।

ঢোক গিলল রবিন।

জোনসকে দেখলাম মনে হল! মিলফোর্ডও জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন।

শয়তান ডকটাকেও দেখেছি! মুসা বলল।

ওই লোকটা সব চেয়ে বিপজ্জনক! রবিনের কণ্ঠে অস্বস্তি। খুন করতে ওর একটুও হাত কাঁপে না!

আরি, আমাদের মোড়লচাচাকেও দেখছি! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে জনের। নিওমো কয়েলও আছে?

হালকাপাতলা লোকটার কথা মনে পড়ল কিশোরের, যে মালটিকে ইশারা করেছিল পিকআপ রেডি হয়েছে জানিয়ে। জিজ্ঞেস করল, নিওমো মোড়লের সহকারী, তাই না?

সব সময় না, জন বলল। মাঝে মাঝে কাজে সাহায্য করে। দুজনের। হাতেই ওয়াকি-টকি আছে। রাইফেল আছে! মোড়লচাচার হাতে রাইফেল থাকাটা মারাত্মক। নিশানা বড় সাংঘাতিক!

রাগার টেন বাই টোয়েন্টি টু হান্টিং রাইফেল! বিড়বিড় করল কিশোর। আতঙ্কিতই হয়ে পড়েছে প্রায়। এতগুলো লোক আর শক্তিশালী অস্ত্রের মুখ থেকে বেঁচে বেরোবে কি করে?

মালটি বলেছে, তোমাদের মোড়ল নাকি গাঁয়ের জন্য নানা রকম জিনিস কিনে নিয়ে আসে, রবিন বলল। মোটর ইঞ্জিনের পার্টসের মত দামি জিনিসও আনে। তার একটা নতুন গাড়ি দেখেছি, অনেক দামি। এখন বোঝা যাচ্ছে। জোনসের কাছ থেকে ভাল টাকা পায় সে, মুখ বন্ধ রাখার জন্যে।

কালো হয়ে গেছে জনের মুখ। বিশ্বাসই করতে পারছি না! এত ভাল একজন মানুষ…

গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা।

এই ভাল মানুষদের নিয়েই সমস্যা, মিলফোর্ড বললেন। দেখে মনেই হয় না। এরা খারাপ কিছু করতে পারে। মোড়লকে ফাঁসানোর মত কোন প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। নিওমোকে ধরার মতও নেই।

তাহলে কে আমাদের ব্রেক নষ্ট করে দিয়ে মেরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই? রেগে গিয়ে বলল মুসা।

ওর দিকে তাকিয়ে রইল জন। তারপর ঘুরে তাকাল আরেক দিকে, জানি না। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মোড়ল কিংবা নিওমো এরকম কাজ করতে পারে।

ওসব আলোচনার অনেক সময় পাব, আবার ড্রাইভারের সীটের দিকে রওনা হলো কিশোর। এখন একটাই কাজ, বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

একটা ঝাড়ু রাখার আলমারি দেখিয়ে নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করল মুসা, ওর মধ্যে বন্দুক-টক আছে?

থাকলেও লাভ নেই, মিলফোর্ড বললেন, এম সিক্সটিনের বিরুদ্ধে বন্দুক দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। তাছাড়া ওখানে কিছু রেখেছে বলেও মনে হয় না। অন্য উপায় করতে হবে আমাদের।

ড্যাশবোর্ডের নিচে হাতড়াচ্ছে কিশোর। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে। মাথায়। মেরিচাচী প্রায়ই বলেনঃ সব রকম বিপদের জন্যে সব সময় তৈরি থাকলে মানুষের বিপদ অনেকটাই কমে যায়। কিশোরও মানে সেকথা। জোনসকে দেখে যা মনে হয়েছে, অনেকটাই মেরিচাচীর স্বভাব। সব কিছুর জন্যেই যেন তৈরি থাকে সব সময়। এই গাড়িটাকে যখন অফিস বানিয়েছে, অনেক কিছুর জন্যই তৈরি করে রেখেছে:হ্যাঁ, এই তো, যা ভেবেছিল। পেয়ে গেল জিনিসটা। হাতটা ড্যাশবোর্ডের নিচ থেকে বের করে এনে মুঠো খুলল। ছোট একটা ম্যাগনেটিক কেস, যার মধ্যে লোকে গাড়ির বাড়তি চাবি রাখে, একটা হারিয়ে গেলেও যাতে প্রয়োজনের সময় দ্বিতীয়টা পেয়ে যায়।

গাড়ির ভেতরের উত্তেজনা মুহূর্তের জন্যে সহজ হলো। হাসি-মুখে চাবিটা মুসার হাতে তুলে দিল কিশোর। প্রায় লাফ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা।

মুসা, দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিলফোর্ড, তোমাকে যে রাস্তা দিয়ে এনেছে ডক, সেই রাস্তা দিয়েই চলে যাও। গুলি করে টায়ার ফাটিয়ে দিলেও থামবে না, বসা টায়ার নিয়েই চালাবে। মোট কথা, কোন কারণেই থামবে না। তোমার একমাত্র লক্ষ্য হবে, চালিয়ে যাওয়া। ডায়মণ্ড লেকে যাব আমরা!

বাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সহজে ভয় পান না তার বাবা। এখন পেয়েছেন। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

মুসা বলল, সবাই মাথা নামিয়ে রাখো। শক্ত করে ধরে থাকো কিছু।

মেঝেতেই শুয়ে পড়ল সকলে, মিলফোর্ড সহ। জন সতর্ক, সাংঘাতিক সতর্ক, গভীর দুর্গম বনে চলার সময় যেমন থাকে। রবিন ভাবছে, রকি বীচে আর কি কোনদিন ফিরে যেতে পারবে? যেতে পারবে ট্যালেন্ট এজেন্সি কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে? বার দুই ঢোক গিলল কিশোর। মনে মনে বলছে, খোদা, এবার যেন। ফোর্ড পিকআপটায় চড়ার মত দুর্গতি না হয়।

আর মুসা, ভারি একটা দম নিয়ে আস্তে মোচড় দিল ইগনিশনে। জেগে গেল ইঞ্জিন।

.

১৬.

স্টিয়ারিঙের ওপর ঝুঁকে রয়েছে মুসা। যতটা সম্ভব গুলির নিশানা থেকে সরে থাকতে চাইছে। কয়েকটা মোচড় দিয়েই গাড়ির নাক ঘুরিয়ে ফেলল, ছুটল খোলা জায়গাটার দিকে। জোনসের চওড়া মুখে বিস্ময় দেখতে পেল সে।

তারপরই ছুটে আসতে লাগল বুলেট। বিধতে লাগল গাড়ির শরীরে। একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

এই, সবাই ঠিক আছ? চিত্তার করে জিজ্ঞেস করল মুসা।

আছি! চারটা কণ্ঠই জবাব দিল।

আরও একঝাঁক বুলেট এসে বিধল গাড়ির শরীরে। আরেক ঝাঁক ধুলো ওড়াল রাস্তায় লেগে। মাটির কণা লাফিয়ে উঠল। চাকা ফুটো করতে চাইছে।

বার্চ আর পাইন বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে সরু রাস্তাটা, সেটা ধরে ছুটেছে মুসা।

জোনসের পাশে এসে দাঁড়ালেন গভীর চেহারার মোড়ল, উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন। হাত তুলে গুলি থামানর নির্দেশ দিল জোনস। বেল্ট থেকে ওয়াকি-টকি খুলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

পাশ দিয়ে গাড়িটা ছুটে বেরোনর সময় এদিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল সে, রাগ দেখানর পরিবর্তে একটা হাসি দিল। রহস্যময়, শয়তানি হাসি। কারণটা বুঝতে পারল না মুসা। ওরা পালিয়ে যাচ্ছে। ধরে রাখতে পারছে না। তাহলে হাসল কেন লোকটা?

আমাদেরকে কিছু করছে না ওরা! চেঁচিয়ে সঙ্গীদেরকে জানাল মুসা।

আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে তীব্র গতিতে চলেছে গাড়ি। অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরে রেখেছে মুসা। গতিবেগ আর বাড়ানোর সাহস করতে পারছে না। রাস্তায় একটু পর পরই বাঁক, বিশ-পঁচিশ গজের বেশি দেখা যায় না মোড়ের জনে) রাস্তাও খারাপ। এপাশ ওপাশ ভীষণ দুলছে গাড়ি। গাছের ডালে ঘষা লাগছে।

এতক্ষণে জোনসের হাসির কারণটা বুঝতে পারল মুসা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল।

কি হলো? চিৎকার করে উঠল কিশোর।

সামনে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে জোনস কোম্পানির বিশাল এক ট্রাক। হিলারি কিংবা অন্য কেউ চালান দিয়ে এসেছিল বোধহয়, তাকে রেডিওতে নির্দেশ দিয়েছে জোনস। মুসা যেটা চালাচ্ছে সেটাও অনেক বড় গাড়ি। ট্রাকটা যেভাবে। পথ জুড়ে রয়েছে, তাতে ছোট ফোক্সওয়াগেনকেও পাশ কাটিয়ে নেয়ার জো নেই। এটা তো অসম্ভব।ট্রাকের সামনে পেছনের বাম্পারের সঙ্গে গাছ ছুঁয়ে আছে।

ফাঁদে পড়েছি! চিৎকার করে জানাল মুসা।

স্কিড করে থেমে গেল গাড়ি। ট্রাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল হিলারি, হাতে এম-১৬, মুসার দিকে তাক করা। বেল্টে ঝুলছে ওয়াকি-টকি।

জানালার কাছে উঠে এল গাড়ির ভেতরের চারজন।

 এবার? গুঙিয়ে উঠল রবিন।

 নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করেছে কিশোর।

অ্যাই, ঘটে যদি কিছুটা বুদ্ধিও থাকে, চেঁচিয়ে আদেশ দিল হিলারি, আর খেপামি কোরো না। ভালয় ভালয় নেমে এসো। তোমাদেরকে মারতে মানা করেছে। বস্, বেঁচে গেলে। তাই বলে গোলমাল সহ্য করব না।

দলবল নিয়ে এখুনি চলে আসবে জোনস, মিলফোর্ড হুঁশিয়ার করলেন।

একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আমি হিলারির নজর সরিয়ে রাখি, তোমরা সব সারি দিয়ে নেমে একেকজন একেকদিকে পালাও…

অ্যাই, কথা কানে যায় না! ধমক দিয়ে বলল হিলারি। জলদি নাম!

 সাবধান! মিলফোর্ড বললেন।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দরজার হাতল ধরে দ্বিধা করল। তারপর লম্বা দম নিয়ে টান দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা। দুহাতে মাথা চেপে ধরে প্রচণ্ড মাথা ব্যথার অভিনয় শুরু করল। ওওওহ! ওওওহ! ককাতে লাগল সে। মাটিতে নেমে টলতে টলতে এগোল হিলারির দিকে। মরে যাচ্ছি! ব্যথায় মরে যাচ্ছিরে বাবা!

ভুরু কুঁচকে ফেলেছে হিলারি। মোরগের মত গলা লম্বা আর মাথা কাত করে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে সন্দেহ। কিশোরের দিকে তাক করেছে এখন রাইফেল।

আমি মরে যাচ্ছি! টলতে টলতে আরও দুই পা আগে বাড়ল কিশোর। বাঁচান আমাকে! মরে গেলাম!

সরো! চেঁচিয়ে উঠল হিলারি।

আরেকটু এগোল কিশোর। টলে পড়ে যাচ্ছে যেন এরকম ভঙ্গি করে প্রায় পায়ের ওপর গিয়ে পড়ল হিলারির। ধরে সামলানর জন্যে চেপে ধরল ওর রাইফেল ধরা হাত। ঠেলে রাইফেলের নল সরিয়ে দিল আরেক দিকে।

তাকিয়েই ছিল মুসা। লাফিয়ে নামল মাটিতে। পেছনে রবিন, জন আর মিলফোর্ড।

জুডোর এক প্যাঁচে হিলারিকে মাটিতে ফেলে দিল কিশোর। শরীর দিয়ে চেপে ধরল।

সরো! সরো! চেঁচাতে লাগল হিলারি।

পালাচ্ছে! পেছন থেকে জোনসের চিৎকার শোনা গেল! ধরো ওদেরকে!

দলবল নিয়ে ছুটে আসতে লাগল সে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বনের দিকে দৌড় দিয়েছে রবিন আর মিলফোর্ড। মুসা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে বনে ঢোকার মুখটার দিকে। সেদিকেই ছুটল গোয়েন্দাপ্রধান। ঝড়ো হাওয়ার মত ছুটছে জন, জোনস কোম্পানির একটা ট্রাকের দিকে।

মোড়লও ছুটছেন, কিশোরকে ধরার জন্যে। জনের চেয়ে কম ছুটতে পারেন না। দ্রুত কমছে দুজনের মাঝের দূরতু। সাঁ করে ঘুরে গিয়ে গুহার দিকে ছুটল কিশোর। আরেকটা বুদ্ধি করেছে। একটু আগে জোনসের ওপর কতটা রেগে গিয়েছিলেন মোড়ল, দেখেছে। সেই রাগটাকেই কাজে লাগাতে চায়।

সব চেয়ে কাছে যে গুহাটা রয়েছে সেদিকে ছুটল কিশোর। পেছনে তাড়া করছেন মোড়ল।

ঢুকে পড়ল কিশোর।

চিৎকার করে ডাকলেন মোড়ল, বেরোও! জলদি বেরোও! ওটা পবিত্র জায়গা! তোমাদের ঢোকার অধিকার নেই।

তাহলে জোনস আর তার লোকেরা ঢুকল কি ভাবে? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওরা আমাদের মানুষকে সাহায্য করে। ঈশ্বর সেটা বুঝবেন। আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠেছিল। মিস্টার জোনস আসাতে বেঁচেছি।

বাঁচলেন আর কই? অসুখে তো মরতে চলেছেন।

 সেটা মিস্টার জোনসের দোষ নয়। বেরোও!

আসুন ভেতরে, ডাকল কিশোর। দম নিয়ে দেখুন, কেমন নাক আর গলা জ্বালা করে। মারাত্মক বিশাক্ত বর্জ্য পদার্থ রয়েছে এই ড্রামগুলোতে।

ড্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন মোড়ল, না, তা হতে পারে না। মিস্টার জোনস বলেছেন, এগুলোতে বিস্ফোরক রয়েছে। আমাকে রেখেছেন পাহারাদার। এখানে বাইরের কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে তাকে জানাতে বলেছেন। ব্যবসায় প্রতিযোগিতা এখন বেশি, অনেক প্রতিযোগী আছে তার। ওরা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। সে জন্যেই সব কথা বাইরের লোকের কাছে গোপন রাখতে বলেছেন। ওয়াকি-টকি দিয়েছেন যোগাযোগ করার জন্যে। জায়গাটার ভাড়া দেন। তিনি, সেই টাকায় গাঁয়ের লোকে.দরকারী জিনিস কিনতে পারে। এখানে জিনিস রাখার অধিকার তার আছে। যা খুশি রাখুক, আমাদের নাক গলানর কিছু নেই। থামলেন মোড়ল। বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ভাড়ার টাকাটা এখন আমাদের খুবই দরকার। গাঁয়ের দুঃসময় যাচ্ছে।

কিন্তু বিষাক্ত বর্জ্য যে অসুস্থ করে ফেলছে আপনাদেরকে একথাটা ভেবেছেন?

কিশোরের চারপাশে একপাক ঘুরলেন মোড়ল। রাইফেলের নল নেড়ে আদেশ দিলেন, বেরোও!

জোনস হল সেই বিদেশী ডাইনী, যার কথা বলেছেন শামান, গুহামুখের দিকে এগোতে এগোতে বলল কিশোর। আবার রোদের মধ্যে বেরিয়ে বলল, আপনি আসলে ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে। আমি জানি, গুলি করতে পারবেন না।

দ্বিধা করলেন মোড়ল। তারপর রাইফেলের নল কিশোরের পিঠে ঠেসে ধরে ঠেলে নিয়ে চললেন জোনসরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে।

বনের ভেতরে রবিন আর মিলফোর্ডের পিছু নিয়েছে নিওমো।

ডকের সঙ্গে নদীর কিনারে লড়ছে মুসা। এম-১৬টা কেড়ে নিতে চায়।

ভাতিজা! চিৎকার করে জনকে ডাকলেন মোড়ল।

ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে চেপে বসেছে জন। ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করছে।

 খোলা দরজার কাছে গিয়ে তার দিকে রাইফেল তাক করল হিলারি।

ভাতিজা, বোকামি কোরো না! আবার বললেন মোড়ল। নেমে এস!

আটকা পড়েছে সবাই, বুঝতে পারছে কিশোর। যে কোন মুহূর্তে এখন। ওদেরকে গুলি করে মেরে ফেলার আদেশ দিতে পারে জোনস। ওদের বাঁচিয়ে রাখার আর কোন কারণ নেই।

ওদেরকে সরিয়ে দেয়ার পর নিশ্চিন্তে আবার এই উপত্যকার রাজা হয়ে বসবে। জোনস। বাধা দেয়ার কেউ থাকবে না। দুষিত করতে থাকবে উপত্যকার পরিবেশ, অসুস্থ হতে থাকবে গাঁয়ের লোক। মরবে। ডাইনী খোঁজা চালিয়ে যাবে ইনডিয়ানরা, কিন্তু খুঁজে আর পাবে না। ঠেকাতেও পারবে না। গান গাওয়া উৎসব চালিয়ে যেতে থাকবে ওরা, একের পর এক মেসেজ পাঠাতে থাকবে ঈশ্বরের কাছে, লাভ হবে না কিছুই।

মেসেজ! অনুষ্ঠানের সময় জনকে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে গান গাওয়া ডাক্তারঃ ডাইনী যা চায়, তাকে তাই দিয়ে দাও, ধ্বংস হয়ে যাবে সে!

 দ্রুত চারপাশে তাকাল কিশোর। জোনস ডাইনী হয়ে থাকলে এখন সে চাইছে ওরা সবাই ধরা পড়ুক। আশার আলো উঁকি দিল তার মনে…মস্ত ঝুঁকি হয়ে। যাবে..কিন্তু আর কোন উপায়ও নেই।

জন! মুসা! রবিন! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। সবাই চলে এস! ধরা দাও!

কক্ষণো না! বলেও শেষ করতে পারল না মুসা, ধা করে তার পেটে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি মারল ডক।

জনেরও নামার ইচ্ছে নেই। কিন্তু হিলারির রাইফেলের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছেটা করতেই হল।

ঝোপের ভেতর থেকে মিলফোর্ডের কলার ধরে টেনে বের করে আনল নিওমো। রবিন বেরোল তার পাশে। বাধাও দিল না, কিছু করতেও গেল না।

এই, চলে এসো তোমরা! আবার ডাকল কিশোর। আর কোন উপায় নেই আমাদের!

অবাক হয়েছে সবাই। রেগে গেছে মুসা আর জন। কেবল রবিন বুঝতে পারছে, কোন ফন্দি করেছে কিশোর পাশা। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সবাই জোনস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

আপনি জানেন, মোড়লকে বলল কিশোর, জোনস আমাদের মেরে ফেলবে!

না, মোড়লের এখনও ধারণা, কিশোর ঠিক কথা বলছে না, মারবে না। কেবল বের করে দেবে এই এলাকা থেকে।

বের করে দেয়ার জন্যেই কি আমাদের যে পিকআপটা দিয়েছিলেন, তার ব্রেক নষ্ট করে দিয়েছিল?

কি বললে? জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন মোড়ল, পিকআপটাকে পড়ে থাকতে দেখে এসেছি। কিন্তু… চৌকোনা গম্ভীর মুখটাতে এই প্রথম সন্দেহ ফুটল।

খোলা জায়গাটায় হাজির হলো সবাই। জোনের বাকসটা দেখিয়ে মোড়লকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ওরকম বাকলস আর কে পরত, বলুন তো?

জনের চাচা, জবাব দিলেন মোড়ল।

জন, দেখাও, কিশোর বলল।

পকেট থেকে বাকলস বের করে মোড়লকে দেখাল জন। উপত্যকায় পেয়েছে। এটা কিশোর। একটা কঙ্কালের পাশে। কঙ্কালের খুলিতে গুলির ফুটো।

চমকে গেল ডক। জোনসের দিকে ফিরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আমি বার বার বলছি এগুলোকে শেষ করে দেয়া দরকার, ওই বুড়ো ইনডিয়ানটার মত, নইলে গোলমাল করবেই! আপনি শুনছেন না! আমি আর এসবের মধ্যে নেই, চললাম!

ট্রাকের দিকে দৌড় দিল ডক।

এই, দাঁড়াও, গাধা কোথাকার! জোনস বলল।

থামল না ডক। জোনস আর কিছু বলার আগেই রাইফেল তুললেন মোড়ল। গুলির শব্দ হলো একবার।

হাত থেকে উড়ে চলে গেল ডকের এম-১৬। ওটাতেই গুলি করেছেন তিনি। ডকের দিকে ছুটল মুসা।

পাঁই করে ঘুরলেন মোড়ল। রাইফেল তাক করলেন জোনসের দিকে।

দাঁড়ান! দাঁড়ান! হাত থেকে রাইফেল খসে পড়ল জোনসের। পিছিয়ে গেল।

শয়তান! রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন মোড়ল, এগিয়ে গেলেন জোনসের দিকে, তুমি আমার ভাইকে খুন করেছ! এখন এই ভাল মানুষগুলোকে খুন করতে যাচ্ছিলে! ধাম করে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি মারলেন লোকটার পেটে।

ব্যথায় ককিয়ে উঠল জোনস। বাঁকা হয়ে গেল শরীর। থামলেন না মোড়ল। প্রচণ্ড এক ঘুসি মারলেন জোনসের চোয়ালে। একটা মুহূর্ত বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে রইল লোকটার চোখ। তারপরই বুজে এল চোখের পাতা। বেহুশ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

কারাতে-লাথি মেরে বসল রবিন, হিলারির চোয়ালে। মেরেই গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেল একবার, যে পা-টা ভোলা ছিল ভোলাই রইল, সোজা, টানটান। আরেকবার কারাতের মাই-গেরি লাথি খেল হিলারি, হজম করতে পারল না, টু শব্দটি না করে ঢলে পড়ল বসের পাশে।

ডকের হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে ঘুরিয়ে ফেলেছে মুসা। ভারসাম্য হারাল লোকটা। কনুই দিয়ে তার বুকে কষে এক মাই হিজি-আতি লাগাল সে। আরেকটা লাগাতে যাচ্ছিল, ত্রাহি চিৎকার শুরু করল ডক, থাম! থাম! দোহাই তোমার, আর মের না! আমার কোন দোষ নেই! জোনস যা করতে বলেছে, করেছি! কসম!

এত অনুনয় করলে আর মারে কি করে? লোকটাকে টেনে নিয়ে এল মুসা, ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল মাটিতে, বেহুশ বসু আর তার সহকর্মীর পাশে।

তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন মোড়ল ডুম সোবল। মিস্টার জোনস যে এত বড় শয়তান, কল্পনাই করতে পারিনি!

করবেন কি করে? মিলফোর্ড বলল। ভীষণ ধূর্ত লোক। আপনাদেরকে সাহায্য করছে বলে বলে ভুলিয়ে রেখেছিল। ঠেকার সময় উপকার পেয়েছেন, ফলে আপনারাও তার ওপর নরম ছিলেন।

আসলে, কিশোর বলল, ঋণী যদি হতে হয় কারও কাছে, গান গাওয়া ডাক্তারের কাছে হোন। শামানের মেসেজটা কি ভাবে কাজে লাগিয়েছে বুঝিয়ে বলল সে।

এদিক ওদিক তাকাতে লাগল জন। নিওমো কোথায়?

 নিঃশব্দে কখন বনে ঢুকে গেছে ইনডিয়ান লোকটা, খেয়ালই করেনি কেউ।

ওকেও টাকা খাইয়েছে জোনস, মোড়ল বললেন জনকে, টাকা খাইয়ে দলে নিয়ে নিয়েছে। ওই ব্যাটাই পিকআপের ব্রেকটা খারাপ করে রেখেছিল। আরেকটু হলেই মেরে ফেলেছিল বেচারাদের।

তাহলে তো পালানোর চেষ্টা করবে।

যাবে কোথায়? ধরবই আমি ওকে, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন মোড়ল। এগুলোকে বেঁধেছেদে এখন ট্রাকে তোলো…

জোনসের গাড়িটায় তুলতে হবে, মিলফোর্ড বললেন। ওটাতে জরুরী দলিলপত্র আছে। নিয়ে যাব পুলিশের কাছে। প্রমাণ এবং আসামী একসাথে পেয়ে গেলে পুলিশের সুবিধে হবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন মোড়ল। জন যাবে আপনাদের সাথে। কাছের থানাটা কোথায় দেখিয়ে দেবে।

নিওমোর কি হবে? জানতে চাইল মুসা।

আমাদের নিজেদেরও পুলিশ আছে, মোড়ল বললেন।

চাচা হলেন আমাদের পুলিশ প্রধান, বলল জন।

 আমেরিকান সরকারের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে কিছু শর্ত দেয়া আছে, মোড়ল জানালেন। তার মধ্যে একটা হল, আমাদের সমাজে যেসব অপরাধ ঘটবে, সেগুলোর সাজা দেবার ভার আমাদের, পুলিশ নাক গলাতে আসবে না। আসামীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষমতাও আছে আমাদের।

দাদা হলেন আমাদের বিচারক, জানিয়ে দিল জন।

জোনস আর দুই সহচরের হাত-পা বেঁধে গাড়িতে ভোলা হলো। মোড়ল গিয়ে বড় ট্রাকটাকে রাস্তা থেকে সরালেন। গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ফিরে তাকাল। বিদায় জানিয়ে হাত নাড়লেন ডুম। এই প্রথম তার গম্ভীর মুখে হাসি দেখতে পেল সে।

ঘুরে দাঁড়ালেন মোড়ল। হালকা পায়ে ঢুকে পড়লেন বনের ভেতর।

.

ডায়মণ্ড লেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল গোয়েন্দাদেরকে জন। এই রাস্তাটার কথাই তিন গোয়েন্দাকে বলেছিল তার বোন মালটি, মাত্র আগের দিন, অথচ ছেলেদের মনে হল সেটা হাজার হাজার বছর আগের কথা।

ডায়মণ্ড লেকে পৌঁছল ওরা। ছোট, সুন্দর একটা পার্বত্য শহর। চকচকে সুইমিং পুল পেরিয়ে এল ওরা, গল্ফ কোর্সের পাশ কাটাল। টেনিস কোর্ট, ঘোড়া রাখার জায়গা, ব্যাকপ্যাক কাঁধে পাহাড়ে ঘুরতে বেরোনো ভ্রমণকারী, ছবির মত সুন্দর দামি দামি বাংলো দেখল। ব্যক্তিগত বিমানবন্দরের ওপর ঘুরছে বড় একটা লিয়ারজেট বিমান।

যাক, জোরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, এলাম শেষ পর্যন্ত।

আমার খিদে পেয়েছে, ঘোষণা করল কিশোর।

হায় হায়, আমার খিদেটা তোমার পেটে চলে গেল কি করে! হেসে বলল সহকারী গোয়েন্দা! খিদে খিদে তো কেবল আমি করতাম!

মিস্টার মিলফোর্ড বললেন, আমার একটা টেলিফোন দরকার প্রথমে। তারপর গোসল।

রবিন বলল, আমার ডাক্তার দরকার। বলে জানালা দিয়ে মুখ বের করতেই দেখল পথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটি সুন্দরী কিশোরী মেয়ে। ওর দিকে চোখ পড়তেই হাসল। হাত নাড়ল একজন। রবিনও তার জবাব দিল। শিস দিয়ে উঠল একটা মেয়ে।

জন তো অবাক। মেয়েরা শিস দেয়? উল্টো হয়ে গেল না ব্যাপারটা?

মুচকি হাসল মুসা। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তিন গোয়েন্দার অভিধানে উল্টো বলে কোন কথা নেই। এই তো, আমার খিদে কিশোরের পেটে চলে গেল, যে খেতেই চায় না। রবিনের দিকে তাকিয়ে মেয়েরা শিস দেয়, অথচ চিরকাল জেনে এসেছি মেয়েদের দিকে তাকিয়েই ছেলেরা শিস দেয়…

তোমরা আসলেই স্পেশাল, জন বলল। একটা কাজ করা দরকার। দাদাকে গিয়ে বলতে হবে, তোমাদের জন্যে যাতে একটা অনুষ্ঠান করে। তোমাদের ওপর অশুভ শক্তির নজর পড়েছে, সে জন্যেই এত বিপদ গেল। সেটা কাটানো দরকার। তোমরা যাবে তো?

নিশ্চয়ই! সাথে সাথে জবাব দিল মুসা। তোমাদের রান্না সত্যিই চমৎকার! আর তোমার বোন মালটি খুব ভাল মেয়ে!

কি ব্যাপার, মুসা, পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল রবিন। ঘটনাটা কি?

না, কিছু না! লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল মুসা।

কিশোর তাকিয়ে রয়েছে সিয়েরা মাদ্রের বরফে ঢাকা নীলচে সাদা চূড়ার দিকে। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে তার সুন্দর মায়াময় চোখ। বিড়বিড় করে আনমনে বলল, প্রেমে যদি সত্যিই পড়তে হয় কারও, তাহলে ওগুলোর…ওই বরফে ছাওয়া পাহাড়, রূপালি ঝর্না, নীল আকাশ, চিল…

অ্যাই, কি বিড়বিড় করছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

চমকে যেন স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে এল গোয়েন্দাপ্রধান, অ্যাঁ!…না, কিছু না!…ও, থানা এসে গেছে?

‘ডায়মণ্ড লেক পুলিশ স্টেশন’ লেখা বাড়িটার ওপর চোখ পড়েছে তার।

Super User